গুরু-শিষ্য সংবাদ
এবারের আলোচনা লেখাপড়া, পড়াশুনা নিয়ে।
অবশ্য এসব পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাপারে আমার মাথা না-গলানোই উচিত। লেখাপড়া, পড়াশুনা আমার বিশেষ কিছু নেই। আমার বিদ্যের দৌড় আমার ক্লান্ত পাঠকদের অজানা নয়, সেটা লুকোনো আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
তবে ওই লেখাপড়ার লেখাটা কিছুটা অভ্যাসবশত, কিছুটা অর্থলোভে একটু আধটু এখনও করে যাচ্ছি। সেসব লেখা পাঠ করে অনেকেই যে হাস্য সংবরণ করতে পারেন না, সে সংবাদও আমার জানা আছে। আমার সম্পাদকেরাও জানেন, তাই মাঝে মধ্যে আমার তত্ত্বতালাশ করেন।
সেসব কথা এখন থাকুক। সেসব দুঃখের কথা বলতে গেলে সাতকাহন, ফুরবার নয়। যে জন্যে আমার লেখা, সেই হাসি-ঠাট্টা, রঙ্গ-রসিকতা তা হলে জমবে না।
আমরা সরাসরি লেখাপড়ার আলোচনায় যাচ্ছি। লেখাপড়া মানে ছাত্র-মাস্টারমশায়, গুরু-শিষ্যের কথা।
লেখাপড়ার গল্প প্রথমে একটা ইস্কুল দিয়ে শুরু করি। একটি স্কুলের ছাত্র তার মাস্টারমশায়কে একবার দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘স্যার স্কুল আমার একদম ভাল লাগে না। অথচ ভেবে দেখুন অন্তত ষোলো বছর বয়েস পর্যন্ত এই স্কুলে আমাকে থাকতে হবে।’
মাস্টারমশায় সাত্বনা দিয়ে বললেন, ‘একবার ভেবে দ্যাখো আমার কথা। আমারও তো স্কুলটা একদম ভাল লাগে না, অসহ্য লাগে। অথচ আমাকে এখানে ষাট-পঁয়ষট্টি বছর বয়েস পর্যন্ত থাকতে হবে।’
এই গল্পেরই একটা রকমফের আছে। এ গল্পটা শৈবালের গল্প।
একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শৈবাল বলল, ‘মা, আমি ইস্কুলে যাব না।’
বলা বাহুল্য শৈবাল এ রকম মাঝেমাঝেই করে।
শৈবালের মা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘কেন যাবে না ?’
শৈবাল বিরক্তিভরা গলায় বলল, ‘কেন আবার কী? আমার ইস্কুলে যেতে ভাল লাগে না।’
শৈবালের মা আবার শীতল গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন ভাল লাগে না?’
শৈবাল বলল, ‘ইস্কুলের ছেলেরা আমাকে একদম পছন্দ করে না। ইস্কুলের মাস্টারমশায়রাও আমাকে পছন্দ করেন না। দারোয়ান, বেয়ারা দপ্তরি কেউ আমাকে দেখতে পারে না। আমি ইস্কুলে কিছুতেই যাব না।’
এতক্ষণে শৈবালের মা বললেন, ‘না তা হতে পারে না। শৈবাল এসব তোমার মনগড়া কথা। তা ছাড়া তুমি তো বাচ্চা ছেলে নও। তোমার চল্লিশ বছর বয়েস হয়েছে। আর তুমি হলে ইস্কুলের হেডমাস্টার, তোমার না গেলে চলবে ?’
ইস্কুল বিষয়ক এ রকম দুটো গোলমেলে গল্প লেখার পর একটু তত্ত্বকথা বলি।
ভিক্টর হুগো বলেছিলেন, ‘একটা ইস্কুল খোলা মানে হল একটা জেলখানা বন্ধ করে দেয়া।’
কথাটার অর্থ সুদূর প্রসারী। লেখাপড়া শিখলে মানুষ দুষ্কর্ম করবে না, অপরাধ করবে না ফলে তাকে জেলে যেতে হবে না।
তবে আজকাল যখন দেখি লেখাপড়া করা, বিদ্বান, শিক্ষিত ভদ্রলোক কত রকম অবর্ণনীয় অপরাধ করছে জাল জোচ্চুরি, ঘুষ, বধূহত্যা, ধর্ষণ তখন কেমন যেন খটকা লাগে।
একটা পুরনো কালের বিলিতি প্রবাদ বাক্য ছিল যে সব মানুষের প্রকৃতিই একরকম, শুধু লেখাপড়াই তাদের আলাদা করে তোলে, স্বতন্ত্র করে গড়ে।
এই সঙ্গে শিক্ষা বিষয়ে আর একটা কথাও মনে পড়ছে। মূল কথাটি কার জানি না, তবে আমরা আমাদের এক অধ্যাপকের কাছে শুনেছিলাম। তিনি কিছুদিন আগে বিগত হয়েছেন। এই সূত্রে তাঁকে স্মরণ করে কিঞ্চিৎ স্মৃতি তর্পণ করছি।
কথাটা অবশ্য স্মরণযোগ্য।
অধ্যাপকমহোদয় বলেছিলেন, লেখাপড়ার উদ্দেশ্য নয় বড় উকিল কিংবা ভাল ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার অথবা বড় নেতা বানানো, লেখাপড়ার উদ্দেশ্য একটাই সেটা হল মানুষ বানানো, মানুষের মতো মানুষ বানানো।
এ সম্পর্কে শেষ আপ্তবাক্যটি লিখে তার আবার সরস কথিকায় প্রবেশ করব।
রাস্তাঘাটে বইয়ের ভারে ন্যুব্জ হয়ে, ক্লান্ত অক্ষম পায়ে শিশুর দল বিদ্যালয় থেকে যাতায়াত করছে। খাতা বইয়ের ঝোলা তাদের ঘাড়ে চেপে বসে আছে, তাদের মুখে হাসি নেই, তাদের চলনেবলনে শিশুসুলভ চঞ্চলতা নেই।
দেখলে মায়া হয়। এদের অমল শৈশব কত দুঃখে, কত কষ্টে কাটছে।
আর কে লক্ষ্মণের একটা পুরানো কার্টুনের কথা মনে পড়ছে। একটা ছয়-সাত বছরের ছেলেকে নিয়ে তাঁর বাবা হেডমাস্টারমশায়ের ঘরে স্তম্ভিত হয়ে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন আর হেডমাস্টার মশায় গম্ভীরভাবে সেই ভদ্রলোককে বলছেন, ‘আপনার ছেলেকে ক্লাসে তোলা যাবে না। এর প্রমোশন হবে না। ও ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি, তামিল, ইতিহাস, ভূগোল, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, অঙ্ক, জীববিদ্যা এই সব বিষয়ে খুব খারাপ করেছে।
কিন্তু এতটুকু ছেলে এত সব শিখবে কী করে? আর শিখেই বা কী লাভ হবে? দু’দিনের মধ্যেই ভুলে যাবে, যেতে বাধ্য। তখন আবার নতুন করে শিখতে হবে।
এই সূত্রেই আমার শেষ আপ্তবাক্যটি।
একটা সরু গলা শিশির মধ্যে তাড়াতাড়ি যদি জল ভরার চেষ্টা করো, দেখতে পাবে জল ভেতরে প্রায় কিছুই যায়নি। প্রায় সবটাই উপচিয়ে পড়ে গেছে।
তেমনিই একটি শিশুকে জোর করে তাড়াতাড়ি অনেক কিছু গলাধঃকরণ করাতে যাও, দেখবে কিছুই সে খাচ্ছে না, খেতে পারছে না। জোর করে চাপানো সব খাদ্য উপচিয়ে বাইরে পড়ে যাচ্ছে, তার অন্তরে কিছু ঢুকছে না।
তবে শিক্ষা মানে শুধু বই পড়া নয়।
একটা আমেরিকান কাহিনী জানি। শিকাগো শহরের এক বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ফ্রান্সিস ওয়েল্যান্ড পার্কার, সেই পার্কার সাহেবকে এক মহিলা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আচ্ছা স্যার, আমার বাচ্চার শিক্ষাদান আমি কবে থেকে শুরু করব ?’
পার্কার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার বাচ্চা কবে জন্মাবে?’
মহিলা হেসে বললেন, ‘জন্মাবে কী? তার তো এখন পাঁচ বছর বয়েস।’
পার্কার বললেন, তা হলে আর সময় নষ্ট করবেন না। জীবনের শ্রেষ্ঠ পাঁচটা বছর এর মধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যান। বাচ্চার শিক্ষা শুরু করে দিন।’
শিক্ষা শুরু হল। এবার তবে ইস্কুলে যাই।
ইস্কুলের গল্প মানে পরীক্ষার গল্প। পরীক্ষার নম্বর নিয়ে গল্প।
এ বিষয়ে আমার নিজের একটা অতি পুরানো পচামার্কা গল্প আছে। গল্পটা আগে যাঁরা পড়েছেন, দয়া করে নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।
এই ভগ্নকাহিনী অন্যের পক্ষে যথেষ্টই হাসির, আমার পক্ষে খুবই দুঃখের।
জীবনের অন্যান্য পরীক্ষার মতোই স্কুলের পরীক্ষাতেও আমি কখনও কখনও শূন্য পেতাম। অঙ্কের খাতায় একসময় এটা বাঁধাধরা ব্যাপার হয়েছিল।
একবার ওইরকম শূন্য পেয়ে, যাকে ছোট বয়সে আমরা বলতাম গোল্লা, তাই পেয়ে বাড়ি এসে দেখি বাবা অগ্নিমূর্তি, কী করে ভাইদের কাছে আগেই জেনে গেছেন যে আমি জিরো পেয়েছি।
বাড়ি পৌঁছানো মাত্র বাবা আমাকে এই মারেন কি সেই মারেন। সেই যাত্রা আমার পরম স্নেহশীলা পিসিমা আমাকে রক্ষা করেন তাঁর একটি প্রবাদপ্রতিম উক্তির দ্বারা।
উক্তিটি হল, ‘শুধু শুধু খোকাকে মারতে যাচ্ছ কেন? খোকা একেবারে কিছু যে পায়নি তাতো নয়, জিরো তো পেয়েছে।’
পরীক্ষায় জিরো পাওয়া নিয়ে অন্য একটা গল্প আছে। সেটা অবশ্য এত মজার নয়, তবু বলা যেতে পারে।
পরীক্ষার খাতায় গোল্লা পেয়ে একটি দুঃখিত ছাত্র অধ্যাপককে বলেছিল, ‘কিন্তু স্যার, আমি তো কখনও ভাবতে পারি না যে আমি গোল্লা পাওয়ার উপযুক্ত।’
পরীক্ষক মহোদয় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে খাটো গলায় বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ জিরোর নীচে কিছু নেই বলে তোমাকে জিরোর থেকে কম দিতে পারলাম না।’
পরীক্ষার নম্বর নিয়ে আরও একটা গল্প মনে পড়ছে। সেটা অবশ্য ভালর দিকে।
টিউটোরিয়াল ক্লাসে অধ্যাপিকা পরীক্ষার খাতা ফেরত দিয়ে ছাত্রীকে বললেন, ‘আমার ইচ্ছে ছিল যে তোমাকে আশ মিটিয়ে নম্বর দিই।’
ছাত্রীটি খাতা নিয়ে দেখে যে সে পঁচাশি পেয়েছে। তখন সে খাতাটাকে দিদিমণির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘দিদিমণি আপনার আশা অপূর্ণ রাখবেন কেন, পঁচাশি যখন দিয়েছেন; আর মাত্র পনেরো দিয়ে পুরো একশোই করে দিন।’
একশো অবশ্যই কেউ কখনও পায় না। পায় না বলা ঠিক হচ্ছে না। এখন পায় কি না জানি না, আমাদের সময় পেত না। মাস্টারমশায়দের কে যেন মাথার দিব্যি দিয়ে রেখেছিল একশো দেয়া যাবে না। এক বা দুই কমিয়ে নিরানব্বুই বা আটানব্বুই দেয়া হত শতকরা একশেভাগ শুদ্ধ খাতায়। এই মানসিক দীনতার এই কৃষ্টি-কৃপণতার কী ব্যাখ্যা তা অবশ্য আমি জানি না।
এই প্রসঙ্গে সাড়ে তিন দশক আগে আমরা যারা ছাত্র ছিলাম তাদের অভিজ্ঞতা একটু স্মরণ করি। আমার মনে হয়, আশঙ্কা হয় সে প্যাটার্ন এখনও বদলায়নি, এখনও রয়েছে। আমার বাপ-ঠাকুরদার আমলেও সেই একই প্যাটার্ন নাকি ছিল। কয়েকবছর আগে আমার ছেলের আমলেও সেই একই নম্বরদান প্রণালী দেখেছি।
বলা বাহুল্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি। নতুন কালের অর্বাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সম্বন্ধে আমার ধারণা শূন্য, জিরো এবং গোল্লা।
অনার্স এবং এম এ দুটোই এখন আট পেপার, এক সময়ে যথাক্রমে ছয় ও আট পেপার ছিল।
সে যা হোক ছকটা পরিষ্কার।
প্রত্যেক পেপার বা পত্রে একশো নম্বর। প্রত্যেক পত্রের দুটো করে অংশ, তাকে বলা হয় হাফ, মানে প্রত্যেক পেপারে দুই হাফ। প্রত্যেক হাফে পাঁচটা করে প্রশ্ন, তার মধ্যে যে কোনও তিনটে উত্তর দিতে হবে।
প্রত্যেক পেপারে একশো নম্বর অর্থাৎ হাতে পঞ্চাশ। অর্থাৎ প্রত্যেক প্রশ্নে মোট নম্বর হল ১৬.৬৬৬৬৬৬৬…পুরো ছয়টি প্রশ্নের নম্বর যোগ দিলে তখনও দশমিক শূন্য শূন্য চার কম থাকছে, হৃদয়বান প্রশ্নকর্তারা অবশ্য এই খামতি পূরণের জন্য অবশিষ্ট নম্বরটুকু পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা বা বিচক্ষণতার জন্য নির্দিষ্ট করতেন।
তবে সে-ও নিতান্ত চক্ষু লজ্জার জন্য।
কারণ ষোলো, সাড়ে ষোলো থেকে পৌনে সতেরো নম্বর সীমা যাই হোক, যে যতই ভাল লিখুক তাকে কোনও প্রশ্নে দশের বেশি দেওয়া হত না।
একদম লটারি খেলা। আট-দু’গুণে ষোলোটা অর্ধপত্র মানে হাফে প্রতিটি প্রশ্নে দশ করে পেয়ে শতকরা ষাট পেলে তবে প্রথম শ্রেণী।
বিনা কারণে বেশি কথা হয়ে গেল। কিন্তু এখানে তো শেষ করা যায় না। রম্যরচনাকে সমস্যা জর্জরিত অথবা জিজ্ঞাসা চিহ্নিত করার পাপ আর যেই করুক আমি নিশ্চয় করব না।
সুতরাং এইটি শেষ গল্প।
গল্পটি আমার নিজের।
একটি অপাপবিদ্ধ শিশু প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় একতলার সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় আমার কাছে আসে। তার বয়েস ছয় সাত।।
আমি একটি ক্ষীণ প্রশ্ন করি, ‘তুমি এলে, তোমার বাবা মা কী করছেন।’
মেয়েটির নাম নিনো, সে গোল গোল চোখ করে বলে, ‘কী আর করবে আমার হোমওয়ার্ক করছে।’
আমি বলি, ‘দু’জনে করছে কেন ?’
নিনো বলে, ‘কে ঠিক করবে তা কি আমি জানি ?’
আমি বলি, ‘তবে ?’
নিনো বলে, ‘তাই নিয়েই তো গোলমাল। মা বলে, আমার হোম ওয়ার্ক ঠিক, বাবা বলে আমার।’
আমি বলি, ‘তবে? নিনোদেবী, তুমিই তোমার বাবা মায়ের সব গোলমালের কারণ।’
নিনো একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে, ‘তা কেন? বাবামায়ের কোনও বিষয়েই তো মিল নেই।’
প্রবীণ ও নির্বোধ তারাপদ রায়, মানে আমি, অনেকক্ষণ নিনোর দিকে তাকিয়ে থাকি, তারপর তাকে বলি, ‘তোমার বাবা-মা-র কোনও বিষয়েই মিল নেই ?’
নিনো করুণ চোখে তাকাল তারপর বললে, ‘জেঠু, একটা বড় মিল আছে, আমার বাবামায়ের একই দিনে বিয়ে হয়েছিল।’