গেঞ্জি
ভূমিকা
আমার ছেলে কিছুতেই বাঁচামাছ খেতে চায় না। যাঁরা খান, জানেন বাঁচামাছ জাবদা বা ট্যাংরার। মতোই কিংবা তার চেয়েও সুস্বাদু জাতের মাছ। এবার কয়েকদিন পরপর বাজারে বাঁচামাছ উঠল, দামও খুব চড়া নয়।
আমি নিজেই বাজার করি, ইচ্ছে করে এবং ছেলেকে জোর করে বাঁচামাছের স্বাদ গ্রহণ করানোর জন্যে পরপর তিনদিন বাঁচামাছ কিনে আনলাম বাজার থেকে। হয়তো এর পরেও আরও কয়েকদিন আনতাম যদি না আমার স্ত্রী মারমুখী হতেন।
সে যাহোক, বাড়িতে বাঁচামাছের প্লাবনেও আমার ছেলে কিন্তু বাঁচামাছ স্পর্শ করল না, বাঁচামাছের একটা টুকরোও খাওয়ার পাতে ছুঁল না। তৃতীয় দিনে তার এই মৎস সত্যাগ্রহের পর যখন তাকে কঠোরভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপারটা কী? সে বিনীতভাবে জানাল, এ লড়াই বাঁচার লড়াই।
ভূমিকাতেই বলে রাখা ভাল আমার এই সামান্য গল্পটি মাছ বা মাছ খাওয়া নিয়ে নয়, তার চেয়ে অনেক গুরুতর বিষয়ে, একালের ওই স্লোগান বাঁচার লড়াই নিয়ে।
সম্ভবত এই গল্পটির নাম পাঠ করে কোনও কোনও কৃতবিদ্য পণ্ডিত তৎসহ সাহিত্যের পাঠকের এই নামে একটি বিখ্যাত উপন্যাসের কথা মনে পড়তে পারে। আমার স্বীকার করা উচিত, ওই কালজয়ী গেঞ্জি উপন্যাসটির কাহিনির সঙ্গে মিল না থাকলেও এবং এটি একটি ক্ষুদ্র গল্প হলেও, ওই একই জাতের জীবনসংগ্রাম, যাকে অধুনা বাঁচার লড়াই বলে, আমার অক্ষম লেখনীতে এক্ষণে আমি ব্যক্ত করার চেষ্টা করছি।
কাহিনি
পৈলান বাসস্ট্যান্ডে নেমে একটু এগিয়ে মোড় ঘুরে হাঁটাপথে মাত্র সাড়ে তিন মাইল। জীবনে এই আমার দীর্ঘতম পদযাত্রা। কোনও উপায় নেই, প্রাণের দায়ে হাঁটতেই হল। পথে রেলিংহীন একটি পঞ্চাশ হাত বাঁশের সাঁকো, যার শেষ প্রান্ত এবং খালধারের মধ্যের দূরত্ব দীর্ঘ লক্ষে অতিক্রম করতে হয়, সেও প্রায় ছয়-সাত হাত। প্রাণের দায়ে সেটুকুও লাফাতে হল। কাদামাটিতে মুখ থুবড়িয়ে পড়ে একটা গড়াগড়ি দিতে হল। সকালবেলা ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরে বেরিয়েছিলাম। এখন যা চেহারা হল বলার নয়।
লাফের পর মিনিট দশেক দম নিয়ে আবার হাঁটতে হল। এমনিই সারাক্ষণ আমার দমবন্ধ ভাব, তার উপরে এই হুজ্জোত।
কিন্তু এই দমবন্ধ ভাবটা কাটানোর জন্যে এ হুজ্জোত আমাকে পোহাতেই হচ্ছে।
ব্যাপারটা আরেকটু আগের থেকেই খুলে বলা উচিত। বছর দুয়েক হল আমার কেমন একটা গলাচাপা, দমবন্ধ ভাব। বাসায় বা বিছানায় ভালই থাকি। সকালবেলা খোলামেলা খালি গায়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে বেশ আরাম এবং স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে চা খাই, খবরের কাগজ পড়ি। বিকেলে কাজ থেকে বাড়ি ফিরে স্নান-টান করে স্বস্তি ফিরে পাই। কিন্তু যখনই রাস্তায় বেরোই বা কাজে যাই, কেমন যেন কানের ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করে, নাকের ডগা লাল হয়ে ওঠে, চোখ টনটন করে, মাথা। ঘুরতে থাকে, রীতিমতো দমবন্ধ অবস্থা দাঁড়িয়ে যায়।
একদিনে এরকম হয়নি। আস্তে আস্তে হয়েছে। যখন কষ্ট বাড়ল অফিসের এক বন্ধুকে বললাম। তিনি একবাক্যে রায় দিলেন, তোমার প্রেশার হয়েছে।
প্রেশার হয়েছে কথাটা এমনিতে নিরর্থক। নিচু হোক, উঁচু হোক প্রেশার তো জীবিত মানুষের থাকবেই। শুধু যখন সে মরে যাবে তখন প্রেশার থাকবে না।
প্রেশারের ব্যাপারটা আমি অবশ্য ভাল বুঝি না। আমার দাদাকে একবার ডাক্তার বলেছিলেন, আপনার হাই-লো-প্রেশার। দাদা ধরে নিয়েছিলেন হাই এবং লো যখন একসঙ্গে, সুতরাং মাঝারি, সুতরাং নর্মাল; তাই কোনও চিকিৎসা করাননি। শেষে এক গোধূলি লগ্নে আমাদের এক আত্মীয়কন্যার বিবাহমণ্ডপে কনের পিড়ি ধরে সাতপাক ঘোরানোর সময় প্রথম পাকের মাথায় দাদা মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। এবং মুহূর্তের মধ্যে তাঁর সেই ভূপতিত মস্তকে প্রথমে পড়ল শতাব্দীপ্রাচীন আধমণি কাঁঠাল কাঠের পিড়ি এবং তারপরে পড়ল সিকি শতাব্দীপ্রাচীন দেড়মণি নাদুসনুদুসী কনেটি।
পরে জানা গিয়েছিল ওই হাই-লো প্রেশারের ব্যাপারটা। হাই-লো অর্থাৎ উচ্চনীচ রক্তচাপ অর্থাৎ খুব বেশি নিচু। ব্যাপারটা না বোঝার জন্যে আমার অগ্রজের সমূহ ক্ষতি হয়েছিল, ওই ঘটনার পরে জ্ঞান ফিরে আসার থেকে তার বিবাহ, রমণী এবং কাঠের উপরে সম্পূর্ণ অনীহা জন্মায়।
আমার অশ্রুগ্রন্থি দুর্বল। অগ্রজের কথা লিখতে গেলে আমার চোখে জল আসে। তার চেয়ে নিজের কথা লিখি।
আমার রক্তচাপ বার বার বহু ডাক্তারের কাছে মাপিয়ে দেখেছি, মোটামুটি স্বাভাবিক। নানা রকম ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়েও দেখলাম, আমার তেমন খারাপ কিছু ধরা পড়ল না। ঘুম, খিদে হজম ইত্যাদিও চমৎকার। কিন্তু বাড়ির মধ্যেও কেমন একটা দমবন্ধ ভাব, কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করে, গলা শুকিয়ে যায়, মাথা ঘোরে।
কোনও ডাক্তারই যখন চিকিৎসা করে সুরাহা করতে পারলেন না, তখন কোবরেজি, হোমিওপ্যাথি সবই চেষ্টা করলাম। কিছুতেই কিছু হল না, পরশুরামের চিকিৎসা সংকটের মতো অবস্থা প্রায়। তবু অবশেষে মুষ্টিযোগ, তারপরে যোগ ব্যায়ামের পথে এগোলাম। বিশেষ সুবিধে হল না। মধ্য থেকে সর্বাঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথা হল। শীর্ষাসন করার সময় হঠাৎ বাড়ির বহু পুরনো বুড়ো হুলো বেড়ালটা কেমন চমকে গিয়ে আমার নাকটা আঁচড়ে দিল। নাকের মাংস বড় নরম, দরদর করে কপাল বেয়ে রক্ত পড়ে মাথার চুল আঠা হয়ে গেল।
সবচেয়ে বেকায়দা হয়েছিল জল চিকিৎসা করতে গিয়ে। কাঁচা মাটির হাঁড়িতে শায়িত অবস্থায় চুমুক দিয়ে সাত সকালে পরপর সাত হাঁড়ি জল শুয়ে শুয়ে খেতে হবে বিছানা পরিত্যাগ না করে। যে সময়ে জলত্যাগ করার জন্যে মানুষ বিছানা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয় ঠিক সেই সময়ে সাত হাঁড়ি জলপান করা আমার পক্ষে সম্ভব হল না। এদিকে সেই মাথা ঘোরা, কান ভোঁ ভোঁ, দমবন্ধ ভাব সেটা কিন্তু লেগেই রয়েছে।
অগত্যা পৈলান, পৈলানের পথে আসি। অবশ্য ঠিক পৈলান নয়। পৈলান থেকে তিন মাইল অর্থাৎ পাঁচ কিলোমিটার দূরে বড় মহাদেবপুর। বড় মহাদেবপুরের শেষ সীমানায় গ্রামের কুমোরপাড়া, সেখানে খোকা পালের বাড়িতে সাদা আমড়া, ভগবানের এক আশ্চর্য দান, পৃথিবীতে আর কোথাও পাওয়া যায় না। এই সাদা আমড়া রোদ্দুরে শুকিয়ে যখন ঝরঝরে হয়ে যাবে, হামানদিস্তায় হেঁচে একরকম হালকা তেল বেরোবে, সেই তেল নাকে দিয়ে রাতে ঘুমোতে হবে। এই রকম সাত রাত চালাতে পারলেই চোখ টনটন, কানের ভেতর ভোঁ ভোঁ ডাক, নাকের ডগা লাল হওয়া সব সেরে যাবে।
পরামর্শটা দিয়েছিলেন আমার এক সহকর্মী মহেশবাবু। মহেশবাবুর মামাশ্বশুর এই সাদা আমড়ার তেল নাকে দিয়ে সাক্ষাৎ মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন। মহেশবাবু আরও বলেছিলেন, কলকাতার যত বড় বড় ডাক্তার তারা রোগীকে যতসব উলটোপালটা ওষুধ খাওয়ান কিন্তু নিজেরা গোপনে এই সাদা আমড়ার তেল নাকে দেন, কোনও ওষুধ স্পর্শ করেন না।
আজ বড় মহাদেবপুরে বড় আশা নিয়ে এসেছি। কিন্তু আশা পূর্ণ হল না। কুমোরপাড়ার খোকা পালের বাড়ি খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধেই হল না। সারা অঞ্চলে ওই সাদা আমড়ার দৌলতে খোকা পালের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সম্প্রতি বড় একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমড়া গাছে আর সাদা আমড়া হচ্ছে না, অন্য সব গাছে যেমন হয় তেমনই স্বাভাবিক সবুজ রঙের আমড়া হচ্ছে।
খোকা পাল মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। যদিও সে আমাকে কখনও দেখেনি, আমি তাদের উঠোনে পা দিতেই ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। বোঝা গেল সাদা আমড়ার ব্যবসায় তার বিলক্ষণ দু পয়সা হচ্ছিল, এখন আমড়ার শুভ্রতা চলে যাওয়ায় সে পথে বসে পড়েছে। সাদা আমড়ার উপর নির্ভর করে সে তার জাতব্যবসার সম্বল কুমোরের চাকটা পর্যন্ত বেচে দিয়েছে।
আমি আর কী করব, নিজের ভাগ্যকে মনে মনে বলিহারি দিয়ে দমবন্ধ, কান ভোঁ ভোঁ, নাক লাল, চোখ টনটন অবস্থা চিরস্থায়ী ধরে নিয়ে পৈলানের হাঁটাপথে কলকাতার মুখে রওনা হলাম।
এখন রোদ আরও চড়া। তবে এবার আর সেই খালধার থেকে বাঁশের সাঁকোয় লাফিয়ে উঠতে গেলাম না। খালের মধ্য দিয়ে হেঁটে পার হলাম। জামাকাপড় তো আগের বারেই কাদা মাখামাখি হয়ে গেছে। আরও একটু কাদাজল লাগল।
বাসস্ট্যান্ডে যখন এসেছি, রোদ্দুরে শুকিয়ে সারা গায়ে কাদা চটচট করছে। শরীরের অস্বস্তির জন্যে কষ্ট হচ্ছে, এমন সময় চোখে পড়ল পাশে একটা হোসিয়ারির দোকান। মনে মনে ভাবলাম, এখান থেকে গেঞ্জি কিনে নিই। তারপর গায়ের কাদামাখা জামা আর গেঞ্জি ছেড়ে নতুনটা পরে নেব, একটু আরাম হবে।
দোকানটার ভেতরে গেলাম। অল্পবয়েসি একটি ছেলে, বড় জোর কুড়ি-বাইশ বছর বয়েস হবে, কাউন্টারে বসে রয়েছে। আমি তাকে গিয়ে বললাম, ভাই, একটা চৌত্রিশ সাইজ হাওলা গেঞ্জি হবে?
ছেলেটি এতক্ষণ আমার কর্দমাক্ত পোশাক পর্যবেক্ষণ করছিল। আমার কথা শুনে আমার মুখের দিকে তাকাল, তারপর প্রশ্ন করল, কত সাইজ? চৌত্রিশ? কার জন্যে?
আমি বললাম, আমার জন্যে। আমার চৌত্রিশই লাগে।
ছেলেটি বলল, আপনি আগে নিশ্চয় রোগা ছিলেন তখন চৌত্রিশ লাগত।
আমি ভেবে দেখলাম, ছেলেটি ঠিকই বলেছে। বহুকাল ধরে চৌত্রিশ নম্বর গেঞ্জি গায়ে দিয়ে আসছি, এর মধ্যে আমার ওজন সোয়াগুণ বেড়েছে।
ছেলেটি এরপরে বলল, আর তা ছাড়া আজকাল গেঞ্জির সাইজগুলোও ঠিক নয়। চৌত্রিশ সাইজের গেঞ্জির দরকার হলে কিনতে হবে ছত্রিশ। আর আপনার এখন দরকার ছত্রিশ, আপনাকে। কিনতে হবে আটত্রিশ।
আমি অবাক হয়ে ছেলেটির কথা শুনছি, এবার ছেলেটি মোক্ষম কথা বলল, আটত্রিশের জায়গায় এখন যদি আপনি চৌত্রিশ গেঞ্জি গায়ে দেন তাহলে আপনার কানের ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করবে, নাকের ডগা লাল হয়ে উঠবে, চোখ টনটন করবে, মাথা ঘুরবে, দম বন্ধ হয়ে আসবে।
আমি অবাক হয়ে দোকানি ছেলেটির কথা শুনছি। সমস্ত লক্ষণ মিলে যাচ্ছে, কান ভোঁ ভোঁ, নাক লাল, চোখ টনটন, দম বন্ধ, আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে আমি আমার কর্দমাক্ত জামাসুদ্ধ চৌত্রিশ নম্বর গেঞ্জি থেকে মুক্ত হলাম।
আঃ কী আরাম! সঙ্গে সঙ্গে সব উপসর্গ দূর হয়েছে। কান ভোঁ ভোঁ করছে না, চোখ টনটন করছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে না, নাক-মাথা সব ঠিক। আমি ছেলেটির কাছ থেকে একটা আটত্রিশ নম্বর গেঞ্জি গায়ে দিলাম।
এরপর থেকে আটত্রিশ নম্বর গেঞ্জি গায়ে দিচ্ছি আর ডাক্তার-বৈদ্য, ওষুধ-টোটকা লাগে না। আর কান ভোঁ ভোঁ করে না, নাক লাল হয় না, চোখ টনটন করে না, মাথা ঘোরে না, আর দম বন্ধ হয়ে আসে না।