গেলির প্রবেশ

গেলির প্রবেশ

সম্পূর্ণ অচিন্তনীয়, অবিশ্বাস্য অতিপ্রাকৃত বা মিরাই বলা যেতে পারে।

নিতান্ত একটি চিংড়ি (চ্যাংড়ার স্ত্রীলিঙ্গ) মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এলেন হিটলার তাঁর অন্যতম ক্যাফেতে। অতি দ্রভাবে সে সবাইকে নমস্কারাদি করল। সে তো স্বাভাবিক। কিন্তু তাজ্জব। কি বাৎ। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতে তাবৎ কথাবার্তা সে-ই বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে ওদিকে এতই বিবেচনা ধরে যে একে কথা বলতে দেয়, ওকেও কথা বলতে দেয়, কাউকে অস্বাভাবিক আড়ষ্ট হতে দেয় না– সবাই, ইংরেজিতে যাকে বলে ভেরি মাচ্ অ্যাট ইজ– কিন্তু সব মন্তব্য, সব আলোচনা ঘুরেফিরে যায় ওই মেয়েটিরই কাছে।

আর অতিপ্রাকৃত, মিরা হল এই যে, স্বয়ং হিটলার চেয়ারে আরামসে হেলান দিয়ে সুমধুর পরিতৃপ্তির মৃদুহাস্য বদনমণ্ডলে ছড়িয়ে দিয়ে বসে আছেন।

হিটলারকে যখনই তার চেয়ে বয়সে বড় মুরুব্বিস্থানীয় পার্টি মেম্বরেরা শুধোতেন, বয়েস তো হল, বিয়ে-শাদির কথা–

হিটলার বাধা দিয়ে বলতেন, জর্মনি আমার বধূ!

ঠাট্টাছলে বললেও এর ভেতর যে অনেকখানি সত্য লুক্কায়িত আছে সে তত্ত্বের কিছুটা সে-সব মুরুব্বিরা জানতেন। নইলে এ-জাতীয় প্রশ্ন ব্যক্তিগত জীবনে দ্বিরদরদ-নির্মিত শিখরবাসী হিটলারকে জিগ্যেস করবে কে? কারণ তারা এবং পার্টির অন্য সবাই জানতেন, হিটলার জাত-ব্যাচেলার। তা সে ভিয়েনিজ কেতায় সুন্দরীদের সামনে যতই গ্যালানট্রি, শিভালরি দেখান না কেন, রমণীদের কথা উঠলে টেবিলে দু হাত রেখে, সুমুখের দিকে ঝুঁকে যতই সিরিয়াসলি তিনি কোথায় কোন সুন্দরী রমণী দেখেছেন, যে বেভারিয়াকে তিনি এত ভালোবাসেন যে আপন মাতৃভূমি ত্যাগ করে এখানে এসে স্থায়ী আবাস নির্মাণ করেছেন সেই বেভারিয়া মায় তার মুনিক সুন্দরীর ব্যাপারে যে ভিয়েনার কাছেই আসতে পারে না– এসব নিয়ে যত ধানাইপানাই তিনি করুন না কেন, পার্টির উঁচু মহলের প্রায় সবাই জানতেন যে হিটলারের পক্ষে কোনও সুন্দরীকে নিয়ে পার্টির অতি সঙ্কীর্ণ গণ্ডির ভেতর কিছুটা ঢলাঢলি বরঞ্চ সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়, কিন্তু বিয়ে করে বউ কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে ঘর বাঁধবার মতো মানুষ হের হিটলার নন। মাঝে মাঝে তাকে এ মন্তব্যও করতে শোনা গেছে : সুন্দরীদের ভালোবাসব না– সে কী? আমি কি এতই রসকষ বর্জিত আকাট! যা বলুন, যা কন্ আপনারা তো জানেন, আমার সত্তার অন্তস্তলে যে পুরুষ লুকানো আছে তিনি আর্টিস্ট! এবং আমি ফুলও ভালোবাসি কিন্তু তাই বলে কি আমাকে বাগানের মালী হতে হবে? প্রায় এ সত্যটিই চার্লস ল্যাম্ বলেছেন, আমার ঘরে ফুল নেই কেন, শুধদচ্ছেন? আমি কি ফুল ভালোবাসিনে? নিশ্চয় বাসি। আমি শিশুদেরও ভালোবাসি তাই বলে তাদের মুণ্ডুগুলো কেটে ঘরের ভেতর ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখিনে। আর এ বিষয়ে পরিপূর্ণ সত্যের শেষ শব্দটি বলতে হলে বাংলা প্রবাদেরই শরণাপন্ন হতে হয়;– বাজারে যখন দুধ সস্তা তখন গাই পোর কি প্রয়োজন?

পূর্বেই বলেছি, সত্যকার অন্তরঙ্গ বন্ধু হিটলারের কেউ ছিল না। তবু মোটামুটি যাকে বন্ধু বলা যেতে পারে তিনি তার ফোটোগ্রাফার হফমান। একে তিনি এই প্রসঙ্গে খাঁটি বৈষয়িক তত্ত্বকথাটি বলেন, জর্মনিকে গড়ে তোলা আমার জীবনের একমাত্র কাম্য, আদর্শ! একবার আমার জেল হয়েছে, আবার যে কোনও মুহূর্তে আমার ছ বছরের জেল হতে পারে। তখন বউ-বাচ্চা বাইরে, আমি গরাদের ভেতর। এটা কি খুব বাঞ্ছনীয় পরিস্থিতি?

তবু বেশিরভাগই এই নবাগতা সুন্দরী, ব্লন্ডিনী, মধুরভাষিণী, আত্মসচেতন, অথচ বিনয়ী মেয়েটিকে দেখে, (এবং বিশেষ করে লক্ষ করে যে হিটলার কফি-চক্রের চক্রবর্তীর সম্মানিত আসন সানন্দে তাকে ছেড়ে দিয়েছেন। ভাবলেন, তবে কি হিটলারের জর্মনি আমার বধূ নীতিটি পরিবর্তন করার সময় এসেছে?

মেয়েটির নাম আঙেলিকা রাউবাল। হিটলারের সৎবোনের মেয়ে ভাগ্নি। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে কিঞ্চিৎ অসুবিধা আছে সত্য কিন্তু তেমন কোনও অলঙ্ঘ্য আপ্তবাক্যপ্রসূত নিষেধ নেই।(১) মেয়েটির মা বিধবা, সামান্য যে পেনশন পায় তাতে দুই কন্যাসহ জীবনযাপন সহজ নয়; এদিকে যে ছোট বৈমাত্রেয় ভাই অ্যাডলকে তার বহু দোষ– তার মারাত্মক গোটা তিনেক পূর্বেই নিবেদন করেছি– থাকা সত্ত্বেও তাকে ছেলেবেলা থেকেই গভীরভাবে স্নেহ করেছে, সেই অ্যাডলফ এখন সচ্ছল হওয়ার দরুন আপন জন্মভূমি অস্ট্রিয়ার কাছেই সীমান্তের লাগোয়া অঞ্চলে মুনিক থেকে একশো মাইল দূরে বেৰ্ষটেশগাডেনে বাড়ি কিনে তাঁকে অনুরোধ করেছে সীমান্তের এপারে এসে সে বাড়ির জিম্মা নিতে। বেচারা অ্যাডলফুকে বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয় মুনিক শহরে রাজনীতি নিয়ে, সময় পেলে ওই গ্রামের নতুন বাড়িতে গিয়ে যেন একটুখানি আরাম পায়। তদুপরি এ তথ্য সর্বজনবিদিত যে, আঙেলিকা রাউবালের মা, হিটলারের এই সৎবোনটি যেমন বাড়ি চালাতে জানে, অতিথিসজ্জনের সেবা করাতে নিপুণা, তেমনি পাচিকারূপে সমস্ত নগরীতে অতুলনীয়া।(২) স্বভাবতই সঙ্গে নিয়ে এলেন দুই মেয়েকে। এদের বড়টিই আঙেলিকা বা গেলি।

মেয়েটি যে অসাধারণ সুন্দরী ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এর সম্বন্ধে এবং মামা অ্যাডফের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক ছিল সে সম্বন্ধে একাধিক লেখক আপন আপন মতামত দিয়েছেন। এর ভেতর দুজন দুই মত পোষণ করেন, এবং পঁয়ত্রিশ বছর পর আজ সত্য নিরূপণ করা অসম্ভব। তবে দু-জনাই একমত যে, ওই গেলি-ই হিটলারের ওয়ান গ্রেট লাভ! এঁদের একজন হিটলারের ফোটোগ্রাফার বন্ধু হাইনরিষ হন। হিটলারের মৃত্যুর দশ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ইনি হিটলার সম্বন্ধে একখানা বই লেখেন। বইখানার নাম হিটলার উয়োজ মাই ফ্রেন্ড ইংরেজি অনুবাদে। বলা বাহুল্য যে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দেও তিনি সব কথা প্রাণ খুলে বলতে পারেননি। তবে একথা সত্য, সব তত্ত্ব গ্যাস-চেম্বারে ইহুদি পোড়ানো ইত্যাদি জেনে-শুনেও তিনি হিটলারের নিন্দার চেয়ে প্রশংসাই করেছেন বেশি– তবে এ কথাও বলে রাখা ভালো, রাজনৈতিক ব্যাপারে হফমানের কোনও চিত্তাকর্ষণ ছিল না, ওই বিষয়, যুদ্ধবিগ্রহ, কনসেট্রেশন ক্যাম্প ইত্যাদি নিয়ে দুই বন্ধুতে আলোচনা হত খুবই কম। ফটোগ্রাফার হলেও হফমান উত্তম উত্তম ছবির কদর ও সন্ধান জানতেন, এবং হিটলারেরও রুচি ছিল স্থাপত্যে, চিত্রে ও ভাস্কর্যে। দু-জনার আলাপ-আলোচনা হত আর্ট নিয়ে।

অন্যজনের নাম পুৎসি হানফস্টেঙেল। এঁর বইয়ের নাম আনহার্ড উইটনেস্। হিটলার যখন মুনিকে তার দল গড়ে তুলতে আরম্ভ করেন তখন উভয়ের পরিচয় হয়। পুৎসি বিত্তশালী খানদানি ঘরের ছেলে বলে তিনি হিটলারকে নানাভাবে সাহায্য করতে সক্ষম হন। হিটলার ফুরার হওয়ার পরও বেশ কিছুকাল তিনি দরবারে আসা-যাওয়া করতেন এবং প্রায়ই নিভৃতে হিটলারকে পিয়ানো বাজিয়ে শোনাতেন। শেষ পর্যন্ত তিনি দরবারের কূটনৈতিক মারপ্যাঁচে হেরে যান এবং সুইটজারল্যান্ডে পালিয়ে গিয়ে সেখানেই ঘর বাঁধেন। ইনি তাঁর পুস্তকে হিটলার এবং গেলি উভয়েরই বিরুদ্ধে প্রচুর বিষোদগার করেছেন। তাঁর মতে গেলি অতিশয় সাধারণ আর পাঁচটা মেয়ের মতো ফ্লার্ট করার জন্য আকুল, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রসিদ্ধ ইংরেজ ঐতিহাসিকরা হিটলার সম্বন্ধে আপন আপন বই লেখার পর, এই দু-জনার বই বেরিয়েছে এবং ইংরেজ ঐতিহাসিকদের ধারণা হফমানের কাছাকাছি। তা সে যা-ই হোক, এ কথা সত্য হিটলার তার ভাগ্নিকে নিয়ে ক্যাফেতে যেতেন এবং আগে কাজের চাপে সিনেমা, থিয়েটার, অপেরায় অল্প যেতেন– এখন গেলির চাপে সেগুলো বেড়ে গেল। কিন্তু আসলে হিটলার সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন গেলিকে মোটরে করে নিয়ে পিকনিক করতে–মুনিকের চতুর্দিকে পিকনিকের জন্য অত্যুৎকৃষ্ট স্থল বিস্তর। পাহাড়, উপত্যকা, হ্রদ, নদী, বনফুলে ভর্তি মোলায়েম ঘাসের ঢালু মাঠ, মহান বনস্পতি–কোনও বস্তুরই অভাব নেই। হফমান পরিবার প্রায়ই সঙ্গে যেতেন।

সোজা বাংলায় বলতে গেলে হিটলার এই কুমারীকে যেন দেবতার আসনে বসিয়ে পুজো করতেন। এবং তাই লোকজনসমক্ষে তিনি কখনও বে-এক্তেয়ার হয় এমন কোনও আচরণ করেননি যা মুগ্ধ প্রণয়ী ইয়োরোপে মাঝে মাঝে করে থাকে। গেলির কণ্ঠস্বর মিষ্ট ছিল, হিটলার সে স্বর তালিম দিয়ে অপেরার জন্য গেলিকে তৈরি করতে চাইলেন এবং উপযুক্ত গুরু নিয়োগ করলেন। পুৎসি বলেন অন্য কাহিনী। তিনি বলেন, মেয়েটা ছিল অত্যন্ত বাজে ফ্লার্ট টাইপের। অপেরায় উপযুক্ত কণ্ঠস্বর প্রস্তুত করতে হলে যে রেওয়াজ এবং বিশেষ করে যে কঠোর অধ্যবসায়ের প্রয়োজন ছিল, গেলির চরিত্রে তার কণামাত্র উপাদান ছিল না। প্রায়ই গুরুকে ফোন করে রেওয়াজ নাকচ করে দিত এবং এই ফাঁকে ফ্লার্ট করার তালে লেগে যেত। পুৎসির মতে শেষ পর্যন্ত গানের ক্লাস সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

তবে এ-কথা সর্বদীসম্মত যে, ভিয়েনায় যে গুরুর কাছে গেলি সর্বপ্রথম গান গাইতে শেখা আরম্ভ করে সে তার কাছে ফিরে যেতে চাইত। জনশ্রুতি এ-কথাও বলে, সেখানে নাকি গেলির দয়িত বাস করত।

এবং ঠিক এইখানেই ছিল হিটলারের ঘোরতর আপত্তি। শুধু তাই নয়, যদিও গেলিকে খুশি করার জন্যে হিটলার সবকিছুই করতে রাজি ছিলেন– যেমন গেলির সঙ্গে টুপিজুতো কিনতে যাওয়ার মতো মারাত্মক একঘেয়ে ঘষ্টানিও তিনি বরদাস্ত করে নিতেন (হিটলার নিজেই বলেছেন, গেলির সঙ্গে হ্যাট টুপি কাপড় কিনতে যাওয়ার চেয়ে কঠিনতর অগ্নিপরীক্ষা ত্রিসংসারে আর নেই। আধঘণ্টা একঘণ্টা ধরে দোকানের মেয়েকে দিয়ে বস্তার পর বস্তা কাপড় নামাবে, তার সঙ্গে সে-সব নিয়ে প্রাণ ঢেলে দিয়ে আলোচনা করবে। এবং শেষ পর্যন্ত কিছুটি না কিনে গট গট করে বেরিয়ে চলে যাবে অন্য দোকানে। হিটলার ততক্ষণ বোধহয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা বসে বসে আঙুলের নখ কামড়াতেন, কিন্তু যাই করুন আর নাই করুন, তার পরের বারও বাছুরছানাটির মতো গেলির সঙ্গে কেনা-কাটা করতে যেতেন ঠিকই) কিন্তু একটা বিষয়ে তিনি অচল অটল। তার অনুমতি ভিন্ন গেলি যার-তার সঙ্গে আলাপচারী করতে পারবে না। এমনকি পরিচিতজনের সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ার্কিও চলবে না। এবং এই ফরমান যে কত সুদূরপ্রসারী সেটা স্বয়ং গেলিও জানত না।

গেলি অবশ্যই জানত হিটলার তাকে ভালোবাসেন, তার প্রেমমুগ্ধ, সে প্রেম যে কত অতল গভীর সে সম্বন্ধে বেচারীর কোনও ধারণাই ছিল না। একদিন সেটা সে বুঝতে পারল রীতিমতো ভীতশঙ্কিত হয়ে।

হিটলারের পার্টির সদস্যগণ যে যে কাজই করুন না কেন, সমাজে তাদের যে স্থানই হোক না কেন, পার্টির ভেতর একটা প্রশংসনীয় সাম্যবাদ ছিল। হিটলারের মোটর ড্রাইভার এমিল মরিস ছিল প্রাচীন দিনের পার্টি মেম্বার। সে একদিন কাঁপতে কাঁপতে হফমানের সামনে এসে বলল, সে গেলির সঙ্গে ঠাট্টাটুটি করছিল, এমন সময় হঠাৎ হিটলার ঘরে ঢুকে রেগে, জিঘাংসায় যেন সর্ব আত্মকতত্ত্ব হারিয়ে চিৎকারের পর চিৎকারে মরিসকে গালাগাল দিতে আরম্ভ করেন। মরিস তো রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে ভাবল, হিটলার যে কোনও মুহূর্তে পিস্তল বের করে গুলি চালাতে পারেন। ঘটনাটি হফমানকে বলার সময় সে তখনও ভয়ে কাঁপছে।

হফমানের মতে গেলি ছিল পূত, পবিত্র, পুষ্পটির মতো। তিনি বলেন, অপরাধ তার দিক দিয়ে নিশ্চয়ই কিছু ছিল না। কিন্তু মরিসটি ছিলেন ঈষৎ নটবর। কিন্তু সে-ও যে ফুরারের ভাগ্নির সঙ্গে বাড়াবাড়ি করবে সেটা অবিশ্বাস্য। করতে গেলে বহু পূর্বেই মরিসের বন্ধুবান্ধব তাকে এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন করে দিত।

হিটলারের শত্রুর অভাব কোনওকালেই ছিল না। এমনকি তাঁর প্রধান শত্রু কম্যুনিস্ট দলের কিছু কিছু সদস্য পার্টির আদেশ অনুযায়ী নাৎসি মেম্বারশিপ নিয়ে হিটলারের কার্যকলাপ লক্ষ করে যথাস্থানে তাদের রিপোর্ট পাঠাত। এদের তো কথাই নেই, আরও কেউ কেউ বলেন, সমস্ত ব্যাপারটা এতখানি ধোয়া তুলসীপাতা ছিল না।(৩) তা সে যাই হোক, হিটলার আত্মকর্তৃত্ব ফিরে পেলেন বহু কাল পরে–ইতোমধ্যে মরিস গা-ঢাকা দিয়ে থাকত– হঠাৎ সামনে পড়ে গেলে তুলকালাম কাণ্ড লেগে যেত।

ইতোমধ্যে আরেকটা কাণ্ড ঘটে গেল। হিটলার প্রপাগান্ডা-সফরে বেরুলে গেলি মায়ের কাছে, হিটলারের গ্রামের বাড়িতে চলে যেত। বোধহয় তারই কোনও এক সময়ে হিটলার প্রিয়া গেলিকে একখানা চিঠি লেখেন– সেটাতে নাকি যৌনসম্পর্ক সম্বন্ধে হিটলার অতিশয় প্রাঞ্জল শত্রুপক্ষের অভিমতে– অশ্লীল ভাষায় আপন কাম্য আদর্শ যৌনসম্পর্ক সম্বন্ধে অভিমত প্রকাশ করেন। যৌনবিজ্ঞানীরা বলেন অত্যাচারী শাসকদের (টাইরেন্ট) অনেকেই নাকি মাজোকিস্ট হয়ে থাকেন–অর্থাৎ স্বাভাবিক যৌনসঙ্গমের পরিবর্তে উলঙ্গ রমণী সে স্থলে পুরুষকে তীব্র কশাঘাত করে, কিংবা তলায় সূক্ষ্ম লোহা লাগানো রাইডিং বুট পরে পুরুষের স্কন্ধোপরি ঘন ঘন বুটাঘাত করে, তবেই নাকি পুরুষ তার যৌনানন্দ পায়(৪) শত্রুপক্ষের মতে হিটলারের চিঠি মাজোকিস্ট দর্শন(!) বিবৃত করেছিল। সে চিঠি নাকি দুর্ভাগ্যক্রমে পড়ে যায় অন্য লোকের হাতে। অতি কষ্টে, বহু অর্থ নিয়ে (বলা হয় পার্টি ফান্ড থেকে) এক ক্যাথলিক পাদ্রি–ইনি তাঁর ইহুদি-বিদ্বেষ নাৎসি পার্টিতে যোগ দিলে কার্যে পরিণত করতে পারবেন এই আশায় পার্টিতে যোগ দেন- তারই বিনিময়ে চিঠিখানা কিনে নেন। (কথিত আছে, ৩০ জুন ১৯৩৪-এ হিটলার যখন বিনা বিচারে এক তথাকথিত বিদ্রোহী দলের নেতা র্যোম, হাইস্ ইত্যাদিকে গুলি করে মারবার আদেশ দেন তখন সেই মোকায় আরও জনা চারশোর সঙ্গে এই ফাদার স্টেমপফুলে-কেও খুন করা হয়। তার দোষ তিনি ওই চিঠির সারমর্ম স্বমস্তিষ্কে সীমাবদ্ধ না রেখে দু-একজন অন্তরঙ্গ পার্টি মেম্বারকে বলে ফেলেন। হিটলার-সখা হফমান অবশ্য এ চিঠির উল্লেখ করেননি বরঞ্চ স্টেপলে ও অন্যান্য নাৎসি নেতা নিহত হওয়ার কয়েকদিন পর হিটলারের সঙ্গে যখন দেখা করতে যান তখন তাকে দেখামাত্রই নাকি হিটলার বলে ওঠেন, জানো হফমান, শুয়োরের বাচ্চারা আমার প্যারা ফাদারকেও খুন করেছে! অবশ্য এ কথা সত্য যে, জুন ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে হিটলারের আদেশে যে পাইকারি খুন জুন পাৰ্জ বা জুন মাসের জোলাপ হয়–এ লেখক তখন জর্মনিতে ও ধুন্ধুমারের যতখানি আর পাঁচটা রাস্তার নাগরিক দেখতে পেয়েছিল, সে-ও পেয়েছে, কিন্তু সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর হিটলার জাতির সম্মুখে যখন আপন সাফাই গেয়ে বক্তৃতা করলেন, তখন আর পাঁচজন নাগরিকের মতো সে সেটা বিশ্বাস না করে অবিশ্বাস করেছিল এবং পরবর্তী ইতিহাস-উদঘাটন লেখককেই সমর্থন করে তখন গ্যোরিং, হিমলার আদেশদাতা হিটলারকে না জানিয়ে, পরে মিথ্যে অভিযোগ এনে, আপন আপন ব্যক্তিগত শত্রুও খতম করেন। কোনও কোনও ঐতিহাসিক বলেন, ফুরারের গোপনীয় কেলেঙ্কারি বাবদে যখন ফাদার এতই অসতর্ক তখন এ মোকায় তাকে সরিয়ে ফেলাই ভালো– এই উদ্দেশ্য নিয়ে তাকেও খুন করা হয়। কিন্তু এই পার্জ বা জোলাপ গেলি-প্রেমের ছ বছর পরের কথা, আমরা ১৯২৮-এ ফিরে যাই)।

