গুপ্তধনের সন্ধানে
টিফিনের ঘণ্টা বাজতেই মেয়ের দল হইহই করে বেরিয়ে পড়ল। শ্রাবণী, অদিতি, মধুছন্দা, সমাপ্তি, মিতালি আর জয়শ্রী—এরা মাঠে গিয়ে গোল হয়ে বসল। সবাই ঝরিয়া কীর্তিচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। সাত ক্লাসে পড়ে। এই ছজন এক প্রাণ, এক মন। স্কুলে সব সময়ে একসঙ্গে।
শ্রাবণী বলল, এই মিতালি, টিফিনের সময় কী বলবি বলছিলি, বল?
মিতালি টিফিন বাক্স খুলে পাঁউরুটির টুকরো বের করে সকলের হাতে দিল। অদিতি সন্দেশ এনেছিল, তা-ই সবাইকে বিলি করল।
শ্রাবণী বলল, তোদের একটা নতুন জিনিস খাওয়াব। কলকাতায় আমার দিদার বাড়ি থেকে আমের আচার এনেছি। পাঁউরুটি দিয়ে ভালোই লাগবে। এই নে।
শ্রাবণী ছোটো একটা কাচের শিশি বের করে সকলের সামনে রাখল। আচারের নামে মেয়েরা পাগল। সবাই শিশি খুলে আচার পাঁউরুটিতে মাখিয়ে নিল।
জয়শ্রী আবার মনে করিয়ে দিল। কী রে মিতালি, কী বলবি বল। এখনই তো ঘণ্টা পড়ে যাবে।
হাতের ওপর গড়িয়ে-আসা আচার চাটতে চাটতে মিতালি বলল, বলছি, সে ভারী মজার কথা।
মেয়েরা আরও ঘন হয়ে বসল।
মিতালি বলতে আরম্ভ করল।
কাল রাতে বাবা মা-কে যা বলছিল, আমি সব শুনতে পেয়েছি। সেই কথাই তোদের বলব। রাজবাড়ির পিছনে টিলার পাশে যে ভাঙা বাড়িটা আছে সেটা আমাদের, জানিস তো? মেরামত হয়নি বলে বাড়িটার ওই অবস্থা। কেউ ওখানে থাকে না। আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা এই বাড়িটা পেয়েছিল।
মধুছন্দা জিজ্ঞাসা করল, পেয়েছিল মানে?
মিতালি বলল, পেয়েছিল মানে, জানিস তো অনেক আগে ঝরিয়া বাংলাদেশের মধ্যে ছিল। মোগল আমলে একজন মনসবদার ছিল নাজামউদ্দিন। এসব জায়গা সে-ই দেখাশোনা করত। লোকটা ভীষণ অসৎ ছিল আর মতলববাজ। প্রজাদের কষ্ট দিয়ে অনেক টাকাকড়ি করেছিল। ওই বাড়িতে সেইসব টাকাকড়ি জমিয়ে রাখত। যেসব প্রজারা তার কথা শুনত না, কিংবা গোলমাল করত, তাদের ওই বাড়ির চোরাকুঠুরিতে পুরে রাখত। না খেতে পেয়ে খিদেয়, তেষ্টায় তারা সব মরে যেত।
দিনকাল বদলাল। মোগলদের কাছ থেকে দেশ ইংরেজদের হাতে চলে এল। ওই বাড়িও ইংরেজরা নিয়ে নিল।
আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা ইংরেজদের কুঠিয়াল ছিলেন। তাদের ব্যাবসার অনেক খোঁজখবর দিতেন। ফলে তিনি খুব বিশ্বাসের পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। কানিংহাম সায়েব এই বাড়িটা আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদাকে উপহার দেয়। আমার বাবার ধারণা, খোঁজ করলে ও বাড়িতে এখনও কিছু ধনরত্নের সন্ধান মিলতে পারে।
মধুছন্দা প্রশ্ন করল, তোর বাবা খোঁজ করছেন না কেন?
মিতালি বলল, মা-ও তো বাবাকে সেই কথাই বলছিল। একদিন লোকজন ডেকে বাড়িটা পরিষ্কার করাও-না। যদি কিছু পাওয়া যায়। আজকাল সোনার যা দাম হচ্ছে।
বাবা বলল, লোকজন ডাকলে সব জানাজানি হয়ে যাবে, তার চেয়ে ভাবছি, আমি দিন সাতেকের ছুটি নেব, নিয়ে বাড়িটার মধ্যে ঢুকব।
মিতালি একবার সব মেয়েদের মুখের দিকে দেখে নিয়ে বলল, আমি কী ভাবছি জানিস?
কী? কী? সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল।
বাবা ছুটি নিয়ে বাড়িতে ঢোকার আগে, চল, দল বেঁধে আমরাই যাই। কাল থেকে তো স্কুল ছুটি হয়ে যাচ্ছে। প্রচুর অবসর। ধনরত্নের আমাদের খুব দরকার।
শ্রাবণী বলল, ঠিক বলেছিস। দরকারের সময় একটা পয়সা আমার হাতে পাই না। দেখ-না, জন্মদিনে কতগুলি টাকা পেলাম, সব কৌটোর মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম, মা হঠাৎ বলল, শ্রাবণী, তোর কৌটো থেকে পয়সা নিচ্ছি, রেডিয়োটা সারাতে হবে। ব্যাস, সব পয়সা শেষ। আর-একবার বাবাও মাথায় হাত বুলিয়ে ছাতা কেনবার নাম করে পয়সা নিয়েছিল।
দেখা গেল সব মেয়েরই অর্থাভাব। মোগল আমলের কিছু ধনরত্ন পেলে খুবই ভালো হয়।
অদিতির একটু সাহসের অভাব। সে এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল। এবার বলল, কিন্তু যেসব প্রজাদের না খেতে দিয়ে মেরে ফেলেছিল তাদের অতৃপ্ত আত্মারা ওখানেই নেই তো? তারা যদি গোলমাল করে? আমি আবার ভূতপ্রেত একেবারে সহ্য করতে পারি না।
মিতালি ঠোট বেঁকাল, শোন অদিতির কথা। ভূতপ্রেত আবার আছে নাকি? মানুষ মারা গেলেই তো শেষ।
সমাপ্তি আর থাকতে পারল না। বলল, যাক, ওসব বাজে কথা, আমরা কবে ওই বাড়িতে যাচ্ছি, তা-ই বল। এবার কলকাতায় গিয়ে যা চমৎকার গোটাকয়েক ফ্রক দেখে এসেছি। বড্ড দাম, ওই ধনরত্নগুলো পেলে আর ভাবনা নেই।
ঠিক হল—কাল থেকে ছুটি। কালকের দিন বাদ দিয়ে পরশু দিনই ওইবাড়ির মধ্যে ঢোকা হবে। ইতিমধ্যে মিতালি বাড়ির সদর দরজার চাবিটা জোগাড় করে রাখবে।
জয়শ্রী বলল, শোন, কিছু টর্চ আর গোটাকয়েক থলে সবাই সঙ্গে নিবি। অন্ধকারে টর্চ খুব কাজে লাগবে আর ধনরত্ন বয়ে আনার জন্য থলেও দরকার।
এও ঠিক হল, দুপুরবেলা সবাই বাড়ির মধ্যে ঢুকবে আর সন্ধ্যার সময় অদিতিদের মোটর টিলার নীচে অপেক্ষা করবে, না হলে অত ধনরত্ন বয়ে আনা সম্ভব নয়।
শ্রাবণীদেরও মোটর আছে, কিন্তু মোটর চালায় শ্রাবণীর বাবা। তার বাবা গেলে আর ধনরত্নের একটি টুকরোও মেয়েরা পাবে না।
ঠিক দিনে দুপুরবেলা শ্রাবণীদের উঠোনে সবাই এসে জড়ো হল। শ্রাবণীর বাবা কোর্টে, মা ঘুমে অচেতন। কাজেই কোনও অসুবিধা নেই।
জয়শ্রী বলল, আমি পাঁজি দেখেছি। দুপুর একটা বাইশ মিনিটে যাত্রা শুভ। এখন ঠিক একটা, আর বাইশ মিনিট পরে আমরা রওনা হব।
ছজন মেয়ে চারটে টর্চ এনেছে, কিন্তু সকলের হাতেই পাট করা কাপড়ের থলে।
ঠিক একটা বাইশে মেয়েরা যাত্রা শুরু করল।
রাজবাড়ি পিছনে রেখে টিলা পার হয়ে চলল। এখানে রাস্তা নেই, পায়ে-চলা সরু পথ। তেঁতুল, বট আর অশ্বত্থ গাছে দিনের বেলাতেও জায়গাটা অন্ধকার। ঝিঁঝি ডাকছে। গাছের গুঁড়ি বেয়ে কাঠবেড়ালি ওঠানামা করছে।
মেয়েরা সন্তর্পণে পা ফেলে এগোতে লাগল।
বাঁক ঘুরতেই দেখা গেল জরাজীর্ণ একটা বাড়ি। ইটের ফাঁকে ফাঁকে বট-অশ্বত্থের চারা। সামনের বারান্দাটা ভেঙে মাটিতে পড়ে গেছে। ছাদের কিছুটা নেই। বাড়িটার আদিতে কী রং ছিল বলা মুশকিল, এখন বৃষ্টির প্রকোপে কালো একটা আস্তরণ পড়েছে।
মিতালি হাত তুলে দেখাল, ওই আমার ঠাকুরদার বাড়ি। দেখেই মনে হচ্ছে ভিতরে ধনরত্ন ঠাসা।
শ্রাবণী মনে করিয়ে দিল, চাবিটা এনেছিস তো?
মিতালি নিজের গলার হারটা তুলে ধরল। সবাই দেখল হারের সঙ্গে মস্ত বড়ো একটা পিতলের চাবি।
মেয়ের দল দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মিতালি আগে, পিছনে আর সব।
বাড়ির তুলনায় দরজার আয়তন খুব ছোটো। দরজার ওপর উর্দু ভাষায় কী সব লেখা রয়েছে।
মিতালি বলল, জয় গুরু, তারপর নিচু হয়ে দরজাটা খোলার জন্য চাবি বের করল।
দুটো বিরাট গাছ ডালপালা ছড়িয়ে এদিকে দাঁড়িয়ে আছে। ফলে জায়গাটা রীতিমতো অন্ধকার।
কিছুক্ষণ চেষ্টা করে মিতালি বলল, কই রে, তালা তো খুঁজে পাচ্ছি না। কুঁজো হয়ে আমার পিঠ ব্যথা হয়ে গেল। তোরা কেউ চেষ্টা কর।
এবার শ্রাবণী এগিয়ে গেল। হতের টর্চ জ্বালিয়ে এদিক-ওদিক দেখে বলল, কই রে, তালাই তো নেই। ভাঙা কবজা পড়ে রয়েছে।
জয়শ্রী বলল, সর্বনাশ, তাহলে নিশ্চয় কেউ আগে এসে ধনরত্ন সব নিয়ে গেছে। আমাদের পরিশ্রমই সার হল।
মেয়েরা কেউ কিছু বলল না। শুধু মধুছন্দা গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল। দরজাটা কেঁপে উঠল, কিন্তু খুলল না।
তখন সব মেয়েরা একসঙ্গে দরজার ওপর এসে পড়ল, তারপর প্রাণপণ শক্তিতে ধাক্কা।
ক্যাঁচ, কোঁচ, ক্যাঁচ। বিকট শব্দ করে দরজার পাল্লা দুটো হঠাৎ খুলে গেল। জয়শ্রী আর মধুছন্দা সামনে ছিল, তারা টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলো কালো কালো ছায়া মেয়েদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল।
অদিতি কাঁপতে কাঁপতে বলল, রাম, রাম। নিশ্চয় সেই অতৃপ্ত আত্মা। যেসব প্রজাদের অনাহারে মেরে ফেলেছিল, তারা।
শ্রাবণী বলল, দূর, আত্মাটাত্মা নয়, বাদুড়। ওই দেখ-না বাইরে গাছের ডালে সব ঝুলছে।
মেয়েরা কোমর বে�ধে ঢুকে পড়ল।
বাড়ির মধ্যে বিশ্রী একটা গন্ধ। নিশ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না।
সমাপ্তি সাবধান করে দিল, এখন কেউ ভিতরে যেয়ো না। অনেক বছর বাড়িটা বন্ধ ছিল, ভিতরে গ্যাস হয়েছে। একটু অপেক্ষা কর। বাইরের হাওয়া ভিতরে ঢুকুক।
মেয়েরা সবাই সার বেঁধে দরজার কাছে দাঁড়াল।
কেউ কেউ আবার নাকে কাপড় জড়াল।
একটু পরে একে একে সবাই ভিতরে ঢুকল।
পাশের ঘরটা খুব ছোটো। তার ওপর অন্ধকার। অন্ধকারে চোখ একটু অভ্যস্ত হয়ে যেতে সকলে দেখল সার সার অনেকগুলো মাটির জ্বালা।
মিতালি আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, এর মধ্যে নিশ্চয় ধনরত্ন আছে। থলেগুলো নিয়ে আয়।
জয়শ্রী যেমনি সামনের মাটির জারে হাত ঢোকাতে গেছে, অমনি গম্ভীর গলায় আওয়াজ হল, হুম হুম হুম।
জয়শ্রী লাফিয়ে পিছিয়ে এল।
অদিতি জয়শ্রীর পিছনে ছিল। তার খুব ইচ্ছা, তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে বড়ো সাইজের মণিমাণিক্যগুলো তুলে নেবে। সে তার বাবার কাছে শুনেছে, মোগল আমলে খুব দামি দামি হিরা-জহরত পাওয়া যেত। গোটাকয়েক সেরকম পেলেই আর দেখতে হবে না। সারাজীবন পায়ের ওপর পা দিয়ে কাটাতে পারবে।
হুম হুম শুনে ওপরদিকে চেয়েই অদিতি হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল, ওরে বাবা রে, গেলাম রে। আমাকে বাঁচাও।
মধুছন্দা জিজ্ঞাসা করল, তোর কী হল রে? ওরকম করছিস কেন?
কোনও কথা না বলে অদিতি আঙুল দিয়ে দেখাল।
সব মেয়েরা মুখ তুলে দেখল।
ঘন অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ। আগুনের ভাঁটার মতন। মেয়েরা পিছিয়ে এল।
মিতালি বলল, ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। আগের দিনে ধনরত্ন আগলাবার জন্যে লোকেরা একজনকে মেরে যক্ষ বানিয়ে রাখত। সে-ই সব ধনরত্ন পাহারা দিত। এটা হচ্ছে সেই যক্ষ।
অদিতি কেঁদে উঠল, আমার ধনরত্নের দরকার নেই ভাই। তোরা আমাকে বাড়ি পৌঁছে দে। আমি একলা যেতে পারব না।
হুম, হুম, হুম।
গম্ভীর শব্দ খালি ঘরে যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল। চোখ দুটো আরও জ্বলতে লাগল।
অদিতির সেইদিকে চোখ পড়তেই সে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। দাঁতে দাঁতে আটকে গেল। মুখ দিয়ে উঁ উঁ শব্দ করতে লাগল।
অদিতি পড়ে যেতেই পটপট আওয়াজ। মেয়েদের মাথার ওপর দিয়ে সেই জ্বলন্ত চোখ ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে গেল।
মিতালি বলল, প্যাঁচা, প্যাঁচা, লক্ষ্মীপ্যাঁচা। অদিতি মিছামিছি ভয় পেল।
সমাপ্তি থলে দিয়ে অদিতির মুখে হাওয়া করছিল। সে বলল, লক্ষ্মীপ্যাঁচা যখন আছে তখন নিশ্চয় ধনরত্নও আছে। মা লক্ষ্মীই তো সম্পদের দেবী।
একটু পরেই অদিতি চোখ খুলল। ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, আমি কোথায়?
জয়শ্রী বলল, তুই রাশি রাশি ধনরত্নের পাশে শুয়ে আছিস। কোনও ভয় নেই। তুই যাকে যক্ষ ভাবছিলি সেটা যক্ষ নয়, লক্ষ্মীপ্যাঁচা। আমাদের ঐশ্বর্যের সন্ধান দিয়ে গেল।
সব শুনে অদিতি উঠে বসল, তারপর বলল, তাহলে আর আমরা দেরি করছি কেন? থলেগুলো বোঝাই করে নিলেই তো পারি।
সমাপ্তি মাটির জ্বালার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে প্রথমেই জ্বালার মধ্যে হাত ঢোকাল।
একটু পরেই চেঁচিয়ে উঠল, উঃ মা, কী রে এর মধ্যে!
সমাপ্তি হাতটা টেনে বের করতেই অন্য মেয়েরা হাতের ওপর টর্চের আলো ফেলল।
কনুই পর্যন্ত কালো হয়ে গেছে।
সমাপ্তি নিজের হাতটা নাকের কাছে নিয়ে গিয়েই নাক কোঁচকাল, কী বিশ্রী গন্ধ রে বাবা, অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার দাখিল।
শ্রাবণী এগিয়ে এসে শুঁকে বলল, এ তো পচা গোবর রে। জমিতে সার দেবার জন্য দরকার হয়।
মধুছন্দা বলল, সব জ্বালাগুলোতেই কি গোবর আছে? হাত দিয়ে দেখ-না।
কিন্তু দেখবে কে? দুর্গন্ধের জন্য কেউ হাত ঢোকাতে রাজি হল না।
শেষকালে জয়শ্রী সব জ্বালাগুলির মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখল। সবগুলোতেই এক ব্যাপার। পচা গন্ধ। মনে হল, এগুলোতে সার পচিয়ে রেখেছে।
শ্রাবণী বলল, এখানে কিছু নেই। চল, পাশের ঘরে দেখা যাক।
সবাই পাশের ঘরে ছুটল।
ঢোকবার মুখেই বাধা। দরজায় পুরু মাকড়সার জ্বাল। মেয়েদের চুলে, চোখে, মুখে জড়িয়ে গেল।
রুমাল দিয়ে মুখ-চোখ মুছে সবাই ভিতরে ঢুকল।
মধুছন্দা বলল, এই হাতের টর্চগুলো জ্বাল। এ ঘরে কী আছে দেখি।
চারজন মেয়ে চারটে টর্চ টিপল। বরাত, তিনটেই জ্বলল না। বোধহয় ব্যাটারি খতম। শুধু অদিতির টর্চটা জ্বলল।
সেই আলোয় দেখা গেল কোণের দিকে অনেকগুলো বেতের ধামা। মেঝের ওপর টুকরো টুকরো কাঠ ছড়ানো।
মিতালি বলল, এই অদিতি, তোর টর্চের আলো অত কাঁপছে কেন?
অদিতি কী উত্তর দেবে! তার সারা দেহই ঠকঠক করে কাঁপছে, সেইজন্য টর্চের আলোও কাঁপছে।
সমাপ্তি বলল, তুই এক কাজ কর অদিতি, টর্চটা এই কাঠের টুকরোর ওপর রাখ। তাহলে আলোটা কাঁপবে না। সবাই দেখতে পাবে।
পাশেই চৌকো একটা কাঠের বাক্স ছিল, অদিতি তার ওপর টর্চটা রাখল।
দু-এক মিনিট, তারপরই দারুণ কাণ্ড আরম্ভ হল।
টর্চসুদ্ধ কাঠের বাক্সটা ছুটোছুটি আরম্ভ করল। একবার এদিক, আর-একবার ওদিক, তারপর চরকির মতন বোঁ বোঁ করে।
কখনও কোনও মেয়ের গায়ের ওপর এসে পড়তে লাগল।
এতক্ষণ কয়েকজন মেয়ে তবু সাহস করে এগোচ্ছিল, কিন্তু টর্চের কাণ্ড দেখে সবাই চেঁচামেচি শুরু করল।
অদিতি তো কাঁদতেই লাগল।
ওরে বাবা, ঘূর্ণিভূতের পাল্লায় পড়েছি। কে কোথায় আছ, বাঁচাও। আমার ধনরত্নে দরকার নেই। আমার যা আছে, সেই ভালো।
ছুটোছুটি করতে করতে জয়শ্রী আর মধুছন্দা নিজেদের মধ্যে ধাক্কা লেগে দুজনে দু-দিকে ছিটকে পড়ল।
টর্চের থামবার নাম নেই। প্রচণ্ড বেগে ছুটোছুটি করে চলেছে।
শ্রাবণী বলল, চল, আমরা বেরিয়ে পড়ি। আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়।
শ্রাবণীর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের দল ছিটকে এদিকের ঘরে চলে এল।
তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে জয়শ্রী আর অদিতির পায়ে পায়ে জড়িয়ে একটা মাটির জ্বালার ওপর সজোরে পড়ল।
ফটাস করে শব্দ। মাটির জ্বালা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আর ভিতরের পচা সারে জয়শ্রী আর অদিতি স্নান করে উঠল।
আপাদমস্তক কুচকুচে কালো, শুধু চোখের দুটো সাদা অংশ দেখা গেল।
বিপদের ওপর বিপদ।
অদিতির সেই টর্চ মেয়েদের পিছনে এসে আগের মতন ছুটোছুটি শুরু করল।
ওরে বাবা, ও দুটো পেতনি নাকি রে?
অদিতি আর জয়শ্রী দুজনেরই নাকে কালো কালো সার ঢুকে গিয়েছিল। ভালো করে কেউ কথা বলতে পারছিল না।
মেয়েরা ভয় পাচ্ছে দেখে অদিতি বলল, এঁই আঁমাদের দেঁখে তোঁরা ভঁয় পাঁচ্ছিস কেঁন? আঁমাদের চিঁনতে পাঁরছিস নাঁ?
তার নাকিসুর শুনে মেয়েরা আরও ভয় পেয়ে গেল।
ঢোকবার সময় ঠেলে দরজা খুলে সবাই ঢুকেছিল, সেই দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়েরা অনেক চেষ্টা করেও ভিতর থেকে দরজা আর খুলতে পারল না।
সর্বনাশ, সারারাত এই ভূতুড়ে বাড়িতে বন্ধ থাকলে কেউ প্রাণে বাঁচব না। মেয়েরা কান্না শুরু করে দিল।
মেয়েদের কান্না ছাপিয়ে হঠাৎ সোঁ সোঁ আওয়াজ শোনা গেল। মনে হল, ঘরের মধ্যে দুটো দৈত্য বুঝি ঝটাপটি শুরু করেছে।
টর্চটা এখন এক জায়গায় স্থির হয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে বিকট সোঁ সোঁ আওয়াজে চরকি ভূতও বুঝি ভয় পেয়ে গেছে।
ইতিমধ্যে অদিতি আর জয়শ্রী নিজেদের রুমাল, ফ্রক আর কাপড়ের থলি ঘষে ঘষে গা থেকে পচা সার অনেকটা উঠিয়ে ফেলেছে। তাদের এবার চেনা যাচ্ছে।
সব মেয়েরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণপণ শক্তিতে দরজা ধরে টানল, কিন্তু দরজা এক ইঞ্চি ফাঁক হল না।
মধুছন্দা আর সমাপ্তি দরজার কাছে মুখ রেখে চেঁচাল, কে আছ বাঁচাও। আমরা ছজন মেয়ে এই পোড়োবাড়িতে আটকে পড়েছি।
কোনও সাড়া নেই।
অদিতি বলল, আরও জোরে চেঁচা, রাজবাড়িতে অনেক লোক আছে। তারা যদি শুনতে পায়, ঠিক বাঁচাতে আসবে।
এবার সবাই চেঁচাতে আরম্ভ করল।
বাইরে থেকে সাহয্যের জন্য কেউ তো এলই না, বরং মেয়েদের চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে টর্চ আবার ছুটোছুটি শুরু করল। এবার আরও বিদ্যুদবেগে।
প্রথমে মিতালির চোখে পড়ল।
আলোটা স্থির নয়, অনবরত ঘুরছে, কিন্তু তাতেই দেখা গেল।
ওই দেখ।
মিতালি আঙুল দিয়ে দেখাল।
পিছনের দেওয়ালে হাত তিনেক লম্বা একটা সাপ। গাঢ় কালো রং, বেশ মোটা। একভাবে চুপ করে রয়েছে।
মারাত্মক অবস্থা। চারদিক বন্ধ। পালাবার কোনও পথ নেই। এই সময় ওই সাপটা যদি লাফিয়ে নীচে পড়ে, তাহলে কাউকে আর বাঁচতে হবে না। সাপের যা আকৃতি, পাহাড়ে সাপ, নিশ্বাসে বিষ।
মেয়ের দল সবাই পিছনের দেয়াল থেকে যতটা সম্ভব সরে এল।
অদিতি কাঁদতে কাঁদতে বলল, কী মুশকিলেই যে পড়েছি। কাকে ডাকি বল তো? রামকে, না মা মনসাকে কে বাঁচাবে। এদিকে ঘূর্ণিভূত আর ওপরে ফোঁস।
মেয়েরা কোনও উত্তর দিল না, কিন্তু সবাই মনে মনে মনসা-রামনাম জপ করতে লাগল।
হঠাৎ আবার সোঁ সোঁ শব্দ। বিকট শব্দ করে দরজার পাল্লা দুটো খুলে গেল।
বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন বৃষ্টি নেই, হালকা রোদ উঠেছে।
দরজার পাল্লা দুটো খুলতেই আর-এক কাণ্ড। একটা পাল্লা সবেগে টর্চের ওপর গিয়ে পড়তেই, টর্চটা ঠিকরে পড়ল, আর কাঠের বাক্সটা উলটে যেতেই তার মধ্যে থেকে একটা বিরাট সাইজের ইঁদুর ছুটে পালাল।
জয়শ্রী বলল, ও মা। চরকি ভূত নয়, বাক্সের মধ্যে ইঁদুর ঢুকে ছুটোছুটি করছিল। এবার অদিতি সাহস করে পিছনের দেওয়ালের দিকে দেখল।
সাপ নয়, আঁকাবাঁকা একটা ফাটল। বাইরের রোদে এবার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
মেয়েদের চেহারা যা হয়েছে দেখবার মতন। কেউ খোঁড়াচ্ছে, কারো ফ্রক ছিঁড়ে গেছে, একজনের মুখ ভরতি মাকড়সার জাল, দুজনে তো পচা সারে স্নান করে উঠেছে।
জয়শ্রী বলল, এই নাক-কান মলছি, আর আমার ধনরত্নের দরকার নেই। ভগবান যা দিয়েছেন তা-ই ভালো। এখন ভালোয় ভালোয় বাড়ি পৌঁছাতে পারলে বাঁচি।
সকলে ক্লান্ত হয়ে পোড়োবাড়ি থেকে বেরিয়ে টিলার পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
ওদিকে অদিতিদের মোটর থাকবার কথা। না হলে এ পোশাকে রাস্তা দিয়ে হাঁটলে সবাই পাগলি বলবে।
একটু পরেই রোদটুকু কমে গেল! আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। ঘন অন্ধকার নামল।
বট গাছতলা দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে বাজখাঁই আওয়াজ উঠল।
গোলমেলে লেলুয়া।
জয়শ্রী আর মধুছন্দা ধার দিয়ে যাচ্ছিল, চিৎকার শুনে তারা ছুটতে শুরু করল।
ওরে বাবা রে, ভূত এখনও আমাদের ছাড়েনি। পিছন পিছন এতটা রাস্তা এসেছে।
বিদ্যুৎ চমকাতেই দেখা গেল, ভূত নয়, বান্টু। শ্রাবণীর ভাই।
থলিতে দেহ ঢেকে শুধু মুখটা বের করে বট গাছতলায় বসে আছে।
সে বলল, মা আমাকে আর-একটা থলি দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিছু বেশি ধনরত্ন দিয়ে যাবার জন্য।
মেয়েরা আর কথাটি বলল না। মুখও তুলল না।
সরু পথ দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। থলেগুলো মাথায় দিয়ে।
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।
শুকতারা, অক্টোবর ১৯৭৬