গুপ্তধন
ভুতনাথবাবু অনেক ধার-দেনা করে, কষ্টে জমানো যা-কিছু টাকা-পয়সা ছিল সব দিয়েযে পুরোনো বাড়িখানা কিনলেন তা তার বাড়ির কারোর পছন্দ হল না। পছন্দ হওয়ার মতো বাড়িও নয়, তিন-চারখানা ঘর আছে বটে কিন্তু সেগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। দেয়ালে শ্যাওলা, অশ্বত্থের চারা জন্মেছে। দেয়ালের চাপড়া বেশির ভাগই খসে পড়েছে, ছাদে বিস্তর ফুটো-টুটো। মেঝের অবস্থাও ভালো নয়, অজস্র ফাটল। ভূতনাথবাবুর গিন্নি নাক সিঁটকে বলেই ফেললেন, ‘এ তো মানুষের বাসযোগ্য নয়।’ ভূতনাথবাবুর দুই ছেলে আর তিন মেয়েরও মুখ বেশ ভার-ভার। ভূতনাথবাবু সবই বুঝলেন। দু:খ করে বললেন, ‘আমার সামান্য মাস্টারির চাকরি থেকে যা আয় হয় তাতে তো এটাই আমার তাজমহল। তাও গঙ্গারামবাবুর ছেলেকে প্রাইভেট পড়াই বলে তিনি দাম একটু কম করেই নিলেন। পঁয়ত্রিশ হাজার টাকায় এ বাজারে কি বাড়ি কেনা যায়! তবে তোমরা যতটা খারাপ ভাবছ ততটা হয়তো নয়। এ বাড়িতে বহুদিন ধরে কেউ বাস করত না বলে অযত্নে এরকম দুরবস্থা, টুকটাক মেরামত করে নিলে খারাপ হবে না। শত হলেও নিজেদের বাড়ি।’
কথাটা ঠিক। এই মহীগঞ্জের মতো ছোট গঞ্জেও বাড়ি ভাড়া বেশ চড়া। ভূতনাথবাবু যে বাড়িতে ছিলেন সে বাড়ির বাড়িওলা নিতাই তাঁকে তুলে দেওয়ার জন্য নানা ফন্দিফিকির করত। মরিয়া হয়েই বাড়ি কেনার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন তিনি।
যাই হোক, বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে, গিন্নি ও পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে একদিন ভোরবেলা ভূতনাথবাবু বাড়িটায় ঢুকে পড়লেন। অপছন্দ হলেও বাড়িটা নিজের বলে সকলেরই খুশি-খুশি ভাব। সবাই মিলে বাড়িটা ঝাড়পোঁছ করতে আর ঘর সাজাতে লেগে গেল। ভূতনাথবাবুর ছাত্ররা এসে বাড়ির সামনের বাগানটাও সাফসুতরো করে দিল। কয়েকদিন আগে ভূতনাথবাবু নিজের হাতে গোলা চুন দিয়ে গোটা বাড়িটা চুনকাম করেছেন। তাতেও যে খুব একটা দেখনসই হয়েছে তা নয়, তবে বাড়িতে মানুষ থাকলে ধীরে-ধীরে বাড়ির একটা লক্ষ্মীশ্রীও এসে যায়।
আজ আর রান্নাবান্না হয়নি, সবাই দুধ-চিঁড়ের ফলার খেয়ে ক্লান্ত হয়ে একটু গড়িয়ে নিতে শুয়েছে, এমন সময় একটা লোক এল। বেঁটেখাটো, কালো, রোগাটে, চেহারা, পরনে হেঁটো ধুতি আর গেঞ্জি। গলায় তুলসির মালা। ভূতনাথবাবু বারান্দায় মাদুর পেতে শুতে যাচ্ছিলেন, এমনসময় লোকটা এসে হাতজোড় করে বলল, ‘পেন্নাম হই বাবু, বাড়িটা কিনলেন বুঝি?’
‘হ্যাঁ, তা আপনি কে?’
‘আজ্ঞে আমি হলুম পরাণচন্দ্র দাস। চকবেড়ে থেকে আসছি। চকবেড়ের কাছেই গোবিন্দপুরে নিবাস।’
‘অ। তা কাকে খুঁজছেন?’
‘আমাকে আপনি-আজ্ঞে করবেন না। নিতান্তই তুচ্ছ লোক। আপনি বিদ্বান মানুষ। পুরোনো বাড়ি খোঁজা আমার খুব নেশা।’
‘তাই নাকি?’
‘আজ্ঞে, তা বাবু কিছু পেলেনটেলেন? সোনাদানা বা হীরে-জহরত কিছু?’
ভূতনাথবাবু হেসে ফেললেন, ‘তাই বলো! এইজন্য পুরোনো বাড়ি খুঁজে বেড়াও? না হে বাপু, আমার কপাল অত সরেস নয়, ধুলোবালি ছাড়া আর কিছু বেরোয়নি।
‘ভালো করে খুঁজলে বেরোতেও পারে। মেঝেগুলো একটু ঠুকে-ঠুকে দেখবেন কোথাও ফাঁপা বলে মনে হয় কিনা।’
বাড়িতে গুপ্তধন থাকলে গঙ্গারামবাবু কি আর টের পেতেন না? তিনি ঝানু বিষয়ী লোক।
পরাণ তবু হাল না ছেড়ে বলল, ‘তবু একটু খুঁজে দেখবেন। কিছু বলা যায় না। এ তো মনে হচ্ছে একশো বছরের পুরোনো বাড়ি।
‘তা হতে পারে।’
‘আর একটা কথা বাবু তেনারা আছেন কিনা বলতে পারেন?’
‘কে? কাদের কথা বলছ?’
‘ওই ইয়ে আর কী—ওই যে রাম নাম করলে যারা পালায়।’
ভূতনাথবাবু ফের হেসে ফেললেন, ‘না হে বাপু, ভূতপ্রেতের সাক্ষাৎ এখনও পাইনি। আমার নাম ভূতনাথ হলেও ভূতপ্রেত আমি মানি না।’
‘না বাবু অমন কথা কবেন না, পুরোনো বাড়িতেই তেনাদের আস্তানা কিনা। আপনি আসাতে তাঁরা কুপিত হলেই মুশকিল।’
‘তা আর কী করা যাবে বলো! থাকলে তাঁরাও থাকবেন, আমিও থাকব।’
‘একটু বসব বাবু? অনেক দূর থেকে হেঁটে আসছি।’
ভূতনাথবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, ‘বোসো-বোসো। দাওয়া পরিষ্কারই আছে।’
লোকটা সসঙ্কোচে বারান্দার ধারে বসে বলল, ‘তা বাবু বাড়িটা কতয় কিনলেন?’
‘তা বাপু অনেক টাকাই লেগে গেল। পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। ধারকর্জও হয়ে গেল মেলা।’
‘উরিব্বাস! সে তো অনেক টাকা।’
‘গরিবের কাছে অনেকই বটে, ধার শোধ করতে জিভ বেরিয়ে যাবে। তা তুমি বরং বোসো, আমি একটু গড়িয়ে নিই। বড্ড ধকল গেছে।’
‘আচ্ছা বাবু, আমি একটু বসে থাকি।’
ভূতনাথবাবু একটু চোখ বুজতেই ঘুম চলে এল। যখন চটকা ভাঙল তখন সন্ধে হয়-হয়। অবাক হয়ে দেখলেন, পরাণ দাসও বারান্দার কোণে শুয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছে।
ভূতনাথবাবুর একটু মায়া হল। লোকটাকে ডেকে তুলে বললেন, ‘তা পরাণ, তুমি এখন কোথায় যাবে?’
পরাণ একটা হাই তুলে বলল, ‘তাই ভাবছি।’
‘ভাবছ মানে! তোমার বাড়ি নেই?’
‘আছে, তবে সেখানে তো কেউ নেই। তাই বাড়ি যেতে ইচ্ছে যায় না। যা বললুম তা একটু খেয়াল রাখবেন বাবু। পুরোনো বাড়ি অনেক সময় ভারি পয়মন্ত হয়।’
লোকটা উঠতে যাচ্ছিল। ভূতনাথবাবু বাধা দিয়ে বললেন, ‘আহা, এই সন্ধেবেলা রওনা হলে বাড়ি যেতে তো তোমার রাত পুইয়ে যাবে বাপু। আজ নতুন বাড়িতে ঢুকলুম, তুমিও অতিথি। থেকেও যেতে পারো। তিন-চারখানা ঘর আছে। বস্তা-টস্তা পেতে শুতে পারবে না?’
পরাণ দাস আর দ্বিরুক্তি করল না, রয়ে গেল। সরল-সোজা গাঁয়ের লোক দেখে ভূতনাথবাবুর গিন্নি বেশি আপত্তি করলেন না। শুধু বললেন, ‘চোরটোর নয় তো!’
ভূতনাথবাবু ম্লান হেসে বললেন, ‘হলেই বা আমাদের চিন্তার কী? আমাদের তো দীনদরিদ্র অবস্থা, চোরের নেওয়ার মতো জিনিস বা টাকা-পয়সা কোথা?’
পরাণ দাস কাজের লোক। কুয়ো থেকে জল তুলল, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলল, রাতে মশলা পিষে দিল। তারপর একখানা খেঁটে লাঠি নিয়ে সারা বাড়ির মেঝেতে ঠুক-ঠুক করে ঠুকে ফাঁপা আছে কিনা দেখতে লাগল। কাণ্ড দেখে ভূতনাথবাবুর মায়াই হল। পাগল আর কাকে বলে!
খেয়েদেয়ে সবাই ঘুমোলো। শুধু পরাণ দাস বলল, ‘আমি একটু চারদিক ঘুরেটুরে দেখি। রাতের বেলাতেই সব অশৈলী কাণ্ড ঘটে কিনা।’
মাঝরাতে নাড়া খেয়ে ভূতনাথবাবু উঠে বসলেন, ‘কে?’
সামনে হ্যারিকেন হাতে পরাণ দাস। চাপা গলায় বলল, ‘পেয়েছি বাবু।’
অবাক হয়ে ভূতনাথবাবু বললেন, ‘কী পেয়েছ?’
‘যা খুঁজতে আসা। তবে বুড়োকর্তা দেখিয়ে না দিলে ও জায়গা খুঁজে বের করার সাধ্যি আমার ছিল না।’
ভূতনাথবাবুর মাথা ঘুমে ভোম্বল হয়ে আছে। তাই আরও অবাক হয়ে বললেন, ‘বুড়োকর্তাটা আবার কে?’
‘একশো বছর আগে এ বাড়িটা তো তাঁরই ছিল কিনা। বড্ড ভালো মানুষ। সাদা ধবধবে দাড়ি, সাদা চুল, হেঁটো ধুতি পরা, আদুর গা, রং যেন দুধে-আলতা। খুঁজে-খুঁজে যখন হয়রান হচ্ছি তখনই যেন দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে এলেন।’
একটা হাই তুলে ভূতনাথবাবু বললেন, ‘তুমি নিজে তো পাগল বটেই এবার আমাকেও পাগল বানিয়ে ছাড়বে দেখছি। যাও গিয়ে শুয়ে একটু ঘুমোও বাপু।’
‘বিশ্বাস হল না তো বাবু। আসুন তাহলে, নিজের চোখেই দেখবেন।’
বিরক্ত হলেও ভূতনাথবাবুর একটু কৌতুহলও হল।
পরাণ দাসের পিছু-পিছু বাড়ির পিছন দিকে রান্নাঘরের পাশের এঁদো ঘরখানায় ঢুকে থমকে গেলেন। মেঝের ওপর স্তুপাকার ইট, মাটি ছড়িয়ে আছে, তার মাঝখানে একটা গর্ত।
‘এসব কী করেছ হে পরাণ? মেঝেটা যে ভেঙে ফেলেছ।’
‘যে আজ্ঞে, এবার গর্তে একটু উঁকি মেরে দেখুন।’
হ্যারিকেনের ম্লান আলোয় ভূতনাথবাবু গর্তের মধ্যে উঁকি মেরে দেখলেন একটা কালোমতো কলসি জাতীয় কিছু।
‘আসুন বাবু, নেমে পড়ুন। বড্ড ভারী। দুজনা না হলে টেনে তোলা যাবে না।’
ভূতনাথবাবুর হাত-পা কাঁপতে লাগল উত্তেজনায়।
বললেন, ‘কী আছে ওতে?’
‘তুললেই দেখতে পাবেন। আসুন বাবু, একটু হাত লাগান।’
ভূতনাথবাবু নামলেন। তারপর মুখ ঢাকা ভারী কলসিটা দুজনে মিলে অতি কষ্টে তুললেন ওপরে। পরাণ একগাল হেসে বলল, ‘এবার খুলে দেখুন বাবু আপনার জিনিস।’
বেশ বড় পিতলের কলসি। মুখটায় একটা ঢাকনা খুব আঁট করে বসানো। শাবলের চাড় দিয়ে ঢাকনা খুলতেই চকচকে সোনার টাকা এই হ্যারিকেনের আলোতেও ঝকমক করে উঠল।
‘বলেছিলুম কিনা বাবু! এখন দেখলেন তো, যান আপনার আর কোনও দু:খ থাকল না। দু-তিন পুরুষ হেসে খেলে চলে যাবে।’
ভূতনাথবাবু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এরকমও হয়! পরাণের দিকে চেয়ে বললেন, ‘এসব সত্যি তো স্বপ্ন নয় তো!’
‘না বাবু, স্বপ্ন নয়। বুড়ো কর্তার সবকিছু এর মধ্যে। এত দিনে গতি হল।’
ভূতনাথবাবু পরাণকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘পাগল হলেও তুমি খুব ভালো লোক। এর অর্ধেক তোমার।’
পরাণ সভয়ে পিছিয়ে গিয়ে বলল, ‘ওরে বাবা, ও কথা শুনলেও পাপ। টাকা-পয়সায় আমার কী হবে বাবু?’
‘তার মানে? এত মোহর পেয়েও নেবে না?’
‘না বাবু, আমার আছেটা কে যে ভোগ করবে? একা বোকা মানুষ, ঘুরে-ঘুরে বেড়াই, বেশ আছি। টাকা-পয়সা হলেই বাঁধা পড়ে যেতে হবে।’
ভূতনাথবাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘তাহলে গুপ্তধন খুঁজে বেড়াও কেন?’
‘আজ্ঞে, ওইটেই আমার নেশা। খুঁজে বেড়ানোতেই আনন্দ। লুকোচুরি খেলতে যেমন আনন্দ হয় এও তেমনি। আচ্ছা আসি বাবু। ভোর হয়ে আসছে, অনেকটা পথ যেতে হবে।’
পরাণ দাস চলে যাওয়ার পর ভূতনাথবাবু অনেকক্ষণ বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ভাবলেন, একটা সামান্য লোকের কাছে হেরে যাব? ভেবে কলসিটা আবার গর্তে নামিয়ে মাটি চাপা দিলেন। ওপরে ইটগুলো খানিক সাজিয়ে রাখলেন। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে একটু হাসলেন।