গুজবে কান দেবেন না

গুজবে কান দেবেন না

শনিবারের বিকেল। রাস্তাঘাটে গা-ছাড়া ভাব। লিনটন স্ট্রিট থেকে প্রায় ফাঁকা একটা বাসে উঠে পড়ে কাবুল। বাসটা ডালহৌসি অবধি যাবে।

গোটা বাসে একটাই লোক দাঁড়িয়ে। ঠিক শালা লেডিস সিটের সামনে। এমন মুখ করে আছে, যেন এইমাত্র মঠ-মন্দির থেকে ঘুরে এল। লোকটার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় কাবুল। কন্ডাক্টর শিয়োর ভাঁজমারা চোখে দেখছে কাবুলকে। এই রুটের সব কন্ডাক্টর, হেলপার কাবুলদের চেনে, শনিবার বিকেলে কাবুলরা কাজ করে না। যে যার ঠেকে রেস্ট করে, মস্তি

করে খারাপ পাড়ায় গিয়ে। ফাঁকা বাসে পকেটমার, কন্ডাক্টর তো চোখ কোঁচকাবেই। চোখে ঝাঁঝ এনে আচমকা গেটের দিকে ঘুরে তাকায় কাবুল, সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে ‘ধর্মতলা, ধর্মতলা, বিবিডি বাগ’ করতে থাকে কন্ডাক্টর।’

এরা কাবুলদের ঘাঁটায় না। এলাকার ওপর দিয়ে যেতে হয় রোজ।

এখন যে কাজে বেরিয়েছে কাবুল, মেজাজ একদম হাই ভোল্টেজ থাকা উচিত। ফাঁকা বাসটার জন্যই কি না কে জানে, মুড ঢিলে পড়ে যাচ্ছে। বাসে ওঠার আগে ফেলার ঝোপড়ায় গিয়ে এক পাঁইট দুম দুম করে চার্জ করে নিয়েছে কাবুল। শালা, কানের লতি পর্যন্ত গরম হয়নি। এই টেম্পোতে অপারেশনটা সাকসেসফুল হলে হয়!

মৌলালি থেকে বেশ ক’টা প্যাসেঞ্জার উঠল। বাস স্টার্ট নিতেই ইচ্ছে করে পাশের লোকটার গায়ে পড়ল কাবুল। বুটসুদ্ধ পা-টা তুলে দিল ভদ্রলোকের চটি পরা পায়ে। শুরু হয়ে গেল হাট্টিচিল্লি, এ কী, আপনি আমার পায়ের ওপর উঠে পড়ছেন কেন? ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারছেন না!

আপনিই বা একগাদা জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন কেন? মনে হচ্ছে দুটো টিকিট কেটেছেন।

অ্যাই, মুখ সামলে কথা বলবে, ভদ্রলোকের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জানো না? আর ভদ্দরলোক সাজতে আসবেন না। পুরো বাস ফাঁকা, সেই থেকে কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন লেডিস সিটের সামনে। লজ্জা করে না?

অ্যাই চুপ, এক চড়ে দাঁত ক’টা ফেলে দেব। কী ভাবিস তুই নিজেকে?

ঝগড়া চালিয়ে যায় কাবুল। এই তো বেশ কান-মাথা গরম হচ্ছে। ভদ্দরলোকদের সঙ্গে ঝগড়া করার এই এক মজা, ফার্স্টে আপনি দিয়ে শুরু করে, একে একে জামা-প্যান্ট খোলার মতো তুইতে এসে নামে। এক এক সময় এমন খিস্তি দেয়, স্টক বেড়ে যায় কাবুলদের।

ঝগড়া লাগিয়ে দিয়ে পকেট কাটা কাবুলদের ট্যাকটিক্স। আজকের ঝগড়াটা কিন্তু নেট

প্র্যাকটিস। ভিড় নেই বলে তেমন জমল না। কেউ বলল না, দাদা হাত থাকতে মুখে কেন! লোকটা সরে গেল সামনের গেটের দিকে।

ফেলার চোলাই কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে, চিড়িক মারছে রগে। ব্যস, এই গরমটা ঘণ্টাখানেক থাকলেই চলবে।

রোজকার কাজের সঙ্গে আজকের কাজে খুব একটা যে তফাত আছে তা নয়। আজও প্যান্টের পকেটে নতুন ব্লেড। এখনও দাঁত ভাঙা, মানে প্যাকেট সুদ্ধ হাফ করে নেওয়া হয়নি। অন্য দিন ব্লেড চালায় মরা চামড়ায়, রেক্সিনে বা কাপড়ে। আজ চালাবে জ্যান্ত চামড়ায়। জন্মের শোধ দাগ মেরে দেবে। অপারেশনটায় রিস্ক তেমন কিছু নেই। যাকে মারবে ব্লেড, ভদ্রসমাজের বাইরের, কাবুলের মতোই, পুলিশ এসব লোয়ার ক্লাস সেমসাইড লাফড়ায় নাক গলায় না। কামাই নেই। খামোকা টাইম নষ্ট।

কাবুলের বাবা ভদ্দরলোকদের ঝাড়ে বাঁশ কাটতে গিয়েছিল, তাই এখন জেলে। কাবুলের মা নিরুদ্দেশ। পার্কসার্কাসের লালচাঁদ কাবুলকে ক্লাস ফোর থেকে মানুষ করছে। লেখাপড়াটা চলুক, চাইত লালচাঁদ। কিছুদিন বাদেই বুঝতে পারল, হওয়ার নয়। শুরু হল জোরদার ট্রেনিং। খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে বড় মাপের আর্টিস্ট হিসেবে প্রমাণ করল কাবুল। লালচাদের শিষ্যদের মধ্যে একমাত্র কাবুল এখন অবধি পাবলিকের ধুম ক্যালানি বা থানার রুল খায়নি।

বস গর্ব করে বলে, কাবুলের হচ্ছে এক্স-রে চোখ, ব্যাগে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে, মাল কী আছে। অনেক দূর যাবে ছেলেটা। কাবুলের অন্য সব পার্টনার প্রায়ই ফল্স খেয়ে যায়, চকচকে ব্যাগ দেখে টানল ব্লেড, বেরিয়ে এল না-ধোওয়া টিফিন বক্স, ডজন দরে কেনা ইন্টুসিন্টুর প্যাকেট, বউয়ের ইয়ে… একেবারে কাঁথা-বালিশ কেস। তবে, কাবুলও একবার হেভি কেলো করেছিল, বাঁকড়া-পার্কসার্কাস মিনিতে বোরখা পরা মেয়ের ব্যাগ ফাঁসাল, হাতে চলে এল কালো কুচকুচে কেউটের বাচ্চা। পিস্তলটা নিয়ে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না কাবুল। শীতকালেও কপালে বিনবিন করছিল ঘাম। মালটা পায়ের কাছে ফেলতে যাবে, বোরখার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল হিসহিসে ছেলের গলা, দে দো। আয়িন্দা অ্যায়সা নেহি করনে কা।

জিনিস ফেরত দিয়ে লাফিয়ে বাস থেকে নেমে গিয়েছিল কাবুল। সেই লাস্ট বার, আর কখনও ভুল হয়নি। নিজের গুণেই কাবুল এত অল্প বয়সে গুরুর ফেভারিট। থাকা-খাওয়া এখনও লালচাঁদদার গ্যারাজে। সবাই জানে লালচাঁদ মরলে কাবুল গ্যাং অপারেট করবে। সেই কাবুলই কিনা বুদ্ধু বনে গেল! ভাগ্যিস দলের কেউ জানে না। জানলে, এইসান প্যাক দেবে…

থানা-পুলিশ, খোচড়, পার্টির দাদা সামলায় লালচাঁদদা। কাবুল আজ যে অপারেশনে চলেছে, ফেঁসে গেলে কোনও হেল্প পাবে না বস-এর। লালচাঁদদার কড়া অর্ডার, ব্লেড চালাও, ব্লাড না বেরোয়। জানতে পারলে আমিই ঢুকিয়ে দিয়ে আসব লকআপে। কিন্তু কাবুল নাচার, অপমানের শোধ তাকে নিতেই হবে।

ওয়েলিংটনে এসে বাস একদম থেমে গেল। মোড়ের বাঁদিক থেকে দুবলা মিছিল,

ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ঢুকছে এস এন ব্যানার্জি রোডে। চৌমাথা জ্যাম।

বাস থেকে নেমে আসে কাবুল। কন্ডাক্টর ভাড়া চায় না। সিস্টেম নেই।

বারবেলার মিছিল মানে কর্পোরেশনের সাফাই গাড়ি, সমস্ত কাস্টমারকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে দেয়। যে ক’টা লোক পড়ে থাকে রাস্তায়, বাড়ি সেঁধোতে পারলে যেন বাঁচে। পাকা দোকানের হাফ ছুটি, ঝাঁপ পড়ে যায় আগেই। ডালা তুলে নেয় ফুটপাতের দোকানি। ফাস্টফুডের দোকান রোল, চাউমিন বানায় না নতুন করে। ফল্স ভিখারিরা গলতায় লুকোনো ভাল জামাকাপড় বার করে গায়ে চড়ায়, বাড়ি ফেরার বাস ধরে। রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় পাগল, মাতাল আর মুখ কালো হয়ে যাওয়া লাইনের মেয়ে। কুকুরগুলোর র‍্যালা বাড়ে। পাড়া দখলে নেমে পড়ে সব।

ধর্মতলাটা হয়ে যায় বাঁজা মেয়ের বাপের বাড়ি ফেরত আসার মতো। লালচাঁদদার বোন ফিরে এসেছে, সাজগোজ নেই, তিরিক্ষি মেজাজ।

মিছিল এগিয়ে গেছে অনেকটা। রাস্তায় গড়াচ্ছে ছেঁড়া পোস্টার, প্লাস্টিকের চায়ের কাপ। একটু উঁচুতে উড়ছে হাওয়া-ভরা ক্যারি ব্যাগ। ট্রাফিক এ দিককার গাড়ি ছাড়েনি এখনও। এই শুখা ওয়েদারে সে থাকলে হয়। আজকের দিনটা ফসকালে, সামনের শনিবারটা টিপ করে বসে থাকতে হবে। এই দিনটাতে সে একটু আলগা থাকে, রাস্তায় সাক্ষী থাকে কম।

সেদিন রাস্তায় ভিড় ছিল। বাসেও বাদুড়ঝোলা। কাজ করতে না পেরে নিউ সিনেমার সামনে নেমে পড়েছিল কাবুল। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দেখছিল, হাতে-টানা রিকশায় চাপা সাহেব-মেমের আহ্লাদ। হঠাৎ কানের পাশে একটা মেয়ের গলা, আপনি কারুর জন্য ওয়েট করছেন?

ঘাড় ফেরাতে কাবুল দেখে, আশপাশের সব দোকানের রঙিন আলো মেখে ছিপছিপে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কাবুল বলে, না, কেন?

দাঁত কেলিয়ে হাসে মেয়েটা। ছোট্ট আড়মোড়া ভেঙে বলে,

এমনি।

পাশে দাঁড়িয়ে হাত ওঠা-নামা করে কাচের চুড়ির মিউজিক শোনায় মেয়েটা। একটু পরে বলে, সিনেমা যাবেন?

ভদ্রবাড়ির আনকা ছেলে হলে কোমরের বেল্ট হড়কে যেত। কাবুল ফুটপাতের বুলি চেনে। ঘড়ি দেখে বলে, টাইম নেই।

তা হলে চলুন না, কোল্ড ড্রিংক্স খাই। উলটোদিকের রেস্টুরেন্ট দেখিয়েছিল মেয়েটা। সেদিন দুপুরে কলকাতায় পিচ-ঘামা গরম গেছে।

ঠান্ডা খেতে খেতে ভাল করে আলাপ হল রাকার সঙ্গে। নাম শুনেই বোঝা যায়, আসল নয়। পরের কথাগুলো মনে হয়েছিল সত্যি, রোজ লোকাল ট্রেনে ক্যানিং থেকে আসে। বাড়িতে অভাব। সংসারের জন্যই এই কাজে নামা। লাইনে থাকতে গেলে অনেক জায়গায় দিতে-থুতে হয়। এ ছাড়াও আছে নিত্য নতুন শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, জুতো, পাউডার, লিপস্টিক আরও কত কী! সব ঠিকঠাক না হলে পার্টি ক্যাচ হবে না। ক’টা টাকাই বা দিতে

পারে বাড়িতে, বলে গোলাপি ফুলছাপ রুমালে চোখের জল মুছেছিল। কিছুটা কাজল দুঃখের মতো রুমালে লেগে যায়।

তার পর থেকেই এক দু’দিন অন্তর দেখা হতে লাগল দু’জনের। কাবুলকে হেঁটে আসতে দেখলেই দিওয়ানা হয়ে যেত রাকা। একটা পার্টি হয়তো গেঁথে ফেলেছে বঁড়শিতে, ছিপ ফেলে দিয়ে চলে আসত কাছে। তখন সন্ধে নামত ঝুপ ঝুপ করে। আনসান কিছু খাওয়ার পর রাকা নিয়ে যেত নিউ সিনেমার পেছনের ফুটপাতে। গাড়ির পার্কিং প্লেস। তার আড়ালে রাকার রেস্ট করার জায়গা। তার থেকে বেশি কিছু নয়, ছাদ, দেওয়াল তো নেই। একটু দূরে রুমালওলা, ব্যাঙ্কের দোরগোড়ায় হাড্ডিসার এক মেয়ে ভিখারি, পাঁচ-ছ’মাসের বাচ্চা আছে তার। রাকা বলেছে, ভিক্ষে করাটা তার দিখাবা, আসলে পাউডার বেচে। মানে হেরোইন। হতেও পারে। মেয়েটার কাছে ফাটা-চটা, ঝিমমারা লোকজন আসা-যাওয়া করে, কিছু একটা হাতবদল হয়। অন্যের গাড়িতে হেলান দিয়ে রাকার সঙ্গে কথা বলতে বলতে দেখেছে কাবুল।

রাকার একটা ব্যাড হ্যাবিট হচ্ছে, ওর গায়ে হাত দিতে দেবে না, খালি ঝুঁকে আসবে কাবুলের বুকে। বোতাম লাগানো আছে, তবু শার্টের বোতাম খুলবে আর লাগাবে। কাবুল বলেছিল, চলো না, একদিন ডায়মন্ডহারবারে রুম নিই।

রাজি নয় রাকা। লাইনের মেয়ে হতে পারে, ওটা তার অফিসের মতো। যাকে ভালবাসবে বিয়ে করার পর সব দেবে। রাস্তায় এখনও নিজের সবটা খুইয়ে ফেলেনি সে। ‘বিয়ে’ কথাটা কানের ভেতর দিয়ে ঢুকে পাঁজর ধরে ঝুলতে থাকে।

কাবুলদের গ্রুপে তিনজন বিয়ে করা ছেলে আছে, থাকে আলাদা বাসা ভাড়া করে। বাকিদের সব একটা-দুটো করে মেয়ে ফিট করা আছে। কাবুল সবার থেকে ছোট। বিয়ের কথাটা এখনই কী করে বলবে লালচাঁদদাকে!

এদিকে রাকার কথাও তো ভাবতে হয়, রং মেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, যেসব পাবলিকের ওর কাছে ভেড়ার দম নেই, দূর থেকে হাসাহাসি করে। যেন খোরাক। ফুটপাতের অন্য কারবারিরা ওকে নিজেদের লোক মনে করে না, ছোট চোখে দেখে। রুমালওলার ডালার সামনে ঘুরঘুর করলে, মুখ করে লোকটা। ভিখারি মায়ের বাচ্চাটার সঙ্গে আতুপুতু করতে গেলে তেড়েফুঁড়ে আসে মা। রাকা হয়তো হাইহিল পরে বিউটি কনটেস্টের মতো হেঁটে যাচ্ছে, আখমাড়াইয়ের লোকটা পেছন থেকে টুক করে জল ছুড়ে দিয়ে ভালমানুষের মতো বসে রইল। রাকা বোকার মতো প্রতিবার আকাশ দেখে, মেঘের চিহ্ন নেই।— হঠাৎ ভিজিট করতে এসে এসব দেখে ফেলেছে কাবুল। ফাইনাল ডিসিশন নেয়, বিয়েটা করে ফেলা উচিত। এভাবে রাকাকে আর ইনসাল্ট হতে দেওয়া যায় না।

দালাল মারফত কসবার দিকে একটা ভাড়াবাড়ি পছন্দ করল কাবুল। এখন রাকার পছন্দ হয় কি না দেখা যাক, এই ভেবে গত বুধবার রাকাকে দুপুরবেলা নিতে এসেছিল। নিউ সিনেমার পেছনে গিয়ে দেখে, ধামাসান ফাইট, রাকার সঙ্গে রুমালওলার। লোক জমা হয়ে গেছে। ভিখারি মা, আখমাড়াইয়ের লোকটা, পানওলা, জুতো পালিশওলা সবাই রুমালওলার হয়ে চেঁচাচ্ছে। রাকার কোনও সাপোর্টার নেই।

কী নিয়ে ঝামেলা কে জানে। কাবুল ভেবে পাচ্ছিল না, তার কী করা উচিত? রাকার হয়ে কিছু বলতে বা করতে গেলে ফুটপাতের লোক তার চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করে দেবে। যা মুখ সব! তবে রাকা একা কম যায় না। রুমালওলাকে মাটিতে ফেলে এইসান হিড়কান দিচ্ছিল, যেন নিউ সিনেমার পরদা থেকে নেমে এসেছে।

শেষমেশ কেসটা সামলাল তিনটে হিজড়ে এসে। দু’জন সরিয়ে নিয়ে গেল রাকাকে। একজন ভারী গলায় রুমালওলাকে বলতে লাগল, কেন ছেলেটার পেছনে লাগো! তোমার কী ক্ষতি করেছে?

‘ছেলে’ কথাটা স্টোনচিপের মতো ছিটকে এসে লেগেছিল কাবুলের মাথায়। ঠিক শুনল কি? মারপিটের সিনটা ভাবলেই কথাটা খাপ খেয়ে যাচ্ছে। এত ভুল হল কাবুলের। রাকার গায়ে লোম নেই, গলাটা একটু ভাঙা, তা বলে ছেলেদের মতন নয়। ব্লাউজ পরে। বুক কম, তবু আছে।

মাথা ঝিমঝিম করছিল কাবুলের। তাড়াতাড়ি ডেরায় ফিরে আসে। লালচাঁদদা এক্সপেরিয়েন্সড লোক, ঘুরিয়ে তার কাছেই জানতে চাইল কাবুল, লালদা, ধর্মতলায় যেসব মেয়েরা রাস্তায় দাঁড়ায়, তাদের মধ্যে

ছেলেও আছে?

ঠিক ছেলেও নয়, হিজড়েদের মতন। কেন রে?

আজ একটা মাল আমাকে হিড়িক দিচ্ছিল।

হারগিস যাবি না। বহুত ডেঞ্জারাস। পার্টিকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে ড্যাগার চমকায়, লুটে নেয় পার্স, ঘড়ি, আংটি সব।

কিন্তু দেখে তো একদম মেয়ে মনে হয়, বুকও আছে।

বুক হয় কারুর কারুর, খুব কম। সারবস্তু কিছু নেই। ফোঁপরা। তুলো ভরা বডিস পরে বানিয়ে রাখে।

তখনই কাবুল ঠিক করে ফেলে, রাকার মুখে দাগ মেরে দেবে। কারবার করে খেতে হবে না ওকে। এত বড় বেইমান! শালা প্রথমবার লাভ-এ পড়েছিল কাবুল…

কর্পোরেশনের সামনে এসে কাবুল একটু দাঁড়ায়। বাঁদিকে ঘুরলেই রাকাদের এলাকা। মিছিল পৌঁছে গেছে মনুমেন্টে। এদিকটা এখন সান্নাটা। ব্লেডটা পকেটে ভেঙে নেয় কাবুল। ঘুরে যায় বাঁ রাস্তায়।

না, দেখা যাচ্ছে না রাকাকে। কর্পোরেশনের দেওয়াল ঘেঁষে পাতা খাচ্ছে কালোঝুলো চার-পাঁচটা লোক। ডালা সাজিয়ে বসে আছে রুমালওলা, খদ্দের নেই। আখমাড়াই কলের ঘণ্টি বাজছে না। দেশওয়ালির সঙ্গে গ্যাঁজাচ্ছে লোকটা। ভিখারি মা লালপড়া বাচ্চাটাকে নিয়ে দিল্লাগি করছে। সাঁ সাঁ করে প্রাইভেট গাড়ি চলে যাচ্ছে নিউ মার্কেটের দিকে— সব আছে, যাকে দরকার সে নেই।

জেরক্স, এস টি ডি বুথে ঢুকে পড়ে কাবুল। কালো কাচে ঘেরা দোকান, বাইরেটা দেখা যায়, ভেতরের লোককে মালুম হয় না। এখান থেকে ওয়াচ করতে হবে। রাকা আশেপাশে আছে নিশ্চয়ই। ফিরলেই ওকে নিয়ে যেতে হবে আরও ফাঁকা কোনও জায়গায়। মুখে

রুমাল চেপে গালে আড়াআড়ি… ওই তো রাকাকে দেখা যাচ্ছে। পার্কিং গাড়ির জানলার কাচে পোজ দিচ্ছে। রুপালি কাচ। আঁচল নামিয়ে বুকটা একবার দেখে নিল। গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল ড্রাইভার, কাক তাড়ানোর মতো তাড়াল রাকাকে। দূরে গিয়ে দাঁত ক্যালাচ্ছে রাকা।

প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকায় কাবুল। আধখানা ব্লেড প্যাকেট থেকে বার করে দু’আঙুলের মাঝে রাখে। এই অবস্থায় কাবুল ভাত পর্যন্ত খেতে পারবে। এত প্র্যাকটিস!

বেরিয়ে আসে এস টি ডি বুথ থেকে। মুখ গম্ভীর, পুরো সলমন স্টাইল। রাকা দেখতে পেয়েছে, লাভ মার্কা হেসে এগিয়ে আসছে পাশ দুলিয়ে। কী গো, কখন এলে? জানতে চায় রাকা।

এই তো কিছুক্ষণ হল।

এতদিন আসা হয়নি কেন?

কাজ ছিল। ছোট করে উত্তর দিয়ে কাবুল বলে, কার্জন পার্ক যাবে?

চলো, তার আগে কিছু খাওয়াতে হবে কিন্তু। আজ মার্কেট খুব খারাপ।

উত্তর না দিয়ে হাঁটতে থাকে কাবুল। ওর একটা হাত পকেটে। চোখের কোণ দিয়ে মেপে নিচ্ছে আশপাশ, তখনই খেয়াল করে, পাতাখোরগুলো হঠাৎ কেমন যেন ফড়ফড় করে উঠল। তারপর যে যেদিকে পারল মারল দৌড়। তার মানে হাল্লাগাড়ি আসছে। রাকা কাবুলকে টেনে নিল রাস্তার ধারে।

ধাঁ করে ঢুকে এল পুলিশের জিপ। থামল ভিখারি মায়ের সামনে। পালানোর টাইম পেল না বউটা। বাচ্চাটাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিল। শুধু মাকেই তুলল পুলিশ। মায়ের কোমর, ব্লাউজের ভেতর থেকে বার করে নিচ্ছে পুরিয়া।

জিপ চলে গেল। ফুটপাতে শুয়ে চিল চিৎকার জুড়েছে বাচ্চাটা। পেট ভরেনি বেচারির। ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসা লোক একপলক দেখলেও, ফুটপাতের দোকানদাররা ঘুরেও দেখছে না।

পাল্টি খেয়ে গেল বাচ্চাটা, বুক ঘষটে নেমে আসছে রাস্তায়। কেঁদে কেঁদে একসা হচ্ছে। রাকা বলল, আজ বোধহয় যাওয়া হবে না গো। কখন ওর মাকে ছাড়বে! তুমি বাড়ি যাও।

দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল রাকা। কান্না থামছেই না। ভিখারি মায়ের চটে বসে পড়ে রাকা। কোল নাচিয়ে বাচ্চাটাকে ভোলাবার চেষ্টা করে। ভোলে না বাচ্চা। ও তো চেনে না রাকাকে। ওর মা রাকাকে ঘেঁষতেই দেয় না কাছে।

রাকা এরপর একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে, ব্লাউজ নামিয়ে ওর সেই শুকনো বুক তুলে দেয় বাচ্চাটার মুখে।

মাথা গুলিয়ে ওঠে কাবুলের। ওপেনলি এ কী করছে রাকা! কাস্টমাররা তো জেনে যাবে, ও মেয়ে নয়। বাচ্চাটাই বা থামবে কেন, যদি না দুধ পায়। রুমালওলা খ্যাকখ্যাক করে হাসছে। এগিয়ে আসছে পানওলা, আখওলা, আরও সব রাস্তা-চলা লোকজন। বাচ্চাটা কেঁদে-ককিয়ে ধর্মতলার লোক জড়ো করছে। এরপর তো মিছিলের মানুষ চলে আসবে।

কাবুল দৌড়ে রাস্তার ওপারে যায়। প্যাকেটের দুধ কিনে ফিরে আসে। ধমক দেয় জমা

হওয়া লোকগুলোকে। রাকাকে আড়াল করে দাঁড়ায়। যে ব্লেডে গাল কাটবে ভেবেছিল, দুধের প্যাকেট কাটে কাবুল। রাকার দিকে এগিয়ে দিলে বলে, কুছ তো লাজ শরম কর। নে খাইয়ে দে!

পরের দিন কাগজে তিনের পাতায় চারের কলমে হেডিং ছিল, সাদা বৃষ্টি। লেখা ছিল, গতকাল বিকেল পাঁচটা নাগাদ ধর্মতলার কিছু অংশ জুড়ে ছিটেফোঁটা সাদা রঙের বৃষ্টি হয়। কেউ বলছেন, অ্যাসিড বৃষ্টি, কেউ বা গুজব ছড়াচ্ছেন ‘দুধ বৃষ্টি’ বলে। বৃষ্টির পরিমাণ এতই কম ছিল, নমুনা পাওয়া যায়নি।

রবিবাসরীয় (আনন্দবাজার পত্রিকা) এপ্রিল ২০০৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *