‘ বন্ধু , তোমরা ফিরে যাও ঘরে এখনো সময় নয় ' — নিশি অবসান , যমুনার তীর , ছোটো গিরিমালা , বন সুগভীর , গুরু গোবিন্দ কহিলা ডাকিয়া অনুচর গুটি ছয় । ‘ যাও রামদাস , যাও গো লেহারি , সাহু , ফিরে যাও তুমি । দেখায়ো না লোভ , ডাকিয়ো না মোরে ঝাঁপায়ে পড়িত কর্মসাগরে — এখনো পড়িয়া থাক্ বহু দূরে জীবনরঙ্গভূমি । ‘ ফিরায়েছি মুখ , রুধিয়াছি কান , লুকায়েছি বনমাঝে । সুদূরে মানবসাগর অগাধ চিরক্রন্দিত - ঊর্মি - নিনাদ , হেথায় বিজনে রয়েছি মগন আপন গোপন কাজে । ‘ মানবের প্রাণ ডাকে যেন মোরে সেই লোকালয় হতে । সুপ্ত নিশীথে জেগে উঠে তাই চমকিয়া উঠে বলি ‘ যাই যাই ' , প্রাণ মন দেহ ফেলে দিতে চাই প্রবল মানবস্রোতে । তোমাদের হেরি চিত চঞ্চল , উদ্দাম ধায় মন । রক্ত - অনল শত শিখা মেলি সর্পসমান করি উঠে কেলি , গঞ্জনা দেয় তরবারি যেন কোষমাঝে ঝন্ ঝন্ । ‘ হায় , সেকি সুখ , এ গহন ত্যজি হাতে লয়ে জয়তুরী জনতার মাঝে ছুটিয়া পড়িতে , রাজ্য ও রাজা ভাঙিতে গড়িতে , অত্যাচারের বক্ষে পড়িয়া হানিতে তীক্ষ্ণ ছুরি ! ‘ তুরঙ্গসম অন্ধ নিয়তি , বন্ধন করি তায় রশ্মি পাকড়ি আপনার করে বিঘ্ন বিপদ লঙ্ঘন ক ' রে আপনার পথে ছুটাই তাহারে প্রতিকূল ঘটনায় । ‘ সমুখে যে আসে সরে যায় কেহ , পড়ে যায় কেহ ভূমে । দ্বিধা হয়ে বাধা হতেছে ভিন্ন , পিছে পড়ে থাকে চরণচিহ্ন , আকাশের আঁখি করিছে খিন্ন প্রলয়বহ্নিধূমে । ‘ শত বার করে মৃত্যু ডিঙায়ে পড়ি জীবনের পাড়ে । প্রান্তগগনে তারা অনিমিখ নিশীথতিমিরে দেখাইছে দিক , লোকের প্রবাহ ফেনায়ে ফেনায়ে গরজিছে দুই ধারে । ‘ কভু অমানিশা নীরব নিবিড় , কভু বা প্রখর দিন । কভু বা আকাশে চারি - দিক - ময় বজ্র লুকায়ে মেঘ জড়ো হয় , কভু বা ঝটিকা মাথার উপরে ভেঙে পড়ে দয়াহীন । ‘‘ আয় আয় আয়' ডাকিতেছি সবে , আসিতেছে সবে ছুটে । বেগে খুলে যায় সব গৃহদ্বার , ভেঙে বাহিরায় সব পরিবার , সুখ সম্পদ মায়া মমতার বন্ধন যায় টুটে । ‘ সিন্ধুমাঝারে মিশিছে যেমন পঞ্চ নদীর জল , আহ্বান শুনে কে কারে থামায় , ভক্তহৃদয় মিলিছে আমায় , পঞ্জাব জুড়ি উঠিছে জাগিয়া উন্মাদ কোলাহল । ‘ কোথা যাবি ভীরু , গহন গোপনে পশিছে কণ্ঠ মোর । প্রভাতে শুনিয়া ‘ আয় আয় আয় ' কাজের লোকেরা কাজ ভুলে যায় , নিশীথে শুনিয়া ‘ আয় তোরা আয় ' ভেঙে যায় ঘুমঘোর । ‘ যত আগে চলি বেড়ে যায় লোক , ভরে যায় ঘাট বাট । ভুলে যায় সবে জাত - অভিমান , অবহেলে দেয় আপনার প্রাণ , এক হয়ে যায় মান অপমান ব্রাহ্মণ আর জাঠ । ‘ থাক্ ভাই , থাক্ , কেন এ স্বপন — এখনো সময় নয় । এখনো একাকী দীর্ঘ রজনী জাগিতে হইবে পল গণি গণি অনিমেষ চোখে পূর্ব গগনে দেখিতে অরুণোদয় । ‘ এখনো বিহার কল্পজগতে , অরণ্য রাজধানী — এখনো কেবল নীরব ভাবনা , কর্মবিহীন বিজন সাধনা , দিবানিশি শুধু বসে বসে শোনা আপন মর্মবাণী । ‘ একা ফিরি তাই যমুনার তীরে দুর্গমগিরিমাঝে । মানুষ হতেছি পাষাণের কোলে , মিশাতেছি গান নদীকলরোলে , গড়িতেছি মন আপনার মনে , যোগ্য হতেছি কাজে । ‘ এমনি কেটেছে দ্বাদশ বরষ , আরো কতদিন হবে ! চারি দিক হতে অমর জীবন বিন্দু বিন্দু করি আহরণ আপনার মাঝে আপনারে আমি পূর্ণ দেখিব কবে ! ‘ কবে প্রাণ খুলে বলিতে পারিব — ‘ পেয়েছি আমার শেষ ! তোমরা সকলে এসো মোর পিছে , গুরু তোমাদের সবারে ডাকিছে , আমার জীবনে লভিয়া জীবন জাগো রে সকল দেশ ! ‘‘ নাহি আর ভয় , নাহি সংশয় , নাহি আর আগু - পিছু । পেয়েছি সত্য , লভিয়াছি পথ , সরিয়া দাঁড়ায় সকল জগৎ — নাই তার কাছে জীবন মরণ , নাই নাই আর কিছু ।' ‘ হৃদয়ের মাঝে পেতেছি শুনিতে দৈববাণীর মতো — ‘ উঠিয়া দাঁড়াও আপন আলোতে , ওই চেয়ে দেখো কতদূর হতে তোমার কাছেতে ধরা দিবে ব ' লে আসে লোক কত শত । ‘‘ ওই শোনো শোনো কল্লোলধ্বনি , ছুটে হৃদয়ের ধারা । স্থির থাকো তুমি , থাকো তুমি জাগি প্রদীপের মতো আলস তেয়াগি , এ নিশীথমাঝে তুমি ঘুমাইলে ফিরিয়া যাইবে তারা ।' ‘ ওই চেয়ে দেখো দিগন্ত - পানে ঘনঘোর ঘটা অতি । আসিতেছে ঝড় মরণেরে লয়ে — তাই বসে বসে হৃদয় - আলয়ে জ্বালাতেছি আলো , নিবিবে না ঝড়ে , দিবে অনন্ত জ্যোতি । ‘ যাও তবে সাহু , যাও রামদাস , ফিরে যাও সখাগণ । এসো দেখি সবে যাবার সময় বলো দেখি সবে ‘ গুরুজির জয় ' , দুই হাত তুলি বলো ‘ জয় জয় অলখ নিরঞ্জন' । ' বলিতে বলিতে প্রভাততপন উঠিল আকাশ - ' পরে । গিরির শিখরে গুরুর মুরতি কিরণছটায় প্রোজ্জ্বল অতি — বিদায় মাগিল অনুচরগণ , নমিল ভক্তিভরে ।