গোখরো

গোখরো

সাপ, সাপ!

চেঁচিয়ে উঠল বিভা। সজোরে ভূপতিকে ধাক্কা দিয়ে বললে, শুনছ, সাপ!

ওভারটাইম খেটে ভূপতি ফিরেছে রাত সাড়ে দশটায়। ঘুমে আর ক্লান্তিতে ধসে-পড়া বাড়ির মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শিথিল হয়ে আছে তার। তুলোয়-গিট-ধরা চ্যাপটা বালিশটা থেকে মাথা বেকায়দায় সরে গিয়ে এক-আধটু নাক ডাকছিল বটে, তবু অচেতনার একেবারে গভীর অতলে নিমগ্ন হয়ে ছিল সে। সাপ তো সাপ, এই সময়ে একটা রয়াল-বেঙ্গল তাকে মুখে করে তুলে নিয়ে গেলেও জানবার সম্ভাবনা ছিল না ভূপতির।

কিন্তু বিভা রয়াল-বেঙ্গলের চাইতেও মারাত্মক। তারপর গত বছর আট মাসের ছেলেটা মরে যাওয়ার পর থেকে অদ্ভুত হিংস্র হয়ে আছে সে। কিছুদিন আগেও মিষ্টি মিনমিনে বউ বিভাকে যারা দেখেছে, আজ আর তারা তাকে চিনতেও পারবে না। বাঁশির মতো গলা এখন কাঁসির মতো প্রখর এবং প্রবল, শান্ত ঠাণ্ডা মেজাজ এখন যেন বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি। অতএব অতলান্ত বিরাম থেকে আস্তে আস্তে ভূপতি চেতনার সীমান্তে ভেসে উঠতে লাগল।

ঘরে যে সাপ ঢুকেছে, শুনছ না? মরেছ নাকি? বিভার গলা ঝনঝন করে বেজে উঠল। জোরে ধাক্কা দিতে গিয়ে হাতের নোয়াটার একটা মোলায়েম আঘাত লাগল ভূপতির পিঠে।

উ-হু-হুঁ! মরলে তো বেঁচে যেতাম! ভূপতি ধড়মড়িয়ে উঠে বসল, কই সাপ?

আমার পায়ের ওপর দিয়ে নেমে গেল। হিম ঠাণ্ডা! খাটের তলায় ঢুকেছে বোধ হয়।

গৌরবে খাট, আসলে মাঝে মাঝে তক্তার জোড় খুলে-যাওয়া, নড়লে-চড়লে শব্দমুখর পুরোনো একটি তক্তাপোশ। আর তলায় টিনের তোরঙ্গ, থালাবাটি আর খুঁটিনাটি গৃহস্থালির একটি বিশুদ্ধ সুন্দরবন। মশা, আরশোলা আর নেংটি ইঁদুরের মনোরম উপনিবেশ। তার ভেতর সাপ যদি আশ্রয় নিয়ে থাকে, তা হলে তাকে খুঁজে বের করা আস্তিকেরও অসাধ্য।

কিন্তু সমস্যাটা অন্যত্র।

হাত বাড়িয়ে পাশের ছোটো টিপয়ের ওপর রাখা লণ্ঠনটাকে উজলে দিলে ভূপতি। ম্লান। মুখে বললে, খাটের তলায়? কী হবে তাহলে?

 বের করে পিটিয়ে মারো! নইলে অন্তত হুড়োতাড়া দাও, পালিয়ে যাক। খাটের নীচে সাপ নিয়ে বসে থাকব, বলো কী গো! মাঝরাত্তিরে যদি ফোঁস করে অলক্ষুণে কথা আর শেষ করতে পারল না বিভা। অ্যানিমিয়ায় হলদে শীর্ণ মুখে পাঁশুটে ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল একটু একটু।

ভয়ে এতক্ষণে ভূপতিও কাঠ হয়ে গেছে। চোখভরা ঘুম ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রায় আসানসোল পার। ফিসফিস করে বললে, কী সাপ?

আতঙ্কের মধ্যেও বিরক্তিতে বিভা খিচিয়ে উঠল, কী সাপ আমি দেখেছি নাকি? খরিশ টরিশ হবে বোধ হয়। শোল মাছের মতো মোটা, লম্বাও হবে হয়তো হাত চারেক।

হাত চারেক! খরিশ!

কই, কী করবে? অধৈর্য বিভার জিজ্ঞাসা।

নিরুপায় ভূপতির এইবার খেঁকিয়ে ওঠার পালা।

কী করব? খাট থেকে নামতে যাই আর তলা থেকে বসিয়ে দিক আমার পায়ে! তখন?

তাইতো, একথাটা বিভার মনে হয়নি। এবারে কান্না এল তার গলায়।

ওগো, তবে কী হবে? সারারাত এমন সাপ কোলে নিয়ে বসে থাকব?

উপায় তো কিছু দেখছি না। সকাল হোক, আপনিই বেরিয়ে যাবে ঘর থেকে। এটুকু সময় নয় বসে বসেই কাটানো যাক।

এটুকু সময়! সবে গোটা বারো এখন। অসুস্থ দুর্বল শরীর নিয়ে সারাদিন সংসার ঠেলেছে বিভা, ওভারটাইম খেটে প্রায় অ্যাম্বুলেন্সে চেপে ঘরে ফিরেছে ভূপতি। এই অবস্থায় দুজনে ঠায় বসে ঘণ্টা পাঁচেক জেগে থাকা খুব লোভনীয় প্রস্তাব নিশ্চয়!

বিভা আকুল হয়ে বললে, না না, সে হবে না। তলায় আছে, ওপরে উঠে আসতে কতক্ষণ? আমি পাগল হয়ে যাব। হাঁকডাক করো, লোকজন জড়ো হোক।

হাঁকডাক করলেই-বা শুনছে কে এখন? এই বাদলার এমন রাত্তিরে খুন হয়ে গেলেও কেউ সাড়া দেবে না। এ তো আর কলকাতা শহর নয়!

তা নয়। কলকাতা থেকে বারো মাইল দূরে শহরের উচ্ছিষ্ট অঞ্চল এটা। পাড়াগাঁয়ের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে আশপাশে গোটা কয়েক কারখানা তৈরি করে, কিন্তু নগরলক্ষীর দাক্ষিণ্যও ছড়িয়ে পড়েনি। দূরে দূরে বিজলি আলো যেন অনুকম্পার কৌতুকে চোখ মিটমিট করে। ভাঙাচুরো বাড়ি, মুখ-থুবড়ানো বস্তি, একটা পিচের রাস্তায় সম্প্রতি বোমার ক্রেটারের মতো অসংখ্য গর্ত। এদিক-ওদিকে দু-একটা পোড়ো ইটের পাঁজা থাকায় সাপের বংশবৃদ্ধির সুযোগ হয়েছে। এলোমেলো ঝোপ-জঙ্গল, ন্যাড়াটে গাছগুলোর প্রাণহীন পাতায় আধ ইঞ্চি পুরু কালির আস্তরণ।

ভূপতির দৌলতখানা এর মধ্যে আবার একটু একটেরে। রাস্তার ওধারে হঠাৎ-বড়োলোক ঘোষবাবুদের নতুন লালবাড়িটা ছাড়া নিকট প্রতিবেশী কেউ নেই আর। ঘোষবাবুদের ছোটোছেলে করুণাসিন্ধু অবশ্য মাঝে মাঝে করুণাবৃষ্টি করতে চায়। কিন্তু নানা কারণে সেটা পছন্দ করতে পারে না ভূপতি, তার স্ত্রী বিভা এবং বিভার ছোটোবোন প্রাইভেটে আইএ পরীক্ষার্থিনী আভা।

পড়শিকে হাঁকডাক করতে হলে অবশ্য করুণাসিন্ধুকেই ডাকতে হয়। কিন্তু… ডাকলে তারও কি এখন সাড়া মিলবে? খানিকক্ষণ কান পেতে শুনল ভূপতি। টিনের চালের ওপর বৃষ্টির ঝিমঝিমে আওয়াজ। বাইরের আমলকী গাছটার শিরশিরানি। পেছনের ডোবায় ব্যাঙের আনন্দধ্বনি।

ঘর ছেড়ে ওই মোটা মোটা কোলা ব্যাংগুলোর সন্ধানে কেন যায় না সাপটা? ভূপতির মনে কূট জিজ্ঞাসা উদিত হল। বিভা চেঁচিয়ে উঠল, কী আশ্চর্য, একেবারে পাথর হয়ে বসে রইলে যে! কিছু-একটা করো। মারা যাব নাকি সাপের কামড়ে?

কী হয়েছে দিদি? তখন থেকে সমানে চেঁচামেচি করছিস কেন? দরজার বাইরে আর গলা পাওয়া গেল। পাশের ঘর থেকে এতক্ষণে টের পেয়েছে আভা—উঠে এসেছে।

বিভা আর্তস্বরে বললে, ঘরে সাপ!

কী সাপ?

ভূপতিই জবাব দিলে। নিজের অজ্ঞাতেই এক পোঁচ রং চড়িয়ে ফেলল বিভার বর্ণনায়। মস্ত খরিশ। পাঁচ হাত লম্বা।

তাতে কী হয়েছে? দাঁড়াও আমি লাঠি নিয়ে আসছি।

দুপ দুপ করে আভার চলে যাওয়ার আওয়াজ শোনা গেল।

গরিব বোনের গলগ্রহ, দু-বেলা খেতেও পায় না পেটপুরে। তারপরে আছে একটা এম ই স্কুলের হাড়ভাঙা চাকরি। তবু আশ্চর্য সতেজ আর সুস্থ এই আঠারো-উনিশ বছরের মেয়েটা। আরও আশ্চর্য, আভা রূপবতী। এই বিবর্ণ বিষণ্ণ আনন্দ থেকে কেমন করে এমন প্রাণ আর স্বাস্থ্যকে আহরণ করে, কে বলবে

একটু পরেই দরজায় বাঁশ ঠোকার শব্দ। আভা অস্ত্র সংগ্রহ করে এসেছে।

দরজা খোল দিদি।

খাট থেকে নামতে পারছি না যে! বিভার হতাশ আর্তনাদ, তলাতেই কুন্ডলী পাকিয়ে আছে। নীচে পা দিলেই যদি ছোবল মারে?

বুঝেছি।

ওপাশ থেকে ধাক্কা দিতেই কপাটের জোড় একটু ফাঁক হয়ে গেল মাঝখানে। তার ভেতরে আঙুল চলিয়ে ভেতরের খিলটা খুলে ফেলল আভা। এবাড়ির ঘর-দরজা সবই তার নাড়িনক্ষত্রে জানা।

এবারে নড়েচড়ে উঠল ভূপতি।

এই আভা, কী হচ্ছে ওসব পাগলামি। মস্তবড় সাপ। বরং পাড়ার লোকজন ডেকে…

একটা সাপ মারবার জন্যে সাত পাড়া জড়ো করতে হবে! তুমি পুরুষ মানুষের নাম। ডোবালে ভূপতিদা।

দরজা ঠেলে সদর্পে আভা ঢুকল। গাছকোমর বাঁধা, হাতে একটা বাঁশের টুকরো।

আভা, মুখপুড়ি, সর্বনাশ করবি তুই! তারপরে বিভা ককিয়ে উঠল বেরো, বেরিয়ে যা ঘর থেকে।

কিন্তু সেসব শোনবার পাত্রী আভা নয়। ততক্ষণে সে উবু হয়ে খোঁচা দিয়েছে খাটের তলায়। বিভার একরাশ হাঁড়িকুড়ি ঝনঝনিয়ে উঠল, তারপরেই ফোঁস করে একটা হিংস্র আওয়াজ।

বিভা পৈশাচিক আর্তনাদ তুলল, ভূপতির গলা দিয়ে বেরুল খানিক অর্থহীন জান্তব ধ্বনি। তারপরেই তক্তাপোশের আরেক প্রান্তে খোলা জানালা বেয়ে আবির্ভূত হল একটি নিকষ কালো গোখরো সাপ। লণ্ঠনের আলোয় তার চক্রাঙ্কিত ভয়ংকর সুন্দর দেহটা ঝিকমিকিয়ে উঠল।

মাঝখানে চৌকির ব্যবধান, আর তার ওপরে বসে সমানে চিৎকার করছে স্বামী-স্ত্রী। আভা খানিকক্ষণ যেন হতভম্ব হয়ে রইল, তারপর চৌকির পাশ ঘুরে সাপের গায়ে আঘাত করার আগেই জানালার বাইরে সেটা নেমে গেল আগাছা-ভরা ছাইগাদার ভেতরে।

আভা ক্ষুব্ধ হয়ে বললে, পালাল। চেঁচিয়েই তোমরা সব মাটি করে দিলে। নইলে…

এতক্ষণে ধড়ে প্রাণ এসেছে বিভার। সশব্দে জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে বললে, খুব হয়েছে—থাম! মেয়ের কী দুঃসাহস বাবা! যে-সাপের চেহারা দেখে জোয়ান মানুষের বুক কাঁপে, একটা ভাঙা বাঁশ নিয়ে উনি তাই মারতে গেছেন। যদি ফসকে যেত তাহলে?

ফসকাত না।

নাঃ, ফসকাত না। মস্ত এক লাঠিয়াল এসেছেন উনি! যা, এখন ঘরে গিয়ে শো, খুব বাহাদুরি দেখানো হয়েছে।

ও, ভালো করলাম কিনা? নিজেরা তো ভয়ে হার্টফেল করার দাখিল হয়েছিলে! ক্ষুন্ন। বিষণ্ণ মুখে আভা বেরিয়ে গেল।

একটা বুকচাপা নিশ্বাস ছেড়ে ভূপতি এতক্ষণে বিড়ি ধরাতে পারল ধীরেসুস্থে।

উঃ, এক নম্বরের ডাকাত হয়েছে মেয়েটা!

ডাকাত বলে ডাকাত। ও দরকার হলে মানুষ মারতে পারে! বিভা সায় দিলে। তারপর পড়ল ভূপতিকে নিয়ে। তবু তো ও-ই এসে সাপটা বের করে দিলে ঘর থেকে। আর তুমি পুরুষ মানুষ হয়ে…

বা রে, আমি কী করব! ঘরের বাইরে থাকলে আমিও…

ঢের হয়েছে, চুপ করো! আর তোমাকে আমি বার বার বলিনি আস্তাকুঁড়ের ওদিককার জানালাটা খুলে রেখো না? খানাখন্দল ঝোপঝাড় আছে, চাই কী চোরে হাত বাড়িয়ে গলার হারটারও টেনে নিতে পারে। তা বাবুর গরম লাগে! এখন হল তো? বাদলা পেয়ে সাপ এসে ঢুকেছিল, যদি আমি ঠিক সময়মতো টের না পেতাম তাহলে…।

বিভার আত্মস্তুতি শেষ হল না। তার আগেই বাইরের বারান্দায় জুতোর শব্দ শোনা গেল, আর তার সঙ্গে এল ভরাট গলার ডাক, ভূপতিবাবু, ভূপতিবাবু।

বিভা ফিসফিসিয়ে বললে, করুণাসিন্ধু।

এস্ত উঠে পড়ল ভূপতি, কাপড়ের কষিটা বেঁধে নিয়ে সসম্রমে বাইরের দিকের দরজা খুলে দিলে।

আসুন আসুন। গায়ে বর্ষাতি ফেলা, হাতে বন্দুক, নাটকীয়ভাবে করুণাসিন্ধু প্রবেশ করলে। ঘোমটা টেনে মুখ ফিরিয়ে বসল বিভা। লোকটার চাউনি ভালো নয়, মদও খায় এক-আধটু, গায়ে পড়ে আলাপ করতে চায়। কিছুদিন থেকে কারণে-অকারণে বড়ো বেশি খোঁজ করছে সে। বিভার মনে একটা গভীর সন্দেহ জেগেছে, অত্যন্ত বিব্রত হয়ে উঠেছে ভূপতিও।

বন্দুকটাকে বাগিয়ে ধরে করুণাসিন্ধু বললে, সাপ সাপ বলে খুব চিৎকার শুনলাম। ভাবলাম বন্দুকটা হয়তো কাজে লাগতে পারে, তাই এলাম। তা কোথায় সাপ?

সে আর নেই, বাইরে পালিয়েছে। ভূপতি জবাব দিলে, তবু আপনি যে কষ্ট করে এসেছেন, সেজন্যে অনেক ধন্যবাদ! বিভার দিকে তাকিয়ে অস্বস্তিভরে যোগ করল, তা এলেন যখন, বসুন-না একটু। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

এরপরে ভদ্রতার খাতিরেই করুণাসিন্ধু বিদায় নেবে এমনই একটা আশা ছিল ভূপতির। কিন্তু আশাটা ব্যর্থ হল। একটা চেয়ার নিয়ে জমিয়ে বসল করুণাসিন্ধু।

এই সময়টা বড়ো খারাপ, সাবধানে থাকবেন। কোনো দরকার পড়লেই ডাকবেন আমাকে। একটা সোনার সিগারেট কেস বের করে সেটা এগিয়ে দিলে ভূপতির দিকে। হ্যাভ ওয়ান?

নাঃ, বিড়ি নইলে আমাদের নেশা জমে না। বিভার কুন্ডলী-পাকানো চেহারার দিকে আবার আড়চোখে তাকিয়ে শুকনো গলায় ভূপতি জবাব দিলে।

তা বটে! আপনারা আবার কড়ার ভক্ত। বিড়ির দীনতাকে ভদ্রতার প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দিলে করুণাসিন্ধু, যার যা।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

করুণাসিন্ধু সিগারেট ধরিয়ে এক বার কাশল, যা বলব ভাবছিলাম। ভালো কথা ভূপতিবাবু, আপনার শালি বোধ হয় আইএ পড়ছেন আজকাল?

বিভা এক বার নড়ে উঠল। সভয়ে মাথা নাড়ল ভূপতি।

করুণাসিন্ধু বলে চলল, ক-দিন থেকেই বলব ভাবছি। আমাদের কলকাতার অফিসে শ দেড়েক টাকা মাইনের একটা ভ্যাকেন্সি হচ্ছে শিগগিরই। যদি বলেন, ঢুকিয়ে দিই ওকে। আমার হাতেই সব।

বলেন কী? দেড়শো টাকা! এ যে এমএ পাসের মাইনে! ও তো শুধু ম্যাট্রিক পাস!

আমি বাবাকে বললে সবই হয়ে যাবে। করুণাসিন্ধু করুণায় বিগলিত হয়ে পড়ল, আপনারা আমাদের প্রতিবেশী, যদি কিছু সাহায্য করতে পারি, নিজেকেই ধন্য মনে করব। করুণাসিন্ধু এবার ঠোঁট চাটল, কাল যদি আমার সঙ্গে এক বার ওকে কলকাতায় পাঠিয়ে

দেন…

বাইরে ছাইগাদার ওপরে ধপ ধপ করে আওয়াজ হল গোটা দুই। ভূপতি চমকে গেল, ও কী! কে ওখানে?

আমি আভা ভূপতিদা!

করুণাসিন্ধুর অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে বিভা আর্তনাদ ছাড়ল, হতভাগী, এই অন্ধকারে ওখানে গেছিস কেন? চলে আয় শিগগির, চলে আয়।

আসছি। আবার ধপাধপ করে গোটা কয়েক আওয়াজ!

সর্বনাশ করবে, ও আমার সর্বনাশ করবে! বিভা কেঁদে ফেলল।

ডাকাতটা ওখানে এই অন্ধকারে সাপ খুঁজতে গেছে!

অ্যাঁ! সাপ খুঁজতে গেছেন? করুণাসিন্ধু লাফিয়ে উঠল, অসম সাহস ওঁর! বন্দুকটা তুলে নিয়ে বললে, যদি আমি ওঁকে সাহায্য করতে পারি।

আভা–আভা। ভূপতি হুংকার ছাড়ল!

আসছি ভূপতিদা।

করুণাসিন্ধু আভার উদ্দেশেই বেরিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু দরজার কাছে গিয়েই আতঙ্কে পিছু হটে এল। এক হাতে টর্চ আর এক হাতে লাঠির মাথায় কালো কুচকুচে গোখরোটার মৃতদেহ ঝুলিয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকেছে আভা। সাপটার ঝুলে-পড়া থ্যাঁতলানো মুখ থেকে সুতোর মতো আঠালো লালা গলে পড়ছে।

সুন্দর গালে কাদার ছিটে, ভিজে চুল বেয়ে জলের ফোঁটা নামছে, একটা অদ্ভুত বন্য আলোয় জ্বলছে আভার চোখ। তীক্ষ্ণ হাসি হেসে বললে, কেমন দিদি, তুই যে বলেছিলি সাপটা আমি মারতে পারব না। পাথরের মতো দৃষ্টি মেলে স্তম্ভিত ভূপতি আর বিভা যেখানে ছিল, ঠিক সেইখানেই বসে রইল। আর আভার চোখের বন্য আলোয় কী ছিল কে জানে—হঠাৎ পাংশু হয়ে নিবে গেল করুণাসিন্ধুর মুখ! বিনা সম্ভাষণেই সে দ্রুতবেগে ঘরের বাইরে ছিটকে পড়ল, ক্ষিপ্রগতিতে নেমে যেতে যেতে ডাক দিয়ে বললে, চলি ভূপতিবাবু, আপনারা তাহলে বিশ্রাম করুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *