গৃহিণী গৃহ মুছ্যতে
দাম্পত্যকলহ যে সব সময় বহু আড়ম্বর করেই শুরু হয় তা নয়, সামান্য কথায়ও হতে পাবে।
তবে আরম্ভ-র মধ্যে বৌ না থাকলেও, তার মাঝখানে বউ থাকেই!
পূজার বোনাসের উপরি পাওনার কী গতি করা যায় তাই নিয়ে কথা হচ্ছিল দুজনাব—টাকাটা দিয়ে কী করা হবে তারই বিলি বন্দেজ।
শিখরিণী বলছিল—–টাকাটা যা তা করে উড়িয়ে দেয়া চলবে না…।
শেখর বলল-তা তো নয়ই। আজে বাজে খরচ করা হবে না কিছুতেই যে, তা ঠিক।
টাকা তো আসতে না আসতেই ফুট! বলছিল বৌ-কী করে কোথা দিয়ে যে খরচ হয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না। কপূরের মতই উপে যায় যেন।
যা বলেছ। বৌয়ের কথায় ওর সায়।
এবার আর তা নয়। হিসেব মতন কেনা কাটা করতে হবে সব। অনেক কিছু করা যায় এই টাকায়। কী কী কিনতে হবে তার একটা লিস্টি করে ফেলা যাক, কী বলে?
তোমার খান কয়েক শাড়ি তো প্রথমেই—শেখরই পাড়তে যায়।
অনেক ঘাটের জল খেয়ে অবশেষে ঘাটশিলায় এসে প্রায় কপর্দক-হীন অবস্থায় কপার মাইনের চাকরিটা পেয়েছে শেখর-তার বৌয়ের পয়েই বলতে হয়। কোম্পানির থেকে কোয়ার্টারও পেয়েছে তারপর। ঘর পাবার পর ঘরণীকেও নিয়ে এসেছে তার পরে। আর তার পরেই এই মোটা টাকার পূজা বোনাস—তার বৌয়ের পয়েই নিশ্চয়। অতএব বৌকে সুখী করার কথাই সর্ব প্রথম।
আর বৌ খুশি হয় শাড়ি পেলে—তা কে জানে? শুক আর সারি যেমন জোড়বাঁধা, তেমনি শাড়ির সঙ্গে সুখ ওতপ্রোত। জড়োয়া গয়না দেবার সামর্থ্য নেই ওর, অতএব শাড়ি দিয়েই বোকে সুখের সঙ্গে জড়াও।
খা, শাড়ি তো আছেই, কিন্তু তার আগে চাই আসবাব পত্তর— শিখরিণীর বক্তব্য—কোনো ঘরে এক চিলতে সামগ্রী নেই। আসবাব পত্তর না থাকলে ঘরদোর যেন মানায় না। কোন্ ঘরে কী কী জিনিস দরকার তার একটা তালিকা করে ফেলা যাক। কোন্ ঘরের জন্য কী দরকার তার লিস্টি করা যাক, কেমন?
কাগজ আর পেনসিল নিয়ে দুজনে দুখানা ফর্দ করতে বসে গেল।
শেখরের লেখা শুরু হবার আগেই শিখরিণীর ফর্দের অর্ধেক প্রায় খতম্।
শেখরের তালিকায় একটা আইটেম ততক্ষণে খাড়া হয়েছে কোনো রকমে, শিখরিণী বলল, আমি রুম্ বাই রুম্ লিটি করছি, বুঝেছ? রান্নাঘর থেকেই শুরু করেছি আগে।
শেখর ওর কথায় আইডিয়াটা পেল। রান্নাঘরের পরেই খাবার ঘরের কথা। সে এক নম্বর আইটেম লিখল :
(১) আরো মাছ, তারপর আরো চিনি… দুনম্বরে ভেবে চিন্তে বসালো সে।
কী তোমার লেখা হলো? শেষ হল লিস্টি?
প্রায় শেষ। জানালো শেখর।
আচ্ছা, আমার তালিকাটা পড়ছি আমি আগে। তারপর তোমারটা শোনা যাবে। তখন কারটা বেশি জরুরি ভেবে চিন্তে ঠিক করা যাবে তারপর।
আচ্ছা।
রান্নাঘরের জন্য, একনম্বর, একটা ইলেকট্রিক স্টোভ চাই সবার আগে। তারপর এক সেট স্টেইনলেস স্টিলের বাসনকোসন, প্রেসার কুকার…
এমনি করে প্রায় সাতাশটা আইটেম আউড়ে গেল শিখরিণী।
তারপর বসবার ঘরের জন্য সোফাসেট, টিপয়, চেয়ার এসব না হলে চলে নাকো। শোবার ঘরে দেরাজ আলমারি ড্রেসিং টেবল…
শেখর মনে মনে খতিয়ে দেখল, সব কিনতে প্রায় সাত হাজার টাকার ধাক্কা। আর বোনাস তো মাত্র বারোশো টাকার। সে নিজের তালিকায়, আরো একটা, তিন নম্বরের আইটেম যোগ করল তখন।
এবার তোমার তালিকাটা শুনি তো। ওর বৌয়ের তলব।
তালিকার লেখাটা দেখালো সে—
(১) আরো বেশি মাছ (২) আরো বেশি চিনি (৩) আরো বেশি টাকা।
তোমার খালি খাওয়া। ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো ওর বৌঃ খাই খাই করেই গেলে! মাছ আর চিনি? খাওয়া ছাড়া দুনিয়ায় যেন কিছুই নেই আর।।
কী আছে আর? তাছাড়া, যা আছে তা হলো গিয়ে শোয়া। খেয়ে দেয়ে পেট ঠাণ্ডা করে শুয়ে পড়া, বলল শেখর কাজের মধ্যে দুই, খাই আর শুই।
ভারী একলফেঁড়ে লোক বাবা তুমি!
একলষেঁড়ে হলুম? আমি কি একলা খাব নাকি? তোমাকে নিয়েই খাব তো। আর শোবার কথা যদি ধরো…।
হয়েছে, আর বলতে হবে না। বুঝতে পেরেছি। সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। বলল শিখরিণী।
খানিক চুপ থেকে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেয়ে মুখর হয়ে ওঠে শেখর—কিন্তু এত আসবাব-পত্তর এনেই বা কী হবে শুনি? আসবাব আনলেই হয় না, তা সব সময় ঝকঝকে তকতকে রাখতে হয়। নইলে, দুদিনেই নোংরা হয়ে যাচ্ছেতাই হয়ে যায়। এত সোফাসেটি দেরাজ আলমারি রোজ রোজ ঝাড়-পোঁছ করবে কে? শুনি একবার?
ঝি থাকবে না? বলল বৌঃ লোক রাখব একটা।
কপার মাইনের এই আড়াই শশা টাকা মাইনের চাকরীতে আর ঝি চাকর পোষায়। জানাল শেখর, একটা ঝির বেতন আর খোরাকীতে এই বাজারে কত পড়ে তা জাননা? ষাট সত্তর টাকা চলে যায়–তার খেয়াল আছে?
শিখরিণী চুপ করে কথাটা ভাবে।
তবে হ্যাঁ, তুমি নিজে যদি আসবাব পত্তরের যত্ন নাও, ঝাড়-পোঁছ করার ভার নাও তো হয়। অবশ্যি, শাস্ত্রেও সেই কথা বলে বটে। বলে যে, গৃহিণী গৃহ মুছতে, ঘর দোর ঝাড়া মোছর কাজ যা তা বাড়ির গিন্নীরই করবার…
বিয়ে করে ভালো বিনে মাইনের দাসী পেয়েছে, না? ঝামটা দিয়ে উঠল ওর বৌ : তোমার ভাত রাঁধব, বাসন মাজব, আসবাব পত্তর ঝকঝকে তকতকে রাখব সারাদিন দাসীবৃত্তি করে, তবে তুমি দুটি আমায় খেতে দেবে—তাই না?
ব্যাস। শাস্ত্রকথার থেকে অনেক অশাস্ত্রীয় কথা উঠল তারপর। কলহ গড়ালো অনেক দূর, শেষ পর্যন্ত ধুত্তোর বলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল শেখর।
যথারণ্যথা গৃহম্। আরেকটা শাস্ত্রবাক্য আউড়ে বোধকরি রোদশে জনেই অরণ্যের উদ্দেশে বেরুলো সে।
অরণ্যও খুব বেশি দূরে ছিল না। ঘাটশিলার চার ধারেই অরণ্য। শাস্ত্রমতে যে বাণপ্রস্থ পঞ্চাশশার্ধে হবার, পঞ্চাশের অর্ধেই তাই বরণ করে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে সেঁধুল সে।।
সন্ধ্যে হয় হয়। জীবনসন্ধ্যা আসার ঢের আগেই সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল তার জীবনে।
বিকেলে অফিস থেকে ফিরে চায়ের সঙ্গে এক বাটি হালুয়া খেয়েছে—খিদে তাই পাচ্ছিল না তার। আজ রাতটা না খেয়েই সে কাটাতে পারবে। কাল থেকে বনের ফলমূল তার সম্বল—জীবনের আমূল পরিবর্তন তার কাল থেকেই।
বুদ্ধি করে হালুয়াটা খেয়ে এসেছে পেট ভরে—নিজের বুদ্ধির সে তারিফ দিল। চায়ে চিনি ছিল না, চিনির অভাবে হালুয়াটাও মিষ্টি হয়নি তেমন—সেই কারণেই তার ফর্দের দুনম্বরে আরো বেশি চিনির উল্লেখ ওই।
কিন্তু চিনির যোগাড় করা যেমন কঠিন নিজের বৌকে চিনতে পারাও তার চেয়ে কিছু কম কঠিন নয় বুঝি। বহু আড়ম্বরে শুরু না হলেও এবং বউ-র দিক থেকে আরম্ভ নাহলেও এই প্রথম কলহেই জীবনে অরুচি ধরে গেহল তার। তাই শেখরের এই যৌ-বনপ্রস্থানকে নেহাত লঘুক্রিয়া বলা যায় না হয়ত বা।
শেখর শুনেছিল, ঘাটশিলার জঙ্গলের এই ভূমিকা আদৌ সামান্য নয়, ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হয়ে মধ্যপ্রদেশের দণ্ডক পর্যন্ত চলে গেছে এই অরণ্য। এর আনাচে কানাচে বাঘ, ভাল্লুক, বন-বেড়াল, খাকশেয়াল, সাপ, বিছে, বাদুড়, বাঁদর সব ওতপ্রোত হয়ে রয়েছে।
কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘোরা ফেরার পর গাছের ফাঁকে চাঁদের আলোয় ঘড়ি দেখে সে জানল যে রাত দশটা হয়েছে—এবার শোবার ব্যবস্থা করতে হয় কোথাও। বনে রাত কাটাতে হলে গাছই হচ্ছে সব চেয়ে নিরাপদ এই ভেবে সে একটা গাছে উঠে তার শাখাপ্রশাখার জোড়বিজোড়ের ফোকরে কায়দা করে শুয়ে পড়ল কোনরকমে এবং প্রকৃতির ক্রোড়ে আদিম মানবদের মতই সে ঘুমিয়ে পড়ল দেখতে না দেখতেই।
খানিক বাদে এক বিরাট অজগর সেই পথে যেতে দেখতে পেল শেখরকে। ইস্ লোকটা কী বেকায়দায় শুয়েছে দ্যাখো দেখি! ঘুমের ঘোরে উলটে পড়ে হাড় গোড় ভাঙবে বোধ হয় বেচারা। না, ওকে বক্ষা করা আমার দরকার। আপনমনে আওড়ালো অজগর।
এই না ভেবে সেই পরহিতচিকীর্ষু সাপটা গাছে উঠে সাত পাকে তাকে জাপটে ধরল। এইভাবে ওকে সাপটে রাখলে আর ও গাছের থেকে পড়বে না, ভাবল সাপটা, আর, এখন যদি ওকে রক্ষা করি, তাহলে কাল সকালে এর আমি আরো সেবা করতে পারব। প্রাতরাশ হিসেবে নেহাত মন্দ হবে না মনে হচ্ছে।
সকালে গাছের ফোকর দিয়ে সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল শেখরের। ঘুম ভাঙতেই শেখর দেখল বিরাট এক অজগর তাকে জড়িয়ে রয়েছে। এক সাতপাকের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে আরেক সাতপাকের ফাঁসে এসে পড়েছে সে। সাপটা তখনন গভীর নিদ্রায় অচেতন। শেখরের ডান হাতটা মুক্ত ছিল, আর দেরি না করে পকেট থেকে তার ছোরাটা বার করে সে সাপের পিঠে বসিয়ে দিল সবলে।
সাপটা তখন আরো জোরে জাপটাবার চেষ্টা করল তাকে-আর ছুরিটাও সেই চেষ্টায় আরো বেশি গেঁথে বসল তার গায়। একটু পরেই অজগর নিজের বাঁধন আগা কবে গাছ থেকে খসে পড়ে ভূমিশয্যায় দেহরক্ষা করল তার।
আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে গাছের থেকে নামল শেখর। অজগরের অধঃপতনে শাখায় শাখায় পাখির দল কিচির মিচির লাগিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে, বাঁদররা ডালে ডালে হপ হপ করে লাফাতে লেগেছে আর সামনের গাছে এক কাকাতুয়া শেখরের কাণ্ড না দেখে চেঁচিয়ে উঠেছে—কেয়া বাত! কেয়া বাত!
কিন্তু তাদের এসব উৎসাহ-প্রকাশে নজর ছিল না শেখরের। কাল রাত্রে শোবার আগে যদিও তার সংকল্প ছিল যে সকালে উঠে আরো গভীরতর বনে সে প্রবেশ করবে, কিন্তু এখন, সকলের অভিনন্দন, এমনকি, কাকাতুয়াটার সাধুবাদ সত্বেও সে-মতলব সে পরিহার করল। তার মনে হলো যে, বন যতই কেন উপাদেয় হোক না, বাড়ির মতন জায়গা আর নেই।
ইত্যাকার ভেবে বন ছেড়ে ঘরের পানেই পা বাড়ালো শেখর।
আবজানো দরজা ঠেলে ঢুকতেই তার নজরে পড়লো, ঘরের নেতৃত্ব নিয়েছে বৌ। সাবানজলে ভেজানো ন্যাতা দিয়ে মেজে ঘষে ঘরের মেজে তকতকে করতে লেগেছে। গৃহিণী গৃহ মুছতে-ই বটে!
বৌ তাকে আসতে দেখে বলল, কী কাণ্ড তোমার! অমন দুম করে কিছু না বলে চলে গেলে, আমি সারা রাত বাড়া ভাত নিয়ে ঠায় বসে কাটালুম। তোমার যে নাইট ডিউটি ছিল সেটা আমায় বলে যাবে তো?
শেখর কিছু না বলে গুম হয়ে থাকে।
চায়ের জল চাপিয়েছি। নাও, মুখ হাত পা ধুয়ে বোসো এখন–টোস্ট, ডিমসেদ্ধ নিয়ে আসছি সব।
ডেকচেয়ারটায় গা এলিয়ে মনে হলো শেখরের, গভীরতর বনে না সেঁধিয়ে ভালোই করেছে সে। কেননা, পরের বন যতই কেন গভীর হোক না, পরের বোনের মতন মিষ্টি আর হয় না—যদি সে পরী মতই হয় আবার। আর যদি সে ফের ঘরণী হয়ে আসে।