গুহা

গুহা

রসময় সামন্ত টোঁক গিললেন। নিচু গলায় বললেন, ‘মারাত্মক!’

বৃন্দাবন জ্বলজ্বলে চোখে বলল, ‘হ্যাঁ স্যার, মারাত্মক। খুবই মারাত্মক!’

রসময় সামন্ত ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘ঘটনা সত্যি তো বৃন্দাবন? মিথ্যে বলছে না তো? দেখো বাপু আমার প্রেস্টিজের ব্যাপার কিন্তু।’

বৃন্দাবন টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘সত্যি স্যার। হান্ড্রেড ওয়ান পারসেন্ট সত্যি।’ রসময় সামন্তর চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা।

‘প্রথমে কুলি মজুর আর মাপজোকের লোকেরা দেখেছিল স্যার। তখন বিশ্বাস করিনি। আপনাকেও কিছু জানাইনি। গত মাসে ডেপুটি সেক্রেটারি সাহেব নিজের চোখে দেখে এসেছেন।’

রসময় সামন্ত গম্ভীর গলায় বললেন, ‘চোখে দেখে এলে হবে না। সরকারি কাজে চোখের কোনও দাম নেই। ফাইলের দাম আছে। ফাইল হয়েছে?’

বৃন্দাবন বলল, ‘হয়েছে স্যার, এই যে স্যার।’

বৃন্দাবন ফাইল এগিয়ে ধরল। সবুজ রঙের ফাইল। কালো দড়ি দিয়ে বাঁধা। ফাইলের গায়ে লেখা ‘মোস্ট কনফিডেনশিয়াল’। রসময় খুশি হলেন। ‘মোস্ট কনফিডেনশিয়াল’ লেখা সহজ কথা নয়। সরকারি কাজ এমনিতেই গোপনীয়। তারপরেও যখন ‘অতি গোপনীয়’ লেখা হয় তখন বুঝতে হবে বিষয় খুবই সিরিয়াস। তিনি হাত বাড়িয়ে ফাইল নিলেন। তারপর বললেন, ‘মোট ক’টা পাওয়া গেছে?’

‘তেইশটা স্যার। ছোট-বড় মিলিয়ে তেইশটা।’

মাঝারি নেই?’

‘আছে স্যার, ফাইলে ফোটোগ্রাফও আছে। আমাদের ডেপুটি সেক্রেটারি সাহেব করিতকর্মা মানুষ। তিনি নিজে ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলেন।’

কথা শেষ করে বৃন্দাবন দাঁত বের করে হাসল। রসময় সামন্ত ফাইলের দড়ি খুলতে খুলতে বললেন, ‘দরজার বাইরে আলো জ্বালানো আছে বৃন্দাবন? কেউ ঢুকে পড়বে না তো?’

বৃন্দাবন বলল, ‘আছে স্যার, তার ওপর দিপুকেও বসিয়ে রেখেছি।’

রসময় বললেন, ‘গুড।’

প্রথমদিন অফিসে এসেই রসময়বাবু তাঁর পার্সোনাল সেক্রেটারি বৃন্দাবনকে ডেকে পাঠিয়ে বলেছিলেন, ‘বৃন্দাবন, এই ঘরে লাল আলোর ব্যবস্থা কেমন?’

লাল আলো! কথাটা বুঝতে বৃন্দাবনের সময় লাগে। সে থতমত খেয়ে যায়। সে ভেবে রেখেছিল মন্ত্রী প্রথমদিন ফাইল, ডিকটেশন, বাজেট প্রভিশন, অ্যাটেনডেন্স, সারপ্রাইজ ভিজিট জাতীয় কঠিন এবং অস্বস্তিকর প্রশ্ন করবে। তার বদলে লাল আলো! একটু পরে বুঝতে পেরে লাফিয়ে ওঠে বৃন্দাবন।

‘আছে স্যার, আলবাত আছে। থাকবে না কেন? তবে স্যার….।’

‘তবে কী?’ রসময় সামন্ত চোখ তুলে তাকালেন।

বৃন্দাবন মাথা চুলকে বলল, ‘স্যার বাস্তুটা কাটা। আগের মিনিস্টার জ্বালাতেন না। কখন যে বাল্‌ব কেটে বসে আছে বুঝতে পারিনি। কালই স্যার বদলানোর ব্যবস্থা করব।’

রসময়বাবু চাপা গলায় বললেন, ‘কাল নয়, আজ। আজ এখনই। আর মনে রাখবে আমি যতক্ষণ ঘরে থাকব, ওই আলো জ্বলবে। সবাই জানবে মিনিস্টার বিজি। বুঝতে পারলে?’

বৃন্দাবন বুঝতে পারে না। তবু সে ঘাড় নাড়ে। সে জানে সব জিনিস তার বোঝার নয়। মন্ত্রী চেয়েছেন এটাই যথেষ্ট। তিনি যদি একটার বদলে একশো আলো জ্বালতে চাইতেন সেটাই হত। ঘরের সামনে আলোর মালা ঝুলত।

‘স্যার, নেমপ্লেটটা কেমন হবে যদি বলে দিতেন। কাঠের করব? নাকি মেটাল? আমার মনে হয় কাঠই ভাল। কাঠ মাটি খুড়ে একটা গ্রাম বাংলা, গ্রাম বাংলা ব্যাপার থাকে। কাঠের গায়ে নাম থাকবে। নামের নীচে ডিপার্টমেন্ট।’

রসময় সামন্ত কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। গদি মোড়া চেয়ারে হেলান দিলেন। চেয়ারে অসুবিধে আছে। একটু একটু দোলেও। দোলা জিনিস ভাল নয়, হড়কে যাওয়ার চান্স থাকে। ছোটবেলায় একবার দোলনা হড়কে পড়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকে ভয়। চেয়ারের হাতল শক্ত করে ধরে বললেন, ‘দেখো বৃন্দাবন, তুমি আমার পার্সোনাল লোক। নিয়মমতো তোমাকে সবই বলার কথা। পার্সোনাল লোকের কাছে লজ্জার কিছু নেই। দপ্তরের নাম শুনেই নিশ্চয় বুঝতে পারছ দপ্তর ভাল নয়। অতি ফালতু। নাম উচ্চারণেই দাঁত ভেঙে যাওয়ার জোগাড়। তুমি কি একবারে নামটা বলতে পারবে?

বৃন্দাবন আমতা আমতা করে বলল, ‘একবারে পারব না। এখনও সড়গড় হয়নি স্যার। কাগজ দেখে বলব?

বৃন্দাবন পকেট থেকে চিরকুট বের করল।

মন্ত্রী বললেন, ‘থাক, বাড়িতে গিয়ে মুখস্থ কোরো। আমি বলছি। দপ্তরের নাম হল, রুক্ষ পার্বত্য অঞ্চলের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা। ভাল দপ্তরের জন্য ক্যাচ ধরেছিলাম। ক্যাচ কাজ করেনি। সব দপ্তর বিলি বণ্টনের পর, আমার জন্য এই অদ্ভুত জিনিস বানানো হয়েছে। রুক্ষ পার্বত্য অঞ্চলের আবার সম্ভাবনা কীসের? কোনও সম্ভাবনা নেই। সুতরাং আমারও কোনও সম্ভাবনা নেই।’

শেষ করে মন্ত্রী সুন্দর করে হাসলেন। বললেন, ‘তবে কী জানো, মন্ত্রীই আসল, ডিপার্টমেন্ট নয়। সুতরাং নেমপ্লেটে শুধু আমার নাম দাও। দপ্তরের কথা বলে লোককে ঘাবড়ে দিয়ে কাজ নেই।’

বৃন্দাবন বড় করে ঘাড় কাত করল। সুন্দর করে হাসল। মন্ত্রী হাসলেন তাই হাসল। এটাই নিয়ম। মন্ত্রী যদি কাঁদতেন তা হলে তাকেও কাঁদতে হত।

নেমপ্লেট হল, প্যাড হল, রবার স্ট্যাম্প হল। কিন্তু দপ্তরে কোনও কাজ হল না। মন্ত্রী আসেন, যান। লাঞ্চ সারেন, টিফিন করেন। চা খান, সিগারেট টানেন। ঘরের বাইরে লাল আলো জ্বলে। জ্বলতেই থাকে।

একদিন বৃন্দাবনকে ঘরে ডেকে মন্ত্রী বললেন, ‘আচ্ছা বৃন্দাবন, এই জিনিস কোথায় পাওয়া যায়?

‘কোন জিনিস স্যার?’

‘এই যে রুক্ষ পৰ্বত না কী যেন, ছাইয়ের মাথা, কোথায় পাওয়া যায় জানো?’

বৃন্দাবন মাথা চুলকে বলল, ‘স্যার, আমি একটা অন্যায় করেছি। আপনাকে না বলেই জেলায় জেলায় রুক্ষ পর্বতের সন্ধানে অফিসার পাঠিয়ে দিয়েছি স্যার। সঙ্গে পাহাড় মাপার লোক। যতই হোক দপ্তরের সম্পত্তি, কাজকর্ম না হোক, একটা হিসেব তো রাখতে হবে। নিজেদের কাছে নিজেদের সম্পত্তির হিসেব নেই, এটা ভাল দেখায়?’

রসময়বাবু খুশি হলেন। বললেন, ‘গুড, ভেরি গুড। হিসেব কবে আসবে?’

‘দ্রুত আসতে শুরু করবে স্যার। কাল পরশু না হোক এক সপ্তাহের মধ্যেই অনেকটা পিকচার পাওয়া যাবে।

হিসেব দ্রুত এল। আর তখনই জানা গেল এই মারাত্মক তথ্য! যাকে বলে রোমহর্ষক! বৃন্দাবন তার ‘স্যার’-এর জন্য সেই রোমহর্ষক তথ্য ফাইল বন্দি করে নিয়ে এসেছে।

তিন জেলার সীমান্তে, বিস্তৃত রুক্ষ পর্বতমালায় সরকারি অফিসার আর পাহাড় মাপার লোকজন গুহার সন্ধান পেয়েছে! একটা নয়, দুটো নয়, একেবারে তেইশ তেইশটা! গুহার বয়স বোঝা যাচ্ছে না, তবে প্রাচীন এটা বোঝা যাচ্ছে। গুহাগুলো এতদিন লুকিয়ে ছিল বুনো ঝোপের আড়ালে, পাথরের ফাঁকে, ঝরনার পাশে! কোনওটার মুখ চওড়া, কোনওটা সরু। কোনওটা চলে গেছে অনেকখানি, পাহাড়ের পেট ফুড়ে! গুহাগুলোয় পৌঁছোতে হয় পাথরের খাঁজে পা রেখে, শুকনো গাছের ডাল ধরে। সেই সময় পায়ের ধাক্কায় নুড়ি গড়িয়ে পড়ে। সুন্দর আওয়াজ হয়।

সবটাই ফাইলে নোট করা হয়েছে।

ফাইল দেখা হয়ে গেলে রসময় সামন্ত সোজা হয়ে বসলেন। তাঁর চোখের পাতা পড়ছে না, মণি স্থির। কপালে ভাঁজ।

‘বৃন্দাবন, এ জিনিস কি আমাদের?

‘বৃন্দাবন গলায় জোর এনে বলল, ‘আলবাত আমাদের স্যার। থাউজেন্ড টাইম আমাদের। রুক্ষ পর্বত যখন আমাদের, তার গুহাও আমাদের। পাহাড়ের ভবিষ্যৎ যদি আমাদের হয়, অতীত কী দোষ করল? গুহা তো স্যার অতীত-ই।’

‘এতদিন কেউ খোঁজ পায়নি কেন?’

বন্দাবন এর উত্তর ঠিক জানে না। সে আমতা আমতা করে খানিকটা দার্শনিক কায়দায় জবাব দিল, ‘কত কিছুর খোঁজই তো আগে পাওয়া যায় না স্যার। হাজার হাজার বছর লুকিয়ে থাকে। এই লে স্যার কাগজে পড়লাম, আফ্রিকার কোথায় যেন মাটি খুঁড়ে ডায়নোসোরের হাড়…।’

বৃন্দাবনের কথার মাঝখানেই ডান হাত মুঠো করে রসময় সামন্ত টেবিলে হালকা ঘুসি মারলেন। দাতে দাত ঘষলেন। তারপর কিড়মিড় আওয়াজ তুলে বললেন বাছাধন, এবার দেখবে খেলা কাকে বলে। এতদিন এক কোণে পড়ে ছিলাম, এবার আমাকে নিয়ে টানাটানি হবে, মারামারি হবে। শালারা সবাই হাড়ে হাড়ে টের পাবে রুক্ষ পর্বতের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কত প্রকার এবং কী কী। বৃন্দাবন, আমরা এই গুহা বেচব।’

‘গুহা বেচব!’

বৃন্দাবন এতটাই চমকে যায় সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। রসময় সামন্ত উত্তেজনায় ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে থাকেন। বলেন, ‘হ্যাঁ বেচব। জমি, বাড়ি, জল জঙ্গল যদি বেচা যায়, তা হলে গুহা বেচা যাবে না কেন? আপত্তি কোথায়?’

বৃন্দাবন চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ে। বিড়বিড় করে বলে, ‘আপত্তি নেই স্যার। কিন্তু গুহা কে কিনবে? এই যুগে গুহা কি বিক্রি হবে? এখন স্পেস টাইম। সবাই চাঁদে অথবা মঙ্গল গ্রহে জমি খুঁজছে। তার বদলে গুহা?’

রসময় সামন্ত চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘আমি মন্ত্রী না তুমি মন্ত্রী বৃন্দাবন? তর্ক না করে বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করো। নোট খাতা এনেছ? নোট খাতা না নিয়ে মন্ত্রীর ঘরে কেন ঢুকেছ? হা ডু ডু খেলতে?’

রসময় সামন্ত চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘আমি মন্ত্রী না তুমি মন্ত্রী বৃন্দাবন? তর্ক না করে বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করো। নোট খাতা এনেছ? নোট খাতা না নিয়ে মন্ত্রীর ঘরে কেন ঢুকেছ? হা ডু ডু খেলতে?’

বৃন্দাবন দ্রুত ছুটে গিয়ে প্যাড এবং পেন নিয়ে আসে। রসময় সামন্ত কপালে হাত রেখে

বিজ্ঞাপন ডিকটেশন দিতে থাকেন। মন্ত্রী হওয়ার পর এই প্রথম তিনি ডিকটেশন দিচ্ছেন। গুহা বিক্রির ডিকটেশন। অনেক কাটাছেড়ার পর বিজ্ঞাপনের যে কপি তৈরি হল সেটা

এরকম—

‘আপনার ফ্ল্যাট আছে। বাগান ঘেরা বাংলো আছে। টাওয়ারে আছে ডুপলেক্স বা ট্রিপলেক্স। কিন্তু আপনার যা নেই তা হল একটা গুহা। গা ছমছমে গুহা। আধো অন্ধকার, আধো আলো। বুনো ফুলের গন্ধ, জ্যোৎস্না এবং সঙ্গে ঝরনা স্নান। আপনি যদি এরকম একটা গুহার মালিক হতে চান তা হলে এখনই আমাদের দপ্তরে লিখিত আবেদন করুন। মেলে জানান। গুহার নীচে পার্কিং স্পেসের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হচ্ছে। থাকছে লিফট। ইচ্ছে করলে দড়ি ধরে পাহাড়ে বেয়ে ওঠানামাও করা যাবে। টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স রক ক্লাইমবং ট্রেনার থাকবে আপনার জন্য। হিল টপে হবে শপিং মল, রেস্তোরাঁ। পাহাড়ি ঝরনায় আপনার ছেলেমেয়েরা করবে ওয়াটার স্পোর্টস। গুহায় টেলিফোন, ইন্টারনেট, কেবল কানেকশনের জন্য স্যাটেলাইট যোগাযোগের ব্যবস্থা হবে। মনে রাখবেন, এই গুহা প্রকল্প কোনও ব্যাবসায়িক কারণে করা হচ্ছে না। এই প্রকল্প থেকে পাওয়া অর্থ রুক্ষ পর্বতমালার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার জন্য ব্যয় করা হবে। সুতরাং আর দেরি না করে…।’

রসময় সামন্ত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কালই এই বিজ্ঞাপন প্রচারের ব্যবস্থা করো বৃন্দাবন। অফিসের পোস্টাল অ্যাড্রেস, মেল অ্যাড্রেস সব দেবে। ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইট আছে? না থাকলে আজকের মধ্যে রেডি করবে।’

‘স্যার, অ্যাডভার্টাইসমেন্টে আপনার ছবি থাকবে? বড় প্রকল্পে যেমন থাকে না স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা টুলু পাম্পের পাশে মন্ত্রীর ছবি থাকে না? দেব স্যার?’

রসময় শান্ত গলায় বললেন, ‘না এখন নয়। ছবির সুযোগ অনেক আসবে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি টিভি, রেডিয়ো, পত্রিকাওলারা আমার পিছনে দৌড়াচ্ছে। আমি পালাচ্ছি, আমি পালাচ্ছি…।’

রসময় সামন্ত চেয়ারে বসে একটু একটু দুলছেন। কদিন আগেও যে দুলুনিতে তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, আজ তাতে আরাম লাগছে। তিনি চোখ বুজে আছেন। চোখ বোজা অবস্থাতেই কথা বলছেন। বড়মানুষদের মাঝেমধ্যে এরকম হয়। চোখ বুজে কথা বলতে ভাল লাগে। রসময় শুধু চোখ বোজেননি, তিনি হাসছেনও। গত কদিন হল তার হাসি বেড়েছে। হয় মিটিমিটি হাসছেন, নয় জোরে হাসছেন। এখন তিনি মিটিমিটি হাসছেন।

উলটোদিকের চেয়ারে বসে থাকলেও বৃন্দাবন ‘স্যার’-এর মুখ ভাল করে দেখতে পাচ্ছে দেখবে কী করে? টেবিলে স্তুপীকৃত খাম। গুহা কেনার আবেদন। এই খাম বৃন্দাবন মন্ত্রীর টেবিলে রাখতে চায়নি। কিন্তু উপায় নেই। ঘরের দু’-দুটো আলমারি ভরে গেছে। একটা ট্রাঙ্ক জোগাড় করা হয়েছিল, সেটারও ঠাসাঠাসি অবস্থা। বৃন্দাবন বিরক্ত হয়ে ক’টা খাম মাটিতে ফেলে দিল। খামের থেকে মন্ত্রীর মুখ দেখা অনেক বেশি জরুরি।

‘স্যার মোটে তো তেইশটা ওই পাওয়া গেছে, অথচ অ্যাপ্লিকেশন পড়েছে হাজার হাজার কী হবে? আমার চিন্তা হচ্ছে স্যার। রাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।’

রসময়বাবু ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু হাসলেন। এই হাসি হল প্রশান্তির হাসি।

‘তুমি চিন্তা কোরো না বৃন্দাবন, সব ঠিক হয়ে যাবে। এভরিথিং উইল বি অলরাইট। তোমার নামটা ভাল। বৃন্দাবন, মথুরা ধরনের নামের মধ্যে একটা ভক্তি ভক্তি ব্যাপার থাকে। আমার এক ভাইপোর নাম ছিল কাশী। সেই ছেলেও ভাল ছিল। একটু চোর টাইপ, কিন্তু বিনয়ী ছিল। আজকাল চোর গুড়া পাওয়া সহজ, বিনয়ী পাওয়া সহজ নয়। ওসব ছাড়ো, গুহা কাণ্ডে ডিপার্টমেন্টের নাম কেন ছড়িয়েছে সেই কথাটা বলো?’

বৃন্দাবন শুকনো মুখে বলল, ‘অ্যাটম বোমার মতো স্যার। ওহার জন্য পাবলিকের যে এত ক্রেজ হবে ভাবতেও পারিনি। মেলে মেলে কম্পিউটার বোঝাই হয়ে গেছে। সাইটে যেভাবে সবাই ঢুকতে চাইছে তাতে যে-কোনও সময় ক্র্যাশ করে যেতে পারে। আপনি স্যার ভবিষ্যৎদ্রষ্টা।’

রসময় হাসলেন। এবার তৃপ্তির হাসি। বললেন, ‘শুধু পাবলিক? ভি. আই. পি-দের কথাটা বলবে না? সকাল থেকে শুধু ফোন আর ফোন। দাদা, ভাই, বন্ধু বলে কান্নাকাটি। একটা লাগবে, লাগবেই লাগবে। লাইনে কে নেই? মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ, ফিল্মস্টার, ইনটেলেকচুয়াল, ইউনিভার্সিটির প্রফেসর— সব্বাই। সবার মুখে একটাই কথা, গুহা চাই, গুহা চাই। হা হা…। এই তো মিস্টার ঘোড়েল ঢুনঢুনিয়া একটু আগে মোবাইলে ফোন করলেন। মিস্টার ঘোড়েলকে চেনো তো? এই যে তোমাদের শিল্পপতি না কী বলে, সাত-সাতটা কারখানা ব্যাটার। আরও দুটো পাইপ লাইন আছে। আমাকে কী বলল জানো? বলল, গুহার খবর পেয়ে স্টেটস থেকে তার মেয়ে নাকি ফোন করেছিল। শি নিডস আ কেভ। ফার্নিশড কেভ। সামারে বন্ধুরা মিলে এখানে আসছে। সোজা গুহায় গিয়ে উঠবে। তারপর গোটা ছুটি জুড়ে গুহার গায়ে ছবি আঁকবে। গুহাচিত্র! হা হা…। ঘোড়েল তো ফোনেই আমার পা চেপে ধরে। দাদা, মেরে লিয়ে এক বুক কর দিজিয়ে। যিতনা প্রাইস…। আমি বললাম সরি মিস্টার ঘোড়ল। যা নিয়ম সবাইকে মেনে চলতে হবে। গুহার ক্ষেত্রে ধনী দরিদ্র সবাই সমান। শালা সেদিন পর্যন্ত চিনতে পারত না। দেখলে নাক সিঁটকাত আমি যে একজন মন্ত্রী, মানতই না। আর এখন? এখন পা ধরছে। শুধু কি এই বৃন্দাবন? আরও আছে।’

বৃন্দাবন মিথ্যে করে চোখ বড় বড় করল। বলল, ‘আরও আছে স্যার?’

‘বলছি কী, তোমার বউদির এক মামাতো না পিসতুতো ভাগনে হল গিয়ে তোমার বিরাট

মাতব্বর। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। নাম সান্টু না টান্টু। বছরে স্যালারি ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ।’

বৃন্দাবন নড়ে চড়ে বসল। বলল, ‘ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ! সেটা কী স্যার?

রসময় ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘দূর, অত কি আমি জানি? এখন তোমার ওই ওয়ান পয়েন্ট, টু পয়েন্টের সিস্টেম চলছে। যাক, সেই টান্টু তোমার বিয়ে করছে। পরশু ভাবী বউকে নিয়ে বিরাট গাড়ি চালিয়ে বাড়িতে এসে হাজির। গাড়ি নিজে চালাচ্ছে না, তার বউ চালাচ্ছে। এসে বলল, মামা, আমরা ঠিক করেছিলাম হানিমুনে হাওয়াই দ্বীপে যাব। এখন সেই পরিকল্পনা বাতিল আমাদের মধুচন্দ্রিমা হবে গুহায়। তুমি একটা হানিমুন গুহার ব্যবস্থা করে দাও। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ মামু। হারামজাদা এমন করে বলছে যেন ওরিজিনাল ভাগনে। মায়ের পেটের…।’

‘আপনি কী বললেন স্যার?’

‘কী আবার বলব? বললাম, টান্টু, তোমাদের মামা সব পারবে কিন্তু স্বজনপোষণ পারবে না। তার একটা নীতি আছে, আদর্শ আছে। গুহা বণ্টনের ক্ষেত্রেও সে সেই আদর্শচ্যুত হবে না…।’

বৃন্দাবনের হাসি পেল না, তব সে হাসল। মন্ত্রী হাসছে, তার না হেসে উপায় নেই। হাসি থামিয়ে বলল, ‘স্যার, এবার আলটমেন্টের ব্যাপারটা যদি ঠিক করে ফেলেন। লটারি কৱল?

মন্ত্রী কিছুক্ষণ হল চোখ খুলছেন। এবার দুলুনি থামালেন। সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, ‘লটারি করব না, হরির লুট দেব সেটা পরে। আগে কোটা ঠিক করতে হবে।’

‘কোটা!’

রসময় সামন্ত ধমক দেওয়ার গলায় বললেন, ‘অবশ্যই কোটা। জমি বাড়ি গাড়ি চাকরি, সব কিছুর কোটা হয়, গুহার কেন কোটা হবে না? নাও লেখো। ভি আই পি কোটা, এন আর আই কোটা, পার্টি কোটা, অপজিশন কোটা, বিলো পভার্টি লাইন কোটা…।’

‘বিলো পভার্টি লাইন কোটা!’ বৃন্দাবন কলম থামিয়ে মুখ তোলে। বলে, ‘স্যার, আপনি কি দরিদ্র মানুষের কথা বলছেন? দরিদ্র মানুষ গুহা কিনবে!’

রসময় সামন্ত আবেগঘন গলায় বলেন, ‘কেন নয় বৃন্দাবন? দরিদ্র মানুষ কি মানুষ নয়? আমি, তুমি গুহায় থাকতে পারি, ঘোড়েল পারে, টান্টু পারে। নেতা, মন্ত্রী, পুলিশ পারে, দরিদ্র মানুষ কেন পারবে না? ছি ছি। এই মনোভাব তোমার ঠিক নয়। ভেরি ব্যাড। ভেরি ভেরি ব্যাড।

বৃন্দাবন কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘না না দামটা তো বেশি, তাই ভাবছিলাম…।’

রসময় বিরক্ত গলায় বললেন, ‘বেশি তো কী হয়েছে? ওদের জন্য ইনস্টলমেন্টের ব্যবস্থা করো। সেরকম হলে সাবসিডি দাও।’

‘স্যার, আপনি নিজের হাতে ক’টা রাখবেন না? ধরুন হুট বলতে কেউ চাইল। বলা তো যায় না কিছু।’

রসময় সামন্ত ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলেন। তারপর দার্শনিক ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি কে? কে আমি? কেউ নই রে পাগল, কেউ নই। আজ আছি কাল নেই, কাল আছি আজ নেই। আমার জন্য কিছু লাগবে না। তুমি শুধু একটা বড় দেখে সার্কিট হাউসের জন্য সরিয়ে রেখো মাঝে মধ্যে যদি…।

বৃন্দাবন এবার প্রায় ভেঙে পড়ল।

‘স্যার, এরপর তো হাতে রইল মাত্র কয়েকটা! অথচ এত অ্যাপ্লিকেশন…’

রুক্ষ পার্বত্য অঞ্চলের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিষয়ক মন্ত্রী কিছু বলতে যান, আর তখনই ইন্টারকম বেজে ওঠে। বাইরে দুটো টিভি চ্যানেলের লোকেরা অপেক্ষা করছে। মন্ত্রী ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বৃন্দাবনের উদ্দেশে দ্রুত হাত নেড়ে বলেন, ‘এখন ওসব বাদ দাও বৃন্দাবন, এখন বাদ দাও। কাল অফিসে এসে বাকিটা ফাইনাল করব। তোমার কাছে চিরুনি আছে?’

আজও গদিচেয়ারে অল্প অল্প দুলছেন রসময় সামন্ত। তবে আজ আর তাঁর মুখ হাসি হাল নয়। মুখ থমথমে। তিনি চেয়ে আছেন শূন্যের দিকে। সেই দৃষ্টিতে দুঃখ, হতাশা।

উলটোদিকে বসা বৃন্দাবনের মুখও ভেঙে পড়া টাইপ। সে মাথা চুলকে বলল, ‘স্যার, কথাটা আমার জিজ্ঞেস করা উচিত নয়, তবু না করে পারছি না। স্যার এই নিষেধ কি চিফ মিনিস্টারের?’

রসময় কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘না।’

‘তা হলে কি আপনার পার্টির লিভার?

‘না?’

বৃন্দাবন অবাক হয়ে বললে, ‘তবে কি নিয়মকানুনে কোনও ঝামেলা হল?’

বন্দাবন অধৈর্য হয়ে বলল, ‘তা হলে? তা হলে এই সিদ্ধান্ত বদলের কারণ কী স্যার? এত নল একটা প্রজেক্ট। এত ভাবনা চিন্তা। অমন চমকে দেওয়া বিজ্ঞাপন। হাজার হাজার অ্যাপ্লিকেশন। দশ রকমের কোটা। তার ওপর আপনার টিভি ইন্টারভিউ। একেবারে মারকাটারি। তা হলে কেন পিছিয়ে এলেন স্যার।

রসময় সামন্ত শান্ত গলায় বললেন, ‘স্বপ্ন।’

‘স্বপ্ন! স্যার স্বপ্নের জন্য এরকম একটা পরিকল্পনা বাতিল! এ আপনি কী বলছেন স্যার? বৃন্দাবন হাসবার চেষ্টা করল।

রসময়বাবু এবার সোজা হয়ে বসলেন। টেবিলে ঢাকা দিয়ে রাখা গ্লাস তুলে লম্বা চুমুকে জল খেলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। বললেন, ‘হাসছ কৃন্দাবন। ওই স্বপ্ন দেখার পর আমি ঘামতে ঘামতে বিছানায় উঠে বসেছি। তুমি যদি দেখতে তা হলে তুমিও তাই করতে বৃন্দাবন। ঘুম ভেঙে ঘামতে ঘামতে বিছানায় উঠে বসতে। উফ্‌ কী ভয়ংকর!’

‘স্বপ্নটা আপনি কবে দেখেছেন স্যার?’

কাল রাতে। শেষ রাতেও হতে পারে। দুঃস্বপ্ন সাধারণত শেষ রাতের দিকেই দেখা যায়।’

বৃন্দাবন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘স্যার, আমি কি স্বপ্নটা কেমন ছিল সেটা রসময় মুখটা ওপরে তুললেন। ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে অনেকটা আপনমনেই বলতে শুরু করলেন—

‘গুহা গুহায় মানুষ। মহিলা, পুরুষ, শিশুদের হইচইতে পাহাড় একেবারে জমজমাট। কেউ গল্প করছে। কেউ বসে আছে ঝরনার পাশে। কেউ উঠছে পাহাড় বেয়ে। কারও কোলে ল্যাপটপ, কেউ কানে রেখেছে মোবাইল। পাথরের খাঁজে বসে বকবকানি চালাচ্ছে। কেউ আই পড় হাতে বেঁধে পাহাড় বেয়ে উঠছে ওপরে।’

রসময় সামন্ত যেন চোখের সামনে স্বপ্নটা দেখতে পাচ্ছেন। সিনেমার মতো।

‘হিল টপ রেস্তোরাঁ জমজমাট। বাইরে বারবিকিউ চলছে। লোহার শিকে মাংস নিয়ে পোড়ানো হচ্ছে। আগুন ঘিরে ছেলেমেয়েরা গান ধরছে। জংলি গান। সেই সঙ্গে কোমর দুলিয়ে নাচ। আর নীচে? পাহাড়ের নীচে একটার পর একটা গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছে। ঝাঁ চকচক গাড়ি সব। পুরুষ মহিলারা নামছে জোড়ায় জোড়ায়, দল বেঁধে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে পাহাড়ে উৎসব শুরু হয়েছে, গুহা উৎসব।’

মন্ত্রীর সামনে হাত পা নেড়ে কথা বলা ঠিক নয়। বৃন্দাবন তবু হাত উলটে বিরক্ত গলায় বলল, ‘এ তো দারুণ! চমৎকার! প্রজেক্ট একেবারে সুপার ডুপার সাকসেসফুল। আমি তো অসুবিধে কিছু দেখছি না। স্যার আপনি কী দেখলেন?’

রসময় সামন্ত মুখ নামালেন। পার্সোনাল সেক্রেটারির চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখলাম, সবাই উলঙ্গ! কয়েকজনের গায়ে সামান্য যেটুকু ছাল-বাকলের আবরণ রয়েছে সেটুকুও না থাকার মতো। পুরুষ নারী সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে উদোম হয়ে। হাসছে, খেলছে কথা বলছে, কাজ করছে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। শুধু গায়ে কিছু নেই। আদিম গুহামানবেন মতো তাদের বড় বড় চুল, গোঁফ দাড়ি। মেয়েদের নগ্ন শরীরে হাড়ের গয়না, পুরুষদের সঙ্গে পাথরের অস্ত্র।’

বৃন্দাবনের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। সে ফিসফিস করে বলল, ‘তারপর?’

রসময় এতক্ষণ পর হাসলেন। শুকনো হাসি।

‘তারপরটা আসল ভয়ংকর। হঠাৎ দেখি একটা গাড়ি আসছে পাহাড়ের উঁচুনিচু রাস্তা বেয়ে। এসে দাঁড়ায় বড় গুহাটার সামনে। গাড়ি চেনা লাগে। স্বপ্নের মধ্যেই আমি একটা পাথরের আড়ালে সরে যাই দ্রুত। সেখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাই, গাড়ির দরজা খুলে নেমে আসছি আমি। আমিও পোশাকহীন! উলঙ্গ। এরপরেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। তখন ঘামে বালিশ বিছানা ভিজে গেছে।’

বেশ অনেকটা সময় মাথা নামিয়ে চুপ করে বসে থাকে বৃন্দাবন। তার মুখ তুলতে লজ্জা করে। যেন স্বপ্ন তার ‘স্যার’ দেখেনি, সে দেখেছে। একটা সময় মাথা নামিয়েই বলে, ‘স্যার গুহাগুলোর কী হবে?’

রসময় সামন্ত অল্প হেসে বলেন, ‘ওরা ওদের মতোই থাক। যেমন ছিল। তুমি বরং ঘরের বাইরে লাল আলোটা নিভিয়ে দাও বৃন্দাবন।’

আমার সময়, এপ্রিল ২০০৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *