গুপ্ত রহস্য

গুপ্ত রহস্য

(অর্থাৎ জনৈক ধনশালী ব্যক্তির চরিত্রের গুপ্ত কথা প্রকাশ!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ

মৃজা কাসেম বেগ, মৃজা ওমান বেগ নামক জনৈক ধনশালী মুসলমান সওদাগরের পুত্র। কাসেম বেগের সহিত আমার অনেক দিবস হইতে পরিচয় ছিল; তাঁহার বয়ঃক্রম আমা অপেক্ষা চারি পাঁচ বৎসর কম হইলেও, তিনি সমবয়স্ক ভাবে আমার সহিত কতকটা বন্ধুত্বসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। তিনি জাতিতে মুসলমান হইলেও, মুসলমানগণ হিন্দুর সহিত সদাসর্বদা যেরূপ দূরবর্তী থাকিতে চাহেন, তিনি সেইরূপ থাকিতেন না। কার্য্যের অবসর পাইলে, সময়ে সময়ে তিনি এক একবার আমার নিকট আসিয়া, বন্ধুভাবে অনেক সময় অতিবাহিত করিতেন; আবশ্যক হইলে, আমিও তাঁহার বাটীতে তাঁহার নিকট গমন করিতাম। তাঁহার বৃদ্ধ পিতা মৃজা ওমান বেগের সহিত সাক্ষাৎ হইলে, সময়ে সময়ে তাঁহার নিকট বসিয়া, দুই চারিটি কথাবার্তা কহিতাম, কিন্তু তাঁহাকে একটু বিশেষ মান্য করিয়া চলিতাম। যাহাতে নিজের মর্য্যাদা বজায় থাকে, তিনিও তৎপ্রতি সদাসর্বদা দৃষ্টি রাখিতেন। 

আমি যে সময়ের ঘটনা আজ পাঠকগণের নিকট বর্ণন করিতেছি, সেই সময়ে ওমান বেগের বয়ঃক্রম সত্তর বৎসরের কম ছিল না। তাঁহার বর্ণ উজ্জ্বল গৌর, তাহার উপর পরিষ্কার শুভ্রবর্ণ শ্মশ্রু ও গুল্ফ এরূপ ভাবে রক্ষিত হইয়াছিল যে, তাঁহাকে দেখিয়া, তাঁহার উপর কাহারও ঘৃণা উদিত হওয়া দূরে থাকুক, মনে কেমন একরূপ ভক্তি আসিয়া উপস্থিত হইত। এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁহার আকৃতি দেখিলেই বোধ হইত, যৌবনে তিনি কেমন সুপুরুষ ছিলেন। 

এখন তাঁহার বয়ঃক্রম অধিক হইলেও, তাঁহার অন্তরে যে কোনরূপ ক্রোধের সঞ্চার ছিল, এরূপ অনুমান হয় না। তাঁহার বদন সর্ব্বদাই প্রসন্ন থাকিত এবং তিনি অতিশয় মিষ্টভাষী ছিলেন। ইহা ব্যতীত তাঁহার আরও অনেকগুলি সদ্‌গুণ সৰ্ব্বদা দেখিতে পাওয়া যাইত। তাঁহার বদান্যতাও যথেষ্ট ছিল; যতদিবস তিনি জীবিত ছিলেন, কোন ব্যক্তি ভিক্ষাপ্রার্থী হইয়া, তাঁহার নিকট হইতে রিক্তহস্তে প্রত্যাবর্তন করিয়াছে, একথা আমরা অদ্যাবধি শ্রবণ করি নাই। 

শুনিয়াছিলাম, মৃজা ওমান বেগ, প্রথমতঃ “বোটের” কার্য্য আরম্ভ করেন। সেই কার্য হইতেই তিনি ক্রমে ধনশালী হইতে আরম্ভ হন, এবং ক্রমে অপরাপর ব্যবসা আরম্ভ করিয়া, তাহা হইতে প্রচুর পরিমাণে অর্থ উপার্জ্জন পূর্ব্বক দেশীয় সওদাগরদিগের মধ্যে একজন প্রধান সওদাগররূপে পরিগণিত হন, এবং বৃহৎ অট্টালিকার সঙ্গে সঙ্গে অনেক অর্থও সঞ্চয় করিয়া লন। 

মৃজা ওমান বেগের সেই বৃহৎ অট্টালিকা সদাসৰ্ব্বদাই লোকজনে পূর্ণ থাকিত; কিন্তু তাঁহার নিজ পরিজনের সংখ্যা নিতান্ত অল্প ছিল। তিনি, তাঁহার গৃহিণী, তাঁহার পুত্র মৃজা কাসেম বেগ, এবং কাসেম বেগের স্ত্রী ও কয়েকটি ছোট পুত্র-কন্যা ব্যতীত আর যে সকল ব্যত্তি সেই বাটীতে বাস করিতেন, তাঁহাদিগের মধ্যে মুজাসাহেবের আপনার আর কেহই ছিল না। অপরাপর যে সকল ব্যক্তি সেই বৃহৎ বাটী সৰ্ব্বদা জনাকীর্ণ রাখিত, তাহাদের প্রায় অধিকাংশই পিতাপুত্র ও পরিজনবর্গের দাসদাসী ও কর্মচারীবর্গ। অবশিষ্ট সকলে নানারূপ দুর্দ্দশাগ্রস্ত হইয়া উদারান্নের নিমিত্ত, ক্রমে ক্রমে ওমান তাহাদের শরণাপন্ন হইয়াছে এবং তাহারা সকলেই সেই স্থানে অবস্থিতি করিয়া বৃদ্ধের অন্নে প্রতিপালিত হইতেছে। সেই বাটীতে যে সকল ব্যক্তি বাস করিতেন, তাঁহারাই যে কেবল মুজাসাহেব কর্তৃক প্রতিপালিত হইতেন, এরূপ নহে; তদ্ব্যতীত অনেকে তাঁহার বদান্যতার উপর নির্ভর করিয়া জীবনযাপন করিত। এতদ্ভিন্ন অনেক সময়ে আমি নিজে দেখিয়াছি, কেহ কোনরূপ বিপদগ্রস্ত হইয়া তাঁহার নিকট দানপ্রার্থী হইলে, কেহই বিফল মনোরথ হইয়া প্রত্যাবর্তন করেন নাই। স্থূল কথায়, মুজাসাহেব যেমন মিষ্টভাষী ছিলেন, দানশীলতাগুণে তাঁহার হৃদয়ও সেইরূপ পরিপূর্ণ ছিল। 

মৃজা কাসেম বেগ তাঁহার পিতার ন্যায় ততদূর মিষ্টভাষী ও বদান্যতাগুণে ভূষিত না থাকিলেও তাঁহার চরিত্র অপরাপর সকলের চরিত্র অপেক্ষা কোন অংশে নিকৃষ্ট ছিল না। তাঁহার বাক্যাবলী শ্রবণ করিয়া, তাঁহার কার্য্যকলাপ দর্শন করিয়া, বিপদাপন্ন ব্যক্তিগণের প্রতি তাঁহার সহানুভূতির আভাস পাইয়া, আমরা সর্ব্বদাই মনে করিতাম যে, কালে পুত্রও পিতার সমতুল্য স্থান অধিকার করিবেন। 

এক্ষণে পিতাপুত্রের চরিত্র সম্বন্ধে যতদূর পরিচয় আমি এইস্থানে প্রদান করিলাম, ইহা ব্যতীত অধিক কথা এই স্থানে বলিবার আর এখন কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। ইহাতে পাঠক-পাঠিকাগণ অনায়াসেই বুঝিতে পারিবেন যে, বৃদ্ধ মৃজা ওমান বেগ এই রাজধানীর মধ্যে একজন ধনশালী সওদাগর ছিলেন। তাঁহার স্বজাতি এবং এই স্থানের অপরাপর অধিবাসিগণের নিকট তাঁহার যথেষ্ট খাতির সম্ভ্রম এবং প্রতিপত্তি ছিল। সওদাগরদিগের মধ্যে ব্যবসা সম্বন্ধে কোনরূপ নূতন প্রস্তাবের অবতারণা হইলে, তৎসম্বন্ধে তাঁহারই পরামর্শ সর্ব্বাগ্রে গৃহীত হইত; মহম্মদীয় ধৰ্ম্ম সম্বন্ধে হউক, বা তাঁহাদিগের সমাজ সম্বন্ধে হউক, কোনরূপ সভাসমিতি গঠনের প্রয়োজন হইলে তাঁহাকেই তাহার মূলভিত্তিরূপে দণ্ডায়মান হইতে হইত। রাজনৈতিক বিষয়ের কোনরূপ কূটপ্রশ্ন উত্থাপিত হইলেও, তাঁহার নিকট হইতে যে কোনরূপ অভিমত গৃহীত হইত না, এরূপ নহে; স্থূল কথায়, তিনি এই সহরবাসিগণের মধ্যে একজন শীর্ষ স্থানীয় ছিলেন। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে এক সময়ে আমাকে প্রায় দুই তিনমাস স্থানান্তরে থাকিতে হয়; এই দুই তিনমাসের মধ্যে কাসেম বেগের সহিত আমার সাক্ষাৎ হয় না। আমি সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্তন করিবার একদিবস কি দুইদিবস পরে, একদিন প্রাতঃকালে কাসেম বেগ আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ইতিপূর্ব্বে যখন তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইত, সেই সময়ে প্রায় তাঁহার হর্ষোৎফুল্লচিত্ত দেখিতে পাইতাম; আজ কিন্তু তাঁহার সেরূপ ভাব দেখিতে পাইলাম না! তাঁহার মুখ দেখিয়াই অনুমান হইল, তাঁহার হৃদয় যেন কোন বিষম চিন্তায় আচ্ছন্ন; মুখে কথা কহিতেছেন, কিন্তু মনে যেন সুখ নাই, দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছেন, কিন্তু চক্ষুতে যেন প্রখর জ্যোতিঃ নাই। 

কাসেমের এই অবস্থা দেখিয়া আমি তাঁহাকে কহিলাম, –তোমার মুখ দেখিয়া অনুমান হইতেছে যে, তোমার হৃদয় যেন দুঃখরাশিতে পূর্ণ হইয়াছে; যদি আমার অনুমান প্রকৃত হয়, তাহ হইলে কি হইয়াছে, জানিতে পারি কি? অনেকদিবস পর্য্যন্ত তোমার পিতার সংবাদ পাই নাই, তিনি শারীরিক কুশলে আছেন ত? 

আমার কথার উত্তরে কাসেম বেগ কহিলেন, ‘আপনি যে অনুমান করিতেছেন, তাহা প্রকৃত। আমার হৃদয় প্রকৃতই ভয়ানক দুঃখরাশিতে আচ্ছন্ন হইয়াছে এবং সেই দুঃখের কারণ বলিবার নিমিত্তই আজ আমি আপনার নিকট আসিয়াছি। পিতা ভয়ানক পীড়িত, মৃত্যুশয্যায় শায়িত; চিকিৎসকগণ সর্ব্বদা তাঁহার চিকিৎসায় নিযুক্ত, পরিচারকগণ তাঁহার পরিচর্যায় ব্যস্ত; কিন্তু রোগের কিছু মাত্র উপশম নাই, বরং দিন দিনই বৃদ্ধি পাইতেছে। কি কারণে পিতা আমার এরূপ ভয়ানক রোগগ্রস্ত হইলেন, জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি তাহার কোনরূপ উত্তর প্রদান করেন না। নিতান্ত পীড়াপীড়ি করিলে বলেন, ‘তোমরা আমার নিমিত্ত যতই কেন চেষ্টা কর না, রোগ উপশমের নিমিত্ত যত কেন চিকিৎসা করাও না, এবার কিন্তু আমার কিছুতেই রক্ষা নাই, এবার আমার মৃত্যু নিশ্চয়।’ এরূপ অবস্থায় এখন কি করা কর্তব্য, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। দুই একজনকে এ সম্বন্ধে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিয়ছিলাম, তাঁহারাও কোনরূপ সৎপরামর্শ দিতে সমর্থ হন নাই। কল্য রাত্রিতে জানিতে পারিলাম যে, আপনি কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন, তাই অদ্য প্রত্যূষে আসিয়াই আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি; আমার নিকট হইতে সমস্ত অবস্থা শ্রবণ করিয়া, যাহাতে আমি এই বিপদ হইতে উদ্ধার পাইতে পারি, তাহার সৎপরামর্শ প্রদান করুন, নতুবা এ অবস্থায় আমি যে কি করিব, তাঁহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।” 

আমি কহিলাম, “কি হইয়াছে বল দেখি?” 

উত্তরে কাসেম বেগ কহিলেন, “আমি প্রথম হইতে আরম্ভ করিয়া, সকল কথা আপনাকে বলিতেছি, আপনি বিশেষ মনোযোগ পূর্ব্বক শ্রবণ করিয়া দেখুন দেখি, ইহার ভিতরের অবস্থা কিছু বুঝিয়া উঠিতে পারেন কি না।” এই বলিয়া কাসেম বেগ বলিতে আরম্ভ করিলেন। 

“প্রায় তিনমাস অতীত হইল, একদিবস সন্ধ্যার প্রাক্কালে আমি আমার পিতার নিকট বারান্দায় বসিয়া আছি, এরূপ সময় দ্বারবান্ আসিয়া সংবাদ প্রদান করিল, ‘একটি প্রাচীন মুসলমান আমার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে দ্বারদেশে দণ্ডায়মান আছেন।’ দ্বারবানের কথা শুনিয়া পিতা কহিলেন, “তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া, এখানে আনয়ন কর।’ পিতার কথা শুনিয়া, দ্বারবান্ প্রস্থান করিল, এবং অতি অল্পক্ষণ মধ্যেই একটি বৃদ্ধকে আমাদিগের নিকট আনিয়া উপস্থিত করিল ও কহিল, ‘ইনিই দেখা করিতে আসিয়াছেন।’ এই বলিয়া দ্বারবান সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। বৃদ্ধটি আমাদিগের নিকট আসিয়া দণ্ডায়মান হইলেন, পিতা তাঁহাকে সেইস্থানে বসিতে বলিলেন। যে স্থানে আমরা বসিয়াছিলাম, সেই স্থানে চারি পাঁচখানি চেয়ার ছিল, তিনি তাহারই একখানির উপর উপবেশন করিলেন এবং আমার পিতার দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, ‘আমাকে কি আপনি চিনিতে পারিতেছেন না?” 

“পিতা অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাঁহার মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিয়া পরিশেষে কহিলেন, ‘আপনার মুখ আমার নিকট বিশেষ পরিচিত বলিয়া মনে হইতেছে, কিন্তু আমি ঠিক ঠাওরাইয়া উঠিতে পারিতেছি না।’ 

উত্তরে বৃদ্ধ কহিলেন, “আমি আপনাকে একটু মনে করিয়া দিতেছি, তাহা হইলেই আপনি আমাক চিনিতে পারিবেন। বোম্বাই প্রদেশীয় **** গ্রামের আলি ভাইর নাম কি আপনাকে স্মরণ করাইয়া দিতে হইবে? আমি সেই গ্রামের ইব্রাহিম ভাই।’ 

বৃদ্ধের এই কথা শুনিয়া, পিতার মুখশ্রী যেন কিরূপ বিবর্ণ হইয়া গেল। তিনি সেই বৃদ্ধের দিকে দুই চারিবার কটাক্ষপাত করিয়া আমাকে কহিলেন, ‘কাসেম! তুমি একটু স্থানান্তরে গমন কর, ইহার সহিত আমি নির্জ্জনে দুই চারিটি কথা কহিতে চাই।’ 

“পিতার এই কথা শুনিয়া আমি স্থানান্তরে গমন করিলাম। তাহার পর উভয়ের মধ্যে যে কিরূপ কথাবার্তা হইল, তাহা আমি অবগত নহি; অধিকন্তু তিনি যে কে, তাঁহারও কোন পরিচয় আমি পাই নাই। পিতার বয়স অপেক্ষা তাঁহার বয়স অধিক এবং সদাসর্ব্বদা তিনি পিতার নিকটই থাকিতেন, এই নিমিত্ত তাঁহার পরিচয়-আদি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করি নাই; কিন্তু দেখিলাম, সেই দিবস হইতেই তিনি আমাদিগের বাটীতে বাস করিতে লাগিলেন। “তাঁহার থাকিবার একটি ঘর পিতা স্থির করিয়া দিলেন, তাঁহার প্রয়োজনীয় কৰ্ম্ম- কার্য্য নির্ব্বাহ করিবার নিমিত্ত দুইটি পরিচারকও নিযুক্ত হইল, আহারাদিরও উত্তমরূপে ব্যবস্থা হইল। তিনি সদাসৰ্ব্বদা পিতার নিকটই থাকিতেন। পিতার বন্ধুবান্ধবদিগের মধ্যে কোন ব্যক্তি তাঁহার কথা পিতাকে জিজ্ঞাসা করিলে, পিতা কেবলমাত্র এই বলিয়া, তাঁহার পরিচয় প্রদান করিতেন যে, ইনি আমার বাল্যকালের বন্ধু।’ 

“প্রথম দিবসের কথা শুনিয়া, আমি তাঁহার সম্বন্ধে কেবলমাত্র ইহাই জানিতে পারিয়াছিলাম যে, তাঁহার নাম ইব্রাহিম ভাই; বাসস্থান বোম্বাই প্রদেশীয় কোন পল্লীতে। এই পরিচয় ভিন্ন আমি তাঁহার অপর কোন পরিচয় এ পৰ্য্যন্ত জানি না।” 

“আমাদিগের বাটীতে বাস করিবার কালীন প্রথম প্রথম তিনি একটু স্থিরভাবেই থাকিতেন; কিন্তু ক্রমে আমাদিগের উপর কেমন একরূপ কর্তৃত্ব দেখাইতে আরম্ভ করিলেন। চাকরচাকরাণীগণের উপর নানারূপ অপ্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান করিতে আরম্ভ করিলেন। সেই সকল আদেশ যে অপালন করিত, বা পালন করিতে যাহার কিছুমাত্র বিলম্ব হইত, তাহার উপর নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া পিতার সাক্ষাতেই তিনি তাহাদিগকে প্রহার পর্যন্তও করিতেন। তাঁহার এইরূপ ব্যবহার দেখিয়া পিতা তাঁহাকে কিছুই বলিতেন না; সুতরাং চাকরচাকরাণীগণ এইরূপ অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া একে একে চাকরী পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিল। বহুপুরাতন চাকরচাকরাণীগণও এইরূপে ক্রমে কর্ম্ম পরিত্যাগ করায় আমাদিগের অতিশয় কষ্ট হইতে আরম্ভ হইল। এ সকল বিষয় পিতা স্বচক্ষে দেখিয়াও কোন কথা কহিতেন না, বিনা বাক্য ব্যয়ে তিনি সকলই সহ্য করিতেন। তিনি সেই বৃদ্ধের উপর কেন যে এরূপ সদয় ছিলেন, তাহার কিছুই আমরা বুঝিয়া উঠিতে পারিতাম না। 

“বাণিজ্য কার্য্যের সমস্ত ভার যাহার হস্তে ন্যস্ত ছিল, একদিবস সেই বৃদ্ধ তাঁহাকে বিনাকারণে কতকগুলি অযথা কটুকাটব্য কহিলেন। তিনি বৃদ্ধকে কোন কথা না বলিয়া, সমস্ত অবস্থা পিতার নিকট বলিলেন; যে সময় তিনি সমস্ত অবস্থা পিতার নিকট কহিলেন, সেই সময় সেই বৃদ্ধও সেই স্থানে উপস্থিত ছিল; পিতা সমস্ত কথা শুনিয়া কোন কথাই কহিলেন না। অধিকন্তু ইব্রাহিম ভাই, পিতার সম্মুখেই তাঁহাকে আরও কতকগুলি কটুকাটব্য শুনাইয়া দিল। কর্ম্মচারী এই অবস্থা দেখিয়া কহিলেন, ‘এ সংসারে আর চাকরী করিতে নাই।’ এই বলিয়া, সেইদিবসই তিনি কাৰ্য্য পরিত্যাগ করিয়া, স্থানান্তরে গমন করিলেন। 

“ইনি কার্য পরিত্যাগ করিলে, তাঁহার সমস্ত কার্য্য ভার আমার উপর পতিত হইল। আমি আমার সাধ্যমত কৰ্ম্ম কাৰ্য্য সকল দেখিতে লাগিলাম। এইরূপে পাঁচ সাতদিবস অতিবাহিত হইয়া গেলে, এক দিবস সেই বৃদ্ধ ইব্রাহিম ভাই আমার কর্ম্মস্থলে গিয়া উপস্থিত হইল। সেই স্থানে উপবেশন করিয়া আমাকে কহিল, ‘কাসেম! আমার নিমিত্ত একছিলুম তামাকু সাজিয়া আন ত।’ 

“তাঁহার কথায় আমি কোনরূপ দ্বিরুক্তি না করিয়া, একজন পরিচারককে ডাকিয়া কহিলাম, ‘একছিলুম তামাকু সাজিয়া আনিয়া ইহাকে দেও।’ 

“আমার কথা শুনিয়া ইব্রাহিম ভাই, নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইলেন, এবং কহিলেন, ‘কি আমার আদেশ অমান্য করিয়া চলা! আমি তোমাকে তামাকু সাজিতে কহিলাম, তুমি কি না আমার আদেশ অমান্য করিয়া অপর আর একজনকে সেই কার্য্য করিতে কহিলে, ইহা নিতান্ত অন্যায়; তোমার পিতা যাহা করিতে সাহসী হন না, অদ্য তুমি কি না তাহাই আমার সম্মুখে সম্পাদন করিলে।’ 

বৃদ্ধ ইব্রাহিম ভাইর উপর পূর্ব্ব হইতেই আমরা সকলেই বিশেষরূপে অসন্তুষ্ট ছিলাম; কিন্তু পিতা উঁহাকে বিশেষরূপ যত্ন ও মান্য করিতেন বলিয়া তাঁহাকে আমরা কেহই কিছু বলিতাম না। সেই দিবস কিন্তু আমি কোনরূপেই আমার ক্রোধ সম্বরণ করিতে পারিলাম না। তাঁহার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া, ‘আমি নিজেই তোমার নিমিত্ত তামাকু সাজিয়া দিতেছি।’ কেবল এইমাত্র বলিয়া, একখানি পাদুকা হস্তে আমি গাত্রোত্থান করিলাম, এবং তাহাদ্বারা সেই বৃদ্ধকে সেই স্থানে উত্তম মধ্যমরূপে শিক্ষা প্রদান করিলাম। 

“বৃদ্ধ ক্রোধে কাঁপিতে কাঁপিতে, আমাকে সহস্র গালি বর্ষণ করিতে করিতে ও আমাকে নানারূপ ভয় প্রদর্শন করিতে করিতে, সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমি তাঁহার দিকে একবারের নিমিত্ত দৃকপাতও করিলাম না। 

“আমা কর্তৃক বৃদ্ধ এইরূপে অপমানিত হওয়ায়, অপরাপর কর্ম্মচারীগণ যে কতদূর সন্তুষ্ট হইল, তাহা আমি বলিতে পারি না। 

“এই ঘটনার কিয়ৎক্ষণ পরেই পিতা আমাকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন, পিতৃ আদেশ পাইবামাত্রই, আমি তাহার নিকট গমন করিলাম; দেখিলাম, বৃদ্ধ ইব্রাহিম ভাই সেই স্থানে বসিয়া আছেন, আমি সেই স্থানে উপস্থিত হইবামাত্রই পিতা আমাকে কহিলেন, “তুমি ইঁহাকে পাদুকা দিয়া প্রহার করিয়াছ?’ 

“আমি। হাঁ পিত! আমি ইঁহাকে প্রহার করিয়াছি, ইঁহার অত্যাচার আর কোনরূপেই সহ্য করিতে সমর্থ হই নাই বলিয়া এই কার্য্য করিয়া ফেলিয়াছি। 

“এই বলিয়া তামাকু সাজা সম্বন্ধে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহার সমস্ত কথা আনুপূর্ব্বিক পিতার নিকট বর্ণন করিলাম। তদ্ব্যতীত তিনি সদাসর্বদা দাসদাসী ও কর্ম্মচারীগণের উপর যেরূপ ব্যবহার করিয়া থাকেন, তাহাও, সেই সময় আমার যতদূর মনে পড়িল, পিতার নিকট বর্ণন করিলাম। 

“আমার কথা শুনিয়া পিতা কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, ও পরিশেষে কহিলেন, “দেখ, নিতান্ত অন্যায় কাৰ্য্য করিয়াছ। নিজে একছিলিম তামাকু সাজিয়া দিলেই যদি ইনি সন্তুষ্ট থাকিতেন, তাহা হইলে উহা সাজিয়া দিলেই পারিতে, এই সামান্য কার্য্যের নিমিত্ত তুমি ইঁহাকে প্রহার করিলে, তুমি বড় অন্যায় কার্য্য করিয়াছ।’ 

“পিতার কথা শুনিয়া আমার হঠাৎ ক্রোধের উদয় হইল, যেরূপ ভাবে আমি কখনও তাঁহার সম্মুখে কথা কহি নাই, সেইদিবস তাহাই করিলাম। কহিলাম, ‘পিতঃ, আপনি কি কখনও আমাকে তামাকু সাজিতে শিখাইয়াছেন যে, আমি স্বহস্তে ইহাকে তামাকু সাজিয়া দিব। আপনি পিতা, আপনি বলুন দেখি যে, আপনি কখনও আমাকে তামাকু সাজিতে কহিয়াছেন। আজ কি না, যে পরের অন্নে উদর পরিপূরণ করিতেছে, সে আমাকে তামাকু সাজিতে কহিল, আর তাহার আদেশ আমাকে প্রতিপালন করিতে হইবে। কাল আর একজন নীচ ভৃত্য আসিয়া, আমাকে আর একটি অন্যায় কার্য করিতে কহিবে, তাহা না করিলে, আপনি কহিবেন, ইহা তোমার করা কর্তব্য ছিল। আপনি আমার উপর সন্তুষ্ট হউন বা অসন্তুষ্ট হউন, এরূপ কার্য্য আমাদ্বারা কখনই হইবে না। 

“পিতা। তুমি যেরূপ অন্যায় কার্য্য করিয়াছ, কোথায় তাহার নিমিত্ত, তুমি ইঁহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিবে; তাহা না করিয়া, পুনরায় লম্ব লম্বা কথা কহিতেছ। এই বৃদ্ধ ইব্রাহিমকে আমি যেরূপ ভাবে মান্য করিয়া থাকি, তাহা তোমার অবিদিত নাই। এরূপ অবস্থায় ইঁহাকে অবমাননা করায়, ইঁহার কিছুমাত্র অবমাননা হয় নাই, আমাকেই যথেষ্ট অবমাননা করা হইয়াছে। ইহার মস্তকে তুমি পাদুকাঘাত করিয়াছ, কিন্তু জানিও, সেই পাদুকা ইঁহার মস্তকে পতিত হয় নাই, উহা আমার মস্তকেই পতিত হইয়াছে। আমি এখনও তোমাকে বলিতেছি, হাতে ধরিয়া হউক, পায়ে ধরিয়া হউক, তোষামোদ বা অনুনয়-বিনয় করিয়া হউক, যাহাতে তুমি পার, ইঁহাকে সন্তুষ্ট করিতে চেষ্টা কর, নতুবা জানিও কিছুতেই তোমার মঙ্গল নাই। 

“আমি। আমার মঙ্গল হউক বা অমঙ্গল হউক, আমি কিন্তু কিছুতেই আপনার প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারিব না। আমি দেখিতেছি, আপনি আমার উপর নিতান্ত অন্যায় আদেশ প্রদান করিতেছেন। ইঁহার অবমাননায় আপনি অবমানিত হইয়াছেন, একথা আপনি যে কেন বলিতেছেন, তাহা আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। এ একজন নিতান্ত সামান্য ব্যক্তি, ইহার প্রকৃতি অতিশয় নীচ। সামান্য অতিথিরূপে আমাদিগের গৃহেও প্রবেশ করিয়াছে, একথা ইহার আর এখন মনে নাই। আপনার একটু কৃপাপাত্র হইয়াছে বলিয়া, এখন নিজের অবস্থা ভুলিয়া গিয়াছে, ও মনে করিতেছে, ওই যেন আপনার অগাধ বিষয়ের অধিকারী, আর আমরা সকলে ইহার দাসানুদাস মাত্র। এ আজকাল আমাদিগের উপর যেরূপ ভাবে ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিয়াছে, তাহার উপযুক্ত শাস্তি এ এখন পর্যন্ত পায় নাই। আমার যাহা ইচ্ছা আছে, তাহা আজ আমি আপনার সম্মুখে মুক্তকণ্ঠে বলিতেছি, ইহার পরও যদি ইনি আর কোনরূপ অসদ্ব্যবহার করেন, তাহা হইলেই আপনার সম্মুখেই আমি একদিবস উহার আপাদ-মস্তক পাদুকাচিহ্নে আবৃত করিয়া এই স্থান হইতে বহির্গত করিয়া দিব। 

“পিতা। আমি ভাবিয়াছিলাম, তুমি আমার একমাত্র উপযুক্ত পুত্র। দয়া-দাক্ষিণ্য ও সদ্গুণে ক্রমে তুমি জনসমাজে আদরনীয় হইবে, কিন্তু আমি এখন দেখিতেছি যে, আমি মহাভ্রমে পতিত হইয়াছি। তোমার সদৃশ কুলাঙ্গারকে আমি পুত্র বলিয়া সম্ভাষণ করিতেছি। যে সন্তান পিতার বাক্য লঙ্ঘন করিয়া থাকে, আমি তাহার মুখ দেখিতে চাহি না, তুই এখনই আমার সম্মুখ হইতে দূর হ। সর্ব্বশাস্ত্রে কথিত আছে, পিতৃ আজ্ঞা লঙ্ঘনকারী পুত্র, পুত্র মধ্যেই পরিগণিত নহে। 

“আমি। পিতঃ আপনি আমার উপর নিতান্ত অন্যায় ক্রোধ প্রদর্শন করিতেছেন, দুষ্ট ব্যক্তিকে দণ্ড প্রদান না করিলে, চলিবে কি প্রকারে? আপনি পিতা, আপনার আদেশ আমার শিরোধার্য্য। সুতরাং আপনার এক আদেশ আমি প্রতিপালন করিতেছি। আমি এখনই আপনার সম্মুখ হইতে প্রস্থান করিতেছি; কিন্তু যাইবার সময় ওই বৃদ্ধকে পুনরায় উত্তমরূপ শিক্ষা প্রদান করিয়া যাইতেছি। 

“এই বলিয়া আমি, আমার পা হইতে পাদুকা উন্মোচন করিয়া পিতার সম্মুখেই তাহাকে উত্তমরূপে প্রহার করিলাম। সেই সময় সেই স্থানে অপরাপর ভৃত্যাদি যাহারা ছিল, তাহারা ধীরে ধীরে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। পিতা আমাকে সহস্র গালি দিলেন, এবং তাঁহার সম্মুখে ওইরূপ অসৎকার্য্য করিতে, আমাকে নিবৃত্ত করিবার নিমিত্ত বিশেষরূপ চেষ্টা করিলেন; কিন্তু নিতান্ত বার্দ্ধক্য-নিবন্ধন তিনি আমাকে প্রতিনিবৃত্ত করিতে সমর্থ হইলেন না। সেই কাৰ্য্য ইহতে আমাকে নিবৃত্ত করিবার নিমিত্ত তিনি তাঁহার পরিচারকগণকে বার বার ডাকিতে লাগিলেন; কিন্তু সেই সময় কেহই তাঁহার সম্মুখে আসিল না। আমি ইচ্ছানুযায়িনী আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া সেইস্থান হইতে বহির্গত হইয়া গেলাম। যাইবার সময় তাহাকে বলিয়া গেলাম, ইহার পরেও যদি তোমাকে এইস্থানে দেখিতে পাই, তাহা হইলে জানিও, আমার হস্তে তোমার মৃত্যু নিশ্চয়। 

“আমার ব্যবহার দেখিয়া পিতা এতদূর রাগান্বিত হইয়াছিলেন যে, তাঁহার মুখ হইতে আর কোনরূপ বাক্য নির্গত হইল না। তিনি রাগে ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন। 

“আমি সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম সত্য, কিন্তু বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া কোন স্থানে গমন করিলাম না। পার্শ্ববর্তী একটি প্রকোষ্ঠে পিতার অজ্ঞাতে প্রবেশ করিয়া দেখিতে লাগিলাম, পিতা ও সেই বৃদ্ধ কি করেন।’ দেখিলাম, বৃদ্ধ গাত্রোত্থান করিয়া পিতাকে কহিলেন, “দেখ আলি! আমি এই চলিলাম, যদি ইহার প্রতিশোধ লইতে পারি, তবেই জানিও আমার নাম ইব্রাহিম ভাই।’ এই বলিয়া বৃদ্ধ আমাদের বাটী হইতে বহির্গত হইয়া চলিয়া গেল। গৃহ পরিত্যাগ করিবার কালীন পিতা তাহাকে বার বার নিষেধ করিলেন, কিন্তু সে কোনরূপেই তাঁহার নিষেধ শুনিল না। নিতান্ত রাগভরে ও দর্পের সহিত সে গৃহ পরিত্যাগ করিল। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

“বৃদ্ধ ইব্রাহিম ভাইর এই অবস্থা দেখিয়া, আমি মনে মনে হাসিলাম। ভাবিলাম, ‘সামান্য প্রহারেই যে এই আপদ আমাদের গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া গেল, ইহাই আমাদের মঙ্গলের বিষয়।’ যে সময় হইতে বৃদ্ধ ইব্রাহিম আমাদের গৃহ পরিত্যাগ করিয়া গেল, সেই সময় হইতেই যেন পিতার ভাবান্তর উপস্থিত হইল। তাঁহার মুখে ক্রমে কালীমারেখা পড়িতে আরম্ভ হইল, নেত্র জ্যোতিঃহীন হইয়া, ক্রমে কোটরাভ্যন্তরিত হইতে আরম্ভ করিল। দেখিয়া সকলে অনুমান করিতে লাগিলেন, তাঁহার মন যেন কোনরূপ গাঢ় চিন্তায় নিমগ্ন হইয়া রহিয়াছে। অথবা তিনি যেন জানিতে পারিয়াছেন যে, শীঘ্রই তিনি যেন কোনরূপ ভয়ানক বিপদগ্রস্ত হইতে বসিয়াছেন। সেইদিবস হইতে তাঁহাকে আর সুষুপ্তি সুখ অনুভব করিতে দেখিলাম না। যখনই দেখিতাম, তখনই তিনি জাগরিত ও গাঢ় চিন্তায় অভিভূত। নিদ্রার সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার আহারও কমিয়া গেল, ইতিপূর্ব্বে তিনি যে পরিমাণে আহার করিতে পারিতেন, এখন হইতে তাহার দশমাংশের একাংশও তৃপ্তির সহিত আহার করিতে পারিতেন কি না সন্দেহ। 

“যেদিবস আমি সেই বৃদ্ধকে প্রহার করিয়া পিতার সম্মুখ হইতে চলিয়া আসিয়াছিলাম, সেইদিবস হইতে আর আমি তাঁহার সম্মুখীন হইলাম না, অন্তরাল হইতে সদাসর্ব্বদা তাঁহাকে দেখিতাম, তিনি কি করিতেছেন, কি না করিতেছেন, সে বিষয়ে সর্ব্বদা লক্ষ্য রাখিতাম ও কোন্ সময় কিরূপ অবস্থায় থাকেন, এবং কোন্ সময় কিরূপ অবস্থায় অতিবাহিত করেন, তাহা পরিচারকগণের নিকট হইতে সদাসর্বদা তন্ন তন্ন করিয়া গ্রহণ করিতাম। পিতার অবস্থা দেখিয়া আমার মনেও একটু ভয়ের উদয় হইল। মনে করিলাম, আমাকর্তৃক ইব্রাহিম অপমানিত হওয়াতে, পিতা কি মনে মনে অপমানিত হইয়া আত্মজীবন ত্যাগ করিতে বসিয়াছেন? নতুবা দিন দিন তাঁহার এরূপ অবস্থা হইতেছে কেন? আমার মনে মনে এই প্রকার চিন্তা আসিয়া উদিত হইল সত্য, কিন্তু ভাবিয়া-চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। একদিবস দুইদিবস করিয়া, ক্রমে দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল, সপ্তাহ চলিয়া গেল। একদিবস পূৰ্ব্বাহ্নে পিতা তাঁহার বসিবার স্থানে চুপ করিয়া বসিয়া আছেন; দেখিয়া বোধ হইতেছে, কোন গাঢ় চিন্তায় তিনি মনঃসংযোগ করিয়াছেন, এমন সময় জনৈক ডাকপিয়ন আসিয়া পিতার হস্তে একখানি পত্ৰ প্ৰদান করিল। পিয়ন নিজে আসিয়া পিতার হস্তে পত্র প্রদান করায় আমি একটু বিস্মিত হইলাম। কারণ, কর্ম্মচারী বা দ্বারবান্ ব্যতীত এ পর্যন্ত কোন পিয়নকে নিজে আসিয়া পিতার হস্তে পত্রাদি প্রদান করিতে দেখি নাই। ইতিপূৰ্ব্বে ডাকে যে সকল পত্রাদি আসিত, ডাকপিয়ন, হয় তাহা দ্বারবানের হস্তে অথবা কোন কর্মচারীর হস্তে প্রদান করিয়া চলিয়া যাইত। কৰ্ম্মচারীগণ সেই পত্রের আবশ্যক অনুযায়ী সময় বুঝিয়া সেই সকল পত্র পিতার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত করিত। তখন সেই নিয়মের ব্যতিক্রম দেখিয়া প্রথমতঃ আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল; কিন্তু পরে যখন আমি সেই পত্র হস্তগত করিতে সমর্থ হই, তখন আমার সেই সন্দেহ মিটিয়া যায়। সেই সময় দেখিয়াছিলাম, সেই পত্রের উপর লেখা ছিল, ‘যাহার নামীয় পত্র তাহাকে ব্যতীত এই পত্র অপরের হস্তে দিতে নিষেধ।’ 

“ডাকপিয়ন পিতার হস্তে পত্রখানি প্রদান করিয়া প্রস্থান করিবার পর, পিতা সেই পত্রখানি খুলিয়া ফেলিলেন, এবং নিতান্ত সোৎসুক মনে সেই পত্রখানি একবার দুইবার করিয়া বোধ হয়, ক্রমাগত বিংশতিবার পাঠ করিলেন। পাঠ সমাপ্ত হইলে, উহা আপনার পকেটেই রাখিয়া দিলেন। 

“পত্রখানি পাঠ করিবার পর হইতে পিতার মুখশ্রী যেন একটু পরিবর্ত্তিত হইয়া গেল। সেই ভয়ানক নীলিমার মধ্য হইতে যেন ঈষৎ হাস্যরেখা প্রকাশিত হইল। তাঁহার সেই চির-প্রফুল্ল নেত্রের জ্যোতিঃ তখন আবার দর্শন করিলাম। 

“পত্রপাঠে পিতার ভাবান্তর দেখিয়া, আমার অন্তঃকরণেও আনন্দ সঞ্চারিত হইল। মনে করিলাম, পিতা হয়ত কোন স্থান হইতে কোনরূপ শুভ সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছেন; কিন্তু এখন দেখিতেছি, নিৰ্ব্বাণোম্মুখ দীপশিখা যেমন হঠাৎ প্রজ্জ্বলিত হয়, ইহাও তাহাই। মৃত্যুশয্যায় শায়িত রোগী মৃত্যুর পূর্ব্বে যেরূপ সমস্ত ব্যাধি হইতে নির্মুক্ত হন, ইহা তাহাই। 

“বৃদ্ধ ইব্রাহিম আমাকর্তৃক অবমানিত হইয়া, স্থানান্তরে প্রস্থান করিবার পর হইতেপিতার যেরূপ অবস্থা আমাদিগের আর নয়নগোচর হয় নাই, তখন পুনরায় তাহা দেখিতে পাইলাম। পত্রপাঠ করিবার পরে নিতান্ত হৃষ্টচিত্তে তাঁহার ভৃত্যকে ডাকিলেন, আদেশ পাইবামাত্র ভৃত্য আসিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইল। তিনি তাহাকে কহিলেন, “শারীরিক অসুস্থতা নিবন্ধন আজ কয়েকদিবস আমি উত্তমরূপে স্নানাহার করিতে পারি নাই, আজ উত্তমরূপ বন্দোবস্ত কর।’ আদেশ প্রতিপালিত হইল। পিতা উত্তমরূপে স্নান করিয়া সময়মত আহার করিতে বসিলেন, দেখিলাম, অপরাপর দিবস অপেক্ষা তখন তিনি পরিতৃপ্তির সহিত আহার করিলেন। আহারান্তে একটু শয়ন করা তাঁহার চিরদিবসের অভ্যাস, সেইদিবস কিন্তু সেই অভ্যাসের ব্যতিক্রম দেখিলাম। আহারান্তে নিয়মিতরূপ তিনি আপন প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলেন; কিন্তু নিয়মিতরূপ শয়ন না করিয়া, একখানি পত্র লিখিতে আরম্ভ করিলেন। আমার এত বয়স হইয়াছে ইহার মধ্যে পিতাকে কখনও স্বহস্তে পত্র লিখিতে দেখি নাই। যখন তাঁহার পত্রাদি লিখিবার প্রয়োজন হইত, তখন তিনি তাঁহার কর্মচারীর উপর আদেশ করিতেন, কাচারী তদনুযায়ি পত্র লিখিয়া তাঁহার স্বাক্ষর করাইয়া লইয়া যাইত মাত্র। তখন পিতাকে স্বহস্তে লিখিতে দেখিয়া মনে মনে বিস্মিত হইলাম সত্য; কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলিতে পারিলাম না। আহারান্তে পিতা পত্র লিখিতে আরম্ভ করিলেন, কিন্তু সেই পত্র যে কখন শেষ হইল, বলিতে পারি না; সন্ধ্যা পর্য্যন্ত তিনি অনবরত লিখিলেন। সন্ধ্যার সময় একবার গাত্রোত্থান করিলেন মাত্র; কিন্তু সন্ধ্যার পরে পুনরায় সেই পত্র লিখিতে বসিলেন। কোন্ সময় তাঁহার পত্র লেখা শেষ হয়, তাহা জানিবার নিমিত্ত রাত্রি দুইটা পর্য্যন্ত আমি জাগরিত ছিলাম, তাহার মধ্যেও তাঁহার সেই পত্র লেখা শেষ হয় নাই। রাত্রি দুইটার পর আমি নিদ্রিত হইয়া পড়ি, তাহার পর পিতা কখন যে সেই পত্র লেখা সমাপ্ত করেন, তাহা আমি অবগত নহি। 

“পরদিবস প্রাতঃকালে যখন আমি শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিলাম, তখন দেখিলাম, পিতা তাঁহার পালঙ্কোপরি নিদ্রিত আছেন। তিনি প্রত্যহ যেরূপ সময় শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করেন, আজ কিন্তু সেই সময়ে শয্যা হইতে উঠিলেন না। ক্রমে বেলা অধিক হইতে লাগিল, একজন পরিচারক গিয়া তাঁহাকে উঠাইবার চেষ্টা করিল; তাহাতে তিনি কহিলেন, ‘আমার শরীর নিতান্ত অসুস্থ, শয্যা ত্যাগ করিবার ক্ষমতা আমার নাই।’ 

“পরিচারকের নিকট হইতে এই সংবাদ অবগত হইয়া আমরা আর কোনরূপে স্থির থাকিতে পারিলাম না। যেদিবস আমি ইব্রাহিমকে অবমাননা করিয়াছিলাম, যেদিবস পিতা আমার উপর বিশেষরূপ অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন, সেইদিবস হইতে আমি পিতার সম্মুখে আর গমন করিয়াছিলাম না। পরিচারকের মুখে তাঁহার পীড়ার সংবাদ জানিতে পারিয়া, আর আমি স্থির থাকিতে পারিলাম না। তাঁহার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া তাঁহার পালঙ্কোপরি উপবেশন করিলাম, তাঁহার গাত্রে হস্তার্পণ করিয়া বুঝিলাম, তিনি প্রবল জ্বরে আক্রান্ত। পিতার এই অবস্থা দেখিয়া আমি অতিশয় ভীত হইলাম, এবং পিতাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘পিতঃ! আপনার কি হইয়াছে?’ উত্তরে পিতা কহিলেন, ‘পুত্র! আমার যে কি হইয়াছে, তাহা আমি নিজেই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না, তোমাকে কি বলিব? অনুমান হইতেছে, প্রবল জ্বরে আমি আক্রান্ত, আরও বুঝিতে পারিতেছি, আমার এ জ্বরের বিরাম হইবে না, কালের হস্ত হইতে এবার আমার নিষ্কৃতি নাই।’ 

“আমি। পিতঃ জ্বর কাহার না হইয়া থাকে? সামান্য জ্বরের নিমিত্ত আপনি এত ভীত হইতেছেন কেন? এই মহানগরীতে সুচিকিৎসকের কিছুমাত্র অভাব নাই, তাঁহাদের সুচিকিৎসায় আপনি শীঘ্রই আরোগ্যলাভ করিবেন। 

“পিতা। যখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, এবার আমার নিষ্কৃতি নাই, তখন অনর্থক অর্থ নষ্ট করিতে চাহিতেছ কেন? 

“আমি। অর্থ কিসের নিমিত্ত? এই অসীম অর্থ কাহার? আজীবন উপার্জ্জন করিয়া যিনি এই অগাধ অর্থ সঞ্চয় করিয়াছেন, তাঁহারই জীবনের নিমিত্ত যদি এ অর্থ ব্যয়িত না হয়, তাহা হইলে এ অর্থে প্রয়োজন কি? আপনি আমার উপর সন্তুষ্ট হউন, বা অসন্তুষ্ট হউন, এ সম্বন্ধে আমি আপনার কোন কথা শুনিব না। আপনার জীবনের নিমিত্ত যত অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হইবে, অবলীলাক্রমে আপনার সঞ্চিত অর্থ হইতে তাহা ব্যয় করিব, আপনি এ সম্বন্ধে আমাকে কোন কথা কহিবেন না। প্রধান প্রধান কর্ম্মচারিবর্গের সহিত পরামর্শ করিয়া যাহা কৰ্ত্তব্য বিবেচনা হইবে, তাহা করিবার নিমিত্ত আমি যাইতেছি। 

“এই বলিয়া পিতার আর কোন কথা কহিবার পূর্ব্বেই আমি সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া বাহিরে আসিলাম। “যে সমস্ত নিয়মিত পরিচারকগণ পিতার সেবা শুশ্রূষার নিমিত্ত সর্ব্বদা নিযুক্ত ছিল, তদ্ব্যতীত আরও কয়েকজন পরিচারক তাঁহার সেবায় নিযুক্ত হইল। প্রধান প্রধান পুরাতন ও বিশ্বস্ত কর্ম্মচারিগণের সহিত পরামর্শ করিয়া এই মহানগরীর মধ্যস্থিত বিচক্ষণ এবং বহুদর্শী চিকিৎসকগণকে তাঁহার চিকিৎসায় নিযুক্ত করিলাম। চিকিৎসকগণ বিশেষ যত্নের সহিত তাঁহার চিকিৎসা করিতে আরম্ভ করিলেন, পরিচারকগণ প্রাণপণে তাঁহার পরিচর্য্যায় নিযুক্ত রহিল, কিন্তু রোগের উপশম হওয়া দূরে থাকুক, ক্রমেই উহা প্রবল হইতে আরম্ভ হইল। চিকিৎসকগণ বাছিয়া বাছিয়া কত ঔষধ প্রয়োগ করিতে লাগিলেন; কিন্তু সকল ঔষধেই বিপরীত ফল ফলিতে লাগিল। এই সহরের মধ্যে এমন কোন প্রধান চিকিৎসক নাই, যিনি তাঁহাকে অন্ততঃ একবারও না দেখিয়াছেন। এখন পিতার অবস্থা অতিশয় শোচনীয়, তাঁহার জীবনদীপ নির্ব্বাপিত হইবার আর কিছুমাত্র বিলম্ব নাই, তাঁহার এই শেষ অবস্থায় যদি আপনি একবার দেখিতে চাহেন, তাহা হইলে আর বিলম্ব করিবেন না; আমার সহিত এখনই আসুন।” 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

কাসেম বেগের সমস্ত কথাগুলি আমি বিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিলাম। বৃদ্ধ ওসমান বেগকে আমি বিশেষরূপ মান্য করিয়া চলিতাম, তাঁহার অন্তিমকাল উপস্থিত হইয়াছে শুনিয়া, তাঁহার সহিত দেখা করিতে তখনই প্রস্তুত হইলাম। কাসেম বেগকে সেই সময় আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, তাঁহার সহিত তাঁহার গাড়িতে গিয়া উপবেশন করিলাম, আদেশ পাইবামাত্র কোচবান্ গাড়ি চালাইয়া দিল। ওসমান বেগকে দর্শন করিবার নিমিত্ত কাসেম বেগের সহিত গমন করিতে লাগিলাম সত্য: কিন্তু জানি না, মনে কেন কতকগুলি অভাবনীয় চিন্তা আসিয়া উদিত হইতে লাগিল। মৃজা ওসমান বেগের বাটীতে ইব্রাহিম ভাইয়ের আতিথ্য গ্রহণ, ওমান্ বেগ কর্তৃক দেবতাসম ইব্রাহিমের আদর ও যত্ন, কাসেম বেগ কর্তৃক তাহার অবমাননা, ক্রোধভরে ইব্রাহিমের এই স্থান পরিত্যাগ প্রভৃতি ঘটনার সহিত ওমান বেগের পীড়ার কোনরূপ সংশ্রব আছে কি না, ইহা একবার মনে উদিত হইল। ওমান্ বেগ কোথা হইতেই বা পত্র প্রাপ্ত হইলেন, সেই পত্রে কি লিখিত ছিল, এবং সেই পত্র প্রাপ্তির পর হইতে তাঁহার কেনই বা ভাবান্তর উপস্থিত হইয়াছিল, তাহাও একবার মনে আসিল, রাত্রি জাগরণ করিয়া ওমান বেগ যে দীর্ঘ পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাই বা কি? তিনি যে পত্র পাইয়াছিলেন উহা কি তাহারই প্রত্যুত্তর? যদি তাহাই হইবে, তাহা হইলে উহা তিনি কিরূপেই বা তাঁহার নিকটও প্রেরণ করিলেন? যাহা হউক, এ সম্বন্ধে দুই একটি কথা কাসেম বেগকে জিজ্ঞাসা করা আবশ্যক। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি কাসেম বেগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার পিতা যে পত্র প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাহা কাহার লিখিত ও তাহার সারমর্ম্মই বা কি, তাহার কিছু অবগত হইতে পারিয়াছেন কি? 

কাসেম। সেই পত্রখানি যে কাহার লিখিত, এবং উহাতে যে কি লিখিত ছিল, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমারও নিতান্ত কৌতূহল জন্মিয়াছিল। অনেক অনুসন্ধান করিয়া সেই পত্রখানি খুঁজিয়া বাহিরও করিয়াছিলাম; কিন্তু মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারি নাই। সেই পত্রে কাহারও নাম স্বাক্ষরিত নাই, যাহা লেখা আছে তাহারও ভাবার্থ কিছু গ্রহণ করিতে সমর্থ হই নাই। পত্রখানি আমার সঙ্গেই আছে, পাঠ করিয়া দেখুন, যদি আপনি ইহার মর্ম্ম কিছু বুঝিয়া উঠিতে পারেন। 

এই বলিয়া কাসেম বেগ একখানি পত্র আমার হস্তে প্রদান করিলেন। পত্রখানি আমি খুলিলাম ও পাঠ করিলাম; কিন্তু ইহার ভাবার্থ সম্যকরূপে কিছুই অবগত হইতে পারিলাম না। পত্রে লেখা ছিল, “আলি! সমস্তই ঠিক্ হইয়া গিয়াছে, আর বিলম্ব নাই প্রস্তুত হও! সহর বোম্বাই।” পত্রখানি পাঠ করিয়া পুনরায় আমি উহা কাসেম বেগের হস্তে অর্পণ করিলাম ও কহিলাম, বাস্তবিকই এ পত্র দেখিয়া কিছুই বুঝিবার উপায় নাই। ইব্রাহিম ভাই যখন প্রথম তোমাদিগের বাটীতে আগমন করে, সেই সময় তাঁহার মুখ হইতে আলি এই নাম প্রথম উচ্চারিত হয়, এবং বাটী পরিত্যাগ করিবার কালীনও আলি, এই নাম তাহার মুখে শুনিতে পাওয়া গিয়াছিল। সেই নামের সহিত তোমার পিতার কোনরূপ সংস্রব আছে কি না জানি না। যদি কোনরূপ সংশ্রব থাকে, তাহা হইলে এই পত্রপাঠে বিপদের এমন কোন আশঙ্কা করিতে পারা যায় না, যাহাতে তোমার পিতার অন্তঃকরণে ভয়ানক ভয়ের বা দুঃখের সঞ্চার হইতে পারে, এবং যাহার নিমিত্ত তাঁহার এই ভয়ানক পীড়ার উৎপত্তি হয়। অধিকন্তু এই পত্রপাঠে এইরূপ অনুমান হয় যে, যে ব্যক্তি এই পত্র লিখিয়াছেন, তাঁহাকে কোনও কাৰ্য্য নির্ব্বাহ করিবার নিমিত্ত, তোমার পিতা অনুরোধ করিয়াছিলেন, তিনি সেই কার্য্য সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইয়া তোমার পিতাকে প্রস্তুত হইতে লিখিয়াছেন। তোমার পিতা কাহাকে, কি কার্য্যের নিমিত্ত নিযুক্ত করিয়াছিলেন, তাহা তিনি যে পর্য্যন্ত নিজে প্রকাশ না করিবেন, সে পৰ্য্যন্ত আমাদিগের জানিবার আর উপায় নাই। এ পত্র প্রাপ্ত হইবার পর, তাঁহার মনের গতি যে পরিবর্তিত হইয়াছিল, তাহার কারণ, তাঁহার উদ্দেশ্য সফল হওয়া ভিন্ন আর কিছুই নহে। এই পত্রের লিখিত বিষয়ের সহিত তাঁহার বর্তমান পীড়ার যে কোনরূপ সংশ্রব আছে, তাহা আমার বোধ হয় না। সে যাহা হউক, তিনি যে দীর্ঘ পত্রখানি লিখিয়াছিলেন, তৎসম্বন্ধে কিছু জানিতে পারিয়াছেন কি? 

কাসেম। জানিবার নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু কিছুই জানিতে পারি নাই। 

আমি। যদি সেইখানি পত্রই হয়, তাহা হইলে যাঁহার নিমিত্ত উহা লিখিত হইয়াছে, তাঁহার নিকট উহা প্রেরণ করা হইয়াছে বলিয়া আপনার অনুমান হয় কি? 

কাসেম। যে সময় পত্র লেখা শেষ হইয়াছে, সেই সময় উহা কোনরূপে প্রেরিত হইতে পারে না। আমি রাত্রি দুইটার সময় শয়ন করিয়াছিলাম, তখনও তাঁহার সেই পত্র লেখা শেষ হয় নাই, তদ্ব্যতীত এ সম্বন্ধে পরিচারকগণের নিকটও অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছি, কিন্তু কেহই কোন কথা বলিতে পারে না। 

আমি। এরূপ অবস্থায় আমার বোধ হয়, তিনি যাহা লিখিয়াছিলেন, উহা পত্র নহে। তিনি একে বৃদ্ধ হইয়াছেন, তাহাতে গত কয়েকদিবস পর্য্যন্ত তাঁহার শরীর একটু অসুস্থই ছিল। এরূপ অবস্থায় আমার বিবেচনায় তিনি ভবিষ্যৎ ভাবিয়া তাঁহার এই অগাধ বিষয় সম্বন্ধে কোনরূপ বন্দোবস্ত করিয়া কোনরূপ লেখাপড়া করিয়া রাখিয়াছেন। যাহা তিনি লিখিয়াছেন, তাহা কোন স্থানে প্রেরিত হয় নাই, তাঁহার ঘরের মধ্যে কোন না কোন স্থানে রক্ষিত আছে। 

কাসেম। যতদূর সম্ভব, আমি ঘরের প্রায় সমস্ত স্থান উত্তমরূপে দেখিয়াছি; কিন্তু কোন স্থানেই উহার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। 

আমাদের উভয়ের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় আমাদিগের গাড়ী আসিয়া একস্থানে দণ্ডায়মান হইল। দেখিলাম, আমরা মৃজা ওমান বেগের বাটীর সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

আমি ও কাসেম বেগ উভয়েই গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া বাটীর ভিতর প্রবেশ করিবার উদ্যোগ করিতেছি, এমন সময় বাটীর মধ্য হইতে ভয়ানক ক্রন্দনধ্বনি উত্থিত হইল। বুঝিলাম, যে মুজা ওসমান বেগের সহিত আমাদিগের সাক্ষাৎ হইবার আর উপায় নাই, তিনি ইহজগৎ পরিত্যাগ করিয়া চলিলেন। 

একবার মনে করিলাম, যখন বৃদ্ধ ওসমান বেগের সহিত সাক্ষাৎ হইবার আর সম্ভাবনা নাই, তখন আর বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়াই বা লাভ কি? কিন্তু কাসেম বেগকে এই অবস্থায় পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতেও ইচ্ছা হইল না। তদ্ব্যতীত বৃদ্ধ ওসমান বেগ কর্তৃক লিখিত সেই পত্রের কথা লইয়া আমার মনের ভিতর অনেক বিষয় উদিত হইতেছিল। সেই সম্বন্ধেও যদি কোন বিষয় অবগত হইতে পারি, এই ভাবিয়া সেই সময় আমি সেই স্থান হইতে প্রত্যাগমন করিলাম না। বহু কষ্টে অশ্রুজল নিবারণ করিয়া কাসেম বেগের সমভিব্যাহারে সেই রোরুদ্যমানা পুরীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম ওমান বেগের প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিবার উপায় নাই; অন্তঃপুরবাসিনীগণ দ্বারায় উহা একেবারে পরিপূর্ণ। কাসেম বেগের সহধর্মিণী ও অপর স্ত্রীলোকগণ, যাঁহারা কখনও অন্তঃপুরের বহির্ভাগে পদার্পণ করেন নাই, আজ তাঁহারা পর্য্যন্ত বৃদ্ধ ওসমান বেগের ঘরের ভিতর উপবিষ্ট হইয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন ও আর্তনাদ করিতেছেন। তাঁহাদিগের অবস্থা দেখিয়া পরিচারিকাগণ পর্য্যন্ত দূরে দাঁড়াইয়া অশ্রুজলে আপন আপন বসন সিক্ত করিতেছে। আত্মীয়স্বজন, পরিচারকগণ ও কর্ম্মচারিবর্গ বৃদ্ধের নিকটবর্ত্তী হইতে পারিতেছেন না, তাঁহারা শোকে বিহ্বলচিত্ত হইয়া দূরে দাঁড়াইয়া আছেন। 

কাসেম বেগ আমার সহিত নিঃশব্দে বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন সত্য; কিন্তু সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া কোনরূপেই স্থির থাকিতে পারিলেন না; নিতান্ত বালকের ন্যায় উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। 

বাটীর ভিতর এইরূপ বিষম গোলযোগ উপস্থিত হওয়ায় সেই সময় কি কৰ্ত্তব্য, তাহা প্রায় সকলেই বিস্মৃত হইয়া গিয়াছেন। সেই স্থানে যে সকল কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে জনৈক প্রধান মুসলমান কর্ম্মচারীর সহিত পরামর্শ করিয়া এই স্থির করিলাম যে, স্ত্রীলোকগণকে সেই স্থান হইতে অন্তঃপুরে পাঠাইয়া দিয়া যতশীঘ্র হয়, ইঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ করাই কর্তব্য। কারণ, বৃদ্ধ ওমান বেগ সর্ব্বসাধারণের যেরূপ প্রীতিভাজন ছিলেন, তাহাতে তাঁহার মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হইবামাত্র এই স্থানে এত লোকের সমাগম হইতে পারে, যাহাতে একটি বিষম গোলযোগ হইবার সম্ভাবনা। 

প্রধান কর্ম্মচারী পরামর্শানুযায়ি কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইলেন ও পরিচারিকাগণদ্বারা অনেকরূপ বুঝাইয়া অন্তঃপুরবাসিনীগণকে ক্রমে ক্রমে অন্তঃপুরের ভিতর পাঠাইয়া দিলেন। এইরূপে ওসমান বেগের গৃহ হইতে স্ত্রীলোকগণ প্রস্থান করিবার পর, তাঁহার মৃতদেহ সেই ঘর হইতে বাহিরে আনা হইল। মুসলমানদিগের রীত্যনুযায়ি বস্ত্রাদি যে সকল দ্রব্য মৃতদেহের সৎকারার্থ আবশ্যক হয়, সে সমস্ত দ্রব্যই দেখিতে দেখিতে সংগৃহীত হইল। মুসলমান কর্ম্মচারীগণ ও মৃজা ওসমান বেগের মুসলমান বন্ধুবান্ধবগণ, যাঁহারা সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা সেই মৃতদেহ একখানি পালঙ্কের উপর স্থাপিত করিয়া সৎকারার্থ সেই স্থান হইতে লইয়া প্রস্থান করিলেন। বলা বাহুল্য যে, কাসেম বেগও সেই সঙ্গে চলিয়া গেলেন। 

সেই সময় সেই স্থানে যে সকল ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে প্রায় সকলেই সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। কেবল আমি সেই স্থানে রহিলাম। সকলে প্রস্থান করিবার পর, ওসমান বেগের বন্ধু বান্ধবগণের মধ্যে যাঁহারা তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে কেবল দুই একজন আমার নিকটে রহিলেন মাত্ৰ। 

মৃত্যুর পূর্ব্বে মৃজা ওসমান বেগ পীড়িত হইয়া যে গৃহে শয্যাগত ছিলেন, আমি সেই গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, সেই গৃহের মধ্যে যে পালঙ্কে তিনি শয়ন করিতেন, সেই পালঙ্ক ও অপরাপর নিতান্ত প্রয়োজনীয় দুই চারিটি টেবিল, চেয়ার, ট্রিপয় ব্যতীত অপর আর কোন দ্রব্য সেই ঘরে ছিল না। আমাকে সেই ঘরের ভিতর প্রবিষ্ট হইতে দেখিয়া, ওসমান বেগের একজন পরিচারক কোথা হইতে আসিয়া উপস্থিত হইল, আমি তাহাকে সময় সময় মুজাসাহেবের নিকট দেখিতাম ও জানিতাম, সেই ব্যক্তি তাঁহার একজন বিশ্বস্ত পরিচারক। তাহাকে দেখিয়াই আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এইটি কি মৃজাসাহেবের শয়ন ঘর ছিল?” 

পরিচারক। হাঁ মহাশয়! ইদানীং তিনি এই ঘরে শয়ন করিতেন। তিনি ব্যতিরেকে অপর কোন লোকেরই এই গৃহে শয়ন করিবার আদেশ ছিল না। 

আমি। কতদিবস হইতে তিনি এই ঘরে শয়ন করিতেন? 

পরিচারক। গত পাঁচ সাত বৎসর হইতে তাঁহাকে এই ঘরেই শয়ন করিতে দেখিতেছি। 

আমি। তাঁহার নিজের বাক্স, সিন্ধুক প্রভৃতি কোন্ ঘরে থাকে? 

পরিচারক। তাঁহার নিজের নির্দিষ্ট কোন বাক্স, সিন্ধুক নাই। 

আমি। তাঁহার প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তিনি কোথায় রাখিতেন? 

পরিচারক। তাঁহাকে কখনও কোন দ্রব্য কোন স্থানে স্বয়ং রাখিতে দেখি নাই, কোন দ্রব্যের প্রয়োজন হইলে হয়, তিনি তাহা কাসেম বেগ সাহেবের নিকট হইতে চাহিয়া লইতেন, না হয় কোন কর্ম্মচারীর উপর আদেশ করিতেন, তিনি তাহা আনিয়া মৃজাসাহেবের নিকট উপস্থিত করিতেন। 

আমি। তাঁহার নিজের গোপনীয় বা প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র তিনি কোথায় রাখিতেন?

পরিচারক। এ পর্যন্ত কোন কাগজ-পত্র আমি মৃজাসাহেবকে স্বহস্তে রাখিতে দেখি নাই।

আমি। টাকা, পয়সা? 

পরিচারক। আমি যতদিবস তাঁহার নিকট চাকরী করিতেছি, তাহার মধ্যে তাঁহাকে কখনও টাকা কি পয়সা স্পর্শ করিতে দেখি নাই। যখন টাকাকড়ির আবশ্যক হইত, কৰ্ম্মচারিকে আদেশ করিলেই তাহা সম্পন্ন হইত। 

আমি। মুজাসাহেব পীড়িত হইবার পূর্ব্বে তিনি স্বহস্তে একখানি পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহা তুমি দেখিয়াছিলে কি? 

পরিচারক। হাঁ দেখিয়াছিলাম। একদিবস তিনি রাত্রিদিন বসিয়া বসিয়া অনেক লিখিয়াছিলেন। 

আমি। তুমি বলিতে পার, যে কাগজে তিনি উহা লিখিয়াছিলেন, সেই কাগজ তিনি কি করিলেন?

পরিচারক। তিনি যে উহা কি করিলেন, তাহা আমি বলিতে পারি না। 

আমি। তিনি কি উহা কাহাকেও প্রদান করিয়াছেন? 

পরিচারক। কাহাকেও উহা আমি প্রদান করিতে দেখি নাই, বোধ হয়, কাহাকেও তিনি উহা দেন নাই। কারণ, কাহাকেও প্রদান করিলে আমরা নিশ্চয় তাহা জানিতে পারিতাম। 

আমি। তাহা হইলে তিনি উহা কি করিলেন? 

পরিচারক। বোধ হয়, কোন স্থানে রাখিয়া দিয়াছেন। 

আমি। কোথায় রাখিয়া দিবার সম্ভাবনা? 

পরিচারক। রাখিবার অপর কোন স্থানও ত আমি দেখিতেছি না, এই ঘর ভিন্ন তাঁহার ত আর রাখিবার স্থান নাই, যদি রাখিয়া দিয়া থাকেন, তাহা হইলে এই ঘরের কোন না কোন স্থানে নিশ্চয় উহা রাখিয়াছেন। 

আমি। তবে আইস, আমরা উভয়ে মিলিয়া এই ঘরটি উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখি। দেখি, তাঁহার স্বহস্ত লিখিত সেই কাগজখানি কোন স্থান হইতে বাহির করিতে পারি কি না? 

এই বলিয়া সেই পরিচারকের সাহায্যে সেই ঘরটি আমি উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিলাম। ঘরটি পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন, তাহার মধ্যে দ্রব্য সামগ্রী অধিক কিছুই ছিল না। সুতরাং কেবলমাত্র পালঙ্ক ব্যতীত অপরাপর স্থান অনুসন্ধান করিতে বোধ হয়, পাঁচ মিনিটের অধিক সময় লাগিল না। তাহার পর পালঙ্ক অনুসন্ধান আরম্ভ করিলাম, পালঙ্কের উপর যে তিন চারিটি বালিশ ছিল, তাহা উত্তমরূপে দেখিলাম, কিছুই পাইলাম না। উপর্যুপরি দুইখানি চাদর বিছান ছিল, চাদর দুইখানি উঠাইয়া ফেলিলাম, চাদরের নিম্নে দুইখানি তোষক ছিল, তাহাও স্থানান্তরিত করিলাম, কিন্তু কোন স্থানে কিছুই দেখিতে পাইলাম না। তোষকের নিম্নে উপর্যুপরি তিনটি গদি বিছান ছিল, প্রথম গদিটি উঠাইলাম, কিছুই দেখিতে পাইলাম না, দ্বিতীয় গদিটি উঠাইতে গিয়া দেখি, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গদির মধ্যস্থলে একটি বদ্ধ করা লেফাপা রহিয়াছে। লেফাপাখানি হস্তে উঠাইয়া লইলাম, দেখিলাম, উহাতে লেখা আছে, “আমার জীবিতাবস্থায় এই লেফাপা যদি কাহারও হস্তে পতিত হয়, তাহা হইলে তিনি যেন ইহা না খুলিয়া আমাকে প্রত্যর্পণ করেন। আর যদি তিনি ইহা আমাকে প্রত্যর্পণ করিতে অসম্মত হন, তাহা হইলে যে পর্য্যন্ত আমি জীবিত থাকিব, সেই পৰ্য্যন্ত ইহা যেন খোলা না হয়। মুজা ওসমান বেগ।” 

এই পত্রখানি পাইবামাত্র আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, বৃদ্ধ ওসমান বেগ তাঁহার মৃত্যুর পূর্ব্বে দিবারাত্র পরিশ্রম করিয়া যে পত্র লিখিয়াছিলেন, ইহাই সেই পত্র। সেই পত্রের উপর মৃজা ওসমান বেগের স্বহস্ত লিখিত যে কয়েকটি কথা ছিল, তাহা পাঠ করিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম, এখন এই পত্র খুলিতে তাঁহার আর নিষেধ নাই। সেই পত্রখানি খুলিয়া পাঠ করিবার নিমিত্ত আমার নিতান্ত কৌতূহল জন্মিল, কিন্তু অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া স্থির করিলাম, যে পৰ্য্যন্ত কাসেম বেগ প্রত্যাবর্তন না করেন, সেই পর্য্যন্ত এই পত্র খোলাও কৰ্ত্তব্য নহে, পাঠ করাও উচিত নহে। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

কাসেম বেগ তাঁহার পিতার সৎকারকার্য সম্পন্ন করিয়া নিয়মিত সময়ে প্রত্যাবর্তন করিলে, আমি তাঁহার হস্তে সেই পত্রখানি প্রদান করিলাম, এবং যেরূপ অবস্থায় সেই পত্রখানি প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহার সমস্ত অবস্থা তাঁহার নিকট বিবৃত করিলাম। পত্রের উপরিভাগে যাহা লিখিত ছিল, তাহা পাঠ করিয়াই কাসেম বেগ সেই পত্রখানি খুলিয়া ফেলিলেন। দেখিলাম, উহা প্রকৃতই পত্রের আকারে লিখিত, কিন্তু অতিশয় দীর্ঘ। পত্রের লেখা দেখিয়া কাসেম বেগ কহিলেন, “ইহা আমার পিতার স্বহস্ত লিখিত।” এই বলিয়া তিনি সেই পত্রখানি পুনরায় আমার হস্তে প্রদান করিলেন, ও কহিলেন, “ এখন আমার মস্তকের কিছুমাত্র স্থিরতা নাই, এবং পত্রখানিও দেখিতেছি অতিশয় দীর্ঘ, আপনি ইহা পাঠ করুন।” 

কাসেম বেগের কথা শুনিয়া আমি সেই পত্রখানি তাঁহাকে শুনাইয়া পাঠ করিতে আরম্ভ করিলাম। সেই পত্রে লেখা ছিল :- 

“প্রিয়পুত্র কাসেম বেগ! তুমি আমার একমাত্র সন্তান, তোমারও সন্তান হইয়াছে। সুতরাং তুমি বেশ বুঝিতে পার যে, তুমি আমার কিরূপ প্রিয় পদার্থ। যেদিবস আমি তোমাকে বিশেষরূপে তিরষ্কৃত করিয়া আমার সম্মুখ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিয়াছিলাম, সেই দিবসের ঘটনা তোমার মনে আছে কি? একজন সামান্য অপরিচিত ব্যক্তিকে তুমি অবমানিত করিয়াছিলে বলিয়াই, আমি সেই সময় তোমার উপর বিশেষরূপ অসন্তুষ্ট হইয়াছিলাম। সেই অপরিচিত বৃদ্ধ ইব্রাহিম ভাই যে কে, সে পরিচয় আমি সেই সময় তোমাকে প্রদান করিতে পারি নাই। তাঁহাকে আমি যে কেন এত মান্য করিয়া চলিতাম, সদাসর্ব্বদা তাঁহাকে সন্তুষ্ট রাখিবার জন্য আমি কেন যে এত চেষ্টা করিতাম, তাঁহার কৃত শত সহস্র অরাধ আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে কেন সহ্য করিতাম, তাহার পরিচয় দিবার সময় তখন নহে, এখন আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। 

“আমি জানি, তিনি তোমাদিগের উপর বড়ই অত্যাচার করিতেন, আমি জানি আমার বিশ্বস্ত ও বহু পুরাতন পরিচারকগণের সহিত তিনি নিতান্ত অন্যায় ব্যবহার করিতেন, আমি দেখিয়াছি, তাঁহার অত্যাচারে জর্জরিত হইয়া অনেকেই আমাকে পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিয়াছে। আমি দেখিয়াছি, তাঁহার অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া প্রধান প্রধান কর্ম্মচারিবর্গ কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাওয়ায়, তোমাকে অযথা অনেক কষ্ট ভোগ করিতে হইয়াছে, তথাপি সেই সময় আমি তাঁহার পরিচয় প্রদান করিতে সমর্থ হই নাই। এখন সেই পরিচয়ের সময় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। 

“তিনি কে, ইহা যদি তুমি সেই সময় জানিতে পারিতে, এবং তাঁহার সেই সকল অত্যাচার সেই সময় আমি অবলীলাক্রমে কেন যে সহ্য করিয়াছিলাম, তাহা যাদি তুমি বুঝিতে পারিতে, তাহা হইলে তাঁহার বিষম অত্যাচারের দিকে একবারের নিমিত্তও লক্ষ্য করিতে না। তিনি যাহাই করিতেন মৌনাবলম্বনে তুমি তাহা আমার ন্যায় সেই সময় সকল সহ্য করিতে। কিন্তু ইহাতে আমি তোমাকে কিছুমাত্র দোষ দিতে পারি না। কারণ, তুমি সেই সময় তাঁহার কোন পরিচয় জানিতে না। এখন তাঁহার পরিচয় প্রদান করিবার পূর্ব্বে আমার নিজের পরিচয় প্রদান করিতেছি। আমার প্রকৃত পরিচয় অবগত হইতে পারিলে তুমি সমস্ত বিষয়ই জানিতে পারিবে। 

“আমার প্রকৃত নাম ওসমান বেগ নহে, বা আমি এই কলিকাতা সহরীতে জন্মগ্রহণ করি নাই। আমার প্রকৃত নাম আলি ভাই। বোম্বাই প্রদেশের অন্তর্গত ***** গ্রামে আমার জন্মস্থান, অর্থাৎ ইব্রাহিম ভাই যে গ্রামে বাস করেন, আমিও সেই গ্রামে জন্মগ্রহণ করি। আমার পিতা সেই স্থানের একজন প্রধান লোকের মধ্যে পরিগণিত না হইলেও, তিনি নিতান্ত দরিদ্র ছিলেন না। আমি ধনবান ব্যক্তির গৃহে জন্মগ্রহণ না করিলেও, অল্প বয়সে ধনশালী ও অসচ্চরিত্র ব্যক্তিগণের সহিত মিলিত হইলে সদাসৰ্ব্বদা লোকের যেরূপ অবস্থা ঘটিয়া থাকে, আমার অদৃষ্টেও ঠিক সেইরূপ ঘটিয়াছিল। পুত্র! আমার নিজের চরিত্রের বিষয় তোমার নিকট বর্ণন করিতে, আমি মনে মনে যেরূপ লজ্জিত হইতেছি, তাহা তুমি বেশ বুঝিতে পারিতেছ, কিন্তু কি করি, আমি নিজেই আমার অসচ্চরিত্রের বিষয় তোমার নিকট বর্ণন না করিলে চিরকালের নিমিত্ত তোমার হৃদয়ে বিষম সংশয় থাকিয়া যাইবে। কারণ, আমি ভিন্ন আমার বিষয় এখন আর কেহই অবগত নহে। আর এক জানিত, বৃদ্ধ ইব্রাহিম, তাঁহাকে বিশেষরূপে অবমানিত করিয়া তুমি দূর করিয়াই দিয়াছ। সে যাহা হউক, পিতা হইয়া পুত্রের নিকট যে সকল বিষয় বর্ণন করা লোকাচার বিরুদ্ধ, আজ আমি তাহাই তোমাকে বলিতে বসিয়াছি। 

“যে গ্রামে আমার বাসস্থান ছিল, সেই গ্রামে একজন ধনশালী জমীদার বাস করিতেন, বিস্তর অর্থের সহিত আমার সমবয়স্ক একটি পুত্র রাখিয়া, তিনি কাল-কবলে পতিত হন। সেই সময়ে আমার বয়ঃক্রম ষোড়শ কি সপ্তদশ বর্ষ হইয়াছিল। আমার পিতামাতা বর্তমান থাকিলেও আমি বাল্যকাল হইতে সেই ধনবান ব্যক্তির পুত্রের সহিত বন্ধুত্বসূত্রে আবদ্ধ ছিলাম। অধিকাংশ ধনশালী ব্যক্তির পুত্রগণের চরিত্র যেরূপ হইয়া থাকে, তাঁহার চরিত্রও সেইরূপ ছিল। সুতরাং সদাসর্ব্বদা তাঁহার সহিত মিলিত থাকায় আমার চরিত্র যে কলুষিত হইবে, তাহার আর বিচিত্র কি? তাঁহার পিতার মৃত্যুর পর, অসীম ধনরাশির অধিপতি হইয়া তিনি তাঁহার কলুষিত চরিত্রকে আরও কলুষিত করিতে লাগিলেন। আমার ও মৎ সদৃশ তাঁহার আরও কয়েকজন অনুচরের সাহায্যে, তিনি যখন যাহাই মনে করিতেন, তাহাই সম্পন্ন হইত। সেই সময় সেই ধনিপুত্রের অর্থে আমাদিগের অত্যাচার এতই বৰ্দ্ধিত হইয়াছিল যে, সেই প্রদেশীয় অনেক লোকের স্ত্রী-পুত্র লইয়া বাস করা একরূপ দায় হইয়া উঠিয়াছিল। সেই সময় আমাদিগের মনে যখন যেরূপ দুষ্কর্ম্মের উদয় হইত, পরের অর্থ ব্যয় করিয়া আমরা তখনই তাহা সম্পন্ন করিতাম। সেই প্রদেশীয় অপরাপর ব্যক্তিগণের সুশ্রী স্ত্রী-কন্যাগণের উপর আমাদিগের লক্ষ্য পতিত হইলে, ছলে হউক, বলে হউক, কৌশলে হউক ও অজস্র অর্থ ব্যয় করিয়াই হউক, আমরা আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া লইতাম। এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, কিন্তু আমাদিগের অবৈধ অত্যাচারের স্রোত কিছুমাত্র নিবৃত্ত হইল না। 

“যে গ্রামে আমি বাস করিতাম, তাহার নিকটবর্তী অপর আর একখানি গ্রামে আমাদিগের স্বজাতীয় একজন বর্দ্ধিষ্ণু লোক বাস করিতেন। তাঁহার একটি সুশ্রী যুবতী কন্যা ছিল, সেই যুবতীর উপর সেই সময় আমার ধনবান্ বন্ধুর দৃষ্টি পতিত হয়। তাহাকে হস্তগত করিবার নিমিত্ত আমরা নানারূপ কৌশল অবলম্বন করি; কিন্তু কোনরূপে কৃতকার্য্য হইতে না পারায় পরিশেষে আমাদিগকে দস্যুবৃত্তি অবলম্বন করিতে হয়। কোন্ দিবস সেই স্ত্রীলোকটির পিতা কাৰ্য্যগতিকে স্থানান্তরে গমন করেন, প্রথমতঃ কয়েকদিবস আমরা তাহার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হই। এইরূপ চারি পাঁচ দিবস অতিবাহিত হইতে না হইতেই জানিতে পারি, একদিবস তাহার পিতা স্থানান্তরে গমন করিয়াছেন, তাঁহার সহিত তাঁহার বাটীর আরও কয়েকজন গিয়াছে। আমরা সেই সংবাদ যেদিবস জানিতে পারি, সেই রাত্রিতেই আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে প্রবৃত্ত হই। রাত্রিকালে স্বদলবলে আমরা দস্যুরূপে তাঁহার বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়া, তাঁহার সেই কন্যাটিকে অপহরণ করিয়া আনি। আমাদিগের এই কার্য্য করিবার পরই ভয়ানক গোলযোগ উপস্থিত হয়, সেই স্ত্রীলোকটির পিতা তাঁহার বাটীতে প্রত্যাবর্তন করিয়া এই সকল অবস্থা জানিতে পারেন, এবং থানায় গিয়া এই সংবাদ প্রদান করেন। পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ আসিয়া ইহার অনেকরূপ অনুসন্ধান করেন; কিন্তু কাহাদ্বারা এই কার্য্য হইয়াছে, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে না পারিয়া, পরিশেষে এইরূপ রিপোর্ট দিয়া এই অনুসন্ধান পরিত্যাগ করেন যে, ‘ডাকাইতি হইয়াছে বলিয়া যে এজাহার দেওয়া হয়, তাহা মিথ্যা, ডাকাইতগণ বাটীর ভিতর প্রবেশ করিয়া কিছুমাত্র দ্রব্য অপহরণ করে নাই, বা অপহরণ করিবার কোনরূপ চেষ্টাও করে নাই; কেবলমাত্র বাদীর যুবতী কন্যাকে লইয়া প্রস্থান করিয়াছে। অনুমান হইতেছে, বাদীর বিধবা যুবতী কন্যা ঘর হইতে বাহির হইয়া গিয়াছে; কিন্তু লোকলজ্জায় বাদী সেই কথা প্রকাশ করিতে না পারিয়া, এইরূপ মিথ্যা এজাহার দিয়াছে। আমাদিগের বিবেচনায় তাহার মিথ্যা এজাহার দেওয়ার উদ্দেশ্য এই যে, পুলিসের অনুসন্ধানে যদি তাহার কন্যার কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যায়, তাহা হইলে তাহার স্বার্থ অনায়াসেই সাধিত হয়। 

