যখন টুনটুনি তখন ছোটাচ্চু
গুটলু
দাদি (কিংবা নানি) বসে বসে টেলিভিশন দেখছেন তখন তার টেলিফোনটা বাজল। প্রথম দুটো রিং দাদি খেয়াল করলেন না, তৃতীয় রিং শুনে ফোনটা খুঁজতে শুরু করলেন, খুঁজে খুঁজে বের করে টেলিফোনটা ধরতে ধরতে লাইন কেটে গেল। এটি অবশ্যি নতুন কিছু না, দাদি (কিংবা নানি) কখনোই একবারে ফোন ধরতে পারেন না। কমপক্ষে দুইবার চেষ্টা করতে হয়। টেলিফোনটা ধরার জন্য কোন বোতামটা টিপতে হয় সেটাও তার মনে থাকে না তাই বেশির ভাগ সময় ফোন ধরতে গিয়ে লাইন কেটে দেন।
ফোনটা খুঁজে পেয়ে তার স্ক্রিনের দিকে তাকালেন, কে তাকে ফোন করার চেষ্টা করেছে পড়ার চেষ্টা করলেন। দাদি স্ক্রিনটা স্পষ্ট দেখতে পেলেন না। কোনো কিছু ভালো করে দেখতে হলে সবাই সেটা চোখের কাছে আনে, দাদির বেলায় সেটা উল্টো। দাদি সেটাকে যতদূর সম্ভব দূরে নিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। এবারেও সেভাবে চেষ্টা করতে লাগলেন তখন টুম্পা বলল, “নানি, তোমার এত কষ্ট করতে হবে না। আমাকে দাও, আমি পড়ে দিই।”
নানি তখন টেলিফোনটা টুম্পার হাতে দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, দেখ দেখি কে টেলিফোন করেছে। মানুষের কোনো ধৈর্য নেই, ফোনটা ধরার আগেই লাইনটা কেটে দেয়।”
টুম্পা বলল, “না নানি। তুমি ফোন ধরতে এত দেরি করো যে লাইন কেটে যায়।”
“হয়েছে–আমাকে শিখতে হবে না। কে ফোন করেছে দেখ।”
টুম্পা খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “ঠিক বোঝা যাচ্ছে না নানি। মনে হয় লেখা দুষ্টু ছেলের মা
“দুষ্টু ছেলের মা? সর্বনাশ! দুষ্টু ছেলের মা কেন ফোন করছে? চলে আসবে তো?”
দুষ্টু ছেলের মাটি কে, সে ফোন করলে কেন সর্বনাশ, চলে আসলে কী হবে টুম্পা কিছুই বুঝতে পারল না। কিন্তু তখন আবার টেলিফোন বেজে উঠল, দুষ্টু ছেলের মা আবার ফোন করছে। টুম্পা তাড়াতাড়ি ফোনটা তার নানির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও নানি! সর্বনাশ হয়ে গেছে। দুষ্টু ছেলের মা আবার ফোন করেছে।”
নানি ফোনটা নিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভয়ে ভয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা ধরলেন, তারপর ভয়ে ভয়ে বললেন, “হ্যালো।”
দুষ্টু ছেলের মা মানুষটি কে টুম্পা জানে না কিন্তু তার গলার স্বরে যথেষ্ট জোর, টুম্পা কাছে বসে থেকেই তার কথা স্পষ্ট শুনতে পেল। দুষ্ট ছেলের মা বলল, “চাচি! কেমন আছেন? কতদিন আপনার সাথে যোগাযোগ নাই।”
নানি ভয়ে ভয়ে বললেন, “কেন ওই যে চন্দনের বিয়েতে দেখা হলো–”বিয়েতে দেখা হলে ভিড়ের মাঝে কী কথা বলা যায়?”
নানি দুর্বল গলায় বললেন, “ইয়ে তা মানে আজকাল সবাই যেরকম ব্যস্ত এইভাবেই তো কথা বলতে হবে!”
দুষ্টু ছেলের মা তেজি গলায় বলল, “না, না চাচি, আমি এসে ভালো করে কথা বলতে চাই।”
নানি মিনমিন করে শোনা যায় না প্রায় সেইভাবে বললেন, “ঠিক আছে, এসো একবার—”
অন্যপাশ থেকে বলল, “আমার দেবরের বিয়ে। বিয়ের কার্ড দিতে আসব।”
নানি প্রায় হা হা করে উঠে বললেন, “আরে আজকাল কী আর কেউ কার্ড দিতে বাসায় আসে? কবে কোথায় বিয়ে ফোনে বলে দাও তাহলেই হবে! আমি চলে আসব।”
“না না না চাচি কী বলেন আপনি? আপনাকে নিজের হাতে কার্ড না দিলে কাকে দেব? আমি নিজে এসে দিয়ে যাব।”
নানি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন, “না, না–তোমার এত কষ্ট করার কোনো দরকার নাই। তুমি কার্ডটা কুরিয়ার করে দাও। আমি পেয়ে যাব। আজকাল সবাই তাই করে।”
“সবাই করে দেখে আমিও করব? আপনার সাথে? কখনো না।”
“নানি হাল ছেড়ে দিয়ে দুর্বল গলায় বললেন, ঠিক আছে।”
“তা ছাড়া আপনি কত দিন গুটলুকে দেখেন নাই।”
নানি কেমন জানি আতকে উঠলেন, “শুটলু?”
“হ্যাঁ। গুটলু মনে নাই আপনার?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে। খুব ভালো করে মনে আছে।”
“একটু বেশি চঞ্চল হয়েছে। কিন্তু এই বয়সের বাচ্চারাতো একটু চঞ্চল হবেই। তাই না?”
নানি শুকনো মুখে ঢোক গিললেন। বললেন, “হ্যাঁ। একটু তো হবেই।”
“আমি কী ভাবছি জানেন চাচি?”
“কী ভাবছ?”
“গুটলুকে আপনার কাছে রেখে আমি এই এলাকায় সব বাসায় কার্ড দিয়ে ফেলি।”
নানি প্রায় আর্তনাদ করে বললেন, “না। না; আমার কাছে রেখো না। আমি ছোট বাচ্চাদের দেখে-শুনে রাখতে পারি না। বয়স হয়ে গেছে তো”
টেলিফোনের অন্য পাশ থেকে মহিলাটি হা করে হাসির মতো শব্দ করে বলল, “কী বলছেন চাচি? আপনার বয়স হয়ে গেছে? আপনি হচ্ছেন চির তরুণ! আপনার বয়স হয়ে গেলে আমরা কোথায় যাব?”
“না মানে আজকাল আর ছোট বাচ্চাদের সামলাতে পারি না।”
“আপনাকে সামলাতে হবে না। আপনার বাসায় আরো বাচ্চা-কাচ্চা আছে। গুটুল ওদের সাথে খেলবে।” মহিলা হঠাৎ গলার সর পাল্টে বলল, “বুঝলেন চাচি, আপনার কাছে রেখে যেতে চাই তার কারণ আপনি বাচ্চাদের আদর করেন–আজকাল কী হয়েছে কে জানে, গুটলুকে নিয়ে যাব শুনেই একজন বলে বসল আসার দরকার নাই। চিন্তা করতে পারেন?”
নানি দুর্বল গলায় বললেন, “না। পারি না।”
মহিলা আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রেখে দিল, নানি সারাক্ষণ শুধু হু হাঁ বলে গেলেন। টেলিফোনে কথা শেষ করার পর নানি বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, তাকে দেখে মনে হতে লাগল এইমাত্র কোনো একটা মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন।
টুম্পা কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু ঠিক তখন টুনি এসে ঢুকল, নানিকে একনজর দেখে বলল, “নানি তোমার কী হয়েছে?”
নানি উত্তর দেওয়ার আগেই টুম্পা বলল, “গুটলুর মা ফোন করে বলেছে। গুটলুকে সারা দিনের জন্য নানির কাছে রেখে যাবে।”
টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “গুটলু? মানে সেই ভয়ংকর দুষ্টু ছেলে?”
টুম্পা বলল, “তুমি গুটলুকে চেন?”
“উঁহু। শুধু গল্প শুনেছি।”
“আমাদের বাসায় কখনো এসেছে?”
“না। এখন পর্যন্ত যে যে বাসায় গেছে সেই বাসাগুলো ধসে গিয়েছে। তাই না দাদি?”
দাদি (কিংবা নানি) দুর্বলভাবে মাথা নাড়লেন।
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “গুটলু কী করে?”
“একজনের বাসায় ড্রইংরুমের কার্পেটে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। “সর্বনাশ!”
“আরেকজনের বাসায় তাদের পোষা বিড়ালটা মাইক্রোওয়েভ ওভেনে ঢুকিয়ে গরম করার চেষ্টা করেছিল।”
টুম্পা চোখ কপালে তুলে বলল, “হায় খোদা।”
“আরেকবার একজনের বাসায় গিয়ে তাদের ল্যাপটপের ওপর কোক ঢেলে দিয়েছিল।”
“কেন?”
“কোকে নাকি ঝাজ ছিল না, সেইজন্যে।”
“কী সর্বনাশ! তারপর–”
“তারপর আর কী! ল্যাপটপটা শেষ।”
টুম্পা বলল, “তার মানে গুটলু খালি দুষ্টু না অনেক ডেঞ্জারাস।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল “হ্যাঁ অনেক ডেঞ্জারাস। পকেটে চুইংগাম থাকে, সেইটা চাবায় তারপর সেটা এখানে সেখানে লাগিয়ে দেয়। ফেবারিট জায়গা মানুষের চুল-দাড়ি, মোছ।”
“হায় হায়।”
“একটা বাসায় গুটলু গিয়েছিল পরের দিন সেই বাসার প্রত্যেকটা মানুষের কারো এক মাথায় চুল নাই কারো একদিকের মোছ নাই কারো দাড়ি অর্ধেক নাই–”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি। কোনো বাসায় গিয়ে যদি মার্কার পায় তাহলেই গেল।”
“কেন?” “সেই মার্কার দিয়ে দেওয়ালে ছবি আঁকে। স্লোগান লিখে।”
“কিসের ছবি? কিসের স্লোগান?”
“কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং। আজেবাজে স্লোগান।”
টুম্পা খানিকক্ষণ মুখ হা করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “এই ছেলেটা আমাদের বাসায় আসবে? সারাদিন থাকবে?”
টুনি বলল, “সেটা তো জানি না। তারপর দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদি, সত্যি নাকি?”
দাদি দুর্বল গলায় বললেন, “তাইতো বলল। শুনে শরীর খারাপ হয়ে গেছে। ঝুমুকে ডেকে বলত বুকের মাঝে একটু তেল মালিশ করে দিতে। কেমন যেন লাগছে।”
টুনি দাদির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “দাদি। তুমি চিন্তা করো না। তোমার গুটলুকে আমরা সামলাব।”
“ঐ ছেলেকে তোরা কীভাবে সামলাবি? এই ছেলে এখন পর্যন্ত যে বাসায় গেছে সেই বাসায় হয় আগুন ধরেছে, না হয় জিনিসপত্র ভাঙচুর হয়েছে না হয় কারো শরীর কেটেকুটে গেছে, না হয় বাসা পানিতে ভেসে গেছে–তোরা ওই বাচ্চাকে কীভাবে সামলাবি?”
“টুনি বলল, দেখি চেষ্টা করে সামলানো যায় কিনা। দাদি, তুমি এখন আর কাউকে বলো না বাচ্চাটা দুষ্টু।”
“বলব না?”
“না দাদি শুধু শুধু সবাইকে আগে থেকে ভয় দেখিয়ে কী লাভ?”
দাদি (কিংবা নানি) দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে তুই যদি তাই চাস তাহলে বলব না। আমি আরো ভাবছিলাম আমার পরিচিত একজন পুলিশের এসআই আছে সাথে সবসময় পিস্তল থাকে, তাকে বলে রাখতাম।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু! পরে গুটলু ঐ পিস্তল দিয়ে কিছু একটা করে ফেলবে।”
দাদি মাথা নাড়লেন, বললেন, “সেটা অবশ্যি তুই খুব একটা ভুল বলিস নাই! গুটলুকে কোনো বিশ্বাস নাই।”
টুনি তখন টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, “টুম্পা, তুইও কাউকে বলিস না। এই বাসায় খালি আমরা তিনজন জানব যে গুটলু হচ্ছে সাংঘাতিক একটা দুষ্টু ছেলে।”
টুম্পা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে টুনিকে, সে মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে টুনি আপু। বলব না।”
“আয় তাহলে আমরা একটা প্ল্যান করি, দেখি কীভাবে গুটলুকে সামলানো যায়।”
টুম্পা সবগুলো দাঁত বের করে হাসল। বলল, “চল টুনি আপু।”
.
গুটলুর মা গুটলুকে নিয়ে এলো পরের দিন দুপুর বেলা। দাদির (কিংবা নানির) কাছে প্রায়ই এরকম অনেকে দেখা করতে আসে। কাজেই গুটলুকে নিয়ে গুটলুর মায়ের দেখা করতে আসা যে বিশেষ কোনো ঘটনা হতে পারে সেটা কেউ টের পেল না। বাইরের ঘরের দরজা খুলে টুনি গুটলু আর গুটলুর মা’কে দাদির কাছে নিয়ে এলো। গুটলু টুনির বয়সী কিংবা তার থেকে এক-দুই বছর ছোট হতে পারে। মায়া কাড়া চেহারা, মাথায় এলোমেলো চুল দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এই ছেলেটি পৃথিবীর সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেগুলোর একজন। চোখের দৃষ্টিতে কেমন যেন নিষ্পাপ সরল একটা ভাব, তবে চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ মাঝে মাঝে ঝিক করে ভেতর থেকে দুষ্টুমিটা উঁকি দেয়।
গুটলুর মা দাদির পায়ে ধরে সালাম করে গুটলুকে বলল, “গুটলু, চাচিকে সালাম কর।”
দাদি ভয় পেয়ে প্রায় চিৎকার করে বললেন, “না, না, না। সালাম করতে হবে না। সালাম করতে হবে না। আমি এমনিতেই দোয়া করে দেব।”
গুটলু তখন সালাম না করে একটা চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। টুনি দাদির পায়ের কাছে বসে চোখের কোনা দিয়ে গুটলুকে লক্ষ করে। টুম্পা ধারে কাছে নেই। টুনি জানে যখন সময় হবে তখন চলে আসবে।
গুটলুর মা বেশ কিছুক্ষণ দাদির (কিংবা নানির) সাথে এটা-সেটা নিয়ে গল্প করল। গল্পের বিষয়বস্তু খুবই একঘেঁয়ে। অমুক কেমন আছে তমুক কেমন আছে। অমুকের মেয়ের বিয়ে হয়েছে তমুকের ছেলের বিয়ে ভেঙে গেছে, অমুক মারা গেছে তমুক মারা যাবে যাবে অবস্থা–এরকম গল্প। পুরো সময়টাতে গুটলু পিঠ সোজা করে বসে রইল, টুনিও দাদির পায়ের কাছে বসে রইল। গুটলুর মা যতক্ষণ আছে ততক্ষণ সে গুটলুকে এখান থেকে সরাতে চায় না।
শেষ পর্যন্ত গুটলুর মা উঠল, গুটলুকে রেখে দাদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেল। অনেকগুলো বিয়ের কার্ড নিয়ে এসেছে, এই এলাকায় সবার বাসায় সেগুলো দিয়ে গুটলুকে নিতে আসবে-টানা কয়েক ঘণ্টার ধাক্কা।
টুনি উঠে দাঁড়াল, গুটলুকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী আমার সাথে আসবে?”
গুটলু মাথা নেড়ে টুনির সাথে সাথে ঘর থেকে বের হলো। টুনি ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র কোথা থেকে জানি টুম্পা পা টিপে টিপে এসে হাজির হলো। টুনির কাছে গিয়ে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তিন তলায়।”
টুনিও এদিক-সেদিক তাকিয়ে সতর্ক গলায় বলল, “ঠিক তো?”
“হ্যাঁ ঠিক। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে এসেছি।”
“তোকে দেখেছে?”
“না দেখে নাই।”
“দোতলায় যাওয়া যাবে?”
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, “এখন যাওয়া যাবে।”
“তাহলে আয় যাই।”
টুনি গুটলুর দিকে তাকাল, বলল “এসো। কোনো শব্দ করো না।”
গুটলু একটু অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“কাল রাতে জানালা ভেঙে বের হয়ে গেছে।“
“কে জানালা ভেঙে বের হয়ে গেছে?”
টুনি ঝট করে ঘুরে গুটলুর দিকে তাকাল। বলল, “তুমি জানো না?”
“কী জানি না?”
“আমার একজন কাজিন যে ম্যানিয়াক? চেইন দিয়ে অন্ধকারে ঘরের ভেতর বেঁধে রাখতে হয়? টোটাল সাইকোটিকা ডিসঅর্ডার?”
গুটলু মাথা নাড়ল, বলল, সে জানে না।
টুনি গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে বলল, “এই জন্য আমি খুবই অবাক হয়েছি যখন দেখেছি তুমি আর তোমার আম্মু আজকে আমাদের বাসায় এসেছ। দাদি তোমাদের নিষেধ করে নাই?”
টুম্পা বলল, “টুনি আপু, দাদিকে তো বলে নাই। দাদির হার্টের সমস্যা সেইজন্যে খারাপ কিছু হলে এখন দাদিকে কেউ কিছু বলে না। শান্ত ভাইয়া যে জানালা ভেঙে বের হয়ে গেছে দাদিকে কেউ বলে নাই।”
টুনি বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে বলল, “সেইজন্যে দাদি তোমার আম্মুকে কিছু বলে নাই। অবস্থা খুব ডেঞ্জারাস হতে পারে।”
গুটলু শুকনো মুখে, জিজ্ঞেস করল, “কী রকম ডেঞ্জারাস?”
টুনি উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার ব্লাড গ্রুপ কী?”
গুটলু বলল, “ব্লাড গ্রুপ?”
“হ্যাঁ।”
“জানি না। কেন?”
“কখন কী দরকার হয় কে বলতে পারে। এর আগে তানজিম বেঁচে গেল কারণ তার রক্তের গ্রুপ জানত। হাসপাতালে নিয়ে তাকে সাথে সাথে রক্ত দেওয়া গেছে।”
গুটলু কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “তানজিম কে?”
“আগেরবার যখন এরকম অবস্থা হয়েছিল তখন যে ভাইয়া এসেছিল। এর পরে থেকে সবসময় বাসার সামনে একটা অ্যাম্বুল্যান্স রেডি রাখা হয়।” টুনি টুম্পাকে বলল, টুম্পা দেখ দেখি অ্যাম্বুল্যান্সটা আছে কী না।”
টুম্পা জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, “না, দেখি না তো।”
টুনি বলল, “কী মুশকিল।”
টুম্পা বলল, “মনে হয় ওষুধ খাওয়ানো গিয়েছে সেই জন্যে দেরি করছে।”
টুনি বলল, “তা ঠিক। পুরো ডোজ নিউরো হেক্সা গ্লাইকোজিন খাওয়ানো গেছে।”
গুটলু জিজ্ঞেস করল, “এইটা খেলে কী হয়?”
“ব্রেনের ভায়োলেন্সটা কন্ট্রোলের মাঝে আসে। তখন একেবারে নরমাল মানুষের মতো কথাবার্তা বলে। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“নরমাল মানুষের মতো কথা বলে তার মানে কিন্তু নরমাল তা না। যেকোনো সময় ক্ষেপে উঠে। তানজিম ভাইয়ার–”
টুনি কথা বন্ধ করে শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করল।
টুম্পা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “বলো না টুনি আপু। প্লিজ বলো না। আমার ভয় করে।”
টুনি পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভান করে বলল, “আয় যাই।”
“চল।”
গুটলু এদিক সেদিক তাকিয়ে টুনি আর টুম্পার পেছনে পেছনে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় যেতে থাকল। একটু শব্দ হলেই গুটল চমকে উঠছিল। দোতলায়। পৌঁছে পা টিপে টিপে তারা টুনির ঘরে ঢুকল। ঘরের দরজা বন্ধ করে গুটলু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, বলল, “এখন তো আর ঢুকতে পারবে না। তাই না?”
টুম্পা হাসির মতো ভঙ্গি করে বলল, “ঢুকতে পারবে না? শান্ত ভাইয়ার গায়ে অসম্ভব জোর। এক ধাক্কায় দরজা ভেঙে ফেলবে।”
টুনি মাথা নেড়ে বলল, “দরজা ভাঙা তো পরের ব্যাপার। যদি দরজায় ধাক্কা দিলে দরজা না খুলি তাহলেই খেপে উঠবে। আমাদের একেবারে নরমাল ব্যবহার করতে হবে, যেন কিছুই হয় নাই। সবাই একেবারে নরমাল ব্যবহার করবে। তুমি দেখলে বুঝতেই পারবে না যে শান্ত ভাইয়া সাইকোটিক ম্যানিয়াক। ভয়ংকর উন্মাদ চেইন দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। কথা শেষ করে টুনি শিউরে উঠল, টুনিকে দেখে টুম্পা আর টুম্পাকে দেখে গুটলু আরো জোরে শিউরে উঠল।
টুনির ঘরে গুটলু একটা চেয়ারে বসল। আর টুম্পা টুনির বিছানায় পা তুলে বসল। টুনির ঘরটা টুনি সব সময় সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে, ঘরের ভেতরে বেশির ভাগই হচ্ছে বই কাজেই সাজিয়ে রাখা সোজা। গুটলু এদিক সেদিক তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না একটা বাসায় এসে এরকম একটা বিপদে পড়বে।
টুনি বলল, “তুমি চাইলে একটা বই পড়তে পারো। আমার ঘরে অনেক বই। সব রকম বই আছে–”
গুটলু বলল, “আমি বই পড়ি না।”
টুনি প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “বই পড় না? কোনো বই পড় না?”
“খালি পাঠ্য বই পড়ি।”
“খালি পাঠ্য বই?”
“হ্যাঁ। সেইটাও পড়তে চাই না। যখন জোর করে তখন পড়ি।”
টুনি বিস্ফোরিত চোখে কিছুক্ষণ গুটলুর দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পর জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোন ক্লাসে পড়?”
“ক্লাস সিক্স।”
“গুড। আমার কাছে ক্লাস সিক্সের একটা অঙ্ক বই আছে। তুমি বসে বসে অঙ্ক কর।”
গুটলু কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ইতস্তত করে বলল, “বসে বসে অঙ্ক করব?”
“হ্যাঁ। সময়টা তো কাটাতে হবে। অঙ্ক করলে সময় কেটে যায়।” বলে টুনি কয়েকটা কাগজ একটা বলপয়েন্ট কলম, আর ক্লাস সিক্সের অঙ্ক বইটা গুটলুর দিকে এগিয়ে দিল। মানুষ যেরকম করে বিষাক্ত সাপ কিংবা বিছার দিকে তাকায় গুটলু সেভাবে অঙ্ক বইটার দিকে তাকিয়ে রইল।
টুনি বলল, “যদি অঙ্ক করতে না চাও তাহলে তুমি এই কাগজগুলোতে একটি রচনা লিখতে পার।”
“রচনা?”
“হ্যাঁ। সৎ জীবন এবং মহৎ জীবনের ওপর রচনা।”
গুটলু এমনভাবে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল যেন সে খুব খারাপ একটা কথা বলে তাকে গালি দিয়েছে।
টুনি বলল, “আর যদি কিছু করতে না চাও তাহলে চুপচাপ বসে থাকতে পার।”
“আমি চুপচাপ বসে থাকি।”
“ঠিক আছে।”
কিছুক্ষণ পর টুম্পা বলল, “আমি বাইরে যাই, গিয়ে দেখি কী অবস্থা।”
টুনি বলল, “যা। খুব সাবধান কিন্তু।”
টুম্পা দরজা খুলে বের হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর টুনি বলল, “গুটলু, তুমি এখানে একটু অপেক্ষা করতে পারবে?”
“আমি? একা?”
“হ্যাঁ। আমি একটু দেখে আসি।”
“কী দেখে আসবে?”
“বাসার কী অবস্থা।”
“যদি শান্ত ভাইয়া চলে আসে?
“চলে আসলে আসবে। কোনো রকম বাড়াবাড়ি করবে না। যেটা জিজ্ঞেস করে তার উত্তর দেবে। চেষ্টা করবে চোখের দিকে না তাকাতে।”
গুটলু ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, “চোখের দিকে তাকালে কী হয়?
“অনেক সময় শান্তভাইয়ার ভায়োলেন্সটা বের হয়ে আসে। তাকে আরেক ডোজ নিউরো হেক্সা গ্লাইকোজিন খাওয়াতে পারলে আরেকটু সেফ হবে।”
গুটলু বলল, “ও।”
“ঠিক আছে? যাব?”
গুটলু শুকনো মুখে বলল, “যাও।”
টুনি তখন ঘর থেকে বের হয়ে গেল। গুটলু তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিল।
টুনি শান্তকে খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত দাদির কাছে এসেছে। সব বাচ্চারা দাদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। দাদির মুখ শুকনো এবং চেহারা বিমর্ষ। একজন জিজ্ঞেস করল, “দাদি তোমার কী হয়েছে?”
দাদি বললেন, “বুকটা ধরফর করছে।”
দাদি উত্তর দেবার আগেই টুনি বলল, “দাদির বুক ধরফড় করছে তার কারণ গুটলু এই বাসায় এসেছে।”
“গুটলু?” সবাই অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকাল। “গুটলু কে?”
টুনি বলল, “পৃথিবীর সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে। সে যে বাসায় যায় সেই বাসায় হয় সে আগুন ধরিয়ে দেয় না হলে পানিতে বাসাটা ভাসিয়ে দেয়।”
“কী বলছিস?” একজন অবাক হয়ে বলল, “সত্যি তাই করে?”
“হ্যাঁ, সেই বাসার জিনিসপত্র ভেঙেচুরে ফেলে না হয় বাসার মানুষজনের হাত পা কেটেকুটে যায়। সেই গুটলু এখন আমাদের বাসায়।”
“কোথায়?”
“আমার রুমে।”
“তোর রুমে কী করছে?”
“আমি যখন এসেছি তখন বসে ছিল। এখন কী করছে জানি না।”
বাচ্চাদের একজন বলল, “চল দেখে আসি।”
অন্যরা বলল, “চল।”
টুনি বলল, “না, না, সবাই যেও না। শুধু একজন গিয়ে নিয়ে এসো এখানে।”
“একজন? একজন কেন?”
টুনি মুখ গম্ভীর করে বলল, “কারণ শুধু একজন এই বাচ্চাটাকে কন্ট্রোল করতে পারবে।”
“কে? কে কন্ট্রোল করতে পারবে।”
টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া।”
শান্ত অবাক হয়ে বলল, “আমি?”
টুনি বলল, “হ্যাঁ তুমি। এই দুষ্টু বাচ্চাটাকে কন্ট্রোল করার মতো পার্সোনালিটি শুধু তোমার আছে। আর কারো নাই।”
শান্ত খুশি হয়ে বলল, “শুধু আমার আছে? তোর তাই ধারণা। শুধু আমার?”
টুনি বলল, “শুধু তুমি যখন বাচ্চাটাকে আনতে যাবে, তখন “তখন কী?”
“যখন বাচ্চাটাকে প্রথম দেখবে তখন তার দিকে তাকিয়ে ভিলেনের মতো একটু হাসবে?”
“ভিলেনের মতো হাসব? আমি?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“এমনি একটু মজা করার জন্য। আজকালকার বাচ্চা-কাচ্চারা এগুলো দেখলে খুব মজা পায়।”
“তা ঠিক।” শান্ত মাথা নাড়ল।
“পারবে না হাসতে? তখন বুকে থাবাও দিতে পার।”
“বুকে থাবা দিয়ে ভিলেনের মতো করে হাসব? এই রকম?” বলে শান্ত বুকে থাবা দিয়ে ভিলেনের মতো হাসল, প্রথমে আস্তে আস্তে হো হো শব্দ করতে করতে সেটাকে হা হা করে অট্টহাসির মতো করে ফেলল।
যারা হাজির ছিল তারা সবাই মাথা নেড়ে বলল, ভিলেনের হাসিটা খুবই ভালো হয়েছে। হিন্দি সিনেমার ভিলেন থেকেও ভালো।
টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া তুমি তাহলে যাও। নিয়ে এসো। গুটলু একা একা আমার রুমে বসে আছে। এতক্ষণে আমার রুমটা জ্বালিয়ে দিয়েছে কী না কে জানে।”
শান্ত বলল, “ঠিক আছে। যাচ্ছি।ঃ তারপর ভিলেনের হাসি হাসতে হাসতে সে দোতলায় রওনা দিল।।
.
গুটলু টুনির ঘরে চেয়ারটায় বসেছিল কিন্তু তার মতো মানুষের পক্ষে চুপচাপ চেয়ারে বসে থাকা সম্ভব না। কাজেই সে এখন ঘরটাতে কী কী আছে দেখতে শুরু করল। ঘরটা তার জন্যে মোটামুটি বিরক্তকর, বই ছাড়া আর কিছু নেই। শেলফের ওপরে একটা ফ্রেমে টুনির বন্ধুদের সাথে তার একটা ছবি। ছবিটা বের করে সবার নাকের নিচে গোঁফ একে দিলে ছবিটা মনে হয় আরো ভালো দেখাবে। গুটলু টুনির ডেস্কের জিনিসপত্র ওলটপালট করে একটা মার্কার খুঁজল, খুঁজে পেল না। বলপয়েন্ট কলম দিয়েই মনে হয় কাজ চলে যাবে। বল পয়েন্ট কলমই হাতে নিয়ে ছবির ফ্রেমটা খোলার চেষ্টা করার সময় তার মনে হলো সে একজনের হাসির শব্দ শুনতে পেল। সিনেমায় ডাকাতের সর্দারেরা যেভাবে হাসে অনেকটা সেরকম।
গুটলু তখন ছবির ফ্রেমটা শেলফের ওপর রেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ করে তার কেমন যেন ভয় ভয় করতে থাকে। যদি এই বাসার ম্যানিয়াক সাইকোটিক ছেলেটা চলে আসে তখন কী হবে? গুটলু শুনতে পেল হাসির শব্দটা ধীরে ধীরে ঘরের দরজার সামনে থেমেছে। কেউ একজন দরজাটা খোলার জন্য ধাক্কা দিল। খুলতে না পেরে দরজায় শব্দ করল।
গুটলু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
“আমি।”
গুটলু কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “আমি কে?”
“আমি শান্ত।”
গুটলুর মনে হলো সে হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে। এই বাসার ম্যানিয়াক সাইকোটিক ভয়ংকর উন্মাদ ছেলেটি এখানে চলে এসেছে। এখন কী হবে? দরজাটি বন্ধ রাখবে? মেয়েগুলো বলেছে তাহলে নাকি আরো বিপদ। দরজা ভেঙে ঢুকে যাবে তখন আরো ভয়ংকর ঘটনা ঘটবে। ভয়ে গুটলুর শরীর অল্প অল্প কাঁপতে থাকে। এখন সে কী করবে?
আবার দরজায় শব্দ হলো। খট খট খট। আবার গলার স্বর শোনা গেল, “দরজা খোলো।”
গুটলু রীতিমতো ঘামতে থাকে। দরজা বন্ধ রাখা যাবে না। তাহলে আরো বড় বিপদ হবে। গুটলু কাঁপা হাতে ছিটকিনি খুলল। ছিটকিনি খুলে দিতেই ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ভয়ংকর ম্যানিয়াক সাইকোটিক উন্মাদ ছেলেটা ঢুকে গেল। মেয়ে দুজন তাকে চোখের দিকে তাকাতে নিষেধ করেছিল সে তাই চোখের দিকে তাকাল না। দরজা খোলার সময় শুধু এক ঝলক দেখেছিল তাতেই তার শরীর হিম হয়ে গেছে। কী ভয়ংকর চোখের দৃষ্টি! শুধু যে ভয়ংকর চোখের দৃষ্টি তা নয় বুকে থাবা দিয়ে রক্তশীতল করা একটা অট্টহাসি দিয়েছে। এখন কী তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে? ঘাড়ের রগ কামড় দিয়ে রক্ত চুষে খাবে? রক্তের গ্রুপটাও সে জানে না।
কিন্তু ভয়ংকর ম্যানিয়াক সাইকোটিক উন্মাদ ছেলেটা সেরকম কিছু করল। খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, “তুমি গুটলু?”
গুটলু মাথা নাড়ল।
“গুটলু নামটা খুবই ফানি।” ম্যানিয়াক ছেলেটা হা হা করে হাসল। বলল, “গুটলু গুটলু গুটলু। হাউ ইন্টারেস্টিং।”
গুটলু কোনো কথা বলল না। ম্যানিয়াক ছেলেটা ভুল বলে নাই। গুটলু নামটা ইন্টারেস্টিং। এই নামের জন্যে তার অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়।
“চল, নিচে আমাদের সব ভাই-বোনেরা আছে। তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।”
গুটলু মাথা নাড়ল। শুকনো গলায় বলল, “ঠিক আছে। ঠিক আছে।”
“আমাদের ঝুমু খালা খুব ভালো ডালপুরী তৈরি করে। খেলে তুমি অবাক হয়ে যাবে।”
মেয়ে, দুজন বলেছিল একেবারে নরমালভাবে থাকতে নরমালভাবে কথা বলতে। ম্যানিয়াক ছেলেটাও নরমালভাবে কথা বলছে। গুটলুও নরমাল ভাবে কথা বলল, “ডালপুরি খেতে আমারও খুব ভালো লাগে।”
দাদির আশেপাশে বাচ্চারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল। তারা পৃথিবীর সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল, কিন্তু অবাক হয়ে দেখল শান্তর পিছু পিছু খুবই নিরীহ একটা বাচ্চা ছেলে কেমন যেন ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাতে তাকাতে ঘরে এসে ঢুকল। কাছাকাছি একটা চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসে পড়লো, তাকে দেখে একেবারেই দুষ্ট মনে হচ্ছে না। চোখে-মুখে দুষ্টুমির কোনো চিহ্ন নেই, সেখানে কেমন যেন আতঙ্ক!
কিছুক্ষণের মাঝে ঝুমু খালা প্লেট বোঝাই করে ডালপুরি চটপটি আর লাড়ু নিয়ে এলো। বাচ্চারা ঝপাঝাপি কাড়াকাড়ি করে খেতে থাকে। গুটলু কাড়াকাড়িতে অংশ নিল না। পিঠ সোজা করে বসে রইল। টুনি তখন একটা প্লেটে তার জন্য কিছু খাবার তুলে দিয়ে গুটলুর হাতে তুলে দিয়ে কানের কাছে। মুখ লাগিয়ে ফিস ফিস করে বলল, “শান্ত ভাইয়াকে দেখছ?”
গুটলু মাথা নাড়ল।
“সবাই কী রকম নরমালভাবে তার সাথে কথা বলছে দেখেছ?”
গুটলু আবার মাথা নাড়ল।
“আসলে কিন্তু পুরোটা অভিনয়। তার হাতে দুইটা লাড়ু দেখেছ?”
গুটলু মাথা নাড়ল।
“এই লাড়ুর ভেতর পুরো ডোজ নিউরো হেক্সা গ্লাইকোজিন আছে। যদি লাড্ড দুইটা খেয়ে ফেলে তখন বিপদ অনেকটা কেটে যাবে।”
গুটলু ভয়ে ভয়ে বলল, “খাবে তো?”
“মনে হয় খাবে। শান্ত ভাইয়া খেতে পছন্দ করে।”
গুটলু শুকনো মুখে বলল, “ও।”
“ডিনারের সময় খাবারের সঙ্গে সিডেটিভ দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলবে। তারপর ওপরে ঘরে নিয়ে চেইন দিয়ে বেঁধে ফেলবে।”
শান্ত হঠাৎ করে টুনি আর গুটলুকে লক্ষ করে বলল, “তোরা কী নিয়ে গুজগুজ ফুসফুস করছিস?”
গুটলু আতঙ্কে চমকে উঠে বলল, “না, না কিছু না কিছু না।”
টুনিও মাথা নাড়ল, বলল, “কিছু না শান্ত ভাইয়া।”
ডালপুরিটা খুবই মজার ছিল, চটপটিটাও ছিল অসাধারণ কিন্তু গুটলু সেগুলো খুব মজা করে খেতে পারল বলে মনে হলো না। সে সারাক্ষণ শান্তর দিকে তাকিয়ে ছিল। শান্ত পরপর তিনটা লাড়ু খাওয়ার পর গুটলু প্রথমবার একটুখানি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
.
গুটলুর মা বিয়ের কার্ড দিয়ে ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা পার করে ফেলেছিল কিন্তু গুটলুকে নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। সে পুরো সময়টা একটা চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসেছিল। গুটলুর মা ভেবেছিল এই বাসায় এসে গুটলুর দুই চারটি দুষ্টুমির গল্প শুনবে কিন্তু কিছুই শুনল না। তখন আরো কিছুক্ষণ দাদির সাথে গল্প করতে চাইছিল কিন্তু গুটলু চলে যাবার জন্য একেবারে অস্থির হয়ে গেল।
গুটলুকে নিয়ে গুটলুর মা চলে যাবার পর শান্ত বলল, “কী আশ্চর্য, এরকম শান্তশিষ্ট ভদ্র একটা বাচ্চার নামে সবাই কী রকম আজেবাজে কথা ছড়াচ্ছে, দেখেছিস?”
প্রমি বলল, “হ্যাঁ, কী সুইট একটা বাচ্চা। পুরো সময়টা চুপ করে বসে রইল। একটার চেয়ার থেকে উঠল পর্যন্ত না! কে বলেছে এই বাচ্চা দুষ্ট? মোটেও দুষ্টু না।”
দাদি (কিংবা নানি) বললেন, “হ্যাঁ। আমিও অবাক হয়ে গেলাম। চন্দনের বিয়েতে আমি নিজের চোখে দেখেছি। শামিয়ানার দড়ি ধরে–” দাদি হঠাৎ কথা থামিয়ে ভুরু কুচকে টুনির দিকে তাকালেন। বললেন, “টুনি? তুই কিছু করেছিস নাকি?”
টুনি বলল, “আমি? আমি কী করব?”
টুনি টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, “টুম্পা তুই তো সারাক্ষণ আমার সাথে ছিলি। আমরা কী কিছু করেছি?”
টুম্পা মাথা নাড়ল। বলল, “না টুনি আপু। আমরা আবার কী করব?”
তারপর দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসল। ঠিক তখন দাদির (কিংবা নানির) টেলিফোনটা বাজল। দাদি টেলিফোনটা খুঁজে বের করতে করতে লাইন কেটে গেল তখন আবার টেলিফোনটা বাজল। দাদি টেলিফোনটার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী ব্যাপার গুটলুর মা আমাকে ফোন করছে কেন?”
দাদি টেলিফোনের বোতাম টিপে কানে ধরলেন। গুটলুর মায়ের গলায় জোর আছে, ফোনে কানে না লাগিয়েই সবাই শুনল গুটলুর মা বলছেন, “চাচি! আপনি তো কখনো আমাকে বলেন নাই আপনার একজন নাতিকে চেইন দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। ছাড়া পেলে সর্বনাশ হয়ে যায়–”
টুনি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে টুম্পাকে বলল, “টুম্পা আয় আমাদের স্কুল প্রজেক্টটা শেষ করতে হবে। যাই।”
টুম্পাও লাফ দিয়ে উঠে বলল, “চল টুনি আপু।”
কিছু বোঝার আগে দুজন ঘর থেকে উধাও হয়ে গেল।