গেলির আত্মহত্যায় হিটলারের শোক

গেলির আত্মহত্যায় হিটলারের শোক

হিটলারের চরিত্রবল ছিল অসাধারণ এবং তাঁর ভেঙে পড়াটাও ছিল অসাধারণ। তবে যে দুটো ভেঙে পড়ার কারণ ইতিহাসের জানা আছে তার শেষটা আত্মহত্যা করার কয়েক দিন আগে থেকে তার খাস-চাকর (ভ্যালে) লিঙে সেটির কিছুটা বর্ণনা দিয়েছেন, এবং গেলির মৃত্যুর পর। দুটো প্রায় একই প্রকারের।

প্রথম দু দিনের খবর কেউ ভালো করে লেখেননি, তবে তখনকার দিনের অন্যতম প্রধান নাৎসি নেতা গ্রেগর স্ট্রাসার পরে বলেন যে, এ দু দিন তিনি এক মুহূর্ত হিটলারের সঙ্গ ত্যাগ করেননি, পাছে তিনিও আত্মহত্যা করেন।(১)

এর পর তাঁর সঙ্গে ছিলেন, একমাত্র সাক্ষীরূপে, আমাদের পূর্বপরিচিত হন। এবার তাকে অক্ষরে অক্ষরে অনুবাদ ভিন্ন গত্যন্তর নেই। এটা সত্যই ওয়ান ম্যান্স স্টোরি। তিনি বলছেন, মুনিকে ফেরার পর দু দিন পর্যন্ত হিটলারকে আমি আদৌ দেখতে পাইনি। তার স্বভাব আমি ভালো করেই জানতুম, এবং বর্তমান শোচনীয় পরিস্থিতিতে আমি উত্তমরূপেই হৃদয়ঙ্গম করেছিলুম যে, তিনি হয়তো নির্জনে একা একা থাকাটাই বেশি পছন্দ করবেন– আমিও তাই তাঁর পাশ ঘেঁষিনি। তার পর হঠাৎ মাঝরাতে টেলিফোনের ঘণ্টা বাজল। নিদ্রাজড়িত অবস্থায় আমি গেলুম উত্তর দিতে।

হিটলারের গলা। হফমান, এখনও জেগে আছ কি? কয়েক মিনিটের তরে আমার এখানে আসতে পার কি? হিটলারের গলা বটে কিন্তু কেমন যেন অদ্ভুত অচেনা। সে কণ্ঠ ক্লান্ত আর সর্ব অনুভূতি গ্রহণে জড়ত্বে চরমে গিয়ে পৌচেছে। পনেরো মিনিট পরেই আমি তার কাছে পৌঁছলুম।

দরজা তিনি নিজেই খুলে দিলেন। অভ্যর্থনাসূচক কোনও কথা না বলে নীরবে তিনি আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন তাঁকে দেখাচ্ছে বিরস; যেন সর্ব আত্মজন বিবর্জিত। বললেন, হফমান, আমাকে তুমি সত্যিকার একটি মেহেরবানি করবে কি? আমি এ বাড়িতে আর টিকতে পারছিনে, যেখানে আমার গেলি মরে গেছে; মুলার টেগার্নজে হ্রদের উপর তার সেন্ট কুইরিনের বাড়ি আমাকে থাকতে দিতে চেয়েছে; তুমি আমার সঙ্গে আসবে? গেলির কবর না হওয়া পর্যন্ত সে কটা দিন আমি সেখানে থাকতে চাই। ম্যলার কথা দিয়েছে। সে ও-বাড়ির চাকর-বাকর সব কটাকে ছুটি দিয়ে ওখান থেকে সরিয়ে দেবে। একমাত্র তুমিই সেখানে থাকবে আমার সঙ্গে। আমাকে এ অনুগ্রহটা তুমি করবে কি? তাঁর কণ্ঠস্বরে ছিল সনির্বন্ধ মিনতির অনুনয়; বলা বাহুল্য আমি তৎক্ষণাৎ সম্মতি জানালুম।

সেন্ট কুইরিন বাড়ির প্রধান ভূত্য বাড়ির চাবিটা আমার হাতে তুলে দিল। বিস্ময় এবং সহানুভূতির দৃষ্টি দিয়ে শোকাঘাতে ভেঙেপড়া হিটলারের দিকে একবার তাকিয়ে সে চলে গেল। শোফার শ্রে আমাদের সে বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেওয়ার পর তাকেও ফেরত পাঠানো হল। চলে যাওয়ার আগে সে কোনও গতিকে সুযোগ করে আমাকে কানে কানে বলে গেল, সে হিটলারের রিভলবার সরিয়ে নিয়েছে, কারণ তার ভয় পাছে নৈরাশ্যের চরমে পৌঁছে তার আত্মহত্যা করার প্রলোভন হয়। এবারে রইলুম সুন্ধুমাত্র আমরা দুজন– আর একটিমাত্র জনপ্রাণী নেই। হিটলার উপরের ঘরে আর আমি ঠিক তার নিচের ঘরটায়।

সে-বাড়িতে হিটলার আর আমি মাত্র এই দুজন। আমি তাঁকে তাঁর ঘর দেখিয়ে বেরিয়ে যেতে না যেতেই তিনি দু হাত পিছনে নিয়ে এক হাতে আরেক হাত ধরে পায়চারি করতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। আমি জিগ্যেস করলুম, তার খেতে ইচ্ছে করছে কি না, একটিমাত্র শব্দ না বলে তিনি শুধু মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালেন। আমি তবু এক গেলাস দুধ আর কিছু বিস্কুট উপরে নিয়ে তার ঘরে রেখে এলুম।

আমি আপন কামরার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে শুনলাম উপরের পায়চারির তালে তালে ওঠা ভারি শব্দ। ঘন্টার পর ঘন্টা চলল সেই পায়চারি– একবারও ক্ষান্ত দিল না, একবারও জিরুল না। রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে এল– আমি তখনও শুনছি তার একটানা পায়চারি ঘরের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত, ফের ওই প্রান্ত থেকে এ প্রান্ত। সেই একটানা শব্দের মোহে আমি অল্প কিছুক্ষণের জন্য তন্দ্রাচ্ছন্নই হয়ে গিয়েছিলুম। হঠাৎ কী যেন আচমকা ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ সচেতন করে দিলে। পায়চারি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, আর যেন মৃত্যুর নীরবতা চতুর্দিকে বিরাজ করছে। আমি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালুম। তবে কী করছেন হিটলার এখন…? অতি সন্তর্পণে এবং মৃদু পদক্ষেপে আমি যেন লুকিয়ে উপরের তলায় গেলুম। উঠবার সময় কাঠের সিঁড়ি অল্প অল্প কাঁচ ক্যাচ শব্দ করল। আমি দরজায় পৌঁছতেই– ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আবার পায়চারিটা আরম্ভ হল। বুকের বোঝা যেন অনেকটা হালকা হয়ে গেল; আমি চুপিসারে আপন ঘরে ফিরে এলুম।

এবং এইভাবে চলল সমস্ত দীর্ঘ রাত ধরে সেই পায়চারি– ঘণ্টার পর ঘণ্টা, অন্তহীন দীর্ঘ ঘণ্টা। আমার মন চলে গেল আমাদের বিগত একাধিকবার এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-পরিপূর্ণ টেগার্নজে হ্রদের কোলে লালিত বাড়িতে আসার স্মরণে। তখন সবকিছু কতই-না সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।

গেলির মৃত্যু আমার বন্ধুর গভীরতম সত্তাকে নাড়া দিয়ে কাঁপিয়ে তুলেছে। তবে কি তিনি নিজেকে তার জন্য দায়ী অনুভব করছিলেন। তিনি কি অনুতপ্ত আত্ম অভিযোগ দিয়ে আপন সত্তাকে কঠোরতম যন্ত্রণা দিচ্ছিলেন। তিনি এখন করবেনই-বা কী? এ ধরনের অনেক প্রশ্ন আমার মাথার ভেতরে ক্রমাগত হাতুড়ি পেটাচ্ছিল, আর আমি খুঁজে পাচ্ছিলুম না একটারও উত্তর।

উষার প্রথম আবির্ভাব অন্ধকার আকাশকে আলোকিত করে তুলছিল, এবং আমি আমার জীবনে উষাগমনে হৃদয়ের ভেতর কখনও এতখানি কৃতজ্ঞ অনুভব করিনি। আমি আবার উপরে গিয়ে তার দরজায় মৃদু করাঘাত করলুম। কোনও উত্তর এল না। আমি ভিতরে গেলুম কিন্তু হিটলার আমার উপস্থিতি সম্বন্ধে বিস্মৃতিতে নিমগ্ন হয়ে আমাকে লক্ষমাত্র করলেন না। দেহের পিছনে এক হাত দিয়ে অন্য হাত ধরে সুদূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে কিন্তু কোনও জিনিস না দেখে, তিনি তাঁর অন্তহীন পায়চারি চালিয়ে যেতে লাগলেন। যন্ত্রণায় তার মুখের রঙ পাশুটে, ক্লান্তিতে সেটা ঝুলে পড়েছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি চেহারাটাকে করে দিয়েছে বিষদৃশ, চোখদুটো ডুবে গিয়েছে কোটরের গভীরে, সেগুলোর নিচের অংশ কালো কৃষ্ণমসীলিপ্ত আর ঠোঁটদুটো একটা আরেকটাকে চেপে ধরে এঁকেছে যেন তিক্ত অভিশপ্ত একটি রেখা। দুধ আর বিস্কুট স্পর্শ করা হয়নি।

চেষ্টা করেও সামান্য একটা কিছু খাবেন না তিনি, প্লিজ? আমি শুধালুম। আবার কোনও উত্তর এল না, শুধু সামান্য একটু মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেন। আমি মনে মনে ভাবলুম, অন্তত অল্প কিছু একটা ওঁকে খেতেই হবে, নইলে তিনি যে হুমড়ি খেয়ে ভিরমি যাবেন। আমি মুনিকে আমার বাড়িতে ফোন করে শুধালুম গেত্তি কী করে রাঁধতে হয়? হিটলারের অন্যতম প্রিয় খাদ্য এটি। সেখান থেকে পাক-প্রণালীর যে দিকনির্দেশ পেলুম বর্ণে বর্ণে সেই অনুযায়ী আমি রন্ধনকলায় আমার নৈপুণ্য আছে কি না সেই পরীক্ষাতে প্রবেশ করলুম। আমার নিজের মতে ফলটা ভালোই ওত্রালো। কিন্তু আবার আমার ভাগ্য বাম। যদিও এই ধরনের গেত্তি তাঁর প্রিয় খাদ্য, যদিও আমি আমার রন্ধন-নৈপুণ্য প্রশংসায় প্রশংসায় সপ্তম স্বর্গ অবধি তুলে দিয়ে তাঁকে অনুনয়-বিনয় করলুম, চেষ্টা দিয়েও অতি অল্প একটুখানি মুখে দিতে–আমার মনে হল আমি যা কিছু বলেছি, সে তার দু পাশ দিয়ে চলে গেছে, তিনি তার এক বর্ণও শোনেননি।

ধীরে মন্থরে দিনটা তার সীমান্তের দিকে এগিয়ে চলল, তার পর এল আরেকটা রাত্রি, সেটা আগেরটার চেয়েও বিভীষিকাময়। আমি আমার সহ্যশক্তি, আত্মকর্তৃত্বের শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছি। জেগে থাকা আমার পক্ষে এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে; ওদিকে উপরে সেই পায়চারি চলেছে তো চলেছে অবিরাম, আর তার শব্দ যেন কেউ তুরপুন দিয়ে আমার খুলি ফুটো করে ভেতরে ঢোকাচ্ছে। যেন এক ভয়াবহ উত্তেজনা তাঁকে তার পায়ের উপর রেখে চলেছে এবং কিছুই তাঁকে ক্লান্ত করতে পারে না।

তার পর এল আরেকটা দিন। আমি নিজেই তখন যে কোনও মুহূর্তে আপন সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় জড়ন্দ্রিায় অভিভূত হয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতে পারি। আমার নড়াচড়া, আমার কাজকর্ম করা সবকিছু যন্ত্রচালিত বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত অন্ধশক্তির প্রকাশ মাত্র। কিন্তু মাথার উপরে পদধ্বনি কখনও থামেনি।

সন্ধ্যা ঘনানোর পর আমরা শুনলুম, গেলির গোর হয়ে গিয়েছে, এবং হিটলারের সে গোরের দিকে তীর্থযাত্রারম্ভ করতে কোনও অন্তরায় নেই। সেই রাত্রেই আমরা রওনা দিলুম। নিঃশব্দে হিটলার ড্রাইভার শ্রেকের পাশে বসলেন। আমার উপরে যে অসহ্য চাপ আমাকে ধরে রেখেছিল সেটা যেন হঠাৎ ছিঁড়ে দু-টুকরো হয়ে গেল আর আমি গাড়ির ভেতর সেই অবসাদজনিত অঘোর নিদ্রায় ঘণ্টাখানেক কিংবা দুই ঘুমিয়ে নিলুম। ভোরের দিকে আমরা ভিয়েনা পৌঁছলুম, কিন্তু এই সমস্ত দীর্ঘ চলার পথে হিটলার একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করেননি।

আমরা সোজা নগরের ভেতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে কেন্দ্রীয় গোরস্তানে পৌঁছলুম। এখানে এসে হিটলার একা গোরের দিকে গেলেন। সেখানে পেলেন তাঁর নিজস্ব দুই এডিকং শ্বাস এবং শাউব– তারা সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আধঘণ্টার ভেতরই তিনি ফিরে এলেন এবং গাড়ি ওবের-জালসূবের্গে চালিয়ে নিয়ে যেতে হুকুম দিলেন।

গাড়িতে উঠতে না উঠতেই তিনি কথা আরম্ভ করলেন। উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে তিনি স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে যেন আত্মচিন্তা করছিলেন, কিন্তু স্পষ্ট কথা বলে বলে। আচ্ছা! তাই সই! বললেন তিনি। আরম্ভ হোক তবে সংগ্রাম– যে সগ্রাম শিরোপরি কৃতকার্যতার বিজয়মুকুট পরবেই পরবে, পরতে বাধ্য। আমরা সকলেই বিধির এক বিরাট আশীর্বাদ-প্রাপ্ত স্বস্তি অনুভব করলুম।…

এর পর হিটলার আঁপিয়ে পড়লেন তাঁর বক্তৃতাসফরে। আজ এখানে কাল সেখানে এমনকি একই দিনে দু-তিন ভিন্ন ভিন্ন নগরে বক্তৃতা দিয়ে যেতে লাগলেন। সেগুলো আগের চেয়ে যেন শ্রোতাদের করে দেয় অনেক বেশি আত্মহারা, যেন তাদের চিন্তাধারাকে তিনি হুকুম দিয়ে বাধ্য করছেন তারা যাবে কোন পথে। এবং শ্রোতাকেও বক্তৃতা দিয়ে আপন মতে টেনে আনার শক্তি যেন তার বেড়ে গেছে শতগুণে। হফমান বলছেন, এই শহর থেকে শহর ছুটোছুটি, প্রথমে জর্মনির সবচেয়ে শক্তিশালী মোটর মেসেডেজে করে, পরে আপন অ্যারোপ্লেনে (অনেকেই বলেন রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার জন্য ইওরো-আমেরিকায় হিটলারই সর্বপ্রথম নিজস্ব হাওয়াই জাহাজ ব্যবহার করেন এই ব্লিস্ প্রোপাগান্ডা যেন পরবর্তী যুগের ব্লিৎসক্ৰিগের পূর্বাভাস।); এখানে বিরাট বিরাট জনসভা, শ্রোতাদের চিৎকার করতালি, মিটিংশেষে উন্মত্ত জনতার প্ল্যাটফর্ম আক্রমণ– ফুরারকে কাছের থেকে দেখার জন্য এসব হট্টগোল ধুন্ধুমারের ভেতর হিটলার যেন গেলির শোক নিমজ্জিত করে দিতে চাইছিলেন।

এর তিন সপ্তাহ পরে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গ আলাপ-আলোচনার জন্য হিটলারকে ডেকে পাঠান, সে কথা পূর্বেই বলেছি; যারা বলেন, সে আলোচনা নিষ্ফল হওয়ার কারণ গেলির শোকে হিটলার এমনই মোহাচ্ছন্ন ছিলেন তাঁর দাবি তিনি যথোপযুক্ত ভাষা ও দৃঢ়তার সঙ্গে প্রকাশ করতে পারেননি, ব্যক্তিগতভাবে আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। আমি বরঞ্চ হফমান যা বলেছেন তার সঙ্গে একমত। আমার মনে হয়, তখনও হিডেনবুর্গ তাঁর চিরপরিচিত প্রাচীনপন্থী আপন চক্রের ভেতরকার নেতাদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিরাশ হননি। তখনও হিটলারের সময় হয়নি।

***

গেলির জীবন, তার মৃত্যু, তার স্মৃতি সবকিছু ধর্মে উদাসীন হিটলারকে যেন এক নতুন অনুষ্ঠানবেষ্টিত সংস্কার-বিশ্বাসী করে তুলল। তিনি স্বহস্তে গেলির কামরা চাবি বন্ধ করে দিয়ে হুকুম দিলেন, একমাত্র গৃহরক্ষিণী ফ্রাই ভিন্টারেরই সেখানে প্রবেশাধিকার। বহু বছর ধরে তিনি প্রতিদিন গেলির প্রিয় ফুল তাজা ক্রিসেনথিমাম সে ঘরে রাখতেন। বেৰ্ষটেশগাডেনের বাড়িতে এবং পরবর্তী যুগে ফুরার যখন দেশের সর্বাধিকারী (তিনি প্রথমে চ্যানসেলর বা প্রাইম মিনিস্টাররূপে রাজ্যভার গ্রহণ করেন, এবং বছর দেড়েক পর প্রেসিডেন্ট গত হলে তিনি সে পদ পূর্ণ না করে নিজেই গ্রহণ করে পরিপূর্ণ ডিকটেটর নিরঙ্কুশ নেতা ফুরার হন) তখন রাজভবনে গেলির ছবি বিরাজ করত সর্বত্র। বছরে দুই দিন তার জন্মদিন আর মৃত্যুদিন রুচিসম্মত আড়ম্বরে উদযাপিত হত। সর্বোকৃষ্ট চিত্রকর ও ভাস্করদের দেওয়া হল গেলির নানা অবস্থায় তোলা নানাবিধ ফোটোগ্রাফ। সেগুলোর ওপর নির্ভর করে উত্তম ওয়েলপেন্টিং মূর্তি নির্মিত হল। জর্মনির অন্যতম উক্তৃষ্ট শিল্পী, তখনকার দিনের সর্বোকৃষ্টদের একজন– গেলির একটি অনবদ্য ব্রোঞ্জু মূর্তি নির্মাণ করেন। এদের একটা না একটা হিটলারের প্রতি বাসভবনে সর্বোচ্চ সম্মানের স্থানে রাখা হত।

এর প্রায় তেরো বছর পর এই আর্টিস্টদের অন্যতম, সিলার যখন যুদ্ধে পরাজয় মনোবৃত্তি প্রকাশের ফলে নাৎসি গেস্তাপো পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দীর্ঘ কারাবাসের পর মুক্তির আশা সম্বন্ধে নিরাশ হয়ে গিয়েছেন তখন তিনি যে একদা গেলির ছবি এঁকেছিলেন (যদিও কারও কারও মতে তিনি আর্টিস্ট হিসেবে ছিলেন অতিশয় মামুলি) সে কথা হিটলারকে স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি তাঁকে তদ্দশ্যেই মুক্তি দেন।

হফমানের বিশ্বাস, গেলির সঙ্গে হিটলারের যদি পরিণয় হত তবে হিটলারের জীবন এরূপ শোচনীয় পরিসমাপ্তি পেত না। তাঁর মতে, শতধাবিভক্ত জৰ্মনিকে একাঙ্গ করে তাকে নব জীবনরস দিয়ে তিনি পুনরুজ্জীবিত করতেন নিশ্চয়ই, কিন্তু জর্মনির বাইরে যেসব বিবেচনাহীন অভিযানে বেরুলেন, সেখানে পারিবারিক শান্তি এবং তৃপ্তি– হিটলার যেটাকে অসীম মূল্য দিতেন– তথা গেলির তীক্ষ্ণবুদ্ধি, হিটলারের ওপর তার অসীম প্রভাব তাঁকে সংযত করে নিরস্ত করত– তাঁর অন্তিম নিশ্বাস বীভৎসতাময় পরিবেশে ত্যাগ না করে শান্তিতেই ফেলতে পারতেন।

হফমান বলেন, তার পরে যখনই গেলির কথা উঠেছে, হিটলারের চোখ জলে ভরে যেত। এবং একাধিক পরিচিতজনকে হিটলার স্বয়ং বলেছেন, জীবনে ওই মাত্র একবারই তিনি ভালোবেসেছিলেন।

***

গেলির মৃত্যুর চৌদ্দ বছর পর, হিটলার, আত্মহত্যা করার প্রায় দেড় দিন পূর্বে, এফা ব্রাউনকে বিয়ে করেন এবং তাঁর সম্বন্ধে কৌতূহল পৃথিবীবাসীর এখনও যায়নি। কিন্তু তার বর্ণনা এর সঙ্গে যায় না।

আমি হিসাব করে দেখেছি, হিটলারের জীবনে তিনটি দুর্দৈব দেখা দেয়। প্রথম দুটিতে তিনি প্রায় ভেঙে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যেতেন পাঠক আদৌ ভাববেন না, গ্যাস-চেম্বার নির্মাতার অন্য কোনও দিকে কোনও প্রকারের স্পর্শকাতরতা থাকে না, (তা হলে কসাইয়ের ছেলে মরলে সে কাঁদত না) এবং এঁরা অসাধারণ জীব বলে সে-সব স্থলে তাঁদের স্পর্শকাতরতা হয় অসাধারণ সূক্ষ্ম, তাঁদের বেদনানুভূতি প্রায় অনৈসর্গিক তীব্র–তৃতীয়বারের ঘটনা সকলেই জানেন। সেবার তিনি নিষ্কৃতি পাননি। আত্মহত্যা ছাড়া তখন তার আর অন্য কোনও গতি ছিল না। প্রথম দুর্দৈব তাঁর মাতার মৃত্যু। হিটলার তখন বালক, কিন্তু সেই বালকই তার মাকে যা সেবা করেছে সেটা অবর্ণনীয়, অবিশ্বাস্য– শুধু বলা যেতে পারে, স্বর্গজাত ভক্তি-প্রেমরস যেন ওই মাত্র একবার পৃথিবীতে হিটলার-জননীর মৃত্যুশয্যাপাশ্বে অবতীর্ণ হয়েছিল। তাঁর বাল্যবন্ধু তখনকার দিনের হিটলার ও মাতার মৃত্যুর পর তাঁর অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। এরকম বর্ণনা আমি আর কোথাও পড়িনি। সেবারে তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িতা মাতার শয্যাপার্শ্বে টুলের উপর বসে বসে কাটিয়েছিলেন দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি, সেবা করেছেন সমস্ত হৃদয় ঢেলে দিয়ে।

দ্বিতীয় দুর্দৈব– গেলির আত্মহত্যা।

তৃতীয়বারে– এবং শেষবারের মতো তিনি সুযোগ পেলেন সেই পায়চারি করার।

তার খাস চাকর লিঙে তার বর্ণনা দিয়েছেন। শুধু লিঙে দেখেছিলেন কাছের থেকে বলে তন্ন। তন্ন করে বর্ণনা দিতে পেরেছেন, আর হফমান নিচের তলা থেকে শুনতে পেয়েছিলেন শুধু!

কিন্তু হায়, তাঁর শেষ পদচারণার পূর্বেই তার স্বাস্থ্য সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। তার শরীরের সম্পূর্ণ বাঁ দিকটা সমস্তক্ষণ কাপে (পার্কিনসন ব্যাধি কিংবা সেন্ট ভাইরাসের নৃত্য রোগ) বা হাতটা এত বেশি স্বেচ্ছায় স্বাধীনভাবে ঘন ঘন ওঠে নামে যে পায়চারি না করার সময়ও সেটাকে প্রায়ই তিনি ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে শান্ত করার চেষ্টা দিতেন। বাঁ পা-টাকে ঘষ্টে ঘষ্টে টেনে টেনে তাঁকে চলাফেরা করতে হয়, আর দু চোখের উপর কখনও-বা ফিমের মতো বাম্পাভাস, আর কখনও-বা অস্বাভাবিক তীব্র, উজ্জ্বল জ্যোতির মতো।

এই বেদনাদায়ক অবস্থায় যখন সাধারণ জন শুয়ে-বসেও শান্তি পায় না, তখন হিটলার দু হাত পিছনে নিয়ে সজোরে ডান হাত দিয়ে বা হাত চেপে ধরে বাঁ পা টেনে টেনে– যেন কোনও জড়পদার্থ, তিনি আপন দেহ দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন– আরম্ভ করলেন সেই প্রাচীন দিনের পায়চারি। মাঝে মাঝে দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে তার উপর মুষ্ট্যাঘাত করেন– কারাবাসী-জন যে-রকম করে থাকে; তবে কি তিনি শহরের চতুর্দিকে শত্রুসৈন্য বেষ্টিত হয়ে কারাবন্দির অনুভূতিই অনুভব করেছিলেন? কিন্তু হায়, এখন তিনি শক্তিহীন জরাজীর্ণ। প্রহরের পর প্রহর, দিনের পর দিন পদচারণা করার দৈহিক শক্তি আর নেই। তাই মাঝে মাঝে বসেন চেয়ারের উপর আর শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকেন দেওয়ালের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

কিন্তু এখন আর কী প্রয়োজন পদচারণের?

সেদিন গেলির মৃত্যুর পর উত্তেজিত হয়ে তুমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলে এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়চারি করে সে উত্তেজনা বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলে। এবার যে ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অন্ধকার! শত্রুর হাতে অসীম যন্ত্রণা, অশেষ অপমানের পর হয়তো ফাঁসি। এবার তোমার আত্মহত্যার পালা।

তবু পদচারণ করো, হিটলার।

একদা গেলি চলে যাওয়ার পর করেছিলে অস্থির পদক্ষেপ, এবার গেলির সঙ্গে পুনর্মিলনের প্রাক্কালে অবশ্য দেহ টেনে টেনে।

———–

১. বোধহয়, তারই কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ স্ট্রাসারকে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন জোলাপের (এটার উল্লেখ আমরা একাধিকবার করেছি) সময় মেরে ফেলা হয়।

২. ইতালীয়দের স্টেপলফুড– আমাদের ভারতের মতো নিত্য খাদ্য। মাক্কারনি, মাগেত্তি, ভেরমিচেল্পি ইত্যাদি। সবই ময়দার তৈরি, অনেকটা মুসলমানদের সেঁওইয়ের মতো। রান্না করা হয় নানা পদ্ধতিতে, তার শত শত রেসিপি (পাক-প্রণালী) আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *