গোপনচারিণী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

গোপনচারিণী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

ওই উকিল ছোকরাটি ছাড়া সে জমিদার বংশের আজ আর কেহ কোথাও নাই। গ্রাম ছাড়িয়া দিয়া সে আজ শহরে আসিয়া বাস করিতেছে। গ্রামখানি অবশ্য শহর হইতে বেশি দূরে নয়—ডেলি প্যাসেঞ্জারি করিয়াও তাহার কাজ চলিতে পারে, কিন্তু গ্রামে তাহার আর নিজের বলিতে কিছু নাই—জমিদারি নিশ্চিহ্ন হইয়া গেছে, চাষের জমি যে—কয়—বিঘা ছিল তাহাও বিক্রি করিয়াছে; আছে মাত্র—গ্রামের দক্ষিণপ্রান্তে প্রকাণ্ড একটি আমবাগানের মাঝখানে মস্ত বড় একখানি দোতলা বাড়ি। বাড়িখানিও সে বিক্রি করিবার চেষ্টার ত্রুটি করে নাই, কিন্তু কিনিবার লোকের অভাবে সেখানি এখনও তেমনি পড়িয়া আছে। তাহার না আছে সংস্কার, না আছে কিছু—জরাজীর্ণ অট্টালিকা গ্রামপ্রান্তে ঠিক বিভীষিকার মতো খাড়া দাঁড়াইয়া থাকে। সন্ধ্যার পর সে পথ দিয়া লোকজন কেহ যাওয়া আসা করে না এবং তাহাকে লইয়া গ্রামবাসীর মুখে মুখে কিছু কিংবদন্তী কত ভূতুড়ে গল্প যে বিরচিত হইয়াছে তাহার আর ইয়ত্তা নাই। জঙ্গল, আনাচে—কানাচে নিশাচর পাখিরা বাসা বাঁধিয়াছে, দেওয়ালে চুন—বালি খসিয়া খসিয়া বর্ষায় নোনা ধরিয়া কি অপরূপ চেহারাই যে তাহার হইয়াছে তাহা আর বলিয়া বুঝাইবার নয়; ঝড়ে—বাতাসে শার্সি—ভাঙা জানলা—কপাট দড়াম দড়াম করিয়া দেওয়ালের গায়ে গিয়া লাগে—অমানিশার গভীর অন্ধকারে কিংবা কোনও বৈশাখী ঝড়ের রাত্রে মনে হয় যেন একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ অসহায় দানব তাহার দুই হাত দিয়া বুক চাপড়াইয়া আর্তনাদ করিতেছে।

ইট—বাহির—করা ফটকের দুইটা স্তম্ভের পাশে দুইটি বটগাছ—সম্পদের দিনে হয়তো তাহারা বাড়ির শোভা বর্ধন করিত, কিন্তু আজকাল তাহারা তাহাদের অসখ্য শাখা—প্রশাখা বিস্তার করিয়া, নাবাল নামাইয়া বিকটাকার দুই প্রেত—মূর্তির মতো অন্ধকারে দাঁড়াইয়া থাকে, সামান্য একটুখানি বাতাসের আন্দোলনে চিৎকার করিয়া ওঠে।

বহুকাল পরে এ হেন বাড়িতেও একদিন এক ভাড়াটে জুটিল। ভাড়াটে এক প্রৌঢ় ডাক্তার—শহরের সিভিল সার্জেন। বাঙালি ক্রিশ্চান। শহরে তাঁহার মনের মতো বাড়ি পাইলেন না বলিয়া এখানে আসিয়া বাস করিতে লাগিলেন।

শুনিলেন বাড়িটা ভূতুড়ে এবং মানুষের পক্ষে একাকী এখানে বাস করা অসম্ভব।

ডাক্তার ঈষৎ হাসিলেন। বলিলেন, ‘ভূতের ভয় আমি করি না।’

ঘর দোরের ধূলা ঝাড়াইয়া, চুনকাম করাইয়া, আসবাব—পত্র দিয়া তিনি ঘর সাজাইলেন, বাগান পরিষ্কার করাইলেন, আগাছার জঙ্গল সাফ হইয়া গেল, দরজায় জানালায় রঙিন পর্দা ঝুলিতে লাগিল, ঘরে ঘরে আলো জ্বলিল। ডাক্তার হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন।—চমৎকার বাড়ি, চারিদিক ফাঁকা, আলো—বাতাসের অভাব নাই। অবিবাহিত একা মানুষ—এমনি বাড়ি তিনি ভালোবাসেন।

এত বড় ডাক্তার, দেখিতে দেখিতে নীচের প্রকাণ্ড ‘হলে’ নানারকমের রুগি আসিতে লাগিল, পরমানন্দে তিনি চিকিৎসা আরম্ভ করিলেন। কিন্তু দেখেন, সন্ধ্যার পর কেহ আসে না, নিস্তব্ধ গ্রামপ্রান্তে শুধু ঝিঁঝিঁপোকা ঝিম ঝিম করিতে থাকে, মাঝে মাঝে পত্র—পল্লবের মর্মর শব্দ শোনা যায়, দূর প্রান্তরে সমস্বরে শৃগাল ডাকিয়া ওঠে, গ্রাম্য কুকুরের একঘেয়ে চিৎকার যেন থাকিয়া থাকিয়া নৈশ নিঃশব্দ অন্ধকারটাকে বিদীর্ণ করিয়া ডাক্তারের কানে আসিয়া বাজে। শয্যায় শয়ন করিয়া মশারি ফেলিয়া দিয়া আলো নিভাইয়া ডাক্তার ভাবেন, ভালো কথা, সমস্ত দিন পরিশ্রমের পর রাত্রে আর তাঁহাকে কেহ বিরক্ত করিতে আসিবে না।

ভূত—প্রেতে বিশ্বাস তাঁহার নাই। নিজে বৈজ্ঞানিক, সুতরাং বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে সত্য বলিয়া যাহা প্রমাণিত হয় না, মানুষের যাহা কপোল—কল্পিত, যাহা অসম্ভব, যাহা অদৃশ্য—তাহাতে বিশ্বাস তিনি করেন কেমন করিয়া?

কিসের যেন একটা শব্দে ডাক্তারের হঠাৎ একদিন ঘুম ভাঙিয়া গেল। জাগিয়া উঠিতেই মনে হইল, খটখট করিয়া খড়ম পায়ে দিয়া অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সিঁড়ি ধরিয়া কে যেন নীচে নামিয়া যাইতেছে। টর্চ হাতে লইয়া তৎক্ষণাৎ তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বাহিরে আসিয়া দেখেন, কেহ কোথাও নাই। সর্বাঙ্গ তাঁহার শিহরিয়া উঠিল। পুনরায় ফিরিয়া আসিয়া শয্যায় শয়ন করিলেন। কিন্তু রাত্রে ভালো ঘুম হইল না।

দিন—কয়েক পরে, আবার একদিন রাত্রে ঠিক তেমনি শব্দ! সেদিনও আবার তেমনি টর্চ লইয়া উঠিলেন। উঠিতেই দেখেন, সিঁড়ির রেলিং—এর পাশ দিয়া মস্তবড় একটা ইঁদুর তাড়াতাড়ি পলায়ন করিতেছে, আর সিঁড়ির একেবারে নীচের ধাপে লম্বা একটা গরুর হাড় পড়িয়া আছে।

হাড়টা হাত দিয়া ডাক্তার সেখান হইতে বাগানের মধ্যে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিলেন। ব্যাপারটা বুঝিতে সেদিন তাঁহার আর বিশেষ কষ্ট হইল না। মৃদু হাসিয়া নিশ্চিন্তমনে সেদিন তিনি চমৎকার ঘুমাইলেন। নির্বোধ মানুষ ইহাকেই ভূত মনে করিয়া অস্থির হয়।

বিবাহ তিনি করেন নাই। কেন করেন নাই কে জানে। হইতেও পারে বা, হয়ত তিনি তাঁহার মনের মতো মেয়ে খুঁজিয়া পান নাই, কিংবা হয়তো কাহাকেও ভালবাসিয়াছিলেন। যাই হোক, সেজন্য মনে তাঁহার কোনও ক্ষোভ বা দুঃখ আছে বলিয়া তো বিশ্বাস হয় না। দিব্য নিশ্চিন্ত, নির্বিকার, সদানন্দ পুরুষ; নিয়ত সংযত শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণের মতো তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ দেহ, প্রশস্ত ললাট, উন্নত নাসিকা, আয়ত দুইটি চক্ষু—দূর হতে সহসা দেখিলে ধূমলেশহীন জ্যোতি শিখা বলিয়া ভ্রম হয়। অথচ ইহার জন্য কোনও নারীচিত্ত কোনোদিন খুব ক্ষুধাতুর হইয়া উঠে নাই—ইহাই আশ্চর্য।

ডাক্তারবাবু ক্রিশ্চান, তার ওপর বাড়িটা ভূতুড়ে—লোকজন কেহই সহজে তাঁহার বাড়ি কাজ করিতে চায় না। শেষে অতি কষ্টে শহর হইতে চারজন লোক পাওয়া গেল। তিনজন চাকর, একজন রাঁধুনি।

রাঁধুনির নাম তেওয়ারি। জাতিতে পশ্চিমা ব্রাহ্মণ, গলায় সাদা ধপধপে পৈতার গোছা। বলে, ‘আজ্ঞে না, খিরিস্তান—ফিরিস্তান আমি মানি না। ইংরেজের রাজ্য—ওরাই যখন খিরিস্তান, তখন জাতটি যে আমাদের আছে তারই বা কি মালুম!’

ভালো কথা।

আর তিনজন ব্রাহ্মণ নয়। কি জাতি, ডাক্তারবাবু একবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু এখন আর সে কথা তাঁহার মনে নাই। একজনের নাম গোকুল, একজন গোবিন্দ, আর একজন রাম—বিরিজ। তাহারা চাকরের কাজ করিবে।

আরও লোক হইলে তাঁহার ভাল হয়। অত বড় বাড়ি, নীচে ডাক্তারখানা, পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন রাখিতে, কাজকর্ম করিতে বিস্তর লোকের দরকার।

অথচ লোক আসে। কাজকর্ম করে, আবার দিনকতক পরেই মাহিনা চুকাইয়া লইয়া ভূতের ভয়ে বাড়ি ছাড়িয়া পালায়।

যাইবার সময় মনিবের জন্য সকলেই আফশোস করে। এমন মনিব জীবনে তাহারা কখনও পাইবে না, কিন্তু উপায় নাই, বাঁচিয়া থাকিবার ব্যবস্থা তাহাদের আগে করিতে হয়।

কেহ বলে, ‘রাত্রে নাকি সে বাগানের ভেতর আলো জ্বলিতে দেখিয়াছে।’ কেহ বলে, ‘বাছুরের মতো কি একটা জানোয়ার প্রত্যহ ওই বটগাছের তলায় লাফালাফি করে।’ আবার কেহ কেহ এই বলিয়া অভিযোগ জানায়—যে, এ বাড়িতে আসিয়া অবধি যে সব অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়াছে এবং যেগুলি তাহারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছে—সে সব কথা স্পষ্ট দিবালোকে বসিয়া শুনিলেও মানুষের সর্বাঙ্গ শিহরিয়া ওঠে।

ডাক্তারবাবু জোর করিয়া কাহাকেও ধরিয়া রাখিতে চান না। টাকাকড়ির হিসাব চুকাইয়া দিয়া বলেন, ‘যাও। যার ইচ্ছা হবে সে—ই থাকবে, আর যার ইচ্ছা হবে না, তাকে জোর করে রেখে লাভ কী!’

কিন্তু ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায় জানি না—তেওয়ারি, গোকুল, গোবিন্দ ও রাম—বিরিজ টিঁকিয়া গেল। টিঁকিল যে কি কারণে, ডাক্তারবাবু তাহা জানিতেন না। তাহার কারণ অনুসন্ধান করিবার মতো অবসরও তাঁহার ছিল না।

কম্পাউন্ডার দুজন বাইকে চড়িয়া শহর হইতে এখানে আসে। একবেলা এইখানেই খায়, তাহার পর সমস্ত দিন থাকিয়া সূর্যাস্তের পূর্বেই তাহারা পলায়ন করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া ওঠে।

তাহাদেরই মধ্যে একজন সেদিন ডাক্তারবাবুর কাছে আসিয়া নালিশ জানাইল যে, ভাইনাম গেলিসিয়ার বড় বড় দুইটা বোতল ডিসপেনসারির আলমারির ভিতর হইতে চুরি গিয়াছে। কে চুরি করিয়াছে অনেক অনুসন্ধান করিয়াও টের পাওয়া গেল না, তবে তাহার মনে হয়—ইহা চাকরদের কাজ।

কথাটাকে ডাক্তারবাবু হাসিয়া উড়িয়া দিলেন। বলিলেন, ‘পাগল! চাকররা মদ নিয়ে করবে কী?’

কম্পাউন্ডার ছোকরাটি হাসিল। বলিল, ‘বিক্রি করবে। খেতেও পারে হয়তো।’

ডাক্তারবাবু বিশ্বাস করিলেন না; বলিলেন, ‘যাক গে। ও তোমরা খরচ লিখে দিও। চাকরদের কিছু বোল না।’

যাহা বলিবার তাহা সে আগেই বলিয়াছিল। আর কিছু বলিবার প্রয়োজন হইল না।

দিন—তিনেক পরে রাত্রে একদিন ভীষণ চিৎকারের শব্দে ডাক্তারবাবু নীচে নামিয়া আসিলেন। দেখিলেন, নীচের হলঘরে তেওয়ারি, গোকুল, গোবিন্দ ও রাম—বিরিজ— চারজনে জড়াজড়ি করিয়া বু বু করিয়া চিৎকার শুরু করিয়াছে। আলো লইয়া ডাক্তারবাবু তাহাদের কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন। এতক্ষণে ধড়ে যেন তাহাদের প্রাণ আসিল। তেওয়ারি সর্বাগ্রে উঠিয়া দাঁড়াইল এবং ডাক্তারবাবুর পায়ের কাছে ঢিপ করিয়া একটা প্রণাম করিয়া বলিল, ‘আজ আমরা ভূত দেখেছি বাবু।’

‘কী রকম?’

বাহিরের বাগানের দিকে আঙুল বাড়াইয়া তেওয়ারি বলিল, ‘ওইখানে। কালো রঙের একটা পেত্নি ওই গাছের ওপর পা ঝুলিয়ে বসেছিল বাবু, আমি নিজের চোখে দেখেছি।’

ডাক্তারবাবু দেখিলেন, কথা তাহার শেষ না হইতে হইতে গোকুল, গোবিন্দ ও রাম—বিরিজ প্রত্যেকেই উঠিয়া আসিয়া তাঁহার পায়ের কাছে ঢিপ—ঢিপ করিয়া প্রণাম করিল এবং সকলেই ঘাড় নাড়িয়া বলিল, তাহারাও দেখিয়াছে।

গতিক তাহাদের বিশেষ ভালো বলিয়া বোধ হইল না। তেওয়ারি আর দাঁড়াইয়া থাকিতে না পারিয়া টলিতে টলিতে হাতজোড় করিয়া সেইখানেই বসিয়া পড়িল।

সেদিনও মদ চুরির কথা ডাক্তারবাবুর মনে ছিল। বলিলেন, ‘ওগুলো আর অমন করে খাসনে বাবা। ও সব খেলে ভূত দেখতে দেরি হয় না।’

হাত নাড়িয়া না না বলিয়া কথাটাকে তেওয়ারি অস্বীকার করিতে যাইতেছিল, এমন সময় নিতান্ত সমঝদারের মতো গোবিন্দ ঘাড় নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, ‘হ্যাঁ বাবু, ঠিক বলেছেন, বড় জবর নেশা।’

ডাক্তারবাবু বুঝিলেন সবই। কিন্তু সে সম্বন্ধে আর কোনোরূপ উচ্চবাচ্য না করিয়া বলিলেন, ‘ঘরে খিল বন্ধ করে তোরা শুয়ে পড়, আলো নিয়ে আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি, ভয় নেই।’

খিল বন্ধ করিবার জন্যই তেওয়ারি বোধ করি টলিতে টলিতে আবার উঠিয়া দাঁড়াইল।

প্রত্যহ প্রত্যুষে দেখা যায়, গ্রাম হইতে এক ভদ্রলোক ডাক্তারবাবুর বসিবার ঘরখানিতে আসিয়া বসে। ডাক্তারবাবুকে নমস্কার করিয়া প্রত্যহ তাঁহার কুশলপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে, তাহার পর ইংরেজি খবরের কাগজটা একবার উলটাইয়া—পালটাইয়া দেখিয়া বলে, ‘এই খবরের কাগজ পড়ার অভ্যেস আমার এমন ছিল যে, কুড়ি বছর ধরে ‘বঙ্গবাসী’ কাগজখানার গ্রাহক ছিলাম।’

ডাক্তারবাবু হাসিয়া একবার তাহার মুখের পানে তাকাইয়া বলেন, ‘এখন আর নেই বুঝি?’

ঘাড় নাড়িয়া লোকটি বলে, ‘না। ছেড়ে দিয়েছি। দিয়েছি বটে, কিন্তু এখনও তারা ললিত মুখুজ্যেকে চেনে। বঙ্গবাসী আপিস থেকে আমার নামে চিঠি—পত্তর এখনও আসে। দুঃখু করে লেখে—এতদিনের পুরোনো গ্রাহক আপনি ছেড়ে দিলেন কেন…? আমি তার জবাব—টবাব দিই না।—সকালে আপনি চা খান?’

ডাক্তারবাবু বলেন, ‘হ্যাঁ খাই। কেন বলুন তো? আপনি খাবেন?’

মুখুজ্যে হাসিয়া বলে, ‘ওই একটা ছেলেবেলার অভ্যেস আমি এখনও ছাড়তে পারিনি।’

ডাক্তারবাবু তৎক্ষণাৎ একটা চাকরকে ডাকিয়া চা দিতে বলেন।

চায়ের পেয়ালা হাতে লইয়া মুখুজ্যের চোখ দুইটি আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া ওঠে। বলে, ‘খাসা রং হয়েছে চায়ের। আহা, এমনটি আর কোনোদিন আমার বাড়িতে হল না। আমার বাড়ির মেয়েদের মশাই এমনি মজা পোলাও বলুন, মাংস বলুন, কাবাব, কোর্মা যা বলুন—রেঁধে দেবে খাসা, কিন্তু চায়ের বেলা—’ ঘাড় নাড়িয়া মুখের চেহারাখানা একেবারে কিম্ভূতকিমাকার করিয়া মুখুজ্যে বলে, ‘পারবে না।’

সকালবেলা অনেকগুলি রুগি বিদায় করিতে হয়। বসিয়া বসিয়া গল্প করিবার অবসর ডাক্তারবাবু পান না। বলেন, ‘আপনি রোজ এইখানে এসে দু’বেলা চা খেয়ে যাবেন। আমি খুব খুশি হব।’

বলিয়াই ওঠেন। ঈষৎ হাসিয়া নমস্কার করিয়া বলেন, ‘অনেকগুলি রুগি বসে আছে। উঠতে হল, কিছু মনে করবেন না।’

ললিত মুখুজ্যেকে আজকাল আর চায়ের জন্য অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকিতে হয় না। আসিবামাত্র, ডাক্তারবাবু থাকুন আর নাই থাকুন, তেওয়ারি কিংবা চাকরদের যে কেউ একজন চায়ের বাটিটি তাহার সুমুখে ধরিয়া দিয়া যায়।

কিন্তু কাহারও সঙ্গে কথা কহিতে না পাইলে মুখুজ্যে যেন হাঁপাইয়া ওঠে। ডাক্তারবাবু উপস্থিত না থাকিলে সে গোকুল, গোবিন্দ, রাম—বিরিজ, তেওয়ারি—যাহাকে হোক কাছে ডাকিয়া বলে, ‘বস।’

ডাক্তারবাবুর বসিবার ঘরে চেয়ারের উপর তাহারা বসেই বা কেমন করিয়া। দাঁড়াইয়া থাকিয়াই বলে, ‘বলুন কি বলছেন।’

ভূতের ভয় তাহারা পায় কি না সেই কথাই মুখুজ্যে শুনিতে চায়। বলে, ‘দ্যাখনি কোনোদিন?’

গোবিন্দ বলে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, একদিন দেখেছিলাম। ডাক্তারবাবু ভাগ্যিস তখন আলো নিয়ে নীচে নেমে এলেন, নইলে সেইদিনই আমরা গিয়েছিলাম।’

মুখুজ্যে চা খাইতে খাইতে গোবিন্দকে উপদেশ দেয়। বলে, ‘খুব সাবধানে থেকো বাবা, এ বাড়ি বড় সহজ বাড়ি নয়। আমরা তখন ছেলেমানুষ এখনও মনে আছে, একদিন শুনলাম, বাবুদের ছোট—বৌ নাকি বাগানের ওই একটা গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। দেখতে এলাম। লোকে লোকারণ্য। বৌটিকে তখনও গাছ থেকে নামানো হয়নি। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে। পুলিশ এল। বাবুদের যে কত টাকা খরচ হল সেবার—। তারপর থেকে দেখা যেতে লাগল—বছরের পর বছর, বাড়িতে একটা না একটা কিছু হবেই। কখনও বা কেউ শুনি জলে ডুবে মরেছে, কেউ মরেছে বিষ খেয়ে—কেউ বা গলায় দড়ি দিয়ে। এমনি হতে হতে পাঁচ—ছ বছরের মধ্যে বাবুদের বাড়ি একেবারে সাফ হয়ে গেল।’—এ বাড়িতে ভূত থাকবে না তো থাকবে কোথায়! ধন্যি ডাক্তারবাবুর সাহস, তাই এখানে বাস করতে এলেন, আর কেউ হলে পারত না, এ আমি হাঁক মেরে বলে দিতে পারি। তোরা বাবা একটু সাবধানে থাকিস, রাতবিরেতে ঘর থেকে বেরোসনি, বুঝলি বাবা গোবর্দ্ধন!’

গোবিন্দ বলিল, ‘আমার নাম গোবিন্দ।’

সেইদিন হইতে মুখুজ্যে আর একা যায় না, সদানন্দকেও সঙ্গে লইয়া যায়।

অথচ সুবিধামতো ঔষধের কথা কোনোদিনই আর ওঠে না। কথা কহিতে কহিতে কথার ধারাটাকে মুখুজ্যে সেইদিক দিয়াই লইয়া যাইতে চায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৃতকার্য হইতে পারে না। ডাক্তারবাবু অন্য পথ ধরেন।

মুখুজ্যের কথায়—বার্তায় তাহার মনের কথার খানিকটা আভাস ডাক্তারবাবু পাইয়াছিলেন। তাহার মতো অত বড় বিজ্ঞ কম্পাউন্ডারের প্রয়োজন তাঁহার ছিল না বলিয়াই হোক, কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক, মুখুজ্যের মুখে ঔষধের প্রসঙ্গ উঠিলেই কৌশলে তিনি তাহা চাপা দিয়া অন্য কথা পাড়িয়া বসেন।

এবং নিজের কথা ওঠে না বলিয়া সদানন্দর কথাও মুখুজ্যে কোনোদিনই উত্থাপন করে না।

দুজনেই প্রত্যহ সেখানে যায়—আর বিফল মনোরথ হইয়া ফিরিয়া আসে।

সদানন্দ মনে মনে ভাবে, ইহার চেয়ে সোজাসুজি ডাক্তারবাবুকে একদিন জিজ্ঞাসা করিলেই ভালো হইত। মুখুজ্যেকে বলে, ‘হাঁ হে মুখুজ্যে, কই আমার কথা তো ভাই বললে না একদিনও। আমি নিজেই একবার বলে দেখি—কি বল?’

মুখুজ্যে বলে, ‘খবরদার খবরদার, অমন কাজটি করিস না। আমারটা আগে হয়ে যাক, তারপর তোর ব্যবস্থা আমি সেইদিনই করে দেব।’

কি আর করিবে, সদানন্দ চুপ করিয়া থাকে।

কিন্তু তাহার কপাল ভালো। বেশিদিন তাহাকে চুপ করিয়া থাকিতে হয় না।

গোবিন্দকে সেদিন কাছে ডাকিয়া এই ভূতুড়ে বাড়ির অতীত ইতিহাস বলিয়া দিয়া ললিত মুখুজ্যে তাহাকে কি ভয় যে ধরাইয়া দিয়াছিল, তাহা একমাত্র গোবিন্দই জানে।

সেইদিন হইতে ক্ষণে ক্ষণে তাহার শুধু ওই ভূতের কথাই মনে হয়। সন্ধ্যার অন্ধকার নামিলে আর সে ঘরের বাহির হইতে পারে না। ঘরের ভিতরে একসঙ্গে সকলে মিলিয়া বসিয়া থাকিতে থাকিতেও হঠাৎ হয়তো তাহার জানালার দিকে নজর পড়িয়া যায়, বাহিরে বাতাসের আন্দোলনে গাছপালা মড় মড় করিতে থাকে—গোবিন্দর আপাদমস্তক তৎক্ষণাৎ শিহরিয়া ওঠে।

অথচ, এ কথা সে কাহাকেও বলিতে পারে না।

মদের যে দুইটা বোতল তাহারা চুরি করিয়াছিল, তাহার মধ্যে একটা তো সেদিন প্রায়ই শেষ হইয়াছিল, বাকি আর একটা শেষ করিবার সুযোগ—সুবিধা তাহারা কোনোদিনই করিয়া উঠিতে পারিতেছিল না।

ডাক্তারের জন্য ভিন্নগ্রাম হইতে সেদিন কে যেন খানিকটা কাঁচা মাংস পাঠাইয়া দিয়াছিল। তেওয়ারি ভাবিল, বোতলটা শেষ করিবার ইহাই উপযুক্ত সময়।

ডাক্তারবাবু মাছ—মাংস খান না। আহারাদির পর আলো নিভাইয়া তিনি তাঁহার উপরের ঘরে গিয়া শয়ন করিলেন। অন্ধকার রাত্রি। চারিদিক নিস্তব্ধ। নীচের হলঘরে, তখন তেওয়ারি, গোকুল, গোবিন্দ ও রাম—বিরিজের মজলিশ বসিল। তেওয়ারি আগে হইতেই সকলকে সাবধান করিয়া দিল।—

‘দেখিস বাবা, সেদিনের মতো ভূত—টুত দেখিস না কেউ।’

গোবিন্দ ছাড়া সকলেই হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। সে তখন ঘরের এককোণে গিয়া চুপ করিয়া বসিয়াছে।

দু’এক পাত্র পেটে যাইতে না যাইতেই তাহারা আপন আপন কাজ শুরু করিয়া দিল। তেওয়ারির সঙ্গে রাম—বিরিজ দু—একদিন গাঁজা খাইয়া দেখিয়াছে—নেশা করিলেই যত দুঃখের কথা তাহার মনে পড়ে আর কান্না পায়। সেদিনও সে কান্না শুরু করিল। পরনের কাপড়টাকে গোকুলচন্দ্র মেয়েদের মতো করিয়া পরিয়া, নাচিয়া নাচিয়া গান গাহিতে লাগিল। এলুমিনিয়ামের দুটা ডেকচি উপুড় করিয়া তেওয়ারি তাহাই ডুগি—তবলার মতো গুম গুম করিয়া বাজাইতে লাগিল। গোবিন্দ বেচারা মদ খাইতে চায় না, কিন্তু এক তীর্থে আসিয়া পৃথক ফল হওয়া উচিত নয় বলিয়া সকলে মিলিয়া একরকম জোর করিয়াই তাহাকে খাওয়াইল।

নাচগান ও কান্না তাহাদের কতক্ষণ চলিয়াছিল কে জানে। প্রত্যুষে তেওয়ারির ঘুম ভাঙিতেই দেখিল, মেঝের উপর যে যেখানে পারিয়াছে শুইয়া পড়িয়া সকলেই ঘুমাইতেছে। ঘরের দরজা খোলা। কাচের গ্লাস দুইটা ভাঙিয়া গেছে, বোতল ভাঙিয়াছে, মাংসের কাঁটায় ঝোলে চারিদিক ছতিছন্ন। তাড়াতাড়ি সে নিজের হাতেই সেগুলা পরিষ্কার করিয়া একে একে সকলকে উঠাইতে আরম্ভ করিল। গোঁ গোঁ করিয়া গোকুল উঠিল, রাম—বিরিজ উঠিল, কিন্তু গোবিন্দ কিছুতেই ওঠে না। আধখানা দেহ তাহার দরজার বাহিরে এবং বাকি আধখানা ঘরের ভিতর রাখিয়া উপুড় হইয়া সে শুইয়া আছে। বোধ করি রাত্রে সে ঘরের বাহিরে গিয়াছিল। ফিরিয়া আসিয়া আর ঘরের ভিতর পর্যন্ত পৌঁছিতে পারে নাই, এইখানেই শুইয়া পড়িয়া নেশার ঝোঁকে বমি করিয়া ফেলিয়াছে। দুর্গন্ধে সেখানে দাঁড়ানো যায় না। অথচ তাড়াতাড়ি এসব পরিষ্কার করিয়া না ফেলিলে ডাক্তারবাবু টের পাইবেন। তেওয়ারি হাত দিয়া খুব জোরে জোরে নাড়িয়া গোবিন্দকে উঠাইতে লাগিল।

কিন্তু ঘুম তাহার কিছুতেই ভাঙে না!

