গোড়ার কথা
সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ সাল।
ভোর হওয়ার ঠিক পূর্ব-মুহূর্ত। বিশ্বের সবথেকে পবিত্র দেওয়ালের সামনে ইহুদিরা সমবেত হয়েছে। পাহাড়কাটা, হলদেটে চুনাপাথরের এই দীর্ঘ দেওয়ালটাই ইহুদিদের রাজা হেরড নির্মিত জেরুসালেমের দ্বিতীয় মন্দিরের একমাত্র অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ। হিব্রুতে দেওয়ালকে বলে ‘কোটেল’। এই কোটেল এক সময়ে ছিল রাজা হেরডের তৈরি মন্দিরের বেষ্টনী। আবার রাজা হেরডের দ্বারা নির্মিত মন্দিরটা কিন্তু আদি মন্দির নয়, সেটা কিং সোলোমানের তৈরি মন্দিরের সংস্কারকৃত রূপ। বয়স্ক, তরুণ, রোগা, মোটা, দাড়িওয়ালা ও দাড়িবিহীন — সব ধরনের মানুষ জেরুসালেমের গলিপথ ধরে এই দেওয়ালের কাছে পৌঁছেছিল।
তরুণেরা অফিসের করণিক আর জেরুসালেমের বাইরের পাহাড়ি এলাকা থেকে আসা মেষপালকদের সঙ্গে সগর্বে পায়ে পা মিলিয়ে চলেছিল। শহরের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা হাইফা, তেল আভিভ এবং গ্যালিলি সাগরের আশেপাশের গ্রাম থেকে আসা দোকানিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছিল।
তাদের প্রত্যেকের পোশাক ছিল কালো এবং হাতে ছিল প্রার্থনার বই। সবাই দাঁড়িয়ে ছিল সুউচ্চ দেওয়ালটার সামনে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই বিশেষ দিনটির উদযাপনের পরম্পরা চলে আসছে। কিন্তু এবারে, মানে সেপ্টেম্বর মাসের শুক্রবারের ‘শাপাথ’ ছিল অন্য বারের তুলনায় আলাদা। ইহুদি ধর্মগুরুরা সবাইকে আহ্বান করেছিলেন এই প্রার্থনাতে সামিল হওয়ার জন্য। বলা হয়েছিল যে, ইহুদিদের ঐক্য ও দৃঢ়তা গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দেওয়ার সময় এসে গেছে। আরবরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও ইহুদিরা যে তাদের ভয়ে ভীত নয়— এটা বোঝানোর জন্য এবং জায়নিজমের প্রতি তারা কতখানি দায়বদ্ধ, সেটা প্রকাশ করার জন্যই ছিল এই প্রার্থনা।
কিন্তু কী ছিল এই জমায়েতের প্রেক্ষাপট?
জায়নিজমের প্রসারের বিরুদ্ধে আরবদের ক্ষোভ ক্রমশ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল, আর এই খবর বিগত কয়েক মাস ধরে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯১৭ সালের বেলফোর ডিক্লেয়ারেশনের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনের মধ্যে একটি আলাদা ইহুদি-রাষ্ট্র গঠন করার কথা বলা হয়। ইহুদিদের প্রতি আরবদের ক্ষোভের সূত্রপাত সেখান থেকেই। যে জমিতে তারা তাদের নবি, মহম্মদের সময় থেকে বাস করে আসছিল, সেই জমি তারা ইহুদিদের ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না।
কিন্তু প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশ শাসন চলছিল এবং ব্রিটিশরা কোনো পক্ষকেই ঘাঁটাতে চাইছিল না। তারা দু’ পক্ষকেই তুষ্ট রাখতে চাইছিল। আর এতেই সমস্যা বাড়ছিল। আরব ও ইহুদিদের মধ্যে সংঘাত ক্রমশ বেড়েই চলল। যেখানেই ইহুদিরা উপাসনার জন্য সিনাগগ বানাতে চাইল, সেখানেই দাঙ্গা আর খুনোখুনি শুরু হল। কিন্তু ইহুদিরাও ছাড়বার পাত্র নয়। তারাও জেরুসালেমের ওয়েস্টার্ন ওয়ালের সামনে প্রার্থনা করার অধিকার প্রয়োগ করতে বদ্ধপরিকর। ইহুদিরা এই দেওয়ালটাকে কিং সোলোমানের পবিত্র মন্দিরের অংশ বলেই গণ্য করে। এখানেই নাকি বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের সঙ্গে ঈশ্বরের সাক্ষাৎ হত। ইতিহাস বলছে, আজ যেখানে ১,৬০০ ফুটের দীর্ঘ দেওয়াল, এক সময়ে সেখানেই ছিল ৪,০০০ ফুটের সুদীর্ঘ প্রাচীর। রোমান আক্রমণে তা বিধ্বস্ত হয়। তারপর জেরুসালেমের ওল্ড সিটিকে ঘিরে এই পাঁচিলকে কত বার যে ভাঙা এবং গড়া হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ইহুদি আস্থায় অটুট রয়ে গেছে এই দেওয়াল।
দুপুরবেলা: শেমা প্রেয়ারের সময় ওয়েস্টার্ন ওয়ালের সামনে হাজার হাজার কণ্ঠে প্রার্থনার ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছিল। সমবেত ছন্দের ওঠানামায় তৈরি হয়েছিল এক অনির্বচনীয় পরিবেশ।
আর ঠিক তখনই সমবেত জনতার ওপর ভাঙা বোতল, পাথরভর্তি টিন এসব এসে পড়তে লাগল। আরবরা দেয়ালের আশেপাশে সুবিধাজনক অবস্থান থেকে আক্রমণ চালাচ্ছিল। মুসলিম বন্দুকবাজরা গাদা বন্দুক থেকে গুলি ছুড়ছিল সমানে। ভয়ার্ত ইহুদিরা প্রাণ বাঁচাতে ছুটতে শুরু করে দিল। আশ্চর্যজনকভাবে সেদিন কারও প্রাণহানি হয়নি, যদিও আহতের সংখ্যাটা কম ছিল না।
সেই রাতেই য়িশুভের নেতারা একটি সভা ডাকলেন।
‘য়িশুভ’ কী জিনিস?
ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের আগে জেরুসালেমের পুণ্যভূমিতে বসবাসকারী ইহুদিদের সমিতিকেই ‘য়িশুভ’ বলা হত।
তা কী বললেন য়িশুভের নেতৃবৃন্দ?
একজন নেতা বললেন, ‘আরব-আক্রমণের দিকটা কেউ ভেবে দেখেনি। ভাই সব, আমাদের প্রাচীন ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। রাজা ডেভিডের সময় থেকেই আমরা গুপ্তচরবৃত্তিকে গুরুত্ব দিয়ে আসছি।’
এই দিনই, হ্যাঁ এই দিনই বিশ্বের সবথেকে দুর্ধর্ষ গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ-এর বীজ উপ্ত হয়েছিল। আর তার প্রথম ধাপ ছিল অর্থ জোগাড় করা। কারণ এই অর্থই পরে ব্যবহার করা হবে আরবদের ঘুষ দেওয়ার জন্য— যারা টাকার বিনিময়ে আরবদের আক্রমণের আগাম খবর দেবে।
এদিকে ইহুদিরা ওয়েস্টার্ন ওয়ালের সামনে প্রার্থনা চালিয়ে যেতে থাকল। এই কাজটা তারা হাজার হাজার বছর ধরে করে আসছে। লম্বা কাতারে মানুষ ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর দেওয়াল স্পর্শ করে কাঁদে। কান্নার লাইনে একজনের পালা শেষ হলে পরের জন সুযোগ পায়। ডুকরে কাঁদে, ফুঁপিয়ে কাঁদে। কান্না শেষ করে নিজের পাতলুন কিংবা ঢোলা জামার পকেট থেকে এক খণ্ড কাগজ বের করে ভরে দেয় দেওয়ালের খাঁজে।
কী থাকে তাতে?
ইচ্ছে। ওগুলো ইচ্ছে-লেখা কাগজ।
কাঁদতে কাঁদতে ছুঁয়ে থাকা দেওয়ালটার নাম তাই ওয়েলিং ওয়াল। কথায় বলে না, দেওয়ালেরও কান আছে? এই প্রবাদের উৎপত্তি এখান থেকেই।
যাইহোক, ইহুদিরা তাদের সুরক্ষার জন্য আর ব্রিটিশদের ভরসায় বসে রইল না। তারা তৈরি করল তাদের নিজস্ব সামরিক বাহিনী— ‘হেগানা’। পরের ক’ মাসে আগাম সতর্কবার্তা পাওয়ার ফলে এবং হেগানার মাধ্যমে ইহুদিরা বেশ কয়েকটি আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হল। পরবর্তী পাঁচ বছরে সংঘর্ষ অনেকটাই কমে এল। ইহুদিরা আগে থেকেই আক্রমণের খবর পেয়ে যাচ্ছিল যে!
এদিকে ইহুদিরা অত্যন্ত গোপনে নিজেদের চরবৃত্তি বাড়িয়ে চলেছিল। প্রথম দিকে তাদের এই গুপ্তচর বাহিনীর কিন্তু কোনো নাম ছিল না, ছিল না কোনো নির্দিষ্ট নেতাও। এক একজন আরবকে বেছে বেছে নির্দিষ্ট কাজের জন্য ব্যবহার করা হত। জেরুসালেমের আরব-অধ্যুষিত এলাকায় বসবাসকারী ফেরিওয়ালা, জুতো পালিশের লোকদের মাসিক বেতনের ভিত্তিতে নিয়োগ করা হল। কখনো কখনো ছাত্র, শিক্ষক এবং ব্যবসায়ীদেরও এই কাজে লাগানো হতে থাকল। ধীরে ধীরে এর সুফলও পেল ইহুদিরা। আরবদের গতিবিধির খবর ছাড়াও ইংরেজদের মতিগতির খবরও তারা পাচ্ছিল।
১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানিতে ক্ষমতায় আসার পর জার্মান ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে পালিয়ে আসতে শুরু করে। ১৯৩৬ সালের মধ্যে প্রায় ৩ লক্ষ ইহুদি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে পালিয়ে আসে। তাদের অধিকাংশই সর্বস্বান্ত অবস্থায় জেরুসালেমের পবিত্র ভূমিতে পৌঁছায়। য়িশুভ এদের জন্য কোনো রকমে খাবার ও থাকার জায়গার বন্দোবস্ত করেছিল। কয়েক মাসের মধ্যে ইহুদিদের জনসংখ্যা প্যালেস্টাইনের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশে পরিণত হল। আরবরাও কিন্তু ওদিকে চুপচাপ বসে রইল না। শত শত মসজিদের উঁচু মিনার থেকে কট্টর মুসলমানদের ক্রুদ্ধ চিৎকার ভেসে আসতে থাকল— ইহুদিরা ফেরত যাও, ইহুদিরা ফেরত যাও!
যে জমিগুলো ইহুদিরা আরবদের কাছ থেকে আইনানুগভাবে কিনে নিয়েছিল, সেই জমি আরবরা আবার জবরদখল করতে শুরু করে দেয়, আর এই কাজে ইংরেজরা আরবদের প্রচ্ছন্নভাবে প্ররোচিত করতে থাকে।
ব্রিটিশরা দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপনে উদ্যোগী হলেও সেই প্রয়াস বিফলে গেল। আরবরা বিদ্রোহ ঘোষণা করল। শুরু হল ব্রিটিশ ও ইহুদিদের সঙ্গে আরবদের লড়াই। ব্রিটিশরা শক্ত হাতে সেই বিদ্রোহ দমন করল। তবে ব্রিটিশরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল যে, আরবরা আবার শক্তি সঞ্চয় করে আঘাত হানবে।
এদিকে ইহুদি যুবকরা দলে দলে হেগানাতে যোগ দিতে লাগল। ধীরে ধীরে তারা এক গোপন দুর্ধর্ষ বাহিনীর অঙ্গ হয়ে উঠল। তারা ছিল শারীরিকভাবে অসম্ভব সক্ষম আর ইসরায়েলের নেগেভ মরুভূমির শেয়ালের মতো ধূর্ত। আরব চরদের জাল তত দিনে আরও ছড়িয়ে পড়েছিল। হেগানার পক্ষ থেকে একটি রাজনৈতিক বিভাগ খোলা হল, যার কাজ হল নানারকম গুজব ও প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে আরবদের মধ্যে অশান্তি ছড়ানো।
হিব্রুতে ‘হেগানা’ শব্দের অর্থ হল ‘প্রতিরক্ষা’। হেগানা কিন্তু প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছিল পবিত্র ভূমির শ্রেষ্ঠ প্রতিরক্ষা শক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে অনেকেরই গুপ্তচর হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। এরাই পরবর্তীতে ইসরায়েলি ইন্টেলিজেন্স সংস্থার কিংবদন্তি ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্যালেস্টাইনে এক নতুন অস্বস্তিকর পরিবেশের জন্ম দেয়। নাৎসিরা যুদ্ধে জয়ী হলে তাদের কপালে কী ঘটবে সেটা ভেবে ইহুদি ও আরব দু’ পক্ষই বিশেষ চিন্তিত ছিল। আসলে ইউরোপের ডেথ ক্যাম্পের ঘটনাগুলোর খবর সেখানেও এসে পৌঁছেছিল যে।
১৯৪২ সাল। হাইফা শহরে একটা গুরুত্বপূর্ণ সভা ডাকা হল। সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন ডেভিড বেন গুরিয়ন ও য়িত্জাক রাবিন। এই সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, হলোকাস্টে বেঁচে যাওয়া ইহুদিদের ইসরায়েলের পবিত্র ভূমিতে ফিরিয়ে আনা হবে। এভাবে বেঁচে যাওয়া ইহুদিদের সংখ্যা সম্পর্কে কারো কোনো ধারণা তখন ছিল না। তবে এটা পরিষ্কার ছিল যে, এর ফলে আরবদের সঙ্গে সংঘাত একটা নতুন মাত্রা নেবে। হয়তো ব্রিটিশরাও তাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে। ব্রিটিশদের যুক্তি ছিল— এর ফলে জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হবে।
বেন-গুরিয়ন হেগানার চরবৃত্তির ক্ষমতা আরও বাড়াবার প্রস্তাব দিলেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে সেই প্রস্তাব গৃহীত হল। একটি কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট গঠন করা হল, যার কাজ ছিল যে সমস্ত ইহুদিদের সঙ্গে ব্রিটিশদের দহরম মহরম আছে, তাদের ওপর নজর রাখা। এই ইউনিটের নাম রাখা হল ‘রেকুল হেজদি’। রেকুল হেজদি ইউনিটের প্রধান হলেন একজন ফ্রেঞ্চ ফরেন লিজিনেয়ার। সাধারণ মানুষের চোখে তিনি ছিলেন একজন সাধারণ ট্রাভেলিং সেলসম্যান।
অনেক ইহুদি মহিলা ইংরেজদের সঙ্গে মেলামেশা করত। তাদের দিকে নজর রাখতে আরম্ভ করলেন লিজিনেয়ার। যেসব দোকানদাররা ইংরেজদের মালপত্র সরবরাহ করত এবং এবং যে সমস্ত কাফেতে ইংরেজদের ওঠা-বসা ছিল, তাদের মালিকদের ওপর নজরদারি শুরু হল।
সন্দেহভাজনদের ধরে মাঝরাতে হেগানার সামনে কোর্ট-মার্শালের জন্য আনা হত। দোষীদের শাস্তি হিসাবে হয় নির্দয়ভাবে প্রহার করা হত নয়তো জুডিয়েন পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে মাথার পিছনে গুলি করে হত্যা করে দিত হেগানার সদস্যরা। আজকের মোসাদ যেভাবে ইসরায়েলের শত্রুকে সরিয়ে দেয়, সেই নৃশংসতার প্রাথমিক পরিচয় এখান থেকেই মেলে।
১৯৪৫ সালে হেগানার একটি ইউনিটকে অস্ত্র সংগ্রহ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বললেই তো আর অস্ত্র জোগাড় হয় না রে বাবা!
কিন্তু অস্ত্র এল।
কীভাবে?
উত্তর আফ্রিকাতে মিত্রশক্তির সামনে পরাস্ত হল হিটলারের প্রতিনিধি রোমেল। অনেক জার্মান অস্ত্র আটক করল মিত্রশক্তি। এই মিত্রবাহিনীতে ইহুদি সৈন্যরাও ছিল। তারা সেই অস্ত্রশস্ত্র মিশরের সিনাই মরুভূমির ভেতর দিয়ে প্যালেস্টাইনে পাচার করল। অস্ত্রগুলো লঝঝরে ট্রাকে চাপিয়ে আর উটের পিঠে বোঝাই করে জনহীন মরুভূমির গুহায় এনে রাখা হয়েছিল।
১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে জাপান আত্মসমর্পণ করার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। মিত্রশক্তিতে ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে কাজ করা ইহুদিরা হেগানাতে যোগ দিতে শুরু করল দলে দলে। এভাবেই বেন-গুরিয়নের স্বপ্ন ধীরে ধীরে সাকার হতে শুরু করে। ইসরায়েলের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল।
হলোকাস্ট সারভাইভারদের ইউরোপ থেকে আনা শুরু করে দিল প্যালেস্টাইনের মাটিতে থাকা ইহুদিরা। এই অপারেশনের হিব্রু নাম দেওয়া হল ‘ব্রিচা’। প্রথমে শ’য়ে শ’য়ে ও পরে হাজারে হাজারে মানুষ আসতে থাকল। তাদের অনেকেরই পরনে ছিল কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের পোশাক। প্রত্যেকের শরীরে ছিল নাৎসি ট্যাটু, যাতে শনাক্তকরণ সংখ্যা লেখা থাকত। তারা সড়কপথে বা রেলপথে বাল্কান পেরিয়ে এবং তারপর ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে ইসরায়েলের সৈকতে এসে নামছিল। ইহুদি রিলিফ এজেন্সিগুলো জাহাজ, স্টিমার, নৌকো এই সমস্ত মাধ্যমের সাহায্যেই উদ্ধারকাজ চালাচ্ছিল। এই জাহাজ ও বোটগুলো আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে চড়া দামে কিনতে হয়েছিল; কিছু অবশ্য ভাড়াতেও নেওয়া হয়েছিল। ১৯৪০ সালে ডানকার্ক ইভ্যাকুয়েশনের পর এটাই ছিল এত বড় মাপের ইভ্যাকুয়েশন।
হাইফা ও তেল আভিভের মাঝের সৈকতে অপেক্ষা করছিল ব্রিটিশ সৈন্যরা যাদের মধ্যে ডানকার্ক থেকে লন্ডনে পাঠানো কিছু সৈন্যও ছিল। তাদের নির্দেশ দেওয়া ছিল যেন হলোকাস্ট সারভাইভাররা কোনোভাবেই সেখানে নামতে না পারে। কিন্তু তারা নামল। শুরু হল বিশ্রী ধ্বস্তাধ্বস্তি। কিন্তু একটা সময়ে সম্ভবত ব্রিটিশদের মনে পড়ে গেল নিজেদের ইতিহাস— ডানকার্কের কথা— তারা পথ ছেড়ে দিল।
এদিকে বেন-গুরিয়ন দেখলেন যে, কেবল কারো দয়ার ওপর নির্ভর করে স্বাধীন ইহুদি-রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয় এবং তাঁর এই ভাবনাকে সশক্ত করার জন্য ব্রিটিশ ও আরবদের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ শুরু করে দিল ইহুদিরা।
প্রত্যেক ইহুদি কমান্ডার এই কথা জানত যে, প্রতিটা অপারেশনই অত্যন্ত বিপজ্জনক, কারণ অস্ত্রশস্ত্রের ভাণ্ডার ছিল খুবই সীমিত। ভুল পদক্ষেপ মানে মৃত্যু। ব্যর্থতা মানে মৃত্যু। দু’ পক্ষই এক ভয়ানক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ল। হেগানার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে ইহুদিদের গুলি করে মারা হচ্ছিল। এদিকে ব্রিটিশ সৈন্যরাও মারা পড়ছিল ইহুদিদের হাতে। তাদের সেনানিবাসগুলো বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছিল হেগানার অপারেটিভরা। আরবদের গ্রামগুলোকে তছনছ করে দিতে লাগল হেগানা। মধ্যযুগীয় বর্বরতা যেন আবার ফিরে আসছিল মধ্যপ্রাচ্যে।
এবার হেগানা একটা অসাধারণ চাল চালল। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ফেসবুকের ফেক নিউজ তো রোজ পড়েন, অনেকে খবর যাচাই না করেই ফরোয়ার্ড করে বেকুবও বনে যান। ঠিক এই কৌশল নিয়েই ইহুদিরা ভুয়ো খবর ছড়াতে লাগল।
গুজবে কী বলা হল?
ইহুদিদের সামরিক শক্তি নাকি ব্রিটিশ ও আরবদের তুলনায় অনেক বেশি।
ব্রিটিশ সৈন্যরা শত্রুর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠল। তাদের মনোবল ভাঙতে লাগল। হেগানা ঠিক এটাই তো চেয়েছিল।
১৯৪৬ সালের বসন্তকাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে ব্রিটেনের কাছে অনুরোধ এল ১ লক্ষ হলোকাস্ট সারভাইভরকে প্যালেস্টাইনে জায়গা করে দিতে হবে। তাদের এই অনুরোধ ব্রিটেন নাকচ করে দিল। আর এসব ডামাডোলের মধ্যেই ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটেন প্যালেস্টাইন অধিকার ছেড়ে দেবে বলে জানায়। সিদ্ধান্ত হল যে, ১৯৪৮ সালের মে মাস নাগাদ তারা প্যালেস্টাইন ত্যাগ করবে। আর এরপর প্যালেস্টাইন সমস্যার দেখভাল করবে ইউনাইটেড নেশনস।
অবশেষে ইসরায়েল স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে আত্মপ্রকাশ করল। বেন-গুরিয়ন আর তার কমান্ডাররা জানতেন আরবদের সঙ্গে চলা দীর্ঘকালীন সংঘর্ষের একটা হেস্তনেস্ত করা খুব জরুরি বিষয়। তা নাহলে ইসরায়েল নামে আলাদা দেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হবে। আরবদের সামরিক কার্যকলাপের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য সংগ্রহ করা হতে থাকল।
স্বাধীনতার কয়েক মাস পরেই কায়রো আর আম্মান থেকে ইহুদি গুপ্তচরেরা খবর পাঠাল— মিশর ও জর্ডনের সেনাবাহিনী ইসরায়েল আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরব দেশগুলি সম্মিলিতভাবে ইসরায়েলকে আক্রমণ করল। ইসরায়েলের অস্তিত্ব তখন বিপন্ন। তারা জানত যুদ্ধে পরাজয় মানে ইহুদিরা পৃথিবী থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সব প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে যুদ্ধে জয়ী হল ইসরায়েল। সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে ইসরায়েলের পুনর্জন্ম হল বলতে পারেন।
বেন-গুরিয়ন ছিলেন ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তিনি পাঁচটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস তৈরি করলেন। অল্প দিনের মধ্যেই তারা দেশে এবং দেশের বাইরে অপারেট করতে শুরু করে দিল। দেশের বাইরের চরেরা ব্রিটেন, ফ্রান্স ও
যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষা এজেন্সিগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করল। সব কিছু পরিকল্পনামতোই এগোচ্ছিল। বেন-গুরিয়ন চেয়েছিলেন একটা পরিপূর্ণ ইন্টেলিজেন্স সংস্থা জন্ম নিক, আর সেই স্বপ্নই মূর্ত রূপ ধারণ করছিল। কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন সুখ কোনো মানুষেরই সহ্য হয় না। বাধ সাধল তার নিজের দেশের লোকেরাই। ক্ষমতার লোভ বড় বালাই, আর তখন নেতা, মন্ত্রী ও আধিকারিকদের পেয়ে বসেছিল ক্ষমতার লোভেই। ফলে যা হওয়ার তা-ই হল – কলহ।
ইন্টেলিজেন্স স্ট্র্যাটেজির নেতৃত্ব কে দেবে?
কে তথ্য বিশ্লেষণ করবে?
কে গুপ্তচর নিয়োগ করবে?
রিপোর্ট প্রথমে কার হাতে যাবে?
রাজনৈতিক নেতাদের কাছে কে সমস্ত তথ্যের বিশ্লেষণ করবে?
বলা বাহুল্য, এসব প্রশ্নের উত্তর কারো কাছে ছিল না।
দেশের বাইরে অপারেট করার দায়িত্ব কার হাতে থাকবে তা নিয়ে বিদেশ মন্ত্রক ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের মধ্যে শুরু হল টানাপোড়েন। ওদিকে আরব সন্ত্রাসবাদীদের হাতে রোজ লোক মরছিল। সিরিয়া, মিশর, জর্ডন ও লেবাননের সেনাদল তখনও ইসরায়েলের কাছে বিপজ্জনক। তার ওপরে আবার লক্ষ লক্ষ মৌলবাদী আরব জেহাদের জন্য তৈরি হচ্ছিল। জন্মলগ্ন থেকেই এমন শত্রু- পরিবেষ্টিত দেশ হয়তো পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। আছে কি? আপনারাই বলুন না সুধী পাঠক!
বেন-গুরিয়নকে লোকে মসীহার মতো শ্রদ্ধা করত। ইহুদিরা বিশ্বাস করত যে, মোজেসের মতো বেন-গুরিয়নও বিপদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করবেন। আর বেন-গুরিয়ন জানতেন যে, তিনি কোনো মসীহা নন
সর্বহারা এক জাতির সামান্য এক প্রতিনিধি, যে আরব-শত্রুর হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। এই আরব-শত্রুরা ছিল ইহুদিদের তুলনায় সংখ্যায় প্রায় কুড়ি গুণ। মেষপালক বালক ডেভিডের কথা মনে আছে? ডেভিড আর গোলিয়াথের গল্পের ডেভিডের কথা বলছি বন্ধুরা। মনে পড়ছে সে কীভাবে দানব গোলিয়াথকে পরাজিত করে বধ করেছিল। অগুনতি আরবদের বিরুদ্ধে মুষ্টিমেয় ইহুদিদের জয় আসলে ডেভিড-গোলিয়াথের লড়াইতে ডেভিডের জয়লাভের মতোই একটা মিরাকল, একটি অভাবনীয় ঘটনা।
এদিকে আরবরা নতুন নতুন উপায়ে ইহুদিদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছিল। তারা রাতের বেলায় চোরের মতো হানা দিত। নির্দয়ভাবে ইহুদিদের হত্যা করার পর অন্ধকারে গা-ঢাকা দিত আরব আততায়ীর দল।
২ মার্চ, ১৯৫১। পাঁচটি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির প্রধানদের ডাকা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। বেন গুরিয়ন বিদেশে কাজ করার জন্য Ha Mossad le Teum নামে একটি নতুন এজেন্সির পরিকল্পনা সবার সামনে আনলেন। বললেন, বরাদ্দ হবে ২০ হাজার ইসরায়েলি পাউন্ড। তার মধ্যে ৫ হাজার পাউন্ড বিশেষ অপারেশনের জন্য সংরক্ষিত থাকবে; তবে সেই অর্থের ব্যবহারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নেওয়া হবে বাধ্যতামূলক। এই নতুন এজেন্সিতে পুরোনো এজেন্সিগুলো থেকেই লোক নির্বাচন করা হবে বলে ঠিক হল। প্রাত্যহিক ব্যবহারের সুবিধার জন্য নামটা ছোট করে ফেলা হল— জন্ম নিল মোসাদ।
মোসাদকে রাখা হল বিদেশ মন্ত্রকের আওতায়। অন্যান্য সব ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলোতে মোসাদের একজন করে সিনিয়র অফিসারকে নিযুক্ত করা হল। তাদের কাজ ছিল ক্লায়েন্টের কী প্রয়োজন সেটা সম্পর্কে মোসাদকে অবহিত করা। যে কোনো মতানৈক্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হবে।
মোসাদের প্রথম চিফ হিসাবে নিয়োগ করা হল রিভেন শিলোয়াহকে। তিনি ১৯৫৩ সাল অবধি মোসাদের ডিরেক্টর পদে ছিলেন। বেন-গুরিয়নের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল— ‘মোসাদ আমার অধীনে কাজ করবে, আমার নির্দেশ অনুযায়ী চলবে এবং আমাকেই রিপোর্ট করবে।’ ইত্যবসরে ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শাপাথের সেই রাতের গোপন সভার পর ২৮ বছর কেটে গেছে। এতগুলো বছর পরে এমন একটা ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি ইহুদিরা তৈরি করল, যা পরবর্তীতে হয়ে উঠল পৃথিবীর সবথেকে দুর্ধর্ষ ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি।
মোসাদকে এবার ইরাকে গুপ্তচর চক্র সামলানোর ভার দেওয়া হল। এই কাজটা তার আগে অবধি করে এসেছিল ইসরায়েলি সুরক্ষা বাহিনীর রাজনৈতিক বিভাগ।
কাজটা কী ছিল?
ইরাকি সেনার উচ্চ পদগুলি ব্যবহার করে গোপনে ইরাকি ইহুদিদের ইসরায়েলে নিয়ে আসা।
১৯৫১ সালের মে মাস। মোসাদের বয়স তখন মাত্র কয়েক সপ্তাহ। একটা খারাপ খবর এল ইরাক থেকে। দুজন মোসাদ এজেন্ট এবং মোসাদের হয়ে অর্থের বিনিময়ে খবর দেওয়ার কাজ করা বেশ কিছু ইরাকি ইহুদি ও আরবদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২৮ জনের বিরুদ্ধে চরবৃত্তির অভিযোগ আনল ইরাক। দুজন এজেন্টকেই মৃত্যুদণ্ডের সাজা শোনানো হল। ১৭ জনের আজীবন কারাবাসের সাজা হল। আর বাকিরা ছাড়া পেল। ইরাকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্যুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে মৃত্যুদণ্ডে সাজা শোনানো ওই দুই এজেন্টকে ইরাকের জেল থেকে ছাড়ানো হল।
এরপর আরেকটা দুঃসংবাদ এল এর পরপরই। থিওডোর গ্রস নামের এক এজেন্ট দীর্ঘ দিন ধরে রোমে ইসরায়েলের রাজনৈতিক বিভাগের হয়ে চরবৃত্তি করছিল। ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে প্রমাণ পাওয়া গেল যে, গ্রস ইসরায়েলের সঙ্গে বেইমানি করছে। সে একজন ডাবল এজেন্ট। গ্রস মিশরের হয়েও চরবৃত্তি করছিল। আইজার হ্যারেল তখন শিন বেটের প্রধান। তিনি ছুটলেন রোমে। গ্রসকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ইসরায়েলে ফিরিয়ে আনলেন। তাকে বলা হয়েছিল যে, তাকে শিন বেটে একটি উচ্চ পদ দেওয়া হবে। আসলে তাকে আনা হয়েছিল শাস্তি দেওয়ার জন্য। পাকড়াও করে গোপনে তার বিচার শুরু হল। শাস্তি মিলল ১৫ বছরের জেল। জেলেই গ্রসের মৃত্যু হয়।
এসব ঘটনার ফলে শিলোয়াহ খুব মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি পদত্যাগও করে দিলেন। তাঁর জায়গায় এলেন হ্যারেল। টানা ১১ বছর তিনি মোসাদের চিফ ছিলেন, যেটা আজও রেকর্ড।
হ্যারেলকে দেখে কিন্তু মোসাদের প্রধান কার্যালয়ের কর্মীরা একদমই খুশি হয়নি। সাদামাটা চেহারা, উচ্চতা মাত্র ৪ ফুট ৮ ইঞ্চি। হিব্রু উচ্চারণে ছিল ইউরোপীয় টান। হ্যারেলের পরিবার ১৯৩০ সালে লাটভিয়া থেকে প্যালেস্টাইনে আসে। ভদ্রলোকের জামাকাপড় দেখলে মনে হত যেন এখনই ঘুম থেকে উঠে এলেন। এ হেন মোসাদ চিফকে দেখে কার শ্রদ্ধা-ভক্তি হবে ভাই?
সবাইকে প্রথম সম্বোধনেই তিনি বললেন, ‘ইতিহাসের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা এগোব। একজোট হয়ে কাজ করব। আর হ্যাঁ, এখানে আমার কথাই হবে শেষ কথা!’
হ্যারেল যে নিজের কথায় আর কাজে এক তার প্রমাণ দিলেন পরদিনই। লাঞ্চের পর ড্রাইভারকে ডেকে পাঠালেন। ড্রাইভার বলল, ‘কোথায় যাব সার?’
‘বলা যাবে না,’ কাটা কাটা ভাবে বলে দিলেন হ্যারেল। তারপর তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আর ফিরলেন এক বাক্স ব্যাগেল নিয়ে। পয়েন্ট ক্লিয়ারড। প্রশ্ন করবে একজনই— মিস্টার হ্যারেল! তিনি যা বলতেন, সেটা নিজেও করতেন। মোসাদকে পুনরুজ্জীবিত করে তুললেন হ্যারেল। এই মোসাদ চিফ নিজে গোপনে আরব দেশগুলোতে যেতেন মোসাদের নেটওয়ার্ক বাড়াবার জন্য। যারা মোসাদে যোগ দিতে চাইত, তাদের ইন্টারভিউ তিনিই নিতেন। যারা কিবুটজে বড় হয়েছে তাদেরকেই ফার্স্ট প্রেফারেন্স দিতে হ্যারেল বেশি পছন্দ করতেন। কিন্তু তাঁর এই পছন্দ আবার অনেকেরই অপছন্দ ছিল। একজন
সিনিয়র আধিকারিক তো হ্যারেলের এই পলিসি সম্পর্কে সরাসরি প্রশ্ন তুলে বসলেন। হ্যারেল তখন বললেন, ‘কিবুটজের লোকেরা আরবদের কাছাকাছি থাকে। তাই তারা আরব-শত্রুদের খুব ভালো ভাবে চেনে জানে। আর সে কারণেই আমি ওদের প্রেফার করি।’
হ্যারেলের কথা বলছি, আগে একটু ‘কিবুটজ’ ব্যাপারটাকে বুঝে নেওয়া যাক। হিব্রুর ভাষায় ‘কিবুজ্’ শব্দের অর্থ ‘কম্যুনাল সেটলমেন্ট’। এ হল এমন এক সংস্থা বা সমাজব্যবস্থা, যার উদ্দেশ্য একটি নির্দিষ্ট জাতির মানুষকে সংগঠিত করে একসঙ্গে চাষবাস করা তথা কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি চালানো। যখন ইহুদিরা বিভিন্ন দেশ থেকে প্যালেস্টাইনে আসতে শুরু করে, তখন প্যালেস্টাইনের বেশিরভাগটাই ছিল অনুর্বর মরুভূমি। বেঁচে থাকার তাগিদেই তারা একজোট হয়ে কাজে নেমেছিল।
প্রতিটি কিবুটজে তারা গড়ে তুলেছিল থাকার ঘর, বাগান, বাচ্চাদের জন্য আলাদা ঘর, খেলার মাঠ, কমন ডাইনিং হল, অডিটোরিয়াম, গ্রন্থাগার, হাসপাতাল, সুইমিং পুল ও আরও অনেক কিছু। আর তার পাশেই থাকত খেতখামার, ডেয়ারি, গবাদি পশুপালন কেন্দ্র, কলকারখানা, মাছ চাষের জন্য পুকুর ইত্যাদি।
এই ব্যবস্থায় সবকিছুর মালিকানা থাকে যৌথভাবে সকল সদস্যের নামে। আর প্রত্যেকের থাকে সমান অধিকার। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সমস্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করে।
কিবুটজের ব্যবস্থা হল গণতান্ত্রিক। সব সদস্যদের নিয়ে সাধারণ সভায় পলিসি, বাজেট এরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর দৈনন্দিন কাজ পরিচালনার জন্য কিছু নির্বাচিত সদস্য থাকেন। এখানে বাচ্চাদের পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট ছোট দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে তারা ছোটবেলা থেকেই কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে ওঠে।
প্রথম ‘কিবুটজ্’ ডেগানিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ১৯০৯ সালে। আজ ইসরায়েলে কিবুটজের সংখ্যা প্রায় ২৭০। এক একটি কিবুটজের সদস্য সংখ্যা ৪০ থেকে ১,০০০ বা তারও বেশি। ইসরায়েলি জনতার প্রায় ২.৫% এখনও কিবুটজেই থাকে।
ফিরে আসি হ্যারেল সাহেবের কথায়। তিনি কিন্তু ধর্মীয় ব্যাপারগুলোকে মানতেন না। তাই প্রাচীনপন্থী বা অর্থোডক্স ইহুদিদের ভারী অপছন্দ করতেন। এখানে এই কট্টর ইহুদিদের নিয়ে কিছু শব্দ বলার দরকার আছে বলেই মনে করি।
এদের চালচলন, রীতি-রেওয়াজ ভারী অদ্ভুত! এরা মাথার দু’ ধারের চুল কাটে না। জুলপি বরাবর নেমে আসে লম্বা সাইডলকস্। গোঁড়া জিউসদের মধ্যে মেয়েরা বিয়ের আগের দিন নিজের সব চুল কেটে ফেলে। উইগ পরে তারা বিয়ে করে। এর কারণ, তারা চায় বিয়ের আগে যে চুল সকলে দেখেছে তা স্বামীকে দেখাবে না। নতুন যে চুল বেরোবে, সেটাই স্বামী প্রথম দেখবে। অর্থোডক্স ইহুদিরা সবসময়ে কালো কাপড় পরে। সোলোমানের হুকুমত না ফেরা অবধি শোকে থাকতে চায় যে। বেশ জোরে জোরে হাঁটে। এই জোরে হাঁটার কারণটা শুনলে অবাকই লাগে। তাদের মতে এই দুনিয়ার সকল অ- ইহুদিই গুণাহগার। তাদের স্পর্শদোষ এড়িয়ে চলতে চায় অর্থোডক্সরা। চমকপ্রদ ব্যাপার হল এদের কোনো ট্যাক্সই দিতে হয় না। শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদন করাই এদের কাজ। শুক্রবারের সন্ধ্যার প্রার্থনা থেকে শনিবারের সন্ধ্যার প্রার্থনার সময়টাকে এরা বলে ‘শাপাথ’। আর এই ‘শাপাথ’ পর্বে কিছু অদ্ভুত নিয়ম মানে অর্থোডক্সের দল। যেমন: কোনো ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস ব্যবহার করে না, পারফিউম ব্যবহার করে না। এই সময়ে এরা রান্না করে খায় না, আগে থেকেই রান্না করে রাখে। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের সঙ্গে কোনো কথা বলে না। এমনকী নির্দিষ্ট দূরত্বের বেশি হাঁটাহাঁটিও করে না।
আশা করি, অল্পবিস্তর হলেও অর্থোডক্সদের সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া গেল। তা এই অর্থোডক্স ইহুদিরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দরবার করলেন আইজার হ্যারেলকে মোসাদ চিফের পদ থেকে সরাতে হবে। কিন্তু হ্যারেল নিজের পদে বহাল রইলেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও যে কিবুটজে বড় হয়েছিলেন!
আর হ্যারেল বেশ ভালো কাজও করেছিলেন। মিশরের বিরুদ্ধে সিনাইয়ের যুদ্ধে সাফল্যের পিছনে মোসাদের এজেন্টদের বিরাট অবদান ছিল। আরব লিগের প্রতিটা দেশের রাজধানীতে তাঁর গুপ্তচরেরা ছড়িয়ে ছিল। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সব খবরই ঠিক সময়ে ইসরায়েলে পৌঁছে যেত। ১৯৫৪ সালে তিনি ওয়াশিংটন গেলেন। তার লক্ষ্য ছিল সদ্য সিআইএ-এর ভার গ্রহণ করা অ্যালেন ডুলসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। তিনি ডুলসকে একটা ছুরি উপহার দিলেন। ছুরিটার ওপর খোদাই করা ছিল— ‘ইসরায়েলের রক্ষকেরা কখনো ঘুমোয় না।’
ডুলস্ জবাবে বলেছিলেন, ‘ভরসা করতে পারো, তোমার সঙ্গে আমিও জেগে থাকতে পারি।’
সিআইএ আর মোসাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া তৈরি হল। ডুলস্ মোসাদের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করলেন। ট্র্যাকিং ডিভাইস, রিমোট চালিত ক্যামেরা এবং আরো অনেক কিছু মোসাদের হাতে এল। বস্তুত, এমন অনেক যন্ত্র মোসাদ পেল, যেগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কেই হ্যারেল জানতেন না। দুজনে মিলে একটা ব্যাক চ্যানেল সার্ভিসও চালু করলেন, যাতে জরুরি সময়ে তাঁরা ফোনে যোগাযোগ করতে পারেন।
১৯৬১ সালে হ্যারেল মরক্কোয় থাকা কয়েক হাজার ইহুদিকে ইসরায়েলে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা বানালেন। এক বছর বাদে হ্যারেল সাউথ সুদানে গেলেন বিদ্রোহী ইহুদিদের সাহায্য করার জন্য। ওই বছরই তিনি ইথিয়োপিয়ার রাজা হাইলে সেলাসিকে একটা বিদ্রোহ দমন করতে সাহায্য করেছিলেন। সেলাসি ছিলেন ইসরায়েলের দীর্ঘ দিনের বন্ধু।
এদিকে তাঁর নিজের দেশে অর্থোডক্স ইহুদিরা তাঁকে সরানোর জন্য উঠে- পড়ে লেগেছিল। হ্যারেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি স্বৈরাচারী এবং ইহুদিদের ধর্মীয় অনুভূতির ধার ধারেন না। তিনি নিজে যা ভালো মনে করেন, তা-ই করেন। তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগও ছিল যে, তিনি তলে তলে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ছক কষছেন। আর এখানেই নড়েচড়ে বসলেন বেন-গুরিয়ন। রাজা যে কান দিয়ে দেখেন। একটা সময়ে তিনি হ্যারেলের ওপরই সবকিছু ছেড়ে দিয়েছিলেন। এবার তিনি প্রত্যেকটা অপারেশনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে হ্যারেলের কাছে কৈফিয়ত চাইতে আরম্ভ করলেন। হ্যারেলও আঁচ করলেন যে, কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। তবে তিনি এ ব্যাপারে কারো কাছে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি।
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। একটা সাংঘাতিক ঘটনা ইসরায়েলের গোটা ইহুদি সমাজে আলোড়ন ফেলে দিল। ইয়োসেলি শ্যমাখার নামের এক বালক বিগত দু’ বছর ধরে নিখোঁজ ছিল। সবার ধারণা ছিল— ইয়োসেলিকে আলট্রা- অর্থোডক্স ইহুদিরা অপহরণ করেছে। তার দাদুর নাম ছিল নাহমান স্টাকস। তিনি ছিলেন ‘গার্ডিয়ান অব দ্য ওয়ালস অব জেরুসালেম’ দলের সদস্য। সন্দেহের তির ছিল তাঁর দিকেই। ওই দু’ বছরে পুলিশ অনেক চেষ্টাতেও ইয়োসেলির কোনো খবর পায়নি। তদন্তে অসহযোগিতা করার জন্য নাহমানকে কিছু দিনের জন্য গ্রেফতারও করা হয়েছিল। কিন্তু হিতে বিপরীত ঘটল। রাতারাতি অর্থোডক্স ইহুদিদের কাছে তিনি নায়কে পরিণত হলেন। হাজার হাজার মানুষ ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নামল। ব্যানারে লেখা ছিল— একজন বৃদ্ধকে কয়েদ করার জন্য ধিক্কার! বেন-গুরিয়ন আর নাৎসিদের মধ্যে কোনো ফারাক নেই।’ বৃদ্ধের শারীরিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রতিবাদ ও মিছিল কিন্তু চলতেই থাকল।
বেন-গুরিয়নের রাজনৈতিক পরামর্শদাতারা তাঁকে সতর্ক করলেন যে, এভাবে চলতে থাকলে পরবর্তী নির্বাচনে তাঁর ভরাডুবি নিশ্চিত। আরেকটা বিপদের সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছিল। আরবদের সঙ্গে যদি আবার যুদ্ধ বাধে, আর তাতে যদি অর্থোডক্সরা আরবদের সমর্থন করে? বেন-গুরিয়ন বড় চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি মোসাদকে আদেশ দিলেন, ইয়োসেলিকে খুঁজে বের করো! হ্যারেল প্রথমে এই কাজটা নিতে রাজি হননি। তাঁর মনে হয়েছিল মশা মারতে কামান দাগা হচ্ছে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘দিস ইজ মাই অর্ডার!’
অগত্যা হ্যারেল পুলিশ ফাইল চাইলেন।
বেন-গুরিয়ন বললেন, ‘তোমার হাতে মাত্র এক ঘণ্টা আছে, যা দেখার দেখে নাও।’
ফাইলটা বেশ মোটা। হ্যারেল উলটে পালটে দেখতে লাগলেন। ইয়োসেলির জন্ম ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে। বাবা আর্থার ও মা ইদা শ্যমাখার। পরিবারের আর্থিক সমস্যার কারণে ইয়োসেলিকে জেরুসালেমে তার দাদুর কাছে পাঠানো হয়। ইয়োসেলি সেখানে একটা গোঁড়া ধর্মীয় পরিবেশে বড় হচ্ছিল। ওদিকে ইয়োসেলির বাবা-মা কেউই অর্থোডক্স ছিলেন না। যখনই তাঁরা ইয়োসেলিকে দেখতে জেরুসালেম যেতেন, তখনই তাঁদের পাঁচ-কথা শুনিয়ে দিত ইয়োসেলির দাদু। একদিন এই কটুকাটব্য আর সহ্য করতে না পেরে তারা ইয়োসেলিকে নিজেদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে চলে যাবেন বলে মনস্থির করলেন। রীতিমতো ঝগড়া হয়ে গেল বুড়োর সঙ্গে। ইয়োসেলিকে ছাড়তে রাজি হলেন না ওর দাদু। সে যাত্রায় আর ওকে নিয়ে ফিরতে পারেননি ওর বাবা-মা। পরের বার যখন আবার তাঁরা ইয়োসেলিকে দেখতে গেলেন, তখন ইয়োসেলির টিকিটিরও দেখা মিলল না।
আর এখান থেকেই ঝামেলাটা বড় আকার নিল। গোঁড়া ও ধর্মনিরপেক্ষ এই দুই দলে গোটা দেশ ভাগ হয়ে গেল। ইসরায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটেও এই নিয়ে ঝামেলা শুরু হল। ধর্মনিরপেক্ষরা চাইছিল, ইয়োসেলিকে খুঁজে বের করে তার বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
ফাইল দেখার পর হ্যারেল দ্রুত মোসাদের ৪০ জন সদস্যকে নিয়ে একটা দল গঠন করলেন। ওই দলের অনেকেই আপত্তি তুলেছিলেন যে, এত সামান্য একটা কাজের জন্য এত আয়োজনের কী প্রয়োজন? কারণ মোসাদ সবসময় দুরূহ অপারেশনগুলোই করত। হ্যারেল সবাইকে বোঝালেন যে, এই কাজটিও অন্যান্য অপারেশনের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সরাসরি এর প্রভাব পড়ছে ইসরায়েলের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে। এতে সরকারের কর্তৃত্ব ও মানসম্মানের প্রশ্নও জড়িয়ে আছে। অনুসন্ধান শুরু হল। প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই গোটা দল চমকে উঠল— কারণ তাঁরা কেসটাকে যতখানি সরল ভেবেছিলেন, তা মোটেও ততটা সরল ছিল না।
একজন মোসাদ এজেন্ট আলট্রা অর্থোডক্সদের বলয়ে ঢোকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। অন্য একজন একটা স্কুলের বাইরে নজরদারি চালাচ্ছিল। কয়েক দিনের মধ্যেই সেটা লোক জানাজানি হতেই তাকে পিছু হটতে হল। একজন আবার হাসিডিক কমিউনিটির একটা শবযাত্রার দলের সঙ্গ নিল। সেও ধরা পড়ে গেল। সে আবার এক কেলোর কীর্তি— প্রার্থনার সময় সঠিক মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারেনি।
একের পর এক ব্যর্থতা! আর এই ব্যর্থতাগুলোই হ্যারেলের চোয়াল আরো শক্ত করে দিল। তিনি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, ইয়োসেলি আর ইসরায়েলে নেই; তাকে হয় ইউরোপে বা তার বাইরে কোথাও পাঠানো হয়েছে। তিনি ওই অপারেশনের হেডকোয়ার্টার প্যারিসে স্থানান্তরিত করিয়ে দিলেন। সেখান থেকে হ্যারেল তাঁর লোকেদের ইতালি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের বিভিন্ন জায়গায় পাঠালেন। কিন্তু ওই জায়গাগুলোকেই বাছা হল কেন? কারণ ওই দেশগুলোতেই গোঁড়া ইহুদিরা থাকত। যখন সেখানেও কোনো খবর পাওয়া গেল না, তখন তিনি দক্ষিণ আমেরিকায় এজেন্ট পাঠালেন।
লন্ডনের কাছে-পিঠেই একটা ছোট শহর হেন্ডন। ইয়োসেলির খোঁজে ১০ জন মোসাদ এজেন্ট সেখানকার একটা সিনাগগে শনিবারের প্রার্থনায় হাজির হয়েছিলেন। সেখানকার সমবেত ভক্তদের সন্দেহ হল তাঁদের হাবভাবে। শুরু হল কথা কাটাকাটি, যা সামান্য সময় পরেই ধস্তাধস্তিতে পরিণত হল। এজেন্টদের নকল দাড়ি-গোঁফ খুলে গেল। পুলিশ ডাকা হল এবং ১০ জন এজেন্টই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলেন। সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড! শেষমেষ সেখানে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতের মধ্যস্থতায় তাঁরা ছাড়া পেলেন। এদিকে আরেকটা ঘটনায় আসি। একজন গণ্যমান্য গোঁড়া ইহুদি ধর্মগুরুকে প্যারিসে আমন্ত্রণ করা হল। তাকে জানানো হল যে, এক ধনী পরিবারের খৎনা অনুষ্ঠান উপলক্ষে এই আমন্ত্রণ। তিনি বিমানবন্দরে পৌঁছলে তাঁকে রিসিভ করার জন্য কালো কোট ও অর্থোডক্স ইহুদিদের ট্রেডমার্কড হ্যাট পরা দুজন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। এরা ছিলেন মোসাদের এজেন্ট।
ধর্মগুরু বা রাবাইকে তুলে নিয়ে পিগালেতে একটি বেশ্যালয়ে চলে যান ওই দুই এজেন্ট। দুজন বেশ্যা ধর্মগুরুকে ধরে জাপটাজাপটি করতে থাকে। এই কাজটা করার জন্য আগে থেকেই টাকা দেওয়া হয়েছিল। পোলারয়েড ক্যামেরায় সেই মুহূর্তের ছবিও তোলা হয়। এবার সেই ছবি দেখিয়ে ধর্মগুরুকে ভয় দেখানো হল, যদি ইয়োসেলি কোথায় আছে না বলেন, তাহলে এই ছবি ভাইরাল করে দেওয়া হবে।
ভদ্রলোক অনেক কষ্টে তাদের বোঝালেন যে, ইয়োসেলির ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে এজেন্টরা তাঁর সামনেই ছবিগুলো নষ্ট করলেন।
আরেক জন রাবাইকে মোসাদ এজেন্টরা পাকড়াও করেছিল। তার নাম সাই ফেয়ার। প্যারিস থেকে জেনিভা যাওয়ার পথে ভদ্রলোককে আটক করা হয়। এবারেও এজেন্টদের বিফল হতে হল। তবে ধর্মগুরুকে ছাড়া হয়নি। হ্যারেলের নির্দেশে তাঁকে সুইৎজারল্যান্ডের একটা গোপন ঠিকানায় আটকে রাখা হল। মোসাদ চিফের ভয় ছিল, ওই ভদ্রলোক ছাড়া পেলে কট্টরপন্থীদের মধ্যে একটা শোরগোল তৈরি করতে পারেন।
এরই মধ্যে আর একজনকে পাওয়া গেল, যার জন্য একটু হলেও আশার আলো জেগে উঠল। তিনি ম্যাডেলিন ফ্রেই। ফ্রান্সের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের এই মেয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি অনেক ইহুদি শিশুকে নাৎসি ডেথ ক্যাম্পে যাওয়ার আগে উদ্ধার করেছিলেন। যুদ্ধের পর তিনি ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেন।
ইসরায়েলে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। বেশ কয়েক বার তিনি ইয়োসেলির দাদুর সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। শেষ বার তিনি ইসরায়েল গিয়েছিলেন ঠিক সেই সময়েই, যখন ইয়োসেলি নিখোঁজ হয়ে যায়। এরপর আর তিনি ওমুখো হননি। দুইয়ে দুইয়ে চার যেন মিলে যাচ্ছিল।
মোসাদের এজেন্টরা ফ্রেইকে প্যারিসেরই সীমান্ত-ঘেঁষা একটা এলাকা থেকে খুঁজে বের করল। এজেন্টরা নিজেদের পরিচয় দিলে ক্ষিপ্ত ম্যাডেলিন তাঁদের আক্রমণ করে বসলেন। এজেন্টরা তখন বাধ্য হয়েই হ্যারেলকে সেখানে ডাকলেন।
হ্যারেল এলেন। তিনি বোঝালেন ম্যাডেলিনকে— ‘জোসেলের বাবা-মায়ের সঙ্গে কিন্তু চরম অন্যায় হচ্ছে! প্রত্যেক বাবা-মায়েরই নিজের সন্তানকে তাঁদের ইচ্ছেমতো লালন-পালন করার অধিকার আছে। আর এই অধিকার কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে না।’
ম্যাডেলিন কিন্তু সমানে বলে চললেন, ‘আমি কিস্যু জানি না।’
হ্যারেল দেখলেন যে, তাঁর লোকেরা ম্যাডেলিনের কথা বিশ্বাসও করে নিয়েছে। কিন্তু হ্যারেল বুঝে গিয়েছিলেন ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। তিনিও নাছোড়বান্দা। তিনি ম্যাডেলিনকে বললেন, ‘শো মি ইয়োর পাসপোর্ট।’
পাসপোর্টে ম্যাডেলিনের ছবির নীচে তাঁর এক মেয়ের ছবি লাগানো ছিল। হ্যারেল সেটা দেখেই নির্দেশ দিলেন, ‘কেউ একজন ইয়োসেলির একটা ছবি নিয়ে এসো।’
দুটো ছবির মুখ হুবহু মিলে গেল। এবার আর কোনো সন্দেহ রইল না। তৎক্ষণাৎ হ্যারেল তেল আভিভে ফোন করলেন।
এই ইন্টারোগেশন দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিল। তবে অতি অল্পে বলি, স্বীকারোক্তি ছাড়া ম্যাডেলিনের কাছে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা ছিল না। ম্যাডেলিন এবার নিজের কাহিনি বলতে শুরু করলেন। শিশুকন্যার রূপ ধরিয়ে ইয়োসেলিকে পাচার করা হয়। তাঁরা যখন হাইফার ইমিগ্রেশন অফিসে পৌঁছলেন, তখন মেয়েরূপী ইয়োসেলি তাঁর হাত ধরে ছিল। ইমিগ্রেশন অফিসার বাচ্চাটিকে ম্যাডেলিনের মেয়ে বলেই ভেবেছিলেন। সরকারি কাগজে সেটাই নোট হয়। আর তার এক সপ্তাহ পরেই ইসরায়েলি পুলিশের নাকের ডগার সামনে দিয়ে ম্যাডেলিন ‘মেয়ে’কে নিয়ে জুরিখের বিমানে চেপে বসেন। তার আগে অবশ্য ইয়োসেলির চুলে রঙ করে দেওয়া হয়েছিল, আর তাকে মেয়েদের পোশাক পরানো হয়েছিল।
কিছু দিন ইয়োসেলিকে সুইজারল্যান্ডের একটা অর্থোডক্স স্কুলে রাখা হয়েছিল। ওই স্কুলেই ধর্মগুরু সাই ফ্রেয়ার একজন শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। ফ্রেয়ার পাকড়াও হওয়ার পর ম্যাডেলিন ইয়োসেলিকে নিয়ে নিউ ইয়র্কে চলে আসেন। সেখানে তিনি ইয়োসেলিকে অর্থোডক্স সম্প্রদায়ের এক পরিবারের কাছে রেখে আসেন।
হ্যারেলের শেষ প্রশ্ন ছিল, ‘আপনি আমাকে ওই পরিবারের নাম ও ঠিকানা দিতে পারেন?’
দীর্ঘ স্তব্ধতার পর ম্যাডেলিন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘১২৬ পেন স্ট্রিট, ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক। ওখানে ইয়োসেলির নাম য়াঙ্কালে গার্টনার।’
প্রথম বার হ্যারেলের মুখে হাসি ফুটল, ‘ধন্যবাদ, ম্যাডেলিন! আমি আপনাকে মোসাদের হয়ে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনার মতো প্রতিভা ইসরায়েলের বড় দরকার।’
ম্যাডেলিন এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
মোসাদ এজেন্টরা নিউ ইয়র্ক পৌঁছলেন। সেখানে এফবিআই এজেন্টরা আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডির নির্দেশ ছিল যে, মোসাদ এজেন্টদের সমস্ত রকম সহযোগিতা করতে হবে। বেন- গুরিয়নের কাছ থেকে এর জন্য ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ এসেছিল। এজেন্টরা ১২৬ পেন স্ট্রিটের সেই অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছলেন। গৃহকর্ত্রী দরজা খুললেন। এজেন্টরা তাঁকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। ভেতরে ভদ্রমহিলার স্বামী প্রার্থনা করছিলেন। আর তার পাশে ছিল পাংশুটে চেহারার এক বালক, যার মাথায় ‘য়ামিকা’ টুপি
‘হ্যালো ইয়োসেলি, আমরা তোমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছি,’ এজেন্টরা তাকে মৃদু স্বরে বললেন।
আট মাস ধরে চলা অপারেশেনে ইতি পড়ল। এর পিছনে খরচ হয়ে গিয়েছিল প্রায় এক মিলিয়ন ইউএস ডলার।
ইয়োসেলি নিরাপদে ঘরে ফেরার পরও ইসরায়েলে চলা পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হল না। নেসেটে নির্বাচিত অল্পসংখ্যক কট্টরপন্থী সদস্যদের জন্য সরকার টলোমলো অবস্থায় থাকত, অধিবেশন প্রায় দিনই ভেস্তে যেত।
ইয়োসেলিকে উদ্ধার করে দেশে ফেরার পর হ্যারেলকে জেনারেল মির অমিতের প্রখর সমালোচনার মুখে পড়তে হল।
কে এই মির অমিত?
মিলিটারি ইনটেলিজেন্স সংস্থা আমানের নব নির্বাচিত চিফ। ঠিক যেভাবে হ্যারেল তাঁর পূর্বতন মোসাদ প্রধানের সমালোচনা করেছিলেন, এবার তিনি নিজে সেটা ফেরত পেলেন। পাপ যে তার বাপকে ছাড়ে না।
মির অমিত ছিলেন একজন দুর্দান্ত ফিল্ড কমান্ডার! ইসরায়েলের টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি বেন গুরিয়নের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বেন-গুরিয়নকে বোঝালেন যে, হ্যারেল এই অপারেশনে অর্থের অপচয় করেছেন। পুরো অপারেশনটা যেভাবে চলেছে তা দেখলে বোঝা যায় যে, তাঁর অবসর নেওয়ার সময় এসে গেছে। বেন-গুরিয়নও ভুলে গেলেন যে তাঁর কথাতেই হ্যারেল ওই অপারেশনে নেমেছিলেন। তিনি মিরকে বললেন, ‘তুমি ঠিক বলছ।’
১৯৬৩ সালের মার্চের ২৫ তারিখ অপমানিত হ্যারেল পদত্যাগ করলেন। তাঁর সহকর্মীরা চোখের জলে তাঁকে বিদায় দিলেন। হ্যারেল সবার সঙ্গে করমর্দন করে মোসাদ হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মোসাদের ইতিহাসে একটি যুগের অবসান হল।
কয়েক ঘণ্টা পর লম্বা, ছিপছিপে, সুদর্শন এক ব্যক্তি দ্রুত পদে মোসাদের হেডকোয়ার্টারে প্রবেশ করলেন। মির অমিত, হ্যাঁ মির অমিতই মোসাদের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। সবাই বুঝতে পেরেছিল এবার অনেক রদবদল হবে।
নিজের ডেস্কে পনেরো মিনিটের মতো কাটানোর পর তিনি সকল বিভাগীয় প্রধানদের ডেকে পাঠালেন। সবাই তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ তিনি সবাইকে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর নিজস্ব ভঙ্গীতে বললেন, ‘হারানো শিশুদের খুঁজে বের করার কাজ মোসাদ আর কখনো করবে না। কোনো রাজনৈতিক প্রভাব এখানে আর কাজ করবে না। বাইরের সমস্তরকম সমালোচনা সামলানোর দায়িত্ব আমার, কারোর ওপর কোনো আঁচ আসতে দেব না আমি। কিন্তু যাকে যে দায়িত্ব দেব, সেটাতে ব্যর্থ হলে তার চাকরিও কেউ বাঁচাতে পারবে না। আমি প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করব, যাতে মোসাদের হাতে উন্নত যন্ত্রপাতি এবং ব্যাকআপ রিসোর্স থাকে। কিন্তু সবার ওপরে হল হিউম্যান ইনটেলিজেন্স। আমি চাই এদিক থেকে মোসাদ হয়ে উঠুক সবার সেরা।’
মির অমিতের কেরিয়ারে সবথেকে বড় অধ্যায় ছিল ইরাক থেকে একটা আস্ত মিগ ২১ তুলিয়ে আনা। সেই কাহিনিও আমরা জানব। পরে। ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সিস্টেমের জন্মকথায় এখানেই ইতি টানলাম।