একাদশ পরিচ্ছেদ
সন্ধ্যার পর নত-মস্তকে ধীরে ধীরে মহিম যখন তাহার বাসার দিকে পথ চলিতেছিল, তখন তাহার মুখ দেখিয়া কাহারও বলিবার সাধ্য ছিল না যে, ঠিক সেই সময়ে তাহার সমস্ত প্রাণটা যন্ত্রণায় বাহিরে আসিবার জন্য তাহারই হৃদয়ের দেয়ালে প্রাণপণে গহ্বর খনন করিতেছিল। কি করিয়া সুরেশ এখানে আসিল, কেমন করিয়া এত ঘনিষ্ঠ পরিচয় করিল—এই-সব ছোটখাটো ইতিহাস এখনো সে জানিতে পারে নাই বটে, কিন্তু আসল জিনিসটা আর তাহার অবিদিত ছিল না। কেদারবাবুকে সে চিনিত। যেখানে টাকার গন্ধ একবার তিনি পাইয়াছেন, সেখান হইতে সহজে কোনমতেই যে তিনি মুখ ফিরাইয়া লইবেন না, ইহাতে তাহার কিছুমাত্র সংশয় ছিল না। সুরেশকেও সে ছেলেবেলা হইতে নানারূপেই দেখিয়া আসিয়াছে। দৈবাৎ যাহাকে সে ভালবাসে, তাহাকে পাইবার জন্য সে কি যে দিতে না পারে, তাহাও কল্পনা করা কঠিন। টাকা ত কিছুই নয়—এ ত চিরদিনই তাহার কাছে অতি তুচ্ছ বস্তু। একদিন তাহারই জন্য যে মুঙ্গেরের গঙ্গায় নিজের প্রাণটার দিকেও চাহে নাই, আজ যদি সে আর-একজনের ভালবাসার প্রবলতর মোহে সেই মহিমের প্রতি দৃক্পাত না করে ত তাহাকে দোষ দিবে সে কি করিয়া? সুতরাং সমস্ত ব্যাপারটা একটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা বলিয়া মনে করা ব্যতীত কাহারও উপর সে বিশেষ কোন দোষারোপ করিল না। কিন্তু এই যে এতগুলা বিরুদ্ধ ও প্রচণ্ড শক্তি সহসা জাগিয়া উঠিয়াছে, এতগুলিকে প্রতিহত করিয়া অচলা যে তাহার কাছে ফিরিয়া আসিবে, এ বিশ্বাস তাহার ছিল না; তাই তাহার শেষ কথা, তাহার শেষ আচরণ ক্ষণকালের নিমিত্ত চঞ্চল করা ভিন্ন মহিমকে সত্যকার ভরসা কিছুই দেয় নাই। আংটিটার পানে বারংবার চাহিয়াও সে কিছুমাত্র সান্ত্বনা লাভ করিল না। অথচ, শেষ-নিষ্পত্তি হওয়াও একান্ত প্রয়োজন। এমন করিয়া নিজেকে ভুলাইয়া আর একটা মুহূর্তও কাটানো চলে না। যা হবার তা হোক, চরম একটা মীমাংসা করিয়া সে লইবেই। এই সঙ্কল্প স্থির করিয়াই আজ সে তাহার দীন-দরিদ্র ছাত্রাবাসে গিয়া রাত্রি আটটার পর হাজির হইল।
পরদিন অপরাহ্ণকালে কেদারবাবুর বাটীতে গিয়া খবর পাইল, তাঁহারা এইমাত্র বাহির হইয়া গিয়াছেন—কোথায় নিমন্ত্রণ আছে। তাহার পরদিন গিয়াও দেখা হইল না। বেহারা জানাইল, সকলে বায়স্কোপ দেখিতে গিয়াছেন, ফিরিতে রাত্রি হইবে। সকলে যে কে তাহা প্রশ্ন না করিয়াও মহিম অনুমান করিতে পারিল। অপমান এবং অভিমান যত বড়ই হোক, উপর্যুপরি দুই দিন ফিরিয়া আসাই তাহার মত লোকের পক্ষে যথেষ্ট হইতে পারিত; কিন্তু হাতের আংটিটা তাহাকে তাহার বাসায় টিকিতে দিল না, পরদিন পুনরায় তাহাকে ঠেলিয়া পাঠাইয়া দিল। আজ শুনিতে পাইল, বাবু বাড়ি আছেন—উপরের ঘরে বসিয়া চা-পান করিতেছেন।
মহিমকে দ্বারের কাছে দেখিয়া কেদারবাবু মুখ তুলিয়া গম্ভীরস্বরে শুধু বলিলেন, এসো মহিম। মহিম হাত তুলিয়া নিঃশব্দে নমস্কার করিল।
দূরে খোলা জানালার ধারে একটা সোফার উপর পাশাপাশি বসিয়া অচলা এবং সুরেশ। অচলার কোলের উপর একটা ভারী ছবির বই। দুজনে মিলিয়া ছবি দেখিতেছিল। সুরেশ পলকের জন্য চোখ তুলিয়াই, পুনরায় ছবি দেখায় মনঃসংযোগ করিল; কিন্তু অচলা চাহিয়াও দেখিল না। তাহার অবনত মুখখানি দেখা গেল না বটে, কিন্তু সে যেরূপ একান্ত আগ্রহভরে তাহার বইয়ের পাতার দিকে ঝুঁকিয়া রহিল, তাহাতে এমন মনে করা একেবারে অসঙ্গত হইত না, যে পিতার কণ্ঠস্বর, আগন্তুকের পদশব্দ—কিছুই তাহার কানে যায় নাই।
মহিম ঘরে ঢুকিয়া একখানি চেয়ার টানিয়া লইয়া উপবেশন করিল।
কেদারবাবু অনেকক্ষণ পর্যন্ত আর কোন কথা কহিলেন না—একটু একটু করিয়া চা পান করিতে লাগিলেন। বাটিটা যখন নিঃশেষ হইয়া গেল এবং আর চুপ করিয়া থাকা নিতান্তই অসম্ভব হইয়া উঠিল, তখন সেটা মুখ হইতে নামাইয়া রাখিয়া কহিলেন, তা হলে এখন কি করচ? তোমাদের আইনের খবর বার হতে এখনো ত মাস-খানেক দেরি আছে বলে মনে হচ্চে।
মহিম শুধু কহিল, আজ্ঞে হাঁ।
কেদারবাবু বলিলেন, না হয় পাসই হলে—তা পাস তুমি হবে, আমার কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু কিছুদিন প্র্যাক্টিস করে হাতে কিছু টাকা না জমিয়ে ত আর কোনদিকে মন দিতে পারবে না। কি বল সুরেশ, মহিমের সাংসারিক অবস্থা ত শুনতে পাই তেমন ভাল নয়।
সুরেশ কথা কহিল না। মহিম একটু হাসিয়া আস্তে আস্তে বলিল, প্র্যাক্টিস করলেই যে হাতে টাকা জমবে, তারও ত কোন নিশ্চয়তা নাই।
কেদারবাবু মাথা নাড়িয়া কহিলেন, না, তা নেই—ঈশ্বরের হাত, কিন্তু চেষ্টার অসাধ্য কাজ নেই। আমাদের শাস্ত্রকারেরা বলেছেন, ‘পুরুষসিংহ’; তোমাকে সেই পুরুষসিংহ হতে হবে। আর কোনদিকে নজর থাকবে না—শুধু উন্নতি আর উন্নতি। তার পরে সংসারধর্ম কর—যা ইচ্ছা কর, কোন দোষ নেই—তা নইলে যে মহাপাপ! বলিয়া সুরেশের পানে একবার চাহিয়া কহিলেন, কি বল সুরেশ—তাদের খাওয়াতে পরাতে পারব না, সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারব না—এমনি করেই ত হিন্দুরা উচ্ছন্ন হয়ে গেল। আমরা ব্রাহ্মসমাজের লোকেরাও যদি সৎদৃষ্টান্ত না দেখাই, তা হলে সভ্যজগতের কোনমতে কারো কাছে মুখ দেখাতে পর্যন্ত পারব না, ঠিক কি না? কি বল সুরেশ?
সুরেশ পূর্ববৎ মৌন হইয়া রহিল। মহিম ভিতরে ভিতরে অসহিষ্ণু হইয়া কহিল, আপনার উপদেশ আমি মনে রাখব। কিন্তু আপনি কি এই আলোচনা করবার জন্যই আমাকে আসতে বলেছিলেন?
কেদারবাবু তাহার মনের ভাব বুঝিলেন; বলিলেন, না, শুধু এই নয়, আরও কথা আছে, কিন্তু—, বলিয়া তিনি সোফার দিকে চাহিলেন।
সুরেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, আমরা তা হলে ও-ঘরে গিয়ে একটু বসি, বলিয়া হেঁট হইয়া অচলার ক্রোড়ের উপর হইতে ছবির বইখানা তুলিয়া লইল। তাহার এই ইঙ্গিতটুকু কিন্তু অচলার কাছে একেবারে নিষ্ফল হইয়া গেল। সে যেমন বসিয়াছিল তেমনি রহিল, উঠিবার লেশমাত্র উদ্যোগ করিল না। কেদারবাবু তাহা লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, তোমরা দুজনে একটুখানি ও-ঘরে গিয়ে বসো গে মা, মহিমের সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।
অচলা মুখ তুলিয়া পিতার মুখের পানে চাহিয়া শুধু কহিল, আমি থাকি বাবা।
সুরেশ কহিল, আচ্ছা বেশ, আমি না হয় যাচ্ছি, বলিয়া একরকম রাগ করিয়াই হাতের বইটা অচলার কোলের উপর ফেলিয়া দিয়া সশব্দে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
কন্যার অবাধ্যতায় কেদারবাবু যে খুশি হইলেন না, তাহা তিনি মুখের ভাবে স্পষ্ট বুঝাইয়া দিলেন; কিন্তু জিদও করিলেন না। খানিকক্ষণ রুষ্টমুখে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া বলিলেন, মহিম, তুমি মনে করো না, আমি তোমার উপর বিরক্ত; বরঞ্চ তোমার প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধাই আছে। তাই বন্ধুর মত উপদেশ দিচ্ছি যে, এখন কোনপ্রকার দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে নিজেকে অকর্মণ্য করে তুলো না। নিজের উন্নতি কর, কৃতী হও, তার পরে দায়িত্ব নেবার যথেষ্ট সময় পাবে।
মহিম মুখ ফিরাইয়া একবার অচলার পানে চাহিল। সে চক্ষের পলকে চোখ নামাইয়া ফেলিল। তখন তাহার পিতার পানে চাহিয়া কহিল, আপনার আদেশ আমার শিরোধার্য; কিন্তু আপনার কন্যারও কি তাই ইচ্ছা?
কেদারবাবু তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিলেন, নিশ্চয়! নিশ্চয়! মুহূর্তকাল স্থির থাকিয়া কহিলেন, অন্ততঃ এটা ত নিশ্চয় যে, সমস্ত জেনে-শুনে তোমার হাতে আমি মেয়েকে বিসর্জন দিতে পারব না।
মহিম শান্তস্বরে কহিল, ইংরেজদের একটা প্রথা আছে, এ-রকম অবস্থায় তারা পরস্পরের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। আপনার সেই অভিপ্রায়ই কি বুঝব?
কেদারবাবু হঠাৎ আগুন হইয়া উঠিলেন; কহিলেন, দেখ মহিম, আমি তোমার কাছে হলফ নেবার জন্য তোমাকে ডাকিনি। তুমি যে-রকম ব্যবহার আমাদের সঙ্গে করেচ, তাতে আর কোন বাপ হলে কুরুক্ষেত্র কাণ্ড হয়ে যেত। কিন্তু আমি নিতান্ত শান্তিপ্রিয় লোক, কোনরকমের গোলমাল হাঙ্গামা ভালবাসি নে বলেই যতটা সম্ভব মিষ্টি কথায় আমাদের মনের ভাব তোমাকে জানিয়ে দিলুম। তাতে তুমি অপেক্ষা করে থাকবে, কি থাকবে না, সাহেবেরা কি করে, এত কৈফিয়তে ত আমাদের প্রয়োজন দেখিনে। তা ছাড়া, আমরা ইংরেজ নই, বাঙালী। মেয়ে আমাদের বড় হয়ে উঠলেই বাপ-মায়ের চোখে ঘুম আসে না, মুখে অন্ন-জল রোচে না, এ-কথা তুমি নিজেই কোন্ না জান?
মহিমের চোখ-মুখ পলকের জন্য আরক্ত হইয়া উঠিল; কিন্তু সে আত্মসংবরণ করিয়া ধীরভাবে বলিল, আমি কি ব্যবহার করেচি, যার জন্যে অন্যত্র এত বড় কাণ্ড হতে পারত—এ প্রশ্ন আপনাকে আমি করতে চাইনে। শুধু আপনার কন্যার নিজের মুখে একবার শুনতে চাই, তাঁরও এই অভিপ্রায় কি না। বলিয়া নিজেই উঠিয়া গিয়া অচলার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কহিল, কেমন, এই ত?
অচলা মুখ তুলিল না, কথা কহিল না।
একটা উচ্ছ্বসিত বাষ্প মহিম সবলে নিরোধ করিয়া পুনরায় কহিল, তোমার মনের কথা নিভৃতে জানবার, জিজ্ঞেস করে জানবার অবকাশ আমি পেলুম না—সেজন্যে আমি মাপ চাচ্চি। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় ঝোঁকের উপর যে কাজ করে ফেলেছিলে, তার জন্যেও তোমাকে কোন জবাবদিহি করতে হবে না। শুধু একবার বল, সেই আংটিটা ফিরে চাও কি না।
সুরেশ ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকিয়া কহিল, আমাকে মাপ করতে হবে কেদারবাবু, আমার আর এক মিনিট অপেক্ষা করবার জো নেই।
উপস্থিত সকলেই মৌন-বিস্ময়ে চোখ তুলিয়া চাহিল। কেদারবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন?
সুরেশ অভিনয়ের ভঙ্গিতে হাত-দুটো বাড়াইয়া দিয়া বলিল, না—না, এ ভুলের মার্জনা নেই। আমার অন্তরঙ্গ সুহৃদ আজ প্লেগে মৃতকল্প, আর আমি কিনা সমস্ত ভুলে গিয়ে, এখানে বসে বৃথা সময় নষ্ট করচি!
কেদারবাবু শশব্যস্ত হইয়া কহিলেন, বল কি সুরেশ, প্লেগ? যাবে নাকি সেখানে?
সুরেশ একটু হাসিয়া বলিল, নিশ্চয়! অনেক পূর্বেই আমার সেখানে যাওয়া উচিত ছিল।
কেদারবাবু অত্যন্ত শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, কিন্তু প্লেগ যে! তিনি কি তোমার এমন বিশেষ কোন আত্মীয়—
সুরেশ কহিল, আত্মীয়! আত্মীয়ের অনেক বড়, কেদারবাবু! মহিমের প্রতি কটাক্ষ করিয়া এই প্রথম কথা কহিল, বলিল, মহিম, আমাদের নিশীথের কাল রাত্রি থেকে প্লেগ হয়েচে, বাঁচে যে এ আশা নেই। আমার তোমাকেও একবার বলে উচিত—যাবে দেখতে?
মহিম নিশীথ লোকটিকে চিনিতে পারিল না। কহিল, কোন্ নিশীথ?
কোন্ নিশীথ! বল কি মহিম! এরই মধ্যে আমাদের নিশীথকে ভুলে গেলে? যার সঙ্গে সমস্ত সেকেন্ড-ইয়ারটা পড়লে, তাকে তার এতবড় বিপদের দিনে আর মনে পড়ছে না? বলিয়া ঘাড় ফিরাইয়া, একবার অচলার মুখের প্রতি চাহিয়া লইয়া শ্লেষের স্বরে বলিল, তা মনে পড়বে না বটে! প্লেগ কিনা!
এই খোঁচাটুকু মহিম নীরবে সহ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তিনি কি ভবানীপুর থেকে আসতেন?
সুরেশ ব্যঙ্গ করিয়া জবাব দিল, হাঁ, তাই। কিন্তু নিশীথ ত আমাদের দু-চারজন ছিল না মহিম, যে, এতক্ষণ তোমার মনে পড়েনি! বলি যাবে কি?
মহিম চিনিতে পারিয়া কহিল, নিশীথ কোথায় থাকে এখন?
সুরেশ কহিল, আর কোথায়? নিজের বাড়িতে, ভবানীপুরে। এ সময় তাকে একবার দেখা দেওয়া কি কর্তব্য বলে মনে হয় না? আমি ডাক্তার, আমাকে ত যেতেই হবে; আর অত বড় বন্ধুত্ব ভুলে গিয়ে না থাক ত তুমিও আমার সঙ্গে যেতে পার। কেদারবাবু, আপনাদের কথা বোধ করি শেষ হয়ে গেছে? আশা করি, অন্ততঃ খানিকক্ষণের জন্যেও ওকে একবার ছুটি দিতে পারবেন?
এ বিদ্রুপটা যে আবার কাহার উপর হইল, তাহা ঠিক ধরিতে না পারিয়া কেদারবাবু উদ্বিগ্নমুখে একবার মহিমের, একবার কন্যার মুখের দিকে চাহিতে লাগিলেন। তাঁহার এই বড়লোক ভাবী জামাতাটির মান-অভিমান যে কিসে এবং কতটুকুতে বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠে, আজও বৃদ্ধ তাহার কূলকিনারা ঠাহর করিয়া উঠিতে পারেন নাই। তাঁহার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না, মহিমও হতবুদ্ধির মত নীরবে চাহিয়া রহিল।
দেখিতে দেখিতে অচলার সমস্ত মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল। সে ধীরে ধীরে আসিয়া হাতের বইখানা সুমুখের টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া এতক্ষণ পরে কথা কহিল; বলিল, তুমি ডাক্তার, তোমার ত যাওয়াই উচিত; কিন্তু ওঁর ওকালতির কেতাবের মধ্যে ত প্লেগের চিকিৎসা লেখা নেই? উনি যাবেন কি জন্যে শুনি?
এই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত জবাবে সুরেশ অবাক হইয়া গেল। কিন্তু পরক্ষণেই বলিয়া উঠিল, আমি সেখানে ডাক্তারি করতে যাচ্ছিনে, তার ডাক্তারের অভাব নেই। আমি যাচ্ছি বন্ধুর সেবা করতে। বন্ধুত্বটা আমার প্রাণটার চেয়েও বড় বলে মনে করি।
একটা নিষ্ঠুর হাসির আভাস অচলার ওষ্ঠাধরে খেলিয়া গেল; কহিল, সকলেই যে তোমার মত মহৎ হবে, এমন ত কোন কথা নেই। অতবড় বন্ধুত্বজ্ঞান যদি ওঁর না থাকে ত আমি লজ্জার মনে করিনে। সে যাই হোক, ও জায়গায় ওঁর কিছুতেই যাওয়া হবে না।
সুরেশের মুখ কালিবর্ণ হইয়া গেল।
কেদারবাবু সশঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। সভয়ে বলিতে লাগিলেন, ও-সব তুই কি বলচিস অচলা? সুরেশের মত—সত্যই ত—নিশীথবাবুর মত—
অচলা বাধা দিয়া কহিল, নিশীথবাবুকে ত প্রথমে চিনতেই পারলেন না। তা ছাড়া উনি ডাক্তার—উনি যেতে পারেন। কিন্তু আর-একজনকে বিপদের মধ্যে অনর্থক টেনে নিয়ে যাওয়া কেন?
আহত হইলে সুরেশের কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। সে টেবিলের উপর প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত করিয়া, যা মুখে আসিল উচ্চকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, আমি ভীরু নই—প্রাণের ভয় করিনে। মহিমকে দেখাইয়া বলিল, ঐ নেমকহারামটাকেই জিজ্ঞাসা করে দেখ, আমি ওকে মরতে মরতে বাঁচিয়েছিলুম কি না।
অচলা দৃপ্তস্বরে কহিল, নেমকহারাম উনি । তাই বটে! কিন্তু যাকে এক সময়ে বাঁচানো যায়, আর এক সময়ে ইচ্ছে করলে বুঝি তাকে খুন করা যায়?
কেদারবাবু হতবুদ্ধির মত বলিতে লাগিলেন, থাম না অচলা; থাম না সুরেশ। এ-সব কি কাণ্ড বল দেখি!
সুরেশ রক্ত-চক্ষে কেদারবাবুর প্রতি চাহিয়া বলিল, আমি প্লেগের মধ্যে যেতে পারি—তাতে দোষ নেই! মহিমের প্রাণটাই প্রাণ, আর আমারটা কিছু নয়! দেখলেন ত আপনি!
লজ্জায় ক্ষোভে অচলা কাঁদিয়া ফেলিল। রুদ্ধস্বরে বলিতে লাগিল, ওঁর প্রাণ উনি দিতে পারেন, আমি নিষেধ করতে পারিনে; কিন্তু যেখানে বাধা দেবার আমার সম্পূর্ণ অধিকার, সেখানে আমি বাধা দেবই। আমি কোনমতেই অমন জায়গায় ওঁকে যেতে দিতে পারব না। বলিয়া সে প্রস্থানের উপক্রম করিতেই কেদারবাবু চেঁচাইয়া উঠিলেন, কোথায় যাস অচলা!
অচলা থমকিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, না বাবা, দিন-রাত্রি এত পীড়ন আর সহ্য করতে পারিনে। যা একেবারে অসম্ভব, যা প্রাণ থাকতে স্বীকার করবার আমার একেবারে জো নেই, তাই নিয়ে তোমরা আমাকে অহর্নিশ বিঁধছ। বলিয়া উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন চাপিতে চাপিতে দ্রুতপদে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল। বৃদ্ধ কেদারবাবু বুদ্ধিভ্রষ্টের মত খানিকক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া, শেষে বার বার বলিতে লাগিলেন, যত সব ছেলেমানুষ—কি সব কাণ্ড বল ত!
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
মাস-খানেক গত হইয়াছে। কেদারবাবু রাজি হইয়াছেন—মহিমের সহিত অচলার বিবাহ আগামী রবিবারে স্থির হইয়া গিয়াছে। সেদিন যে কাণ্ড করিয়া সুরেশ গিয়াছিল, তাহা সত্যই কেদারবাবুর বুকে বিঁধিয়াছিল। কিন্তু সেই অপমানের গুরুত্ব ওজন করিয়াই যে তিনি মহিমের প্রতি অবশেষে প্রসন্ন হইয়া সম্মতি দিয়াছেন, তাহা নয়। সুরেশ নিজেই যে কোথায় নিরুদ্দেশ হইয়াছে—এতদিনের মধ্যে তাহার কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই। শুনা যায়, সেই রাত্রেই সে নাকি পশ্চিমে কোথায় চলিয়া গিয়াছে—কবে ফিরিবে, তাহা কেহই বলিতে পারে না।
সেদিন কান্না চাপিতে অচলা ঘর ছাড়িয়া যখন চলিয়া গেল, তখন অনেকক্ষণ পর্যন্ত তিনজনেই মুখ কালি করিয়া বসিয়া রহিলেন। কিন্তু কথা কহিল প্রথমে সুরেশ নিজে। কেদারবাবুর মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, যদি আপত্তি না থাকে, আমি আপনার সাক্ষাতেই আপনার কন্যাকে গোটা-কয়েক কথা বলতে চাই।
কেদারবাবু ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, বিলক্ষণ! তুমি কথা বলবে, তার আবার আপত্তি কি সুরেশ? যত সব ছেলেমানুষের—
তা হলে একবার ডেকে পাঠান—আমার বেশি সময় নেই।
তাহার মুখের ও কণ্ঠস্বরের অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য লক্ষ্য করিয়া কেদারবাবু মনে মনে শঙ্কা অনুভব করিলেন। কিন্তু জোর করিয়া একটু হাস্য করিয়া, আবার সেই ধুয়া তুলিয়াই বলিতে লাগিলেন, যত সব ছেলেমানুষের কাণ্ড! কিন্তু একটুখানি সামলাতে না দিলে—বুঝলে না সুরেশ, ও-সব প্লেগ-ফ্লেগের জায়গার নাম করলেই—মেয়েমানুষের মন কিনা! একবার শুনলেই ভয়ে অজ্ঞান—বুঝলে না বাবা—
কোনপ্রকার কৈফিয়তের প্রতি মনোযোগ দিবার মত সুরেশের মনের অবস্থা নয়—সে অধীর হইয়া বলিয়া উঠিল, বাস্তবিক কেদারবাবু, আমার অপেক্ষা করবার সময় নেই।
তা ত বটেই। তা ত বটেই। কে আছিস রে ওখানে? বলিয়া ডাক দিয়া কেদারবাবু মহিমের প্রতি একটা বক্র কটাক্ষ করিলেন। মহিম উঠিয়া দাঁড়াইয়া একটা নমস্কার করিয়া নীরবে বাহির হইয়া গেল।
কেদারবাবু নিজে গিয়া অচলাকে যখন ডাকিয়া আনিলেন, তখন অপরাহ্ণ-সূর্যের রক্তিম-রশ্মি পশ্চিমের জানালা-দরজা দিয়া ঘরময় ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। সেই আলোকে উদ্ভাসিত এই তরুণীর ঈষদ্দীর্ঘ কৃশ দেহের পানে চাহিয়া, পলকের জন্য সুরেশের বিক্ষুব্ধ মনের উপর একটা মোহ ও পুলকের স্পর্শ খেলিয়া গেল, কিন্তু স্থায়ী হইতে পারিল না। তাহার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাতমাত্রেই সে ভাব তাহার চক্ষের নিমেষে নির্বাপিত হইল। কিন্তু, তবুও সে চোখ ফিরাইয়া লইতে পারিল না, নির্নিমেষনেত্রে চাহিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। অচলার মুখের উপর আকাশের আলো পড়ে নাই বটে, কিন্তু সুমুখের দেওয়াল হইতে প্রতিফলিত আরক্ত আভায় সমস্ত মুখখানা সুরেশের চোখে কঠিন ব্রোঞ্জের তৈরি মূর্তির মত বোধ হইল। সে স্পষ্ট দেখিতে পাইল, কি যেন একটা নিবিড় বিতৃষ্ণায় এই নারীর সমস্ত মাধুর্য, সমস্ত কোমলতা নিঃশেষে শুষিয়া ফেলিয়া মুখের প্রত্যেক রেখাটিকে পর্যন্ত অবিচলিত দৃঢ়তায় একেবারে ধাতুর মত শক্ত করিয়া ফেলিয়াছে। সহসা কেদারবাবুর প্রবল নিশ্বাসের চোটে সুরেশের চমক ভাঙ্গিতেই সোজা হইয়া বসিল।
কেদারবাবু আর একবার তাঁহার পুরাতন মন্তব্য প্রকাশ করিয়া কহিলেন, যত সব পাগলামি কাণ্ড—কাকে যে কি বলি, আমি ভেবে পাইনে—
সুরেশ অচলাকে উদ্দেশ করিয়া নিরতিশয় গম্ভীরকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, আপনি যা বলে গেলেন, তাই ঠিক?
অচলা ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হাঁ।
এর আর কোন পরিবর্তন সম্ভব নয়?
অচলা মাথা নাড়িয়া বলিল, না।
রক্তের উচ্ছ্বাস এক ঝলক আগুনের মত সুরেশের চোখ-মুখ প্রদীপ্ত করিয়া দিল; কিন্তু সে কণ্ঠস্বর সংযত করিয়াই কহিল, আমার প্রাণটার পর্যন্ত যখন কোন দাম নেই, তখনি আমি জানতুম। তাহার বুকের ভিতরটা তখন পুড়িয়া যাইতেছিল। একটুখানি স্থির থাকিয়া বলিল, আচ্ছা, জিজ্ঞাসা করি, আমিই কি আপনাদের প্রথম শিকার, না এমন আরও অনেকে এই ফাঁদে পড়ে নিজেদের মাথা মুড়িয়ে গেছে?
অসহ্য বিস্ময়ে অচলা দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া চাহিল।
সুরেশ কেদারবাবুর প্রতি চাহিয়া কহিল, বাপ-মেয়েতে ষড়যন্ত্র করে শিকার ধরার ব্যবসা বিলাতে নতুন নয় শুনতে পাই; কিন্তু এ-ও বলচি আপনাকে, কেদারবাবু, একদিন আপনাদের জেলে যেতে হবে।
কেদারবাবু চিৎকার করিয়া উঠিলেন, এ-সব তুমি কি বলচ সুরেশ!
সুরেশ অবিচলিত-স্বরে জবাব দিল, চুপ করুন কেদারবাবু; থিয়েটারের অভিনয় অনেকদিন ধরে চলচে। পুরানো হয়ে গেছে—আর এতে আমি ভুলব না। টাকা আমার যা গেছে, তা যাক—তার বদলে শিক্ষাও কম পেলুম না; কিন্তু এই যেন শেষ হয়।
অচলা কাঁদিয়া উঠিল—তুমি কেন এঁর টাকা নিলে বাবা?
কেদারবাবু পাগলের মত একখণ্ড সাদা কাগজের সন্ধানে এদিকে-ওদিকে হাত বাড়াইয়া, শেষে একখানা পুরাতন খবরের কাগজ সবেগে টানিয়া লইয়া চেঁচাইয়া বলিলেন, আমি এখ্খুনি হ্যান্ডনোট লিখে দিচ্ছি—
সুরেশ বলিল, থাক—থাক, লেখালিখিতে আর কাজ নেই। আপনি ফিরিয়ে যা দেবেন, সে আমি জানি। কিন্তু আমিও ঐ ক’টা টাকার জন্য নালিশ করে আপনার সঙ্গে আদালতে গিয়ে দাঁড়াতে পারব না।
জবাব দিবার জন্য কেদারবাবু দুই ঠোঁট ঘন ঘন নাড়িতে লাগিলেন, কিন্তু গলা দিয়া একটাও কথা ফুটিল না।
সুরেশ অচলার প্রতি ফিরিয়া চাহিল। তাহার একান্ত পাংশু মুখ ও সজল চক্ষের পানে চাহিয়া তাহার একবিন্দু দয়া হইল না, বরঞ্চ ভিতরের জ্বালা শতগুণে বাড়িয়া গেল। সে পৈশাচিক নিষ্ঠুরতার সহিত বলিয়া উঠিল, কি তোমার গর্ব করবার আছে অচলা, ঐ ত মুখের শ্রী, ঐ ত কাঠের মত দেহ, ঐ ত গায়ের রঙ! তবু যে আমি ভুলেছিলাম—সে কি তোমার রূপে? মনেও করো না।
পিতার সমক্ষে এই নির্লজ্জ অপমানে অচলা দুঃখে ঘৃণায় দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া কৌচের উপর উপুড় হইয়া পড়িল।
সুরেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ব্রাহ্মদের আমি দু’ চক্ষে দেখতে পারিনে। যাদের ছায়া মাড়াতেও আমার ঘৃণা বোধ হত, তাদের বাড়িতে ঢোকবামাত্রই যখন আমার আজন্মের সংস্কার—চিরদিনের বিদ্বেষ একমুহূর্তে ধুয়ে মুছে গেল, তখনি আমার সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল—এ যাদুবিদ্যা! আমার যা হয়েছে, তা হোক, কিন্তু যাবার সময় আপনাদের আমি সহস্রকোটি ধন্যবাদ না দিয়ে যেতে পারছি নে। ধন্যবাদ অচলা!
অচলা মুখ না তুলিয়াই অবরুদ্ধ-কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, বাবা, ওঁকে তুমি চুপ করতে বল। আমরা গাছতলায় থাকি, সে-ও ঢের ভালো, কিন্তু ওঁর যা নিয়েছ, তুমি ফিরিয়ে দাও—
সুরেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, গাছতলায়? একদিন তাও তোমাদের জুটবে না, তা বলে দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সেদিন আমাকে স্মরণ করো, বলিয়া প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই দ্রুতবেগে বাহির হইয়া গেল।
কেদারবাবু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া অবশেষে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, উঃ, কি ভয়ানক লোক! এমন জানলে আমি কি ওকে বাড়ি ঢুকতে দিতুম!
পিতার কথা অচলার কানে গেল, কিন্তু সে কিছুই বলিল না, উপুড় হইয়া পড়িয়া যেমন করিয়া কাঁদিতেছিল, তেমনি একভাবে পড়িয়া বহুক্ষণ পর্যন্ত নীরবে অশ্রুজলে বুক ভাসাইতে লাগিল। অদূরে চৌকির উপর বসিয়া কেদারবাবু সমস্ত দেখিতে লাগিলেন; কিন্তু সান্ত্বনার একটা কথা উচ্চারণ করিতেও আর তাঁহার সাহস হইল না। সন্ধ্যা হইয়া গেল। বেহারা আসিয়া গ্যাস জ্বালাইবার উপক্রম করিতেই অচলা নিঃশব্দে উঠিয়া নিজের ঘরে চলিয়া গেল।
কিন্তু, মহিম ইহার কিছুই জানিল না। শুধু যেদিন কেদারবাবু অত্যন্ত অবলীলাক্রমে কন্যার সহিত তাহার বিবাহের সম্মতি দিলেন, সেই দিনটায় সে কিছুক্ষণের জন্য বিহ্বলের মত স্তব্ধ হইয়া রহিল। অনেকপ্রকারের অনেক কথা, অনেক সংশয় তাহার মনে উদয় হইল বটে, কিন্তু তাহার এই সৌভাগ্যের সুরেশ নিজেই যে মূল কারণ, ইহা তাহার সুদূর কল্পনায়ও উদয় হইল না। অচলার প্রতি স্নেহে, প্রেমে, কৃতজ্ঞতায় তাহার সমস্ত হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল; কিন্তু চিরদিনই সে নিঃশব্দ-প্রকৃতির লোক; আবেগ উচ্ছ্বাস কোনদিন প্রকাশ করিতে পারিত না, পারিলেও হয়ত তাহার মুখে নিতান্তই তাহা একটা অপ্রত্যাশিত, অসংলগ্ন আচরণ বলিয়া লোকের চোখে ঠেকিত। বরঞ্চ, আজ সন্ধ্যার সময় যখন সে একাকী কেদারবাবুর সহিত দুই-চারিটা কথাবার্তার পর বাসায় ফিরিয়া গেল, তখন অন্যান্য দিনের মত অচলার সহিত দেখা করিয়া তাহাকে একটা ছোট্ট নমস্কার পর্যন্ত করিয়া যাইতে পারিল না। কথাটা কেদারবাবু নিজেই পাড়িয়াছিলেন। প্রসঙ্গ উত্থাপন হইতে শুরু করিয়া সম্মতি দেওয়া—মায় দিন-স্থির পর্যন্ত, একাই সব করিলেন। কিন্তু সমস্তটাই যেন অনন্যোপায় হইয়াই করিলেন; মুখে তাঁহার স্ফূর্তি বা উৎসাহের লেশমাত্র চিহ্ন প্রকাশ পাইল না। তথাপি দিন কাটিতে লাগিল এবং ক্রমশঃ বিবাহের দিন আসিল।
পরশু বিবাহ। কিন্তু মেয়ের বিবাহে তিনি কোনরূপ ধূমধাম হৈচৈ করিবেন না—স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন বলিয়া, আগামী শুভকর্মের আয়োজন যতটা নিঃশব্দে হইতে পারে, তাহার ত্রুটি করেন নাই।
আজও বিকাল-বেলা তিনি যথাসময়ে চা খাইতে বসিয়াছিলেন। একটা সেলাই লইয়া অচলা অনতিদূরে কৌচের উপর বসিয়া ছিল। অনেকদিন অনেক দুঃখের মধ্যে দিন-যাপন করিয়া আজ কয়েকদিন হইতে তাহার মনের উপর যে শান্তিটুকু স্থিতিলাভ করিয়াছিল, তাহারই ঈষৎ আভাসে তাহার পাণ্ডুর মুখখানি ম্লান জ্যোৎস্নার মতই স্নিগ্ধ বোধ হইতেছিল। চা খাইতে খাইতে মাঝে মাঝে কেদারবাবু ইহাই লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছিলেন। কলহ করিয়া সুরেশ চলিয়া যাওয়া পর্যন্ত, এতদিন তিনি মন-মরা ভাবেই দিন-যাপন করিতেছিলেন। সে ফিরিয়া আসিয়া কি করিবে, না করিবে—এই এক দুশ্চিন্তা; তা ছাড়া, তাঁহার নিজের কর্তব্যই বা এ সম্বন্ধে কি—হ্যান্ডনোট লিখিয়া দেওয়া বা টাকাটা পরিশোধ করিতে আর কোথাও ঋণের চেষ্টা করা, কিংবা মহিমের উপর দায়িত্ব তুলিয়া দেওয়া—কি যে করা যায়, তাহা ভাবিয়া ভাবিয়া কোন কূল-কিনারাই দেখিতেছিলেন না। অথচ একটা কিছু করা নিতান্তই আবশ্যক—সুরেশের নিরুদ্দেশ অবস্থার উপর বরাত দিয়া যে চিরদিন চলিবে না, অথবা মেয়ের মত নিজের খেয়ালে মগ্ন হইয়া, চোখ বুজিয়া থাকিলেই যে বিপদ উত্তীর্ণ হইতে পারা যাইবে না, তাহাও হাড়ে হাড়ে বুঝিতেছিলেন। হতাশ প্রেমিক একদিন যে চাঙ্গা হইয়া উঠিবে এবং সেদিন ফিরিয়া আসিয়া কথাটা চারিদিকে রাষ্ট্র করিয়া মস্ত হাঙ্গামা বাধাইয়া দিবে এবং যে টাকাটা চেকের দ্বারা তাঁহাকে দিয়াছে—তাহা আর কোন লেখাপড়া না থাকা সত্ত্বেও যে আদালতে উড়াইতে পারা যাইবে না, ভাবিয়া ভাবিয়া এ বিষয়ে একপ্রকার তিনি নিঃসংশয় হইয়া উঠিয়াছিলেন। কিন্তু, মেয়ের সহিত এ-বিষয়ে একটা পরামর্শ করিবার পর্যন্ত জো ছিল না। সুরেশের নামোল্লেখ করিতেও তাঁহার ভয় করিত। এখন অচলার ওই শান্ত স্থির মুখচ্ছবির প্রতি চাহিয়া তাঁহার ভারী একটা চিত্তজ্বালার সহিত কেবল মনে হইতে লাগিল, এই মেয়েটাই তাঁহার সকল দুঃখের মূল। অথচ, কি সুবিধাই না হইয়াছিল, এবং অদূর-ভবিষ্যতে আরও কি হইতে পারিত!
যে নিষ্ঠুর কন্যা বৃদ্ধ পিতার বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও তাঁহার সুখ-দুঃখের প্রতি দৃক্পাতমাত্র করিল না, সমস্ত পণ্ড করিয়া দিল, সেই স্বার্থপর সন্তানের বিরুদ্ধে তাঁহার প্রচ্ছন্ন ক্রোধ অভিশাপের মত যখন-তখন প্রায় এই কামনাই করিত—সে যেন ইহার ফলভোগ করে, একদিন যেন তাহাকে কাঁদিয়া বলিতে হয়, “বাবা, তোমার অবাধ্য হওয়ার শাস্তি আমি পাইতেছি।” পাত্র হিসাবে সুরেশ যে মহিমের অপেক্ষা অসংখ্য গুণে অধিক বাঞ্ছনীয়, এ বিশ্বাস তাঁহার মনে এরূপ বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল যে, তাহার সম্পর্ক হইতে বিচ্যুত হওয়াটাকে তিনি গভীর ক্ষতি বলিয়া গণ্য করিতেছিলেন। মনে মনে তাহার উপর তাঁহার ক্রোধ ছিল না। এত কাণ্ডের পরেও যদি আজ আবার তাহাকে ফিরিয়া পাইবার পথ থাকিত, উপস্থিত বিবাহ ভাঙ্গিয়া দিতে বোধ করি লেশমাত্র ইতস্ততঃ করিতেন না। কিন্তু কোন উপায় নাই—কোন উপায় নাই! অচলার কাছে তাহার আভাসমাত্র উত্থাপন করাও অসাধ্য।
সেলাই করিতে করিতে অচলা সহসা মুখ তুলিয়া বলিল, বাবা, সুরেশবাবুর ব্যাপারটা পড়লে?
অচলার মুখে সুরেশের নাম! কেদারবাবু চমকিয়া চাহিলেন। নিজের কানকে তাঁহার বিশ্বাস হইল না। সকালের খবরের কাগজটা টেবিলের উপর পড়িয়া ছিল; অচলা সেটা তুলিয়া লইয়া পুনরায় সেই প্রশ্নই করিল। কাগজখানার স্থানে স্থানে তিনি সকালবেলায় চোখ বুলাইয়া গিয়াছেন। কিন্তু অপরের সংবাদ খুঁটিয়া জানিবার মত আগ্রহাতিশয্য তাঁহার মনের মধ্যে এখন আর ছিল না। কহিলেন, কোন্ সুরেশ?
অচলা সংবাদপত্রের সেই স্থানটা খুঁজিতে খুঁজিতে বলিল, বোধ করি, ইনি আমাদেরই সুরেশবাবু।
কেদারবাবু বিস্ময়ে দুই চক্ষু প্রসারিত করিয়া বলিয়া উঠিলেন, আমাদের সুরেশবাবু? কি করেছেন তিনি? কোথায় তিনি?
অচলা উঠিয়া আসিয়া সংবাদপত্রের সেই স্থানটা পিতার হাতে তুলিয়া দিয়া বলিল, পড়ে দেখ না বাবা!
কেদারবাবু চশমার জন্য পকেট হাতড়াইয়া বলিলেন, চশমাটা হয়ত আমার ঘরেই ফেলে এসেছি। তুমি পড় না মা, ব্যাপারটা কি শুনি?
অচলা পড়িয়া শুনাইল, ফয়জাবাদ শহরের জনৈক পত্রপ্রেরক লিখিতেছেন, সেদিন শহরের দরিদ্র-পল্লীতে ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ড হইয়া গিয়াছে। একে প্লেগ, তাহাতে এই দুর্ঘটনায় দুঃখী লোকের দুঃখের আর পরিসীমা নাই। কিছুদিন হইতে সুরেশ নামে একটি ভদ্র-যুবক এখানে আসিয়া অর্থ দিয়া, ঔষধ-পথ্য দিয়া, নিজের দেহ দিয়া রোগীর সেবা করিতেছিলেন। বিপদের সময় তিনি উপস্থিত হইয়া শুনিতে পান, রোগশয্যায় পড়িয়া কোন স্ত্রীলোক একটি প্রজ্বলিত গৃহের মধ্যে আবদ্ধ হইয়া আছে—তাহাকে উদ্ধার করিবার আর কেহ নাই।
সংবাদদাতা অতঃপর লিখিয়াছেন, ইহার প্রাণরক্ষা করিতে কি করিয়া এই অসমসাহসী বাঙালী যুবক নিজের প্রাণ তুচ্ছ করিয়া জ্বলন্ত অগ্নিরাশির মধ্যে প্রবেশ করিয়া,—ইত্যাদি ইত্যাদি—
পড়া শেষ হইয়া গেল। কেদারবাবু অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, কিন্তু এ কি আমাদের সুরেশ বলেই তোমার মনে হয়?
অচলা শান্তভাবে বলিল, হাঁ বাবা, ইনি আমাদেরই সুরেশবাবু।
কেদারবাবু আর একবার চমকিয়া উঠিলেন। বোধ করি, নিজের অজ্ঞাতসারেই অচলার মুখ দিয়া এই ‘আমাদেরই’ কথাটার উপর একবার একটা অতিরিক্ত জোর প্রকাশ পাইয়াছিল। হয়ত সে শুধু একটা নিশ্চিত বিশ্বাস জানাইবার জন্যই, কিন্তু কেদারবাবুর বুকের মধ্যে তাহা আর একবার বাজিয়া উঠিল; এবং মজ্জমান ব্যক্তি যেভাবে তৃণ অবলম্বন করিতে দুই বাহু বাড়াইয়া দেয়, ঠিক তেমনি করিয়া বৃদ্ধ পিতা কন্যার মুখের এই একটিমাত্র কথাকেই নিবিড় আগ্রহে বুকে চাপিয়া ধরিলেন। এই একটি কথাই তাঁহার কানে কানে, চক্ষের নিমিষে কত কি অসম্ভব সম্ভাবনার দ্বারোদ্ঘাটনের সংবাদ শুনাইয়া গেল, তাহার সীমা রহিল না। তাঁহার মুখখানা আজ এতদিন পরে অকস্মাৎ আশার আনন্দে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। বলিলেন, আচ্ছা মা, তোমার কি মনে হয় না যে—
পিতাকে সহসা থামিতে দেখিয়া অচলা মুখপানে চাহিয়া কহিল, কি মনে হয় না বাবা?
কেদারবাবু সাবধানে অগ্রসর হইবার জন্য মুখের কথাটা চাপিয়া গিয়া বলিলেন, তোমার কি মনে হয় না যে, সুরেশ যে ব্যবহার আমাদের সঙ্গে করে গেল, তার জন্য সে বিশেষ অনুতপ্ত?
অচলা তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া বলিল, আমার তা নিশ্চয় মনে হয় বাবা।
কেদারবাবু প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, নিশ্চয়! নিশ্চয়! এক শ-বার। তা না হলে সে এভাবে পালাত না—কোথাকার একটা তুচ্ছ স্ত্রীলোককে বাঁচাতে আগুনের মধ্যে ঢুকত না। আমার নিশ্চয় বোধ হচ্ছে, সে শুধু অনুতাপে দগ্ধ হয়েই নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে গিয়াছিল। সত্য কি না বল দেখি মা!
অচলা পিতার ঠিক জবাবটা এড়াইয়া গিয়া ধীরে ধীরে কহিল, শুনেছি, পরকে বাঁচাতে এইরকম আরও দু-একবার তিনি নিজের প্রাণ বিপদাপন্ন করেছিলেন।
কথাটা কেদারবাবুর তেমন ভাল লাগিল না। বলিলেন, সে আলাদা কথা অচলা। কিন্তু এ যে আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দেওয়া! এ যে নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা! দুটোর প্রভেদ দেখতে পাচ্চ না?
অচলা আর প্রতিবাদ না করিয়া বলিল, তা বটে। কিন্তু যারা মহৎপ্রাণ, তাঁদের যে-কোন অবস্থাতেই, পরের বিপদে নিজের বিপদ মনে থাকে না—
কেদারবাবু উৎসাহে লাফাইয়া উঠিলেন। দৃপ্তকণ্ঠে বলিলেন, ঠিক, ঠিক! তাই ত তোকে বলচি অচলা—সে একটা মহৎপ্রাণ। তার সঙ্গে কি আর কারো তুলনা চলে! এত লোক ত আছে, কিন্তু কে কারে পাঁচ-পাঁচ হাজার টাকা একটা কথায় ফেলে দিতে পারে, বল দেখি! সে যাই কেন না করে থাক, বড় দুঃখেই করে ফেলেচে—এ আমি তোমাকে শপথ করে বলতে পারি।
কিন্তু শপথের কিছুমাত্র প্রয়োজন ছিল না। এ সত্য অচলা নিজে যত জানিত, তিনি তাহার শতাংশের একাংশও জানিতেন না। কিন্তু জবাব দিতে পারিল না—নিমিষের লজ্জা পাছে তাহার মুখে ধরা পড়ে, এই ভয়ে তাড়াতাড়ি ঘাড় হেঁট করিয়া মৌন হইয়া রহিল। কিন্তু বৃদ্ধের সতৃষ্ণ-দৃষ্টির কাছে তাহা ফাঁকি পড়িল না। তিনি পুলকিত-চিত্তে বলিতে লাগিলেন, মানুষ ত দেবতা নয়—সে যে মানুষ! তার দেহ দোষে-গুণে জড়ানো; কিন্তু তাই বলে ত তার দুর্বল মুহূর্তের উত্তেজনাকে তার স্বভাব বলে ধরে নেওয়া চলে না! বাইরের লোক যে যা ইচ্ছে বলুক অচলা, কিন্তু আমরাও যদি এইটেকেই দোষ বলে বিচার করি, তাদের সঙ্গে আমাদের তফাত থাকে কোন্খানে বল দেখি? বড়লোক ত ঢের আছে, কিন্তু এমন করে দিতে জানে কে? কি লিখেচে ওইখানটায় আর-একবার পড় দেখি মা! আগুনের ভেতর থেকে তাকে নিরাপদে বার করে নিয়ে এল! ওঃ কি মহৎপ্রাণ! দেবতা আর বলে কাকে! বলিয়া তিনি দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিলেন।
অচলা তেমনি নিরুত্তর অধোমুখে বসিয়া রহিল।
কেদারবাবু ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে বসিয়া থাকিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, আচ্ছা, আমাদের একখানা টেলিগ্রাফ করে কি তার খবর নেওয়া উচিত নয়? তার এ বিপদের দিনেও কি আমাদের অভিমান করা সাজে?
এবার অচলা মুখ তুলিয়া কহিল, কিন্তু আমরা ত তাঁর ঠিকানা জানিনে বাবা।
কেদারবাবু বলিলেন, ঠিকানা! ফয়জাবাদ শহরে এমন কেউ কি আছে যে আমাদের সুরেশকে আজ চেনে না? তার ওপর আমার রাগ খুবই হয়েছিল, কিন্তু এখন আর আমার কিছু মনে নেই। একখানা টেলিগ্রাম লিখে এখ্খুনি পাঠিয়ে দাও মা; আমি তার সংবাদ জানবার জন্যে বড় ব্যাকুল হয়ে উঠেছি।
এখুনি দিচ্চি বাবা, বলিয়া সে একখানা টেলিগ্রাফের কাগজ আনিতে ঘরের বাহির হইয়া একেবারে সুরেশের সম্মুখেই পড়িয়া গেল।
অন্তরে গভীর দুঃখ বহন করার ক্লান্তি এত শীঘ্র মানুষের মুখকে যে এমন শুষ্ক, এমন শ্রীহীন করিয়া দিতে পারে, জীবনে আজ অচলা এই প্রথম দেখিতে পাইয়া চমকাইয়া উঠিল। খানিকক্ষণ পর্যন্ত কাহারও মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। তার পরে সে-ই কথা কহিল। বলিল, বাবা বসে আছেন; আসুন, ঘরে আসুন। ফয়জাবাদ থেকে কবে এলেন? ভাল আছেন আপনি?
অজ্ঞাতসারে তাহার কণ্ঠস্বরে যে কতখানি স্নেহের বেদনা প্রকাশ পাইল, তাহা সে নিজে টের পাইল না; কিন্তু সুরেশ একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িবার মত হইল; কিন্তু তবুও আজ সে তাহার বিগত দিনের কঠোর শিক্ষাকে নিষ্ফল হইতে দিল না। সেই দুটি আরক্ত পদতলে তৎক্ষণাৎ জানু পাতিয়া বসিয়া পড়িয়া, তাহার অগাধ দুষ্কৃতির সমস্তটুকু নিঃশেষে উজাড় করিয়া দিবার দুর্জয় স্পৃহাকে আজ সে প্রাণপণ-বলে নিবারণ করিয়া লইয়া, সসম্ভ্রমে কহিল, আমার ফয়জাবাদে থাকবার কথা আপনি কি করে জানলেন?
অচলা তেমনি স্নেহার্দ্রস্বরে বলিল, খবরের কাগজে এইমাত্র দেখে বাবা আমাকে টেলিগ্রাফ করতে বলছিলেন। আপনার জন্যে তিনি বড় উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন—আসুন একবার তাঁকে দেখা দেবেন, বলিয়া সে ফিরিবার উপক্রম করিতেই সুরেশ বলিয়া উঠিল, তিনি হয়ত পারেন, কিন্তু তুমি আমাকে কি করে মাপ করলে অচলা?
অচলার ওষ্ঠাধরে একটুখানি হাসির আভা দেখা দিল। কহিল, সে প্রয়োজনই আমার হয়নি। আমি একটি দিনের জন্যেও আপনার ওপর রাগ করিনি—আসুন, ঘরে আসুন।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
সুরেশ যখন জানাইল, সে মহিমের পত্রে বিবাহের সংবাদ পাইয়াই তাড়াতাড়ি চলিয়া আসিয়াছে, তখন কেদারবাবু লজ্জায় চঞ্চল হইয়া উঠিলেন বটে, কিন্তু অচলার মুখের ভাবে কিছুই প্রকাশ পাইল না।
সুরেশ বলিল, মহিমের বিবাহে আমি না এলেই ত নয়, নইলে আরও কিছুদিন হাসপাতালে থেকে গেলেই ভাল হত।
কেদারবাবু উৎকণ্ঠায় পরিপূর্ণ হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হাসপাতালে কেন সুরেশ, সে-রকম ত কিছু—
সুরেশ বলিল, আজ্ঞে না, সে-রকম কিছু নয়—তবে, দেহটা ভাল ছিল না।
কেদারবাবু সুস্থির হইয়া বলিলেন, ভগবানকে সেজন্য শতকোটি প্রণাম করি। অচলা যখন খবরের কাগজ থেকে তোমার অলৌকিক কাহিনী শোনালে সুরেশ, তোমাকে বলব কি—আনন্দে, গর্বে আমার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। মনে মনে বললুম, ঈশ্বর! আমি ধন্য যে—আমি এমন লোকেরও বন্ধু! বলিয়া দু’হাত জোড় করিয়া কপালে স্পর্শ করিলেন। একটুখানি থামিয়া বলিলেন, কিন্তু, তাও বলি বাবা, নিজের প্রাণ বারংবার এমন বিপদাপন্ন করাই কি উচিত? একটা সামান্য প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে এতবড় একটা মহৎ প্রাণই যদি চলে যেত, তাতে কি সংসারের ঢের বেশি ক্ষতি হত না?
ক্ষতি আর কি হত! বলিয়া সুরেশ সলজ্জভাবে মুখ ফিরাইতেই দেখিতে পাইল, অচলা নির্নিমেষ-চক্ষে এতক্ষণ তাহারই মুখের পানে চাহিয়া ছিল—এখন দৃষ্টি আনত করিল।
কেদারবাবু বারংবার বলিতে লাগিলেন, এমন কথা মুখে আনাও উচিত নয়; কারণ আপনার লোকেদের এতে যে কত বড় ব্যথা বুকে বাজে, তার সীমা নেই।
সুরেশ হাসিতে লাগিল, কহিল, আপনার লোক আমার ত কেউ নেই কেদারবাবু! থাকবার মধ্যে আছেন শুধু পিসিমা,—আমি গেলে সংসারে তাঁরই যা-কিছু কষ্ট হবে।
তাহার মুখের হাসি সত্ত্বেও তাহার কেহ নাই শুনিয়া কেদারবাবুর শুষ্ক চক্ষু সজল হইয়া উঠিল, বলিলেন, শুধু কি পিসিমাই দুঃখ পাবেন সুরেশ? তা নয় বাবা, এ বুড়োও বড় কম শোক পাবে না। তা সে যাক, অন্ততঃ আমি যে ক’টা দিন বেঁচে আছি, সে ক’টা দিন নিজের শরীরে একটু যত্ন রেখো সুরেশ, এই আমার একান্ত অনুরোধ।
ঘড়িতে রাত্রি দশটা বাজিল। বাড়ি ফিরিবার উদ্যোগ করিয়া সুরেশ হঠাৎ হাত জোড় করিয়া বলিল, আমার একটা প্রার্থনা আছে কেদারবাবু, মহিমের বিয়ে ত আমার ওখান থেকেই হবে, স্থির হয়েছে; কিন্তু সে ত পরশু। কাল রাত্রেও এই অধমের বাড়িতেই একবার পায়ের ধুলো দিতে হবে—নইলে বিশ্বাস হবে না যে, আমি ক্ষমা পেয়েচি। বলুন, এ ভিক্ষে দেবেন? বলিয়া সে অকস্মাৎ নিচু হইয়া কেদারবাবুর পায়ের ধুলো লইতে গেল।
কেদারবাবু শশব্যস্ত হইয়া বোধ করি বা তাহাকে জোর করিয়াই নিরস্ত করিতে গিয়াছিলেন—অকস্মাৎ তাহার অস্ফুট কাতরোক্তিতে লাফাইয়া উঠিলেন। পিঠের খানিকটা দগ্ধ হওয়ায় ব্যান্ডেজ করা ছিল, একটা শাল গায়ে দিয়া এতক্ষণ সুরেশ ইহা গোপন করিয়া রাখিয়াছিল। না জানিয়া টানাটানি করিতে গিয়া, তিনি ব্যান্ডেজটাই সরাইয়া ফেলিয়াছিলেন। এখন অনাবৃত ক্ষতের পানে চাহিয়া বৃদ্ধ সভয়ে চিৎকার করিয়া উঠিলেন।
তড়িৎস্পৃষ্টের মত উঠিয়া আসিয়া অচলা ব্যান্ডেজ ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, ভয় কি, আমি ঠিক করে বেঁধে দিচ্চি। বলিয়া তাহাকে ও-ধারের সোফার উপর বসাইয়া দিয়া, সযত্নে সাবধানে ব্যান্ডেজটা যথাস্থানে বাঁধিয়া দিতে প্রবৃত্ত হইল।
কেদারবাবু তাঁহার চৌকির উপর ধপ্ করিয়া চোখ বুজিয়া বসিয়া পড়িলেন—বহুক্ষণ পর্যন্ত আর তাঁহার কোনরূপ সাড়া-শব্দ রহিল না। কৌচের পিঠের উপর দুই কনুইয়ের ভর দিয়া পিছনে দাঁড়াইয়া অচলা নিঃশব্দে ব্যান্ডেজ বাঁধিতেছিল। দেখিতে দেখিতে তাহার দুই চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল এবং অনতিকাল পরেই মুক্তার আকারে একটির পর একটি নীরবে ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। সুরেশ ইহার কিছুই দেখিতে পাইল না; এদিকে তাহার খেয়ালই ছিল না। সে শুধু নিমীলিতচক্ষে স্থির হইয়া বসিয়া, তাহার অসীম প্রেমাস্পদের কোমল হাত-দু’খানির করুণ স্পর্শ বুকের ভিতর অনুভব করিতে লাগিল।
কোনমতে চোখের জল মুছিয়া ফেলিয়া অচলা এক সময়ে চুপি চুপি বলিল, আজ আমার কাছে আপনাকে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
সুরেশ ধ্যান ভাঙ্গিয়া চকিত হইয়া উঠিল; কিন্তু সেও তেমনি মৃদুস্বরে প্রশ্ন করিল, কি প্রতিজ্ঞা?
এমন করে নিজের প্রাণ আপনি নষ্ট করতে পারবেন না।
কিন্তু প্রাণ ত আমি ইচ্ছে করে নষ্ট করতে চাইনে! শুধু পরের বিপদে আমার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না—এ যে আমার ছেলেবেলার স্বভাব, অচলা।
অচলা তাহার প্রতিবাদ করিল না; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে যে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপিয়া ফেলিল, সুরেশ তাহা টের পাইল। বাঁধা শেষ হইয়া গেলে সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া ধীরে ধীরে বলিল, কাল কিন্তু এ দীনের বাড়িতে একবার পায়ের ধুলো দিতে হবে—তাহার দু’ চক্ষু ছলছল করিয়া উঠিল; কিন্তু কণ্ঠস্বরে ব্যাকুলতা প্রকাশ পাইল না।
অচলা অধোমুখে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আচ্ছা।
সুরেশ কেদারবাবুকে নমস্কার করিয়া হাসিয়া বলিল, দেখবেন, আমাকে নিরাশ করবেন না যেন। বলিয়া অচলার মুখের পানে চাহিয়া, আর একবার তাহার আবেদন নিঃশব্দে জানাইয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।
পরদিন যথাসময়ে সুরেশের গাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। কেদারবাবু প্রস্তুত হইয়াই ছিলেন, কন্যাকে লইয়া নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে যাত্রা করিলেন।
সুরেশের বাটীর গেটের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কেদারবাবু অবাক হইয়া গেলেন। সে বড়লোক, ইহা ত জানা কথা, কিন্তু তাহা যে কতখানি—শুধু আন্দাজের দ্বারা নিশ্চয় করা এতদিন কঠিন হইতেছিল; আজ একেবারে সে বিষয়ে নিঃসংশয় হইয়া বাঁচিলেন।
সুরেশ আসিয়া অভ্যর্থনা করিয়া উভয়কে গ্রহণ করিল; হাসিয়া বলিল, মহিমের গোঁ আজও ভাঙতে পারা গেল না কেদারবাবু। কাল দুপুরের আগে এ বাড়িতে ঢুকতে সে কিছুতেই রাজি হলো না।
কেদারবাবু সে কথার কোন জবাবও দিলেন না। তিনজনে বসিবার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিতেই একজন প্রৌঢ়া রমণী দ্বারের অন্তরাল হইতে বাহির হইয়া অচলার হাত ধরিয়া তাহাকে বাড়ির ভিতরে লইয়া গেলেন। তাঁহার নিজের ঘরের মেজের উপর একখানি কার্পেট বিছান ছিল, তাহারই উপর অচলাকে সযত্নে বসাইয়া আপনার পরিচয় দিলেন। বলিলেন, আমি সম্পর্কে তোমার শাশুড়ি হই বৌমা। আমি মহিমের পিসি।
অচলা প্রণাম করিয়া পায়ের ধুলা লইয়া সবিস্ময়ে তাঁহার মুখপানে চাহিয়া কহিল, আপনি এখানে কবে এলেন?
মহিমের যে পিসি ছিলেন, তাহা সে জানিত না। প্রৌঢ়া তাহার বিস্ময়ের কারণ অনুমান করিয়া, হাসিয়া কহিলেন, আমি এইখানেই থাকি মা, আমি সুরেশের পিসি; কিন্তু মহিমও পর নয়, তাই তারও আমি পিসি হই মা।
তাঁহার স্বভাব-কোমল কণ্ঠস্বরে এমনই একটা স্নেহ ও আন্তরিকতা প্রকাশ পাইল যে, একমুহূর্তেই অচলার বুকের ভিতরটা আলোড়িত হইয়া উঠিল। তাহার মা নাই, সে অভাব এতটুকু পূর্ণ করে, বাড়িতে এমন কোন আত্মীয় স্ত্রীলোক কোনদিন নাই। তাহার জ্ঞান হওয়া পর্যন্ত এতদিন সে পিতার স্নেহেই মানুষ হইয়া উঠিয়াছে; কিন্তু সে স্নেহ যে তাহার হৃদয়ের কতখানি খালি ফেলিয়া রাখিয়াছিল, তাহা একমুহূর্তেই সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল—আজ পরের বাড়ির পরের পিসিমা যখন ‘বৌমা’ বলিয়া ডাকিয়া তাহাকে আদর করিয়া কাছে বসাইলেন। প্রথমটা যে অভিনব সম্বোধনে একটুখানি লজ্জিত হইয়া পড়িল; কিন্তু ইহার মাধুর্য, ইহার গৌরব তাহার নারী-হৃদয়ের গভীর অন্তস্তলে বহুক্ষণ পর্যন্ত ধ্বনিত হইতে লাগিল।
দেখিতে দেখিতে দু’জনের কথা জমিয়া উঠিল। অচলা লজ্জিতমুখে প্রশ্ন করিল, আচ্ছা পিসিমা, আমাকে যে আপনি কাছে বসালেন, কৈ ব্রাহ্ম-মেয়ে বলে ত ঘৃণা করলেন না!
পিসিমা তাড়াতাড়ি আপনার অঙ্গুলির প্রান্ত দ্বারা তাহার চুম্বন গ্রহণ করিয়া বলিলেন, তোমাকে ঘৃণা করব কেন মা? একটু হাসিয়া কহিলেন, আমরা হিন্দুর মেয়ে বলে কি এমন নির্বোধ, এত হীন বৌমা, যে, শুধু ধর্মমত আলাদা বলে তোমার মত মেয়েকেও কাছে বসাতে সঙ্কোচবোধ করব? ঘৃণা করা ত অনেক দুরের কথা মা!
অচলা অত্যন্ত লজ্জা পাইয়া বলিল, আমাকে মাপ করুন পিসিমা, আমি জানতুম না। আমাদের সমাজের বাইরে কোন মেয়েমানুষের সঙ্গেই কোনদিন আমি মিশতে পাইনি; শুধু শুনেছিলুম যে, তাঁরা আমাদের বড় ঘৃণা করেন; এমন কি, একসঙ্গে বসলে দাঁড়ালেও তাঁদের স্নান করতে হয়।
পিসিমা বলিলেন, সেটা ঘৃণা নয় মা, সে একটা আচার। আমাদের বাইরের আচরণ দেখে হয়ত তোমাদের অনেক সময় এই কথাই মনে হবে, কিন্তু সত্যি বলচি মা, সত্যিকারের ঘৃণা—আমরা কাউকে করিনে। আমাদের দেশের বাড়িতে আজও আমার বাগদী-জেঠাইমা বেঁচে আছে—তাকে কত যে ভালবাসি, তা বলতে পারিনে।
একটুখানি থামিয়া বলিলেন, আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি মা তোমাকে—এ কি সুরেশের মুখ থেকে শুনে, না আজ তোমার আমাকে দেখে এ কথা মনে পড়ল?
সুরেশের উল্লেখে অচলা ধীরে ধীরে বলিল, অনেকদিন আগে একবার তিনিও বলেছিলেন বটে।
পিসিমা বলিলেন, ঐ ওর স্বভাব। একটা মনে হলে আর রক্ষে নেই—ও তাই চারিদিকে বলে বেড়াবে। কোনদিন ব্রহ্মদের সঙ্গে না মিশেই ও ভেবে নিলে, তাদের ও ভারী ঘৃণা করে। এই নিয়ে মহিমের সঙ্গে ওর কতদিন ঝগড়া হবার উপক্রম হয়ে গেছে। কিন্তু আমি ত তাকে একরকম মানুষ করেচি, আমি জানি সে কাউকে ঘৃণা করে না—করবার সাধ্যও ওর নেই। এই দেখ না মা, যেদিন থেকে সে তোমাদের দেখলে, সেদিন থেকে—
কিন্তু কথাটা শেষ করিতে পারিলেন না, অচলার মুখের প্রতি দৃষ্টি পড়ায় হঠাৎ মাঝখানেই থামিয়া গেলেন। তিনি তাহাদের সম্বন্ধে কতদূর জানিয়াছেন, তাহা বুঝিতে না পারিলেও অচলার সন্দেহ হইল যে, অন্ততঃ কতকটা পিসিমার অবিদিত নাই। ক্ষণকালের জন্য উভয়েই মৌন হইয়া রহিল; অচলা নিজের জন্য লজ্জাটাকে কোনমতে দমন করিয়া অন্য কথা পাড়িল। জিজ্ঞাসা করিল, পিসিমা, আপনিই কি তবে সুরেশবাবুকে মানুষ করেছিলেন?
পিসিমা আবেগে পরিপূর্ণ হইয়া বলিলেন, হাঁ মা, আমিই তাকে মানুষ করেছি। দু’বছর বয়সে ও মা-বাপ হারিয়েছিল। আজও আমার সে কাজ সারা হয়নি—আজও সে বোঝা মাথা থেকে নামেনি, কারুর দুঃখ-কষ্ট কারুর আপদ-বিপদ ও সহ্য করতে পারে না, প্রাণের আশা-ভরসা ত্যাগ করে তার বিপদের মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কত ভয়ে ভয়ে দিন-রাত থাকি বৌমা, সে তোমাকে আর বলতে পারিনে।
অচলা আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, ফয়জাবাদের ঘটনাটা শুনেছেন?
পিসিমা ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, শুনেছি বৈ কি মা! ভগবানকে তাই সদাই বলি, ঠাকুর, আমি বেঁচে থাকতে যেন আমাকে আর সে দেখা দেখিয়ো না—মাথায় পা দিয়ে একেবারে আমাকে রসাতলে ডুবিয়ে দিয়ো না। এ আমি কোনমতে সহ্য করতে পারব না। বলিতে বলিতেই তাঁহার গলা ধরিয়া গেল। তাঁহার সেই মাতৃস্নেহমণ্ডিত মুখের সকাতর প্রার্থনা শুনিয়া অচলার নিজের চোখ-দু’টি সজল হইয়া উঠিল; করুণকণ্ঠে কহিল, আপনি নিষেধ করে দেন না কেন পিসিমা?
পিসিমা চোখের জলের ভিতর দিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, নিষেধ! আমার নিষেধে কি হবে মা? যার নিষেধে সত্যি সত্যি কাজ হবে, আমি তাকেই ত আজ কত বছর থেকে খুঁজে বেড়াচ্চি। কিন্তু সে ত যে-সে মেয়ের কাজ নয়। ওকে বাঁচাতে পারে, তেমন মেয়ে ভগবান না দিলে আমি কোথায় পাব মা?
অচলা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, আপনার মনের মত মেয়ে কি কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না?
পিসিমা কহিলেন, ঐ যে তোমাকে বললুম মা, ভগবান না দিলে কেউ পায় না। যে সুরেশ কখ্খনো এ কথায় কান দেয় না, সে নিজে এসে যেদিন বললে, পিসিমা, এইবার তোমার একটি দাসী এনে হাজির করে দেব, সেদিন আমার যে কি আনন্দ হয়েছিল, তা মুখে জানানো যায় না। মনে মনে আশীর্বাদ করে বললুম, তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক বাবা। সেদিন আমার কবে হবে যে, বৌ-ব্যাটা বরণ করে ঘরে তুলব। কত বললুম, সুরেশ, আমাকে একবার দেখিয়ে নিয়ে আয়, কিন্তু কিছুতেই রাজি হল না, হেসে বললে, পিসিমা, আশীর্বাদের দিন একেবারে গিয়ে দিনস্থির করে এসো। তার পর হঠাৎ একদিন শুধু এসে বললে, সুবিধে হল না পিসিমা, আমি রাত্রির গাড়িতে পশ্চিমে চললুম। কত জিজ্ঞাসা করলুম, কিসের অসুবিধে আমাকে খুলে বল্, কিন্তু কোন কথাই বললে না, সেই রাত্রেই চলে গেল। মনে মনে ভাবলুম, শুধু আমার ছেলের ইচ্ছেতেই ত আর হতে পারে না—সে মেয়েরও ত জন্ম-জন্মান্তরের তপস্যা থাকা চাই! কি বল মা?
অচলা নীরবে ঘাড় নাড়িল। এতক্ষণে সে টের পাইল—মেয়েটি যে কে, পিসিমা তাহা জানেন না। তাহার একবার মনে হইল বটে—তাহার বুকের উপর হইতে একটা পাথর নামিয়া গেল—কিন্তু পাথরখানা যে সহজে যায় নাই, বুকের অনেকখানি ছিঁড়িয়া পিষিয়া দিয়া গিয়াছে, তাহা পরক্ষণেই আবার যেন স্পষ্ট অনুভব করিতে লাগিল।
আহারের আয়োজন হইলে পিসিমা অচলাকে আলাদা বসাইয়া খাওয়াইলেন এবং সঙ্গে করিয়া বাড়ির প্রত্যেক কক্ষ, প্রতি জিনিসপত্র ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখাইয়া আনিয়া, সহসা একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, মা, ভগবানের আশীর্বাদে অভাব কিছুরই নেই—কিন্তু এ যেন সেই লক্ষ্মীহীন বৈকুণ্ঠ। মাঝে মাঝে চোখে জল রাখতে পারিনে বৌমা।
চাকর আসিয়া খবর দিয়া গেল, বাহিরে কেদারবাবু যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছেন। অচলা প্রণাম করিয়া পায়ের ধূলা লইতেই পিসিমা তাহার একটা হাত ধরিয়া একবার একটু দ্বিধা করিয়া চুপি চুপি বলিলেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, যদি কিছু না মনে কর মা!
অচলা তাঁহার মুখপানে চাহিয়া শুধু একটুখানি হাসিল।
পিসিমা বলিলেন, সুরেশের কাছে তোমার আর মহিমের সমস্ত কথা আমি শুনতে পেয়েচি মা। তার মুখেই শুনতে পেলুম, সে গরীব বলে নাকি তোমার বাবার ইচ্ছে ছিল না। শুধু তোমার জন্যেই—
অচলা ঘাড় হেঁট করিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, সত্যি পিসিমা।
পিসিমা অকস্মাৎ যেন উচ্ছ্বসিত আবেগে অচলার হাত দুখানি চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, এই ত চাই মা! যাঁকে ভালবেসেচ তাঁর কাছে টাকাকড়ি, ধনদৌলত কতটুকু? মনে কোন ক্ষোভ রেখো না মা। আমি মহিমকে খুব জানি, সে এমনি ছেলে, যত কেন না দুঃখ তার জন্যে পাও—একদিন ভগবানের আশীর্বাদে সমস্ত সার্থক হবে। তিনি এত বড় ভালবাসার কিছুতেই অমর্যাদা করতে পারবেন না, এ আমি তোমাকে নিশ্চয় বলচি।
অচলা আর একবার হেঁট হইয়া তাঁহার পায়ের ধূলা লইল।
তিনি তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া চুম্বন করিয়া মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, আহা, এমনি একটি বৌ নিয়ে যদি আমি ঘর করতে পেতুম!
সুরেশ আসিয়া উভয়কে গাড়িতে তুলিয়া দিয়া নিঃশব্দে নমস্কার করিয়া ফিরিয়া গেল। যাবার সময় লণ্ঠনের আলোকে পলকের জন্য তাহার মুখখানা অচলার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। সে মুখে যে কি ছিল, তাহা জগদীশ্বর জানেন, কিন্তু অদম্য বাষ্পোচ্ছ্বাস তাহার কণ্ঠ পর্যন্ত ঠেলিয়া উঠিল, জুড়ি-গাড়ি দ্রুতপদে পথে আসিয়া পড়িল। রাস্তার জনস্রোত তখন মন্দীভূত হইয়াছে, সেইদিকে চাহিয়া তাহার হঠাৎ মনে হইল, এতক্ষণ সে যেন একটা মস্ত স্বপ্ন দেখিতেছিল। তাহা সুখের কিংবা দুঃখের তাহা বলা শক্ত। কেদারবাবু এতক্ষণ মৌন হইয়াই ছিলেন—বোধ করি সুরেশের ঐশ্বর্যের চেহারাটা তাঁহার মাথার মধ্যে ঘুরিতেছিল; সহসা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, হাঁ, বড়লোক বটে!
মেয়ের তরফ হইতে কিন্তু এতটুকু সাড়া পাওয়া গেল না। উৎসাহের অভাবে বাকি পথটা তিনি চুপ করিয়াই রহিলেন।
গাড়ি আসিয়া যখন তাঁহার দ্বারে লাগিল এবং সহিস কবাট খুলিয়া দিয়া সরিয়া দাঁড়াইল, তখন আর একবার যেন তাঁহার চমক ভাঙ্গিয়া গেল। আবার একটা নিশ্বাস ফেলিয়া নিজের মনে মনেই বলিলেন, সুরেশকে আমরা কেউ চিনতে পারিনি! একটা দেবতা!
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
আজ অচলার বিবাহ। বিবাহ-সভার পথে পলকের জন্য সুরেশকে দেখা গিয়াছিল। তাহার পরে সে যে কোথায় অন্তর্ধান হইয়া গেল, সারা রাত্রির মধ্যে কেদারবাবুর বাটীতে আর তাহার উদ্দেশ পাওয়া গেল না।
বিবাহ হইয়া গেল। দুই-একটা দিন অচলার মনের মধ্যে বিপ্লব বহিতেছিল। সেই নিমন্ত্রণের রাত্রে সুরেশের পিসিমার কথা সে কোনমতেই ভুলিতে পারিতেছিল না; আজ তাহার নিবৃত্তি হইল।
মহিমের অটল গাম্ভীর্য আজও অক্ষুণ্ণ রহিল। আনন্দ-নিরানন্দের লেশমাত্র বাহ্য-প্রকাশ তাহার মুখের উপর দেখা দিল না। তবুও শুভদৃষ্টির সময় এই মুখ দেখিয়াই অচলার সমস্ত বক্ষ আনন্দে মাধুর্যে পরিপূর্ণ হইয়া গেল। অন্তরের মধ্যে স্বামীর পদতলে মাথা পাতিয়া মনে মনে বলিল, প্রভু, আর আমি ভয় করিনে। তোমার সঙ্গে যেখানে যে অবস্থায় থাকিনে কেন, সেই আমার স্বর্গ; আজ থেকে চিরদিন তোমার কুটীরই আমার রাজপ্রাসাদ।
শ্বশুরবাটী যাত্রার দিন কেদারবাবু জামার হাতায় চোখ মুছিয়া কহিলেন, মা, আশীর্বাদ করি স্বামীর সঙ্গে দুঃখ-দারিদ্র্য বরণ করে জীবনের পথে, কর্তব্যের পথে নির্বিঘ্নে অগ্রসর হও। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করবেন। বলিয়া তেমনি চোখ মুছিতে মুছিতে পাশের ঘরে প্রবেশ করিলেন।
তাহার পরে, শ্রাবণের এক স্বল্পালোকিত দ্বিপ্রহরে মাথার উপর ক্ষান্ত-বর্ষণ মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ও নীচে সঙ্কীর্ণ কর্দমাচ্ছন্ন পিচ্ছিল গ্রাম্য পথ দিয়া পালকি চড়িয়া অচলা একদিন স্বামিগৃহে আসিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু এই পথটুকুর মধ্যেই যেন তাহার নব-বিবাহের অর্ধেক সৌন্দর্য তিরোহিত হইয়া গেল।
পল্লীগ্রামের সহিত তাহার ছাপার অক্ষরের ভিতর দিয়াই পরিচয় ছিল। সে পরিচয়ে দুঃখ-দারিদ্র্যের সহস্র ইঙ্গিতের মধ্যেও ছত্রে ছত্রে কবিতা ছিল, কল্পনার সৌরভ ছিল। পালকি হইতে নামিয়া সে বাড়ির ভিতরে আসিয়া একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিল—কোথাও কোন দিক হইতে কবিত্বের এতটুকু তাহার হৃদয়ে আঘাত করিল না। তাহার কল্পনার পল্লীগ্রাম সাক্ষাৎ-দৃষ্টিতে যে এমনি নিরানন্দ, নির্জন—মেটেবাড়ির ঘরগুলা যে এরূপ স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার জানালা-দরজা যে এতই সঙ্কীর্ণ ক্ষুদ্র—উপরে বাঁশের আড়া ও মাচা এত কদাকার—ইহা সে স্বপ্নেও ভাবিতে পারিত না। এই কদর্য গৃহে জীবন-যাপন করিতে হইবে—উপলব্ধি করিয়া তাহার বুক যেন ভাঙ্গিয়া পড়িতে চাহিল। স্বামিসুখ, বিবাহের আনন্দ সমস্তই একমুহূর্তে মায়ামরীচিকার মত তাহার হৃদয় হইতে বিলীন হইয়া গেল। বাটীতে শ্বশুর-শাশুড়ি জা-ননদ কেহই ছিল না। দূরসম্পর্কের এক ঠানদিদি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হইয়া বর-বধূ বরণ করিয়া ঘরে তুলিবার জন্য ও-পাড়া হইতে আসিয়াছিলেন। তিনি বিবাহের আজন্ম-পরিচিত সাজসজ্জার একান্ত অভাব লক্ষ্য করিয়া অব্যক্ত-বিস্ময়ে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন ; অবশেষে বধূর হাত ধরিয়া তাহাকে ঘরে আনিয়া বসাইয়া দিলেন। পাড়ার যাহারা বধূ দেখিতে ছুটিয়া আসিল, তাহারা অচলার বয়স অনুমান করিয়া মুখ চাওয়া-চাওয়ি, গা টেপাটেপি করিল এবং প্রত্যাগমনকালে তাহাদের অস্ফুট কলরবের মধ্যে ‘বেহ্ম’ ‘মেলেচ্ছ’ প্রভৃতি দুই-একটা মিষ্ট কথা আসিয়াও অচলার কানে পৌঁছিল।
অনতিবিলম্বেই গ্রামময় রাষ্ট্র হইয়া পড়িল যে, কথাটা সত্য যে, মহিম ম্লেচ্ছ-কন্যা বিবাহ করিয়া ঘরে আনিয়াছে। বিবাহের পূর্বেই এইপ্রকার একটা জনশ্রুতির কিছু কিছু আন্দোলন ও আলোচনা হইয়া গিয়াছিল; এখন বৌ দেখিয়া কাহারও বিন্দুমাত্র সংশয় রহিল না যে, যাহা রটিয়াছিল, তাহা ষোল-আনাই খাঁটি।
প্রতিবেশিনীরা প্রস্থান করিলে ঠানদিদি আসিয়া কহিলেন, নাতবৌ, আজ তা হলে আসি দিদি। অনেকটা দূর যেতে হবে, আর ঘরে না গেলেও নয় কিনা—ছোট নাতিটি—ইত্যাদি বলিতে বলিতে তিনি অনুরোধ-উপরোধের অবকাশমাত্র না দিয়াই চলিয়া গেলেন। তিনি যে এতক্ষণ শুধু একটা সম্বন্ধ স্মরণ করিয়াই যাইতে পারেন নাই এবং সেজন্য মনে মনে ছটফট করিতেছিলেন, অচলা তাহা বুঝিয়াছিল। বস্তুতঃ ঠানদিদির অপরাধ ছিল না। ব্যাপারটা যথার্থই এরূপ দাঁড়াইবে তাহা জানিলে হয়ত তিনি এদিক মাড়াইতেন না। কারণ পাড়াগাঁয়ে বাস করিয়া এ-সকল জিনিসকে ভয় করে না, এত বড় বুকের পাটা পল্লী-ইতিহাসে সুদুর্লভ।
ঠানদিদি অন্তর্ধান করিলে, বাড়ির যদু চাকর ও উড়ে বামুন এবং কলিকাতা হইতে সদ্য আগত অচলার বাপের বাড়ির দাসী হরির মা ভিন্ন সমস্ত বিবাহের বাড়িটা শূন্য খাঁ-খাঁ করিতে লাগিল। কিছুক্ষণের জন্য বৃষ্টির বিরাম হইয়াছিল, পুনরায় ফোঁটা ফোঁটা করিয়া পড়িতে শুরু করিল। হরির মা কাছে আসিয়া ধীরে ধীরে কহিল, এমন বাড়ি ত দেখিনি দিদি, কেউ যে কোথাও নেই—
অচলা অধোমুখে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ছিল, অন্যমনস্কের মত শুধু কহিল, হুঁ—
হরির মা পুনরপি কহিল, জামাইবাবুকেও ত দেখচি নে, সেই যে একটিবার দেখা দিয়ে কোথায় গেলেন—
অচলা এ কথার জবাবও দিল না।
কিন্তু এই বনজঙ্গলপরিবৃত শূন্যপুরীর মধ্যে হরির মার নিজের চিত্ত যত উদ্ভ্রান্ত হইয়া উঠুক, অচলাকে ছেলেবেলা হইতে মানুষ করিয়াছে, তাহাকে একটুখানি সচেতন করিবার জন্য কহিল, ভয় কি! সত্যই ত আর জলে এসে পড়িনি! জামাইবাবু এসে পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ততক্ষণ এ-সব ছেড়ে ফেল দিদি, আমি তোরঙ্গ খুলে কাপড়-জামা বার করে দি—
এখন থাক হরির মা, বলিয়া অচলা তেমনি অধোমুখে কাঠের মূর্তির মত বসিয়া রহিল। জীবনের সমস্ত স্বাদ-গন্ধ তাহার অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছিল।
বৃষ্টি চাপিয়া আসিল। সেই বর্ধিত-বেগ বারিধারার মধ্যে কখন যে দিনশেষের অত্যল্প আলোক নিবিয়া গেল, কখন শ্রাবণের গাঢ় মেঘাস্তীর্ণ আকাশ ভেদ করিয়া মলিন পল্লীগৃহে সন্ধ্যা নামিয়া আসিল, কিছুই ঠাহর হইল না। শুধু আনন্দ-লেশহীন আঁধার ঘরের কোণে কোণে আর্দ্র অন্ধকার নিঃশব্দে গাঢ়তর হইয়া উঠিতে লাগিল। যদু চাকর আসিয়া হ্যারিকেন লণ্ঠন ঘরের মাঝখানে রাখিয়া দিল। হরির মা প্রশ্ন করিল, জামাইবাবু কোথায় গো?
কি জানি, বলিয়া যদু ফিরিতে উদ্যত হইল। তাহার সংক্ষিপ্ত ও বিশ্রী উত্তরে হরির মা শঙ্কিত হইয়া কহিল, কি জনি কি-রকম? বাইরে তিনি নেই নাকি?
না, বলিয়া যদু প্রস্থান করিল। সে যে আগন্তুকদিগের প্রতি প্রসন্ন নয়, তাহা বেশ বুঝা গেল। হরির মা অত্যন্ত ভীত হইয়া অচলার কাছে সরিয়া আসিয়া ভয়ব্যাকুলকণ্ঠে কহিল, রকম-সকম আমার ত ভাল ঠেকছে না দিদি। দোরে খিল দিয়ে দেব?
অচলা আশ্চর্য হইয়া কহিল, খিল দিবি কেন?
হরির মা ছেলেবেলায় দেশ ছাড়িয়া কলিকাতায় আসিয়াছে, আর কখনও যায় নাই। পল্লীগ্রামের চোর-ডাকাত, ঠ্যাঙাড়ে প্রভৃতি গল্পের স্মৃতি ছাড়া আর সমস্তই তাহার কাছে ঝাপসা হইয়া গিয়াছে। সে বাহিরের অন্ধকারে একটা চকিতদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া অচলার গা ঘেঁষিয়া চুপি চুপি কহিল, পাড়াগাঁ—বলা যায় না দিদি। বলিতে বলিতেই তাহার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া উঠিল।
ঠিক এমনি সময়ে প্রাঙ্গণের মাঝখান হইতে ডাক আসিল, ঠানদি কোথায় গো? বলিতে বলিতেই একটি কুড়ি-একুশ বৎসরের পাতলা ছিপছিপে মেয়ে জলে ভিজিতে ভিজিতে দোরগোড়ায় আসিয়া উপস্থিত হইল; কহিল, আগে একটা নমস্কার করে নিই ঠানদি, তার পরে কাপড় ছাড়ব এখন, বলিয়া ঘরে ঢুকিয়া অচলার পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিল, এবং লণ্ঠনটা অচলার মুখের কাছে তুলিয়া ধরিয়া ক্ষণকাল একদৃষ্টে নিরীক্ষণ করিয়া চিৎকার করিয়া ডাক দিল, সেজদা, ও সেজদা—
মহিম বাটী পৌঁছিয়াই এই মেয়েটিকে নিজে আনিতে গিয়াছিল। ও-ঘর হইতে সাড়া দিল, কি রে মৃণাল?
এদিকে এসো না, বলচি—
মহিম দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া বলিল, কি রে?
মৃণাল লণ্ঠনের আলোকে আর একবার ভাল করিয়া অচলার মুখখানি দেখিয়া লইয়া বলিল, নাঃ—তুমিই জিতেচ সেজদা। আমাকে বিয়ে করলে ঠকে মরতে ভাই।
মহিম বাহির হইতে তাড়া দিয়া কহিল, কিছুতেই আমার কথা শুনবি নে মৃণাল? আবার এই-সব ঠাট্টা? তুই কি আমার কথা শুনবি নে?
বাঃ, ঠাট্টা বৈ কি, অচলার মুখের প্রতি চাহিয়া মুচকিয়া হাসিয়া বলিল, ঠানদি, মাইরি বলচি ভাই, তামাশা নয়। আচ্ছা, তোমার বরকেই জিজ্ঞাসা কর—আমাকে এক সময় উনি পছন্দ করেছিলেন কি না!
মহিম কহিল, তবে তুই বকে মর্, আমি বাইরে চললুম।
মৃণাল কহিল, তা যাও না, তোমাকে কি ধরে রেখেচি? অচলার চিবুকটা একবার পরম স্নেহে নাড়িয়া দিয়া কহিল, আচ্ছা ভাই ঠানদি, হিংসে হয় নাকি? এ সংসারে আমারই ত গিন্নী হবার কথা! কিন্তু আমার মা পোড়ারমুখী কি যে মন্তর সেজদার কানে ঢুকিয়ে দিলে—আমি সেজদার দু’ চক্ষের বিষ হয়ে গেলুম। নইলে—ওরে যদু, ঘোষালমশাই গেলেন কোথায়?
যদু কহিল, পুকুরে হাত-পা ধুতে গেছেন।
অ্যাঁ, এই অন্ধকারে পুকুরে? মৃণালের হাসিমুখ একমুহূর্তে দুশ্চিন্তায় ম্লান হইয়া গেল। ব্যস্ত হইয়া কহিল, যদু যা বাবা, আলো নিয়ে একবার পুকুরে। বুড়োমানুষ, এখুনি কোথায় অন্ধকারে পিছলে পড়ে হাত-পা ভাঙবে।
পরক্ষণেই অচলার মুখের পানে চাহিয়া লজ্জিতভাবে হাসিয়া কহিল, কি কপাল করেছিলুম ভাই ঠানদি, কোথাকার এক বাহাত্তুরে বুড়ো ধরে আমাকে দিলে—তার সেবা করতে করতে আর তাকে সামলাতে সামলাতেই প্রাণটা গেল। আচ্ছা ভাই, আগে ও-ঘর থেকে ভিজে কাপড়টা ছেড়ে আসি, তার পরে কথা হবে। কিন্তু সতীন বলে রাগ করতে পাবে না, তা বলে দিচ্চি—আর বল ত, না হয়, আমার বুড়োটাকেও তোমায় ভাগ দেব। বলিয়া হাসির ছটায় সমস্ত ঘরটা যেন আলো করিয়া দিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল।
এই শ্রেণীর ঠাট্টা-তামাশার সহিত অচলার কোনদিন পরিচয় ঘটে নাই। সমস্ত পরিহাসই তাহার কাছে এমনি কুরুচিপূর্ণ ও বিশ্রী ঠেকিতেছিল যে, লজ্জায় সে একেবারে সঙ্কুচিত হইয়া উঠিয়াছিল। এত বড় নির্লজ্জ প্রগল্ভতা যে কোন স্ত্রীলোকের মধ্যে থাকিতে পারে, তাহা সে ভাবিতে পারিত না। সুতরাং সমস্ত রসিকতাই তাহার আজন্মের শিক্ষা ও সংস্কারের ভিত্তিতে গিয়া আঘাত করিতেছিল। কিন্তু তবুও তাহার মনে হইতে লাগিল, ইহার আগমনে তাহার নির্বাসনের অর্ধেক বেদনা যেন তিরোহিত হইয়া গেল; এবং এ কে, কোথা হইতে আসিল, তাহার সহিত কি সম্বন্ধ—সমস্ত জানিবার জন্য অচলা উৎসুক হইয়া উঠিল!
হরির মা কহিল, এ মেয়েটি কে দিদি? খুব আমুদে মানুষ।
অচলা ঘাড় নাড়িয়া শুধু বলিল, হাঁ।
ভিজে কাপড় ছাড়িয়া মৃণাল এ-ঘরে আসিয়া কহিল, কেবল ঠাট্টা-তামাশা করেই গেলুম ঠানদি, আমার আসল পরিচয়টা এখনো দেওয়া হয়নি। আর পরিচয় এমন কি-ই বা আছে? তোমার বর যিনি, তিনি হচ্চেন আমার মায়ের বাপ। আমি তাই ছেলেবেলা থেকে সেজদামশাই বলে ডাকি। বলিয়া একটুখানি স্থির থাকিয়া পুনরায় কহিল, আমার বাবা আর তোমার শ্বশুর—দু’জনে ভারী বন্ধু ছিলেন। হঠাৎ একদিন গাড়ি চাপা পড়ে, ডান হাতটা ভেঙ্গে গিয়ে বাবার যখন চাকরি গেল, তখন তোমার শ্বশুর এই বাড়িতে তাঁদের আশ্রয় দিলেন। তার অনেক পরে আমার জন্ম হয়। সেজদা তখন আট বছরের ছেলে। তাঁর মা ত তাঁর জন্ম দিয়েই মারা যান; বড় দু’ ছেলে আগে ডিপথিরিয়া রোগে মারা গিয়েছিল। তাই আমার মা আসা পর্যন্তই হলেন এ বাড়ির গিন্নী। তার পরে বাবা মারা গেলেন, আমরা এ বাড়িতেই রইলুম। তার অনেক পরে তোমার শ্বশুর মারা গেলেন, আমরা কিন্তু রয়েই গেলুম। এই সবে পাঁচ বছর হল পলাশীর ঘোষাল-বাড়িতে আমার বিয়ে দিয়ে সেজদা আমাকে দূর করে দিয়েছেন। মা বেঁচে থাকলেও যা হোক একটু জোর থাকত।
বড়বৌ এই ঘরে নাকি? বলিয়া একটি বৃদ্ধগোছের বেঁটেখাটো গৌরবর্ণ ভদ্রলোক দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন।
মৃণাল কহিল, এসো, এসো। অচলার পানে চাহিয়া মুখ টিপিয়া হাসিয়া কহিল, ঐটি আমার কর্তা ঠানদি। আচ্ছা, তুমিই বল ত ভাই, ওই বাহাত্তুরে বুড়োর সঙ্গে আমাকে মানায়? এ জন্মের রূপ-যৌবন কি সব মাটি হয়ে গেল না ভাই?
অচলা জবাব দিবে কি, লজ্জায় মাথা হেঁট করিল।
ভদ্রলোকটির নাম ভবানী ঘোষাল। তিনি হাসিয়া কহিলেন, বিশ্বাস করবেন না ঠানদি—সব মিছে কথা। ওর কেবল চেষ্টা—আমাকে খেলো করে দেয়। নইলে, বয়স ত আমার এই সবে বায়ান্ন কি তি—
মৃণাল কহিল, চুপ করো, চুপ করো। এই সেজদাটি যে আমার কি শত্রু, তা ভগবানই জানেন। আমাকে সবদিকে মাটি করেছেন। আচ্ছা, এই বুড়োর হাতে দেওয়ার চেয়ে, হাত-পা বেঁধে কি আমায় জলে ফেলে দেওয়া ভাল হত না ঠানদি? সত্যিই বলো ভাই।
অচলা তেমনি আরক্তমুখে নীরব হইয়াই রহিল।
ঘোষাল ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকিয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া অচলার লজ্জানত মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া সহসা একটা মস্ত আরামের নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, বাঁচালেন ঠানদি, এ ছুঁড়ীর অহঙ্কার এতদিনে ভাঙল। রূপের দেমাকে এ চোখে-কানে দেখতেই পেত না।
স্ত্রীকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, কেমন এইবার হল ত? বনদেশে এতদিন শিয়াল-রাজা ছিলে, শহরের রূপ কারে বলে, এইবার চেয়ে দেখো।
মৃণাল কহিল, তাই বৈ কি! আমার যেখানে অহঙ্কার সেখানে ভাঙতে যায়—সাধ্যি কার? বলিয়া স্বামীর প্রতি সে যে গোপন কটাক্ষ করিল, অচলার চোখে সহসা তাহা পড়িয়া গেল।
ঘোষাল হাসিয়া বলিলেন, শুনলেন ত ঠানদি,—একটু সাবধানে থাকবেন, দুজনের যে ভাব, যে আসা-যাওয়া, বলা যায় না—আর আমি ত বাহাত্তুরে বুড়ো, মাঝে থাকলেই বা কি, আর না থাকলেই বা কি! নিজেরটি সামলে চলবেন—হিতৈষী বুড়োর এই অনুরোধ।
মৃণাল, তোরা কি সারারাত্রি এই নিয়েই থাকবি?
কি করব সেজদা?
একবার রান্নাঘরের দিকেও যাবিনে?
মৃণাল লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, কি ভুল হয়েই গেছে সেজদা, উড়ে বামুনটাকে আমার আগে দেখে আসা উচিত ছিল। আচ্ছা, তোমরা বাইরে যাও, আমরা যাচ্চি।
মহিম জিজ্ঞাসা করিল, আমরা কে?
মৃণাল কহিল, আমি আর ঠানদি। অচলাকে উদ্দেশ করিয়া বলিল, আমি যখন এসেচি, তখন এ সংসারের সমস্ত চার্জ তোমাকে বুঝিয়ে দিয়ে তবে যাবো সেজদি।
মহিম এবং ভবানী বাহিরে চলিয়া গেল। মৃণাল অচলাকে পুনরায় কহিল, আমার দু’দিন আগে আসাই উচিত ছিল। কিন্তু শাশুড়ির হাঁপানির জ্বালায় কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে বেরুতে পারলুম না। আচ্ছা, তুমি কাপড় ছেড়ে প্রস্তুত হও সেজদি, আমি এখ্খুনি ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো। বলিয়া মৃণাল রান্নাঘরের উদ্দেশে প্রস্থান করিল।
তখন বৃষ্টি ধরিয়া গিয়াছিল এবং গাঢ় মেঘ কাটিয়া গিয়া নবমীর জ্যোৎস্নায় আকাশ অনেকটা স্বচ্ছ হইয়া উঠিতেছিল।
রান্নার সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া দিয়া মৃণাল অচলার কাছে আসিয়া বসিল। তাহার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে লইয়া কহিল, ঠানদিদির চেয়ে সেজদি ডাকটা ভালো, কি বল সেজদি?
অচলা মৃদুস্বরে কহিল, হাঁ।
মৃণাল কহিল, সম্পর্কে তুমি বড় হলেও বয়সে আমি বড়। তাই ইচ্ছে হয়, আমাকেও তুমি মৃণালদিদি বলে ডেকো, কেমন?
অচলা কহিল, আচ্ছা।
মৃণাল কহিল, আজ তোমাকে রান্নাঘর দেখিয়ে আনলুম; কিন্তু কাল একেবারে ভাঁড়ারের চাবি আঁচলে বেঁধে দেব, কেমন?
অচলা কহিল, চাবিতে আমার কাজ নেই ভাই।
মৃণাল হাসিয়া কহিল, কাজ নেই? বাপ রে, ও কি কথা! ভাঁড়ারটা কি তুচ্ছ জিনিস সেজদি যে, বলচ—তার চাবিতে কাজ নেই? গিন্নীর রাজত্বের ওই ত হল রাজধানী গো।
অচলা কহিল, হোক রাজধানী, তাতে আমার লোভ নেই। কিন্তু তোমার ওপর আমার ভারী লোভ। শিগ্গির ছেড়ে দিচ্চিনে মৃণালদিদি।
মৃণাল দুই বাহু বাড়াইয়া অচলাকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, সতীনকে ঝাঁটা মেরে বিদায় না করে, ঘরে ধরে রাখতে চাও—এ তোমার কি-রকম বুদ্ধি সেজদি?
অচলা আস্তে আস্তে বলিল, তোমার এই ঠাট্টাগুলো আমার ভাল লাগলো না ভাই। আচ্ছা, এ দেশে সবাই কি এই রকম করে তামাশা করে?
মৃণাল খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। কহিল, না গো ঠানদি, করে না। এ শুধু আমিই করি, সবাই এ জিনিস পাবে কোথায় যে করবে?
অচলা কহিল, পেলেও আমরা মুখে আনতে পারিনে ভাই। আমাদের কলকাতার সমাজে অনেকে হয়ত ভাবতে পর্যন্ত পারে না যে, কোন ভদ্রমহিলা এ-সব মুখে উচ্চারণ করতে পারে।
মৃণাল কিছুমাত্র লজ্জিত হইল না। বরঞ্চ জোর করিয়া অচলাকে আর একবার জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, তোমাদের শহরের ক’জন ভদ্রমহিলা আমার মত এমন করে জড়িয়ে ধরতে পারে, বল ত সেজদি? সবাই বুঝি সব কাজ পারে? এই ত তোমাকে কতক্ষণই বা দেখেচি, এর মধ্যেই মনে হচ্ছে, আমার বোন ছিল না, একটি ছোট বোন পেলুম। আর এ শুধু কথার কথা নয়, সারাজীবন ধরে আমাকে এর প্রমাণ যোগাতে হবে—তা মনে রেখো। এখানে আর ঠাট্টা-তামাশা চলবে না।
অচলা শিক্ষিতা মেয়ে। এই পল্লীগ্রামের বিরুদ্ধসমাজের মধ্যে তাহার ভবিষ্যৎ-জীবন যে কিভাবে কাটিবে, তাহা বাটীতে পা দিয়াই সে বুঝিয়া লইয়াছিল। এ সুযোগ সে সহজে ছাড়িয়া দিল না। পরিহাসকে গাম্ভীর্যে পরিণত করিয়া কহিল, মৃণালদিদি, সত্যই কি এর প্রমাণ তুমি সারা জীবনভোর যোগাতে পারবে?
মৃণাল বলিল, আমরা ত শহরের মহিলা নই ভাই—যোগাতে হবে বৈ কি! যে সত্য তোমাকে ছুঁয়ে করে ফেললুম, সে ত মরে গেলেও আর উলটোতে পারব না!
অচলা এ কথার আর অধিক নাড়াচাড়া না করিয়া অন্য কথা পাড়িল; হাসিয়া কহিল, শিগ্গির পালাবে না, তাও অমনি বল।
মৃণাল হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, বোকা পেয়ে বুঝি ক্রমাগত ফাঁস জড়াতে চাও সেজদি? কিন্তু সে ত আগেই বলেচি ভাই, ভাল করে চার্জ বুঝিয়ে না দিয়ে পালাব না।
অচলা মাথা নাড়িয়া বলিল, চার্জ বুঝে নেবার আমার একতিল আগ্রহ নেই।
মৃণাল বলিল, সেইটে আমি করে দিয়ে তবে যাবো, কিন্তু বেশিদিন আমার ত বাড়ি ছেড়ে থাকবার জো নেই ভাই! জান ত, কত বড় সংসারটি আমার মাথার ওপর।
অচলা ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না, জানিনে।
মৃণাল আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, সেজদা আমার কথা তোমাকে আগে বলেন নি?
অচলা কহিল, না, কোনদিন নয়। তাঁর বাড়িঘর সম্বন্ধে সব কথাই আমাকে জানিয়েছিলেন; কিন্তু যা সকলের আগে জানানো উচিত ছিল, সেই তোমার কথাই কেন যে কখনো বলেন নি, আমার ভারী আশ্চর্য বোধ হচ্ছে মৃণালদিদি!
মৃণাল অন্যমনস্কের মত বলিল, তা বটে।
অচলা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া মৃদুকণ্ঠে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করিল, তোমার সঙ্গে বুঝি ওঁর প্রথম বিয়ের কথা হয়?
মৃণাল তখনও অন্যমনস্ক হইয়া ভাবিতেছিল, কহিল, হাঁ।
অচলা কহিল, তবে হল না কেন? হলেই ত বেশ হত।
এতক্ষণে কথাটা মৃণালের কানের ভিতর গিয়া ঘা দিল। সে অচলার মুখের প্রতি চোখ তুলিয়া বলিল, সে হবার নয় ব’লে হল না।
অচলা তথাপি প্রশ্ন করিল, হবার বাধা কি ছিল? তুমি ত আর সত্যিই তাঁর কোন আত্মীয়া নও? তা ছাড়া, ছেলেবেলায় যে ভালবাসা জন্মায় তাকে উপেক্ষা করাও ত ভালো কাজ নয়!
তাহার প্রশ্নের ধরনে মৃণাল হঠাৎ চমকিয়া উঠিল। ক্ষণকাল স্থিরদৃষ্টিতে অচলার মুখের পানে চাহিয়া থাকিয়া কহিল, এ-সব কি তুমি খুঁজে বেড়াচ্চ সেজদি? তুমি কি মনে কর, ছেলেবেলার সব ভালবাসারই শেষ ফল এই? না, মানুষে বিয়ে দেবার মালিক? এ শুধু এ-জন্মের নয় সেজদি, জন্ম-জন্মান্তরের সম্বন্ধ। আমি যাঁর চিরকালের দাসী, তাঁর হাতে তিনি সঁপে দিয়েছেন। মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কি যায় আসে!
অচলা অপ্রতিভ হইয়া বলিল, সে ঠিক কথা মৃণালদিদি, আমি তাই জিজ্ঞাসা করছিলুম—
কথাটা সে শেষ করিতে পারিল না, সমস্ত মুখ লজ্জায় আরক্ত হইয়া উঠিল। মৃণালের কাছে তাহা অগোচর রহিল না। সে অচলার হাতখানি সস্নেহে মুঠার মধ্যে লইয়া বলিল, সেজদি তুমি শুধু সেদিন স্বামী পেয়েচ, কিন্তু আমি এই পাঁচ বচ্ছর ধরে তাঁর সেবা করচি। আমার এই কথাটা শুনো ভাই, স্বামীর এই দিকটা কোনদিন নিজের বুদ্ধির জোরে আবিষ্কার করবার চেষ্টা করো না। তাতে বরং ঠকাও ঢের ভাল, কিন্তু জিতে লাভ নেই।
যদু বাহির হইতে কহিল, দিদি, বাবুদের খাবার জায়গা হয়েছে।
আচ্ছা চল, আমি যাচ্চি, বলিয়া মৃণাল হঠাৎ দুই হাত বাড়াইয়া অচলার মুখখানা কাছে টানিয়া আনিয়া একটু চুমা খাইয়া দ্রুতপদে উঠিয়া গেল।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
ওলো সেজদি!
অচলা পাশের ঘর হইতে ব্যস্ত হইয়া এ ঘরে আসিয়া পড়িল।
মৃণালের কোমরে আঁচল জড়ানো—সে একটা ছোট দেরাজ একলাই টানাটানি করিয়া সোজা করিয়া রাখিতেছিল। অচলা ঘরে ঢুকিতেই, সে মহা রাগতভাবে চেঁচাইয়া উঠিল, ওরে মুখপোড়া মেয়ে, তুমি নবাবের মত হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে, আর আমি তোমার শোবার ঘর গুছিয়ে দেব? নাও বলচি ওই ঝাঁটাটা তুলে—ঐ কোণটা পরিষ্কার করে ফেল। বলিয়া হাসি আর চাপিতে না পারিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
চেঁচামেচি শুনিয়া হরির মাও পিছনে পিছনে আসিয়াছিল, সে কহিল, তোমার এক-কথা দিদি! বাড়িতে কত গণ্ডা দাসদাসী—দিদিমণির কি কোনদিন ঝাঁটা হাতে করা অভ্যাস আছে নাকি, যে আজ পাড়াগাঁয়ের মেয়েদের মত ঘর ঝাঁট দিতে যাবে? আমি দিচ্চি, বলিয়া সে ঝাঁটাটা তুলিতে যাইতেছিল—মৃণাল কৃত্রিম ক্রোধের স্বরে তাহাকে একটা ধমক দিয়া কহিল, তুই থাম্ মাগী। দিদিমণিকে আমার চেয়ে তুই বেশি চিনিস নাকি যে, সালিসি করতে এসেচিস? বলিয়া অচলার হাতের মধ্যে ঝাঁটা গুঁজিয়া দিয়া হরির মাকে হাসিয়া বলিল, ওরে তোর দিদিমণি ইচ্ছে করলে যে কাজ পারে, তা তোর সাতগণ্ডা পাড়াগাঁয়ের মেয়েতে পারে না। অচলাকে কহিল, নাও ত সেজদি, ঐ কোণটা চট্ করে ঝেড়ে ফেল ত।
অচলা ঝাঁট দিতে প্রবৃত্ত হইয়া কহিল, মৃণালদিদি, তুমি যাদুবিদ্যে জানো, না?
মৃণাল কহিল, কেন বল দেখি?
অচলা বলিল, তা নইলে এই বাড়ি পরিষ্কার করবার জন্য ঝাঁটা হাতে নিয়েচি, এ ভোজবিদ্যে নয় ত কি?
মৃণাল কহিল, তুমি নেবে না ত কে নেবে গো? তোমার বাড়ি ঝাঁট-পাট দেবার জন্যে কি ও-পাড়া থেকে পদির মাসী আসবে নাকি? নাও, কথা কয়ে সময় নষ্ট করতে হবে না, সন্ধ্যা হয়।
অচলা কাজ করিতে করিতে হাসিয়া কহিল, নিজেও একদণ্ড বসবে না, আমাকেও খাটিয়ে খাটিয়ে মারলে, সত্যি বলচি মৃণালদিদি, এই পাঁচ-ছ’দিন যে খাটান আমাকে খাটিয়েচ, চা-বাগানের কর্তারাও বোধ করি তাদের কুলীদের এত করে খাটায় না।
মৃণাল কাছে আসিয়া তাহার চিবুকের উপর আঙুলের একটা ঘা দিয়া বলিল, তাই ত, ঘরদোর দেখে মনে হচ্ছে, বাড়িতে লক্ষ্মীর আবির্ভাব হয়েছে, খাটুনি বলছিস ভাই সেজদি—যেদিন স্বামী-পুত্র ঘরকন্না নিয়ে, নাবার খাবার সময় পাবে না, শুধু তখনি ত এই মেয়েমানুষ-জন্মটা সার্থক হবে। ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি, একদিন যেন তোমার সেদিন আসে—এখুনি খাটুনির হয়েচে কি গিন্নী! বলিয়া হাসিতে গেল বটে, কিন্তু তাহার ঠোঁট কাঁপিয়া গেল।
হরির মা হঠাৎ ভ্যাক্ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, সেই আশীর্বাদ কর দিদি, শুধু সেই আশীর্বাদই কর। তাহার অচলার মাকে মনে পড়িয়া গিয়াছিল—সেই সাধ্বী অত্যন্ত অসময়ে যখন স্বর্গারোহণ করেন, তখন একরত্তি মেয়েকে হরির মায়ের হাতেই সঁপিয়া দিয়া গিয়াছিলেন। সেই মেয়ে এখন এতরড় হইয়া স্বামীর ঘর করিতে আসিয়াছে।
মৃণাল তাহাকে ধমক দিয়া বলিল, আ মর্! ছিঁচকাঁদুনী মাগী, কাঁদিস কেন?
হরির মা চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল, কাঁদি কি সাধে দিদি! তোমার কথা শুনে কান্না যে কিছুতে ধরে রাখতে পারিনে। মাইরি বলচি, তুমি না এসে পড়লে এ বাড়িতে একটা রাতও যে আমাদের কি করে কাটত, তাই আমি ভেবে পাইনে।
আজ ছয় দিন হইল, মৃণাল এ বাটীতে আসিয়াছে। আসিয়া পর্যন্ত বাড়ি-ঘরদ্বার হইতে আরম্ভ করিয়া মানুষগুলোর পর্যন্ত চেহারা বদলাইয়া দিবার কার্যেই নিজেকে ব্যাপৃত রাখিয়াছে। কিন্তু তাহার সব কাজকর্ম, হাসিঠাট্টার মধ্যে হইতে একটা যাই-যাই ভাব অচলাকে পীড়া দিতেছিল। কারণ, মৃণালের কাজে কথায়, আচারে ব্যবহারে এতবড় একটা সহজ আত্মীয়তা ছিল, যাহার আড়ালে স্বচ্ছন্দে দাঁড়াইয়া অচলা উঁকি মারিয়া তাহার নূতন জীবনের অচেনা ঘরকন্নাকে চিনিয়া লইবার সময় পাইতেছিল এবং ইহার চেয়েও একটা বড় জিনিসকে তাহার ভাল করিয়া এবং বিশেষ করিয়া চিনিবার কৌতূহল হইয়াছিল, সে স্বয়ং মৃণালকে। তাহার সাংসারিক অবস্থা যে সচ্ছল নহে, তাহা তাহার সম্পূর্ণ অলঙ্কারবর্জিত হাত-দুখানির পানে চাহিলেই টের পাওয়া যায়। তাহাতে ভগ্নস্বাস্থ্য বৃদ্ধ স্বামী—কোন দিক দিয়াই যাহাকে তাহার উপযুক্ত বলিয়া অচলার মনে হয় না; তাহার উপর বাড়িতে পরিশ্রমের অন্ত নাই—জরাজীর্ণ শাশুড়ি মর মর অবস্থায় অহর্নিশি গলায় ঝুলিতেছে; কারণে-অকারণে তাহার বকুনি-ঝকুনির বিরাম নাই—এ কথা সে মৃণালের নিজের মুখেই শুনিয়াছে-অথচ কোন প্রতিকূলতাই যেন দুঃখ দিয়া এই মেয়েটিকে তাহার জীবনযাত্রার পথে অবসন্ন করিয়া বসাইয়া দিতে পারে না। হৃদয়ের আনন্দ-নিরানন্দ ছাড়া বাহিরের কোন-কিছুর যেন অস্তিত্ব নাই—এমনি এই মূর্খ পাড়াগাঁয়ের মেয়েটার ভাব। অনুক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে থাকিয়া সে বেশ বুঝিতেছিল, পদ্ম যেমন পাঁকের মধ্যে জন্মলাভ করিয়াও মলিনতার অতীত, ঠিক তেমনি যেন এই লেখাপড়া না-জানা দরিদ্র পল্লী-লক্ষ্মীটিও সর্বপ্রকার সাংসারিক দুঃখ-দারিদ্র্যের ক্রোড়ে অহোরাত্র বাস করিয়াও সমস্ত বেদনা-যন্ত্রণার উপরে অবলীলাক্রমে ভাসিয়া বেড়াইতেছে। না আছে তাহার দেহের ক্লান্তি, না আছে তাহার মুখের শ্রান্তি। সুতরাং অচলাকেও সে যে সকল অনভ্যস্ত কাজের মধ্যে অবিশ্রান্ত টানিয়া লইয়া ফিরিতেছিল, যদিচ তাহার কোনটার সহিত তাহার শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কারের সামঞ্জস্য ছিল না, তথাপি না বলিয়া মুখ ফিরাইয়া দাঁড়ানটা যেন অতি-বড় লজ্জার কথা, এমনই অচলার মনে হইতেছিল। নিজের ভাগ্যটাকেও যে একবার ধিক্কার দিবার জন্য সে একমুহূর্ত বসিয়া শোক করিবে, এ ছয়টা দিনের মধ্যে সে ফাঁকটুকু পর্যন্ত তাহার মিলে নাই—সমস্ত সময়টা সে কাজ দিয়া, হাসি-গল্প দিয়া এমনি ভরাট করিয়া গাঁথিয়া আনিতেছিল। তাই তাহার শ্বশুরবাড়ি ফিরিয়া যাইবার ইঙ্গিত মাত্রেই অচলার মনে হইতেছিল, সঙ্গে সঙ্গেই এই সমস্ত মেটেবাড়িটা তাহার দরজা-জানালা-দেয়ালসমেত যেন তাসের ঘরের মত চক্ষের নিমিষে উপুড় হইয়া পড়িয়া যাইবে, মৃণালদিদি চলিয়া গেলে এখানে সে একদণ্ডও তিষ্ঠিবে কি করিয়া?
সন্ধ্যার পর একসময়ে অচলা কহিল, কেবল যে পালাই পালাই করচ মৃণালদিদি, বাপের বাড়ি এসে কে এত শীঘ্র ফিরে যায় বল ত? তা হবে না—আমি যতদিন না কলকাতায় ফিরে যাব, ততদিন তোমাকে থাকতেই হবে।
মৃণাল কহিল, কি করব ভাই সেজদি, শাশুড়িবুড়ী না নিজে মরবে, না আমাকে একদণ্ড ছেড়ে দেবে। আমি বলি, বুড়ী তুই মর্। তোর ছেলের বয়স ষাট হতে চলল, শেষে তাকে খেয়ে তবে যাবি? তা এত যে দিবারাত্রি কাসে, দমটা ত একবারও আটকে যায় না!
অচলা হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, তোমাকে বুঝি তিনি দেখতে পারেন না?
মৃণাল মাথা নাড়িয়া কহিল, দুটি চক্ষে না।
অচলা কহিল, আর তুমি?
মৃণাল বলিল, আমিও না। বুড়ীকে গঙ্গাযাত্রা করিয়ে আমি পাঁচ-সিকের হরির-লুট দেব মানত করে রেখেচি যে!
অচলা মাথা নাড়িয়া কহিল, বিশ্বাস হয় না মৃণালদিদি! তুমি সংসারে কাকে যে দেখতে পারো না, তা তোমার মুখের কথা শুনে কিছুতেই বলবার জো নেই! হয়ত এই বুড়ীকেই তুমি সবচেয়ে বেশি ভালবাস।
মৃণাল হাসিমুখে কহিল, সবচেয়ে বেশি ভালবাসি? তা হবে। বলিয়া অচলার গাল টিপিয়া দিয়া কাজে চলিয়া গেল।
যাই-যাই করিয়া মৃণালের আবার কিছুদিন গড়াইয়া গেল। একদিন হঠাৎ অচলার চোখে পড়িল, যাবার দিকে তাহার মুখে যত তাড়া, কাজের দিকে তত নয়। সত্যই চলিয়া যাইতে সে যেন ঠিক এত উৎসুক নয়। এতদিন তাহার অন্তরালে দাঁড়াইয়া পৃথিবীকে সে যেভাবে চিনিয়া লইতেছিল, এখন তাহার আবরণের বাহিরে আসিয়া, পৃথিবীর সে চেহারা তাহার চোখে যেন আর রহিল না। এ বাটিতে পা দিয়া পর্যন্ত যখনই তাহাকে স্বামীর সঙ্গে কোন-একটা হাসি-তামাশা করিতে দেখিয়াছে, তখনই তাহার বুকের মধ্যে ছাঁৎ করিয়া উঠিয়াছে, কিন্তু এখন মাঝে মাঝে যেন সুচ ফুটিতে লাগিল। এ-সব কিছুই নয়, ইহার মধ্যে যথার্থ পরিহাস ভিন্ন আর কিছুই নাই—মন খারাপ করিবার কোন হেতু নাই—তাহার মন বড় অশুচি—এমনি করিয়া আপনাকে সে যতই শাসন করিবার চেষ্টা করে, ততই কোথা হইতে সংশয়ের বিপরীত তর্ক তাহার হৃদয়ের মধ্যে অনিচ্ছা-সত্ত্বেও বারংবার মুখ তুলিয়া তাহাকে ভ্যাঙচাইতে থাকে। মহিমের স্বাভাবিক গাম্ভীর্য এইখানে যেন অতিশয় বাড়াবাড়ি বলিয়া তাহার মনে হয়। সে এই বলিয়া বিতর্ক করিতে থাকে, ভিতরে যদি কিছুই নাই, তবে পরিহাসের জবাব পরিহাস দিয়া করিতেই বা দোষ কি! যে তামাশা করিয়া উত্তর দিতে পারে না, সে ত অন্ততঃ হাসিমুখে সেটা উপভোগ করিতেও পারে! অথচ সে যেন স্পষ্ট দেখিতে পায়, মৃণালের রহস্যালাপের সূত্রপাতেই মহিম লজ্জিতমুখে কোনমতে তাড়াতাড়ি অন্যত্র পলাইয়া বাঁচে। তাই কোথায় কি একটা যেন প্রচ্ছন্ন অন্যায় রহিয়াছে, আজকাল এ চিন্তা কোনমতেই সে মন হইতে সম্পূর্ণ তাড়াইতে পারে না। মৃণালের সঙ্গে একত্র কাজকর্ম করিতে করিতেও তাহার এক শ’বার মনে হয়, সে নিজে মেয়েমানুষ হইয়া যখন বুকের মধ্যে একটা ঈর্ষার বেদনা বহন করিতে থাকিয়াও ইহাকে কোনমতে ছাড়িয়া দিতে পারিতেছে না, একত্র এতকাল ঘর করিয়াও কি কোন পুরুষমানুষে এ মেয়েকে ভাল না বাসিয়া থাকিতে পারে?
মৃণাল আসিলেই যে উড়ে বামুন তাহার রান্নাঘরের দায় হইতে মুক্তি পাইয়া বাঁচিত, এ কথা অচলা জানিত না। এবারেও সে ছুটি পাইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল ; কিন্তু অচলা কেবলই লক্ষ্য করিয়া দেখিতে লাগিল, মৃনাল নিজের হাতে রাঁধিয়া মহিমকে খাওয়াইতে যেন প্রাণ দিয়া ভালবাসে। আজ সকালে সে হঠাৎ বলিয়া বসিল, মৃণালদিদি, আজ তোমার ছুটি।
মৃণাল বুঝিতে না পারিয়া কহিল, কিসের ভাই সেজদি?
অচলা কহিল, রান্নার। আজ আমিই রাঁধব।
মৃণাল অবাক হইয়া বলিল, পোড়া কপাল! তুমি আবার রাঁধবে কি?
অচলা মাথা নাড়িয়া কহিল, বাঃ, আমি বুঝি জানিনে? বাড়িতে আমি ত কতদিন রেঁধেছি। সে হবে না মৃণালদি, আজ আমি রাঁধবই।
তাহার আগ্রহ দেখিয়া মৃণাল হঠাৎ ম্লান হইয়া গেল; কহিল, সে কি হয়, আমি থাকতে তুমি কি দুঃখে রান্নাঘরের ধুঁয়োর মধ্যে কষ্ট পেতে যাবে ভাই?
তাহার মুখের ভাব লক্ষ্য করিয়া অচলা জিদ করিয়া বলিল, তা হলে বামুন থাকতে তুমিই বা কেন কষ্ট কর? এবেলা আমি নিশ্চয় রাঁধব।
কেন যে তাহার এই আগ্রহ, মৃণাল তাহার কিছুই বুঝিল না। সে হাসি চাপিয়া কৃত্রিম অভিমানের সুরে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, বা রে মেয়ে। একে একে বুঝি তুমি আমার সব কেড়েকুড়ে নিতে চাও? সবই ত নিয়েছ, দুটো দিন রেঁধে খাইয়ে যাবো তাও বুঝি সইচে না? এখন থেকে সতীনের হিংসে শুরু হল বুঝি?
অচলার বুকের ভিতরটায় আবার ছাঁৎ করিয়া উঠিল। মৃণালের শেষ কথাটা গিয়া তাহার ঈর্ষার ব্যথায় সজোরে ঘা দিল। সে একমুহূর্তেই গম্ভীর হইয়া শুধু সংক্ষেপে কহিল, না, আজ আমিই রাঁধব।
এতক্ষণে মৃণাল দেখিতে পাইল, অচলা রাগ করিয়াছে। তাই আর তর্কাতর্কি না করিয়া বিষণ্ণমুখে একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, বেশ, তা হলে তুমিই রাঁধো গে। আচ্ছা চল, কোথায় কি আছে, দেখিয়ে দিয়ে আসি।
মহিম যে এতক্ষণ ঘরেই ছিল, তাহা দু’জনের কেহই জানিত না। সহসা তাহাকে সম্মুখে দেখিয়া উভয়েই অপ্রতিভ হইয়া গেল।
মহিম অচলাকে উদ্দেশ করিয়া ধীরে ধীরে বলিল, মৃণাল যে-ক’দিন আছে ওই রাঁধুক না।
কেন যে সে আপত্তি করিতেছিল, মহিম তাহা জানিত। কিন্তু সে কথা ত খুলিয়া বলা চলে না।
অচলা আরও জ্বলিয়া উঠিল। কিন্তু রাগ চাপিয়া শুধু কহিল, না, আমিই রাঁধতে যাচ্চি, বলিয়াই বাদানুবাদের অপেক্ষামাত্র না করিয়া দ্রুতপদে সরিয়া গেল।
অচলা জোর করিয়া রাঁধিতে গেল। রান্নার কাজে সে কাহারও চেয়েই খাটো ছিল না; কিন্তু এদিকে সে মন দিতেই পারিল না। বিগত দিনের সমস্ত কাহিনী নড়িতে চড়িতে কেবলই খচখচ করিয়া বিঁধিতে লাগিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, হয়ত মহিম কোনদিনই তাহাকে তেমন করিয়া ভালবাসিতে পারে নাই। তাহার বিবাহের অনতিকাল পূর্বে সুরেশকে লইয়া যে সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছিল, এই-সকল কথা খুঁটিয়া খুঁটিয়া মনে করিয়া আজ সহসা সে যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইল, মহিম তাহার প্রতি চিরদিনই উদাসীন; এমন কি পিতার অভিমতে পূর্ব-সম্বন্ধ যখন একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম করিয়াছিল, তখনও মহিম যে কিছুমাত্র বিচলিত হয় নাই, ইহাতে তাহার যেন আর লেশমাত্র সংশয় রহিল না।
এখানে আসা অবধি মৃণাল ও অচলা একসঙ্গে আহারে বসিত। দুপুরবেলা হরির মাকে ডাকিতে পাঠাইয়া দিয়া অচলা মৃণালের জন্য অপেক্ষা করিতেছিল; সে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, মৃণালদিদির জ্বরের মত হয়েছে, তিনি খাবেন না।
অচলা কোন কথা না কহিয়া মৃণালের ঘরে আসিয়া ঢুকিল। মৃণাল চোখ বুজিয়া বিছানায় শুইয়া ছিল, অচলা কহিল, খাবে চল মৃণালদিদি।
মৃণাল চাহিয়া দেখিয়া, একটুখানি হাসিয়া বলিল, তুমি খাও গে ভাই সেজদি, আমার শরীর ভাল নেই।
অচলা শুষ্কস্বরে প্রশ্ন করিল, কি হয়েছে? জ্বর?
মৃণাল কহিল, তাই মনে হচ্চে। আজ উপোস করলেই সেরে যাবে।
অচলা হেঁট হইয়া হাত দিয়া মৃণালের কপালের উত্তাপ অনুভব করিয়া বলিল, আমি অত বোকা নই মৃণালদিদি, খাবে চল।
মৃণাল ঘাড় নাড়িয়া বলিল, মাইরি বলচি, সেজদি, আমার খাবার জো নেই। কেন তুমি আবার কষ্ট করে ডাকতে এলে ভাই! বরং চল, আমি না হয় গিয়ে তোমার সুমুখে বসচি।
অচলা কঠিন হইয়া কহিল, একজন অভুক্ত বন্ধুকে মুখের সামনে বসিয়ে রেখে খাবার শিক্ষা আমরা পাইনি মৃণালদিদি।
মৃণাল তথাপি হাসিবার প্রয়াস করিয়া বলিল, আর বন্ধুর যদি ভোজনের উপায় না থাকে তা হলে?
অচলা তেমনিভাবে জবাব দিল, নেই কেন আগে শুনি? তোমার জ্বর হয়নি, হয়েছে রাগ। নিজে না খেয়ে আমাকেও শুকোবে, এই যদি তোমার ইচ্ছে হয়ে থাকে ত স্পষ্ট করে বল, আমি আর তোমাকে বিরক্ত করব না।
মৃণাল তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিয়া ঝোঁকের মাথায় বলিয়া ফেলিল, স্বামীর দিব্য করে বলচি সেজদি, আমি এতটুকু রাগ করিনি। কিন্তু আমার খাবার জো নেই। চল দিদি, আমি তোমাকে কোলে করে বসে খাওয়াই গে।
অচলা কহিল, তা হলে জ্বর-টর নয়? ওটা শুধু ছল।
মৃণাল চুপ করিয়া রহিল। অচলা নিজেও কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া আস্তে আস্তে বলিল, এতক্ষণে বুঝলুম। কিন্তু গোড়াতেই যদি মুখ ফুটে বলে দিতে মৃণালদিদি, আমার ছোঁয়া তুমি ঘৃণায় মুখে দিতে পারবে না, তা হলে এই অন্যায় জিদ করে তোমাকে কষ্ট দিতুম না, নিজেও দাসী-চাকরের সামনে লজ্জায় পড়তুম না। তা সে যাক—আমাকে মাপ করো ভাই, কিন্তু দুধ ত ছোঁয়া যায় না শুনেছি, তাই এক বাটি এনে দি—আর যদু গিয়ে দোকান থেকে কিছু সন্দেশ কিনে আনুক। কি বল?
প্রথমটা মৃণাল হতবুদ্ধির মত স্তব্ধ হইয়া রহিল; খানিক পরে সে ভাব কাটিয়া গেলেও সে কথা কহিল না, অধোমুখে নির্বাক হইয়া বসিয়া রহিল।
অচলা পুনরায় খোঁচা দিয়া কহিল, কি বল?
মৃণাল আঁচলে চোখ মুছিয়া মৃদুকণ্ঠে শুধু কহিল, এখন থাক।
অচলা আরও কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।
মৃণাল মুখও তুলিল না, কথাও কহিল না। বুড়া শাশুড়িকে তাহার রাঁধিয়া দিতে হয়; তিনি অতিশয় শুচিবাই-প্রকৃতির লোক; এ কথা শুনিলে কোনকালে যে তাহার জলস্পর্শ করিবেন না, নিদারুণ অভিমানে এ কথা সে আভাসেও অচলার কাছে প্রকাশ করিল না।
অচলা রান্নাঘরে গিয়া সেখানকার কাজকর্ম সারিয়া হাত ধুইয়া নিজের ঘরে গিয়া শুইয়া পড়িল। কিন্তু আর যে-কোন কারণেই হোক, কেবল ঘৃণায় যে তাহার প্রস্তুত অন্নব্যঞ্জন মৃণাল স্পর্শ করে নাই এ কথা মিথ্যা বলিয়াই অচলা মনে মনে জানিত বলিয়া অমন করিয়া আজ আঘাত করিয়াছিল। সত্য বলিয়া বুঝিলে, মুখ দিয়া উচ্চারণ করিতেও অচলা পারিত না। অথচ যে প্রভাত আজ কলহের দ্বারাই আরম্ভ হইয়াছিল, তাহার মধ্যাহ্নে ভগবান কাহারও অদৃষ্টেই যে প্রস্তুত অন্ন মাপান নাই, তাহা উভয়েই মনে মনে বুঝিল।
অপরাহ্নবেলায় গরুর গাড়ি আসিয়া সদরে উপস্থিত হইল। মৃণাল অচলার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া কহিল, নমস্কার করতে এসেছি—সেজদি, বাড়ি চললুম। যদি কখনো ইচ্ছে হয়, একটা ডাক দিয়ো, আবার এসে হাজির হব। একটুখানি থামিয়া কহিল, কিন্তু যাবার সময় একটা কথাও কবে না ভাই? বলিয়া ক্ষণকাল উৎসুক-চক্ষে চাহিয়া রহিল।
কিন্তু অচলা একটা কথাও কহিল না, যেমন বসিয়াছিল, তেমনি মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল।
তাহার ঘর হইতে বাহির হইয়াই মৃণাল দেখিতে পাইল, মহিম বাড়ি ঢুকিতেছে। কহিল, একটু দাঁড়াও সেজদা, তোমাকেও একটা নমস্কার করি।
মহিম মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কিছু না খেয়েই বাড়ি চললি মৃণাল? না হয়, রাত্রিটা থেকে সকালেই যাসনে!
মৃণাল শুধু একটুখানি হাসিয়া মাথা নাড়িয়া বলিল, না সেজদা, যদু গাড়ি ডেকে এনেছে, আজ যাই—কিন্তু আর একদিন নিয়ে এসো। বলিয়া গলায় আঁচল দিয়া নমস্কার করিয়া পায়ের ধূলা লইল। বলিল, মাথা খাও সেজদাদামশাই, আর একদিন আনতে যেন ভুলো না ভাই।
আজ মহিম হাসিয়া ফেলিল। কহিল, পোড়ামুখী, তোর স্বভাব কি কোনদিন যাবে না রে?
মরলে যাবে, তার আগে নয়, বলিয়া আর একবার হাসিয়া মৃণাল গিয়া গাড়িতে উঠিল।
আজই এত অকস্মাৎ মৃণাল চলিয়া যাইতে পারে, অচলা তাহা কল্পনাও করে নাই। মৃণাল নিজে খায় নাই, তাহাকে খাইতে দেয় নাই, এই অপরাধের সব চেয়ে বড় দণ্ড অচলা যে কি করিয়া দিবে, একলা ঘরে বসিয়া এতক্ষণ পর্যন্ত সে এই চিন্তাই করিতেছিল। যে ভালবাসে, তাহাকে ঘৃণা করার অপবাদ দেওয়ার মত গুরুতর শাস্তি আর নাই, এ কথা ভালবাসাই বলিয়া দেয়। এই গুরুদণ্ডই মৃণালের প্রতি মনে মনে বিধান করিয়া অচলা বসিয়া ছিল। মৃণালদিদি যে তাহাকে ব্রাহ্মমেয়ে বলিয়া অন্তরের মধ্যে ঘৃণা করে, উঠিতে বসিতে এই খোঁচা দিয়া সে আজকের শোধ লইবে স্থির করিয়াছিল; কিন্তু সমস্ত ব্যর্থ হইয়া গেল।
অথচ অভুক্ত মৃণাল বিদায় লইয়া যখন ঘর হইতে বাহির হইয়া গিয়াছিল, তখন তাহারও চোখের জলে দুই চক্ষু পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু মৃণালের মুখে সেই একফোঁটা হাসির শব্দ তপ্তমরুর মত চক্ষের পলকে তাহার উদ্গত অশ্রু শুষ্ক করিয়া ফেলিল; এবং দরজার আড়ালে দাঁড়াইয়া সে সমস্ত চিত্ত দিয়া উভয়ের বিদায়ের পালা দর্শন করিয়া ঠিক বজ্রাহত তরুর মত নিস্তব্ধে দাঁড়াইয়া জ্বলিতে লাগিল।
অনতিকাল পরে মহিম আসিয়া যখন ঘরে প্রবেশ করিল, তখন তাহার স্বাভাবিক ধৈর্য প্রায় সমূলে বিনষ্ট হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু তথাপি তাহার আজন্ম শিক্ষা-সংস্কার তাহাকে ইতরতার হাত হইতে রক্ষা করিল। প্রাণপণ বলে আত্মসংবরণ করিয়া, কঠোর হাসি হাসিয়া কহিল, বাস্তবিক, শহরের লোক পাড়াগাঁয়ে এসে বাস করার মত বিড়ম্বনা বোধ করি সংসারে অল্পই আছে, না?
মহিম স্ত্রীর মুখের প্রতি চাহিয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, তোমার নিজের কথা বলছ ত? বুঝতে পারি, প্রথমটা তোমার নানাপ্রকার কষ্ট হবে; কিন্তু মৃণালের সঙ্গে যে তোমার বনিবনাও হবে না, এ আমি কিছুতেই ভাবিনি। কেননা, তার সঙ্গে কোনদিন কারও ঝগড়া হয়নি।
অচলা কহিল, আমার সঙ্গেই যে পাড়াসুদ্ধ লোকের চিরকাল ঝগড়া হয়, এ খবরই বা তুমি কোথায় শুনলে?
মহিম ধীরে ধীরে বলিল, তোমার সমস্তদিন খাওয়া হয়নি,—থাক, এ-সব কথায় এখন কাজ নেই।
অচলা অধিকতর জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, মৃণালদিদিও সমস্তদিন না খেয়েই বাড়ি গেলেন ; কিন্তু তাঁর সঙ্গে হেসে কথা কইতে ত তোমার আপত্তি হয়নি!
মহিম আশ্চর্য হইয়া বলিল, এ-সব তুমি কি বলচ অচলা?
অচলা কহিল, আমি এই বলচি যে, কি এমন গুরুতর অপরাধ তোমার কাছে করেচি, যাতে এই অপমানটা আমাকে না করলে তোমার চলছিল না?
মহিম হতবুদ্ধি হইয়া পুনরায় সেই প্রশ্নই করিল। কহিল, কি বলছ? এ-সব কথার মানে কি?
অচলা অকস্মাৎ উচ্চকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, মানে এই যে, কি অপরাধে আমাকে এই অপমান করলে তুমি? তোমার কি করেছি আমি?
মহিম বিহ্বল হইয়া উঠিল, বলিল, আমি তোমাকে অপমান করেছি?
অচলা বলিল, হাঁ, তুমি।
মহিম প্রতিবাদ করিয়া বলিল, মিছে কথা।
অচলা মুহূর্তকালের জন্য স্তম্ভিত হইয়া রহিল। তার পরে কণ্ঠস্বর মৃদু করিয়া বলিল, আমি কোনদিন মিছে কথা বলিনে। কিন্তু সে কথা যাক; এখন তোমার নিজের যদি সত্যবাদী বলে অভিমান থাকে, সত্য জবাব দেবে?
মহিম উৎসুক-দৃষ্টিতে শুধু চাহিয়া রহিল।
অচলা প্রশ্ন করিল, মৃণালদিদি যা করে আজ চলে গেলেন, তাকে কি তোমাদের পাড়াগাঁয়ের সমাজে অপমান করা বলে না?
মহিম বলিল, কিন্তু তাতে আমাকে জড়াতে চাও কেন?
অচলা কহিল, বলচি। আগে বল, তাতে কি বলা হয় এখানে?
মহিম কহিল, বেশ, তাই যদি হয়—
অচলা বাধা দিয়া কহিল, হয় নয়, ঠিক জবাব দাও।
মহিম কহিল, হাঁ, পাড়াগাঁয়েও অপমান বলেই লোকে মনে করে।
অচলা কহিল, করে ত? তবে তুমি সমস্ত জেনে শুনে এই অপমান করিয়েছ। তুমি নিশ্চয় জানতে, তিনি আমার ছোঁয়া রান্না খাবেন না। ঠিক কি না? বলিয়া সে নির্নিমেষ-চক্ষে চাহিয়া মহিমের বুকের ভিতর পর্যন্ত যেন তাহার জ্বলন্ত দৃষ্টি প্রেরণ করিতে লাগিল। মহিম তেমনি অভিভূতের মত শুধু চাহিয়া রহিল। তাহার মুখ দিয়া একটা কথাও বাহির হইল না।
ঠিক এমনি সময়ে বাহির হইতে সুরেশের চিৎকার আসিয়া পৌঁছিল—মহিম! কোথা হে?