অবশেষে রাগিয়া সে তাহার চুলের মুঠি ধরিয়া জোর করিয়া তাহাকে উল্টাইয়া দিয়া বলিল, ‘ওঠ!’

এবং ‘ওঠ’ বলিয়া গোবিন্দর মুখের পানে তাকাইবামাত্র তেওয়ারি চিৎকার করিয়া লাফাইয়া একেবারে ছিটকাইয়া পড়িল।

গোকুল ও রাম—বিরজ তখনও বসিয়া বসিয়া ঢুলিতেছিল, তেওয়ারির চিৎকারে তাহারা চোখ মেলিয়া চাহিল।

ঠক ঠক করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে তেওয়ারি বলিল, ‘গোবিন্দ মরে গেছে।’

নেশা ছুটিতে তাহাদের বিলম্ব হইল না। উঠিয়া গিয়া দেখিল, সত্যই তাই। মুখে তাহার তখনও ভয়ের চিহ্ন। ঘোলাটে চোখ দুইটা যেন ঠিকরাইয়া বাহির হইয়া পড়িতেছে, দাঁতের পাশ দিয়া জিভটা বাহির হইয়া গেছে, নাক দিয়া খানিকটা রক্ত গড়াইয়া মুখে আসিয়া জমিয়াছে। সেদিকপানে তাকাইতেও ভয় করে।

ডাক্তারবাবু নীচে আসিয়া বসিয়াছিলেন। ললিত মুখুজ্যে, সদানন্দ—দুজনেই আসিয়াছিল।

চায়ের জন্য তাহারা অপেক্ষা করিতেছে এমন সময় ছুটিয়া তেওয়ারি আসিয়া ঘরে ঢুকিল এবং ডাক্তারবাবুর পায়ের কাছে দড়াম করিয়া আছাড় খাইয়া পড়িয়া বলিয়া উঠিল, ‘আর আমি এখানে থাকব না বাবু, আমায় ছুটি দিন।’

ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কেন?’

তেওয়ারি উঠিয়া বসিয়া থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। বলিল, ‘গোবিন্দকে কাল ভূতে মেরে দিয়ে গেছে বাবু। আসুন—দেখবেন আসুন।’

উপস্থিত সকলেই চমকিয়া উঠিল। মুখুজ্যে জিজ্ঞাসা করিল, ‘মেরে দিয়ে গেছে কি হে? একেবারে খুন? মরে গেছে?’

ঘাড় নাড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে তেওয়ারি বলিল, ‘হ্যাঁ বাবু।’

ডাক্তারবাবু উঠিলেন, মুখুজ্যে উঠিল, সদানন্দ উঠিল, এবং সকলে মিলিয়া ঘটনাস্থলে গিয়া দেখিল, গোবিন্দর মৃতদেহ তখনও তেমনি দরজার উপর কাঠ হইয়া পড়িয়া আছে।

কাহারও মুখে কোনো কথা নাই!

ডাক্তারবাবু অধোমুখে গুম হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। বুঝিলেন সবই। কিন্তু কাহাকেও কোনো প্রশ্ন করিলেন না। বহুক্ষণ তেমনি ভাবে দাঁড়াইয়া থাকিবার পর একজন কম্পাউন্ডারকে কাছে ডাকিয়া বলিলেন, ‘বাইক নিয়ে যাও, থানায় খবর দিয়ে এস।’

গলার আওয়াজ তাঁহার ভারী বলিয়া বোধ হইল।

তেওয়ারি কি যেন বলিতে যাইতেছিল, ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘চুপ কর। তোমাদের সকলকে তাড়িয়ে দেব আমি। আবার নতুন লোক রাখব।’

সদানন্দ কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল। এমন সুযোগ সে কোনোদিনই পায় নাই। বলিল, ‘দিন না বাবু, লোকের ভাবনা কি! আমি আপনার রসুই করে দেব।’

ডাক্তারবাবু তাহার মুখের পানে তাকাইলেন। বলিলেন, ‘পারবে তুমি?’

সদানন্দ ঈষৎ হাসিয়া একবার মুখুজ্যের মুখের পানে তাকাইল, অর্থাৎ তাহার সম্বন্ধে যাহা বলিতে হয় সে বলুক।

কিন্তু মুখুজ্যের বোধ করি হিংসা হইল। কিছুই সে বলিল না দেখিয়া সদানন্দ নিজেই বলিল, ‘ভাত রাঁধার কাজই তো আমি করতাম বাবু, আজকাল চাকরি নেই, বসে আছি, বড় কষ্ট হচ্ছে।’

ডাক্তারবাবু তখন আর বেশি কথা বলিতে পারিলেন না। ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, ‘বেশ, থাক তুমি আজ থেকেই।’

তেওয়ারি হাতজোড় করিয়া বলিল, ‘আমায় তাহলে ছুটি দিন বাবু, আমি আর এ ভূতুড়ে বাড়িতে থাকব না।’

গম্ভীর কণ্ঠে ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘এখন নয়। পুলিশের হাঙ্গামা চুকুক আগে। তারপর যেয়ো।’

পুলিশ!

পুলিশের নামে তেওয়ারির চোখ দিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল।

ডাক্তারবাবু সরকারি মানুষ। পুলিশের হাঙ্গামা দু’দিনেই চুকিয়া গেল।

আহা বেচারা গোবিন্দ!

তাহার আত্মীয়স্বজন কেহ কোথাও আছে কি না জানিবার জন্য ডাক্তারবাবু অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোথাও কেহ সন্ধান দিতে পারিল না।

পুলিশের হাঙ্গামা চুকিলে ডাক্তারবাবু বলিয়াছিলেন, সকলকে তাড়াইয়া দিবেন, কিন্তু কাহাকেও তাড়ানো আর হইয়া ওঠে নাই।

তেওয়ারি নিজেই যাইতে চাহিয়াছিল, কিন্তু দেখা গেল, যাইবার নামটি পর্যন্ত সে আর মুখেও আনে না। গোকুলও থাকিল, রাম—বিরিজও থাকিল। সদানন্দ কাজ করিতে লাগিল।

ডাক্তারবাবু কাহাকেও কিছু বলেন না। অনেক সময় চুপ করিয়া বসিয়া বসিয়া বোধ করি শুধু গোবিন্দর কথাই ভাবেন।

সেদিন তিনি শহরে যাইবার জন্য বাহির হইতেছেন, সদানন্দ হঠাৎ তাঁহার সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

ব্যাপার কী?

সদানন্দ বলিল, ‘বাড়িতে আমার বড় গোলমাল চলছে হুজুর। যদি বলেন তো ওই রান্নাঘরের পাশের ঘরখানায় মেয়েছেলে নিয়ে আমি উঠে আসি।’

‘বেশ তো, এস।’ বলিয়া ডাক্তারবাবু চলিয়া গেলেন এবং সন্ধ্যার পূর্বে ফিরিয়া আসিয়া শুনিলেন, গ্রাম ছাড়িয়া দিয়া সদানন্দ সপরিবারে এখানে উঠিয়া আসিয়াছে।

রাত্রে তিনি খাইতে বসিয়া দেখিলেন, অন্য দিনের মতো তেওয়ারি কিংবা সদানন্দ কেহই তাঁহার খাবারের থালা লইয়া আসিল না। আসিল যে, তাহাকে তিনি তাঁহার জীবনে এই প্রথম দেখিতেছেন। অসামান্যা সুন্দরী একটি মেয়ে—স্বাস্থ্যবতী, যুবতী, পরনে মাত্র একখানি সাদাসিধা শাড়ি—হাতে দুটি শাঁখা ও সিঁথিতে সিঁদুর ছাড়া সর্বাঙ্গে আভরণের কোথাও এতটুকু চিহ্ন পর্যন্ত নাই।

খাবার নামাইয়া দিয়া মেয়েটি চলিয়া যাইতেছিল, পশ্চাতে হাসি হাসি মুখে সদানন্দ আসিয়া দাঁড়াইল, বলিল, ‘আমার স্ত্রী।’

ডাক্তারবাবু মুখ তুলিয়া তাকাইলেন। বলিলেন, ‘তোমার ছেলে—মেয়ে—’

‘আজ্ঞে না, ছেলেমেয়ে নেই।’

ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘তাহলে কেন তুমি ওঁকে একলা এ বাড়িতে নিয়ে এলে সদানন্দ? অন্যায় করলে।’

‘আমি তো আনতে চাইনি বাবু, ও নিজেই এল।’ বলিয়া সদানন্দ ডাক্তারবাবুর আরও একটুখানি কাছে আগাইয়া গিয়া বলিল, ‘একা নয় আজ্ঞে, ওর সঙ্গী আর একটি আছে।’

‘কে?’

সদানন্দ বলিল, ‘আমার প্রথম স্ত্রী। ইনি আমার দ্বিতীয় পক্ষের।’

কথাটা ডাক্তারবাবুর বোধ করি ভালো লাগিল না। অস্ফুটস্বরে মাত্র একবার ‘ও’ বলিয়া তিনি আবার খাওয়ায় মন দিলেন।

পরদিন দিনের বেলা ডাক্তারবাবু শহরে গিয়াছিলেন, ফিরিয়া আসিতে সন্ধ্যা হইল। গ্রামপ্রান্তে বাগান এবং সেই বাড়িটার উপর তখন অন্ধকার নামিয়াছে। নীচের ডিসপেনসারি ঘরের তালা বন্ধ করিয়া কম্পাউন্ডারেরা বাড়ি চলিয়া গেছে। কাহারও কোথাও সাড়াশব্দ নাই। প্রতিদিনের অভ্যাসমতো অন্ধকারেই সিঁড়ি ধরিয়া ডাক্তারবাবু উপরে উঠিয়া গেলেন। ঘরে তখনও তাঁহার আলো দেওয়া হয় নাই। ভাবিলেন, সকলে মিলিয়া হয়তো রান্নাঘরে বসিয়া এখনও জটলা করিতেছে; গোকুল কিংবা রাম—বিরিজের নাম ধরিয়া চিৎকার করিয়া ডাকিতে যাইবেন—হঠাৎ তাঁহার ঘরের মধ্যে খুট করিয়া কিসের যেন একটা আওয়াজ হইল। চমকিয়া তিনি সেইদিকপানে একদৃষ্টে তাকাইয়া রহিলেন। মনে হইল, আবছা অন্ধকারে কে যেন ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। সহসা ফস করিয়া একটা দিয়াশালাই জ্বলিল, দেখিতে দেখিতে টেবিলের উপর বাতিটা জ্বলিয়া উঠিল এবং সেই আলোকে দেখিলেন, মায়াপুরীর রাজকন্যার মতো সদানন্দর স্ত্রী তাহার অপূর্ব রূপরাশি লইয়া টেবিলের একপাশে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া মুখের পানে একাগ্র উন্মুখ দৃষ্টিতে তাকাইয়া আছে।

ধীরে ধীরে ডাক্তারবাবু ঘরে ঢুকিলেন। দেখিলেন, ঘরের যাবতীয় জিনিস—পত্র আবার নতুন করিয়া সাজান হইয়াছে—দিব্য পরিপাটি, এ যেন বহুদিনের গোছানো সংসার!

কেমন যেন তাঁহার লজ্জা করিতে লাগিল। জামাটি খুলিয়া তিনি কোথায় রাখিবেন বুঝিতে পারিতেছিলেন না, মেয়েটি তাড়াতাড়ি আগাইয়া আসিয়া হাত হইতে তাঁহার জামাটি একরকম কাড়িয়া লইল। পশ্চিম দিকের দেওয়ালে ‘হুক’ টাঙানো হইয়াছে, তাহারই উপর জামাটি টাঙাইয়া দিয়া সে স্টোভ জ্বালিতে বসিল।

জুতার ফিতা খুলিতে খুলিতে ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘আপনি কেন,—চাকর—বাকরদের কাউকে ডেকে দিলেই তো হত।’

মেয়েটি ঈষৎ হাসিল।

সে বড় চমৎকার হাসি!

ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘আপনি যান।’

কিন্তু সে কথা বোধ করি সে শুনিতেই পাইল না। স্টোভে তখন শব্দ উঠিতেছে, তাহারই উপর জল চড়াইয়া দিয়া চায়ের সাজ—সরঞ্জাম হাতের কাছে আনিয়া সে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।

‘ট্রে’র উপর চা লইয়া মেয়েটি টেবিলের কাছে আসিয়া দাঁড়াইতেই ডাক্তারবাবু মুখ তুলিয়া তাহার মুখের পানে একবার তাকাইলেন। এত ভালো করিয়া তাহাকে দেখিবার অবসর তাঁহার হয় নাই। দেখিলেন, খোলা চুলের গোছা তাহার কাঁধের উপর পিঠের উপর ছড়ানো, কপালে একটুখানি সিঁদুরের টিপ, হরিণীর মতো দুটি আয়ত চক্ষু, কালো দুইটি স্বচ্ছ তারকা তাহারই মাঝখানে ঢলঢল করিতেছে, গায়ের রং যেন দুধে—আলতায় গোলা, সর্বোপরি একখানি নীলাম্বরী শাড়ি তাহার সেই নিটোল সুন্দর দেহ খানিক বেষ্টন করিয়া কি গৌরব যে দান করিয়াছে তাহা আর বুঝাইয়া বলিবার নয়। দেখিয়া দেখিয়া তৃপ্তি যেন আর কিছুতেই হয় না। অথচ এমন নির্লজ্জের মতো তাকাইয়া থাকিতেও লজ্জা করে। ডাক্তারবাবু মুখ ফিরাইয়া চায়ের বাটিতে চুমুক দিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনার নাম?’

নারীর সঙ্গে পরিচয় জীবনে তাঁহার অত্যন্ত কম। চিরকালই তাহাদের সংস্রব হইতে নিজেকে তিনি দূরে সরাইয়া রাখিয়াছেন, কোথায় কখন কিরূপ ভাবে তাহাদের সহিত কথা কহিতে হয়, তাহা তিনি জানেন না। বোধ করি নাম জিজ্ঞাসা করা তাঁহার উচিত হয় নাই।

মেয়েটি ঈষৎ হাসিয়া চোখ নামাইয়া বলিল, ‘আরতি।’

আরতি! চমৎকার নাম!

কিন্তু এ—মেয়ের বিবাহ ওই অশিক্ষিত কুৎসিত সদানন্দর সঙ্গে হইল কেমন করিয়া—জানিবার জন্য ডাক্তারবাবুর মনে কৌতূহল অত্যন্ত প্রবল হইয়া উঠিল।

এ কৌতূহলই বা তাঁহার হয় কেন? মনের ইচ্ছা মনেই চাপিয়া রাখিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, ‘যান, আপনি নীচে যান। আমি আলো দেখিয়ে দিই।’

‘আলো চাই না।’ বলিয়া আরতি তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরিল এবং নিঃশব্দে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

একখানা বই লইয়া ডাক্তারবাবু সোফার উপর শুইয়া পড়িলেন। মনের মধ্যে ঘুরিয়া ফিরিয়া শুধু আরতির কথাই জাগিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে পিছনে শব্দ হইতেই তাকাইয়া দেখিলেন, খাবারের থালা হাতে লইয়া আরতি আবার তাহার ঘরে ঢুকিতেছে এবং সুমুখে লণ্ঠন হাতে লইয়া সদানন্দ। দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটার পানে তাকাইয়া দেখিলেন, তিন ঘণ্টা পার হইয়াছে, অথচ বই—এর একটি পৃষ্ঠাও তখনও পড়া হয় নাই।

পরদিন সদানন্দর মুখে সবই শুনিলেন।

শুনিলেন, আরতির সঙ্গে বিবাহ তাহার মোটে তিন বৎসর হইয়াছে। পূর্বদেশে কোন একটা শহরে সে নাকি একবার চাকরি করিতে যায়। যে বাড়িতে সে ভাত রাঁধিত, তাহারই পাশের বাড়িতে থাকিতেন আরতির মা। তিনিও নাকি সে বাড়িতে ঝি—এর কাজ করিতেন। হঠাৎ একদিন শোনা গেল, আরতির মা মৃত্যুশয্যায় এবং তাঁহারই সনির্বন্ধ অনুরোধে বাড়ির কর্তা নাকি তাঁহার বয়স্থা কন্যা আরতির বিবাহের আয়োজন করিয়াছেন। বি—এ পাশ করা একটি ছেলে নাকি দয়া করিয়া তাহাকে বিবাহ করিবে। সেইদিনই বিবাহ। সদানন্দ বিবাহ—সভায় উপস্থিত। অনাথা বিধবার মেয়ে, দয়া করিয়া তাহাদের কাজকর্ম সে করিয়া দিতেছিল। বিবাহের লগ্ন উপস্থিত। বর আসে না। শেষ মুহূর্তে বর বলিয়া পাঠাইল—ও মেয়েকে বিবাহ সে করিবে না, তাহার গোপন তথ্য সবই সে জানিয়া ফেলিয়াছে। সর্বনাশ! বাড়ির কর্তা অস্থির হইয়া ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। আরতির মা’র অবস্থা তখন এখন যায় তখন যায়। তাঁহাকে জানানো হইল না। অথচ সময় আর নাই! কোথাও কিছু ঠিক করিতে না পারিয়া বুড়া কর্তা—মহাশয় সদানন্দকে ধরিয়া বলিলেন—’ব্রাহ্মণের মান রক্ষা কর বাবা, তোমায় আমি নগদ পঞ্চাশটি টাকা দিচ্ছি।’ ব্যস! তৎক্ষণাৎ বিবাহ। বিবাহের তিন দিন পরে মা মরিলেন। গোপন তথ্য প্রকাশ হইয়া পড়িল। ব্যাপার আর এমন বিশেষ কিছুই নয়। হঠাৎ একদিন রাত্রে কয়েকজন গুণ্ডা আসিয়া আরতিদের বাড়ি হইতে তাহাকে চুরি করিয়া লইয়া গিয়া মুখে, হাতে, পায়ে কাপড় বাঁধিয়া তাহার সর্বনাশ করিয়া পথের মাঝে ফেলিয়া দেয়। চোর—গুণ্ডা কেহই ধরা পড়ে নাই। জাতিচ্যুতা হইয়া আরতিকে লইয়া লোকলজ্জায় তাহার মা সে গ্রাম ছাড়িয়া দিয়া দূরের শহরে আসিয়া দাসী—বৃত্তি আরম্ভ করেন। অনেক কষ্টে শেষে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বহু লাঞ্ছনা ভোগ করিয়া ওই বৃদ্ধের বাড়িতে আসিয়া একটুখানি নিরাপদ আশ্রয় পান।

আরতির জীবনের এই সামান্য ইতিহাস।

ডাক্তারবাবু শুনিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিয়া চুপ করিয়া রহিলেন।

সদানন্দ জিজ্ঞাসা করিল, ‘খাবার আনব?’

‘হ্যাঁ আনো। কিন্তু নিজে এনো। ওঁকে আর বারবার কেন বিরক্ত করছ?’

‘যে আজ্ঞে।’ বলিয়া সদানন্দ চলিয়া গেল বটে, কিন্তু খাবার আনিল আরতি।

রাত্রি নয় যে, আলো দেখাইয়া সদানন্দ সঙ্গে আসিবে।

খাবার ধরিয়া দিয়া আরতি বলিল, ‘উঠুন।’

ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘আপনি নিজে কেন বারবার—’

কথাটা আরতি তাঁহাকে শেষ করিতে দিল না। বলিল, ‘আমি কি আপনার ‘আপনি’?’

বলিয়া ঈষৎ হাসিল। বলিল, ‘আমি আপনার রাঁধুনি ব্রাহ্মণের স্ত্রী। ‘আপনি’ বললে আমার লজ্জা হয়।’

ডাক্তারবাবু এবার নিজেকে অত্যন্ত দৃঢ় করিয়া বলিয়া বসিলেন, ‘লজ্জার কোনো প্রয়োজন নেই। দয়া করে আপনি আর এখানে আসবেন না।’

আরতির গাল দুইটা হঠাৎ লাল হইয়া উঠিল। মুখ চোখ যেন আগুনের মতো জ্বলিতে লাগিল। হেঁটমুখে শাড়ির খানিকটা পাড় ধরিয়া সে দুহাত দিয়া টানিতে টানিতে নিতান্ত সন্তর্পণে ধীরে ধীরে সেখান হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল—এবং তাহার পর দুই দিন ডাক্তারবাবু তাহাকে আর দেখিতে পাইলেন না। খাবার লইয়া কখনও বা তেওয়ারি আসে, কখনও সদানন্দ।

আরতি আর আসে না।

এক একবার মনে হয়, আরতির কথা কাহাকেও একবার জিজ্ঞাসা করেন, কিন্তু পরক্ষণেই মনের দুর্বলতা মনেই চাপিয়া রাখিয়া ভাবেন, ভালোই হইয়াছে।

দিন কয়েক পরেই দেখেন, ঘর—দোর আবার সব আগেকার মতোই বিশৃঙ্খল হইয়া গেছে। টেবিলের ধূলা ঝাড়া হয় না, আলোর কাচটা তেমন পরিষ্কার নাই, দোয়াতের কালি ফেলিয়া মেঝের কার্পেটটা সেদিন নিজেই তিনি নোংরা করিয়া ফেলিয়াছেন, ভাঙা দোয়াতটা সেদিন হইতে ঘরের কোণে তেমনি পড়িয়া আছে।

আগে হয়তো ইহার জন্য কাহারও কাছে তিনি কোনও অভিযোগই করিতেন না, কিন্তু সেদিন হঠাৎ তাঁহার চোখে এসব বড় বিসদৃশ বোধ হইল। গোকুল ও রাম বিরিজকে ডাকিয়া খুব খানিকটা তিরস্কার করিয়া দিলেন।

জোরে কথা বলিতে কেহ তাঁহাকেও কখনও শোনে নাই। তাহারা তো অবাক!

শহরে সেদিন একটা আত্মহত্যার মৃতদেহ ‘ময়না’ করিতে হইয়াছিল। সন্ধ্যায় বাড়ি যখন ফিরিলেন, ডাক্তারবাবুর মনের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। টেবিলের আলোটা গোকুল জ্বালিয়া দিয়া গেল। সাজ—পোশাক খুলিয়া ডাক্তারবাবু তাঁহার প্রতিদিনের অভ্যাসমতো বই লইয়া পড়িতে বসিলেন। কিছুক্ষণ পড়িতে না পড়িতেই দেখিলেন, আলোর জ্যোতি কমিয়া আসিতেছে। আলোয় তেল নাই। ডাকিলেন, ‘গোকুল! রাম—বিরিজ!’

জোরে জোরে কয়েকবার ডাকিবার পর রাম—বিরিজ আসিয়া দাঁড়াইল।

ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘তোরা দূর হয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।’

অপরাধের কথা কিছুই সে বুঝিতে পারিল না, হাত জোড় করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

এমন সময় কি যেন তাঁহাকে বলিবার জন্য সদানন্দ আসিয়া ঘরে ঢুকিল। ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘কে, সদানন্দ? আলোয় একটু তেল দাও তো বাবা? আর এই চাকর দুটোকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে কাল দুটো নতুন চাকর দ্যাখো।’

সদানন্দ তৎক্ষণাৎ কেরোসিন তেলের বোতল আনিয়া আলোয় তেল পুরিয়া দিল। বলিল, ‘আমি একটা বড় জরুরি কথা বলবার জন্যে আপনার কাছে এসেছিলাম।’

‘কি কথা?’

সদানন্দ রাম—বিরিজের মুখের পানে একবার তাকাইল। কথাটা তাহার সুমুখে বলিতে বোধ করি ইতস্তত করিতেছিল। ডাক্তারবাবু বুঝিলেন। তা তিনি দরজার পাশে দণ্ডায়মান রাম—বিরিজের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘দাঁড়িয়ে রইলি কেন হতভাগা? বেরো এখান থেকে! দূর হ! মাইনে যা পাবি, যাবার সময় চেয়ে নিয়ে যাস।’

রাম—বিরিজ চলিয়া গেলে সদানন্দ বলিল—’তেওয়ারির জ্বালায় তো হুজুর আমায় এ বাড়ি ছাড়তে হল।’

‘কেন?’

সদানন্দ বলিল, ‘একসঙ্গে কাজ করি, ভাবলাম বন্ধুলোক, বাড়ির ভেতরে আসে আসুক, দোষটাই বা কি! কিন্তু ওর যে এত গুণ তা কেমন করে জানব বাবু, তাহলে ওকে বাড়ি ঢুকতে দিতাম না।’

ডাক্তারবাবু সোজা হইয়া উঠিয়া বসিলেন।

সদানন্দ বলিল, ‘ব্যাটা দেখলাম, আমার ছোট বৌকে দেখলেই কেমন যেন করতে থাকে। বন্ধু মানুষ, কি আর বলি বলুন, তখন আমি অতটা ভাবিনি। তারপর আজ সকালে—আমি রান্নাঘরে রান্না করছি, ছোট বৌ আমার কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আমায় বললে, ‘তেওয়ারি আমার গায়ে হাত দিলে কেন জিজ্ঞেস কর।’ তেওয়ারি তখন—’

ডাক্তারবাবু যেন দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিলেন। কথাটা তাহাকে শেষ করিতে না দিয়াই বলিলেন, ‘ডাক দেওয়ারিকে।’

তেওয়ারি আসিয়াই হাত জোড় করিয়া বলিল, ‘না হুজুর, আমি কি কখনও—’

হাত তুলিয়া ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘চুপ কর।’

জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি না ভূতুড়ে বাড়ি বলে অনেকদিন আগেই যেতে চেয়েছিলে—যাওনি কেন?’

তেওয়ারি বলিল, ‘আপনার মতো মনিব ছেড়ে কোথায়ই বা যাই বলুন?’

‘বা, কথা শিখেছ তো বেশ।’ বলিয়া ডাক্তারবাবু বলিলেন, যেখানে খুশি সেইখানে যাও। তোমার স্থান আর আমার এখানে নেই।’

কথাটাকে পরিহাস মনে করিয়া তেওয়ারি দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কাষ্ঠ হাসি হাসিতেছিল, ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘না, হাসি নয়।’ বলিয়া চাবি দিয়া ড্রয়ার খুলিয়া দশটাকার পাঁচখানি নোট বাহির করিয়া টেবিলের উপর নামাইয়া দিয়া বলিলেন, ‘যাও। যতদিন না তোমার চাকরি বাকরি জোটে ততদিন এই দিয়ে চালিয়ো। কাল থেকে তোমায় যেন আর আমি এখানে দেখতে না পাই। বুঝলে?’

অতগুলো টাকার মায়া ত্যাগ করা বড় সহজ কথা নয়। নোটগুলো হাত বাড়াইয়া লইবার সময় তেওয়ারির চোখ দুইটা জলে ভরিয়া আসিল।

ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘দাঁড়াও।’

বলিয়াই তিনি সদানন্দর মুখের পানে তাকাইলেন।—’ডাক তোমার স্ত্রীকে এইখানে। তেওয়ারি ওঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে যাক।’

লণ্ঠন হাতে লইয়া সদানন্দ নীচে নামিয়া গেল এবং কিয়ৎক্ষণ পরে একাকি ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘কিছুতেই এল না বাবু, খালি খালি কাঁদছে। বললে, ‘বল গিয়ে—আমি যাব না। ওকে আমি ক্ষমা করেছি।’

‘বেশ, তাহলে তাঁকে আর ডেকে কাজ নেই।’ বলিয়া একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া ডাক্তারবাবু তাঁহার সোফার উপর হেলান দিয়া ভালো করিয়া বসিয়া বলিলেন, ‘যাও, তোমরা যাও এখান থেকে।’

ডাক্তারবাবু বই পড়িতে পড়িতে সোফার উপরেই কোনো সময় ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন, শব্দ হইতেই আচমকা তাকাইয়া দেখেন, এক হাতে লণ্ঠন ও এক হাতে খাবারের থালা লইয়া বেচারা আরতি বড় বিব্রত হইয়া পড়িয়াছে।

কতদিন পরে সে আজ তাঁহার খাবার লইয়া উপরে আসিয়াছে। ডাক্তারবাবু ঘুমাইয়া থাকিবার ভান করিয়া সোফার উপর শুইয়া শুইয়াই দেখিতে লাগিলেন, অত্যন্ত সন্তর্পণে থালা নামাইয়া, লণ্ঠন নামাইয়া, হাত ধুইয়া আরতি আসন বিছাইয়া, কুঁজো হইতে জল গড়াইতে বসিল। জল গড়ানোর বক বক শব্দ হইতেই সে জিভ কাটিয়া পিছন ফিরিয়া তাকাইয়া দেখিল, ডাক্তারবাবুর ঘুম ভাঙিয়া গেল কিনা। কিন্তু জাগিয়া যে ঘুমায় তাহার ঘুম সহজে ভাঙে না। জলের গ্লাসটি ধীরে ধীরে নামাইয়া দিয়া আরতি উঠিয়া দাঁড়াইল। ভাবিল, এইবার সে দরজার কাছে গিয়া দুমদাম করিয়া খুব জোরে খানিকটা শব্দ করিয়া তাঁহাকে জাগাইয়া দিয়া ছুটিয়া পালাইবে।—লণ্ঠনটি হাতে লইয়া পা টিপিয়া টিপিয়া সে কী তাহার পলাইবার ভঙ্গি!

ডাক্তারবাবু আর না হাসিয়া থাকিতে পারিলেন না। হাসিতে হাসিতে উঠিয়া বসিতেই সহসা অপ্রস্তুত হইয়া গিয়া আরতি টেবিলের এপাশে একেবারে তাঁহার মুখোমুখি থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।

ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘চোর চোর বলে যদি ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে উঠতাম?’

আরতি হাসিল। বলিল, ‘আপনি মিথ্যাবাদী হতেন, কেউ বিশ্বাস করত না।’

ডাক্তারবাবু হাসিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তেওয়ারি চলে গেছে?’

লজ্জায় আরতির মুখখানা কেমন যেন হইয়া গেল। ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হ্যাঁ।’

‘কাল যে ডাকতে পাঠালাম, এলে না?’

আরতিকে এই তাঁহার প্রথম ‘তুমি’ সম্বোধন। হয়তো বা ভুলিয়াই বলিয়াছেন।

আরতি তাঁহার মুখের পানে একবার তাকাইল। বলিল, ‘যাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, ফিরে আসতে তার লজ্জা করে।’

‘তাড়িয়ে তো দিইনি।’

‘তাহলে আপনি মিথ্যাবাদী।’

বলিয়া একটি চঞ্চল বালিকার মতো চোখে—মুখে সলজ্জ একটুখানি মধুর হাসি হাসিয়া আরতি সেখান হইতে ছুটিয়া পলাইল।

ডাক্তারবাবুর চোখের সুমুখে যেন হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকিয়া গেল। চিৎকার করিয়া ডাকিয়া উঠিলেন—

‘শোনো আরতি! শোনো!’

আরতির পদশব্দ তখন সিঁড়ির নীচে মিলাইয়া গেছে। তাঁহার নিজেরই কণ্ঠস্বর সেই নিস্তব্ধ নিশীথে সেই নির্জন কক্ষের মধ্যে তাঁহার নিজেরই বুকের উপর আবার যেন ফিরিয়া আসিয়া ধক করিয়া বাজিল। এ আহ্বান যদি আর কেহ শুনিতে পায়! ছি, ছি, নিজের দুর্বলতায় নিজেই তিনি নিরতিশয় লজ্জিত হইয়া উঠিলেন।

শহর হইতে ফিরিয়া আসিয়া ডাক্তারবাবু প্রত্যহই লক্ষ করেন, ঘরের জিনিসপত্র তাঁহার আবার ঠিক আগেকার মতোই গোছালো হইয়া উঠিয়াছে। হাতের কাছে কোনও জিনিসের প্রয়োজন হইলে তাহা তিনি ঠিক হাতের কাছেই পান, কোনও কিছুর জন্য তাঁহাকে আর ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতে হয় না।

কে যে এসব ঠিক করিয়া রাখে তাহা তিনি জানেন। একবারটি তাহাকে দেখিবার জন্য, তাহার সঙ্গে কথা বলিবার জন্য মন তাঁহার মাঝে মাঝে বিদ্রোহী হইয়া ওঠে, কিন্তু তাহার দেখা মেলা ভার! অলক্ষে থাকিয়াই সে তাঁহার কাজকর্ম করিয়া যায়।

আরতি আর ডাক্তারবাবুর চোখের সুমুখে কোনোদিনই আসে না। যদি বা কোনোদিন হঠাৎ হয়তো সিঁড়ির বাঁকে, কিংবা হয়তো ঘরের কোণে চোখাচোখি হইয়া যায়, তো সে ছুটিয়া তৎক্ষণাৎ সেখান হইতে পলায়ন করে।

ডাক্তারবাবু সেদিন তাঁহার পকেট হইতে রুমাল বাহির করিতে গিয়া দেখেন, রুমালের কোণে তাঁহার নামের প্রথম ইংরেজি অক্ষরটি রঙিন সূতা দিয়া লিখিয়া রাখা হইয়াছে, শার্টের প্রায় অধিকাংশ বোতাম ছিঁড়িয়া গিয়াছিল, দেখেন, সেগুলো আবার নূতন করিয়া কে যেন বসাইয়া রাখিয়াছে।

মন্দ লাগে না। কিন্তু কোথায় যেন কিসের গ্লানি তাঁহার বুকের ভিতর কাঁটার মতো খচ খচ করিয়া বিঁধিতে থাকে।

মনে হয়, কিসের এ দুর্বলতা। যাহাকে তিনি এতদিন জয় করিয়া আসিয়াছেন, আজ যদি আবার তাহারই কাছে পরাজয় স্বীকার করিতে হয় তবে তাঁহার লজ্জার আর বাকি থাকিবে না।

গ্রামের ললিত মুখুজ্যে এখনও আসে। তবে তাহার কম্পাউন্ডারির আশা সে এখন একেবারেই পরিত্যাগ করিয়াছে।

রোগী দেখিবার আগে প্রত্যহ সকালে ডাক্তারবাবু নীচের যে ঘরখানায় আসিয়া বসেন, দেখেন, তাহারই এককোণে একটি চেয়ারের উপর মুখুজ্জ্যে চুপ করিয়া বসিয়া চা খাইতেছে।

ডাক্তারবাবুকে দেখিবামাত্র একগাল হাসিয়া জিজ্ঞাসা করে, ‘কি রকম? ভূতের ভয়—টয় আর—’

ঘাড় নাড়িয়া ঈষৎ হাসিয়া ডাক্তারবাবু বলেন, ‘না।’

কিন্তু এই ‘না’ বলা মুখুজ্যের ভালো লাগে না। এত বড় ভূতুড়ে বাড়ি—অন্ধকার নামিলে তাহার ত্রিসীমানায় মানুষ আসিতে পারে না—সেই বাড়িতে দিবারাত্রি যাহারা বাস করিতেছে, তাহারা এতটুকু ভয় পায় না—সে কথা সে বিশ্বাস করে কেমন করিয়া! ভূত তো এ বাড়ির আনাচে—কানাচে আছেই, তাহার উপর গোবিন্দ চাকরটা মরিয়াছে। ভয় ইহারা নিশ্চয়ই পায়—লোকের কাছে বলে না।

সে যাই হোক, ডাক্তারবাবু তেওয়ারিকে তাড়াইয়া দিয়াছেন, এবং তাহার জন্য ডাক্তারবাবুর নামে যে অপবাদ সে সর্বত্র প্রচার করিয়া বেড়াইতেছে, সে কথা ডাক্তারবাবুকে বলা প্রয়োজন। কিন্তু কথাটা সে কোনও প্রকারেই তাঁহাকে জানাইতে পারিতেছিল না।

অবশেষে ডাক্তারবাবু নিজেই তাহার ব্যবস্থা করিলেন। বোধ করি কথা খুঁজিয়া পাইতেছিলেন না, তাই মুখুজ্যেকে তিনি একসময় হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া বসিলেন, ‘আচ্ছা, আপনাদের গ্রামের লোক সদানন্দকে কিছু বলে না—আমার এখানে এসে থাকবার জন্যে? আমি তো ক্রিশ্চান।’

‘হ্যাঁ, বলে না আবার!’ বলিয়া চায়ের পেয়ালাটা হাত হইতে নামাইয়া মুখুজ্যে বলিল, ‘সেদিন তো এক মজলিশ ডাকিয়ে গ্রামের লোক ওকে পতিত করে দিয়েছে, শোনেননি সে কথা?’

‘তাই নাকি?’—ডাক্তারবাবু একটুখানি চিন্তিত হইয়া পড়িলেন।

মুখুজ্যে থামিল না। বলিল, ‘তেওয়ারিকে আপনার ছাড়িয়ে দেওয়া উচিত হয়নি। সে আপনার ভারী নিন্দে করে বেড়াচ্ছে।’

ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি রকম?’

‘না। সে আর আপনার শুনে কাজ নেই। কানে আঙুল দিতে হয়।’

এই বলিয়া ললিত মুখুজ্যে না বলিবার ভান করিয়া পকেট হইতে একটি বিড়ি বাহির করিয়া দিয়াশালাই দিয়া জ্বালাইয়া নির্বিকার চিত্তে তাহাই সে টানিতে লাগিল।

জানিবার আগ্রহ হওয়া ডাক্তারবাবুর স্বাভাবিক। জিজ্ঞাসা করিলেন—’বলুন না, বলতে দোষ কি?’

মুখুজ্যে একমুখ ধোঁয়া ছাড়িয়া এদিক—ওদিক তাকাইয়া চাপা গলায় বলিল, ‘হারামজাদা বলে কিনা—সদানন্দ এবার ডাক্তারবাবুর বাড়িতেই চিরকাল রয়ে গেল।’—’কেন?’ বলে, ‘জানো না কি? ডাক্তারবাবু বিয়ে—থা করেননি, আর ওর ছোট বৌটিও দেখতে—শুনতে বেশ। দুজনের আজকাল…’

ডাক্তারবাবু উদগ্রীব হইয়া শুনিতেছিলেন। হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, ‘থাক।’

মুখুজ্যে চুপ করিয়া নেবানো বিড়িটা আবার ধরাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল।

ডাক্তারবাবুর মুখখানা তখন রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং কিছু না বলিয়াই তিনি দ্রুতপদে রুগি দেখিবার ঘরের দিকে চলিয়া গেলেন।

সেদিনও তাঁহাকে শহরে যাইতে হইয়াছিল।

ফিরিতে রাত্রি হইল। উপরে উঠিবার আগেই তিনি সিঁড়ির কাছ হইতে ডাকিলেন, ‘সদানন্দ!’

সদানন্দ তাড়াতাড়ি কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, ‘আজ্ঞে!’

‘এস আমার সঙ্গে।’ বলিয়া সদানন্দকে তিনি সঙ্গে করিয়া উপরের ঘরে লইয়া আসিলেন। বললেন, ‘সদানন্দ বসো।’

কোথায় বা বসিবে! একটা চেয়ারের গায়ে হাত দিয়া পিছনে দাঁড়াইয়া বলিল, ‘বসুন, আমি বেশ আছি।’

ডাক্তারবাবু কি যে বলিবেন বুঝিতে পারিতেছিলেন না। একবার জানালার কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন। একবার ঘরের মাঝখানে আসিলেন, একবার এদিকে গেলেন, একবার ওদিকে গেলেন, এবং শেষে প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে সোফার কাছে আসিয়া তেমনি দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়াই বলিলেন, আচ্ছা সদানন্দ, এই যে ‘কলিয়ারি’ রয়েছে, এখানে একটি চাকরি পাওয়া যায় না?’

সদানন্দ কথাটা ভালো বুঝিতে পারিল না; বলিল, ‘আজ্ঞে কিসের চাকরি?’

ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘তোমার।’

সদানন্দ সত্যই ভীত হইয়া উঠিল। বলিল, ‘কেন হুজুর, আমায় কি আপনি ছাড়িয়ে দেবেন?’

অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে চোখ বুজিয়া তিনি ঘাড় নাড়িলেন, ‘হ্যাঁ।’

বলিয়াই একটুখানি থামিয়া তিনি আবার আরম্ভ করিলেন, ‘গ্রামেও তোমার ঘর—বাড়ি আছে, সেইখানেই এখন তোমার স্ত্রীদের—’

বাধা দিয়া সদানন্দ বলিয়া উঠিল, ‘চালে যে খড় নেই হুজুর, নইলে আর এখানে এলাম কেন?’

ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘খড়? কত টাকার খড় লাগবে?’

‘তা আজ্ঞে পনেরো কুড়ি টাকার।—কিন্তু আমি…আমি কি হুজুরের কাছে দোষ—অপরাধ কিছু…’

বলিতে বলিতে গলাটা তাহার ধরিয়া আসিল।

ডাক্তারবাবুও কথা বলিতে পারিতেছিলেন না। জোর করিয়া ঘাড় নাড়িয়া ‘না’ বলিয়া তিনি তাঁহার পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া দেরাজটা খুলিলেন এবং দশটাকার দশখানা নোট হাতে লইয়া সদানন্দের হাতের কাছে বাড়াইয়া ধরিয়া বলিলেন, ‘ধর।’

কম্পিত হস্তে সদানন্দ তাহা গ্রহণ করিল।

ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘চাকরি যতদিন না পাও, টাকার দরকার হলেই আমার কাছে নিয়ে যেও।’

এই বলিয়া ডাক্তারবাবু সেখানে আর অপেক্ষা করিলেন না, কাপড়—জামা ছাড়িবার জন্য পাশের ঘরে চলিয়া গেলেন।

পরদিন সকালে রোগী দেখা শেষ করিয়া ডাক্তারবাবু উপরে উঠিয়া যাইতেছেন, সিঁড়ির পাশে দাঁড়াইয়া গোকুল জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনার খাবার?’

অন্যমনস্কের মতো ডাক্তার বলিলেন, ‘হুঁ, কি বললি?’

গোকুল আবার জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনার খাবার কি এক্ষুনি আনব?

খাবার কোথায় পেলি? সদানন্দ যায়নি?’

বলিতে বলিতে তিনি তাঁহার ঘরে আসিয়া ঢুকিলেন।

গোকুলও পিছু পিছু আসিয়া বলিল, ‘রাত থাকতে উঠে রান্না করে দিয়ে গেছে। ও—বেলা থেকে আমায় রান্না করতে বলে গেছে।’

ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুই জানিস রাঁধতে?’

সলজ্জ একটুখানি হাসিয়া গোকুল বলিল, ‘জানি।’

বলিয়াই হঠাৎ তাহার কি মনে হইল, বলিল, ‘যাবার সময় সদানন্দর ছোট বৌটা খুব কাঁদছিল।’

‘কেন?’

গোকুল বলিল, ‘সদানন্দ একটা ছড়ি দিয়ে তাকে এমন মার মারলে—!’

ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন বল দেখি?’

গোকুল বলিল, ‘জিজ্ঞেস করলাম, তা কিছুতেই বললে না। মারলে তাই দেখলাম।’

ডাক্তারবাবু স্নানের ঘরে চলিয়া যাইতেছিলেন, গোকুল আবার জিজ্ঞাসা করিল, ‘আনব খাবার?’

ডাক্তারবাবু ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, ‘না।’

সাজ—পোশাক পরিয়া না খাইয়াই তিনি শহরে চলিয়া যাইতেছিলেন, ভাবিলেন, অন্যায় হইবে, চাকরেরাও হয় তো তাহা হইলে নানাপ্রকার সন্দেহ করিতে পারে, অথচ খাইবার ইচ্ছা তাঁহার একেবারেই নাই। ডাকিলেন, ‘গোকুল!’

‘আজ্ঞে!’

‘নিয়ে আয় খাবার।’

ভূতুড়ে বাড়ি আবার খাঁ খাঁ করিতে থাকে।

গোকুল ও রাম—বিরিজ—দুজনকেই সব কাজ করিতে হয়। দিনের বেলা গোকুল হয়ত রান্না করে, রাম—বিরিজ ঝাঁটা হাতে লইয়া উপরের ঘর পরিস্কার করিতে যায়। কিন্তু সন্ধ্যার পর, তাহাদের আর ছাড়াছাড়ি হয় না। ঘরের বাহির হইতে হইলে একজন আর একজনের গা ঘেঁষিয়া ঘেঁষিয়া চলে।

ডাক্তারবাবু কোনোদিন শহরে যান, কোনোদিন যান না। কোনোদিন খান, কোনোদিন—বা না খাইয়াই ঘুমাইয়া পড়েন। গোকুল কিংবা রামবিরিজ ডাকিয়া তুলিতে গেলে বলেন, ‘শরীর ভালো নেই।’

ঘর—দোর আবার তেমনি অপরিষ্কার অগোছাল হইতে আরম্ভ করিয়াছে। আগে যদি বা বলিতেন, এখন আর কাহাকেও কিছু বলিবার প্রবৃত্তি নাই—কোনোরকমে দিন চলিয়া যাওয়া মাত্র।

সকালে ললিত মুখুজ্যে আসে। সেদিন আসিয়া বলিল, ‘বড় ভালো কাজ করেছেন মশাই, তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে।’

‘কাদের?’

মুখুজ্যে হাসিয়া বলিল, ‘কাদের আবার? সদানন্দকে আর ওর সেই ছুঁড়ি বৌটাকে। বেশ করেছেন।’

ডাক্তারবাবু চুপ করিয়া রহিলেন।

মুখুজ্যে বলিল, ‘শুনলাম না কি শ’পাঁচেক টাকাও দিয়েছেন ওদের। তা বেশ করেছেন। আপনার মতো বড় একটা জেন্টোমেন্টো মানুষ—আমরা যে কথা কইতে পাই এই যথেষ্ট—নিজের মানটা তো বাঁচাতে হবে। বেশ করেছেন।’

ডাক্তারবাবু এবার উঠিতে যাইতেছিলেন, মুখুজ্যে আবার বলিল, ‘শুনেছেন, তেওয়ারির সঙ্গে গিয়ে আবার মিলেছে ব্যাটা! দুজনেই চাকরি পেয়েছে এক জায়গায়। কলিয়ারিতে বেশ রয়েছে দুজনে। বৌটাকেও নিয়ে গিয়েছে সেইখানে।’

ডাক্তারবাবু এবার সত্যই উঠিলেন। বলিলেন, ‘আসি। আমার একটু কাজ আছে।’

কাজ কিন্তু সত্যই ছিল না। দোতলায় উঠিয়া গিয়া তাঁহার সেই ঘরখানির পাশে ছোট যে বারান্দাটুকু ছিল, তাহারই উপর একটি ‘ডেক—চেয়ারে’ তিনি শুইয়া পড়িলেন। সম্মুখে উন্মুক্ত পল্লি প্রান্তর। বহুদূরে কয়লাকুঠির একটা চিমনি দেখা যাইতেছে। তাহারই ধোঁয়ায় আকাশটা যেন কালো হইয়া গিয়াছে। একদৃষ্টে তিনি সেইদিক পানে তাকাইয়া রহিলেন। চৈত্র মাস। রিক্তপত্র বৃক্ষশাখায় বসিয়া একটা কাক ডাকিতেছে। বাহিরে রৌদ্র ইহারই মধ্যে প্রচণ্ড হইয়া উঠিয়াছে। সম্মুখে রৌদ্র—দগ্ধ অসমতল প্রান্তর, দূরে একটা পুকুরের পাড়ে কতগুলো তালের গাছ, মাথা তুলিয়া যেন আকাশ স্পর্শ করিতে চায়। দিগন্ত—বিস্তৃত ওই বন্ধ্যা প্রান্তরের মতোই তাঁহার বুকের ভিতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকিতে লাগিল। ডাক্তারবাবু একবার উঠিয়া দাঁড়াইলেন। একবার ঘরের ভিতর খানিকটা পায়চারি করিয়া আসিলেন। কিন্তু কিছুই যেন তাঁহার আজ ভালো লাগে না। সামান্য একটি নারীর জন্য আজ যে তাঁহার এই অবস্থা—সে কথা কোনো প্রকারেই তিনি বিশ্বাস করিতে পারিলেন না। মনে হইল, ইহাই হয় তো তাঁহার বার্ধক্যের লক্ষণ। এবং সেই জন্যই বুঝি এই ঔদাসীন্য তাঁহাকে ধীরে ধীরে ধরিয়া বলিতেছে। ইহাকে জয় করিতে হইবে।

শহরে সেদিন কোনও কাজ ছিল না, তবু তিনি শহরে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া গোকুলকে ডাকিয়া খাবার দিতে বলিলেন।

দিন দুই পরে ডাক্তারবাবু হঠাৎ সেদিন একটা স্বপ্ন দেখিলেন। সকালে উঠিয়া মনটা তাঁহার কেমন যেন ভারী ভারী বোধ হইতে লাগিল। সারারাত্রি ধরিয়া তিনি স্বপ্ন দেখিয়াছেন। স্বপ্নটা আবছা আবছা তাঁহার মনে আছে। মনে আছে—আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে। কোথায় যেন কোন পার্বত্য প্রদেশে গিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। চারিদিকে ছোট ছোট পাহাড়, শালের জঙ্গল, ফুলের গাছ এবং তাহারই মাঝখানে অনেকগুলি পাতার কুটির। তাহারই একটিতে যেন তিনি বাস করিতেছেন। দূরে একটি ছোট্ট নদী হইতে তাহাদের জল আনিতে হয়। তখন বর্ষাকাল। পরিপূর্ণতার শেষ রেখা পর্যন্ত নদী তখন ভরিয়া উঠিয়াছে। তাহারই সেই আত্মহারা উদ্দাম চঞ্চল স্রোতের মাঝখানে হঠাৎ একটি মেয়ে সেদিন জল লইতে আসিয়া ভাসিয়া গেল। ডাক্তারবাবু তাহাকে উদ্ধার করিবার জন্য জলে ঝাঁপ দিলেন। বহুক্ষণ দুজনে সাঁতার কাটিয়া ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া যখন তীরে উঠিলেন, দেখিলেন, মেয়েটি আর কেহ নয়—’আরতি।—’তুমি এখানে?’ মৃদু হাসিয়া আরতি বলিল, ‘তোমারই জন্যে।’ আরতি হাঁটিতে পারিতেছিল না। ডাক্তারবাবু তাহাকে বুকের উপর তুলিয়া ধরিয়া তাঁহার সেই পাতার কুটিরে লইয়া আসিয়া বলিলেন, ‘তোমায় আর যেতে দেব না কিন্তু।’ আরতি বলিল, ‘লোকে কি বলবে?’ ডাক্তারবাবু তাহাকে বুকে জড়াইয়া ধরিলেন, বলিলেন, ‘বলুক।’

স্বপ্নে যেন তিনি আরও কি কি দেখিয়াছিলেন, কিন্তু সেসব কথা তাঁহার আর মনে নাই। শুধু মনে হইল, আরতির স্পর্শ যেন এখনও তাঁহার সর্বাঙ্গে লাগিয়া আছে।

অথচ ইহা অন্যায়, ইহা অপরাধ, ইহা পাপ!

সারাদিন ধরিয়া এই স্বপ্নের কথা সেদিন তিনি তাঁহার মন হইতে মুছিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। প্রতিজ্ঞা করিলেন, কোনও দুর্বলতাকেই আর তিনি মনে তাঁহার স্থান দিবেন না। তাঁহাকে শক্ত হইতে হইবে।

কিন্তু পরদিন আবার…

আবার সেই স্বপ্ন!

এবার আর সে পার্বত্য প্রদেশে নয়। এবার মনে হইল যেন কোনো শহরের একটা প্রকাণ্ড বাড়িতে দাস—দাসী পরিবৃত হইয়া বৃহৎ একটি পরিবারের মধ্যে আরতি বাস করিতেছে। তিনি যেন সেই শহরের ডাক্তার। রোগী দেখিতে গিয়া দেখিলেন, রোগশয্যায় আরতি শুইয়া আছে, বিছানার উপর ছটফট করিতে করিতে বলিতেছে, ‘আমায় বাঁচাও।’

প্রভাতে সেদিন শয্যাত্যাগ করিয়া মনটা তাঁহার খারাপ হইয়া গেল। মশারির ভিতরেই চুপ করিয়া খানিকক্ষণ বসিয়া রহিলেন। ক্রমাগত মনে হইতে লাগিল—তাহার সেই আর্ত চিৎকার এখনও যেন তাঁহার কানে আসিয়া বাজিতেছে—’আমাকে বাঁচাও! আমায় বাঁচাও!’

কেমন আছে কে জানে! হইতেও পারে বা হয়তো তাহার অসুখ করিয়াছে।

কিন্তু সে যাই হোক, পরদিন তিনি রাত্রে আর কিছু খাইলেন না। ভাবিলেন, উপবাস দিলে হয়ত তিনি এ স্বপ্নের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইতে পারিবেন। শুইবার আগে হাত—পা মুখ—চোখ ভালো করিয়া ধুইয়া ফেলিলেন। শয়নের পূর্বে দেবতার নাম স্মরণ করিয়া চোখ বুজিতেই কখন যে তিনি ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন বুঝিতেও পারেন নাই।

সকালে উঠিলেন। সেরাত্রে তাঁহার ঘুম হইয়াছে চমৎকার। অনেক করিয়া স্মরণ করিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু স্বপ্ন সেদিন তিনি দেখিয়াছেন বলিয়া মনে হইল না।

ডাক্তারবাবু একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিলেন।

পাঁচদিন তিনি আর কোনো স্বপ্ন দেখেন নাই।

কিন্তু এই পাঁচটি দিন ধরিয়া সমস্ত কাজকর্মের মধ্যে তিনি শুধু সেই স্বপ্নের কথাই ভাবিয়াছেন। ভাবিয়াছেন, মনে তাঁহার কোনও সুখ নাই, শান্তি নাই, বিশ্রাম নাই—তীব্র তাপিত মরুভূমির মতো সমস্ত অন্তঃকরণ তাঁহার যেন শুধু এক অতৃপ্ত পিপাসার আকণ্ঠ জ্বালা লইয়া দিবারাত্রি জলিয়া পুড়িয়া খাক হইয়া যাইতেছে।

মনে হইল, স্বপ্নে যেন তাঁহার সুখ ছিল, শান্তি ছিল, তৃপ্তি ছিল। নীরব নিস্তব্ধ নির্জন নিশীথে, লোকচক্ষুর অগোচরে একান্ত সন্তর্পণে যে গোপন অভিসারিকা নিঃশব্দ পদক্ষেপে তাঁহার নিদ্রিত মনোরাজ্যে প্রবেশ করিয়া তাঁহারই অবচেতন অন্তস্থলের কোন গভীর গুপ্ত প্রদেশে এতটুকু একটি মৃদু করস্পর্শ রাখিয়া চলিয়া যাইত, এমন করিয়া তাহাকে চিরনির্বাসিত করিবার কি প্রয়োজন যে তাঁহার ছিল, কে জানে!

আবার তাহাকে তিনি তেমনি করিয়াই ফিরিয়া পাইতে চান।

স্বপ্নে আবার তিনি তাহাকেই দেখিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন।

কিন্তু স্বপ্ন যেন আর কিছুতেই আসে না। মনে হয়, অভিমান করিয়া সে অভিমানী যেন তাঁহাকে ছাড়িয়া চিরদিনের জন্য পলায়ন করিয়াছে।

উপবাস দিয়া, শয়নের পূর্বে স্নান করিয়া অতি কষ্টে যে স্বপ্ন তিনি নিবারণ করিয়াছিলেন, আজ আবার তাহারই প্রতীক্ষায় মন তাঁহার উদগ্রীব হইয়া উঠিল।

রাত্রে আবার তিনি আহার শুরু করিলেন। সকালে রোগী বিদায় করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকেন, কোনো কাজেই তাঁহার গা লাগে না।

শহর হইতে আজকাল সকাল সকাল ফিরিয়া প্রায়ই তিনি দোতলার বারান্দায় গিয়া বসেন। বৈশাখের অপরাহ্ণ। কোনোদিন বা কালবৈশাখীর কালো মেঘ ঘনঘোর করিয়া পশ্চিমের আকাশ ছাইয়া ধীরে ধীরে সমস্ত আকাশটাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে, আবার কোনোদিন বা নির্মেঘ নির্মুক্ত আকাশপ্রান্তে নীলাঞ্জনবর্ণ বনরেখার মাথার উপরে শান্ত সমাহিত সূর্যাস্ত দেখা যায়—বিচিত্র বর্ণে আকাশ রঞ্জিত হইয়া ওঠে, বাতাসে কিসের যেন মাদকতা ভাসিয়া আসে— দেখিতে দেখিতে সন্ধ্যা নামে, আকাশে কৃষ্ণপক্ষের জীর্ণ—প্রান্ত চাঁদ দেখা দেয়—এবং সেই জনশূন্য গৃহের মধ্যে দিগন্ত—প্রসারিত সেই জ্যোৎস্নালোকে বসিয়া ডাক্তারবাবুর বুকের ভিতরটা কেমন যেন তোলপাড় করিতে থাকে,—এই স্নেহহীন বন্ধুহীন বৈচিত্র্যহীন একাকী নিঃসঙ্গ জীবনযাত্রা তাঁহার কাছে ধীরে ধীরে অসহ্য হইয়া ওঠে।

সেদিন এমনি বসিয়া আছেন। রবিবার। সূর্যাস্ত তখনো হয় নাই। চোখের সমুখে কয়লা কুঠির প্রকাণ্ড একটা চিমনির মাথায় ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকাইয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া আকাশ স্পর্শ করিতেছিল। তাহাই তিনি একাগ্র উন্মুখ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। হঠাৎ কোথায় যেন বাতাস বন্ধ হইয়া গিয়া চারিদিক গুমোট করিয়া উঠিল। পশ্চিম আকাশে কালবৈশাখীর কয়েক খণ্ড কালো মেঘ দেখা গেল। হয়তো বা বৃষ্টি নামিবে।

নামুক বৃষ্টি। ডাক্তারবাবু সেখান হইতে নড়িলেন না।

সহসা মনে হইল, মেঘ কাটিয়া গিয়া কোথায় যেন ঝড় উঠিয়াছে। ভীষণ একটা ঝড়ের গর্জন কানে আসিয়া বাজিতে লাগিল। দূর প্রান্তরে ঘূর্ণিবায়ু ঘুরিয়া ঘুরিয়া ঊর্ধ্বে উঠিতেছে। দেখিতে দেখিতে আকাশ—বাতাস সব যেন ধূলায় ধূসর হইয়া গেল। ধূলি—ধূসরিত গাছের পাতা, ধূলাবালি উড়িয়া উড়িয়া গায়ে আসিয়া লাগিল। চোখ চাহিয়া সেখানে আর বসিয়া থাকা যায় না। ডাক্তারবাবু উঠিতে যাইবেন, প্রবল বাতাসের বেগে খড়—কুটার সঙ্গে হঠাৎ একটা সাদা কাগজ উড়িয়া আসিয়া তাঁহার গায়ে লাগিতেই কি যেন কৌতূহল হইল কে জানে, হাত দিয়া সেটা তিনি ধরিয়া ফেলিলেন। দেখিলেন, সাদা একটা কাগজের গায়ে টকটকে খানিকটা কাঁচা রক্ত লাগিয়া আছে। শিহরিয়া উঠিয়া সেটা তিনি নীচে ফেলিয়া দিতে গেলেন, কিন্তু যতবার ফেলিবার চেষ্টা করিলেন, ততবারই সেটা উড়িয়া তাঁহার গায়ে আসিয়া লাগিতে লাগিল।

রাত্রে সেদিন তিনি তাঁহার বহু দিনের বাঞ্ছিত স্বপ্ন আবার দেখিলেন।

দেখিলেন, কোথায় যেন কোন একটা অপরিচিত রাস্তার পাশ দিয়া তিনি ঘোড়ায় চড়িয়া চলিয়াছেন। পথের মাঝে হঠাৎ ঝড় উঠিল। ঘোড়া আর চলিতে পারে না। পথের ধারে ছোট একটা ঘরের দরজায় ঘোড়া থামাইয়া তাড়াতাড়ি আশ্রয় লইবার জন্য সেইখানেই তিনি ঢুকিয়া পড়িলেন। ঘরে ঢুকিয়া দেখেন, আলো জ্বলিতেছে, এবং সেই ক্ষীণালোকিত গৃহের ঠিক মাঝখানে তালপাতার একটা চাটাই বিছাইয়া কতকগুলা লোক মদ খাইয়া হল্লা করিতেছে। তিনি ঘরে ঢুকিতেই হল্লা তাহাদের মুহূর্তের জন্য থামিল। এবং তৎক্ষণাৎ সবিস্ময়ে দেখিলেন, পাশের দরজা দিয়া কৃষ্ণদীপ্ত—নয়না গৌরাঙ্গী কৃশতনু পরমাসুন্দরী এক যুবতী সবুজ রঙের ঘাঘরা ঘুরাইয়া বাসন্তী রঙের ওড়না উড়াইয়া নৃত্যচপল ভঙ্গিতে হেলিয়া—দুলিয়া ঘরে আসিয়া ঢুকিল। আসিবামাত্র কোথা হইতে যেন যাদুবিদ্যার মতো চারিদিকে আলো জ্বলিয়া উঠিল, সঙ্গীত শুরু হইল এবং নূপুরের শব্দে গৃহপ্রাঙ্গণ মুখরিত করিয়া সেই রূপলাবণ্যবতী যুবতী সকলের হাতে হাতে সুরাপাত্র বিতরণ করিতে লাগিল।

মেয়েটি ডাক্তারবাবুর কাছে আসিয়া দাঁড়াইতেই তিনি ঘাড় নাড়িয়া তাঁহার অনিচ্ছা প্রকাশ করিলেন।

চারিদিকে হো হো করিয়া একটি হাসির শব্দ উঠিল।

ডাক্তারবাবু দেখিলেন, মেয়েটি তাহার সুললিত দুই বাহু দিয়া তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিয়া হাসিতেছে। এতক্ষণ ভালো করিয়া তিনি তাহাকে দেখিতে পান নাই; মুখের পানে তাকাইতে লজ্জা করিতেছিল; কিন্তু সেইবার তাহাকে একান্ত সন্নিকটে পাইয়া প্রথমে তাহার সেই অলসবিন্যস্ত বাহুর দিকে, পরে তাহার সেই উৎক্ষিপ্ত বঙ্কিম কণ্ঠরেখার দিকে, পরে তাহার সেই বিস্তৃত পক্ষ প্রদীপ্ত কৃষ্ণ চঞ্চল দুটি চক্ষু—তারকার দিকে নিরতিশয় নিস্তব্ধ একাগ্রতার সহিত বিস্মিত মুগ্ধ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিতে গিয়া সহসা চমকিয়া শিহরিয়া উঠিলেন—’তুমি! তুমি! আরতি! তুমি এখানে?’

আরতি মুখে কোনও কথা বলিল না, ঈষৎ হাসিয়া শুধু সে তাঁহার দুটি আতপ্ত ওষ্ঠপুটে নিজের দুটি সুচারু আরক্তিম ওষ্ঠ চাপিয়া ধরিয়া আনমিত মুখে চক্ষু মুদ্রিত করিল।

সর্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠিতেই ডাক্তারবাবুও চক্ষু মুদ্রিত করিয়াছিলেন।

এমন সময় ভীষণ একটা শব্দে তাঁহার চমক ভাঙিল। দেখিলেন, সর্বনাশ! আরতির মাথার উপর সজোরে একটা বোতল ভাঙিয়া দিয়া কে একটা লোক যেন তাঁহার চোখের সুমুখ দিয়া ছুটিয়া পলাইল। ঘরের মধ্যে হৈ হৈ একটা চিৎকার উঠিল। আরতির মাথাটা কাটিয়া গিয়া রক্তের ফোয়ারায় ডাক্তারবাবুর সর্বাঙ্গ তখন ভিজিয়া যাইতেছে। মর্মভেদী একটা আর্ত চিৎকার করিয়া আরতি তাঁহার হাতের উপরেই লুটাইয়া পড়িল। ডাক্তারবাবু হায় হায় করিয়া উঠিলেন। চারিদিকে লোক জড় হইয়া গেল। সদানন্দ কাঁদিতে কাঁদিতে কোথা হইতে ছুটিয়া আসিল। ডাক্তারবাবু বসিয়া পড়িয়াছিলেন। তাঁহারই কোলে মাথা রাখিয়া আরতি অত্যন্ত কাতরকণ্ঠে কহিল, ‘চললাম। আবার যেন দেখা হয়।’ বলিয়া সে তাহার ঘোলাটে চক্ষু স্থির করিয়া দিয়া তৎক্ষণাৎ মরিয়া গেল।

ডাক্তারবাবু তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিতে লাগিলেন।

কাঁদিতে কাঁদিতেই তাঁহার ঘুম ভাঙিল। জাগিয়া দেখেন, বালিসের উপর মাথা গুঁজিয়া তিনি ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছেন, চোখের জলে বালিশ ভিজিয়া গেছে।

চোখ মুছিয়া তিনি উঠিয়া বসিলেন। বুকের ভিতরটা কেমন যেন করিতে লাগিল।

রোগী সেদিন আসিয়াছিল মাত্র তিনজন, কিন্তু এই তিনজন রোগী বিদায় করিতে সেদিন তিনি ঘণ্টা তিন কাটাইয়া দিলেন। ঘটনাটা ভুলিবার কত চেষ্টাই না তিনি করিলেন, অথচ যত চেষ্টা করেন ততই যেন স্বপ্নটা তাঁহার চোখের সুমুখে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ হইয়া ওঠে। প্রেসক্রিপশন লিখিতে গিয়া রোগীর নাম লিখিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। মনে হইল, যে লোকটা আরতির মাথায় বোতল মারিয়া ছুটিয়া পলাইল, তাহাকে তিনি চিনিতে পরেন নাই, তবে সদানন্দ যে কাঁদিতে কাঁদিতে তাঁহার কাছে ছুটিয়া আসিয়াছিল, সে দৃশ্য তাঁহার মনে আছে।

কলমের মাথাটা দাঁত দিয়া চাপিয়া ধরিয়া ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ মনে পড়িল তিনি প্রেসক্রিপশন লিখিতেছেন। একটা ঔষধের নাম লিখিয়াই তিনি আবার চোখ বুজিয়া রহিলেন।—হিন্দুস্থানী পোশাকে আরতিকে মানাইয়াছিল চমৎকার!

যাই হোক, অনেক কষ্টে অনেক ভাবিয়া রোগী বিদায় করিয়া তিনি উপরে উঠিয়া গেলেন। রাম—বিরিজ স্নানের জল ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল। কলের পুতুলের মতো স্বপ্নের কথা ভাবিতে ভাবিতেই তিনি স্নান করিলেন। গোকুল খাবার দিয়া গেল। কি যে খাইলেন, কি না খাইলেন, বুঝিলেন না। শহরে যাইবার পোশাক পরিতে গিয়া তাঁহার মনে হইল, আজ আর শহরে গিয়া কাজ নাই, তাহার চেয়ে শয্যায় শয়ন করিয়া আর একবার ঘুমাইবার চেষ্টা করিতে দোষ কি!

কিন্তু ঘুম তাঁহার হইল না। শুইয়া শুইয়া কত কথাই না ভাবিতে লাগিলেন।

বেলা তখন প্রায় তিনটা। গোকুল আসিয়া একখানা চিঠি দিয়া জানাইয়া গেল যে, শহর হইতে এই চিঠি লইয়া পেয়াদা আসিয়াছে। দেখিলেন সরকারি চিঠি।—মর্গে একটা ‘লাশ’ আসিয়াছে, ময়না করিবার জন্য এখনই তাঁহাকে যাইতে হইবে।

যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতে হইল। ব্যাগের ভিতর আবশ্যকীয় জিনিসপত্র লইয়া তৎক্ষণাৎ তিনি রওনা হইলেন।

অ্যাসিসটেন্ট সার্জেন, পুলিশের ইন্সপেক্টর, দারোগা, সকলেই উপস্থিত।

ডাক্তারবাবু ‘মর্গে’ গিয়া দেখেন, লম্বা টেবিলের উপর আপাদ মস্তক ঢাকা দেওয়া মৃতদেহ পড়িয়া আছে। মাথার উপর দেওয়ালের গায়ে একটা ছিদ্র পথ অতিক্রম করিয়া অস্তমান সূর্যের সুদীর্ঘ একটি রশ্মিরেখা ঘরের ঠিক মাঝখানে আসিয়া পড়িয়াছে।

ইন্সপেক্টরবাবু বলিলেন, ‘আলো থাকতে থাকতে একটুখানি তাড়াতাড়ি করুন ডাক্তারবাবু।’

কালো রঙের একটা লম্বা জামা গায়ে দিয়া, হাতের আস্তিন গুটাইয়া, ডাক্তারবাবু তাঁহার ব্যাগ হইতে ছুরি বাহির করিলেন। তাহার পর দ্রুতপদে টেবিলের কাছে গিয়া বাঁ হাত দিয়া মৃতদেহের ঢাকা খুলিবামাত্র চোখের সুমুখে ভূত দেখিলে মানুষ যেমন চমকিয়া উঠে, তিনিও তেমনি চমকিয়া উঠিলেন।

‘ওরকম করে উঠলেন যে? ব্যাপার কি?’

ডাক্তারবাবুর মুখ দিয়া কথা বাহির হইতেছিল না, অতি কষ্টে তিনি হাতের ইশারায় সকলকে সেখান হইতে চলিয়া যাইতে বলিলেন।

অ্যাসিসটেন্ট সার্জেন জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আমিও যাব?’

ঘাড় নাড়িয়া ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘হ্যাঁ।’

সকলেই চলিয়া গেল। ডাক্তারবাবু ভিতর হইতে খিল বন্ধ করিয়া দিলেন।

খিল বন্ধ করিয়া মাতালের মতো টলিতে টলিতে তিনি টেবিলের কাছে আসিলেন। একাগ্র দুই ব্যগ্র ব্যাকুল দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বারে বারে তিনি মৃতদেহের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার বিস্ময়ের আর সীমা রহিল না।

আরতির মৃতদেহ!

এখনও তিনি স্বপ্ন দেখিতেছেন কিনা, কে জানে।

স্বপ্ন হোক সত্য হোক—সেই আরতি! সেই মুখ, সেই চোখ, সেই ঠোঁট, সেই দেহ, সেই অপরূপ রূপলাবণ্যবতী সৌন্দর্য প্রতিমা! ডাক্তারবাবু কম্পিত হস্তে তাহাকে স্পর্শ করিলেন, কপালের উপর খানিকটা কাঁচা রক্ত গড়াইয়া আসিয়া শুকাইয়া গিয়াছিল, পকেট হইতে তাহারই হাতের নাম লেখা রুমালটি বাহির করিয়া সযত্নে তাহা মুছাইয়া দিলেন, মুখের উপর হইতে চুলগুলি সরাইয়া দিয়া সেই অম্লান প্রফুল্ল প্রস্ফুটিত শতদলের মতো অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানি দুই হাত দিয়া তুলিয়া ধরিয়া দেখিতে দেখিতে হঠাৎ একসময় তিনি ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন। বাঁচিয়া থাকিতে যাহাকে তিনি তাড়াইয়া দিয়াছিলেন, মরিয়া আজ সে তাহারই কাছে বিদায় লইতে আসিয়াছে।

কিয়ৎক্ষণ পরে দরজার বাহিরে ঠক ঠক করিয়া আওয়াজ হইতে লাগিল। ইন্সপেক্টরবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আর কতক্ষণ?’

ডাক্তারবাবু দেখিলেন, জ্ঞানহীন উন্মাদের মতো তিনি তখন তাহার সেই নিঃসাড় নিস্পন্দ হিমশীতল মৃতদেহ আলিঙ্গন করিয়া তাহারই অনাবৃত নগ্নবক্ষে মাথা রাখিয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছেন।

‘এই যে, হল।’ বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন।—ছুরিখানি তুলিয়া লইতেই এতদিনের অভ্যস্ত হাত তাঁহার থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। এই দেহে আজ তাঁহাকে অতি বড় নিষ্ঠুরের মতো ছুরি চালাইতে হইবে। কিন্তু উপায় নাই। ডাক্তারবাবু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, কালই এ কাজ তিনি পরিত্যাগ করিবেন। এই শেষ। বলিয়া দাঁতে দাঁত চাপিয়া চোখ বুজিয়া তিনি তাহার সেই শুভ্র সুকোমল বক্ষপ্রান্তে হাতের ছুরিখানি আমূল বসাইয়া দিয়া টানিয়া আনিলেন। তাহার পর নিতান্ত নির্মম কসাই—এর মতো কাটিয়া ছিঁড়িয়া মৃতদেহটিকে পরীক্ষা করিতে করিতে হঠাৎ একসময় তাঁহার মাথার ভিতরটা কেমন যেন করিতে লাগিল, সংজ্ঞাহীনের মতো কখন যে তিনি আবার তাহার বুকের উপর লুটাইয়া পড়িয়াছিলেন বুঝিতেও পারেন নাই, বাহিরে আবার করাঘাতের শব্দে তাঁহার জ্ঞান হইল। কাজ তখন তাঁহার শেষ হইয়াছে, আর একবার মুখখানি বেশ ভালো করিয়া চিরজীবনের মতো দেখিয়া লইয়া কাপড় ঢাকা দিয়া দরজা খুলিয়া দিলেন। মাতালের মতো তখনও তিনি টলিতেছিলেন।

হাতমুখ ধুইয়া ডাক্তারবাবু রিপোর্ট লিখিতে গিয়া দেখিলেন, সদানন্দ কাঁদিতে কাঁদিতে তাঁহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।—’তেওয়ারি আমার এই সর্বনাশ করে দিলে বাবু, মেয়েটাকে খুন করে ফেললে।’

ডাক্তারবাবু একবার মুখ তুলিয়া তাকাইয়াও দেখিলেন না, আত্মসমাহিতভাবে নতমুখে বসিয়া রহিলেন।

অ্যাসিসটেন্ট সার্জেনের বয়স বেশি নয়। নাম বিনোদবাবু। রিপোর্টে তাঁহাকেও সহি করিতে হইবে। সদানন্দকে তাড়াইয়া দিয়া তিনিও ডাক্তারবাবুর কাছে আসিয়া বসিলেন।

সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছিল। চাকর আসিয়া টেবিলের উপর আলো দিয়া গেল। রিপোর্ট শেষ করিয়া ডাক্তারবাবু তাহাতে সহি করিতেছিলেন, হঠাৎ তাঁহার বাঁ হাতের আস্তিনের ভিতর দিয়া কাগজের উপর টপ করিয়া একফোঁটা কাঁচা রক্ত গড়াইয়া পড়িল।

বিনোদবাবু সবিস্ময়ে চিৎকার করিয়া উঠিলেন।—’এ কি! রক্ত কোত্থেকে পড়ল? আপনার হাত থেকে? কই— দেখি!’

বলিয়া বিনোদবাবু তাড়াতাড়ি জামাটা তাঁহাকে খুলিয়া ফেলিতে বলিলেন। ডাক্তারবাবু জামা খুলিলেন। দেখা গেল, তাঁহার বাঁ হাতের কনুই—এর উপরে খানিকটা জায়গা কাটিয়া গেছে।

বিনোদবাবু অত্যন্ত বিচলিত হইয়া উঠিলেন। যে ছুরি দিয়া মৃতদেহ কাটা হইয়াছে, সেই ছুরি দিয়া কাটিয়াছে নিশ্চয়ই। এবং সে যে কী ভীষণ ব্যাপার, তাহা ডাক্তারবাবুও জানেন, অথচ তাঁহাকে কিছুমাত্রও বিচলিত হইতে দেখা গেল না। মৃতদেহ কাটিয়া ছিঁড়িয়া হঠাৎ যখন তিনি মূর্ছিত হইয়া পড়িয়াছিলেন সেই সময়েই কাটিয়াছে বোধ হয়। এই কথা ভাবিয়া তিনি একটুখানি হাসিলেন মাত্র। শুধু মনে হইল, কাটিবে তাহা জানা কথা। মনে হইল, মানুষ মাত্র নিয়তির হাতে খেলার পুতুল। প্রত্যেকটি জীবনের প্রতিটি ঘটনা বিধাতা আগে হইতেই সাজাইয়া রাখিয়াছেন।

এমন সময় বিনোদবাবু ছুটিয়া আসিয়া ক্ষতমুখে ঔষধ লাগাইয়া দিলেন এবং ঔষধ লাগাইয়াই ক্ষান্ত হইলেন না। শহরে একজন খুব নামকরা বড় ডাক্তার আছেন, তাঁহাকে ডাকিবার জন্য লোক পাঠাইলেন।

লোক ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘তিনি ‘কলে’ গেছেন।’

বিনোদবাবু তাড়াতাড়ি একখানা চিঠি লিখিয়া ইন্সপেক্টরবাবুর হাতে দিয়া বলিলেন, ‘কল থেকে ফিরে এলেই তাঁকে এই চিঠি দেখিয়ে মোটরে করে যেন ডাক্তারবাবুর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা সেইখানেই চললাম।’

ইন্সপেক্টর চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ব্যাপার কি খুব—’

বিনোদবাবু বলিলেন, ‘বিশ্বাস নেই।’

আবার সেই ভূতুড়ে বাড়ি। সেই নিস্তব্ধ নির্জন পল্লি প্রান্তর। আরতির সঙ্গে এইখানেই তাঁহার প্রথম দেখা।

ডাক্তারবাবুর জ্বর আসিয়াছিল। বিনোদবাবু তাঁহাকে ধরিয়া ধরিয়া উপরে লইয়া গেলেন। বিছানায় শোয়াইয়া দিয়া নীচের ডিসপেনসারি ঘরে গিয়া তিনি তাঁহার ঔষধের ব্যবস্থা করিতে লাগিলেন।

তাড়াতাড়ি একটা ইনজেকশান দিয়া বিনোদবাবু অবার নীচে নামিয়া যাইতেছিলেন, ডাক্তারবাবু তাঁহার হাতখানা চাপিয়া ধরিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘বসুন!’

বিমর্ষমুখে বিনোদবাবু তাঁহার মুখের পানে তাকাইয়া চুপ করিয়া বসিলেন।

ডাক্তারবাবু ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ভয় পেয়েছেন?’

জোর করিয়া বিনোদবাবু ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, ‘না।’

ঠোঁটের ফাঁকে আবার একটুখানি ম্লান হাসি হাসিয়া ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘ভয় পাবার কিছু নেই।’

তাহার পর দুজনেই চুপ। ঘড়ির টিক টিক শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। চারিদিকে কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর নীরবতা বিরাজ করিতে লাগিল।

ডাক্তারবাবু চোখ বুজিয়া কি যেন ভাবিতেছিলেন, সহসা চোখ খুলিয়া বিনোদবাবুর হাতে হাত দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘জীবনের রহস্য কি বুঝেছেন?’

বিনোদবাবু বলিলেন, ‘না।’

ডাক্তারবাবু বলিলেন, ‘চমৎকার!’ বলিলেন, ‘সুমুখের ওই জানালা সব খুলে দিন।’

গোকুল ও রাম—বিরিজ তৎক্ষণাৎ ছুটিয়া গিয়া দরজা জানালা খুলিয়া দিল। উদার উন্মুক্ত নীল আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে, তাহারই অপর্যাপ্ত স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় ঘর ভরিয়া গেল। ডাক্তারবাবু তাঁহার হাত দুইটি বুকের উপর রাখিয়া এক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিলেন।

বাহিরে শাখাজালনিবদ্ধ তরুশ্রেণিতলে মর্মরিত ঘন পল্লবের দীর্ঘশ্বাস, যা এই গৃহের মধ্যে স্তম্ভিত সংযত একটি অবাঞ্ছিত নিঃশব্দতা!

বিনোদবাবু চুপ করিয়া রহিলেন। মনে হইল যেন তাঁহার চোখের সুমুখে শয্যাশায়ী ওই মুমূর্ষু রোগীর অন্তঃকরণ হইতে একটি অব্যক্ত স্তব উত্থিত হয়ে ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বে উঠিতেছে।

কোন মঙ্গলময় রহস্যময় বিশ্বদেবতার চরণে কি যে তাঁহার অন্তিম প্রার্থনা কে জানে, তথাপি বিনোদবাবুর একবার মনে হইল, চোখ চাহিলেই তিনি একবার তাহার আত্মীয় স্বজনের কথা জিজ্ঞাসা করিবেন, এমন সময় ফটকের কাছে মোটর দাঁড়াইবার শব্দ হইল। নিঃশব্দ পদসঞ্চারে বিনোদবাবু লণ্ঠন হাতে লইয়া নীচে নামিয়া গেলেন।

শহরের ডাক্তারবাবু আসিয়াছেন। যাক এখনও সময় আছে।

সিঁড়ির উপর জুতার শব্দ করিয়া কথা কহিতে কহিতে তাঁহারা তিন—চারজনে উপরে উঠিয়া আসিলেন।

কিন্তু তাঁহারা সকলে মিলিয়া ডাক্তারবাবুকে জাগাইতে গিয়া দেখেন তিনি তখন নিস্তব্ধ স্থির মৌন মূক প্রশান্ত গম্ভীর।

তাঁহারা আসিবার পূর্বেই তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *