গুম খুন

গুম খুন 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

“দারোগাবাবু এসেছেন?” 

“এসেছেন, কিন্তু এখন দেখা হওয়া দায়।” 

“আমার কাজ বড় জরুরি—আমাকে দেখা করিতেই হইবে।” 

“সমস্ত দিনের পরে তিনি এইমাত্র ফিরিয়া আসিয়াছেন। আমি কোন্ সাহসে এখন তোমাকে তাঁহার নিকট লইয়া যাইব?” 

এইরূপ কথোপকথন শুনিতে পাইয়া আমি আমার ঘর হইতেই আগন্তুককে লইয়া আসিতে বলিলাম। বাস্তবিকই আমি প্রাতঃকাল হইতে কোন এক তদন্তে নিযুক্ত ছিলাম, সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে ফিরিয়া আসিয়া অন্ততঃ কিছুক্ষণ বিশ্রামের আশায় যেমন করে আসিয়া উপবেশন করিলাম, অমনই পূর্ব্বোক্ত কথোপকথন আমার কর্ণগোচর হইল। আগন্তুকের বিনীত কণ্ঠস্বর, তাঁহার কাতরোক্তি ও তাঁহার আত্যন্তিক অনুরোধ শুনিয়া আমার হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক হইয়াছিল। তাই বিশ্রামের আশায় জলাঞ্জলি দিয়া তাঁহাকে আমার নিকটে আসিতে বলিলাম। 

কিছুক্ষণ পরেই এক দীর্ঘ শ্মশ্রুধারী প্রৌঢ় মুসলমান আমার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। তাঁহার বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ বৎসর, কিন্তু বোধ হয়, তখনও যৌবনের উত্তেজনা তাঁহার শরীর ও অঙ্গ হইতে অপসৃত হয় নাই। তাঁহাকে দেখতে অতি সুপুরুষ। কিন্তু তাঁহার তৎকালীন ম্লানমুখ অবলোকন করিলে পাষাণহৃদয়ও দ্রবীভূত হইত। 

আমি তাঁহাকে বসিতে ইঙ্গিত করিলাম। তিনি সম্মুখে উপবেশন করিলে পর, আমি তাঁহাকে সেখানে আসিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন “আমার নাম মহম্মদ আবদুল খাঁ, মলঙ্গায় আমার বাড়ী। আমার পুত্র- একমাত্র পুত্র আজ সাত দিন আমার ঘরে নাই। হুজুর, তাহাকে আমার নিকট আনিয়া দিউন।” 

আমি তাহার বয়স কত জিজ্ঞাসা করিলাম। মহম্মদ উত্তর করিলেন “করিম খাঁ আমার পোষ্যপুত্র, ঔরসজাত পুত্র নহে। তাহার বয়স তের হইতে পনর বৎসরের ভিতর। নিজের কোন সন্তান না হওয়ায় এবং যৎসামান্য বিষয় সম্পত্তি থাকায় পোষ্যপুত্র লইতে বাধ্য হইয়াছি। করিম আমারই সহোদরের তৃতীয় পুত্র। খোদার ইচ্ছায়, তাঁহার আটটি পুত্র ও দুইটি কন্যা। করিম তাহাদের মধ্যে তৃতীয়। সে আমাকেই পিতা ও আমার স্ত্রীকে মাতা বলিয়া জানে। যখন তাহার বয়স ছয় মাস, তখন হইতে আমাদের দ্বারা প্রতিপালিত।”

আ। আপনার সহোদর জীবিত আছেন? 

ম। আজ্ঞে হাঁ—আছেন। 

আ। তাঁহার নিবাস কোথায়? 

ম। হুগলী। সম্প্রতি আমারই বাড়ীতে আসিয়াছেন। 

আ। আপনার পুত্রের নিরুদ্দেশের কারণ কিছু জানেন? 

ম। বুধবার সন্ধ্যার পর একজন ভদ্রলোক আমার হস্তে একখানি পত্র দিলেন, পত্রখানির লেখা ঠিক আমার সহোদরের লেখার মত। পাঠ করিয়া জানিলাম, তাঁহারই পত্র। তিনি সাংঘাতিক পীড়িত। করিমের সহিত দেখা করিতে তাঁহার একান্ত বাসনা হইয়াছে। পত্র-বাহকের সহিত তাহাকে পাঠাইতে অনুরোধ করিয়াছেন। আমি কোনরূপ সন্দেহ না করিয়া তখনই সেই ভদ্রলোকের সহিত পাঠাইয়া দিলাম। তাঁহাকে বারম্বার বলিয়া দিলাম, যেন সে সেখানে পঁহুছিয়াই তাহার পিতার শরীরের অবস্থা জ্ঞাপন করিয়া এক পত্র লিখে। করিমও আমার কথায় সম্মত হইয়া সেই অপরিচিত লোকের সহিত হুগলী যাত্রা করে। সেই অবধি করিম আমার নিকট ফিরিয়া আইসে নাই, কিম্বা কোন পত্রও লিখে নাই। 

আমি বলিলাম “আজ শনিবার, বুধবার রাত্রেই করিম হুগলী পঁহুছিয়াছিল। যদি সে বৃহস্পতি কিম্বা শুক্রবারেও পত্র লিখিত, তাহা হইলেও আপনি সে পত্র পাইতেন। এখান হইতে হুগলী একদিনের ডাক।” 

আমার কথা শেষ হইতে না হইতে মহম্মদ বাধা দিয়া বলিলেন “আমিও সেই জন্য সেখানে কোন পত্ৰ লিখি নাই। ভাবিয়াছিলাম, যদি আমার সহোদরের সত্য সত্যই সাংঘাতিক পীড়া হইয়া থাকে, তাহা হইলে করিম খাঁ নিশ্চয়ই ব্যস্ত আছে, হয়ত পত্র লিখিবারও অবসর পায় নাই। কিন্তু মহাশয়! বেলা একটার পর আমি ঘরে বসিয়া আছি, এমন সময় আমার সহোদর, ‘করিমের পিতা সহসা সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন এবং তখনই করিমের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। বুধবারে যিনি সাংঘাতিক পীড়িত ছিলেন, তিনি যে হঠাৎ শনিবারে সুস্থ শরীরে এতটা পথশ্রম সহ্য করিতে পারিবে, এ কথা আমার বিশ্বাস হইল না। আমার স্ত্রী গত বৎসর ওলাউঠায় মারা গিয়াছে, একমাত্র করিম ভিন্ন আমার প্রকাণ্ড বাটীতে আর কোন আত্মীয় স্বজন নাই। দিবা দ্বিপ্রহরে সেই নির্জ্জন গৃহে আমার সহোদরকে দেখিয়া আমার ভয় হইল। ভাবিলাম, বুঝি তাঁহার প্রেতমূর্ত্তি আমার নিকট উপস্থিত হইয়াছে। এই মনে করিয়া আমি সহসা কোন কথা কহিতে পারিলাম না। আমার কোন উত্তর না পাইয়া আমার সহোদরের সন্দেহ হইল, তিনি পুনর্ব্বার করিমের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। সেবার আমার সন্দেহ দূর হইল; আমার দৃঢ় বিশ্বাস হইল, তিনিই আমার সহোদর। আমি তখন আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “শুনিলাম, আপনি না কি সাংঘাতিক পীড়িত হইয়াছিলেন?” 

পীড়ার কথা শুনিয়া তাঁহার চিন্তা হইল। তিনি বিরক্তির সহিত বলিলেন “আমার পীড়া! কে বলিল? এখন সে কথা ছাড়িয়া দাও, আমার করিম কোথায় বল?” 

আমি সমস্ত কথা তাঁহার নিকট প্রকাশ করিলাম। বলিলাম “আপনিই ত পত্ৰ দিয়াছিলেন এবং সেই পত্রের কথামতই করিমকে পত্রবাহকের সহিত হুগলী পাঠাইয়া দিয়াছি।” 

তিনি ভয়ানক রাগান্বিতা হইলেন এবং চীৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “কে সেই পত্র তোমার নিকট আনিল? সে পত্রই বা কোথায়?” 

আমি তখনই পত্রখানি বাহির করিয়া আমার সহোদরের হস্তে দিলাম। বলিলাম “আপনার প্রাণের গঙ্গাধর এই পত্রখানি আনিয়াছিল।” 

আমার কথা শুনিয়া তিনি আরও ক্রুদ্ধ হইলেন, বলিলেন “গঙ্গাধর! নিশ্চয়ই সে হিন্দু। তুমিও বেশ জান, কোন হিন্দুর সহিত আমার সদ্ভাব নাই। আমি পৌত্তলিকদিগের সহিত কোন সংশ্রব রাখিতে ইচ্ছা করি না। আমি তোমার ও সকল কথা শুনিতে চাই না। তুমি আমার করিমের কি করিয়াছ শীঘ্ৰ বল?” 

আমি তাঁহাকে অনেক বুঝাইলাম। বলিলাম “যাহাকে শিশুকাল হইতে মানুষ করিয়া আসিতেছি, সে আমার ঔরসজাত পুত্র না হইলেও তাহার উপর আমার ততোধিক স্নেহ জন্মিয়াছে। এক করিম ভিন্ন এজগতে আমার আর কেহ নাই। আপনি আমার উপর অন্যায় সন্দেহ করিতেছেন। বাস্তবিকই বুধবার রাত্রি হইতে তাহার বিষয় আমি কিছুমাত্র অবগত নহি।” 

এই বলিয়া আমি রোদন করিতে লাগিলাম। আমার সহোদর আমাকে ক্রন্দন করিতে দেখিয়া সমস্ত ব্যাপার বুঝিতে পারিলেন। আমি যে তাঁহাকে সত্য কথা বলিতেছি তাহাও জানিতে পারিলেন। তখন দুই ভ্রাতার পরামর্শ করিয়া একবার চারিদিক অন্বেষণ করিলাম কিন্তু কোথাও করিমের কোন সংবাদ পাইলাম না। অবশেষে হতাশ হইয়া হুজুরের নিকট আসিয়াছি। এখন আপনিই গরিবের মা, বাবা; আপনি আমার পুত্রকে আনিয়া দিউন।” 

মহম্মদ আবদুলের সমস্ত কথা শুনিয়া আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। বলিলাম “আপনার সহোদরের নাম কি? আর কেনই বা অদ্য আপনার নিকট আসিয়াছিলেন?” 

মহম্মদ উত্তর করিলেন “আমার সহোদরের নাম সলামৎ খাঁ। তিনি মধ্যে মধ্যে আমার ও আমার পুত্রের সংবাদ লইতে আসিয়া থাকেন, এবং বোধ হয়, এই অভিপ্রায়েই তিনি আজও আমার নিকট আসিয়াছেন।” 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

কিছুক্ষণ পরে আমি মহম্মদ আবদুলকে জিজ্ঞাসা করিলাম “বালকের গাত্রে কোনপ্রকার অলঙ্কার ছিল কি?” ম। আজ্ঞে না। তবে তাহার গলায় একছড়া প্রবালের মালা ছিল। মালাগাছটির মূল্য অতি সামান্য হইলেও ওই প্রকার প্রবাল আজ-কাল সহজে দেখিতে পাওয়া যায় না। 

আ। আপনার কোন শত্রু আছে জানেন? 

ম। আজ্ঞে না। আমি অধিক লোকের সহিত মিশিতে ইচ্ছা করি না। নিজের জমীদারীর হিসাবপত্র আপনিই করিয়া থাকি অবসর অতি সামান্য। আমার শত্রু বা মিত্র কেহই নাই। 

আ। আপনার সহোদর সলামৎ খাঁর কোন শত্রু আছে কি? 

ম। আজ্ঞে সে কথা আমি ঠিক করিয়া বলিতে পারি না, যদি অনুমতি হয়, তাহা হইলে তাঁহাকে কল্য আপনার কাছে আনিয়া হাজির করিব। 

আ। কাহারও উপর আপনার কোন সন্দেহ হয়? 

ম। করিম খাঁ অল্পবয়স্ক হইলেও বড় ধাৰ্ম্মিক। তাহাকে কখনও সমবয়স্ক বালকদিগের সহিত খেলা করিতে দেখিতে পাই না। যখনই সে অবসর পাইত, তখনই সে কোন মুসলমান ফকিরের নিকট যাইয়া ধৰ্ম্মবিষয়ে নানা প্রশ্ন করিত। মুসলমান ফকিরেরাও তাহাকে এত ভালবাসিয়া থাকেন, যে তাঁহারা তাহাকে একদিন দেখিতে না পাইলে আমার বাড়ীতে আসিয়া তাহার সন্ধান লইতেন। 

আ। করিম কেমন করিয়া ফকিরদিগের সহিত মিশিত? এত ফকিরই বা কোথায় পাইত? 

ম। আমাদের বাড়ী হইতে কিছুদূরে একটা মসজিদ আছে। অনেক মুসলমান ফকির সেই মসজিদে আসিয়া থাকেন। করিম সংবাদ পাইলেই তাঁহাদের সহিত দেখা করিয়া আমাদের ধর্ম্মের কূটতত্ত্ব অবগত হইতে চেষ্টা করিত। আপনি যদি দয়া করিয়া একবার আমাদের বাড়ীতে পদধূলি দেন, তাহা হইলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, শীঘ্রই এ রহস্য ভেদ হইবে। আমি তাঁহাকে মিষ্ট কথায় সান্ত্বনা করিয়া বলিলাম “পরদিন প্রাতে আমার একজন বিশ্বাসী লোককে তাঁহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিব, এবং আমি স্বয়ং বৈকালে সেখানে গিয়া যাহা হয় বন্দোবস্ত করিব।” 

মহম্মদ বাহ্যিক আনন্দিত হইয়া আমার নিকট বিদায় লইলেন। 

পরদিন প্রাতে আমার হেড কনেষ্টবলকে মলঙ্গায় মহম্মদ আবদুলের বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলাম। পরে নির্জ্জনে বসিয়া কিছুক্ষণ গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হইলাম। 

এই সময় কলিকাতার দক্ষিণে খিদিরপুর নামক স্থানে জাহাজ মেরামত করিবার জন্য একটি ডক প্রস্তুত হইতেছিল। কিছুদিন পূর্ব্বে একটা জনরব শোনা গেল যে, কন্ট্রাক্টার বাবুরা কোনপ্রকারে ওই ডক প্রস্তুত করিতে পারিতেছেন না। যে অংশ আজ প্রস্তুত হইয়া গেল, পরদিন সকালে আশ্চর্যান্বিত হইয়া দেখিল যে, তাহা সম্পূর্ণরূপে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। বার বার এইরূপে ভাঙ্গিয়া যাওয়ায় কন্ট্রাক্টারদের যথেষ্ট ক্ষতি হইতেছিল। অবশেষে এই স্থির হইল যে, কোন ধাৰ্ম্মিক বালকের মস্তক ভিত্তি স্থাপনের সময় না দিলে কখনও ডক প্রস্তুত হইবে না। এইরূপ জনরব শুনিয়া অনেকেই ভীত হইল। প্রায় সকলেই আপনাপন পুত্রকে সাবধান করিতে লাগিল। কিন্তু তখনও পর্যন্ত একটিও অভিযোগ শোনা যায় নাই। মহম্মদ যখন করিমের নিরুদ্দেশের কথা বলিলেন, সেও এইরূপ সন্দেহ করিলেন না। তাঁহার ভ্রাতা সলাম‍ হুগলীতে থাকিতেন, সম্ভবতঃ সেখানেও এ জনরব রাষ্ট্র হয় নাই। সুতরাং তিনি এ বিষয়ে সন্দেহ না করিতে পারেন। কিন্তু মহম্মদ আবদুল, তিনি সর্ব্বদাই কলিকাতায় থাকিতেন, নিশ্চয়ই তিনি ওই জনরব শুনিয়াছিলেন। তিনি কেন তবে ওই প্রকার সন্দেহ করিলেন না? মহম্মদের মুখে করিমের চরিত্র-বিষয়ে যে সকল কথা শুনিলাম, তাহাতে করিম খাঁ যে একটা ধৰ্ম্মভীরু বালক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। তাঁহার ওই সন্দেহ না করিবার কারণ কি? 

অনেকক্ষণ ধরিয়া এইরূপ চিন্তা করিলাম, অবশেষে এই স্থির করিলাম যে, মলঙ্গায় গিয়া স্বয়ং এ বিষয়ের তদন্ত করিব। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

বেলা এগারটার পর থানা হইতে বাহির হইলাম এবং খিদিরপুর অভিমুখে যাইতে লাগিলাম। সৌভাগ্যক্রমে সম্মুখেই একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ি দেখিতে পাইলাম। তাহারই সাহায্যে বেলা প্রায় দুপুরের সময় যেখানে সেই ডক প্রস্তুত হইতেছিল, সেই স্থানে উপস্থিত হইলাম। 

পাছে কোন লোক আমার উপর সন্দেহ করে, এই ভয়ে আমি পুলিসের বেশে যাই নাই, কিম্বা সঙ্গে কোন কনেষ্টবল লই নাই। 

কন্ট্রাক্টারের সহিত দেখা করাই আমার অভিপ্রেত ছিল। একজন কৰ্ম্মচারীর মুখে শুনিলাম, তিনি বাঙ্গালী, নিকটেই একখানি অট্টালিকায় তাঁহার অফিস। তিনি তখন অফিসেই ছিলেন। সুতরাং তাঁহার সহিত দেখা করিতে আমার বিশেষ কোন কষ্ট হইল না। সৌভাগ্যক্রমে আমরা পরস্পরের পরিচিত ছিলাম। আমাকে সেখানে সাধারণ বেশে দেখিয়া তিনি আশ্চর্যান্বিত হইলেন। ভাবিলেন, বুঝি আমি ছদ্মবেশে কাহাকেও গ্রেপ্তার করিতে গিয়াছি। ডকে অনেক লোক কার্য্য করে, তাহাদের মধ্যে বদমায়েসের অভাব নাই। সুতরাং তাঁহার অনুমান বড় মিথ্যা নহে। 

কিছুক্ষণ উভয়ের আলাপের পর সদাশিব বাবু আমাকে লইয়া তাঁহার প্রধান কর্ম্মচারী রাজারামের নিকট গমন করিলেন। রাজারাম আমাদিগকে লইয়া ডকের যে যে অংশ সম্পূর্ণ হইয়াছিল, যে অংশ আরম্ভ হইয়াছিল, সেই সমস্ত কাৰ্য্য দেখাইতে লাগিল। 

অতি অদ্ভুত ব্যাপার। দেখিবার একটি জিনিষ বটে। কত বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার যে এই কার্য্যে বুদ্ধি খরচ করিয়াছেন, তাহার ইয়ত্তা নাই। অসংখ্য রাজমিস্ত্রী, ছুতোর, কামার সেই মহৎ কার্য্যে নিযুক্ত। কোথাও গাঁথনী হইতেছে, কোথাও কাষ্ঠের কার্য্য হইতেছে, কোথাও বা লৌহের বড় বড় কড়ি উপরে তোলা হইতেছে। 

রাজারাম যখন আমাদিগকে লইয়া ফিরিয়া আসিতেছিল, সেই সময়ে সদাশিব বাবু একটা প্রাচীর লক্ষ্য করিয়া রাজারামকে বলিলেন “দেখ রাজারাম! এ রকম কার্য্যের মজুরি ত দিবই না, আর তা ছাড়া, যে এ কাজ করিয়াছে, তাহাকে দুই দিনের বেতন জরিমানা করিব। ছি! ছি! এ প্রকার কার্য্য তোমার নজরে পড়িল না?” 

রাজারাম যেন অত্যন্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইল। নির্দিষ্ট স্থানে গমন করিয়া দেখিল, সত্য সত্য সেখানকার প্রাচীর অত্যন্ত বক্র হইয়াছে। সে লজ্জিত হইল; বলিল “এদিকটা নেপাল মিস্ত্রীর কাজ। লোকটা এত ভাল কাজ করে যে, তাহার কাজ কখনও দেখিতে হয় না। সেই জন্যই এদিকে আর পরীক্ষা করিতে আসি নাই। এখন দেখিতেছি, নেপালের উপর বিশ্বাস করিয়া বড় অন্যায় করিয়াছি। আমি আজই ইহার কৈফিয়ৎ তলব করিব। 

সকল দিক ভাল করিয়া দেখিয়া আমি সেই বেশেই মলঙ্গায় গমন করিলাম। হেড কনেষ্টবল আমার অপেক্ষা করিতেছিল, আমাকে দেখিয়াই নিকটে আসিল এবং একখণ্ড প্রবালের মালা আমার হস্তে দিয়া বলিল “ওই মাঠে এইরূপ আর একখণ্ড পড়িয়া আছে। চারিদিক অন্বেষণ করিতে মসজিদের পার্শ্বের মাঠে দুইখণ্ড মালা দেখিতে পাই। একখণ্ড আপনাকে ও মহম্মদকে দেখাইবার জন্য আনিয়াছি আর একখণ্ড স্থান-নির্দ্দেশার্থ যথাস্থানেই রাখিয়া আসিয়াছি।” 

আমি তাহার কথায় সন্তুষ্ট হইলাম। বলিলাম “উত্তম করিয়াছ। আর কিছু জানিতে পারিয়াছ?” 

হেড কনেষ্টবল বলিল “কিছুদিন হইল এই মাঠে একদল ফকির বাস করিত। শুনিলাম, তাহারা মক্কা যাত্রার ব্যয় নির্ব্বাহের জন্য প্রত্যেক মসজিদ হইতে ভিক্ষা গ্রহণ করিতেছে। যেদিন করিম খাঁ সেই অপরিচিত লোকের সহিত হুগলী যাত্রা করে, এই ফকিরদলও সেইদিন এই স্থান হইতে চলিয়া যায়।” 

মহম্মদ যদিও পূর্ব্বে সেই প্রবালের হার দেখিয়াছিলেন, তত্রাপি আমি তাহাকে পুনরায় দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, উহা করিমের কি না? 

মহম্মদ সে হার সনাক্ত করিলেন। বলিলেন “এই হারই করিমের গলায় ছিল। বাছা আমার আর নাই। তাহাকে কেহ খুন করিয়াছে।” এই বলিয়া তিনি কাঁদিতে লাগিলেন। 

আমারও সেইরূপ বিশ্বাস হইল। করিম খাঁ যে জীবিত নাই, তাহা আমারও ধারণা হইল। কিন্তু পাছে তখন সে কথা বলিলে মহম্মদ আরও ব্যাকুল হন, এই ভয়ে সেরূপ কোন কথার উল্লেখ করিলাম না। হেড কনেষ্টবলকে নির্দ্দিষ্ট স্থানে লইয়া যাইতে আদেশ করিয়া আমি তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিলাম। 

যথাস্থানে উপনীত হইয়া দেখিলাম, তখনও সেই স্থানে হারের একখণ্ড পড়িয়া রহিয়াছে। হারের সেই অংশ তুলিয়া…. লইলাম–দুইটি অংশ মিলাইয়া দেখিলাম, উভয়ের প্রবালগুলি একই প্রকার। সেই দুইখণ্ড যে একই হারের অংশ, তাহাও বুঝিতে পারিলাম। 

তখন হেড কনেষ্টবলকে কোন কার্য্যে দূরে পাঠাইয়া দিয়া আমি সেই স্থানে বসিয়া পড়িলাম এবং কিছুক্ষণ ওই বিষয়ের সন্ধান লইলাম। হারের দ্বিতীয় অংশ যেখানে পড়িয়াছিল, সেই স্থানে অনেকেরই পদচিহ্ন দেখিতে পাইলাম। কিন্তু তাহা হইতে বিশেষ কোন সাহায্য পাইলাম না। 

তখনও সন্ধ্যা হইতে কিছু বিলম্ব ছিল। আমি সেই আলোকে সেই স্থান তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিলাম। দুই একবার পদচিহ্ন অনুসরণ করিয়া কিছুদূরেও যাইতে হইল, কিন্তু সে অল্পক্ষণের জন্য। ‘কারণ কিছুদূর গমন করিয়া সেই পদচিহ্নগুলি এত অস্পষ্ট হইয়াছিল যে, আমি অণুবীক্ষণের সাহায্যেও তাহা দেখিতে পাইলাম না। 

এইরূপে অনুসন্ধান করিয়া যথাস্থানে ফিরিয়া আসিবামাত্র আমার হেড কনষ্টেবলের সহিত দেখা হইল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “ যে ফকিরের দল এখান হইতে প্রস্থান করিয়াছে, তাহারা কবে গিয়াছে এবং কোনদিকেই বা গিয়াছে?” 

হেড কনেষ্টবল উত্তর করিল “আমি তাহারও সন্ধান লইয়াছি। যেদিন করিম খাঁ সেই অপরিচিত লোকের সহিত গমন করে, সেইদিনই ফকিরের দল এখান হইতে চলিয়া যায়। এক্ষণকার মসজিদের অধ্যক্ষের মুখে শুনিলাম, তাহারা হাওড়ায় গিয়াছে। সেখানে চারি পাঁচ দিন মসজিদে মসজিদে ভিক্ষা করিয়া বম্বে যাত্রা করিবে। পরে বম্বে হইতে মক্কায় গমন করিবে। 

হেড কনষ্টেবলের কথা শুনিয়া আমি তখন হাওড়ার মাজিষ্ট্রেটের নিকট এক টেলিগ্রাম করিলাম। লিখিলাম, একদল ফকির মসজিদে ভিক্ষা করিবার জন্য গত বুধবার কলিকাতা ত্যাগ করিয়াছে। যদি তাহাদিগের কোন সন্ধান পান, তাহা হইলে নজরবন্দী করিয়া রাখিবেন। অনেকের বিশ্বাস এই যে, তাহারা করিম খাঁ নামক একটি বালককে কৌশলে লইয়া গিয়াছে। যদি সেই বালকের কোন সন্ধান পাওয়া যায়, তাহা হইলে তাহাকে ও অপরাপর ফকিরগণকে গ্রেপ্তার করিবেন। 

সন্ধ্যার সময় এই টেলিগ্রাম লিখিয়া নিকটস্থ টেলিগ্রাফ অফিসে পাঠাইয়া দিলাম এবং হেড কনেষ্টবলকে লইয়া বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

সোমবার বেলা একটার সময় হাওড়ার মাজিষ্ট্রেটের নিকট হইতে উত্তর পাইলাম। তিনি লিখিয়াছেন, “একদল ফকির বুধবার রাত্রে হাওড়ার প্রধান মসজিদে আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। তাহাদিগকে দেখিয়া সত্য সত্যই ধাৰ্ম্মিক বলিয়া বোধ হয়। কোন বালককে তাহাদের সহিত দেখিতে পাইলাম না। তাহাদের সকলেরই বয়স পঞ্চাশ বৎসরের অধিক। তাহাদের অবয়ব ও আচরণ দেখিয়া অসৎ লোক বলিয়া বোধ হয় না। যদি আদেশ হয়, তাহা হইলে গ্রেপ্তার করা যাইতে পারে। তাহাদিগকে নজরবন্দীতে রাখা হইয়াছে।” 

হাওড়ার মাজিষ্ট্রেট একজন বিচক্ষণ লোক। তিনি যখন তাহাদিগের উপর কোন সন্দেহ করিতে পারেন নাই, তখন তাহারা নিশ্চয়ই অসৎ লোক নহে। যদিও করিম খাঁ যেদিন সেই অপরিচিতের সহিত গমন করিয়াছে, সেইদিনেই তাহারা এখান হইতে চলিয়া গিয়াছে, তত্রাপি তাহাদের সহিত যে করিম খাঁর নিরুদ্দেশের কোন সম্পর্ক আছে এরূপ বোধ হয় না। 

এই স্থির করিয়া আমি হেড কনেষ্টবলকে নিকটে ডাকিয়া সেই টেলিগ্রামের উত্তর পাঠ করিলাম। হেড কনেষ্টবলের দৃঢ় বিশ্বাস যে, সেই ফকিরদলের সহিতই ইচ্ছায় হউক বা অনিচ্ছায় হউক, করিম খাঁ চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু হাওড়ার মাজিস্ট্রেটের উত্তর পাইয়া তাহার সে বিশ্বাস দূর হইল। সে আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তবে করিম গেল কোথায়?” 

আমি ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলাম “সে কথা এখন তোমায় বলিতে পারিলাম না। আশা করি, দুই একদিনের মধ্যেই এই ভয়ানক রহস্য ভেদ করিতে সক্ষম হইব।” 

এই বলিয়া আমি পুলিসের পোষাক পরিধান করিলাম এবং হেড কনেষ্টবল আমাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু আমি তাহার একটিরও উত্তর দিলাম না। 

যখন ডকের নিকট উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা প্রায় চারিটা। রাজারাম ব্যস্তসমস্ত হইয়া ফিরিয়া যাইতেছিল, এমন সময়ে আমার সহিত তাহার দেখা হইল। তাহাকে ব্যস্ত দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “এত তাড়াতাড়ি কোথায় যাইতেছ রাজারাম?” 

রাজারাম আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিল। প্রথমে সে আমাকে চিনিতে পারিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে বলিয়া উঠিল “আপনি পুলিসের লোক? তবে সেদিন এ বেশে আইসেন নাই কেন?”

আমি হাসিয়া উঠিলাম। বলিলাম “পুলিসের লোকে সর্ব্বদা এক প্রকার পোষাক পরিধান করিলে চলে না। তাঁহাদিগকে মধ্যে মধ্যে বেশ পরিবর্তন করিতে হয়। কিন্তু তা বলিয়া তোমার মত বিচক্ষণ লোক সহসা প্রতারিত হইতে পারে না। আজ আমার বেশ অন্য প্রকার হইলেও তুমি আমায় চিনিতে পারিয়াছ। এখন বল, এত তাড়াতাড়ি কোথায় যাইতেছ? আজিকার কার্য্য শেষ হইয়াছে?”

রাজারাম হাসিল বটে, কিন্তু সে হাসি বড় আনন্দদায়ক নহে। কাষ্ঠহাসি হাসিয়া সে উত্তর করিল, “আজ্ঞে হ্যাঁ, এইমাত্র আমার দৈনিক কাৰ্য্য শেষ হইল। এখন বাসায় আহার করিতে যাইতেছি। অতি প্রত্যুষেই আমাকে এখানে আসিতে হয়, সমস্ত দিনের মধ্যে একটুও অবকাশ পাওয়া যায় না যে, সময়ে আহার করি। যতক্ষণ না কাৰ্য্য শেষ হয়, ততক্ষণ আহার করিতে যাইতে পারি না। আজিকার কার্য্য এইমাত্র শেষ করিয়াছি, সেই জন্য বাসায় ফিরিয়া যাইতেছি।” 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “আজ আর তবে এখানে আসিবে না?” 

রাজরাম অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া বলিল “আসিব না? সে কি! যতক্ষণ না সূর্য্য অস্ত যান, ততক্ষণ আমার নিষ্কৃতি নাই। আমায় এখানে উদয়াস্ত কাজ করিতে হয়।” 

আ। তবে যে বলিলে কাজ শেষ করিয়াছ? 

রা। আজ্ঞে হাঁ-একটা কাজ শেষ করিয়াছি; কুলিদিগের সহিত আর খাটিতে হইবে না। কিন্তু আজ কি করিলাম, তাহার একটা হিসাব দিতে হইবে। 

আ। কাহার নিকট? 

রা। বাবুর নিকট, সদাশিব বাবুর কাছে। তিনি যে আমার উপর সমস্ত কার্য্যের ভার দিয়া নিশ্চিন্ত রহিয়াছেন। আমি যদি প্রত্যহ তাঁহাকে কার্য্যের হিসাব না দিই, তাহা হইলে তিনি জানিবেন কিরূপে? নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কার্য্য নির্ব্বাহ করিবার জন্য আর লোক নিযুক্ত করিতে হইবে কি না, তাহা জানিবেন কোথা হইতে? 

আমি তাহার প্রশংসা করিলাম। বলিলাম “রাজারাম! তুমি একজন উপযুক্ত লোক। যে কোন কাৰ্য্য হউক না কেন, তোমার উপর ভার দিয়া নিশ্চিন্ত থাকা যায়।” আমার মুখে সুখ্যাতি শুনিয়া রাজারাম আনন্দিত হইল। সে আমাকে বারম্বার প্রণাম করিয়া বিদায় লইল। 

রাজারাম প্রস্থান করিলে পর আমি সদাশিব বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমায় দেখিয়া হাসিতে হাসিতে অভ্যর্থনা করিলেন এবং সাদরে নিকটে বসিতে বলিলেন। 

ডক নিৰ্ম্মাণ বিষয়ে সদাশিব বাবুর যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। তিনি ওই সম্বন্ধে অনেক কথা বলিলেন। শেষে জিজ্ঞাসা করিলেন “ব্যাপার কি ভায়া! আজকাল ঘন ঘন যে এখানে চরণধূলি পড়িতেছে? এখানে কোন শিকার আছে না কি?” 

তাঁহার প্রশ্ন শুনিয়া একবার চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। দেখিলাম, ঘরের ভিতরে কোন লোক নাই বটে, কিন্তু বাহিরে কে যেন পায়চারি করিতেছে। আমার সন্দেহ হইল, আমি উঠিয়া দাঁড়াইলাম এবং অতি ধীরে ধীরে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে দ্বারের দিকে যাইতে লাগিলাম। কিছুদূর যাইতে না যাইতে দেখিলাম, কোন লোক সেখান হইতে চলিয়া গেল। 

আমি তখনই বাহিরে গেলাম। যাহা দেখিলাম, তাহাতে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। দেখিলাম, রাজারাম যাইতেছে। কিছুক্ষণ পূর্ব্বে যে আমার নিকট বিদায় লইয়া বাসায় আহার করিতে গেল, এখনও দশ মিনিট অতীত হয় নাই, ইহারই মধ্যে সে আহার করিয়া ফিরিয়া আসিল? না, সে এখনও বাসায় গমন করে নাই? আমার সন্দেহ হইল। আমি সত্বর তাহার নিকট গেলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম “এ কি রাজারাম! তুমি এখানে? এই না আহার করিতে যাইব বলিলে?” 

রাজারাম তখনই হাসিয়া উত্তর করিল “আজ্ঞে হাঁ; কিন্তু, একটা দরকারি কথা বাবুকে বলিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম, তাহা বলিবার জন্য তাঁহার নিকট আসিয়াছিলাম। আপনি ঘরে রহিয়াছেন দেখিয়া ঘরের ভিতর যাইতে সাহস করি নাই। মনে করিয়াছিলাম, আপনি শীঘ্রই ঘরের বাহিরে আসিবেন। সেই জন্য দ্বারের নিকট পায়চারি করিতেছিলাম। 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “তুমি চলিয়া আসিলে কেন?” 

রাজারাম তখনই উত্তর করিল “আপনাদের কথাবার্তায় বোধ হইল যে আপনি তখন উঠিবেন না। কিছুক্ষণ গল্প গুজব করিবেন। সেই জন্যই মনে করিলাম, অগত্যা আহার করিয়া আসিয়া বলিব।” 

রাজারাম যে ভাবে কথাগুলি বলিল, তাহাতে তাহার উপর কোনরূপ সন্দেহ হওয়া উচিত নহে। কিন্তু তাহার কথায় আমার মনে সন্দেহ ঘুচিল না। তাহার কথা যেন মিথ্যা বলিয়া বোধ হইল। মনে হইল, সে যেন ইচ্ছা করিয়া আমাদের কথোপকথন শুনিতে আসিয়াছিল। 

যাহা হউক, তাহাকে কোন কথা না বলিয়া তাহার যথেষ্ট প্রশংসা করিয়া সন্তুষ্ট করতঃ বিদায় দিলাম। কিন্তু তাহাকে নজরবন্দী করিয়া রাখিতে হেড কনেষ্টবলকে ইঙ্গিত করিলাম। 

আমার হেড কনেষ্টবল বেশ চতুর। সে আমার সঙ্কেত বুঝিতে পারিয়া তখনই দূরে থাকিয়া রাজারামের অনুসরণ করিল। আমি যথাস্থানে ফিরিয়া আসিলাম। 

কিছু বিলম্ব হওয়ায় সদাশিব আমাকে কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি সমস্ত কথা ব্যক্ত করিলাম। তিনি বলিলেন “রাজারাম বেশ কাজের লোক বটে, কিন্তু মধ্যে মধ্যে বিনা কারণে তাঁহাকে অত্যন্ত বিরক্ত করিয়া থাকে। সামান্য কারণে ভীত হয় ও তাঁহার নিকট গিয়া তাঁহার বহুমূল্য সময় নষ্ট করে। সে নিশ্চয়ই সেইরূপ কোন কথা বলিতে আসিয়াছিল; আপনাকে দেখিয়া পলায়ন করিয়াছে।” 

সদাশিব বাবুর কথাতেও আমার সন্দেহ গেল না। রাজারামের উপর আমার যে সন্দেহ হইয়াছিল, তাহা যেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। আমার ধারণা হইল, সে যেন আমাদের কথোপকথন শুনিবার জন্যই দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়া ছিল। হঠাৎ ধরা পড়ায় পলায়ন করিতেছিল। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

সূর্য্য অস্ত যাইবার কিছু পূর্ব্বে রাজারাম আহার করিয়া ফিরিয়া আসিল। এবার সে আর বাহিরে দাঁড়াইল না, একেবারে ঘরের ভিতর আগমন করিল। পরে সদাশিব বাবুর নিকট গিয়া বলিল “বাবু! একটা কথা আছে। যদি অনুমতি হয় ত নিবেদন করি। কিন্তু—” 

এই বলিয়া সে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিল। 

সদাশিব বাবু তাহার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলেন। বলিলেন “দেখ রাজারাম! এই বাবু আমার পরম বন্ধু। বাল্যকাল হইতে এক স্কুলে পাঠ করিয়াছি। বোধ হইতেছে, আমাদের উভয়ের বয়স যখন দশ বৎসর,তখন হইতে আমরা পরস্পরের পরিচিত। ইহার সমক্ষে তুমি সকল কথাই বলিতে পার। অনেক বিষয়ে আমি ইহার পরামর্শ লইয়া কার্য করি।” 

রাজারাম অপ্রতিভ হইয়া লজ্জায় মস্তক অবনত করিল। পরে অতি বিনীত ভাবে বলিল “না জানিয়া বলিয়াছি, গরিবের অপরাধ লইবেন না, ক্ষমা করিবেন।” 

আমি এতক্ষণ কোন কথা বুলি নাই। কিন্তু রাজারামকে লজ্জিত দেখিয়া আমি তাহার পক্ষ সমর্থন করিলাম। বলিলাম “রাজারাম কোন অন্যায় কার্য্য করে নাই। বিষয় কর্ম্মের কথা গোপনে বলাই ভাল। আমার সহিত তোমার যে এত সদ্ভাব আছে এবং তুমি যে আমার নিকট কোন কথাই গোপন কর না, এ সকল বিষয় রাজারাম কেমন করিয়া জানিবে? কথায় বলে, “যকর্ণো ভিদায়েত মন্ত্র।” বোধ হয়, রাজারাম সেই ভয়েই আমার সাক্ষাতে কোন কথা বলিতে সাহস করে নাই! 

এই কথা শুনিয়া রাজারাম আন্তরিক আনন্দিত হইল এবং কোন কথা বলিবার জন্য ব্যগ্র হইল। কিন্তু সদাশিব বাবু তাহাকে বাধা দিয়া বলিলেন “এখন নয় রাজারাম! ইনি এই কতক্ষণ একটা অদ্ভুত কথা বলিতেছিলেন। তোমার আগমনে উনি নিরস্ত হইয়াছেন। আগে উহার কথা শুনিতে দাও, পরে তোমার কথা শুনিব।” 

এই বলিয়া সদাশিব বাবু আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন “তাহার পরে কি হইল ভায়া?” 

আমি উত্তর করিলাম “করিম খাঁকে কোথাও পাওয়া গেল না। আমি স্বয়ং অনেক অন্বেষণ করিলাম, নানাস্থানে লোক পাঠাইয়া দিলাম কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না।” 

স। করিম খাঁর বাড়ী কোথায়? 

আ। মলঙ্গায়—সে মহম্মদ আবদুল খাঁর পোষ্যপুত্ৰ। 

স। যখন তোমার হস্তে তাহার তদন্তের ভার পড়িয়াছে, তখন তোমাকেই যেন তেন প্রকারেণ একটা উপায় করিতে হইবে। কি করিবে মনে করিয়াছ? 

রাজারাম অতি মনোযোগের সহিত আমাদের কথা শুনিতেছিল। করিম খাঁ ও মহম্মদ আবদুলের নাম শুনিবা মাত্র সে যেন চমকিয়া উঠিল। কিন্তু পরক্ষণেই আত্মসংবরণ করিয়া হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিল “মহাশয়, ব্যাপার কি? কোম্পানির রাজ্যে এই দিনের বেলায় কেমন করিয়া ছেলে চুরি গেল বুঝিতে পারিলাম না।” 

সদাশিব বাবুর সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি পুনরায় সমস্ত কথা আদ্যোপান্ত ব্যক্ত করিহলাম। বলিলাম ‘আমার দৃঢ়বিশ্বাস যে, সেই ফকিরেরাই করিমকে কোথায় সরাইয়া দিয়াছে।” 

রাজারাম তখন গম্ভীর ভাবে উত্তর করিল “আপনি অতি বিচক্ষণ লোক। আমারও সেইরূপ বিবেচনা হয়। তাহারা যে রাত্রে এখন হইতে চলিয়া গিয়াছে, সেই রাত্রেই যখন করিম খাঁও প্রস্থান করিয়াছে, তখন সে যে ওই ফকিরদলের সহিতই গিয়াছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। আপনি শীঘ্রই তাহাদিগকে গ্রেপ্তার করিতে হুকুম দিন। নতুবা তাহারা পলায়ন করিবে।” 

আ। পলায়ন করিতে পারিবে না। হাওড়ার মাজিষ্ট্রেট তাহাদিগকে নজরবন্দী করিয়া রাখিয়াছেন। আমার সামান্য সঙ্কেত পাইবামাত্রই তাহারা ধৃত হইবে। 

রা। তবে এখনও বিলম্ব করিতেছেন কেন? আমি জানি, মুসলমান ফকিরগণ ওই প্রকার অনেকানেক ভয়ানক কাণ্ড করিয়া থাকে। 

আ। আমিও তাহা জানি। কিন্তু কোন বিষয় নিশ্চয় না জানিয়া কাহাকেও গ্রেপ্তার করিবার আদেশ দিতে পারা যায় না। 

রা। তবে কবে তাহাদিগকে ধরিবার হুকুম দিবেন? 

আ। সম্ভবতঃ কাল দ্বিপ্রহরের পর। 

রা। কেন, আজই হুকুম দেন না? 

আ। এখনও একটা কথা জানিতে পারি নাই। সেই জন্য বিলম্ব। 

রাজারাম আর কোন কথা কহিল না। আমি তখন সদাশিব বাবুর সহিত অন্যান্য দুই চারিটা কথা কহিয়া বিদায় লইলাম। 

সদাশিব বাবু করিম খাঁর কি হয় জানিবার জন্য আমাকে পরদিন সেখানে যাইতে বার বার অনুরোধ করিলেন। আমিও তাঁহার কথা মত কার্য্য করিব প্রতিজ্ঞা করিয়া সেদিনের মত থানায় ফিরিয়া আসিলাম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

যখন থানায় ফিরিয়া আসিলাম, তখন রাত্রি প্রায় আটটা। সরকারী কার্য্য শেষ করিতে আরও একঘণ্টা অতিবাহিত হইল। পরে আহারদি শেষ করিয়া এক নিৰ্জ্জন স্থানে বসিয়া চিন্তা করিতে লাগিলাম। 

হেড কনেষ্টবল যেখানে সেই হারের অংশ পাইয়াছিল, সেই স্থান পরীক্ষা করিয়া যদিও কোন প্রকার পদচিহ্ন দেখিতে পাই নাই, তত্রাপি এই অদ্ভুত রহস্যের একটি সূত্র পাইয়াছিলাম। জিনিষটি আমার নিকটেই ছিল—আমি বাহির করিলাম। দেখিলাম, একটি দুয়ানি। আজ-কাল লোকে দুইটি দুয়ানি রৌপ্যের তার দিয়া একত্রিত করিয়া হাতের বোতাম করিয়া থাকে। আমি যে দুয়ানিটি কুড়াইয়া পাইয়াছিলাম, তাহার মধ্যে একটু দাগ ছিল। সেই দাগ দেখিয়া আমার স্পষ্টই বোধ হইল যে, উহা ওইরূপ কোন বোতাম হইতে খুলিয়া পড়িয়াছে। বোতামটি কাহার? নিশ্চয়ই তাহার এক হাতের বোতাম নষ্ট হইয়া গিয়াছে এবং সে এখন দুই হাতে দুই প্রকার বোতাম ব্যবহার করিতেছে। 

দ্বিতীয়তঃ যদি ফকিরেরা করিম খাঁকে হত্যা করিয়া থাকে, আর যদি তাহার পূর্ব্বে করিমের গলার হার ছিঁড়িয়া সেই স্থানে পড়িয়া থাকে, তাহা হইলে হেড কনেষ্টবল যে অংশ কুড়াইয়া পাইয়াছিল, তাহা কদমাক্ত হইত; কারণ সেই রাত্রে এবং পরদিন প্রাতে বৃষ্টি হইয়াছিল। যখন হারের অংশদ্বয়ে কোনরূপ কদম নাই, তখন উহা যে, বৃষ্টির পর ওইখানে রাখা হইয়াছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু কে এই কার্য্য করিল? দুয়ানিটি দেখিয়া বোধ হইল, তাহাতেও কোন কদম নাই। নিশ্চয়ই বৃষ্টির পর উহা সেখানে পড়িয়াছিল। বোতামটিই বা কাহার? অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া স্থির করিলাম, ওই বোতামটি যাহার, সেই ওই হারের অংশ দুইটি ওইখানে ফেলিয়া রাখিয়াছিল। 

তৃতীয়তঃ, যখন সদাশিব বাবুর সহিত সেদিন সেই ডকের কার্য্য দেখিতে গিয়াছিলাম এবং যেস্থানের গাঁথনী বক্র ছিল, সেই স্থান বিশেষ করিয়া পরীক্ষা করিয়াছিলাম, তখন সেখান হইতে দু-একটি জিনিষ সঙ্গে আনিয়াছিলাম। বাহির করিয়া দেখিলাম, কতকগুলি দগ্ধ দিয়াশলাইয়ের কাটি ও বাতির চর্বি। রাজারামের মুখে শুনিয়াছিলাম, তাহার লোকেরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। কিন্তু ওই দুই প্রকার জিনিষ দেখিয়া আমার স্পষ্টই প্রতীয়মান হইল যে, সেই অংশ রাত্রিতেই গঠিত হইয়াছে। প্রাচীরটি হইল যে, সেই অংশ রাত্রিতেই গঠিত হইয়াছে। প্রাচীরটি বক্র হইবার তাহাই প্রধান কারণ। একে রাত্রে কার্য্য করা তাহাদের অভ্যাস নাই, তাহাতে সে দিন রাত্রে জোর বাতাস থাকায় ক্রমাগত আলোক নিবিয়া গিয়াছিল, সেইজন্যই অতগুলি দিয়াশলাই নষ্ট হইয়াছিল এবং সেই কারণেই প্রাচীরটি বক্র হইয়াছিল বলিয়া বোধ হয়। 

যে মিস্ত্রী ওই প্রাচীর গাঁথিয়াছিল, সে যে একজন পাকা লোক, তাহা রাজারাম নিজেই বলিয়াছিল। তবে তাহার কাৰ্য্য মন্দ হয় কেন? মুনীনাঞ্চ মতিভ্রমঃ–অতি বিজ্ঞ লোকেরও ভুল হইতে পারে। 

এইরূপ নানা চিন্তার পর কর্তব্য স্থির করিলাম। যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহাতে যদিও আমার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল না, তত্রাপি তাহা যে সম্ভব, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না। 

রাত্রি এগারটা বাজিল। আমি হেড কনেষ্টবলকে ডাকিলাম এবং আবশ্যকীয় উপদেশ দিয়া বিদায় দিলাম। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

পরদিন সূর্যোদয়ের পূর্ব্বেই খিদিরপুরে যাত্রা করিলাম। যখন সেখানে পৌঁছিলাম, তখন অল্প রৌদ্র দেখা দিয়াছিল। অসংখ্য কর্ম্মচারী ইতিপূৰ্ব্বেই আপন আপন কার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছিল। পান চুরুটের কিম্বা খাবারের দোকানগুলি অগ্রেই খোলা হইয়াছিল। হরেক রকম বিক্রিওয়ালা স্ব স্ব বিক্রেয় দ্রব্য লইয়া হাঁকিয়া বেড়াইতেছিল। একজন বৈরাগী সর্ব্বাঙ্গে ছাই মাখিয়া হস্তে রুদ্রাক্ষ মালা লইয়া একস্থানে উপবেশন করিয়াছিল। নিকটেই একজন ফকির মুসলমানের নিকট হইতে ভিক্ষা প্রার্থনা করিতেছিল। 

এই সমস্ত ব্যাপার দেখিতে দেখিতে আমি সদাশিব বাবুর ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। সেই প্রত্যুষে আমাকে খিদিরপুরে দেখিয়া সদাশিব বাবু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভায়া, আজ কাল ঘন ঘন দেখা দিতেছ কেন? তোমার মত লোকের সহিত এত ঘনিষ্ঠতা ভাল নয়। ব্যাপার কি? রাত্রে কি ভাল ঘুম হয় নাই?” 

আমি হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলাম “তোমার অনুমান মিথ্যা নহে। কাল রাত্রে সত্য সত্যই ভাল নিদ্রা হয় নাই। কেবল কাল কেন, যতদিন না করিম খাঁর কোন সন্ধান পাইতেছি, ততদিন আমার ভাল নিদ্রা হইবে না।” 

স। কিছু সুবিধা করিতে পারিলে? সেই ফকিরদিগকে গ্রেপ্তার করিবার আদেশ দিয়াছ? 

আ। না ভায়া, এখনও সে হুকুম দিই নাই। হওড়ার মাজিস্ট্রেট যেরূপ উত্তর দিয়াছেন, তাহাতে তাহাদের উপর সন্দেহ করা যায় না। সেই জন্যই ত আজ এত সকালে তোমার নিকট আসিয়াছি। 

“আমার নিকট? কেন? আমাকে কি তোমার কোনরূপ সন্দেহ হয় না কি?” 

এই বলিয়া সদাশিব হাসিয়া উঠিলেন। আমিও হাসিতে হাসিতে বলিলাম “না, তোমার উপর নয়। তবে আমার বিশ্বাস, এইখানেই করিমের সন্ধান পাওয়া যাইবে।” 

সদাশিব যেন গম্ভীর হইলেন। বলিলেন, “সে কি! করিমের বাড়ী মলঙ্গায়, এখান হইতে প্রায় চারি মাইলের কম নহে। যে লোক করিমকে লইয়া গিয়াছে, সে হুগলী হইতে আসিয়াছিল। তাহার সহিত এখানকার লোকের সম্পর্ক কি?” 

সদাশিব বাবু শেষোক্ত কথাগুলি যেভাবে বলিলেন, তাহাতে তিনি যে আমার উপর বিরক্ত হইয়াছেন, তাহা বেশ বুঝিতে পারিলাম। কিন্তু আমার দোষ কি? যখন আমার হস্তে এই তদারকের ভার পড়িয়াছে, তখন আমাকে প্রাণপণে চেষ্টা করিতে হইবে। জগদীশ্বরের কৃপায় এ পর্যন্ত কোন বিষয়ে আমি অকৃতকার্য হই নাই। গত রাত্রে যাহা স্থির করিয়াছি, তাহা আমাকে করিতেই হইবে। যদি সফল হই, ভাল নতুবা আমাকে সদাশিব বাবুর নিকট অত্যন্ত অপ্রতিভ হইতে হইবে। এই ভাবিয়া আমি উত্তর করিলাম “ভায়া! আমার উপর বিরক্ত হইলে কি করিব? আমাদের কাৰ্য্যই এই। কোন এক সামান্য সূত্র ধরিয়া এক মহৎ কার্য্য সিদ্ধ করিতে হয়। যদি তুমি এই অবস্থায় পড়িতে, তাহা হইলে তোমাকেও আমার মত কার্য্য করিতে হইত। করিম খাঁর সহিত তোমার কোন লোকের কোনরূপ সংশ্রব আছে কি না, তাহা আমি জোর করিয়া এখন বলিতে পারিতেছি না কিন্তু আমার ভয়ানক সন্দেহ যে, তাহার সহিত এখানকার কোন না কোন লোকের বিশেষ সম্বন্ধ আছে।” 

আমার কথায় সদাশিব উত্তর করিলেন “প্রমাণ কর। যতক্ষণ না প্রমাণ করিতে পারিবে, ততক্ষণ কোন কথা বলি ও না।” 

আ। সেই জন্যই ত আজ এত সকালে তোমাকে বিরক্ত করিতে আসিয়াছি। কিন্তু প্রমাণ করিতে হইলে তোমাকে কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হইবে। 

স। কেন? কিসে আমার ক্ষতি হইবে? 

আ। আমি কোন স্থানের গাঁথনী ভাঙ্গিতে ইচ্ছা করি। 

সদাশিব আমার কথায় স্তম্ভিত হইলেন। বলিলেন “বল কি? আর দশ দিন মাত্র সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে যদি কার্য শেষ করিতে না পারা যায়, তাহা হইলে আমাকে সৰ্ব্বস্বান্ত হইতে হইবে। যতগুলি লোক এখন এখানে কার্য্য করিতেছে, তাহাদিগকে ডবল রোজ দিয়া খাটাইলেও ওই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হইবে না; সম্ভবতঃ, আরও কয়েকজন লোক নিযুক্ত করিতে হইবে। এ অবস্থায় আমি কেমন করিয়া প্রস্তুত অংশ নষ্ট করিতে বলি।” 

আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম “তাহার জন্য তোমার কোনরূপ কৈফিয়ত দিতে হইবে না। আমার নিজের কোন কার্য্যের জন্য তোমায় ভাঙ্গিতে বলিতেছি না, কিম্বা আমার কৌতূহল নিবারণের জন্য এ কার্য্য করিতে অনুরোধ করিতেছি না। তুমি যাঁহার কার্য্য করিতেছ, আমিও তাঁহারই কার্য্য করিতেছি। আমার কার্য্যের জন্য আমি দায়ী হইব।” 

বাধা দিয়া সদাশিব উত্তর করিলেন “যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে আমার কোন আপত্তি নাই। কোন্ অংশ ভাঙ্গিতে হইবে দেখাইয়া দাও, আমার লোকে এখনই তোমার আদেশ পালন করিবে।” 

এই বলিয়া সদাশিব দাঁড়াইয়া উঠিলেন এবং আমার হস্ত ধারণ করিয়া ঘর হইতে বাহিরে আসিলেন। ঠিক এই সময় রাজারাম সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং আমাকে দেখিয়াই হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিল “কি মহাশয়! ফকিরদিগকে গ্রেপ্তার করিবার হুকুম দিয়াছেন কি?” 

আমি হাসিয়া বলিলাম “এত ব্যস্ত কেন? একবার তাহাদের সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া হঠাৎ কি কোনপ্রকার হুকুম দিতে পারা যায়? তবে আমার বিশ্বাস যে, তাহারাই করিম খাঁকে কোথাও চালান দিয়াছে।” 

রাজারাম একগাল হাসি হাসিয়া বলিল “আপনি একজন বিচক্ষণ লোক; আপনার চক্ষে ধূলি দেওয়া নিতান্ত সহজ নহে। কিন্তু যদি তাহারা ইত্যবসরে পলায়ন করে, তাহা হইলে আপনাকে আরও কষ্ট পাইতে হইবে। শুনিয়াছি, তাহারা নাকি শীঘ্রই মক্কায় যাইবে।” 

রাজারামের শেষ কথা শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। ভাবিলাম, রাজারাম সে সংবাদ কোথায় পাইল? এই ভাবিয়া আমি রাজারামকে জিজ্ঞাসা করিলাম “তুমি এ কথা শুনিলে কোথায়?”

আমার কথা শেষ হইতে না হইতে রাজারাম হাসিয়া উত্তর করিল “কেন? গতকল্য আপনারই মুখে ওই কথা শুনিয়াছিলাম।” 

আমি চমকিত হইলাম। আমার বেশ স্মরণ ছিল যে, আমি কোন দিন তাহাকে ওই সংবাদ দিই নাই। হয় সে পূৰ্ব্ব হইতেই ওই কথা জানিত, নচেৎ সে ইতিমধ্যে আর কাহারও মুখে ওই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছে। 

সে যাহা হউক, আমি তখন আর তাহাকে ওই বিষয়ে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না দেখিয়া, সদাশিব বাবু তাহার দিকে চাহিয়া বলিলেন “রাজারাম! একটা কাজ আছে। আমাদের সঙ্গে এস।” 

রাজারামের সকল কথাতেই হাসি। সে হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল “কি কাজ মহাশয়?” 

স। আমার এই বন্ধুর একটা অনুরোধ আছে। চল একবার বেড়াইয়া আসি। 

রা। কোথায়? কতদূর? 

সদাশিব আমার দিকে চাহিলেন। আমি তাঁহার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া রাজারামকে বলিলাম “অধিক দূর নহে। তোমায় বেশীক্ষণ থাকিতে হইবে না।” 

এই কথা বলিয়া আমরা অগ্রসর হইলাম। রাজারাম বিরক্তির সহিত আমাদের অনুসরণ করিতে লাগিল। কিছুদূর গিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “ভাল কথা মনে পড়িয়াছে রাজারাম! সেদিন যে প্রাচীরটার গাঁথনী বাঁকা হইয়াছিল, তাহা মেরামত হইয়া গিয়াছে? যে মিস্ত্রী উহা নির্ম্মাণ করিয়াছিল, তাহার জরিমানা করিয়াছ? 

রাজারাম আবার হাসিল। বলিল “না মহাশয়, সে কাজ এখনও মিটে নাই। নেপাল মিস্ত্রী যে অমন কাজ করিবে, তাহা স্বপ্নেও জানিতাম না। ও কথা আমি একেবারে ভুলিয়া গিয়াছিলাম। আজই আমি নেপালকে ডাকিয়া উহার একটা মীমাংসা করিতেছি।” 

সদাশিব বা আমি তাহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। বৃথা সময় নষ্ট হইতেছে দেখিয়া সদাশিব আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “কোন্ অংশ ভাঙ্গিতে হইবে দেখাইয়া দাও।” 

ভাঙ্গিবার কথা শুনিয়া রাজারাম স্তম্ভিত হইল। বলিল “কি ভাঙ্গিতে হইবে?” 

আমি তাহাকে কোন উত্তর না দিয়া সদাশিব বাবুকে বলিলাম “যে প্রাচীরটি বাঁকা হইয়াছে, সেইটিই ভাঙ্গিতে হইবে। ইহাতে আমাদের উভয়েরই উপকার হইবে সন্দেহ নাই। প্রাচীরের গঠনও ভাল হইবে এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার দ্রষ্টব্য বিষয়ও দেখিতে পাওয়া যাইবে।” 

আমার কথা শেষ হইতে না হইতে রাজারাম সহসা আমায় আক্রমণ করিল এবং এক ধাক্কা দিয়া এরূপে ফেলিয়া দিল যে, আমি কোনমতেই আত্মরক্ষা করিতে পারিলাম না। নিমেষ মধ্যে রাজারাম আমার উপরে উঠিয়া বসিল। কিন্তু সে কেবল এক মুহূর্তের জন্য–কারণ ইতিপূর্ব্বে যে ফকির ও বৈরাগীর কথা বলিয়াছিলাম, তাহারা ঠিক সেই মুহূর্ত্তেই রাজারামের নিকট আসিল এবং তখনই তাহার হস্ত পদ বন্ধন করিয়া ফেলিল। সদাশিব এই সমস্ত ব্যাপার দেখিয়া যুগপৎ আশ্চর্যান্বিত ও স্তম্ভিত হইলেন। কিছুক্ষণ তাঁহার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না। 

আমাকে পড়িয়া যাইতে ও রাজারামকে গ্রেপ্তার করিতে দেখিয়া অনেক লোক সেখানে জমায়েত হইল। আমি দণ্ডায়মান হইয়া সদাশিবের দিকে চাহিয়া বলিলাম “করিম খাঁর হত্যাপরাধে রাজারামকে গ্রেপ্তার করিতে বাধ্য হইয়াছি। প্রাচীরটি এখনই ভাঙ্গিতে হুকুম দাও, আমি প্রমাণ দেখাইতেছি।” 

সদাশিব দ্বিরুক্তি না করিয়া তখনই সেই প্রাচীর ভগ্ন করিতে আদেশ করিলেন। দশ বারজন কুলী তখনই সেই কার্য্যে নিযুক্ত হইল এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই উহা ভূমিসাৎ হইল। সঙ্গে সঙ্গে একপ্রকার ভয়ানক দুর্গন্ধ বাহির হইল। উপস্থিত প্রায় সকলেই নাসিকাবৃত করিয়া সেখান হইতে পলায়ন করিতে লাগিল। 

আমি সদাশিবকে লইয়া সেই প্রাচীরের নিকটে গেলাম। দেখিলাম, এক মানবদেহ। কিছুক্ষণ উভয়ে পরীক্ষা করিবার পর জানিলাম, উহা এক মুসলমান বালকের মৃতদেহ। দুর্ভাগ্যক্রমে উপস্থিত লোক সকলের মধ্যে করিম খাঁকে কেহই চিনিত না। আমি একজন কনেষ্টবলকে মহম্মদের নিকট পাঠাইয়া দিলাম এবং তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া আনিতে বলিয়া দিলাম। 

পাঁচ ছয় দিন পূর্ব্বে মৃত্যু হওয়ায় দেহের অনেক স্থান বিকৃত হইয়া গিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহার পিতা তাহাকে এই অবস্থায়ও সনাক্ত করিতে পারিবে। দেহ পচিতে আরম্ভ হইয়াছিল। উহা হইতে এক ভয়ানক দুর্গন্ধ বাহির হইতেছিল। স্থানে স্থানে ফুলিয়া উঠিয়াছিল। দেখিলেই একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দেহ বলিয়া বোধ হয়। 

করিমের পিতা উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই রাজারাম সমস্ত স্বীকার করিল। বলিল “উহা করিমেরই দেহ। সত্যই আমি তাহাকে হত্যা করিয়া প্রাচীরে গাঁথিয়া রাখিয়াছিলাম। তাহা না হইলে এত শীঘ্র এ কাজ হইতে পারে না। বিশেষতঃ দেবতার উদ্দেশ্যে যথোচিত উৎসর্গ না করিয়া কি এ কার্য্যে সিদ্ধ হওয়া যায়? যে কার্য্য করিয়াছি, তাহা স্বীকার না করিব কেন?” 

শীঘ্রই মহম্মদ ও সলামৎ উভয়েই সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। তাঁহারা সেই দেহ দেখিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন। উভয়েই উহা করিমের দেহ বলিয়া সনাক্ত করিলেন। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

সদাশিব বাবু দেখিয়া শুনিয়া স্তম্ভিত হইলেন। কিছুক্ষণ কোন কথা কহিলেন না। পরে আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “এ সকলের অর্থ কি? এ কি ভোজবাজী? তোমারই মুখে শুনিলাম যে, ফকিরেরা সেই মুসলমান বালককে কোথায় চালান দিয়াছে, তুমি কালই তাহাদিগকে ধরিবার জন্য পরোয়ানা বাহির করিবে। অথচ মনে মনে রাজারামের উপর সন্দেহ করিয়া এই অদ্ভুত রহস্য ভেদ করিয়াছ! কেমন করিয়া কি করিলে বলিতে হইবে।” 

আমি হাসিয়া বলিলাম “নিশ্চয়ই, আমাকে যে ইহার জন্য একটা কৈফিয়ত দিতে হইবে, তাহা আমি পূৰ্ব্বেই বুঝিয়াছি। হাওড়ার মাজিষ্ট্রেট যখন আমায় টেলিগ্রামের উত্তর দিলেন, তখনই জানিতে পারিলাম, ফকিরদিগের সহিত করিম খাঁর কোন সংশ্রব নাই। নিশ্চয়ই ইহার মধ্যে কোন গূঢ় রহস্য নিহিত আছে।” 

সদাশিব বাবু আমাকে বাধা দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “কই, সে কথা ত তুমি পূৰ্ব্বে বল নাই? তুমি কালও বলিয়াছ যে, ফকিরদিগের ধরিবার জন্য শীঘ্রই পরোয়ানা বাহির করিবে।” 

আমি হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলাম “সেরূপ না বলিলে রাজারাম আমার উপর সন্দেহ করিত। হয় ত সে এমন স্থানে পলায়ন করিত যে, ছয় মাস পরেও তাহাকে গ্রেপ্তার করিতে পারিতাম না। মুখে তোমায় যাহাই বলি না কেন, মনে মনে রাজারামেরই উপর সন্দেহ হইয়াছিল।” 

স। কেন? রাজারামের সহিত করিম খাঁর সম্পর্ক কি? কোথায় করিম খাঁ আর কোথায় রাজারাম! এরূপ অন্যায় সন্দেহের কারণ কি? 

আ। আমরা সকলেই হিন্দু। আমাদের একটা বিশ্বাস আছে যে, এই প্রকার কোন মহৎ কার্য্য করিতে হইলে দেবতার উদ্দেশে একটি নরবলি দিতে হয় এবং যখন সেই কার্য্যের ভিত্তি স্থাপনা হয়,তখন সেই দেহ তাহার ভিতর প্রোথিত থাকে। এই কার্য্যের প্রথমে তোমাকে অনেকবার নিষ্ফল হইতে হইয়াছিল, অনেক অর্থ বৃথা ব্যয় করিতে হইয়াছিল। ইহার কারণ যাহই হউক না কেন, রাজারামের মত গোঁড়া হিন্দুগণ মনে করিয়াছিল যে, যখন কার্যারম্ভের সময় কোন শবদেহ ভিত্তিতে প্রোথিত হয় নাই, তখনই নিশ্চয়ই এ কাৰ্য্য নিষ্ফল হইবে। এইরূপ একটা জনরবও কিছুদিন পূর্ব্বে আমার কর্ণ গোচর হইয়াছিল। সেই জনরব শুনিয়া এবং রাজারামকে গোঁড়া হিন্দু দেখিয়া আমার সেই সন্দেহ দৃঢ়ীভূত হয়। আমি ঘন ঘন তোমার নিকট আসিয়া ক্রমাগত রাজারামের কার্য্য পরিদর্শন করি। 

স। কেবল সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়াই কি এই ভয়ানক রহস্য ভেদ করিয়াছ? 

আ। না—তুমিই সেদিন আমার সন্দেহ বৃদ্ধি করিয়াছ। 

সদাশিব আমার কথায় স্তম্ভিত হইলেন। বলিলেন “সে কি? আমি তোমার মনের কথা কেমন করিয়া জানিলাম যে, আমার কথায় তোমার সন্দেহ বাড়িল?” 

আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম “ভায়া! সকল কথা এত শীঘ্র ভুলিয়া যাও কেন? তোমার সহিত ডকের কার্য্য দেখিতে না যাইলে এই প্রাচীরটি সেদিন দেখিতে পাইতাম না। সুতরাং আমার সন্দেহও বাড়িত না। রাজারামের মুখে যখন শুনিলাম, যে মিস্ত্রী প্রাচীরটি নির্ম্মাণ করিয়াছে, সে একজন পাকা লোক;যদি তাহাই হয়, তবে তাহার কাৰ্য্য বিনা কারণে কখনও এত অপরিষ্কার হইবে না। যখন তোমার আমার চক্ষে এই কার্য্য এত বিশ্রী দেখাইয়াছিল, তখন একজন পাকা মিস্ত্রী কি এরূপ কুৎসিত কার্য্য দেখিয়াও রাখিয়া দেয়-সংশোধন করিতে চেষ্টা না করিয়া নিশ্চিন্ত থাকে? কখনই না। নেপাল মিস্ত্রী যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু ইহাপেক্ষা আর ভাল হয় না দেখিয়া অমনই রাখিয়া দিতে বাধ্য হইয়াছিল। আর এক কথা, যখন রাজারামকে এই প্রাচীরের গঠন বাঁকা হইয়াছে বলা হইল, তখন তাহার মুখের ভাব যেরূপ পরিবর্তিত হইয়াছিল, তাহাতে স্পষ্টই জানিতে পারিয়াছিলাম যে, এই প্রাচীরের মধ্যেই কোন গুপ্ত রহস্য নিহিত আছে। 

“তাহার পর করিম খাঁর গলায় যে হার ছিল, তাহারই কিয়দংশ সেই পূর্ব্ব বাসস্থানের নিকট পাওয়া গিয়াছিল। বোধ হয়, এ কথা তুমি আমার মুখে শুনিয়া থাকিবে। সেও এই রাজারামের কাজ। নির্দোষী, পরম ধার্ম্মিক মুসলমান ফকিরদিগের স্কন্ধে আপনার দোষ আরোপ করাই উহার উদ্দেশ্য। কিন্তু রাজারাম পাকা লোক নহে। এই সকল ভয়ানক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে হইলে যেরূপ বুদ্ধির প্রয়োজন, রাজারামের সেরূপ তীক্ষ্ণবুদ্ধির অভাব। যেদিন সে করিম খাঁকে হত্যা করিয়াছিল, সেইদিন রাত্রে ও পরদিন সকালে বেশ বৃষ্টি হইয়াছিল। পথ কৰ্দ্দমাক্ত হইয়াছিল। করিম খাঁর হার যদি তাহার পূর্ব্বে সেই স্থানে পড়িয়া থাকিত, তাহা হইলে উহা নিশ্চয়ই কদমাক্ত হইত। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তাহাতে কাদার লেশ মাত্রও ছিল না। হার দেখিয়াই বোধ হইল, কোন লোক ফকিরদিগের উপর দোষারোপ করিবার জন্য এবং গোয়েন্দাকে বিপথে লইয়া যাইবার নিমিত্তই এ কার্য্য করিয়াছে। আমার হেড কনেষ্টবলের বিশ্বাস ছিল যে, করিম খাঁকে হত্যা করিবার সময় সে যখন নিতান্ত অস্থির হইয়াছিল, সেই সময়ে তাহার গলার হার ছিঁড়িয়া সেই স্থানে পড়িয়া যায়। কিন্তু আমার কথায় তাহার ভ্রম দূরীভূত হইয়াছিল। 

“আরও একটা ব্যাপারে রাজারামের উপর সন্দেহ অত্যন্ত বৃদ্ধি হয়। যেখানে ওই হারের অংশ দুইটি পড়িয়াছিল, তাহারই কিছুদূরে সেই মাঠে এই বোতাম বা দুয়ানিটা পড়িয়াছিল। ইহার মধ্যে কড়া দেখিয়া স্পষ্টই প্রতীয়মান হইয়াছিল যে, উহা কোন বোতামের অংশ মাত্র।” 

এই বলিয়া আমি পকেট মধ্য হইতে কড়াযুক্ত একটা দুয়ানি বাহির করিয়া সদাশিবের হস্তে দিলাম। তিনি মনোযোগের সহিত দেখিয়া আমার কথায় সায় দিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন “তার পর?” 

আমি উত্তর করিলাম “রাজারামের হাতের দিকে চাহিয়া দেখ। তখনও তাহার গাত্রে যে জামা আছে, তাহার এক হাতের বোতাম কড়াযুক্ত দুইটি দুয়ানি, অপর হস্তে কাচের বোতাম।” 

সদাশিব আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। তিনি অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিলেন। বলিলেন “আশ্চর্য্য! অদ্ভুত! এই সামান্য বিষয় হইতে তুমি যে এত বড় একটা কাণ্ড করিবে, তাহা কেহ স্বপ্নেও অনুভব করিতে পারে না।” 

আমি বলিলাম “যখন আমি বোতামটি সেই মাঠে কুড়াইয়া পাইলাম, আর যখন দেখিলাম, তাহাতে কোনপ্রকার ধূলা বা কদম নাই, তখনই আমার সন্দেহ হইল যে, যে লোক হারের অংশ সেই স্থানে ফেলিয়া গিয়াছে, বোতামটি তাহারই; কারণ ওই দুইটি বস্তুই এক সময়ে পড়িয়াছিল। সেই সময় হইতে আমি প্রত্যেকেরই হাতের বোতাম লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। যখন আমি তোমার নিকট আসিলাম এবং রাজারাম আমার সম্মুখে পড়িল, তখন আমি তাহার হাতে ওই দুয়ানির বোতাম লক্ষ্য করিলাম। বুঝিলাম, উহা রাজারামেরই কাজ। রাজারামই ওই হারের অংশ দুইটি সেই মাঠে সকলের অগোচরে ফেলিয়া রখিয়া ছিল এবং সম্ভবতঃ সেই সময়ে তাহার হাত হইতে ওই বোতামটি খুলিয়া পড়িয়াছিল; বোধ হয়, রাজারামও সে বিষয়ে কোন প্রকার সন্দেহ করে নাই। প্রকৃত কথা বলিতে কি, তুমি আমার পরম বন্ধু হইলেও আমি প্রথমে তোমাকেই সন্দেহ করিয়াছিলাম। কারণ তোমার অনুমতি না পাইলে সে যে ওইরূপ কোন গুরুতর কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিবে, এমন বোধ হয় নাই। সেই জন্য আমি বাহ্যিক তোমার উপর কোন সন্দেহ না করিলেও, ভিতরে ভিতরে তোমার কার্য্য লক্ষ্য করিতেছিলাম।” 

আমার শেষোক্ত কথা শুনিয়া সদাশিব অত্যন্ত ভীত হইলেন। বলিলেন “কি সৰ্ব্বনাশ! তুমি ত বেশ বন্ধু! যখন বন্ধু হইয়াও তুমি আমার সর্ব্বনাশ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলে, তখন তোমার অসাধ্য যে কোন কার্য্য্য আছে, তাহা বোধ হয় না। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, এখনও কি তোমায় সেই সন্দেহ আছে না কি?” 

যেরূপ ভীত হইয়া সদাশিব শেষোক্ত কথাগুলি বলিলেন, তাহাতে আমি না হাসিয়া থাকিতে পারিলাম না। বলিলাম, “না ভাই! এখন আর সে সন্দেহ নাই। রাজারাম তোমার কোন কথা না বলিয়া নিজেই এই কাৰ্য্য শেষ করিয়াছে। তবে আর একজন লোক তাহার সহায় ছিল। তাহাকেও গ্রেপ্তার করিতে হইবে।” 

স। কে সে? 

আ। কে তাহা জানি না, তবে সেও যে এখানেই আছে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। 

স। কেমন করিয়া জানিলে? 

আ। যে লোক গঙ্গাধর সাজিয়া করিমকে মহম্মদের বাড়ী হইতে ভুলাইয়া আনিয়াছিল, সলামতের পীড়া হইয়াছে বলিয়া একখানা জাল চিঠি দিয়াছিল, সে নিশ্চয়ই রাজারামের লোক। আর আমার দৃঢ়বিশ্বাস যে, নেপাল মিস্ত্রীই ওই কার্য্য করিয়াছিল। যদি সে এখন এখানে থাকে, তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়া আমার নিকট লইয়া আইস। 

আমার কথা শেষ হইতে না হইতে আমার হেড কনেষ্টবল সেই বৈরাগী অপর একজন কুলীর সহিত তখনই সেই ঘর হইতে বাহির হইল এবং কিছুক্ষণ পরেই একজন লোককে লইয়া পুনরায় সেই স্থানে আগমন করিল। 

নবাগত লোককে দেখিয়া মহম্মদ আবদুল চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন “এই যে গঙ্গাধর! এই লোকই ত সেদিন আমার হাতে এই পত্র দিয়াছিল। করিমকে আমি ইহার সহিতই পাঠাইয়াছিলাম।” 

আমি এতক্ষণ কোন কথা বলি নাই। মহম্মদের কথা শুনিয়া বলিলাম “আমি পূর্ব্বেই ওইরূপ অনুমান করিয়াছিলাম। যখন রাজারাম উহার কার্য্যের সুখ্যাতি করিয়াছিল, তখন বুঝিয়াছিলাম যে, সেই গঙ্গাধর সাজিয়া মহম্মদকে ভুলাইয়া করিম খাঁকে লইয়া আসিয়াছিল।” 

নেপাল মিস্ত্রীর বয়স প্রায় চল্লিশ বৎসর। লোকটাকে দেখিতে খৰ্ব্বাকৃতি, কিন্তু বেশ হৃষ্টপুষ্ট ও বলিষ্ঠ। তাহার চক্ষু দেখিলেই বোধ হয়, সে একজন ভয়ানক দুর্দান্ত লোক। আমার আদেশে তাহার হাতে হাতকড়ি পড়িল। 

কিছুক্ষণ পরে সদাশিব আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “তোমার সকল কথাই বুঝিলাম। কিন্তু তুমি কেমন করিয়া জানিতে পারিলে যে, করিমের দেহ ওই প্রাচীরের ভিতর গাঁথা রহিয়াছে?” 

আমি উত্তর করিলাম “যখন উহার গঠন বাঁকা হইয়াছিল এবং উহা যে মিস্ত্রীর দ্বারা গঠিত, সে একজন পাকা লোক জানা গিয়াছিল, তখনই আমার সন্দেহ হয়। তাহার পর সেদিন তোমার সহিত যখন ওই স্থান পরীক্ষা করিতে গিয়াছিলাম, তখন এই সকল দ্রব্য সেখানে পড়িয়াছিল দেখিয়া গোপনে কুড়াইয়া আনিয়াছিলাম। 

এই বলিয়া পকেট হইতে একটি কাগজের মোড়ক বাহির করিয়া দিলাম। সদাশিব শশব্যস্তে সেই মোড়কটি হস্তে লইয়া খুলিয়া ফেলিলেন। দেখিলেন, তাহার ভিতর কতকগুলি দগ্ধ দিয়াশলাইয়ের কাটি ও বাতির দগ্ধাংশ। 

সদাশিব হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন “এ কি, ইহা লইয়া কি করিব?” 

আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম “কেন? এইগুলি দেখিয়া মনে কি কোন সন্দেহ হয় না?”

সদাশিব অনেকক্ষণ চিন্তা করিলেন। কিন্তু কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। বলিলেন “না ভায়া! আমার বুদ্ধি তোমার মত প্রখর নহে। আমি তোমার কথা ভাল বুঝিতে পারিতেছি না।” 

আমি বলিলাম “যখনই এই সকল দ্রব্য আমার দৃষ্টি গোচর হইল, আমি তখনই বুঝিতে পারিলাম যে, প্রাচীরের অংশ রাত্রিকালে গঠিত হইয়াছিল। তোমার স্মরণ থাকিতে পারে, সে রাত্রে ঝড় ও বৃষ্টি হইয়াছিল; সেই ঝড়ে নেপাল মিস্ত্রীর আলোক মধ্যে মধ্যে নিবিয়া গিয়াছিল বলিয়াই তাহাকে এতগুলি দিয়াশালাই নষ্ট করিতে হইয়াছিল। একদিন কথায় কথায় রাজারাম বলিয়াছিল, তাহার লোকে রাত্রে কার্য্য করে না; উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। যখন এখানে রাত্রে কার্য্য করিবার হুকুম নাই, তখন নেপাল মিস্ত্রী রাত্রে এ কার্য্য করে কেন?”

সদাশিব স্তম্ভিত হইলেন। বলিলেন “ভায়া, তোমার যুক্তি অকাট্য। তুমি যাহা বলিতেছ তাহা সম্পূর্ণ সত্য। আশ্চর্য্য এই যে, এই সকল তুচ্ছ পদার্থ হইতে, অতি সামান্য সূত্র হইতে তুমি এই ভয়ানক জটিল রহস্য ভেদ করিতে সক্ষম হইয়াছ।” 

আমি বলিলাম “ এই সমস্ত স্থির করিয়া গত রাত্রে আমার হেড কনেষ্টবলকে বৈরাগীর ছদ্মবেশ ও অপর এক কনেষ্টবলকে ফকিরের বেশ করিয়া এই স্থানে ভিক্ষা করিতে আদেশ করিয়াছিলাম। আজ আমি যখন এখানে আসিয়া উপস্থিত হই, তখন সবেমাত্র সূর্য্যোদয় হইয়াছিল। কিন্তু তাহার অনেক পূর্ব্বেই উহারা দুইজনে যথোচিত বেশে এখানে আসিয়া ভিক্ষা করিতে আরম্ভ করিয়াছিল। 

সদাশিব জিজ্ঞাসা করিলেন “কেন? এরূপ করিবার কারণ কি?” 

আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম “কারণ স্বচক্ষেই দেখিয়াছ। আমি পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতাম, রাজারাম সহজ লোক নহে। সে যে আমাকে আক্রমণ করিবে, তাহাও আমি বুঝিতে পারিয়াছিলাম এবং সেই জন্যই আমার সাহায্যার্থ উহাদিগকে নিকটে থাকিতে বলিয়া দিয়াছিলাম। বোধ হয়, এখন সমস্ত ব্যাপার বেশ বুঝিতে পারিয়াছ।” 

সদাশিব সন্তুষ্ট হইলেন, বলিলেন “এরূপ অদ্ভুত ব্যাপার আমি এই প্রথম দেখিলাম।” আমি তখন বন্দীদ্বয়কে যথাস্থানে পাঠাইয়া দিলাম এবং সত্বর থানায় ফিরিয়া আসিলাম। কিছুদিন পরে উভয়ের বিচার হইল। বিচারে উভয়েরই ফাঁসি হইল। 

সম্পূর্ণ 

[ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৬ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *