গোপন আতঙ্ক

গোপন আতঙ্ক

মূল গল্প  The Lurking Fear (Howard Phillips Lovecraft)

এক—চিমনিতে কালো ছায়া

টেম্পেস্ট পাহাড়ের চূড়ার পরিত্যক্ত প্রাসাদে আমরা যখন উপস্থিত হলাম তখন আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে৷ আমার সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের দুই সহকারী—বেনেট আর টোবি৷ বলাবাহুল্য শারীরিক ক্ষমতার জন্যই ওদের সঙ্গে এনেছি আমি৷ এই আদিম প্রাসাদে লুকিয়ে থাকা আতঙ্ককে খুঁজে বের করাই আমাদের উদ্দেশ্য৷

টেম্পেস্ট পাহাড়ে ওঠার স্থায়ী কোনও পথ নেই৷ শুধু মাইলের পর মাইল আদিম বৃক্ষের কুটিল আর ভয়াবহ অরণ্য৷ বিশেষ করে রাতের দিকে এমন এক নৈঃশব্দ্য এসে জঙ্গলটাকে গ্রাস করে যে থেকে-থেকে মনে হয় আমাদের মোটর গাড়ির পিছন-পিছন অজ্ঞাত কেউ ছুটে চলেছে৷ নিষেধ থাকা সত্ত্বেও বেশ কয়েকবার হেডলাইট জ্বালাতে হয়েছে আমাদের৷ বুনো জন্তুর ভয়ে নয়, তারা নিজেরাই যেন কিছুর ভয়ে বহুযুগ আগে পালিয়ে গেছে জঙ্গল ছেড়ে৷ কেবল দাঁড়িয়ে আছে আকাশছোঁয়া মাটি থেকে পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে ওঠা গাছগুলো, উপর দিকে উঠে দলা পাকিয়ে গেছে তাদের মাথা, ঠিক যেন সারি সারি দানবীয় চেহারার সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে, সেই কুণ্ডলীর মাঝে ধরা আছে এক একটা মৃত মানুষের মাথা৷

যাই হোক, সে জঙ্গল নিয়ে নয় আমার এই গল্প৷ টেম্পেস্ট পাহাড়ের চূড়ায় আমরা কেন এসেছি সেই কারণটাই বলে রাখি এইবেলা৷

প্রায় একশো বছর ধরে এই টেম্পেস্ট মাইউন্টেনকে ঘিরে ভয় আর আতঙ্কের কিছু লোকগাথা তৈরি হয়েছে৷ ব্যাপারটা প্রথম আমার চোখে পড়ে খবরের কাগজে৷ এখানে ঘটে যাওয়া একটা দুর্যোগের খবর ছাপা হয়েছিল সেখানে৷ জায়গাটা নির্জন, আর জনবসতি থেকে বেশ দূরে, লোকজন খুব একটা আসে না এদিকটায়৷ কারণ, সেই অজ্ঞাত ভয়৷

সেটার কথাতেই আসা যাক এবার৷ ভয়টা গড়ে উঠেছে পাহাড়ের মাথার পরিত্যক্ত মারতেনস প্রাসাদটাকে ঘিরে৷ প্রাসাদটা ঠিক কবে তৈরি হয়েছিল তা কেউই বলতে পারে না৷ তবে তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া গল্পগুলো ভারী বিচিত্র আর ভয়াবহ৷ খোদ মৃত্যু নাকি বাস করে সেই প্রাসাদে, অনেকে বলে মৃত্যু নয়, ডেমন৷ সে নাকি অন্ধকারের সুযোগে এখানে ঘুরে বেড়ানো মানুষদের গ্রাস করে৷ হয় তাদের ধরে নিয়ে যায় প্রাসাদের কোনও গুপ্তকক্ষে না হয় তার স্পর্শে উন্মাদ হয়ে যায় মানুষ৷ গভীর রাতে কেউ-কেউ এই প্রাসাদ থেকে রক্ত হিম করা চিৎকারও নাকি শুনতে পেয়েছে৷ বজ্রের মতো কণ্ঠস্বর৷

এই শেষের কথাটা অবশ্য সত্যি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, তার কারণ আমি কিছু জিওলজিক্যাল রেকর্ডবুকে লক্ষ করেছি ডানউইচের এই জায়গাটায় স্বাভাবিকের থেকে অনেকটা বেশি বজ্রপাত হয়৷

বলাবাহুল্য শহরের শিক্ষিত লোক এসব গল্পকে হেসে উড়িয়ে দেয়৷ তবে এ অঞ্চলের গরিব কৃষক আর গ্রামবাসীদের মনে এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে টেম্পেস্ট মাউন্টেন অভিশপ্ত৷ এ অঞ্চলের বৃদ্ধারা তাদের নাতি-নাতনিদের এখনও মারতেনস ফ্যামিলির গল্প বলে ঘুম পাড়ায়৷ সে পরিবারের ইতিহাস ভয়াবহ সব খুন ও অলৌকিকত্বের বর্ণনায় পরিপূর্ণ৷

কয়েকদিন আগে এক গ্রীষ্মের রাতে এক ভয়াবহ ঝড়ঝাপটার পর কোনও একটা কারণে এলাকার গ্রামবাসীদের ঘুম একসঙ্গে ভেঙে যায়৷ সবাই কান পেতে শুনতে পায় পাহাড়ের দিক থেকে একটা দানবীয় পায়ের আওয়াজ ভেসে আসছে, যেন আকাশ থেকে মহাজাগতিক কোনও দৈত্য নেমে এসেছে পাহাড়ের গায়ে৷ ভয়ে কেউ বাড়ি থেকে বেরোয় না৷ শুধু গ্রামের সমস্ত পশুজন্তুর সম্মিলিত চিৎকার আর সেই পায়ের আওয়াজ তাদের বুকের রক্ত জল করে দেয়৷

সকালে কিছু পর্বতারোহীর নেতৃত্বে গ্রামবাসীরা মিলে পাহাড়ের মাথাটা পরীক্ষা করতে যায়৷ তারা দেখে, সত্যি কাল রাতে মৃত্যু নেমে এসেছিল পাহাড়ের মাথায়৷ পাহাড়ের কোলে একটা বিরাট মেপল গাছকে ঘিরে গড়ে ওঠা বিরাট জনপদ বজ্রপাতের ফলে ভেঙে মাটির তলায় দেবে গেছে৷ অন্তত সত্তর-আশিজন মানুষ বাস করত এখানে৷ তাদের কেউ জীবিত নেই৷ গোটা জায়গাটা জুড়ে মানুষের রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ পড়ে রয়েছে৷ যেন প্রবল আক্রোশে কেউ ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খেয়েছে তাদের৷ অথচ আশ্চর্যের কথা, গোটা জায়গাটায় কোনও বড় প্রাণীর পায়ের ছাপ চোখে পড়েনি কারও৷ ব্যাপারটা নিয়ে তেমন মাতামাতি হয়নি, কিন্তু বিকেলের দিকে আবিষ্কার হয়—যে ৭৫ জন মানুষ এখানে বাস করত তাদের মধ্যে অন্তত জনা পঁচিশেকের দেহ নেই এখানে৷

বেশি ভাবনা-চিন্তা না করে লোকে সিদ্ধান্ত নেয় আকাশ থেকে নেমে আসা একটা অতিকায় বজ্রের গোলা আছড়ে পড়েছিল এখানে৷ তাতেই মারা গেছে লোকগুলো, তারপর কোনও বন্য প্রাণী এসে ছিঁড়ে খেয়েছে মৃতদেহগুলো৷

এই ঘটনার সঙ্গে যে মারতেনস প্রাসাদের সম্পর্ক আছে তা নিয়ে এলাকাবাসীর বদ্ধমূল ধারণা জন্মায়৷ যদিও ঘটনাস্থল থেকে প্রাসাদটা প্রায় তিন মাইল দূরে৷ নতুন করে একটা সার্চপার্টি তৈরি করে গোটা প্রাসাদটা তদন্ত করে দেখা হয়৷ এমনকী প্রাসাদের লাগোয়া পুকুর, ভাঙা বাড়িঘর সবই তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনও নরখাদক বন্য প্রাণীর চিহ্ন পাওয়া যায় না৷

এই গোটা ঘটনার বিবরণ ফলাও করে ছাপা হয় কাগজে৷ সেটা পড়েই এখানে আসার কৌতূহলটা জাগে আমার মনে৷

কাগজপত্রের বিবরণ পড়ে এবং প্রাচীন কিছু বইপত্র পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে একটা কথা বারবার মনে হয়েছে আমার৷ এই এলাকায় যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তা কোনও স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়৷ লোকগাথা যদি সত্যি হয় তাহলে এই ডানউইচ অঞ্চলে সত্যি কোনও প্রাচীন ডেমন বসবাস করে৷ এবং তীব্র বজ্রপাতের শব্দে সে তার লুকানো কক্ষ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে৷ এলাকাবাসীর মুখে-মুখে তার একটা নামও তৈরি হয়েছে—গোপন আতঙ্ক৷ তবে যত গোপনই হোক না কেন, আমি তাকে দেখতে চাই৷

প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে চারিদিকে ভালো করে তাকালাম৷ প্রাসাদটা একসময় আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকত তাতে সন্দেহ নেই৷ কিন্তু এখন চারপাশ ভেঙে পড়ায় তুলনায় কিছুটা ছোট দেখায় তাকে৷ চতুর্দিক ওক গাছের জঙ্গলে ঢেকে আছে৷ প্রাসাদের দেওয়াল বরাবর ভাঙা পাথরের চাঁই ছড়িয়ে আছে, তার নীচগুলো অন্ধকারে ঢাকা৷ ভারী ভয় লাগে সেদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে৷ বাইরের দরজা দিয়ে আমরা ভিতরে ঢুকে এলাম৷

এর আগেও এ ক্যাসেলে এসেছিলাম আমি, ফলে ভিতরের প্ল্যান আগে থেকেই ঠিক করা ছিল৷ জ্যান মারতেনসের ঘরেই আমি থাকব৷ শোনা যায় জ্যান মারতেনস নাকি খুন হয়েছিলেন৷

ঘরটা লম্বায় কুড়ি ফুট, চৌকো৷ কয়েক জায়গায় রাবিশ জড়ো হয়ে আছে, একসময় সেগুলো ফার্নিচার ছিল হয়তো৷ ঘরটা দোতলায়, দু-দিকের দেওয়াল জুড়ে দুটো মস্ত জানলা৷ দুটো জানলাতেই গরাদ বা শাটার নেই৷ জানলার উল্টো দিকে একটা ফায়ারপ্লেস, তার ঠিক উপরে একটা বড় চিমনির খোলা অংশ, তার পাশেই বিছানা৷ চিমনির গহ্বরটা এখন জমাট অন্ধকারে ঢেকে আছে, সেদিকে তাকিয়ে জানি না কেন, বুকটা দুরু-দুরু করে উঠল আমার৷

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে কাজে লেগে পড়লাম৷ প্রথমে দুটো জানলার বাইরেই দুটো বড় মই লাগিয়ে দিলাম৷ মইটা শেষ হয়েছে বাইরে ঘাসের জমির উপরে৷ কারণ একটাই৷ ‘গোপন আতঙ্ক’ যদি আমাদের বাইরে থেকে আক্রমণ করে তাহলে দরজা তো আছেই, কিন্তু যদি সে ঘরের ভিতর থেকে উদয় হয় তাহলে জানলা দিয়েও বাইরের খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে আসা যাবে৷

ঠিক হল আমরা তিনজনেই পালা করে বাইরে নজর রাখব৷ ঘরের দু-দিকের জানলায় দু-জন পাহারা দেবে, বাকি একজন তখন ঘরের ঠিক মাঝখানে ঘুমাবে৷

রাত বারোটা থেকে একটা অবধি আমি বসে রইলাম সেই জানলার কাছে, ফাঁকা জানলা দিয়ে দূরে আসন্ন ঝড়ের মেঘ চোখে পড়ছে৷ নীচে তাকালে সারি-সারি মাটির ঢিবি চোখে পড়ে৷ পাহাড়ের গা বরাবর ছড়িয়ে আছে ঢিবিগুলো৷ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে কখন যেন ঘুম পেয়ে গেল আমার৷

আমার জায়গায় বেনেটকে রেখে আমি বিছানায় শুলাম৷ আপাতত ঘরের মাঝের বিছানায় আমি শুয়ে আছি, দু-দিকে জানলার সামনে বসে বাইরে নজর রাখছে আমার দুই সহকারী বেনেট আর টোবি৷

একটু আগে আকাশের কোণে দেখা কালো মেঘটা মনে হয় আমার মনের উপরেও প্রভাব ফেলেছে৷ ঘুমের ঘোরে কিছু অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম আমি৷ একবার মনে হল আধ-ঘুমে আছি৷ আমার আশপাশে বেনেট আর টোবির হাঁটাচলার শব্দও শুনতে পাচ্ছি৷ সেই সঙ্গে বুকের উপর কিছু যেন একটা চেপে আছে—একটা ভারী, শক্ত হাত৷

পরেরবার ঘুমটা আবার একটু হালকা হতে অনুভব করলাম ঘরটা খালি, বুকের উপর সেই চাপটা এবার বেড়ে উঠেছে৷ আমার শরীর আর দু-দিকের জানলার মাঝে কিছু যেন একটা আছে, বিছানার ধারে ঢাকা পড়ে গেছে বলে দেখতে পাচ্ছি না৷

সেভাবে কতক্ষণ কেটেছে জানি না, আচমকা পাহাড়টাকে কাঁপিয়ে দিয়ে বাজ পড়ল একটা৷ প্যাঁচানো গাছেদের সার যেন মাটি থেকে লাফিয়ে উঠল সেই শব্দে৷ আমার বাঁদিকে থাকা চিমনির নীচের ফাঁকা অংশ থেকে একটা ঘন কালো ছায়া এগিয়ে এসে আছড়ে পড়ল আমার শরীরের উপরে, মুহূর্তে মিলিয়ে গেল সেটা৷ বয়ে যাওয়া জলপ্রবাহের মতো আওয়াজ ভেসে এল সেইসঙ্গে৷ আমি থতমত খেয়ে উঠে বসলাম বিছানার উপরে৷

কয়েক সেকেন্ডের জন্যে হৃৎপিণ্ড স্থির হয়ে গেল৷ একটা অজ্ঞাত নিরাকার অস্তিত্ব যেন ঢেকে ফেলেছে আমার চারপাশ৷ চারদিক তাকিয়ে দেখলাম সেই অভিশপ্ত প্রাসাদের ঘরে আমি একা, বেনেট আর টোবির কোনও চিহ্ন নেই৷ সেদিনের পর থেকে তাদের আর কখনও দেখতে পাইনি আমি৷

দুই—ঝড়ের পথিক

এই ঘটনার চারদিন পরে আজ আমি লেফার্ট কর্নারে আমার হোটেলের ঘরে শুয়ে আছি৷ সেদিন সেই ঘটনার পরে কীভাবে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে মোটরগাড়ির কাছে পৌঁছেছিলাম, সেটাকে চালু করে কীভাবে বা আবার সেই গ্রামের রাস্তায় ফিরে এসেছিলাম তা আর মনে নেই৷ শুধু মনে পড়ে একটা ফিসফিস শব্দ ক্রমাগত তাড়া করে আসছিল আমাকে৷ আকাশছোঁয়া জঙ্গলের সেই গাছগুলো যেন বারবার পথ আগলে দাঁড়াচ্ছিল আমার৷

চিমনির নীচ থেকে বেরিয়ে আসা সেই ছায়াটার অর্থ আমি আজও বুঝতে পারিনি, তবে এটুকু বুঝেছি যে পৃথিবীর অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা কোনো অজ্ঞাত আতঙ্ক আমার চোখে ধরা দিয়েছিল সেদিন৷ এমন কোনো অজানা অস্তিত্ব, যার আঁচড়ের শব্দ মাঝে-মাঝে শুনতে পাই আমরা—কিন্তু দেখতে পাই না কোনওমতে৷ এটুকু শুধু জানি আমার বুকের উপরে যে ভারী বস্তুটা হাতের মতো পড়েছিল সেটা আমার স্বপ্নের কল্পনা নয়৷

গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলাম৷ যেভাবেই হোক বেনেট আর টোবিকে খুঁজে বের করতে হবে, তাছাড়া আমার এইসব অভিজ্ঞতার কথা অন্য কাউকেও জানানো দরকার৷

লেফার্ট কর্নারে লোকজন বলতে বেশিরভাগই সাংবাদিক, ঠিক করলাম তাদের মধ্যেই একজনকে সব কথা খুলে বলতে হবে৷

সেরকম একজনকে পেয়েও গেলাম—আর্থার মুনরো৷ পেশায় অকাল্ট জার্নালিস্ট৷ সেপ্টেম্বরের এক দুপুরে তাকে সব কথা খুলে বলি আমি৷ আমার কথা শুনে প্রথমে তার মুখে বিস্ময়ের অভিব্যক্তি খেলে যায়, নিজের গালে একটা হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ‘আমার কী মনে হয় জানো, তোমাদের কাজটা বোকামি হয়েছে, কেবল কৌতূহলের ঝোঁকে ওই প্রাসাদে গিয়ে থাকা মোটেই উচিত হয়নি৷’

‘তাতেও তো লাভ হল না কিছু, মারতেনস প্রাসাদের রহস্য এখন আগের মতোই অন্ধকারে ঢাকা…’ আমি হতাশ গলায় বললাম৷

‘হুম… ও বাড়িতে গিয়ে থেকে কোনও লাভ হবে বলে তো মনে হয় না আমার৷ তবে অন্য একটা উপায়ে কিছু জানা যেতে পারে৷’

‘কী উপায়?’

চেয়ারে সোজা হয়ে বসল মুনরো, ‘এখানে আশপাশের গ্রামে মারতেনসদের সম্পর্কে কিছু ফোকলোর চালু আছে, সেগুলো এক্সপ্লোর করলে তা থেকে খানিকটা সত্যি বেরিয়ে আসতে পারে, তাছাড়া এ জায়গাটার জিওলজিক্যাল ডাটাও স্টাডি করে দেখতে হবে৷ আমি এই নিয়ে কিছুদূর অগ্রসরও হয়েছি… একটা ডায়েরি হাতে এসেছে আমার…’ কথাটা মাঝপথে থামিয়ে সিগারেটে একটা টান দিল মুনরো, ‘এ গ্রামে এক বয়স্ক ভদ্রলোকের থেকে মারতেনসদের পারিবারিক ইতিহাস সংক্রান্ত একটা ডায়েরি পেয়েছি৷ সেটা ভালো করে পড়া দরকার…’

‘কোথায় সে ডায়েরি?’

মুনরো হাসল, ‘আমার কাছেই আছে, তবে এটার কথা আর কোনও সাংবাদিককে জানিও না আপাতত৷ এসো আমার সঙ্গে…’

এর পরের কয়েকদিন আমারা গোটা গ্রামটাকে চিরুনির মতো চষে ফেললাম৷ যেইসব জায়গার সঙ্গে মারতেনস ফ্যামিলির কোনও ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িয়ে আছে সেগুলো নিজেরা গিয়ে দেখে এলাম৷

প্রথম দিকে তেমন দরকারি কিছু পাইনি৷ শুধু এটুকু আন্দাজ করা গেল যে কয়েক শতাব্দী যাবৎ ভয়াবহ ঘটনাগুলো যে জায়গাগুলোকে কেন্দ্র করে ঘটেছে তার সবক-টাই মারতেনস প্রাসাদের কাছাকাছি এবং গাছপালা দিয়ে ঘেরা৷

সেই ‘গোপন আতঙ্কের’ বিবরণ সম্পর্কে বলা বাহুল্য নানা মুনির নানা মত৷ কেউ বলছে সে সাপের মতো, কেউ বলছে দৈত্যের মতো৷ অনেকের মতে নাকি চলমান গাছের মতো শরীর তার, একটা বড় অংশের মতামত যে তার নাকি ডানা আছে৷ তবে যেভাবে সে গাছপালার আড়ালে বেশিরভাগ সময় গা ঢাকা দিচ্ছে তাতে সে উড়তে পারে বলে তো মনে হয় না৷ অবশ্য যে গতিতে সে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে, তা কেবল পায়ে হেঁটে সম্ভব না৷

এখানকার গ্রামের লোকেরা খানিক ভীতু আর আতঙ্কগ্রস্ত, তাও আমাদের সাহায্য করতে পিছপা হয়নি তারা৷ মাঝে একদিন লোকজন নিয়ে গোটা মারতেনস প্রাসাদটা খুঁজে দেখেছি আমরা৷ বেনেট আর টোবির কোনও চিহ্ন নেই কোথাও৷ গ্রামবাসীদের কথামতো ওই ক্যাসেলের আশপাশে যারা যায় তাদের উধাও হয়ে যাওয়া নাকি মোটেই বিচিত্র কিছু না৷ খানিকটা সেই কারণেই লাগোয়া জঙ্গলে পশু-জন্তু এত কম৷

অক্টোবরের মাঝামাঝি অবধি আমাদের কাজকর্ম প্রায় কিছুই এগোল না৷ এর মধ্যে বাজ পড়েনি তেমন, চারপাশের আবহাওয়ায় একটা শিরশিরে ঠান্ডা ভাব খেলা করে চলেছে শুধু৷ বুঝলাম, যতদিন না বাজ পড়ছে, গোপন আতঙ্ক আমাদের দেখা দেবেন না৷

গ্রামে ঘুরতে-ঘুরতে ক্যাসেল থেকে দু-মাইল দূরে একটা ছোট নামহীন জনপদে এসে পড়লাম আমরা৷ গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই ভয়ে তাদের ঘর ছেড়ে চলে গেছে৷ বাকিদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, এ গ্রামের উপরই সব থেকে বেশিবার আঘাত হেনেছে ‘গোপন আতঙ্ক’৷

একটা পরিত্যক্ত জলা জায়গায় এসে দাঁড়াতেই দূরে কিছু পাহাড়ের চূড়া দেখা গেল৷ মুনরো আমাকে সেদিকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই পাহাড়টার নাম কোন মাউন্টেন, এ গ্রামে যতবারই সে আঘাত হেনেছে, ততবারই লোকে ওই পাহাড়ের দিক থেকে ভেসে আসা কিছু শব্দ শুনেছে৷’

আমি একটু সময় নিয়ে বললাম, ‘মানে বলছ যেসব জায়গায় পাহাড় আছে তার আশপাশেই সে আক্রমণ করে৷’

‘তাই তো মনে হচ্ছে, এর কারণ কী হতে পারে বল তো?’

আমি মাথা নাড়লাম৷ কোনও উত্তরই আমার কাছে স্পষ্ট নয়৷ দু-জনে আরও কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম সেই গ্রামে, আকাশ কখন আরও জমাট অন্ধকারে ভরে গেছে খেয়ালই হয়নি৷

বিকেল গড়াতেই আকাশ থেকে ভেসে আসা একটা গড়-গড় শব্দ আমাদের চমকে দিল৷ দক্ষিণকোণে কালো মেঘ জমা হয়েছে৷ সাদা আলোর রেখাও দেখা যাচ্ছে থেকে-থেকে৷ বুঝলাম, আজ রাতে রীতিমতো বজ্রপাতের সম্ভাবনা আছে৷ তাই যদি হয় তাহলে আজ রাতেই হয়তো আবার আঘাত হানবে সেই গোপন আতঙ্ক৷

আমাদের ফেরার উপক্রম করার আগেই ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামল চারিদিকে, একটা নিশাচর অন্ধকার উড়ে এসে ঢেকে ফেলল আকাশ৷ মাঝে-মাঝে বজ্রপাতের ঝলকানিতে আলো এসে ভরিয়ে দিতে লাগল সেই অন্ধকার৷ মনে হল সেই আলো যেন কিছু দেখাতে চাইছে আমাদের, আমাদের চারপাশে অন্ধকারের সুযোগে যে অপার্থিব অস্তিত্ব এসে দাঁড়িয়েছে তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে আলোটা৷

সেই আলোতে পথ খুঁজে কোনওরকমে গ্রামের মধ্যেই একটা পরিত্যক্ত কুটির খুঁজে নিলাম আমরা৷ কয়েক বছর আগেও হয়তো লোক থাকত এখানে, আতঙ্কে ঘরছাড়া হয়েছে৷

ফাঁকা কুটিরের ভিতর ঢুকে বাইরের কাঠের দরজাটা বন্ধ করে দিলাম আমি৷ ঘরের ভিতরে একটা চেয়ার রাখা ছিল, আমরা মেঝের উপরেই বসে পড়লাম৷ কাঠের দেওয়ালের ফাটল দিয়ে বিদ্যুৎ ঝলকের আলো দেখা যাচ্ছে মাঝে-মাঝে৷৷ বৃষ্টির শব্দ বাইরে থেকে ভেসে আসছে একটানা, ভালো করে কান পাতলে মনে হয় তার মধ্যে একটা শনশন আওয়াজ মিশে আছে, কে জানে কিসের আওয়াজ৷

‘একটা ব্যাপার আমার থেকে থেকে মনে হচ্ছে, জানো?’ একটা সিগারেট ধরিয়ে নার্ভ চাঙ্গা করার চেষ্টা করল মুনরো৷

‘কী ব্যাপার?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷

‘টেমপেস্ট মাউন্টেন আর কোন মাউন্টেন ছাড়াও আরও কিছু পাহাড় আছে এখানে, সেগুলো থেকে কোনও আক্রমণ হয় না, এমন স্পেশাল কী আছে এই পাহাড়দুটোয় যে ওগুলো থেকেই সে আক্রমণ করে?’

আমি একটু সময় নিয়ে বললাম, ‘উত্তরটা বের করার একটা সহজ রাস্তা আছে, ওই দুটো পাহাড়ের মধ্যে এমন কিছু একটা সিমিলারিটি আছে যা বাকি পাহাড়গুলোতে নেই, সেটা বের করতে পারলেই…’

মুহূর্তে মুনরোর মুখে একটা আতঙ্ক খেলে যায়, মুখের উপর একটা অপার্থিব ছায়া নামে তার, ‘আছে… সাদৃশ্য আছে… কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে তো…’

তার কথা শেষ হয় না, আমাদের বুকের রক্ত হিম করে দিয়ে কুটিরটার ঠিক কাছেই কান ফাটানো শব্দ করে একটা বাজ পড়ে৷ মনে হল আমাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে৷ সেই সঙ্গে বুনো নেকড়ের মতো বইতে থাকা দানবীয় হাওয়া উলুধ্বনির মতো শব্দ তুলছে… আমরা ছিটকে পড়লাম কুটিরের উল্টোদিকে৷ মুনরো দ্রুত ছুটে গেল জানলার দিকে৷ বাইরে মুখ বাড়িয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করল৷ তারপর চিৎকার করে বলল, ‘বাইরে কিছু একটা আছে… হে ঈশ্বর!’

‘কী? কী আছে?’

আমি মাটি থেকে উঠে দৌড়ে গেলাম দরজার কাছে৷ শনশন করে ঝড়ের হাওয়া ঢুকে আসছে দেওয়ালের ফাটল দিয়ে, ছাদের কোথাও মনে হয় ফুটো হয়ে গেছে৷ ঘরের মেঝেটা জল পড়ে ভিজে গেছে৷

দরজার উপর দুটো হাত রেখে ফাটলে চোখ রাখলাম৷ বাইরেটা ফিকে আলোয় ভরে আছে, তার মধ্যে এসে জড়ো হয়েছে কুয়াশার মতো বৃষ্টির জলের ফোঁটা৷ মনে হল আকাশ থেকে নেমে আসা একখণ্ড মেঘ উড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের চুড়োর দিকে৷ সামনের জমিটা ভেসে যাচ্ছে অথৈ জলে!

‘আমাদের আরও আলো জোগাড় করতে হবে৷’ মুনরোর দিকে চেয়ে বললাম৷ তার কোমরের উপর থেকে শরীরের বাকি অংশ আপাতত জানলার বাইরে, মন দিয়ে কিছু দেখছে সে, উত্তর দিল না৷

এগিয়ে এসে তার পিঠে হাত দিয়ে একটা ধাক্কা দিলাম, সে কিন্তু নড়ল না৷ আমি দু-হাতে কিছুটা শক্তি এনে তার গোটা দেহটা টেনে এনে ফেললাম ঘরের মেঝেতে৷ একটা জরাগ্রস্ত ভয় আমার শরীরের প্রতিটা কোনায় শিকড় মেলে দিল৷

আর্থার মুনরো মারা গেছে, তার কোমরের উপর থেকে বাকি দেহটা চিবিয়ে খেয়েছে কেউ৷ মাথাটা এখনও চিনে নেওয়া যায়, কিন্তু মুখমণ্ডল বলে আর কিচ্ছু নেই তাতে৷

তিন—দুটি রক্তাভ চোখ

১৯২১ সালের ৮ নভেম্বর দুপুরে আমি একা, জ্যান মারতেনসের কবর খোঁড়া শুরু করি৷ আকাশের কোণে তখন ধীরে-ধীরে একটা মেঘ জমতে শুরু করেছে৷ কিছু আগে একটা বাজ পড়ে কবরের ওপর থেকে খানিকটা মাটি সরে গেছে; ফলে সুবিধাই হচ্ছিল আমার৷ কিছু ঐতিহাসিক তথ্য সামনে আসার পর এই কবর খোঁড়ার সিদ্ধান্ত নিই আমি৷ সেই তথ্যই আমায় বলে দেয়—গোপন আতঙ্ক কোনও রক্ত-মাংসের প্রাণী নয়৷ তার সঙ্গে জ্যান মারতেনসের খুন হওয়ার কোনও গভীর সম্পর্ক আছে৷ কিছু একটা গোপন সূত্রে বাঁধা আছে তারা৷ সেটা খুঁজে বের করতেই, আমার আজকের এই অভিযান৷

গ্যারেট মারতেনস নামে নিউ আমস্টারডামের এক বণিক ১৬৭০ সালে এই প্রাসাদ তৈরি করেন৷ ব্রিটিশ আইনের রীতি-নীতি তাঁর পছন্দ হয়নি; ফলে শহর থেকে এতদূরে পালিয়ে এসে এই প্রাসাদ তৈরি করে সেখানে থাকতে শুরু করেন৷ মনোরম দৃশ্যপট আর নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দ হয় তাঁর৷

শুধু একটা মাত্র ব্যাপার তাঁকে ভাবিয়ে তোলে৷ বাজ পড়ার শব্দ একেবারে সহ্য করতে পারতেন না তিনি৷ এদিকে এই পাহাড়ের মাথায় ঘন-ঘন বাজ পড়তে থাকে৷ যদিও বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় ছাড়া বজ্রপাতের উৎপাত থাকে না, তবে গ্রীষ্মকালটা আসতেই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেন গ্যারেট৷ শেষে উপয়ান্তর না দেখে, বাড়ির ভিতরেই একটা গুপ্ত কক্ষ তৈরি করান; আকাশে মেঘ দেখলে, সেখানে গিয়েই আশ্রয় নিতেন তিনি৷

গ্যারেট মারতেনসের বংশধরদের ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানা যায় না৷ তারা প্রায় সবাই ব্রিটিশ সভ্যতার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একরকম অবরুদ্ধ জীবনযাপন করতেন৷ বছরের পর বছর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার ফলে, তাঁদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যেও কিছু বদল এসেছিল৷ তাঁদের কণ্ঠস্বর আশ্চর্যরকম ভারী হত; চোখের রং হত হয় ঘন নীল, নয়তো ঘন সবুজ৷ সামাজিক যোগাযোগ এত কমে আসে যে, পরিবারের মধ্যেই বিয়ে হত তাঁদের৷

পরিবারের বহু সদস্য প্রাসাদ ছেড়ে চলে যায় কালক্রমে৷ যারা যায়নি, তাদের বজ্রপাতের বিষয়ে অসহ্য ভীতি জন্মায়৷ মারতেনস ফ্যামিলির ব্যাপারে বেশিরভাগ তথ্য আমরা পাই, জ্যান মারতেনসের থেকে৷ পারিবারিক প্রথার বিপরীতে গিয়ে তিনি নাকি ইংলিশ আর্মিতে যোগ দেন৷ ছয় বছর পরে ১৭৬০ সালে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন৷ কিন্তু বাড়ি ছেড়ে বাইরের পৃথিবীতে পা রাখার ফলে, তাঁর বাবা তাঁকে ঘৃণা করতে শুরু করেন৷

জ্যানও আর মারতেনসদের অদ্ভুত অসামাজিকতা মেনে নিতে পারেননি৷ আলবানিতে এক বন্ধুকে চিঠি লিখে সমস্ত জানাতে থাকেন তিনি৷ ১৭৬৩-র বসন্তে জ্যান হঠাৎ চিঠি লেখা বন্ধ করে দিতে, আলবানির সেই বন্ধু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন৷ তিনি নিজেই টেম্পেস্ট মাউন্টেনে এসে হাজির হন, জ্যানের খবর নিতে৷ মারতেনস প্রাসাদের অবস্থা দেখে তাঁর মুখ হাঁ হয়ে যায়৷ এমন অন্ধকার ভগ্নদশার ইমারতে কোনও মানুষ থাকতে পারে বলে ধারণা ছিল না তাঁর৷

তাঁকে জানানো হয় যে জ্যান মারতেনস নাকি মাথায় বাজ পড়ে মারা গেছেন৷ জ্যানের কবরটাও দেখানো হয় তাঁকে৷

এতকিছুর মাঝে, এই মারতেনসদের ব্যবহারে কিছুটা সন্দেহ হয় তাঁর মনে৷ এক সপ্তাহ পরে গোপনে ফিরে এসে সেই কবর খুঁড়ে, জ্যান মারতেনসের যে দেহাবশেষ সে খুঁজে পায়, তার কোথাও বজ্রপাতের কোনও চিহ্ন নেই৷ বরঞ্চ স্পষ্ট বোঝা যায়—তাঁকে মাথায় আঘাত করে খুন করা হয়েছে৷ আলবানিতে ফিরে সে মারতেনস পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা করে৷

জ্যান মারতেনসকে যে তাঁর পরিবারের লোকেরাই খুন করেছে সে ব্যাপারে বিশেষ কোনো এভিডেন্স পাওয়া যায় না৷ তবে এই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে৷ এলাকার লোকের মনে তাদের সম্পর্কে ঘৃণার উদয় হয়৷

এরপর থেকেই, ধীরে-ধীরে মারতেনস পরিবারের দীপ নিভে আসতে থাকে৷ দূরের গ্রাম থেকে ম্যানসনের ঘরগুলোতে আলো জ্বলতে দেখা যেত; ক্রমাগত সেই আলো ফিকে হতে-হতে, নিভে যায়৷

এরপর থেকে মারতেনস প্রাসাদকে নিয়ে গুজব রটতে থাকে৷ ১৮১৬ অবধি কারওর পায়ের ছাপ পড়েনি এখানে৷ ১৮১৭ সালে একদল সার্চ পার্টি প্রাসাদে ঢুকে দেখে, ভিতরে জনপ্রাণী নেই৷ এবং, ভিতরের বেশিরভাগ ঘর, ভাঙা পড়েছে৷ তবে প্রাসাদের কোথাও কোনও কঙ্কাল পাওয়া যায়নি; ফলে লোকে ধারণা করে নেয়, পরিবারের সদস্যরা মরে যায়নি, কয়েক বছর আগেই হয়তো কোথাও চলে গেছে তারা৷ মারতেনস প্রাসাদ বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে থেকে একইভাবে সময়ের হাতে আরও ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে৷

প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে মাটি খুঁড়তে-খুঁড়তে অবশেষে কফিনের গায়ে গিয়ে লাগল আমার শাবলটা৷ জামার হাতায় মুখের ঘামটুকু মুছে নিলাম; এতটা মাটি খুঁড়তে গিয়ে খুব একটা কম পরিশ্রম হয়নি৷

টর্চের আলো নীচে ফেলে দেখতে পেলাম কফিনটা৷ মাটির ছাপ লেগে আছে তার উপরে৷ ডালাটুকুনি দেখা যাচ্ছে এখন৷ ঠিক কী খুঁজে পাওয়ার আশায় কবর খুঁড়তে শুরু করেছিলাম নিজেও জানি না৷ তবে এটুকু বুঝলাম, এই মারতেনস প্রাসাদের সমস্ত রহস্য লুকিয়ে আছে এই বাক্সের ভিতরে৷

আরও খানিকটা কসরত করে বাক্সটা তুলে আনলাম মাটির ভিতর থেকে৷ কিন্তু, সেটা খুলতে ইচ্ছা করল না আমার৷ উল্টে মনে হল, ওই বাক্সের নীচের মাটিটা আরও খানিকটা খুঁড়ে দেখা দরকার৷ মন বলল, আরও কিছু লুকিয়ে আছে—ওই মাটির তলায়৷

আবার শাবল তুলে নিলাম৷ পুনরায় মাটি খুঁড়তে শুরু করলাম৷ আমার সমস্ত শরীর ঘেমে চান করে গেছে, তবুও হাল ছাড়লাম না৷ যেন একটা নেশায় পেয়ে বসেছে আমাকে৷ যত খুঁড়ছি, তত মনে হচ্ছে কিছু আছে—কিছু নিশ্চয়ই আছে মাটির তলায়৷ নিজেকে চিনতে পারছি না৷

ঠিক কতটা মাটি খুঁড়েছিলাম মনে নেই৷ হঠাৎ মনে হল, আমার পায়ের তলার মাটি খসে পড়ছে৷ আমি ডুবে যাচ্ছি, জমাট অন্ধকারে৷ অর্থাৎ, কফিনের ঠিক নীচেই কিছুটা ফাঁকা জায়গা ছিল৷

একটু পরেই, শক্ত মাটির উপর এসে আছড়ে পড়লাম৷ মাথাটা আরেকটু হলেই ঠুকে যাচ্ছিল৷ হাতের উপর ভর দিয়ে কোনওক্রমে বাঁচিয়ে নিলাম নিজেকে৷ মাটিতে আছড়ে পড়ার দমকে টর্চটা নিভে গেছে৷ মনের ভিতরে কে যেন বলে দিল—গোপন আতঙ্কের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছি আমি৷

খেয়াল করলাম, ভিতরে দুটো সরু টানেল রয়েছে৷ তার দুটো মুখ আমার সামনে দু-দিকে উন্মুক্ত হয়েছে৷ ঠিক করলাম, যে সুড়ঙ্গটা মারতেনস প্রাসাদের দিকে চলেছে, সেটা ধরেই এগোব আমি৷ এরপরের ঘটনা, আর ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই আমার৷

সেই অদ্ভুত অবিনশ্বর অন্ধকারের মধ্যে হাঁটতে-হাঁটতে বারবার মনে হচ্ছিল—তীব্র ক্ষতিকর কিছু একটা আছে আমার সামনে৷ অথচ এগিয়ে যাওয়া থামাইনি একবারও৷ একটা অজ্ঞাত বল যেন টেনে নিয়ে চলেছে আমাকে—আরও, আরও গভীর অন্ধকারের ভিতর৷

কিছুক্ষণ চলার পর আমার টর্চের ব্যাটারি প্রায় নিভে এল৷ মনে হল, এখান থেকে টানেলটা উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে৷ নিজের গতিপথ বদলে উপরে উঠতে যাচ্ছিলাম এমন সময়, থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে৷

মনে হল টানেলের একেবারে শেষপ্রান্তে, আমার হাতের নিভে আসা টর্চের মতো আরও দুটো টর্চ জ্বলছে৷ বিষাক্ত উজ্জ্বল দুটো প্রদীপ বিম্ব৷ মস্তিষ্কের গহ্বরের সমস্ত মুছে যাওয়া স্মৃতি যেন জাগিয়ে তুলছে সেই আলো৷ সম্ভবত, দুটো চোখ৷ বা, দুটো অতিকায় চোখের ভগ্নাংশ৷

আমি নড়তে পারছি না৷ সে চোখ দুটো আরও কাছে এগিয়ে আসতে লাগল; সেইসঙ্গে একটা পাথরের ওপর নখের ঘষা খাওয়ার শব্দ৷ মাথার ওপর থেকে আসা শব্দে বুঝলাম, বাইরে বাজ পড়তে শুরু করেছে৷

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, সেই চোখদুটো ঠিক কিসের ছিল তা আমি বুঝতে পারিনি৷ জানলে হয়তো, আর বেঁচে থাকতে পারতাম না৷ আরও কিছুক্ষণ সেইভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকার পর, আকাশ ফুঁড়ে নেমে আসা একটা বজ্রপাত বাঁচিয়ে দিল আমাকে৷ মাটি ভেদ করে সুড়ঙ্গের মধ্যে নেমে এল সেটা৷ কান ফাটানো শব্দে আর হাওয়ার ধাক্কায় আমি ছিটকে পড়লাম উল্টোদিকের মেঝেতে৷

মনে হল একইসঙ্গে অন্ধ ও বধির হয়ে গেছি৷ মাটি পোড়ার গন্ধ আর জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলাম সুড়ঙ্গের ওপরে তৈরি হওয়া ফাটলের মধ্যে দিয়ে৷

পিঠের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়তে বুঝলাম, উপরে উঠে এসেছি৷ চারপাশে তাকিয়ে জায়গাটা চিনতে পারলাম৷ প্রাসাদের পিছনের ওক গাছের জঙ্গলের একটা অংশ এটা৷ দূরে তাকিয়ে ভূতল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা মাটির স্তূপ লক্ষ করলাম৷ যেন ছবিতে আঁকা একটা ল্যান্ডস্কেপকে জল রং দিয়ে ঘেঁটে দিয়েছে কেউ৷

আমার মাথার অবস্থা, ঠিক ওই ল্যান্ডস্কেপের মতোই৷ মনে হল মাটির স্তূপের মধ্যে থেকে সেই গনগনে লাল দৃষ্টি, মিলিয়ে আসছে৷

চার—অন্ধকারের অতল থেকে

এই ঘটনার ঘোর কাটিয়ে ওঠার দু-দিন আগেই, একটা খবর আসে আমার কানে৷ মাটির তলায় সেই রক্তাভ চোখ দুটো যখন আমার দিকে তাকিয়ে ছিল ঠিক সেই সময়, মারতিনস প্রাসাদ থেকে প্রায় কুড়ি মাইল দূরে একটা গ্রামে, একই রকম আরেকটি আক্রমণের কথা শোনা যায়৷ অর্থাৎ, এই পার্বত্য অঞ্চলে একটি নয়, অন্তত দুটি ভয়াবহ প্রাণীর অস্তিত্ব আছে৷ আমার ভয়টা, আরও বেড়ে উঠল৷

জ্যান মারতেনসের কবরের কাছে ফিরে গিয়ে আর কিছুরই হদিশ মিলল না৷ বজ্রপাতের ফলে আমার এক্সপিডিশনে পাওয়া সেই কফিন আর সুড়ঙ্গ পথ একসাথে মাটির তলায় হারিয়ে গেছে চিরতরে৷

সেটা নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই৷ বরঞ্চ দ্বিতীয় আক্রমণটা যেখানে ঘটেছে সেখানে গিয়ে কিছু খবর জোগাড় করার চেষ্টা করলাম৷ যা জানলাম, তা খানিকটা এই রকম—

গাছে ঘেরা একটা কেবিনের ওপর, গাছের ডাল বেয়ে একটা রাক্ষস-জাতীয় প্রাণীকে নামতে দেখে, গুলি চালায় গ্রামের কিছু লোক৷ সঙ্গে-সঙ্গে গোটা কেবিনটাই জ্বলে ওঠে৷ কিছু পোড়া হাড় ছাড়া, আর কিছুরই আপাতত হদিশ পাওয়া যায়নি সেখানে৷

লোকজনের সঙ্গে গিয়ে সেই পোড়া হাড়গুলো ভালো করে দেখে একটা অসঙ্গতি লক্ষ করলাম৷ কেবিনের ভিতরে যে লোকটা ছিল তার কঙ্কালের সবক-টা হাড় নেই সেই ধ্বংসস্তূপে৷ গলা অবধি আছে, মাথার খুলিটা গায়েব৷

রাক্ষসটাকে যারা দেখেছে, তাদের কারওর থেকেই কোনো পরিষ্কার বর্ণনা পাওয়া গেল না৷ এই ব্যাপারটা, বারবার লক্ষ করছি৷ আক্রমণ যেভাবেই হোক না কেন, দানবের বর্ণনা একেকজনের একেকরকম৷ ভারী আশ্চর্য!

এরপর আমি মেপল গাছের কাছে বাজ পড়ে যে জনপদটা মাটির ভিতর ধসে গেছিল, সেটা খুঁজে দেখার চেষ্টা করলাম৷ সেখানেও কিছু পাওয়া গেল না৷ শেষে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার তোড়জোড় শুরু করলাম৷

ততক্ষণে আকাশ চাঁদের আলোয় ভরে গেছে৷ সেই রূপালি আলো-ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে, একটা অদ্ভুত ভাবনা এসে ঘিরে ধরল আমাকে৷ প্রকৃতির বুকে একটা নির্দিষ্ট দিকে চোখ চলে গেল৷

পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিক্ষিপ্ত ঢিবিগুলোর ওপর এখন চাঁদের আলো এসে পড়েছে৷ সেই জ্যোৎস্নামাথা চূড়াগুলোর দিকে তাকিয়ে খেয়াল হল, ঢিবিগুলোর ওপরের মাটি নরম৷ কী একটা বিজাতীয় ভাবনা এসে ঘিরে ধরল আমাকে৷ কোন মাউন্টেন আর টেম্পেস্ট মাউন্টেনের মধ্যে মিলটা বুঝতে পেরেছিল মুনরো; কিন্তু আমাকে বলে যেতে পারেনি৷ আমাকেই খুঁজে বের করতে হবে সেটা৷ কিছু একটা যোগসূত্র নিশ্চয় আছে৷ কোথাও একটা বড় মিল—দেখেও দেখতে পাচ্ছি না৷ একটা আকৃতি…

থমকে গেলাম৷ আমার মাথার ভিতরে আলোর রেখা ফুটে উঠতে শুরু করেছে৷ যদিও জিওলজির ব্যাপারে তেমন জ্ঞান নেই আমার তাও, পাহাড়ের গায়ে ওই ছোট-ছোট ঢিবিগুলোর বিষয়ে প্রথম থেকেই বেশ আগ্রহ জন্মেছিল৷ তখনই লক্ষ করেছিলাম, পাহাড়ের যত উপরের দিকে ওঠা যায়, ততো বেশি করে ঢিবি চোখে পড়তে থাকে৷ এখন তাদের ওপর এসে পড়া চাঁদের আলোয় যে কিম্ভূত ছায়াগুলো তৈরি হয়েছে, তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে মনে হল, এই সমস্ত ঢিবিগুলোকে যদি একটা লাইন দিয়ে যোগ করা যায়, তাহলে একটা বিশেষ জ্যামিতিক আকৃতি তৈরি হবে৷ এবং সেই আকৃতির কেন্দ্র হবে পাহাড়ের চূড়াটা৷ ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে আছে মারতেনস প্রাসাদ৷ মারতেনস প্রাসাদকে কেন্দ্র করেই ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে এখানে৷

মাথার ভিতর ভাবনার ঝড় পাগল করে তুলল আমাকে৷ যেটুকু সময় মাটির নীচে কাটিয়েছিলাম তাতে এটুকু বুঝেছি যে এই মাটির তলায় একটা নয়, বেশ কিছু সুড়ঙ্গ আছে৷ একটা সম্ভাবনা ফুটে উঠল আমার পরিশ্রান্ত মনে৷

বিড়বিড় করতে লাগলাম৷ ‘হে ঈশ্বর! এই গোটা জায়গাটাই একটা মৌমাছির চাকের মতো হয়ে আছে৷ কতগুলো… মানে সেদিন ফায়ার প্লেসের ভেতর থেকে…’ বাকি ভাবনাগুলো উচ্চারণ করতেও আমার জিভ সরছে না আতঙ্কে৷

পাহাড় যত উপরে উঠেছে তত ঢিবির আয়তন ও ঘনত্ব বেড়ে উঠেছে৷ অর্থাৎ, সব থেকে বড় ঢিবিটা আছে মারতিনস প্রাসাদের একেবারে নীচে৷

এক দৌড়ে ঘরে ফিরে শাবল আর ছোট কয়েকটা যন্ত্রপাতি টেনে আনলাম আমি৷ সেই চন্দ্রাহত রাতে শাবল হাতে আমি ছুটে বেড়াতে লাগলাম আকাশছোঁয়া গাছের জঙ্গল ভেদ করে৷ মারতিনস প্রাসাদের ভিতরে ঢুকে বেপরোয়াভাবে খুঁড়তে লাগলাম প্যাসেজওয়েগুলোর মেঝে৷ পুরনো চিমনির নীচের গর্তটাতে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম; একদিকের ভাঙা প্রান্তের শ্যাওলার স্তূপ ভেদ করে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম৷ আমার হাতে ধরা মোমের আলো গিয়ে পড়ল প্রাসাদের প্রতিটা প্রাচীন দেওয়ালে, কড়িকাঠে৷ মনের ভেতর থেকে বারবার ডাক উঠল—এই শতাব্দীপ্রাচীন প্রাসাদেই লুকিয়ে আছে সেই গোপন আতঙ্ক৷

একবার ভাবলাম, তাকে কেবল একটা মোমবাতি আর শাবল সম্বল করে খোঁজা ঠিক হচ্ছে না৷ ইচ্ছে করল গ্রামে ফিরে গিয়ে আরও কাউকে ডেকে আনি৷ কিন্তু প্রাসাদ থেকে বেরোনোর আগেই একটা দমকা হাওয়া ছুটে এসে নিভিয়ে দিল আমার হাতের মোমবাতি৷ বাইরে ঝড় উঠতে শুরু করেছে; জঙ্গল পার হওয়ার আগেই ঝাঁপিয়ে নামবে সেটা৷

অনেকগুলো বিপরীত ভাবনা খেলা করতে লাগল মাথায়; আমায় টেনে নিয়ে চলল সেলারের একেবারে শেষপ্রান্তে৷ চোখ যদিও তখনও চিমনির নীচের মস্ত ফাটলটা থেকে সরেনি৷ বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হয়েছে এতক্ষণে৷ দেওয়ালের ইটগুলো যেন কেঁপে-কেঁপে উঠছে তাতে৷ একইসঙ্গে ভয় আর কৌতূহল এসে চেপে ধরল আমাকে৷ এই ঝড় না জানি আবার কোন বিপদকে ডেকে আনতে চলেছে৷ চিমনির নীচের ফাঁকটার দিকে চোখ রেখে বিপরীতদিকের দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে বসে পড়লাম আমি৷

ঈশ্বর যদি করুণাময় হন তবে একদিন হয়তো আমার স্মৃতি থেকে সেই চিমনির গর্তে আমি যা দেখেছিলাম, তা মুছে দেবেন৷ আমিও আবার তখন শান্তিতে অন্তিম জীবন অতিবাহিত করতে পারব৷ এখন আর রাতে ঘুম হয় না আমার৷ বাজ পড়লেই ওষুধপত্র খেয়ে নার্ভকে সচল রাখতে হয়৷

চিমনির সেই ফাটলের ভেতর থেকে একটা ইঁদুরের কিচির-মিচির শব্দ ভেসে আসছিল৷ মনে হচ্ছিল যেন জল বয়ে চলেছে চিমনির ভিতর দিয়ে৷ ধীরে-ধীরে এক নারকীয় নিঃশ্বাসের শব্দের আবির্ভাব হল৷ তারপর…

তারপরই সেই অন্ধকারের মধ্যে থেকে কালচে সাপের মতো একটা জীবিত ঘৃণ্য অস্তিত্ব বেরিয়ে এল, সরীসৃপের মতো প্যাঁচালো অথচ স্বচ্ছ৷ একটু-একটু করে বেড়ে উঠছে সেটা৷ কোথা থেকে বাষ্প এসে যেন ঘিরে ফেলছে তাকে৷ টেন্টাকেলস—একটা অতিকায় জীবন্ত শুঁড়৷ তার ডগার কাছটা কয়েক সহস্র হিংস্র দাঁতের সারিতে পরিপূর্ণ৷

কিছুর একটা খোঁজ করছে শুঁড়টা৷ সে জীবিত প্রাণীর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে৷ আমার মাথার ভেতর সমস্ত উত্তর স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল৷ গোটা পাহাড়ি অঞ্চলটার মাটির নীচে শুয়ে আছে একটা অজ্ঞাত প্রাগৈতিহাসিক অক্টোপাসের মতো প্রাণী৷ সে ঘুমিয়ে আছে, ঘুমিয়ে আছে কোনও একদিন জেগে ওঠার অপেক্ষায়৷ তার মূল মাথাটা আছে এই মারতেনস প্রাসাদের নীচে৷ বাজ পড়লে কোনও অলৌকিক নিয়মে কেবল তার শুঁড়গুলো জেগে ওঠে৷ মাটির উপরে ঢিবিগুলো দিয়ে বেরিয়ে এসে সেই জেগে ওঠা শুঁড়গুলো আক্রমণ করে গ্রামের মানুষদের৷ কিন্তু কে সেই প্রাণী?

আমি আর ভাবার সময় পেলাম না৷ দাঁতের সারি এগিয়ে আসছে ক্রমশ৷ প্রাণভয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম৷ আমার কানের পাশে শুরু হয়েছে একটা ফিসফিস৷ কেউ যেন ডেকে চলেছে আমাকে৷ হিসহিসে সাপের মতো শব্দে পৃথিবীর অতল থেকে সে ডাকের সুর ভেসে আসে যেন৷ মাথার ভিতরে অতীতের সব দৃশ্য ফুটে উঠছে৷

বাজ পড়ার ভয়ে সেই গুপ্তকক্ষে লুকাতে গিয়ে হয়তো মাটির তলায় শুয়ে থাকা অতিকায় প্রাণীটার অস্তিত্বের কথা জানতে পারেন গ্যারেট৷ তারপর থেকেই তিনি উন্মাদ হয়ে পড়েন৷ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন নিজেকে৷ একে-একে বংশধরদেরও সেই অস্তিত্বের কথা জানান তিনি৷ পারিবারিক প্রথা মেনে সকলেই চুপচাপ থাকলেও, জ্যান বেঁকে বসেন৷ তিনি বাইরের পৃথিবীর কাছে প্রকাশ করে দিতে চেয়েছিলেন সব৷ কিন্তু কিছু বলতে পারার আগেই খুন হন তিনি৷

প্রাসাদ থেকে ছুটে বেরিয়ে এলাম৷ এতক্ষণে বুঝতেই পেরেছি, বেনেট আর টোবিকে খুঁজে পাব না আর কোনওদিনই৷ বরং, বেশিক্ষণ এখানে থাকলে আমারও হদিশ পাবে না কেউ৷ যে-কোনও উপায়ে পালাতেই হবে আমাকে৷

বিস্তৃত পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ছুটতে লাগলাম অনন্তের দিকে৷ মনে হল পাহাড়ের গায়ের সমস্ত ঢিবির মুখগুলো যেন ক্রমশ খুলে যাচ্ছে—ক্রমাগত বাজ পড়ার শব্দে যেন প্রাণ সঞ্চার হচ্ছে সেগুলোতে৷ সমস্ত প্রাণশক্তি একত্র করে ছুটলাম৷ এক সময় পায়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গেলাম পাহাড়ের ঢাল বেয়ে৷

যখন জ্ঞান ফিরল তখন ঝড় থেমে গেছে৷ একটা ওক গাছের গায়ে ধাক্কা খেয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমি৷ এখন আমার মাথার ওপর খোলা আকাশে তারা ঝলমল করছে৷ সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম৷ দূরে গাছপালার ফাঁক দিয়ে মারতেনস প্রাসাদের একাংশ দেখা যাচ্ছে৷ ধীরে-ধীরে উঠে বসলাম৷ শরীরের অনেক জায়গায় ছড়ে গেছে; জামা-কাপড় ভরে গেছে মাটি আর ধুলোতে৷ উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম গ্রামের দিকে৷

মাটির উপর আমার পায়ের শব্দ হচ্ছে৷ আমি জানি, মাটি ভেদ করে সেই শব্দ নেমে যাচ্ছে আরও গভীরে, গিয়ে আঘাত করছে লক্ষ বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা কোনও মহাজাগতিক প্রাণীর কোষে৷

হাঁটতে-হাঁটতে একটা ব্যাপার মনে পড়ে গেল৷ চিমনির নীচ থেকে বেরিয়ে আসা সেই শুঁড়টার অজস্র দাঁতের মধ্যে দুটো জ্বলজ্বলে চোখ লক্ষ করেছিলাম৷ আমাকে দেখতে পায়নি সে তবে আমি দেখেছিলাম৷ দুটো চোখের রং দু-রকম৷ একটা নীল, আরেকটা সবুজ৷

অনূদিত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *