গেজেটেড অফিসার কবি

গেজেটেড অফিসার কবি

এ সংসারে দীনবন্ধুর বড়ই অভাব। তবে গজবন্ধুর কল্যাণে এ অধমের দু-একজন আছেন। তারা মাঝে-মধ্যে দয়া করে আমাকে দু-একখানা অতিশয় উচ্চাঙ্গের, অতিশয় হাইব্রাও– উন্নাসিক মাসিক পাঠান। আগের দিন হলে আমার আর কোনও দুঃখ রইত না। এসব মাসিক থেকে চুরি করে হপ্তার পর হপ্তা দিব্য অরিজিনাল লেখা লিখে দেশে নাম করে ফেলতুম, কার এদেশে কটা গ্যোটে আছেন যে আমার লেখা পড়ে বলবেন, মহাশয়, আপনার লেখাতে অনেক অরিজিনাল এবং অনেক সুন্দর কথা আছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় যেগুলো অরিজিনাল সেগুলো সুন্দর নয়, আর যেগুলো সুন্দর সেগুলো অরিজিনাল নয়। চুরি করতে এখন অসুবিধাটা কী? সবচেয়ে বড় অসুবিধা ত্রিশ বৎসর আগেও আমি এসব লেখা পড়ে বেশ বুঝতে পারতুম, এখন আর পারিনে। তার কারণ, এখন ইয়োরোপীয় লেখকের অধিকাংশই, ইংরিজিতে যাকে বলে বিউইলডার্ড- হতভম্ব, দিভ্রান্ত, মাথা গুবলেট– যা খুশি বলতে পারেন। নিজের কৃষ্টি-কলচর সম্বন্ধে এদের মনে দ্বিধা, হৃদয়দ্বন্দ্বের অন্ত নেই; শ্লীল-অশ্লীল বিবেচনা করতে গিয়ে লেডি চ্যাটার্লির মতো সাধারণ বই এঁদের তালুক-মুলুক-কুল্লে দেশে হালের চাটগাঁইয়া সাইক্লোন তোলে; এক দেশের বড় পাদ্রি অন্য দেশের বড় পাদ্রির সঙ্গে সামান্য লৌকিকতার দেখা করতে গেলে তারা হুররা রব ছেড়ে বলে, এবারে তাবৎ মুশকিল আসান, ঘড়ি ঘড়ি কলচরল কনফারেন্স, তড়িঘড়ি ফের নেশার অবসাদ, পুনরায় খোঁয়ারি–

আর সর্বক্ষণ আৰ্তরব! ওই এলরে, ওই খেলরে! কে? ক্যুনিস্ট।

এরা এই একটি বিষয়ে সম্পূর্ণ মনস্থির করে ফেলেছেন যে, ক্যুনিস্ট এলে এদের আর কোনও গতি নেই। ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ বিলকুল বরবাদ হবে। সারি বেঁধে সবাই সাইবেরিয়া।

ওদিকে কম্যুনিস্টরা অভয় দিয়ে বলছে, আমরা এলে তো তোমাদের পরিত্রাণ। ধনপতিদের অত্যাচারে খেতে পারছ না, পরতে পাও না, রাষ্ট্র তোমাদের জন্য কড়ে আঙুলটি তোলে না, বস্তাপচা ধর্মের আফিঙ পর্যন্ত এখন যে তোমাদের নেশায় বুঁদ করে রাখবে তারও উপায় নেই, ইত্যাদি অনেক মূল্যবান কথা।

পশ্চিম ইয়োরোপের লেখকরা কম্যুনিস্টদের এই অভয়বাণী, যে তারা এলে পর ক্যাপিটালিস্ট দেশের লেখকরা অন্ততপক্ষে খেয়ে-পরে বাঁচবে, কতখানি মনে মনে বিশ্বাস করেন সে-কথা বলা কঠিন, কিন্তু তাঁরা কম্যুনিস্টদের এই অভয়বাণীর একটি পরিপূর্ণ সুযোগ নিচ্ছেন।

সেইটে ইদানীং একটি পত্রিকাতে সরল ভাষায় আলোচিত হয়েছে। ওইটেই নিবেদন করি। বাকি– ওই যে বললুম– বিউইলডার্ড জিনিস, সে তো আর চুরি যায় না, খালি-পকেট মারা যায় না, কিংবা বলতে পারেন, হাওয়ার কোমরে রশি বাঁধা যায় না।

সুইডেন থেকে জনৈক সুইস সংবাদদাতা তার দেশের খবরের কাগজে সংবাদ পাঠিয়েছেন যে, সে দেশের লেখকরা তাদের মূল্য বৃদ্ধির জন্য সরকারকে উদ্বস্ত করে তুলেছেন (এস্থলে আমার মন্তব্য, ভাবটা এই ক্যুনিস্ট রাষ্ট্রে লেখক কত সুখে আছে, এদিকে তোমার তথাকথিত জনকল্যাণ রাষ্ট্র আমাদের জন্য কিছুই করছে না, অনেকটা পাশের বাড়ির চাটুজ্যে তার গিন্নিকে কীরকম গয়না দিয়েছে দ্যাখো গে গোছ)। পত্রলেখক সুইডেনের লেখক সম্প্রদায় সরকার থেকে যেসব অর্থসাহায্য পান তার যে সবিস্তর নির্ঘন্ট দিয়েছেন তার থেকে মাত্র একটি আমি তুলে দিচ্ছি– এ দেশে চালালে মন্দ হয় না– সাধারণ পাঠাগার থেকে যে পাঠক ধার নিয়ে বই পড়ে তার প্রত্যেক বারের জন্য সরকার পাঠক নয়– লেখককে কিঞ্চিৎ দক্ষিণা দেন। সেটা সামান্যই, কিন্তু জনপ্রিয় লেখকের কাছে সেটা কিছু সামান্য নয়।

হালে তাই ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের লেখক সম্প্রদায়ের মুরুব্বিরা সমবেত হয়ে রেডিও ও টেলিভিশনে তাদের ফরিয়াদ ক্রন্দন শুনিয়েছেন ও দেখিয়েছেন। হেলসিঙ্কি শহরের তালকিসৎ বললেন, সরকার লেখকদের বই কিনে পাঠাগারে পাঠাগারে ফ্রি বিতরণ করে পাঠককে বদলে দেন করুণার মুষ্টি-ভিক্ষা (উপরে যেটা উল্লেখ করেছি)। অপিচ, পশ্য পশ্য, ওই লেখক নামক জীবটি না থাকলে তামাম বইয়ের ব্যবসা লাটে উঠত। প্রকাশক, মুদ্রাকর, দপ্তরি, পুস্তক বিক্রেতা এমনকি, পুস্তক সমালোচকের পর্যন্ত পাকা-পোক্ত আমদানি আছে, নেই কেবল লেখকের, তাকে সর্বক্ষণ কাঁপতে হয় অনিশ্চয়তার ভয়ে ভয়ে। সুইডিশ লেখক-সম্প্রদায়ের প্রধান মুরুব্বি বললেন, পূর্বে লেখক ছিল গরিবদের মধ্যে একজন গরিব; আজ সে-ই একমাত্র গরিব। যখন অকরুণ ইঙ্গিত করা হল, আজকের দিনে লেখকদেরও বড্ড বেশি ছড়াছড়ি, তখন তিনি বললেন, হিমালয়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য শুধু পাহাড়ের চূড়ো দিয়ে নির্মিত হয় না।

শেষ পর্যন্ত এঁরা দাবি জানিয়েছেন, সরকারকে ওরকম ভিক্ষে দিলে চলবে না (বর্তমান লেখকের মন্তব্য : ব্যক্তিগতভাবে আমার কণা পরিমাণ ভিক্ষা নিতে কণামাত্র আপত্তি নেই); দিতে হবে পাকা-পোক্ত মাইনে। তবেই সে নিশ্চিন্ত মনে, পূর্ণ স্বাধীনতায় আপন সৃষ্টিকার্য করে যেতে পারবে, এবং তার জন্য সে সরকারের কাছে বাধ্যবাধক হবে না। (রাশার প্রতি ইঙ্গিত নাকি?)। এঁদের মতে সরকার এবং ফ্রি পাঠাগার থেকে লেখকরা বর্তমানে যা পান সেটাকে দশগুণ বাড়িয়ে দিলেও তারা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য পাবেন না, যার কৃপায় অন্য চাকরি না করে তারা দারাপুত্র পোষণ করে আপন কার্যে মন দিতে পারবেন।

তার পর ইংরেজ, যুগো শ্লোভ, সুইডিশ ও জর্মন লেখকরা আপন আপন দেশ থেকেই টেলিফোনযোগে আপন আপন মন্তব্য সুইডেনে পাঠালেন ও সেখানকার বেতার কেন্দ্র থেকে সেগুলো বিশ্ব-সংসারের জন্য বেতারিত হল।

জর্মনির হাইনরিষ বোল বললেন, ঈশ্বর রক্ষতু (ফর হেভেস্ সেক, উম্ হিমেস্ বিলে! সর্বনাশ হবে– লেখক যদি সরকারের মাইনেখোর হয়। সে সৃষ্টির কাজ করে যাবে নিছক সৃষ্টিরই জন্যে। এই আমাদের জৰ্মনিতে পঁয়ত্রিশ হাজার লেখক আছেন। (সর্বনাশ! এই সোনার বাংলায় পঁয়ত্রিশ হাজার লেখক ক্রেতা নেই)। কে এমন মাপকাঠি বের করবে যা দিয়ে স্থির করা হবে, কোন লেখক কত পাবেন? কৃতকার্য লেখকই যে মূল্যবান লেখক এ কথা বলে কে (সাকসেস এবং কোয়ালিটি সমার্থসূচক নয়)।

লন্ডন থেকে রবার্ট গ্রেভসেরও বিচলিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, আমার আটটি সন্তান। সত্য বলতে কী, এদের পালা-পোষা আমার পক্ষে সবসময় সহজ হয়নি। তাই বলে যে-কাজ আমি এখনও আদপেই করিনি তার জন্য আগেভাগেই পয়সা নিয়ে বসব? ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, হি হু পেজ দি পাইপার কলান্ড দি টুন– যে কড়ি ফেলে সে-ই হুকুম দেয় কোন সুর গাইতে হবে। আমি আমার ইচ্ছেমতো যে সুর খুশি গাইব।

আর বেলগ্রেড থেকে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল ডুসান মাটিকের,- না, দয়া করে চাকুরে কবি তৈরি করতে যাবেন না– আমরা কারও চাকরি করিনে। কবিতা রচনা করা আর ফর্ম ফিল্ আপ করা এক কাজ নয়। মানুষকে লেখক হবার জন্য জোর করা যায় না, কবিতা রচনা করার সময় কোনও কবি কর্তব্যবোধ থেকে তা করে না, বরঞ্চ সে রচে যখন ভিতরকার তাড়না সে আর থামিয়ে রাখতে পারে না। কী করে মানুষ যে কবিকে সরকারি চাকুরে বানাবে তা তো আমার বুদ্ধির অগম্য…।

এসব নিদারুণ মন্তব্য শোনার পরও কিন্তু সুইডেনের ঔপন্যাসিক ফলকে ইসাকসন তার সুইডিশ নৌকোর হাল ছাড়লেন না, অর্থাৎ সরকারি সাহায্যের প্রস্তাবটা। বললেন, কত ভালো লেখক দৈনন্দিন জীবনধারণ সমস্যায় এমনই ভার-গ্রস্ত যে, লেখার কাজ করে উঠতে পারেন না। সরকারের কিছু একটা করা উচিত…। তার মানে এই নয়, সুইডেনের সব লেখকই এই মত পোষণ করেন। জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক আকে ভার্সিং বলেছেন, প্রচুর, প্রচুর আমি শিখেছি মানবচরিত্রের, গড়ে তুলেছি আমার জীবনদর্শন, আমার জীবনের পেশা থেকে। এঁর পেশা দারোয়ানি। অর্থাৎ বাড়ির দরওয়ান। পত্রলেখক জাৎসার চিঠি শেষ করেছেন এই মন্তব্য করে, বাড়ির দরওয়ানই যদি এত ভালো লেখে তবে চিন্তা করো তো বড় হোটেলের পোর্টার (দরওয়ানই তো) আরও কত শতগুণে ভালো লিখবে। অর্থাৎ কাকতালীয়!

লেখাটি পড়ে শোনাতে আমার একজন প্রিয় লেখক-বন্ধু আশ্চর্য হয়ে শুধোলেন, বলেন কী মশাই! ওসব দেশের পাঠক যখন প্রতিবার লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে যায় তার জন্য সরকার লেখককে পয়সা দেয়। আর এদেশের লাইব্রেরি আমার কাছ থেকে ফ্রি বই চায়! বইটার দাম পর্যন্ত দিতে চায় না।

আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললুম। গরিব দেশ! তার পর বললুম, কিন্তু ভেবে দেখুন, না চাইলে কি আরও ভালো হত? একদম পড়তেই চায় না, সেটা কি আরও ভালো হত? প্রিয়ার বিরহ বেদনা পীড়াদায়ক; কিন্তু যার একদম কোনও প্রিয়াই নেই?

বন্ধু অধৈর্য হয়ে শুধোলেন, তোমার কাছে চাইলে তুমি কী করতে?

আমার চিত্তে সহসা কবিত্বের উদয় হল। বাইরের দিকে তাকিয়ে উদাস নয়নে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করতে লাগলুম ॥

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *