গুপ্তধন
ওইযে লোকটি লাঠি ঠকঠক করতে করতে এগিয়ে আসছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, ওকে তোমরা কেউ চেনো কি?
গায়ের রং ভুসোকালির মতো; বয়স ষাটের কাছাকাছি এবং দেহ অস্থিচর্মসার হলেও তেলপাকা বাঁশের লাঠির মতো শক্ত ও সোজা; চোখ দুটো একে কুতকুতে, তায় ট্যারা এবং ডান পা-খানা বাঁকা ও খোঁড়া৷ লোকটি নাপিতকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাবার জন্যে মাথায় রাখে লম্বা চুল এবং মুখে রাখে গোঁফ-দাড়ি৷ কাপড়ের বাজার আক্রা বলে পরে কালো রঙের লুঙ্গি৷ সর্বদাই গলায় চিটচিটে ময়লা পইতে ঝুলিয়ে আদুর গায়ে থাকে এবং বাইরে যেতে বাধ্য হলে অঙ্গে ধারণ করে বড়োজোর একটা গেঞ্জি৷
চেহারাখানি পছন্দ হচ্ছে না? ওর নামটিও বোধ হয় তোমাদের মনে ধরবে না- শ্রীবটুকভৈরব ভট্টাচার্য৷
মহাকবি সেক্সপিয়রের সৃষ্ট কুশীদজীবী মহাজন সাইলকের নাম আজ সারা পৃথিবীতে কুবিখ্যাত হয়ে আছে৷
বরানগরে সেক্সপিয়রের সমকক্ষ কবির জন্ম হয়নি, তাই বটুকভৈরব ভট্টাচার্যের নাম দুনিয়াময় ছড়িয়ে পড়তে পারেনি৷ কিন্তু স্থানীয় লোকজনদের কাছে সে ছিল বিভীষিকার কুখ্যাত অগ্রদূতের মতো৷
বটুক দিন গুজরান করত সুদে টাকা খাটিয়ে৷ মা বাপ ভাই বোন বউ ছেলেমেয়ে বলতে বটুকের কেউ ছিল না, কিন্তু তার মুখ দেখলে বা কথা শুনলে মনে হয় না যে, এজন্যে সে কিছুমাত্র অভাববোধ করে৷ নিজের বাড়িতে একাই একশো হয়ে থাকতে চায়, বামুন চাকর ঝি পর্যন্ত রাখতে নারাজ-বলে, চুরি করবে, গলায় ছুরি দেবে, সর্বস্ব লুটে নেবে৷ লোকে বলে, তার লোহার সিন্দুক হাতড়ালে পাওয়া যাবে নগদে আর সোনাদানায় লক্ষ টাকার ঐশ্বর্য৷ অথচ একখানা পুরাতন নড়বড়ে ছোটো বাড়ির তিনখানা খুপরি খুপরি ঘর নিয়ে সে থাকে এবং সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম চালনা করে স্বহস্তে৷
বুঝতেই পারছ, যাকে বলে হাড়কিপটে, বটুক হচ্ছে সেই দলের লোক৷ সে ফোঁটা-তিলক কেটে নিজেকে পরম বৈষ্ণব বলে প্রচার করে, কাজেই সেই অজুহাতে মাছ-মাংস ছোঁয় না৷ মাসে দুই-একদিনের বেশি বাজারে যায় না, কারণ নিজের বাড়ির সঙ্গে সংলগ্ন একখণ্ড জমিতে ফলিয়েছিল লাউ, কুমড়ো, বেগুন ও ঝিঙে-ধুঁধুল প্রভৃতি তরিতরকারি, দুটি ভাতের সঙ্গে তাই দিয়েই সেই নিবারণ করত ক্ষুধার তাড়না৷
আমরা বলাবলি করতাম, বটুকের টাকায় হাত দেবার জনপ্রাণী নেই, তবে কার জন্যে সে এত কষ্ট স্বীকার করছে? এই টাকার কুমির কি মরবার পরও যক হয়ে নিজের সিন্দুক আগলে বসে থাকবে?
সে কথা কয় এমন ট্যাঁকখোরের মতো যে, শুনলেই খারাপ হয়ে যায় মেজাজ৷ তার মনের মিল নেই কারুর সঙ্গেই এবং সাধ্যমতো কেউ তার ছায়া মাড়াতে চাইত না৷ কিন্তু তবু অভাবী ও অভাগা লোকেরা তার দরজায় ধন্না দিতে বাধ্য হত কেবল টাকা ধার করবার জন্যেই৷
উত্তমর্ণ ও অধমর্ণ অর্থাৎ টাকা যারা ধার দেয় আর যারা ধার নেয় তাদের মধ্যে মিষ্ট সম্পর্ক থাকে না কোনো কালেই৷
আবার এমন সব মহাজনও আছে, ঋণীদের কাছে যারা দুর্জন নয়৷ গোড়াতেই বলে রেখেছি এ শ্রেণির মহাজন ছিল না বটুকভৈরব৷ নিতান্ত দুর্ভাগ্য না হলে কেউ তার দ্বারস্থ হতে চাইত না৷ সুদ তার যেমন চড়া, মেজাজ তার তেমনি কড়া৷
দৃষ্টান্তস্বরূপ নিতাইচাঁদের কথাই ধরো না! বছর দুই আগে কলেরায় একসঙ্গে মারা পড়ল তার বউ, এক ছেলে ও এক মেয়ে৷ তার সংসারে আপন বলতে রইলেন কেবল মা, গত বৎসর থেকে তিনিও পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী এবং এ-বৎসর তাঁর শয্যা পরিণত হয়েছে মৃত্যুশয্যায়৷ এখনও বেঁচে আছেন বটে, কিন্তু ডাক্তার জবাব দিয়ে গেছে৷
নিতাই একে গরিব, তার উপরে ওই সব আধিব্যাধির দায়ে তাকে বাধ্য হয়ে বারে বারে বটুকের কাছ থেকে বাড়ি ও জমি বাঁধা রেখে টাকা ধার করতে হয়েছিল৷ আসল ধার পাঁচশো টাকার বেশি নয়, কিন্তু নিতাইকে এ-পর্যন্ত সুদ গুণতে হয়েছে যত টাকা, তার পরিমাণ ছাড়িয়ে উঠেছিল আসলকেও৷
নিতাইয়ের মায়ের অবস্থা সেদিন অতিশয় খারাপ, সে দিনটা কাটে কি না সন্দেহ৷
এমন দুর্দিনেই নিতাইদের সদরে লাঠি ঠকঠকিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বটুকের আত্মপ্রকাশ৷ এসেই খ্যাঁকখেঁকিয়ে সে বলে উঠল, ‘অহে নিতাই, বলি তোমার মতলবখানা কী? গেল মাসের সুদ বাকি পড়েছে, এ মাসে আমি আর কোনো কথাই শুনব না!’
নিতাই হাতজোড় করে বলল, ‘আজ্ঞে ভট্টাচার্যমশাই, বাড়ির পাশেই থাকেন, কিছুই তো আপনার অগোচরে নেই৷ আমার মা যে এখন যান তখন যান হয়ে আছেন৷’
বটুক তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলল, ‘তোমার মা মরবে আমার কী? নিয়ে এসো আমার টাকা, নইলে আমি নালিশ করব৷’
নিতাই বলল, ‘মা মারা গেলে আমি এই বাড়ি আর জমি বেচে সুদে-আসলে আপনার টাকা শোধ করব৷ অন্তত এ মাসটা আমাকে রেহাই দিন৷’
কিন্তু বটুক নাছোড়বান্দা৷ নিতাইয়ের কাকুতিমিনতি, চোখের জল, পায়ে ধরা সবই ব্যর্থ৷ অবশেষে পাড়ার এর-ওর-তার কাছে হাত পেতে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে কোনো রকমে তাকে দুই মাসের সুদের দাবি মেটাতে হল৷
তারপর কাটল তিন সপ্তাহ৷
ইতিমধ্যে নিতাইয়ের মায়ের মৃত্যু ও শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া শেষ হয়ে গিয়েছে এবং শ্রাদ্ধের ভোজসভায় বটুকও যোগ দিতে লজ্জিত হয়নি৷
সেইদিনই নিতাই তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিল, ‘ভটচার্যমশাই, আপনার পাঁচশো টাকার জন্যে ভাববেন না, বাড়ি আর জমি বিক্রি করবার জন্যে এর মধ্যেই আমি দালালদের খবর দিয়েছি৷’
চলে আসতে আসতে নীরস কন্ঠে বটুক বলেছিল, ‘দেখা যাবে৷’
বটুকের ঘুম বড়ো সজাগ, চোরের ভয়ে কোথাও খুট করে শব্দ হলেই সে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে৷
এক রাত্রে কী এক সন্দেহজনক আওয়াজে চট করে তার ঘুম ভেঙে গেল৷ স্তব্ধ গভীর রাত্রে কোথায় যেন কোদাল দিয়ে মাটি কোপানো হচ্ছে৷ বটুক বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেল এক অদ্ভুত দৃশ্য৷
নিতাইদের বাড়ির পিছনদিকটা জুড়ে ছিল খানিকটা জঙ্গলভরা পোড়ো জমি, কেউ সেদিকে যেত না৷ একটা ঝোপের পাশে জ্বলছে হ্যারিকেন লন্ঠন৷ একজন লোক কোদাল দিয়ে মাটি কোপাচ্ছে আর একজন লোক মস্ত পোঁটলা থেকে কী সব বার করে পাশের একটা বড়ো ট্রাঙ্কের ভিতর রেখে দিচ্ছে৷
কী ওগুলো! রাশি রাশি টাকার মতো চকচকে চাকতি! হ্যাঁ, ওগুলো টাকা না হয়ে যায় না! হে ভগবান, এ যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা!
ওরে বাস রে, ওসব আবার কী? তাড়া তাড়া কাগজ যে! কী কাগজ? মিটমিটে আলোয় দূর থেকে স্পষ্ট না দেখা গেলেও কাগজের আকার দেখে এটুকু বুঝতে দেরি লাগে না যে, ওগুলো হচ্ছে নোটের তাড়া! বটুক একে একে গুণে দেখল, পঞ্চাশটা মোটা মোটা তাড়া৷ ওরে বাবা!
গর্ত খোঁড়বার পর লোকদুটো ট্রাঙ্কটা তার মধ্যে পুরে আবার মাটি চাপা দিল৷ তারপর সেখানে গাদা গাদা ডাল-পাতা ও রাবিশ বিছিয়ে উঠে দাঁড়াল৷ একবার চারিদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে আলো নিবিয়ে ফেলল৷ তারপর আবছা-আবছা দেখা গেল, তারা চোরের মতো চুপিচুপি পাঁচিল ডিঙিয়ে বাইরে এসে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল কোথায়!
বিষম লোভে বটুকের চোখ জ্বলতে ও দারুণ উত্তেজনায় তার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল৷ এ যে গুপ্তধনের ব্যাপার, তাতে আর সন্দেহ নেই৷ ব্যাটারা নিশ্চয় চোর কি ডাকাত, কোথায় চুরি বা লুঠতরাজ করে পুলিশের ভয়ে আপাতত কিছুদিনের জন্যে এখানে বামাল লুকিয়ে রেখে গেল! সবাই জানে এই পোড়ো জমিতে কেউ পা বাড়ায় না৷
বটুক আন্দাজ করতে লাগল, কত টাকা ওখানে থাকতে পারে? অন্তত পঁচিশ-ত্রিশ হাজারের কম নয়-চাই কি পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর বা তারও চেয়ে বেশি হতে পারে৷ নোটগুলো যদি একশো টাকার হয়, তাহলে তো কথাই নেই!
উঃ!
লাফ মেরে পাঁচিল ডিঙিয়ে তখনই চোরের উপর বাটপাড়ি করবার জন্যে বটুকের হাত-পা নিশপিশ করতে লাগল৷ কিন্তু তার পা খোঁড়া এবং পাঁচিল যা উঁচু! তারও উপরে নিতাইদের আছে দুটো বড়ো বড়ো খেঁকি নেড়ি কুকুর, মাঝে মাঝে তারা তাকেও দাঁত খিঁচিয়ে তাড়া করে আসে৷ কুকুরের কামড় খেয়ে জলাতঙ্ক রোগে মরবার সাধ তার নেই৷
কিন্তু কুকুরেরা এই অজানা লোকদুটোর সাড়া পেল না কেন? তারা কি বাইরে টইল দিতে গিয়েছে?
পরের দিন ভোরবেলাতেই বটুক হন্তদন্ত হয়ে নিতাইয়ের বাড়িতে ছুটল৷
নিতাই সুধোল, ‘কী ভটচাযমশাই, এত সকালে যে?’
বটুক বাজে কথায় সময় নষ্ট করবার লোক নয়৷ বলল, ‘বাবা নিতাই, তুমি সেদিন বলছিলে না, তোমার বাড়ি আর জমি বেচতে চাও?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ দালালের মুখে একজন খদ্দের দর দিয়েছেন সাড়ে হাত হাজার টাকা৷’
‘সাড়ে সাত হা-জার! ওরে বাবা, ওই পচা বাড়ি আর পোড়ো জমির দাম সাড়ে সাত হাজার টাকা! কারুর কি মাথা খারাপ হয়েছে হে?’
নিতাই বলল, ‘এক বুড়ো জমিদারের সখ হয়েছে শেষ জীবনটা গঙ্গার ধারে কাটিয়ে দেবেন৷ আমার বাড়ি থেকে গঙ্গা দেখা যায়৷ দুই-একদিনের মধ্যেই বায়না হবার কথা৷’
নগদ সাড়ে সাত হাজার টাকা যে বুকের রক্তের অনেকখানি! অতগুলো টাকা কি ফস করে হাতছাড়া করা যায়? দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বটুক গুটিগুটি বাড়ি ফিরে এল৷ সারা রাত দুর্ভাবনায় তার ঘুম হল না৷ বলে কিনা দুই-একদিনের মধ্যেই বায়না হয়ে যাবে! তবেই তো!
কিন্তু যে পড়ো-পড়ো বাড়ির বাজার-দর দেড় হাজার টাকাও উঠবে না, তার জন্যে কি-
বটুক আর ভাবতে পারল না, পরদিনই আবার গিয়ে হাজির হল নিতাইয়ের দরজায়৷
‘কি ভটচার্যমশাই!’
‘নিতাই, তোমার বাড়ি আমিই কিনব৷ কিন্তু এক শর্তে৷’
‘শর্তটা কী?’
‘তোমাকে তিন দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হবে৷’
‘এত তাড়াতাড়ি কীসের?’
‘ভালো ভাড়াটে পেয়েছি৷ এক বছরের ভাড়া আগাম দেবে৷ এখনই আসতে চায়৷’
‘বেশ, আমার আপত্তি নেই৷ কিন্তু চাই নগদ সাড়ে সাত হাজার টাকা৷’
ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বটুক তিক্তকন্ঠে বলল, ‘বেশ, বেশ, তাই হবে!’
তাই হল৷ লেখাপড়া হয়ে গেল চটপট৷ ধার শোধের জন্য মহাজনকে পাঁচ শত টাকা দিয়ে, পুরো সাত হাজার টাকা নিয়ে নিতাই তিন দিনের মাথায় ছাড়ল তার বাস্তুভিটা৷
বটুকের আর তর সইল না, তৎক্ষণাৎ নিতাইয়ের বাড়ি দখল করে বসল৷ তার মন বুকের ভিতরে ধেইধেই করে নাচতে নাচতে ক্রমাগত বলতে লাগল-কেল্লা মার দিয়া, কেল্লা মার দিয়া বাবা, কেল্লা মার দিয়া!
তারপর সেই রাত্রেই৷
ঝিমন্ত রাতে ঘুমন্ত বাতাস৷ গঙ্গার বুকেও ঝিমঝিম ভাব, স্রোত বইছে ঝিরঝির-শোনা যায় কি না যায়৷ খালি ঝিঁঝিঁপোকাগুলো ঝর্ঝরে গলায় একটানা ডেকে চলেছে ঝিঁঝিঁ ঝিঁঝিঁ-
এমন সময়ে পোড়ো জমির উপরে এক হাতে লন্ঠন ও আর এক হাতে কোদাল নিয়ে বটুকের আবির্ভাব৷
এই সেই জায়গাটা৷
তাড়াতাড়ি ডালপালা ও রাবিশ সরিয়ে মাটি কোপাতে কোপাতে বেরিয়ে পড়ল একটা মরচে-ধরা, তোবড়ানো ও পুরাতন টিনের ট্রাঙ্ক৷
থরথর কম্পিত বুকে বটুক ট্রাঙ্কের ভিতর হাত চালিয়ে আঁজলা করে বার করতে লাগল রাশি রাশি চকচকে টিনের চাকতি৷ আর বেরোতে লাগল নোটের মাপে কাটা তাড়া তাড়া চোতা কাগজ!
ট্রাঙ্কের ভিতর আর কিছুই নেই-খালি রাশি রাশি টিনের চাকতি আর তাড়া তাড়া চোতা কাগজ-টিনের চাকতি আর চোতা কাগজ৷
বিকট স্বরে আর্ত চিৎকার করে বটুক অজ্ঞান হয়ে ঘুরে পড়ে গেল সেইখানেই৷
তখন কলকাতায় চৌরঙ্গির এক রেস্তোরাঁয় বসে চপ, কাটলেট আর ফাউল কারির অর্ডার দিয়ে নিতাই তার আরও দুই বন্ধুর সঙ্গে হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল৷
তাদের ফন্দি যে এত সহজে এমন লাগসই হবে এটা কেউই আন্দাজ করতে পারেনি৷