তা সে চিঠি আদৌ হিটলার লিখেছিলেন কি না সে তর্ক উত্থাপন না করলেও জানা যায়, ওই সময়ে পার্টিসদস্যদের ভেতর কানাঘুষা আরম্ভ হয়। কারণ ইতোমধ্যে হিটলার আরও ভালো রাস্তায় বৃহৎ ভবন কিনে সেখানে গেলির জন্য রাজরানির মতো আবাস নির্মাণ করে সেইটেকে আপন স্থায়ী আবাস-বাটি করেছেন, গেলিকে যত্রতত্র সর্বত্র সঙ্গে নিয়ে যান, এবং নিতান্ত সরল পার্টিসদস্যও দু-চারবার লক্ষ করলেই বলত, নিশ্চয়ই ফুরার এ মেয়েতে মজেছেন। তা তিনি মজুন, কিন্তু একে বিয়ে করলেই তো পারেন। নইলে শত্রুপক্ষ যে বলছে হিটলার রক্ষিতা পোষণ করেন, দু কান কাটার মতো স্বভবনে তার সঙ্গে বাস করেন, তিন কান কাটার মতো সগর্বে সদম্ভে তাকে নিয়ে সর্বত্র এমনকি পোলিটিক্যাল পার্টি মিটিঙেও যাতায়াত করেন, এবং আপন ভাগিনীর–তা হোক না কেন সৎবোনের মেয়ে– ভবিষ্যৎটি যে ঝরঝরে করে দিচ্ছেন সে বিষয়ে তাঁর কোনও বিবেকদংশন নেই; আর এতদিন ধরে প্রচার আর প্রচার যে, হিটলারের মতো সর্বত্যাগী, জিতেন্দ্রিয় পুরুষ আর হয় না, তিনি যে উনচল্লিশ বছর বয়সেও দারগ্রহণ করেননি তার একমাত্র কারণ, দারাপুত্ৰপরিবার দেশের জন্যে তার আত্মোৎসর্গে অন্তরায় হবে বলে। জিতেন্দ্রিয় না কচু!

এই কেলেঙ্কারিতে পার্টির কতখানি ক্ষতি হচ্ছিল বলা কঠিন, কিন্তু এ-কথা সত্য যে নাৎসি পার্টির ভরটেমূবের্গ অঞ্চলাধিপতি মুরুব্বি, পার্টির এক অতি প্রাচীন সদস্য যখন হিটলারের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করলেন তখন তিনি রাগে ক্রোধে চিৎকার করে তাকে পার্টি থেকে স্রেফ খেদিয়ে দিলেন।

এদিকে হিটলারের কড়া পাহারা গেলির ওপর। হফমানের মতে তিনি আদৌ জানেন না যে গেলি অন্যজনকে অতি গভীরভাবে ভালোবাসে– ভিয়েনায় নাকি দয়িতের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এবং এ কথাও সত্য, গেলি বার বার সঙ্গীতচর্চা করার জন্য তার প্রাচীন গুরুর কাছে ভিয়েনায় যেতে চায় এবং হিটলারের কবুল জবাব, নাই অর্থাৎ নো! যে মুনিকের সহস্র সহস্র নরনারী হিটলারের উচ্ছ্বসিত ভক্ত, সেই হিটলার যখন গেলির পদপ্রান্তে তাঁর প্রণয় রাখলেন তখন আর কিছু না হোক, এত বড় সর্বজনপ্রশংসিত একটি গ্রেটম্যানের বশ্যতা গেলিকে নিশ্চয়ই মুগ্ধবিহ্বল করেছিল। (প্রেমের প্রতিদান দিক আর না-ই দিক) এবং হয়তো হিটলার সেই বিহ্বলতাকেই প্রণয়ের প্রতিদান হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। হফমানের মতে, হিটলারের গ্রেট লভ ছিল স্বার্থপর প্রেম অনেক মুনিঋষিরাও বলেন, গ্রেট ল কখনও নিঃস্বার্থ হতে পারে না, সে লাভার অন্য সকলের প্রতি হয়ে যায় হিংসাপরায়ণ, তার বুভুক্ষা অসীম। বার্নার্ড শ-ও বলেছেন, গ্রেট লড় সামলে-সুমলে অল্প মেকদারে ধীরে ধীরে প্রকাশ করতে হয়। নইলে দয়িতার দম বন্ধ হয়ে আসে। যেন কোনও ম্যানিয়াক প্রেমোন্মাদ তাকে অষ্টপ্রহর আলিঙ্গনাবদ্ধ করে নিরুদ্ধনিশ্বাস করে তুলেছে।

মুনিকের বছরের সবচেয়ে বড় নাচের পরব এগিয়ে আসছে। প্রাণচঞ্চলা গেলি কেন, নিতান্ত অর্থাভাব না হলে, কিংবা প্রেমিকও দরিদ্র হলে, মুনিকের কোন তরুণী সে নাচ বর্জন করে? প্রথমটায় হিটলার তো কানই দেন না। আর গেলিও ছাড়বেন না। শেষটায় বাধ্য হয়ে হিটলার রাজি হলেন, কিন্তু শর্ত রইল দুটি। সঙ্গে যাবেন দুই গার্জেন এবং দুই গার্জেনদের প্রতিজ্ঞা করতে হল যে রাত এগারোটার ভেতর গেলিকে ফের বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে।

সেই ডানসের জন্য যে পারে সে-ই নতুন হালফেশানের ফ্রক তৈরি করায়। মুনিকের সর্বশ্রেষ্ঠ ডিজাইনার-দর্জি ডাই ভঁই অতি অরিজিন্যাল ডিজাইন রেখে গেল। হিটলার এক নজর বুলিয়েই সব কটা নামঞ্জুর করে দিলেন। এগুলো বড্ড বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বড় বেশি সালঙ্কার– যদ্যপি ফ্রক হিসেবে অত্যুকৃষ্ট। গেলি যাবে সাধারণ ইভনিং ড্রেস পরে।

তাই হল। স্বয়ং হফমান ও তার চেয়ে বুড়ো পার্টির প্রাচীন সদস্য আমান গেলির চরিত্ররক্ষকস্বরূপ তাকে মধ্যিখানে নিয়ে গেলেন নাচের মজলিশে। এক্ষেত্রে তরুণীরা প্রায় সর্বদাই আপন আপন লভারের সঙ্গে এ নাচে কেন– সব নাচেই যায়।

এবং ফিরতে হবে রাত ১১টায়। বলে কী? মাথা খারাপ।

 হফমান বলেছেন এবং এ লেখকও আপন একাধিক অভিজ্ঞতা থেকে অসংকোচে সায় দেবে– এ-সব নাচে ফুর্তি ফষ্টি-নষ্টি এমনকি কিঞ্চিৎ বেলেল্লাপনা আসলে আরম্ভ হয় রাত বারোটার পর। আমার মতে জমে প্রায় দুটোয় এবং নাচ ভাঙে ছটায়।

অনুমান করা কঠিন নয় যে, গেলি অত্যধিক আপ্যায়িত বা সন্তুষ্ট হয়নি। নাচের মাঝে মাঝে ফাঁকে ফাঁকে কপোত-কপোতীরা জোড়ায় জোড়ায় ফটোগ্রাফ তোলায়। গেলির যথেষ্ট কাষ্ঠরস ছিল। সে-ও ছবি তোলাল ওই দুই প্রহরী ডালকুত্তার মাঝখানে। কপোত-কপোতীর এক হাতে থাকে সফেন শ্যাম্পেন গ্লাস, অন্য হাতে গোটাপাঁচেক বেলুনের সুতো, মাথায় ওই বলডাসেই কেনা রঙবেরঙের ফুস ক্যাপ, গাধার টুপি ইত্যাদি। গেলি ছবি তোলাল এমন কায়দায় যেন মনে হয় ফাঁসির আসামিকে তার দুই জল্লাদ তাকে ফাঁসিকাঠে নিয়ে যাবার সময় প্রেস ফটোগ্রাফার যেভাবে ছবি তোলে।

হফমান বিরক্তির সঙ্গে কাঁটায় কাঁটায় এগারোটার সময় হিটলারের গচ্ছিত মহামূল্যবান গেলিকে মালিকের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন।

পরদিন সকালবেলা সাড়ম্বরে সরকারি কায়দায় গেলি ফটোগ্রাফখানা মামাকে উপহার দিলেন। হিটলার এসব নাচ এককালে বিস্তর না হোক অল্প-বিস্তর নিশ্চয়ই দেখেছিলেন। তাঁর মতো তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি যে ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ না করাই ভালো।

বৈমাত্রেয় মামা হলেও গেলি পেয়েছিল হিটলারের একটি মহৎ গুণ; সে তার পেটের কথা কাউকে বলত না। যে-পুৎসি হাস্টেলে তাঁর পুস্তকে হিটলার ও গেলির বিরুদ্ধে প্রচুরতম বিষোদগার করেছেন তিনি সে সময়ে নিত্য নিত্য হিটলারের বাড়িতে আসতেন, এবং গেলির সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা ছিল। তৎসত্ত্বেও তিনি তাঁর পুস্তকে গেলিকে দিয়ে রামগঙ্গা কিছুই বলাতে পারেননি। শুধু একবার নাকি তিনজন যখন একসঙ্গে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন হিটলার কী একটি রূঢ় মন্তব্য করলে, পুৎসি শুনতে পেলেন, গেলি দাঁতে দাঁত চেপে অস্ফুট কণ্ঠে বলল, ব্রুট–পশু!

গেলির ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল হফমান পরিবারের প্রতি এবং সমস্ত মুন্যিক শহরে ওই পরিবারের কর্তী এনা হফমানের সঙ্গে তার ছিল অন্তরঙ্গতা। কিন্তু তিনিও শেষ পর্যন্ত আগাপাশতলা কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি, স্বামীকেও বোঝাতে পারেননি। পুৎসি তার বিষোদ্গারের সময় গেলির যত নিন্দাই করে থাকুন না কেন, এনা পাঁচজনকে যা বলেছেন। তার থেকে বোঝা যায়, তিনি, এনা নিজে আর্টিস্ট ছিলেন বলে শুধু যে গেলির অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে মজেছিলেন তাই নয়, তার মানসিক ও চারিত্রিক একাধিক বিরল সৎগুণ তাঁকে সত্যই মুগ্ধ করেছিল। এমন যে বয়স্কা বান্ধবী যার কাছ থেকে সান্ত্বনা পাওয়া যায়, বিপদে-আপদে উপদেশ পথনির্দেশ চাওয়া যায় পাওয়া যায় তার কাছেও গেলি তার সুখ-দুঃখের কথা বলত না। শুধু একদিন মাত্র, কেমন যেন আত্মহারা হয়ে স্বীকার করে যে, সে যখন ভিয়েনায় ছিল তখন কোনও একজনকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিল। সামান্য এই, এইটুকু বলার পর সে হঠাৎ থেমে গেল, যেন সংবিতে ফিরে এসে বুঝতে পারল, বড় বেশি বলা হয়ে গিয়েছে, তাই সঙ্গে সঙ্গে বলল, আর যা আছে, সেটা আছেই। আপনিও কিছু করতে পারবেন না, আমিও কিছু করতে পারব না। অতএব অন্য কথা পাড়ি। এর্না দুঃখিনী গেলিকে অনেক সান্ত্বনা দিলেন, সর্বপ্রকারে সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতি দিলেন এনা বাস্তবিকই দৃঢ় চরিত্রের রমণী ছিলেন, অনেকের জন্য অনেক কিছু করেছিলেন, নাৎসি পার্টিতে যোগ দেননি, এবং যদিও হিটলারকে সমীহ করে চলতেন তবুও অন্যান্য বাবদে দু-একবার তাঁকেও খাঁটি অপ্রিয় সত্যকথা শোনাতে কসুর করেননি কিন্তু গেলি আর শামুকের খোল থেকে বেরুতে রাজি হল না। পরবর্তী ঘটনা থেকে মনে হয়, সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল, সে যা চায় হিটলার তার ঘোরতর বিরোধী এবং এই নিরীহ হফমান দম্পতি এখনও হিটলারের স্বরূপ চেনেন না, হিটলার তার মর্জিমাফিক যেসব সম্ভব-অসম্ভব কার্য করতে ও করাতে পারেন সে সম্বন্ধে এদের কণামাত্র ধারণা নেই– হিটলারের যে-স্বরূপ সে তার প্রতিদিনের সান্নিধ্যে সম্যক হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হয়েছিল।

এদিন এর্না শুধু এইটুকু জানতে পেরেছিলেন যে, গেলি ভিয়েনার একজন আর্টিস্টকে ভালোবাসে, কিন্তু সে কে, তাদের দু-জনার মধ্যে কী আদান-প্রদান হয়েছে, গেলি যদি তার ভালোবাসার প্রতিদান পেয়ে থাকে তবে উভয়ের বিবাহের প্রতিবন্ধকই-বা কী– এসব হফমানরা জানতে পারেননি, পরে অন্য কেউও জানতে পারেনি।

এদিকে গেলির মুখ সদা প্রফুল্ল, মামার বুড়ো বুড়ো প্রাচীন দিনের পার্টিসদস্যরা তার ওপর বড়ই প্রসন্ন, মামার বানানো সেই কাটাজালের ভেতরও তার বিধিদত্ত সরসতা লোপ পায়নি। পুস এটাকেই ঘৃণা করে বলেছেন ককেটরি– এর বাংলা প্রতিশব্দ কী? ঢলাঢলিপনা? কী জানি। হফমান বলেন তার মনে সন্দেহ নেই যে এটা ছিল তার বাইরের মুখোশ। এই প্রাণবন্ত, প্রকৃতিদত্ত সদা চঞ্চলা, আনন্দে হাসিতে যে কোনও মুহূর্তে কারণে-অকারণে শতধা হয়ে ফেটে যাওয়া যার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, তার চতুর্দিকে বিধিনিষেধের কাঁটার জাল! মুনিকের মতো স্বাধীন শহরে– যেখানে নর-নারী কীরকম অবাধে মেলামেশা করে সেটা এদেশে বসে কল্পনা করা সম্পূর্ণ অসম্ভব– গেলি কারও সঙ্গে কথা কইতে পারবে না মামার অজান্তে, কারও সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতে পারবে না মামার পরিষ্কার অনুমতি ভিন্ন, এমনকি ওই বয়সের আর পাঁচটা মেয়ে যে সামাজিকতা করে থাকে, যে লোকাচারসম্মত ভদ্রতা-সৌজন্য করে পাঁচজনের সাহচর্য সঙ্গসুখ পায়– এর কোনও একটা সে করতে পারে না, মামাকে না জানিয়ে, মামার অনুমতি ছাড়া।

সেই ডালকুত্তা শব্দটা হফমান তিক্ততার সঙ্গে নিজেই ব্যবহার করেছেন– দুটিকে নিয়ে ডাসে যাওয়ার ফার্সের পরের দিন হফমান আর সহ্য করতে না পেরে হিটলারকে বলেন, আপনি গেলির চতুর্দিকে যে পাঁচিল খাড়া করে তুলেছেন তার ভেতর মেয়েটার যে দম বন্ধ হয়ে আসছে! যে নাচে কাল রাত্রে তার ফুর্তি করার কথা ছিল সেটা শুধু তার অবরুদ্ধ জীবনের তিক্ততা তিক্ততর করে তুলেছিল।

হিটলার উত্তরে বললেন, আপনি জানেন, হফমান, গেলির ভবিষ্যৎ আমার কাছে এমনই প্রিয়, এমনই মূল্যবান যে তাকে সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখা আমি আমার কর্তব্য বলে মনে করি। একথা খুবই সত্য আমি গেলিকে ভালোবাসি এবং আমি তাকে বিয়েও করতে পারি, কিন্তু বিয়ে করা সম্বন্ধে আমার মতামত কী আপনি ভালো করে জানেন, এবং আমি যে কদাপি বিয়ে করব না বলে দৃঢ় সিদ্ধান্ত করেছি সেকথাও আপনি জানেন। তাই আমি এটাকে আপন ন্যায়সম্মত অধিকার বলে ধরে নিয়েছি যে, যতদিন না গেলির উপযুক্ত বর এসে উদয় হয় ততদিন পর্যন্ত সে যার সঙ্গে পরিচয় করতে চায় এবং যারা তার পরিচিত তাদের ওপর কড়া নজর রাখা। আজ গেলি যেটাকে বন্ধন বলে মনে করছে সেটা প্রকৃতপক্ষে বিচক্ষণ আত্মজনের সুচিন্তিত সতর্কতা। আমি মনে মনে দৃঢ়তম সংকল্প করেছি গেলি যেন জোচ্চোরের হাতে না পড়ে বা এমন লোকের পাল্লায় না পড়ে যে গেলিকে দিয়ে আপন ভবিষ্যৎ গুছিয়ে নেবার অ্যাভেঞ্চারের তালে আছে।

হফমান এস্থলে যোগ দিচ্ছেন, হিটলার অবশ্য জানতেন না যে, গেলি গোপনে গোপনে ভিয়েনাবাসী এক তরুণকে মনপ্রাণ দিয়ে গভীর ভালোবাসে।

হিটলার গিয়েছিলেন মুনিকের বাইরে গেলিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মায়ের কাছে আবার যাবেন দূর হামবুর্গে, মাঝপথে কয়েক ঘণ্টার জন্য মনিকে থামবেন এবং গেলিকে গ্রাম থেকে আনিয়েছেন। হামবুর্গের দীর্ঘ সফরে সহযাত্রী হওয়ার জন্য তিনি পূর্বেই হফমানকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এস্থলে হফমানের বিবরণী মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ১৭ সেপ্টেম্বর (অর্থাৎ মুনিক সমাজে হিটলার গেলিকে পরিচয় করিয়ে দেবার চার বছর পর কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি গেলিকে মুনিক সমাজে উপস্থিত করেন, তা হলে হবে সাত বছর পর, কিন্তু এ বাবদে আমি হফমানকেই বিশ্বাস করি, এবং এসব ঐতিহাসিকদের বই বেরিয়েছে হফমানের বই বেরুবার পূর্বেই) হফমান এলেন হিটলারের বাড়িতে। গেলি মায়েরই মতো ভালো ঘরকন্না করতে জানত, তাই সে তখন হিটলারের স্যুটকেস গুছিয়ে দিচ্ছে। হিটলার সখাসহ যখন সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নামছেন, তখন উপরের তলায় রেলিঙের উপর ভর করে, নিচের দিকে ঝুঁকে গেলি বলতে লাগল, ও রেভোয়া মামা অ্যাড়ল, ও রেভোয়া হার হফমান! হিটলার দাঁড়ালেন, তার পর উপরের দিকে তাকিয়ে আবার সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দিকে চললেন। হফমান বাইরে এসে পেভমেন্টে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

হিটলার এলে পর মোটরে উঠে দুজন চললেন উত্তর দিকে নরবের্গ পানে। শহর থেকে বেরুবার সময় হিটলার বন্ধু হফমানকে বললেন, কেন জানিনে আমার মনটা যেন অস্বস্তিতে ভরে উঠেছে।

হফমান বিবেচক লোক। তিনি নিজেই ঠাট্টা করে বলেছেন, অনেকেই আমাকে আড়ালে হিটলারের কোর্টজেস্টার (গোপালভাড়) বলত, এবং হয়তো সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়। তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, এ সময়কার দখিনা ফ্যোন বাতাসটা সক্কলেরই বুকের উপর চেপে বসে সবাইকে মনমরা করে দেয়। কিন্তু হিটলার চুপ করে রইলেন, এবং দীর্ঘ নরবের্গের রাস্তা ড্রাইভ করার পর সেখানকার পার্টি-মেম্বারদের প্যারা হোটেলে উঠলেন।

পরের দিন ন্যুরনবের্গ শহর ছেড়ে যখন তারা বায়রট শহরের দিকে এগুচ্ছেন তখন হিটলার ড্রাইভিং সিটের সামনের ছোট্ট আয়নাটিতে লক্ষ করলেন, আরেকখানা মোটর দ্রুততর বেগে ক্রমশই তাদের গাড়ির কাছে এগিয়ে আসছে। নিরাপত্তার জন্য হিটলারের হুকুম ছিল কোনও গাড়ি যেন তার গাড়ি ওভারটেক না করতে পায়, কারণ ওই সময় দুটো গাড়িই কিছুক্ষণ পাশাপাশি চলে বলে অন্য গাড়ি থেকে হিটলারের উপর গুলি চালানো কঠিন নয়। হিটলার শোফার শ্ৰেককে সেই আদেশ দিতে যাচ্ছেন সেই সময় তিনিই লক্ষ করলেন, যে গাড়ি পশ্চাদ্ধাবন করছে সেটা ট্যাক্সি এবং ড্রাইভারের পাশে হোটেলের উর্দিপরা একটি ছোকরা ক্ষিপ্তের ন্যায় দু হাত নাড়িয়ে তাদের থামবার জন্য সঙ্কেত করছে। শ্ৰেক্‌ গাড়ি দাঁড় করালে ছেলেটি উত্তেজনায় হাঁফাতে হাঁফাতে বললে, হ্যার হেস (ইনি তখন এবং ১৯৪১-এ যখন অ্যারোপ্লেনে করে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে লন্ডন যান তখনও হিটলারের পরেই তাঁর স্থান ছিল) মুনিক থেকে ট্রাঙ্ককল করে অত্যন্ত জরুরি বিষয় নিয়ে হিটলারের সঙ্গে কথা বলতে চান। তিনি ফোনে না পৌঁছানো পর্যন্ত হেস লাইন ছাড়বেন না। দুই বন্ধু মোটর ঘুরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে চললেন নরবের্গ পানে।

গাড়ি ভালো করে থামতে না থামতেই হিটলার লাফ দিয়ে মোটর থেকে বেরিয়ে ছুটে ঢুকলেন হোটেলের ভেতর, এবং তার পর টেলিফোনের বাক্সে (বুথে বুথের দরজা পর্যন্ত তিনি বন্ধ করেননি। পিছনে পিছনে ছুটে এসেছেন হন এবং টেলিফোন বুথের দরজা খোলা বলে হিটলারের প্রত্যেকটি শব্দ শুনতে পেলেন।

এখানে হিটলার– কী হয়েছে? উত্তেজনায় হিটলারের গলা খসখসে কর্কশ হয়ে গিয়েছে। হে ভগবান! এ কী ভয়ঙ্কর! অপর প্রান্ত থেকে কী একটা খবর শুনে তিনি চিৎকার করে উঠলেন, এবং তাঁর কণ্ঠস্বরে পরিপূর্ণ হতাশা। তার পর দৃঢ়তর কণ্ঠে বলতে লাগলেন, এবং সে কণ্ঠস্বর শেষটায় প্রায় চিৎকারের পর্যায়ে পৌঁছল, হেস! আমাকে উত্তর দাও–হ্যাঁ, কিংবা না মেয়েটা এখনও বেঁচে আছে তো?… হে, তুমি অফিসার, সেই অফিসারের নামে দিব্যি দিচ্ছি– আমাকে সত্য করে বল– মেয়েটা বেঁচে আছে, না মরে গেছে? হেস!…হেস! এবার হিটলার তীব্রতম কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন। মনে হল তিনি অপর প্রান্ত থেকে কোনও সাড়া পাচ্ছেন না। হয় লাইন কেটে গেছে, নয় হেস উত্তর দেবার দুর্বিপাক এড়াবার জন্য রিসিভার হুকে রেখে দিয়েছেন। হিটলার টেলিফোন বুথ থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এলেন, তার চুল নেমে এসে কপাল ঢেকে ফেলেছে (এ কথাটা তার খাস চাকর লিঙে একাধিকবার বলেছে যে, হিটলার তার মাথার চুল কিছুতেই বাগে রাখতে পারতেন না– অল্পতেই সেটা কপাল ঢেকে ফেলত), তার চাউনি ছন্নের মতো, তাঁর চোখদুটো যে উজ্জ্বল হয়ে ঝকঝক করছে সেটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক।

শ্ৰেকের দিকে মুখ করে বললেন, গেলির কী যেন একটা কি ঘটেছে। আমরা মুনিক ফিরে যাচ্ছি। গাড়ির যা জোর আছে তার শেষ আউনস্ পর্যন্ত কাজে লাগাও। গেলিকে জীবিত অবস্থায় আবার আমাকে দেখতেই হবে।

টেলিফোনে বুথ থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরো টুকরো যেসব কথা ভেসে এসেছিল তার থেকে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলুম, গেলির কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু ঠিক ঠিক কী সেটা বুঝতে পারিনি, এবং হিটলারকে জিগ্যেস করার মতো সাহসও আমার ছিল না।– বলছেন স্বয়ং হফমান।

হিটলারের উন্মাদ উত্তেজনা যেন সংক্রামক। শ্ৰেক চেপে ধরেছে অ্যাকসিলিরেটর। মোটরের মেঝে পর্যন্ত তার গাড়ি তীব্র আর্তনাদ করে ছুটে চলেছে মুনিকের দিকে। হফমান মাঝে মাঝে মোটরের ছোট্ট আর্শিতে দেখছেন হিটলারের চেহারা– ঠোঁটদুটো চেপে তিনি উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে সম্মুখ পানে তাকিয়েও যেন কিছু দেখছেন না। তাদের মধ্যে একটিমাত্র বাক্য বিনিময় হল না– যে যার বিমর্ষ চিন্তা নিয়ে ডুবে আছে আপন মনের গহনে।

অবশেষে আমরা তাঁর বাড়িতে পৌঁছলুম এবং সেই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ জানতে পেলুম। চব্বিশ ঘন্টা আগে গেলি মারা গিয়েছে। সে তার মামার অস্ত্রভাণ্ডার থেকে একটি ৬,৩৫ পিস্তল নিয়ে হৃৎপিণ্ডের কাছাকাছি জায়গায় গুলি করেছে। ডাক্তারদের মতে যদি সঙ্গে সঙ্গে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা হত তবে হয়তো তাকে বাঁচানো অসম্ভব হত না। কিন্তু সে দরজা বন্ধ করে গুলি ছুঁড়েছিল, কেউ সে শব্দ শুনতে পায়নি এবং ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণে সে ইহলোক ত্যাগ করেছে।

ইতোমধ্যে পোস্টমর্টেম, করোনারের তদন্ত সবকিছু হয়ে গিয়েছে এবং পুলিশ মৃতদেহ ফেরত দিয়েছে। ডাক্তারের রিপোর্ট থেকে বোঝা গেল হিটলারের বিদায়ের অল্প পরেই গেলি আত্মহত্যা করে। সে দেহ তখন আনুষ্ঠানিকভাবে সুসজ্জিত করে কবরস্থানে রাখা হয়েছে তিন দিন পর গোর হবে– এ সময় আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব মৃতকে শেষবারের মতো দেখে নেন এবং আত্মার সদগতির জন্য আপন আপন প্রার্থনা জানান।

গেলির মা ইতোমধ্যে বেৰ্ষটেসগাডেন থেকে এসে গেছেন। পার্টির মুরুব্বিদের একাধিকজন ও হিটলার-ভবনের বন্ধু প্রাচীন দিনের গৃহরক্ষিণী ফ্রাউ ভিনটারও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। গেলির মা নির্বাক অশ্রুধারে সিক্ত হচ্ছিলেন।

***

গৃহরক্ষিণী ফ্রাউ ভিনটার যা বললেন তার সারমর্ম এই, হিটলার বাড়ি ছাড়ার পূর্বে সিঁড়ি দিয়ে আবার দোতলায় উঠেছিলেন– এর বর্ণনা আমরা হফমান মারফত আগেই দিয়েছি

গেলিকে আরেকটু আদর করার জন্য, কারণ তিনি সেদিনই মুনিক ফিরেছিলেন এবং সেদিনই আবার রবের্গ হয়ে হামবুর্গ চলে যাচ্ছিলেন বলে গেলির প্রতি যথেষ্ট যত্নবান হতে পারেননি। সেই অনিচ্ছাকৃত অবহেলাটা যেন খানিকটে দূর করার জন্য তিনি উপরে উঠে গেলির গালের উপর হাত দিয়ে আদর করতে করতে কানে কানে সোহাগের কথা কইছিলেন কিন্তু গেলি যেন কোনও সান্ত্বনা মানতে চায়নি, তার রাগও পড়েনি।

দু-জনার চলে যাওয়ার পর গেলি ফ্রাই ভিনটারকে বলে, সত্যি বলছি, আমার ও মামার মধ্যে কোনও জায়গায় মিল নেই (নাথিং ইন কন)।

ফ্রাই ভিনটার কিন্তু একথা বললেন না, হফমানও নীরব, যে সেদিনই হিটলারে গেলিতে তুমুল কথাকাটাকাটি হয়, এবং সেপ্টেম্বর মাসে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হলে এবং সেদিন আদৌ হয়নি– অনেকেরই জানালা খোলা থাকে বলে একাধিক প্রতিবেশী সে কলহের উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনতে পান। শাইরার প্রভৃতি ঐতিহাসিকেরা বলেন (Shirar A.; The Rise ও Fall of the Third Reich; Aufsting und Fall des dritten Reiches 1960/61) যে গেলি। ভিয়েনা গিয়ে গলা সাধবার জন্য আবার অনুমতি চাইছিল, এবং হিটলার পূর্বের ন্যায় দৃঢ় কণ্ঠে অসম্মতি জানাচ্ছিলেন।

এই ব্যথাটা অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত নয়, কারণ গেলির মৃত্যুর পর তার ঘরে ভিয়েনার শুরুর উদ্দেশ্যে তার লেখা একখানা অর্ধসমাপ্ত চিঠি পাওয়া যায়। সেটাতে সে গুরুকে জানাচ্ছে, সে আবার ভিয়েনায় এসে তার কাছে কণ্ঠসঙ্গীত শিখতে চায়।

ফ্রাই ভিনটার আরও বললেন যে, মিত্রসহ হিটলার চলে যাওয়ার পর গেলি তাঁকে বলে যে সে এক বন্ধুর (বা বান্ধবীর সঙ্গে সিনেমায় যাচ্ছে, এবং তার জন্য যেন রাত্রের কোনও খাবার তৈরি না করা হয়। সে রাত্রে তিনি তাই গেলিকে আবার দেখতে না পেয়ে বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা করেননি। গেলি ব্রেকফাস্ট খেত ভোরেই, এবং সে যখন তার অভ্যাসমতো ওই সময়ে ব্রেকফাস্ট করতে এল না, তখন ফ্রাউ ভিনটার তার ঘরে গিয়ে টোকা দিলেন। কোনও উত্তর না পেয়ে তিনি চাবির ফুটো দিয়ে ভিতরের দিকে তাকাবার চেষ্টা দিলেন, কিন্তু চাবি ফুটোতে লাগানো এবং ঘর ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে তিনি স্বামীকে ডাকেন। তিনি দরজা ভেঙে যখন ভেতরে ঢুকলেন, তখন সম্মুখে ভয়ানক দৃশ্য। গেলি একডোবা রক্তে পড়ে শুয়ে আছে, আর পিস্তলটা সোফার এক কোণে। ফ্রাউ ভিনটার তৎক্ষণাৎ গেলির মাকে খবর দেন, এবং হেস পার্টির কোষাধ্যক্ষ শ্বাসকে জানান।

অনেকেই এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু হফমানের আত্মচিন্তা এস্থলে বিশেষ মূল্য ধরে। তিনি বলছেন, হিটলার কি গেলির আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ জানতেন? তিনি যে শহর ছাড়ার সময় বলেছিলেন, কেন জানিনে, আমার মনটা যেন অস্বস্তিতে ভরে উঠেছে সেটা কি ইন্দ্রিয়াতীত কোনও অনুভূতিসঞ্জাত অস্বস্তিবোধ, অথবা কি গেলির কাছ থেকে শেষ বিদায় নেবার সময় এমন কিছু একটা ছিল যেটা তার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল?

তার চেয়ে যে জিনিস হফমানের কাছে একেবারেই দুর্বোধ্য ঠেকেছিল সেটা এই : ফ্রাউ ভিনটার বলেন, হিটলার এবং তিনি চলে যাওয়ার পর গেলি অত্যন্ত বিষণভাবে নুয়ে পড়ে। এ তথ্যটা বুঝতে তার কোনও অসুবিধা হল না, কিন্তু তার পর ফ্রাউ ভিনটার যা বললেন সেটা তার বিচার-বিবেচনাকে দিল একদম ঘুলিয়ে। ফ্রাই ভিনটার বার বার জোর দিয়ে বললেন, গেলি হিটলার একমাত্র হিটলারকেই ভালোবাসত; বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা, গেলির বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকিটাকি মন্তব্য ফ্রাউ ভিনটারকে দৃঢ়নিশ্চয় করেছিল, হিটলারকেই গেলি ভালোবাসে। হফমান বলছেন, কিন্তু আমার যতদূর জানা এবং ভালো করেই জানা, গেলি ভালোবাসত অন্য একজনকে।

এর সঙ্গে তা হলে আরেকটি তথ্য জুড়তে হয়, হফমানের ফোটো-কর্মশালায় তার কিছুদিন পূর্বে হিটলার শ্রীমতী এফা ব্রাউনের সঙ্গে পরিচিত হন(৫) যে এফাঁকে তিনি মৃত্যুর অল্প পূর্বে বিয়ে করেন, এবং হফমানের মতে তাঁদের বন্ধুত্ব নিবিড়তর হয় বেশ কিছুকাল পরে এবং গেলি মামাকে লেখা এফার একখানা চিঠি দৈবযোগে মামার কোটের পকেটে পেয়ে যায়। তা হলে বলতে হবে ফ্রাউ ভিটারের রহস্য সমাধান হয়তো সম্পূর্ণ ভুল না-ও হতে পারে।

একটা কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যদিও সেটা পরের এবং অনেক দিন ধরে চলেছিল। গেলির মা এমনিতেই এফা ব্রাউনকে পছন্দ করতেন না, এবং গেলির মৃত্যুর পর সে অপছন্দ পরিপূর্ণ ঘৃণায় গিয়ে পৌঁছল। হফমান এবং অন্যান্যরা তাঁকে যতই বোঝাবার চেষ্টা করতেন তিনি ততই অকুণ্ঠ ভাষায় জোর দিয়ে বলতেন, তাঁর মনে কণামাত্র দ্বিধা নেই যে, তাঁর মেয়ে হিটলারকেই ভালোবাসত এবং ওই এফা ব্রাউনের অস্তিত্ব ও হিটলারের ওপর তার প্রভাব গেলিকে গভীরতম নৈরাশ্যে নিমজ্জিত করে দেয়, এবং এইটেই গেলির অকাল মৃত্যুর অন্যতম প্রধানতম কারণ।

***

এদেশে জোরালো গোটা দু-ত্তিন দল এবং তাদের বেপরোয়া আপন আপন দৈনিক নেই বলে বহু কেলেঙ্কারি-কেচ্ছা অনায়াসে চাপা পড়ে। ইয়োরোপের অধিকাংশ দেশে অবস্থাটা ভিন্ন প্রকারের। বিশেষত ভাইমার রিপাবলিক যুগে এই খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দশকে, হিটলার চ্যানসেলার না হওয়া পর্যন্ত (১৯৩৩) জর্মনির খবরের কাগজে কাগজে নরক ছিল গুলজার, বিশেষত জর্মনরা যখন ইংরেজি খবরওয়ালাদের চোরে চোরে মাসতুতো ভাই  থিক্স এগ্রিমেন্টে আদৌ বিশ্বাস করে না। তাই মুনিকের খবরের কাগজগুলোর ওপর গেলির অস্বাভাবিক মৃত্যু যেন মৌচাকের উপর ঢিলের মতো হয়ে এসে পড়ল। আর কাফে কাফে বারেতে বারেতে গুজবগুঞ্জরণের তো কথাই নেই। এমনকি নাৎসি পার্টির ভেতরও নানা মুনি নানা মত দিতে লাগলেন। যারা সরাসরি দুশমন তাদের এক দল বেশ জোর গলায় বলল, নাৎসি পার্টি তার প্রভাব ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে অটপসি আদৌ করাতে দেয়নি, করোনারের সামনে যা-কিছু ঘটেছে তার সমস্তটাই আগাগোড়া থাচ্ছো কেলাসি থিয়েডারের ফার্স, এবং এক দল বলল, তাই হবে, কারণ এটা আত্মহত্যা নয়, আসলে খুন, এবং খুনি স্বয়ং হিটলার। তিনি হামবুর্গ পানে রওনা হয়েছিলেন সত্য কিন্তু সেটা ছিল ফাঁদ পাতার মতো। সন্ধ্যার সময় ফের বাড়ি ফিরে আসেন, এবং গেলিকে অন্য পুরুষের সঙ্গে এমন অবস্থায় পান যে, তখন হিটলারের মতো হিংস্র প্রাণীর মাথায় যে খুন চাপবে তাতে আর বিচিত্র কী? অন্য দলের বক্তব্য, না, পরপুরুষ ছিল না, শুধু গেলির ভিয়েনা যাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে কথা-কাটাকাটি এমনই চরমে পৌঁছয় যে হিটলার আত্মকর্তৃত্ব সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেন এবং উন্মাদ অবস্থায় গেলিকে খুন করেন। আবার কেউ কেউ বললেন, না, খুন করেছেন হিমলার। পার্টির মুরুব্বিরা যখন দেখলেন যে হিটলারের খোলাখুলি বেলেল্লাপনার ঠেলায় পার্টির ইজ্জৎ যায়-যায় ( যদিও আমি যতদূর জানি জনসমাজে গেলির সঙ্গে হিটলারের আচরণ ছিল ভদ্র, সংযত, ইংরেজিতে যাকে বলে করেকটু; অন্যপক্ষের বক্তব্য আমরা যদি মিনিমাটাও নিই সেটাও যথেষ্ট খারাপ, কারণ এ-কথা তো আর মিথ্যে নয় যে তুমি মেয়েটাকে ভালোবাস এবং তাকে নিয়ে একই বাড়িতে বাস কর, আর তার মাকে রেখেছ দূরে গাঁয়ের বাড়িতে যখন তুমি তাকেও অনায়াসে এখানেই রাখতে পারতে–), ওদিকে হিটলার ছাড়া যে পার্টি দু দিনেই কাত হয়ে যাবে সেটাও অবিসংবাদিত সত্য, তখন তারা পার্টি বাঁচাবার জন্য হিমলারের ওপর গেলিকে সরাবার ভার দিলেন। কর্মটি করেছেন হয় স্বয়ং তিনি বা তার কোনও গুণ্ডাকে দিয়ে (পার্টিতে যে গুণ্ডার অভাব ছিল না সে তথ্যটি সবাই জানতেন, এবং না থাকলে নাৎসি পার্টি যে রাস্তায় কম্যুনিস্টদের ঠেলায় একদিনও টিকতে পারত না সেটা আরও সত্য)। ইত্যাকার নানাপ্রকারের গুজবে তখন জর্মনি ম-ম করছে, কারণ গেলির মৃত্যুর পূর্বেই নাৎসি পার্টি এমনই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে রাস্তার উপর কারণে-অকারণে যাকে-তাকে চ্যালেঞ্জ করে, এবং কমুনিস্টদের কাউকে একা পেলে তাকে পেটাতেও কসুর করে না; প্রতিদিন আবার কানে আসছে, এই বুঝি প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গ নাৎসি নেতা হিটলারকে ডেকে পাঠাবেন, হয় আপন মন্ত্রিসভা গড়ে প্রধানমন্ত্রী-চ্যানসেলর হতে, কিংবা কোয়ালিশন সরকার নির্মাণ করতে।

আমি তখন মুনিকে বাস না করলেও জর্মনিতে, এবং প্রতিদিন লাঞ্চ টেবিলে বন্ধুদের আলোচনা, কথা-কাটাকাটি শ্রবণই ছিল আমার পক্ষে যথেষ্ট। আমাদের রিডিং রুম স্যুনিক তথা জর্মনের সব বড় বড় শহরের প্রধান প্রধান খবরের কাগজ রাখত, তদুপরি আমাদের কেউ না কেউ মুনিক আসা-যাওয়া করছে, আর একজন তো খাস মনিকবাসী– সে শহরের বিরাট ম্যাপ খুলে হিটলারের বাড়ি, তিনি যে যে কাফেতে যান, সবগুলো পিন্ ডাউন করতে পারত, কাজেই আমাদের লাঞ্চ টেবিলে গুজবেরও অনটন ছিল না। কিন্তু এটাও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক যে এতদিন পরে আজ আমি তার অধিকাংশই ভুলে গিয়েছি। তবে, ঘটনার প্রায় কুড়ি বছর পর থেকে যখন হিটলার সম্বন্ধে নানাপ্রকারের পুস্তক বেরুতে আরম্ভ করল (গেলি আত্মহত্যা করে ১৯৩১-এ; হিন্ডেনবুর্গ হিটলারকে ডেকে পাঠান তার তিন সপ্তাহ পরে এবং আলাপচারী যে নিষ্ফল হয় তার একমাত্র কারণস্বরূপ নাৎসিরা বলেন, হিটলার গেলির মৃত্যুশোক তখনও সম্পূর্ণ সামলে উঠতে পারেননি বলে সমস্ত চিন্তাশক্তি একাগ্রচিত্তে ব্যবহার করতে পারেননি– ঘন ঘন আনমনা হচ্ছিলেন; ১৯৩৩-এর জানুয়ারি মাসে হিটলার চ্যানসেলর হন, ১৯৩৯-এ তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ করেন, ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫-এ তিনি আত্মহত্যা করেন, ইংরেজিতে প্রচলিত অ্যালন বুলক লিখিত ওই ভাষায় হিটলারের স্ট্যান্ডার্ড জীবনী বেরোয় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে, হানের ১৯৫৪-৫৫ খ্রিস্টাব্দে, এবং অধুনা– ১৯৬১–প্রকাশিত শাইরারের ১১৭৪ পৃষ্ঠার যে বিরাট বই বাজারে নাম করেছে তাতে কোনও মৌলিকতা নেই এবং আমার মনে হয় তিনি হফমানের বইখানা হয় পড়েননি, নয় একপেশে বলে খারিজ করেছেন। বলা বাহুল্য বুলক, শাইরার এবং শতকরা ৯০ খানা বই রাজনৈতিক তথা যুদ্ধবিদ হিটলারকে নিয়ে আলোচনা করে বলে তার মধ্যে প্রেম অল্পই স্থান পায়, এবং তারও অধিকাংশ পান এফা ব্রাউন, গেলি সত্যিই এখনও কাব্যের উপেক্ষিতা!) তখন দেখে বড় আশ্চর্য বোধ হল যে তখনকার দিনে যেসব গুজব আমরা সে গাঁজা বলে উড়িয়ে দিয়েছিলুম তার অনেকগুলোই এসব পুস্তকে রীতিমতো সম্মানের আসন পেয়েছে, এবং যেগুলোকে আমরা সত্য বা সত্যের নিকটতম বলে স্বীকার করে নিয়েছিলুম সেগুলোর উল্লেখ পর্যন্ত নেই!

অবশ্য এ-কথা উঠতে পারে যে, হফমানের মতে হিটলার গেলির আত্মহত্যার জন্য নিতান্ত পরোক্ষভাবে দায়ী, আদৌ যদি তাঁকে দায়ী করা হয়, তিনি গেলিকে কড়া শাসনে রাখতেন (হিটলারের সাফাই আজ গেলি যেটাকে বন্ধন বলে মনে করছে সেটা বিচক্ষণ আত্মজনের সুচিন্তিত সতর্কতা) আবার ওদিকে বলেছেন, গেলি ছিল হিস্টিরিয়াগ্রস্ত, সদাই আত্মহত্যার জন্য মুখিয়ে থাকা টাইপের একদম খাঁটি উল্টোটি। তার প্রকৃতি ছিল বেপরোয়া, জীবনের মুখোমুখি হত সে প্রতিদিন নিত্যনতুন সুস্থ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসব ভাবলে তো কিছুতেই বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না যে সে আপন জীবন আপন হাতে নিতে নিজেকে বাধ্য অনুভব করল।

হফমানকৃত তাঁর সখা হিটলারের জীবনী হয়তো অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখবেন, ভাববেন, রাজনৈতিক এবং গ্যাস-চেম্বারের প্রবর্তন ও সফলীকরণ কর্তা হিটলারকে তিনি সমর্থন করতে না পেরে অবশ্য এটা সবাই স্বীকার করেছেন যে আর্ট ভিন্ন অন্য কোনও বিষয় নিয়ে তিনি অতি দৈবেসৈবে হিটলারের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং আরও সত্য যে হিটলার, বিশেষ করে গ্যোবেলুসের শত চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি ডাঙরতম সরকারি চাকরি বা পার্টিতে কোনও গণ্যমান্য আসন নিতে নারাজের চেয়ে নারাজ সম্পূর্ণ নারাজ ছিলেন, অতএব রাজনৈতিক হিটলারকে দোষী বা নির্দোষী প্রমাণ করার হাত থেকে তিনি (সানন্দে) অব্যাহতি পেয়েছেন তিনি মানুষ হিটলারকে অযথা অপবাদ থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছেন। তাঁর এ নেমকহালালি প্রশংসনীয়, কিন্তু সে কর্ম করতে গিয়ে তিনি কতখানি সত্যবাচন করেছেন সেটা অনেকের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করবে।

আমি তাকে মোটামুটি বিশ্বাস করেছি, এবং দৈনন্দিন জীবনে হিটলার যেখানে ছোট লোক সেখানে পুৎসি হানস্টেঙেলের হিটলারের বিরুদ্ধে ভার বহুস্থলে অহেতুক বিষোদ্গার সত্ত্বেও অনেক কথা মেনে নিয়েছি।

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে আমার মনে হয়েছিল এখনও মনে হয়, হিটলার জানতেন এবং ভালো করেই জানতেন যে গেলি ভিয়েনার এক আর্টিস্টকে গভীরভাবে ভালোবাসত (আমার মনে হয়, হান যে বলেছেন, হিটলার সে-খবরটি জানতেন না, এটা তার ভুল এবং গেলির ভিয়েনা যাবার জন্য উৎসাহ এবং মামাকে পীড়াপীড়ি সেখানে যাবার অনুমতির জন্য)–এ বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে গেলি বরাবরই মনিকের রাজসিক বাসভবন, অতি সাধারণ মেয়ের সমাজে সর্বোচ্চ আসন, মুনিকের সর্বজন সম্মানিত মামার গরবে গরবিনী হওয়া, সেই গ্রেট মামার প্রেমনিবেদন তারই পদপ্রান্তে, সে মামা আবার তার কথায় উঠ-বস করেন, সর্বোত্তম থিয়েটার-অপেরায় সর্বশ্রেষ্ঠ আসনাধিকার, এক কথায় বলতে গেলে মুনিকের মতো সুখৈশ্বর্য, সর্বপ্রকারের বিলাস, চিত্তহারিণী আমোদ-প্রমোদ দিতে সক্ষম এসব ছেড়ে ভিয়েনাতে তাকে থাকতে হত সাধারণ অবশ্য অপেক্ষাকৃত বিত্তশালিনী– ছাত্রীর মতো। এ দুয়ের আসমান-জমিন ফারাক। শুধু সঙ্গীতে পারদর্শিনী হওয়ার জন্য এত বড় সুখসম্মান বিসর্জন? আমার বিশ্বাস হয় না। পুৎসি যখন কটুবাক্য ব্যবহার করে বলেন, মেয়েটা পয়লা নম্বরের ফুর্তিবাজ ফ্লার্ট, কণ্ঠসঙ্গীত উচ্চতম পদ্ধতিতে আয়ত্ত করতে হলে যে অধ্যবসায় ও ফুর্তিফার্তি বিসর্জন অবশ্য প্রয়োজনীয় সে-দুটো গেলির ছিল কোথায়? তখন আমার মনে হয় গেলির মন পড়ে থাকত ভিয়েনায় যেখানে সে অধ্যবসায়ের সঙ্গে রেওয়াজ করবে, ও সন্ধ্যায় পাবে তার আর্টিস্ট দয়িতের কাছে অনুপ্রেরণা, যদি সেখানে দৈন্যেও বাস করতে হয়, সেটা সে ভাগাভাগি করবে তারই সঙ্গে; তার তুলনায় মুনিকে মামার সঙ্গে বাস করে, মনে মনে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ থেকে উৎকৃষ্টতম বিলাসভোগ শতগুণে নিকৃষ্ট। ভিয়েনার ছাত্রজীবনের স্বাধীনতা, তরুণ-তরুণীর সঙ্গে সম্মিলিত আনন্দোল্লাস নিশ্চয়ই মুনিকের বন্দিশালা এবং প্রতি সন্ধ্যায় কাফেতে মামা এবং তার বুড়োহাবড়া ভারিক্কি-ভারিক্কি রাজনৈতিক পার্টিমেম্বারদের সঙ্গে প্রসন্নতা এমনকি উল্লাসের ভান করার চেয়ে শতগুণে শ্রেয়, কিন্তু সেইটেই তত্ত্বকথা নয়–তত্ত্বকথা ওই দয়িতের সঙ্গসুখ। সঙ্গীতই যদি বড় কথা হবে তবে অ্যানিক অজপাড়াগা? মুনিকে ঠিক সে সময়ে হয়তো কোনও মেস্ত্রো ওস্তাদের ওস্তাদ ছিলেন না, কিন্তু গেলি যে ভিয়েনাতে কোনও মেস্ত্রোর কাছে সঙ্গীতাধ্যয়ন করেছিল এ কথা তো কেউ বলেনি। না, সঙ্গীত তার শেষ বচসার এবং সর্বশেষে নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যার কারণ নয়।

হফমান বুঝতে পারেননি, কিংবা বলতে ভুলে গেছেন– সেটা পরবর্তী যুগের সহচরগণ বার বার উল্লেখ করেছেন– হিটলার ঝাণ্ডু ঝাণ্ড সুপকুতম রাজনৈতিকদের পেটের কথা টেনে বের করার কৌশলটিতে সুপটু ছিলেন। আর এ তো চিংড়ি ভাগনি! হয়তো মামা তার প্রেম নিবেদন করার পূর্বেই আবেগ-বিহ্বল তরুণী মামার সহানুভূতি এবং আনুকূল্য পাবার আশায় পূর্বাহেই সবকিছু বলে বসে আছে। কিংবা হয়তো হিটলার যখন লক্ষ করলেন, গেলি তার প্রেমের উপযুক্ত প্রতিদান দিচ্ছে না তখন সেটা চেপে দিয়ে আঁকশি চালিয়ে বের করলেন গেলির পেটের কথা– বরঞ্চ বলা উচিত হৃদয়ের ব্যথা। এবং তারই-বা কী প্রয়োজন? সেই ১৯৩১ সালেই তাঁর পার্টির অসংখ্য স্পাই ছিল ভিয়েনায়– যে নগরে তিনি নিজে যৌবনের একাংশ রাস্তায় রাস্তায় স্বহস্তে অঙ্কিত পিকচার পোস্টকার্ড ফেরি করেছেন– নইলে ১৯৩৪-এ, এ ঘটনার মাত্র আড়াই বছর পরে তিনি তাঁর পার্টির লোকের দ্বারা ভিয়েনা শহরের জনসমাগমে পরিপূর্ণ দফতরে অস্ট্রিয়ান প্রধানমন্ত্রী ডলফুসকে খুন করলেন কী প্রকারে? এবং তার চার বছর পরে একটিমাত্র গুলি না চালিয়ে ভিয়েনা দখল করলেন কী কৌশলে? তার তুলনায় একটি সাদামাটা ছাত্রী ভিয়েনাতে কীভাবে জীবন-যাপন করেছিল সেটা বের করা তো অতি সহজ। ভিয়েনাতে সে-যুগে বিস্তর প্রাইভেট ডিটেকটিভও ছিল।

আমার মনে হয় বিশ্বাস করুন আর নাই করুন–বুদ্ধিমতী গেলি তার মামার চরিত্রের একটি দিক আবিষ্কার করতে পেরেছিল তখনই, যেটি বিশ্বমানব আবিষ্কার করে স্তম্ভিত হল পুরো পনেরোটি বছর পরে, এবং তা-ও সম্ভব হত না, যদি যুদ্ধে হিটলার পরাজিত না হতেন এবং ফলে গ্যাসচেম্বার ইত্যাদি আবিষ্কৃত না হত। সে তত্ত্বটি হিটলার কী অবর্ণনীয়, নিষ্ঠুর দানব!– এই তত্ত্বটি গেলি আবিষ্কার করে এক বিভীষিকার সম্মুখীন হল। হিটলার যে কোনও মুহূর্তে, কারও সুখদুঃখের কথা মুহূর্তমাত্র চিন্তা না করে তার দয়িতকে নিষ্ঠুরতম পদ্ধতিতে খুন করাতে পারেন। আজ যদি কেউ বলে, এই ভয় দেখিয়েই ব্ল্যাকমেল করে হিটলার গেলিকে ১৯২৭ থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত তার মুনিকের বাড়িতে— আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীন কিন্তু বস্তুত পরাধীনের চেয়েও পরাধীনভাবে আটকে রেখেছিলেন তবে সেটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য মনে হবে কেন? এবং হয়তো ওই চার বছর ধরে তাকে বাধ্য হয়ে রক্ষিতার লীলাখেলাও খেলতে হয়েছিল। হফমান বলেছেন, গেলির চরিত্রবল ছিল দৃঢ় এবং সে ছিল স্পিরিটেড গার্ল। মুনিক থেকে অস্ট্রিয়ার পথ কতখানি? আর বেৰ্ষটেশগাডেনের বাড়ি থেকে তো অস্ট্রিয়ান সীমান্ত আরও কাছে। পায়ে হেঁটে ওপারে যাওয়া যায়। বস্তুত হিটলার সেই কারণেই বেছে বেছে ওই জায়গাটিতেই বাড়ি কিনেছিলেন। এ-পারে, অর্থাৎ জর্মনিতে রাজনৈতিক বাতাবরণ বড় বেশি উষ্ণ হয়ে পড়লে, কাউকে না জানিয়ে, বনের ভেতর দিয়ে অক্লেশে ওপারে যেতে পারবেন বলে– অঞ্চলটাও অস্বাভাবিক নির্জন এবং ওই যুগে পাসপোর্টের কড়াকড়ি তো ছিলই না, এ-সব জায়গায় যারা নিত্য নিত্য ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে এপার-ওপার করত তাদের তো পাসপোর্ট আদৌ থাকত না।

এমন অবস্থায়ও স্পিরিটেড গেলি গ্রামে থাকাকালীন ওপারে চলে গিয়ে ভিয়েনা যেতে পারল না?– সেখান থেকেও ভিয়েনা তো রেলে মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। না, তা নয়! অমতে যাওয়ার মানেই হত, দয়িতের অবশ্যমৃত্যু। এবং পরে সে নিজেও হয়তো কিডন্যাপড় হতে পারত। তাই সে আপন কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বলেছিল, হফমানের স্ত্রীকে : Well thats that! And theres nothing you or I can do about it. So lets talk about something else এ কথোপকথনের উল্লেখ আমি পূর্বেই করেছি।

হয়তো আমার নিছক কল্পনা! কিন্তু আমার মনে হয় গেলি দিনের পর দিন অভিনয় করে গেছে (যেটা হন ঠিক ধরতে পেরেছিলেন, কিন্তু পুৎসি বুঝতে না পেরে ঢলাঢলি বলেছেন) যদি শেষ পর্যন্ত মামার মন গলানো যায়, যখন দেখল কোনও ভরসাই নেই তখন করেছিল শ্মশান-চিকিৎসা পুরোপুরি ঝগড়া, যেটা একাধিক প্রতিবেশী শুনতে পেয়েছিল, এবং হয়তো-বা হয়তো-বা আত্মহত্যার ভয়ও দেখিয়েছিল, এবং হয়তো তার চোখে-মুখে তখন এমন ভাব ফুটে উঠেছিল যে চতুর–শঠ– হিটলার বুঝেছিলেন, এ ভয় দেখানোটা নিতান্ত শূন্যগর্ভ নয়, এটা আর পাঁচটা হিস্টেরিক (এবং হফমান বলেছেন, গেলি আদপেই হিস্টেরিক ছিল না) মেয়ের মতো নিতান্ত অর্থহীন প্রলাপ নয়। তাই বোধহয় মনিক শহর থেকে বেরোবার সময় সখাকে বলেছিলেন, কেন জানিনে আমার মনটা যেন অস্বস্তিতে ভরে উঠেছে, I dont know why, but I have a most uneasy feeling তাই তার পরবর্তী বিষণ্ণতা। পথিমধ্যে টেলিফোনের কথা শুনেই যেন বুঝতে পেরেছিলেন, এ টেলিফোনে থাকবে গেলি সম্বন্ধে দুঃসংবাদ।

এ অনুমান যদি সত্য হয় তবে বলতে হবে গেলি যে ভয় দেখিয়েছিল সেটা শূন্যগর্ভ, ফাঁকা আওয়াজ ছিল না। সে সেটা কাজে পরিণত করেছিল প্রথমতম সুযোগেই।

————

১. এই ভারতের অন্ধ্র অঞ্চলে হিন্দু সমাজে আপন সহোদরা ভগ্নীর মেয়েকে বিয়ে করা খুবই স্বাভাবিক ও নিত্য নিত্য হয়। বস্তুত প্রথমেই মামাকে কন্যাদানের প্রস্তাব করতে হয়– যেন ন্যায্য হক তারই। সে রাজি না হলে অন্যত্র তার বিয়ে হয়।

২. হিটলার-পরিবারের কুলজীটি দেশি-বিদেশি কোনও ঘটক-ঠাকুরেরই অমলানন্দের কারণ হবে না। প্রথমত হিটলারের (Hitler, Hiedler, Huetler, Huettler–আমাদের দেশের অল্পশিক্ষিত চাষাদের মতো হিটলারের ঠাকুরদাদারা নানাভাবে এ নাম বানান করেছেন; স্বয়ং হিটলারের পিতা– তাঁর জন্ম জারজরূপে– সেকথা পরে হবে, গোড়াতে Hiedler, এবং পরে Hitler বানান করেছেন) পিতা এবং মাতা উভয়েই দুই ভাই, অর্থাৎ হিটলার পদবি ধরেন এমন দুজনার বংশগত, এবং এই কারণে হিটলারের পিতা যখন তাঁর মাতাকে বিয়ে করেন তখন চার্চের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়েছিল। দ্বিতীয়ত ফুরার আডলফ হিটলারের পিতামহ বিবাহ করেন Maria Anna Schicklgruber-কে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে, কিন্তু তার পাঁচ বছর পূর্বে Schicklgruber একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন কুমারী অবস্থাতেই ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে ৭ জুন। এই পুত্রই ফুরার আডলফ হিটলারের পিতা। এবং যেহেতু নবজাত শিশুর মাতা বিবাহিতা নয় তাই রীতি অনুযায়ী তাকে দেওয়া হয় মাতা-মাতামহের পারিবারিক নাম Alois Schicklgruber। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, বিয়ের পরও পিতা তার পুত্রের নাম Hiedler (তিনি এভাবেই বানান করতেন)-এ পরিবর্তন করার মেহন্নটুকু আপন স্কন্ধে তুলে নেননি। অবশ্য এ কথা যেমন প্রমাণ করা যায় না, তেমনি বাতিল করাও যায় না যে Alois সত্যই ফুরারের পিতামহ Johann Georg Hiedler-এর ঔরসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কি না, তবে সে অঞ্চলের সাধারণজনের বিশ্বাস ছিল Alois-এর জন্ম Johann Georg-এর ঔরসেই। Alois-এর মাতা Maria ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে মারা যেতেই Johann Hiedler অন্তর্ধান করেন। ত্রিশ বছর পর তিনি পুনরায় দেখা দিলেন এবং তিনজন সাক্ষী ও নোটারির (উকিলের) সামনে শপথ নিলেন যে, Alois Schicklgruber তারই ঔরসজাত পুত্র বটে। ওইদিন থেকে তার নাম হল Alois Hitler (বা Hiedler)। ইনিও একাধিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে তার পিতারই মতো। এদিক ওদিক বিস্তর ঘোরাঘুরির পর বিয়ে করেন শুল্ক বিভাগের এক পালিতা কন্যা Anna Glasl-Hoerer-কে। এ বিয়ে সুখের হয়নি। এবং একে তালাক দেওয়ার পূর্বেই Alois বন্ধুত্ব করেন কুমারী Franziska Matzelsberger-এর সঙ্গে। ফলে একটি পুত্রসন্তান হয়। এর নামও Alois। ইনিও জারজ; পরে আইনত পিতার নাম পান। এর পিতা তাঁর মাতা Franziska-কে বিয়ে করেন তার তালাকপ্রাপ্তা প্রথম স্ত্রী Anna Glasl-Hoerer-এর মৃত্যুর পর। বিয়ের তিন মাস পর Franziska একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেন (এর নাম Angela এবং ইনিই পরবর্তীকালে হিটলারের নতুন বাড়ি দেখাশুনা করার ভার নেন ও সঙ্গে নিয়ে আসেন কন্যা, হিটলারের প্রেয়সী Angelica, ডাকনাম Geli)। কিন্তু Angela-র জন্মের এক বছর পরে Franziska ক্ষয়রোগে মারা যান। এর চার বছর পর ফুরার আডলফ হিটলারের পিতা Alois Hitler বিয়ে করেন তার ঠাকুদ্দার ভাইয়ের নাতনি শ্রীমতী Klara Poetzl-কে, ৭ জানুয়ারি ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে। এ বিয়ের চার মাস দশদিন পরে জন্মান ফুরারের সর্বজ্যেষ্ঠ সহোদর ভ্রাতা Gustav এবং বাল্যকালেই মারা যান, এবং তার পরের কন্যা Idao-ও অল্পবয়সে মারা যান। ফুরার অ্যাডলফ হিটলার তৃতীয় সন্তান (পিতার তৃতীয় বিবাহের)। তার ছোট ভাই Edmund এ পৃথিবীতে মাত্র ছ মাস ছিল। সর্বশেষ সন্তান– পঞ্চমা– Paula ফুরারের মৃত্যুর পর, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত চিরকুমারী অবস্থায় Salzburg-এ বাস করতেন। এই পাউলা একবার ভ্রাতার (হিটলার তখন ফুরার) বাড়িতে তাঁকে দেখতে আসেন কিন্তু দীর্ঘদিন (হিটলারের হিসেবে) থাকেন বলে ভ্রাতা অ্যাডল্ফ তাকে আর কখনও নিমন্ত্রণ জানাননি। সভাই (পিতার ২য় বিবাহের জ্যেষ্ঠ পুত্র Alois) বার্লিনে মদ বেচতেন। তাঁর সম্বন্ধে হিটলার কখনও একটি বর্ণও উচ্চারণ করেননি। তাঁর ছোট বোন Angela বেশ কয়েক বছর হিটলারের গ্রামের বাড়ি চালানোর পরে ঝগড়া করে চলে যান এবং এক ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করেন। হিটলার এমনই চটে যান যে, বিয়েতে কোনও উপহার পর্যন্ত পাঠাননি।

৩. হিটলারের প্রখ্যাত জীবনীলেখক বুল বলেন–he (Hitler) discovered that she (Geli) had allowed Maurise to make love to her, ইংরেজিতে to make love হয়তো একাধিক অর্থ ধরে।

 ৪. লন্ডন পুলিশ নাকি বেশ্যাবাড়িতে হামলা চালালে মাঝে মাঝে চাবুক, লোহার গুলিওয়ালা রাইডিং বুট, ইত্যাকার যন্ত্রণাদায়ক সাজসরঞ্জাম পায়। বেশ্যাদের বক্তব্য, খদ্দের ভদ্রলোক। তিনি স্ত্রীকে এসব করতে আদেশ দিতে পারেন না– স্বাভাবিক লজ্জাবশত। তাই এ ধরনের লোক আমাদের কাছে আসেন। আমরাও সাজসরঞ্জাম তৈরি রাখি। স্ত্রীলোক ম্যাজোকিস্টও আছে, এবং যেসব রমণী স্বামী মারপিট করলে চিৎকার করে, কিন্তু যৌনানন্দ পায়, তাদের নরমতর ম্যাজোকিস্ট বলা হয়। অনেকের মতে অনেক রমণী বাড়িতে এমন সব কাজ করে থাকে বা করে না (যেমন ঘর ঝাঁট দিল না, রান্না করল না, বা স্বামীর গামছাখানা লুকিয়ে রাখল) যাতে করে স্বামী তাকে ঠ্যাঙায়।

৫. শাইরার বলেন, হিটলার ও ব্রাউনের পরিচয় হয় গেলির মৃত্যুর এক বা দুই বছর পরে। কিন্তু এ বিষয়ে হফমানের বক্তব্যই অধিকতর বিশ্বাস্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *