গেঁহু

গেঁহু 

শ্রাবণ-সন্ধ্যা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মাল-গাড়ীর বগীর উপর। দূর থেকে মনে হয় যেন পাহাড়ের গুহা। মেঘ-ক্লিষ্ট অন্ধকার নিকষ কালো পাথরের তুলনা। 

আদিম পরিবেশ থমথম করছে নীরবতার শাসনে। 

হঠাৎ একটা ল্যাম্পের আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল বগীর ভিতর। অস্পষ্ট কিরণ। আপনার চোখে পড়ে, সঞ্চরণ-রত মানুষের ছায়া মূর্তি। বর্ঝর যুগের কোন মানব সন্তান যেন ফিরে এলো বিংশ শতকের এই বন্দর-ঘাটে। পেছনে আলো। বিকট দেখায় সিলুয়েট-মূৰ্ত্তি। 

আরো দৃঢ়-শিখা জ্বলে ল্যাম্প। 

আপনার এতক্ষণের কল্পনা ধূলিসাৎ। মাল-গাড়ীর গুহা তবে বগী নয়? মানুষের আবাস। নরাকার ছায়া কোন আদিম গোষ্ঠী নয়। আমাদের প্রতিবেশী। রেল-ভ্রমণের সময় দেখে থাকবেন : এই মানুষেরা ফিশ-প্লেট পরিষ্কার করে, লাইনে খোয়া ঢালে, সিগ্‌ন্যাল ওঠায়-নামায়। আরো কত-শত কাজের সঙ্গী তারা। 

পুনরায় অন্য একটা ল্যাম্প জ্বলে উঠল ধীরে ধীরে কম্পিত শিখায়। 

কল্পনার সামান্য রেশ হয়ত ছিল আপনার মগজে। মাফ করবেন, তা-ও কর্পূরের মত উবে যেতে বাধ্য।

গেল না? 

গুহা এখন রীতি-মত মানুষের আবাস-ভূমি ও গৃহ-কক্ষ। 

দু-টো ল্যাম্প জ্বল্‌ছে। আপনার দৃষ্টির কোন অসুবিধা ঘটে না। 

দ্বিতীয় ল্যাম্প-খানি এক বৃদ্ধার হাতে। সত্তরের বেশী বয়স। চেহারায় বাংলাদেশের কোন পরিচয় নেই। ময়লা শাড়ী পরনে। কোমরে আঁচল জড়ানো; গায়ে কুর্তা। মাথায় কোন আবরণ ছিল না। সমস্ত চুল পাকা শণের মত। বাতাসে কয়েক-গাছি, তার রেখা-দীর্ণ মুখের উপর এসে পড়েছে। 

স্পষ্ট দেখা যায় বগীর অভ্যন্তর। একটা গেরস্থর সংসার রীতি-মত। এইটুকু জায়গা। তবু সান্নিধ্যের কি অপরূপ মহিমা! 

এককোণে হাঁড়ি-কুড়ি, পায়খানার লোটা, রান্নার অন্যান্য আসবাব : উঠোন-চুলো, লড়ী, ন্যাড়া, ফ্যান-গালা গামলা, কয়েকটা বাঁশের পালা চুপড়ী। অন্য কোনে কয়লা এবং এই জাতীয় ইতর স্তূপের বোঝা। একটা ছাগল বাঁধা রয়েছে দুই কোণের মাঝখানে। কয়লার উপর জমেছে ছাগলের লাদী। 

বগীর অপর দিক শয়ন কক্ষ। আপনাদের বাংলা ভাষায় বেড-রুম। ড্রইং-রুমের রেওয়াজ নেই এই মহল্লায়, নচেৎ তারও একটা স্থান হোত বৈকি। ঘন-সান্নিধ্যের মহিমা ত আপনার নিজের চোখেই দেখছেন। ঠাস বুনানীর আস্বাদ কার্পেটে চেখেছেন কোনদিন। এই আপনার তৃতীয় অভিজ্ঞান। 

অপর দিকে মাদুর, ছেঁড়া কাপড়, তেল-চিটা দাগ-লাগা বালিশ, ছেলেদের মোতা-কাঁথা।

বাকী অর্ধেক কল্পনা। 

রুক্ষ-চুল একজন জোয়ান ল্যাম্প তুলে নিয়ে কি যেন খুঁজতে লাগল। তার চেরার কাঠামো মজুত। একদা মজবুত ছিল, প্রথম দর্শনে ধরা পড়ে। 

বেড-রুমে একজন মেয়ে শায়িতা। কাঁথা-ঢাকা শরীর। মুখের উপর হাতের আড়াল। একটা পাঁচ ছ’মাসের শিশু মাই চুষছে। তার হাত বেরিয়ে আছে। সাদা কচি হাত। নড়া-চড়া আর চুকচুক শব্দ তার অস্তিত্বের একমাত্র প্রমাণ। অপর একটি উলঙ্গ ছেলে, বয়স চার কি পাঁচ, মার পা-তলার দিকে শুয়ে আছে। তার পাশে আর একটি বিছানা। অনুমান করা যায়; বৃদ্ধা বাড়ীর কর্ত্রী। তিনি সেখানে রাত গুজরান করেন। মার শিয়রে বছর সাত বয়সের একটা মেয়ে বসে আছে বগীর দেওয়ালে হেলান দিয়ে। ঘুমিয়ে রয়েছে সে এই অবস্থায়। কোন জিদ ধরেছিল। বকুনি খেয়ে স্তব্ধ হোয়ে গেছে। গালে শুষ্ক অশ্রুর দাগ তার সাক্ষী। এই মেয়েটার গা আদুল। পশ্চিমা চুড়ী-ওয়ালীদের ছোট ঘাঘ্রা পরিহিতা। ঝাঁকড়া চুল একরাশ হাতের উপর। তালুর উপর আলতো-লতানো মাথা। 

জওয়ান একবার তার দিকে চেয়ে আবার কয়লার স্তূপে খোঁজার তৃষ্ণা মেটাতে লাগল। 

ঠাণ্ডা বাতাস বইছে শনশন শব্দে। 

বৃদ্ধা ল্যাম্পে শীর্ণ কর-তালুর আড়াল দিয়ে এক কোনে সরে গেল নিজের বিছানার দিকে। সুপ্তোত্থিত ভাব তার মুখে। 

যুবক হঠাৎ ডাকে : মাতারি। 

বৃদ্ধা বিছানার উপর পা ছড়িয়ে উকুন চয়ন করছিল। 

—আরে মেরা বেটা জব্বার, তু আ গইল। 

—হাঁ, মাতারী। 

—জব্বার বেটা, আঁখমে কৈসা ধুঁয়া লাগ ভৈল। তু আ গৈল বেটা। ডিউটী কবর খতম ভৈল?

—হাম ভী আ-কে শো গয়া থা। তোম লোগ সবে শো গয়া থা। লেকিন ফিন বাত্তি কেঁউ জ্বালায়া?

বৃদ্ধা চট করে জবাব দিতে পারে না। একটু থতমত খায়। 

—বেটা, বুড্ডা আঁখ। তোমকো খানা দেনা হোগা। হাম ভি নেহি খায়া। 

—মায়ি, বাত্তি বুঝা দেও। দো বাত্তি জ্বলনে সে খানা ভি নেহি মিলেগা। মাট্টি তেল (কেরোসিন) কেনা মাহাঙ্গা। তভি এইসা করতা। 

জব্বারের কণ্ঠস্বর ঈষৎ উষ্ণ। তার চোখে বিরক্তির ছাপ। 

বৃদ্ধা নিজে চিন্তা-মগ্ন। ঘুম-ভাঙার পর মাঝে মাঝে স্মৃতি-ভ্রংশ হয় তার। 

আপন খেয়ালে সে বলে : উ কিনা দূর আজম-গড় জিলা। মেরা দেহাত মে শর-গুজা ফুল আর কেনা না ভৈল। নিসু ভাই কা চাচ্চি আভি জেন্দা হ্যায়। 

—এই মায়ি? 

বৃদ্ধার হঠাৎ খোঁয়ারি ভাঙে : মেরা লাল, জব্বার, কা হুয়া? 

মেরা শির ভৈল্। আভি তক্ বাত্তি নেহি বুঝায়া? 

—আরে বেটা, থোড়া জ্বল্‌নে দে। তোম আর খানা খা লো। দেখতা না কেত্তা কীড়া—পোকা বোতা হ্যায় এই লোগ। 

বৃদ্ধার কথা সত্য। বাদল দিনে ঘরে নানা প্রকার ছোট-ছোট পোকা ঢোকে। আহারের সময় সাবধান না হোলে কাঁকর-পোকা একাকার মিশে যায়। 

—তো জলদি কর, মায়ি! আজ বড়া ডিউটী ভৈল। 

গড়ি-মসী ভাব তবু কাটে না জব্বারের মার। পালিতকেশা জিজ্ঞাসা করে : বেটা জব্বার, নিসু ভাই খৎ লিখা তা নি? 

—নেহি। 

মাথা দোলায় জব্বার। 

—দেহাৎ, কেনা দূর হামারা দেহাৎ, জব্বার। 

—মায়ি কিয়া বকতে হো। খানা দো জলদি। ফিন্ ভোর কো জানা হ্যায়। 

জব্বারের মা এইবার সশব্যস্ত উঠে পড়ে। 

বাইরে মেঘের হুঙ্কার শোনা যায়। বন্দর-ঘাটের স্তিমিত রেশের মধ্যে জাহাজের হুইসেল তীক্ষ্ণ আওয়াজের দাগ কাটে 

কৰ্ম্ম-প্রাণ জননী হঠাৎ নিজরূপে আবির্ভূত হন। ভরা বাতি সে নিজেই গুহার মুখে টেনে নিয়ে এলো। এখানে বাসন-কোষন ধোওয়া সহজ। নিচে পানি গড়িয়ে যায়। বগী উঁচু কম নয় ত। সেদিন জব্বারের মেয়ে গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল। হাতে বেশ চোট লাগে তার। বাঁশের সিঁড়ি বেঁধে দিয়েছে জব্বার। ওঠা-নামার সুবিধা আছে। এই নিয়ে জব্বার মাঝে মাঝে মার সঙ্গে রসিকতা করে : মাতারি, হাম-লোগ কো দো-মঞ্জেলা ঘর মিলা হ্যায়। নিচু মে রহতা সাঁপ, বিচ্ছু। উপর আদমী। তব ভী দো—মঞ্জেলা। মিতা ইয়ে তোমরা দেহাত মে? 

জব্বারের মা বাসন ধুতে বসে গেল। চট্‌পট হাত চালায় সে। হঠাৎ তার নজর পড়ে শায়িতা রমণীর দিকে। আহ-শব্দে কাৎ ফেরে সে। 

—বহু, অ বহু—

শায়িতা জব্বারের স্ত্রী খয়রন। বাংলাদেশের পানি সে বরদাস্ত করতে পারে না। ম্যালেরিয়ায় ভুগছে।

বহু জবাব দিল : মায়ি। 

—অ বহু মিয়া? 

—মায়ি এথি থোড়া। 

বাসনা-মাজা ফেলে সে খয়রনের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। 

—মায়ি। 

—বহু, বোখার হ্যায়? 

—হাঁ, মা। 

মা জিজ্ঞাসা করে : জব্বার, ডগদর কো কুচ পুছা? 

—ইয়ে ম্যালেরি হ্যায়, মায়ি। ঠিক হো জায়েগা। কুইলিন চাহিয়ে। দাওয়াই জরুরত ন ভৈল।

মা কোন জবাব দিল না। মন মত হয়নি জবাব। বধূর দিকে মুখ বাড়ায় সে। 

কিছুক্ষণ আগে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি ঝরছিল। ঝিরিঝিরি বর্ষণ শুরু হয় আবার। 

মা বধূর ইঙ্গিতে তার মুখের কাছে নিজের কান পাতে। ফিফিস কথা বলে পুত্র-বধূ।

—থোড়া সবুর করো। 

শাশুড়ীর আশ্বাস-বাণী 

—বড়া তলীফ, মায়ি। 

—বহু—

বহু আর জবাব দেয় না, কাত্রায়। 

বগীর দেওয়ালে হেলান দিয়ে শুয়েছিল জব্বারের মেয়ে। সে মাথা ঠুকে কাৎ হয়ে পড়ে একবার ককিয়ে উঠলো। পর মুহূর্তে নিঃস্তব্ধতা। বেজায় ঘুম তার। 

বৃদ্ধার কণ্ঠ ভেঙে পড়ে : জব্বার। 

—মায়ি। 

—তু থুড়া মেরা বিস্তারা মে আঁখ বন্দ করকে শো যা।

—কাহে মাতারী? 

—বহু কা—

বৃদ্ধা থেমে যায়। ইঙ্গিত জব্বার বুঝতে পারে। 

—আচ্ছা মায়ি, হাম বাহার যাতা। 

—নেই-নেই বেটা। পানী হোতা হ্যায়। 

—থোড়া বাদ হাম আয়েগা। 

—নেহি বেটা। তু ভিং জায়েগা। হাতা না ভৈল, তু বুখার সে উঠা। 

—মেরা ইজ্জত আব্রু কা খেয়াল আভি তক্ হ্যায়। হাম মুৰ্দ্দা নেহি। হাম—

কথা শেষ করে না জব্বার। সে তার সজীবতার প্রমাণ দিল সিঁড়ির পৈঠা-পার অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। থলি একটা মাথায় তার। ছাতার বদলে ছালা। 

পেছনে মার অনুনয় চীৎকার : জব্বার-জব্বার-। 

তারপর বৃদ্ধা পীড়িতা বধূর উপর তম্বী ঝাড়ে। প্রস্রাব পায়খানার আর সময় নেই। এমন জুলুম চালায় বিবি খামের উপর। গালি-অভিশাপ বৃদ্ধার পাশুটে মুখ থেকে গরম সীসার মত ঝরতে থাকে।

জব্বারের স্ত্রী তবু উঠে বস্ল। স্তনাভাবে চীৎকার করে শিশু। আজম গড়ের মেয়ে। ম্যালেরিয়ার কাছে পশ্চিমা শরীরও কাবু। খয়রন তার প্রমাণ। 

—বজ্জাৎ বহু, তু এয়সি ত না থি। 

—মায়ি। 

বধূ কাতর চোখে তাকায়। 

—মায়ি, আর্ট বরস হাম তুমারা পাশ আয়া। হাম কভি দুর্বল গলায় কথা আটকে যায়। বৃদ্ধা হঠাৎ নরম হোয়ে পড়ে। 

—নেহি বেটী, নেহী। তু বড়া আচ্ছা বহু। 

—মায়ি 

অনুপস্থিত ছেলের উপর মা আক্রোশ ঝাড়ে : দেখা না, বহু। বোলে ইজ্জত—আব্রু। হাম যব দেহাৎ মে থা, হাম এ্যায়সা রহতী? না, পয়সা কা ভিখারণ থা এতনা। হাম ভী তো কোইলা চুন্‌নে জাতা রেল লাইন বা পাশ। উমে খুব আব্রু রহতা? 

বৃদ্ধার শ্লেষোক্তি শেষ হয় না। 

কথা সত্যি, জ্বালানী কাঠ হরদম কেনা সামর্থ্যের বাইরে। রেল লাইনের পাশে পোড়া কয়লার টুকরো সে-ও নাতনীর সঙ্গে কুড়িয়ে বেড়ায়। 

ইত্যবসরে বধূ ধীরে ধীরে উঠে আসে। মাথা ঘুরছে তার। 

—মায়ি, হামে থোড়া পাকড় না। 

কোলের ছেলে বিছানায় শুয়ে চীৎকার করে। খয়রন ধমকায় : চুপ। মরতা ভি নেহি। 

হোক ছ-মাস বয়স। মরদের বাচ্চা কিনা, মার কথা গ্রাহ্য করে না। সে প্রাণপণে চীৎকার করে।

—ফিন এইসা কহেগী, ত বড়া জোর পিটোঙ্গী, বহু। ধম্‌কানির পর জব্বারের মা বগীর দরজা বন্ধ করে দিল।

.

বাইরে জোর বৃষ্টি আরম্ভ হয়। বগীর টিনের চালে ঝঝম শব্দ। কান পাতা দায়। একটু পরে দরজায় করাঘাত শোনা গেল। জব্বারের মা ভেতর থেকেই ডাকে : জব্বার, মেরা লাল। 

—মাতারি, জদি খোল্‌না কেওয়াড়ী। 

—আয়ি, বেটা। 

বৃদ্ধা তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল। তার এক হাতে চুপড়ি-আড়াল ল্যাম্প। দরজার মুখ পর্যন্ত এগিয়ে এলো সে। নিচে জব্বার। পিচ্ছল বাঁশের পৈঠা। পুত্রকে সতর্ক করা দরকার। ল্যাম্প এগিয়ে ধরে সে হাঁকে : বেটা, থোড়া হুঁশিয়ার হোনা। বগীর আশে পাশে অস্পষ্ট আলো ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ খেলে গেল একবার। 

মোটা দাগে খড়ি দিয়ে কে যেন লিখে গেছে বগীর গায়ে, “ইসলাম জিন্দাবাদ।” 

সাদা দাগ আরো ঝকমক করে। 

বিদ্যুতের চমক এই আক্ষরিক ইসলাম-কে একবার জেন্দা করে দিয়ে গেল। স্পষ্ট লেখা। 

বৃদ্ধা ভয়ে চোখ বুজে। 

বিদ্যুৎ অথবা ইসলামের ঝলকে সে ভীতা, তা বোঝা গেল না। 

এই সময়-টুকুর মধ্যে জব্বার সিঁড়ির উপর লাফ দিয়ে বগীর ভেতর ঢুক্‌ল। 

বৃদ্ধা অবাক। এতক্ষণে চোখ খোলে সে। 

—তু আয়ি। আ রে ইয়ে কিয়া, তু একদম ভিং গিয়া। 

জব্বার আবক্ষ ঝাপ্টায় বেশ ভিজেছিল। 

হি হি করে বাতাস, খোলা কপাটের শিকলের উপর। 

—মাতারি, গাম্‌ছা দো। 

—উ ভি ভিংগা বেটা। 

স্যাঁতসেঁতে গামছায় অগত্যা জব্বার গা মোছে। 

—মাতারি, তোমরা বহু ক্যায়সা হ্যায়? 

—ফিন থোড়া বুখার চড়া। 

জব্বার গা-হাত মুছে একটা হাফ-প্যান্ট পরল। জননী নিজে আবার শুষ্ক আঁচল দিয়ে পুত্রের শরীর 

মোছার জন্য এগিয়ে যায়। 

—রহনে দো মাতারি। 

—নেহি বেটা। এক হাফতা না ভৈল, ত বুখার উঠা। 

—কুচ নেহি হোগা। 

অভয় মন্ত্ৰ মা শোনে না। 

গৃহ-কোণের অন্যান্য দিকে নীরবতা। ছোট শিশু আবার মাই চুষছে চুকচুক শব্দে। ছাগ-মাতা খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। দু-টো বাচ্চা ঢুঁ মারছে স্তনের উপর। 

—খানা দোঁ, বেটা? 

—নেহি।

—কাহে? 

—বড়া জাড়া, মাতারি। 

শীতে কাঁপছে জব্বার। পনর মিনিটের বেশী বৃষ্টির জুলুম ভোগ করেছে, সে তাড়াতাড়ি একটা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে নিল। 

মার বিছানার পাশে বসে সে শীতে তবু কাঁপে। 

—ফিন বুখার না আয়ে, বেটা। 

—চুপ করো, মায়ি। থোড়া বদন গরম হোনে দো। হাম খানা খায়েগা। 

—আচ্ছা, বেটা। 

উৎকণ্ঠিত মুখে জননী জব্বারের দিকে চেয়ে থাকে। কোন কথা বলে না। পুত্রের গতিবিধি মনে শঙ্কা জাগায়। পাছে আবার না জ্বর আসে। 

বৃদ্ধা-ও বসে পড়ল নিজের বিছানায়। উকুন চয়ন শুরু হয় পুনরায়। 

কয়েক মিনিটে জব্বার চাঙ্গা হোয়ে ওঠে। নিঝুম বসে আছে মা। পাছে ঘুমিয়ে পড়ে, তাই হাঁক দিল সে, মায়ি! 

—বেটা। 

—মায়ি, আওর থোড়া গরম হোনে দো। খানা খায়েঙ্গে। 

—বেটা, হাম বইঠা হ্যায়। 

—আচ্ছা মায়ি। 

—আ রে হাঁ, ভুল্ গয়া থা। তু আটা লায়া হ্যায়? 

—আ-টা-! 

জব্বার আরো কিছুক্ষণ স্তব্ধতার পর উত্তর দিল : নেহি, মায়ি। 

—নেহি। কাহে? 

—নেহি মিলা। 

—তো গেঁহু কাহে নেহি লায়া? হাম পিষ লেতে। 

—ও কাঁহা মিলেগা? 

বৃদ্ধা পুত্রের কথা বিশ্বাস করে না। মনে মনে বিরক্ত হয়। পুত্রের উপর মনে মনে অভিযোগ চালায়। তার দিকে কারো খেয়াল নেই। নিজ চিন্তা-স্রোতে বৃদ্ধা তেতে উঠে। 

—তু তো চাহতা হ্যায়। 

—কিয়া, মায়ি? 

—হাম মরে তো আচ্ছা হোই। 

জব্বার ব্যথিত হয়। এই জননী তার অসচ্ছল সংসারে আব্রু বজায় রেখেছে। তার মৃত্যু অর্থাৎ সংসার অন্ধকার। অনুনয় তার কণ্ঠে স্বভাবতই উঁকি মারে। 

—মাতারি, তু এহি সমতা? 

—তো আওর কিয়া। আজ হাতা-ভর বোলতা। কেনা দফে দাম বোলা, বহু বোলা। আওর তুম শুনা নেহি? 

—নেহি মিলা, মায়ি। 

—নেহি মিলা, নেহি মিলা। ইসে সিধা বাত আওর কিয়া হ্যায়। তু জানতে হো, মেরা ভী থোড়া—থোড়া বুখার হোতা। চাওল খাতে-খাতে মর জায়েঙ্গে। 

—তুম্রা বুখার হোতা? 

—বোল্‌তে সে ফায়দা। বেচারা বহু পড়া হ্যায় চেটাই পর। ফির হাম ভী পড়ে তো—জব্বার কোন জবাব দিতে পারে না। সে মার স্বাস্থ্যের কোন খোঁজ রাখে না কোন দিন। 

বৃদ্ধা আপন মনে বকে : গেঁহু। নির্সু ভাই কা ক্ষেত মে উ বরষ কেনা গেঁহু ভৈল। কেনা দিয়া 

থা হামকো। হাম পিষা, খায়া। 

হঠাৎ পুত্রের দিকে ফিরে সে উষ্ণ কণ্ঠে বলে : গেঁহু লা-তা নেহি কিউ? 

জব্বার নিরুত্তর। 

—জওয়াব নেহি দেতি? 

—নেহি, মায়ি। 

বৃদ্ধার আত্ম-কাহিনী শেষ হয় না। জব্বার একবার বিরক্ত হয়। বৃদ্ধ-বয়সে এই এক হাঙ্গামা। খালি বকর-বকর। বেশ চটে উঠে সে মার উপর। বাইরে কোন চিহ্ন প্রকাশ পায় না। 

ছাগল-ছানা চীৎকার করে : ম্যা-ম্যা। ধাড়ী আর দুধ দিতে নারাজ। এক দিকে সরে পা ছোঁড়ে। এক মগ পানী ছিল উল্টে পড়ে গেল। 

জল বিছানার দিকে গড়িয়ে আসে। 

জব্বারের মা হচকিয়ে উঠে পড়ল। ঝাঁটা খোঁজে সে। বিছানার কিনারায় পানা। এই ত সামান্য ব্যবধান। বগীর এই দিক ঈষৎ ঢালু। 

জব্বারের মা ঝাড় দিতে থাকে। অন্যদিকে পুত্রের মেজাজ তেতে উঠেছিল। সে উঠে বাচ্চা দু—টো-কে মারল এক লাথি। তারপর ধাড়ীর উপর। শেষে একটা চেলা কাঠ তুলে নিল সে। 

নিরীহ পশুর চীৎকার। হট্টগোল। 

নিমেষে ব্যাপারটা ঘটে যায়। 

বৃদ্ধা ঝাঁটা ফেলে হতভম্বের মত পুত্রের দিকে ছুটে আসে : হায়, আরে ইয়ে কিয়া। মর জায়েগা, 

বাচ্চা মর জায়েগা। 

—মরনে দো। 

মার কণ্ঠে রীতিমত কান্নার সুর। 

শান্ত হয় পুত্র তখন-ই। হাতের চেলা কাঠ এক দিকে ফেলে দিল সে। 

এই ফাঁকে পানীর রেখা বিছানার কাঁথায় পৌঁছে গেছে। বৃদ্ধা পুনরায় হাউমাউ করেঃ তু কিয়া কিয়া, জব্বার। গেঁহু লানে নেহি সাতা, ফিন মরদমী দেখাতা। 

—চুপ মাতারি, হামকো খানা দো। 

—বড়ে মরদ কা বাচ্চা আয়া। 

—চুপ করো। খানা দো। 

ভারী ঝাঁঝাঁলো কণ্ঠ জব্বারের। 

বৃদ্ধা একদম স্তব্ধ পাহাড়। যন্ত্রের মত কাজ করে যায় সে। আহার পরিবেশন সমাপ্ত। 

খেতে বসে জব্বার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে : মায়ি, তু ভী খা লে। 

স্তব্ধ পাহাড়ে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই। পানী ঢালা হয়নি। মাটীর পেয়ালায় পানী ঢেলে দিল বৃদ্ধা। অতঃপর স্যাঁতসেঁতে বিছানার একপাশে গিয়ে বস্ সে। 

—মায়ি, তু ভী খানা খা’ লে। 

—গেঁহু কা রোটী খায়েগা।

—আচ্ছা, কাল লায়েগা। 

—তু তো এক মাহিনা সে লাতা হ্যায়। হামরা মরনা আচ্ছা হ্যায়। 

—আম্মা… 

এই একটী শব্দে জব্বারের অনুতাপ-দগ্ধ অনুভূতি প্রকাশ পায়। 

বৃদ্ধা থামে না মোটেই : দেখা মেরা সব ভিং গয়া। গেঁহু নেহি লা সাকতা। মা কা পাশ মরদমি দেখাতা? 

—মায়ি, আল্লা কা ওয়াস্তে চুপ করো। মেরা হাল ভী দেখনা। হাম কৈসা হ্যায়? 

—গেঁহু কাঁহা? 

—ও জমিদার কা পাশ, চুট্টা কারওয়ারী কে পাশ। 

—তু উঁহা মরদমি কাহে নেহি দেখাতা? 

জব্বার এইবার নিঃস্তব্ধ। সম্মুখে ভাতের বাসন। 

আঙ্গুলের ডগায় কয়েকটা ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করে আর কি যেন ভাবে। 

—মায়ি। 

পুনরায় ডাকে সে। 

—তু খা লো। হাম নেহি। 

—আম্মা। 

—নেহি। 

খেঁকিয়ে উঠে বৃদ্ধা। 

জব্বার ভাতের বাসন ঢাকা দিয়ে এগিয়ে আছিল মার কাছে সানুনয় অনুরোধের জন্য, আর পা বাড়াল না। 

রুগ্না খয়রন একবার চোখ মেলে তাকিয়ে কাঁথায় মুখ ঢাকল। ল্যাম্পের আলো তার চোখে সহ্য হয় না। 

ছেলেরা নিঃশব্দে ঘুমোচ্ছে। 

মার দিকে আর একবার তাকায় জব্বার। সে তখন হাঁটুর ভেতর মুখ গুঁজে বসে আছে। সাদা খড়ি-ওঠা চুল শুধু বাতাসে উড়ছে। 

মার দিকে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে জব্বার ল্যাম্প দুটো নিভিয়ে দিল।

অল্পক্ষণ পরে জরতী কণ্ঠ-নিসৃত ফুঁপানির শব্দ শোনা গেল অন্ধকারে। অনেক রাত্রে জব্বারের মার ঘুম ভেঙ্গে গেল। 

ভেজা কাঁথার উপর নাতির পাশে কখন ঢলে পড়েছিল, খেয়াল নেই। 

অন্ধকারে খস্থস শব্দ, তারপর ম্যাও ম্যাও ডাক শোনা যায়। বেড়াল এসেছে কোথাও থেকে। দরজা বন্ধ নয় কী? জব্বারের মেয়ে পাড়ার একটা বেড়াল এনেছিল। এমন ন্যাওটা হোয়ে পড়ে, অতি কষ্টে সে-টা বিদায় করা গেছে। 

হুশিয়ার সংসারী মেয়ে, বৃদ্ধা তাড়াতাড়ি উঠে ল্যাম্প জ্বালে। চোখে আর এতটুকু খোঁয়ারী নেই। গৃহ-কাজের নামে তার চেতনার দল সামান্য বিশ্রাম পোহাতে জানে না। 

আলোয় দেখা যায়, হাঁড়ির কাছে বেড়াল ছানা ঘুরে বেড়াচ্ছে। উদ্দেশ্য নিশ্চয় মহৎ নয়।

জব্বারের মা চেলা-কাঠ নিয়ে তেড়ে যায়। খোলা দরজা দিয়ে সুড়ুৎ পালিয়ে গেল বিড়াল-ছানা।

বৃষ্টি থেমে গেছে। 

বাইরে দিগন্তে তারা ফুটেছে। 

বেড়াল তাড়াতে গিয়ে মার চোখে পড়ল ঢাকা ভাতের বাসন। আবরণ উন্মোচন করে সে দেখে, ভাত ঠিক আছে। 

জব্বার খায়নি তবে? 

বদ্ধা সালনের হাঁড়ি পরীক্ষা করল। না, তরকারী পূর্ব্ব-বৎ। জব্বার অভুক্ত, আর কোন সন্দেহ থাকে না মার। ঘুমন্ত পুত্ৰ। 

পরিশ্রান্ত মুখের উপর ল্যাম্পের আলো বিষণ্ণ ছায়ার মত। জব্বারের মা পুত্রের দিকে চেয়ে থাকে।

ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো সে তার শিয়রে উবু-অবস্থায়। শান্ত কণ্ঠে ডাকে জননীঃ জব্বার, মেরা লাল।

লাল ঘুমের ঘোরে ‘উঁ’ শব্দে পাশ ফিরে শোয়। নিদ্রিত ব্যক্তির নিকট মাতৃ-স্নেহ কোন প্রভাব বিস্তার করে না। 

জননীর আশঙ্কা বাড়ে। বুখার নেই চড়া ত? পুত্রের কপালে হাত দিল সে। না, কোন উত্তাপ নেই।

মার স্পর্শে জব্বারের ঘুম ভেঙে গেল। হঠাৎ মা-কে সিথানে দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে নিদ্রালু কণ্ঠেই সে জিজ্ঞেস করে : কিয়া? 

—উঠঠো বেটা, খানা খা লো। 

—নেহি। 

—উঠঠো, মেরা লাল। 

জননী জব্বারের রুক্ষ চুলে আঙ্গুল চালায়। 

—হাম ভি নেহি খায়া, চলো। 

—তুম খায়েগা, মাতারি? 

—হাঁ, বেটা। গেঁহু কা মু মে ঝাড়ু মারো। 

মার মুখের দিকে তাকিয়ে জব্বার বিস্মিত হয়। 

—চলো। 

আর বিলম্ব করে না সে। সম্মতির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধা পরিবেশনের নৈপুণ্য দেখায় আবার। নিজে-ও বাসনে ভাত নিল সে। 

জব্বার তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধোয়। 

বগীর বাইরে তাকায় সে। রাত্রির বন্দর সুপ্ত। 

গোয়ালন্দ—গামী জাহাজের দূরাগত ধাতব আর্তনাদ এক-টানা ভেসে আসে। ঠাণ্ডা বাতাসে ক্লান্তি-হর স্পর্শ। 

দুইজনে আহারে বসে। 

মা জিজ্ঞেসা করে : থোড়া সালন? 

—নেহি মাতারি।

—লো, বেটা। 

—নেহি। তু লে। 

বৃদ্ধার হঠাৎ খেদোক্তি শোনা যায় : হাম তো এয়সি না থি, মেরা লাল। হাম এয়সি—

কথাটা ভয়ানক সত্যি। জব্বার জানে, মার এমন মেজাজ কোন দিন ছিল না। 

—হাম ভি কিয়া হো গেয়া। জব্বার বলে। 

পুত্রের জবাবে বৃদ্ধা সন্তুষ্ট হয়। তার ফোলা গালে হাসির রেশ। 

পুত্র আবার বলে : ঠিক কহা, মায়ি, মরদামি উঁহা দেখানা চাহিয়ে, যো মেরা গেঁহু ছিন লিয়া। যো হামকো ইস্ তরহ কা জানোয়ার বানায়া। উঁহি, উঁহি-। 

দৃঢ় বলিষ্ঠ কণ্ঠ নিশীথিনীর নিথর পট-ভূমিকায় আরো তীক্ষ্ণ মনে হয়। বৃদ্ধা পুত্রের অনুভূতির কোন হিস্যা ভোগ করে না। কথাটা শুনতে বেশ। তাই আবার তুপড়ানো গালে হাসির আমেজ ফোটে। চোখে চোখে হাসি বিনিময় হয় দুইজনে। 

—আওর থোড়া সালন দোঁ, বেটা? 

—নেহি। 

বৃদ্ধা একটা পরিতৃপ্তির ঢেকুর তোলে। 

একটু পরে বগীর মুখ বন্ধ হোয়ে গেল। নিভে গেল ল্যাম্প। 

.

ক্ষমা করবেন, আপনার কল্পনার ইমারৎ যদি এতক্ষণ চূর্ণ করে দিয়ে থাকি। সৌধ আবার গড়ে তুলুন।

শ্রাবণের ঝিল্লী-ঝঙ্কত রাত্রি… চারিদিক অন্ধকার। আপনার সম্মুখে বগী নেই। এখন শুধু গুহা আর গুহা। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *