গোদাবরী
পূণার বাঙালীরা রামকানাইবাবুকে একঘরে করেছে, বারোয়ারি পুজোয় চাঁদা আদায় করা ছাড়া তাঁর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখে না।
বছর দশেক আগে প্রথম যখন আমি পুণায় আসি তখন রামকানাইবাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আমি নবাগত, তিনি একঘরে; দু’জনেই বিকেলবেলা পেশোয়া পার্কে গিয়ে বসতাম। প্রথমে দূরে থেকে পরস্পরের দিকে আড়চোখে তাকাতাম, ধুতি পরার ধরন থেকে দু’জনেই দু’জনকে বাঙালী বলে চিনতে পেরেছিলাম। তারপর আমিই যেচে আলাপ করলাম। তিনি যেন স্বর্গ হাতে পেলেন।
তাঁর চেহারাটা মধ্যমাকৃতি এবং নিরেট গোছের, দেখে মারাঠী বলে মনে হয়। বয়স পঞ্চাশের নীচে; রঙ ফরসা, মুখে বসন্তের দাগ, চোয়ালের হাড় ভারী, মাথার কাঁচা-পাকা চুল এত ছোট করে ছাঁটা যে টেরি কাটা যায় না। প্রথম আলাপের পর রোজই দেখা হতে লাগল। তারপর একদিন তিনি আমাকে নিজের বাড়িতে ধরে নিয়ে গেলেন। বাড়িটি তাঁর নিজস্ব, নতুন তৈরি করিয়েছেনে। ছোটখাটো ছিমছাম বাড়ি, চারিদিকে প্রকাণ্ড বাগান, দেখে ভারি পছন্দ হয়েছিল। এবং বুঝেছিলাম যে রামকানাইবাবু পয়সাওয়ালা লোক।
দার্জিলিঙ চায়ের সহযোগে প্রচুর খাইয়েছিলেন তিনি। বাংলা দেশের মিষ্টি পেয়ে পুলকিত হয়েছিলাম; তখন জানতাম না যে মিষ্টান্নগুলি তাঁর বাড়িতে তৈরি। গোদাবরীকে তখনো দেখিনি। অর্থাৎ—দেখেছিলাম, কিন্তু—
একদিন তিনি আমাকে নৈশ ভোজনের নেমন্তন্ন করলেন। আহারের পর একটু নিষিদ্ধ অনুপানের ব্যবস্থা ছিল। রাত্রি আন্দাজ সাড়ে দশটার সময় রামকানাইবাবু দ্রব্যগুণে মুক্তকণ্ঠ হয়ে পড়লেন, সরলতার প্রবল বন্যায় তাঁর জীবনের কাহিনী বেরিয়ে এল। অসামান্য অভিনবত্ব হয়তো নেই তাঁর কাহিনীতে, কিন্তু শুনে বেশ আমোদ অনুভব করেছিলাম।
তাঁর কাহিনী নীচে লিখছি। —
যৌবনকালে রামকানাইবাবু বোম্বাই এসে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তীক্ষ্ণ বাণিজ্যবুদ্ধির ফলে তিনি অল্পকালের মধ্যে গুজরাতী মহলে আসর জাঁকিয়ে বসলেন। তাঁর ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন, এই সময়ে মহাযুদ্ধ বেধে গেল। তিনি দু’হাতে টাকা লুটতে লাগলেন। মহাযুদ্ধ যখন শেষ হল তখন দেখা গেল তাঁর ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স ফুলে ফেঁপে লাল হয়ে উঠেছে।
কিন্তু ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স যে-পরিমাণে ফাঁপলো, রামকানাইবাবুর শরীর সেই পরিমাণে চুপসে গেল। বোম্বাই-এর যাঁরা বহিরাগত বাসাড়ে তাঁরা জানেন, বম্বে-স্টমাক নামক এক বিচিত্র রোগ আছে; এই রোগ যাকে ধরে তার খেয়ে সুখ নেই, ঘুমিয়ে সুখ নেই, জেগে সুখ নেই; মনটা পাকস্থলীকে কেন্দ্র করে অহর্নিশ ঘুরপাক খেতে থাকে। ডাক্তারেরা তখন মাথা নেড়ে বলেন—যদি প্রাণত্যাগ করতে না চান তো স্থানত্যাগ করুন, এ রোগের ওষুধ নেই। বেশীর ভাগ লোকই স্থানত্যাগ করেন।
মহাযুদ্ধ যখন শেষ হল, তখন রামকানাইবাবুর আয়ের রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেল। তিনি ভাবলেন—দূর ছাই, টাকা তো অনেক রোজগার করেছি, আর বেশী রোজগার না করলেও বাকি জীবনটা সুখে-স্বচ্ছন্দে কেটে যাবে। এখন প্রাণটা রক্ষা দরকার। তিনি এক জ্যোতিষীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।
জ্যোতিষী মহাশয় রামকানাইবাবুর কোষ্ঠী দেখে ভারী খুশি। বললেন—‘আরে বাঃ! এ যে পদে পদে রাজযোগ! রোজগার অনেক করেছেন, আর বেশী হবে না। এখন জীবন উপভোগ করুন। শুক্রের মহাদশা আরম্ভ হচ্ছে, স্ত্রী-সুখ, ভোজন-সুখ, বিশ্রাম-সুখ, সবই আপনি পাবেন।’
রামকানাই জিজ্ঞেস করলেন—‘আর শরীর-সুখ?’
জ্যোতিষী বললেন—‘আপনি কেতুর দশায় শরীর-কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু আর বেশী দিন নয়, শীঘ্রই শরীর নীরোগ হবে।’
রামাকানাই জ্যোতিষীকে দক্ষিণা দিয়ে ফুল্লমুখে ফিরে এলেন।
তাঁর সংসার খুবই সংক্ষিপ্ত, ছেলেপুলে নেই; কেবল তিনি আর তাঁর স্ত্রী। বন্ধ্যা স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ব্যবহারিক ভালবাসা ছিল। মনের দিক দিয়ে খুব যে প্রগাঢ় ঘনিষ্ঠতা ছিল তা নয়, কিন্তু স্ত্রী খুব ভাল রাঁধতে পারতেন, এবং রামকানাই ছিলেন ভোজনবিলাসী। তিনি স্ত্রীকে মাসে একখানি সোনার গহনা কিনে দিতেন। টাকার দাম যেখানে হুহু শব্দে নেমে যাচ্ছে, সেখানে সোনা একমাত্র অচলপ্রতিষ্ঠ বস্তু; রামকানাইবাবু এক ঢিলে দুই পাখি মারতেন, ঘরে সোনাও আসত, গিন্নীও খুশি থাকতেন। খুশি হয়ে গিন্নী তাঁকে নানাবিধ অন্নব্যঞ্জন রান্না করে খাওয়াতেন। দু’জনেই দু’জনের কদর বুঝতেন।
তারপর জ্যোতিষী মহাশয়ের ভবিষ্যদ্বাণী ওলট-পালট করে দিয়ে এক ব্যাপার ঘটল; রামকানাইবাবুর স্ত্রী মাত্র কয়েকদিন জ্বরে ভুগে মারা গেলেন। রামকানাইবাবুর স্ত্রী-সুখ এবং ভোজন-সুখ একসঙ্গে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তিনি হৃদয়ে যত আঘাত পেলেন, তার চেয়ে বেশী আঘাত পেলেন হৃদয়ের নিকটবর্তী অন্য একটা স্থানে। গৃহিণীর রান্না খেয়ে তিনি কোনও মতে পাকস্থলীকে খাড়া রেখেছিলেন, এবার পাকস্থলী জবাব দিল। বম্বে-স্টমাক সংহার মূর্তি ধারণ করল।
রামকানাই গোয়ানীজ বাবুর্চি রাখলেন, কিন্তু তাতে পেটের যন্ত্রণা বেড়ে গেল, অত গরগরে রান্না রোগা পেটে সহ্য হবে কেন? গোয়ানীজকে বরখাস্ত করে তিনি বাংলা দেশ থেকে রাঁধুনী বামুন আনালেন; কিছুদিন মন্দ চলল না। কিন্তু ক্রমাগত থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড় খেয়ে তাঁর অরুচি ধরল; দিনান্তে অন্ন মুখে দিতে পারেন না। বম্বে স্টমাক আসর জাঁকিয়ে বসল। রামকানাইবাবু গৃহিণীর রান্না স্মরণ করে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন।
ডাক্তার এলেন, মাথা নেড়ে বললেন—‘যদি বাঁচতে চান বম্বে ছেড়ে পালান। এখানে থাকলে বাঁচবেন না।’
রামকানাইবাবু কাতরস্বরে বললেন—‘কিন্তু যাব কোথায়। বাংলা দেশে দু’দিন থাকলেই আমার ম্যালেরিয়া ধরে।’
ডাক্তার বললেন—‘কেন, পুণায় যান না। পুণার স্বাস্থ্য খুব ভাল, আপনার বম্বে-স্টমাক সেরে যাবে।’
সুতরাং রামকানাইবাবু পাততাড়ি গুটিয়ে পূণায় এলেন। পুণায় তিনি পূর্বে কখনো আসেননি, তাঁর রেস খেলার নেশা নেই, ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন সম্বন্ধেও তাঁর মন সম্পূর্ণ উদাসীন। কিন্তু পুণায় এসেই জায়গাটা তাঁর ভাল লেগে গেল। তখন হেমন্ত কাল, শীত পড়ি-পড়ি করছে। শুকনো ঠাণ্ডা বাতাসে তাঁর শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠল। তিনি একটি হোটেলে উঠলেন এবং তৎক্ষণাৎ মশালা দোসা এবং দহিবড়া হুকুম দিলেন। এখানকার খাদ্যদ্রব্যের স্বাদই যেন আলদা; আরো সতেজ, আরো মুখরোচক। শুধু তাই নয়, মশালা দোসা এবং দহিবড়া অবিলম্বে হজম হয়ে গেল।
তিন দিন পুণায় থেকে রামকানাইবাবু বুঝলেন, পুণার মতো পুণ্যস্থান আর নেই; তিনি এখানেই ডেরাডাণ্ডা গাড়বেন; কাশী-বৃন্দাবনে যারা যেতে চায় যাক, তাঁর পরম তীর্থ পুণা। কিন্তু হোটেলে কতদিন থাকা যায়। হোটেলের খাবার প্রথম দু’চার দিন মন্দ লাগে না, ক্রমে অসহ্য হয়ে ওঠে। হোটেলের একটি ঘরে আবদ্ধ থাকা কারাবাসের সামিল। অতএব চটপট একটা ব্যবস্থা করা দরকার।
রামকানাইবাবু কর্মতৎপর লোক, তিনি মহা উৎসাহে লেগে গেলেন। পুণার পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে শঙ্কর শেঠ রোড নামে রাস্তা আছে, সেখানে একটু নিরিবিলি দেখে দুই বিঘা মাপের একখণ্ড জমি কিনে ফেললেন। তারপর প্ল্যান তৈরি করিয়ে কপোরেশন থেকে প্ল্যান স্যাংশন করিয়ে কাজ আরম্ভ করে দিলেন। এখানে আসবার পর তাঁর যে দু’চারজন বন্ধু জুটেছিল, তারা বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল— ‘পূণায় বাড়ি ফেঁদেছেন, পাক্কা তিনটি বছর লাগবে। এখানে তিন বছরের কমে বাড়ি হয় না।’
রামকানাইবাবু বললেন—‘দেখা যাক।’
পাঁচ মাস পরে তিনি গৃহপ্রবেশ করলেন। চার-পাঁচখানা ঘর নিয়ে একতলা বাড়ি, তাকে ঘিরে প্রশস্ত বাগান। গৃহপ্রবেশের দিন রামকানাইবাবু নিজের জানা-শোনা বন্ধু-বান্ধবদের নিমন্ত্রণ করে প্রচুর ভূরিভোজন করালেন। পুণায় তাঁর দ্বিতীয় সংসার-যাত্রা আরম্ভ হল।
একলা বাড়িতে থাকেন, সঙ্গী-সাথী নেই। বোম্বাই শহরে তিনি ভাড়াটে বাড়িতে থাকতেন, বাগান ছিল না; এখানে নিজের বাগান তৈরি করা নিয়ে বেশ আনন্দে দিন কাটতে লাগল। একদিন একটি বিলিতি পত্রিকায় দেখলেন, প্রাক্-কম্যুনিস্ট যুগের চীনা ভাষায় প্রবাদ আছে—যদি একদিনের জন্যে সুখী হতে চাও, মদ খাও; যদি একমাসের জন্যে সুখী হতে চাও, বিয়ে করো; আর যদি চিরদিনের জন্যে সুখী হতে চাও তো বাগান করো। প্রবাদটি রামকানাইবাবুর খুব ভাল লাগল। তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে বাগান বানাতে শুরু করে দিলেন। কলকাতা থেকে চালতার চারা, পাতিনেবুর কলম আনালেন; দেওঘর থেকে গোলাপ, দার্জিলিঙ থেকে অর্কিড্। দিনের বেলাটা বাগানের চিন্তায় আনন্দে কেটে যায়। এটি তাঁর জীবনের অন্যতম বিলাস।
একটি বিলাসের কথা আগে বলেছি; তিনি সুরন্ধিত অন্নব্যঞ্জন খেতে ভালবাসতেন, আহারটি মনের মতো না হলে তাঁর জীবনটাই বিস্বাদ হয়ে যেত। যতদিন গিন্নী ছিলেন, ততদিন খাওয়া সম্বন্ধে তাঁর চিন্তা ছিল না, কিন্তু এখন তিনি নির্জনে বসে প্রায়ই গৃহিণীর কথা স্মরণ করে অশ্রু বিসর্জন করেন। ডুমুরের ডালনা, পাব্দা মাছের ঝাল, মুর্গীর রোস্ট তেমন করে কে রাঁধবে?
রামকানাই হাতে-কলমে রন্ধন-বিদ্যা আয়ত্ত না করলেও থিওরিটা ভাল রকম জানতেন। পুণায় এসে তিনি পাঁচটা রাঁধুনী বদল করেছেন, দাঁড়িয়ে থেকে তাদের রান্না শেখাবার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু কেউ কোনও কর্মের নয়, কেবল সম্বর শুখি-ভাজি আর মশালাভাত রাঁধতে জানে; নতুন রান্না শেখালেও শেখে না।
রন্ধন-কর্মটি আসলে একটি শিল্পকর্ম। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, কবিত্ব আর ল্যাজ টেনে বার করা যায় না। যার হবার, তার হয়। রন্ধন-পটুত্বও তাই। চন্দনং ন বনে বনে। রামকানাইবাবু একটি প্রতিভাবান রাঁধুনী খুঁজছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না।
রামকানাইবাবুর আর-একটি নেশার কথা এখনো বলা হয়নি, সেটি হচ্ছে তবলা। যদিও ওস্তাদ তবল্চি নন, তবু মোটের ওপর তিনি ভালই বাজাতে পারেন। তাঁর একজোড়া ডুগি-তবলা আছে; কলকাতা থেকে বটতলার ছাপা তবলা শিক্ষার বইও আনিয়েছেন। রোজ সন্ধ্যের পর বাঁয়া-তবলা নিয়ে বসেন। তাঁর শ্রোতা নেই, একলা বসে বসে বাজিয়ে যান আর অস্ফুটকণ্ঠে তবলার বোল আবৃত্তি করেন—
ধিনাগ্ ধা ধিনাগ্ ধা ধিনাগ্ ধিনাগ্ ধা ধা ধা—
এইভাবে পুণার নতুন বাড়িতে তাঁর দিন কাটছে। দু’জন মালী রেখেছেন, তাদের নিয়ে সকাল বিকেল বাগানের পরিচর্যা করেন। তাঁর বাড়ির দুই মাইলের মধ্যে কোনও বাঙালীর বাস নেই, তাই তাঁর বাড়িতে বন্ধু-সমাগম বড় একটা হয় না। সন্ধ্যের পর তিনি বাঁয়া-তবলা নিয়ে বসেন। কিন্তু তাঁর চিত্তে সুখ নেই; আহারের কথা মনে হলেই তাঁর মন খারাপ হয়ে যায়। ভাপা ইলিশ মাছ, ইঁচড়ের ডালনা, পুঁইশাক আর কুচো চিংড়ির চচ্চড়ি-স্মরণ হলেই তাঁর চক্ষু এবং রসনা যুগপৎ জলপূর্ণ হয়ে ওঠে।
একদিন বিকেলবেলা বাগানের কাজকর্ম সেরে রামকানাইবাবু বাড়ির সামনের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেছিলেন। আজ তাঁর মন বড় খারাপ; যে রাঁধুনী-চাকরটি মাসখানেক কাজ করছিল, সে আজ সকালে মাইনে পেয়ে দুপুরবেলা উধাও হয়েছে। আজকাল চাকর-বামুনদের পাখ্না গজিয়েছে, সর্বদাই উড়ু উড়ু করছে; বেশীদিন তাদের এক জায়গায় ধরে রাখা যায় না। আজ রাত্রিটা রামকানাইবাবুকে হাত পুড়িয়ে বেঁধে খেতে হবে। কিংবা হোটেলে গিয়ে খেয়ে এলে কেমন হয়? বাড়ির কাছাকাছি হোটেল নেই। লস্করে—অর্থাৎ ক্যান্টনমেন্টে—গেলে ভাল আমিষ হোটেল পাওয়া যায়। হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে নিলে মন্দ হয় না—
ফটক দিয়ে একজন নিম্নশ্রেণীর বুড়ো গোছের লোক ঢুকল, তার সঙ্গে একটি দশ-বারো বছরের মেয়ে। এ দেশে নিম্নশ্রেণীর লোক সাধারণত ‘মারাঠা’ নামে পরিচিত; এরা মহারাষ্ট্র দেশের ‘মাটির সন্তান’। এরা চাষবাস করে, কুলিকাবাড়ির কাজ করে, সৈন্যদলে যোগ দেয়—এরাই দেশের মেরুদণ্ড। বৃদ্ধ লোকটি রামকানাইবাবুর কাছে এসে প্রশ্ন করল—‘ঘাটি মনুষ্য পাইজে?’ অর্থাৎ চাকর চাই?
রামকানাইবাবু মারাঠা ভাষা বোঝেন ও বলতে পারেন। তিনি বৃদ্ধের পাকানো চেহারার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—‘রাঁধতে পারিস?’
বৃদ্ধ বলল—‘আমার নাতনী গোদাবরীবাঈ রাঁধতে জানে।’ এই বলে পাশের মেয়েটার দিকে চোখ নামালো।
মেয়েটাকে রামকানাইবাবু এতক্ষণ ভাল করে চেয়ে দেখেননি। নিতান্তই ছেলেমানুষ মেয়েটা; কৈশোরে পদার্পণ করেছে কিনা সন্দেহ। কাছা দিয়ে কাপড় পরা অপরিণত শ্যামল দেহটিতে কিন্তু বেশ শ্ৰী আছে, ‘যৌবনে কুক্কুরী ধন্যা’ জাতীয় অস্থির লাবণ্য নয়, সহজাত বলিষ্ঠ শ্রী। চোখে-মুখে উৎসুক বুদ্ধির ছাপ রয়েছে, মনে হয়, সে স্বভাবতই নিপুণ ও কর্মতৎপর।
রামকানাইবাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন—‘তুই কি কি রাঁধতে পারিস?’
গোদাবরীর চোখ দুটি চকচক করে উঠল, সে বলল—‘যা বলবে, সব রাঁধতে পারি।’
রামকানাইবাবু বললেন—‘মারাঠী রান্না ছাড়া আর কিছু রাঁধতে জানিস?’
গোদাবরী বলল—‘না। কিন্তু শিখিয়ে দিলে পারি।’
মেয়েটার আত্মপ্রত্যয় রামকানাইবাবুর ভাল লাগল। তিনি গোদাবরীর ঠাকুর্দা মারুতিকে বললেন—‘বয়স কম, পারবে কিনা জানি না; তবু চেষ্টা করে দেখব।’ তারপর গোদাবরীর চাকরির শর্ত ঠিক হল : বারো টাকা মাইনে, দু’বেলা খেতে পাবে; হোলি আর দেয়ালির সময় কাপড় পাবে; রোজ সূর্যোদয়ের আগে আসবে, সারাদিন কাজকর্ম করবে, তারপর রাত্তিরের রান্নাবান্না সারা হলে নিজের খাবার নিয়ে ঘরে চলে যাবে।
শর্ত পাকা হলে রামকানাই গোদাবরীকে বললেন—‘তবে আজ থেকেই কাজ শুরু করে দে। আজ বেশী কিছু রাঁধতে হবে না; জোয়ারের ভাকড়ি, আমটি, কথ্বেলের চাটনি আর মাটন। বেশী ঝাল দিবি না। কাল থেকে বাংলা-রান্না শেখাব। আয়, তোকে রান্নাঘর দেখিয়ে দিই।’
মারুতি সামনের বারান্দায় উপু হয়ে বসে রইল, রামকানাই গোদাবরীকে রান্নাঘরে নিয়ে গেলেন। রান্নাঘরটি আকারে বেশ বড়, একাধারে রান্নাঘর এবং ভাঁড়ার ঘর; তার পাশে টেবিল-পাতা খাবার ঘর। গোদাবরী সব দেখে শুনে নিয়ে চটপট কাজ আরম্ভ করে দিল।
রামকানাই বসবার ঘরে গিয়ে মেঝেয় মাদুর পাতলেন, তার ওপর ডুগি-তবলা রাখলেন, একটা কাচের গেলাসে ফিকে হুইস্কি তৈরি করে ডুগি-তবলার সামনে বসলেন; একটি কাঠের হাতুড়ি দিয়ে যন্ত্র বাঁধতে বাঁধতে ভাবলেন—মেয়েটা চটপটে আছে, কিন্তু বয়স বড় কম। বাড়ির সব কাজ হয়তো পারবে না। যদি রান্নাটা শেখাতে পারি, তাহলে না-হয় অন্য কাজের জন্যে একটা চাকর রাখলেই চলবে।
গেলাসে একটি ছোট্ট চুমুক দিয়ে তিনি চক্ষু অর্ধমুদিত করে বাজাতে আরম্ভ করলেন—
ধিনা ধিন্ তাক্ ধিনা ধিন্—
ঘণ্টাখানেক কেটেছে কি না কেটেছে, রামকানাইবাবু সবেমাত্র হুইস্কির গেলাসে শেষ চুমুক দিয়েছেন, গোদাবরী দোরের কাছে এসে দাঁড়াল, বলল—‘রাও, তোমার খাবার তৈরি।’
রামকানাইবাবু অবাক হয়ে চোখ তুললেন—‘বলিস কিরে! এরি মধ্যে!’
গোদাবরী বলল—‘হো।’
রামকানাই গিয়ে টেবিলে খেতে বসলেন। গোদাবরী পরিবেশন করল। রামকানাই প্রত্যেকটি রান্না চেখে চেখে খেলেন। তাঁর মন খুশি হয়ে উঠল—বাঃ, মেয়েটার রান্নার হাত আছে, ওকে শেখালে শিখবে। তিনি আহার শেষ করে অনেকদিন পরে একটি পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুললেন, বললেন—‘বেশ বেঁধেছিস। তুই এবার তোর খাবার নিয়ে ঘরে যা, তোর ঠাকুর্দা বসে আছে।’
গোদাবরীর মুখে এক ঝলক সার্থকতার হাসি খেলে গেল। সে নিজের খাবার পুঁটুলি বেঁধে নিয়ে ঠাকুর্দার হাত ধরে চলে গেল। রামকানাই তাকে বলে দিলেন—‘ভোরবেলা আসবি। আমি সাড়ে ছ’টার সময় চা খাই।’
পরদিন সূর্যোদয়ের আগে রামকানাই বাগানে বেড়াচ্ছিলেন, গোদাবরী এল। আজ আর তার সঙ্গে মারুতি নেই, একাই এসেছে। সন্ধ্যেবেলা মারুতি আসবে তাকে নিয়ে যাবার জন্যে। তাদের ঘর বেশী দূর নয়, আধ মাইল আন্দাজ হবে, কিন্তু গোদাবরী অন্ধকারে একলা পথ চলতে ভয় পায়।
দশ মিনিটের মধ্যে গোদাবরী স্টোভে চা তৈরি করে রামকানাইবাবুকে ডাকল। চায়ে চুমুক দিয়ে তিনি একটু হাসলেন; মারাঠী চা হয়েছে, কড়া পাঁচনে প্রচুর দুধ আর চিনি। তিনি বললেন—‘চা ভাল হয়নি। বেজায় কড়া হয়েছে।’
গোদাবরী লজ্জা পেয়ে বলল—‘তুমি কেমন চা খাও আমাকে শিখিয়ে দাও, আমি করে দেব।’
‘বিকেলবেলা চা তৈরি করার সময় শিখিয়ে দেব।’
চা খেয়ে রামকানাই বাজার করতে বেরুলেন। অন্যান্য শাকসব্জির সঙ্গে তিনি একটি মোচা পেলেন। মোচা এ দেশে সুলভ সামগ্রী নয়, এদেশের লোক কি করে মোচা রাঁধতে হয় জানে না; তিনি স্থির করলেন মোচার ঘণ্ট দিয়েই গোদাবরীর রান্নার হাতেখড়ি দেবেন। রোজ একটি করে বাংলা রান্না শেখাবেন।
সাতদিন কাটবার পর রামকানাই নিঃসংশয়ে বুঝলেন গোদাবরী একটি নারীরত্ন। রান্নার কথা তাকে একবারের বেশী দু’বার বলতে হয় না, নুন ঝাল টক মিষ্টি যা যা দিতে হয় এবং যতখানি দিতে হয় একবারেই শিখে নেয়। তাছাড়া সারাদিন বাড়িময় যেন চরকিপাক ঘুরে বেড়ায়। এটা ধুচ্ছে ওটা মুছছে, আসবাব ঝাড়ছে, মেঝে ঝাড় দিচ্ছে; শরীরে ক্লান্তি নেই, মুখে হাসিটি লেগে আছে। এক হপ্তা পরে রামকানাইবাবুকে আর কিছু বলতে হয় না, ঘড়ির কাঁটার মতো বাড়ির কাজ চলতে থাকে।
একমাস পরে রামকানাইবাবু গোদাবরীর মাইনে বাড়িয়ে দিলেন, বারো টাকা থেকে পনেরো টাকা। তিনি অবশ্য ব্যবসাদার লোক, মনে মনে যতটা খুশি হয়েছেন মুখে ততটা প্রকাশ করেন না। কিন্তু তাঁর অন্তরের সমস্ত বাৎসল্য স্নেহ গিয়ে পড়েছে এই ছোট্ট মেয়েটার ওপর। শুধু তাই নয়, গোদাবরীর অশেষ বুদ্ধি ও গুণপনার জন্যে তাকে মনে মনে সমীহ করেন। হোক বারো বছরের মেয়ে, এমন মেয়ে কোটিকে গুটিক মিলে।
এইভাবে, রামকানাইবাবুর জীবনে তৃপ্তি ও সন্তোষের ফল্গুধারা বইতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু একটি উদ্বেগ মাঝে মাঝে তাঁর মনের মধ্যে উঁকি মারে, গোগাদাবরী যদি চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যায়! এই রকম উদ্বেগের একটু কারণও ঘটেছিল। একদিন সন্ধ্যেবেলা পরিচিত একটি বাঙালী ভদ্রলোক বেড়াতে এলেন। রামকানাইবাবু সমাদর করে তাঁকে হিঙের কচুরি আর রসবড়া খাওয়ালেন। খেয়ে ভদ্রলোকউচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন—‘এত চমৎকার বাংলা খাবার কোথায় পেলেন?’ রামকানাইবাবু তখন সগর্বে গোদাবরীকে ডেকে দেখালেন,— ‘এই মেয়েটা তৈরি করেছে।’ ভদ্রলোক কৌতূহলী হয়ে গোদাবরী সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন করলেন, তিনিও সরলভাবে উত্তর দিলেন।
দু’তিনদিন পরে আর একটি পরিচিত ভদ্রলোক বেড়াতে এলেন। তিনি গোদাবরীর তৈরি নিমকি ও দরবেশ খেয়ে চমৎকৃত। গোদাবরী সম্বন্ধে তত্ত্বতল্লাস সুলুক সন্ধান নিলেন; সে কত মাইনে পায়, কোথায় থাকে, এই সব।
দিনে দিনে রামকানাইবাবুর অতিথির সংখ্যা বাড়তে লাগল। সকলেই গোদাবরীকে দেখতে চায়, তার তৈরি খাবার খেতে চায়, তার কথা জানতে চায়।
রামকানাই বেশ আনন্দে আছেন; কারণ তিনি যেমন খেতে ভালবাসেন তেমনি খাওয়াতে ভালবাসেন। বুড়ো মারুতি রোজ সন্ধ্যের পর আসে, দেয়ালে ঠেস দিয়ে উপু হয়ে বসে থাকে; গোদাবরীর কাজ সারা হলে তাকে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। একদিন মারুতি গলা খাঁকারি দিয়ে বলল—‘রাও, একজন বাঙালীবাবু কুড়ি টাকা পগার দিয়ে গোদাকে রাখতে চায়।’ এই বলে মারুতি মিটিমিটি চক্ষে রামকানাইবাবুর মুখ দেখতে লাগল।
রামকানাইবাবু চমকে গেলেন, হঠাৎ কথা খুঁজে পেলেন না। কি ভয়ানক ব্যাপার! ভিতরে ভিতরে গোদাবরীকে ভাঙিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা চলছে। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে নীরস কণ্ঠে বললেন—‘গোদাবরী যদি যেতে চায় যাবে।’ তিনি বারান্দা থেকে উঠে গিয়ে তবলা বাজাতে বসলেন। ঘটনাক্রমে সেদিন কোনও বাঙালী বন্ধুর আবির্ভাব হয়নি।
যথাসময় তিনি খেতে বসলেন, গোদাবরী পরিবেশন করল। তিনি মুখ গম্ভীর করে খাচ্ছেন, অন্যদিনের মতো রান্নার দোষগুণ আলোচনা করছেন না। গোদাবরী কয়েকবার তাঁর মুখের দিকে তাকাল; তারপর তাঁর খাওয়া যখন শেষ হয়ে এসেছে তখন সে সহজ গলায় বলল— ‘বুঢ়া বড় লোভী, বাবুরা বেশী পয়সা দিয়ে আমাকে নিতে চায় তাই বুঢ়ার লোভ হয়েছে। আমি কিন্তু যাব না, যে যত টাকাই দিক আমি যাব না।’
রামকানাইবাবুর মুখে সহর্ষ হাসি ফুটে উঠল, তিনি গদ্গদ স্বরে বললেন—‘যাবি না!’ গোদাবরী বলল—‘না, আমি আট বছর বয়স থেকে কাজ করছি, অনেক বাড়িতে কাজ করেছি। তোমার বাড়িতে কাজ করতে আমার ভাল লাগে।’
যেসব বন্ধুরা গোদাবরীকে ভাঙিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা যখন তাকে ভাঙাতে পারলেন না তখন রামকানাইবাবুর ওপর ভীষণ চটে গেলেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কানাকানি করতে লাগলেন, মেয়েটা দেখতে ছোটখাটো হলে কি হবে, মারাঠী মেয়ে তো, মেঘে মেঘে বেলা হয়েছে। নিশ্চয় রামকানাইবাবুর সঙ্গে ইত্যাদি।
কিন্তু ইতিমধ্যে আর একটি ঘটনা ঘটেছিল যার ফলে সন্দিগ্ধ ব্যক্তিদের সন্দেহ আরো বেড়ে গিয়েছিল। মারুতি বুড়ো রোজ সন্ধ্যের পর গোদাবরীকে নিতে আসত, একদিন সে এল না। রামকানাইবাবু রাত্রির আহার সমাধা করে বাগানে বেড়াচ্ছিলেন, মারুতির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করেননি; তিনি দেখলেন গোদাবরী বারবার ঘর বার করছে, কখনো ফটক পর্যন্ত গিয়ে বাইরে উঁকি মেরে দেখছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন—‘কি তুই এখনো ঘুরঘুর করছিস যে! ঘরে যাবি না?
গোদাবরী উদ্বিগ্নস্বরে বলল—‘বুঢ়া এখনো আসেনি রাও। সকালবেলা বলেছিল শরীর ভাল নয়, হয়তো বিছানা নিয়েছে।’
‘তা কী হয়েছে, তুই একাই চলে যা না, তোর ঘর তত বেশী দূর নয়।’
‘না রাও, রাত্তিরে একলা পথ হাঁটতে আমার ভারি ভয় করে। আর একটু দেখি, বুঢ়া যদি না আসে তখন রান্নাঘরে শুয়ে রাত কাটিয়ে দেব।’
আরো আধঘণ্টা কেটে গেল কিন্তু মারুতি এল না। গোদাবরী তখন রান্নাঘরের মেঝেয় মাদুর পেতে শুয়ে পড়ল।
তারপর থেকে রামকানাইবাবুর বাড়িতে গোদাবরীর রাত্রিবাস একরকম কায়েমী হয়ে গেল। বুড়ো রোজ আসে না, যেদিন আসে গোদাবরীকে নিয়ে যায়। বাকি রাত্রিগুলি গোদাবরী রামকানাইবাবুর বাড়িতে ঘুমোয়।
গুজবের যিনি অধিষ্ঠাত্রী উপদেবতা তিনি চুপ করে থাকেন না। পুণায় বাঙালীদের ঘরে ঘরে উত্তেজিত জল্পনা শুরু হয়ে যায়; রামকানাইবাবু যে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছেন এ বিষয়ে কারুর মনে সন্দেহ থাকে না। আশ্চর্য এই যে রামকানাইবাবু এই সব আলাপ-আলোচনার জল্পনা-কল্পনার কিছুই খবর রাখেন না। এমন কি সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে বাঙালী বন্ধুবান্ধবের পদার্পণ যে থেমে গেছে তা তিনি লক্ষ্য করেননি; তিনি তাঁর বাগান তবলা এবং রান্নাবান্নার মধ্যে মগ্ন হয়ে আছেন।
এইভাবে প্রায় চার বছর কেটে গেল।
এখন, মানুষের জীবনে চার বছর খুব কম সময় নয়; যার পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স ছিল সে উনপঞ্চাশে পৌঁছেছে, বারো বছর বয়সের খুকী যোল বছরে পদার্পণ করেছে; কারুর গোঁফ গজিয়েছে; কারুর গোঁফে পাক ধরেছে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে রামকানাইবাবু এই কাল-সঞ্চার কিছুই জানতে পারেননি। তাঁর শরীরে গুরুতর রোগ আর কিছু নেই, বম্বে-স্টমাক বোম্বাই বর্ষার মতো সহ্যাদ্রির ওপারে আটকে গিয়েছে; নানা রঙের দিনগুলি তাঁর হৃদয়ের বাগানে বিচিত্র সুন্দর প্রজাপতির মতো মধুপান করে বেড়াচ্ছে। মনে হয় তাঁর জীবনের এই অকাল বসন্ত কোনও দিন শেষ হবে না।
গোদাবরী মোল বছরে পা দিয়েছে। মেয়েদের পক্ষে যোল বছরে পা দেওয়া সামান্য নয়। কিন্তু গোদাবরী যেন নিজের অজ্ঞাসারেই যোড়শী হয়ে উঠেছে। তার শরীর একটু লম্বা হয়েছে, একটু পরিণত হয়েছে, চোখের দৃষ্টিতে একটু গভীরতা এসেছে। সে নিম্ন শ্রেণীর মেয়ে, কিন্তু তার মন প্রসারশীল; অবস্থান্তরের সঙ্গে সে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। এ ছাড়া সে যেমনটি ছিল এখনো ঠিক তেমনটি আছে।
হঠাৎ একদিন শান্ত রসাস্পদ তপোবনে বিঘ্নরাজের আবির্ভাব হল; নানা রঙের দিনগুলি চৈতালী ঘূর্ণির মুখে উড়ে যাবার উপক্রম করল।
একদিন দুপুরবেলা খেতে বসে রামকানাই লক্ষ্য করলেন গোদাবরীর মুখ ফুলোফুলো, চোখ ছলছল করছে। তার প্রকৃতি স্বভাবতই প্রফুল্ল; কিন্তু আজ তার মুখে কথা নেই, হাসি নেই। রামকানাই জিজ্ঞেস করলেন—‘কিরে গোদা, তোর সর্দি হয়েছে নাকি?’
গোদা উত্তর দিল না, নিঃশব্দে পরিবেশন করে চলল। রামকানাই ভাবলেন, সর্দি হয়েছে, সেরে যাবে। তিনি আর কিছু বললেন না। গোদার যে সর্দি হয়নি, সে লুকিয়ে কেঁদেছে, একথা তিনি তখন জানতে পারলেন না।
সেদিন সন্ধ্যের সময় মারুতি এসে উপু হয়ে বসল, কয়েকবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলল—‘গোদা আর কাজ করতে পারবে না, ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে।’
রামকানাই বজ্রাহতের মতো ক্ষণকাল বসে রইলেন, তারপর চিড়িক্ মেরে বলে উঠলেন—‘কি বললি! কার বিয়ে? কি রকম বিয়ে?’
মারুতি তাঁকে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করল যে পুণা থেকে বিশ কোশ দূরে একটি গ্রামে গোদাবরীর বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হয়ে গেছে, সামনের হপ্তায় বর বিয়ে করতে আসবে।
রামকানাই ভীষণ অস্থির হয়ে বললেন—‘না না না, এ আবার কী হাঙ্গামা! ঐটুকু মেয়ের বিয়ে! হতেই পারে না। যা তুই—পালা—ভাগ।’
মারুতি ভাগলো না, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল—‘রাও, গোদার ষোল বছর বয়স হয়েছে, এখন ওর বিয়ে না দিলে জাত থেকে কেটে দেবে। তা ছাড়া বরের বাপের কাছ থেকে আমি গোদার দাম নিয়েছি তিনশো টাকা। সে ছাড়বে কেন? আমার নামে মামলা করে দেবে।’
রামকানাই গুম হয়ে বসে রইলেন। মারুতি উঠে দাঁড়াল, বলল—‘আজ আমি তোমাকে খবর দিতে এসেছিলাম, কাল বিকেলবেলা এসে গোদাকে নিয়ে যাব।’
সে-রাত্রে আর তবলা বাজানো হল না, রামকানাই উষ্ণ মস্তিষ্কে বাগানে পায়চারি করতে লাগলেন।
রাত্রি ন’টা বেজে যাবার পরও যখন তিনি খেতে এলেন না তখন গোদাবরী বাইরে এসে তাঁকে। ডাকল—‘রাও, খেতে এস, খাবার দিয়েছি।’
রামকানাই হঠাৎ তেরিয়া হয়ে বললেন—‘খাব না আমি, ক্ষিদে নেই।’ বলে নিজের বিছানায় গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন।
গোদাবরী তাঁর পায়ের কাছে এসে বসল, পায়ের ওপর হাত রেখে বলল—‘খাবে চল, সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
রামকানাই ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলেন, আঙুল তুলে বললেন—‘দেখ্ গোদা, তুই যদি আমায় ছেড়ে চলে যাস তাহলে আমিও পুণা ছেড়ে চলে যাব।’
গোদাবরী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, বুজে-যাওয়া গলায় বলল—‘আমি কি করব। আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই না, বিয়ে করতে চাই না, কিন্তু জাতের লোকেরা নানা কথা বলছে—’
কথাটা রামকানাই-এর কানে খোঁচা দিল, তিনি ভ্রূকুটি করে বললেন—‘কি বললি! নানা কথা বলছে! কী কথা বলছে?’
গোদাবরী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল—‘সে তোমার শুনে কি হবে।’ তার মুখের লজ্জা দেখে বোঝা যায় সে আর নেহাত ছেলেমানুষ নয়, জ্ঞানবুদ্ধি হয়েছে।
রামকানাই সিংহবিক্রমে লাফিয়ে খাট থেকে নামলেন, হুঙ্কার ছেড়ে বললেন—‘কী! ছোট মুখে বড় কথা! আমার নামে—আমাদের নামে কলঙ্ক! কে বলেছে একথা? কচাং করে তার মুণ্ডু উড়িয়ে দেব।’
তিনি কিছুক্ষণ দাপাদাপি করলেন, শেষে ক্লান্ত হয়ে বললেন—‘কিন্তু এখন উপায় কি গোদা?’
গোদাবরী বলল—‘উপায় কিছু নেই, বিয়ে আমাকে করতেই হবে—’
রামকানাই আবার গরম হয়ে উঠলেন—‘বিয়ে করতেই হবে! এ কি মগের মুল্লুক নাকি! তুই সাবালক হয়েছিস—’
এই পর্যন্ত বলে তিনি হঠাৎ থেমে গেলেন। তার মাথায় অ্যাটম বোমার মতো একটি প্রচণ্ড আইডিয়া বিস্ফুরিত হল। তিনি কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল চক্ষে চেয়ে থেকে বললেন—‘গোদা!’ তার গলার সব জোর যেন ফুরিয়ে গেছে।
শঙ্কাকম্পিত স্বরে গোদাবরী বলল—‘কি?’
রামকানাই খুব খানিকটা নিশ্বাস টেনে নিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন—‘আমাকে বিয়ে করবি? আমার বয়স হয়েছে, কিন্তু এখনো অনেক দিন বাঁচব। আমার টাকাও আছে অনেক। সব তুই পাবি। করবি আমাকে বিয়ে?’
গোদা খাটের পাশে যেমন বসেছিল তেমনই বসে রইল, তারপর বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। রামকানাই ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললেন—‘অ্যাঁ—তাহলে—তুই তাহলে রাজী নয়।’
গোদা চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল, ধরা-ধরা গলায় বলল—‘আমাকে তাড়িয়ে দিলেও আমি এ বাড়ি নড়ব না। এস।’ সে রামকানাইকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলল।
রামকানাই মহানন্দে তার পিছু নিলেন, বলতে বলতে চললেন—‘এ বাড়ি থেকে তোকে তাড়ায় কার সাধ্যি। ব্যস্, তুই যখন রাজী তখন আর ভয় কাকে। কালই আমি সব ঠিক করে ফেলছি। আর দেরি নয়, বিলম্বে কার্যহানি। খুব খিদে পেয়ে গেছে রে গোদা। এবেলা কি কি রেঁধেছিস বল্ দেখি?
রামকানাই করিৎকর্মা লোক। পরদিন সকালে উঠেই তিনি উকিলের বাড়ি গেলেন। বিকেলবেলা মারুতি গোদাবরীকে নিতে এসে দেখল, পুরোহিত উকিল সাক্ষী সকলের সামনে রামকানাই ও গোদাবরীর বিয়ে হচ্ছে। মহারাষ্ট্র দেশে দিনের বেলা বিয়ে হয়।
বিবাহ ক্রিয়া শেষ হলে রামকানাই মারুতির হাতে এক হাজার টাকা দিয়ে বললেন—‘এই নে গোদাবরীর কন্যা-পণ।’ মারাঠী উকিল মহাশয় রসিদের ওপর মারুতির টিপসই নিলেন। মারুতি এক হাজার টাকা পেয়ে এমন বোকা বনে গেল যে আপত্তির একটি কথাও তার মুখ দিয়ে বেরুলো না।
রামকানাইবাবু সুখে আছেন, গোদাবরী তাঁকে সুখে রেখেছে। কবি গেয়েছেন—রমণীর মন, সহস্র বর্ষের সাধনার ধন। আবার না চাইলেও তাকে পাওয়া যায়। রামকানাইবাবুর জীবনে প্রার্থনীয় আর কিছু নেই। এইভাবে যদি বাকি দিনগুলি কেটে যায়—
ডুগি-তবলা বাজাতে বাজাতে মাঝে মাঝে তাঁর সেই জ্যোতিষীর কথা মনে পড়ে। স্ত্রী-সুখ ভোজন-সুখ বিশ্রাম-সুখ। জ্যোতিষীর কথা মিথ্যে হয়নি।
কেবল পুণার বাঙালীরা রামকানাইকে একঘরে করেছে, ক্রিয়াকর্মে ডাকে না। কিন্তু বাৎসরিক বারোয়ারি চাঁদা তোলার সময় তাঁর কথা তাদের মনে পড়ে যায়।
২ নভেম্বর ১৯৬২