‘এদিকে আমার ধনবান বন্ধু সেই বিধবা যুবতীকে লইয়া কিছু দিবস অতিবাহিত করিলেন। এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইতে না হইতেই আর একটি সুন্দরী যুবতী স্ত্রীলোকের কথা তাহার কর্ণগোচর হইল, তখন তিনি তাহারই দিকে আপন মন নিয়োজিত করিলেন, এবং অনেক অর্থ ব্যয় করিয়া সেই স্ত্রীলোকটিকে আপন হস্তগত করিলেন। এই সময় হইতে পূৰ্ব্ব-বর্ণিত স্ত্রীলোকটির উপর তাহার অনুগ্রহ ক্রমে কমিতে আরম্ভ হইল। এবং পরিশেষে তিনি তাহাকে পরিত্যাগ করিলেন, কিন্তু আমি তাহাকে সেই স্থান হইতে স্থানান্তরিত করিয়া, আপন ভার্য্যার ন্যায় প্রতিপালন করিতে লাগিলাম। ইতিপূর্ব্বে আমার বিবাহ হইয়াছিল না। সুতরাং তাহার উপরেই ক্রমে আমার ভালবাসা জন্মিতে লাগিল। তাহাকে আমি আমার বিবাহিতা স্ত্রীর ন্যায় দেখিতে লাগিলাম। আমার উপর তাহার ব্যবহারাদি দেখিয়াও আমার মনে মনে বিশ্বাস জন্মিল যে, সে আমাকে তাহার স্বামীর ন্যায় প্রকৃতই ভালবাসে। এইরূপে ক্রমে একবৎসর অতিবাহিত হইয়া গেল, কিন্তু তাহার পিতা এ পর্যন্ত তাহার কন্যার কোনরূপ সংবাদ প্রাপ্ত হইলেন না। সে ইচ্ছা করিয়া তাহার পিতাকে কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিল না। 

‘এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইতে না হইতেই উহার চরিত্রের উপর আমার কেমন একটু সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। ক্রমে জানিলাম, আমার সন্দেহ নিতান্ত অমূলক নহে। যেস্থানে আমি তাহাকে রাখিয়া দিয়াছিলাম, তাহার নিকটে একটি লোক বাস করিত, সে লোকটি আর কেহই নহে, যে বৃদ্ধ ইব্রাহিম ভাইকে তুমি অপমানিত করিয়া এই স্থান হইতে দূর করিয়া দিয়াছ, সেই ব্যক্তি তাঁহারই কনিষ্ঠ সহোদর ইয়াসিন। ক্রমে আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, সেই ইয়াসিনের সহিত ইদানীং সেই হতভাগিনী অবৈধ প্রণয়ে আবদ্ধ হইয়াছে। যাহার নিকট আমি আমার মন-প্রাণ অর্পণ করিয়াছিলাম, তাহাকে এইরূপ কার্য্য করিতে দেখিয়া, আমি আর কোনরূপেই আমার মনকে স্থির রাখিতে পারিলাম না। কোন্ সময় আমি উভয়কে একত্রে পাই, কেবলমাত্র তাহারই সুযোগ অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। একদিবস সন্ধ্যার সময় আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম, যাইবাই সময় আমি তাহাকে বলিয়া আসিলাম যে, কোন বিশেষ প্রয়োজন উপলক্ষে আমি আমার বন্ধুর সহিত স্থানান্তরে গমন করিতেছি, দুই তিনদিবস আমি আর আসিতে পারিব না।’ এই বলিয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম, ও আমার বন্ধুর বাটীতে আসিয়া সেই রাত্রি অতিবাহিত করিলাম, পরদিবসও আমি সেইস্থানে থাকিলাম, রাত্রিকালে আহারাদি করিয়া আমার বন্ধু শয়ন করিবার নিমিত্ত প্রস্থান করিলেন, আমিও একখানি অস্ত্র হস্তে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া যেস্থানে আমি সেই স্ত্রীলোকটিকে রাখিয়া দিয়াছিলাম, সেই স্থানে আগমন করিলাম, কিন্তু বাটীর ভিতর প্রবেশ না করিয়া বাহিরে চোরের ন্যায় অবস্থান পূর্ব্বক আমার মনে সন্দেহ মিটাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। ক্রমে রাত্রি অধিক হইয়া আসিল, দেখিলাম স্ত্রীলোকটি তাহার ঘর হইতে বহির্গত হইয়া বাটীর দরজার নিকট আসিয়া কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল। পরিশেষে ইয়াসিন আপনার বাটী হইতে বহির্গত হইয়া সেই স্থানে গমন করিলে, উভয়ে একত্রে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। এই অবস্থা দেখিয়া আমি আর কালবিলম্ব করিলাম না, আমিও তাহাদিগের অগোচরে তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। ঘরের ভিতর প্রবিষ্ট হইবামাত্রই ইয়াসিন আমার সম্মুখীন হইল, আমার হস্তস্থিত অস্ত্রদ্বারা তাহাকে সজোরে এমন এক আঘাত করিলাম যে, সেই আঘাতেই ইয়াসিন সেই স্থানে পতিত হইল। এই অবস্থা দেখিয়া স্ত্রীলোকটি ভয়ানক চীৎকার করিয়া উঠিল, সেই চীৎকারের সঙ্গে সঙ্গে তাহার অঙ্গেও অস্ত্রাঘাত করিয়া, তাহারও চীৎকার নিবৃত্ত করিলাম, সেও সেইস্থানে ইয়াসিনের নিকট পতিত হইল। যাহাতে উহারা আর বাঁচিয়া উঠিতে না পারে, এই ভাবিয়া তাহাদিগের উপর আরও কয়েকটি অস্ত্রাঘাত করিয়া আমি সেই ঘর হইতে বহির্গত হইলাম। বাহিরে আসিয়াই দেখি, বাটীর সম্মুখে পাড়ার অনেক লোক আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে, তাহারা আমাকে দেখিয়া ধরিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সেই অস্ত্রখানি আমার হস্তে ছিল বলিয়া, সহজে কেহ আমার নিকটে আসিতে সাহসী হইল না। কিন্তু পশ্চাৎ হইতে কে আসিয়া আমার হস্তে সজোরে এমন এক যষ্ঠী প্রহার করিল যে, আমার হস্তস্থিত অস্ত্রখানি সেই স্থানে পড়িয়া গেল, তখন কয়েকজন লোককর্তৃক সেই রক্তাক্ত কলেবরেই আমি সেই স্থানে ধৃত হইলাম। ক্রমে পুলিস আসিয়া উপস্থিত হইলে, আমি পুলিসের হস্তে অর্পিত হইলাম। 

“আমি যখন ধৃত হইয়াছিলাম, তখন শুনিয়াছিলাম যে, ইয়াসিন ও সেই স্ত্রীলোকটি উভয়েই জীবিত আছে, কিন্তু পুলিস সেই স্থানে উপস্থিত হইবার পরই শুনিতে পাইলাম যে, উভয়েই মরিয়া গিয়াছে। 

“দুই-দুইটি নরহত্যা করা অপরাধে, আমার উপর মোকদ্দমা রুজু হইল, সেই স্ত্রীলোকটির পিতা এতদিবস পর্য্যন্ত তাঁহার কন্যার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিয়াছিলেন না, এখন তাঁহার বোধ হইল, আমিই তাঁহার বাটীতে ডাকাইতি করিয়া তাঁহার কন্যাকে অপহরণ করিয়া আনিয়াছিলাম, এবং পরিশেষে আমিই তাহাকে স্বহস্তে হত্যা করিয়াছি। সুতরাং তিনি আমার বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইয়া সাধ্যমত এই মোকদ্দমার যোগাড় করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। এদিকে ইব্রাহিম ভাইর ভ্রাতা ইয়াসিনকে আমি স্বহস্তে হত্যা করিয়াছি। সুতরাং ইব্রাহিম প্রাণপণে তাহার ভ্রাতৃহন্তার প্রতিশোধ গ্রহণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। আমি খুনী মোকদ্দমার আসামী হইয়া বিচারার্থ প্রেরিত হইলাম। অনেকদিবস পর্য্যন্ত এই মোকদ্দমা চলিল। আমার পিতা তাঁহার যথাসর্বস্ব নষ্ট করিয়া আমাকে বাঁচাইবার নিমিত্ত প্রাণপণে চেষ্টা করিলেন। আমার সেই ধনশালী বন্ধুও আমার নিমিত্ত অনেক অর্থ ব্যয় করিলেন, কিন্তু ফলে কিছুই হইল না। হত্যাপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায়, আমার উপর চরম দণ্ডের আজ্ঞা প্রদত্ত হইল। যে সময় আমার বিচার শেষ হইয়া যায়, সেই সময় বিচারকারী জজসাহেবের কাছারী সদরে ছিল না। তিনি সেই সময় মফঃস্বল পরিদর্শন করিয়া বেড়াইতেছিলেন। সুতরাং আমার বিচারও সদরে না হইয়া মফঃস্বলেই হয়। বিচার শেষ হইযা যাইবার পর, মফঃস্বল হইতে সদরে আনীত হইবার কালীন, মফঃস্বলের একটি থানায় আমাকে রাত্রি অতিবাহিত করিতে হয়। হাতকড়ি সহিত থানার হাজত গৃহে আমাকে রাখা হয়, আমার উপর যে দুইজন প্রহরীর পাহারা ছিল, তাহারা হাজত গৃহের সম্মুখে পাহারায় নিযুক্ত থাকে, পাহারা দিবার সঙ্গে সঙ্গে যেমন রাত্রি অধিক হইল, অমনি প্রহরীদ্বয়ও ক্রমে সেই স্থানে নিদ্রিত হইয়া পড়িল, আমি হাজত গৃহের মধ্য হইতে সমস্তই দেখিতে লাগিলাম। যখন দেখিলাম, উভয়েই নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছে, সেই সময় বিশেষ জোর করিয়া আমার হস্ত হইতে হাতকড়ি খুলিয়া সেই হাজত গৃহের মধ্যেই রাখিয়া দিলাম। হাতকড়ি খুলিবার সময় আমার হস্তে যে কতদূর বেদনা লাগিল, তাহা আমি বলিতে পারি না, হাতের চামড়া স্থানে স্থানে উঠিয়া গেল, বোধ হইল কব্জার হাড়ও যেন ভিতর হইতে ভাঙ্গিয়া গেল। কিন্তু আমি তাহার দিকে কিছুমাত্র দৃকপাত না করিয়া হস্ত হইতে হাতকড়ি খুলিয়া ফেলিলাম। 

“হাতকড়ি খুলিয়া ফেলিয়া ভাবিতে লাগিলাম, কিরূপে আমি সেই হাজত গৃহ হইতে বহির্গত হইতে সমর্থ হই। হাজত গৃহের সমস্ত স্থান উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিলাম, কোন স্থান দিয়া বহির্গত হইবার কিছুমাত্র উপায় নাই। হাজত গৃহের কেবল একটি মাত্র দরজা, উহাতে কপাট নাই, লোহার রেল বসান, এবং সেই দরজার বাহিরেই প্রহরীদ্বয় নিদ্রা যাইতেছে। আমি রেলগুলি এক এক খানি করিয়া আস্তে আস্তে নাড়িয়া দেখিতে লাগিলাম। দেখিলাম, একখানি রেল একটু নড়িতেছে, অনুমান হইল, যে কাষ্ঠের সহিত সেই রেলখানি সংলগ্ন আছে, অনেক পুরাতন হওয়ায়, সেই কাষ্ঠখানি পচিয়া গিয়াছে। যে রেলখানি নড়িতেছিল, সেই রেলখানির গোড়া ধরিয়া আমি প্রাণপণে ভিতরের দিকে টানিলাম। রেল সংলগ্ন পুরাতন কাষ্ঠ আমার মৃত্যুকালীন জোর সহ্য করিতে পারিল না। যে কাষ্ঠের সহিত সেই রেলখানি বদ্ধ ছিল, তাহার একপ্রান্ত ভাঙ্গিয়া গেল। সুতরাং রেলখানি বাহির করিয়া লইবার উপায় হইল, সেইরূপ উপায়ে আমি রেলখানি আস্তে আস্তে বাহির করিয়া ফেলিলাম। রেলখানি স্থানান্তরিত হইলে দেখিলাম, আমি সেইস্থান দিয়া অনায়াসেই বহির্গত হইয়া যাইতে পারিব। অর কালবিলম্ব না করিয়া, আমি সেই স্থান দিয়া বহির্গত হইলাম। কিন্তু বহির্গত হইবামাত্রই একজন প্রহরীর হঠাৎ নিদ্রাভঙ্গ হইল। ‘আসামী পলাইল’ বলিয়া সে চীৎকার আরম্ভ করিল। আমি ছুটিলাম, সেও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিল। কিন্তু আমি তাহার দৃষ্টিপথের বহির্গত হইয়া পড়িলাম। যে ফাঁসি যাইতেছে, তাহার মৃত্যুর ভয় নাই। সুতরাং আমার মনে কোনরূপ ভয়ই ছিল না, বন জঙ্গল আমি দৃপাত করিলাম না, কেবল দৌড়িতে লাগিলাম। কোথায় যে যাইতেছি, তাহার স্থিরতা নাই, কেবলই চলিতে লাগিলাম। এইরূপে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। বলিতে পারি না, আমি সেই রাত্রিতে কত পথ অতিক্রম করিয়া আসিয়াছিলাম। রাত্রি প্রভাত হইবার সঙ্গে সঙ্গে আমি একটি জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিলাম, সেই জঙ্গলের মধ্যে সমস্ত দিবস অতিবাহিত করিয়া সন্ধ্যার পর পুনরায় বহির্গত হইলাম, এবং সমস্ত রাত্রি ক্রমান্বয়ে চলিতে লাগিলাম। এইরূপে দুই রাত্রি চলিয়া, আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, আমি এখন অনেক দূরে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। ইহার পর আর আমি জঙ্গলে আশ্রয় লইলাম না, একজন গৃহস্থের বাটীতে অতিথিরূপে উপস্থিত হইলাম, তিনি অতিথি সেবা করিলেন। কয়েকদিবস পরে আহার করিয়া আপনাকে একটু সুস্থ বোধ করিলাম, এবং কথায় কথায় তাহার নিকট হইতে আমি জানিতে পারিলাম যে, আমি যেস্থান হইতে পলায়ন করিয়াছি, সেই স্থান এই স্থান হইতে প্রায় চল্লিশ ক্রোশ দূরবর্তি। আহারান্তে আমি পুনরায় সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম, পুনরায় চলিতে লাগিলাম। এইরূপে সমস্ত দিবস চলিতাম, আহারের সময় উপস্থিত হইলে, একস্থানে অতিথি হইতাম, বা কোন স্থানে ধৰ্ম্মশালা দেখিতে পাইলে সেইস্থানে গমন করিতাম। যেস্থানে রাত্রি হইত, সেইস্থানে কাহারও বাটীতে বা কোন দোকানে অথবা অতিথিশালায় শয়ন করিয়া রাত্রি অতিবাহিত করিতাম। এইরূপে গমন করিবার সময়, আমি আমার বেশ পরিবর্তন করিয়া ফকিরি বেশ পরিধান করিলাম, ও গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করিতে করিতে ক্রমে কলিকাতা অভিমুখে আগমন করিতে লাগিলাম। এইরূপে অনুমান ছয়মাসকাল চলিয়া, ক্রমে আমি কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম, যে সময় আমি কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম, সেই সময় আমার হস্তে ভিক্ষালব্ধ প্ৰায় পঁচিশ টাকা জমিয়াছিল। 

“কলিকাতা আমার নিকট সম্পূর্ণরূপ অপরিচিত স্থান। কাহারও সহিত আলাপ-পরিচয় ছিল না। সুতরাং কোথায় গিয়া যে অবস্থান করিব, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে না পারিয়া, একদিবস রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। দেখিলাম, বোম্বাই প্রদেশীয় অনেক লোক এই স্থানে আছে, কিন্তু কাহারও নিকট গমন করিতে সাহসী হইলাম না, মনে ভয়—বোম্বাই প্রদেশীয় কোন লোকের নিকট গমন করিলে পাছে আমি ধৃত হই। 

“আমি ফকিরি বেশে রাস্তায় রাস্তায় দুই তিনদিবস অতিবাহিত করিয়া কলিকাতা সহরের অবস্থা কিয়ৎপরিমাণ অবগত হইলাম। জানিতে পারিলাম, সামান্য পল্লির মধ্যে চেষ্টা করিলে, অনায়াসেই কোন না কোন বাটীর ভিতর ঘর ভাড়া পাওয়া যাইতে পারে। 

“চতুর্থদিবসে আমি একটি মুসলমান বস্তির ভিতর প্রবেশ করিয়া একখানি ঘরের অনুসন্ধান করিলাম। পশ্চিমদেশবাসী জনৈক মুসলমানের একখানি খোলার বাটীর বাহিরস্থ একখানি ঘর খালি ছিল। মাসিক পাঁচসিকা ভাড়া সাব্যস্ত করিয়া সেই ঘরখানি আমি গ্রহণ করিয়া সেই স্থানেই আমার বাসস্থান স্থাপিত করিলাম। সেই ঘরে বাস করিবার কালীন আমি আমার ফকিরি বেশ পরিবর্ত্তন করিয়া পুনরায় অপর বেশ ধারণ করিলাম; কিন্তু আমি আমার দেশীয় পরিচ্ছদ আর পরিধান করিলাম না। এদেশীয় মুসলমানগণ যেরূপ পরিধেয় ব্যবহার করিয়া থাকেন, আমি সেইরূপ পরিচ্ছদ পরিধান পূর্ব্বক নানাস্থানে ভ্রমণ করিয়া সহরের নানাস্থান দেখিয়া বেড়াইতে লাগিলাম, এবং কোন্ কার্য্য অবলম্বন করিলে অনায়াসেই আপন জীবন যাপন করিতে সমর্থ হইতে পারিব, তাহার চেষ্টা দেখিতে লাগিলাম। আমি ভিক্ষালব্ধ যে পঁচিশ টাকা লইয়া সহরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলাম, তাহা ক্রমে খরচ হইয়া যাইতে লাগিল। সেই টাকা হইতেই আবশ্যক অনুযায়ী বস্ত্রাদি ও বিছানাপত্র খরিদ করিতে হইল, সেই অর্থ হইতেই আহারীয় সংগ্রহ করিয়া জীবন ধারণ করিতে হইল। এইরূপে ক্রমে আট দশদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, কিন্তু জীবন ধারণের নিমিত্ত কি উপায় যে আমি অবলম্বন করিব, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। “একদিবস প্রাতঃকালে আমি গঙ্গাতীরে বসিয়া আছি, ও মনে করিতেছি, জাহাজে কোন কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইতে হইলে, কি উপায় অবলম্বন করা যাইতে পারে। এরূপ সময়ে একজন বৃদ্ধ মুসলমানের সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল, তিনি আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি এখানে বসিয়া আছ কেন?’ উত্তরে আমি কহিলাম, ‘আমার এখন কোন কৰ্ম্ম-কাৰ্য্য নাই, সুতরাং এই স্থানে বসিয়া অন্নের চিন্তা করিতেছি।” 

“আমার কথা শুনিয়া তিনি কহিলেন, ‘তোমার এক্ষণে কোন কাৰ্য্য নাই, একদিবসের নিমিত্ত আমি তোমাকে একটি কার্য্য প্রদান করিতে পারি। তুমি আমার সহিত আগমন কর, একখানি জাহাজে আমার কতকগুলি কুলি কাৰ্য্য করিতেছে; কিন্তু আমার যে সরকার কুলিদিগের কার্য্যের পর্যবেক্ষণ করিয়া থাকেন, তিনি অদ্য আসেন নাই, তুমি যদি অদ্য তাঁহার কার্য্য সম্পন্ন করিতে পার, তাহা হইলে একদিবসের নিমিত্ত আমি তোমাকে সেই কার্য্যে নিযুক্ত করিতে পারি।’ 

“বৃদ্ধের প্রস্তাবে আমি সম্মত হইয়া, তাঁহার সহিত একখানি জাহাজে গমন করিলাম। দেখিলাম, সেই জাহাজে তাঁহার প্রায় একশত কুলি কার্য্য করিতেছে। তিনি উহাদিগের কার্য্যের পরিদর্শনভার আমার উপর প্রদান করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন, যাইবার সময় বলিয়া দিলেন, তোমাদিগের ছুটী হইবার পূর্ব্বেই আমি আগমন করিব। 

“তিনি ঠিক সময়মত আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। আমার কার্য্য দেখিয়া তিনি বিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন। অপরাপর দিবস সেই সকল লোকদ্বারা যে কাৰ্য্য হইয়া থাকে, সেইদিবস তাহার প্রায় দেড়গুণ কাৰ্য্য হইয়াছিল। কাৰ্য্য শেষ হইয়া গেলে, সকলের পারিশ্রমিক মিটাইয়া দিয়া, তিনি বিদায় করিয়া দিলেন। আমাকে এক টাকা প্রদান করিলেন, এবং সেইদিবস হইতে মাসিক কুড়ি টাকা বেতনে তিনি আমাকে তাঁহার কার্য্যে নিযুক্ত করিলেন। আমি বিশেষ যত্নে তাঁহার কার্য্য করিতে লাগিলাম, তিনি আমার কার্য্য দেখিয়া, আমার উপর দিন দিনই সন্তুষ্ট হইতে লাগিলেন। এইরূপে আমি তাঁহার নিকট প্রায় পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত করিলাম, শেষ এক বৎসর আমি মাসিক পঞ্চাশ টাকা হিসাবে বেতন প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। পাঁচ বৎসর পরে তাঁহার মৃত্যু হইল, সেই সঙ্গে তাঁহারও কার্য্য বন্ধ হইয়া গেল। এই সময় আমার হস্তে কিছু টাকা জমিয়া গিয়াছিল, সেই টাকা দিয়া, আমি একখানি বোট খরিদ করিয়া তাহার ভাড়া খাটাইতে লাগিলাম, উহাতে বেশ লাভ হইতে আরম্ভ হইল। ক্রমে একখানি বোটের পরিবর্তে দশখানি বোট হইল, দিন দিন আমার কার্য্যের উন্নতি হইতে লাগিল। বোটের কারবার ব্যতীত আমি ক্রমে অপরাপর কার্য্য আরম্ভ করিয়া, ক্রমে একজন মহাজনের মধ্যে পরিগণিত হইতে লাগিলাম। খোলার ঘরে বাস উঠিয়া গেল, বড় গোছের একটি বাড়ী ভাড়া করিয়া তাহাতে নিজের আফিস করিলাম। সেই সময় আমি বিবাহ করিয়াছিলাম, আমার অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তুমিও জন্মগ্রহণ করিলে, নিজের বাড়ী-ঘর হইতে লাগিল, অর্থ যথেষ্ট উপার্জ্জন হইতে লাগিল, এক কথায় ক্রমে আমি এই মহানগরীর একজন প্রধান ধনশালী ব্যবসাদাররূপে পরিগণিত হইলাম। আমি কলিকাতায় আসিয়া আমার প্রকৃত নাম ও বাসস্থান গোপন করিয়াছিলাম। সুতরাং আমি যে একজন ফাঁসির আসামী, তাহা কেহই জানিত না। কলিকাতায় আসিবার পর আমি আমার পিতামাতাকে কেবলমাত্র একখানি পত্র লিখিয়াছিলাম, তাহাতে ইহা লেখিছিল যে, ‘আমি মরি নাই’, পলায়ন করিয়া জীবন বাঁচাইয়াছি, কিন্তু আপনাদিগের সহিত কখনও দেখা বা গ্রামে গমন করিব না। তবে সময় সময় আপনাদিগকে সাহায্য করিব, কিন্তু পত্রাদি আর লিখিব না।’ সেই সময় হইতে যতদিবস পিতামাতা বাঁচিয়াছিলেন, বৎসরে একবার করিয়া ডাকযোগে আমি কিছু কিছু টাকা পাঠাইয়া দিতাম, কিন্তু কলিকাতা হইতে সেই টাকা কখনও পাঠাইতাম না, টাকা পাঠাইবার সময় হইলে আমি কখনও মান্দ্রাজে কখনও রেঙ্গুনে, কখনও বা দূরবর্তী অপর আর কোনস্থানে গমন করিতাম ও সেইস্থান হইতে এরূপ পরিমাণে অর্থ তাঁহাদিগকে পাঠাইয়া দিতাম, যে এক বৎসরের মধ্যে তাহাদিগের কিছুমাত্র কষ্ট হইত না। 

“এতদিবস পর্য্যন্ত আমি এইরূপ ভাবে কাটাইয়া আসিয়াছি, আমার কথা কেহ জানিতে পারে নাই; কিন্তু জানি না, এতদিবস পরে ইব্রাহিম ভাই কিরূপে আমার সন্ধান পাইয়া আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। আমার মৃত্যুবাণ তাহার হস্তে ছিল বলিয়াই, আমি তাহার এতদূর অত্যাচার সহ্য করিতাম। কারণ, সে যদি আমার কথা প্রকাশ করিয়া দেয়, তাহা হইলে একে দারুণ অবমাননা, তাহার উপর মৃত্যু নিশ্চয়। তোমার নিকট অপমানিত হইয়া এখন সে বোম্বাই সহরে গমন করিয়াছে, সেইস্থানের পুলিসের নিকট আমার সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়া দিয়া, আমাকে পত্র লিখিয়াছে, এখন শীঘ্রই সেইস্থান হইতে পুলিস আগমন করিয়া আমাকে লইয়া যাইবে, এবং আমাকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলাইয়া দিবে। 

“পুত্র! এই আমার পরিচয় ও অবস্থা, পুলিস যেমন আগমন করিবে, আমি কাহাকেও কিছু না বলিয়া, এই স্থান হইতে প্রস্থান করিব। কারণ, এই স্থানে কোনরূপ গোলযোগে উপস্থিত হইলে এখন তোমার যেরূপ মানসম্ভ্রম হইতেছে, তাহা নষ্ট হইয়া যাইবে। আমার নিমিত্ত তুমি দুঃখিত হইওনা, সংসারের যাহা প্রয়োজনীয় তাহার সমস্তই আমি করিয়াছি, এখন আমার মৃত্যুর সময় উপস্থিত; সুতরাং হাসিতে হাসিতে আমি চলিলাম।” 

পত্রপাঠ শেষ হইলে আমরা সকলেই বিস্মৃত হইলাম, জানিতে পারিলাম, বৃদ্ধের বাল্যজীবনী কি ভয়ানক! এই ঘটনার প্রায় পনরদিবস পরে বোম্বাই সহর হইতে কয়েকজন পুলিস আসিয়া উপস্থিত হন, তাহাদিগের সঙ্গে ছিলেন ইব্রাহিম ভাই। এখানে আসিয়া তাঁহারা জানিতে পারিলেন, বৃদ্ধ আর ইহজগতে নাই, সুতরাং তাঁহারা খুন্ন অন্তঃকরণে এই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। 

[কার্তিক, ১৩০৬] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *