সকলেই বলিতেছেন, এখানে গোঁফ না বলিয়া গুম্ফ বলা উচিত ছিল। আমি বলিতেছি তাহার কোনো আবশ্যক নাই। গোঁফটা কিছু এমন একটা হেয় পদার্থ নহে যে, তাহাকে সংস্কৃত গঙ্গাজলে না ধুইয়া ভদ্রসমাজে আনা যায় না। স্বনামা পুরুষো ধন্যঃ। গোঁফের পিতামহের নাম ছিল গুম্ফ; তিনি ভরদ্বাজ, কাশ্যপ, শাণ্ডিল্যদের মুখে যথাকাল বিরাজ করিয়া গুম্ফলীলা সংবরণ করিয়াছেন, তাঁহারই কুল-কজ্জল বংশধর শ্রীযুক্ত গোঁফ অধুনা চাটুর্যে বাঁড়ুয্যে মুখুয্যেদের ওষ্ঠ বৈদূর্য সিংহাসনের উপর উপবিষ্ট হইয়া দিবারাত্রি নাসারন্ধ্রের সমীরণ সুখে সেবন করিতেছেন। অতএব গোঁফ যখন তাহার পিতা-পিতামহের বাস্তুভিটা না ছাড়িয়া তাহার পাঁচ-ছয় সহস্র বৎসরের পৈতৃক স্বত্ব সমান প্রভাবে বজায় রাখিয়াছে, তখন যদি তাহাকে তাহার নিজের নামে অভিহিত না করিয়া গুম্ফের নামে তাহার পরিচয় দেওয়া হয়, তবে অভিমানে সে চিবুকের নীচে আসিয়া ঝুলিয়া পড়ে!
তোমাদের কল্পনাশক্তি সামান্য, এইজন্যই ছোটো কথাকে বড়ো করিয়া না বলিলে তোমাদের কানে পৌঁছায় না! বাজের শব্দ তোমরা শুনিতেই পাও না, কাজেই তোমাদের জন্য ইরম্মদের কড়্কড়্ করা আবশ্যক। প্রকৃতির ছোটো জিনিসের মহত্ত্ব তোমরা দেখিতে পাও না, এইজন্য তোমাদিগকে হ্যাঁ করাইবার অভিপ্রায়ে বড়ো বড়ো আতস কাচ আনাইয়া শিশুদের মুখের উপর ধরিয়া তাহদিগকে দৈত্য দানব করিয়া তুলিতে হয়। কিন্তু তাই বলিয়া যে তোমাদের স্থূল কল্পনাকে আঁকড়াইয়া ধরিবার জন্য আমি এই দুই-চারি ইঞ্চি গোঁফকে টানিয়া টানিয়া চিনেম্যানের টিকির মতো অযথা পরিমাণে বাড়াইয়া তুলি, এবং গোঁফ শব্দের সহজ-মাহাত্ম্যের পেটের মধ্যে গোটা আষ্টেক-দশ বড়ো বড়ো অভিধান পুরিয়া তাহাকে উদরী রোগীর মতো অসম্ভব স্ফীত করিয়া তুলি তাহা আমার কর্ম নহে।
আমি আজ গোঁফের সম্বন্ধে কেবলমাত্র গুটিকতক সহজ সত্য বলিব ও আমার বিশ্বাস, তাহা হইলেই কল্পনাবান মনস্বীগণ স্বতই তাহার পরম মহত্ত্ব অনুভব করিতে পারিবেন।
ইহা দেখা গিয়াছে গোঁফ যতদিন না উঠে ততদিন পরিষ্কাররূপে বুদ্ধির বিকাশ হয় না। স্ত্রীলোকদের গোঁফ উঠে না, স্ত্রীলোকদের পরিপক্ক বুদ্ধিরও অভাব দেখিতে পাওয়া যায়। বিপদে পড়িলে বুদ্ধির নিমিত্ত গোঁফের শরণাপন্ন হইতে হয় না, এমন কয়জন গুঁফো লোক আছে জানিতে চাহি। সংসার ক্ষেত্রে কাজ করিতে করিতে একটা কঠিন সমস্যা উপস্থিত হইলেই তৎক্ষণাৎ দুই হাতে গোঁফের হাতে ধরিয়া পায়ে ধরিয়া গায়ে হাত বুলইয়া ১০-১৫ মিনিট অনবরত খোশামোদ করিতে হয়, তবেই তিনি প্রসন্ন হইয়া ভক্তের সেব্যমান হস্তে পাকা বুদ্ধি অর্পণ করেন।
অতএব স্পষ্টই প্রমাণ হইতেছে, বুদ্ধির সহিত গোঁফের সহিত একটা বিশেষ যোগ আছে। বয়স্কেরা যে শ্মশ্রুগর্বে গর্বিত হইয়া অজাত-শ্মশ্রুদিগকে অর্বাচীন জ্ঞান করেন, অবশ্যই তাহার একটা মূল আছে। গোঁফ উদ্গত হইয়াই তৎক্ষণাৎ একজোড়া ঝাঁটার মতো বালকদের বুদ্ধিরাজ্যের সমস্ত মাকড়সার জাল ঝাঁটাইয়া পরিষ্কার করিয়া ফেলে, ভাবের ধূলা ঝাড়িয়া দেয়, সমস্ত যেন নূতন করিয়া দেয়। অতএব এই অজ্ঞান-ধূমকেতু গোঁফ যুগলের সহিত বুদ্ধির কী যোগ আছে, আলোচনা করিয়া দেখা যাক।
এ বিষয়ে মনোনিবেশপূর্বক ধ্যান করিতে করিতে সহসা আমার মনে উদিত হইল, “গোঁফে তা দেওয়া’ নামক একটি শব্দ চলিত ভাষায় ব্যবহৃত হয়। আপেল ফল পতন যেমন মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব আবিষ্কারের মূলস্বরূপ হইয়াছিল, “গোঁফে তা দেওয়া’ শব্দটি তেমনি বর্তমান আলোচ্য মহত্তর আবিষ্কারের মূলস্বরূপ হইল। ইহা হইতে এই অতি দুর্লভ সত্য বা তত্ত্ব সংগ্রহ করা যায় যে বায়ুবাহিত বা পক্ষীমুখভ্রষ্ট বীজ অপেক্ষা তদুৎপন্ন বৃক্ষ অনেকগুণে বৃহৎ ও বিস্তৃত হইয়া থাকে।
“তা দেওয়া’ শব্দ আমার মাথায় আসিতেই আমার সহসা মনে পড়িল যে নাকের গুহার নীচে এই যে গোঁফটা ঝুলিতেছে ইহা বুদ্ধির নীড় মাত্র। বুদ্ধি বল, ভাব বল, এইখানে তাহার ডিম পাড়িয়া যায়। কতশত বুদ্ধির ডিম, ভাবের ডিম আমাদের গোঁফ-নীড়ের অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য ভাবে রক্ষিত হইয়াছে, দিবারাত্রি উত্তপ্ত নিশ্বাসবায়ু লাগিয়া ফুটিয়া ফুটিয়া উঠিতেছে, তাহা কি আমরা জানিতে পারি? মায়াবিনী প্রকৃতিদেবী সকল কার্য কী গোপনেই সম্পন্ন করিতেছেন! বিশেষত অপরিস্ফুট জন্ম-পূর্ব অবস্থায় তিনি সকল দ্রব্যকে কী প্রচ্ছন্ন ভাবেই পোষণ করিতে থাকেন। বৃক্ষ হইবার পূর্বে বীজ মৃত্তিকার মধ্যে লুক্কায়িত থাকে, প্রাণীদিগের ভ্রূণ জঠরান্ধকারে নিহিত থাকে, এবং এই চরাচর অস্ফুট শৈশবে অন্ধকারগর্ভে আবৃত ছিল, মনুষ্যের বুদ্ধির এবং ভাবের ডিমও গোঁফের মধ্যেই আচ্ছন্ন হইয়া বাস করিতে থাকে। মনুষ্যবুদ্ধি বিজ্ঞান মায়াবীর কাঁধে চড়িয়া প্রকৃতির মহা-রহস্যশালার দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়া আছে ও সেই রুদ্ধ দ্বারের ছিদ্রের মধ্য দিয়া সেই অপরিসীম অন্ধকারের মধ্যে দৃষ্টি চালাইবার চেষ্টা করিতেছে কিন্তু আজ পর্যন্ত কয়জন বিজ্ঞানবিৎ গোঁফের অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করিয়া ভাবডিম্ব পরিস্ফুটনের মহত্তত্ত্ব আবিষ্কারে অগ্রসর হইয়াছেন! আমি আজ দুঃসাহসে ভর করায় সেই গোঁফের মহারণ্যের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছি, ইহার অগণ্য শাখা-প্রশাখার উপরে কতবিধ জাতীয় ভাব আসিয়া নিঃশব্দে ডিম পাড়িয়া যাইতেছে, তাহাই চুপ করিয়া দেখিতেছি।
আমরা অনেক সময়ে জানিতেই পারি না কোথা হইতে সহসা এ বুদ্ধি আমার মাথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। কেমন করিয়া জানিব বলো! কখন আমাদের গোঁফে নিঃশব্দে ডিম্ব ভাঙিয়া পাখিটি মাথায় আসিয়া উড়িয়া বসিল, তাহা সব সময়ে টের পাওয়া যায় না তো। কিন্তু যখন আমাদের তাড়াতাড়ি একটা কোনো বুদ্ধির আবশ্যক পড়ে, তখন স্বভাবতই আমরা ঘন ঘন গোঁফে তা দিতে থাকি, ও তামাক টানিয়া তাহার উত্তপ্ত ধোঁয়া গোঁফের শাখায় শাখায় সঞ্চারিত করিয়া দিই।
আজ গোঁফের কী মহত্ত্ব আমাদের মনের সম্মুখে সহসা উদ্ঘাটিত হইয়া গেল! ভাবের প্রবাহ অনুসরণ করিয়া আমরা গোঁফের গঙ্গোত্রী শিখরের উপরে গিয়া উপনীত হইয়াছি। আজ ভূতত্ত্বশাস্ত্র অনুসারে পৃথিবীর যুগপরম্পরা অতিক্রম করিয়া, দ্রব অবস্থায় পৃথিবী যে চতুর্দিকব্যাপী ঘন মেঘনীড়ের মধ্যে আচ্ছন্ন ছিল, ভাবজগতের সেই আদিম গুম্ফমেঘনীড়ের মধ্যে বিজ্ঞান-বলে গিয়া উপস্থিত হইয়াছি, মহৎ ভাবে সর্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠিয়াছে।
ব্যাসদেবের যে অত্যন্ত বৃহৎ এক জোড়া ঘোঁফ ছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই; কারণ যে গোঁফে তিনি বৃহৎ মহাভারতের অষ্টাদশ পর্বের আঠারোটি ডিম নয়টা নয়টা করিয়া দুইদিকে অদৃশ্যভাবে ঝুলাইয়া বহন করিয়া বেড়াইতেন সে বড়ো সাধারণ গোঁফ হইবে না। ক্রম্ওয়েল সাহেবের গোঁফে ইংলন্ডের বর্তমান পার্ল্যামেণ্টের ডিম যখন ঝুলিত, তখন কেহ দেখিত পায় নাই, আজ দেখো, সেই পার্ল্যামেণ্ট ডিম ভাঙিয়া মস্ত ডাগর হইয়া ক্যাঁক ক্যাঁক করিয়া বেড়াইতেছে। পিতামহ ব্রহ্মার আর কিছু থাক্ না থাক্ চার মুখে চার জোড়া খুব বড়ো বড়ো গোঁফ অনন্ত আকাশ আচ্ছন্ন করিয়াছিল, ইহা কি কেহ অস্বীকার করিতে পারিবে? নহিলে চরাচর কোথায় থাকিত।
হায় হায়, যাহারা গোঁফ কামায়, তাহারা জানে না কী ভয়ানক কাজ করিতেছে। হয়তো এক জোড়া গোঁফের সঙ্গে সঙ্গে একটা দেশের স্বাধীনতা কামাইয়া ফেলা হইল! একটা ভাষার সাহিত্য কামাইয়া ফেলা হইল! হয়তো কাল প্রত্যুষেই আমি মানব সমাজে এক ভূমিকম্প উপস্থিত করিতে পারিতাম, কিন্তু আজ সন্ধ্যাবেলায় গোঁফ কামাইয়া ফেলিলাম, ও তাহার সঙ্গে সঙ্গে একটা সমাজের ভূমিকম্প কামাইয়া ফেলিলাম! কবি গ্রে সাহেব কবরস্থানে গিয়া মূক, গৌরবহীন মৃত গ্রাম্য মিল্টনদের স্মরণ করিয়া বিলাপ করিয়াছেন, কিন্তু তিনি যদি নাপিতের ক্ষৌরশালায় গিয়া কবির দিব্যচক্ষে ছিন্ন গোঁফরাশির মধ্যে শত শত ধূলিধূসরিত সভ্যতা, সাধু সংকল্প ও মহৎ উদ্দেশ্যের ভ্রূণহত্যা দেখিতে পাইতেন, ধূলিতে লুণ্ঠমান নীরব সংগীত শিশু, অঙ্কুরে বিদলিত মহত্ত্বের কল্পবৃক্ষ সকল দেখিতে পাইতেন, তবে না জানি কী বলিতেন।
আমি যখন কোনো বড়ো লোক দেখি, তখন তাঁহার গোঁফজোড়াটা দেখিয়াই সম্ভ্রমে অভিভূত হইয়া পড়ি। তাঁহার সহিত তর্ক করিবার সময় তিনি যদি গোঁফে চাড়া লাগান্ তো ভয়ে তর্ক বন্ধ করিয়া ফেলি! মনে মনে একবার কল্পনা করিয়া দেখি, যেন বর্তমান কাল অত্যন্ত ভীত হইয়া ওই গোঁফের দিকে চাহিয়া রহিয়াছে, ভাবিতেছে, না জানি কোন্ একটা বলবান ভবিষ্যৎ-বাচ্ছা কাল-পরশুর মধ্যে ডিম্ব ভেদ করিয়া গরুড়-পরাক্রমে ওই গোঁফের ভিতর দিয়া হুস্ করিয়া বাহির হইয়া পড়িবে, ও বর্তমান কালটাকে সিংহাসন হইতে হেঁচ্ড়াইয়া আনিয়া নিজে তাহার উপরে গট্ হইয়া বসিবে! মনে মনে এই কামনা করি যে নাপিতের ক্ষুর কখনো যেন ও গোঁফজোড়া স্পর্শ না করে!
নৈয়ায়ক মহাশয়েরা গোটাকতক তীক্ষ্ণ-চঞ্চু ক্ষুদ্রচক্ষু হিংস্র পাখি পুষিয়া রাখিয়াছেন, তাহারা কোনো কালে নিজে ডিম পাড়িতে পারে না, কেবল পরের নীড়ে খোঁচা মারিয়া ও পরের শাবককে ঠোকরাইয়া বেড়ায়। এইরূপে ইহাঁরা অনেক ভালো ভালো জাতের ভাবগুলিকে বধ করিয়া থাকেন। মনে মনে বিষম অহংকার। কিন্তু ইহা হয়তো জানেন না, যদি এই শাবক বেচারিরা নিতান্তই শিশু অবস্থায় এরূপ খোঁচা না খাইত ও পুষ্ট হইয়া কিছু বড়ো হইতে পারিত, তবে এই নৈয়ায়িক হিংস্র পক্ষীগণ ইহাদের কাছে ঘেঁসিতে পারিত না। আমার সামান্য গোঁফ হইতে আজ এই যে একটি পাখি বাহির হইয়াছে, ইহার জন্ম সংবাদ পাইয়াই অমনি চারি দিক হইতে নৈয়ায়িক পক্ষীগণ ইহার চারিদিকে চ্যাঁ্ চ্যাঁ করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কেহ-বা ইতিহাসে ঠোঁট শানাইয়া আসিয়াছেন, কেহ-বা পুরাণের আগায় ঠোঁট ঘষিয়া আসিয়াছেন, কেহ-বা তর্কশাস্ত্র নামক ইস্পাতের ছুরি দিয়া ঠোঁট চাঁচিয়া চাঁচিয়া নিন্দুকের কলমের আগার মতো ঠোঁটটাকে খরধার করিয়া আসিয়াছেন, রক্তপাত করিবার আশায় উল্লসিত! ইহাঁরা আমার শাবককে নানারূপে আক্রমণ করিতেছেন। একজন নিতান্ত কর্কশ স্বরে বলিতেছেন, যে, “তোমার কথা অপ্রামাণ্য। কারণ ভারতবর্ষের পূর্বতন ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণ গোঁফ দাড়ি এমন-কি, চুল পর্যন্ত কামাইয়া কেবল একটুখানি টিকি রাখিতেন! তাঁহারা কি আর বুদ্ধির চর্চা করিতেন না!’ এই লোকটার কর্কশ কণ্ঠ শুনিয়া একবার ভাবিলাম, “আমি ভাবকে জন্ম দিয়া থাকি, কাজেই ন্যায়শাস্ত্র লইয়া খোঁচাখুঁচি করা আমার কাজ নহে। আমরা ভাবের উচ্চ আসনে বসিয়া থাকি, কাজেই উহারা নীচে হইতে চেঁচামেচি করিয়া থাকে। করুক, উহাদের সুখে ব্যাঘাত দিব না।’ অবশেষে গোলমালে নিতান্ত বিরক্ত হইয়া উহাদেরই অস্ত্র অবলম্বন করিতে হইল! আমি কহিলাম– “প্রমাণ খুঁটিয়া খুঁটিয়া বেড়ানো আমার পেশা নহে, সুতরাং আমার সে অভ্যাস নাই; আমি কেবল একটি কথা বলিতে চাহি, ভারতবর্ষে যখন বৃহৎভাবের জন্ম হইত, তখন ঋষিদের বড়ো বড়ো গোঁফ ছিল। অবশেষে ভাবের জন্ম যখন বন্ধ হইল, কেবলমাত্র সঞ্চয়ের ও শ্রেণীবিভাগের পালা পড়িল, তখন গোঁফের আবশ্যকতা রহিল না। তখন সঞ্চিত ভাবের দলকে মাঝে মাঝে টিকি টানিয়া জাগাইয়া দিলেই যথেষ্ট হইত, তখন আর তা দিয়া ফুটাইয়া তুলিবার প্রয়োজন রহিল না। কিন্তু আর্যদের অবনতির আরম্ভ হইল কখন হইতে? না, যখন হইতে তাঁহারা গোঁফ কামাইয়া টিকি রাখিতে আরম্ভ করিলেন। এককালে যে ওষ্ঠের ঊর্দ্ধে ভাবের নিবিড় তপোবন বিরাজ করিত, এখন সেখানে সমতল মরুভূমি! কেবল প্রাচীন কালের কতকগুলি ভাবের পক্ষী ধরিয়া স্মৃতির খাঁচায় রাখিয়া দেওয়া হইয়াছে, তাহারা সকালে বিকালে একটু একটু শুষ্ক মস্তিষ্ক খাইয়া থাকে। অনেকগুলা মরিয়া গিয়াছে, অনেকগুলা ডাকে না, কেহ আর ডিম পাড়ে না, স্বাধীন ভাবে গান গায় না, কেবল টিকি নাড়া দিলে মাঝে মাঝে চেঁচায়! গোঁফ কামাইয়া এই তো ফল হইল! অতএব হে ভারতবর্ষীগণ, আজই তোমরা “রাখো গোঁফ কাটো টিকি’।
“যাঁহারা বিশুদ্ধ জ্ঞান ও বিশুদ্ধ কাব্যের প্রতি বিমুখ, যাঁহারা পদে পদে ফল, উদ্দেশ্য ও তত্ত্ব দেখিতে চান তাঁহাদের নিমিত্ত আমার এই গোঁফ তত্ত্ব আবিষ্কারের ফল বুঝাইয়া দিই! আমার এই লেখা পড়িলে ভারতবাসীদের চৈতন্য হইবে যে– ভারতবর্ষে বহুবিধ খনিজ ও উদ্ভিজ্জ পদার্থ সত্ত্বেও আমাদের জ্ঞান ও উদ্যমের অভাবে যেরূপ তাহা থাকা না থাকা সমান হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তেমনি আমরা গোঁফের উপযোগিতা জানি না বলিয়া তাহার যথার্থ সদ্ব্যবহার করিতে পারিতেছি না, ও এইরূপে দেশের উন্নতির ব্যাঘাত হইতেছে। আজ হইতে আমরা যদি গোঁফের শুশ্রূষা করি, গোঁফে অনবরত তা দিতে থাকি ও গোঁফ না কামাই, তবে তাহা হইতে না জানি কী শুভ ফলই প্রসূত হইবে! যেদিন ভারতবর্ষের বিংশতি কোটি লোক আকর্ণ-পূরিত গোঁফ নাপিতের ভীষণ আক্রমণ হইতে রক্ষা করিয়া রাখিবে, সেদিন ভারতবর্ষের কী শুভদিন! আমি যেন দিব্য চক্ষে দেখিতে পাইতেছি পূর্ব মেঘমালার অন্ধকার হইতে যেমন ধীরে ধীরে সূর্য উত্থান করিতে থাকেন, তেমনি ভারতবর্ষের বিংশতি কোটি সন্তানের গুম্ফমেঘের মধ্য হইতে ওই দেখো ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-সূর্য ধীরে ধীরে উত্থান করিতেছে, ওই দেখো সিন্ধুনদ হইতে ব্রহ্মপুত্র ও হিমালয় হইতে কন্যাকুমারী পর্যন্ত আলোকিত হইয়া উঠিতেছে, যাজ্ঞবল্ক্য ও শাক্যসিংহের পবিত্র জন্মভূমিতে পুনরায় প্রভাত কিরণ বিস্তীর্ণ হইতেছে!’ (ঘন ঘন করতালি)।
হে আমি, হে গোঁফতত্ত্ববিৎ বুধঃ, তুমি আজ ধন্য হইলে! আজ তোমার গোঁফের কী গর্বের দিন! তাহারই নীড়জাত শাবকগুলি আজ কলকণ্ঠে গাহিতে গাহিতে তোমার মুখ দিয়া অনর্গল বাহির হইয়া আসিতেছে এবং সেই গোঁফ স্নেহভরে নতনেত্রে মুখের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া সগর্বে মুখ হইতে উড্ডীন শাবকদিগের প্রতি চাহিয়া রহিয়াছে।
হে সমালোচকশ্রেষ্ঠ, তুমি যদি এই শাবকগুলি ধরিয়া তোমার খরশান কলম দিয়া জবাই কর ও লঙ্কা মরিচ দিয়া রন্ধন কর তবে তাহা নব্যশিক্ষিত পাঠকদের মুখরোচক হইবে সন্দেহ নাই, কিন্তু সে কাজটা কি হিন্দুসন্তানের মতো হইবে?
ভারতী, আষাঢ়, ১২৯০