গোয়েন্দা ও প্রেতাত্মা – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকার নেমেছে। শহর নয়, শহরতলী। উঁচু-নিচু কাঁকর বিছানো রাস্তা। দুপাশে আকন্দ, ফণিমনসা আর বনতুলসীর ঝোপ। এই সব গাছ-গাছড়ার জন্য জায়গাটা আরো অন্ধকার দেখাচ্ছে।
একটা জীর্ণ পাঁজরপ্রকট বাড়ি। বাড়ির আদি রং কি ছিল বলা মুশকিল। দু’ একটা জানলা খুলে ঝুলে পড়েছে।
কোন লোক বাস করে বলে মনে হয় না।
আশপাশে কোন বাড়ি নেই। বাঁজা মাঠ, মজা পুকুর, শেয়াল কুকুরের আস্তানা।
সহসা অন্ধকার উদ্ভাসিত করে আলোর তির্যক রেখা দেখা গেল।
মোটরের হেডলাইট।
এ রাস্তায় মোটর মাঝে মাঝে যায়। গোবিন্দপুর যাবার এটাই সোজা পথ। সেখানে তামার সন্ধান পাওয়া গেছে, তাই দলে দলে ব্যবসায়ীরা ছোটে।
এ মোটরটা কিন্তু এই বাড়ির সামনেই থামল।
মোটর থেকে শার্ট-প্যান্ট পরা একটি যুবক নামল। হাতে সুটকেশ। টর্চ ফেলে রাস্তা দেখে দেখে বাড়ির মধ্যে ঢুকল।
লোকটি নামার পরই মোটর চলে গেল। যেদিক থেকে এসেছিল, সেই দিকে।
নিচের ঘরে মোমবাতির আলো জ্বলে উঠল। বোঝা গেল, লোকটি নিচের ঘরেই রয়েছে।
আধঘণ্টা—তার বেশি নয়।
বিদ্যুৎবেগে একটা জীপ এসে থামল। জীপ থেকে একজন ইন্সপেক্টর অফ পুলিশ নামল। পেছনে দুজন পুলিশ।
ইন্সপেক্টর জীপের মধ্যে উঁকি দিয়ে কাকে লক্ষ্য করে বলল, কিহে, এই বাড়িটাই তো?
ভেতর থেকে উত্তর এল: আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর।
ঠিক আছে, চল।
সামনে পেছনে দুজন পুলিশ, মাঝখানে ইন্সপেক্টর বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
দরজা ঠেলবার আগে ইন্সপেক্টর কোমরের রিভলবার হাতে নিল।
জীপ এসে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই মোমবাতির আলো নিভে গিয়েছিল। সমস্ত বাড়ি জুড়ে অন্ধকারের রাজত্ব।
প্রায় মিনিট পনেরো করাঘাতের পর ভেতর থেকে আওয়াজ এল: কে?
যাক, হুজুরের কপট নিদ্রা ভেঙেছে।
দরজা খুলে গেল। যুবকটি দাঁড়িয়ে। হাতের বাতিদানে একটি বাতি।
বাতির কোন দরকার ছিল না।—ইন্সপেক্টরের হাতের টর্চের আলোয় সব কিছু উদ্ভাসিত।
যুবকটির দুটি ভ্রূর মাঝখানে বিরক্তির খাঁজ। রুক্ষ গলায় প্রশ্ন করল, কাকে চাই?
ইন্সপেক্টর হাসল: পোশাক দেখেই তো বুঝতে পারছেন আমি পুলিশের লোক। এ বাড়ি আমরা সার্চ করব।
সার্চ করবেন! কারণ?
কারণ, আমরা সন্দেহ করি নেপালের মধ্যে দিয়ে কিছু হাসিস আপনি আমদানি করেছেন, এবং একটু আগে সেসব এ বাড়িতে এসে পৌঁছেছে।
যুবকটি ঠোঁট মচকে হাসল। এমন আজগুবি খবর কোথা থেকে সংগ্রহ করলেন?
ইন্সপেক্টর এ ব্যঙ্গোক্তির কোন উত্তর দিল না। পুলিশদের দিকে ইশারা করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল, বাতি জ্বালান। সুইচ কোথায়?
কথার সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলো এদিক-ওদিক ফেলল।
যুবকটির কণ্ঠে হাসির সুর: সুইচ থাকলে তো পাবেন! এ বাড়িতে আলো নেই। মোমবাতি ভরসা করে আছি।
সর্বনাশ, বাতিও নেই! নিবান্ধব পুরীতে কি করে থাকেন মশাই?
শহরের হৈ চৈ একেবারে ভাল লাগে না। তাই মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিতে আসি।
সেজন্য, না চোরাকারবারের সুবিধা বলে?
আপনাদের সঙ্গে তর্ক করে তো আর লাভ নেই। নিন, কি সার্চ করবার করুন। বাড়ি সার্চ করার আগে আমাকে সার্চ করবেন না?
ইন্সপেক্টর আড়চোখে যুবকটির দিকে দেখল। ওর পরনে গেঞ্জি আর লুঙ্গি। এ পোশাকে কিছু লুকিয়ে রাখবে—এ সম্ভাবনা কম। তবু ইন্সপেক্টর একজন পুলিশকে বলল, রামবিলাস, তুমি বাবুকে পাহারা দাও। আমি ঘরগুলো খুঁজে দেখি।
দুটি মাত্র ঘর। পেছনের বারান্দায় খাবার ব্যবস্থা। একটা ঘর একেবারে খালি। দু’একটা ভাঙা কাগজের বাক্স রয়েছে। এদিকের ঘরে তক্তপোশের ওপর বিছানা। একটা আলনা।
ইন্সপেক্টর সব উল্টে-পাল্টে দেখল। এমন কি দেয়ালের গায়ে লাঠির ঠোক্কর দিয়ে দেখল, কোথাও ফাঁপা কিনা। বিছানাপত্র তছনছ করল। পেছনের বারান্দায় টেবিলের ওপর কয়েকটা পাঁউরুটি আর মাংস বাটি-চাপা দেওয়া।
যুবকটি বোধ হয় খাবার আয়োজন করছিল। পুলিশ আসতে বাধা পড়েছে।
ইন্সপেক্টর যুবকটির সামনে দাঁড়াল। বলল, কি করা হয়?
চাকরি করি।
চাকরি, তো বুঝেছি। কিসের?
কিউরিও বোঝেন? আমি ইন্ডিয়ান কিউরিও হাউসের প্রতিনিধি।
অফিসটা কোথায়?
সাত নম্বর ওয়েলফেয়ার স্ট্রীট।
ইন্সপেক্টর পকেট থেকে ছোট ডায়ারি বের করে ঠিকানাটা লিখে নিয়ে বলল, ওখানে আপনাকে খোঁজ করলে পাত্তা পাওয়া যাবে?
পাওয়া তো উচিত।
আপনার নাম?
অতনু গুপ্ত।
নাম কি একটাই?
মানে?
মানে, মহাপুরুষদের অনেক নাম থাকে কিনা!
মাফ করবেন, এখন আমি খুব ক্ষুধার্ত; আপনার রসিকতা তারিফ করতে পারছি না। আপনার কাজ হয়ে থাকলে যেতে পারেন—
যাবার আগে ইন্সপেক্টর শেষবারের মতন টর্চের আলো এদিক-ওদিক ফেলল। না, সন্দেহজনক কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না।
রাস্তায় এসে ইন্সপেক্টর একজন পুলিশকে বলল, তুলসীচরণ, তোমাকে সারারাত এখানে পাহারা দিতে হবে।
সারারাত!
হ্যাঁ। আমার মনে হচ্ছে, রাত্রে এ বাড়িতে কেউ আসবে। মালপত্র হাতবদল করবে।
কেউ যদি মোটরে আসে, আমি একলা কি করতে পারি?
ইন্সপেক্টর অভয় দিল: তুমি একলা নও, রাত বারোটা নাগাদ জীপে করে থানার ছোটবাবু আসবে। তার সঙ্গে পুলিশও থাকবে।
তুলসীচরণ ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করল।
জীপ বেরিয়ে গেল।
পরের দিন ছোটবাবু ইন্সপেক্টরের সঙ্গে দেখা করল।
ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করল, কি সেন, কি খবর?
ছোটবাবু মাথা নেড়ে বলল, না, কোন খবর নেই। সাড়ে আটটা বাজতেই বাতি নিভে গেল। ব্যস, সব চুপচাপ। মশার কামড়ে আমাদের প্রাণ যায়। সকাল আটটা পর্যন্ত ছিলাম। মনে হল, ভদ্রলোক তখনো ঘুমোচ্ছে। বেচারামকে পাহারায় রেখে চলে এলাম।
বাড়ির পেছন দিকে খোঁজ নিয়েছ?
হ্যাঁ, নিয়েছি। সেদিকটা জঙ্গল। সেদিক দিয়ে কেউ গেছে বলে মনে হল না।
আশ্চর্য! অথচ যে লোকটা খবর দিয়েছে, সে মোটেই বাজে লোক নয়। এর আগে অনেক দামী খবর দিয়েছে। আর এ কেসে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমরা বাড়িতে ঢুকে পড়লাম, কিন্তু কিছুই পেলাম না!
বেলা বাড়তে ইন্সপেক্টর বেরিয়ে পড়ল।
ইন্ডিয়ান কিউরিও হাউস। ইন্সপেক্টর দরজা ঠেলে ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে গেল।
প্রৌঢ় পার্শী ভদ্রলোক পুলিশের লোক দেখে একটু শঙ্কিত হয়ে পড়ল: কি ব্যাপার?
আপনাদের এখানে অতনু গুপ্ত কাজ করেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, গুপ্ত আমাদের সেলস্ রিপ্রেজেনটেটিভ। খুব কাজের ছেলে—
গুপ্ত থাকেন কোথায়?
শহরের বাইরে। মামুদপুরে। তবে গুপ্ত মাসের বেশির ভাগ দিনই বাইরে কাটায়। বিহার, ইউ-পি, রাজস্থান।
কত দিন গুপ্ত আপনাদের এখানে কাজ করছেন?
প্রায় বছর চারেক।
তার আগে কোথায় ছিলেন?
তা জানি না। এত খোঁজ করছেন কেন বলুন তো?
ইন্সপেক্টর কোন উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে এল। সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। হিসাব মিলছে না।
পথের মধ্যে ইন্সপেক্টর নেমে পড়ল।
বরাত ভাল। বাইরের ঘরেই পারিজাত বক্সী বসেছিলেন। বিখ্যাত সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীর ভাইপো। ইন্সপেক্টরকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি বললেন, স্বাগতম! কি ব্যাপার, গরীবের কুটিরে?
বড় বিপদে পড়ে এসেছি।
তা জানি। সুসময়ে কে আর আমার খোঁজ নেয়! বলো, কি করতে পারি?
ইন্সপেক্টর চেয়ার টেনে বসল। বলল, ব্যাপারটা এমন কিছু জটিল নয়। খুব সোজা কেস, কিন্তু তদন্ত করতে গিয়ে কোন কিনারা পাচ্ছি না।
ইন্সপেক্টরের কাছ থেকে পারিজাত বক্সী মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন। শেষে বললেন, যে খবর এনেছে সে খুব বিশ্বাসী?
আবদুল খবর এনেছে। তার খবর এ পর্যন্ত ভুল হয়নি। সে বলেছে, মারিজুয়ানা আর হাসিস আমদানি করে যে দল, সে দলে অতনু গুপ্ত আছে। এবং সেদিন সে সুটকেশে ভরে মাল নিয়ে ওই পোড়ো বাড়িতে উঠেছে, এ একেবারে ধ্রুব সত্য। অথচ সার্চ করে আমরা কিছুই পাইনি।
পারিজাত বক্সী প্রশ্ন করলেন, অতনুবাবুর বাড়ির সামনে কোন পাহারা আছে?
হ্যাঁ, আছে। একজন কনস্টেবলকে মোতায়েন রেখেছি।
বাড়িটা ঠিক কোন্ জায়গায় আমাকে বুঝিয়ে দাও তো—
ইন্সপেক্টর নক্সা একে বাড়ির অবস্থান বুঝিয়ে দিল।
পারিজাত বক্সী বললেন, ঠিক আছে, আমি একবার সরেজমিনে তদারকে যাব।
আমার থাকার দরকার আছে?
না, না, তোমার কনস্টেবল আমাকে ঠিক চিনবে। আমি ছদ্মবেশে যাব না।
ইন্সপেক্টর নমস্কার করে বেরিয়ে গেল।
পারিজাত বক্সী কাজের ভার নিলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। অদ্ভুত বিচক্ষণ শক্তি, অনুধাবন ক্ষমতা, অপরাধতত্ত্বের সব কিছু নখদর্পণে। পুলিশকে বহুবার সাহায্য করেছেন। খোদ বড়কর্তা থেকে সাবইন্সপেক্টর পর্যন্ত কৃতজ্ঞ। মনে হয়, কালে ব্যোমকেশ বক্সীর সমকক্ষ হওয়া বিচিত্র নয়।
পরের দিন সকালে পারিজাত বক্সী মামুদপুরে গিয়ে হাজির। মোটর একটু দূরে রেখে হাঁটতে হাঁটতে পোড়োবাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। যে কনস্টেবল ডিউটিতে ছিল, সে এসে সেলাম করল। কি খবর, বাড়ির বাবু বের হন না?
হ্যাঁ, সাব, বেলা সাড়ে নটা নাগাদ বেরিয়ে পড়েন।
ফেরেন কখন?
অনেক রাতে।
উনি কোথায় যান খোঁজ রাখ?
ছোট দারোগাবাবু চৌরাস্তার পেট্রোলপাম্পে বসে থাকেন। বাবু ওখান থেকেই ট্যাক্সিতে ওঠেন। ছোট দারোগাবাবু জীপে তাকে অনুসরণ করেন। পার্ক স্ট্রীটের ‘মনোলীনা’ হোটেলে যান। সেখানে সাত নম্বর ঘর ওঁর নামে নেওয়া আছে। সারাদিন চুপচাপ হোটেলে নিজের রুমে বসে থাকেন। হোটেলেও আমাদের লোক পোস্টেড আছে।
পারিজাত বক্সী কিছু বললেন না। চিন্তা করতে লাগলেন, তাহলে লোকটা কিভাবে মাল পাচার করে? কোন ছিদ্রপথে?
হোটেলের রুমটাও নিশ্চয় সার্চ করা হয়েছে।
কথাবার্তার মধ্যেই অতনু বের হয়ে এল।
পরনে শার্ট আর ফুল প্যান্ট। নিতান্ত সাধারণ চেহারা। কোনদিকে না চেয়ে হনহন করে রাস্তা ধরে চলতে আরম্ভ করল।
তার আগেই পারিজাত বক্সী আর কনস্টেবল ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করল।
অতনু পথের বাঁকে মিলিয়ে যেতে পারিজাত বক্সী বললেন: তাহলে রাত পর্যন্ত লোকটার তো ফেরবার সম্ভাবনা নেই। আমি একটু বাড়ির মধ্যে যাব। যদি কোন কারণে লোকটি ফিরে আসে, আমাকে হুইসিল বাজিয়ে জানিয়ে দিও।
কনস্টেবল ঘাড় নাড়ল।
পারিজাত বক্সী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হলেন। তাঁর ধারণা ছিল, দরজায় খুব দামী তালা লাগানো থাকবে। কিন্তু না, একেবারে সাধারণ তালা।
পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে পারিজাত বক্সী দু’ মিনিটে তালা খুলে ফেললেন।
ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক দেখলেন। তক্তপোষের ওপর বিছানা গোটানো। বিছানা খুঁজলেন তন্নতন্ন করে। আলনার জামা-কাপড় নেড়েচেড়ে দেখলেন। দেয়ালে একটা ফটো টাঙানো। জাঁদরেল চেহারার এক ভদ্রলোক। পাকানো গোঁফ। মিলিটারি পোশাক। বোধ হয়, অতনু গুপ্তর পূর্বপুরুষদের কেউ হবে।
পাশের ঘর একেবারে ফাঁকা। কোন জিনিসই নেই।
পারিজাত বক্সী কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। অতনু গুপ্তর এ বাড়ি থাকার রহস্য কি তাহলে? অন্য লোকের হাতে ‘মাল’ কিভাবে কখন পাচার করল?
কোণের দিকে ছোট টেবিল। তাতে দুখানা বই।
নিতান্ত কৌতূহলের বশে পারিজাত বক্সী বই-দুটো তুলে দেখলেন। একটা বই ‘পরলোক রহস্য’, অন্যটা ‘মৃত্যুর পর’। এ ধরণের লোকদের এ জাতীয় বই আকৃষ্ট করে, এটাই আশ্চর্য। মনে হল, অতনু গুপ্তর পরলোকতত্ত্বের প্রতি ঝোঁক আছে।
পারিজাত বক্সী বেরিয়ে এলেন।
এমন তো নয়, অতনু গুপ্ত ‘মাল’ আগেই সরিয়ে ফেলে, খালি সুটকেশ হাতে নিয়ে এখানে নেমেছে। স্রেফ পুলিশের চোখে ধূলো দেবার জন্য। ছোট সুটকেশটাই বা গেল কোথায়!
মনোলীনা হোটেল।
অতনু গুপ্ত বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল, নিজের রুমের সামনে, পেছনে নারীকণ্ঠ শুনে ফিরে দেখল।
অপরূপ সুন্দরী এক তরুণী। পরনে হালকা নীল শাড়ি, সেই রঙেরই ব্লাউজ। পাখির বাসার আকারে খোঁপা।
শুনছেন?
আমাকে বলছেন?
এখানে আর কে আছেন। আপনি তো এইমাত্র সিঁড়ি দিয়ে উঠলেন, তাই না?
হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
আমার ঘড়িটা ব্যান্ড ছিঁড়ে পড়ে গেছে।
সিঁড়িতে?
তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু এখন পাচ্ছি না।
আমি তো ঘড়ি-টড়ি দেখিনি।
কিছু মনে করবেন না। ঘড়িটা একজন আমাকে উপহার দিয়েছিল, তাই ঘড়িটা হারিয়ে মনটা বড় খারাপ হয়ে গেছে।
অতনু কি ভাবল, তারপর বলল, চলুন, আর একবার না হয় সিঁড়িটা খুঁজে আসি।
দুজনে সিঁড়ি দিয়ে নামল।
ভাল করে খুঁজল। ম্যাটিং-এর তলায়, রেলিংয়ের ফাঁকে। না, ঘড়ি কোথাও নেই। বয়, বেয়ারা থেকে শুরু করে নানা ধরণের লোক অনবরত ওঠা-নামা করছে, তাদের কেউ সরিয়ে ফেলেছে হয়তো।
তরুণীর মুখ বিষণ্ণ।
অতনু বলল, পাওয়া গেল না।
তরুণী স্নান হাসল, আমার অদৃষ্ট।
চা খাবার ঘণ্টা পড়ল।
অতনু বলল, চলুন, চা খেয়ে আসি।
তরুণী কিছু বলল না। অতনুকে অনুসরণ করল।
চায়ের টেবিলে দুজনে মুখোমুখি বসল।
অতনু জিজ্ঞাসা করল, আপনি কত নম্বরে থাকেন?
দু’নম্বর। আমি মাত্র কাল এসেছি। বাবা দিল্লী বদলি হয়ে গেলেন····আমি এখানে বি টি পড়ি। এ হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে বাবার অনেক দিনের আলাপ। তাই এখানে এসে উঠেছি।····আপনি?
আমি দিনের বেলা এ হোটেলে থাকি। এক কিউরিও প্রতিষ্ঠানের আমি প্রতিনিধি। এখান থেকে অনেকদূরে আমার বাড়ি। ক্রেতাদের পক্ষে অতদূরে যাওয়া সম্ভব নয়। তারা এই হোটেলে আমার কাছে আসে।
তরুণী উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল: কিউরিও? ওসবে আমার খুব আগ্রহ। দু’একটা দেখাবেন আমাকে?
নিশ্চয়। চা খেয়ে নিয়ে চলুন আমার রুমে।
অতনু তরুণীকে নিয়ে নিজের রুমে এল।
টেবিলের ওপর ছোট দুটো প্যাকেট।
চেয়ারের ওপর তরুণী বসল।
একটা প্যাকেট খুলে অতনু দেখাল।
টেরাকোটার সাতটা ঘোড়া। একটি লোক লাগাম ধরে আছে।
অতনু বলল, উড়িষ্যার এক শিল্পীর তৈরি। কোনারকের অনুকরণে। সাতটি ঘোড়া সাতটি রশ্মির প্রতীক। চালক অরুণদেব। খুব পুরোন জিনিস। মাটির তলা থেকে পাওয়া।
তরুণী মূর্তি নিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে পর্যবেক্ষণ করল। অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল।
তারপর অতনুর হাতে ফেরত দিয়ে বলল, চমৎকার জিনিস। এটার দাম কত।
অতনু হাসল: কিউরিওর কোন নির্দিষ্ট দাম থাকে না। ক্রেতা হিসাবে এর দাম। আমেরিকান মহিলা পাকড়াতে পারলে, হাজার টাকা দাম হতে পারে।
হাজার টাকা একটা মূর্তিতে? তাহলে তো আপনি বড়লোক।
হাজার টাকা তো আর আমি পাই না। আমার কমিশন দশ পার্সেন্ট।
দ্বিতীয় প্যাকেট খোলা হল। নটরাজ মূর্তি।
তরুণী বলল, এ মূর্তি কিন্তু সাধারণ। খুব দেখা যায়।
অতনু মাথা নাড়ল। বলল, প্রথম দৃষ্টিতে এ মূর্তি সাধারণ বলে মনে হলেও, পায়ের ভঙ্গিটা দেখলে বুঝতে পারবেন, সচরাচর যে নটরাজ মূর্তি আমরা দেখতে পাই, তাতে পায়ের ভঙ্গি এরকম নয়। সেই জন্যই এ মূর্তির আলাদা একটা কদর আছে। এটি পাওয়া গেছে ম্যাঙ্গালোরের কাছে। এক চাষার লাঙলের মুখে।
অনেকক্ষণ ধরে বিভিন্ন ধরণের মূর্তি নিয়ে দুজনে আলোচনা হল।
তরুণী বলল, মাঝে মাঝে এসে কিন্তু আপনাকে বিরক্ত করব।
অতনু হাসল। বলল, বিরক্তির কি আছে। দুপুরবেলা তো আমি থাকি। যখন খুশি চলে আসবেন।
আপনার রুমটা বেশ ঠাণ্ডা·····আমার রুমটার জানলা পশ্চিম দিকে বলে দুপুরের পর থেকেই গরম হয়ে ওঠে। পাখার হাওয়াও গরম। একেবারে পড়াশোনা করতে পারি না।
আপনি যখন প্রয়োজন মনে করবেন, এ ঘরে চলে আসবেন। আমার কাছ থেকে চাবি নিয়ে নেবেন।
তরুণী ধন্যবাদ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
অতনু জিজ্ঞাসা করল, আপনার নামটা কিন্তু জানা হল না।
আমার নাম শিপ্রা নাগ।
সেই শুরু। তারপর থেকে প্রতিটি দিন।
অতনু রোজই নতুন নতুন কিউরিও হোটেলে নিয়ে আসত। তারপর সাল, কুলুজী নির্ণয় চলত শিপ্রার সঙ্গে।
মাঝে মাঝে চাবি নিয়ে শিপ্রা এ রুমে চলে আসত। অতনুর অনুপস্থিতিতে। বইখাতা নিয়ে পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকত।
একদিন অতনু বলল, চলুন, কোথাও বেড়িয়ে আসি।
কোথায়?
কাছাকাছি কোথাও, তারপর রাত্রে কোন হোটেলে ডিনার খেয়ে নেব।
সলজ্জ ভঙ্গিতে শিপ্রা নিমরাজী হল।
দিন পনেরোর মধ্যে দুজনের মধ্যে মোহময় এক সম্পর্ক রচিত হল।
খুব সকালে অতনু হোটেলে চলে আসত।
বারান্দায় অতনু আর শিপ্রা পাশাপাশি বসত। চায়ের কাপ সামনে নিয়ে। দুপুরে অতনুর রুমে মজলিশ বসত দুজনের।
প্রায়ই এই হোটেলে, কিংবা বাইরে কোথাও ডিনার খাওয়া চলত।
পনেরো দিন পর মনোলীনা হোটেলের সামনে পুলিশের জীপ এসে দাঁড়াল। জীপ থেকে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টরের সঙ্গে একটি মাঝবয়সী ভদ্রলোক নামল। পেছনে তিনজন পুলিশ।
দুজন পুলিশ অতনুর রুমের সামনে দাঁড়াল।
মাঝবয়সী ভদ্রলোক আর পুলিশ ইন্সপেক্টর প্রথমে দু’নম্বর রুমে ঢুকল, তারপর বেরিয়ে অতনুর দরজায় করাঘাত করল।
অতনু দরজা খুলেই পিছিয়ে গেল। বলল, কি ব্যাপার?
পুলিশ ইন্সপেক্টর রুক্ষকণ্ঠে বলল, কি ব্যাপার, তাই জানতেই তো আপনার কাছে আসা।
তার মানে?
মানে, শিপ্রা দেবী কোথায়? মিস্টার নাগের মেয়ে?
এবার মাঝবয়সী ভদ্রলোক বলল, শুনলাম, আমার মেয়ের সঙ্গে আপনার খুব হৃদ্যতা ছিল। এখানকার বন্ধুরা দিল্লীতে আমাকে লিখেছিল। এখানে ওখানে দুজনকে একসঙ্গে দেখা যেত।
অতনু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমার সঙ্গে আলাপ ছিল। শিপ্রা বলেছিল, আপনি এলে আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে।
হুঁ, কিন্তু মেয়ে কোথায় আমার?
কাল দুপুরে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বলেছিল, সন্ধ্যাবেলা এক প্রফেসরের কাছে যাবে। আমার সঙ্গে দেখা হবে না। আজ সকালে অনেকক্ষণ বারান্দায় অপেক্ষা করেছিলাম, শিপ্রা আসেনি। দু’নম্বর রুমও দেখলাম তালা বন্ধ।
ঠিক এই সময় একজন পুলিশ ভেতরে ঢুকল: সাব, টেলিফোন।
পুলিশ ইন্সপেক্টর দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এল।
মিনিট দশেক পরে ইন্সপেক্টর যখন আবার অতনুর রুমে ঢুকল, তখন সে রীতিমত উত্তেজিত।
মিঃ নাগের দিকে ফিরে বলল, মিস্টার নাগ, বড় দুঃসংবাদ আছে।
দুঃসংবাদ?
হ্যাঁ, এইমাত্র লালপুর থানা থেকে খবর এল শিপ্রা নাগের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
সেকি!
মিঃ নাগ চেয়ারের ওপর বসে পড়ল। সারা মুখে রক্ত নেই। দুটি চোখ জলে ভেজা।
চলুন, আমরা এখনই বেরিয়ে পড়ি।
তারপর ইন্সপেক্টর অতনুর দিকে রোষকষায়িত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, মিস্টার গুপ্ত, আপনাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হলাম। যতক্ষণ না নিজের গতিবিধি সম্বন্ধে সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারবেন, ততক্ষণ আপনার মুক্তি নেই।
দুজন পুলিশ অতনুর দুপাশে গিয়ে দাঁড়াল।
সবাই জীপে উঠল।
শহরের বাইরে লালপুর থানা। সেখানে ইন্সপেক্টর কিছুক্ষণের জন্য নেমে গেল, তারপর এক পুলিশ সঙ্গে করে আবার উঠে এল।
পচা ডোবার পাশে জরাজীর্ণ একতলা বাড়ি।
সকলে নেমে গেল।
ইন্সপেক্টর জানলার ভাঙা খড়খড়ি দিয়ে দেখে নিয়ে বলল, আমাদের ভেতরে যাওয়া উচিত হবে না। ফোরেনসিক ডিপার্টমেন্টের লোক আসবে। তাছাড়া ধুলোতে পায়ের দাগ থাকাও বিচিত্র নয়। সেগুলো মুছে যেতে পারে।
সবাই খড়খড়ি দিয়ে দেখল। অতনুও।
একটা কড়িকাঠে দড়ি বাঁধা। শিপ্রা ঝুলছে। জিভ অনেকটা বেরিয়ে পড়েছে। দুটি চোখ বিস্ফারিত। ঠোঁটের দুপাশে রক্তের দাগ।
অতনুও চিৎকার করে উঠল: শিপ্রা!
ইন্সপেক্টর তীব্রকণ্ঠে বলল, খুব চমৎকার অভিনয় করতে পারেন তো? কিন্তু ওসব অভিনয়ে পুলিশের লোক ভোলে না। কাল হোটেল থেকে আপনারা দুজন বেরিয়েছেন, সে প্রমাণ আমাদের আছে। সন্ধান করে ট্যাক্সিওয়ালাকেও ধরেছি, সে স্বীকার করেছে আপনাদের লালপুর নিয়ে এসেছিল।····মিস্টার নাগ, আপনার মেয়ের গায়ে গহনা ছিল না?
হ্যাঁ, জড়োয়ার হার, চুড়ি ছিল।
এটা আত্মহত্যা নয়, হত্যা। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে সঠিক খবরই পাওয়া যাবে। নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, আপনার মেয়ের গায়ে কোন গহনা নেই। খুনের মোটিভ বোঝা গেল।
এবার অতনু রেগে উঠল; আপনারা মগের মুলুক পেয়েছেন নাকি? যা খুশি তাই করবেন!
ইন্সপেক্টরও গলার স্বর গম্ভীর করল: আপনার যা বক্তব্য কোর্টে বলবেন।
আমার উকিলের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।
বেশ, থানায় গিয়ে উকিলকে ফোন করবেন।
অতনুকে থানায় নিয়ে আসা হল। সেখান থেকে অতনু উকিল ভবতোষ মজুমদারকে ফোন করল। উকিল নেই। খবর দেওয়া হল, এলেই যেন থানায় অতনুর সঙ্গে যোগাযোগ করে।
বিকালে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এল। আত্মহত্যা নয়, হত্যা। কেউ গলা টিপে শিপ্রাকে মেরে ফেলেছে, তারপর তার গলায় মোম মাখানো দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে।
ফোরেনসিক ডিপার্টমেন্ট হাতের ছাপ তুলে নিয়েছে। পরের দিন সকালে তারা অতনুর হাতের ছাপ নিয়ে গিয়ে মেলাবে। সেই সময় অতনুর জুতোর ছাপও নেবে।
ইতিমধ্যে ভবতোষ মজুমদার এসে দেখা করল। অনেকক্ষণ অতনুর সঙ্গে কথা হল। সঙ্গোপনে।
তারপর উকিল বলল, কত টাকার জামিন হলে ছাড়তে পারেন?
ও-সি মাথা নাড়ল: তিনশ’ দু’ধারার কেস নন-বেইলেবল। জামিন চলে না।
আপনারা তো শুধু সন্দেহ করছেন।
খুনের কেসে প্রত্যক্ষ সাক্ষী খুব কমই থাকে। পরোক্ষ সাক্ষী অনেক আছে। তাছাড়া ফোরেনসিক ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত ছাড়বার প্রশ্নই ওঠে না।
আমি তাহলে কোর্টে দরখাস্ত করব।
স্বচ্ছন্দে।
ভবতোষ মজুমদার বেরিয়ে গেল।
থানার পেছনে অন্ধকার এক ঘরে অতনুকে রাখা হল। খড়ের বিছানা। এককোণে জলের কুঁজো।
খাওয়া হয়ে যেতে অতনু দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসল। দূরে পেটা ঘড়িতে বারোটা বাজার শব্দ। অতনুর চোখে ঘুম নেই। এ কি বিপদে সে পড়ল?
মনে হচ্ছে তাকে ঘিরে বিরাট একটা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত করা হয়েছে। এ থেকে উদ্ধার পাওয়া মুশকিল।
হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ।
অতনু চমকে মুখ ফেরালো, তারপরই মেরুদণ্ডে শীতল একটা শিহরণ অনুভব করল। কোণের দিকে দরজার কাছে শিপ্রা নাগ দাঁড়িয়ে।
একি, তুমি বেঁচে আছ?
শিপ্রা মাথা নেড়ে বলল, না, আমি বেঁচে নেই। আমার এক পুরোনো প্রেমিক ঈর্ষার বশে আমাকে হত্যা করেছে।
কিন্তু আমি যে জড়িয়ে পড়েছি।
জড়িয়ে পড়েছ কারণ তুমি মিথ্যাবাদী।
মিথ্যাবাদী!
নিশ্চয়। তুমি নেশার জিনিসের চোরাকারবারী, সেকথা আমার কাছে লুকিয়েছ।
অতনু ভ্রূ কুঞ্চিত করল: বাজে কথা।
বাজে কথা! আমি এখন যে-লোকে রয়েছি, সেখানে আমাদের অগোচর কিছু নেই—থাকতে পারে না। আমি জানি, তুমি মারিজুয়ানা, হাসিস আর কোকেনের এক বিরাট আন্তর্জাতিক চোরাকারবারী দলের সঙ্গে জড়িত। ঠিক কিনা বল?
অতনু কোন কথা বলল না।
বারবার শিপ্রা একই প্রশ্ন করল; কিন্তু অতনুর কাছ থেকে কোন উত্তর পেল না।
পর পর তিনদিন একই ব্যাপার।
ক’দিনেই অতনুর চেহারা অর্ধেক হয়ে গেল। চোখের কোলে কালি, নীরক্ত ঠোঁট।
এরপর ফোরেনসিক ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টও এসে গেল।
শিপ্রার গলায় অতনুর হাতের ছাপ। ঘরের মেঝেয় জুতোর ছাপের সঙ্গে অতনুর জুতোর ছাপের কোন তফাৎ নেই।
রিপোর্ট অতনুকে শোনানো হল।
বিস্ফারিত চোখে, বিবর্ণ মুখে অতনু সব শুনল। সে-রাত্রে সে আহার্য স্পর্শ করল না।
মাঝরাতে শিপ্রা এসে দাঁড়াল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, তোমাকে ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচানো আর সম্ভব নয়।
আর সম্ভব নয়?
কি করে সম্ভব হবে? আমি যা প্রশ্ন করেছিলাম, তুমি তার উত্তর দিলে না—
কিন্তু একটার সঙ্গে আরেকটার সম্পর্ক কী? তুমি তো ভালই জানো, আমি তোমার হত্যাকারী নই। তবে আমাকে বাঁচাবে না কেন?
বাঁচাব না, কারণ তুমি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছ।
এখন যদি আমি স্বীকার করি, তাহলে?
তাহলে হত্যার অপরাধ থেকে তোমাকে আমি বাঁচাব।
আর হাসিস নিয়ে কারবারের ব্যাপারে?
তুমি হাসিস কোথায় লুকিয়ে রেখেছ বল, সেখান থেকে হাসিস আমি সরিয়ে ফেলব। কেউ তোমায় ধরতে পারবে না।
কিন্তু তুমি যদি সবই জানো, তাহলে কোথায় হাসিস লুকিয়ে রেখেছি, তা তো তোমার অজানা থাকার কথা নয়—
শিপ্রা একটু দম নিল, তারপর বলল, কিছুটা বায়ুমণ্ডল পর্যন্ত আমরা জানি। মামুদপুর আমার এলাকা নয়, তাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি।
তুমি ঠিক আমাকে বাঁচাবে?
আমরা মিথ্যা বলি না।—শিপ্রার কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ।
মামুদপুরে যে ফটো টাঙানো আছে, তার পেছনে হাসিস আছে।
সুটকেশ—সুটকেশ কোথায়?
ও সুটকেশ খোলা যায়। খুললে চাদরের মতন হয়ে যায়। প্রথম দিন আমি লুঙ্গির মধ্যে পরেছিলাম, ইন্সপেক্টর টের পায়নি; কারণ আমার বডি সার্চ করেনি। তারপর এক সময় কোটের মধ্যে করে মনোলীনা হোটেলে এনে রেখেছিলাম। পুলিশ আমার পেছনে লেগেছে বলে এতদিন হাসিস আমি পাচার করতে পারিনি। নাহলে মূর্তির মধ্যে কবে খদ্দেরের হাতে চলে যেত।
শিপ্রা হাসল। বলল, অশেষ ধন্যবাদ।
পারিজাত বক্সীর বাইরের ঘরে ইন্সপেক্টর রায় বসেছিল। এদিকের সোফায় শিপ্রা নাগ।
পারিজাত বক্সী হাসলেন।
স্বীকার করি পদ্ধতিটা কিঞ্চিৎ গ্রাম্য হয়ে গেল। বিশেষ করে এই ফোরেনসিক যুগে। অতনুর ঘরে পরলোকতত্ত্ব সম্বন্ধে দু’খানা বই দেখে মতলবটা আমার মাথায় এসেছিল। শিপ্রা আমার শালী। ওর আসল নাম বিজয়া। শখের অভিনয়ে খুব নাম করেছে। ওকে কাজে লাগালাম। অতনুকে কাবু করতে ওর বিশেষ দেরি হল না। চোরাকারবারীই হোক, আর খুনীই হোক, এক জায়গায় সবাই দুর্বল। তারপর শিপ্রা ওকে প্রায়ই বলত, আমাদের মধ্যে যে আগে মারা যাবে, সে আরেকজনকে দেখা দেবে।
পরের ব্যাপারটা খুব শক্ত নয়।
কৃষ্ণনগরের হেমন্ত পালকে দিয়ে শিপ্রার মূর্তি তৈরি হল। দেখেছ তো কি অদ্ভুত জীবন্ত মূর্তি রক্তের দাগ, মুখের চেহারা সব কি স্বাভাবিক! আলোছায়ার রহস্যের মধ্যে সে-মূর্তি দেখে আমারই ভ্রম হচ্ছিল।
তাছাড়া, পোস্টমর্টেম আর ফোরেনসিক রিপোর্ট সব জাল। কিন্তু তাতে খুব কাজ হল। অতনু গুপ্ত একেবারে ভেঙে পড়ল। আমার নিজেরও ধারণা হয়েছিল যে কিউরিও মারফত চোরাই জিনিস এদিক-ওদিক চালান দেওয়া হয়। তাই শিপ্রা ভাব করে অতনুর কাছ থেকে রুমের চাবি জোগাড় করেছিল।
অতনুর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সবকিছু তল্লাসী করেছে। মূর্তিগুলোও, কিন্তু কিছু পায়নি।
তারপর শিপ্রার প্রেতাত্মার আবির্ভাব। কয়েকদিন সুবিধা হল না, তারপর অতনু ভেঙে পড়ল। তার স্বীকারোক্তি সবই টেপ-রেকর্ডে ধরা হয়েছে। কাজেই সেদিক দিয়ে কোন অসুবিধা হবে না!
ইন্সপেক্টর রায় জিজ্ঞাসা করল, হাসিস?
মামুদপুরে অতনুর ঘরে মিলিটারি পোশাকে যে ফটোটা ছিল, যেটা আমরা ভেবেছিলাম অতনুর পূর্বপুরুষের ছবি, তার মধ্যেই সব পাওয়া গেছে। ছবিটা ফাঁপা। ছবির পোশাকের মধ্যে বেশ ফাঁক, সেখানে হাসিস সাজানো। পিজবোর্ড ভাঙতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল। পারিজাত বক্সী দাঁড়িয়ে উঠলেন। হেসে বললেন, এবার আমার কাজ শেষ। তোমাদের কাজের শুরু। দেখ, যদি জেরার মুখে অতনু অন্য সঙ্গীদের নাম করে। তবে সে সম্ভাবনা কম।