গুগলি রোল
একটা গাড়ি হুস করে বেরিয়ে গেল। পেছনের আসনে গা এলিয়ে বসে আছেন মাঝবয়সী এক মানুষ। গম্ভীর মুখ। কাঁচাপাকা চুল। চোখে চশমা। ধোপ-দুরন্ত পোশাক। কোনও দিকেই তাকাচ্ছেন না; অথচ তাকিয়ে আছেন। চোখের এই দৃষ্টি আনতে অনেক বছর সাধনা করতে হয়েছে। উদ্দেশ্যহীন তাকানো। সকলেরই মনে হবে, হয়তো আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন; কিন্তু না, সে তাকানোয় কোনও স্বীকৃতি নেই। অসাড় নয়নের সামনে দিয়ে নিজের পাড়া এলাকাটি পিছলে- পিছলে চলে গেল। এই সময়টা ভদ্রলোক একটু অস্বস্তিতে থাকেন। রাস্তার দু-পাশে পাড়ার ছেলেরা দাঁড়িয়ে থাকে। শক্ত, সমর্থ, মোটামুটি শিক্ষিত। এদের প্রায় সকলেই কোনও না কোনও সময়ে ভদ্রলোকের কাছে গিয়েছে ও একটা কিছু করে দেওয়া যায় কি না বলে ভীষণ অনুরোধ করেছে। প্রতিপত্তিশালী মানুষ। গাড়ি। বাড়ি। বড় চাকরি। বাড়িতে কখনও নেতারা আসেন। আসেন সাহিত্যিক, শিল্পী, সম্পাদক, সাংবাদিক, নতুন-নতুন গাড়ি আসে। বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর চলে যায়। পাড়ার এমন একটা মাথাওয়ালা মানুষ থাকতে ছেলেদের কিছু হবে না! এ কেমন কথা।
ছেলেরা গেছে। ভদ্রলোক অমায়িক হেসেছেন। ভাই সম্বোধনে কথা বলেছেন। কারোর-কারোর কাঁধে হাত রেখেছেন। দেখাতে চেষ্টা করেছেন কতই যেন আপন। সাজানো বৈঠকখানা। কাঁচের অ্যাকোরিয়ামে দু-হাজার টাকার মাছ খেলা করছে, জানালায় দরজায় বাহারী পর্দা। টিপটিপ। তিনি টিপটপ থাকতে ভালোবাসেন। তিন জাতের তিনটে কুকুর ঘেউ-ঘেউ ডাকে বাড়ি মাথায় করে রেখেছে। কুকুর হল স্ট্যাটাস সিম্বল। সারাদিনে তাঁর হাজারো জ্ঞানগর্ভ কথার অর্ধেকই হল কুকুরসংক্রান্ত। তিনি কখনও ‘না’ বলেন না। চাকরি? কি আছে আমি বলে দোবো। তোমার একটা বায়ো ডাটা আমাকে দিয়ে যেও। দেরি কোরো না। হাজার দেড় হাজারে চলবে না? পরে অবশ্য বাড়বে।
বেকার যুবক হাতে পরম আশ্বাসের চাঁদ পেয়ে নাচতে-নাচতে চলে গেল। পরের দিনই ফিরে এল জীবনপঞ্জী নিয়ে। প্রথমে তিনি চিনতে পারলেন না। পরে বললেন, ওটা আবার কি? ছেলেটি চুপসে গেল। তিনি কাগজটি বাঁ হাতে নিয়ে তাচ্ছিল্য ভরে ফেলে রাখলেন টেবিলের এক পাশে। বললেন, চাকরি কি অত সহজ, ভাই। কোয়ালিফায়েড ছেলেরাই ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরছে। তোমাদের এই চাকরির মনোবৃত্তি ছাড়ো। চাকরি-চাকরি করেই বাঙালি জাতটা ফিনিশ হয়ে গেল। ব্যবসা ইজ দি ওনলি থিং। ছেলেটি মুখ চুন করে ফিরে গেল। সারাটা রাত সে কত স্বপ্নই না দেখেছিল। হাজার টাকার সুরে জীবন বাঁধছিল কল্পনায়। স্বপ্নের দেউল ভেঙে পড়ে গেল। ফিরে গেল রকে। ব্যবসা করো, ব্যবসা। ব্যবসা ইজ দি ওনলি থিং। ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ। একবার ইনজেকসান দেবার পরই ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়। ভদ্রলোকের মুখনি:সৃত বাণী ওই সিরিঞ্জ। প্রথম সাক্ষাতে মধু বর্ষণ করেই দ্বিতীয় ক্ষেপে ডাস্টবিন। বিদেশে এক ধরনের বাহারী কাগজের জামা পাওয়া যায়। একবার পরেই ফেলে দিতে হয়। ভদ্রলোকের ব্যবহারও ওই রকম। প্রথমে অমায়িক, পরে উদাসীন।
ভদ্রলোকের বাড়ি বছর-বছর নতুন রঙে সেজে ওঠে। পাঁচিলের মাথায় বোগেনভ্যালিয়া রঙের ফোয়ারা ছাড়ে। নতুন-নতুন ফার্নিচার আসে। কালার টিভির সহধর্মিণী ভি সি আর। একবার এটা চলে তো আর একবার ওটা। সপ্তাহে তিনদিন বাজার করেন। গোটা বাজারটাই যেন তুলে আনেন। রোজ তিন চার রকমের মাছ হয়। গর্ব করে সেকথা আবার সকলকে শোনান। চিকেন তন্দুরী ভদ্রলোকের প্রিয় খাদ্য। কোন রেস্তোরাঁর কোন খাবার সর্বোত্তম তাঁর কণ্ঠস্থ। তিনি দিশি সাবান গায়ে ঠেকান না। বিলিতি পার্ফুম ছাড়া মাখেন না। ফোম দিয়ে দাড়ি কামান। বাড়িতে একটা টেপডেক, তিনটে স্টিরিও। চারটে বিভিন্ন মাপের রেডিও। কেউ পড়ুক না পড়ুক চারখানা খবরের কাগজ আসে রোজ। প্রায় সব ম্যাগাজিন রাখা হয়।
রকের ছেলেরা দেখে ভদ্রলোকের টাপুরটুপুর ছেলে আর মেয়ে কড়া ইউনিফর্ম পরে রোজ যাচ্ছে নামী স্কুলে মানুষ হবার জন্যে। ভদ্রলোকের স্ত্রী খোঁপা বাঁধতে যান পার্ক স্ট্রিটের পারলারে। তিনি আবার মহিলা সমিতির প্রেসিডেন্ট। টাকা সংগ্রহের জন্য চ্যারিটি করে চন্ডালিকা নামান। দাতব্য চিকিৎসালয় খুলেছেন। সেখানে ফ্যামিলি প্ল্যানিং হয়। বড়-বড় বক্তা এসে নারী প্রগতির কথা বলেন, কিন্তু নিজেদের বাড়ির কাজের মেয়েরা মাস দুয়েক কোনও রকমে টিঁকে থাকার পর ‘বাপ’ ‘বাপ’ বলে ছেড়ে পালায় খিটখিট আর দুর্ব্যবহারের চোটে। সমাজসেবী ভদ্রমহিলাকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, কাজের মেয়েদের টাইট দিয়ে রাখতে হয়, নয় তো মাথায় উঠে যায়।
কেউ কখনও সাহায্য চাইতে এলে, ভদ্রলোক বলেন, খেটে খাও। খেটে খাও। ডোন্ট বি এ বেগার। সাহায্যপ্রার্থী যদি বলে কোথায় খাটব? তিনি বলেন, নিজে-নিজে খাটো। মাথার ঘাম পায়ে ফেলো। সাহায্যপ্রার্থী তখন বলবে, মারব? আপনার সামনে পাঁচ শো ডন আর হাজার বৈঠক। ডন বৈঠক ছাড়া আর তো কোনও খাটুনির পথ বাঙালির জন্যে খোলা নেই! আপনি একটা চাকরি যোগাড় করে দিন না! আপনার তো এত ইনফ্লুয়েনস।
ভাই, চাকরির আশা ছাড়। মারোয়াড়ি হবার চেষ্টা করো। ছোট দিয়ে শুরু করো, তারপর বড়, আরও বড়। তারপর আরও বড়। বিনা ক্যাপিটেলে কত ব্যবসা আছে, জানো। হিংচে আর কলমি শাকের নাম শুনেছ? নর্দমার ধারে আর জলা জায়গায় হয়। ওষুধ। পিত্তপ্রধান বাঙালি বাজারে হন্যে হয়ে খোঁজে। শুধু তোলো আর ব্যাচো। তুলবে আর বেচবে। বেচবে আর তুলবে। তারপর ধরো গেঁড়ি আর গুগলি। এদের খোলে যে জল থাকে তা চোখের মহৌষধ। ওর চেয়ে ভালো আইড্রপস আর হয় না। রোজ সকালে হাঁটতে-হাঁটতে, গান গাইতে-গাইতে শহরতলির দিকে চলে যাও। মজা পুকুর থেকে ঝুড়ি-ঝুড়ি তোলো। খোলা ছাড়ালেই ডুমো মাংস। একেবারে তৈরি মাল। চার চাকার ঠেলা গাড়ি যোগাড় করো। লাগিয়ে দাও রোল কাউন্টার—গুগলি রোল। ভদ্রলোকের ছেলে ভেতর থেকে বললে, বব, ইওর কফি ইজ গেটিং কোল্ড। বাবার ইংরেজি হয়েছে বব। এঁরা যতটা পারেন ইংরেজিতেই কথা বলেন। বাঙালি ডেড, বাঙলাভাষাও ডেড।
ইদানিং ভদ্রলোকের গাড়ি মোড়ের মাথায় এলেই ছেলেরা সিটি মারে কোরাসে। চিৎকার ছাড়ে, মাল, মাল। ভদ্রলোক মনে-মনে বলেন—রটন বেঙ্গলি।