গৃহদাহ – ১৬-২০

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

একি, সুরেশ যে! এস এস, বাড়ির ভেতরে এস। ভাল ত?

মহিমের স্বাগত-সম্ভাষণ সমাপ্ত হইবার পূর্বে সুরেশ সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। হাতের গ্লাডস্টোন ব্যাগটা নামাইয়া রাখিয়া কহিল, হ্যাঁ, ভাল। কিন্তু কি রকম, একা দাঁড়িয়ে যে? অচলা বধূঠাকুরানী একমুহূর্তে সচলা হয়ে অন্তর্ধান হলেন কিরূপে? তাঁর প্রবল বিশ্রম্ভালাপ মোড়ের ওপর থেকে যে আমাকে এ বাড়ির পাত্তা দিলে।

বস্তুতঃ অচলার শেষ কথাটা রাগের মাথায় একটু জোরে বাহির হইয়া পড়িয়াছিল, ঠিক দ্বারের বাহিরেই তাহা সুরেশের কানে গিয়াছিল।

সুরেশ কহিল, দেখলে মহিম, বিদুষী স্ত্রী-লাভের সুবিধে কত? ক’দিনই বা এসেছেন, কিন্তু এর মধ্যেই পাড়াগাঁয়ের প্রেমালাপের ধরনটা পর্যন্ত এমনি আয়ত্ত করে নিয়েছেন যে, খুঁত বের করে দেয়, পাড়াগেঁয়ে মেয়েরও তা সাধ্য নেই।

মহিম লজ্জায় আকর্ণ রাঙ্গা হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সুরেশ ঘরের দিকে চাহিয়া অচলাকে উদ্দেশ করিয়া পুনরায় কহিল, অত্যন্ত অসময়ে এসে রসভঙ্গ করে দিলুম বৌঠান, মাপ কর। মহিম, দাঁড়িয়ে রইলে যে! বসবার কিছু থাকে ত নিয়ে চল, একটু বসি। হাঁটতে হাঁটতে ত পায়ের বাঁধন ছিঁড়ে গেছে—ভাল জায়গায় বাড়ি করেছিলে ভাই—চল, চল, কলকাতায় চল।

চল, বলিয়া মহিম তাহাকে বাহিরের বসিবার ঘরে আনিয়া বসাইল।

সুরেশ কহিল, বৌঠান কি আমার সামনে বের হবেন না নাকি? পর্দানশীন?

মহিম জবাব দিবার পূর্বেই পাশের দরজা ঠেলিয়া অচলা প্রবেশ করিল। তাহার মুখে কলহের চিহ্নমাত্র নাই, নমস্কার করিয়া প্রসন্নমুখে কহিল, এ যে আশাতীত সৌভাগ্য! কিন্তু এমন অকস্মাৎ যে?

তাহার প্রফুল্ল হাসিমুখ সুখ-সৌভাগ্যের প্রসন্ন বিকাশ কল্পনা করিয়া সুরেশের বুকের ভিতরটা ঈর্ষায় যেন জ্বলিয়া উঠিল। হাত তুলিয়া প্রতি-নমস্কার করিয়া বলিল, এখন দেখচি বটে, এমন অকস্মাৎ এসে পড়া উচিত হয়নি। কিন্তু কাণ্ডটা কি হচ্চিল? Their first difference না,—আসা পর্যন্ত এইভাবে মতভেদ চলচে? কোন্‌টা?

অচলা তেমনি হাসিমুখে কহিল, কোন্‌টা শুনলে আপনি বেশ খুশি হন বলুন? শেষেরটা ত? তা হলে আমার তাই বলা উচিত—অতিথিকে মনঃক্ষুণ্ণ করতে নেই।

সুরেশের মুখ গম্ভীর হইল; কহিল, কে বললে নেই? বাড়ির গৃহিণীর সেই ত হল আসল কাজ—সেই ত তার পাকা পরিচয়।

অচলা হাসিতে হাসিতে কহিল, গৃহই নেই, তার আবার গৃহিণী! এই দুঃখীদের কুঁড়ের মধ্যে কি করে যে আজ আপনার রাত্রি কাটবে, সেই হয়েছে আমার ভাবনা। কিন্তু ধন্য আপনাকে, জেনে শুনে এ দুঃখ সইতে এসেছেন।

স্বামীর মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, আচ্ছা, নয়নবাবুকে ধরে চন্দ্রবাবুর বাড়িতে আজ রাতটার মত ওঁর শোবার ব্যবস্থা করা যায় না? তাঁদের পাকা বাড়ি—বসবার ঘরটাও আছে, ওঁর কষ্ট হতো না!
সৌজন্যের আবরণে উভয়ের শ্লেষের এই-সকল প্রচ্ছন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে মহিম মনে মনে অধীর হইয়া উঠিতেছিল; কিন্তু কি করিয়া থামাইবে, ভাবিয়া পাইতেছিল না, এমনি অবস্থায় সুরেশ নিজেই তাহার প্রতিকার করিল; সহসা হাতজোড় করিয়া বলিল, আমার ঘাট হয়েচে বৌঠান, বরং একটু চা-টা দাও, খেয়ে গায়ে জোর করে নিয়ে তার পরে নয়নবাবুকে বল, শ্রবণবাবুকে বল—চন্দ্রবাবুর পাকা ঘরে শোবার জন্যে সুপারিশ ধরতে রাজি আছি। কিন্তু যাই বল মহিম, এর ওপর এত টান সত্যি হলে, খুশি হবার কথা বটে।

মহিমের হইয়া অচলাই তাহার উত্তর দিল; সহাস্যে কহিল, খুশি হওয়া না হওয়া মানুষের নিজের হাতে; কিন্তু এ আমার শ্বশুরের ভিটে, এর ওপর টান না জন্মে বড়লাটের রাজপ্রাসাদের ওপর টান পড়লে সেইটে ত হত মিথ্যে। যাক, আগে গায়ে জোর হোক, তার পর কথা হবে। আমি চায়ের জল চড়াতে বলে এসেচি, পাঁচ মিনিটের মধ্যে এনে হাজির করে দিচ্চি—ততক্ষণ মুখ বুজে একটু বিশ্রাম করুন; বলিয়া অচলা হাসিয়া প্রস্থান করিল।

সে চলিয়া যাইতেই সুরেশের বুকের জ্বালাটা যেন বাড়িয়া উঠিল। নিজেকে সে চিরদিনই দুর্বল এবং অস্থিরমতি বলিয়াই জানিত, এবং এজন্য তাহার লজ্জা বা ক্ষোভও ছিল না। ছেলেবেলায় বন্ধুবান্ধবেরা যখন মহিমের সঙ্গে তুলনা করিয়া তাহাকে খেয়ালী প্রভৃতি বলিয়া অনুযোগ করিত, তখন সে মনে মনে খুশি হইয়া বলিত, সে ঠিক যে, তাহার সঙ্কল্পের জোর নাই, সে প্রবৃত্তির বাধ্য; কিন্তু হৃদয় তাহার প্রশস্ত—সে কখনও হীন বা ছোট কাজ করে না। সে নিজের আয় বুঝিয়া ব্যয় করিতে জানে না, পাত্রাপাত্র হিসাব করিয়া দান করিতে পারে না—মন কাঁদিয়া উঠিলে গায়ের বস্ত্রখানা পর্যন্ত বিসর্জন দিয়া চলিয়া আসিতে তাহার বাধে না—তা সে যাহাকে এবং যে কারণেই হোক; কিন্তু এ কথা কাহারও বলিবার জো নেই যে, সুরেশ কাহাকেও দ্বেষ করিয়াছে, কিংবা স্বার্থের জন্য এমন কোন কাজ করিয়াছে, যাহা তাহার করা উচিত ছিল না। সুতরাং আজন্মকাল হৃদয়ের ব্যাপারে যাহার একান্ত দুর্বল বলিয়াই অখ্যাতি ছিল এবং নিজেও যাহা সে সত্য বলিয়াই বিশ্বাস করিত, সেই সুরেশ যখন অকস্মাৎ অচলার সম্পর্কে শেষ-মুহূর্তে আপনার এত বড় কঠোর সংযমের পরিচয় পাইল, তখন নিজের মধ্যে এই অজ্ঞাত শক্তির দেখা পাইয়া কেবল আত্মপ্রসাদই লাভ করিল না, তাহার সমস্ত হৃদয় গর্বে বিস্ফারিত হইয়া উঠিল।অচলার বিবাহের পরে দুটো দিন সে আপনাকে নিরন্তর এই কথাই বলিতে লাগিল—সে শক্তিহীন অক্ষম নয়—সে প্রবৃত্তির দাস নয়; বরঞ্চ আবশ্যক হইলে সমস্ত প্রবৃত্তিটাকেই সে বুকের ভিতর হইতে সমূলে উৎপাটন করিয়া ফেলিয়া দিতে পারে। বন্ধুত্ব যে কি, তাহার সুখের জন্য একজন যে কতখানি ত্যাগ করিতে পারে, এইবার বন্ধু ও বন্ধু-পত্নী বুঝুন গিয়া।

কিন্তু কোন মিথ্যা দিয়াই দীর্ঘকাল একটা ফাঁক ভরাইয়া রাখা যায় না। আত্মসংযম তাহার সত্য বস্তু নয়, ইহা আত্মপ্রতারণা। সুতরাং একটা সম্পূর্ণ সপ্তাহ না কাটিতেই এই মিথ্যা সংযমের মোহ তাহার বিস্ফারিত হৃদয় হইতে ধীরে ধীরে নিষ্কাশিত হইয়া তাহাকে সঙ্কুচিত করিয়া আনিতে লাগিল, মন তাহার বারংবার বলিতে লাগিল, এই স্বার্থত্যাগের দ্বারা সে পাইল কি? ইহা তাহাকে কি দিল? কোন্‌ অবলম্বন লইয়া সে আপনাকে এখন খাড়া রাখিবে? পিসিমা বলিলেন, বাবা, এইবার তুই এমনি একটি বৌ ঘরে আন্‌, আমি নিয়ে সংসার করি।
একদিন সমাজের দোরগোড়ায় কেদারবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে তিনি স্পষ্টই বলিলেন, কাজটা তাঁহার ভাল হয় নাই। মহিমের সহিত বিবাহ দিতে ত গোড়াগুড়িই তাঁহার ইচ্ছা ছিল না—শুধু সে নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিল বলিয়াই তিনি অবশেষে মত দিলেন। ঘরে আসিয়া তাহার মনের মধ্যে অভিশাপের মত জাগিতে লাগিল, এই বিবাহ দ্বারা তাহাদের কেহই যেন সুখী না হয়। নিজের অবস্থাকে অতিক্রম করার অপরাধ বন্ধুও অনুভব করুন, অচলাও যেন নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হইয়া মরে। কিন্তু তাই বলিয়া মন তাহার ছোট নয়। এই অকল্যাণ কামনার জন্য নিজেকে সে অনেকরকম করিয়া শাসিত করিতে লাগিল। কিন্তু তাহার পীড়িত প্রতারিত হৃদয় কিছুতেই বশ মানিল না—নিতান্ত একগুঁয়ে ছেলের মত নিরন্তর ঐ কথাই আবৃত্তি করিতে লাগিল। এমনি করিয়া মাস-খানেক সে কোনমতে কাটাইয়া দিয়া একদিন কৌতূহল আর দমন করিতে না পারিয়া অবশেষে ব্যাগ হাতে মহিমের বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল।

সুরেশ বন্ধুর মুখের পানে চাহিয়া কহিল, এখন দেখতে পাচ্চো মহিম, আমার কথাটা কতখানি সত্যি?

মহিম জিজ্ঞাসা করিল, কোন্‌ কথাটা?

সুরেশ বিজ্ঞের মত বলিল, আমার পল্লীগ্রামে বাস নয় বটে, কিন্তু এর সমস্তই আমি জানি। আমি তথাপি কি সাবধান করে দিইনি যে, গ্রামের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে একটা ঘোরতর বিরোধ বাধবে?

মহিম সহজভাবে কহিল, কৈ, তেমন বিরোধ ত কিছু হয়নি।

বিরোধ আর বল কাকে? তোমার বাড়িতে কেউ খেলে কি? সেইটেই কি যথেষ্ট অশান্তি অপমান নয়?

আমি খেতে কাউকে বলিনি।

বলনি? আচ্ছা, কৈ, বৌভাতে আমাকে ত নেমন্তন্ন করনি মহিম?

ওটা হয়নি বলেই করিনি।

সুরেশ বিস্মিত হইয়া বলিল, বৌভাত হয়নি? ওঃ—তোমাদের যে আবার—কিন্তু এমন করে ক’টা উপদ্রব এড়ানো যাবে মহিম? আপদ-বিপদ আছে, ছেলেমেয়ের কাজ-কর্ম আছে—সংসার করতে গেলে নেই কি? আমি বলি—

যদুর হাতে চায়ের সরঞ্জাম এবং নিজে থালায় করিয়া মিষ্টান্ন লইয়া অচলা প্রবেশ করিল। সুরেশের শেষ কথাটা তাহার কানে গিয়াছিল; কিন্তু তাহার মুখের ভাবে সুরেশ তাহা ধরিতে পারিল না। দুই বন্ধুর জলযোগ এবং চা-পান শেষ হইলে মহিম কাঁধের উপর চাদরটা ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। গ্রামের জমিদার মুসলমান, তাঁহার ছেলেটিকে মহিম ইংরাজি পড়াইত। জমিদারসাহেব নিজে লেখাপড়া না জানিলেও তাঁহার ঔদার্য ছিল, মহিমের সহিত সদ্ভাবও যথেষ্ট ছিল। এইজন্য গ্রামের লোক সমাজের দোহাই দিয়া আজও তাহার উপর উপদ্রব করিতে সাহস করে নাই।

অচলা কহিল, আজ পড়াতে না গেলেই কি হতো না?

মহিম কহিল, কেন?

অচলার মনের জোর ও অন্তরের নির্মলতা যত বড়ই হোক, সুরেশের সহিত তাহার সম্বন্ধটা যেরূপ দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাতে তাহার আকস্মিক অভ্যাগমে কোন রমণীই সঙ্কোচ অনুভব না করিয়া থাকিতে পারে না। সুরেশকে সে ভাল করিয়াই চিনিত, তাহার হৃদয় যত মহৎই হোক, সে হৃদয়ের ঝোঁকের উপর তাহার কোন আস্থা ছিল না—এমন কি, ভয়ই করিত। এই সন্ধ্যায় তাহারই সহিত তাহাকে একাকী ফেলিয়া যাইবার প্রস্তাবে সে মনে মনে উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল; কিন্তু বাহিরে তাহার লেশমাত্র প্রকাশ না করিয়া হাসিয়া কহিল, বাঃ, সে কি হয়? অতিথিকে একলা ফেলে—
মহিম কহিল, তাতে অতিথি সৎকারের কোন ত্রুটি হবে না। তা ছাড়া তুমি ত রইলে—

অচলা ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, কিন্তু আমিও থাকতে পারব না। সুরেশের প্রতি চাহিয়া কহিল, আমাদের উড়ে বামুনটি এমনি পাকা রাঁধুনী যে, তার সঙ্গে না থাকলে কিছুই মুখে দেবার জো থাকবে না। আমি বলি, তুমি বরঞ্চ—

মহিম ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না, তা হয় না। ঘণ্টা-দুই বৈ ত নয়। বলিয়া ঘরের কোণ হইতে সে লাঠিটা তুলিয়া লইল। একে ত মহিমের কাজের ধারা সহজে বিপর্যস্ত হয় না, তাহাতে এই একটা সামান্য কারণ লইয়া বারংবার নির্বন্ধ প্রকাশ করিতেও অচলার লজ্জা করিতে লাগিল, পাছে ভয়টা তাহার সুরেশের চোখে ধরা পড়িয়া লজ্জাটা শতগুণ হইয়া উঠে।

মহিম ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। তাহাকে শুনাইয়া সুরেশ অচলাকে হাসিয়া কহিল, কেন নিজের মুখ হেঁট করা! চিরকাল জানি, ও সে পাত্রই নয় যে, কারও কথা রাখবে।

তুমি বরং যা হোক একখানা বই আমাকে দিয়ে নিজের কাজে যাও—আমার দিব্যি সময় কেটে যাবে।

কথাটা হঠাৎ অচলাকে বাজিল যে, বাস্তবিকই মহিম কোনদিন কোন অনুরোধই তাহার রক্ষা করে না। হউক না ইহা তাহার সুমহৎ গুণ, কিন্তু তবুও সুরেশের মুখ হইতে স্বামীর এই আজন্ম কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয় তাহারই সম্মুখে আজ তাহাকে অপমানকর উপেক্ষার আকারে বিঁধিল। কোন কথা না কহিয়া, সে নিজের ঘরে গিয়া, যদুকে দিয়া একখানা বাংলা বই পাঠাইয়া দিয়া রান্নাঘরে চলিয়া গেল।

অনেক রাত্রে শয়ন করিতে গিয়া মহিম জিজ্ঞাসা করিল, সুরেশ কতদিন এখানে থাকবে তোমাকে বললে?

এমনি ত নানা কারণে আজ সারাদিনই স্বামীর উপর তাহার মন প্রসন্ন ছিল না; তাহাতে এই প্রশ্নের মধ্যে একটা কুৎসিত বিদ্রূপ নিহিত আছে কল্পনা করিয়া সে চক্ষের নিমেষে জ্বলিয়া উঠিল; কঠোর কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, তার মানে?

মহিম অবাক হইয়া গেল। সে সোজাভাবেই কথাটা জানিতে চাহিয়াছিল, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ কিছুই করে নাই। তাহাদের এতক্ষণের আলাপের মধ্যে এ প্রশ্নটা সে বন্ধুকে সঙ্কোচে জিজ্ঞাসা করিতে পারে নাই এবং সুরেশ নিজে হইতে তাহা বলে নাই। কিন্তু তাহার আশা ছিল, সুরেশ নিশ্চয়ই অচলাকে তাহা বলিয়াছে।

মহিমকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া অচলা নিজেই বলিল, এ কথার মানে এত সোজা যে, তোমাকে জিজ্ঞাসা করবারও দরকার নেই। তোমার বিশ্বাস যে, সুরেশবাবু কোন সঙ্কল্প নিয়েই এখনে এসেছেন, এবং তা সফল হতে কত দেরি হবে সে আমি জানি। এই ত?

মহিম আরও ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া স্নিগ্ধস্বরে বলিল, আমার ও-রকম কোন বিশ্বাস নেই। কিন্তু মৃণালের ব্যবহারে আজ তোমার মন ভাল নেই, তুমি কিছুই ধীরভাবে বুঝতে পারবে না। আজ শোও, কাল সে কথা হবে। বলিয়া নিজেই বিছানায় শুইয়া পাশ ফিরিয়া নিদ্রার উদ্যোগ করিল।

অচলাও শুইয়া পড়িল বটে, কিন্তু কিছুতেই ঘুমাইতে পারিল না। তাহার মনের মধ্যে সারাদিন যে বিরক্তি উত্তরোত্তর জমা হইয়া উঠিতেছিল, সামান্য একটা কলহের আকারে তাহা বাহির হইয়া যাইতে পারিলে হয়ত সে সুস্থ হইতে পারিত; কিন্তু এমন করিয়া তাহার মুখ বন্ধ করিয়া দেওয়ায় সে নিজের মধ্যেই শুধু পুড়িতে লাগিল। অথচ যে প্রসঙ্গ বন্ধ হইয়া গেল, তাহাকে অশিক্ষিত সাধারণ স্ত্রীলোকের মত গায়ে পড়িয়া আন্দোলন করায় যে লজ্জা এবং ইতরতা আছে, তাহাও তাহার দ্বারা সম্পূর্ণ অসম্ভব। সে শুধু কল্পনায় স্বামীকে প্রতিপক্ষ দাঁড় করাইয়া, জ্বালাময়ী প্রশ্নোত্তরমালায় নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া গভীর রাত্রি পর্যন্ত বিনিদ্র থাকিয়া শয্যায় ছটফট করিতে লাগিল।
একটু বেলায় ঘুম ভাঙ্গিয়া অচলা ধড়মড় করিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল, যদু কেৎলি হাতে করিয়া রান্নাঘরে চলিয়াছে। ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাবু কিছু বলে গেছেন যদু?

যদু কহিল, এক প্রহর বেলার মধ্যেই ফিরে আসবেন বলে গেছেন।

মহিম প্রত্যহ প্রত্যুষে উঠিয়া নিজের ক্ষেতখামার দেখিতে যাইত; ফিরিয়া আসিতে কোনদিন বা দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া যাইত।

অচলা প্রশ্ন করিল, নতুনবাবু উঠেছেন?

যদু কহিল, উঠেছেন বৈ কি! তিনিই ত চা তৈরি করতে বলে দিলেন।

অচলা তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুইয়া, কাপড় ছাড়িয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল, সুরেশ বহুক্ষণ পূর্বেই প্রস্তুত হইয়া ঘরের সমস্ত জানালা খুলিয়া দিয়া, খোলা দরজার সুমুখে একখানা চেয়ার টানিয়া লইয়া কালকের সেই বইখানা পড়িতেছে। অচলার পদশব্দে সুরেশ বই হইতে মুখ তুলিয়া চাহিল। অচলার মুখের উপর রাত্রিজাগরণের সমস্ত চিহ্ন দেদীপ্যমান। চোখের নীচে কালি পড়িয়াছে, গণ্ড পাংশু, ওষ্ঠ মলিন—সে যত দেখিতে লাগিল, ততই তাহার দুই চক্ষু ঈর্ষার আগুনে দগ্ধ হইতে লাগিল; কিন্তু কিছুতেই দৃষ্টি আর ফিরাইতে পারিল না।

তাহার চাহনির ভঙ্গীতে অচলা বিস্মিত হইল, কিন্তু অর্থ বুঝিতে পারিল না; কহিল, কখন উঠলেন? আমার উঠতে আজ দেরি হয়ে গেল।

তাই ত দেখছি, বলিয়া সুরেশ ধীরে ধীরে মাথা নাড়িল। সুমুখের দেওয়ালের গায়ে বহুদিনের পুরাতন একটা বড় আরশি টাঙ্গান ছিল; ঠিক সেই সময়েই অচলার দৃষ্টি তাহার উপরে পড়ায়, সুরেশের চাহনির অর্থ একমুহূর্তেই তাহার কাছে পরিস্ফুট হইয়া উঠিল এবং নিজের শ্রীহীনতার লজ্জায় যেন সে একেবারে মরিয়া গেল। এই মুখখানা কেমন করিয়া লুকাইবে, কোথায় লুকাইবে, সুরেশের মিথ্যা ধারণার কি করিয়া প্রতিবাদ করিবে—কিছুই ভাবিয়া না পাইয়া সে দ্রুতবেগে বাহির হইয়া গেল—বলিতে বলিতে গেল, যাই, আপনার চা নিয়ে আসি গে।

সুরেশ কোন কথা বলিল না, শুধু একটা প্রচণ্ড দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া শূন্যদৃষ্টিতে শূন্যের পানে চাহিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।

মিনিট-দশেক পরে চায়ের সরঞ্জাম সঙ্গে লইয়া অচলা পুনরায় যখন প্রবেশ করিল, তখন সুরেশ আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়াছিল। চা খাইতে খাইতে সুরেশ কহিল, কৈ, তুমি চা খেলে না?

অচলা হাসিয়া কহিল, আমি আর খাইনে।

কেন খাও না?

আর ভাল লাগে না। তা ছাড়া, এ জায়গাটা গরম না কি, খেলে ঘুম হয় না। কাল ত প্রায় সারারাত ঘুমোতে পারিনি। হাসিয়া বলিল, একটা রাত ঘুম না হলে চোখমুখের কি যে শ্রী হয়—পোড়া-মুখ যে আর লোকের সামনে বার করা যায় না। বলিয়া লজ্জিত মুখে হাসিতে লাগিল।

সুরেশ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, কিন্তু এ তোমার ছেলেবেলার অভ্যাস, চা খেতে মহিম অনুরোধ করে না?

অচলা হাসিয়া বলিল, অনুরোধ করলেই বা শুনবে কে? তা ছাড়া এ আর এমন কি জিনিস যে না খেলেই নয়?

এ হাসি যে শুষ্ক হাসি সুরেশ তাহা স্পষ্ট দেখিতে পাইল। আবার ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, তুমি ত জানই, ভুমিকা করে কথা বলা আমার অভ্যাসও নয়, পারিও নে। কিন্তু স্পষ্ট করে দু-একটা কথা জিজ্ঞাসা করলে কি তুমি রাগ করবে?
অচলা হাসিমুখে কহিল, শোন কথা! রাগ করব কেন?

সুরেশ কহিল, বেশ। তা হলে জিজ্ঞাসা করি, তুমি এখানে সুখে আছ কি?

অচলার হাসিমুখ আরক্ত হইয়া উঠিল; বলিল, এ প্রশ্ন আপনার করাই উচিত নয়।

কেন নয়?

অচলা মাথা নাড়িয়া বলিল, না। আমি সুখে নেই—এ কথা আপনার মনে হওয়াই অন্যায়।

সুরেশ একটুখানি ম্লানহাসি হাসিয়া বলিল, মনটা কি ন্যায়-অন্যায় ভেবে নিয়ে তবে মনে করে অচলা? কেবল মাস-দুই পূর্বে এ ভাবনা শুধু যে আমার উচিত ছিল তাই নয়, এ ভাবনায় অধিকার ছিল। আজ দু’মাস পরে সব অধিকার যদি ঘুচে থাকে ত থাক, সে নালিশ করিনে, এখন শুধু সত্যি কথাটা জেনে যেতে চাই। এসে পর্যন্ত একবার মনে হচ্ছে জিতেছ, একবার মনে হচ্ছে হেরেছ। আমার মনটা ত তোমার অজানা নেই—একবার সত্যি করে বল ত অচলা, কি?

দুর্নিবার অশ্রুর ঢেউ অচলার কণ্ঠ পর্যন্ত ফেনাইয়া উঠিল; কিন্তু প্রাণপণে তাহাদের শক্তি প্রতিহত করিয়া অচলা বেগে মাথা নাড়িয়া বলিল, আমি বেশ আছি।

সুরেশ ধীরে ধীরে কহিল, ভালই।

ইহার পরে কিছুক্ষণ পর্যন্ত কেহই যেন কোন কথা খুঁজিয়া পাইল না। সুরেশ অকস্মাৎ যেন চকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, আর একটা কথা। তোমার জন্যে যে আমি কত সয়েচি, সে কি তোমার কখনো—

অচলা দুই কানে অঙ্গুলি দিয়া বলিয়া উঠিল, এ-সমস্ত আলোচনা আপনি মাপ করবেন।

সুরেশ খোলা দরজায় দুই হাত প্রসারিত করিয়া অচলার পলায়নের পথ রুদ্ধ করিয়া বলিল, না, মাপ আমি করতেই পারিনে, তোমাকে শুনতেই হবে।

তাহার চোখে সেই দৃষ্টি—যাহা মনে পড়িলে আজও অচলা শিহরিয়া ওঠে। একটুখানি পিছাইয়া গিয়া সভয়ে কহিল, আচ্ছা বলুন—

সুরেশ কহিল, ভয় নেই, তোমার গায়ে আমি হাত দেব না—আমার এখনো সে জ্ঞান আছে। বলিয়া পুনরায় চৌকির উপরে বসিয়া পড়িয়া কহিল, এই কথাটা তোমাকে মনে রাখতেই হবে যে, আমি তোমার ওপর সমস্ত অধিকার হারালেও, আমার ওপর তোমার সমস্ত অধিকার বর্তমান আছে।

অচলা বাধা দিয়া কহিল, এ মনে রাখায় আমার কোন লাভ নেই, কিন্তু—, বলিতে বলিতে দেখিতে পাইল, কথাটা যেন সজোরে আঘাত করিয়া সুরেশকে পলকের জন্য বিবর্ণ করিয়া ফেলিল এবং সেই মুহূর্তে নিজেও স্পষ্ট অনুভব করিল অনুতাপের কথা তাহার নিজের পিঠের উপর সজোরে আসিয়া পড়িল।
ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া এবার সে কোমলকণ্ঠে বলিল, সুরেশবাবু, এ-সব কথা আমারও শোনা পাপ, আপনারও বলা উচিত নয়। কেন আপনি এ-সব কথা তুলে আমাকে দুঃখ দিচ্চেন?

সুরেশ তাহার মুখের উপর দৃষ্টি রাখিয়া বলিল, দুঃখ কি পাও অচলা?

অচলার মুখ দিয়া অকস্মাৎ বাহির হইয়া গেল, আমি কি পাষাণ সুরেশবাবু?

সুরেশ তাহার সেই দৃষ্টি অচলার মুখের উপর হইতে নামাইল না বটে, কিন্তু অচলার দুই চক্ষু নত হইয়া পড়িল। সুরেশ ধীরে ধীরে বলিল, ব্যস্‌, এই আমার চিরজীবনের সম্বল রইল অচলা, এর বেশি আর চাইনে। বলিয়া এক মুহূর্ত স্থির থাকিয়া কহিল, তুমি যখন পাষাণ নও, তখন এই শেষ ভিক্ষে থেকে আর আমাকে কিছুতে বঞ্চিত করতে পারবে না। তোমার সুখের ভার যার ওপর ইচ্ছে থাকুক, কিন্তু তোমার হাত থেকে দুঃখই যখন শুধু পেয়ে এসেছি, তখন তোমারও দুঃখের বোঝা আজ থেকে আমার থাক—এই বর আজ মাগি—আমাকে তুমি ভিক্ষা দাও। বলিতে বলিতেই অশ্রুভারে তাহার কণ্ঠরোধ হইয়া গেল। অচলার চোখ দিয়াও তাহার বিগত দিবারাত্রির সমস্ত পুঞ্জীভূত বেদনা তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও এইবার গলিয়া ঝরঝর করিয়া পড়িতে লাগিল।

এমনি সময়ে ঠিক দ্বারের বাহিরেই জুতার শব্দ শোনা গেল এবং পরক্ষণেই মহিম ঘরে ঢুকিতে ঢুকিতে কহিল, কি হে সুরেশ, চা-টা খেলে?

সুরেশ সহসা জবাব দিতে পারিল না। সে কোনমতে মুখ নিচু করিয়া কোঁচার খুঁটে চোখ মুছিয়া ফেলিল, এবং অচলা আঁচলে মুখ ঢাকিয়া দ্রুতবেগে মহিমের পাশ দিয়া বাহির হইয়া গেল। মহিম চৌকাঠের ভিতর এক পা এবং বাহিরে এক পা দিয়া হতবুদ্ধির মত দাঁড়াইয়া রহিল।

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

আপনাকে সংবরণ করিয়া মহিম ঘরে ঢুকিয়া একখানা চৌকি টানিয়া লইয়া উপবেশন করিল।

মানব-চিত্ত যে অবস্থায় সর্বাপেক্ষা অসঙ্কোচে ও অবলীলাক্রমে মিথ্যা উদ্ভাবন করিতে পারে, সুরেশের তখন সেই অবস্থা। সে চট করিয়া হাত দিয়া চোখ মুছিয়া ফেলিল; সলজ্জ হাস্যে, উদারভাবে স্বীকার করিল যে, সে বাস্তবিকই ভারী দুর্বল হইয়া পড়িতেছে। কিন্তু মহিম সেজন্য কিছুমাত্র উদ্বেগ প্রকাশ করিল না, এমন কি তাহার হেতু পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করিল না।

সুরেশ তখন নিজেই নিজের কৈফিয়ত দিতে লাগিল। কহিল, যিনি যাই বলুন মহিম, এ আমি জোর করে বলতে পারি যে, এদের চোখে জল দেখলে কোথা থেকে যেন নিজেদের চোখেও জল এসে পড়ে—কিছুতে সামলানো যায় না। আমি না গিয়ে পড়লে কেদারবাবু ত এ যাত্রা কিছুতেই বাঁচতেন না, কিন্তু বুড়ো আচ্ছা বদমেজাজী লোক হে মহিম, একটিমাত্র মেয়ে, তবুও তাকে খবর দিতে দিলে না। বিয়ের দিন থেকে সেই যে ভদ্রলোক চটে আছে, সে চটা আর জোড়া লাগল না। বললুম, যা হবার, সে ত হয়েই গেছে—

মহিম জিজ্ঞাসা করিল, চা পেয়েছ ত হে?

সুরেশ ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হাঁ পেয়েছি। কিন্তু বাপের কাছে এ-রকম ব্যবহার পেলে কার চক্ষে না জল আসে বল? পুরুষমানুষই সব সময় সইতে পারে না, এ ত স্ত্রীলোক।

মহিম বলিল, তা বটে। রাত্রে তোমার শোবার কোন ব্যাঘাত হয়নি সুরেশ, বেশ ঘুমোতে পেরেছিলে? নতুন জায়গা—

সুরেশ তাড়াতাড়ি কহিল, না, নতুন জায়গায় আমার ঘুমের কোন ত্রুটি হয়নি—একপাশেই রাত কেটে গেছে। আচ্ছা মহিম, কেদারবাবু তাঁর অসুখের খবর তোমাদের একেবারেই দিলেন না, এ কি আশ্চর্য ব্যাপার ভেবে দেখ দেখি!

মহিম একান্ত সহজভাবে কহিল, আশ্চর্য বৈ কি! বলিয়াই একটুখানি হাসিয়া কহিল, হাতমুখ ধুয়ে একটু বেড়াতে বার হবে নাকি? যাও ত একটু চটপট সেরে নাও ভাই, আমাকে ঘণ্টা-খানেকের মধ্যেই বেরুতে হবে। এখনও আমার সকালের কাজকর্মই সারা হয়নি।

সুরেশ তাহার পুস্তকের প্রতি মনোনিবেশ করিয়া কহিল, গল্পটা বেশ লাগছে—এটা শেষ করে ফেলি।

তাই কর। আমি ঘণ্টা-দুইয়ের মধ্যেই ফিরে আসছি, বলিয়া মহিম উঠিয়া চলিয়া গেল।

সে পিছন ফিরিবামাত্রই সুরেশ চোখ তুলিয়া চাহিল। মনে হইল, কোন্‌ অদৃশ্য হস্ত এক মুহূর্তের মধ্যে আগাগোড়া মুখখানার উপরে যেন এক পোঁচ লজ্জার কালি মাখাইয়া দিয়াছে।

যে দ্বার দিয়া মহিম বাহির হইয়া গেল, সেই খোলা দরজার প্রতি নির্নিমেষ চাহিয়া সুরেশ কাঠের মত শক্ত হইয়া বসিয়া রহিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাহার অযাচিত জবাবদিহির সমস্ত নিষ্ফলতা ক্রুদ্ধ অভিমানে তাহার সর্বাঙ্গে হূল ফুটাইয়া দংশন করিতে লাগিল।

দুই বন্ধুর কথোপকথন দ্বারের অন্তরালে দাঁড়াইয়া অচলা কান পাতিয়া শুনিতেছিল। মহিম কাপড় ছাড়িবার জন্য নিজের ঘরে ঢুকিবার অব্যবহিত পরেই সে কবাট ঠেলিয়া প্রবেশ করিল।
মহিম মুখ তুলিয়া চাহিতেই অচলা স্বাভাবিক মুক্তকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, আমার বাবা কি তোমার কাছে এমন কিছু গুরুতর অপরাধ করেছেন?

অকস্মাৎ এরূপ প্রশ্নের তাৎপর্য বুঝিতে না পারিয়া মহিম জিজ্ঞাসুমুখে নীরব রহিল।

অচলা পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, আমার কথাটা বুঝি বুঝতে পারলে না?

মহিম কহিল, না, কথাগুলো প্রিয় না হলেও স্পষ্ট বটে; কিন্তু তার অর্থ বোঝা কঠিন। অন্ততঃ আমার পক্ষে বটে।

অচলা অন্তরের ক্রোধ যথাশক্তি দমন করিয়া জবাব দিল, এ-দুটোর কোনটাই তোমার কাছে কঠিন নয়, কিন্তু কঠিন হচ্ছে স্বীকার করা। সুরেশবাবুকে যে কথা তুমি স্বচ্ছন্দে জানিয়ে এলে, সেই কথাটাই আমাকে জানাবার বোধ করি তোমার সাহস হচ্ছে না। কিন্তু আজ আমি তোমাকে স্পষ্ট করেই জিজ্ঞাসা করতে চাই, আমার বাবা কি তোমার কাছে এত তুচ্ছ হয়ে গেছেন যে, তাঁর সাংঘাতিক অসুখের খবরটাতে তুমি কান দেওয়া আবশ্যক মনে কর না?

মহিম ঘাড় নাড়িয়া বলিল, খুবই করি। কিন্তু যেখানে সে আবশ্যক নেই, সেখানে আমাকে কি করতে বল?

অচলা কহিল, কোন্‌খানে আবশ্যক নেই শুনি?

মহিম ক্ষণকাল স্ত্রীর মুখের প্রতি নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া কঠোরকণ্ঠে বলিয়া ফেলিল, যেমন এইমাত্র সুরেশের ছিল না। আর যেমন এ নিয়ে তোমারও এতখানি রাগারাগি করে আমার মুখ থেকে কড়া টেনে বার করবার প্রয়োজন ছিল না। যাক, আর না। যার তলায় পাঁক আছে, তার জল ঘুলিয়ে তোলা আমি বুদ্ধির কাজ মনে করিনে। বলিয়া মহিম বাহির হইয়া যাইতেছিল, অচলা দ্রুতপদে সম্মুখে আসিয়া পথ আটকাইয়া দাঁড়াইল। ক্ষণকাল পরে সে দাঁত দিয়া সজোরে অধর চাপিয়া রহিল, ঠিক যেন একটা আকস্মিক দুঃসহ আঘাতের মর্মান্তিক চিৎকার সে প্রাণপণে রুদ্ধ করিতেছে মনে হইল। তারপরে কহিল, তোমার বাইরে কি বিশেষ জরুরি কোন কাজ আছে? দু’ মিনিট অপেক্ষা করতে পারবে না?

মহিম কহিল, তা পারব।

অচলা কহিল, তা হলে কথাটা স্পষ্ট হয়েই যাক। জল যখন সরে আসে, তখনই পাঁকের খবর পাওয়া যায়, এই না?

মহিম ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হাঁ।

অচলা বলিল, নিরর্থক জল ঘুলিয়ে তোলার আমিও পক্ষপাতী নই, কিন্তু সেই ভয়ে পঙ্কোদ্বারটাও বন্ধ রাখা কি ভাল? একদিন যদি ঘোলায় ত ঘোলাক না, যদি বরাবরের জন্যে পাঁকের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যায়! কি বল?

মহিম কঠিনভাবে কহিল, আমার আপত্তি নেই, কিন্তু তার চেয়ে ঢের বেশি দরকারী কাজ আমার পড়ে রয়েছে—এখন সময় হবে না।

অচলা ঠিক তেমনি কঠিনকণ্ঠে জবাব দিল, তোমার এই ঢের বেশি দরকারী কাজ সারা হয়ে গেলে ফুরসত হবে ত? ভাল, ততক্ষণ আমি না হয় অপেক্ষা করেই রইলুম। বলিয়া পথ ছাড়িয়া সরিয়া দাঁড়াইল।

মহিম ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। যতক্ষণ তাহাকে দেখা গেল, ততক্ষণ পর্যন্ত সে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পরে কবাট বন্ধ করিয়া দিল।

ঘণ্টা-খানেক পরে যখন সে স্নান করিবার প্রসঙ্গ লইয়া বাহিরে সুরেশের ঘরে আসিয়া দাঁড়াইল, তাহার তখন মুখের শ্রান্ত শোকাচ্ছন্ন চেহারা সুরেশ চোখ তুলিবামাত্র অনুভব করিল। মহিমের সঙ্গে ইতিমধ্যে নিশ্চয় কিছু একটা ঘটিয়া গিয়াছে, ইহা অনুমান করিয়া সুরেশ মনে মনে অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল, কিন্তু সাহস করিয়া প্রশ্ন করিতে পারিল না।
অচলা চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ও কি হচ্ছে?

সুরেশ ব্যাগের মধ্যে তাহার কল্যকার ব্যবহৃত জামা-কাপড়গুলি গুছাইয়া তুলিতেছিল, কহিল, একটার মধ্যেই ত ট্রেন, একটু আগেই ঠিক করে নিচ্চি।

অচলা একটুখানি আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল, আপনি কি আজই যাবেন নাকি?

সুরেশ মুখ না তুলিয়াই কহিল, হাঁ।

অচলা কহিল, কেন বলুন ত?

সুরেশ তেমনি অধোমুখে থাকিয়াই বলিল, আর থেকে কি হবে? তোমাদের একবার দেখতে এসেছিলুম, দেখে গেলুম।

অচলা ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া বলিল, তবে উঠে আসুন। এ-সব কাজ আপনাদের নয়, মেয়েমানুষের; আমি গুছিয়ে সমস্ত ঠিক করে দিচ্ছি। বলিয়া অগ্রসর হইয়া আসিতেই সুরেশ ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, না না, তোমাকে কিছু করতে হবে না—এ কিছুই নয়—এ অতি—

কিন্তু তাহার মুখের কথা শেষ না হইতেই অচলা ব্যাগটা তাহার সুমুখ হইতে টানিয়া লইয়া সমস্ত জিনিসপত্র উপুড় করিয়া ফেলিয়া ভাঁজ করা কাপড় আর একবার ভাঁজ করিয়া ধীরে ধীরে ব্যাগের মধ্যে তুলিতে লাগিল। সুরেশ অদূরে দাঁড়াইয়া অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া বারংবার বলিতে লাগিল, এর কিছুই আবশ্যক ছিল না—সে যদি—আমি নিজেই—ইত্যাদি ইত্যাদি।

অচলা অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোন কথারই প্রত্যুত্তর করিল না, ধীরে ধীরে কাজ করিতে করিতে কহিল, আপনার ভগিনী কিংবা স্ত্রী থাকলে তাঁরাই করতেন, আপনাকে করতে দিতেন না; কিন্তু আপনার ভয় যদি বন্ধুটি ফিরে এসে দেখতে পান—এই না? কিন্তু তাতেই বা কি, এ ত মেয়েমানুষেরই কাজ।

সুরেশ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এইমাত্র মহিমের সহিত তাহার যাহা হইয়া গিয়াছে, অচলা তাহা নিশ্চয়ই জানে না। তাই কথাটা পাড়িয়া তাহাকে ক্ষুণ্ণ করিতেও তাহার সাহস হইল না, অথচ ভয় করিতেও লাগিল, পাছে সে আসিয়া পড়িয়া আবার স্বচক্ষে ইহা দেখিয়া ফেলে।

ব্যাগটি পরিপাটি করিয়া সাজাইয়া দিয়া অচলা আস্তে আস্তে বলিল, বাবার অসুখের কথা না তুললেই ছিল ভাল। এতে তাঁর অপমানই শুধু সার হল—উনি ত গ্রাহ্যই করলেন না।

সুরেশ চকিত হইয়া কহিল, কি বললে তোমাকে মহিম?

অচলা তাহার ঠিক জবাব না দিয়া পাশের দরজাটা চোখ দিয়া দেখাইয়া কহিল, ঐখানে দাঁড়িয়ে আমি নিজেই সমস্ত শুনেচি।

সুরেশ অপ্রতিভ হইয়া কহিল, সেজন্যে আমি তোমার কাছে মাপ চাচ্চি অচলা।

অচলা মুখ তুলিয়া হাসিয়া কহিল, কেন?

সুরেশ অনুতপ্ত-কণ্ঠে কহিল, কারণ ত তুমি নিজেই বললে। আমার নিজের দোষে তাঁকে তোমাকে দুজনকে আজ আমি অপমান করেছি; সেইজন্যেই তোমার কাছে বিশেষ করে ক্ষমা প্রার্থনা করচি অচলা!
অচলা মুখ তুলিয়া চাহিল। সহসা তাহার সমস্ত চোখমুখ যেন ভিতরের আবেগে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল; কহিল, যাই কেননা আপনি করে থাকেন সুরেশবাবু, সে ত আমার জন্যেই করেছেন? আমাকে লজ্জার হাত থেকে অব্যাহতি দেবার জন্যই ত আজ আপনার এই লজ্জা। তবুও আমার কাছে আপনাকে মাপ চাইতে হবে, এত বড় অমানুষ আমি নই। কিসের জন্যে আপনি লজ্জিত হচ্ছেন? যা করেছেন, বেশ করেছেন।

সুরেশের বিস্মিত হতবুদ্ধিপ্রায় মুখের পানে চাহিয়া অচলা বুঝিল, সে তাহার কথাটা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে নাই। তাই একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া কহিল, আজই আপনি যাবেন না, সুরেশবাবু! এখানে লজ্জা যদি কিছু পেয়ে থাকেন সে ত আমারই লজ্জা ঢাকবার জন্যে; নইলে নিজের জন্যে আপনার ত কোন দরকারই ছিল না! আর বাড়ি আপনার বন্ধুর একার নয়, এর ওপর আমারও ত কিছু অধিকার আছে। সেই জোরে আজ আমি নিমন্ত্রণ করচি, আমার অতিথি হয়ে অন্ততঃ আর কিছুদিন থাকুন।

তাহার সাহস দেখিয়া সুরেশ অভিভূত হইয়া গেল। কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত-হৃদয়ে কি একটা বলিবার উপক্রম করিতেই দেখিতে পাইল, মহিম তাহার বাহিরের কাজ সারিয়া বাড়ি ঢুকিতেছে। অচলা তখন পর্যন্ত ব্যাগটা সম্মুখে লইয়া মেঝের উপর বসিয়া এই দিকে পিছন ফিরিয়া ছিল; পাছে মহিমের আগমন জানিতে না পারিয়া আরও কিছু বলিয়া ফেলে, এই ভয়ে যে একেবারে সঙ্কুচিত হইয়া বলিয়া উঠিল, এই যে মহিম, কাজ সারা হল তোমার?

হাঁ হল, বলিয়া মহিম ঘরে পা দিয়াই অচলাকে তদবস্থায় নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ও কি হচ্ছে?

অচলা ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, কিন্তু সে প্রশ্নের জবাব না দিয়া সুরেশকেই লক্ষ্য করিয়া পূর্ব-প্রসঙ্গের সূত্র ধরিয়া কহিল, আপনি আমারও ত বন্ধু—শুধু বন্ধুই বা কেন, আমাদের যা করছেন, তাতে আপনি আমার পরমাত্মীয়। এমন করে চলে গেলে আমার লজ্জার, ক্ষোভের সীমা থাকবে না। আজ আপনাকে ত আমি কোনমতেই ছেড়ে দিতে পারব না।

সুরেশ শুষ্ক হাসিয়া কহিল, শোন কথা মহিম! তোমাদের দেখতে এসেছিলুম, দেখে গেলুম বাস্‌! কিন্তু এ জঙ্গলের মধ্যে আমাকে অনর্থক বেশিদিন ধরে রেখে তোমাদেরই বা লাভ কি, আর আমারই বা সহ্য করে ফল কি বল?

মহিম ধীরভাবে জবাব দিল, বোধ করি রাগ করে চলে যাচ্ছিলে; কিন্তু সেটা উনি পছন্দ করেন না। অচলা তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিল, তুমি পছন্দ কর নাকি?

মহিম জবাব দিল, আমার কথা ত হচ্ছে না।

সুরেশ মনে মনে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল। তার এই অপ্রিয় আলোচনা কোনমতে থামাইয়া দিবার জন্য প্রফুল্লতার ভান করিয়া সহাস্যে কহিল, এ কি মিথ্যে অপবাদ দেওয়া! রাগ করব কেন হে, আচ্ছা লোক ত তোমরা! বেশ, খুশিই যদি হও, আরও দু-একদিন না হয় থেকেই যাবো। বৌঠান, কাপড়গুলো আর তুলে কাজ নেই, বের করেই ফেলো। মহিম, চল হে, তোমাদের পুকুর থেকে আজ স্নান করেই আসা যাক; তার পরে বাড়ি গিয়ে না হয় একশিশি কুইনিনই গেলা যাবে।

চল, বলিয়া মহিম জামা-কাপড় ছাড়িবার জন্য ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

যাহারা নূতন জুতার সুতীক্ষ্ণ কামড় গোপনে সহ্য করিয়া বাহিরে স্বচ্ছন্দতার ভান করে, ঠিক তাহাদের মতই সুরেশ সমস্ত দিনটা হাসিখুশিতে কাটাইয়া দিল; কিন্তু আর একজন, যাহাকে আরও গোপনে এই দংশনের অংশ গ্রহণ করিতে হইল, সে পারিল না।

স্বামীর অবিচলিত গাম্ভীর্যের কাছে এই কদাকার ভাঁড়ামিতে, এত বেহায়াপনায় তাহার ক্ষোভে অপমানে মাথা খুঁড়িয়া মরিতে ইচ্ছা করিতে লাগিল। তাঁহাকে সে আজও হৃদয়ের দিক হইতে চিনিতে না পারিলেও বুদ্ধির দিক হইতে চিনিয়াছিল। সে স্পষ্ট দেখিতে লাগিল, এই তীক্ষ্ণ-ধীমান অল্পভাষী লোকটির কাছে এ অভিনয় একেবারেই ব্যর্থ হইয়া যাইতেছে, অথচ লজ্জার কালিমা প্রতি মুহূর্তেই যেন তাহারি মুখের উপর গাঢ়তর হইয়া উঠিতেছে। আজ সকালবেলার পরে মহিম আর বাটীর বাহির হয় নাই; সুতরাং দিনের বেলায় ভাত খাওয়া হইতে শুরু করিয়া রাত্রির লুচি খাওয়া পর্যন্ত প্রায় সমস্ত সময়টাই এইভাবে কাটিয়া গেল।

অনেক রাত্রি পর্যন্ত বিছানার উপর ছটফট করিয়া অচলা ধীরে ধীরে কহিল, সারারাত্রি আলো জ্বেলে পড়লে আর একজন ঘুমোতে পারে না। তোমার কাছে এটুকু দয়াও কি আর আমি প্রত্যাশা করতে পারিনে?

তাহার কণ্ঠস্বরে মহিম চমকিয়া উঠিয়া এবং তাড়াতাড়ি বাতিটা নামাইয়া দিয়া কহিল, অন্যায় হয়ে গেছে, আমাকে মাপ করো। বলিয়া বই বন্ধ করিয়া আলো নিবাইয়া দিয়া শয্যায় আসিয়া শুইয়া পড়িল। এই প্রার্থিত অনুগ্রহলাভের জন্য অচলা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিল না, কিন্তু ইহা তাহার নিদ্রার পক্ষেও লেশমাত্র সাহায্য করিল না। বরঞ্চ যত সময় কাটিতে লাগিল, এই নিঃশব্দ অন্ধকার যেন ব্যথায় ভারী হইয়া প্রতি মুহূর্তেই তাহার কাছে দুঃসহ হইয়া উঠিতে লাগিল। আর সহিতে না পারিয়া এক সময়ে সে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, জ্ঞানে হোক, অজ্ঞানে হোক, সংসারে ভুল করলেই তার শাস্তি পেতে হয়, এ কথা কি সত্যি?

মহিম অত্যন্ত সহজভাবে জবাব দিল, অভিজ্ঞ লোকেরা তাই ত বলেন।

অচলা পুনরায় কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া কহিল, তবে যে ভুল আমরা দু’জনেই করেছি, যার কুফল গোড়া থেকেই শুরু হয়েচে, তার শেষ ফলটা কি-রকম দাঁড়াবে, তুমি আন্দাজ করতে পারো?

মহিম কহিল, না।

অচলা কহিল, আমিও পারিনে। কিন্তু ভেবে ভেবে আমি এটুকু বুঝেছি যে, আর সমস্ত ছেড়ে দিলেও শুধু পুরুষমানুষ বলেই এই শাস্তির বেশি ভার পুরুষের বহা উচিত।

মহিম বলিল, আরও একটু ভাবলে দেখিতে পাবে, মেয়েমানুষের বোঝা তাতে এক তিল কম পড়ে না। কিন্তু পুরুষটি কে? আমি, না সুরেশ?

অচলা যে শিহরিয়া উঠিল, অন্ধকারের মধ্যেও মহিম তাহা অনুভব করিল।

ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া অচলা ধীরে ধীরে কহিল, তুমি যে একদিন আমাকে মুখের ওপরেই অপমান করতে শুরু করবে, এ আমি ভেবেছিলুম। আর এও জানি, এ জিনিস একবার আরম্ভ হলে কোথায় যে শেষ হয়, তা কেউ বলতে পারে না; কিন্তু আমি ঝগড়া করতেও পারব না, কিংবা বিয়ে হয়েচে বলেই ঝগড়া করে তোমার ঘর করতেও পারব না। কাল হোক, পরশু হোক, আমি বাবার ওখানে ফিরে যাবো।
মহিম কহিল, তোমার বাবা কিন্তু আশ্চর্য হবেন।

অচলা বলিল, না। তিনি জানতেন বলেই আমাকে বারংবার সাবধান করবার চেষ্টা করেছিলেন যে, এর ফল কোনদিন ভাল হবে না। কলকাতায় চলে, কিন্তু পল্লীগ্রামে সমাজ, আত্মীয়, বন্ধু সকলকে ত্যাগ করে শুধু স্ত্রী নিয়ে কারও বেশি দিন চলে না। সুতরাং তিনি আর যাই হোন, আশ্চর্য হবেন না।

মহিম কহিল, তবে তাঁর নিষেধ শোনোনি কেন?

অচলা প্রাণপণ-বলে একটা উচ্ছ্বসিত শ্বাস দমন করিয়া লইয়া কহিল, আমি ভাবতুম, তুমি কিছুই না বুঝে কর না।

সে ধারণা ভেঙ্গে গেছে?

হাঁ।

তাই ভাগের কারবারে সুবিধে হলো না টের পেয়ে দোকান তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে চাচ্ছো?

হাঁ।

মহিম কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, তা হলে যেয়ো। কিন্তু একে ব্যবসা বলেই যদি বুঝতে শিখে থাকো, আমার সঙ্গে তোমার মতের মিল হবে না, কিন্তু এ কথাটাও ভুলো না যে, ব্যবসা জিনিসটাকেও বুঝতে সময় লাগে। সে ভুল যদি কখনো ধরা পড়ে আমাকে জানিয়ো, আমি তখনি গিয়ে নিয়ে আসব।

অচলার চোখ দিয়া এক ফোঁটা জল গড়াইয়া পড়িল; হাত দিয়া তাহা সে মুছিয়া ফেলিয়া কয়েক মুহূর্ত স্থির থাকিয়া কণ্ঠস্বরকে সংযত করিয়া বলিল, ভুল মানুষের বাব বার হয় না। তোমার সে কষ্ট স্বীকার করবার দরকার হবে, মনে করিনে।

মহিম কহিল, মনে করা যায় না বলেই তাকে ভবিষ্যৎ বলা হয়। সেই ভবিষ্যতের ভাবনা ভবিষ্যতের জন্যে রেখে আজ আমাকে মাপ কর, আমি আর বকতে পারচি নে।

অচলা আঘাত পাইয়া বলিল, আমাকে কি তুমি তামাশা করচ? তা যদি হয়, তোমার ভুল হচ্ছে। আমি সত্যই কাল-পরশু চলে যেতে চাই।

মহিম কহিল, আমি সত্যিই তোমাকে যেতে দিতে চাইনে।

অচলা হঠাৎ অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে রাখবে? সে তুমি কিছুতেই পারো না, জানো?

মহিম শান্ত সহজভাবে জবাব দিল, বেশ ত, সেও ত আজই রাত্রে নয়। কাল-পরশু যখন যাবে, তখন বিবেচনা করে দেখলেই হবে। ঢের সময় আছে, আজ এই পর্যন্ত থাক। বলিয়া সে মাথার বালিশটা উলটাইয়া লইয়া সমস্ত প্রসঙ্গ জোর করিয়া বন্ধ করিয়া দিয়া, নিশ্চিন্তভাবে শয়ন করিল এবং বোধ করি বা পরক্ষণেই ঘুমাইয়া পড়িল।

পরদিন সকালে চা খাইতে বসিয়া সুরেশ জিজ্ঞাসা করিল, মহিম ত মাঠের চাষবাস দেখতে আজও ভোরে বেরিয়ে গেছে বোধ হয়?

অচলা ঘাড় নাড়িয়া কহিল, পৃথিবী ওলট-পালট হয়ে গেলেও তার অন্যথা হবার জো নেই।

সুরেশ চায়ের বাটিটা মুখ হইতে নামাইয়া রাখিয়া বলিল, এক হিসেবে সে আমাদের চেয়ে ঢের ভাল। তার কাজের একটা গতি আছে, যা কলের চাকার মত যতক্ষণ দম আছে, ততক্ষণ চলবেই।

অচলা কহিল, কলের মত হওয়াটাই কি আপনি ভাল বলেন?

সুরেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, তা বলি, কেননা, এ ক্ষমতা আমার নিজের সাধ্যাতীত। দুর্বল হওয়ার যে কত দোষ, সে ত আমি জানি; তাই যে স্থিরচিত্ত, তাকে আমি প্রশংসা না করে পারিনে। কিন্তু আজ আমাকে ছুটি দাও, আমি বাড়ি যাই।
অচলা তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া বলিল, যান। আমি কাল যাচ্চি।

সুরেশ আশ্চর্য হইয়া কহিল, তুমি কোথায় যাবে কাল?

কলকাতায়।

হঠাৎ কলকাতায় কেন? কৈ, কাল এ মতলব ত শুনিনি?

বাবার অসুখ, তাই তাঁকে একবার দেখতে যাবো।

সুরেশের মুখের উপর উদ্বেগের ছায়া পড়িল, কহিল, অসুস্থ বাপকে হঠাৎ দেখবার ইচ্ছে হওয়া কিছু সংসারে আশ্চর্য ঘটনা নয়; কিন্তু ভয় হয়, পাছে বা আমার জন্যেই একটা রাগারাগি করে—

অচলা তাহার কোন জবাব দিল না। যদু সুমুখ দিয়া যাইতেছিল, সুরেশ ডাকিয়া কহিল, তোর বাবু মাঠ থেকে ফিরেছেন রে?

যদু কহিল, তিনি ত আজ সকালে বার হননি! তাঁর পড়বার ঘরে ঘুমোচ্চেন।

অচলা তাড়াতাড়ি গিয়া দ্বারের বাহির হইতে উঁকি মারিয়া দেখিল, মহিম একটা চেয়ারের উপর হেলান দিয়া বসিয়া দুই পা টেবিলের উপরে তুলিয়া দিয়া ঘুমাইতেছে। একটা লোক রাত্রের অতৃপ্ত নিদ্রা এইভাবে পোষাইয়া লইতেছে, সংসারে ইহা একান্ত অদ্ভুত নহে, কিন্তু অচলার বাস্তুবিকই বিস্ময়ের অবধি রহিল না, যখন সে স্বচক্ষে দেখিল, তাহার স্বামী দিনের কর্ম বন্ধ রাখিয়া এই অসময়ে ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। সে পা টিপিয়া ঘরে ঢুকিয়া চুপ করিয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিল। সম্মুখের খোলা জানালা দিয়া প্রভাতের অপর্যাপ্ত আলোক সেই নিদ্রামগ্ন মুখের উপর পড়িয়াছিল। আজ অকস্মাৎ এতদিন পরে তাহার চোখের উপর এমন একটা নতুন জিনিস পড়িল যাহা ইতিপূর্বে কোনদিন সে দেখে নাই। আজ দেখিল, শান্ত মুখের উপর যেন একখানা অশান্তির সূক্ষ্ম জাল পড়িয়া আছে; কপালের উপর যে কয়েকটা রেখা পড়িয়াছে, এক বৎসর পূর্বেও সেখানে সে-সকল দাগ ছিল না। সমস্ত মুখের চেহারাটাই আজ যেন তাহার মনে হইল, কিসের গোপন ব্যথায় শ্রান্ত, পীড়িত। সে নিঃশব্দে আসিয়াছিল, নিঃশব্দেই চলিয়া যাইতে চাহিয়াছিল; কিন্তু পিকদানিটা পায়ে ঠেকিয়া যেটুকু শব্দ হইল, তাহাতেই মহিম চোখ মেলিয়া চাহিল, অচলা অপ্রস্তুত হইয়া কহিল, এখন ঘুমাচ্চো যে? অসুখ করেনি ত?

মহিম চোখ রগড়াইয়া উঠিয়া বসিয়া বলিল, কি জানি, অসুখ না হওয়াই ত আশ্চর্য!

অচলা আর দ্বিতীয় প্রশ্ন না করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

খাওয়া-দাওয়ার পরেই সুরেশ যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হইতেছিল, মহিম অদূরে একখানা চৌকির উপর বসিয়া তাহার সহিত কথাবার্তা কহিতেছিল; অচলা দ্বারের নিকট আসিয়া বিনা ভূমিকায় বলিয়া উঠিল, কাল আমিও যাচ্ছি। সুবিধে হলে বাবার সঙ্গে একবার দেখা করবেন।

সুরেশ বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিল, তাই নাকি? বলিয়াই মহিমের মুখের প্রতি চোখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বৌঠানকে তুমি কাল কলকাতা পাঠাচ্চ নাকি মহিম?

স্ত্রীর এই গায়ে-পড়া বিরুদ্ধতায় মহিমের ভিতরটা যেন জ্বলিয়া উঠিল; কিন্তু সে মুখের ভাব প্রসন্ন রাখিয়াই মৃদু হাসিয়া বলিল, আর কোন বাধা ছিল না, কিন্তু আমাদের এই পল্লীগ্রামের গৃহস্থঘরে নাটক তৈরি করার রীতি নেই। কালই বা কেন, আজই ত তোমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিতে পারতুম।
সুরেশের মুখ লজ্জায় আরক্ত হইয়া উঠিল; অচলা চক্ষের পলকে তাহা লক্ষ্য করিয়া জোর করিয়া হাসিয়া বলিল, সুরেশবাবু, আমাদের শহরে বাড়ি বলে লজ্জিত হবার কারণ নেই। অসুস্থ বাপ-মাকে দেখতে যাওয়া যদি পাড়াগাঁয়ের রীতি না হয়, আমি ত বলি আমাদের শহরের নাটকই ঢের ভাল। আপনি না হয় আজকের দিনটেও থেকে যান না, কাল একসঙ্গেই যাবো।

তাহার অপরিসীম ঔদ্ধত্যে সুরেশের মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। সে মাথা হেঁট করিয়া বলিতে লাগিল, না না, আমার আর থাকবার জো নেই বৌঠান! তোমার ইচ্ছে হলে কাল যেয়ো, কিন্তু আমি আজই চললুম। বলিতে বলিতেই সে তীব্র উত্তেজনায় হঠাৎ ব্যাগটা হাতে করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

তাহার উত্তেজনার আবেগ অচলাকেও একবার যেন মূল হইতে নাড়িয়া দিল। সে অকস্মাৎ ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, এখনও ট্রেনের অনেক দেরি সুরেশবাবু, এরি মধ্যে যাবেন না—একটু দাঁড়ান। আমার দুটো কথা দয়া করে শুনে যান। তাহার আর্ত কণ্ঠস্বরের আকুল অনুরোধে উভয় শ্রোতাই যুগপৎ চমকিয়া উঠিল।

অচলা কোনদিকে লক্ষ্য না করিয়া বলিতে লাগিল, তোমার আমি কোন কাজেই লাগলুম না সুরেশবাবু, কিন্তু তুমি ছাড়া আর আমাদের অসময়ের বন্ধু কেউ নেই। তুমি বাবাকে গিয়ে বলো, এরা আমাকে বন্ধ করে রেখেছে, কোথাও যেতে দেবে না—আমি এখানে মরে যাবো। সুরেশবাবু, আমাকে তোমরা নিয়ে যাও—যাকে ভালবাসি নে, তার ঘর করবার জন্যে আমাকে তোমরা ফেলে রেখে দিয়ো না।

মহিম বিহ্বলের ন্যায় নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল।

সুরেশ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া দুই চক্ষু দৃপ্ত করিয়া উচ্চকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, তুমি জানো মহিম, উনি ব্রাহ্মমহিলা। নামে স্ত্রী হলেও ওঁর ওপর পাশবিক বলপ্রয়োগের তোমার অধিকার নেই।

মহিম মুহূর্তকালের জন্যই অভিভূত হইয়া গিয়াছিল। সে আত্মসংবরণ করিয়া শান্তস্বরে স্ত্রীকে কহিল, তুমি কিসের জন্যে কি করচ, একবার ভেবে দেখ দিকি অচলা। সুরেশকে কহিল, পশু-বল, মানুষ-বল, কোন জোরই আমি কারও উপর কোন দিন খাটাই নে। বেশ ত সুরেশ, তুমি যদি থাকতে পার, আজকের দিনটা থেকে ওঁকে সঙ্গে করেই নিয়ে যাও না। আমি নিজে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসব—তাতে গ্রামের মধ্যে বিশেষ দৃষ্টিকটুও হবে না। একটুখানি থামিয়া বলিল, একটু কাজ আছে, এখন চললুম। সুরেশ, যাওয়া যখন হলই না, তখন কাপড়-চোপড় ছেড়ে ফেল। আমি ঘণ্টা-খানেকের মধ্যে ফিরে আসচি। বলিয়া ধীরে ধীরে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

অচলা মূর্তির মত চৌকাঠ ধরিয়া যেমন দাঁড়াইয়াছিল, তেমনই দাঁড়াইয়া রহিল। সুরেশ মিনিট-খানেক হেঁটমুখে থাকিয়া হঠাৎ অট্টহাসি হাসিয়া বলিল, বাঃ রে, বাঃ। বেশ একটি অঙ্ক অভিনয় করা গেল! তুমিও মন্দ করনি, আমি ত চমৎকার! ওর বাড়িতে ওর স্ত্রী নিয়ে ওকেই চোখ রাঙ্গিয়ে দিলুম। আর চাই কি? আর বন্ধু আমার মিষ্টিমুখে একটু হেসে ঠিক যেন বাহবা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি বাজি রেখে বলতে পারি অচলা, ও আড়ালে শুধু গলা ছেড়ে হোহো করে হাসবার জন্যেই কাজের ছুতো করে বেরিয়ে গেল। যাক, আরশিখানা একবার আন ত বৌঠান, দেখি নিজের মুখের চেহারা কি-রকম দেখাচ্চে! বলিয়া চাহিয়া দেখিল, অচলার মুখখানা একেবারে সাদা হইয়া গিয়াছে। সে কোন জবাব দিল না, শুধু দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

যে শয্যা স্পর্শ করিতেও আজ অচলার ঘৃণা বোধ হওয়া উচিত ছিল, তাহাই যখন সে যথানিয়মে প্রস্তুত করিতে অপরাহ্নবেলায় ঘরে প্রবেশ করিল, তখন সমস্ত মনটা যে তাহার কোথায় এবং কি অবস্থায় ছিল—মানব-চিত্ত সম্বন্ধে যাঁহার কিছুমাত্র অভিজ্ঞতা আছে তাঁহারই অগোচর রহিবে না।

যন্ত্র-চালিতের মত অভ্যস্ত কর্ম সমাপন করিয়া ফিরিবার মুখে পাশের ছোট টেবিলটির প্রতি অকস্মাৎ তার চোখ পড়িয়া গেল; এবং ব্লটিং প্যাডখানির উপর প্রসারিত একখানি ছোট্ট চিঠি সে চক্ষের নিমিষে পড়িয়া ফেলিল। মাত্র একটি ছত্র। বার, তারিখ নাই, মৃণাল লিখিয়াছে—সেজদামশাই গো, করছ কি? পরশু থেকে তোমার পথ চেয়ে চেয়ে তোমার মৃণালের চোখ-দুটি ক্ষয়ে গেল যে!

বহুক্ষণ অবধি অচলার চোখের পাতা নড়িল না। ঠিক পাথরে-গড়া মূর্তির পলকবিহীন দৃষ্টি সেই একটি ছত্রের উপর পাতিয়া সে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এ চিঠি কবেকার, কখন, কে আনিয়া দিয়া গেছে—সে কিছুই জানে না। মৃণালের বাটী কোন্‌ দিকে, কোন্‌ মুখে তাহার বাড়ি ঢুকিতে হয়, কোন্‌ পথটার উপর, কিজন্য সে এমন করিয়া তাহার ব্যগ্র উৎসুক দৃষ্টি পাতিয়া রাখিয়াছে, তাহার কিছুই জানিবার জো নাই। সম্মুখের এই ক’টি কালির দাগ শুধু এই খবরটুকু দিতেছে যে, কোন্‌ এক পরশু হইতে একজন আর একজনের প্রতীক্ষায় পথ চাহিয়া চোখ নষ্ট করিবার উপক্রম করিয়াছে, কিন্তু দেখা মিলে নাই।

এদিকে সেই প্রায়ান্ধকার ঘরের মধ্যে একদৃষ্টে চাহিয়া চাহিয়া, তাহার নিজের চোখ-দুটি বেদনায় পীড়িত এবং কালো কালো অক্ষরগুলা প্রথমে ঝাপসা এবং পরে যেন ছোট পোকার মত সমস্ত কাগজময় নড়িয়া বেড়াইতে লাগিল। তবুও এমনি একভাবে দাঁড়াইয়া হয়ত সে আর কতক্ষণ চাহিয়া থাকিত; কিন্তু নিজের অজ্ঞাতসারে এতক্ষণ ধরিয়া তাহার ভিতরে ভিতরে যে নিশ্বাসটা উত্তরোত্তর জমা হইয়া উঠিতেছিল, তাহাই যখন অবরুদ্ধ স্রোতের বাঁধ ভাঙ্গার ন্যায় অকস্মাৎ সশব্দে গর্জিয়া বাহির হইয়া আসিল, তখন সেই শব্দে সে চমকিয়া সম্বিৎ ফিরিয়া পাইল। দ্বারের বাহিরে মুখ তুলিয়া দেখিল, সন্ধ্যায় আঁধার প্রাঙ্গণতলে নামিয়া আসিয়াছে এবং যদু চাকর হ্যারিকেন লণ্ঠন জ্বালাইয়া বাহিরের ঘরে দিতে চলিয়াছে। ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাবু ফিরে এসেছেন, যদু?

যদু কহিল, না মা, কৈ এখনও ত তিনি ফেরেন নি।

এতক্ষণে অচলার মনে পড়িল, দুপুরবেলার সেই লজ্জাকর অভিনয়ের একটা অঙ্ক শেষ হইলে, সেই যে তিনি বাহির হইয়া গিয়াছেন, এখনও ফিরেন নাই। স্বামীর প্রাত্যহিক গতিবিধি সম্বন্ধে আজ তাহার তিলমাত্র সংশয় রহিল না। সুরেশের আসা পর্যন্ত এমনই একটা উৎকট ও অবিচ্ছিন্ন কলহের ধারা এ বাটীতে প্রবাহিত হইয়াছিল যে তাহারই সহিত মাতামাতি করিয়া অচলা আর সব ভুলিয়াছিল। সে স্বামীকে ভালবাসে না, অথচ ভুল করিয়া বিবাহ করিয়াছে, সারাজীবন সেই ভুলেরই দাসত্ব করার বিরুদ্ধে তাহার অশান্ত চিত্ত বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া অহর্নিশি লড়াই করিতেছিল। মৃণালের কথাটা সে একপ্রকার বিস্মৃত হইয়াই গিয়াছিল, কিন্তু আজ সন্ধ্যার অন্ধকারে সে মৃণালের একটিমাত্র ছত্র তাহার সমস্ত পুরাতন দাহ লইয়া যখন উল্টা-স্রোতে ফিরিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন একমুহূর্তে প্রমাণ হইয়া গেল, তাহার সেই ভুল-করা স্বামীরই অন্য নারীতে আসক্তির সংশয় হৃদয় দগ্ধ করিতে সংসারে কোন চিন্তার চেয়েই খাটো নয়।
লেখাটুকু সে আর একবার পড়িবার জন্য চোখের কাছে তুলিয়া ধরিতে হাত বাড়াইল, কিন্তু নিবিড় ঘৃণায় হাতখানা তাহার আপনি ফিরিয়া আসিল। সে চিঠি সেইখানেই তেমনি খোলা পড়িয়া রহিল, অচলা ঘরের বাহিরে আসিয়া, বারান্দার খুঁটিতে ঠেস দিয়া, স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

হঠাৎ তাহার মনে হইল—সব মিথ্যা। এই ঘরদ্বার, স্বামী-সংসার, খাওয়া-পরা, শোওয়া-বসা কিছুই সত্য নয়—কোন কিছুর জন্যেই মানুষের তিলার্ধ হাত-পা বাড়াইবার পর্যন্ত আবশ্যকতা নাই। শুধু মনের ভুলেই মানুষে ছটফট করিয়া মরে, না হইলে পল্লীগ্রাম শহরই বা কি, খড়ের ঘর রাজপ্রাসাদই বা কি, আর স্বামী-স্ত্রী, বাপ-মা, ভাই-বোন সম্বন্ধই বা কোথায়! আর কিসের জন্যেই বা রাগারাগি, কান্নাকাটি, ঝগড়াঝাঁটি করিয়া মরে! দুপুরবেলা অত বড় কাণ্ডের পরেও যে স্বামী স্ত্রীকে একলা ফেলিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিশ্চিন্ত হইয়া বাহিরে কাটাইতে পারে, তাহার মনের কথা যাচাই করিবার জন্যেই বা এত মাথাব্যথা কেন? সমস্ত মিথ্যা! সমস্ত ফাঁকি! মরীচিকার মতই সমস্ত অসত্য! কিন্তু সংসার তাহার কাছে এতদূর খালি হইয়া যাইতে পারিত না, একবার যদি সে মৃণালের ঐ ভাষাটুকুর উপরে তাহার সমস্ত চিত্ত ঢালিয়া না দিয়া, সেই মৃণালকে একবার ভাবিবার চেষ্টা করিত। অন্য নারীর সহিত সেই পল্লীবাসিনী সদানন্দময়ীর আচরণ একবার মনে করিয়া দেখিলে তার নিজের মনটাকে ঐ ক’টা কথার কালিমাই এমন করিয়া কালো করিয়া দিতে বোধ করি পারিত না।

যদু ফিরিয়া আসিয়া কহিল, বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, চায়ের জল গরম হয়েছে কি?

অচলা ঠিক যেন ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিল, কহিল, কোন্‌ বাবু?

যদু জোর দিয়া বলিল, আমাদের বাবু। এইমাত্র তিনি ফিরে এলেন যে। চায়ের জল ত অনেকক্ষণ গরম হয়ে গেছে মা।

চল যাচ্ছি, বলিয়া অচলা রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হইয়া গেল। খানিক পরে চা এবং জলখাবার চাকরের হাতে দিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল, মহিম অন্ধকার বারান্দায় পায়চারি করিতেছে এবং সুরেশ ঘরের মধ্যে লণ্ঠনের কাছে মুখ লইয়া একমনে খবরের কাগজ পড়িতেছে। যেন কেহই কাহারো উপস্থিতি আজ জানিতেও পারে নাই। এই যে অত্যন্ত লজ্জাকর সঙ্কোচ দুটি চিরদিনের বন্ধুর মাঝখানে আজ সহজ শিষ্টাচারের পথটা পর্যন্ত রুদ্ধ করিয়া দিয়াছে, তাহার উপলক্ষটা মনে পড়িতেই অচলার পা-দুটি থামিয়া গেল।

অচলাকে দেখিয়া মহিম থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, সুরেশকে চা দিতে এত দেরি হ’ল যে?

অচলার মুখ দিয়া কিছুতেই কথা বাহির হইল না। সে মুহূর্তকাল মাথা হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া, নীরবে ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হইল।

যদু চায়ের সরঞ্জাম টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া বাহির হইয়া গেলে, সুরেশ কাগজখানা রাখিয়া দিয়া মুখ ফিরাইল; কহিল, মহিম কৈ, সে এখনো ফেরেনি নাকি?

সঙ্গে সঙ্গেই মহিম প্রবেশ করিয়া একখানা চৌকি টানিয়া লইয়া উপবেশন করিল, কিন্তু সে যে মিনিট-দশেক ধরিয়া তাহারই কানের কাছে বারান্দার উপরে হাঁটিয়া বেড়াইতেছিল, এই বাহুল্য কথাটা মুখ দিয়া উচ্চারণ করার প্রয়োজন বোধ করিল না।

তার পরেই সমস্ত চুপচাপ। অচলা নিঃশব্দে অধোমুখে দু বাটি চা প্রস্তুত করিয়া এক বাটি সুরেশকে দিয়া, অন্যটা স্বামীর দিকে অগ্রসর করিয়া দিয়া নীরবেই উঠিয়া যাইতেছিল, মহিমের আহ্বানে সে চমকিয়া দাঁড়াইল।
মহিম কহিল, একটু অপেক্ষা কর, বলিয়া নিজেই চট করিয়া উঠিয়া কবাটে খিল লাগাইয়া দিল। চক্ষের নিমেষে তাহার ছয়-নলা পিস্তলটার কথাই সুরেশের স্মরণ হইল; এবং হাতের পেয়ালা কাঁপিয়া উঠিয়া খানিকটা চা চলকাইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। সে মুখখানা মড়ার মত বিবর্ণ করিয়া বলিল, দোর বন্ধ করলে যে?

তাহার কণ্ঠস্বর, মুখের চেহারা ও প্রশ্নের ভঙ্গীতে অচলারও ঠিক সেই কথাই মনে পড়িয়া মাথার চুল পর্যন্ত কাঁটা দিয়া উঠিল। বোধ করি বা একবার যেন সে চিৎকার করিবারও প্রয়াস করিল, কিন্তু তাহার যে চেষ্টা সফল হইল না। মহিম ক্ষণকালমাত্র অচলার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া সমস্ত বুঝিল। তার পরে সুরেশের মুখের পানে চাহিয়া বলিল, চাকরটা এসে পড়ে, এই জন্যেই—নইলে পিস্তলটা আমার চিরকাল যেমন বাক্সে বন্ধ থাকে, এখনো তেমনি আছে। তোমরা এত ভয় পাবে জানলে আমি দোর বন্ধ করতাম না।

সুরেশ চায়ের পেয়ালাটা নামাইয়া রাখিয়া হাসিবার মত মুখের ভাব করিয়া বলিল, বাঃ, ভয় পেতে যাবো কেন হে? তুমি আমার উপর গুলি চালাবে—বাঃ—প্রাণের ভয়! আমি? কবে আবার তুমি দেখলে? আচ্ছা যা হোক—

তাহার অসংলগ্ন কৈফিয়ত শেষ হইবার পূর্বেই মহিম কহিল, সত্যই কখনো ভয় পেতে তোমাকে দেখিনি। প্রাণের মায়া তোমার নেই বলেই আমি জানতাম। সুরেশ, আমার নিজের দুঃখের চেয়ে তোমার এই অধঃপতন আমার বুকে আজ বেশি করে বাজল। যাতে তোমার মত মানুষকেও এত ছোট করে আনতে পারে—না, সুরেশ কাল তুমি নিশ্চয় বাড়ি যাবে। কোন ছলে আর দেরি করা চলবে না।

সুরেশ তবুও কি একটা জবাব দিতে চাহিল; কিন্তু এবার তাহার গলা দিয়া স্বরও ফুটিল না, ঘাড়টাও সোজা করিতে পারিল না; সেটা যেন তাহার অজ্ঞাতসারেই ঝুঁকিয়া পড়িল।

তুমি ভেতরে যাও অচলা, বলিয়া মহিম খিল খুলিয়া পরক্ষণেই অন্ধকারের মধ্যে বাহির হইয়া গেল।

এইবার সুরেশ মাথা তুলিয়া জোর করিয়া হাসিয়া কহিল, শোন কথা। অমন কত গণ্ডা বন্দুক-পিস্তল রাতদিন নাড়াচাড়া করে বুড়ো হয়ে এলুম, এখন ওর একটা ভাঙ্গা ফুটো রিভলভারের ভয়ে মরে গেছি আর কি! হাসালে যা হোক, বলিয়া সুরেশ নিজেই টানিয়া টানিয়া হাসিতে লাগিল। সে হাসিতে যোগ দিবার মত লোক ঘরের মধ্যে অচলা ছাড়া আর কেহ ছিল না। সে কিন্তু যেমন ঘাড় হেঁট করিয়া এতক্ষণ দাঁড়াইয়া ছিল, তেমনি ভাবেই আরও কিছুকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া ধীরে ধীরে পাশের দরজা দিয়া ভিতরে চলিয়া গেল।

ঘণ্টা-খানেক পরে মহিম নিজের ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, কেহ নাই। পাশের ঘরে গিয়া দেখিল, মাটিতে মাদুর পাতিয়া, হাতের উপর মাথা রাখিয়া অচলা শুইয়া আছে। স্বামীকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া সে উঠিয়া বসিল। পাশে একটা খালি তক্তপোশ ছিল, মহিম তাহার উপর উপবেশন করিয়া বলিল, কেমন, কাল তোমার বাপের বাড়ি যাওয়া ত ঠিক?

অচলা নীচের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল, কোন জবাব দিল না।

মহিম অল্পক্ষণ অপেক্ষা করিয়া পুনশ্চ কহিল, যাকে ভালবাস না, তারই ঘর করতে হবে, এত বড় অন্যায় উপদ্রব আমি স্বামী হলেও তোমার ওপর করতে পারব না।
কিন্তু অচলা তেমনি পাষাণ-মূর্তির মত নিঃশব্দ স্থির হইয়া রহিল দেখিয়া মহিম বলিতে লাগিল, কিন্তু তোমার ওপর আমার অন্য নালিশ আছে। আমার স্বভাব ত জানো। শুধু বিয়ের পর থেকেই ত নয়, অনেক আগেই ত আমাকে জানতে যে, আমি সুখ-দুঃখ যাই হোক, নিজের প্রাপ্য ছাড়া একবিন্দু উপরি পাওনা কখনো প্রত্যাশা করিনে—পেলেও নিইনে। ভালবাসার ওপর ত জোর খাটে না অচলা। না পারলে হয়ত তা দুঃখের কথা, কিন্তু লজ্জার কথা ত নয়। কেন তবে এতদিন কষ্ট পাচ্ছিলে? কেন আমাকে না জানিয়ে ভেবে নিয়েছিলে, আমি জোর করে তোমাকে আটক রাখবো? কোনদিন কোন বিষয়েই ত আমি জোর খাটাই নি। তাঁরা তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলে, তবে তোমার প্রাণ বাঁচবে—আর আমাকে জানালে কি কোন উপায় হতো না? তোমার প্রাণের দামটা কি শুধু তাঁরাই বোঝেন?

অচলা অশ্রু-বিকৃত অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর যতদূর সাধ্য সহজ ও স্বাভাবিক করিয়া চুপি চুপি বলিল, তুমিও ত ভালোবাসো না।

মহিম আশ্চর্য হইয়া কহিল, এ কথা কে বললে? আমি ত কখনো বলিনি।

অচলার উত্তপ্ত হইয়া উঠিতে বিলম্ব হইল না; কহিল, শুধু কথাই কি সব? শুধু মুখের বলাই সত্যি, আর সব মিথ্যে? রাগের মাথায় মনের কষ্টে যা কিছু মানুষের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, তাকেই কেবল সত্যি ধরে নিয়েই তুমি জোর খাটাতে চাও? তোমার মতন নিক্তির ওজনে কথা বলতে না পারলেই কি তার মাথায় পা দিয়ে ডুবিয়ে দিতে হবে? বলিতে বলিতেই তাহার গলা ধরিয়া প্রায় রুদ্ধ হইয়া আসিল।

মহিম কিছুই বুঝিতে না পারিয়া কহিল, তার মানে?

অচলা উচ্ছ্বসিত রোদন চাপিয়া বলিল, মনে করো না—তোমার মত সাবধানী লোকেও মিথ্যেকে চিরকাল চাপা দিয়ে রাখতে পারে! তোমারও কত ভুল হতে পারে—দেখ গে চেয়ে, তোমারই টেবিলের ওপর। শুধু আমাদেরই—

মহিম প্রায় হতবুদ্ধি হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি আমার টেবিলের ওপর?

অচলা মুখে আঁচল গুঁজিয়া মাদুরের উপর উপুড় হইয়া পড়িল। তাহার কাছে আর কোন জবাব না পাইয়া মহিম আস্তে আস্তে তাহার টেবিল দেখিতে গেল। তাহার পড়ার ঘরের টেবিলের উপর খান-কতক বই পড়িয়াছিল; প্রায় দশ মিনিট ধরিয়া সেইগুলা উলটিয়া-পালটিয়া দেখিয়া, তাহার নীচে, আশেপাশে সমস্ত তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া স্ত্রীর অভিযোগের কিছুমাত্র তাৎপর্য বুঝিতে না পারিয়া, বিমূঢ়ের ন্যায় ফিরিয়া আসিবার পথে শোবার ঘরটার প্রতি দৃষ্টি পড়ায়, ভিতরে একটা পা দিয়াই মৃণালের সেই চিঠিখানার উপর তাহার চোখ পড়িল। সেখানা হাতে তুলিয়া লইয়া পড়িবামাত্রই, অকস্মাৎ অন্ধকারে বিদ্যুৎহানার মতই আজ একমুহূর্তে মহিম পথ দেখিতে পাইল। অচলা যে কি ইঙ্গিত করিয়াছে, আর বুঝিতে বিলম্ব হইল না। সেটুকু হাতের মধ্যে লইয়া মহিম বিছানার উপর বসিয়া শূন্যদৃষ্টিতে বাহিরের অন্ধকারে চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল। যেমন করিয়া সে প্রথম দিনটিতে আসিয়াছিল, যেভাবে সে চলিয়া গিয়াছিল, সতীন বলিয়া সে অচলাকে যত পরিহাস করিয়াছে—একটি একটি করিয়া তাহার সমস্ত মনে পড়িতে লাগিল।
পল্লীগ্রামের এইসকল রহস্যালাপের সহিত যে মেয়ে পরিচিত নয়, প্রতিদিন তাহার যে কিরূপ বিঁধিয়াছে, এবং যে নিজেও যখন কোনদিন এই পরিহাসে খোলা মনে যোগ দিতে পারে নাই, বরঞ্চ স্ত্রীর সম্মুখে লজ্জা পাইয়া বারংবার বাধা দিবার চেষ্টা করিয়াছে—তাহার সেই লজ্জা যদি এই উচ্চশিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী রমণীর ধারণায় অপরাধীর সত্যকার লজ্জা বলিয়া ধীরে ধীরে বদ্ধমূল হইয়া উঠিয়া থাকে ত আজ তাহার মূলোচ্ছেদ করিবে সে কি দিয়া? বাহিরের অন্ধকারের ভিতর হইতেই আজ অনেক সত্য তাহাকে দেখা দিতে লাগিল। কেমন করিয়া অচলার হৃদয় ধীরে ধীরে সরিয়া গিয়াছে, কেমন করিয়া স্বামীর সঙ্গ দিনের পর দিন বিষাক্ত হইয়াছে, কেমন করিয়া স্বামীর আশ্রয় প্রতিমুহূর্তে কারাগার হইয়া উঠিয়াছে—সমস্তই সে যেন স্পষ্ট দেখিতে লাগিল। এই প্রাণান্তকর অবরোধের মধ্যে হইতে পরিত্রাণ পাইবার সেই যে আকুল প্রার্থনা সুরেশের কাছে তখন উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছিল—সে যে তাহার অন্তরের কোন্‌ অন্তরতম দেশ হইতে উত্থিত হইয়াছিল, তাহাও আজ মহিমের মনশ্চক্ষের সম্মুখে প্রচ্ছন্ন রহিল না। অচলাকে সে যথার্থই সমস্ত হৃদয় দিয়া ভালবাসিয়াছিল। সেই অচলার এতদিন এত কাছে থাকিয়াও, তাহার এত বড় মনোবেদনার প্রতি চোখ বুজিয়া থাকাটাকে সে গভীর অপরাধ বলিয়া গণ্য করিল। কিন্তু এমন করিয়া আর ত একটা মুহূর্তও চলিবে না! স্ত্রীর হৃদয় ফিরিয়া পাইবার উপায় আছে কি না, তাহা কোথায় কত দূরে সরিয়া গিয়াছে, অনুমান করাও আজ দুঃসাধ্য। কিন্তু অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াও স্বামী বলিয়া যাহাকে সে একদিন আশ্রয় করিয়াছিল, তাহারই কাছে অপমান এবং লাঞ্ছনা পাইয়া যে আজ তাহাকে ফিরিতে হইতেছে, এত বড় ভুল ত তাহাকে জানানো চাই।

মহিম ধীরে ধীরে উঠিয়া গিয়া অচলার দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দেখিল, কবাট রুদ্ধ এবং ঠেলিয়া দেখিল, তাহা ভিতর হইতে বন্ধ। আস্তে আস্তে বার-দুই ডাকিয়া যখন কোন সাড়া পাইল না, তখন শুধু যে জোর করিয়া শান্তিভঙ্গ করিবারই তাহার প্রবৃত্তি হইল না, তাহা নহে, একটা অতি কঠিন পরীক্ষার দায় হইতে আপাততঃ নিষ্কৃতি পাইয়া নিজেও যেন বাঁচিয়া গেল।

মহিম ফিরিয়া আসিয়া শয্যায় শুইয়া পড়িল; কিন্তু যাহার অভাবে পার্শ্বের স্থানটা আজ শূন্য পড়িয়া রহিল, ও-ঘরে সে অনশনে মাটিতে পড়িয়া আছে মনে করিয়া কিছুতেই তাহার চক্ষে নিদ্রা আসিল না। উঠিয়া গিয়া ঘুম ভাঙ্গাইয়া তাহাকে তুলিয়া আনা উচিত কি না, ভাবিতে ভাবিতে দ্বিধা করিতে করিতে অনেক রাত্রে বোধ করি সে কিছুক্ষণের জন্য তন্দ্রামগ্ন হইয়া পড়িয়াছিল, সহসা মুদ্রিত-চক্ষে তীব্র আলোক অনুভব করিয়া চোখ মেলিয়া চাহিল। শিয়রের খোলা জানালা দিয়া এবং চালের ফাঁক দিয়া অজস্র আলোক ও উৎকট ধূমে ঘর ভরিয়া গিয়াছে এবং অত্যন্ত সন্নিকটে এমন একটা শব্দ উঠিয়াছে যাহা কানে প্রবেশমাত্রই সর্বাঙ্গ অসাড় করিয়া দেয়। কোথায় যে আগুন লাগিয়াছে, তাহা নিশ্চয় বুঝিয়াও ক্ষণকালের জন্য সে হাত-পা নাড়িতে পারিল না। কিন্তু সেই কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যেই তাহার মাথার ভিতর দিয়া যেন ব্রহ্মাণ্ড খেলিয়া গেল। লাফাইয়া উঠিয়া, দ্বার খুলিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল, রান্নাঘর এবং যে ঘরে আজ অচলা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, তাহারই বারান্দার একটা কোণ বিদীর্ণ করিয়া প্রধূমিত অগ্নিশিখা উপরের সমস্ত জামগাছটাকে রাঙ্গা করিয়া ফেলিয়াছে।
পল্লীগ্রামে খড়ের ঘরে আগুন ধরিলে তাহা নিবাইবার কল্পনা করাও পাগলামি, সে চেষ্টাও কেহ করে না; পাড়ার লোক, যে যাহার জিনিসপত্র ও গরু-বাছুর সরাইতে ছুটাছুটি করে, এবং ভিন্ন পাড়ার লোক একদিকে মেয়েরা এবং একদিকে পুরুষেরা সমবেত হইয়া অত্যন্ত নিরুদ্বেগে হায় হায় করিয়া এবং কি পরিমাণের দ্রব্য-সম্ভার দগ্ধ হইতেছে এবং কি করিয়া এ সর্বনাশ ঘটিল, তাহারই আলোচনা করিয়া সমস্ত বাড়িটা ভস্মসাৎ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। তার পরে ঘরে ফিরিয়া হাত-পা ধুইয়া বাকি রাত্রিটুকু বিছানায় গড়াইয়া লইয়া পুনরায় সকালবেলা একে একে গাড়ু-হাতে দেখা দেয়; এবং আলোচনার জেরটুকু সকালের মত শেষ করিয়া বাড়ি গিয়া স্নানাহার করে। কিন্তু একজনের গৃহপ্রাঙ্গণের বিরাট ভস্মস্তূপ আর একজনের জীবনযাত্রার লেশমাত্র ব্যাঘাত ঘটাইতে পারে না।

মহিম পল্লীগ্রামের লোক, সকল কথাই সে জানিত। তাই নিরর্থক চেঁচামেচি করিয়া অসময়ে পাড়ার লোকের ঘুম ভাঙ্গাইয়া দিল না। বিন্দুমাত্র প্রয়োজনও ছিল না, কারণ তাহার আম-কাঁঠালের এত বড় বাগানটা অতিক্রম করিয়া এই অগ্ন্যুৎপাত যে আর কাহারও গৃহ স্পর্শ করিবে, সে সম্ভাবনা ছিল না। বাহিরের সারের যে কয়টা ঘরে সুরেশ এবং চাকর-বাকরেরা নিদ্রিত ছিল, অগ্নিস্পৃষ্ট হইবার তখনও তাহাদের বিলম্ব ছিল। বিলম্ব ছিল না শুধু অচলার ঘরটার। সে তাহারই দ্বারে সজোরে করাঘাত করিয়া ডাকিল, অচলা!

অচলা ঠিক যেন জাগিয়াছিল, এমনিভাবে উত্তর দিল, কেন?

মহিম কহিল, দোর খুলে বেরিয়ে এস!

অচলা শ্রান্তকণ্ঠে জবাব দিল, কি হবে? আমি ত বেশ আছি!

মহিম কহিল, দেরি করো না, বেরিয়ে এসো—বাড়িতে আগুন লেগেছে।

প্রত্যুত্তরে অচলা একবার ভয়জড়িতকণ্ঠে চিৎকার করিয়া উঠিল, তার পরে সমস্ত চুপচাপ! মহিমের পুনশ্চ ব্যগ্র আহ্বানে সে আর সাড়াও দিল না। ঠিক এই ভয়ই মহিমের ছিল; কারণ বাটীতে আগুন লাগা যে কি ব্যাপার, তাহার কোনপ্রকার ধারণাই অচলার ছিল না। মহিম ঠিক বুঝিল, ইতিপূর্বে সে চোখ বুজিয়াই কথা কহিতেছিল, কিন্তু চোখ মেলিয়া যে দৃশ্য তাহাকেও কিছুক্ষণের জন্য অবশ করিয়া ফেলিয়াছিল, সেই অপর্যাপ্ত আলোকে উদ্ভাসিত সমস্ত ঘরটা চোখে পড়িবামাত্র অচলারও সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইয়াছে। কিন্তু এই দুর্ঘটনার জন্য মহিম প্রস্তুত হইয়াই ছিল। সে একটা কবাট নাড়িয়া উঁচু করিয়া হাঁসকলটা খুলিয়া ফেলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল এবং মূর্ছিতা স্ত্রীকে বুকে তুলিয়া লইয়া অবিলম্বে প্রাঙ্গণে আসিয়া দাঁড়াইল।
এইবার সে বাটীর অন্য সকলকে সজাগ করিবার জন্য নাম ধরিয়া চিৎকার করিতে লাগিল। সুরেশ পাংশুমুখে বাহির হইয়া আসিল, যদু প্রভৃতি অপর সকলেও দ্বার খুলিয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া পড়িল, তাহার পরেই একটা প্রচণ্ড শব্দে অচলা সচেতন হইয়া দুই বাহু দিয়া স্বামীর কণ্ঠ প্রাণপণ-বলে জড়াইয়া ধরিয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।

মহিম সকলকে লইয়া যখন বাহিরের খোলা জায়গায় আসিয়া পড়িল, তখন বড় ঘরের চালে আগুন ধরিয়াছে। এইবার তাহার মনে পড়িল, অচলার অলঙ্কার প্রভৃতি দামী জিনিস যাহা কিছু আছে, সমস্তই এই ঘরে এবং আর মুহূর্ত বিলম্ব করিলে কিছুই বাঁচানো যাইবে না।

অচলা প্রকৃতিস্থ হইয়াছিল; সে সজোরে স্বামীর হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, না, সে হবে না। প্রতিশোধ নেবার এই কি সময় পেলে? কিছুতেই ওর মধ্যে তোমাকে আমি যেতে দেব না। যাক, সব পুড়ে যাক।

না গেলে চলবে না, অচলা, বলিয়া জোর করিয়া হাত ছাড়াইয়া লইয়া মহিম সেই জমাট ধূমরাশির মধ্যে দ্রুতবেগে গিয়া প্রবেশ করিল। যদু চেঁচাইতে চেঁচাইতে সঙ্গে সঙ্গে ছুটিল।

সুরেশ এতক্ষণ পর্যন্ত অভিভূতের মত চাহিয়া অদূরে দাঁড়াইয়া ছিল; অকস্মাৎ সংবিৎ পাইয়া, সে পিছু লইবার উপক্রম করিতেই অচলা তাহার কোঁচার খুঁট ধরিয়া ফেলিয়া কঠোরকণ্ঠে কহিল, আপনি যান কোথায়?

সুরেশ টানাটানি করিয়া বলিল, মহিম গেল যে—

অচলা তিক্তস্বরে বলিল, তিনি গেলেন তাঁর জিনিস বাঁচাতে। আপনি কে? আপনাকে যেতে আমি কোনমতেই দেব না।

তাহার কণ্ঠস্বরে স্নেহের লেশমাত্র সম্পর্ক ছিল না—এ যেন সে অনধিকারীর উৎপাতকে তিরস্কার করিয়া দমন করিল।

মিনিট দুই-তিন পরেই মহিম দুই হাতে দু’টা বাক্স লইয়া এবং যদু প্রকাণ্ড একটা তোরঙ্গ মাথায় করিয়া উপস্থিত হইল। মহিম অচলার পায়ের কাছে রাখিয়া কহিল, তোমার গহনার বাক্সটা যেন কিছুতে হাতছাড়া করো না, আমরা বাইরের ঘরে যদি কিছু বাঁচাতে পারি, চেষ্টা করি গে।

অচলার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না। তাহার মুঠোর মধ্যে তখনো সুরেশের কোঁচার খুঁট ধরা ছিল, তেমনি ধরা রহিল। মহিম পলকমাত্র সেদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া যদুকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় অদৃশ্য হইয়া গেল।

বিংশ পরিচ্ছেদ

প্রভাতের প্রথম আলোকে স্বামীর মুখের প্রতি চোখ পড়িবামাত্রই অচলার বুকের ভিতরটা হাহা-রবে কাঁদিয়া উঠিল। চোখের জল আর সে কোনমতে সংবরণ করিতে পারিল না। এ কি হইয়াছে! মাথার চুল ধুলাতে, বালুতে, ভস্মে রুক্ষ, বিবর্ণ; শীর্ণ বিরসমুখ অগ্ন্যুত্তাপে ঝলসিয়া একটা রাত্রির মধ্যেই তাহার অমন সুন্দর স্বামীকে যেন বুড়া করিয়া দিয়া গিয়াছে। গ্রামের লোক চারিদিকে ঘুরিয়া ফিরিয়া কলরব করিতেছে। পিতল-কাঁসার বাসন-কোসন সে ত সমস্তই গিয়াছে দেখা যাইতেছে। তা যাক—কিন্তু শাল-দোশালা গহনাপত্র তাই-বা আর কত ঐ একটিমাত্র তোরঙ্গে রক্ষা পাইয়াছে—এই লইয়া অত্যন্ত তীক্ষ্ণ সমালোচনা চলিতেছে। ইহাদেরই একটু দূরে নির্বাণোন্মুখ অগ্নিস্তূপের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া মহিম চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। সমস্তই শুনিতে পাইতেছিল, কিন্তু কৌতূহল নিবারণ করিবার মত মনের অবস্থা তাহার ছিল না। ও-পাড়ার ভিখু বাঁড়ুয্যে—অত্যন্ত গণ্যমান্য ব্যক্তি—বাতের জন্য এ পর্যন্ত আসিয়া পৌঁছিতে পারেন নাই; এখন লাঠিতে ভর দিয়া সদলবলে আগমন করিতেছেন দেখিয়া মহিম অগ্রসর হইয়া গেল। বাঁডুয্যেমশাই বহুপ্রকার বিলাপ করিয়া শেষে বলিলেন, মহিম, তোমার বাবা অনেকদিন স্বর্গীয় হয়েছেন বটে, কিন্তু তিনি আর আমি ভিন্ন ছিলাম না। আমরা দু’জনে হরিহর-আত্মা ছিলাম।

মহিম ঘাড় নাড়িয়া সবিনয়ে জানাইল যে, ইহাতে তাহার কোন সংশয় নাই। শুনিয়া তিনি কহিলেন যে, এই কাণ্ডটি যে ঘটিবে, তাহা তিনি পূর্বাহ্ণেই জানিতেন।

মহিম চকিত হইয়া জিজ্ঞাসুমুখে চাহিয়া রহিল। পার্শ্বে-ই বেড়ার আড়ালে অচলা জিনিসপত্র লইয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ছিল, সেও শুনিবার জন্য উৎকর্ণ হইয়া উঠিল। ভূমিকা এই পর্যন্ত করিয়া বাঁডুয্যেমশাই বলিতে লাগিলেন, ব্রহ্মার ক্রোধ ত শুধু শুধু হয় না বাবা!

আমাদের একবার জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করলে না, এতবড় বামুনের ছেলে হয়ে কি অকর্মটাই না করলে বল দেখি।

মহিম কথাটা বুঝিতে পারিল না। তিনি নিজের কথাটার তখন বিস্তৃত ব্যাখ্যা করিতে অনুচরগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া বলিতে লাগিলেন, আমরা সবাই বলাবলি করি যে, কিছু একটা ঘটবেই। কৈ, আর কারুর প্রতি ব্রহ্মার অকৃপা হল না কেন! বাবা, বেম্মও যা, খ্রিস্টানও তাই। সাহেব হলেই বলে খ্রিস্টান, আর বাঙালী হলেই বলে বেম্ম। এ আমাদের কাছে—যাদের শাস্ত্রজ্ঞান জন্মেছে—তাদের কাছে চাপা থাকে না।

উপস্থিত সকলেই ইহাতে অনুমোদন করিল। তিনি উৎসাহ পাইয়া বলিয়া উঠিলেন, যাই কর না বাবা, আগে একটা প্রায়শ্চিত্ত করে ওটাকে ত্যাগ করে—

মহিম হাত তুলিয়া বলিল, থামুন। আপনাদের আমি অসম্মান করতে চাইনে, কিন্তু যা নয়, তা মুখে আনবেন না। আমি যাঁকে ঘরে এনেচি, তাঁর পুণ্যে ঘর থাকে ভালই; না হয় বার বার পুড়ে যায়, সেও আমার সহ্য হবে। বলিয়া অন্যত্র চলিয়া গেল।

বাঁডুয্যেমশাই সমস্ত সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া কিছুক্ষণ হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া লাঠি ঠকঠক করিয়া ঘরে ফিরিয়া গেলেন। মনে মনে যাহা বলিতে বলিতে গেলেন তাহা মুখে না আনাই ভাল।
অচলা সমস্ত শুনিতে পাইয়াছিল; তাহার দুই চক্ষু বাহিয়া বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা ঝরিয়া পড়িতে লাগিল।

যদু আসিয়া কহিল, মা, তোমাকে জিজ্ঞাসা করে বাবু পালকিবেহারা ডেকে আনতে বললেন। আনব?

অচলা আঁচলে চোখ মুছিয়া ফেলিয়া কহিল, বাবুকে একবার ডেকে দাও ত যদু।

পালকি?

এখন থাক।

মহিম কাছে আসিয়া দাঁড়াইতে তাহার চোখে আবার জল আসিয়া পড়িল। সে হঠাৎ ঝুঁকিয়া পড়িয়া তাহার পায়ের ধূলা মাথায় লইতেই মহিম বিস্মিত ও ব্যস্ত হইয়া উঠিল। হয়ত সে স্বামীর হাত-দুটা ধরিয়া কাছে টানিয়া বসাইত, হয়ত বা আরও কিছু ছেলেমানুষি করিয়া ফেলিত; কি করিত, তা সে তাহার অন্তর্যামীই জানিতেন; কিন্তু সকাল হইয়া গিয়াছে—চারিদিকে কৌতূহলী লোক; অচলা আপনাকে সংযত করিয়া লইয়া কহিল, পালকি কেন?

মহিম কহিল, ন’টার ট্রেন ধরতে পারলেই ত সবদিকে সুবিধে। একটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে স্নানাহার করতে পারবে। কাল রাত্রেও ত কিছু খাওনি।

আর তুমি?

আমি! মহিম আর একটুখানি চিন্তা করিয়া লইয়া বলিল, আমারও যা হোক একটা উপায় হবে বৈ কি।

তা হলে আমারও হবে। আমি যাবো না।

কি উপায় হবে বল?

অচলা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিল না। একবার তাহার মুখে আসিল—বনে, গাছতলায়! কিন্তু সে ত সত্যই সম্ভব নয়। আর পাড়ায় কাহারও বাটীতে একটা ঘণ্টার জন্যও আশ্রয় লওয়া যে কত অপমানজনক, সে ইঙ্গিত ত সে এইমাত্র ভাল করিয়াই পাইয়াছে। মৃণালের কথা যে তাহার মনে পড়ে নাই, তাহা নহে, বারংবার স্মরণ হইয়াছে; কিন্তু লজ্জায় তাহা মুখ দিয়া উচ্চারণ করিতে পারিল না। কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া কহিল, তুমিও সঙ্গে চল।

মহিম আশ্চর্য হইয়া বলিল, আমি সঙ্গে যাবো? তাতে লাভ কি?

অচলা বলিল, লাভ-লোকসান দেখবার ভার আজ থাকে আমি নেব। তোমার শুভানুধ্যায়ী এখানে বেশি নেই, সে আমি জানতে পেরেচি। তা ছাড়া, তোমার মুখের চেহারা এক রাত্রির মধ্যেই যা হয়ে গেছে, সে তুমি দেখতে পাচ্ছো না, আমি পাচ্ছি। আমার গলায় ছুরি দিলেও, এখানে তোমাকে একলা ফেলে রেখে আমি যেতে পারবো না।

মহিমের মনের ভিতর তোলপাড় করিতে লাগিল; কিন্তু সে স্থির হইয়া রহিল।

অচলা বলিতে লাগিল, কেন তুমি অত ভাবচ? আমার গয়নাগুলো ত আছে। তা দিয়ে পশ্চিমে যেখানে হোক কোথাও একটা ছোট বাড়ি অনায়াসে কিনতে পারবো। যেখানেই থাকি, আমাকে না খেতে দিয়ে মেরে ফেলতে তুমি পারবে না। সে চেষ্টা তোমাকে করতেই হবে। আর বলেইচি ত তোমার ভার এখন থেকে আমার ওপর।

যদু অদূরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, পালকি আনতে যাবো মা?

উত্তরের জন্য অচলা উৎসুক-চক্ষে স্বামীর মুখের পানে চাহিয়া রহিল। মহিম ইহার জবাব দিল। যদুকে আনিতে হুকুম করিয়া স্ত্রীকে বলিল, কিন্তু আমি ত এখুনি যেতে পারিনে।

শুনিয়া অনির্বচনীয় শান্তি ও তৃপ্তিতে অচলার বুক ভরিয়া গেল। সে অন্তরের আবেগ সংবরণ করিয়া সহজভাবে কহিল, সে সত্যি, এক্ষুণি তোমার যাওয়া হয় না; কিন্তু সন্ধ্যের গাড়িতে নিশ্চয় যাবে বল? নইলে আমি খাবার নিয়ে বসে বসে ভাবব, আর—
কিন্তু মন্তব্যটা তাহার মহিমের দীর্ঘশ্বাসে যেন নিবিয়া গেল। সে মলিন হইয়া সভয়ে কহিল, ও বেলা যেতে পারবে না? তবে এই অন্ধকার রাত্রে কার বাড়িতে—কিন্তু বলিতে বলিতেই সে থামিয়া গেল। যাহার বাটীতে তাহার স্বামীর রাত্রি যাপনের সম্ভাবনা, সে কথা মনে হইতেই তাহার মুখশ্রী গম্ভীর ও বিবর্ণ হইয়া উঠিল। বোধ করি, তাহার মনের কথা মহিম বুঝিল না। জিজ্ঞাসা করিল, কলকাতায় আমাকে কোথায় যেতে বল?

অচলা তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, কেন, বাবার ওখানে।

মহিম ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না।

না, কেন? সেও কি তোমার নিজের বাড়ি না?

মহিম তেমনি মাথা নাড়িয়া জানাইল, না।

অচলা কহিল, না হয় সেখানে কেবল দুটো দিন থেকেই আমরা পশ্চিমে চলে যাবো।

না।

অচলা জানিত, তাহাকে টলানো সম্ভব নয়। একটুখানি চিন্তা করিয়া বলিল, তবে চল, এখান থেকেই আমরা পশ্চিমের কোন শহরে গিয়ে উঠি গে। আমি সঙ্গে থাকলে কোথাও আমাদের কষ্ট হবে না আমি বেশ জানি। কিন্তু গহনাগুলো ত বেচতে হবে; সে কলকাতা ছাড়া হবে কি করে?

মহিম আর একদিকে চাহিয়া নীরব হইয়া রহিল। অচলা ব্যগ্রকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, পশ্চিমেও ত বড় শহর আছে, সেখানেও ত বিক্রি করা যায়? আমার বাক্সে প্রায় দু’ শ টাকা আছে, এখন তাতেই ত আমাদের যাওয়া হতে পারে? চুপ করে রইলে যে? বল না শিগগির!

মহিম স্ত্রীর চোখের দিকে চাহিতে পারিল না, কিন্তু জবাব দিল; বলিল, তোমার গহনা নিতে পারব না অচলা।

অকস্মাৎ একটা গুরুতর ধাক্কা খাইয়া যেন অচলা পিছাইয়া গেল। খানিক পরে কহিল, কেন পারবে না, শুনতে পাই?

মহিম তাহার উত্তর দিল না এবং কিছুক্ষণ পর্যন্ত উভয়ে নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। হঠাৎ অচলা একসঙ্গে একরাশ প্রশ্ন করিয়া বসিল। কহিল, পৃথিবীতে স্বামী কি কেবল তুমি একটি? দুঃসময়ে তাঁরা নেন কি করে? স্ত্রীর গহনা থাকে কি জন্যে? এত কষ্টে এগুলো বাঁচাতে গেলেই বা কেন? বলিয়া সে ছোট টিনের বাক্সটা হাত দিয়া ঠেলিয়া দিয়া কহিল, আর বিপদের দিনে যদি কোন কাজেই না লাগে ত মিথ্যে বোঝা বয়ে বেড়িয়ে কি হবে? আগুন এখনও জ্বলচে, আমি টান মেরে ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যাই—তোমার মনে যা আছে করো। বলিয়া যে আঁচল দিয়া চোখ চাপিয়া ধরিল।

মিনিট-দুই চুপ করিয়া থাকিয়া মহিম ধীরে ধীরে কহিল, আমি সমস্ত ভেবে দেখলাম অচলা। কিন্তু, তুমি ত জানো, আমি কোন কাজ ঝোঁকের ওপর করিনে; কিংবা আর কেউ করে, সেও চাইনে, তুমি যা দিতে চাচ্ছো, তা নিজের বলে নিতে পারলে আজ আমার সুখের সীমা থাকত না; কিন্তু কিছুতেই নিতে পারিনে। দুঃখ দেখে তোমার মত আরও একজন আরও ঢের বেশি আমাকে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেও যেমন দয়া, এও তেমনি দয়া; কিন্তু এতে না তোমাদের, না আমার, কারও শেষ পর্যন্ত ভাল হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।

অচলা আর সহ্য করিতে পারিল না। কান্না ভুলিয়া বোধ করি প্রতিবাদ করিবার জন্যই দৃপ্ত চক্ষু-দুটি উপরে তুলিবামাত্র স্বামীর দৃষ্টি অনুসরণ করিতে দেখিতে পাইল, কতকটা দূরে তাহাদের যে পুষ্করিণী আছে, তাহারই ঘাটের পাশে বাঁধানো নিমগাছতলায় সুরেশ হাতে মাথা রাখিয়া আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া চুপ করিয়া পড়িয়া আছে। অচলার মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল এবং উচ্ছ্রিত মাথা তাহার আপনি হেঁট হইয়া গেল।
কিন্তু মহিম যেন কতকটা অন্যমনস্কের মত আপন মনেই বলিতে লাগিল, শুধু যে কখনো শান্তি পাবো না তা নয়, তোমাকে বারংবার বঞ্চিত করতে পারি, এ সম্বন্ধই কোনদিন আমাদের মধ্যে হয়নি। একটুখানি থামিয়া কহিল, অচলা, নিজেকে রিক্ত করে দান করবার অনেক দুঃখ। কিন্তু ঝোঁকের ওপর হয়ত তাই একমুহূর্তে পারা যায়, কিন্তু তার ফলভোগ হয় সারা জীবন ধরে। আমি জানি, একটা ভুলের জন্যে তোমাদের মনস্তাপের অবধি নেই। আবার একটা ভুল হয়ে গেলে, তুমি না পারবে কোনদিন নিজেকে ক্ষমা করতে, না পারবে আমাকে মাপ করতে। এ ক্ষতি সইবার মত সম্বল তোমার নেই; এ কথা আজ না টের পেতে পারো, দু’দিন পরে পারবে। তাই তোমার কাছ থেকে কিছুই আমি নিতে পারব না।

কথাগুলা অচলার বুকের ভিতর বিঁধিল। স্বামীর চক্ষে সে যে কত পর তাহা আজ যেমন অনুভব করিল, এমন আর কোনদিন নয়; এবং সঙ্গে সঙ্গেই মৃণালের স্মৃতিতে সে ক্রোধে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। সেও কঠিন হইয়া বলিয়া উঠিল, তুমি এতক্ষণ ধরে যা বোঝাচ্ছো সে আমি বুঝেছি। হয়ত তোমার কথাই সত্যি, হয়ত তোমার মুখ দেখে দয়া হওয়াতেই আমার যথাসর্বস্ব দিতে চেয়েছিলুম। হয়ত দু’দিন পরে আমাকে সত্যি এর জন্যে অনুতাপ করতে হতো; সব ঠিক, কিন্তু দ্যাখো অপরের মনের ইচ্ছে বুঝে নেবার মত যত বুদ্ধিই তোমার থাক, তোমাকে বুঝিয়ে দেবারও জিনিস আছে। স্ত্রীর জিনিস জোর করে নেওয়া ত দূরের কথা, হাত পেতে নেবার সম্বল তোমারই বা কি আছে? আর তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করব না। এটুকু বিবেক-বুদ্ধি যে এখনো তোমাতে বাকি আছে, আজ থেকে তাই আমার সান্ত্বনা। কিন্তু যেখানেই থাকি, একদিন না একদিন তোমাকে সব কথা বুঝতেই হবে। হবেই হবে। বলিয়া সে হাত দিয়া নিজের মুখ চাপিয়া ধরিয়া কান্না রোধ করিল।

ন’টার ট্রেনে সুরেশও বাটী ফিরিতেছিল। গত রাত্রের অগ্নিকাণ্ড তাহাকে কেমন যেন একরকম করিয়া দিয়াছিল। কাহারও সহিত কথা কহিবার যেন শক্তিই তাহাতে ছিল না। গাড়ি আসিতে এখনও কিছু বিলম্ব ছিল; সুরেশ মহিমকে স্টেশনের এক প্রান্তে ডাকিয়া লইয়া গিয়া ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিয়া উঠিল, মহিম, আগুন লাগার জন্যে আমাকে ত তুমি সন্দেহ করোনি?

মহিম তাহার হাতদুটো সজোরে ধরিয়া ফেলিয়া শুধু বলিল, ছি!

সুরেশের দুই চোখ ছলছল করিতে লাগিল। বাষ্পরুদ্ধ-স্বরে বলিল, কাল থেকে এই ভয়ে আমার শান্তি নেই মহিম।
মহিম নীরবে শুধু একটু তাহার হাতের মধ্যে চাপ দিল। তাহার পরে কহিল, সুরেশ, একটা সত্যকার অপরাধ অনেক মিথ্যা অপরাধের বোঝা বয়ে আনে। কিন্তু অনেক দুঃখ পেয়ে তুমি যাই কর না কেন, যাকে ‘ক্রাইম’ বলে, সে তুমি কোনদিন করতে পার না বলে আজও আমি বিশ্বাস করি। একটুখানি থামিয়া কহিল, সুরেশ, তুমি ভগবান মানো না বটে, কিন্তু যে যথার্থ মানে সে অহর্নিশি প্রার্থনা করে, এ বিশ্বাস তিনি যেন তার না ভেঙ্গে দেন।

ট্রেন আসিয়া পড়িল। মেয়েদের গাড়িতে অচলা এবং তাহার দাসীকে তুলিয়া দিয়া মহিম সুরেশের কাছে আসিতেই সে জানালা দিয়া হাত বাড়াইয়া তাহার ডান হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া কহিল, তোমার কালকের ক্ষতিটা পূর্ণ করে দেবার প্রার্থনাটা আমার কিছুতেই মঞ্জুর করলে না, কিন্তু তোমার ভগবান তোমার প্রার্থনা যেন মঞ্জুর করেন ভাই। আমাকে যেন আর তিনি ছোট না করেন, বলিয়াই সে হাত ছাড়িয়া দিয়া মুখ ফিরাইয়া বসিল।

ওদিকে জানালায় মুখ রাখিয়া অচলা যদুর সঙ্গে এতক্ষণ চুপি চুপি কি কথা কহিতেছিল, মহিম নিকটে আসিতেই জিজ্ঞাসা করিল, মৃণালদিদির স্বামী নাকি আজ মারা গেছেন?

মহিম ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ঘণ্টা-খানেক পূর্বে মারা গেছেন শুনলাম।

অচলা জিজ্ঞাসা করিল, প্রায় দশ-বারোদিন ধরে নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন। এ খবরটাও আমাকে দেওয়া কোনদিন তুমি আবশ্যক মনে করোনি?

মহিম জবাব দিতে চাহিল, কিন্তু কি করিয়া কথাটা গুছাইয়া বলিবে, ভাবিতে ভাবিতেই বাঁশী বাজাইয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *