গুপ্তপ্রসঙ্গ
(প্রমীলা কাণ্ড)
রাত সাড়ে দশটার সময় সদ্য খাওয়া শেষ হয়েছে, এর পরে খবরের কাগজগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে শুতে যাব, এমন সময় ফোন এল।
এই সময়টা ফোন-টোন খুব বিরক্তিকর। আমার নিতান্ত নিজস্ব এই কিছুক্ষণ খবরের কাগজের জন্যে নির্দিষ্ট এবং উৎসর্গীকৃত।
সারাদিন খবরের কাগজ পড়ার অবকাশ আমার হয় না। সকালে উঠে ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে পার্কে গিয়ে ভেজা ঘাসের উপরে খালিপায়ে এক ঘণ্টা হাঁটি। তারপর চা, দাড়ি কামানো, স্নান ইত্যাদি, অবশেষে ব্রেকফাস্ট। ততক্ষণে অফিসের প্রিজনভ্যান এসে যায়, ছুটে গিয়ে বন্দি হই। বন্দিদশা থেকে মুক্ত হতে সন্ধে সাড়ে সাতটা-আটটা। ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরি।
বাড়ি ফিরেও বিশেষ বিশ্রাম হয় না। আমার একমাত্র মামাতো ভাই ন্যাড়া গত বছর মন্ত্রী হয়েছে। আমার সূত্রে অনেকেই তার কাছে তদ্বির-তদারক করে। সন্ধ্যার এই সময়টা সেই সব লোকজন আসে৷ যদিও ক্লান্ত থাকি, কিন্তু ভালই লাগে। মন্ত্রী মামাতো ভাইয়ের ক্ষমতার কিঞ্চিৎ ভগ্নাংশ উপভোগ করতে করতে নিজেকেও বেশ ক্ষমতাবান মনে হয়। তাও তো নাড়ু এখনও পুরোপুরি মন্ত্রী নয়, নেহাত উপমন্ত্রী।
কাউকে কাউকে বেশ ধমকিয়ে দিই, বলি, নতুন রেশন কার্ড করার জন্যে বলা যাবে না, ওসব ছোট ব্যাপার পাড়ার কাউন্সিলরকে বলো, মন্ত্রীকে বলা যাবে না।
আবার কাউকে বলি, মন্ত্রীকে কি জামিনের কথা বলা যায়? জজ কোর্টে জামিন না পাও হাইকোর্টে যাও। মন্ত্রী এর মধ্যে মাথা গলাতে পারবে না।
কেউ কেউ ক্ষুণ্ণ হয়ে ফিরে যায়, আবার কারও কারও দরখাস্ত রেখে দিই। প্রত্যেক রোববার সকালে মামার বাড়ি যাই, মামাতো ভাই কদাচিৎ থাকে। আমি মামিমার হাতে কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে আসি। আমার মামিমা খুব বুদ্ধিমতী, চব্বিশ বছর বয়েসে ছয় বছরের ছেলে নিয়ে বিধবা হয়েছিলেন। কত আপদ-বিপদ, ঝড়-ঝঞ্ঝা মাথায় করে ছেলেকে মানুষ করেছেন, শুধু মানুষ নয়, মন্ত্রী করেছেন।
সে যা হোক, সে অন্য গল্প। মন্ত্রীর গল্প বলার সময় বা জায়গা এটা নয়। আর তত সাহসও আমার নেই।
বরং স্রেফ নিজের কথা বলি। সেটাই নিরাপদ। সুতরাং যা বলছিলাম, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ি-অফিস-বাড়ি। তারপর সন্ধ্যাবেলার তদ্বির-তদারক শেষ হওয়ার পরে হাত মুখ ধুয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিই। তারপর ডাক্তারের পরামর্শ মতো আধ ঘণ্টা, এবার আর খালিপায়ে নয়, চটিপায়ে রাস্তায় হাঁটি। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ বিছানায় শুতে আসি সকালবেলার খবরের কাগজ হাতে নিয়ে। তখন সেগুলো আর খবরের কাগজ নেই, ইতিহাস হয়ে গেছে। কিছু কিছু লোকমুখে অফিসে বা বাসায় সকাল থেকে শুনেছি, তেমন অতীব চমকপ্রদ সংবাদ হলে অফিসের বারোয়ারি কাগজে একবার দূর থেকে হেডলাইনে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়েছি।
কিন্তু হেডলাইনের চেয়েও আমাকে অনেক বেশি আকর্ষণ করে খুচরো খবর, আইন-আদালতের কলম এবং নানা ধরনের বিজ্ঞাপন।
রাতে নির্ভার শরীর ও মনে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আরাম করে খবরের কাগজগুলো পড়ি। তিনটে কাগজ রাখি আমি, তিনটেই বাংলা কাগজ, দিশি কাগজের ইংরেজি খবরে তেমন জুত পাই না, তার জন্যে টাইম, নিউজ উইক সপ্তাহান্তে যথেষ্ট।
খবরের কাগজ পড়ার সময় আমাকে কেউ বিরক্ত করে আমি সেটা চাই না। একদিক থেকে আমি নিশ্চিন্ত, আমি চিরকুমার, বিয়ে-টিয়ে করিনি। রাতের বেলা বিছানায় আমাকে বিরক্ত করার তেমন কেউ নেই।
কিন্তু সত্যিই আজ বিরক্ত হলাম। সবে প্রথম কাগজটার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় নিরুদ্দেশ বিজ্ঞাপনের এক যুবতীর (উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, উচ্চতা সোয়া পাঁচ ফুট, পরনে নীল তাঁতের শাড়ি) বর্ণনা পড়ে ফটোর চেহারার সঙ্গে যেটুকু সম্ভব মিলিয়ে নিচ্ছি, এমন সময় ফোনটা এল।
বেশ কয়েকবার ক্রিং ক্রিং করে বেজে ফোনটা থেমে গেল। দিনের বেলায় ফোনটা ভাইয়ের ঘরে থাকে, রাতে আমি আমার ঘরে নিয়ে আসি ওটা। সেটা নিতান্ত আত্মরক্ষার জন্যে, যাতে কাজের লোকজন কেউ ফোনটা ধরে আমাকে না ডাকতে পারে।
অন্যান্য দিন সাধারণত শোয়ার সময় ফোনের রিসিভারটা মেঝেয় নামিয়ে রাখি কিন্তু আজ ভুল হয়ে গিয়েছিল, সেই সুযোগে ফোনটা বাজছে। কার কী তদ্বির পড়েছে এত রাতে, এসব ফোন আমি চট করে ধরি না। এরকম ক্ষেত্রে আমি ফোনটাকে গুণে গুণে কুড়িবার বাজতে দিই, তারপর রিসিভারটা তুলে কট করে কেটে দিই।
এই রকম পরপর তিনবার ট্রায়াল দিই। তারপরেও ধৈর্য ধরে কেউ চতুর্থবার ফোন করে তাহলে ধরেই বলি, রং নাম্বার।
কিন্তু আমার গলার স্বর খুব মিহি, দুরভাষী তারের মধ্যে সে আরও মিহি হয়ে যায়, ফলে প্রায় প্রত্যেকেই ধরতে পারে, বলে, খোকাদা ঘুমুচ্ছিলে নাকি?
আজও সে রকম হতে পারত। কিন্তু আজকের ফোন যে করেছে সে কুড়িবার ক্রিং ক্রিং করার। জন্যে অপেক্ষা না করে আবার ফোন করল। আবারও দু-তিনবার বাজার পর ছেড়ে দিল।
কেমন খটকা লাগছিল। তৃতীয়বারে ফোনটা বাজতেই খপ করে ধরলাম। আমার ফোন ধরার কায়দাটা একটু অন্যরকম। বাইশ বছর বয়েস পর্যন্ত এমন এলাকায় ছিলাম যেখানে রেল স্টেশন, থানা আর দু-তিনটে মাড়োয়ারি গদি ছাড়া কোথাও ফোন ছিল না। আমি দূর থেকে ফোন দেখেছি। আমাকে কেউ কখনও ফোন করেনি, আমিও কাউকে করিনি।
কলকাতায় এসে আরও কিছুর সঙ্গে ফোন ব্যবহার করা শিখলাম। সদাগরি অফিসের কাজের দৌলতে নিজের বাড়িতেও একটা ফোন এল। কিন্তু ফোনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এখনও গড়ে ওঠেনি। জিনিসটাকে আমি দূরে দূরে রাখতেই চাই। নিজে বিশেষ ফোন করি না বা ধরি না, কিন্তু যদি কখনও বাধ্য হয়ে ধরতে হয় তবে অতর্কিতে, খপ করে, শক্ত পাঞ্জায় ধরি, যেন বিষধর সাপের গলা ধরেছি, অসতর্ক হলেই সর্বনাশ।
অবশেষে আজও তাই করলাম, এবং সাপটা ধরা পড়ল দুবার হ্যালো হ্যালোর পর, সাপটা কথা বলল, খোকাদা, আমি প্রসঙ্গ বলছি। বলা বাহুল্য প্রসঙ্গ কারও আসল নাম নয়, প্রসঙ্গ প্রসঙ্গমাত্র। টেলিফোনে আমি প্রসঙ্গ বলছি যে বলল তার পিতৃদত্ত নাম প্রমীলাকান্ত দাশগুপ্ত। সে ছবি আঁকে।
হায় ছবি তুমি শুধু ছবি
প্রমীলাকান্ত ওরফে প্রসঙ্গ আমার খুবই অনুগত। সে আর ন্যাড়া মানে আমার মামাতো ভাই একসঙ্গে ইস্কুলে পড়ত, দুজনে একই সঙ্গে পরপর দুবার হায়ার সেকেণ্ডারি ফেল করে। পরে ন্যাড়া সাপ্লাইয়ের ব্যবসা শুরু করে, কী সাপ্লাই তা অবশ্য কখনও বলেনি। আর প্রসঙ্গ আমার পরামর্শে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়। সেখানেও সে আঁকাজোকা শেষ করে পাশ হয়ে বেরোতে পারেনি। তার। আগেই সে আর্ট কলেজ ছেড়ে দেয়। কিন্তু ওই মহাবিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষা এবং সেই সঙ্গে জটিল অভিজ্ঞতা এখন তাকে জীবনে একটা পঁড়াবার জায়গা খুঁজে দিয়েছে।
তাকে নাম বদলের পরামর্শও আমি দিই, বলি যে, প্রমীলাকান্ত দাশগুপ্ত নামে এ বাজারে ছবি এঁকে সুবিধে করা কঠিন, নাম তোমাকে পালটাতে হবে। সে আমাকে বলেছিল, খোকাদা, তুমি যদি খোকা নামে বুড়ো হতে পারলে, তাহলে প্রমীলাকান্ত নামে আমার কী অসুবিধে হবে?
দু-চারবার চাপ দেবার পর প্রমীলাকান্ত অবশ্য আমার পরামর্শ গ্রহণ করেছিল। তার নতুন নামকরণও আমারও করা, প্রমীলার প্র রইল, সেই প্র দিয়ে হল প্রসঙ্গ, মধ্যপদ কান্ত সম্পূর্ণ বাদ আর। দাশগুপ্তের দাশ ঘেঁটে দিয়ে শুধু গুপ্ত রইল। অর্থাৎ প্রমীলাকান্ত দাশগুপ্ত হল প্রসঙ্গ গুপ্ত।
বেশ কাব্যময় নাম। নামটার মধ্যে একটু আর্টিস্ট আর্টিস্ট ভাব, একটা রহস্যময়তা আছে। আর নামটা বেশ লাকিও বটে, প্রথম একজিবিশনেই উতরিয়ে গেল প্রসঙ্গ গুপ্ত। কাগজে কাগজে অনেকটা লেখালেখিও হল। বাংলা দৈনিকের প্রৌঢ় কলারসিক মন্তব্য করলেন, প্রসঙ্গ অবান্তর নয়। ইংরেজি কাগজে প্রসঙ্গ গুপ্তকে সংক্ষিপ্ত করে দিয়ে লিখল, পি জি ইস ডিফারেন্ট। একটু ধরাধরি করতে হয়েছিল, কিন্তু সেটা বিফলে যায়নি।
তার প্রথম প্রদর্শনীতেই একটা অচেনা লোক একটা ছবি সস্তায় কেনার চেষ্টা করল। যদিও সে কিনল না কিন্তু দামদর করতে করতে পঁচিশ টাকা থেকে ষাট টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। ষাট টাকাতে দিলেও বিশেষ কোনও ক্ষতি ছিল না, কিন্তু ছবির গায়ে দাম লেখা ছিল বাইশশো পঞ্চাশ টাকা। এরপরে ষাট টাকায় দেওয়া খুব সম্মানজনক নয়।
সম্মানজনক হোক আর নাই হোক, শিল্পীর অপরিচিত ব্যক্তি ছবি কিনতে চাইছে–এরকম সাধারণত দেখা যায় না। এই ধরনের প্রদর্শনীতে যারা ছবি-টবি কেনে তারা সবাই শিল্পীর আশেপাশের চেনাশোনা লোক।
তবে এসব কথা বলার কোনও অধিকার নেই। আমি জীবনে কোনওদিন কোনও ছবি কিনিনি। ছবি বুঝিও না, সেটা প্রসঙ্গ জানে। এবং সম্ভবত সেই জন্যেই আমাকে একটু সম্মান-উম্মান করে।
প্রসঙ্গ যে খুব ফালতু নয় সেটা আমি এবং অনেকে টের পায় তারাপদবাবুর একটা লেখা পড়ে। তারাপদবাবু তাঁর কাণ্ডজ্ঞানে এক শিল্পীর কথা লিখেছিলেন, প্রদর্শনীতে যাঁর একটা ছবি দেখে জনৈক দর্শক উক্তি করেছিল, অপূর্ব ছবি। দেখলেই জিবে জল আসে। প্রসঙ্গ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছিল সেই দর্শককে, এটা হল সূর্যাস্তের ছবি। দেখে আপনার মনে আনন্দ হতে পারে। চোখে আরাম হতে পারে, কিন্তু জিবে জল আসে কী করে?
জবাবে নির্বিকার দর্শক বলেছিলেন, আমি ভেবেছিলাম ডবল ডিমের ওমলেটের ছবি। সূর্যাস্তের ছবি বুঝতে পারিনি। মাপ করবেন।
তারাপদবাবুর রসিকতা আমার একদম ধাতে সয় না, কিন্তু তিনি যে প্রসঙ্গের এই ব্যাপারটা নিয়েও রসিকতা করবেন এবং সেটা পড়ে পাবলিক হাসবে তা ভাবতে পারিনি।
গতবার সিঙ্গাপুরে এক কনফারেন্সে আমার যাওয়ার কথা ছিল। সব ঠিকঠাক, কিন্তু কীসে কী হল, আমার বড়সাহেব সেই কনফারেন্সে চলে গেলেন, আমার নিমন্ত্রণ আর এল না, অথচ বিষয়টা আমারই ছিল।
সে যা হোক, চাকরি করতে গেলে এমন অনেক হয়। বড়সাহেব আমি যাতে মনে দুঃখ না পাই, সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার সময় আমার জন্যে এক বোতল লাল জনিওয়াকার আর একটা গেঞ্জি নিয়ে এসেছিলেন।
বোতলটা পেয়ে খুশি হয়েছিলাম কিন্তু গেঞ্জিটার বুকে আর পিঠে বড় বড় বেগুনি অক্ষরে লেখা ছিল, কিক মি এগেইন, প্লিজ মানে আমাকে আবার লাথি মারুন।
বড়সাহেবের ইঙ্গিতটা আমি বুঝেছিলাম, কিন্তু মৃদু আপত্তি জানালাম, না স্যার। এ গেঞ্জিটা আমি গায়ে দিতে পারব না। লোকেরা হাসবে। বড়সাহেব বলেছিলেন, কী যা-তা বলছেন আপনি? জানেন না হাস্যকর হওয়াই এখন আধুনিকতা?
বড়সাহেবের কথাটা আমার মনে ধরেছিল। সুতরাং যখন তারাপদবাবুর কল্যাণে প্রসঙ্গ হাস্যকর হয়ে গেল, বুঝতে পারলাম এবার আর তাকে ঠেকানো যাবে না।
কে কাকে ঠেকাতে চায়? চাইলেও কেউ কাউকে কি ঠেকাতে পারে? যখন সে উঠতে থাকে, উঠতেই থাকে। হয়তো, হয়তো কেন নিশ্চয়, কেউ কেউ তাকে ঠেকাতে চেয়েছিল। প্রসঙ্গ আমার নিজের লোক। তা ছাড়া তার সঙ্গে আমার স্বার্থের কোনও সংঘাত নেই, তাকে যে ঠেকানো যায়নি তাতে আমি খুশি।
অবশ্য আজকাল প্রসঙ্গের সঙ্গে আমার খুব কম দেখাসাক্ষাৎ হয়। কিন্তু আমি মোটামুটি টের পাই যে সে ছবির আকাশে জেট বিমানের মতো তরতর করে উড়ছে।
কথাবার্তা
(পাঠক পাঠিকা মনে রাখবেন সত্যনারায়ণ = আমি এবং প্রমীলাকান্ত = প্রসঙ্গ)
প্রমীলাকান্ত: খোকাদা, আমি প্রসঙ্গ বলছি।
সত্যনারায়ণ: কে, প্রমীলা? তুমি এত রাতে বিরক্ত করছ? তুমি জান না আমি এখন খবরের কাগজ পড়ি!
প্রমীলাকান্ত: তা জানি। খুব ভালভাবেই জানি। কিন্তু একটা খবর কাগজে ছাপা হয়নি অথচ আপনার জানা দরকার সেই জন্যেই ফোন করছি।
সত্যনারায়ণ: (কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে) বলো কী খবর?
প্রমীলাকান্ত: খবরটা শুনলে আপনি চমকে উঠবেন।
সত্যনারায়ণ: তাড়াতাড়ি বলো। দেরি করে চমকাতে আমার মোটে ভাল লাগে না।
প্রমীলাকান্ত: আমি কলম্বো যাচ্ছি। ন্যাড়া পাঠাচ্ছে।
সত্যনারায়ণ: এই দুর্দিনে কলম্বো? তুমি কি ভারতীয় শান্তিসেনায় যোগ দিয়েছ?
প্রমীলাকান্ত: আরে তা নয়, আমি আমার বারোটা ছবি নিয়ে কলম্বোয় ভারত-উৎসবে যাচ্ছি।
সত্যনারায়ণ: এই দুর্দিনে ভারত-উৎসব! সাংঘাতিক কথা বলছ, তোমার কি কোনও বোধ নেই? নাড়ার কথায় ওদিকে যেয়ো না, মারা পড়বে। শোনো, আমাদের কোম্পানির একটা ব্রাঞ্চ অফিস ছিল কলম্বোয়, তার তামিল ম্যানেজারকে আজ আড়াই মাস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো গুমখুন হয়েছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
প্রমীলাকান্ত: দোহাই খোকাদা, এই মাঝরাত্তিরে ভয় দেখাবেন না। সব ঠিকঠাক, এখন ভয় খেলে। চলবে না। ভয় দেখাবেন না।
সত্যনারায়ণ: তুমিও মাঝরাত্তিরে আমার খবরের কাগজ পড়ায় বাধা দিয়ো না। (এই সময় টেলিফোনের মধ্যে একটা তৃতীয় কণ্ঠস্বর মহিলার গলা শোনা গেল, থ্রি মিনিটস ওভার, থ্রি মিনিটস৷)।
সত্যনারায়ণ: (একটু চমকিয়ে উঠে) সর্বনাশ, এটা ট্রাঙ্কল নাকি! এটা তো লোকাল কল মনে হচ্ছে না! প্রমীলাকান্ত তুমি কোথা থেকে কথা বলছ?
প্রমীলাকান্ত: কলকাতায় আমার ফ্ল্যাট থেকেই কথা বলছি। সত্যনারায়ণ: তাহলে থ্রি মিনিটস ওভার–থ্রি মিনিটস এসব কী হচ্ছে?
প্রমীলাকান্ত: আমি নিজে তো ফোন পাইনি। বাড়িওয়ালির কাছ থেকে টাইলাইন নিয়েছি। তার সঙ্গে চুক্তি একনাগাড়ে তিন মিনিটের বেশি কথা বলব না। তাই তিনি তিন মিনিট হয়ে গেলেই ওইরকম আওয়াজ দেন।
সত্যনারায়ণ: কিন্তু মহিলার গলার স্বর কেমন চেনা চেনা মনে হল। উনি কি টেলিফোন ডিপার্টমেন্টে ট্রাঙ্ক সেকশানে আগে কাজ করতেন? (এই সময় টেলিফোনের মধ্যে আবার তৃতীয় কণ্ঠস্বর শোনা গেল, শাট আপ!)।
প্রমীলাকান্ত: খোকাদা আপনি ডোবালেন। বাড়িওয়ালি টাইলাইনে সব কান পেতে শুনছে। (পুনরায় টেলিফোনের মধ্যে তৃতীয় কণ্ঠস্বর, না, আমি শুনছি না। মিথ্যুক কোথাকার!)
সত্যনারায়ণ: উনি তো শুনছেন না বলছেন, শুধু শুধু ভদ্রমহিলার নামে দোষ দিচ্ছ। (আবার টেলিফোনের মধ্যে করুণ তৃতীয় কণ্ঠস্বর, দেখুন তো!)।
প্রমীলাকান্ত: খোকাদা, বাড়িওয়ালির সাইড নেবেন না। ওর গ্যারেজের ঘরে ছবিগুলো রেখেছিলাম। হঠাৎ তালা দিয়ে দিয়েছে। এখন ছবিগুলো কী করে বার করি, কী করে ভারত-উৎসবে নিয়ে যাই! অনেকটা সেই জন্যেই আপনাকে ফোন করছি।
তৃতীয় কণ্ঠস্বর: আগে দেড় বছরের গ্যারেজ ভাড়া মেটাও। তার সঙ্গে দেড় কুইন্টাল দুধের দাম দিতে হবে।
প্রমীলাকান্ত: ভারত-উৎসব থেকে ফিরেই আপনার গ্যারেজ ভাড়া দিয়ে দেব। কিন্তু দুধের দামটা কেন বুঝতে পারছি না।
তৃতীয় কণ্ঠস্বর: বুঝতে পারছ না? গ্যারেজের ঘরে আমার মেনি বেড়াল চারটে বাচ্চা দিয়েছিল। সে তোমার ছবিগুলো দেখে ভয় পেয়ে বাচ্চা ফেলে পালিয়ে যায়। সেই চারটে বাচ্চাকে তাদের তিন মাস বয়েস পর্যন্ত বড় না হওয়া পর্যন্ত একেকটাকে দৈনিক সিকি লিটার করে মাদার ডেয়ারির দুধ খাওয়াতে হয়েছে। হিসেব করলে অনেক হয়, তুমি দেড় কুইন্টালের দামটাই দাও। তা ছাড়া এখন মাদার ডেয়ারির দুধের দাম অনেক বেড়ে গেছে, তুমি না হয় পুরনো দামটাই দাও।
প্রমীলাকান্ত: সব মিথ্যে কথা। আপনি ভঁহা কৃপণ। আপনার মেনি বেড়াল খেতে না পেয়ে পালিয়েছে, আমার ছবি দেখে ভয় পাবে কেন?
তৃতীয় কণ্ঠস্বর: মিথ্যে কথা কেন হতে যাবে? সেবার তুমি যখন খোলা উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকছিলে, এক রাজ্যের কাক এসে পরপর তিনদিন ধরে চিৎকার চেঁচামেচি করেনি?
প্রমীলাকান্ত: তার কারণ ছিল, ওটা আমি কাকতাড়ুয়ার ছবি আঁকছিলাম।
তৃতীয় কণ্ঠস্বর: কিন্তু তখন তুমি আমাকে বলেছিলে আমার পোর্ট্রেট আঁকছ, সেই জন্যে আমি তোমাকে আমার গ্যারেজের ঘরটা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
প্রমীলাকান্ত; কী করব বলুন! আমি তো আপনার ছবিই আঁকতে চেয়েছিলুম। কিন্তু একে আপনার চেহারাটা কেমন যেন, তার পরে সেই আমার প্রথম পোর্ট্রেট, তালেগোলে কাকতাড়ুয়া হয়ে গেল! সে যা হয়েছে ক্ষমা করে দিন! দয়া করে আমার ছবিগুলো ছেড়ে দিন।
সত্যনারায়ণ: (হাই তুলতে তুলতে) ও বাড়িওয়ালি দিদি, ছবিগুলো ছেড়ে দিন না। বুঝছেন না কত বড় ব্যাপার। কলম্বোয় ভারত-উৎসবে যাচ্ছে ভারত-শ্রীলঙ্কা মৈত্রীর পথে বাধা দেবেন না।
তৃতীয় কণ্ঠস্বর: তা বাধা দেব না কিন্তু যা বলেছি, আমার গ্যারেজ ভাড়া আর দুধের দাম মিটিয়ে দিতে হবে।
সত্যনারায়ণ: (বিরক্ত কণ্ঠে) ভাড়া আর দুধের দাম সবসুদ্ধ কত টাকা হবে?
তৃতীয় কণ্ঠস্বর: গ্যারেজ ভাড়া তিনশো টাকা করে, মাসে, দেড় বছরে চার হাজার আটশো টাকা আর সেই সঙ্গে দেড় কুইন্টাল দুধের দাম চার টাকা দরে ছশো টাকা।–পাঁচ হাজার চারশো টাকা হচ্ছে মোটমাট, আমি পাঁচ হাজার পেলেই ছেড়ে দেব।
সত্যনারায়ণ: প্রমীলাকান্ত, তোমার কাছে কত টাকা আছে?
প্রমীলাকান্ত: বহুকষ্টে হাজার দেড়েক টাকা জমিয়েছিলাম। কিন্তু ন্যাড়া বলল, আর্টিস্ট হয়ে বিদেশ সফরে যেতে হলে ভেক চাই। তাই দুজোড়া লাল সিল্কের পাজামা-পাঞ্জাবি বানালাম, একজোড়া জরির নাগরা কিনলাম। তারপরে ফটো ভোলা, পাসপোর্ট করা, তাতেও খরচা হল! এখন হাতে আর একাশি টাকা ষাট পয়সা মাত্র আছে। নাডু বলেছে সরকারি টাকা পাওয়া যাবে, কিন্তু সে কবে পাব কে জানে!
সত্যনারায়ণ: তাহলে ও পাঁচ হাজার টাকা আমিই তোমাকে ধার দেব। ফিরে এসে শোধ দিও। কাল হবে না, পরশু এসে টাকা নিয়ে যেও।
তৃতীয় কণ্ঠস্বর: বাঁচালেন। প্রমীলাকান্ত: এবার দুজনে ফোনটা ছেড়ে দিয়ে আমাকে বাঁচাও তো!
যাত্রাভঙ্গ
এই বাক্যালাপের দুদিন পরে অফিসে গিয়ে প্রথমে ব্যাঙ্ক থেকে প্রসঙ্গের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা তুলোম। সন্ধ্যাবেলা বাসায় সে এসে টাকাটা নিয়ে যাবে, এইরকম ধরে নিয়েছিলাম।
কিন্তু সে এল না। যদি কোনও ফোন করে সেই জন্যে ফোনটা রিসিভার থেকে না নামিয়ে রেখে দিলাম যাতে এলে ধরতে পারি।
কিন্তু কোনও ফোনও এল না। রাতে নির্বিঘ্নে খবরের কাগজ পড়া শেষ করে ঘুমোলাম। খবরের কাগজে দেখলাম মন্ত্রিসভায় রদবদলের সম্ভাবনা কিন্তু বিস্তারিত কিছু লেখেনি। ন্যাড়া ছোটখাটো উপমন্ত্রী, নিশ্চয়ই এই রদবদলের মধ্যে সে আসবে না। কিন্তু তবু কেমন সন্দেহ হল, হয়তো প্রসঙ্গ ন্যাড়া ব্যাপারেই কোথাও আটকে গিয়েছে। পুরনো বন্ধু হিসেবে অনেক সময় ন্যাড়ার হয়ে সে অনেক দৌড়াদৌড়ি করে।
রাতে কোনও ফোন-টোন আসেনি। কিন্তু ভোরবেলা ঘুম ভাঙল ফোনের আওয়াজে। মামিমা ফোন করছেন, খুব উত্তেজিত ও খুশি, খোকা শুনেছিস, একটু আগে খবর পেলাম ন্যাড়া প্রমোশন পেয়েছে।
হায়ার সেকেন্ডারি দুবার ফেল করার পরে ন্যাড়া লেখাপড়া ছেড়েছে সে আজ প্রায় কুড়ি বছর। কোনও চাকরি-বাকরিও করে না, রীতিমতো মন্ত্রী, তার বার আবার প্রমোশন কী! আর এই শেষরাতে কীসের প্রমোশন?
মামিমা নিজেই বুঝিয়ে বললেন, ন্যাড়া কাল রাতে প্রতিমন্ত্রী হয়েছে। আগে তো উপমন্ত্রী ছিল, এখন ক্ষমতা বাড়ল। বড় বাংলো পাওয়া যাবে। খুব বড় প্রমোশন হল।
আপন মামাতো ভাইয়ের এই উন্নতিতে খুশি হয়ে মামিমাকে বললাম, খুব সুখবর। আমি সন্ধ্যাবেলা আসছি।
ফোন নামিয়ে রাখতে না রাখতে প্রসঙ্গ এল। তার মুখে চোখে তেমন আনন্দের ছটা দেখতে পেলাম না, বরং কেমন একটা হতাশ ভাব। বুঝলাম ন্যাড়ার খবরটা সে পায়নি, তাকে চাঙ্গা করার জন্যে প্রমোশনের খবরটা তাকে বললাম।
প্রসঙ্গ বলল, এ তো বাসি খবর। কাল বিকেল থেকেই জানি। আজ সকালে সব খবরের কাগজেই বেরিয়েছে। ন্যাড়ার তো প্রমোশন হল কিন্তু ঠেকে গেলাম আমি।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কী ঠেকে গেলে?
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল, আমার ভারত-উৎসবটা মারা পড়ল।
প্রসঙ্গের কথা প্রথমে ধরতে না পারলেও পরে বুঝলাম যে ন্যাড়া ছিল ঐতিহ্য ও উৎসবদপ্তরের উপমন্ত্রী, এখন সে হল জাহাজ নির্মাণ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী। সুতরাং কলম্বোয় আগের মন্ত্রীর বন্ধুর ছবি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। আমলারা আগে থেকেই আঁচ পেয়েছিল ব্যাপারটা, কাল বিকেলেই প্রসঙ্গের নাম কেটে দিয়ে নতুন বিহারি উপমন্ত্রীর শ্যালিকার নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে। সে মহিলা অবশ্য ছবি আঁকেন না, তাঁর নাচের ইস্কুল আছে পাটনায়।
প্রসঙ্গ বলল, বড় আশা করে ছিলাম, খোকাদা। ন্যাড়া তো আর দুদিন পরেও প্রমোশন পেতে পারত।
আমি একদিকে আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে পাঁচ হাজার টাকাটা আমাকে ধার দিতে হল না। তবু প্রসঙ্গকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে বললাম, দ্যাখো নাড়ু এখনও হয়তো কিছু করতে পারবে।
প্রসঙ্গ শুকনো মুখে বলল, জাহাজ নির্মাণ দপ্তরে ন্যাড়া আমার জন্যে কী করতে পারবে, আমি তো আর জাহাজ বানাতে পারব না! বলে প্রসঙ্গ ভগ্নহৃদয়ে চলে গেল। আমি তাকে বিশেষ ভরসা দিতে পারলাম না।
কিন্তু আমি আর প্রসঙ্গ দুজনেই ন্যাড়াকে মাপতে ভুল করেছিলাম। পরের দিন সকালে আবার প্রসঙ্গ এল হাঁপাতে হাঁপাতে, খোকাদা, খবরের কাগজ দেখেছেন?
আমি তখন পার্কে খালিপায়ে হাঁটছিলাম ভেজা ঘাসের ওপরে, সেখানেই প্রসঙ্গ এসে আমাকে ধরল। আমি তাকে বললাম, তুমি তো জানো, আমি সকালে খবরের কাজ দেখি না।
প্রসঙ্গ বলল, আজ একটু দেখুন। দেখলাম চারের পাতায় সপ্তম কলমে একটা ছোট খবর:
ভারতীয় জাহাজে ছবি
…জাহাজ নির্মাণ দপ্তরের নতুন প্রতিমন্ত্রী কার্যভার গ্রহণ করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে ভারতীয় যাত্রী জাহাজগুলিকে আরও সুন্দর ও সুষমামণ্ডিত করা হবে। প্রত্যেকটি জাহাজের ডেকে একটি করে উচ্চমানের ছবি টাঙানো হবে।
প্রসঙ্গত জানা গেল বিখ্যাত চিত্রকর শ্রীযুক্ত প্রসঙ্গ গুপ্ত প্রথম বারোটি জাহাজের জন্যে তাঁর বারোটি বিখ্যাত ছবি সরকারকে দিতে সম্মত হয়েছেন।
জাহাজ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন যে, এর জন্যে উপযুক্ত মূল্য শিল্পীকে সরকার দেবেন। খবরটা পড়া শেষ হবার পর প্রসঙ্গের মুখের দিকে তাকালাম। তার মুখভরা হাসি, সে বলল, ন্যাড়া কী করল দেখলেন! এখন সেই পাঁচ হাজার টাকাটা দিন তো, বাড়িওয়ালির কাছ থেকে ছবিগুলো ছাড়াতে হবে! তারপর একটু থেমে বলল, আচ্ছা একেকটা ছবির জন্যে সরকার যদি দশ হাজার টাকা করে দেয়, তাহলে তার থেকে বেশি চাওয়া কি উচিত হবে?
আমার অনেকদিন আগের প্রসঙ্গের প্রথম প্রদর্শনীর সেই ক্রেতাটির কথা মনে পড়ল যে ষাট টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। লোকটা এখন এখানে থাকলে অজ্ঞান হয়ে যেত।