গুল্লাকাহিনী
গ্লোরিয়া বলেছিল ছাত্রীবেলায় ও একটা দ্বীপ কিনতে চাইত, ওর বেশ নিজের একটা ছোট্ট দ্বীপ থাকবে, নিজের সমুদ্রতীর, নিজের ঝাউবন। গ্লোরিয়া তখন ম্যানহ্যাটানের কালোপাড়ায় ভাগাভাগির চেঁচামেচির ভাড়াবাড়িতে থেকে, চাকরি করে, পড়াশুনো করত। ওর বাড়ির আর সবাই তখন দক্ষিণ ক্যারোলিনায়। দিনে চাকরি, রাতে কলেজ। আর দ্বীপ কেনার স্বপ্ন দেখা।
পাশ করে বেরিয়ে গ্লোরিয়া কলম ধরল। একদিন তারপর নিজের ফ্ল্যাট কিনল, ওয়াশিংটন হাইট্সে নিউইয়র্ক শহরে। শোবার ঘরের জানলা দিয়ে নদী দেখা যায় নিচে। নদীতে ছোট ছোট জাহাজ ভেসে যায়। নদীর ওপারে প্যালিসেডস পার্ক।
কোথায় তার ছাত্রজীবনের কুঠুরি, কোথায় সুদৃশ্য, সচ্ছল অ্যাপার্টমেন্ট। গ্লোরিয়ার প্রথম উপন্যাস পুরস্কৃত হয়েছে, টিভিতে ‘উইমেন অফ ব্রুস্টার প্লেস’ সিরিয়ালাইজডও হয়েছে। শ্রীমতী ওপরা উইনফ্রীর ওখানেই তো জয়জয়কার হল। দ্বিতীয়, তৃতীয় উপন্যাসও প্রচণ্ড বিক্রি, উচ্চপ্রশংসিত। গ্লোরিয়া এই সময়ে আমাকে চিঠি দিল,–’কিনেছি। দ্বীপ নয় অবশ্য। তবে দ্বীপের অংশ। নিজস্ব, একান্ত ব্যক্তিগত সমুদ্রতট। নিজস্ব ঝাউবন না হোক, ঝোপঝাড়। খুব পুরনো একটা বুড়ো ওকগাছের নিচে ভীষণ পুরনো একটা বুড়ো বাড়ি। তুলোচাষীদের পাড়ায়। শিগগির চলে এসো। আমার বাড়ি মানেই তোমারও বাড়ি।’ আমার যাবার কথাই ছিল তখন আমেরিকাতে। গ্লোরিয়ার আমন্ত্রণে লোভ দ্বিগুণ উঠল। যাচ্ছিলাম শিল্পীদের আশ্রমে নিউইয়র্ক স্টেটে, সারাটোগা স্প্রিংসের ইয়াডোয়। আর সিয়াটলে কবিতা পড়তে। মাঝখানে দশদিন দিব্যি গ্লোরিয়ার দ্বীপে ঘুরে তো আসাই যায়। যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দিত ‘দক্ষিণে ‘ আমি যাইনি, কালোয় সাদায় যেখানে অনন্ত অশান্তি, ক্রীতদাসদের নিঃশ্বাসের ওজনে যেখানে বাতাস এখনও ভারী, কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনি সাহিত্যে যার স্পর্শ এখনো জীবন্ত। চললুম গ্লোরিয়ার দ্বীপভবনে—সস্তার টিকিট যোগাড় হয়ে গেল। উড়ল জাহাজ। যেতে হবে জর্জিয়াতে বস্টন থেকে সাভানা। জর্জিয়ার শহরে। এই প্লেনটা শার্লটে থামে যদিও। সাউথক্যারোলাইনার সুন্দরী শহর শার্লট। সাদা কাঠের ছোট ছোট বারান্দা সুন্দর বাংলোবাড়ির অনেক জায়গায় বর্ণনা পড়েছি কিন্তু দেখা হলো না শার্লট।—যদিও শার্লটে শান্তিনিকেতনের বান্ধবী চিকু এসে এয়ারপোর্টে আড্ডা মেরে গেল। সেখানে প্লেন বদল করে আমাকে সাভানার প্লেন ধরতে হল, সেটা একটুখানি মাত্র দূরত্ব।
সাভানাতে গ্লোরিয়া ছিল, তার বিশালবপু আর ক্ষুদ্র গাড়ি নিয়ে। কবে যেন গ্লোরিয়া আর আমি দুই বোন হয়ে গেছি। সে কৃষ্ণা লেখিকা, আমি বাদামী। সে বিপুলা, আমি খুব চেষ্টা করেও অমন হতে পারব না। তবে বাবা-মা কবিতা-টবিতা মোটে পড়েনি। গান গাইতেন, যখন গায়ে খাটতেন। আমার বাবা-মা ঘরে বসে কবিতা লিখতেন। তার কলমে ম্যাজিক আছে—সে মনে মনেও জাদুবিদ্যায় বিশ্বাসী। গ্লোরিয়া আমার চেয়ে বছর দশেকের ছোটো, প্রিন্সটনে, ইয়েলে ক্রিয়েটিভ রাইটিং পড়ায়। তার বাবা-মা কখনও কল্পনাও করেননি।—এক জব্বর কোলাকুলির পরে গ্লোরিয়া বলল—’এখান থেকে আমরা যাব আমার দ্বীপে, সেন্ট হেলেনায় নেপোলিয়ানের সঙ্গে যদিও কোনো যোগ নেই, এই সেন্ট হেলেনাও কিন্তু ঐতিহাসিক দ্বীপ। এখানেই ক্রীতদাসরা প্রথম মুক্তি পেয়ে জমির মালিক হয়েছিল। এই দ্বীপের সব জমিই কালো মানুষের। সাদা মানুষেরা ঘরদোর ভিটেমাটি সব জলের দরে বেচে দিয়ে উত্তরাঞ্চলে চলে গিয়েছিল ক্রীতদাস মুক্তির পরে। এখানকার ব্যবসা তখন কালো মানুষেরই হাতে চলে আসে। আমরা তাই এই দ্বীপের মাটি নিয়ে খুব গর্ব করি। এই দ্বীপপুঞ্জে আমরাই প্রথম।’
-’কতবড় দ্বীপটা তোমার গ্লোরিয়া?’
-’বড় বেশি নয়। খুব ছোট্ট, ন’মাইল বাই আড়াই মাইল মাত্র। আমাদের বেশ নাগালের মধ্যে সব কিছু। ক’টাই মাত্র ঘরবাড়ি, কিন্তু চার্চ আছে, ইস্কুল আছে, কলেজ আছে, পার্ক আছে, জাদুঘর আছে, দৈনিকপত্রও আছে, ছোট্ট দোকানপাট, বাজারহাট আছে, কয়েকটা রেস্তরাঁও আছে। হোটেল-টোটেল নেই। হোটেলের জন্যে আছে ফ্রিটজ আইল্যান্ড। ঠিক পাশেই অন্য একটা দ্বীপ। টুরিস্টদের জন্যে দ্বীপ। সেখানে ব্যাপারই আলাদা। এটায় গরীব, মধ্যবিত্তদের বসতি। ওটা ধনী, ব্যবসায়ীদের আনাগোনা। ওটা ঠিক যেন ‘বসত্ করবার’ মতন ঠাঁই নয়, ওখানে যদিও বেশ কলোনির মতন তৈরি করেছে, অনেক বাংলো, আর অ্যাপার্টমেন্ট বিলডিং হয়েছে, সেখানে যারা আসে তারা সবাই ঋতুতে ঋতুতে বেড়াতে আসার পাখী। বাসা বাঁধবার পাখী নয়। খুব বিলাসিতাময় জীবন ফ্রিজ আইল্যান্ডে। আমাদের সেন্ট হেলেনার মতো শান্তশিষ্ট, ঘুমন্ত-ঝিমন্ত ছায়া-ছায়া ঘরোয়া দ্বীপ নয় সেটা। খুব ঝিন্চাক দ্বীপ, বিকিনি, ডিস্কো ওখানে সবই আছে। দ্বীপটা আবার চাবিবন্ধ। বাসিন্দা ছাড়া বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ। একদিন দেখিয়ে আনলেই বুঝতে পারবে। প্রাচীর আছে, ফটক আছে, দারোয়ান আছে, আইন্ডেন্টিটি দেখতে চায়। দ্বীপের কোনো লোকের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হলে, তবেই ঢুকতে দেয়। এমনি বেড়াতে যেতে দেয় না। যাতে অযথা ভীড় না বাড়ে। ওই দ্বীপে যাঁরা বেড়াতে এসেছেন তাঁরা জায়গাটা যাতে উপভোগ করতে পারেন।’
-’তাহলে আমরা যাব কেমন করে?’
-’সে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
লজ্জা পাই, আমার প্রশ্নটাই নির্বোধের মতো। গ্লোরিয়া নেইলরের ওই অঞ্চলে পরিচিতপত্র লাগে না সম্ভবত। কিন্তু দারোয়ানরাও কি চিনবে? মন বলল-’ওরে নবনীতা, এ দারোয়ান সে দারোয়ান নয়—’ নৌতুনডালে নৌতুন নৌতুন ফুল ফুটিয়েসে-অন্য ব্যাপার। সে অবশ্য পুলিশ ছিল বোধহয়। গ্লোরিয়া সাভানা শহরে না ঢুকে সোজা চলে এল সেন্ট হেলেনা দ্বীপের দিকে। সাভানা শহর বিষয়েও অনেক কিছু পড়েছি, এই সুযোগে সেটাও ভেবেছিলুম বুঝি দেখা হয়ে যাবে, সে আর আজকে হল না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে দ্বীপগৃহে পৌঁছতে পৌঁছতে।
—’আমার বাড়ির বাগানটা, বাগান মানে ঘাসজমি আর কি, সেটা এগিয়ে গিয়ে ঢালু হয়ে সমুদ্রে মিশে যায় আর সেখানে আমার নিজস্ব বালুকাবেলা।’
–’সেখানে তুমি স্নান কর?’
—’চাইলে রৌদ্রস্নানও করা যায়, তবে একটু ওপাশেই খুব চমৎকার পরিষ্কার সৈকত আছে। আমার সৈকতটা ফেনায়, শ্যাওলায়, ঝিনুকে, নুড়িতে, মাছের আঁশে ময়লা ঝুল হয়ে আছে। নিয়মিত সাফ করতে হলে মালি রাখতে হয়। আমি তো রাখিনি, ভীষণ খরচ। আমার বাড়িতে এখনও ফ্রিজ ছাড়া কোনো আসবাবও নেই। ফ্রিজ আর ফোন। আধুনিকতার সবচেয়ে জরুরি জিনিস।
—’খাও কী করে? উনুন নেই?’
–’সে তো বাড়ির সঙ্গেই গাঁথা, তাই আছে।’
–’খাও কোথায়? টেবিল নেই?’
—’দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। উনুনের পাশে যে কিচেন কাউন্টার গাঁথা আছে, তাতে প্লেটটা রেখে। একটা চেয়ারও আছে অবশ্য।
-’থালাবাসন তো আছে?’
–’যৎসামান্য। যা না থাকলেই নয়।’
–’তবে তো তোমাকে একটা প্লেট কিনতে হবে আর একটা কাপ, একটা গেলাস—কাগজেরই বরং—’
–’না না, ওগুলো সব চারটে করে আছে। কেবল পাঁচজন এলে তখনই মুশকিলে পড়ব।’
—’শোও কিসে?’
—’কেন, মেঝেয়? তুমিও তাই শোবে। মেঝেতে তুমি শুতে দিব্যি পার, তোমার কলকাতার বাড়িতে দেখেছি, মেঝেয় গদিপাতা।’
-’সে তো পারিই। কিন্তু গদি কি আছে? পাথরের মেঝেতে যদি ঠান্ডা লাগে?’
-’পাথর? পাথরের মেঝে কীভাবে হবে? সবই তো কাঠের মেঝে। ঠান্ডা লাগার প্রশ্ন নেই। টেবিলফ্যান চালাতে হয়—যা গরম! স্যাঁতসেঁতে, ঘেমো গরম। কলকাতার মতই।’ শুনে আনন্দ হল না। গ্লোরিয়া বলল,—সেন্ট হেলেনা দ্বীপের নিকটতম শহরের নাম বোফোর (Beaufest) ফরাসী নাম, খুব ফরাসী চাল আছে ওখানে এখনও। অনেক ফরাসী রেস্তোরাঁ আছে—আদবকায়দা আছে, তবু শহর হিসেবে অত্যন্ত স্নিগ্ধ, আর দৃশ্য কী যে সুন্দর। তোমার ঠিক মনে হবে ফ্রান্সে গিয়েছ। আমরা যাব এখন বোফোরেই।’
খাঁ খাঁ মাঠের মধ্যে দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। রোদ আছে। বড় বড় ঘাস মাঠে। এ জন্যেই ‘সাভান্না’ নাম বোধহয় ঐ শহরটার। আমরা অবশ্য শহরের ধারেকাছে যাইনি; পথটা বরং সমুদ্রের কাছে এসে পড়েছে। নোনা বাতাস।—’দ্বীপে যাব কেমন করে? নৌকা নিয়ে? গাড়িসুদ্দু পার হবার স্টিমার আছে বুঝি?’
-’ঐ যে, ঐ দ্যাখো, ওটা পুরনো ব্রিজ। আমরা যাব নতুন ব্রিজ দিয়ে।’ গ্লোরিয়া আঙুল তুলে দূরে একটা ব্রিজের ছায়ামূর্তি দেখাল। আমার সঙ্গে সঙ্গে মন খারাপ হয়ে গেল। ব্রিজ দিয়ে দ্বীপে যাওয়া? এ আবার কেমন দ্বীপ? দূর! বিচ্ছিন্ন হবে তবে তো?
তারপরেই মনে পড়ে গেল। রামেশ্বর থেকে লঙ্কাদ্বীপ পর্যন্ত সমুদ্রে সেতুবন্ধন কবি যদি ভাবতে পেরে থাকেন অতকাল আগে, তাহলে এরাই বা সেতু বাঁধবে না কেন? নিউইয়র্ক শহর তো সেতু সেতুতেই বাঁধা মালা। বোফোর এসে গেল, আমরা পার হয়ে গেলুম নতুন সেতু দিয়ে। সে যে কী সুন্দর সেতু! সমুদ্রের জলের ওপর দিয়ে সেতু আগেও অনেক পার হয়েছি, ক্যালিফোর্নিয়ার বে-এরিয়াতেই তো বে-ব্রিজ আছে, গোলডেন গেট ব্রিজ আছে, দীর্ঘ সেতু নীল নোনা জলের ওপর দিয়ে শূন্যে ছুটে গিয়ে দুটো স্থলভূমিকে গেঁথে রয়েছে। এখানটা সেরকম নয়। এই সমুদ্র অন্য চেহারার। সে ছিল প্রশান্ত মহাসাগরের অংশ, এ অতলান্তিক। কিন্তু এসব ব্যাকওয়াটার্স অঞ্চল, বড় বড় ঘাসবন, শরবনের মত দুলছে, জলের ওপর মাথা তুলে। দীর্ঘ, সবুজ, তন্বী।
-’আগে এই ঘাসবন ঠেলে নৌকো করেই যাতায়াত করতেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা’–বলল গ্লোরিয়া। ‘এই যে আমরা গাড়িতে চড়ে হুশ্ করে পেরিয়ে যাচ্ছি সেকথা তাদের কল্পনার বাইরে ছিল।’
বোফোর শহরের যেটুকু পেরুলুম, শহরটি সত্যিই খুব ছোটোখাটো পরিচ্ছন্ন, আর সুশ্রী। সমুদ্রতীরে একটি ‘প্রোমোনাড’ রয়েছে, হেঁটে বেড়ানোর জন্যে বাঁধানো রাস্তা—তাতে বেঞ্চি পাতা, দোলনা পাতা (অবিকল পিঠে হেলান দেয়া বেঞ্চি) গুজরাতি স্টাইলের, শিকলিতে দোলানো পামগাছের সারি, আর ল্যাম্পপোস্টের সারিতে সাজানো। নাগরিকদের জন্যে সুখদ বেড়ানোর রাস্তা তবে পিছনের দিকে নানাধরনের ছোট ছোট কাফে, রেস্তরাঁ দেখা যাচ্ছে। বোফোর থেকে সেন্ট হেলেনা, নতুন পুল পেরিয়ে যেতে যেতে দুপাশে সমুদ্রের হালকা নীল রং, আকাশের সন্ধে সন্ধে নীল, পাখির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে, পুলে বে-ব্রিজের মত দীর্ঘ, অধীর গাড়ির লাইন নেই। এ ব্যাকওয়াটার্স কেরালার ব্যাকওয়াটার্সের মতন নয়; এখানে নারকোল গাছের সারি নেই, মানুষে টানা নৌকো নেই, সবুজ ধানজমি নেই, এটা যে বিলেতদেশ তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বোফোর অতটুকখানি শহর, তাতে কত যে অ্যান্টিক জিনিসের দোকান! দেখে অবাক না হয়ে পারি না।
-’দক্ষিণে প্রচুর অ্যান্টিক জিনিসপত্র পাওয়া যায়। পুরনো আমেরিকার আসবাবপত্র, বাসনপত্র পর্যন্ত, রূপোর জিনিস, হস্তশিল্প, এসব তো আছেই। অবার নকলও নেই, তা নয়। যে কিনবে তাকে দেখেশুনে জিনিস চিনে, দর করে কিনতে হবে।’ গ্লোরিয়া বলল। ‘সেই জন্যেই তো আমার এখনও কোনো আসবাব নেই বাড়িতে। এইসব অ্যান্টিকের দোকান ঘুরে ঘুরে সুন্দর সুন্দর আসবাব, বাসনপত্র কিনে সংসার গুছোবো। খুব বেশি নয়, যৎসামান্যই কিন্তু খুব মনের মতন হবে। সোশাল হওয়া চাই।’ একটু হেসে ফেলে গ্লোরিয়া বলে,-’এই যেমন তোমার মতন!—আমার বাড়ির প্রথম অতিথি। বেশি নয় মাত্র একজনই, কিন্তু খুব মনের মতন। স্পেশাল মানুষ।’
গ্লোরিয়ার বকবক করা স্বভাব নয়—চুপচাপ, লাজুক, গম্ভীর মেয়ে। কিন্তু কথা বলতে যদি ওর ইচ্ছে করে, তখন আস্তে ধীরে একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে যায়। আমার মনে আছে যখন ও ‘মামা ডে’ উপন্যাসটি মনে মনে ভাঁজছে, ওয়াশিংটন হাইট্সের বাড়ির কাছে একটি পার্কে সারাদিন নদীর ধারে বসে আমাকে পুরো গল্পের ছকটা বলেছিল। কারা ওর মডেল, কাকে দেখে কোন্ চরিত্রটি তৈরি করছে। গ্লোরিয়ার সাদার্ন, কৃষ্ণাঙ্গ উচ্চারণের ঢংটা তখনও সবটা বুঝতে পারতুম না, এখন যেমন পারি। তাই সেদিন গাছের ছায়ায় বসে চীনেবাদাম খেতে খেতে নদীর দিকে চেয়ে চেয়ে সেই কাহিনী আমি পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। তারপর এক সাদা পাগল ছুরি হাতে তেড়ে এল, তার ভাষা খুব স্পষ্ট–আর আমরা উঠে, পাঁই পাঁই করে দৌড়ে পালিয়ে এলুম প্রাণ হাতে করে। পরে যখন বইটি বেরুল, বই নিয়ে চতুর্দিকে খুব লেখালেখি হল, অ্যালিসওয়াকারের সদ্য এই বইয়ের জন্যে গ্লোরিয়ার নাম একত্রে ‘টাই’ হল একটি পুরস্কারের জন্যে—মনে করে গ্লোরিয়া আমাকে বইটি পাঠিয়েছিল। যখন হার্ভাডে সে বইয়ের অংশ পাঠ করতে গেছিল গ্লোরিয়া, টুম্পা কিউ দিয়ে দাঁড়িয়ে ওর কেনা বইতে গ্লোরিয়ার সই নিয়েছিল। কিউতে দাঁড়ানো টুম্পাকে গ্লোরিয়ার কিন্তু চিনে নিয়ে আদর করতে দেরি হয়নি। কলেজের সহপাঠীদের কাছে টুম্পার মাথা সাতহাত উঁচু হয়ে গিয়েছিল। গ্লোরিয়া দুটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল—’আমার বোন কেমন আছে? কলকাতায়, তোমার মা? হার্ভার্ডে তোমার কেমন লাগছে?’
টুম্পা রোগাপাৎলা ফর্সা মতন, গ্লোরিয়া কষ্টিপাথরের একটি ছোটখাটো চলন্ত পাহাড়ের মতন—টুম্পার মাকে গ্লোরিয়ার বোন বলে বিশ্বাস করতে পারেনি তার বন্ধুরা, যদিও ওদের চোখে কালো, বাদামী সবই এক। টুম্পাকে ব্যাখ্যা করে দিতে হয়েছিল—টুম্পার মাও তো লেখেন, তাই ওঁরা দুজনে পাতানো বোন, ওঁদের খুব ভাব। সেই টুম্পার এবারে গ্রাজুয়েশন হল।
গ্লোরিয়ার বাড়িতে আমার প্ল্যান ঘরের মেঝেয় উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে লিখব। গ্লোরিয়ার যেহেতু এটা ছুটি, ও লিখবে না। চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে বই পড়বে, ভাববে। মাঝে মাঝে স্যুপটুপ বানিয়ে খাব। জুস। সিরিয়্যালস। ডিম। আমার এদেশে ডিমে অ্যালার্জি অথচ বিদেশে অ্যালার্জি নেই কেন, তার জাদুটা আমার শরীরই জানে, আমি জানি না। কথা আছে কেউ রান্নাবান্নার মধ্যে যাব না। আমিও কোনো সাদার্ন রেসিপি (বিখ্যাত সুস্বাদু ঝালমাল রান্না) শিখতে চাইব না। গ্লোরিয়াও কোনো ভারতীয় রান্না শিখবে না। শুধু সমুদ্র, শুধু বাতাস, শুধু মাঠ, জঙ্গল, শুধু লেখাপড়া, আর কিছু আড্ডা!
সেতু পার হয়ে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে প্রবেশ করেছি। দূরে দূরে বড় বড় বাগানে শান্ত ছবি-ছবি বাংলো—কে বলবে এখানেই এককালে প্রবল অত্যাচার করে গেছে কালো ক্রীতদাসদের ওপরে শাদা তুলোক্ষেত্রের মালিকরা। তুলোচাষীদের দ্বীপ—মাঝে মাঝে বড়ো গাছে ঢাকা বনজঙ্গলের অঞ্চল।—’না না, বনজঙ্গল নয়’, গ্লোরিয়া আমাকে শুধরে দেয়, ‘এসবই বাগবাগিচা। এস্টেট, পার্ক, এর গহনে খোলা মাঠ আছে, তার মধ্যে সুইমিং পুল। ক্ষেতমালিকদের প্রাসাদ। চলো না, স্বচক্ষে দেখবে।’ বড়ো রাস্তার ধারে শহরের মতো দোকানপাটের বালাই নেই। মাঝে একটা চকমতন, তাতেই তিনচারখানা দোকান।; পোস্টঅফিস, একটা অ্যান্টিক শপ, চুলকাটার দোকান, জামাকাপড়ের দোকান, মুদির দোকান, বেকারী, স্যুটের দোকান, এইসব। রেস্তরা নেই।—’রেস্তরাঁ আছে এই দ্বীপে, এদিক-ওদিক ছড়ানো ছেটানো। একদিন তোমাকে আমার প্রিয় দোকানটাতে খাওয়াতে নিয়ে যাব—খুব সুন্দর রান্না।’ গ্লোরিয়া খেতে ভালোবাসে কিন্তু রাঁধতে ভালোবাসে না। নিউইয়র্কেও আমরা বেরিয়ে পড়ে এখানে ওখানে খাই। ওর খুব পছন্দ সামুদ্রিক প্রাণীসকল—চিংড়ি, কাঁকড়া, স্ক্যাম্পি, সবচেয়ে প্রিয় ‘মাসলস্ বলে একরকমের জোড়া ঝিনুকসেদ্ধ। গ্লোরিয়া খেয়ে খেয়ে শূন্য ঝিনুকগুলো খোলা প্লেটে ঢিবি তৈরি করে। ঝিনুকগুলোর বাইরেটা কালচে কিন্তু ভেতরটা কাকের ডিমের মতন সুন্দর নীলচে রং। কখনও রামধনু রংয়েরও হয়। আমার কেবলই মনে মনে লোভ হয় অত ঝিনুক, সব থলিভর্তি করে বাড়ি নিয়ে যাই! কিন্তু রেস্তরাঁ থেকে এঁটো ঝিনুকের খোলা কেউ বাড়ি নিয়ে যায় না। তাছাড়া নিয়ে যাবার পরে সেগুলো নিয়ে কী করব? একেই তো আমার পাথর কুড়োনো নুড়ি কুড়োনো, ঝিনুক কুড়োনোর স্বভাব আছে। কিন্তু এঁটো ঝিনুক কুড়োনোর নেশাটা এখনও ধরেনি। তবু বুক খাঁ খাঁ করতো টেবিলে অতো স্তূপীকৃত ঝিনুকের খোলা ফেলে আসতে। সেই কাঁদিদের গল্প মনে পড়ত, এলডোরাডোর পথেঘাটে সোনারুপো, হীরে-পান্নার ছড়াছড়ি। সেগুলোই তো ওখানে নুড়ি পাথর!
বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁয়ে গাড়ি ঢুকলো ছায়া-সুনিবিড় এক বীথিকায়। বুড়ো বুড়ো গাছেরা মাথায় মাথা ঠেকিয়ে আছে,–তরুণ প্রেমিক-প্রেমিকার মতো ঢং তাদের। সেই ঠেকানো মাথার তলা দিয়ে আমাদের পথ নাক বরাবর চলে গিয়ে একটি মাঠে পৌছোল। মাঠের মাঝখানে এক ধবধবে সাদা তিনতলা প্রাসাদ। দুপাশ দিয়ে খোলা সিঁড়ি উঠে এসেছে দোতলার বারান্দায়। মাঝখানে একতলার ঘর, দালান। লালটালির ঢালু ছাদ। মাঠে নানান গাছগাছালি। কমলা, বেগুনী ফুলে ভরা বোগেনভিলিয়ার ঝাড়। বড় বড় রঙিন বলের মতন সবুজ মাঠে পড়ে আছে।
—’আমরা কিন্তু ওই বাড়িটায় থাকি না’—গ্লোরিয়া আমার বিমুগ্ধ পদক্ষেপে বাধা দিল। ‘ওটা নীলকুঠি। এখানে প্রধানতঃ চাষ হত নীল। তারপরে তুলো। তারপরে ধান। তারপরে তামাক। এই বাড়িটা নীলকুঠির সাহেবের নিজস্ব বাসভবন। ওই যে, আমি থাকি ওইদিকে।’ বলে যে ছোট্ট দোতলা বাড়িটা দেখাল, মস্ত বড়ো ছায়া ঘরা ওকগাছের তলায়, সেটি অনেক বেশি মনের মতন। ওরকম দাম্ভিক শুভ্র সৌধ নয়, ময়লা হয়ে যাওয়া কাঠের বাড়ি। ওকগাছটা থেকে কচি সবুজপ্রায় জলরঙের দীর্ঘ জটাজুট ঝুলছে। পথে অনেক গাছেই এত অপূর্ব জটার শোভা দেখেছি, সুন্দর, ঝিরঝিরে পাতায় ভরা কোনো পরজীবি, কিন্তু এরা গাছকে মেরে ফ্যালে না। স্বর্ণলতার মত যে স্বভাব নয়, সেটা বোঝা যাচ্ছে। ‘স্প্যানিশ মস্’—গ্লোরিয়া বল্ল। জটা না বলে দাড়ি বললেই ভালো হয়, বেশি মিল দাড়ির সঙ্গেই—’। আমাদের দক্ষিণে এই স্প্যানিশ মস্-এর খুব দৌরাত্ম্য। পূর্বকুলে দেখা যায় না। অবশ্য এটাও পূর্বকূলই বটে। এই দ্বীপ অতলান্তিকের বুকেই। কিন্তু মার্কিন দেশের ‘পূর্বউপকূল’ বলতে যে চরিত্রটা মনে ভেসে ওঠে—WASP-দের মুখ—সেটা তো এখানকার চরিত্র নয়। ও পাড়াটা প্রধানত শ্বেতাঙ্গদের আর এ পাড়াটা কৃষ্ণাঙ্গদের। যদিও এখানে শাদা প্রচুর,—আমাদের দ্বীপে এককালে সব জমির মালিকানা ছিল কালোমানুষের। এটাই সেন্ট হেলেনার অহংকার।’ বলতে বলতে দূরে দেখলুম ওই প্ল্যান্টার্সদের প্রাসাদ থেকে একটি শাদা মেয়ে আর শাদা বাচ্চা ছেলে নেমে আসছে—গ্লোরিয়ার সঙ্গে শাড়িপরা আমাকে দেখে একগাল হাসল।
‘ওই হচ্ছে নীলকর সাহেবের বিধবা বউ। উনিই এখানে থাকেন ওই বাচ্চা ছেলেটিকে নিয়ে। বৃদ্ধস্বামী মারা যাবার সময়ে এই বাড়ি জমি ওদেরই দিয়ে গিয়েছেন। এই মেয়েটি ওর চতুর্থ স্ত্রী। আলাপ করবে নাকি? ওর তিনটে সৎ ছেলে আছে, স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের, তিনজনেই ওর চেয়ে বয়েসে অনেক বড়, চল্লিশ পঞ্চাশ বছর বয়েস তাদের।’
—’তারা রাগ করেনি? সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে মামলাটামলা করেনি?’
—’নাঃ, তাদের অন্যান্য সম্পত্তি দান করে গেছেন। উইলির দাদারা ওকে যথেষ্ট স্নেহ করে।’
-’ওই মেয়েটির বয়েস কত হবে?’
—’কত আর, বছর পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ হবে বড়জোর। আমি ওর স্বামীকে দেখেছি, খুব শক্তসমর্থ বৃদ্ধ ছিলেন। টেনিস খেলতেন, সুইমিং করতেন—ওই তো ওপাশে ওদের টেনিস কোর্ট আছে, সুইমিং পুল আছে—অবশ্য সারাবছর, ওরা বস্টনে থাকে, বাচ্চা স্কুলে যায় তো? সামারে আসে।’
-’বস্টনে কেন? ওর মা-বাবা থাকেন বুঝি?’
–’না, সে এক বিচিত্র গল্প। ওর স্বামীরই আরেকটি বাড়ি আছে কেম্ব্রিজে, সেটি তাঁর প্রথমা স্ত্রীকে দেওয়া সেই স্ত্রী ওখানেই থাকেন। এই স্ত্রী-পুত্রও বস্টনে গিয়ে তাঁরই বাড়িতে ওঠেন।’
—’সে কি? ঝগড়া হয় না দুই সতীনে?’
–না না, সেই তো মজা। প্রথমা স্ত্রী নিঃসন্তানা। ভদ্রলোক তারপরে আরও দু’বার বিয়ে করেছেন—জেনি তো চতুর্থ। ওর ওপরে বৃদ্ধা ভদ্রমহিলার কোনো অভিযোগ নেই। ওঁর বিবাহ ভেঙেছিল অন্য এক নারীর কারণে। জেনিকে উনি মায়ের মতো স্নেহ করেন। বাইশ বছরের মেয়ে যখন সত্তর বছরের ভদ্রলোককে বিয়ে করল, সবাই ভেবেছিল এ বিয়ে টিকবে না। কিন্তু পনেরো বছর টিকেছিল। পঁচাশিবছর। গতবছর মারা গেলেন এই বাড়ির কর্তা। কম কী? ‘
–’জেনি আবার বিয়ে করবে না? দেখলে তো খুবই ছেলেমানুষ মনে হয়।’
-’ইচ্ছে আছে তো। কিন্তু মুশকিলও আছে। ওই যে জেনির স্বামীর প্রথমা স্ত্রী, তাঁর এখন সাতাশি, তিনি স্বামীর প্রায় সমান বয়সী ছিলেন—উনি আবার উইলিকে ঠিক নাতির মতন স্নেহ করেন। ওঁর যাবতীয় সম্পত্তি উইলিকেই উইল করে লিখে দিয়েছেন। বস্টনের বাড়ি সমেত। উইলির দেখাশুনো ওর সতীন মহিলাটি করেন বলেই জেনি চাকরি করতে পারে। বস্টনের একটি দৈনিক কাগজে চাকরি করে জেনি। বিয়ে করলে ও ছেলের ওপর অধিকার হারাবে—এরকমই কনডিশান আছে। লিভ টুগেদার করলে আপত্তি নেই বোধহয়। কিন্তু পাচ্ছে কোথায় মনের মত পুরুষ? ধনী হবারও অনেক জ্বালা। তবে একই স্বামীর দুই বিধবা স্ত্রী এত ঘনিষ্ঠতা, এটা বড় দেখিনি।’
-’স্বামীর চেয়ে পঞ্চাশবছরের ছোট হয়েও পনেরো বছর ঘর করাটাও কমই দেখা যায়, গ্লোরিয়া!’ বস্টনের বাড়িটা ঠিক কোথায় ওদের?’
–’কেম্ব্রিজে কোথাও। কাল তোমাকে ওদের ম্যানশন দেখাতে নিয়ে যাব।’
-’এবার তোমার সমুদ্রসৈকতটাতে যাবে না?’
–’হবে হবে, সৈকত তো পালিয়ে যাচ্ছে না? এত তাড়া কিসের?’ গ্লোরিয়া অলসসুরে মাভৈঃ দেয়। আমাদের এই মাঠটা আগাছায় ভরা—ওই সাদা বাড়ির সামনের মাঠের মতন ছাঁটাকাটা নয়। দুটো মাঠের মধ্যে বেড়া নেই–অথচ অদৃশ্য একটা গণ্ডী কাটা আছে। ওদিকটা ভদ্রসুলভ, মার্জিত, লন। আর এদিকটা? এবড়ো খেবড়ো, আগাছায় জংলা কাঁটা ঝোপে, ভর্তি, ফুলগাছবিহীন বুনো ফুলও দেখছি না—ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বেগুনী সাদা ঘাসফুল ছাড়া—কয়েকটা বিশাল বিশাল গাছের আশ্রয়ে যথেচ্ছ বুনো স্বভাবেই বাড়বাড়ন্ত হয়েছে এই মেঠো ঘাসজমিনের। আমার খুব ভালো লাগছে এদিকটা। এটাই গ্লোরিয়ার দিক। এখানে সবিনয়ে সসম্ভ্রমে প্রকৃতিদেবীকে পথ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যেন। যা তাঁর খুশি, তাই তিনি করতে পারেন এই দিকটায়। আর ওইপাশে সগর্বলালিত পাশ্চাত্ত্য সভ্যতা।
–’সাপটাপ বেরোয় না তো তোমার মাঠে? যা ঝোপঝাড় জঙ্গল বানিয়েছ?’
-’বেরোয় মাঝে মাঝে। তবে বিষাক্ত নয়। দক্ষিণে অনেক সাপ, আবার ময়ূরও আছে কোথাও কোথাও। ইউডোরা ওয়েলটির লেখাতে ময়ূরের কথা আছে।’
—’উনি তো শ্বেতাঙ্গিনী।’
—’কিন্তু দক্ষিণের তো। ওঁর মধ্যে রেসিজম নেই। দক্ষিণের সাদা মানুষ মাত্রেই যে রেসিস্ট হয় বলে পূবের মানুষদের ধারণা, তা ঠিক নয়। দক্ষিণী শাদারা বরং বেশি উষ্ণ স্বভাবের, বন্ধুতাপ্রবণ, পূর্বের মতো চালিয়াৎ, উন্নাসিক নয়। গরীব তো! সেই ধনী শ্বেতাঙ্গরা আর কোথায়? তারা অন্য জাত।’
সত্যিসত্যিই যে গ্লোরিয়ার দোতলা বাড়িতে ছ’টা ফাঁকা ঘর থাকবে, তা কিন্তু আমি ভাবিনি। খাটপালঙ্ক না থাক, সোফা কৌচ না থাক, চেয়ার টেবিল তো থাকবে? তাও নেই। কেবল ঢাকা বারান্দায় একটা লম্বা বেঞ্চি-দোলনা। সেটাই বসবার একমাত্র জায়গা। আর রান্নাঘরে একটি প্লাস্টিকের চেয়ার। রান্নাঘরে অবশ্য জিনিসপত্তর আছে। মোটামুটি একমাত্র সুসজ্জিত হচ্ছে ওর ভাঁড়ারের আলমারির তাক। তাকে নানারকমের টিনের খাদ্য, প্যাকেটের খাদ্য, যাতে হঠাৎ কেউ এসে পড়লে গ্লোরিয়াকে অনাহারে না মারা যেতে হয়। এখানে তো দোকানপাটের বালাই নেই, একটা কিছু কিনতে হলেই অনেকদূর চক্-এ ছোটো। এ দ্বীপটায় অবশ্য কোনো জায়গাই ‘অনেকদূরের’ হতে পারে না, যেহেতু লম্বায় ন’মাইল আর চওড়ায় আড়াই মাইল। মাত্ৰ কয়েকশো মানুষের বাস। ছোট্ট গ্রাম একটা।
দোতলায় একটা ফাঁকা ঘরে আমার সুটকেসটা রেখে দিল গ্লোরিয়া। অন্য ঘরটায় দেখলুম ওর কাগজপত্তর, কাপড়চোপড় ছড়ানো অতএব ওটা ওর ঘর। মেঝেয় একটা বিছানাও পাতা। এবার একটা বিশাল বেলুন জাতীয় জিনিস একটা বাক্স থেকে টেনে বের করে ফোলাতে শুরু করে দিল গ্লোরিয়া। ‘তোমার জন্য ১০১ ডলার দিয়ে কিনেছি, ফোলানো গদি। শুনেছি খুব আরামের। চাদর আছে। বালিশও কি লাগে তোমার?’ গদিটা ফোলানো এক বিপুল ব্যাপার। শেষ অবধি গদিতে রূপায়িত হল সে। বিছানাও তো পাতা হল। সমস্যা হল রাত্রে। এদিকে শুলে, ওদিকে গড়িয়ে মেঝেয় পড়ে যাই, হয় গদি ঠেলে ফেলে দেয়, নইলে এদিকটা চেপ্টে যায়, আর ওদিকে শুলে এদিকে। সারারাত যুদ্ধ চলল। যাতে গদি থেকে কিছুতেই না পড়ে যাই। আমাদের রাওসাহেবের গদি আঁকড়ে পড়ে থাকার লড়াইয়ের চেয়ে কিছু কম রোমাঞ্চকর নয় আমার গদি আঁকড়ে শুয়ে ঘুমুবার যুদ্ধ। পরদিন সকালে ক্লান্ত, চোখে কালি, হাতেপায়ে জোর নেই—রাওয়ের মত স্ট্যামিনা নিয়ে আমি তো জন্মাইনি-কোনোরকমে নিচে চললুম কফি খেতে। মনে মনে ঠিক করে ফেললুম, আর নয়। আজ থেকেই সিধে মেঝেয় চাদর পেতে। এবং তাই করলুম বাকি কটা রাত। ওই লাউগড় গড় যোগনিদ্রার ব্যায়াম আমার বাঙালী হাড়ে পোষাবে না!
কিন্তু শোবার আগের ঘটনা তো বলা হয়নি। আমি যাবই গ্লোরিয়ার ‘প্রাইভেট বীচ’ দেখতে—গ্লোরিয়া বলছে, কাল সকালে। তখন গ্লোরিয়া বলল, ‘ওখানটা আগে আমি পরীক্ষা করে আসি। অনেক সময়ে মাছটাছ এসে মরে পড়ে থাকে, তখন একদম সুন্দর লাগে না। তাছাড়া সাপখোপও রাত্রে দেখা শক্ত। যতই টর্চ নিয়ে যাও। সন্ধ্যেবেলার সৌন্দর্য, সমুদ্রের দৃশ্য-সব ঘর থেকেই বরং দেখি না আমরা। দোলায় বসে?’
–’অন্তত বাগানে গিয়ে তো বসতে পারি?’—আমি চঞ্চল হে!
-বাধ্য হয়ে তখন গ্লোরিয়া বলল—’তুমি নিজেই এক্ষুনি বুঝবে, কেন বাগানে বসা যাবে না। আমার বাগান তো বাগান নয়, বনজঙ্গল, তাতে অনেকরকমের পোকা থাকে। সন্ধ্যেবেলায় তারা বেরোয়। ওই ঘাসের জঙ্গল ভেদ করে যাওয়া যাবে না, পোকারাই খেয়ে ফেলবে। পোকারা বন্ বন্ করে তোমায় ঘিরে ঘুরবে, কামড়ে দেবে। আর মশা তো আছেই। সব জানলায় দরজায় জাল লাগিয়েছি—তবু যে ব্যাটারা কোথা দিয়ে ঢোকে!’
এতক্ষণে খেয়াল করি, দিল্লির বাড়ির মতন এই বাড়িতে সব জানলায় জাল আটকানো। আর একটা করে জালের দরজা আছে সব বাইরের দিকে দরজায়। আমেরিকাতে এই দৃশ্য এই প্রথম দেখলুম। এতৎ সত্ত্বেও মাঝে মাঝেই ঘরে চড় চাপড়ের শব্দ হতে থাকল এবং গ্লোরিয়া একটা কী এনে স্প্রে করে দিল। আর ওডোমসএর কোনো মার্কিনি ভায়রাভাইকে নিয়ে এসে আমার হাতেপায়ে মলমও লাগিয়ে দিল সে। বাঃ, নিচের ঘরে সীলিং ফ্যান আছে বটে দোলনার মাথায় কিন্তু ওপরে আমাদের শোবার ঘরে টেবিলফ্যান আছে এক-একজনের এক-একটা। সীলিং ফ্যান এখনও কেনা হয়নি। এগুলো ওর ছিল।
হঠাৎ গ্লোরিয়া দূরে অঙ্গুলিনির্দেশ করে আমাকে বললে—’ওই যে, ওই যে শ্রিঙ্ক বোট, চিংড়িমাছ ধরবার জাহাজ—ঘরে ফিরছে’—আমি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অনেকদূরে আবছা একটা ছাইরঙের আকৃতি দেখলুম। জাহাজ ঠিকই, মাস্তুল আছে—কিন্তু তার দুদিকে দু’টো পাখনা মেলে রাখা—’ওই পাখনামেলা জাহাজগুলোই তো চিংড়িমাছ ধরে বেড়ায়! ওই তো জাল!’ জীবনে প্রথম চিংড়িমাছ ধরার জালকে দুপাশে দুহাত মেলার মতন করে মেলে ধরতে দেখলুম কোনো জাহাজকে। অনেক বছর পরে, ‘ফরেস্ট গাম্প’ সিনেমা দেখতে গিয়ে ওইরকম ডানামেলা জাহাজের ছবি দেখেই ঠিক চিনতে পেরেছিলুম, চিংড়িমাছ ধরতে বেরিয়েছে।
পরদিন সকালে আমরা বনবাদাড় ভেঙে বেশ কটা দড়ি ঝুলোনো ওকগাছ পেরিয়ে, গ্লোরিয়ার আঙ্গিনা পার হয়ে সমুদ্রতীরে গেলুম। সত্যি এ জিনিস আগে কখনও দেখিনি। জানি না, আগে হয়তো পুরীতে বাঙালী বাবুদের এরকম বাঁধানো ঘাট ছিল, বালির তলায় যা আজ নিশ্চিহ্ন, কিন্তু এখানে প্রত্যেক বাড়ির একটা করে ঘাট রয়েছে, বাঁধানো ঘাট। পাথরের সিঁড়ি নেমে গেছে অল্প নিচের সমুদ্রতীরে। বেশ বালুকাবেলা রয়েছে, তাতে ঝিনুক, শাঁখ ছড়ানো, মরামাছ চোখে পড়ল না, কিন্তু মরা ঝাঁজির শেষ নেই। কচুরিপানার মতো দেখাচ্ছে। শরবনের মতো লম্বা লম্বা ঘাস আছে এখানেও, নোনাজলে তাদের কোনো অসুবিধে নেই। গ্লোরিয়ার সিঁড়িটা খুবই বিপজ্জনক। তার আভাস আছে মাত্র, বালিতে অনেকটাই ঢেকে ফেলেছে—গ্লোরিয়া হাহাকার না করে শুধু বলল-’এইসব পরিষ্কার করতে হবে। আমার কিছুতেই সময় হয় না। দ্যাখো দ্যাখো, ওদের সব সিঁড়িটিড়ি কত পরিষ্কার, চলো ওদের ঘাট দিয়ে নামি
সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলে, বালির কার্পেট তো সমানভাবেই পাতা, ওদিকে বাড়ির বালিতে দেখলুম কী সব সামুদ্রিক বস্তু শুকোচ্ছে, জালটালও শুকোচ্ছে, ওদিকের বাড়ির বাসিন্দারা বেশ যত্ন নেন তাঁদের ঘাটের—তাঁদের জলের শরবনও পরিষ্কার করেন মাঝে মাঝে ওঁদের সৈকতটার বেশ ব্যবহৃত চালু চেহারা। একটা নৌকোও উলটে রাখা আছে। গ্লোরিয়ার বাগানের মতোই, তার ঘাটের সিঁড়ির মতই, তার সৈকতও প্রকৃতিমায়ের রক্ষণাবেক্ষণে। বেশ জংলা, এবং অপরিচ্ছন্ন। অনেক শামুকগুগলি ঝিনুক-টিক পড়ে আছে, ভাল করে খেয়াল করলে দেখি তারা নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে-কাঁকড়ার গর্তও রয়েছে দিব্যি ছোট্ট ছোট্ট। জলের কাছে বালি ভিজে ময়লাটে কালচে। অনেক জলজ উদ্ভিদ লেগে আছে কিনারে।
একটু দূরে এপাশে বালি পরিষ্কার, সাদা। মাঝে মনে হয় হাঁটবার রাস্তা, মানুষজনের ব্যায়ামট্যায়াম করতে যাবার পথ। গ্লোরিয়া দোলনায় দোলা ছড়া কেনো ব্যায়াম করে না। এই উপকূলটা ওর নিজস্ব বীচ—কিন্তু এখানে স্নানটান করা যায় না। চেয়ার পেতে বসা যায়, তা এখানে চেয়ার টেয়ার নেই বটে কিন্তু সিঁড়ির মাথায়, মাঠের উপর পাথরের বেঞ্চি আছে, ইচ্ছে করলে তাতে বসে অনন্তকাল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি আমি। যতক্ষণ না পোকারা ও মশারা আপত্তি জানাচ্ছে। অন্যপাশে অন্যদের বীচ, রঙিন ছাতার নিচে রঙিন দুটি প্লাস্টিকের চেয়ার, যেমন বিচে থাকবার কথা। কয়েকটা বড়, ছোট বলও আছে।
গ্লোরিয়া বলল—’ওরা ওদের মাঠে এক্ষুনি আসবে। এইসব পেতে গেছে।’
-’সবসময়ে পাতা থাকে না?’
-’তা কেমন করে থাকবে? এত সরু বীচ, জোয়ার এলেই জলে ভরে যায় তো। তাই তো এই উঁচু পাড়, আর সিঁড়ি। জল যাতে ওপরে না যায়। তবুও তো গৈল বছর বান ডেকেছিল। এদের বাড়িটায় জল ঢুকেছিল। কপালগুণে আমার বাড়ি অনেকটা দূরে—মাঠ পেরিয়ে বন্যার জল অতদূর আর যায়নি।’
এ বাড়িটা খুব আধুনিক দেখতে। পিছনে ট্রাকের মাথায় মস্ত নৌকো বাঁধা—অনেকগুলো গাড়ি অনেকগুলো গ্যারেজ। ক’জন লোক থাকে এখানে?
—’এরাও শ্বেতাঙ্গ, পূর্বাঞ্চলের মানুষ, এখানে বাড়ি বানিয়ে চলে এসেছেন অবসরগ্রহণ করার পরে। বৃদ্ধ মিশুক নন, বৃদ্ধা খুব মিশুক। বৃদ্ধা মধ্য ইউরোপের ইহুদী, বৃদ্ধা WASP (White Anglo Saxon Protestant)। ওঁদের ছেলেমেয়েরা ছুটিতে এসেছে এখন। এমনিতে দুটো ভয়ঙ্করদর্শন কুকুর আছে, কিন্তু ওই দেখতেই ভয়ঙ্কর। স্বভাব খুব মিষ্টি।’
এই সমুদ্রটাকে আমার অ্যাটলান্টিক বলে বিশ্বাসই হচ্ছে না, হালকা রং, ঢেউটেউ নেই—হ্রদ হ্রদ ভাবখানা। নোনাবাতাসটা কেবল জবাব দিচ্ছে, হ্রদ নয়, সাগর। ‘চল, বীচে যাই’–তোয়ালে কস্টুম নিয়ে আমরা চললুম এই দ্বীপের পাবলিক বীচে। কী যে সুন্দর, কি বলব। সেখানে সমুদ্র সমুদ্রের মতোই। বীচে অনেক গাছপালা, ক্যাকটাস আছে বড় বড়, ভিড় নেই, ফাকা, কিন্তু মানুষ আছে। বাচ্চারা খেলছে, বেশ স্বাভাবিক, রিল্যাক্সড্ আবহাওয়া। এই দ্বীপের বাসিন্দারাই তো শুধু এই বীচে আসেন, ট্যুরিস্টের ভিড় নেই। তাই শান্তিপূর্ণ, আর অব্যবসায়িক চেহারা। লক্ষ্য করলুম এখানে কেউ টপলেস হয়ে নেই। বিকিনিও চোখে পড়ল খুব কমই, শুধু খুবই অল্পবয়সী মেয়েরা পরেছে, এবং শিশুরা। দক্ষিণ একটুখানি রক্ষণশীল, জানতুম। এবার চাক্ষুষ প্রমাণ মিলল। সবাই সপরিবারে এসেছে—পিকনিকের আবহাওয়া। ইউরোপের সমুদ্রসৈকতে যে সেক্সের আঁশটে গন্ধ সেটা এখানে, এই ছোট্ট সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নেই।
-’ফ্রিজ আইল্যান্ড গেলেই সেসব পাবে।’ গ্লোরিয়া বলল—’ সেখানে তো স্থানীয় মানুষ খুব কমই, সবাই ট্যুরিস্ট, বাকীরা ট্যুরিজমের ব্যবসা করছে, হোটেলওয়ালা। ওখানে বীচে গেলে এরকম ঘরোয়া পরিবেশ পাবে না।’ এখানে একটা আইসক্রিমওলাও নেই।
-’কবে যাব আমরা ফ্রিজ আইল্যান্ডে?’
–’আরে আগে তো এখানটা চেনো। চলো লাঞ্চ খেয়ে পেন মিউজিয়ামে যাই। এখানকার ইতিহাস জানা হয়ে যাবে।’
-’কলমের যাদুঘর?’
–’আরে না Penn পেন। এখানে শিক্ষার প্রসার করেছিলেন যিনি, এখানে সংস্কৃতির প্রসার করেছিলেন যিনি, সেই মহিলার কথা জানবে—
পেন মিউজিয়ামটি ছোট্ট, সুন্দর। অনেক কিছুই এখন আর মনে নেই—কিন্তু যেটা সবচেয়ে বেশি মনে আছে, সেটা ওখানে দেখা, সদ্য স্বাধীন হওয়া কৃষ্ণাঙ্গিনীদের সম্ভ্রান্ত পোশাক পরা সিপিয়া রঙের ফটো। মুখগুলোতে কী ঔজ্জ্বল্য, কী স্বপ্ন সেইসব চোখে, কী আশা, আর কী আত্মবিশ্বাস। একটা ছোটো ডকুমেন্টারিও দেখলুম। দেখলুম সেইসব ঝুড়িটুকরি, বাসনপত্র, লেপকাঁথা, যা যা ক্রীতদাসীরা বানাতো—এখানে যারা এসেছিল তারা সকলে পূর্ব আফ্রিকার মানুষ। তাদের হাতের কাছে সব তাদের সঙ্গে সঙ্গে এনেছিল অভ্যস্ত আঙুলে এবং এসেছিল তাদের ভাষা। এখন এই দ্বীপপুঞ্জে সাউথ ক্যারোলিনার সরকারের অন্তর্গত এই যে ছোট্ট একগুচ্ছ দ্বীপ, যা জর্জিয়ার মাটির কাছাকাছি—এখানে মানুষরা একটা অন্যরকম ভাষা বলেন। সেটা শুনতে ইংরিজিই, অথচ ঠিক ইংরিজি নয়। এদের ব্যাকরণের ব্যবহার একেবারে আলাদা। ভাষাটার নাম ‘গুল্লা’। ভাষাবিদ্রা শেষটা আবিষ্কার করেছেন গুল্লাভাষার বিচিত্র ব্যাকরণের কারণ—এর ব্যাকরণের কাঠামো পূর্ব আফ্রিকার এক আদিবাসী ভাষার, যেখান থেকে ধরে আনা হয়েছিল এই ক্রীতদাসদের—আর শব্দগুলো ইংরিজি। গুল্লা ভাষার গানে এখনও পূর্ব আফ্রিকার সুর, গুল্লাভাষার রূপকথায় এখনও পূর্ব আফ্রিকার গল্প।
এখন শিক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় নির্ভুল ইংরিজি ভাষা লেখেন, বলেন, কিন্তু এই দ্বীপপুঞ্জেই বাড়িতে সবাই এখনও গুল্লাভাষাতে কথা কন। গানও বাঁধেন গুন্নাভাষায়। ‘ভারি মিষ্টি ভাষা, এ ভাষায় অনেক ক্রীতদাসীদের কাজের সময়কার গান আছে’—যদিও গ্লোরিয়া গুল্লা ভাষা জানে না। আমি এদিকে গুল্লাভাষা শুনতে ভীষণ ব্যাকুল হয়ে পড়েছি।—তখন সে আমাকে তার এক তরুণী বান্ধবীর বাড়ি নিয়ে গেল। বান্ধবী স্কুলে পড়ান, কিন্তু তাঁর স্বামীটি শিল্পী, গান করেন।
সন্ধেবেলায় আমরা গিয়ে উপস্থিত সম্পূর্ণ অন্য চেহারার এক মধ্যবিত্ত পাড়াতে। এখানে উঠোনে সমুদ্র নেই। ছোট্ট রুমালের মতো বাগান নিয়ে ছোট ছোট একতলা বাড়ি। একটি লালরঙের একতলা কাঠের বাড়িতে আমরা ঘণ্টা বাজাই। ওঃ কী যে সুন্দরী সেই মেয়েটি, এবং তার সুশ্রী-সুঠাম যুবক স্বামী—হঠাৎ দেখলে চোখে যেন মায়া জড়িয়ে যায়। আর তাদের যে দুষ্টু বাচ্চা মেয়েটা, তিনি তো একনম্বরের ওস্তাদ। বছর দুই বয়স, টলে টলে হাঁটেন, কিন্তু এখনই জানেন নিজে কত রূপসী। নানান ‘পোজ’ দেন—মনভোলানী।
মোমবাতি জ্বেলে চিরাচরিত সাদার্ন সাপার খাওয়ালো ওরা, বেশ গর্গরে মশলাপাতি দেওয়া রান্না।—নিজেরা কিন্তু ওরা গুল্লা ভাষাতে কথা বলছিল না, আমরা আছি বলে, যতই বলি না কেন আমি গুল্লা ভাষা শুনতে চাই!—শেষে ছেলেটি অনেক অনুরোধে, গুল্লা ভাষাতে গান গাইল—নিজেরই লেখা, নিজের সুর দেওয়া গান। জন্মদিনে নিজের স্ত্রীকে উৎসর্গ করা। মিষ্টি প্রেমের গান। দুষ্টু মেয়েটা গান শুনতে শুনতে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘরে অতিথি এলে শ্বেতাঙ্গ বাচ্চাদের কিন্তু এভাবে মিশতে দেখা যায় না। পূর্ব আফ্রিকার কোনো বাজনা নয়, গিটার-ই বাজাচ্ছিল ছেলেটি ছোটোখাটো অনুপুঙ্খ মনে পড়ছে, ঘরে টকটকে লাল গোলাপফুল ছিল, প্রথমে আমি নকল ভেবেছিলুম। অনেক ক্রিমরঙের ক্রোশের লেসের সুন্দর সুন্দর জিনিসপত্র ছিল, মেয়েটির দিদিমার হাতে বোনা। দিদিমার মা ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তিনি নাকি অনেক তুকতাকও জানতেন; যা দিদিমাকে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। এসব তুক, মেয়েটি বলেছিল, সেই পূর্ব আফ্রিকার জঙ্গলের থেকে স্মৃতির আঁচলে বেঁধে আনা। ছেলেটি হাসলো—’সেই তো, সেই তুকের জন্যেই তো আমি কোনো দ্বিতীয় নারীর দিকে তাকাতে পারি না!’
-শুনে তরুণী স্ত্রীর ভাশা, পেয়ারা রঙের গালে গোলাপী আভা লাগল–এত সুন্দরী স্ত্রী থাকলে, অন্য স্ত্রীর দিকে কেউই ফিরে তাকায় না। মেয়েটির মুখের চারপাশে রঙিন পুঁথিবাঁধা ছোট ছোট বিনুনীর রাশি দুলছে। ব্রাউন চুল। এও হয়তো পূর্ব আফ্রিকা থেকে আনা পুরনো দেশের কেশসজ্জা! খেয়ে দেয়ে গান শুনে যেন একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরে এলুম। এতক্ষণে যেন সেন্ট হেলেনা দ্বীপের সন্ধ্যের সঙ্গে চেনা পরিচয় হল।
.
শ্বেতাঙ্গ কটন প্লান্টারের বাড়ি কেমন হয়, আমাকে দেখাতে, গ্লোরিয়া আমাকে পাশের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল পরের দিনই। বিশাল বিশাল ঘর, পিরিয়ডপীস দিয়ে যত্নে সাজানো, দামী কার্পেটে মোড়া, কাঠের প্যানেলিং করা দেওয়াল—বাইরে থেকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না। সাতবছরের বাচ্চাটির ঘরে অনেক খেলনাপাতি। সে একটা কম্পিউটার নিয়ে বসে মার সঙ্গে খেলছে। দেখলে মনে হয় বুঝি এক্ষুনি ঘন্টি বাজালেই উর্দিপরা দাসদাসীরা আবির্ভূত হবে ভুঁই ফুঁড়ে। কিন্তু ঘন্টি বাজল না, মা উঠলেন আমাদের জন্যে কফি বানাতে। জমানা বদল গয়া। কফি বানাতে বানাতে গল্প হচ্ছিল। বয়স্কা সতীনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মেয়েটি, তার নিজের মা নেই, বাবার পুনর্বিবাহিত সতীনই তাকে মাতৃস্নেহ যুগিয়েছেন। না, ডিভোর্সটা তাঁদের অনেককাল আগেই হয়ে গিয়েছিল। এই জেনির জন্যে হয়নি।
–’বস্টনে কোথায় থাকেন উনি?’
—’বস্টনে ঠিক নয়, কেম্ব্রিজে।’ শুনেই উৎসাহিত হই–’আমার মেয়েও কেম্ব্রিজে থাকে। কেম্ব্রিজে কোথায়?’—হার্ভার্ড স্কোয়্যারের কাছে।’
–’আমার মেয়েও হার্ভার্ড স্কোয়্যারের কাছে, হস্টেলে থাকে। এখন অবশ্য ছুটিতে ওর বাবার বাড়ি পাহারা দিচ্ছে।’
—’আমাদের সতীনের বাড়ির রাস্তাতেও ‘সেন’ বলে একজন থাকেন। সেন নামটা খুব কমন, না? হার্ভার্ডে পড়ান।’
-সেন নাম কমন। কিন্তু হার্ভার্ডে পড়ান এমন সেন খুব বেশি নেই। তাই বলি।
—’রাস্তাটার নাম কী?’
-’হিলিয়ার্ড স্ট্রিট।’
-’কত নম্বর?’
—’আট।’
–’আমার মেয়ের বাবার বাড়ি ছ’নম্বর। আট নম্বরের মহিলাকে আমি চিনি। দুটো কুকুর, অনেক বেড়াল, ভারি চমৎকার মানুষটি।’
-’আমার ঠাকুরমারও ঠিক তাই আছে,—জানো, দুটো কুকুর, আর অনেক বেড়াল।’ এতক্ষণ জেনির পুত্র সোৎসাহে কথা কইল। কী আশ্চর্য আমাদের এই ক্ষুদ্র জগৎ সংসার। কোথায় নির্জন সেন্ট হেলেনা দ্বীপের তরুণী বিধবা জেনি, কোথায় কলকাতার আমি। আর কোথায় কেম্ব্রিজের হিলিয়ার্ড স্ট্রিটের ছায়াঘেরা আট নম্বর। এই আশ্চর্য যোগাযোগের কথা আমি লিখছি বটে, কিন্তু আপনারা হয়তো বিশ্বাস করছেন না। বড্ড বেশি কাকতালীয়, না? এতটা কিন্তু বানানো যায় না। কোনো বুদ্ধিমান লেখক এরকম হিন্দি ছবির মতো করে স্মৃতিকথা বানাবেন না। ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ ছাড়া মিথ্যার বেসাতি হবে না, কিন্তু সত্য প্রায়ই অবিশ্বাস্য।
পেন মিউজিয়ামে গিয়ে একজন শ্বেতাঙ্গিনী মহিলার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তিনি কানাডিয়ান নভেলিস্ট বলে নিজের পরিচয় দিলেন। তাঁর প্রথম বই এখনও প্রেসে। রোমান্স লিখেছেন। কত হাজার হাজার কপি যেন ছাপা হচ্ছে। ওঁর স্বামীই ওকে একাজে লিপ্ত করেছেন। তিনি আইন ব্যবসায়ী। তিনি হিসেব করে দেখেছেন, যে কানাডার ছোট কলেজে ইতিহাস পড়ানোয় যা উপার্জন হয়, একটা সফল বাজারী উপন্যাস লিখতে পারলে তার চেয়ে ঢের বেশি গুণ আয় দেয়। তাই উনি স্বামীর বুদ্ধিতে উপন্যাস লিখেছেন। ওঁর পরবর্তী রোমান্স এই দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে লিখতে চান, তাই এখানে এসে থাকা। গ্লোরিয়ার পরিচয় পেয়ে তিনি মোহিত-কৃতার্থ হয়ে আমাদের তাঁর বাড়িতে লাঞ্চে নেমন্তন্ন করলেন। আমরা তো সেটাই চাই। সঙ্গে সঙ্গে ‘আঁচাব কোথায়?’
পরদিন সেজেগুজে একটি ওয়াইনের বোতল উপহার বগলে করে আমরা রওনা দিই ফ্রিস আইল্যান্ডের দিকে। সেও আরেকটি সাগর সেতু দিয়ে বাঁধা। সত্যি এতই অন্যরকমের দেখতে এই অতি নির্জন দ্বীপ, আর জনশূন্য, বুনোজঙ্গলে ঘেরা সৈকতভূমি, সহজেই একটা নেশা ধরিয়ে দেয়। এখানে সমুদ্র পুরী-গোয়া-দীঘা-জুহুর মতন নয়, একেবারে নগ্ন নির্জন হাতের ছোঁয়াটি পাওয়া যায় এখানে। শুধু নুনের গন্ধই নেই, নির্জনতার একটা আলাদা সোদা গন্ধ মিশে আছে এখানকার বাতাসে।
ফ্রিজ আইল্যান্ড পৌঁছবার আগেই তার সুসজ্জিত অতি মার্জিত সৈকতদৃশ্য দেখা গেল। মনে হল যেন বাহামায় কিম্বা বারবাড় দ্বীপে এসেছি, ক্যারিবিয়ানসের ধরনে সাজানো বীচ। সবুজ-পাম গাছ; রঙিন ছাতা অলস ডেকচেয়ার, খড়ের ছাউনির তলায় নকল কুটিরের পানীয়ের বেসাতি।—কিন্তু ইচ্ছেমতো যে কেউ যেখানে সেখানে যেতে পারবে না। এখানে ঘরবাড়ি, হোটেল টোটেল যাদের, বীচগুলিও তাদের নিজস্ব। এই আমরা যে বাড়িতে যাচ্ছি, তার নিজস্ব বীচে যেতে পারি। গেটে পুলিশপাহারা।—মস্ত প্রাচীর ঘেরা, আঙিনায় অনেকগুলি বাংলোবাড়ি, ফ্ল্যাটবাড়ি। একটা কলোনি আর কি। যেখানে যাব জানাতেই প্রথমে সেই বাড়িতে, ফোন করে জানানো হল অতিথির আগমনীবার্তা; অনুমতি পাবার পরে আমাদের একটা ম্যাপ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে সেই নম্বরের বাসাটিতে পৌঁছতে হবে। কোন পার্কিং লটে গাড়ি থাকবে। এই দ্বীপটির আমাদের দ্বীপের বিপরীত স্বভাব, এর চিত্রও আলাদা, চরিত্রও আলাদা। কোথায় সেন্ট হেলেনা, আর কোথায় ফ্রিজ।
কানাডিয়ান মহিলা স্বামীসমেত অপেক্ষা করছিলেন তাঁর বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। চারদিকের বড় জানলাও ছোট বারান্দা থেকে সমুদ্র ঘিরে আছে। তেতলায় ফ্ল্যাট ওঁদের। স্প্রিট লেভেলের ঘরবাড়ি। নিচে উঠোনে সুইমিং পুল—তার ওপাশে বেড়ার বাইরে সমুদ্রে স্নানের ঘাট। বালুকাবেলায় অনেকেই স্নান করছেন, সকলেই এই বাড়ির বাসিন্দা নিশ্চয়ই। সবাই সবসময়ে সমুদ্রস্নান করেন না। সুইমিং পুলে আগে শিশুদের সাঁতারটা শেখানো পছন্দ করেন অনেকে। এখানে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সপরিবারে ছুটি কাটাতে আসেন মার্কিন দেশের নানা অঞ্চলের ধনী মানুষেরা।
মহিলাটির নামও মনে নেই। অথচ এটা মনে আছে যে তিনি একটি ছদ্মনামে বইটি লিখছিলেন। ‘যদি বাজারে নেয়, তবে কি প্রকৃত নাম দেবেন?’ জিজ্ঞেস করতে উনি বললেন—’না—আমার নামটা নাকি বাজারে চলবে না, বড় প্রোজেইক আর বড্ড ভারি। বাজারে চলার জন্যে চাই একটু আন-ইউজুয়াল, অথচ হালকা, মিঠে নাম। ফিল্মে নামার সময়ও এভাবে নাম বদল হয়, আমার এজেন্ট আমার নাম বদলে দিয়েছেন।’ গ্লোরিয়ার দিকে প্ৰশ্নসূচক চোখে তাকাই। গ্লোরিয়া হেসে বলল—’আমার একটাই নাম। চললে ভাল, না চললে টু-উ ব্যাড়!’ কানাডিয়ান মহিলা বললেন—’আপনি তো সত্যি সত্যি শিল্পী। আমি তো বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে নভেল লিখছি। আমাকে বাজারের কথা ভাবতে হয়। আমি তো এই দ্বীপপুঞ্জে এসেছি সেও আমার এজেন্টের সাজেশানে। প্রথম বইটা ভারতবর্ষের ব্রিটিশরাজ নিয়ে লেখা রোমান্স। ইতিহাসের বই পড়ে পড়ে লেখা। আমি কখনও ভারতবর্ষে যাইনি। একজন মহিলার সঙ্গে ভারতীয় উজীর ও ইংরেজ সেনাপতির ত্রিকোণ প্রেম।’
ভারতবর্ষে না গিয়েই ভারতবর্ষ বিষয়ে নভেল লিখেছেন—আমি হতবাক। সাহেবরা সবই পারেন। মেমরাই বা পারবেন না কেন? অবশ্য এটা তো লেখা উনিশ শতক বিষয়ে। সেই ভারতবর্ষে যাওয়া তো কেবল কল্পনাতেই সম্ভব। তার জন্য বিশশতকের ভারতবর্ষ দেখা জরুার নয়। বইটির প্রিপাবলিকেশন কপি দেখতে দিলেন। স্ট্রবেরি গোলাপী ও রুপোলী জরী রঙের তীব্র রোমান্টিক মলাটের পেপারব্যাক। গ্লোরিয়াকে একটি কপি উপহার দিলেন। আমাকে বই বেরুলে দেবেন বলেছিলেন। আর দেওয়া হয়ে ওঠেনি। ওঁদের ওখানে চমৎকার স্যালাড ও হাল্কা সামুদ্রিক মাছের লাঞ্চ খেয়ে ফিরে এলুম—দুর্ভাগ্য আমার, সেই নোটবইটা খুঁজে পাচ্ছি না যেখানে ওঁদের সকলের নামধাম ও বইয়ের নামধাম সবই লেখা ছিল। পাশাপাশি দুটি দ্বীপে, দু’রকমের বিপরীত অভিজ্ঞতা হল। সাউথ ক্যারোলাইনার অন্তর্গত এই উপকূলবর্তী দ্বীপপুঞ্জের প্রতিটিই রূপবতী, রহস্যময়ী।
জর্জিয়াতে সাভানা শহরে গিয়ে আরেক রকমের অভিজ্ঞতা নিয়ে এলুম। ছায়াঘেরা তরুবীথি, ফোয়ারায় ভরা পার্ক-আর চমৎকার শাদা রট আয়রনের কারুকার্যকরা রেলিঙের বারান্দায় সাজানো দোতলাবাড়ি—কী যে সুন্দর শহরটা। শাদা মানুষ খুব বেশি চোখে পড়ে না। কালোরাই সংখ্যায় বেশি মনে হল পথেঘাটে। সাভানার একটা প্রাচীন দক্ষিণী সম্ভ্রান্ত হারভাব আছে—নাগরিক চরিত্রও আছে একটা। সে যে কোন দ্বীপ নয়, তাতে সন্দেহ নেই। ফ্রিজ আইল্যান্ড যেমন ফুর্তির জন্যেই তৈরি, ধনীদের হলিডে রিসর্টমেন্ট হেলেনা তেমনি বসবাসের: জন্যে তৈরি—মধ্যবিত্তদের ‘দেশের বাড়ি’। বোফোর শহর এ দুটোর ঠিক মাঝামাঝি। সেখানে ব্যবসাবাণিজ্য, ফিল্ম, কনসার্ট সবই হয়। মানুষ বসবাসও করে, আবার ট্যুরিস্ট সমাগমও হয়। সাভানার মতো গাম্ভীর্য তার নেই, আছে সমুদ্রে ঘেরা একটা নীল সৌন্দর্য।
কিন্তু সেন্ট হেলেনাই হল আমাদের নিজস্ব দ্বীপ, দাড়িওলাবুড়ো ওকগাছের নিচের বুড়ো কাঠের বাড়িতে, আসবাবশূন্য ঘরের মেঝেয় চাদর পেতে শুয়ে যেখানে অনন্তকাল পর্দাবিহীন জানলা দিয়ে পাখনার জাল মেলা শ্রিম্প বোটের, চিংড়ি ধরতে নীল ঢেউয়ে ভেসে থাকা দেখতে পাওয়া যায়।
প্রকাশ : শারদীয় কথাসাহিত্য ১৪০৩