গুপ্ত রহস্য

গুপ্ত রহস্য

কখন যে পাঠান ড্রাইভার এসে দাঁড়িয়েছে একটুও বুঝতে পারেননি মিঃ আহাদ, তিনি প্রথমে হতভম্ব হলেন কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বললেন তোমার অসুখ সেরে গেছে?

হাঁ বাবুজী! আপ কাঁহি যায়েঙ্গে?

হা চলো।

চলিয়ে বাবুজী।

মিঃ আহাদ বেরিয়ে আসতেই পাঠান ড্রাইভার তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে এলো, গাড়ির পিছন আসনের দরজা খুলে ধরলো সে।

গাড়িতে উঠে বসলেন মিঃ আহাদ, স্থিরকণ্ঠে বললেন–গ্রীন-হাউস নাইট ক্লাবে চলো।

বহুৎ আচ্ছা বাবুজী।

গাড়িতে স্টার্ট দিলো পাঠান ড্রাইভার।

ঢাকার রাজপথ বেয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। মিঃ আহাদ পিছন আসনে ঠেশ দিয়ে বসে আছেন, ললাটে তাঁর চিন্তারেখা ফুটে উঠেছে। সিগারেট পান করছেন তিনি।

হঠাৎ একসময় বলে উঠে পাঠান ড্রাইভার–বাবুজী, ওহি ক্লাব তো আচ্ছি নেহি!

 কেন? সোজা হয়ে বসলেন মিঃ আহাদ।

বহুৎ খারাব কাম হোতা হয়……

 তুমি কেমন করে জানলে?

পাঠান ড্রাইভার ভাঙা ভাঙা বাংলা বলার চেষ্টা করলোহামি একবার ওহি ক্লাব মে। দারওয়ান থা।

দারওয়ান ছিলে তুমি?

হাঁ বাবুজী। একটু নীরব রইলো ড্রাইভার তারপর বললো–বাবুজী, আভি এক বাৎ হাম আপকো কহেগা।

বলো কি বলতে চাও? বললেন মিঃ আহাদ।

পাঠান ড্রাইভার সম্মুখে দৃষ্টি রেখে গাড়ি চালাচ্ছিলো, বললো–আপকো পুলিশ অফিসমে একবার যানে হোগা।

 বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন মিঃ আহাদ–পুলিশ অফিস?

হাঁ বাবুজী! হাম এক জরুরি বাত আপকো শুনায়েঙ্গে, যো বাত শুনকে আপকা আঁখে খুল যায়েগী বাবুজী। বহুৎ জরুরি বাত………

 বলো কি বলতে চাও তুমি?

আভি সব বাত নেহি খোলাসা কাহুংগা বাবুজী, সব বাত আপ আঁখে সে দেখলিযেগা। আভি আপ পুলিশ ফোর্স লেকর হামারা সাত গ্রীন হাউস নাইট ক্লাব মে চলিয়ে।

ব্যাপার কি বলবে তো?

আভি নেহি, সবকুছ আপ সামঝেঙ্গে।

 মিঃ আহাদ অভিজ্ঞ গোয়েন্দা, তিনি প্রথম থেকেই ব্যাপারখানা রহস্যময় বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি পাঠান ড্রাইভারের কথামতই কাজ করলেন। বললেন মিঃ আহাদ–চলো, পুলিশ অফিসেই চলো।

পুলিশ অফিসে পৌঁছে মিঃ আহাদ ইন্সপেক্টর মিঃ হাফিজকে কিছুসংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ ফোর্স নিয়ে সঙ্গে যাবার জন্য অনুরোধ জানালেন।

 মিঃ হাফিজ কিছু বুঝতে না পারলেও তিনি এটা বুঝলেন যে, বিশেষ কোনো প্রয়োজন ঘটেছে, যার জন্য সশস্ত্র পুলিশ ফোর্সের দরকার। ইন্সপেক্টর মিঃ আহাদের কথামত কাজ করলেন।

ইন্সপেক্টর হাফিজ এবং প্রায় বিশ-পঁচিশজন সশস্ত্র পুলিশ ফোর্স নিয়ে রওয়ানা দিলেন গ্রীন হাউস নাইট ক্লাবের দিকে।

 মিঃ আহাদ হাতঘড়ি দেখে নিলেন, রাত সাড়ে দশটার বেশি হয়ে গেছে। মিঃ আহাদের গাড়িতে বসেছেন মিঃ হাফিজ এবং দু’জন ওসি।

পিছনের গাড়িখানা পুলিশ ভ্যান। প্রত্যেকটা পুলিশ সতর্ক এবং সজাগভাবে গুলীভরা রাইফেল হস্তে দন্ডায়মান রয়েছে।

পাঠান ড্রাইভার স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছে, তারই পরিচালনায় আজ মিঃ আহাদ, মিঃ হাফিজ এবং পুলিশ বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে।

মিঃ আহাদ জীবনে বহু দস্যু-ডাকু এবং ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ লোককে গ্রেফতার করেছেন, কিন্তু আজকের মত অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয় না। অত্যন্ত উদগ্রীবভাবে বসে আছেন তিনি। পিছন আসনে ঠেশ দিয়ে। গাড়িতে বসেই তিনি একবার প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে রিভলভারখানার অস্তিত্ব অনুভব করে নিয়েছিলেন। পাঠান ড্রাইভারের কোনো কু’ অভিসন্ধি থাকলে তিনি তাকে ক্ষমা করবেন না–এটাও নির্ভুল।

মিঃ আহাদ আপন মনে সিগারেট পান করছিলেন বটে কিন্তু তার লক্ষ্য ছিলো সর্বদা ড্রাইভারের হস্তদ্বয়ের উপরে–কোনোরকম শয়তানি নিয়ে ড্রাইভার তাদের যদি বিপদে ফেলতে চেষ্টা করে তাহলে প্রথমে ওর হাত দু’খানাই জখম হবে।

গাড়িতে বসে কারো মুখে কোনো কথা ছিলো না। বিশেষ করে মিঃ আহাদ নিশ্চুপ ছিলেন বলেই মিঃ হাফিজ এবং ওসিদ্বয়ও নীরব ছিলেন।

মিঃ আহাদের ষ্টুডি কমান্ডার গাড়িখানা হাওয়ার বেগে ছুটছে। পথে জনগণ এবং যানবাহন এগিয়ে দক্ষহস্তে গাড়ি চালাচ্ছিলো পাঠান ড্রাইভার।

 গাড়ির মধ্যে প্রত্যেকেই কিছু একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপারের জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। সেটা যে। কি তা কেউ সম্পূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারছিলেন না। মিঃ আহাদের ভূকুঞ্চিত হয়ে আসছিলো, মাঝে মাঝে মুখমন্ডল অত্যন্ত গম্ভীর মনে হচ্ছিলো!

 বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি ছোটার পর গ্রীন হাউস নাইট ক্লাবের সবুজ আলোকরশ্মির কিঞ্চিৎ দৃষ্টিগোচর হলো। এবার পাঠান ড্রাইভারের হাতে ডি কমান্ডারের গতিবেগ মন্থর হয়ে এলো। পাঠান ড্রাইভার গাড়ির মুখ গ্রীন হাউসের পিছন দিকে মোড় ফিরিয়ে একটা ছোট গলির মধ্যে প্রবেশ করলো।

গলিটা সম্পূর্ণ নির্জন বলেই মনে হলো। কতকগুলো চুন-বালি খসা পুরোন বাড়ি। রাস্তায় ডাষ্টবিনের দুর্গন্ধ আসছে। সম্মুখ গাড়িখানা থেমে পড়তেই পিছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো পুলিশ ভ্যানখানা।

দিনের বেলা হলে চারপাশে লোকজন উদ্বিগ্ন হয়ে কানাঘুষা শুরু করতো–ব্যাপার কি, এখানে পুলিশ ভ্যান কেন? রাত দশটার পর এ গলিতে লোকজন বড় একটা দেখা যায় না, তবে যারা এ গলিতে বাস করে অথচ কাজ করে শহরের কোনো কল-কারখানায় কিংবা কোনো দোকানে, তারাই শুধু এতো রাতে এ গলিপথে আনাগোনা করে থাকে।

আজ রবিবার, তাই গলিটা একেবারে সম্পূর্ণ নীরব। কারণ কল-কারখানা সব বন্ধ, কুলী মজুর বা মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী–তারাও আজ ছুটি পেয়ে সকাল সকাল নিদ্রাদেবীর কোলে ঢলে পড়েছে, ভোর পর্যন্তই যা আরাম করবে, তারপর আবার শুরু হবে কাজ।

কোনো কোনো জীর্ণ অট্টালিকার অভ্যন্তর থেকে ভেসে আসছে ছোট্ট শিশুর তীব্র কান্নার আওয়াজ। হয়তো ক্ষুধার্ত শিশু নিদ্রিত মায়ের বুকে খাদ্যের অন্বেষণ করছিলো, জননী বিরক্ত হয়ে বসিয়ে দিয়েছে দু’ঘা। কলরব করে কেঁদে উঠে শিশুটা, পরক্ষণেই আবার থেমে যায়, হয়তো জননী আদর করে টেনে নিয়েছে কোলের মধ্যে, শুকনো স্তনটা ক্ষুধার্ত সন্তানের মুখে গুঁজে দিয়ে বৃথা চেষ্টা করছে তাকে চুপ করাবার।

 দু’ধারে বিরাট উঁচু দেয়াল, মাঝখানে খানটুকুর আকাশ দেখা যায়। এসব বাড়ির বাসিন্দারা বদ্ধ দেয়ালের নাগপাশে যখন অতিষ্ট হয়ে উঠে তখন হয়তো এসে দাঁড়ায় এই পথটুকুর মধ্যে। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে চায়, মুক্তির আস্বাদ গ্রহণ করতে চায় অন্তর দিয়ে।

ডাষ্টবিনের দুর্গন্ধে নাড়ী যেন বেরিয়ে আসতে চায়। মাছের আঁশ আর মুরগীর পঁচা নাড়ীভুড়ির ভ্যাপসা গন্ধ একেবারে যেন অসহনীয়।

পাঠান ড্রাইভারের পরিচালনায় নেমে পড়লেন মিঃ আহাদ, মিঃ হাফিজ, ওসিদ্বয় এবং পুলিশ বাহিনী।

ড্রাইভার বললো চাপা কণ্ঠে বাবুজী, আপলোগ মেরা সাথ আইয়ে। আওর পুলিশ লোক চুপি চুপি নাইট ক্লাব কি চার পাশমে ছুপা রহেগা। বহুৎ হুসিয়ারিসে কাম করনে হোগি বাবুজী। পুলিশ তোক এক সাথে কাভি নেহি যায়েগা। সব লোক আলাদা আলাদা ভিন ভিন রহেগা। যব হুইসেল কি আওয়াজ হোগি তব পুলিশ ফোর্স নাইট ক্লাব কি অন্দর যায়েগা। যাও পুলিশ ভাই, তুমলোগ নিজ নিজ কাম করো। আইয়ে বাবুজী, আপলোগ মেরা সাথ আইয়ে। দেখিয়ে বহুৎ হুশিয়ার…….

মিঃ আহাদ, মিঃ হাফিজ এবং ওসিদ্বয় অনুসরণ করলেন পাঠান ড্রাইভারকে।

পুলিশগণ ততক্ষণে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, সবাই চলে গেছে তাদের গন্তব্য স্থানের দিকে।

একটা নিকষ্ট গলির মধ্যে দিয়ে পাঠান ড্রাইভার মিঃ আহাদ এবং তাঁর সঙ্গীদ্বয়কে নিয়ে। এগিয়ে চললো। এ গলিটা বিভিন্ন বাড়ির পিছনের আবর্জনাপূর্ণ সঙ্কীর্ণ পথ। অতি কষ্টে তাঁরা অগ্রসর হচ্ছিলেন।

শহরের এদোগলি পথ এতো জঘন্য নোংরা কল্পনা করা যায় না, পথের মধ্যে স্থূপাকার আবর্জনা আর ময়লা। বিশ্রী গন্ধে যদিও বমি বমি ভাব লাগছিলো তবু নীরব ছিলো সবাই। কারণ একে গভীর রাত, তারপর এই নোংরা পথে ভদ্রলোকদের দেখলে ব্যাপার সন্দেহজনক না হয়ে যাবে না।

বেশ কিছুক্ষণ আঁকাবাঁকাভাবে চলার পর হঠাৎ তাদের কানে ভেসে এলো অর্কেষ্ট্রার সুমিষ্ট আওয়াজ। তাহলে তারা কি ঠিক গ্রীন হাউসের সীমানার অদূরে এসে পড়েছেন।

 এখনও তেমন কোন আলোকরশ্মি দৃষ্টিগোচর হয়নি। এসব গলি-পথ একেবারে অন্ধকার! কোনোরকম আলোর ব্যবস্থা এখনও হয়নি এসব পথে। তবে মাঝে মাঝে সেকেলে পুরোন। লণ্ঠনযুক্ত লাইট পোষ্টের কঙ্কালখানা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অকেজো বস্তু হয়ে।

মিঃ আহাদ এবং মিঃ হাফিজ ক্ষুদে টর্চ দিয়ে চলার পথ সহজ করে নিচ্ছিলেন।

আর কিছুটা এগুলেই অর্কেষ্ট্রার সুর স্পষ্ট শোনা যেতে লাগলো। দু’পাশের উঁচু প্রাচীরের ফাঁকে সবুজ আলোর ছটাও নজরে পড়লো তাদের। বিরাট একটা দেয়ালের পাশে এসে থেমে পড়লো পাঠান ড্রাইভার।

মিঃ আহাদ, মিঃ হাফিজ এবং ওসিদ্বয়ও দাঁড়িয়ে পড়লেন। সবাই একবার নিজ নিজ পকেটে হাত রেখে আগ্নেয় অস্ত্রের অস্তিত্ব অনুভব করে নিলেন। তারা লক্ষ্য করলেন এবং ভালভাবে বুঝতে পারলেন, নাইট ক্লাবের পিছনে এখন তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন।

পাঠান ড্রাইভার মিঃ আহাদের হাত থেকে ক্ষুদে টর্চটা নিয়ে বিরাট উঁচু দেয়ালটার নিচে আলো ফেলে পাশ কেটে এগুতে লাগলো।

একটা ছোট্ট দরজার মত জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়লো ড্রাইভার। দেয়ালে চাপ দিতেই দরজা খুলে গেলো, স্পষ্ট দেখা গেলো কয়েকটা সরু সিঁড়ির ধাপ।

ড্রাইভার বললো–আপনোক আইয়ে বাবুজী।

মিঃ আহাদ ভড়কে না গেলেও মিঃ হাফিজ এবং অফিসারদ্বয় ঘাবড়ে গেলেন ভিতরে ভিতরে। মিঃ আহাদ নীরবে অনুসরণ করছেন বলে তাঁরাও কোনোরকম উক্তি উচ্চারণ করলেন না।

সিঁড়ির ধাপগুলো ধূলোবালি আর নোংরা জিনিসে ভরা। কতদিন যেন এ সিঁড়ির ধাপে মানুষের পা পড়েনি। সিঁড়ির ধাপগুলো অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ এবং খাড়া, জমাট অন্ধকারও বটে।

ক্লাব-কক্ষ হতে নানারকম বাজনার চাপা সুর শোনা যাচ্ছিলো, তবে স্পষ্ট নয়।

সিঁড়ির ধাপে পাশাপাশি চলবার উপায় নেই।

পাঠান ড্রাইভার ও মিঃ আহাদ চলেছেন আগে, পরে মিঃ হাফিজ, তার পরে ওসিদ্বয় আগাপাছা করে এগুচ্ছে। দুর্গম পথের মতই সিঁড়িটা ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিলো। পাঠান ড্রাইভার অত্যন্ত সর্তকতার সঙ্গে মাঝে মাঝে পেনসিল টর্চটা জ্বেলে সিঁড়ির ধাপগুলো দেখে নিচ্ছিলো।

ড্রাইভারের মুখেও কোনো কথা নেই, ইংগিতে সে পিছনের সবাইকে উঠে আসার জন্য নির্দেশ দিচ্ছিলো।

সিঁড়িখানা কিছুদূর এগুনোর পর বামদিকে মোড় ফিরেছে–এখন আরও জমাট অন্ধকার মনে হচ্ছিলো, সিঁড়ির নিচে একটা ঘড়ঘড় শব্দ শোনা যাচ্ছে। কোনো যন্ত্র বা মেশিনের আওয়াজ হবে। আরও এক রকম খট খট শব্দ বেশ থেমে থেমে শোনা যাচ্ছিলো। মিঃ হাফিজ চাপা স্বরে বললেনক্লাব-কক্ষে মেশিনের আওয়াজ-ব্যাপার কি?

পাঠান ড্রাইভার ঠোঁটে আংগুল-চাপা দিয়ে চুপ থাকার জন্য ইংগিত করলো।

সিঁড়িটা সোজা বাম দিকে কিছুটা এগিয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে, পাঠান ড্রাইভার বলোবাবুজী বহুৎ হুশিয়ার……

 মিঃ আহাদ, মিঃ হাফিজ এবং ওসিদ্বয় সর্তক ছিলেনই, আরও ভালভাবে লক্ষ্য রেখে এগুতে লাগলেন। সিঁড়ির ধাপগুলো সঙ্কীর্ণ এবং নোংরা হওয়ায় চলতে তাদের খুব কষ্ট হচ্ছিলো। অত্যন্ত গরম বোধ করছিলেন তারা।

 মিঃ হাফিজ, মিঃ আহাদের কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন–ড্রাইভারের কোনো কুমতলব নেই তো?

দেখতে দিন কি ঘটে।

সিঁড়ির ধাপগুলো নিচে এসে একটা অন্ধকার সমতল জায়গায় শেষ হয়ে গেছে। জায়গাটা কোনো কক্ষ বা কুঠরী হবে।

এ জায়গাটা এতো বেশি অন্ধকার যে, নিজের হাতখানাও দৃষ্টিগোচর হয় না। এ-ওর গায়ে ধাক্কা লেগে যাচ্ছিলো বারবার। সবচেয়ে আশ্চর্য হলেন তারা–ওদিকের অন্ধকারে দুটো চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

ভালভাবে লক্ষ্য করতেই সন্দেহ দূর হলো, দেয়ালের গায়ে যে দুটো চোখ জ্বলছে আসলে তা চোখ নয়, দুটো ছিদ্রপথ। ছিদ্রপথ দু’টি দিয়ে ওপাশের তীব্র আলোকরশ্মি দেখা যাচ্ছিলো।

পাঠান ড্রাইভার মিঃ আহাদ, মিঃ হাফিজকে ইংগিত করলো ঐ ছিদ্রপথে দৃষ্টি রাখতে। যে ঘড়ঘড় শব্দটা তাঁরা সিঁড়িপথে শুনতে পাচ্ছিলো এখন সে শব্দ আরও কিছুটা স্পষ্ট বলে মনে হচ্ছিলো।

শব্দটা অত্যন্ত চাপা এবং অল্প, অতি নিকটে না এলে শোনা যায় না–সিঁড়ির ধাপ থেকেও তেমনি মৃদুভাবে তারা শুনেছিলেন। কেমন মেশিনের শব্দ এটা সহজে বুঝা মুস্কিল।

মিঃ আহাদ আর মিঃ হাফিজ পাঠান ড্রাইভারের ইংগিতে ঐ ছিদ্রপথে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। ছিদ্রপথে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই বিস্ময়ে চমকে উঠলেন তাঁরা। উভয়ে একসঙ্গে দেখলেন–ওপাশে একটা মাঝারি ধরনের কক্ষ, কক্ষমধ্যে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। কক্ষের চারপাশে কতকগুলো। যন্ত্রপাতি আর অদ্ভুত ধরনের কয়েকটা মেশিন। মাঝখানে একটা বড় জমকালো পাথরে তৈরি টেবিল। টেবিলের পাশে বসে আছে একটা আলখেল্লা পরা মানুষ। সমস্ত শরীর তার জমকালো পোশাকে ঢাকা, এমনকি মাথাটাও ঢাকা পড়েছে আলখেল্লার নিচে। চোখের কাছে দুটো ফুটো, ফুটো দুটো যেন কেমন অদ্ভুত ধরনের।

মিঃ হাফিজ মিঃ আহাদের গায়ে হাত দিয়ে চাপ দিলেন।

 মিঃ আহাদ তাঁকে নিঃশব্দে দেখতে বলে নিজেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে দেখতে লাগলেন।

দেয়ালের পাশের মেশিন আর যন্ত্রগুলো অদ্ভুত ধরনের। এমন মেশিন এবং যন্ত্রপাতি তারা কোনোদিনই দেখেননি। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে দেখছেন মিঃ আহাদ আর মিঃ হাফিজ। দেয়ালের ধারে দক্ষিণ পাশের একটা মেশিনের নিচে একটা লোক শুয়ে আছে, মেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে দু’জন এ্যাপ্রন-পরা লোক-হাতে গ্লস, মুখে মাক্স–কি যেন করছে তারা। একি, শায়িত লোকটা রামসিং বলে মনে হচ্ছে! এ্যাপ্রন-পরা লোক দু’জন রামসিং-এর মুখের মধ্যে একটা রাবারের পাইপ মেশিনের দ্বারা প্রবেশ করিয়ে দিলো। তারপর মেশিনের একটা মুখের মত ফাঁকে কি যেন ঢেলে দিচ্ছে লোক দু’জন। এক ইঞ্চি লম্বা আর আধা ইঞ্চি চওড়া চকচকে জিনিসগুলো। মিঃ .. আহাদ চাপা স্বরে বললেন–সোনা চালান করা হচ্ছে।

মিঃ হাফিজ অস্ফুট শব্দ করলেন–সোনা?

 হাঁ, চুপ করে দেখুন।

পাঠান ড্রাইভার অত্যন্ত চাপাস্বরে বললো-বাত মত কহিয়ে বাবুজী।

মিঃ আহাদ ও মিঃ হাফিজ সজাগ হলেন, তারা বুঝতে পারলেন–পাঠান ড্রাইভার তাদের পিছনেই রয়েছে। মিঃ হাফিজের মনে অনেকটা বিশ্বাস এসেছে এখন, পাঠান ড্রাইভার তাহলে তাদের কুমতলব নিয়ে আসেনি! গভীর কোনো রহস্য উদঘাটনেই সে তাদের সাহায্য করে চলেছে।

রামসিং এবার উঠে দাঁড়ালো।

দ্বিতীয় এক ব্যক্তিকে পুনরায় মেশিনের নিচে রামসিং-এর মত করে শুইয়ে দেওয়া হলো। এ লোকটা রামসিং-এর মত মোটা নয় তবে বেশ লম্বা এবং বলিষ্ঠ। লোকটার মুখেও মেশিন দ্বারা রবারের পাইপ প্রবেশ করানো হলো, তারপর কয়েক মিনিট ধরে কতকগুলো সোনার টুকরা স্তরে। স্তরে সাজানো হলো লোকটার পেটের মধ্যে।

এবার মিঃ আহাদ এবং মিঃ হাফিজের দৃষ্টি পড়লো পাশের একটা মেশিনের দিকে, চমকে উঠলেন উভয়ে–দেওজী মেশিনটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, কখন যে আলখেল্লাধারী গিয়ে দাঁড়িয়েছে দেওজীর পাশে তারা খেয়াল করেনি। সে এক বিস্ময়কর দৃশ্য–সেই মেশিনটার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়েছে রামসিং, দেওজীর প্রধান কর্মচারী সে। মিঃ আহাদ আর মিঃ হাফিজ তাকে দেওজীর ওখানেই দেখেছিলেন।

 লোকটাকে সেই অদ্ভুত মেশিনের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিতেই মেশিনটা তাকে টেনে নিলো ভিতরে।

 মিঃ আহাদ আর মিঃ হাফিজ চমকে উঠলেন, রামসিংকে হত্যা করা হবে নাকি? কিন্তু পরক্ষণেই তারা আশ্বস্ত হলেন, মেশিনের মধ্যে রামসিং স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আলখেল্লাধারী মেশিনের কোনো একটা সুইচে হাত রাখলো, সঙ্গে সঙ্গে নীলাভ এক আলোকরশ্মি রামসিং-এর দেহ ভেদ করে বেরিয়ে এলো।

দেওজী আর আলখেল্লাধারী চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ, তারপর পুনরায় আলখেল্লাধারী সুইচ টিপে আলোটা নিভিয়ে দিলো।

এতো তীব্র আর গভীর আলোকরশ্মি যে, মিঃ আহাদ এবং মিঃ হাফিজের চোখে যেন ধাঁধা লেগে দিয়েছিলো। তাঁরা কিছুক্ষণের জন্য ছিদ্রপথ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

 দ্বিতীয় ব্যক্তিটার উদরে তখন পাইপ প্রবেশ করানো হয়েছে। কয়েক মিনিট পর তাকেও দ্বিতীয় মেশিনের আলোকরশ্মি দ্বারা পরীক্ষা করে দেখা হলো সোনার স্তরগুলো পেটের মধ্যে ঠিকভাবে বসানো হয়েছে কিনা।

এবার দেওজী আর আলখেল্লাধারী টেবিলের পাশে চেয়ারে এসে বসলো। মাঝে মাঝে অত্যন্ত সতর্কভাবে কান পেতেও স্পষ্ট কিছু শুনতে পাচ্ছিলেন না।

পূর্বদিকে একটা মেশিন চলছিলো, তারই শব্দ হচ্ছিলো ঘড় ঘড় করে। মেশিনটা ঠিক আঁখমাড়া মেশিনের মত কিন্তু আকারে অনেক বড়। সেই মেশিনটার পাশেও দু’জন এ্যাপ্রন-পরা লোক কাজ করছে, তবে তাদের মুখে মাক্স বা হাতে গ্লাভ নেই। কি যেন তৈরি হচ্ছে বলে মনে হলো সেখানে। মিঃ আহাদ বললেন–সোনার টুকরোগুলোকে চৌকা বানানো হচ্ছে এবং মসৃণ করা হচ্ছে। কারণ এগুলো লোকের পেটের মধ্য দিয়ে বিদেশে চালান হবে।

আরও কয়েকটা মেশিন চালু অবস্থায় রয়েছে, এসব মেশিনে কি কাজ হচ্ছে, বুঝতে পারলেন না তারা। তবে বুঝতে পারলেন, এতোক্ষণ সঙ্কীর্ণ সিঁড়ির উপরে চলতে চলতে যে শব্দ তারা শুনতে পেয়েছেন সে শব্দ এইসব যন্ত্রদানবের কর্কশ আর্তনাদ।

মিঃ আহাদ আর মিঃ হাফিজ যখন এসব দেখছেন, পাশে দাঁড়িয়ে ওসিদ্বয় আর পাঠান ড্রাইভার অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে প্রতীক্ষা করছে। হঠাৎ শোনা যায় অন্ধকার সঙ্কীর্ণ সিঁড়িপথে জুতোর শব্দ।

আঁতকে উঠলেন তাঁরা।

অন্ধকারেও প্রত্যেকে প্রত্যেকের মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।

পাঠান ড্রাইভার অত্যন্ত নিম্নস্বরে বললো–বাবুজী, কোই আদমী ইধার আতা হায়।

মিঃ হাফিজ বললেন–এখন উপায়?

পাঠান ড্রাইভার বললো–আপনোক আন্ধা কুঠিমে চুপচাপ রহেঙ্গে। জো আদমী আতা হাম উছিকো সাথ সামঝায়েঙ্গে। কথাটা বলে সে অন্ধকারে সিঁড়ির মুখে একপাশে আত্নগোপন করে দাঁড়ালো।

মিঃ আহাদ রিভলভারখানা বাগিয়ে ধরলেন।

মিঃ হাফিজ ও ওসিদ্বয় আত্নরক্ষার জন্য প্রস্তুত রইলেন!

 সিঁড়ির ধাপে কেউ যেন এগিয়ে আসছে।

রুদ্ধ নিঃশ্বাসে প্রতীক্ষা করছে অন্ধকারে চারটি প্রাণী।

জুতোর শব্দটা আরও নিকটে মনে হচ্ছে, অতি দ্রুত কেউ এগিয়ে আসছে যেন। পাঠান। ড্রাইভার মিঃ আহাদকে লক্ষ্য করে বললেন খুব নিম্নস্বরে–বাবুজী, আপ মেরা সাথ আইয়ে, জলদী আইয়ে।

সিঁড়ি বেয়ে ড্রাইভার এবার উপরে উঠতে লাগলো। মিঃ আহাদ অনুসরণ করলেন তাকে। কিছুটা উপরে উঠার পর যে স্থানে সিঁড়ি বাঁক হয়ে অন্যদিকে ফিরেছে সেই স্থানে এসে পাঠান ড্রাইভার দেয়াল ঘেষে ঠেশ দিয়ে দাঁড়ালো।

মিঃ আহাদ পাঠান ড্রাইভারের নিকট হতে প্রায় সিঁড়িকয়েক নিচে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

জুতোর শব্দটা তখন একেবারে পাঠান ড্রাইভারের সম্মুখে এসে পড়েছে। কেউ যেন নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে আসছে সহজভাবে। মিঃ আহাদ এবং তার সঙ্গিগণ ভীষণ একটা মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা শব্দ হলো, কাঁক করে উঠলো যেন কেউ, সঙ্গে সঙ্গে নির্মূপ। মৃদু ধস্তাধস্তির শব্দ হচ্ছে সিঁড়ির বাকে।

 মিঃ আহাদ আরও কয়েক ধাপ এসে ক্ষুদে টর্চটা জ্বালালেন, সঙ্গে সঙ্গে বিস্মিত হতবাক হলেন–একটা ভীষণ চেহারার লোককে পাঠান ড্রাইভার পিছন থেকে গলা টিপে ধরেছে, লোকটার চোখ দু’টি বলের মত ঠিকরে বেরিয়ে আসছে যেন, জিভটা বেরিয়ে এসেছে আধহাত।

পাঠান ড্রাইভারের কঠিন বাহুর নিষ্পেষণে ভীষণ চেহারার লোকটার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যেতে বিলম্ব হলো না। এবার পাঠান ড্রাইভার আলগোছে লোকটাকে শুইয়ে দিলো সিঁড়ির ধাপে, কতকটা বসার মত করে।

মিঃ আহাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন ততক্ষণে মিঃ হাফিজ আর থানা অফিসারদ্বয়। সকলের চোখেমুখে বিস্ময়–আশ্চর্য শক্তি পাঠান ড্রাইভারের দেহে! তাছাড়া তার বুদ্ধি-কৌশল সবাইকে যেন আড়ষ্ট করে ফেলেছে।

পাঠান ড্রাইভার দ্রুত হস্তে লোকটার পকেট হাতড়ে চললো। মিঃ আহাদ টর্চটা তখনও ধরে। আছেন পাঠান ড্রাইভার এবং প্রাণহীন মৃতদেহটার উপর! কারো মুখে কোনো কথা নেই, সবাই। যেন থ’ মেরে গেছেন।

 পাঠান ড্রাইভার লোকটার পকেট হাতড়ে একটা অটোম্যাটিক লগার পিস্তল আর একটা ক্ষুদে ওয়্যারলেস বের করে নিলো আর পেলো একটি চিঠি পাঠান ড্রাইভার জিনিসগুলো নিয়ে ফিরে এলো মিঃ আহাদের পাশে। রীতিমত হাঁপাচ্ছে সে–হাতের পিঠে ললাটের ঘাম মুছে পিস্তল আর ওয়্যারলেসটা মিঃ আহাদের হাতে দিলো, তারপর টর্চের আলোর সামনে মেলে ধরলো কাগজখানা। খাঁটি বাংলায় লেখা। পাঠান ড্রাইভার বাংলা জানে না তাই চিঠিখানা মিঃ আহাদের হাতেই দিয়ে বললো-আপ পড়িয়ে বাবুজী, হাম সামঝাতা নেহি।

মিঃ আহাদ পিস্তল এবং ওয়্যারলেসটা পকেটে রেখে চিঠিখানা টর্চের আলোর নিচে মেলে ধরলেন, স্পষ্ট বাংলায় লেখা

সদরঘাটে নৌকা তৈরি আছে। লাশের কফিন এলেই আমরা নৌকা ছাড়বো। মনে রেখো, পুরো দশ পাউন্ড যেন লাশের পেটে থাকে। অতি সাবধানে কাজ করবে–হুঁশিয়ার, যেন দস্যু বনহুর টের না পায়।
— বাঞ্ছারাম

মিঃ আহাদ যখন চিঠিখানা টর্চের আলো ফেলে পড়ছিলেন তখন পাঠান ড্রাইভার ঝুঁকে। দেখছিলো লেখার অক্ষরগুলো। মিঃ আহাদ পড়া শেষ করে চিঠিখানা পকেটে ভাঁজ করে রাখলেন, তারপর ফিরে এলেন পুনরায় সেই ছোট্ট কুঠরীটার মধ্যে।

মিঃ আহাদ ও মিঃ হাফিজ ছিদ্রপথে দৃষ্টি নিক্ষেপ করার পূর্বে পাঠান ড্রাইভার একবার ফাঁকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখছিলো। প্রথম ছিদ্রপথে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন মিঃ আহাদ।

 মিঃ হাফিজও দ্বিতীয় ছিদ্রপথে চোখ রাখলেন।

এবার দেখলেন, আরও কয়েকজন লোক কক্ষটার মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। আলখেল্লাধারী দাঁড়িয়ে তাদের কি যেন বলছে। প্রত্যেকটা লোকের চেহারা ভয়ঙ্কর গুভাষ রকমের, প্রায় জনেরই বড় বড় গোঁফ আছে।

মিঃ আহাদ ও মিঃ হাফিজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছেন। এমন ধরনের ভয়ঙ্কর কার্যকলাপের সঙ্গে তারা যেন ইতিপূর্বে জড়িত হননি কখনও। মিঃ আহাদ কত দুর্ধর্ষ দস্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়েছেন কিন্তু এমন রহস্যময় অবস্থায় পড়েননি।

মিঃ আহাদের কানে গেলো আলখেল্লাধারীর চাপাকণ্ঠ-ইলিয়াস এখনও এলো না কেন?

অন্য একজন বললো–হুজুর, আপনি মাল তৈরি করে নিন, এক্ষুণি এসে পড়বে হয়তো।

দেওজী একটা এটাচী ব্যাগ থেকে গাদা গাদা একশত টাকার ফাইল বের করে আলখেল্লাধারীর সম্মুখে জমকালো পাথরের টেবিলটার উপর সাজিয়ে রাখতে লাগলো।

আলখেল্লাধারী তার সম্মুখের ভীষণ চেহারার লোকটার দিকে তাকিয়ে কিছু ইংগিত করলো।

লোকটা বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

আলখেল্লাধারী এবার টাকার ফাইলগুলো গুণে দেখতে শুরু করে দিলো।

পাঠান ড্রাইভার তখন ওদিকের একটা ফাঁকে দৃষ্টি রেখে দেখছে। এতোক্ষণ এ ফাঁকটা তাঁরা লক্ষ্য করেননি।

ওসিদ্বয়ও পাঠান ড্রাইভারের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন ওপাশের বিস্ময়কর কার্যকলাপগুলো।

*

নূরী কোনোদিন এমন আনন্দমুখর দৃশ্য উপভোগ করেনি, সে তন্ময় হয়ে গিয়েছিলো। অর্কেষ্ট্রার সুন্দর সুমিষ্ট বাদ্য, পিয়ানো আর বাঁশি তাকে মুগ্ধ করে ফেলেছিলো। টেবিলে তার খাবার পড়ে আছে–অবাক হয়ে দেখছে সে। সমীরের কথায় মাঝে মাঝে খাবারে হাত দিচ্ছে বটে কিন্তু কতটুকু তার মুখ-গহ্বরে প্রবেশ করছে সে নিজেই জানে না।

ক্লাব-কক্ষে কাঁটা-চামচের শব্দ আর নারী-পুরুষের হাসি-গল্পের শব্দ অর্কেষ্ট্রাবাদ্যের সঙ্গে মিলে অদ্ভুত এক পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছিলো। মিসেস শোহেলী প্রতিটি টেবিলে অতিথিদের পাশে দাঁড়িয়ে আদর আপ্যায়নে ব্যস্ত ছিলো।

অল্পক্ষণ পূর্বে মিসেস শোহেলী স্বামীর ইচ্ছা অনুসারে ড্রেস পরিবর্তন করে এসেছে। এখন তার দেহে গাঢ় লাল শাড়ি, ব্লাউজটাও লাল টকটকে। এমনকি মাথার ফিতা থেকে হাতের রুমালখানাও লাল। জুতো জোড়াও লাল রং-এর। গাঢ় লালের মাঝে যেন একটা গোলাপ ফুলের। মতই লাগছে আজ শোহেলীকে। মিসেস শোহেলীর পাতলা ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপষ্টিক। সরু আংগুলের নখগুলি লাল নেল পলিশে রাঙানো। অপূর্ব লাগছে আজ তাকে।

 গ্রীণ হাউসের সবুজ আলো ছটা মিসেস শোহেলীর লাল পরিচ্ছদটাকে মায়াময় করে তুলছিলো। ক্লাব-কক্ষের প্রত্যেকেরই দৃষ্টির আকর্ষণ করছিলো মিসেস শোহেলী। যে-কোনো পুরুষের কাছেই সে কামনার তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

 যদিও গ্রীণ হাউস নাইট ক্লাবের প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে মিসেস শোহেলীর তেমন কোনো পরিচয় নেই, তবু সে হেসে হেসে প্রত্যেকের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলো। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ তাকে বেশি হাস্যোজ্জ্বল মনে হচ্ছিলো।

মিসেস শোহেলীর বাম হস্তের ফাঁকে একটি গাঢ় লাল ভ্যানিটি দুলছিলো। সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলো ভ্যানিটির গায়ে একটি লাল পাথর। ঠিক ভ্যানিটির মুখের কাছে বসানো ছিলো পাথরটা।

গ্রীণ হাউসের সবুজ আলোকরশ্মি পাথরের গায়ে যেন ঠিকরে পড়ছিলো। মূল্যবান পাথর সেটা তাতে কোনো ভুল নেই।

খাওয়া-দাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

মিঃ নিজাম হোসেন মিসেস শোহেলীর বৃদ্ধ স্বামী আজ অত্যন্ত পরিশ্রান্ত,তিনি বেশিক্ষণ আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দের সঙ্গে যোগ দিতে পারেননি, বিশ্রামের জন্য মিঃ নিজাম ক্লাবের ভিতরে চলে গিয়েছেন। কাজেই মিসেস শোহেলীকে সবদিকে লক্ষ্য রেখে চলতে হচ্ছে, আজকের উৎসব যে তারই জন্য।

নাইট ক্লাব আলো ঝলমল আর জনমুখর থাকলেও রাতের প্রহর বেড়ে এসেছে জলস্রোতের মত বাধাহীনভাবে। রাজপথ নীরব হয়ে আসছে ক্রমান্বয়ে। যানবাহন চলাচলও বন্ধ হয়ে এসেছে প্রায়।

গ্রীণ হাউস নাইট ক্লাবে তখন পুরোদমে চলেছে আমোদ-প্রমোদ, হাসি-গান আর পানীয় পান।

বয়গণ প্রত্যেকটা টেবিলে বিলেতী মদের বোতল আর কাঁচপাত্র পরিবেশন করে গেলো। খাবার পর পানীয় পান না করলে মূল্যবান খাবারগুলো হজম হয় না নাকি। গ্রীণ হাউসের এটা রেওয়াজ।

 সমীরের পাশে নূরী এতোক্ষণ সব দেখছিলো। তার খাওয়াও শেষ হয়ে গিয়েছিলো, বয়টা এবার টেবিলে বোতল আর কাঁচপাত্র রেখে গেলে সে সমীরের দিকে চাইলো।

সমীর ইংগিতে তাকে চুপ থাকতে বললো, আলগোছে মদের বোতল আর গেলাসটা সরিয়ে রাখলো দূরে। নূরী বললোকই, আহাদ ভাইয়া তো এলো না?

সমীর হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো–আর কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে রওয়ানা দেবো।

 বললো নূরী–তাই চলুন মিঃ সমীরবাবু, আমার বড় ঘুম পাচ্ছে।

হাঁ, রাত বারোটার বেশি হয়ে গেছে, ঘুম পাবারই কথা।

নূরী হাই তুলছিলো।

অন্যান্য টেবিলে তখন কাঁচপাত্রের টুং টাং শব্দ আর নারী-পুরুষ কণ্ঠের হাস্যধ্বনি ডায়াসের অর্কেস্ট্রার সুরের সঙ্গে মিশে পরিবেশটা মোহগ্রস্ত করে তুলছিলো।

নূরী নিদ্রালস চোখ দুটি মেলে তাকিয়ে আছে। ওর মনে হচ্ছিলো, টেবিলখানায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু এভোগুলো লোকের সম্মুখে এভাবে ঘুমানো কি সম্ভব হবে। তাছাড়া সমীরবাবুই বা ভাববেন কি। নূরী অতি কষ্টে বসে ছিলো নিশ্চুপ হয়ে।

 এমন সময় হঠাৎ আলো নিভে গেলো, সঙ্গে সঙ্গে একটা তীব্র নারীকণ্ঠের আর্তনাদ জেগে উঠলো ক্লাব-কক্ষের জমাট অন্ধকারের মধ্যে। পরক্ষণেই সব চুপ,একটুও শব্দ নেই।

গভীর একটা আতঙ্কের ছায়া যেন ক্লাব-কক্ষটার টুটি চেপে ধরলো লৌহ সাড়াশী দিয়ে। আলো জ্বলে উঠলো, পরস্পর পরস্পরকে দেখতে পেলো সচ্ছভাবে আবার, কিন্তু সকলের মুখের হাসি কোথায় যেন তলিয়ে গেছে। ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে সবার মুখ। একটু পূর্বেই যে ক্লাব কক্ষ হাস্যমুখর উচ্ছল ছিলো এক নিমিষে কে যেন সবার মুখে কালির প্রলেপ মাখিয়ে দিয়েছে।

কিসের আর্তনাদ?

সকলের মনেই ঐ এক প্রশ্ন, ভয়-বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে এ-ওর মুখে, কথা বলবার সাহস হচ্ছে না যেন কারো।

 যে যার টেবিলে বসেছিলো তেমনই আছে–কই, কারো মুখে তেমন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটনার ছাপ ফুটে উঠেনি। তবে যে আর্তনাদ শোনা গেলো সেটা কার কণ্ঠ দিয়ে বের হয়েছিলো? হঠাৎ চমকে উঠলো অনেকে, মিসেস শোহেলী কোথায়? যে স্থানে মিসেস শোহেলী দাঁড়িয়ে ছিলো সেই স্থানের মেঝেতে খানিকটা তাজা রক্ত পড়ে আছে।

ক্লাব-কক্ষ মধ্যে একটা ভীতিকর গুঞ্জনধ্বনি জেগে উঠলো, মরার মত ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে ছাই বর্ণ হয়ে উঠলো সকলের মুখ। একটু পূর্বে যে ক্লাব-কক্ষ নারী-পুরুষের হাসি-গানে মুখর ছিলো এক্ষণে সে কক্ষ যেন এক ভয়ঙ্কর শ্মশানের চেয়েও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।

আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডায়াসে অর্কো থেমে গিয়েছিলো, আলো জ্বলে উঠার পর আবার সবেমাত্র বাজতে শুরু করেছে তখনই মিসেস শোহেলীর অন্তর্ধান-সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো ক্লাব-কক্ষ মধ্যে।

আবার ডায়াসে অর্কেস্ট্রা থেমে গেলো, এবার একেবারে থেমে গেলো গোটা রাতের জন্য। বাদ্যকরগণও উদ্বিগ্ন হয়ে ডায়াস থেকে নেমে এসেছে।

 হঠাৎ একটা থমথমে ভাব গ্রীণ হাউসের সবুজ আলোকরশ্মিকে কালো করে তুললো যেন। একি অদ্ভুত কান্ড মিসেস শোহেলীকে হত্যা করলো কে এবং কেই বা তাকে উধাও করলো? সকলের মনেই এই প্রশ্ন।

এমন ক্ষণে একখানা কাগজের টুকরা দৃষ্টিগোচর হলো, রক্তের পাশেই পড়ে আছে কাগজের টুকরাটা। এতোক্ষণ সবাই মিসেস শোহেলীর খুন ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কাগজের টুকরার দিকে কেউ লক্ষ্য করেনি।

একজন কাগজের টুকরাটা হাতে নিতেই ক্লাবের ম্যানেজার এগিয়ে এলেন। তিনি টুকরাটা হাতে নিয়ে আঁতকে উঠলেন ভীষণভাবে, অস্ফুট কণ্ঠে বললেন–দস্যু বনহুর! দস্যু বনহুর তাহলে মিসেস শোহেলীকে খুন করেছে।

 সঙ্গে সঙ্গে গ্রীণ হাউস নাইট ক্লাব মধ্যে বাজ পড়লো যেন। সবাই ভয়-বিহ্বল কণ্ঠে উচ্চারণ করলো, দস্যু বনহুর তবে মিসেস শোহেলীকে হত্যা করে তাকে নিয়ে উধাও হয়েছে?

সমীরের পাশে নূরীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছিলো, সমীর আর নূরী টেবিলের ধারে দাঁড়িয়ে বিদায় হবার সুযোগ খুঁজছিলো কিন্তু হঠাৎ চলে যাবার উপায় ছিলো না তাদের। কারণ এই মুহূর্তে ক্লাব থেকে কাউকে বাইরে যেতে দেওয়া হচ্ছিলো না।

ম্যানেজার গম্ভীর মুখে মিসেস শোহেলীর রক্তের পাশে দাঁড়িয়ে ব্যথা-ভরা কণ্ঠে বললেন– আজকের এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার জন্য আমি যারপর নেই দুঃখিত।

দস্যু বনহুরই যে মিসেস শোহেলীকে হত্যা করেছে এই কাগজের টুকরাখানাই তার প্রমাণ।

কক্ষমধ্যে কারো মুখে কোনো কথা নেই। পাথরের মূর্তির মত সবাই থ’ বনে গেছে। কারো নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা বুঝা যাচ্ছে না।

 ম্যানেজার রুমালে চোখ দুটো মুছে বাষ্পরুদ্ধ গলায় বললেন—দুর্ধর্ষ দস্যু একটি সুন্দর ফুলের মত জীবন-প্রদীপ চিরতরে নিভিয়ে দিলো। আপনারা অনেকেই জানেন না বা বুঝতে পারেননি, কেন দস্যু বনহুর মিসেস শোহেলীকে হত্যা করেছে। লক্ষ্য করেছেন, মিসেস শোহেলীর হাতে একটি ভ্যানিটি ছিলো এবং সেই ভ্যানিটিতে ছিলো একটি বহু মূল্যবান পাথর। ঐ পাথরটাই হলো দস্যু বনহুরের লক্ষ্য, এবং এই পাথরের লোভেই মিসেস শোহেলীকে হত্যা করে তাকে নিয়ে উধাও হয়েছে। তবে আমার বিশ্বাস, দস্যু বনহুর শোহেলীর লাশ নিয়ে যাবে না, লাশ আমরা পাব বা পেতে পারি, কারণ ভ্যানিটিটা তাড়াহুড়া করে নিতে না পারায় সে লাশসহ উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আমাদের লোক মিসেস শোহেলীর সন্ধানে আত্ননিয়োগ করেছে। পুলিশ অফিসেও ফোন করা হয়েছে, এক্ষুণি পুলিশ ফোর্স ছুটে আসবে দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করতে।

এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে থামলেন ম্যানেজার পারভেজ সাহেব।

পুনরায় বলতে শুরু করলেন–আপনারা দয়া করে বসে পড় ন, যতক্ষণ না পুলিশ ফোর্স আসছে ততক্ষণ কেউ ক্লাবের বাইরে যাবেন না।

সবাই চলে যাবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছেন, এমন সময় ম্যানেজারের উক্তি শ্রবণে হতাশ হয়ে পড়লেন সকলে।

ঐ মুহূর্তে একজন লোক ক্লবের মধ্য হতে বেরিয়ে এলো এবং ম্যানেজারের কানে মুখ নিয়ে কিছু বললো।

ম্যানেজার এবার বললেন মিসেস শোহেলীর লাশ পাওয়া গেছে। তবে দস্যু বনহুরের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি, সে পালাতে সক্ষম হয়েছে তাতে কোনো ভুল নেই। পুলিশ ফোর্স এসে পড়লে আপনাদের চলে যাওয়া সহজ হবে না, কাজেই আপনারা এই মুহূর্তে যেতে পারেন……

ম্যানেজারের উক্তি শেষ হতে না হতে নাইট ক্লাবের আমন্ত্রিত অতিথিগণের মধ্যে সাড়া পড়ে গেলো, সবাই ক্লাব থেকে দ্রুত বিদায় হবার জন্য হুলস্থূল বাধালো। জলস্রোতের মত বেরিয়ে এলো সবাই ক্লাব-কক্ষ থেকে।

 সমীর আর নূরীও বেরিয়ে যাচ্ছিলো এমন সময় পাঠান ড্রাইভার তাদের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়–বাবুজী, আপলোগ ক্লাব মে রহিয়ে, বড়া সাহাব আয়েঙ্গে তব একসাথ যায়েঙ্গে আপলোগ….

সমীর নূরীকে বললো– কি করবে এখন বলো? শুনলে তো ড্রাইভারের কথা?

আমার কিন্তু বড় ভয় করছে। বললো নূরী।

দস্যু বনহুরের ভয়?

হ্যাঁ।

মিছে নয়, আবার কার উপর হামলা করে বসে কে জানে! কথাটা বলে সমীর ভয়াতুর চোখে চারিদিকে তাকালো।

নূরী বললো–বড় সাহেব যখন বলেছে তখন বসতেই হবে।

অগত্যা সমীর নূরীসহ পুনরায় আসন গ্রহণ করলো।

 নূরীর চোখের নিদ্রা ছুটে গিয়েছিলো, কি যেন গভীরভাবে ভাবছে সে বসে বসে।

সমীর অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে মিঃ আহাদের, কখন আসবে সে।

ক্লাব-কক্ষের বড় ঘড়িটা রাত একটা ঘোষণা করলো।

ক্লাব-কক্ষ প্রায় সম্পূর্ণ নীরব, কয়েকজন বয়, বাবুর্চি আর আদালী এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করছে ব্যস্তভাবে। মিসেস শোহেলী যে তাদের এ ব্যস্ততার কারণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

*

হঠাৎ ছিদ্রপথ জমাট অন্ধকারে ভরে গেলো। মিঃ আহাদ, মিঃ হাফিজ, ওসিদ্বয় ও পাঠান ড্রাইভারের চোখের সামনে অন্ধকারের ফুলঝুরি ঝরে পড়লো যেন। সঙ্গে সঙ্গে নারী-কণ্ঠের একটা তীব্র আর্তনাদ জেগে উঠলো গ্রীণ হাউসের অন্ধকারময় অভ্যন্তরের স্তরে স্তরে। মর্মস্পর্শী করুণ সে আর্তচিৎকার।

চমকে উঠলেন কুঠির মধ্যে মিঃ আহাদ ও তার সঙ্গিগণ।

পরক্ষণেই দেয়ালে আলোর চোখ দুটো জ্বলে উঠলো যেন জ্বলজ্বল করে। মিঃ আহাদ ও তার সাথিগণ চোখ রাখলেন আলোর ছিদ্রপথে।

এতোক্ষণ ক্লাবের মধ্য হতে যে একটা আনন্দমুখর প্রতিধ্বনির ক্ষীণ আভাস ভেসে আসছিলো, এই দন্ডে তার কিছুমাত্র শোনা গেলো না। সমস্ত ক্লাবটা যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে বাজ পড়া পোড়া বাড়িটার মত।

 ছিদ্রপথে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই বিস্ময়ে আড়ষ্ট হলেন মিঃ আহাদ ও তাঁর সহচরগণ। তাঁরা দেখতে পেলেন, একটা ভীষণ চেহারার লোক, যাকে কিছু পূর্বে আলখেল্লাধারী ইংগিত করেছিলো, সেই বলিষ্ঠ লোকটা একটি নিহত নারীদেহ কাঁধে করে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলো। নিহত নারীদেহ থেকে তাজা রক্ত ঝরে পড়ছে। নারীটির সমস্ত শরীরে লাল পরিচ্ছদ থাকায় তার দেহের রক্ত বসনে বুঝা যাচ্ছিলো না। লোকটার হাত এবং কাঁধ বেয়ে যে রক্ত পড়ছিলো সেই রক্তই দেখতে পেলেন মিঃ আহাদ ও তাঁর সাথিগণ।

 আলখেল্লাধারী উঠে দাঁড়ালো, জমকালো মুখোসের মধ্যে চোখ দুটো যেন জ্বলছে। আলখেল্লাধারীর ইংগিতে লোকটা নিহত নারী-দেহটাকে শুইয়ে দিলো ওদিকের লম্বা একটা টেবিলের উপর।

চমকে উঠলো পাঠান ড্রাইভার।

মিঃ আহাদ ও মিঃ হাফিজও চমকে উঠলেন ভীষণভাবে, এ যে মিসেস শোহেলীর মৃতদেহ! সর্বনাশ, আজকের উৎসব যে তার এবং মিঃ নিজাম হোসেনের বিবাহ দিন স্মরণেই উদযাপিত হচ্ছিলো–আজকের এই শুভদিনে মিসেস শোহেলীর এ অবস্থা হলো! মনে মনে ভাবলেন মিঃ আহাদ।

কারোমুখে কোনো কথা নেই, রুদ্ধ নিশ্বাসে দেখছেন তাঁরা। মিসেস শোহেলীকে একটা টেবিলে লম্বা করে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। বুকের কাছে লাল শাড়িখানা রক্তের লাল ছোপে ভিজে কালো হয়ে উঠেছে, লালে লাল মিশে কালোই হয়। মিসেস শোহেলীর রক্তশূন্য পাংশু মুখখানা কাৎ হয়ে আছে এদিকে। চোখ দুটো অর্ধনিমীলিত, এখনও চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু চকচক করছে। সরু ঠোঁট দু’খানা থেকে লিপষ্টিকের লাল রং মুছে যায়নি, কেমন যেন একটা বেদনা-ভরা ম্লান হাসির আভাস লেগে আছে এখনও ওর ঠোঁটের কোণে।

আলখেল্লাধারী টাকার ফাইলগুলো কালো পাথরের টেবিলের ড্রয়ারে খুলে উঠিয়ে রাখলো, তারপর উঠে দাঁড়ালো সে। মিসেস শোহেলীর টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালো। আলখেল্লার ভিতর থেকে একখানা হাত বেরিয়ে এলো, মৃত শোহেলীর চিবুক ধরে এপাশ ওপাশ নাড়া দিয়ে ছেড়ে দিলো মুখখানা।

 গড়িয়ে পড়া বলের মত মাথাটা মৃদু ঝাঁকুনি খেয়ে স্থির হয়ে গেলো। সুন্দর মুখখানা মৃত্যুর হিমশীতল পরশেও ম্লান হয়নি এতোটুকু। ঠিক যেন ঘুমিয়ে আছে মিসেস শোহেলী! সুডৌল হাত দু’খানা ঝুলছে টেবিলটার দু’পাশে।

একটু পূর্বেই গ্রীণ হাউস নাইট ক্লাবের নারী-পুরুষের একমাত্র দৃষ্টি আকর্ষণীয় বস্তু ছিলো সে। আজ তার গোলাপী দেহে রক্তাভ-আবরণ অত্যধিক সুন্দর মানিয়েছিলো। কিছুক্ষণ পূর্বেও সে ঐ মুখখানা বিস্ফারিত করে কথা বলেছে, হেসেছে, ঐ দৃষ্টি নিয়ে দেখেছে গ্রীণ হাউসের অপরূপ রূপ। নাসিকা দিয়ে গ্রহণ করেছে নাইট ক্লাবের নারী-পুরুষ দেহের মূল্যবান প্রসাধনের উগ্র গন্ধ। আর এক্ষণে শ্রান্ত-ক্লান্ত-অবসন্ন, হিমশীতল জড়পদার্থ সে। চেতনা নেই, নেই কোনো ভাবের উন্মেষ, নেই কোনো উপলব্ধিবোধ।

আলখেল্লাধারীর ইংগিতে একজন এ্যাপ্রন-পরা লোক একটি সূতীক্ষ্ণ ধার ছুরি নিয়ে মিসেস শোহেলীর মৃতদেহের পাশে এসে দাঁড়ালো।

যদিও মিসেস শোহেলীর প্রাণহীন অসাড় দেহটার পাশে সূতীক্ষ্ণ ধার ছুরি হস্তে লোকটা এগিয়ে এলো তবু কেন যেন আড়ালে দাঁড়িয়ে শিউরে উঠলেন মিঃ আহাদ এবং তার সঙ্গিগণ।

একজন লোক মিসেস শোহেলীর প্রাণহীন দেহটার বুক থেকে পেট অবধি কাপড় সরিয়ে ফেললো। জামাটা কাঠি দিয়ে কেটে ফেললো দ্রুতহস্তে।

এবার ছোরাহস্তে এ্যাপ্রন-পরা লোকটা মিসেস শোহেলীর দেহটার উপর ঝুঁকে ছুরি দিয়ে বুক থেকে পেট অবধি চিরচির করে ছিঁড়ে ফেললো। রক্ত বেরিয়ে এলো কিন্তু অতি সামান্য গড়িয়ে পড়লো চারিপাশে।

ছুরিহস্তে লোকটা অত্যন্ত দ্রুত কাজ করছিলো। আলখেল্লাধারী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো তীক্ষ্ণ নজরে। পাশেই দেওজী দাঁড়িয়ে, সেও নিপুণভাবে লক্ষ্য করছে সব। কিছু পূর্বে যে দু’টি লোকের গলার মধ্যে রবারের পাইপ ঢুকিয়ে সোনার খণ্ডগুলি উঠানো হয়েছে, তারাও বসে আছে। ওপাশের দুটো চেয়ারে। চুপচাপ কতকটা নিরীহ বনমানুষের মত।

কক্ষমধ্যে মেশিনগুলো পূর্বের মতই চালু করা আছে। নানারকম যন্ত্রপাতি স্তরে স্তরে সাজানো কক্ষটার চারপাশে। এক-পাশের টেবিলে বড়-ছোট নানা আকারের শিশিতে তরল পদার্থ, একটা কাঁচের জার থেকে মৃদু মৃদু ধূম্রকুন্ডলী ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিলো। মনে হচ্ছে, কক্ষটা কোনো বৈজ্ঞানিকের ল্যাবরেটরী।

যে টেবিলটায় মিসেস শোহেলীর মৃতদেহের উপর অস্ত্রোপচার চলছে সে টেবিলখানা সরু এবং লম্বাটে। এত সরু যে মিসেস শোহেলীর হাত দুখানা দু’পাশে ঝুলছিলো।

 এ্যাপ্রন-পরা লোকটা মিসেস শোহেলীর বুক এবং পেটের ভিতরটা পরিস্কার করে নিলো লম্বা একটা যন্ত্র দ্বারা।

 মিসেস শোহেলীর বুক এবং পেটের চামড়া টেবিলের দু’পাশে ক্লিপের সাহায্যে ফাঁক করে রাখা হয়েছিলো।

 মিঃ আহাদ ছিদ্রপথ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন।

ওসিদ্বয় আর দেখতে পারলেন না, তাদের পা দুখানা যেন অবশ হয়ে আসছে। বসে পড়লেন ভূতলে, দু’খানে মাথাটা চেপে ধরে রাখলেন হঠাৎ যেন অজ্ঞান হয়ে না পড়েন।

পাঠান ড্রাইভার পাথরের মূর্তির মত জমে গেছে যেন, সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে দেখছে ওদের কার্যকলাপ। মিসেস শোহেলীর বুক এবং পেটের ভিতরটা সঁশ বের করা লাল তরমুজের খোসার মত লাগছিলো।

 মিঃ আহাদ পুনরায় ছিদ্রপথে দৃষ্টি রাখলেন। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ধরে গেলো সবার, তবু ধৈর্যসহকারে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন তাঁরা। কি ভয়ঙ্কর নৃশংস দৃশ্য! যে কোনো ব্যক্তির পক্ষে এ দৃশ্য সহ্য করা কঠিন। দু’জন লোক দুটো থলের মধ্যে কিছু ভারী জিনিস নিয়ে এগিয়ে এলো মিসেস শোহেলীর শায়িত মৃতদেহের পাশে।

 এ্যাপ্রন-পরা লোকটা প্রথম ব্যক্তির হাত থেকে থলেটে নিয়ে কি যেন ঢেলে দিলো মিসেস শোহেলীর নাড়ীভুড়ি বের করা দেহের খোলসের মধ্যে। দ্বিতীয় ব্যক্তির হস্তের থলেটাও ঢেলে দিলো, আরও দু’ব্যাগ বস্তু ঢেলে দিতেই মিঃ আহাদ বুঝতে পারলেন, থলে এবং ব্যাগের বস্তুগুলি অন্যকিছু নয়–সোনার স্তর বা খন্ড।

এ্যাপ্রন-পরা লোকটা সোনার স্তরগুলি মিসেস শোহেলীর দেহের মধ্যে ভয়ে পুনরায় ক্ষিপ্রহস্তে সেলাই করে পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক করে ফেললো। জামা-কাপড়টাও এমনিভাবে গুছিয়ে দিলো, কে বলবে মিসেস শোহেলীর উদরে কয়েক পাউন্ড সোনা আছে।

এতক্ষণ নীরবে কাজ করলেও মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে কথা-বার্তা, আলাপ-আলোচনা চলছিলো, কিন্তু স্পষ্টভাবে কিছুই শুনতে পাচ্ছিলেন না মিঃ আহাদ ও তাঁর সাথিগণ।

এবার আলখেল্লাধারী গম্ভীর কণ্ঠে বললো, স্পষ্ট শুনতে পেলেন মিঃ আহাদ ও সঙ্গিগণ। বললো–দেওজী, ভজুয়া আর রশিদের পেটে দু’পাউন্ড করে চার পাউন্ড রইলো আর লাশটার মধ্যে রইলো বিশ পাউন্ড।

দেওজী বললো-ইলিয়াস খবর নিয়ে আসার কথা ছিলো সে এখনও এসে পৌঁছালো না।

আলখেল্লাধারী বললো–কোনো কারণবশতঃ হয়তো সে আসতে পারেনি বা পথে কোনো এ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে। কাজেই বিলম্ব করা আর মোটেই উচিত হবে না। হঠাৎ পুলিশের লোক জানাজানি হতে পারে। মিসেস শোহেলীর নিহত সংবাদ পুলিসে না জানিয়ে অতিথিদের সামনে ভুয়ো সংবাদ প্রচার করা হয়েছিলো। সদরঘাটে আমাদের নৌকা প্রতীক্ষা করছে। ভজুয়া, রশিদ, মঙ্গল আর রাজু লাশের বাক্স বয়ে নিয়ে যাবে। পথে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে বলবে, ডেলিভারী কেসে হসপিটালে মারা গেছে, তাই নৌকা করে দেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে–বাস্……

দেওজী বললো–আমাকে অতো করে শেখাতে হবে না রায়। আজ সাত বছর ধরে মাল চালানি ব্যবসা করছি……

 আলখেল্লাধারী আর দেওজী যখন গম্ভীর কণ্ঠে কথাবার্তা হচ্ছিলো তখন এ্যাপ্রন-পরা লোকটার তদারকে চারজন লোক মিসেস শোহেলীর মৃতদেহটা একটা লম্বামত কাঠের বাক্সে ভরে পেরেক ঠুকে বাক্সের মুখ বন্ধ করে দিচ্ছিলো। অত্যন্ত ক্ষিপ্র এবং দ্রুতহস্তে কাজ করছিলো তারা।

আর বিলম্ব নয়, পাঠান ড্রাইভার সহসা বেরিয়ে গেলো দ্রুত। পরক্ষণেই তীব্র হুইসেলধ্বনি শুনতে পেলেন মিঃ আহাদ এং পুলিশ অফিসারক্রয়।

সেকি তীব্র আর তীক্ষ্ণ হুইসেল ধ্বনি।

সঙ্গে সঙ্গে গ্রীণ হাউস নাইট ক্লাবের চারপাশ থেকে অসংখ্য পুলিশবাহিনী জলস্রোতের মত ক্লাবের মধ্যে প্রবেশ করলো। প্রত্যেকের হস্তেই উদ্যত রাইফেল।

মিঃ আহাদ, মিঃ হাফিজ রিভলভার বাগিয়ে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন গ্রীণ হাউসের গুপ্ত কক্ষমধ্যে, যেখানে মিসেস শোহেলীর কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে আলখেল্লাধারী এবং তার সহকারী দেওজী আর তাদের অন্যান্য অনুচর। সোনা চোরাচালানি কাজে কর্মরত কয়েকজন কর্মচারীও রয়েছে সেই কক্ষমধ্যে।

মিঃ আহাদ আর মিঃ হাফিজ কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে রিভলভার উদ্যত করে ধরলেন– খবরদার, একচুল কেউ নড়বে না, তাহলেই মরবে।

আলখেল্লাধারী হাত তুলে দাঁড়ালো।

সঙ্গে সঙ্গে দেওজী এবং কক্ষমধ্যে সবাই মাথার উপর হাত তুলতে বাধ্য হলো।

মিসেস শোহেলীর কফিনের মুখ তখনও সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা হয়নি, অর্ধখোলা অবস্থায় রয়েছে!

ওদিকে পাঠান ড্রাইভারের হুইসেলধ্বনির সঙ্গে সঙ্গেই সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী উদ্যত রাইফেল হস্তে তীব্রবেগে নাইট ক্লাবের মধ্যে প্রবেশ করলো।

পাঠান ড্রাইভারের ইংগিতে নাইট ক্লাবের প্রত্যেকটা বয়-বাবুর্চী এবং ম্যানেজার ও তার সহকারিগণকে বন্দী করা হলো। এদিকে এদের বন্দী করার নির্দেশ দিয়েই পাঠান ড্রাইভার কতকগুলো পুলিশ ফোর্স নিয়ে সোনা চোরাচালানি কক্ষে প্রবেশ করলো।

ঠিক সেইমুহূর্তে আলখেল্লাধারী হঠাৎ কক্ষমধ্যস্থ গোল কালো পাথরের টেবিলটার উপরে উঠে দাঁড়ালো, নিমিষে টেবিলখানা নিচে সাঁ সাঁ করে দেবে যাচ্ছে দেখতে পেলেন তাঁরা। মিঃ আহাদ আলখেল্লাধারীকে লক্ষ্য করে গুলী ছুঁড়লেন। একটা অট্টহাসির শব্দ শোনা গেলো।

পাঠান ড্রাইভার এক সেকেন্ড, বিলম্ব না করে সেও লাফিয়ে নেমে পড়লো জমকালো টেবিলখানার উপরে। টেবিলখানা তখন মেঝে থেকে কয়েক গজ নিচে নেমে গেছে। নিমিষে মেঝেটা পূর্বের মত সমতল হয়ে পড়লো, এতোটুকু ফাঁক বা চিহ্ন কোথাও রইলো না।

 আলখেল্লাধারী আর পাঠান ড্রাইভার যেন হাওয়ায় মিলে গেলো।

মিঃ আহাদ, মিঃ হাফিজ পুলিশকে আদেশ দিলেন, দেওজী এবং অন্যান্যকে বন্দী করে ফেলতে।

পুলিশবাহিনী প্রত্যেকের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলো। মিঃ হাফিজ স্বয়ং দেওজীর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন।

 ওদিকে পাথরের টেবিলখানা গভীর মাটির তলায় লিফটের মত সাঁ সাঁ করে নিচে নেমে চলছে। টেবিলের উপর রীতিমত ধস্তাধস্তি চলছে পাঠান ড্রাইভার আর আলখেল্লাধারীর।

পাঠান ড্রাইভার রিভলভার থেকে গুলী নিক্ষেপ করলে আলখেল্লাধারী দাঁতে দাঁত পিষে বলছিলো-ছাতুখোর তুমি আমাকে গুলী বিদ্ধ করে হত্যা করবে? হাঃ হাঃ হাঃ আমার আলখেল্ল। ভেদ করা কোনো আগ্নেয় অস্ত্রের সাধ্য নয়।

পাঠান ড্রাইভার চমকে উঠলো, কিন্তু কোনো জবাব দিলো না। নিজের রিভলভারখানা দূরে ফেলে দিলো।

 ঠিক সেই মুহূর্তে আলখেল্লাধারী তার আলখেল্লার মধ্যে হতে একটা অটোম্যাটিক ন্যুগার পিস্তল বের করে উদ্যত করে ধরলো পাঠান ড্রাইভারের বুক লক্ষ্য করে।

পাঠান ড্রাইভারের কাছ থেকে মাত্র দু’হাত দূরে আলখেল্লাধারীর পিস্তলসহ হাতখানা। পাঠান ড্রাইভার মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়ালো।

ততক্ষণে পাথরের টেবিল লিফট খানা থেমে গেছে।

আলখেল্লাধারী অটোম্যাটিক লগার পিস্তল পাঠান ড্রাইভারের বুক লক্ষ্য করে রেখে যেমন লিফট থেকে নামতে গেলো অমনি পাঠান ড্রাইভার পা দিয়ে প্রচন্ড এক লাথি মারলো আলখেল্লাধারীর দক্ষিণ হস্তে।

সঙ্গে সঙ্গে আলখেল্লাধারীর হস্তস্থিত পিস্তলখানা ছিটকে পড়লো কয়েকহাত দূরে। পাঠান ড্রাইভার মুহূর্ত বিলম্ব না করে ঝাঁপিয়ে পড়লো আলখেল্লাধারীর উপর।

উভয়ে পড়ে গেলো মেঝেতে।

 চললো ধস্তাধস্তি।

কক্ষটা যে গভীর মাটির তলায় তা বেশ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। এ কক্ষটার মধ্যে কোনো মেশিন বা যন্ত্রপাতি নেই কিন্তু কক্ষমধ্যে রয়েছে নানা জাতীয় কাঠের বাক্স। বাক্সগুলো স্তরে স্তরে সাজানো। কক্ষের দেয়ালে কয়েকটা পাওয়ারফুল বাল্ব জ্বলছে।

আলখেল্লাধারী কিছুতেই পাঠান ড্রাইভারের সঙ্গে পেরে উঠছিলো না, হঠাৎ কৌশলে একবার ছাড়া পেয়ে দ্রুত দেয়ালের দিকে চলে গেলো, সঙ্গে সঙ্গে দেয়ালে একটা বোতামের সুইচ টিপে দিলো সে ক্ষিপ্রহস্তে।

অমনি পাঠান ড্রাইভারের দু’পাশের দেয়াল দ্রুতগতিতে সরে আসছে দু’পাশ থেকে। আর মুহূর্ত বিলম্ব হলে পিষে যাবে পাঠান ড্রাইভার। এক লাফে সে আলখেল্লাধারীর পাশে এসে দাঁড়ালো।

তখনও আলখেল্লাধারী সুইচটায় চাপ দিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দেয়াল দুটো এসে প্রচন্ড ধাক্কা খেলো একখানা আর একখানা দেয়ালের গায়ে। শিউরে উঠলো পাঠান ড্রাইভার — এতোক্ষণ তার অবস্থা থেতলে যাওয়া ছোঁড়ার মতই হতো। দেয়াল দুটো আসলে সিমেন্ট বা পাথরে তৈরি নয়। লৌহপাত বা ষ্টিলের তৈরি ভারী দেয়াল দু’খানা। আলখেল্লাধারী কৌশলে হত্যা করতে চেয়েছিলো পাঠান ড্রাইভারকে তারপর পালিয়ে যাবে ভেবেছিলো সে নির্বিঘ্নে।

 কিন্তু পাঠান ড্রাইভার আলখেল্লাধারীর হাত ধরে ভীষণ জোরে টান দিলো।

সুইচ থেকে হাত সরে যেতেই সাঁ করে দু’পাশে দু’খানা দেয়াল ফাঁক হয়ে পূর্বের আকার ধারণ করলো।

আবার শুরু হলো ধস্তাধস্তি।

ক্রমান্বয়ে আলখেল্লাধারী যেন শিথিল হয়ে আসছে। কিছুতেই পেরে উঠছে না সে পাঠান ড্রাইভারের সঙ্গে। রীতিমত হাঁপিয়ে পড়েছে আলখেল্লাধারী।

পাঠান ড্রাইভার এবার আলখেল্লাটা চেপে ধরলো তারপর টেনে নিয়ে এলো ওদিকের সেই পাথর-তৈরি লিফটখানার উপর। পাথরের টেবিল আকারে লিফট-আশ্চর্যই বটে! হঠাৎ পাঠান ড্রাইভারের নজরে পড়লো টেবিলের মাঝখানে কালো দুটো বোতাম। পাঠান ড্রাইভার একটিতে পা দিয়ে চাপ দিলো কিন্তু একটুও নড়লো না পাথরের টেবিলখানা।

আলখেল্লাধারী পাথরের টেবিলখানা থেকে লাফিয়ে পড়ার জন্য অত্যন্ত চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না, পাঠান ড্রাইভারের বলিষ্ঠ হাতের মুঠি থেকে কিছুতেই নিজকে ছাড়িয়ে নিতে পারছে না যেন আর সে।

পাঠান ড্রাইভার দ্বিতীয় বোতামে পা দিয়ে চাপ দিতেই অবাক হলো সে। পাথরের টেবিল লিফটখানা যেন হাওয়ার বেগে উপরে উঠতে লাগলো।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড পাঠান ড্রাইভার দেখলে পুনরায় তারা ফিরে এসেছে গ্রীণ হাউস নাইট ক্লাবের গুপ্তকক্ষে। অবাক হয়ে দেখলো, মিঃ আহাদ, মিঃ হাফিজ অন্যান্য শয়তানকে বন্দী করে ফেলেছেন।

দেওজীর বুকে রিভলভার চেপে ধরে আছেন মিঃ আহাদ হয়তো তাকে প্রশ্ন করা হচ্ছিলো, ভূগর্ভে প্রবেশের কোনো উপায় আছে কিনা পাঠান ড্রাইভারের জন্য তাঁরা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন রীতিমত।

সহসা পাঠান ড্রাইভার আর আলখেল্লাধারীকে যাদুমন্ত্রের আবির্ভাবের মত দেখতে পেয়ে বিস্মিত হলেন।

পাঠান ড্রাইভার আলখেল্লাধারীর ঘাড়ের কাছের আলখেল্লা চেপে ধরে দাঁড়িয়েছিলো।

টেবিল লিফটখানা স্থির হতেই আলখেল্লাধারীকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে নিজেও নেমে দাঁড়ালো পাঠান ড্রাইভার। কক্ষমধ্যে সকলের চোখেমুখেই রাজ্যের বিস্ময়।

মিঃ আহাদ দ্রুত এগিয়ে এসে আলখেল্লাধারীর হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন এবং পাঠান ড্রাইভারের পিট চাপড়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।

 ক্ষণিকের জন্য সবাই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো, পাঠান ড্রাইভারের বুদ্ধি-কৌশলে শুধু বিস্মিতই নন, হতভম্ব তাঁরা। ঠিক ঐ মুহূর্তে আলখেল্লাধারী দ্রুত ওপাশের একটা চক্রাকারে মেশিনের উপর পা দিতে যাচ্ছিলো।

ধরে ফেললো পাঠান ড্রাইভার খপ করে।

আর এগুতে পারলো না আলখেল্লাধারী।

আলখেল্লাধারী চক্রাকারের যে মেশিনটার উপর পা দিয়ে চাপ দিতে যাচ্ছিলো সেটা একটা সাংঘাতিক বোম। ইলেকট্রিক সংযোগ করা এই চক্রটার সঙ্গেই ফিট করা আছে বোমটা। চক্রাকার যন্ত্রটায় চাপ দিলেই বোমা বিস্ফারিত হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে গ্রীণ হাউস নাইট ক্লাব ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। কিন্তু সে সুযোগ আর পেলো না আলখেল্লাধারী।

পাঠান ড্রাইভার এবার একটানে খুলে ফেললো আলখেল্লাধারীর মুখের আবরণটা। সঙ্গে সঙ্গে কক্ষমধ্যে সবাই একটা বিস্ময়কর শব্দ করে উঠলো। মিঃ আহাদ অত্যধিক অবাক কণ্ঠে বললেন– জনাব নিজাম হোসেন, আপনি!

ইন্সপেক্টার মিঃ হাফিজ বলে উঠেন–আপনিই এই সোনা চোরাচালানির অধিনায়ক? আশ্চর্য!

কক্ষমধ্যে তার অনুচরগণও অবাক হয়ে গেছে, তারাও জানে না এই আলখেল্লার নিচে তাদের যে অধিনায়ক আছে কে সে? কি তার পরিচয়? একজন সত্তর বছর বয়সের বৃদ্ধ যে তাদের অধিনায়ক এটা তারা কেউ জানতো না। সবাই জানতে গ্রীণ হাউসের একজুন প্রধান অতিথি জনাব নিজাম হোসেন।

 শুধু অবাক হয়নি জনাব নিজাম হোসেন ওরফে রায় বাহাদুর শ্যামকান্তের প্রধান সহচর বা পার্টনার দেওজী সিং।

পাঠান ড্রাইভার এতোক্ষণে বুঝতে পারলো, আলখেল্লাধারী কেন তার সঙ্গে পেরে উঠছিলো না, বুদ্ধি-কৌশল-শক্তি দিয়ে পাঠান ড্রাইভারকে কাবু করতে চেয়েছিলো কিন্তু পাঠান ড্রাইভারের দেহের শক্তির কাছে কাবু হয়ে পড়েছিলো সে অল্পক্ষণেই।

মিঃ আহাদ বললেন–আশ্চর্য অধিনায়ক আপনি মিঃ নিজাম হোসেন। নিজের স্ত্রীর দেহের খোলসে সোনা চালান করে পৃথিবীতে স্বনামধন্য সোনা চোরাচালানি নামে খ্যাতি অর্জন করতে চেয়েছিলেন?সে আশায় আপনার ছাই পড়েছে। পাষন্ড শয়তান, একটা নিষ্পাপ সুন্দর জীবনকে এভাবে ধ্বংস করতে এতোটুকু মায়া হলো না? পুলিশবাহিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন–শুধু হাতে হাতকড়া লাগিয়ে নয়, প্রকাশ্য রাজপথে হাতে-পায়ে বেড়ী লাগিয়ে হাটিয়ে নিয়ে যাবে। বুকের সঙ্গে বেঁধে দেবে সাইন বোর্ড, তাতে লিখে দেবো-বিশ্বের প্রখ্যাত সোনা চোরাচালানি। এভাবে পুলিশ ফোর্স পরিবেষ্টিত অবস্থায় পুলিশ অফিসে নিয়ে যাবে। তারপর বিচার হবে।

 ততক্ষণে সমীর আর নূরীও এসে পড়েছে পুলিশবাহিনীর সঙ্গে সেই গুপ্ত রহস্যময় কক্ষে।

সমীর আর নূরী যেন এসব দেখে হাবা বনে গেছে। একটু পূর্বে যে মিসেস শোহেলীকে তারা হেসে হেসে কথা বলতে দেখেছে এই দন্ডে তাকে মৃত অবস্থায় কফিনের মধ্যে শায়িত দেখছে। কফিনের মুখ সম্পূর্ণ বন্ধ করা না হওয়ায় মিসেস শোহেলীর ফ্যাকাশে মুখখানার কিঞ্চিৎ দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলো।

অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো তারা কফিনটার ফাঁকে।

পাঠান ড্রাইভার তখন বলে আসার পর নূরী আর সমীর এক পাশে বসেছিলো চুপচাপ, বড় সাহেব কখন আসবেন সেই আশায়, বড় সাহেব ও আসেন না, তাদের যাওয়াও আর হয় না।

এতো কান্ডের মধ্যে বসে বসে দয়াময়ের নাম স্মরণ করছিলো সমীর আর নূরী, এমন সময় হুইসেলধ্বনি শুনতে পায় তারা। অনেকগুলি পুলিশ দ্রুত প্রবেশ করতে থাকে নাইট ক্লাবের ভিতরে।

পুলিশ দেখে সমীরের বুকে সাহস এসেছিলো, সেও নূরীসহ পুলিশবাহিনীর সঙ্গে এসে, পড়েছিলো এই গুপ্তকক্ষে। সমীর আর নূরী কম অবাক হয়নি– জনাব নিজাম হোসেনের হাতে এবং দেওজীর হাতে হাতকড়া দেখে বিস্মিত হয়েছিলো তারা। তবে ব্যাপারটা অল্পক্ষণেই বুঝে নিয়েছিলো ভালভাবে।

মিঃ হাফিজ এবার পাঠান ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বললেন–মিঃ চৌধুরী, আজ এই বিরাট সাফল্যের মূলে আপনার ড্রাইভার হাসান। তাকে সরকার থেকে আমরা পুরস্কারের ব্যবস্থা করবো।

মিঃ আহাদ চৌধুরী শুধু হাসলেন।

পাঠান ড্রাইভার তখন হেসে এগিয়ে এলো, নিজের মাথার পাগড়ি খুলে ফেললো এবং মুখে ফ্রেঞ্চকাটা দাড়ি-গোঁফও খুলে ফেললো।

কক্ষস্থ সবাই চমকে উঠলো।

মিঃ হাফিজ বললেন–মিঃ আলম আপনি! আপনিই মিঃ চৌধুরীর পাঠান ড্রাইভার সেজে– বিস্ময়ে কন্ঠ যেন রুদ্ধ হয়ে এলো তাঁর।

সমীরের চোখেও রাজ্যের আনন্দদ্যুতি খেলে যায়, সকলের অলক্ষ্যে একবার আলম আর নূরীর দৃষ্টি বিনিময় হয়। দৃষ্টির মাধ্যমে নূরী অভিনন্দন জানায় পাঠান ড্রাইভারকে।

 নুরী আর আলমের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাস অন্য কেহ লক্ষ্য না করলেও মিঃ আহাদের চোখে চাপা রইলো না, তিনি সব দেখলেন।

মিঃ হাফিজ বললেন–মিঃ আলম, সত্যি আপনার বুদ্ধির অদ্ভুত ক্ষমতা আমাদিগকে বিস্ময়াবিষ্ট করে দিয়েছে। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আপনার জন্যই আজ এতোবড় একটা ভয়ঙ্কর দুর্দান্ত সোনা চোরাচালানি দলকে আমরা গ্রেফতার করতে সক্ষম হলাম।

মিঃ আলম বললেন-ইন্সপেক্টর এই বৃদ্ধ শয়তান নিজাম হোসেন শুধু সোনা চোরাচালানকারীই নয়, এর আসল নাম রায় বাহাদুর শ্যামকান্ত–একজন নাম করা খুনীও বটে। সে আজ নিজ স্ত্রীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, এমনি আরও অনেক খুন সে করেছে–যা তার স্ত্রী মিসেস শোহেলী আমাকে জানিয়েছিলো ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে থাকাকালে। সেই থেকেই। আমার সন্দেহ জেগেছিলো–ঐ হোটেলে থাকাকালীনই আমি তাকে ফলো করি এবং গোপন রহস্যের সন্ধান পাই। একদিন নয়, এমনি কত দিন আমি তাকে অনুসরণ করেছি। কোনোদিন তার ড্রাইভারের বেশে, কোনোদিন তার চাকর রমেশের বেশে আমি রায় বাহাদুরকে ফলো করেছি এবং কাজ এতোদূর এগুতে সক্ষম হয়েছি—

মিঃ আলম যখন কঠিন কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলো তখন মিঃ আহাদ তার সুন্দর তেজোদ্দীপ্ত মুখমন্ডলের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়েছিলেন।

 মিঃ আহাদ মিঃ হাফিজ পুলিশ ফোর্সসহ সোনা চোরাচালানী দলকে যখন গ্রেফতার করে নিয়ে ফিরে চললেন তখন সকাল হয়ে গেছে।

মিঃ আলমের বুদ্ধি-কৌশলে উদ্ধার পেলো কোটি কোটি টাকার সোনা। আর ধ্বংস হলো এক দুর্ধর্ষ সোনা চোরাচালানী দল।

*

তেজগা বিমান বন্দর।

মিঃ আহাদ আর সমীর এসেছেন মিঃ আলম আর নূরীকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে।

প্লাটফরমে বোইং দাঁড়িয়ে, আকাশে উড়বার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। যাত্রীগণ আত্মীয়-স্বজনের কাছ হতে বিদায় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে প্লেনের দিকে। বোইং ছাড়বার সময় হয়ে এসেছে প্রায়।

মিঃ আলম আর নূরী প্লেনের দিকে এগিয়ে যাবার পূর্বে, নূরী মিঃ আহাদকে লক্ষ্য করে বললো–ভাইজান, এই নগণ্য বোনটিকে নিশ্চয়ই ভুলে যাবেন?

শান্ত গলায় বললেন মিঃ আহাদ–দূরী, তোমার মত বোন পেয়ে হারালাম, সত্যি আমি এ জন্যে অত্যন্ত দুঃখিত হচ্ছি। তোমাকে না পেলে আজ হয়তো এতোদূর এগুতে সক্ষম হতাম না। চিরদিন তোমার কথা স্মরণ থাকবে।

নূরীর চোখ দুটো ছলছল করছিলো, আঁচলে চোখ মুছছিলো সে।

সমীরের তো কথাই নেই, সে প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো–চলেই যদি যাবে তবে এতো মায়া বাড়িয়ে ছিলে কেন বলতো?

নূরী বলে–বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে সমীরবাবু।

মিঃ আলম হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে সমীরের পিঠে চাপড়ে বললো–গুড বাই সমীর বাবু। তারপর মিঃ আহাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো,তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে করতে বললো– গুড বাই মিঃ চৌধুরী চিরদিন আপনার কথা স্মরণ থাকবে।

মিঃ আহাদের কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে এলো অদ্ভুত এক সুর–বন্ধু, তোমাকেও আমি স্মরণ রাখবো, সবার চোখে ধূলো দিলেও আমার চোখে তুমি ধূলো দিতে পারোনি। তোমার মহান হৃদয়ের কাছে আমিও পরাজিত হয়েছি, তাই তোমার পরিচয় জেনেও আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম দস্যু বনহুর বিদায় বন্ধু—

মিঃ আহাদ এমনভাবে কথাগুলো বললেন একমাত্র মিঃ আলম ছাড়া কেউ শুনতে পেলো না।

মিঃ আলমবেশী দস্যু বনহুর চমকালো না, হেসে পুনরায় করমর্দন করলো সে প্রখ্যাত। ডিটেকটিভ আহাদ চৌধুরীর, তারপর নূরীর হাত ধরে এগিয়ে গেলো সে বোইং-এর দিকে।

সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে মিঃ আহাদ ও সমীরকে বিদায় সম্ভাষণ জানালো দস্যু বনহুর।

.

ফিরে এলো দস্যু বনহুর নূরীসহ তার নিজস্ব আস্তানায়। আবার আনন্দমুখর হয়ে উঠলো তার অনুচরগণ। সর্দারকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হলো সবাই।

একটা বড়রকম উৎসবের আয়োজন করলো তারা সকলে মিলে। বনহুরের আস্তানায় এ উৎসব হবে। মহাসমারোহে উৎসবের আয়োজন চলতে লাগলো। দস্যু বনহুরের আস্তানায় আনন্দ উৎসব–কম কথা নয়।

ভূগর্ভ দরবার কক্ষে বনহুর তার আসনে উপবিষ্ট।

অনুচরগণ সম্মুখে দন্ডায়মান।

রহমান বনহুরের আসনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

দরবার-কক্ষের চার কোণে চারটা মশাল দাউ দাউ করে জ্বলছে।

বনহুরের দেহে তার জমকালো ড্রেস। কোমরের বেল্টে রিভলভার। মশালের আলোতে চকচক করছে তার জমকালো ড্রেসটা। মাথায় পাগড়ি। সম্পূর্ণ কালো ড্রেসের মধ্যে দীপ্ত সুন্দর বলিষ্ঠ একখানা মুখ। গভীর নীল দুটো চোখে আজ অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে না। ঠোঁট দু’খানায় ক্রুদ্ধভাব ফুটে উঠেনি, মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠেছে দু’ঠোঁটের কোণে।

দরবার-কক্ষে আলোচনা চলছে।

বনহুর অনুপস্থিতকালে কি কি কাজ হয়েছে তারই হিসাব নিকাশ শুনছিলো সে। রহমানের পরিচালনায় তার আস্তানায় কোনো কাজ বাকি পড়ে নেই শুনে এবং দেখে আনন্দিত হলো বনহুর। খুশিমনে আনন্দ-উৎসব করার জন্যে আদেশ দিলো সে অনুচরদের মধ্যে।

দরবার-কক্ষ থেকে যখন বনহুর বেরিয়ে এলো তখন বৃদ্ধা দাইমা এসে দাঁড়ালো তার সম্মুখে।

রহমান বনহুরের পাশেই ছিলো, বললো–দাইমার একটা অনুযোগ আছে সর্দার।

বনহুর হেসে বললো কেমন আছো দাইমা।

অত্যন্ত বৃদ্ধা হওয়ায় দাইমার কথাবার্তা বেশ জড়িত হয়ে পড়েছিলো, বললো–ভালই তো আছি। কিন্তু আমার কথা কি ভাবিস তুই?

কে বললো তোমার কথা ভাবি না দাইমা?

তবে আমার কাছে যাস না, বসিস না, কথা বলিস না?

সময় পাই না বলে এসব ভুল হয় আমার, বুঝলে দাইমা? চলো আজ তোমার সঙ্গে বসে অনেক গল্প করবো। রহমানের দিকে তাকিয়ে বললো–কই নাসরিনকে তো দেখছি না?

দাইমা ফোকলা মুখে একবার একরাশ হাসি টেনে বললো–সে খুব রেগে আছে তোর উপর।

কেন?

কতদিন পর আস্তানায় ফিরে এলি কারো সঙ্গে দেখাঁটি করলি না?

আজ কোথাও যাবো না দাইমা, তোমাদের নিয়েই কাটাবো। চলো দাইমা, আমরা সবাই মিলে তোমার ঘরে গিয়ে বসি। বনহুর আজ সত্যি ছোট্ট বালকের মত বৃদ্ধা দাইমাকে অনুসরণ করলো।

পাথরের তৈরি মাঝারি কুঠরী। দড়ির খাটিয়ায় শোয় বৃদ্ধা দাইমা। বনহুর আর দাইমা খাটিয়ায় বসে। রহমান চলে যায় নাসরিনের খোঁজে। একটু পরে ফিরে আসে নাসরিনকে নিয়ে।

বনহুর তাকায় রহমান আর নাসরিনের দিকে।

এখন নাসরিন রহমানের স্ত্রী।

 বনহুর হেসে বলে–পালিয়ে বেড়াচ্ছো কেন নাসরিন?

কই না তো।

 তবে যে বড় দেখলাম না তোমাকে এসে অবধি?

 নাসরিন লজ্জায় মাথা নত করে দাঁড়ালো?

বনহুর বললো–বসো তোমরা, আজ তোমাদের সঙ্গে কাটাবো বনহুর কথার ফাঁকে খুঁজছিলো আর একজনকে সে হলো নূরী।

নূরী কোথায় বলতে আজ বাধছিলো বনহুরের, বিশেষ করে রহমান আর দাইমার সামনে।

 দাইমা বললো–বড় রোগা হয়ে গেছিস বনহুর।

 দেহের দিকে তাকিয়ে বললো বনহুর–কই, না তো?

দাইমার কথায় মায়ের মুখখানা খানিকের জন্য ভেসে উঠলো বনহুরের চোখের সম্মুখে তার মাও এমনি করে বলেন যদিও তার স্বাস্থ্য পূর্বের চেয়ে এখন আরও অনেক ভাল হয়েছে।

বৃদ্ধা বনহুরের বুকে হাত বুলিয়ে বললো–নিজের চোখে নিজকে ভালই মনে হয়, বুঝলি? আমি ছোট থেকে মানুষ করেছি, আর আমি জানি না তোর শরীরের কথা? বনহুর।

বলো দাইমা?

একটা কথা তোকে অনেকদিন থেকে বলবো বলবো করে বলা হয়নি।

 আজ বলো?

 রাখবি তো বাবা আমার কথা?

 কেন রাখবোনা দাইমা যা চাইবে তাই দেবো তোমাকে।

একটা ব্যথা-করুণ হাসির আভাস ফুটে উঠলো দাইমার ঠোঁটের কোণে, দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে বললো–কিছু নেবার বয়স কি আর আমার আছে বাপ। এখন নিবি তোরা। আমি বলছিলাম কি বয়স হয়েছে, এবার বিয়ে থা করে সংসারী হও।

হাসলো বনহুর, তাকালো একবার রহমান ও নাসরিনের মুখের দিকে।

দাইমা অবশ্য ভুল বলেনি কিছু, কারণ বনহুরের সঙ্গে মনিরার বিয়ে হয়েছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে। শুধু চৌধুরীবাড়ির কয়েকজন আর বনহুরের অনুচরদের মধ্যে কয়েকজন বিশিষ্ট অনুচর ছাড়া কেউ জানে না এ বিয়ের কথা। বনহুর শুধু মনিরাকে বিয়েই করেনি, তাদের এক সন্তানও হয়েছে। তাছাড়াও নূরীর প্রেম, প্রীতি আর ভালোবাসা তাকে রেহাই দেয়নি। যতই বনহুর নূরীর কাছ থেকে নিজকে সংযত রেখেছে ততই একটা পবিত্র আকর্ষণ তাকে অহরহঃ হাতছানি দিয়ে ডেকেছে, বনহুর উপেক্ষা করেছে সে আকর্ষণকে–মনকে শক্ত করে নিয়েছে কঠিনভাবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত হার হয়েছে বনহুরেরসূরী জয়ী হয়েছে।

রহমান খোদাকে সাক্ষী রেখে নূরীকে তুলে দিয়েছিলো তার হাতে লৌকিকতাপূর্ণ বিয়ে তার নৃরীর সঙ্গেও হয়নি। বনহুর দাইমার কথায় দৃষ্টি নত করে নেয়, কি জবাব দেবে ভেবে পায় না।

রহমান বুঝতে পারে সর্দার বিব্রত বোধ করছে। তাই সে বলে–দাইমা, তুমি কি কোনো মেয়ে পছন্দ করে রেখেছো?

পছন্দ শুধু অমি করব কেন, পছন্দ তোমরা সবাই করবে-নূরীকে আমি মানুষ করেছি ওর : জন্যই তো।

আর একবার বনহুর আর রহমান দৃষ্টি বিনিময় হলো।

বললো রহমান–তুমি যদি ভালো মনে করো তবে তাই হবে।

না, আমি ওর মুখে শুনতে চাই। বল বনহুর তুইতো রাজি আছিস বাপ?

 বনহুর একটু হেসে বলে–হ রাজি।

আমার গা ছুঁয়ে শপথ কর তবে?

বনহুর দাইমার হাতের উপর হাত রাখে।

দাইমা বনহুরের হাতখানা মুঠোয় চেপে ধরে বলে–সত্যি আমি কত খুশি হয়েছি আজ। জানিস, নূরী তোকে কত ভালবাসে। ছোটবেলা থেকেই সে তোকে স্বামী বলে মেনে নিয়েছে। না না, পারবি না পারবি না ওকে গ্রহণ না করে।

এই কথা আদায় করার জন্য তুমি বুঝি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলে দাইমা?

হাঁ বাপ, হাঁ। কবে মরে যাবো, বড় সখ তোর বিয়েটা দেখে যাবো।

তাহলে এখন উঠি কেমন? বনহুর দাইমার পিঠে হাত বুলিয়ে বললো।

দাইমা বনহুরের একখানা হাত নাড়তে নাড়তে বললো–কত ছোট ছিলি–আজ কত বড় হয়েছিস! এই হাতখানা কত ক্ষুদে ছিলো, একদিন আমার হাতের মুঠায় মিশে থাকতো আর আজ আটে না। ভাল করে দেখতে পাই না তাই মন ভরে না তোকে দেখে। যা বাবা যা আজ আমি অনেক খুশি হয়েছি।

বনহুর দাইমার কাছে বিদায় নিয়ে ফিরে আসে নিজের বিশ্রাম কক্ষে।

এতোক্ষণ নূরীকে না দেখে অবাক হয় বনহুর।

 তার বিশ্রামকক্ষেও নূরী নেই, তবে গেলো কোথায়!

আস্তানা থেকে বেরিয়ে এগিয়ে যায় বনহুর ঝরণার ধারে। দ্বিপ্রহরের খররৌদ্রে বনভূমি– আলোকিত। ঝরণার পাশে এসে দাঁড়ায় বনহুর, হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে যায় ঝরণার জলে। বিস্মিত না হয়ে মুগ্ধ হয় বনহুর-পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরণাটা নিচে নেমে এসেছে। তারপর ঠিক নদীর আকারে বয়ে গেছে বনভূমির মাঝখান দিয়ে। দু’পাশে বড় বড় বৃক্ষলতা গুল্ম মাঝখানে ঝরণা। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলোকরশ্মি ঝরণার জলে সোনালী সাপের মত খেলা করছে–তারই ফাঁকে সাঁতার কাটছে পাহাড়িয়া মেয়ে নুরী।

বনহুর তীরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক নয়নে।

আপন মনে সাঁতার কাটছে নূরী, কতকগুলি রাজহাঁস তার চারপাশে সাঁতার কাটছে–যেন ওরা খেলা করছে একসঙ্গে।

 ঝরণার সচ্ছ সাবলীল জলধারায় নূরীর যৌবনভরা দেহখানা যেন অপূর্ব লাগছিলো।

হঠাৎ নূরীর দৃষ্টি চলে আসে বনহুরের দিকে।

লজ্জায় কুঁকড়ে যায় না নূরী বরং খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠে সে। দু’হাত প্রসারিত করে ডাকে–হুর, চলে এসো।

নূরীর আকুল আহ্বান বনহুরকে চঞ্চল করে তোলে গা থেকে জামাটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝরণার বুকে। সাঁতার কেটে এগুতে থাকে নূরীর পাশে।

নূরী ডাকলো বটে কিন্তু সে তাকে ধরা দিতে রাজি নয়। বনহুর যতই এগোয় নূরী বিপরীত দিকে সাঁতার কেটে ততই সরে যায়। বনহুর ধরতে পারে না ওকে। নূরী জংলী পাহাড়ী মেয়ে সাঁতারে সে দক্ষ। বনহুরও কম নয়, ছোট বেলায় ঝরণায় সাঁতার কাটা ছিলো তার নেশা। নূরী যতই দ্রুত সাঁতার কেটে বনহুরের কাছ থেকে দূরে সরে যাক কিন্তু পারে না, বনহুর ওকে ধরে ফেলে খপ করে।

হাঁসগুলো এতক্ষণ আলগোছে নূরীর ঠিক পাশে পাশে সাঁতার কাটছিলো, এবার পাখা ঝাঁপটা দিয়ে সরে যায়।

 বনহুর নূরীকে বাহুবন্ধনে বেঁধে ফেলে।

নূরীর কোমল সিক্ত দেহখানা বনহুরের বলিষ্ঠ বাহুর নিষ্পেষণে রাঙা হয়ে উঠে, বলে নূরী আঃ বড্ড দুষ্ট তুমি।

বলো আর পালাবে?

উঁ হুঁ ছেড়ে দাও, আর পালাবো না।

রাজহাঁসগুলো আবার ঘিরে ধরে ওদের দুজনাকে। বনহুর একটা রাজহাঁসের বাচ্চা নিয়ে নূরীর কাঁধে বসিয়ে দেয়–বাঃ চমৎকার লাগছে।

যাও! হাঁসের বাচ্চাটা বনহুরের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দেয় নূরী।

বনহুর বলে–একটা জরুরি কথা আছে তোমার সঙ্গে।

 জরুরি কথা?

হাঁ।

কোনো মন্দ কথা নয় তো? আশঙ্কাভরা কণ্ঠে বলে নূরী।

বনহুর আর নূরী তখন ঝরণার মধ্যে বুক অবধি জলে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো।

 বনহুর তীরের দিকে এগুতে এগুতে বললো–বড় মন্দ কথা থাক, না শোনাই ভাল।

 নূরী বনহুরের হাতখানা এঁটে ধরে–কি কথা বলো?

না বলবো না।

 ছাড়বো না তোমাকে। বলো হুর? নূরী দু’হাতে বনহুরের কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরে।

বনহুর নূরীর কপাল থেকে ভিজে চুলগুলো আংগুল দিয়ে সরিয়ে দিতে দিতে বলে–দাইমার আদেশ, তোমার কাছ থেকে আমাকে দূরে সরে থাকতে হবে।

মুহূর্তে বিবর্ণ হয় নূরীর মুখমন্ডল–সে জানে, দাইমা তাদের আস্তানার একজন প্রবীণা। কারো কথা বনহুর না মানলেও দাইমার কথা সে সহসা উপেক্ষা করতো না কোনোদিন। দাইমাও তো বনহুরকে মানুষ করেছে মায়ের মত স্নেহ-আদর দিয়ে। নূরীর কথাটা বিশ্বাস হলো, কারণ পূর্বে একবার নূরী আর বনহুরকে নিয়ে বেশ একটা আলোড়ন শুরু হয়েছিলো আস্তানায়। হয়তো দাইমা আবার এই ব্যাপার নিয়ে রাগান্বিত হয়েছে ভীষণভাবে।

প্রায় কাঁদো কাঁদো সুরে বললো নূরী–আমাকে দূরে সরিয়ে দেবে হুর?

না দিয়ে তো কোনো উপায় দেখছি না নূরী?

নূরী ব্যাকুলভাবে বনহুরের হাত দু’খানা চেপে ধরে–হুর!

 এবার হেসে উঠে বনহুর –ঠিক তার উল্টো।

মানে?

 মানে তোমাকে এখন থেকে দাইমা তার কাছে শোবার জন্য জায়গা দেবেন না।

এসব কি বলছো হুর?

এতো সহজ কথাটা বুঝতে পারছো না?

না।

 চলো তীরে গিয়ে বসি?

 চলো।

ঝরণার তীরে এসে পাশাপাশি বসে ওরা। নূরী নিজের ওড়নাখানা ভাল করে নিংড়ে নিয়ে বনহুরের ভিজে চুলগুলো বেশ করে মুছে দেয়, তারপর আংগুল দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বলে–বলো?

বনহুর আর নূরী ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে।

বনহুর বলে-দাইমার আদেশ আমাকে বিয়ে করতে হবে।

বিয়ে।

হাঁ। আমি যে শুধু একটি নয়, দুটি মেয়ের নাগপাশে আবদ্ধ হয়েছি, এ কথা দাইমা জানে না। জানে না বলেই সে আমাকে ধরে বসেছে বিয়ে করতে হবে।

এবার হাসে নূরী–বেশ তো, আর একটি নারীকে নতুন করে বৌ বানিয়ে নিয়ে এসো হুর?

সর্বনাশ, দু’জনার মান-অভিমান ভাঙতেই আমার অবস্থা কাহিল আবার? তা ছাড়া দাইমার পছন্দ-করা মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে।

দাইমার পছন্দ-করা মেয়ে?

হাঁ, আর সে মেয়ে হলে তুমি। নূরীর বুকে আংগুল রেখে দেখালো বনহুর। একটু থেমে বললো–লৌকিকতাপূর্ণ বিয়ে, যা আমাদের দুজনার হয়নি।

নূরী লজ্জায় মাথাটা নিচু করলো।

বনহুর বললো–দেখলে দূরে সরে যাওয়া তো দূরের কথা, তোমাকে আর আমাকে আরও নিবিড় করে বাঁধবার আয়োজন চলছে।

নূরী আনন্দে অধীর হয়ে বনহুরের প্রশস্ত লোমশ বুকে মাথা রাখে, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে– হুর।

 বনহুর ওর চিবুক ধরে উঁচু করে তোলে নূরী তুমি কাঁদছো? তোমার চোখে পানি কেন।

হুর, আমার মনে যে আনন্দ হচ্ছে তা তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না।

তাই চোখের পানিতে আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করছে বুঝি?

চলো, ফিরে যাই।

 বনহুর উঠে দাঁড়ালো–চলো।

আস্তানায় ফিরে নূরী বনহুরকে নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়ে বললো-যাও হুর মনিরা আপার সঙ্গে দেখা করে এসো গে।

আজই তো আস্তানায় এলাম, কাল না হয় যাবো?

না, তা হয় না, তুমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফিরে এসো হুর, তারপর—ফিক করে হাসে নূরী বনহুরের দুষ্টামিভরা চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে।

বনহুর নূরীকে ধরতে চায় কিন্তু ধরতে পারে না, ছুটে বেরিয়ে যায় নূরী কক্ষ থেকে।

রহমান বাইরে এসে দাঁড়ায়–সর্দার!

বনহুর বলে–এসো রহমান।

সর্দার, তাজ প্রস্তুত।

তাজকে প্রস্তুত করার জন্য কে নির্দেশ দিয়েছিলো রহমান?

 নূরী। নূরী বলেছিলো আপনি কান্দাই শহরে যাবেন।

হাঁ যাবো। একবার মনিরার সঙ্গে দেখা করে আসি। রহমান?

বলুন সর্দার?

বসো, কথা আছে কয়েকটা।

 বনহুর বসলো, রহমানও আসন গ্রহণ করলো, এবার।

রহমান ভাবছে কি এমন কথা আছে হঠাৎ এই অসময়ে। প্রশ্ন ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায় সে সর্দারের ভাবগম্ভীর মুখমন্ডলে।

বনহুরের কপালে চিন্তারেখাগুলো দড়ির মত ফুলে উঠে। কি যেন ভাবে সে চোখ দুটো নিচের দিকে রেখে। তারপর হঠাৎ করেই বলে উঠে–রহমান চৌধুরী বাড়ি যাওয়া আমার এখন বড় মুস্কিল হয়ে পড়েছে।

সর্দার।

হাঁ রহমান কারণ নূর এখন বুঝতে শিখেছে জানতে শিখেছে। আমি চাই না নূর আমার পরিচয় জানুক।

সর্দার, চিরদিন আপনি—

হাঁ রহমান, নূরের কাছে আমি চিরদিন আত্মগোপন করে থাকবো। আমি চাই না নূর আমার মত উচ্ছল হোক। আমি চাই না নূর আমার মত মায়ের বুকে ব্যথা দিক। আমি চাই না তার জন্যে তার মা অশ্রু বিসর্জন করুক। না না, তা হয় না, আমি নিজকে কঠিন করে নিয়েছি রহমান, আমি নিজেকে কঠিন করে নিয়েছি। নূর জানে তার পিতা কোথাও গেছে–

সর্দার, আমাকে সে কতদিন বলেছে-কাক্কু, আমার বাপু আর আসে না কেন?

তুমি কি জবাব দিয়েছো রহমান?

 বলেছি তুমি যখন বড় হবে, লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে তখন তোমার বাপু আসবেন।

ভালোই বলেছো। কিন্তু আমি ভাবছি, মনিরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা আমার দুরূহ হয়ে উঠেছে।

সর্দার বৌরাণী যে আপনার জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত আর চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। বৌরাণীর দুঃখ আমার আর সহ্য হয় না সর্দার। আপনি তার সঙ্গে দেখা করুন।

দেখা তো করবো, ভাবছি হঠাৎ যদি নূর আমাকে দেখে ফেলে?

 দেখলে আপনাকে চিনবে না সে, কত ছোট্টটি সে দূরে সরে পড়েছে আপনার কাছ থেকে।

হাঁ, সে কথা সত্য নুর আমাকে দেখলে চিনবে না। কারণ বহুদিন সে আমাকে দেখেনি-তার বুদ্ধি হবার পর থেকে। কিন্তু সে যদি তার মায়ের কাছে আমাকে কথা বলতে দেখে তাহলে তার কচি মনে—না না রহমান, আমি চৌধুরী বাড়ি যেতে পারবো না।

সর্দার, আপনি এক কাজ করুন।

বলো রহমান?

আপনি আত্মগোপন করে না গিয়ে প্রকাশ্যে চৌধুরী বাড়ি যান। বৌরাণী আর আম্মাকে বারণ করে দেবেন তারা যেন নূরের কাছে আপনার আসল পরিচয় না দেন। চৌধুরী বাড়িতে আপনার পরিচয় কেউ জানে না আম্মা, বৌরাণী আর সরকার সাহেব ছাড়া।

ঠিক বলেছো রহমান। বনহুরের মুখে প্রসন্ন ভাব জেগে উঠে।

রহমান খুশি হয়।

*

কান্দাই শহরের জর্দানা পথটা সবচেয়ে নির্জন, জনবিহীন পথ বললেই চলে। বনহুরের অশ্ব এ পথেই এগিয়ে চলেছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ পথ ঝাপসা অন্ধকার হয়ে এসেছে। এ পথে যানবাহনও খুব কমই চলাফেরা করে কাজেই এ পথটাই বনহুরের শহরে আসার একমাত্র নিরিবিলি পথ।

শুধু আজ নয় বহুদিন বনহুর জর্দানা পথ দিয়ে এসেছে–আবার ফিরে গেছে। জানা কান্দাই হয়ে চলে গেছে ফুলার দিকে। ফুলাগু যাওয়া বিভিন্ন পথ এবং উপায় থাকায় এ পথে। লোকজন বড় একটা পা বাড়ায় না। অবশ্য কারণও আছে–পথটা অত্যন্ত দুর্গম এবং ভয়াতুর। এ পথে চলতে গেলে চোর-ডাকাত বদমাইশের কবলে পড়া অস্বাভাবিক নয়। তাই সহসা কোনো পথিককে এ পথে দেখা যায় না।

বনহুরের অশ্ব তাজ উল্কা বেগে ছুটছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা মোটর গাড়ি বেগে চলে গেলো বনহুরের অশ্বের পাশ কেটে। গাড়িখানার চলার গতি দেখে বনহুরের মনে কেমন যেন সন্দেহের দোলা জাগলো। তাজের লাগাম টেনে ধরলো বনহুর, পরমুহূর্তে তাজের মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গাড়িখানাকে উদ্দেশ্য করে ছুটলো, গাড়িখানা তখন বহুদূরে এগিয়ে গেছে। ঘন্টায় পঞ্চাশ মাইলের বেশি বেগে গাড়িখানা চলছে।

বনহুর তাজের লাগাম টান দিয়ে বললো–তাজ, যেমন করে হোক গাড়িখানা ধরতেই হবে।

তাজ যেন প্রভুর কথা বুঝতে পারলো, তার চলার গতি বেড়ে গেলো আরও দ্বিগুণভাবে।

পথ সোজা, তাই গাড়িখানা দৃষ্টির আড়ালে অন্তর্ধান হতে পারলো না। তীব্র গতিতে গাড়িখানা সরে যাচ্ছে। হয়তো বুঝতে পেরেছে অশ্বারোহী তাদের গাড়ি ফলো করছে।

বনহুরের অশ্ব তাজ, যে কোনো যানবাহনের চেয়ে তার গতি কম নয়। প্রভুর উদ্দেশ্য তাকে সফল করতেই হবে।

বনহুর প্রায় গাড়িখানার ক:ছাকাছি এসে পড়েছে। গর্জে উঠলো বনহুরের রিভলভারখানা।

সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখের গাড়ির পিছন চাকা ফেঁসে যাওয়া বেলুনের মত চুপসে গেলো। থেমে গেলো গাড়িখানা।

বনহুর তাজের পিঠ থেকে নেমে পড়ার পূর্বেই গাড়ির দরজা খুলে কয়েকজন গুন্ডার মত লোক নেমেই পালাতে গেলো। একজনের কোলে একটা শিশু-বছর ছ’সাত হবে।

 মুহূর্ত বিলম্ব হলো না বনহুর ঝাঁপিয়ে পড়লো লোকগুলোর উপর। এক-এক ঘুষিতে এক-এক জনকে ধরাশায়ী করলো। উঠি পড়ি করে কে কোন দিক পালালো তা ঠিক নেই। যে লোকটা ছোট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে পালাতে যাচ্ছিলো, বনহুর পিছন থেকে জামার কলার টেনে ধরলো, সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটাকে ওরা কাছ থেকে টেনে নিয়ে এক ঘুষি বসিয়ে দিলো লোকটার নাকে।

 লোকটা প্রথমে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো, তারপর উঠেই দিলো ভো দৌড়। কে কোন্ দিকে পালালো তার ঠিক নেই। নিমিষে গাড়িখানা আশেপাশে জনশূন্য হয়ে পড়লো। গুদল হাওয়ায় উড়ে গেছে যেন।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে আসায় সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো না। বনহুর এবার কোলের বাচ্চাটার প্রতি লক্ষ্য করলো। এতোক্ষণ ছেলেটা কোনো শব্দ করছে না বলে অবাক হয়ে গিয়েছিলো, এবার দেখলো, ছেলেটার মুখ রুমাল দিয়ে বাঁধা রয়েছে। দ্রুতহস্তে বাচ্চার মুখের বাধন মুক্ত করে দিয়ে ভাল করে তাকালো বনহুর, গাড়ির সার্চলাইটের আলোতে চমকে উঠলো~ এ যে তারই সন্তান নূর! সঙ্গে সঙ্গে নিজকে সংযত করে নিলো বনহুর। সে চিনতে পারলেও নূর তাকে চিনতে পারেনি, কারণ বহুদিন পূর্বে নূরের দৃষ্টির আড়ালে সরে পড়েছে সে। বনহুর নিজেও আজ নূরকে চিনতে পারতো না, যদি না সে মাঝে মাঝে তাকে নিদ্রিত অবস্থায় দেখে থাকতো।

নূরের মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে শান্ত স্বরে বলে–খোকা, তোমার নাম কি?

কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে–আমার নাম নূর, ভালো নাম মাসুম চৌধুরী।

 এদের হাতে কি করে পড়েছিলে?

 বাগানে খেলা করছিলাম, ওরা সেই সময় আমাকে ধরে এনেছে। আমার মা অনেক কাঁদছে—তুমি কে? আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো—কেঁদে ফেললো নূর ফুঁপিয়ে।

 বনহুর পারলো না নিজেকে সংযত রাখতে, ওকে চেপে ধরলো বুকে আদর করে মাথায় পিঠে হাত বুলাতে লাগলো।

নূর তো অবাক হয়ে গেছে, ওরা তাকে কত কষ্ট দিয়ে মুখ বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিলো, একটুও তো আদর করেনি–আর কে এই লোকটা যে তাকে গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছে, তারপর বুকে চেপে কত আদর করছে। নূর যেন হতভম্ভ হয়ে পড়ছে একেবারে। নূর লোকটাকে ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না তবু বুঝতে পারছে লোকটা খুব ভাল মানুষ। অন্ধকারেই অবাক হয়ে দেখছে তাকে–মোটরের সার্চলাইটের আলোতে অবাক হয়ে দেখছে তাকে মোটরের সার্চলাইটের আলোতে যতটুকু দেখলো কচি নূরের কাছে বড় ভাল লাগলো ওকে, বড় সুন্দর লাগলো।

বনহুরের সম্বিৎ ফিরে এলো, এখানে এভাবে বিলম্ব করা উচিত নয়–বিশেষ করে নূরের জন্য। তাড়াতাড়ি নূরকে নিয়ে তাজের পাশে এসে দাঁড়ালো।

তাজ খুশিতে শব্দ করলো চিহি চিহি—

 বনহুর নূরকে কোলে করে তাজের পিঠে বসে লাগাম টেনে ধরলো।

তাজ এবার ছুটতে শুরু করলো।

 সাঁ সাঁ করে বাতাস বইছে-নূর কুঁকড়ে বসে আছে পিতার কোলের মধ্যে কিন্তু জানে না কার কোলে বসে আছে সে।

আকাশে ফুটে উঠলো অসংখ্য তারার প্রদীপ।

পথের অন্ধকার সচ্ছ হয়ে এসেছে অনেক, বনহুর অশ্বের গতি কমিয়ে দিলো কারণ প্রবল। বাতাসে নূরের হাড়ে কাঁপন ধরছে। বনহুরের হাতের মধ্যে থরথর করে কাঁপছে নূরের ছোট্ট দেহটা ঠান্ডায় না ভয়ে তা ঠিক বুঝা যাচ্ছে না।

বনহুর বললো-নূর, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি?

শীত করছে আমার।

এই তো আর বেশি পথ নেই, এসে পড়েছি প্রায় তোমাদের বাড়িতে।

 তুমি আমাদের বাড়ি চিনলে কি করে?

নিজ সন্তানের প্রশ্নে হকচকিয়ে গেলো বনহুর, নূরের কথায় হঠাৎ কোনো জবাব দিতে পারলো না, আমতা আমতা করে বললোনূর, আমাকে তুমি চেনো না, আমি কিন্তু তোমাকে চিনি। অনেকদিন আগে তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম।

আমাদের বাড়ি গিয়েছিলে তুমি?

হাঁ।

কেন গিয়েছিলে?

তোমার আব্বার বন্ধু আমি, তার সঙ্গেই তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। তখন তুমি খুব ছোটো ছিলে।

বনুহুরের কথায় খুশি হলো নূর বললো–তুমি আমার আব্বুর বন্ধু?

 হাঁ।

তোমার নাম কি বলো না?

 আমার নাম, আমার নাম—

ভুলে গেছো বুঝি?

 হা–না—মানে—

 মনে নেই এই তো?

ঠিক বলেছো নূর।

নিজের নাম কেউ ভুলে যায় বুঝি?

বনহুর এবারও বেশ ঘাবড়ে গেলো, ঢোক গিলে বললো–আমার নাম দুটো, কোনটা তোমাকে বলবো তাই ভাবছি।

দুটোই বলো? দেখলে না আমার দুটো নাম কেমন তোমাকে শুনালাম।

আচ্ছা বলছি। বনহুর ভাবে—এই নামের মধ্যেই তার নূর তাকে চিরদিন মনে রাখবে তাই যা তা একটা নাম চট করে বলতে পারে না।

কি ভাবছো?

ভাবছি তোমার বাসায় গিয়ে নামটা বলবো।

না, তা হবে না, তুমি এক্ষুণি বলো?

আমার নাম বড্ড খারাপ, তাই বলতে লজ্জা করছে।

কত সুন্দর তুমি, আর তোমার নাম অতো খারাপ কেন? যাক তুমি বলো আমার পছন্দ না হলে আমি পাল্টে রাখবো।

নিশাচর। আমার নাম নিশাচর–দেখলে কেমন বিশ্রী নামটা আমার।

ছিঃ! ছিঃ! এমন নাম তোমার বাবা-মা তোমাকে কেন দিয়েছিলো? বলল তোমার আর একটা নাম কি?

রাত চোরা!

এবার নূর হেসে উঠে বনহুরের কোলের মধ্যে, দুলে উঠে ওর কচি শরীরটা।

বনহুরও হাসে।

নূর বলে বলো না কেন এমন বিশ্রী নাম তোমার রেখেছিলো?

একটু ভেবে বলে বনহুর—-আমি রাতের বেলায় বেড়াতে ভালবাসি কি না, তাই আমার বাবা সখ করে আমার নাম রেখেছিলেন নিশাচর।

আর রাতচোরা নামটা তোমার কে রেখেছিলো?

আমার মা।

কেন? তুমি বুঝি রাতে চুরি করে খেতে?

ঠিক ধরেছো নূর। বাঃ! তুমি কেমন করে জানলে আমি রাতের বেলায় দুধ চুরি করে খেতাম?

এ তো রাতচোরা মানে রাতে যে দুধ চুরি করে খায়। জানো, আমার মা বলে–রাতচোরা পাখি আছে, তারা রাতে চোখে দেখে, দিনে অন্ধ হয়ে থাকে।

ঠিক তোমার মা আমার মতো পাখির কথা বলেছেন। আমিও রাতে চোখে দেখি, দিনে দেখি না।

হ্যাঁ কি বললে? তোমার অমন ডাগর ডাগর চোখ আর দিনে চোখে দেখো না? আচ্ছা মাকে বলববা তোমার কথা।

 তুমি যে আমার কি নাম দেবে বলেছিলে?

একটা ভালো নাম দিতে হবে তো? বাসায় নিয়ে চলো, মা আর দাদীকে বলে তোমার নতুন নাম দেবো।

তুমিই না হয় বুদ্ধি করে একটা নাম আমাকে দিলে?

 দাঁড়াও মনে করি। তুমি এবার জোরসে ঘোড়া চালাও দেখি।

ভয় করবে না তো তোমার?

 আমি ভয় করবো কি যে বলো? খুব জোরে চালাও।

 যদি পড়ে যাও?

 তোমার কোলে থাকতে কিছুতেই পড়বো না।

 নূরকে আরও নিবিড়ভাবে বুকে চেপে ধরে বনহুর। তাজ তখন দ্রুত ছুটতে শুরু করেছে।

অল্পক্ষণের মধ্যেই চৌধুরীবাড়ির সম্মুখে এসে তাজের পিঠ থেকে নেমে পড়লো বনহুর নূরসহ।

বনহুর নূরকে নামিয়ে দিতেই বলে উঠে নূর–তোমার নাম আমি চাঁদ রাখলাম।

হেসে উঠলো বনহুর, সে ভেবেছিলো নূর এতোক্ষণে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভুলে বসে আছে। কিন্তু আশ্চর্য সে ভোলেনি এতোটুকু; ভেবেছে কি নাম দিলে ওকে সুন্দর মানাবে। কচি নূরের কাছে সবচেয়ে প্রিয় আর সুন্দর বুঝি চাঁদ তাই সে ঐ নামটাই তার জন্য খুঁজে খুঁজে বেছে নিয়েছে।

বনহুর বললো–বেশ তাই হবে।

 নূর বনহুরের কোল থেকে নেমে ছুটে যায় অন্দর বাড়ির মধ্যে।

চৌধুরী বাড়িতে তখন গভীর একটা শোকের ছায়া নেমে এসেছে, বিকেলে বাগানে খেলা করার সময় কে বা কারা নূরকে চুরি করে নিয়ে গেছে। সমস্ত শহর তন্ন তন্ন করে খোঁজ করা। হয়েছে কোথাও নূরের সন্ধান পাওয়া যায়নি। মরিয়ম বেগম একমাত্র নাতির অন্তর্ধানে পাগলিনী হয়ে পড়েছেন। কাকে কোথায় পাঠাচ্ছেন তার ঠিক নেই। তিনি সবাইকে বলেছেন যে আমার নাতি নূরকে এনে দেবে তাকে আমার যথাসর্বস্ব বিলিয়ে দেবো।

বৃদ্ধ সরকার সাহেব লোকজন নিয়ে শহরে ঢেরা পিটিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন। নূরের চেহারা বর্ণনা করে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এসেছেন।

মনিরা তো একেবারে পাথরের মূর্তি বনে গেছে। নীরবে শুধু অশ্রু বিসর্জন করে চলেছে, মুখে তার কোনো কথা নেই।

হঠাৎ তার কানে যায় নূরের কণ্ঠস্বর–আমি আম্মি আমি এসেছি, আমি এসেছি—

 মনিরার চোখমুখ মুহূর্তে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে, অস্ফুট ধ্বনি করে উঠে–বাপ নূর নূর—-ওরে নূর তুই এসেছিস ছুটে বেরিয়ে আসে মনিরা ঘরের ভিতর থেকে।

মরিয়ম বেগম তখন এশার নামায পড়ছিলেন খোদার কাছে তিনি কেঁদে কেঁদে মোনাজাত করছিলেন একমাত্র বংশপ্রদীপকে ফিরিয়ে দাও খোদা–নূরের কণ্ঠস্বর শোনামাত্র অনাবিল এক আনন্দ স্রোত বয়ে যায় তার অন্তরে।

মাকে জড়িয়ে ধরে নূর-আম্মি–

মনিরা পুত্রকে বুকে তুলে নিয়ে গলায় মুখে চুমা দিয়ে বলে–বাবা, কোথায় গিয়েছিলি? কে তোকে নিয়ে গিয়েছিলো?

 আম্মি, ডাকাত আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। হেঁ ইয়া মোটা লোকগুলো কি ভীষণ চেহারা

হায় হায় কি করে ফিরে এলি বাপ?

চাঁদ, চাঁদ আমাকে ডাকাতের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছে। জানো আম্মি, চাঁদের গায়ে ভীষণ। জোর। অনেকগুলো লোককে সে এক এক ঘুষিতে কাবু করে ফেলেছে। সবাই ভয় খেয়ে পালিয়ে গেলো চাঁদ আমাকে নিয়ে চলে এলো।

অবাক কণ্ঠে বললো মনিরা–চাঁদ! চাঁদ কে বাবা?

 চাঁদকে চেনো না আম্মি? চাঁদ আমার আব্বুর বন্ধু।

 তোমার আব্বুর বন্ধু–কে সে বাবা?

বললাম তো চাঁদ। এসো, চাঁদ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দেখা করবে না?

ততক্ষণে মরিয়ম বেগম এবং সরকার সাহেব এসে পড়েছেন নূরকে দেখতে পেয়ে সবাই খুশি হয়ে উঠেছেন। সকলের চোখে মুখেই আনন্দ উচ্ছ্বাস।

মনিরা বললো-মামীমা, নূরকে চাঁদ না কি নাম সেই নাকি উদ্ধার করে এনেছে। বাইরে চাঁদ দাঁড়িয়ে আছে দেখা করবে?

মরিয়ম বেগম নূরকে তুলে নিয়ে বুকে জাপটে ধরেন–দাদু! কোথায় গিয়েছিলি দাদু?

সরকার সাহেব বললেন–যাই দেখি কে সে—

 কথা শেষ হয় না, নূর মরিয়ম বেগমের কোল থেকেই বলে উঠে ঐ তো চাঁদ এসে গেছে।

 এক সঙ্গে সিঁড়ির নিচে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সবাই।

মুহূর্তে মনিরার চোখ আনন্দে স্ফীত হয়ে উঠে,দীপ্ত হয়ে উঠে তার মুখমন্ডল। স্বামীকে দেখবে সে ভাবতেও পারেনি এই ক্ষণে।

মরিয়ম বেগম উচ্ছল কণ্ঠে ডেকে উঠেন –বাবা মনির—

সঙ্গে সঙ্গে বনহুর ঠোঁটের উপর আংগুল চাপা দেয়, চুপ থাকতে ইংগিত করে সে।

বৃদ্ধ সরকার সাহেবের ঘোলাটে চোখে খুশির আলো জ্বলে উঠে যেন, তিনি মনে মনে খোদার দরগায় শুকরিয়া করেন। বহুকাল তিনি এ বাড়ির সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। নূর হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়ায় তিনি একেবারে মুষড়ে পড়েছিলেন। নূর এবং মনিরাকে এক সঙ্গে দেখে বুক ভরে উঠলো কানায় কানায়।

নূর মরিয়ম বেগমের কোল থেকে নেমে ছুটে গেলো বনহুরের পাশে চাঁদ এই দেখো আমার দাদী, এটা আমার মা।

 বনহুর শুধু হাসতে লাগলো।

সরকার সাহেব বললেন-নূর, চাঁদ ওর নাম কে বললো দাদু তোমাকে?

মনিরা তখন স্বামীর দীপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক নয়নে।

মরিয়ম বেগম বললেন–মনির—

বনহুর মায়ের কানের কাছে একটু নিচু হয়ে মুদৃস্বরে বললো–মা, ও নামে এখন ডেকো না। নূর আমার নাম চাঁদ দিয়েছে সেই নামেই ডাকবে। আমি চাই না নূর আমার পরিচয় জানতে– পারুক।

বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন মরিয়ম বেগম–বাবা—

মা—

চল ঘরে চল্ বাবা—

বনহুর নিচু স্বরে মায়ের সঙ্গে কথা বললেও মনিরা সব বুঝতে পারলো। পিতা-পুত্রের মধ্যে কোনো পরিচয় ঘটেনি এখনও এটাও সে বুঝতে পারলো সঠিকভাবে। বললো মনিরা–বাবা নূর, চাঁদকে তুমি ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাও। চাঁদ তোমাকে ডাকাতের কবল থেকে উদ্ধার করে এনেছে কম কথা নয়।

অবশ্য কথাটা বলতে মনিরার বুকের মধ্যে ভীষণভাবে ব্যথা লাগছিলো। পুত্রের কাছে। পিতার পরিচয় গোপন রাখতে হচ্ছে, এটা কি কম দুঃখ।

 মায়ের কথায় নূর খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠলো, বনহুরের হাত ধরে তাকে নিয়ে চললো বসবার ঘরের দিকে–এসো চাঁদ, আমার সঙ্গে এসো।

মরিয়ম বেগম বললেন–দাদু, তোমার আব্বুর বন্ধু তাকে হলঘরে বসাচ্ছো কেন? আমার ঘরে নিয়ে যাও।

দাদী, তুমি রাগ করবে নাতো?

না না, রাগ করবো কেন।

মরিয়ম বেগমের ঘরে পুত্র পিতাকে নিয়ে এসে বসালো। তারপর ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেলো মায়ের কাছে–মাম্মি, চাঁদকে কিছু খেতে দেবে না? চাঁদ আমাকে কত কষ্ট করে রক্ষা করেছে।

মরিয়ম বেগম বললেন–যাও বৌমা, ওর জন্য খাবার নিয়ে যাও। নূর, এসো দাদু, আমি তোমার চাঁদের পুরস্কারের জন্য কিছু নিয়ে আসি।

মরিয়ম বেগমের হাত ধরে বলে নূর–আমার চাঁদকে পুরস্কার দেবে দাদী?

 হাঁ, তোমাকে ডাকাতের হাত থেকে উদ্ধার করে এনেছে–পুরস্কার দিতে হবে না? কিন্তু কি দেই বলতো দাদু?

টাকা। দাদী, আমাদের তো অনেক টাকা আছে, ওকে বেশি করে টাকা দিয়ে দাও না।

টাকা ও নেবে না দাদু।

 তবে কি নেবে–দাঁড়াও আমি জিজ্ঞাসা করে আসি?

না না, এখন চলো, সরকার সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করিগে। মরিয়ম বেগমের উদ্দেশ্য নাতিকে ধরে রাখা। কতদিন পর স্বামীকে পেয়েছে মনিরা এ সময় নূরের সরে থাকাই প্রয়োজন কত কথা আছে দু’জনার মধ্যে।

এদিকে যখন নূর অর দাদী চাঁদের পুরস্কার নিয়ে চিন্তা করছে তখন মনিরা খাবার থালা নিয়ে স্বামীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। অভিমান ভরা কণ্ঠে বলে–পুত্রের কাছে পিতা হয়ে ছলনা– কতবড় নিষ্ঠুর তুমি। আকাশের চাঁদ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তাই তুমি নিজকে আকাশের চাঁদের মতই–

বনহুর মনিরাকে নিবিড় করে টেনে নেয়–তোমার কাছে নয়। স্ত্রীর রক্তিম গন্ডে ওষ্ঠদ্বয় রেখে বলে লক্ষীটি আমাকে ভুল বুঝো না।

 কিন্তু আজ তুমি কতখানি ভুল করলে জানো? চিরদিনের জন্য নূরের সামনে তুমি আমার কাছে পর হয়ে গেলে। ওর সামনে কোনোদিনই আমি তোমাকে নিজের করে ভাবতে পারবো না।

মনিরা জানোনা এতে তোমার চেয়ে বেশি ব্যথা পেয়েছি আমি। কতখানি নাচার হয়ে আমি আজ নূরের কাছে নিজেকে গোপন করলাম। মনিরা, আমাকে ক্ষমা করো তুমি।

স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে বলে মনিরা–এতদিন কোথায় ছিলে বলো তো?

 সে অনেক দূরে পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলাম। সে দেশের রূপ দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি যেমন, তেমনি হয়েছি মর্মাহত। নিরিবিলি বলবো একদিন সে দেশের কাহিনী।

মনিরা বললো–এবার খাও।

 মুখে উঠিয়ে না দিলে আমি খাবো না।

হাসে মনিরা–এখনও তোমার সেই ছেলেমানুষি গেলো না। নাও—খাবারের থালা থেকে খাবার তুলে স্বামীর মুখে তুলে দিতে থাকে।

বনহুর মনিরার হাত থেকে খাবার খেতে খেতে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে সে তার মুখের দিকে। মনিরা লজ্জাভরা কণ্ঠে বলে–কি দেখছো?

তোমাকে।

আমাকে দেখছো? কেন বলো তো?

কতদিন তোমাকে দেখিনি মনিরা। বনহুর মনিরাকে তার বলিষ্ঠ বাহু দু’টি দিয়ে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে।

মনিরা স্বামীকে লক্ষ্য করে বলে–এখন যদি নূর এসে পড়ে?

 মনিরা!

সে যদি কোনোদিন তোমার পাশে এমনি করে দেখে তবে চিরদিনের জন্য আমি তার কাছে। কলঙ্কিনী হয়ে যাব। একবার ভেবে দেখো কতবড় ভুল তুমি করেছো?

মনিরা, আমি নিরুপায় নিরুপায় হয়েই তো এ কাজ করেছি। নূরকে তুমি মায়ের ঘরেই রেখো।

মায়ের ঘরেই থাকে সে, তাই বলে চিরদিন তুমি চোরের মত পালিয়ে পালিয়ে আসবে আমার ঘরে?

মনিরা, আমার জীবন যখন স্বাভাবিক নয় তখন চোরের মত পালিয়ে আসা-যাওয়া ছাড়া কিই বা উপায় আছে বলো?

 মনিরা লক্ষীটি—বনহুরের পুরু ওষ্ঠদ্বয় মনিরার গোলাপী সরু ওষ্ঠদ্বয়ের উপরে নেমে আসে গভীর আবেগে।

এমন সময় নূরের চঞ্চল কণ্ঠ শোনা গেলো–চাঁদ চাঁদ তোমার পুরস্কার এনেছি—

 মনিরা স্বামীর সবল বাহু থেকে নিজকে দ্রুত মুক্ত করে নিয়ে সরে দাঁড়ালো।

নূর কক্ষে প্রবেশ করলো; তার পিছনে মরিয়ম বেগম। হাস্যোদ্দীপ্ত তাঁর মুখমন্ডল।

 নূর কক্ষে প্রবেশ করেই বললো–চাঁদ বলো তুমি কি নেবে?

মরিয়ম বেগম হেসে বললেন–ওকে তুমি রক্ষা করেছে বলে ও তোমাকে কিছু পুরস্কার। দিতে চায়–নাও চাঁদ।

বনহুর মায়ের মুখে তাকিয়ে হাসলো, তারপর নূরকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে চিবুকে মৃদু চাপ দিয়ে বললো–কি পুরস্কার দেবে নুর?

নূর হাত দু’খানা উঁচু করে বললো–এই থলে দুটোতে তোমার জন্য পুরস্কার এনেছি। একটি দেবো, দু’টি নয় বলো কোনটি তুমি নেবে?

বনহুর দেখলো, একটি থলে বেশ বড়োসড়ো আর একটি থলে খুব ছোট।

 বনহুর বুঝতে পারলো, বড় থলেটার মধ্যে টাকার গাদা আছে। আর ছোটটার মধ্যে কি আছে ঠিক বুঝা যাচ্ছেনা। বনহুর নূরের দক্ষিণ হাতখানা চেপে ধরলো–এর মধ্যে যা আছে তাই নেবো।

হেসে উঠলো নূর–তুমি বড় ঠকে গেছো চাঁদ।

নূর ছোট্ট থলেটার মুখ খুলে ফেললো–এটা আমার হাতের বাজুবন্দ। আমার আব্বুআমাকে দিয়েছিলো।

আনমনা হয়ে যায় বনহুর, একটু ভেবে বলে–এটা কেন দিচ্ছো নূর?

তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছো তাই আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা আমি তোমাকে দিলাম। জানো চাঁদ আমার আব্বু আমাকে সখ করে এটা তৈরি করে দিয়েছিলো। এই যে পাথর দেখছো এটার দাম অনেক অনেক টাকা—

 বনহুর নূরকে জাপটে ধরলো বুকের মধ্যে, চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো– তোমার সখের জিনিস আমি নিতে পারবো না নূর। ওটা তোমার হাতেই পরিয়ে দি।

না, তোমাকে নিতেই হবে ওটা। আর বলো আবার আসবে তো? আমার আব্বু এলে। তোমাকে দেখে অনেকে খুশি হবেন। আম্মি, চাঁদকে আবার আসতে বলে দাও না?

বনহুর একবার মা ও স্ত্রীর মুখে তাকিয়ে নিয়ে নূরকে আদর করে বললো– আসবো। কিন্তু এটা আমি নেবো না।

আমি তাহলে কাঁদবো।

মরিয়ম বেগম বললেন–ওর যখন এতো সখ তবে নাও চাঁদ।

বনহুর কিছুতেই যেন ধৈর্য ধরতে পারছিলো না, তাড়াতাড়ি বাজু বন্দটা পকেটে রেখে উঠে দাঁড়ালো–চললাম। খোদা হাফেজ।

বনহুর দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো।

 ছোট্ট নূরের মনটা সে অধিকার করে নিয়ে চলে গেলো নতুন মানুষ হিসাবে।

মনিরা নূরকে বুকে চেপে ধরলো।

 নূর মায়ের মুখে দৃষ্টি ফেলে বললো–আম্মি, তুমি কাঁদছো? চাঁদ খুব ভাল মানুষ, তাই না?

 হ বাবা। বললো মনিরা।

 মরিয়ম বেগম মনিরার কোলের কাছ থেকে নূরকে টেনে নিয়ে বললেন চল্ আমার ঘরে চল্ নূর।

মরিয়ম বেগমের সঙ্গে চলে গেলো নূর।

মনিরা নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়লো, বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

*

রাত গম্ভীর হয়ে এলো একসময়ে।

মনিরার চোখে তন্দ্রা নেমে আসে।

হঠাৎ কারো স্পর্শে তন্দ্রা ছুটে গেলো মনিরার, চোখ তুলে তাকাতেই ডিম লাইটের আলোতে স্বামীর দীপ্তমুখখানা নজরে পড়লো। খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠলো মনিরা, স্বামীর বুকের মধ্যে মুখ রেখে বললো–এতো কাঁদাতে পারো, তুমি?

মনিরা! ইচ্ছা করে আমি কাউকে কাঁদাই না।

বনহুর মনিরার অশ্রু হাত দিয়ে মুছে ললাটের চুলগুলো সরিয়ে দিলো আলগোছে।

বললো মনিরা–এমনি করে আর কতদিন কাটবে?

 যতদিন আকাশে চাঁদ হাসবে। সত্যি মনিরা নূরের দেওয়া নামটা আমাকে চাঁদের মতই  সচ্ছ করে দিয়েছে। জীবনে কত পাপ আমি করেছি কত পাপ—

এ সব আবার বলছো কেন? চুপ করো।

মনিরা, মাঝে মাঝে আমি যে কোথায় হারিয়ে যাই কোন অতলে তলিয়ে যাই, যেখানে কোনো সীমানা আমি খুঁজে পাই না।

ওগো কতদিন পর এসেছে, এ সময় যদি ব্যথা আর দুঃখের কথা নিয়েই কাটাবে তাহলে হাসবে কখন বলোত? কতদিন তোমার সেই হাসি দেখিনি।

মনিরা, তোমার পবিত্র পরশে আমার পাপগুলো ধুয়ে মুছে দাও। আমাকে পাপমুক্ত করে, দাও মনিরা….

মনির!

ডাকো, আর একবার ডাকো মনির বলে।

মনিরা, তুমি যে অতি পবিত্র–নিষ্পাপ…..

কিন্তু নিজকে পবিত্র, নিষ্পাপ রাখতে পারলাম কই। তোমার কাছে আমি চরম অপরাধী।

এ তুমি কি বলছো?

আমাকে তুমি ক্ষমা করো। আমাকে তুমি ক্ষমা করো মনিরা। তুমি নির্মল, নিষ্পাপ, পবিত্র, কেন আমি তোমার এই সুন্দর ফুলের মত জীবন……

মনিরা, স্বামীর মুখে হাতচাপা দেয়–না না, চুপ করো তুমি।

 মনিরা একটা কথা তোমাকে বলবো, আমার অপরাধ ক্ষমা করে দেবে তো?

না, আমি তোমার কোনো কথা শুনবো না। শুনতে চাই না।

আমি যে তোমাকে না বলে স্বস্তি পাচ্ছি না মনিরা?

কিন্তু আমি তোমার কোনো কথাই শুনতে রাজি নই।

না বললেই যে নয়!

পরে শুনবো, কতদিন পর আজ তোমাকে পেয়েছি, না জানি কি কথা শুনতে কি কথা শুনবো, হয়তো সহ্য করতে পারবো না!

মনিরা স্বামীকে ভাবাপন্ন হতে দেখে স্বামীর কণ্ঠ বেষ্টন করে একটা চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো।

মনিরা স্বামীকে ভাবাপন্ন হতে দেখে স্বামীর কণ্ঠ বেষ্টন করে বললো–কি ভাবছো এতো?

 কিছু না! বনহুর নিজকে প্রসন্ন করে নেওয়ার চেষ্টা করলো।

মনিরা স্বামীর বুকে মাথা রাখলো।

*

দাইমার নির্দেশে বনহুর নূরীকে গ্রহণ করলো স্ত্রী রূপে। মহা উৎসবের মধ্যে শেষ হলো দস্যু বনহুরের লৌকিকতাপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান। নূরী একান্ত নিজের করে পেলো এবার বনহুরকে।

সার্থক হলো আজ নূরীর জীবন।

সমস্ত আস্তানায় খুশির উৎসব বয়ে চললো। দাইমার কথায় অনুচরদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হলো বহু সোনাদানা আর খানাপিনা। যে যা খেতে চায় তাই তারা খেতে পেলো।

কান্দাই আস্তানা ছাড়াও বনহুরের আরও কয়েকটা আস্তানা ছিলো। কান্দাই শহরের প্রথম আস্তানা পুলিশ হস্তগত করে নেবার পর কান্দাই শহরের এক প্রান্তে একটি পোড়াবাড়ির অভ্যন্তরে বনহুর গভীর মাটির নিচে এ আস্তানা গড়ে তুলেছিলো। এখানে যারা থাকতো তারা শহরের সংবাদ সগ্রহ করতো নানা ছদ্মবেশে, জরুরি খবর হলেই ওয়্যারলেসে সংবাদ পাঠিয়ে দিতো বনহুরের কান্দাই জঙ্গলের ভূগর্ভস্থ আস্তানায়। বনহুর যে শয্যায় শয়ন করতো তার খাটের হাতলেই ছিলো। ওয়্যারলেস। বনহুর সঙ্গে সঙ্গে সংবাদ পেতে এবং সেভাবে কাজ করতো।

আরও কয়েকটা আস্তানা ছিলো, এগুলো কালু খাঁর মৃত্যুর পর বনহুর কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করেছিলো। বনহুরের পক্ষে সবগুলো আস্তানাঃ যাওয়া সম্ভব না হলেও যোগাযোগ ঠিকই ছিলো। ওয়্যারলেসে প্রতিটি আস্তানার সংবাদ সে সংগ্রহ করতো ঠিকভাবে এবং সেভাবে কাজ করতো।

বনহুরের অনুপস্থিতকালেও এসব আস্তানার কাজে কোনো গোলযোগ হতো না। রহমান সূক্ষভাবে পরিচর্যা করতো। এসব আস্তানার অনুচরগণ সবাই ছিলো অত্যন্ত বিশ্বাসী ও সাহসী। বনহুরের প্রধান আস্তানা হলো কান্দাই জঙ্গলের ভূগর্ভ জঙ্গল গড় আস্তানা। এটা কালু খা’র তৈরি আস্তানা। কান্দাই জঙ্গল ছোট-খাটো নয়, প্রায় হাজার মাইলব্যাপী এ জঙ্গল। কালু খাঁ জীবিতকালে কান্দাই জঙ্গলে পোড়াবাড়ির মধ্যে একটা আস্তানা গড়েছিলো। বিরাট আস্তানা–সেটা পুলিশ। ফোর্সের দ্বারা মিঃ জাফরী ধ্বংস করে ফেলেন। এ আস্তানা বিনষ্ট হওয়ায় বনহুরের ক্ষতি হয়েছিলো অনেক–কিন্তু তার পরপরই সে গড়ে নিয়েছিলো একটা নয়, কয়েকটা আস্তানা জবরু জঙ্গলে, নারুন্দী দ্বীপে, নগরগড় জঙ্গলে। প্রত্যেকটা আস্তানা বনহুর অত্যন্ত দক্ষ কারিগর মিস্ত্রি দ্বারা তৈরি করে নিয়েছিলো। শত চেষ্টাতেও এসব আস্তানার সন্ধান কোনো মানুষ পাবে না বা পেতে পারে না।

বনহুরের এই বিয়ের সংবাদ রহমান ওয়্যারলেসে তাদের সবগুলো আস্তানায় পৌঁছে দিলো। সর্দারের বিয়ের সংবাদ পেয়ে মহা ধুমধাম হলো সব আস্তানায়। নানারকম নাচ-গান চললো, খানাপিনাও হলো মহা সমারোহে।

 জংলী মেয়ে নূরীর বিয়ে!

নূরীর সহচরী নাসরিন, সুরাইয়া, জেরিনা, এরা নূরীকে আজ ফুলে ফুলে ফুলরাণী সাজালো। হাতে-খোঁপায়-গলায়-মাজায় শুধু ফুল আর ফুলের গহনা।

তেমনি ফুল দিয়ে সাজালো তারা তাদের সর্দারের কক্ষটাকে–বাসরঘর হিসাবে যে কক্ষটা আজ ব্যবহার করবে দস্যু বনহুর। সভ্য-জগতের বেলী, চামেলী, গোলাপ নয়–বনফুল দিয়ে সাজানো হলো সব।

সহচরী পরিবেষ্টিত হয়ে নুরী যখন বাসরকক্ষে প্রবেশ করলো তখন তার অন্তরে এক অপূর্ব শিহরণ বয়ে গেলো। এই রাত তার কত কামনার, কত সাধনার, কত কল্পনার! নূরী ফুল দিয়ে সাজানো বাসরকক্ষে প্রবেশ করে থমকে দাঁড়ালো।

 সহচরীগণ তাকে বাসরকক্ষে দিয়ে চলে গেলো।

নূরীর পরনে ঘাগড়া, গায়ে পাঞ্জাবী ধরনের জামা। আর ওড়না। ওড়নায় ঘোমটা দেওয়া। মুখমন্ডল। মশালের আলোতে নূরীকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আজ।

এগিয়ে আসে বনহুর নূরীর পাশে।

আজ তার দেহেও নতুন ড্রেস–দস্যুর জমকালো ড্রেস নয়। মূল্যবান পরিচ্ছদ তার দেহে। বিরাজ করছে।

বনহুর নূরীর পাশে দাঁড়ালো, আংগুল দিয়ে ওড়নাটা উঁচু করে চিবুকটা তুলে ধরলো নূরী।

 নূরী তার লজ্জাজড়িত ডাগর দুটি চোখ তুলে তাকালো, মাথা রাখলো বনহুরের বুকে।

ঠিক সেই মুহূর্তে বনহুরের খাটের পায়ায় ওয়্যারলেসটা থেকে সাউন্ড ভেসে এলো।

বনহুর নূরীকে বাহুমুক্ত করে দিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলো খাটের পাশে, ঝুঁকে পড়লো খাটের পায়ার দিকে!

ওয়্যারলেসে ভেসে এলোসর্দার, সিন্ধি ঘাটি থেকে হারুন বলছি। বড় দুঃসংবাদ!

বনহুরের মুখমন্ডল কঠিন হয়ে উঠলো, গম্ভীর কণ্ঠে বললো–দুঃসংবাদ? বলল কি দুঃসংবাদ?

ওয়্যারলেসে শোনা গেলো–সিন্ধি পর্বতের নিকটে সমুদ্র থেকে একটা অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর জীব উঠে এসে সিন্ধিবাসীদের উপর উপদ্রব শুরু করেছে। প্রতিদিন জীবটা আট-দশ জন লোককে হত্যা করে রক্ত পান করছে।

বনহুর অস্ফুট শব্দ করে উঠে–বলো কি হারুন:

সর্দার, আমাদের ঘাটিতেও জীবটি এসে পড়েছিলো। রওশন আলী আর ফরিদ মিয়াকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। পরদিন তাদের মৃতদেহ সমুদ্রের ধারে পাওয়া যায়। সর্দার, সিন্ধিবাসীদের জীবনে এক চরম বিপদ উপস্থিত হয়েছে। এই মুহূর্তে তারা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। সর্দার আমরাও অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছি……

নূরীও বনহুরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো, সেও শুনতে পেলো হারুনের কথাগুলো, শিউরে উঠলো মনে মনে–এই শুভ মুহূর্তে একি অমঙ্গল সংবাদ! আশঙ্কাপূর্ণ ব্যাকুল দৃষ্টি নিয়ে তাকালো সে বনহুরের মুখে।

বনহুর ওয়্যারলেসের নিকটে ঝুঁকে ছিলো, তেমনি ঝুঁকেই বললো–অমি রহমানকে সঙ্গে করে এখনি রওয়ানা দিচ্ছি।

ভেসে এলো হারুনের কণ্ঠ–সর্দার, বন্দুক, পিস্তল, রাইফেলের গুলী তাকে কিছু করতে পারে না। এমন কি সিন্ধি পুলিশবাহিনী কামান নিয়েও জীবটাকে আক্রমণ করেছিলো কিন্তু তার দেহের চামড়া কাটতে পারেনি।

 হুঁ অত্যন্ত আশ্চর্য জীব! আচ্ছা, তোমরা প্রস্তুত থেকো, আমি আসছি। বনহুর সোজা হয়ে দাঁড়ায়, একটু পূর্বে বনহুরের যে রূপ ছিলো সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে যেন মুহূর্তে। দেহের মাংসপেশীগুলো যেন শক্ত হয়ে উঠেছে লোহার মত। ভুলে গেলো বনহুর পাশে নববধুর বেশে দাঁড়িয়ে নূরী। কলিং বেল টিপলো সে।

সঙ্গে সঙ্গে রহমান দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালো–সর্দার!

 ভিতরে এসো রহমান।

 রহমান নতমুখে প্রবেশ করলো দস্যু বনহুরের বাসরকক্ষে।

ভাবলো সে, নিশ্চয়ই নূরীর সঙ্গে কোনো মনোমালিন্য ঘটেছে বা ঐ রকম কিছু হয়েছে। কক্ষে প্রবেশ করে দেখলো, সর্দার মেঝেতে পায়চারি করছে, নূরী চুপচাপ ফুলে ফুলে ফুলরাণী সেজে দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে।

রহমান কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতেই বনহুর পায়চারি ক্ষান্ত করে ফিরে তাকালো-রহমান, সিন্ধি ঘাটি থেকে সংবাদ এসেছে–বড় দুঃসংবাদ।

দুঃসংবাদ?

 হাঁ রহমান।

কোনো দুবৃত্ত কি আমাদের ঘাটিতে…… 

না, কোনো দস্যু বা দুবৃত্ত নয়, সিন্ধি পর্বতের নিকটে সমুদ্র হতে একটা ভয়ঙ্কর জীবের আবির্ভাব ঘটেছে। অতি ভয়ঙ্কর জীব–বন্দুক, পিস্তল বা রাইফেলের গুলী তার দেহে বিদ্ধ হয়নি। কামানের গোলাও নাকি তাকে কাবু করতে পারেনি। প্রতি রাতে সে সিন্ধির পল্লীতে হানা দিয়ে আট-দশজন লোককে হত্যা করে। আমাদের ঘাটি থেকে দু’জনকে হত্যা করেছে……

সর্দার!

হাঁ, রওশন আলী আর ফরিদ মিয়াকে হত্যা করেছে। রহমান, এই মুহূর্তে ক্যাপ্টেন বোরহানকে সংবাদ পাঠিয়ে দাও, আজ রাতেই আমরা সিন্ধির পথে যাত্রা করবো। হাঁ শোন। রহমান-বন্দুক, রাইফেল বা কামান দিয়েও নাকি জীবটাকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি!

রহমান বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে উঠে–আশ্চর্য জীব বটে!

 শুধু আশ্চর্যই নয় রহমান, অত্যন্ত সাংঘাতিক জীব। প্রতিদিন সিন্ধিবাসীদের বহু লোককে এ জীবটা হত্যা করে চলেছে। সিন্ধি পর্বতের পাশে সমুদ্র হতে এ জীবটার আবির্ভাব ঘটে থাকে।

সর্দার, এমন জীবকে হত্যা করা কি করে সম্ভব হবে? আর আমরা গিয়েই বা কি করতে পারবো, কামানের গোলা যে জীবকে হত্যা করতে পারেনি?

সেই কারণেই তো আমি যাবো রহমান, দেখবো কি জীব সেটা। আর দেখবো সিন্ধিবাসীদের রক্ষা করতে পারি কি না। শোন রহমান, ক্যাপ্টেন বোরহানকে জাহাজ ছাড়ার জন্য তৈরি হয়ে নিতে বলে আমার আস্তানার গোপন সুড়ঙ্গপথ দিয়ে কিছু গোলা-বারুদ আর আগ্নেয়, অস্ত্র-শস্ত্র জাহাজে উঠিয়ে নাও, আর উঠিয়ে নাও আলোকরশ্মি স্তম্ভটা। ডবল ডায়নামা মেশিনটার সঙ্গে আলোকরশ্মি স্তম্ভ যোগ করে নিতে বলো।

সর্দার, আলোকরশ্মি স্তম্ভ আর ডবল ডায়নামা মেশিন এ দুটো যে অত্যন্ত……

কষ্টকর এইতো?

না সর্দার, অত্যন্ত বিপদুজনক। আলোকরশ্মি স্তম্ভ ডবল ডায়নামায় সংযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে আলোকরশ্মি স্তম্ভ থেকে যে আলোকরশ্মির উদ্ভব হবে সে রশ্মি খুবই মারাত্নক। হঠাৎ যদি জাহাজের গায়ে কিঞ্চিৎ রশ্মি লেগে যায়, সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যেতে পারে।

রহমান সেই কারণেই আমি আমার আস্তানার সবচেয়ে মারাত্মক যন্ত্র আলোকরশ্মি স্তম্ভ নিয়ে যেতে চাই। আর বিলম্ব করো না।

কিন্তু এ মেশিন চালক জাফর আলী তো ভয়ানক অসুস্থ। তার দক্ষিণ হাতখানা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে গেছে।

হাঁ, আমি জানি…..চিন্তিত কণ্ঠে বললো বনহুর।

 রহমান বললো–সর্দার, আলোকরশ্মি স্তম্ভ চালনা করতে গিয়ে জাফর আলীর শুধু এ অবস্থা হয়নি। বৈজ্ঞানিক মিঃ বাৰ্ডার লর্ডের মৃত্যু ঘটেছে। তার সহকারী মিঃ রবার্টের সম্পূর্ণ মুখমন্ডল ভস্মীভূত হয়েছে। আরও কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে…

 সব আমি অবগত আছি রহমান, কিন্তু সিন্ধি থেকে হারুন যা জানালো তাতে আলোকরশ্মি স্তম্ভ ছাড়া কোন উপায় নেই।

সর্দার, এ মেশিন চালকগণ যে সব আহত এবং নিহত-তাই বলছিলাম।

আমি নিজে এ মেশিন চালনা জানি, কাজেই কোনো অসুবিধা হবে না রহমান।

নূরী এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো কাঠের পুতুলের মত শক্ত হয়ে, এবার বলে উঠে –না না, আমি তোমাকে ঐ ভয়ঙ্কর মেশিন চালু করতে দেবো না।

নূরী, এটাতে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি নিজে এ মেশিন চালু করতে জানি, কাজেই তুমি চিন্তা করো না।

বনহুরের গম্ভীর স্থির কণ্ঠস্বরে নূরী আর কোনো প্রতিবাদ করতে পারলো না। যেমন দাঁড়িয়েছিলো তেমনি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলো বনহুর আর রহমানের কথাগুলো।

বনহুর বললো–রহমান, গোপন সুড়ঙ্গপথে এসব অস্ত্রশস্ত্র এবং আলোকরশ্মি স্তম্ভ সাবধানে জাহাজে উঠিয়ে নাও। আর বাছাই করা সাহসী কয়েকজন অনুচরকেও সঙ্গে নিও, যারা মৃত্যুকে ভয় করে না।

সর্দার, আপনার এমন কোনো অনুচর নেই যে মৃত্যুকে ভয় করে।

 সাবাস, তাহলেই হলো। কমপক্ষে চল্লিশজনকে সঙ্গে নিতে হবে।

আচ্ছা সর্দার।

 যাও আর বিলম্ব করো না।

রহমান বেরিয়ে যায়।

নূরী বনহুরের বুকে আছাড় খেয়ে পড়ে–আমাকে ছেড়ে তুমি চলে যাচ্ছো, হুর?

না গিয়ে কোনো উপায় নেই নূরী। তুমি দোয়া করো যেন জয়ী হয়ে ফিরে আসতে পারি।

খবরটা পৌঁছে যায় দাইমার কানে।

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে দাইমা, বনহুরের কক্ষে প্রবেশ করতেই বনহুর নূরীকে বাহুমুক্ত করে দিয়ে তাকায় দরজার দিকে।

দাইমা ব্যস্তকণ্ঠে বলে উঠে হাঁ রে বনহুর, তুই নাকি আজ রাতে সিন্ধি যাত্রা করছিস?

 আজ রাতে নয় দাইমা, এক্ষুণি।

মনে মনে শিউরে উঠে বলে দাইমা–আজ যে তোদের বাসর রাত?

 বাসর রাতের যাত্রাই শুভযাত্রা। তোমার আশীর্বাদ আমায় রক্ষা করতে হবে দাইমা।

 আজ না গেলে হয় না বাবা?

 না। এক মুহূর্ত বিলম্ব করা আর সম্ভব নয়, দাইমা।

দাইমা কোনো কথা বলতে পারে না–জানে সে, বনহুরকে আটকানো এখন কোনো শক্তির কাজ নয়। তাই সে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

নূরী বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরে–আমি তোমাকে কিছুতেই যমদূতের সঙ্গে লড়াই করতে যেতে দেবো না। কিছুতেই না…….

বনহুর ধীর মোলায়েম স্বরে বললো–তুমি অবুঝ নও নূরী। সিন্ধি-ঘাটির অধিনায়ক হারুনের কথাগুলো সব নিজ কানে শুনেছো?

 শুনেছি, তাইতো বুক কাঁপছে হুর।

 ছিঃ নূরী, তোমার সাজে না এ দুর্বলতা। আমি চাই না তুমি সাধারণ মেয়েদের মত স্বাভাবিক হও।

হুর!

নূরী, জানো আজ সিন্ধিবাসীর সম্মুখে কি চরম দিন। প্রতি মুহূর্তে তারা মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। আমার সিন্ধি-ঘাটিতেও সেই ভয়ঙ্কর জীবটা হানা দিয়ে আমার বিশ্বাসী অনুগত দুঃজন অনুচরকে হত্যা করেছে। বলো, এ মুহূর্তে আমার কি করা কর্তব্য?

আজ আমাদের শুভদিন।

এই শুভদিনে হাসিমুখে আমাকে বিদায় দাও নূরী। নিজের হাতে তুমি আমাকে সাজিয়ে দাও তোমার মনের মত সাজে। বনহুর নূরীর মুখখানা তুলে ধরে–হাসো হাসো নূরী। তোমার হাসিভরা মুখ দেখে আমি যেতে চাই।

নূরীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো, কিন্তু সে হাসি করুণ ব্যথাভরা, গন্ড বেয়ে গড়িয়ে এলো দু’ফোঁটা অশ্রু।

বনহুর নিজের হাত দিয়ে অশ্রু মুছে দিলো নূরীর গন্ড থেকে। তারপর নিবিড় করে টেনে নিলো ওকে…

*

বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে ডেকে দাঁড়িয়ে আছে দস্যু বনহুর। দূরে, বহু দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখছিলো সে। পাশে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন বোরহান আর রহমান। সকলেরই চোখেমুখে একটা উদ্বিগ্নতার ছাপ ফুটে উঠেছে।

দস্যু বনহুরের শাহী জাহাজখানা এখন সিন্ধি নদী অতিক্রম করে সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। আকাশ সচ্ছ মেঘমুক্ত, সিন্ধি নদী একেবারে শান্ত-না হলেও বেশ নীরব। সমুদ্রের তীব্র গর্জনের ক্ষীণ শব্দ শোনা যাচ্ছে, তীর বা কোনো সবুজের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। আকাশে কোনো প্রাণী নেই। তীর থেকে এখন শাহী জাহাজ বহু দূরে সিন্ধি নদীবক্ষে ভাসমান রয়েছে।

বেলা শেষ হয়ে এসেছে।

সূর্যাস্তের সোনালী আলোয় সিন্ধি নদীর কালো জল যেন আগুন ধরেছে।

বনহুর বাইনোকুলার চোখে লক্ষ্য করছিলো। তার সমস্ত মুখমন্ডলে কঠিন কর্তব্যের ছাপ ফুটে উঠেছে। বনহুরের দেহে আজ তার দস্যু ড্রেস নয়, সিন্ধি অধিবাসীদের পরিচিত সিন্ধি-নেতা ড্রেস। পরনে লুঙ্গী ধরনের দামী চাদরের মত কাপড়, সম্মুখে কিছুটা উঁচু করে কোমরে জড়ানো। গায়ে ঢিলা পাঞ্জাবী। মাথায় গাঢ় সবুজ রং-এর পাগড়ি।

বনহুর জাহাজে এসে ড্রেস পাল্টে নিয়েছিলো।

আস্তানা থেকে বনহুর তার নিজস্ব দস্যু ড্রেসেই তাজের পিঠে জাহাজ পর্যন্ত এসেছিলো। বনহুর একা নয়, রহমানও ছিলো তার সঙ্গে।

বনহুরের কান্দাই আস্তানার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কান্দুয়া নদী। এ নদীটা কান্দাই বনের ভিতর দিয়ে চলে গেছে আঁম জঙ্গল হয়ে সিন্ধি নদী মুখে, এবং এর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা গিয়ে মিলিত হয়েছে বিভিন্ন বড় বড় নদী আর সমুদ্রে।

বনহুরের সবচেয়ে বড় জাহাজখানার নাম হলো শাহী’। এ জাহাজ নিয়ে বনহুর সমুদ্রযাত্রা করতো, জলদস্যুদের সঙ্গে লড়াই হতো তার মাঝে মাঝে। সেই কারণে ‘শাহী’ তৈরি করা হয়েছিলো অত্যন্ত কৌশলে মজবুত করে। নানারকম অস্ত্রশস্ত্র গোপনে লুকিয়ে রাখার মত প্রচুর জায়গা ছিলো।

এ জাহাজের খোলের মধ্যেই বসানো হয়েছে বনহুরের সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র আলোকরশ্মি স্তম্ভ। এই নতুন অস্ত্রটা তৈরি করতে গিয়ে একজন জার্মানী বৈজ্ঞানিকের মৃত্যু ঘটেছে। কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ারের জীবন নাশ হয়েছে, আর কয়েকজন শ্রমিকও প্রাণ দিয়েছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে তবেই এ অস্ত্র তৈরি সম্ভব হয়েছে বনহুরের ভূগর্ভস্থ আস্তানায়। এ অস্ত্র সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। অত্যন্ত মারাত্নক বিষাক্ত গ্যাস দ্বারা তৈরি হয়েছে এই আলোকরশ্মি স্তম্ভ। দীর্ঘ তিন বছর অবিরত পরিশ্রম করে তবেই এক জার্মানী বৈজ্ঞানিক এ অস্ত্র তৈরি করতে পেরেছেন।

 বনহুরের বহু দিনের প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে। এ অস্ত্র তৈরি শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রটি প্রয়োজন হবে, একথা বনহুর বা তার অনুচরগণ কেউ ভাবতে পারেনি। আজ বনহুর এ অস্ত্রটি ব্যবহার করে দেখতে চায়! কিন্তু অস্ত্রটি চালনা করবে বলে বিদেশ থেকে যিনি আগমন করেছিলেন সেই দুর্ধর্ষ বৈজ্ঞানিক রবার্টের সম্পূর্ণ মুখমন্ডল ভস্মীভূত হয়েছে।

আজ বনহুর বিপদকালে মিঃ রবার্টকে সঙ্গে নিয়েছে। বনহুর এই ভয়াবহ আলোকরশ্মি স্তম্ভ চালনা সম্পূর্ণভাবে অবগত নয়, হঠাৎ যদি কোনো ভুল হয়ে বসে তাহলে মৃত্যু তার অনিবার্য। কাজেই অসুস্থ রবার্টকে বনহুর এ জাহাজে নিয়েছে, কিন্তু তাঁর যে অবস্থা তাতে বাঁচবেন কি না সন্দেহ আছে। মুখের মাংসপেশীগুলো পুড়ে কুড়ে গেছে। চোখ দুটো অন্ধ হয়ে গেছে চিরদিনের মত, তবে বাম চোখে একটু সামান্য দেখতে পায় অতিকষ্টে। বেচারী রবার্ট মৃত্যুপথের যাত্রী হয়েও সিন্ধী দেশের করুণ অবস্থা এবং সেখানে বনহুরের আগমনের কথা যখন জানলেন তখন বনহুরকে সাহায্য করার জন্য রবার্ট আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েছিলেন এবং তিনি তাদের সঙ্গে সিন্ধী গমনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

 রবার্ট সম্পূর্ণ চলৎশক্তি রহিত বলে তাঁকে ট্রেচারে করে বয়ে নেওয়া হয়েছিলো। জাহাজে ডাক্তার তার চিকিৎসা করছিলেন নিয়মিতভাবে। ঔষধপত্রের কোনো ত্রুটি ছিলো না শাহী’ জাহাজে। স্বয়ং বনহুর সদা-সর্বদা খোঁজ-খবর নিচ্ছিলো তার।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।

বনহুর বাইনোকুলারটা রহমানের হাতে দিয়ে বললো–সিন্ধি নদী অতিক্রম করতে আরও ঘন্টাকয়েক লাগবে। সমুদ্রে আমাদের জাহাজ পড়বার আগে আমরা আলোকরশ্মি স্তম্ভ মেশিনটা একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাই।

সর্দার, কিভাবে আপনি ঐ মেশিন পরীক্ষা করবেন? চারদিকে তো শুধু জল আর জল?

রহমান, এ মেশিন থেকে যে আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হবে তা শুধু সজীব বস্তুকেই ধ্বংস করতে সক্ষম হবে না, সমুদ্রের জলরাশিতেও তার প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হবে। তারপর ক্যাপ্টেন বোরহানকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর–চলুন ক্যাপ্টেন, মিঃ রবার্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসি, জেনে নিতে হবে সব। এসো রহমান।

উপরের একটা ক্যাবিনে মিঃ রবার্টকে রাখা হয়েছিলো।

বনহুর সঙ্গীদ্বয়সহ মিঃ রবার্টের ক্যাবিনে প্রবেশ করলো। দেখলো দু’জন অনুচর তাঁর সেবায় নিয়োজিত আছে। রবার্টের পাশেই বসে আছেন বনহুরের প্রাইভেট ডাক্তার। তাকে বনহুর মিঃ রবার্টের জন্য বিদেশ থেকে এনেছিলো।

বনহুর ক্যাবিনে প্রবেশ করে জিজ্ঞাসা করলো–মিঃ রবার্টের অবস্থা এখন কেমন ডক্টর?

ডক্টর স্মিথ বললেন–পূর্বের চেয়ে অনেক ভাল মনে হচ্ছে। তবে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে আরও বেশ কিছুদিন সময় লাগবে।

বনহুর মিঃ রবার্টের পাশে চেয়ারখানা টেনে নিয়ে বসলো–হ্যালো মিঃ রবার্ট?

মিঃ রবার্টের ব্যান্ডেজ করা দেহটা একটু নড়ে উঠলো, অস্পষ্ট গোঙ্গানির মত একটা শব্দ বেরিয়ে এলো তাঁর মুখমন্ডল থেকে।

বনহুর ঝুঁকে পড়লো অত্যন্ত আপন জনের মতো, যদিও রবার্টের দেহের পঁচা মাংস থেকে ভীষণ গন্ধ বের হচ্ছিলো। শুদ্ধ ইংরেজিতে বললো বনহুর–মিঃ রবার্ট, আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন কি? আমি সমুদ্রে পৌঁছবার পূর্বে আমার আলোকরশ্মি স্তম্ভের গুণাগুণ পরীক্ষা করে দেখতে চাই।

জড়িত কণ্ঠে বললেন মিঃ রবার্ট–খুব ভাল। আমি তোমাকে সর্বান্তকরণে সাহায্য করবো।

মিঃ রবার্টের কথায় বনহুরের গভীর নীল চোখ দুটো খুশিতে চকচক করে উঠলো।

জাহাজের সম্মুখস্থ ডেকে এই অদ্ভুত আলোকরশ্মি স্তম্ভ মেশিনটা বসানো হয়েছিলো।

মিঃ রবার্টকে ট্রেচারে করে ডেকে আনা হলো, বনহুর তার পাশে দন্ডায়মান।

 রহমান এবং বনহুরের অন্যান্য অনুচর দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। সকলের মুখমন্ডল ভয়ে বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। এই অদ্ভুত মেশিনটাকেই তাদের ভয়। কারণ এমন এক রশ্মি এই মেশিন থেকে বিচ্ছুরিত হয় যার সামান্য তাপেও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। লোহার মত শক্ত জিনিস। এমনকি, সমুদ্রের নোনা পানিতেও নাকি আগুন ধরে যাবে! বনহুর আজ নিজে এই ভয়ঙ্কর মেশিনটা চালু করে পরীক্ষা চালাবে। রহমান এবং বনহুরের অনুচরগণ মনে মনে খোদাকে স্মরণ করছে। তারা নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসে সর্দারকে। সর্দারের এতোটুকু অমঙ্গল কামনা তারা কোনোদিন করতে পারে না। আজ তাদের সর্দার যখন সেই যমদূতের মত ভয়ঙ্কর মেশিনটার পাশে এসে দাঁড়ালো তখন সকলের হৃদয় কেঁপে উঠলো মুহূর্তের জন্য।

বনহুর মিঃ রবার্টের মুখের উপর ঝুঁকে পড়লো–এবার আপনি আমাকে নির্দেশ দিন মিঃ রবার্ট?

জড়িত কণ্ঠে দৃঢ় বলিষ্ঠতার ছাপ ফুটে উঠলো–মেশিন ঠিকমত রাখা হয়েছে তো?

হাঁ, ঠিক আপনার কথামত মেশিন বসানো হয়েছে।

মিঃ রবার্ট বললেন আবার–আলোকরশ্মি স্তম্ভের মুখটা ঠিক জলের দিকে আছে তো? দেখো জাহাজের সামান্য অংশও যেন রশ্মির মুখে না পড়ে। তাহলে জাহাজে আগুন ধরে যাবে।

সব আমি ভালভাবে পরীক্ষা করে নিয়েছি মিঃ রবার্ট। আপনি এবার বলুন কিভাবে কাজ করবো?

 আলোকরশ্মি স্তম্ভের নিচে উবু হয়ে দেখবে একটা চাকার মত যন্ত্র আছে। ওটার উপরে যে বোম আছে ওটায় চাপ দেবে, সঙ্গে সঙ্গে আলোকরশ্মি স্তম্ভের ডায়নামা চালু হবে কিন্তু দ্রুত বেরিয়ে আসবে না তা হলে তোমার দেহটা চাকার মধ্যে পিষে থেতলে যাবে। সাবধান, এক মিনিট মাত্র সময় পাবে, বুঝলে?

হাঁ, তারপর কি করতে হবে বলুন?

মেশিন চালু হবার সঙ্গে সঙ্গে আলোকরশ্মি স্তম্ভের কাজ শুরু হবে মানে ডায়নামা চলতে থাকবে। এবার তুমি পিছনে যে বড় বড় হ্যান্ডেল আছে তার উপরে সজোরে চাপ দেবে, সঙ্গে সঙ্গে আলোক-রশ্মি স্তম্ভের মিটারে আলোগুলো জ্বলে উঠবে। আলোর বাল্বগুলো জলবে আর নিভবে।

বলুন?

তারপর দ্রুতহস্তে তুমি হ্যান্ডেলের পাশের ইলেকট্রিক সুইচ চালু করে দেবে। খুলে যাবে আলোকরশ্মি স্তম্ভের মুখ। তুমি তখন চক্রাকারে হ্যান্ডেলটি ঘুরাতে থাকবে, যে আলোর দ্যুতি বেরিয়ে আসবে তা তখন কাজ করতে থাকবে। সাবধান, এতোটুকু ভুল হলে মৃত্যু অনিবার্য।

মিঃ রবার্ট, এবার আপনি যেতে পারেন। রহমান, একে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করো।

 রহমান এগিয়ে এলো–সর্দার, সব কথা স্মরণ আছে তো?

মিঃ রবার্ট বললেন–হ, ভুলে গেলে সর্বনাশ হবে। আলোকরশ্মির চাকা হঠাৎ যদি ঘুরে যায় তাহলে শুধু তুমিই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে না, সমস্ত জাহাজে আগুন ধরে যাবে।

বনহুর পূর্বের ন্যায় শান্ত কণ্ঠে বললো–ভুল হবে না আশা করি।

 মিঃ রবার্ট বললেন–আমাকে এখানে থাকতে দাও।

 বনহুর বললো–আপনি গেলে আমার কোনো অসুবিধা হবে না মিঃ রবার্ট।

তা হয় না, তুমি জানো না এই আলোকরশ্মি কতখানি মারাত্মক!

 জানি—-আর জানি বলেই তো আপনাকে এখান থেকে সরে যাবার জন্য বলছি।

তুমি মিথ্যা অনুরোধ করো না বরং আমার ট্রেচারখানা আরও নিকটে রাখো। আমি তো মৃত্যুপথের যাত্রী, কিন্তু তোমাকে বাঁচতে হবে। আমার প্রচেষ্টা যেন ব্যর্থ না হয়, আলোকরশ্মি স্তম্ভ যেন তোমার উপকারে আসে।

অগত্যা মিঃ রবার্ট বনহুরের পাশেই রয়ে গেলেন।

বনহুর নির্ভীক সৈনিকের মত আলোকরশ্মি স্তম্ভের নিচে উবু হয়ে প্রবেশ করলো।

রুদ্ধ নিশ্বাসে দূরে ডেকের উপর দাঁড়িয়ে আছে বনহুরের বিশ্বস্ত অনুচরগণ। রহমানও দাঁড়িয়ে আছে, না জানি সর্দারের কি অবস্থা হবে–ভয় আর দুর্ভাবনা তাকে বেশ উদ্বিগ্ন করে তুলছে।

জাহাজখানা এখন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে।

ক্যাপ্টেন বোরহান আছে রহমানের পাশে।

বনহুর আলোকরশ্মি স্তম্ভের মেশিন চালু করে দিয়েই অতি দ্রুত নিচে থেকে বেরিয়ে এলো, তারপর হ্যান্ডেলটা ধরে টেনে দিলো ক্ষিপ্রহস্তে। সঙ্গে সঙ্গে মেশিনের গায়ে কতকগুলো আলো জ্বলে উঠলো, একবার নিভছে আর জ্বলছে। বনহুর মিঃ রবার্টের নির্দেশমত কাজ করে চললো, মিটারের বাল্বগুলোও জ্বলছে আর নিভছে। হ্যান্ডেলের পাশে ১নং সুইচটা টিপে চালু করে দিতেই ভীষণ শব্দ হলো, সঙ্গে সঙ্গে বনহুর ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে গেলো ডেকের উপর।

মিঃ রহমান এবং অন্যান্য অনুচর আর্তনাদ করে উঠলো।

মিঃ রবার্ট ট্রেচারে শুয়েই বুঝতে পারলেন কোনো মারাত্নক ভুল করে বসেছে সে। মিঃ রবার্ট চিৎকার করে বললেন–হ্যান্ডেলের পাশের সুইচ অন্ করে দাও, আগুন ধরে গেলোলা, নচেৎ আগুন ধরে গেলো।

 বনহুর সামলে নিলো নিজকে, দ্রুত উঠে মিঃ রবার্টের কথামত হ্যান্ডেলের পাশে ১নং সুইচ অন্ করে দিলো। ভীষণ এক ঝাঁকুনি দিয়ে তীব্র শব্দটা বন্ধ হয়ে গেলো। মিঃ রাবার্ট চিৎকার করে বললেন–৪ নং মেশিন সুইচ টিপে দাও, তারপর ১নং সুইচ টিপে দাও।

বনহুর দ্রুত ৪ নং মেশিন সুইচ টিপে দিয়ে ১নং সুইচ টিপে দিলো, সঙ্গে সঙ্গে আলোকরশ্মি স্তম্ভ মেশিন খুলে গেলো।

সকলের চোখে ধ ধ লেগে গেলো যেন মুহূর্তে, সাঁ সাঁ করে একটা শব্দ হতে লাগলো, তার সঙ্গে জাহাজের সম্মুখে ভাসা পানিতে আগুন জ্বলে উঠলো। যতদূর আলোকরশ্মি গিয়ে পড়লো ততদূর পর্যন্ত সিন্ধি নদীবক্ষে আগুন জ্বলছে। সমুদ্রের পানি যেন গলিত লৌহধাতুর মত লাল দেখাচ্ছে। আলোকরশ্মি এতো তীব্র আর তীক্ষ্ণ যে, বনহুরের অনুচরগণ কেউ দাঁড়াতে পারছিলোনা, রশ্মির ঝাঁঝালো আলোতে গায়ে যেন জ্বালা ধরে গেলো। চোখ মেলে চাইতে পারছিলো না। সবাই জাহাজের ভিতরে প্রবেশ করতে বাধ্য হলো। রহমান তাড়াতাড়ি একটা ড্রামের আড়ালে আত্নগোপন করে ফেললো, সেখান থেকে সে দেখতে লাগলো তার প্রভু দস্যু বনহুরকে। হঠাৎ যদি তার তেমন কিছু হয়ে পড়ে তাহলে সে নিজেও ছুটে গিয়ে আত্মাহুতি দেবে, কিছুতেই এ প্রাণ নিয়ে সে আস্তানায় ফিরে যাবে না।

মিঃ রবার্ট এবার চিৎকার করে উঠলেন–৪নং সুইচ অফ করে দিয়ে ১নং সুইচ অফ করে দাও…..৪নং সুইচ অফ করে দিয়ে ১নং সুইচ অফ করে দাও……

 বনহুর তখন হ্যান্ডেলের চাকা ঘুরিয়ে আলোকরশ্মির তেজ পরীক্ষা করে দেখছিলো, কি ভয়ঙ্কর আর সাংঘাতিক এ রশ্মি!

বনহুর মেশিনের খোলের মধ্যে পিছন অংশে দাঁড়িয়েছিলো কিন্তু চোখ দুটো মেশিনের ছিদ্রপথে, সম্মুখে দেখছিলো সে। মনে হচ্ছে যেন নদীর পানিতে আগুন জ্বলছে।

রবার্টের উচ্চকণ্ঠ বনহুরের কানে পৌঁছতেই দ্রুত ৪নং মিটারের সুইচ অফ্ করে দিয়ে ১নং সুইচ অফ করে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে আলোকরশ্মি নিভে গেলো।

 এবার বনহুর দ্রুত হ্যান্ডেলটা টেনে উপরে তুলে দিতেই সাঁ সাঁ শব্দটা বন্ধ হয়ে গেলো। বনহুর এবার মেশিনের নিচে খোলসের মধ্যে প্রবেশ করে চক্রাকারে হ্যান্ডেলটার সুইচ টিপে অফ করে দিতেই মারাত্নক আলোকরশ্মিস্তম্ভের কাজ বন্ধ হয়ে গেলো।

বেরিয়ে এলো বনহুর মেশিনের ভিতর থেকে।

রহমান নিজকে সংযত রাখতে পারলো না–ছুটে এসে প্রভুকে জড়িয়ে ধরলো–সর্দার!

বনহুর রহমানকে বুকে জড়িয়ে আনন্দ প্রকাশ করলো, এ যে তার জীবনের চরম এক কৃতিত্ব।

জাহাজে তার যতগুলো অনুচর আর কর্মচারী ছিলো সবাই এসে অভিনন্দন জানালো বনহুরকে।

বনহুর ছুটে গেলো এবার রবার্টের পাশে, ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকলো–হ্যালো মিঃ রবার্ট…..হ্যালো মিঃ রবার্ট..

মিঃ রবার্টের গায়ে হাত দিতেই বনহুর স্তব্ধ হয়ে গেলো–মিঃ রবার্টের দেহে প্রাণ নেই, শুধু তাঁর অসাড় দেহটা পড়ে আছে ট্রেচারের উপর।

বনহুর সহসা কথা বলতে পারলো না, তার গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোঁটা অশ্রু।

জাহাজের অনেকেই এসে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, সকলেরই চোখেমুখে উত্তেজনা আর উদ্বিগ্নতার ছাপ। রহমান চলে উঠে–সর্দার, মিঃ রবার্ট কি মারা গেছে?

হাঁ রহমান, মিঃ রবার্ট তাঁর শেষ কাজ সমাধা করে চলে গেছেন। বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো বনহুরের গলার আওয়াজ। একটু থেমে বললো বনহুর–মিঃ রবার্ট অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ায় হার্টফেল করেছেন। অবশ্য তিনি আমাকে ঠিকভাবে পরিচালনা না করলে আমার মৃত্যু আজ অনিবার্য ছিলো। আমি ভুল করে ফেলেছিলাম এবং আমার ভুলই তার মৃত্যুর কারণ।

রহমান চিন্তিত কণ্ঠে বললো–সর্দার, কিন্তু আসল কাজ সমাধা হবার পূর্বেই মিঃ রবার্টের মৃত্যু ঘটলো।

মিঃ রবার্ট তাঁর প্রাণ দিয়েও আমাকে আলোকরশ্মি স্তম্ভ চালু করা শিখিয়ে গেছেন। কাজ সমাধা করেই তিনি বিদায় নিয়েছেন রহমান। কাজেই আমি নিশ্চিন্ত। মিঃ রবার্টের মৃতদেহের সকারের ব্যবস্থা করো। কথাগুলো বলে বনহুর মিঃ রবার্টের মৃতদেহের উপর ঝুঁকে তার মুখে চাদর চাপ দিলো।

বনহুরের চোখ দু’টো ছল ছল হয়ে উঠলো, রুমালে চোখ মুছে নিলো সে।

জাহাজ ছাড়বার পূর্বে রবার্টের মৃতদেহ নদীবক্ষে ভাসিয়ে দেওয়া হলো। গভীর এক বেদনার ছায়া নেমে এলো সকলের মনে। আরও একটা আশঙ্কা সকলকে ভাবিয়ে তুললো। আলোকরশ্মিস্তম্ভ চালনা করতে গিয়ে হঠাৎ যদি তাদের সর্দারের কিছু একটা ঘটে বসে তখন কি হবে।

শাহী জাহাজ আবার চলতে শুরু করেছে।

বিরাট জল-জন্তুর মত ফোঁস ফোঁস করে অগ্রসর হলো জাহাজখানা সিন্ধি সমুদ্র অভিমুখে!

*

গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো নূরীর, পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসলো বিছানায়। তার বনহুর কি তবে ফিরে এসেছে? চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে লাগলো। কই, কক্ষমধ্যে কেউ নেই তো! তবে কে কথা বললো? চমকে উঠলো নূরী–তার গলার লকেটের মধ্যে শুনতে পাচ্ছে বনহুরের কণ্ঠস্বর….নূরী, এখন আমরা সিন্ধি নদী অতিক্রম করে চলেছি। সিন্ধি নদী অতিক্রম করে আমরা সমুদ্রে পৌঁছবো। আজ আমি আলোকরশ্মি স্তম্ভের আলোকরশ্মি পরীক্ষা কাজে কৃতকার্য লাভ করেছি। দোয়া করো নূরী, যেন সেই ভয়ঙ্কর জীবটাকে হত্যা করতে পারি।

নূরীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, দীপ্ত আবেগভরা কণ্ঠে বললো–হুর, তুমি–তুমি কত দূর থেকে কথা বলছো? তোমার কণ্ঠস্বর আমার মনে কি যে আনন্দ দান করছে কি বলবো তোমাকে? তুমি আলোকরশ্মি মেশিন চালনা করে জয়ী হয়েছে, এ যে আমার কত আনন্দ! হুর, বলো কেমন আছো?

আমি এবং আমার অনুচরগণ সবাই ভাল আছি। কিন্তু আমাদের বন্ধু মিঃ রবার্ট মৃত্যুবরণ করেছেন।

বলো কি? কি হয়েছিলো তার?

আলোকরশ্মি স্তম্ভ পরীক্ষা কাজে আমাকে সহায়তা করতে গিয়ে তার মৃত্যু ঘটেছে। অবশ্য আমাকে বাঁচাতে গিয়েই তাকে জীবন দিতে হলো।

উঃ কি সর্বনেশে কথা–না না, তুমি আর ঐ মেশিনে হাত দিও না। তোমাকে আমি অনুরোধ করছি, তোমাকে আমি অনুরোধ করছি হুর।

নূরী, প্রথমেই বলেছি দোয়া করো যেন জয়ী হতে পারি। বলো খুশি আছ তুমি?

হুর….

নূরী…নূরী….বাইরে কিসের চিৎকার শুনছি। ঐ জীবটা নাকি?

বলো? বলো হুর? হুর…হুর

লকেটে আর কোনো কথা শোনা যায় না, নূরী চেনসহ লকেটখানা চেপে ধরে হাতের তালুতে, ব্যাকুলকণ্ঠে লকেটে মুখ রেখে ডাকে–হুর, হুর…হুর….হুর….নূরী আর কিছু শুনতে পায় না, দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনায় ভরে উঠে তার মন।

ওদিকে সিন্ধি নদী অতিক্রম করে জাহাজখানা সমুদ্রের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। জাহাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। রাত গভীর। আকাশে চাঁদ না থাকায় নদীবক্ষ গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছাদিত। জাহাজের সার্চলাইট নদীর জলে এক চক্ষুবিশিষ্ট রাক্ষসের মত আলো ফেলে চলার পথ সচ্ছ করে নিচ্ছিলো।

বনহুর তার ক্যাবিনে বসেছিলো অর্ধশায়িত অবস্থায়। একটু পূর্বেই যে ডেক থেকে ফিরে এসেছে। এতোক্ষণ কয়েকজন সহচরসহ ডেকে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করছিলো। রহমানও ছিলো তার পাশে।

রহমানের অনুরোধেই বনহুর বিশ্রাম গ্রহণ করবার জন্য নিজের ক্যাবিনে এসে শয্যায় বসেছে। মনে পড়লো নূরীর কথা, ওর সঙ্গে আলাপ করার জন্য মনটা হঠাৎ অস্থির হয়ে পড়লো। পকেট থেকে নতুন সিগারেট-কেসটা বের করে একটা সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করলো। আসলে সিগারেট-কেসটার মধ্যে বসানো আছে অতি ক্ষুদ্রকায় একটি ওয়্যারলেস।

বনহুর সিগারেট পানের অবসরে নূরীর সঙ্গে কথা বলছিলো। এমন সময় বনহুরের ক্যাবিনে লাউড স্পীকারে শোনা যায় ক্যাপ্টেন বোরহানের কণ্ঠস্বর–আমাদের জাহাজের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে সমুদ্রের মধ্যে একটি কিছু দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। যার আকৃতি কোনো কচ্ছপের পিঠের মত। বস্তুটি জীবন্ত কোনো জীব তাতে সন্দেহ নেই।

 লাউড স্পীকারে খবরটা ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত জাহাজময়। বনহুরের জাহাজ শাহী’র প্রতিটি ক্যাবিনে ছিলো লাউড স্পীকার। ক্যাপ্টেনের ক্যাবিনে লাউড স্পীকারে কথা হলে তৎক্ষণাৎ কথাটা সব ক্যাবিনেই শোনা যেতো।

 বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে সিগারেট কেসের ঢাকনা বন্ধ করে পকেটে রাখলো, তারপর বেরিয়ে এলো দ্রুতগতিতে। সম্মুখ ডেকে এসে দাঁড়ালো, রহমান এবং আরও কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরও এসে পৌঁছলো সেই স্থানে।

 জাহাজের সার্চলাইট ছাড়াও একটি পাওয়ারফুল সার্চলাইট ছিলো এ জাহাজে। বনহুর একজন নাবিক অনুচরকে আদেশ করলো সার্চলাইটের সুইচ চালু করে দিতে। বনহুর নিজে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে আলো ফেলে দেখতে লাগলো। সত্যিই একটা বিরাট গোলাকার চর্চকে বস্তু নজরে পড়লো, জিনিসটা কি যদিও বুঝা যাচ্ছে না তবে সেটা যে ধীরে ধীরে উঁচু হচ্ছে সেটা বেশ দেখা গেলো। জাহাজের প্রতিটি প্রাণী বিপুল আগ্রহে তাকিয়ে আছে। বনহুর হাজার ভোটের সার্চলাইটের আলো এবার স্থির করে রেখেছে বস্তুটার উপরে!

ক্যাপ্টেন বোরহানের নির্দেশে জাহাজ থেমে গেছে। এখন ‘শাহী জাহাজ সিন্ধি নদী আর সিন্ধি সমুদ্রের মাঝখানে রয়েছে। সমুদ্রের জলোচ্ছাসে জাহাজখানা দোল খাচ্ছে রীতিমত। একটু পূর্বে এমন প্রচন্ড ঢেউ ছিলো না সমুদ্রের জলে। হঠাৎ যেন সমুদ্রটা রেগে উঠেছে ভীষণভাবে।

বনহুর সার্চলাইটের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে আলোটা সরিয়ে নিলো বস্তুটার উপর হতে, সঙ্গে সঙ্গে গোলাকার বলটা যেন উঁচু হয়ে উঠতে লাগলো দ্রুতগতিতে–লম্বা তালগাছের মত একটা দেহ। বোরহান পুনরায় চিৎকার করে উঠলো–সর্দার, আলো ফেলুন, আলো–দেখছেন না আলো সরে যেতেই জীবটা কেমন সজীব হয়ে উঠলো।

বোরহানের কথা কানে যাওয়া মাত্র বনহুর ক্ষিপ্রহস্তে সার্চলাইটের আলো পুনরায় জীবটার উপরে নিক্ষেপ করলো।

বিস্ময়কর ব্যাপার, আলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবটা তলিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হলো।

ক্যাপ্টেন বোরহান বলে উঠলোসর্দার, এটা সাধারণ জীব নয়, এর নাম কিউকিলা– অতি ভয়ঙ্কর জীব। এর চামড়া গন্ডারের চামড়ার চেয়ে একশত গুণ শক্ত আর কঠিন।

সমস্ত জাহাজে একটা ভীষণ ভয়ার্ত গুঞ্জনধ্বনি শোনা গেলো। বনহুরের দুঃসাহসী অনুচরগণও এই ভয়ঙ্কর জীবটাকে দেখে চরম ভীত হয়ে উঠেছে বলে মনে হলো।

রহমান বোরহানের কথায় বলে উঠলো–কিউকিলা? সে আবার কি?

সমুদ্রের রাক্ষস বা দানব এরা। গভীর জলের তলায় ডুবন্ত পাহাড়ের গুহায় এরা লুকিয়ে থাকে। এদের প্রিয় খাদ্য হলো রক্ত। অত্যন্ত ভয়াবহ জীব।

বোরহানের কথা শেষ হতে না হতে জীবটা সম্পূর্ণ তলিয়ে গেলো কিন্তু সেই স্থানের সমুদ্রের পানি যেন তোলপাড় হতে লাগলো। প্রচন্ড ঢেউয়ের উপর বিরাট জাহাজ শাহী’ মোচার খোলার মত দোল খাচ্ছে যেন।

 বনহুর তখনও সেই তরঙ্গায়িত জলরাশির উপর সার্চলাইটের আলো নিক্ষেপ করে চলছে! তার চোখেমুখে একটা কঠিন ব্যক্তিত্বের ছাপ প্রস্ফুট হয়ে উঠেছে।

বোরহান জাহাজ ছাড়ার জন্য বনহুরের কাছে অনুমতি চাইলো।

বনহুর বললো–ক্যাপ্টেন, আমি এখানে জাহাজ আরও কিছু সময় রাখতে চাই, কারণ জীবটাকে যখন এখানেই আমরা দেখেছি, তখন নিশ্চয়ই তার পুনরায় আবির্ভাব ঘটবে।

ক্যাপ্টেনের চোখেমুখে এক আশঙ্কাজনক ভাব জেগে উঠলো, উত্তেজিত কণ্ঠে বললো– এখানে জাহাজ রাখা কিছুতেই সম্ভব নয়। জীবটা যে-কোনো মুহূর্তে আমাদের জাহাজ উল্টে ফেলতে পারে, তার অসাধ্য কিছুই নেই।

অন্যান্য অনুচরও ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে বলে মনে হলো। অগত্যা বনহুর জাহাজ ছাড়বার অনুমতি দিলো।

আবার জাহাজ চলতে শুরু করলো।

বনহুর, রহমান ও কিছুসংখ্যক অনুচর মিলে জাহাজের সম্মুখ ডেকে দাঁড়িয়ে সমুদ্রবক্ষ লক্ষ্য করছিলো। যে স্থানে কিছু পূর্বে সেই ভয়ঙ্কর জীবটার আবির্ভাব ঘটেছিলো সেস্থানে এখন আর কোনো আলোড়ন নেই। জলতরঙ্গ স্থির হয়ে এসেছে।

জাহাজ এখন সমুদ্রবক্ষ অতিক্রম করে সিন্ধি অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে। বনহুর এবং তার প্রত্যেকটা অনুচর উদ্বিগ্নভাবে প্রতিক্ষা করতে লাগলো, না জানি আবার কোন্ মুহূর্তে জীবটা হানা দিয়ে বসবে।

বনহুর এবার অদ্ভুত আলোকরশ্মি স্তম্ভ মেশিনটার পাশে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। একজন অনুচর হাজার ভোল্টের সার্চলাইটটার হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে জাহাজের চারদিকে আলো ফেলে দেখছে। এবার জীবটাকে দেখা গেলেই বনহুর আলোকরশ্মি স্তম্ভ থেকে রশ্মি বিচ্ছুরিত করে ওকে হত্যা করবে।

কিন্তু সমস্ত রাত আর জীবটার কোনো সন্ধান পাওয়া গেলো না।

*

 দু’দিন পর সিন্ধি বন্দরে এসে বনহুরের জাহাজ শাহী’ নোঙর করলো। সিন্ধিবাসিগণ জানে, এরা সামুদ্রিক দানব কিউকিলা হত্যার জন্যই আগমন করেছে। সিন্ধি সর্দার এসে বনহুরকে অভিনন্দন জানালো।

সিন্ধি ভাষা বনহুরের জানা ছিলো কাজেই কোনো অসুবিধা হলো না। বনহুর উদ্বিগ্ন সিন্ধি সর্দারকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো–আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি কিউকিলা হত্যা করে সিন্ধিবাসীদের জীবন রক্ষা করবো।

 সেই দিন রাতেই কিউকিলার আবির্ভাব, ঘটলো! বনহুর তার ঘাটিতে বিশ্রাম করছিলো, সিন্ধি সর্দার ও তার দলবল ছুটে এলো বনহুরের ঘাটিতে। বনহরকে তারা দেবতার মত মনে করতো, কারণ বনহুর সিন্ধিবাসীদের মধ্যে এসে অর্থ দিয়ে, খাদ্য দিয়ে, বিপদগ্রস্তদের বিপদ থেকে উদ্ধার করে মহৎ হৃদয়ের পরিচয় দিয়েছে। তাই সিন্ধিবাসিগণ তাকে ‘দেবরাজ’ বলে। সম্বোধন করে থাকে।

সিন্ধি সর্দার দলবল নিয়ে ভয়-বিহ্বল উদ্বিগ্নভাবে হাজির হলো বনহুরের সিন্ধি ঘাটিতে।

বনহুর তখন বিশ্রাম করছিলো।

সিন্ধি সর্দার দলবল নিয়ে ঘাটিতে উপস্থিত হয়ে সিন্ধি ভাষায় বললো–দেবরাজ, দেবরাজ–বাঁচাও, বাঁচাও, আবার সেই জলদানব হানা দিয়েছে। বাঁচাও দেবরাজ, বাঁচাও আমাদের সবাইকে।

 বনহুর সিন্ধিবাসীদের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলো না, বিশ্রাম ত্যাগ করে বেরিয়ে এলো ঘাটির বাইরে। দেখলো অগণিত সিন্ধিবাসীসহ সিন্ধি সর্দার এসে উপস্থিত হয়েছে। সকলেরই হাতে এক একটি মারাত্মক অস্ত্র, বিষাক্ত বল্লম, তীর-ধনু, বর্শা, বন্দুক, রাইফেল লাঠিসোটা–যে যা পেয়েছে নিয়ে হাজির হয়েছে।

বনহুর সর্দারের মুখে শুনলো, সমুদ্র থেকে কিউকিলা উঠে সিন্ধি অঞ্চলে প্রবেশ করেছে এবং কয়েকজনকে হত্যা করে রক্ত শুষে নিয়েছে।

যে অঞ্চলে কিউকিলা আগমন করেছে সেই অঞ্চলে বনহুর সিন্ধি সর্দার এবং লোকজনের সঙ্গে গমন করলো। সঙ্গে রয়েছে রহমান ও আরও অনেকে। আলোকরশ্মি স্তম্ভটা সঙ্গে নেওয়া সম্ভব নয়, তবু বনহুর ট্রাকটরের মধ্যে বসিয়ে নিয়েছেওটাকে। অতি সাবধানে বহু কষ্টে ওটাকে ট্রাকটরের মধ্যে বসানো সম্ভব হয়েছে বটে কিন্তু ট্রাকটর চালিয়ে সব জায়গায় নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

ট্রাকটর তবু পথঘাট বনজঙ্গল মাড়িয়ে এগুতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে চলেছে বনহুরের দল, যেমন করে থোক কিউকিলাকে ধ্বংস করতেই হবে।

কিন্তু যেখানে কিউকিলার উপদ্রবের কথা শুনতে পাচ্ছে সেখানে গিয়েই হতাশ হচ্ছে বনহুর ও তার দলবল। তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছবার পূর্বেই কিউকিলা সে স্থান চূর্ণ-বিচূর্ণ করে সরে পড়েছে। এক বীভৎস লীলার ধ্বংসস্তূপ শুধু পড়ে রয়েছে। ক্ষত-বিক্ষত নরদেহ আর অগণিত বাড়িঘর ও গাছপালার ধ্বংসাবশেষ ছাড়া কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছে না তারা। এসব লক্ষ্য করে বনহুর বুঝতে পারলো, জীবটা শুধু ভয়ঙ্করই নয়, বিরাট আকার হবে। যার দেহভারে বড় বড় দালান-কোঠা, গাড়ি-ঘোড়া পিষে থেতলে গেছে।

 আরও একটা জিনিস বনহুর লক্ষ্য করলো, শুধু মানুষের রক্তই জীবটা শুষে নেয়নি, যে কোনো জীবকে সম্মুখে পেয়েছে তারই বুকের রক্ত নিংড়ে খেয়েছে। একটা বিরাট অশ্বের মৃতদেহ নজরে পড়লো বনহুরের, দেখলো অশ্বটার বুকের কাছে মস্তবড় একটা ক্ষত, ক্ষতটা ঠিক থেতলানো তাল ছোবড়ার মত। বনহুর এ পর্যন্ত যে কয়টি কিউকিলার দ্বারা নিহত জীব লক্ষ্য করেছে প্রত্যেকটা জীবের বুকের কাছে ঐ একই ধরনের ক্ষত লক্ষ্য করেছে। কিউকিলা যেন চিবিয়ে চুষে রক্ত পান করে নিয়েছে।

বনহুর দেখলো, দলবল নিয়ে কিউকিলার পিছনে ধাওয়া করতে গিয়ে প্রচুর বিলম্ব হয়ে পড়ছে। জীবটা ততক্ষণে দ্রুত সরে যাচ্ছে দূরে–অনেক দূর। কিছুতেই জীবটাকে নাগালের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না।

 বনহুর কিউকিলা হত্যার জন্য তার মারাত্নক অস্ত্র আলোকরশ্মি স্তম্ভসহ ট্রাকটর নিয়ে একাই এগুলো, সে নিজে ট্রাকটর চালনা করতে লাগলো। রহমান দলবল নিয়ে অগ্রসর হলো বিপরীত পথে।

রহমানের সঙ্গে ঝাঁমবীর পুরুষগণ এগুলো।

আর ঝাঁম সর্দার রইলো বনহুরের ট্রাক্টরের উপরে। বন-জঙ্গল অতিক্রম করে বনহুরের ট্রাকটর এগুচ্ছে।

রহমান ঝাঁমবীর পুরুষদের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অন্য পথে অগ্রসর হচ্ছে। রহমানের হাতে ছোট্ট ওয়্যারলেস, বনহুরের সঙ্গে সর্বক্ষণ সে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। কখন কোন পথে গেলে জীবটাকে পাওয়া যেতে পারে এসব নিয়েই ওয়্যারলেসে কথা হচ্ছিলো।

 রহমানের দল পায়ে হেঁটে অগ্রসর হচ্ছে কাজেই তারা কিউকিলার চলার পথ সহজেই আবিষ্কার করে নিচ্ছে এবং সেইভাবে বনহুর ঝাঁম সর্দারকে নির্দেশ দিচ্ছে।

বনহুরের পিঠে বাঁধা রাইফেলের সঙ্গে ওয়্যারলেস বসানো ছিলো, রহমান যা বলছে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে এবং সেইভাবে এগুচ্ছে।

হঠাৎ ওয়্যারলেসে শুনতে পেলো বনহুর….সর্দার, ঝম-কাটোরা জঙ্গলের দিকে কিউকিলা এগিয়ে যাচ্ছে–সর্দার, সাবধান, কিউকিলা টের পেয়েছে–লোকজন তার পিছনে ছুটছে, এটা সে বেশ অনুভব করেছে।

 বনহুর ঝাঁম সর্দারকে বললো-কাটোয়া জঙ্গলপথ দেখিয়ে দাও।

ঝাঁম সর্দার পথ দেখিয়ে দিতে লাগলো।

সেইপথে ট্রাকটর বন বাদাড় ভেঙে ছুটে চলেছে। বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে দেখছে ঝাঁম সর্দার।

হঠাৎ ঝাঁম সর্দার উচ্চকণ্ঠে বলে উঠে–দেবরাজ, দেবরাজ, দেখুন, সম্মুখে তাকিয়ে ২৫০ ) দেখুন…..

বনহুর সামনে তাকিয়ে দেখতেই বিস্মিত হলো, অদূরে গাছপালার উপর দিয়ে একটা বিরাট দেহসহ মাথা নজরে পড়লো। যেন একটা জমকালো চকচকে কভারে ঢাকা তালগাছ, মাথাটা ঠিক জ্বালার মত। মাথায় কোনো চুল বা লোম নেই, দেহটাও অত্যন্ত মসৃণ আর জমাট বলে মনে হলো। একটা মহিষ হাতে উঠিয়ে নিয়ে মুখের কাছে ধরে আছে, মহিষটা তখনও পা নাড়াচ্ছে, ছটফট করছে যন্ত্রণায়।

 ঝাঁম সর্দার বললো–দেবরাজ, এ সময় জলদানবটা মহিষের রক্ত-পানে ব্যস্ত আছে, এটাই তাকে হত্যা করার একটা প্রধান সুযোগ।

বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে আলোকরশ্মি স্তম্ভ চালু করার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলো, ওয়্যারলেসে রহমানকে জানালো….রহমান, কিউকিলার নিকটে পৌঁছে গেছি, আমি আলোকরশ্মি স্তম্ভ চালু করে কিউকিলা হত্যার চেষ্টা নিচ্ছি, তোমরা এদিকে চলে এসো, তোমাদের সাহায্য দরকার হতে পারে।

রহমান জবাব দিলো….এক্ষুণি আমরা আসছি সর্দার। আপনি সাবধানে আলোকরশ্মি স্তম্ভ চালু করবেন, কোনো বিপদ যেন না ঘটে।

 বনহুর আলোকরশ্মি স্তম্ভের নিচে প্রবেশ করে চক্রাকারে যন্ত্রটার বোতাম টিপে ধরলো– অমনি প্রচন্ড শব্দ হলো, বনহুর দ্রুত বেরিয়ে এসে হ্যান্ডেলটা নিচে নামিয়ে দিতেই মেশিনের গায়ে আলোগুলো জ্বলে উঠলো। মিটারের আলোগুলো জ্বলছে আর নিভছে। মুহূর্ত বিলম্ব করলো না সে, ৪নং সুইচ অন করে ১নং বোতাম টিপে ধরলো, সঙ্গে সঙ্গে আলোকস্তম্ভের মুখ জ্বলে গেলো।

বনহুর দক্ষিণ হস্তে হ্যান্ডেল ধরে বামহস্তে ঝাঁম সর্দারকে টেনে নিলো দ্রুত নিজের পাশে। আর এক দন্ড বিলম্ব হলেই ঝাঁম সর্দারের মৃত্যু ঘটতো নিঃসন্দেহে।

 বনহুর তার মারাত্নক আলোকরশ্মি স্তম্ভের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে আলো ফেললো কিউকিলার বিরাট জমকালো কঠিন দেহটা লক্ষ্য করে। বিস্ময়কর ব্যাপার, যেদিক দিয়ে আলোকরশ্মি প্রবাহিত হলো দেখতে দেখতেই সেইদিকের বনভূমির বৃক্ষ-লতা-পাতা সব যেন যাদুমন্ত্রের মত গলে মুচড়ে নেতিয়ে পড়লো। আগুন না ধরলেও গাছপালাগুলো যেন পুড়ে গেলো নাইট্রিক এসিড দেয় বস্তুর মত। কিন্তু আশ্চর্য কান্ড, এখনও জলদানব কিউকিলা তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। একবার এদিকে ফিরে হাতের গলিত মাংসপিন্ডটা ফেলে দিয়ে থপ থপ করে এগিয়ে চললো সম্মুখের দিকে।

কিউকিলার হাতের মহিষটা আলোকস্তম্ভের মারাত্মক রশ্মিতে গলে মাংসপিণ্ড হয়ে পড়েছে। কিউকিলার শরীরে রশ্মি পড়তেই একবার এদিকে ফিরে তাকাবার চেষ্টা করলো, তারপর দ্রুত। সম্মুখে এগিয়ে চললো কিউকিলা। মারাত্নক আলোকরশ্মি তার দেহে যেন কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারলো না।

বনহুর দ্রুতহস্তে আলোকরশ্মি স্তম্ভের মেশিন অফ করে দিলো। তারপর ট্রাকটরে ষ্টার্ট দিলো, ডবল স্পীডে ছুটতে লাগলো ট্রাকটরখানা। ওয়্যারলেস চালু করাই ছিলো, সে বলে চললো….রহমান, আশ্চর্য! মারাত্নক আলোকরশ্মি তেজে বনভূমির বৃক্ষ-লতা-পাতা গলে গেছে, কিন্তু জলদানবের দেহে এতটুকু আঁচ লাগেনি। সে ক্ষিপ্রগতিতে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

ঝাঁম সর্দারও কম আশ্চর্য হয়নি, এমন একটা ভয়ানক রশ্মির মারাত্বক তেজ কিউকিলাকে। কিছু করতে সক্ষম হলো না। ঝাঁম সর্দারের মুখের কথা যেন লোপ পেয়ে গেছে, আড়ষ্ট হয়ে গেছে সে একেবারে। আজ সে এমন অদ্ভুত আর বিস্ময় কান্ড দেখতে পেলো যা সে কোনোদিন দেখেনি। বা শোনেনি এমন কথা।

ওদিক থেকে ওয়্যারলেসে ভেসে এলো….সর্দার, আমরা দূর থেকে লক্ষ্য করছি, আলোকরশ্মি কিউকিলার দেহে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে না পারলেও সে বেশ উন্মত্ত হয়ে উঠেছে এবং সমুদ্রের দিকে দ্রুত ছুটে যাচ্ছে।

বনহুর বললো–তোমাদের সীমানার মধ্যে এলে তোমরা মেশিন চালাবে। যে যা পারো তার উপর অস্ত্র প্রয়োগ করবে।

 রহমানের কণ্ঠ শোনা গেলো ওয়্যারলেসে–মেশিনগান চালানো সম্ভব নয়, আমরা কামান। নিয়ে গহন বনের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে আছি।

মেশিনগান চালাতে হলে কিউকিলার আরও নিকটে সরে আসার প্রয়োজন কিন্তু সে সাহস। কেউ পাচ্ছে না। সর্দার, আপনি আলোকরশ্মি নিক্ষেপ করে কিউকিলাকে নিহত করতে পারলেন না, মেশিনগান বা কামানের গোলাও তাকে কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। সর্দার, সমুদ্রের দিকে কিউকিলা দ্রুত চলে যাচ্ছে।

 হাঁ, আমি তার প্রায় একশত গজ দূরে রয়েছি। তার মাথা এবং অর্ধেক শরীর দেখা যাচ্ছে। ঝাঁম সর্দারের অবস্থা বড় সঙ্কটময়, সে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছে। কিউকিলার আর আলোকরশ্মি স্তম্ভ তাকে বিস্ময়াহত করে তুলেছে। রহমান, কিউকিলা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছে, আমি আলোকরশ্মি স্তম্ভ চালু করবো, সম্মুখ জঙ্গল থেকে দূরে চলে যাও। দূরে চলে যাও……

সঙ্গে সঙ্গে রহমানের ভীত আর্তনাদ শোনা যায়…..কিউকিলা আমাদের দেখে ফেলেছে, সর্দার, আমরা মারা পড়লাম….সর্দার, কিউকিলা আমাদের দেখে ফেলেছে……

বনহুর আলোকরশ্মি স্তম্ভ চালু করতে পারছে না কারণ তাদের সম্মুখে বনাঞ্চলের মধ্যেই রয়েছে রহমান দলবল নিয়ে। কিন্তু কিউকিলার গতিরোধ করার কি উপায় আছে। বনহুর আলোক স্তম্ভের হেডলাইট খুলে দিলো, অত্যন্ত পাওয়ারফুল সার্চলাইট। আলো ফেললো কিউকিলার দিকে। কিন্তু ততক্ষণে জলদানব রহমানের দলের একজনকে ধরে ফেলেছে এবং নিশ্চিন্ত মনে তার বুকে দাঁত বসিয়ে রক্ত শুষে নিচ্ছে।

বনহুর সার্চলাইটের আলো ফেললো, বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে দেখলো, লোকটাকে ধনুকের মত বাকা করে বুকের কাছে কামড়ে ধরে আছে কিউকিলা, বোধ হয় রক্ত খাচ্ছে। শিউরে উঠলো বনহুরের শরীর। ঝাঁম সর্দার বললো–দেবরাজ, কিউকিলাকে কেউ মারতে পারবে না, এখন কি হবে দেবরাজ? এখন কি উপায়ে দেশবাসীকে রক্ষা করা সম্ভব হবে!

বনহুরের সার্চলাইটের তীব্র আলোকরশ্মিতে বেশিক্ষণ কিউকিলা দাঁড়াতে পারলো না, সে দ্রুত সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে!

রহমান তার দলবল নিয়ে বিপরীত পথে ছুটে পালাচ্ছে। বনহুর ক্ষান্ত হলো না, সে। আলোকস্তম্ভসহ ট্রাকটর নিয়ে বন-বাদাড় ভেঙে সম্মুখে এগুচ্ছে।

সমুদ্রের অতি নিকটে পৌঁছে গেছে প্রায় কিউকিলা।

বনহুরের ট্রাকটর থেমে পড়লো, বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে ট্রাকটরের উপরে দাঁড়িয়ে দেখছে বনহুর। কিউকিলা ঠিক একটি স্নানরত মানুষের মত সমুদ্রের মধ্যে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে, সচ্ছন্দে হেঁটে যাচ্ছে সামনের দিকে। সমুদ্রের জলে যতই এগুচ্ছে ততই কিউকিলার বুক অবধি জল এবার ঝুপ করে মাথাটা নিচু করে নিলো। সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে এবার কিউকিলা।

কিন্তু আশ্চর্য! কিউকিলা তলিয়ে যাবার পর সমুদ্রের জলে ভীষণ একটা আলোড়ন সৃষ্টি হলো, যেন কোনো মেশিন দ্বারা সমুদ্রের জলকে তোলপাড় করা হচ্ছে।

কিউকিলাকে মারাত্নক আলোকরশ্মিও যখন কাবু করতে পারলো না তখন সকলের মনে। একটা ভীষণ দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো।

ফিরে এলো বনহুর ট্রাকটরসহ সিন্ধি ঘাটিতে।

ঝাঁম সর্দারের সঙ্গে চললো তার নানারকম পরামর্শ। রহমান ও তার দলবল সবাই যোগ দিলো এ আলোচনায়।

সেইদিনই ঝাঁম রাজ্যের রাজা হেমন্ত সিন্ধু ডেকে পাঠালেন বনহুর ও ঝাঁম সর্দারকে। মোহন্ত সিন্ধুর প্রধান সেনাপতি স্বয়ং ঝাঁম সর্দারকে অনুরোধ জানালো এবং রাজার আদেশ বর্ণনা করে শোনালো।

ঝাঁম সর্দার মহারাজার আদেশ অমান্য করতে সাহসী হলো না, হাজার হলেও মোহন্ত সিন্ধু দেশের রাজা আর সে ঝাঁম জঙ্গলের অধিপতি জংলীদের সর্দার।

বনহুরকে নিয়ে মহারাজ মোহন্ত সিন্দুর রাজদরবারে হাজির হলো।

ঝাঁম দেশের রাজা বনহুর আর ঝাঁম সর্দারকে সাদরে অভিনন্দন জানালেন। সসম্মানে বসালেন নিজের আসনের পাশে। মোহন্ত সিন্দু বনহুরের কার্যকলাপের কথা লোকমুখে শুনে অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছেন। তিনি জানতে পেরেছেন, দেবরাজ নামক একটি যুবক তাদের দেশে আগমন করে কিউকিলা হত্যার চেষ্টা করছে। কিউকিলা এক সাংঘাতিক জীব, সেই জীবটা তাদের। দেশবাসীকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। কিছুদিন হলো কিউকিলা বা জলদানবটির আবির্ভাব ঘটেছে, সে প্রায়ই সমুদ্র হতে এসে ঝাঁম শহরে এবং গ্রামঞ্চলে হানা দিয়ে বহু জীবন ধ্বংস করেছে। কেউ তাকে হত্যা করতে পারছে না। এমন একটা জীবকে হত্যার দুঃসাহস কম কথা নয়। মহারাজ মোহন্ত সিন্দু তাই দেবরাজ নামক বীর পুরুষটিকে ডেকে এনেছেন স্বচক্ষে দেখবার উদ্দেশ্যে।

মহারাজ সিন্দু দেবরাজকে দেখে শুধু মুগ্ধই হলেন না, অবাক হলেন তার অপরূপ সৌন্দর্য দর্শন করে। আবেগভরা কণ্ঠে বললেন মহারাজ–দেবরাজ, সত্যিই তুমি অদ্ভুত মানুষ। দেবরাজ, তুমি যদি এই ভীষণ জীবটাকে নিহত করে ঝমবাসিগণকে উদ্ধার করতে সক্ষম হও তবে আমি আমার কন্যা কুমারী মালাকে তোমায় উপহার দেবো। আর দেবো আমার ঝাম রাজ্যের সাগরতলের রাজপ্রাসাদটি।

অবাক হলো বনহুর, বললো–ঝাঁম রাজ্যের সাগরতলের রাজপ্রাসাদ–সে আবার কি?

মহারাজ বললো-আমার বড় দাদা এই প্রাসাদটি অতি সখ করে গভীর সাগরতলে তৈরি করেছিলেন। এটা তৈরি করতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিলো বড় দাদার। তার কন্যা সিন্ধির রাণীর জন্যই পাতালপুরীতে তিনি এ প্রাসাদ গড়েছিলেন।

চমকে উঠলো বনহুর সিন্ধিরাণী! সে তো তার অতি পরিচিত এক নাম। এবার সব স্পষ্ট বুঝতে পারলো, সাগরতলে সেই সুন্দরীদের কুমারী সিন্ধিরাণী, যে তাকে ভালবেসেছিলো একদিন। গভীরভাবে। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু ঘটেছিলে: সিন্ধিরাণীর। মহারাজ বলে চলেছেন-দাদাকে হত্যা করে এক দুষ্ট ডাকাত, তারপর তার একমাত্র কন্যা সিন্ধিরাণীকে হরণ করে এবং সাগরতলে তাকে নিয়ে বসবাস করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিন্ধিরাণীর মৃত্যু হয়–কে বা কারা সিন্ধিরাণীকে নিহত করে। সাগরতলের প্রাসাদ এখন আমার দখলে। থামলেন মহারাজ–তারপর আবার শুরু করলেন–আমার একমাত্র কন্যা মালার জন্যই আমি সাগরতলের প্রাসাদটি পুনরায় নতুনভাবে মেরামত করছি। দেবরাজ, তোমাকে দেখে আমি সত্যিই অত্যন্ত খুশি আর মুগ্ধ হয়েছি, তুমি কিউকিলাকে হত্যা করে আমার এ সামান্য উপহার গ্রহণ করবে। আশা করি।

 বনহুর কোনো জবাব না দিয়ে হাসলো।

ঝাঁম সর্দার বনহুরের হয়ে বললো–দেবরাজ, আপনার উপহার সানন্দে গ্রহণ করবে মহারাজ।

বেশ, আমি নিশ্চিন্ত রইলাম। বনহুরের সাথে করমর্দন করে আবার বললেন মহারাজ –কিউকিলা হত্যার জন্য যা প্রয়োজন আমাকে জানালেই পাবে। আমি নিজেও তোমাকে প্রাণ দিয়ে সাহায্য করবো।

বনহুরের সঙ্গে ঝাঁম অধিপতি এতোক্ষণ ঝাঁম ভাষায় কথাবার্তা বলছিলেন। বনহুরও ঝাঁম ভাষাতেই উত্তর দিচ্ছিলো।

সাগরতলের প্রাসাদের লোভ বনহুরের মনে এক নতুন উদ্যমের সৃষ্টি করে, তার বহুদিনের আকাক্ষা সাগরতলে একটি আস্তানা গড়ে তুলবে–হয় তো সে আশা তার পূর্ণ হবে এবার কিন্তু রাজকুমারী মালামালাকে নিয়ে সে কি করবে?

মহারাজের আদেশে মালাকে আনা হলো রাজদরবারে।

বনহুরের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো ঝম রাজকুমারী, সহসা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারলো না বনহুর। ঝম রাজকুমারীর সৌন্দর্য তাকে মোহগ্রস্ত করলো কিন্তু বেশিক্ষণ মালাকে নিয়ে ভাববার সময় কই তার।

 বনহুর আর ঝাঁম সর্দার মহারাজ মোহন্ত সিন্ধুর নিকটে বিদায় নিয়ে চলে এলো ঘাটিতে। কিভাবে এই ভয়ঙ্কর জীবটাকে হত্যা করবে, এ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলো। হঠাৎ মনে পড়লো, কিউকিলা যখন সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে গিয়েছিলো তখন সমুদ্রবক্ষে যেন তোলপাড় শুরু হয়েছিলো। বনহুরের মনে বিস্ময় জেগেছিলো–জীবটা তলিয়ে যাওয়ার পর সেখানে সমুদ্রের জলে অমন অদ্ভুত জলতরঙ্গের সৃষ্টি হলো কেন?

এই প্রশ্নটা আরও বেশি উদ্বিগ্ন করে তুললো বনহুরকে, নিশ্চয়ই জীবটার পিছনে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।

*

কয়েকদিন কিউকিলার আবির্ভাব আর হয় না! বনহুর অনেকটা নিশ্চিন্ত, ঝম অধিবাসিগণের মনেও বেশ শান্তি এসেছে তবে কেউ সম্পূর্ণ আশ্বস্ত নয়। কখন কোন মুহূর্তে আবার সেই জলদানব হানা দেবে তার ঠিক নেই।

বনহুর যখন ঝাঁম দেশে জলদানব কিউকিলাকে নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন তখন নূরী বনহুরের জন্য দুর্ভাবনায় অস্থির হয়ে পড়েছে। আজকাল প্রায়ই নূরী তার লকেটের ঢাকনা খুলে ক্ষুদে ওয়্যারলেস নিয়ে বনহুরের খোঁজখবর নেয়।

নূরীর জেদে বনহুর নিজের বাজুতে একটা বাজুবন্দের মধ্যেও ওয়্যারলেস রাখতে বাধ্য হয়েছে। নূরী যেন তার লকেটের ঢাকনা খুললেই জানতে পারে তার বনহুর কখন কি করছে বা কখন কেমন অবস্থায় আছে।

বনহুর যখন ঘুমাতো তখন তার নাসিকাধ্বনিও নূরীর মনে জাগাতো অফুরন্ত এক উন্মাদনা–সে মনে করতো, তার হুর বুঝি পাশেই আছে। বনহুর যখন কথা বলতো তার কণ্ঠস্বর নূরীর হৃদয়ে যোগাতো অসীম আনন্দ।

গভীর রাতেও বনহুর আর নূরীর মধ্যে চলতো কথাবার্তা যেন পাশাপাশি দু’জন বসে বসে আলাপ করছে।

বনহুরের বাজুতে বাঁধা বাজুবন্দে ওয়্যারলেস বসানো আছে, এ কথা জানতো না তার দলের কেউ, এমন কি রহমানও জানতো না এ কথা।

রহমানের সঙ্গে যখন বনহুরের নিভৃতে আলাপ হতো তখন নূরী সব শুনতে কান্দাই আস্তানায় বসে বসে।

বনহুর জানিয়েছে, এখন বেশ কয়েক দিন হলো কিউকিলার আবির্ভাব ঘটেনি, তাই তারা অনেকটা নিশ্চিন্ত। ঝমবাসিগণের মনেও কতকটা স্বস্তি এসেছে। বনহুর নূরীর কাছে ঝমদেশের সবকথাই প্রায় জানিয়েছে, শুধু জানায়নি কিউকিলা হত্যা করতে সক্ষম হলো মরাজ তাকে সাগরতলের রাজপ্রাসাদ আর তার কন্যা মালাকে উপহার দেবেন। বনহুর জানে, এ কথা শুনলে নৃরীর অভিমানী মন ব্যথায় গুমড়ে উঠবে, বিশেষ করে ঝমরাজ কন্যা মালার কথাটা তাকে না জানানোই ভাল।

 বনহুর ঝাঁমরাজ কন্যা মালাকে মনে স্থান না দিলেও মালার মনে বনহুর গভীরভাবে রেখাপাত করেছিলো। সেদিন ওকে দেখার পর থেকে সর্বক্ষণ হৃদয়ে একটা আলোড়ন অনুভব করে চলেছে মালা!

একদিন মালা কয়েকজন ঝামবাসিনী সখীকে সঙ্গে করে তার কাছে এসে হাজির হলো।

বনহুর তখন ঝাঁম সর্দারের আসরে বসে কিউকিলা নিয়ে আলাপ আলোচনা করছিলো। রাজকন্যা মালার আগমনে ঝাঁম সর্দার বিস্মিত হলো, তাকে অভিনন্দন জানালো নত মস্তকে।

মালা ইংগিত করলো সবাইকে চলে যেতে।

 ঝাঁম সর্দার তার দলবল নিয়ে বেরিয়ে গেলো পুনরায় অভিবাদন করে।

 মালা সখীদের নিয়ে ঘিরে ধরলো বনহুরকে।

বনহুর প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি, বুঝলো এক মুহূর্ত পরে।

মালা অতি পরিচিতের মত বনহুরের দক্ষিণ হাতখানা হাতে তুলে নিলো, ঝাঁম ভাষায়। বললো–প্রিয়, সেদিন তোমাকে দেখার পর থেকে আমি তোমাকে একদন্ডের জন্য ভুলতে পারিনি। কিউকিলা হত্যা করতে গিয়ে যদি তোমার কোনো বিপদ ঘটে তাহলে আমিও মৃত্যুবরণ করবো।

মালার কথা শুনে বনহুর একেবারে থ বনে গিয়েছে, কোনো কথা সহসা তার মুখ দিয়ে। বের হচ্ছে না।

সখীরা হেসে উঠলো খিল খিল করে।

বনহুর নিজের বাজুবন্দের ওয়্যারলেসে হাতচাপা দিলো। হয়তো নূরী এ সময় সব শুনে ফেলতে পারে।

বললো বনহুর–কিউকিলা হত্যা করতে গিয়ে আমার মৃত্যু ঘটলে তুমি মৃত্যুবরণ করবে, এটা নেহাৎ ভুল করবে মালা। কারণ আমি বিদেশী…

বনহুরকে কথা শেষ করতে দেয় না মালা, বলে সে তুমি বিদেশী বলেই তো আমি তোমাকে নিজের মত করে পেতে চাই দেবরাজ। আমাদের ঝাঁম দেশে একটি লোকও তোমার মত নয়।

বনহুরের চোখেমুখে বিস্ময় জেগে উঠে, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে মালার মুখের দিকে।

সখীরা বেরিয়ে যায়, কিছু বুঝতে পারে না তারা মনে মনে।

মালা বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে, তখনও বনহুরের হাতখানা তার হাতের মধ্যে। আবেগভরা কণ্ঠে বলে মালা–দেবরাজ, কিউকিলা হত্যা করতে আমি নিজে তোমাকে সাহায্য করবো।

আমি খুশি হবো তোমার সাহায্য পেলে…

চমকে উঠে বনহুর, নূরীর কণ্ঠ শোনা যায়–হুর, তোমার পাশে কোনো নারী কথা বলছে? কে সে শীঘ্র জানাও?

 বনহুর চমকে উঠলেও ঘাবড়ায় না–কারণ সে জানে, নূরী ঝাঁম ভাষা বুঝতে পারবে না, আর মালাও বুঝতে পারবে না বাংলা ভাষা। কতকটা আশ্বস্ত হলো বনহুর, বললো–নূরী, যে যুবতী আমার সঙ্গে কথা বলছে সে একজন ঝমবাসিনী। তার ছেলেকে কিউকিলা ধরে নিয়ে গেছে তাই সে…

বনহুরের কথা শেষ হয় না, নূরীর কণ্ঠ শোনা যায় আবার আমাকে তুমি মিথ্যা কথা বলছো হুর? যে যুবতী তোমার পাশে রয়েছে তার কথা আমি বুঝতে না পারলেও এটুকু আমি বুঝতে পারছি, সে কোনো বিপদের কথা নিয়ে তোমার কাছে আসেনি। তার কণ্ঠস্বর বিপদগ্রস্ত মহিলার নয়…

 হেসে উঠে বনহুর ভীষণ জোরে-হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ…তারপর হাসি থামিয়ে বলে–নূরী, এতো সুচতুরা মেয়ে তুমি! যাক, তুমি বিশ্বাস করো আমাকে নূরী, যার সঙ্গে এখন আমি কথা বলছি সে ঝাঁম রাজার কন্যা মালা। কিউকিলা হত্যা করতে সক্ষম হলে ঝামরাজা। আমাকে তার সাগরতলের রাজপ্রাসাদ আর রাজকন্যা মালাকে উপহার দেবেন….বলো তুমি রাজি আছো এ উপহার গ্রহণে?

নূরীর অভিমানভরা কণ্ঠ–তোমার যা ভালো লাগে তাই করো কিন্তু কিউকিলা হত্যা করা সহজ হবে বলে মনে হয় না। হুর, তুমি ফিরে এসো। তুমি ফিরে এসো হুর…..

এমন একটা মুহূর্তে আমি পৌঁছেছি নূরী যেখান থেকে ফেরা সহজ কথা নয়। কিউকিলাকে হত্যা না করে আমি দেশে ফিরবো না……

তবে আমাকে তোমার পাশে যাবার অনুমতি দাও হুর……

নূরী, যে কথা তুমি বলছো তা সম্ভব নয়। তুমি আমাকে সব সময় বিশ্বাস কর। শুধু মালা কেন, শত মালা এলেও তোমার হুর ঠিক তোমারই থাকবে।

হুর…আমার হুর….।

বনহুরকে এভাবে আপনা আপনি কথা বলতে দেখে মালা বিস্মিত হতবাক হয়ে পড়েছিলো, কোথা থেকে ভেসে আসছে একটা নারীকণ্ঠ সে কিছু বুঝতে পারছিলো না। তাই সে অবাক হয়ে শুনছিলো এতোক্ষণ। একবার বলে উঠে–দেবরাজ, কার সঙ্গে তুমি কথা বলছো?

বনহুর বললো–আমার স্ত্রী নূরীর সঙ্গে।

বনহুর ভেবেছিলো, স্ত্রীর কথা বললে হয়তো মালার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখবে কিন্তু আশ্চর্য, মালার ভিতরে এতোটুকু পার্থক্য দেখা গেলো না, সে পূর্বের মত হাসিভরা মুখে কথাবার্তা বলতে লাগলো।

বনহুরের কাঁধে মাথা রাখলো মালা।

বনহুর অত্যন্ত বিব্রত বোধ করলো, তাড়াতাড়ি বাজুবন্ধ খুলে চাপ দিয়ে রাখলো হাতের মুঠায়। মালা যে এমনভাবে তাকে পেয়ে বসবে ভাবতে পারেনি। সখীদের বিদায় দিয়ে সে দেবরাজকে নিয়ে মেতে উঠলো যেন।

দেবরাজ উঠে দাঁড়ালো–মালা, তুমি যাও; আমি একসময় দেখা করবো তোমার সঙ্গে।

মালা বললো–না, তোমাকেও যেতে হবে আমাদের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে হাতে তালি দিলো। মালা।

সঙ্গে সঙ্গে সখীরা এসে আবার ঘিরে দাঁড়ালো বনহুর আর মালাকে।

 মালা ইংগিত করলো সখীদের।

সখীরা অমনি বনহুরকে এসে ধরলো।

মালা বললো–নিয়ে চলো একে বন্দী করে।

অবাক কণ্ঠে বললো বনহুর–আমাকে বন্দী করে নিয়ে যাবে? কিউকিলা হত্যা করবে তাহলে কে?

চলো এখন, পরে দেখা যাবে।

বনহুর ঝাঁম সর্দারের আড়ার বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখলো, মস্তবড় রথের মত একখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বাইরে।

মালা সখীদেরসহ বনহুরকে নিয়ে রথের মধ্যে উঠে বসলো।

হাসলো বনহুর!

মালা বনহুরকে নিজের পাশে বসিয়ে সারথীকে বললো–রথ ছাড়।

 বনহুরকে নিয়ে ঝম রাজকুমারী চললো ভ্রমণে।

সখীগণ নানারকম আলাপ-ঠাট্টা, হাসি-তামাসা করতে লাগলো।

মালার মুখে উজ্জ্বল দীপ্ত, বার বার তাকাচ্ছে সে তার পাশের জনের দিকে। পাশে বসে অন্য কেউ নয়–বনহুর।

বন-জঙ্গল অতিক্রম করে চলেছে রাজকুমারী মালা তার প্রিয়জনকে নিয়ে। মালার বিশ্বাস, দেবরাজ কিউকিলাকে হত্যা করবেই–তারপর বিয়ে হবে দেবরাজের সঙ্গে তার।

ঝাঁম কুমারীর আবেষ্টনীতে বনহুর যেন জড়িয়ে পড়ছে। নিশ্চুপ বসে আছে সে, দেখছে কি করতে চায় এরা।

সমস্ত দিন বন-বাদাড়ে ঘুরেফিরে বেড়ালো বনহুর ঝম রাজকুমারীর সঙ্গে। তারপর একসময় ফিরে এলো ঘাটিতে। অবসর সময়ে ওয়্যারলেস খুলে বসলো বনহুর–নূরীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, নইলে নূরী অভিমান করে বসে থাকবে–আর কথাই বলবে না।

*

বনহুরকে পেয়ে মালা আনন্দে আত্মহারা হলো। সখীদের সঙ্গ ত্যাগ করে বনহুরকে নিলো, সে সঙ্গী করে। ঝাঁমরাজ কন্যার সখে বাধা দিতে পারলেন না, তিনি আরও ভালভাবে মিশবার সুযোগ-সুবিধা করে দিলেন এ ব্যাপারে। রাজবাড়ি সংলগ্ন উদ্যানে মালা বনহুরের সঙ্গে ভ্রমণ করবে। উদ্যানের মধ্যে আছে মস্তবড় দীঘি, মালার বজরা ভাসতো দীঘির কালো জলে, মালা বনহুরকে নিয়ে বজরার দীঘির মধ্যে বিচরণ করবে।

 কিন্তু বনহুরের এসবে মোটেই মত নেই। সে যদিও মালার সঙ্গে তাল দিয়ে চলতে লাগলো তবুও সবসময় অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো মনে মনে। কিউকিলা হত্যা করতে এসে এ আবার কি ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়লো। রহমানকে ব্যাপারটা সব খুলে বললো বনহুর রহমান, বলো এখন কি করি? সব তো তুমি শুনলে?

 রহমান জানে, তার সর্দার যতই উচ্ছখল চঞ্চল দুষ্ট হোক, কিন্তু সে নিজের বেলায় অত্যন্ত সংযত। কত নারী বনহুরকে স্বামীরূপে পাবার জন্য জীবননাশ করেছে, তবুও তাকে পায়নি। নূরীর জীবনটাই একদিন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যেতো যদি না সে জোর করে নূরীকে সমর্পণ করতো তার। হাতে। রহমান সর্দারকে চরমভাবে জানে–জানে সে, যত সুন্দরী অপ্সরী নারীই হোক না, কিছুতেই সর্দারের মন টলাতে পারবে না। কিন্তু সবেরই তো সীমা আছে হাজার হলেও সর্দার মানুষ, ভুল করে বসাও তার পক্ষে অসম্ভব নয়। রহমানের মনে একটা দুশ্চিন্তার ছায়াপাত হয়। সর্দারের কথাবার্তায় সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে, মালার আচরণ তাকে অত্যন্ত বিব্রত করে তুলেছে। নিজকে সংযত রাখাও হয়তো কঠিন হয়ে পড়বে শেষ মুহূর্তে, রহমান মাথা চুলকে বলে–সর্দার, একটা কথা আমারু মনে হচ্ছে।

বলো?

সর্দার, মহারাজ মোহন্ত সিন্ধুর সঙ্গে দেখা করে জানিয়ে দিন জলদানব কিউকিলা হত্যা না করা পর্যন্ত আপনি রাজপ্রাসাদে আসতে পারবেন না বা তাঁর কন্যা মালার সঙ্গে মিশতে পারবেন না। এমন কি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করাও আপনার পক্ষে সম্ভব নয়।

ঠিক বলছো রহমান। কিন্তু কিউকিলা হত্যার পর কিভাবে মালার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবো?

 সর্দার, তখন যা হয় করা যাবে। সম্মুখে যে বিপদ সেটা থেকে আমরা উদ্ধার পেলে তখন এতো দুশ্চিন্তা থাকবে না।

সত্যি রহমান, আমি যেন কেমন বুদ্ধিহারা হয়ে পড়ছিলাম। সামান্য কথাটা আমি ভাবিনি।

সর্দার, আমার বেয়াদবি মাফ করবেন, আপনাকে আমি বুদ্ধি বাতলে দি, এমন সাহস আমার ছিলো না।

হাসলো বনহুর এবার, বললো–তোমাকে তো একদিন বলেছি রহমান, তুমি আমার সহচর শুধু নও–আমার বন্ধু।

 সর্দার! রহমান আবেগভরা কণ্ঠে বললো।

বনহুর শয্যা গ্রহণ করলো।

 রহমান তার নিজের শয্যার দিকে এগিয়ে গেলো। রাত তখন অনেক হয়েছে।

একসময় ঘুমিয়ে পড়লো রহমান।

বনহুরের চোখে ঘুম নেই, যেমন করে তোক কিউকিলাকে হত্যা করতেই হবে, ঝাম অধিবাসিগণকে এই নৃশংস হত্যা থেকে উদ্ধার করতে হবে, বাঁচাতে হবে সবাইকে। তারপর সাগরতলের রাজপ্রাসাদ তার চাই। কিন্তু মালামালাকে নিয়েই তার বেশি চিন্তা……

বনহুর যখন ঘাটিতে শয্যায় শয়ন করে এসব নিয়ে ভাবছে, ঠিক তখন সিন্ধি সমুদ্রের মধ্যে বিরাট একটা দেহ মাথা তুলে উঠে দাঁড়ালো। জমকালো পাথরের মূর্তির মত গোলাকার মাথায় ফুটবলের মত একটা চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

[পরবর্তী বই কিউকিলা ও দস্যু বনহুর]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *