গুপ্তধনের ঠিকানা – শ্যামল দত্তচৌধুরী

গুপ্তধনের ঠিকানা – শ্যামল দত্তচৌধুরী

ঠাকুরদাকে আমরা ডাকি দাদু, ডাকতাম। গত সোমবার রাত দশটা ছাপ্পান্ন মিনিটে আমাদের দত্তবাগানের আদি বাড়িতে দাদুর মৃত্যু হয়েছে। মাধবকাকা কত বছর ধরে দাদুকে দেখাশোনা করছেন আমি জানি না। আমার বাবা, জেঠুরা, কাকারা, পিসিরা কেউই থাকেন না দত্তবাগানে। মাধবকাকা ছাড়া আর কে দেখবেন? বংশানুক্রমে মাধবকাকা ওই গ্রামেরই মানুষ।

দাদু খুব ভালবাসতেন আমাকে। বলতেন ‘তোমার মধ্যে আমি থেকে যাব দাদুভাই।’ বছরে একবার দুর্গাপুজোর সময় গ্রামে যেতাম আমরা। আমাকে নিয়ে দাদু মাঠেঘাটে সারাদিন ঘুরে বেড়াতেন। চাষ করার পদ্ধতি শেখাতেন, গাছপালা চিনিয়ে দিতেন। পাখির ডাক শুনে পাখি চেনাতেন।

আমিও মন খুলে গল্প করতাম দাদুর সঙ্গে। যেসব সিক্রেট কাউকে বলিনি, এমনকী বাবা-মাকেও না, তা দাদুকে খোলাখুলি বলতে পারতাম। সেসব কথা অন্য কাউকে বলতে পারি না, কারণ, কেমন যেন ভয় ভয় করে। মনে হয় কেউ বিশ্বাস করবে না, আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করবে। আরও বেশি ভয়, কাউকে বললে যদি ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেলি।

এই যেমন বছরখানেক আগের ঘটনা। এরিথমেটিক-অ্যালজেব্রা-জিওমেট্রির পেপার। এরিথমেটিক আর অ্যালজেব্রা মোটামুটি আমার নাগালের মধ্যে। কিন্তু জিওমেট্রি আমার কাছে বরাবরের বিভীষিকা। রাইডার দেখলেই বুক ঢিবঢিব করতে থাকে, আর পরীক্ষার সময় তো থিওরেম, করোলারি সব তালগোল পাকিয়ে যায়। স্যার বলতেন, ‘মেন্টাল প্রবলেম।’ কী জানি!

সেবার পরীক্ষার আগের রাতে বারবার জ্যামিতির সূত্রগুলো ঝালিয়ে নিয়ে ঘুমোতে গিয়েছিলাম দেরিতে। ভোরবেলা ঘুমের মধ্যে হঠাৎ চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠল জ্যামিতির একটা অচেনা রাইডার। তারপর স্টেপ-বাই-স্টেপ পিথাগোরাসের সূত্র খাটিয়ে তার সমাধান। জ্বলজ্বলে ছবিটা মনে নিয়ে স্বপ্ন ভেঙে গেল।

ওই প্রশ্নটা হুবহু এসেছিল পরীক্ষায়। ক্লাসের ফার্স্ট বয় অভিষেক পারেনি। আমি পেরেছিলাম।

এর কয়েক মাস আগের কথা। দিল্লি থেকে বোর্ডের চারজনের একটা দল এসেছিলেন স্কলারশিপের জন্য ছাত্রছাত্রী মনোনয়ন করতে। কলকাতার স্কুলে-স্কুলে ঘুরে তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের ইন্টারভিউ নেবেন। আমাদের স্কুল থেকে তিনজনের নাম গিয়েছে। তার মধ্যে আমি আছি। মেরিট কাম মিনস স্কলারশিপ।

আমার নাম আছে শুনে দাদা তাচ্ছিল্য করে বলেছিল, ‘তোর হবে না। ওসব ইন্টারভিউ শুধু নিয়মরক্ষার জন্যে। ক্যান্ডিডেট আগেই ঠিক করা আছে, বুঝলি ইডিয়ট?’

দাদার কথাবার্তাই ওরকম। নিজে লেখাপড়ায় ভাল। তাই আমাকে পাত্তা দিতেই চায় না। যাই হোক, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে আবার মৌখিক পরীক্ষায় ডাক পড়ল। আমি ঠিকঠাক জবাব দিচ্ছিলাম, তাই বোধহয় প্রশ্নগুলো ক্রমশ অস্পষ্ট হতে আরম্ভ করল। শেষে একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘সু সু গেমেৎসু কী?’

চোখে অন্ধকার দেখলাম। তারপরেই আলো ঝলসে উঠল। আমি বললাম, ‘ওটা এক ধরনের পরজীবী প্রাণী, যাকে বলে প্যারাসাইট। জাপানের মাছধরা আর মুক্তো ডুবুরিদের পায়ের তলা দিয়ে সাধারণত তার শরীরে প্রবেশ করে।’ কিছুই জানতাম না কিন্তু বলে দিলাম সঠিক উত্তর।

কোনও বন্ধুকে কিংবা বাড়িতে আমি এসব আশ্চর্য ঘটনা বলিনি, শুধু দাদুকে বলেছিলাম। দু’জনে গ্রামে দিঘির পাশে বসে ছিলাম। দাদু কোনও উত্তর দেননি, শুধু তাঁর ভারী শক্ত হাতটা আমার কাঁধে রেখেছিলেন। দাদু নিজের হাতে লাঙল ধরে চাষ করতেন তো, তাই অমন শক্ত হাত।

কিছুক্ষণ পরে দাদু বলেছিলেন, ‘আমাদের জমিতে গুপ্তধন পোঁতা আছে, তুমি শুনেছ?’

আমরা দিঘির ধারে একটা ছাতিমগাছের ছায়ায় বসে কথা বলছিলাম। আমি বললাম, ‘ভাসা ভাসা শুনেছি, বাবা বেশি কিছু বলতে চাননি।’

আমরা ছেলেবেলা থেকেই গুপ্তধনের কিংবদন্তি শুনে আসছি। দত্তবাগানের বাড়িতে আমাদের পূর্বপুরুষরা নাকি বংশপরম্পরায় গুপ্তধনের সন্ধান করে যাচ্ছেন। সাংকেতিক ভাষায় গুপ্তধনের হদিশ খিড়কির দরজায় খোদাই করা আছে। একশো বছরের বেশি তা রহস্যই থেকে গিয়েছে, এখনও কেউ সেই কোড ভেঙে তার অর্থ উদ্ধার করতে পারেনি।

আমার সম্পর্কে এক জেঠু ছিলেন ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে। জেঠুর কাজ ছিল শত্রুপক্ষের গুপ্ত সাংকেতিক বার্তার পাঠোদ্ধার করা। তিনি ক্রিপটোলজিস্ট। আমাদের দেশে অনেক গুপ্তচর, জঙ্গি গা-ঢাকা দিয়ে থাকে। বিদেশ থেকে তাদের কাছে গোপন বার্তা মারফত নির্দেশ আসে। সেই সব বার্তার সাংকেতিক কোড ভাঙার দায়িত্ব জের ডিপার্টমেন্টের। শত্রুপক্ষ ঘনঘন সেই কোড বদলায়। ভারতকে রক্ষা করার জন্য গোয়েন্দা বিভাগকে তাই দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়।

এহেন জেঠু চাকরি ছেড়ে দিয়ে একবার নাকি দত্তবাগানের বাড়িতে এসে বাস করেছিলেন আট-দশ বছর। তবু গুপ্তধনের সাংকেতিক কোড ভাঙতে পারেননি। শেষে পুণেতে ছেলের কাছে চলে যাওয়ার আগে আমার বাবাকে বলে গিয়েছিলেন, ‘ওসব আজগুবি গপ্পো রে! কখনওই বিশ্বাস করিস না। গুপ্তধনটুপ্তধন একদম বোগাস!’

একদিন বাবা খেতে খেতে আমাদের বলেছিলেন, ‘আমার ধারণা, কোনও এক পূর্বপুরুষ গুপ্তধনের গল্প ফেঁদেছিলেন বংশধরদের গ্রামে ধরে রাখার জন্য। পরিবার যত বাড়ে ততই দুরে দুরে ছড়িয়ে যায়। আরে, কালের নিয়ম মানতে হবে না। আমাদের আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে আছে সারা বিশ্বে, শুধু বাবা পড়ে আছেন দত্তবাগান আঁকড়ে। এখনও কাল্পনিক গুপ্তধন খুঁজে যাচ্ছেন।’

কিন্তু আমি যখনই দেশের বাড়িতে খিড়কির দরজায় লেখা সংকেতটা দেখি, তখনই আমার শিহরন জাগে। ব্যাপারটা কি তবে আগাগোড়া ভাঁওতা?

৫৬-৫২-২২, ১৬-৬৩-৫১, ৩২-৫১-৫৪-৫২, ১৩-১২-২৩-৩১।

দাদু বলেছিলেন, ‘গুপ্তধন আছে। এখনকার মূল্যে কোটি কোটি টাকার সোনারুপো, মণিমুক্তো, হিরে-জহরত…!’

ঠিক সেই সময় বাড়ি থেকে খাওয়ার ডাক পড়েছিল। তারপর বিকেলে আমরা কলকাতার দিকে রওনা হয়েছিলাম, তাই পুরো ইতিহাস আর শোনা হয়নি। দাদুর সঙ্গে সেবারই আমার শেষ দেখা।

মাধবকাকার ফোন পেয়ে পরদিন সকাল সকাল বাবা আর মা দত্তবাগান রওনা হয়েছিলেন। দাদা আর আমি ছিলাম বাড়িতে। কারণ, তখন আমার পরীক্ষা চলছিল।

বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে দাদুর চিঠি পেলাম ডাকবাক্সে। খামের উপরে আমার নাম। বোধহয় কয়েকদিন আগে লিখেছিলেন। চিঠিটা হাতে নিয়ে আমার সারা শরীরে রোমাঞ্চ হল।

‘স্নেহের দাদুভাই,

আমার সময় ফুরিয়ে আসছে। এখন তোমাকে বলে না গেলে আর হয়তো সুযোগ পাব না। আমার পিতৃদেবের মুখে যে ইতিহাস শুনেছিলাম, তা তোমাকে বলে যেতে চাই। আমাদের বং শ প র ষ্প রা য় এই ইতিহাস মুখে মুখে চলে আসছে। ‘কিংবদন্তির সূত্রপাত ১৮৫৭ সালে। ইংরেজদের এক কুঠিবাড়ি আক্রমণ করে একদল সিপাই প্রচুর ধনসম্পদ লুঠপাট করেছিল। পরে ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে সিপাইদের মধ্যে দারুণ বিবাদ হয়। দলের নেতা সুরজ পান্ডে রাত্রে অন্যদের ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে সাহেবদের ঐশ্বর্য নিয়ে চম্পট দিয়েছিল।

‘তখন দত্তবাগানের জমিদার ছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষ মণিলাল দেবশর্মা। কোজাগরী পূর্ণিমার রাত্রি। একটা গোরুর গাড়ি এসে থেমেছিল বাড়ির দরজায়। ছইয়ের তলায় অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল রক্তাক্ত উর্দি পরনে এক সেপাই। সে-ই সুরজ পান্ডে। তার পাশে দুটো ভারী পেটিকা। গাড়োয়ান ভেবেছিল, লোকটা মারা গিয়েছে। ভয় পেয়ে নিয়ে এসেছিল জমিদারের বাড়িতে।

‘সুরজ পান্ডের কিন্তু মৃত্যু হয়নি তখনও। তার পিঠে বর্শার আঘাতের দগদগে ক্ষত। পাক্কা সাত মাস লেগেছিল সেই ঘা শুকোতে। সুস্থ হয়ে সুরজ পান্ডে গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়াত। ধানখেত পেরিয়ে চলে যেত নদীর ধারে। চুপটি করে বসে থাকত সেখানে। কখনও জঙ্গলে দিয়ে দু’-চারদিন কাটিয়ে আসত। কারও সঙ্গে সে বিশেষ কথাবার্তা বলত না। গাঁয়ের লোকের ধারণা হয়েছিল, তার মাথার গোলমাল দেখা দিয়েছে।

‘তারপর একদিন সুরজ পান্ডে চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়। হাতে ছোট একটা লোহার বাক্স নিয়ে মণিলালের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল।

‘সুরজ বলেছিল, ‘জমিদারবাবু, এই বাক্স আপনার কাছে গচ্ছিত রেখে যাচ্ছি। সাবধান, যেন অন্য কারও হাতে না পড়ে। এতে মূল্যবান কাগজপত্র আছে, গুপ্তধনের সংকেত। আমি কিছুদিন পরে ফিরে আসব। ততদিন যত্ন করে এটা রাখুন।’

‘শুধু নায়েবমশাই লক্ষ করেছিলেন, সুরজ পান্ডে যখন গোরুর গাড়িতে চেপে রওনা হয়ে গেল, তখন তার সঙ্গে ভারী সেই পেটিকা দুটো ছিল না। সুরজের ঘরে সেগুলো পড়ে ছিল। খালি। মণিলালের আদেশে লোহার বাক্সটা সিন্দুকে রেখে দিয়েছিলেন নায়েবমশাই।

‘তারপর কেটে গিয়েছিল বাইশটা বছর। সুরজ পান্ডে আর ফিরে আসেনি। মণিলালের মৃত্যুশয্যায় নায়েমশাই বলেছিলেন, ‘কর্তাবাবু, লোকটা আর ফিরবে না। হয়তো কোথাও মারা গিয়েছে। আপনি এবার ওর লোহার বাক্সটা খোলার অনুমতি দিন।’

‘জমিদারবাবুর সম্মতি নিয়ে বাক্সটা খোলা হয়েছিল। ওর মধ্যে একটা কাগজ পাওয়া যায়। ততদিনে তা হলদে হয়ে গুঁড়ো গুড়ো হতে বসেছিল। তাতে লেখা, ‘দেবশর্মা জমিদারের চৌহদ্দির মধ্যে আমার ধনসম্পত্তি ছ’ হাত মাটির নীচে চোদ্দোটা ঘড়ায় ভরে পুঁতে রেখে যাচ্ছি। তাতে রইল সাহেবদের হিসেব মতে, এক হাজার চারশো একুশ পাউন্ড সোনা, তিন হাজার আটশো পঞ্চাশ পাউন্ড রুপো এবং অজস্র মণিমুক্তো, হিরে-জহরত। সিরাজের কোষাগার ভেঙে সাহেবরা চুরি করেছিল। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে পাথর পেতে তার উপরে ঘড়াগুলো সাজিয়ে রেখেছি। লোহার পাতে ঘড়ার মুখ সিল করা আছে। আমার ঐশ্বর্যের হদিশ রেখে গেলাম সাংকেতিক ভাষায়। আমি ছাড়া কেউ খুঁজে পাবে না গুপ্তধন। ৫৬-৫২-২২, ১৬-৬৩-৫১, ৩২-৫১-৫৪-৫২, ১৩-১২-২৩-৩১।’

‘মণিলাল দেবশর্মা নায়েবমশাইকে বলেছিলেন, ‘এই ঐশ্বর্য সাধারণ মানুষের। খিড়কি দরজার কাঠে খোদাই করে রাখো ওই সংকেত। যে খুঁজে পাবে, তার।’

‘তারপর থেকে শুরু হয়েছিল গুপ্তধন খোঁজার পালা। জমিদারবাবুর নির্দেশে গ্রামেগঞ্জে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে গুপ্তধনের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। বংশপরম্পরায় শুধু মণিলালের পরিবারই নন, রাজ্যের সব লোক শতাধিক বছর ধরে সেই সাত রাজার সম্পদের সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে!

‘হাতে হাতে কবে হারিয়ে গিয়েছিল সুরজ পান্ডের চিঠি। ভাগ্যিস, সংকেতটা লেখা ছিল দরজায়। ব্রিটিশ আমলে একবার বড়লাটের বিশেষজ্ঞ এসেছিল দত্তবাগানে। সুরজ পান্ডের সংকেত নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। এখনও হচ্ছে। সাতের দশকে আমেরিকার একদল এক্সপার্ট এসে শুধু সংকেতের ছবি নয়, ছাঁচ তুলে নিয়ে গিয়েছিল।

‘তাই বলি দাদুভাই, গুপ্তধন আছে, আছে, আছে আছে।কখনও কিংবদন্তিকে ভাঁওতা বলে উড়িয়ে দিতে নেই। আমাদের পরিবারের বংশধররা চায় দত্তবাগানের জমিদারি বেচে দিতে। আমার তাতে সায় ছিল না। এতদিন আগলে রেখেছিলাম, পরে কী হবে জানি না।

‘তোমার ধমনীতে আমার জিন আছে দাদুভাই। তোমার মধ্যে আমি থেকে যাব! প্রাণভরা ভালবাসা ও আশীর্বাদ নিয়ো।

দাদু’।

দাদুর চিঠি পড়ে আমি অনেকক্ষণ কাঁদলাম। কাল কোনও পরীক্ষা নেই। রাতে খাওয়ার পরে আমি গুপ্তধনের সংকেত সংখ্যাগুলো নিয়ে বসলাম। স্কুলের ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলাম। ৫৬-৫২-২২, ১৬-৬৩-৫১, ৩২-৫১-৫৪-৫২, ১৩-১২-২৩-৩১।

আমাদের ক্লাসের অভিষেক কম্পিউটার গুলে খেয়েছে। আমেরিকা হলে নির্ঘাত ওকে বলত, ‘হুইজ কিড’। অভিষেক আমাদের বলে, ও নাকি বাইনারিতে স্বপ্ন দেখে, সারি সারি ০ আর ১। অভিষেক অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সার্ভারের ফায়ারওয়াল ব্রেক করে ঢুকে চুপিচুপি তাদের গোপন তথ্য অ্যাকসেস করতে পারে। এমনকী, একবার ও অ্যাটমিক এনার্জির ডেটা হ্যাকিং করেছিল। কাজটা অবশ্যই বেআইনি। খুব গোলমাল হয়েছিল সেবার।

গুপ্তধনের সাংকেতিক ভাষা আমি দেখিয়েছিলাম অভিষেককে। তিনদিন পরে আমাকে এসে বলেছিল, বাংলায় কোড ব্রেক করা খুব কঠিন। এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে, একটা ম্যাট্রিকস আছে, যার মধ্যে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণগুলো উপর-নীচ আর পাশাপাশি সাজানো রয়েছে। সংখ্যাগুলো এক-একটা অক্ষরের প্রতীক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, একটা ‘কি’ বা ‘চাবি’ পেলে এরকম সংকেতের পাঠোদ্ধার অসম্ভব। বর্ণমালার পার্মুটেশন কম্বিনেশন করে অসংখ্য কোড তৈরি করা যেতে পারে। যেমন, সাতটা শুদ্ধ স্বর আর পাঁচটা কড়ি ও কোমল স্বর নিয়ে পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ গান তৈরি হচ্ছে…।

শেষ পর্যন্ত অভিষেক পারল না। ওর আগে সেই ক্রিপটোলজিস্ট জেঠুও পারেননি। তারও আগে আমেরিকা আর ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞরা ব্যর্থ হয়েছিলেন। আমি তো কোন ছাড়!

তবু মাঝরাত পর্যন্ত সমাধান করার চেষ্টা করে গেলাম। মাথার ভিতর সংখ্যাগুলো গিজগিজ করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

একবার ঘুমোলে আর আমার সকালের আগে ঘুম ভাঙে না। ভোররাতের দিকে কী স্বপ্ন দেখেছিলাম মনে নেই, হঠাৎ চোখের সামনে একটা ছক ভেসে উঠল। একদম স্পষ্ট, যেন দেওয়ালে লেখা।

চমকে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানার ওদিকে দাদা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘরের ভিতরটা আবছা অন্ধকার। তাড়াতাড়ি পড়ার টেবিলে বসে টেবিলল্যাম্প জ্বালালাম। এক্ষুনি ছকটা খাতায় লিখে ফেলতে হবে। মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে, পরে ভুলে যেতে পারি।

সংখ্যা আর অক্ষর সাজিয়ে তৈরি ছক। বর্ণমালা থেকে বাদ গিয়েছে ঙ, ঞ, ঢ়, ং, ঃ, ৎ, ঁ আর ৯। এদের ব্যবহার কম বলেই হয়তো।

এই ছকের পাশে গুপ্তধনের সংকেত ফেললাম। সোজা, দারুণ সোজা। যেমন ৫৬। বাঁ দিকের কলামের ৫ আর উপরের সারির ৬ মিলেছে ‘চ’ অক্ষরে। এমনি করে সাজালে ৫৬-৫২-২২ দাঁড়াচ্ছে চ-আ-শ বা-য। ‘চাশ’ শব্দ কখনও পাইনি, তাই ধরা যাক, ‘চাষ’।

১৬-৬৩-৫১ দাঁড়াবে ক-র-ও অর্থাৎ ‘করো’। তেমনই স-ও-ন-আ হচ্ছে ‘সোনা’। আর ফ-ল-ব-এ ‘ফলবে’।

জানলার কাছে দাড়ালাম ল্যাম্পটা নিভিয়ে। তালগাছের পাতার আড়ালে সূর্য উঠছে। আমি বুঝতে পারছি আমাদের কোনও পূর্বপুরুষ সত্যিই গুপ্তধনের ঠিকানা রেখে গিয়েছেন, ‘চাষ করো, সোনা ফলবে’।

৫ সেপ্টেম্বর ২০১০

অলংকরণ: নির্মলেন্দু মণ্ডল

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *