সাত
আজীবিক মতে, চতুর্দশ লক্ষ জন্মের পরে মানুষ অনিবার্য ভাবেই মোক্ষ লাভ করে। এই রকম অচিন্তনীয় দীর্ঘায়িত জীবনব্যাপ্তি বহু জন্মান্তরের সুফলপ্রাপ্তিকে করতলগত আমলকের মতো চিরায়ত হলেও কী করে অধিগম্য থেকে দূরবর্তী বাস্তবের পরিসরের মধ্যে নিয়ে আসে? বাস্তবে, স্বয়ং চিত্রগুপ্তও এ চরিত্র নন। কাজেই এইখানে হিসেবের একটা বড় ফাঁক হয়ে গেছে। এ অংশটা অজ্ঞাত বলেই মানুষ কোনও অখণ্ডনীয় যুক্তির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হতে পারে না। ফলে এটা শুধুমাত্র কৃষ্ণের কথার ওপর নির্ভর করে মেনে নিতে হয়। অথচ সাধারণ লোককেই জন্মান্তরবাদকে বিশ্বাস করানো খুবই দরকার ছিল। কারণ, সে এ জন্মে যা করতে পারল না, পরজন্মে তা করতে পারবে, এ আশ্বাস তার পক্ষে খুবই লোভনীয়, খুবই দরকার; এর মধ্যেই নিহিত আছে তার এ জন্মের প্রভুদের তার কাছ থেকে অকুণ্ঠ সেবা পাওয়া। শূদ্রের কর্তব্য সম্বন্ধে ঋগ্বেদ থেকে মনু ও অন্য ধর্মশাস্ত্রকারদের রচনায় নানা ভাবে ও ভাষায় একই নির্দেশ দেওয়া আছে: সে উচ্চ ত্রিবর্ণের সেবা করবে— এই তার ধর্ম।
বলা বাহুল্য, সমাজে শূদ্রই সংখ্যায় বেশি ছিল এবং মনু থেকে সকল ধর্মশাস্ত্রকারই বলেছেন, শূদ্রের একমাত্র কর্তব্য হল উচ্চ ত্রিবর্ণের সেবা। এই সেবা পারিবারিক ভৃত্য হিসেবে, পরিবারের খেতমজুর হিসেবে এবং কারখানার শ্রমিক হিসেবে ছোট বা নীচের দিকের কর্মকর হিসেবে। অর্থাৎ চাষি, তাঁতি, কামার, ধোপা, ছুতোর, ডোম, চণ্ডাল প্রভৃতি নানা বৃত্তিতে নিযুক্ত মানুষগুলি। এরাই সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং সেই জন্যেই কৃষ্ণ যখন এই কর্মকরদের বলেন, ‘কর্মেই তোমাদের অধিকার, ফলে কখনও নয়,’ তখন কথা আসে, তা হলে ফলে কার অধিকার? স্পষ্টতই বোঝা যায় অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত, ধনী এবং উচ্চবর্ণের উচ্চপদস্থ মানুষেরই সে অধিকার। এই বিভাজনের ফলে শূদ্রের যে দ্রুত এবং অনিবার্য অবনমন ঘটছিল এমন ভাবে যে, আনুপাতিক ভাবে উচ্চতর শ্রেণির সেই পরিমাণে ঊর্ধ্বগতি ঘটছিল। দু’তরফের মধ্যে ব্যবধানটা দুর্লঙ্ঘ্য হচ্ছিল। তাই বেদপাঠ করলে শূদ্রের জিভ কেটে ফেলা হয়, বেদ শুনলে কানে গলিত সিসা ঢেলে দেওয়া হয়। এই ত্রিবর্ণের পদানত শূদ্র ক্রমেই সামাজিক অবস্থানে তলিয়ে যাচ্ছিল এবং এই প্রক্রিয়ায় গীতার অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গীতা সেই কথাটা আরও স্পষ্ট ও নির্মম ভাবে বলেছে। শূদ্র যেন মানুষই নয়, তার চেয়ে নিচু শ্রেণির জীব। এতে উচ্চ ত্রিবর্ণের লাভ: প্রায় বিনামূল্যে অথবা অল্পমূল্যে, বলতে গেলে পেট ভাতায় কাজ করে দেবার লোক শাস্ত্রসম্মত ভাবে পাওয়া যায়; তাকে দিয়ে যা খুশি করানো যায়। শূদ্রের কোনও প্রতিবাদ করার অধিকার নেই। সে উচ্চ তিন বর্ণের যথাযথ সেবা করলে পরজন্মে আরও ভাল থাকবে। গীতার এই বর্ণাধম শূদ্র, সমাজে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা যেহেতু পরজন্মে উন্নতির সম্ভাবনা জেনে এ জন্মের দৈন্য, অত্যাচার অপমান বিনা প্রতিবাদে সহ্য করে তাই তাদের জন্যে জন্মান্তরকরণ সম্পূর্ণ অপরিহার্য।
গীতার ওপরে গান্ধীজি এক জায়গায় বলেছেন, ‘[এদেশের] মানুষের অজ্ঞান, অতল বিশ্বাস করবার অপরিসীম ক্ষমতা, আত্মপ্রবঞ্চনার প্রবণতা বিস্ময়কর এবং সহিষ্ণুতার ধৈর্য অনন্ত।’[১৫] এ সব ছিল বলেই কর্মেই শুধু তাদের অধিকার, ফলের অধিকার স্বভাবতই উচ্চবর্ণের ধনীদের। কৃষ্ণ বহু অসমানকে সমান করে দেবেন এমন একটা প্রতিশ্রুতি ইতস্তত করেছেন। এতে সমাজে নারীর চরিত্র ও অবস্থান নিয়ে একটা স্পষ্ট মত দেখা যাচ্ছে। সেটা হল, যারা সমাজে নিচু স্তরের— নারী, বৈশ্য, শূদ্র— তারাও আমাকে আশ্রয় করলে পরম গতি প্রাপ্ত হয়। (৯:৩২)
[১৫. Discourses on the Gita, Ahmedabad, 1960]
একটি লক্ষণীয় বিষয় হল, এদের সকলেকেই পাপযোনি বলা হচ্ছে, এবং এ তালিকার শুরুতেই আছে নারী। শূদ্র এবং সমাজের প্রত্যন্তবাসীরা তো চিরকালই নিম্নতম স্তরের জীব ছিল, নতুনের মধ্যে বৈশ্য এখন সে তালিকায় দ্বিতীয় স্থান পেল। দ্বিতীয়ত, পাপযোনির অর্থ পাপ থেকে উদ্ভূতও হয়, এবং অশুচি যোনির অধিকারীও হয়। আর যারা অশুচিযোনিবিশিষ্ট, তারাও হয়। বলা বাহুল্য, দুই-ই সমাজের চোখে অস্পৃশ্যবৎ ঘৃণ্য হয়। অর্থাৎ সমাজ এদের পদনখ দ্বারা স্পর্শ করবে, মানুষের পাশে স্থান কখনও দেবে না। দুই কারণেও এরা অশুদ্ধ এবং উত্তম গতির অযোগ্য হয়। যেহেতু এ তালিকা শুরু হচ্ছে নারী দিয়ে তাই মনে হয় নারীই এই পাপযোনিদের মধ্যে প্রথম স্থানের অধিকারিণী। এরা কৃষ্ণকে আশ্রয় করলে সদগতি প্রাপ্ত হয়। এখানে নারী সম্বন্ধে সমাজের মনোভাব বেশ স্পষ্ট ভাবেই উল্লিখিত: যে পাপযোনি এবং পাপযোনিদের মধ্যে অগ্রণী। অথচ মহাভারতে বহু উত্তম পুণ্যবতী নারীর কথা বলা আছে। তবুও এখানে প্রথমেই নারীকে পাপযোনিদের মধ্যে অগ্রণী দেখানো হল কেন? পরে এ বিষয়ে আলোচনা করব। আপাতত দেখে রাখলাম যে, নারী পাপীদের মধ্যে অগ্রগণ্যা এবং কৃষ্ণকে আশ্রয় করা ভিন্ন তার উন্নতির আর গত্যন্তর নেই। ভুললে চলবে না যে, নারী সমাজের জনসমষ্টির অর্ধেক, সেই অর্ধেক সংখ্যক নারী পাপিষ্ঠা তালিকায় অগ্রগণ্য। সেই পাপিষ্ঠা কেবলমাত্র কৃষ্ণকে আশ্রয় করে ‘তরে’ যেতে পারে। এতে কৃষ্ণের মহত্ত্ব যতটা প্রতীত হল, নারীর পাপাত্মা সত্তা ততটাই নিশ্চিত বোঝা গেল। এটা গীতা নিঃসংকোচে বলেছে এবং কোথাও এর বিপরীত কোনও কথা বলেনি। তাই গীতায় নারীর স্থান শূদ্রের মতোই নিচু এবং পাপিষ্ঠ। প্রতিকার একমাত্র কৃষ্ণের শরণাগত হওয়া।
পাপযোনির মধ্যে শূদ্রের স্থান ওপরের দিকেই, এবং সেটা কৃষ্ণের উদ্ভাবন নয়, বেদের সময় থেকেই তা প্রতিষ্ঠিত ছিল। এখানে লক্ষণীয় যে, শূদ্র সমাজে পুরুষদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এবং এদের কৃষ্ণ পাপযোনি বললেন। একমাত্র কারণ এরা নিম্নবর্ণের।
শূদ্রের প্রসঙ্গে ঠিক নয়, কিন্তু কৃষ্ণ অন্যত্র বলেছেন, ‘চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম বিভাগশ্চ।’ ভারতবর্ষের ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, ঋগ্বেদ থেকেই আমরা চারটি বর্ণের নাম পাই। কেউ এদের সৃষ্টি করেছেন, এমন কথা সেখানে বা অন্যত্র কোথাও নেই। কারণ, সমাজে বিবর্তনের ফলে নিতান্ত স্বভাবিক ভাবেই কর্মবিভাগ (গুণ কোথাও স্পষ্টত উল্লেখিত হয়নি) অনুসারে বর্ণবিভাগ হয়েছিল। প্রথম দিকে সব সময়ে চারটি বর্ণের কথা নেই। তাদের কর্মও খুব সুনির্দিষ্ট ভাবে পৃথক ছিল না। এবং পরস্পরের মধ্যে স্বেচ্ছাসঞ্চরণও হত। অর্থাৎ বর্ণগুলি তখনও কঠোর ভাবে অনমনীয় হয়ে ওঠেনি। অবশ্য, ব্রহ্ম সম্বন্ধে ঋগ্বেদের শেষের দিকের একটি সূক্তে বলা হয়েছে, ‘তাঁর মুখ [হল] ব্রাহ্মণ, [তাঁর] বাহু ক্ষত্রিয়, উরু বৈশ্য এবং পা দুটি হল শূদ্র।’ এখানে চারটি বর্ণকেই ব্রহ্মার শরীরের চারটি অংশ বলা হয়েছে। তা হলে বৈশ্য ও শূদ্র কী করে পাপযোনি হতে পারে? এরা দু’জনেই তো ব্রহ্মার শরীরের বিভিন্ন অংশবিশেষ এবং দেখা যাচ্ছে ব্রাহ্মণের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গেই আনুপাতিক ভাবে প্রথমে শূদ্রের এবং পরে বৈশ্যের সামাজিক অবনমন ঘটছে। একটা কারণ সম্ভবত বেদপরবর্তী কালে বৈশ্য, কৃষি ও পশুপালক হওয়ার দ্বারা এবং অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের দ্বারা বেশ কিছু বিত্তের অধিকারী হতে থাকে এবং কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই বণিক হয়। এখন কোনও সাম্রাজ্যের বা রাজার সাধ্য নেই বণিককে অবহেলা করার। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকেই সমাজে বৈশ্যের অভ্যুত্থান ও সম্মানের আসন উন্নত হতে থাকে। জাতকগুলি এবং অন্যান্য বহু বৌদ্ধ গ্রন্থে বৈশ্যকে রাজার প্রসাদপুষ্ট এবং সম্মানিত শ্রেণিতে উন্নীত হতে দেখতে পাই। কৃষ্ণের ভাষায় এটা সেই বৈশ্য, যে পাপযোনি। একটা কারণ হতে পারে, অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যে লব্ধ ধন বৈশ্যকে সম্মানে এবং শক্তিতে রাজার সহায়ক সম্মানভাজন স্থান দিয়েছিল। ক্ষত্রিয় রাজা ও তাঁর প্রধান সহায়ক ব্রাহ্মণ— বৈশ্যকে প্রতিদ্বন্দ্বী বলে দেখতে শুরু করে। ধর্মীয় ভাষায় তাকে গালাগালি করতে গেলে পাপযোনি বলা সহজ। কৃষ্ণ যে কথা বলছেন, ঐতিহাসিক ভাবে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ, কেউ কোনও সময়ে বর্ণগুলি নির্মাণ করেনি। সমাজের গতিপ্রকৃতি অনুসারে তা স্বভাবিক ভাবেই নির্ণীত হয়েছিল। বর্ণগুলি পরস্পরের মধ্যে সঞ্চরমানও ছিল, অর্থাৎ একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্য বিভিন্ন বৃত্তিতে নিযুক্ত ছিল। এমন অবস্থার কথা কৃষ্ণের না জানার কথাই ওঠে না। তাই তাঁর দাবিটা এমন অযৌক্তিক। এর স্বপক্ষে বলা যেতে পারে, কৃষ্ণ নিজেকে ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম ভাবছেন এবং সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার ভূমিকায় নিজেকে স্থাপন করে তিনি এক অবিসংবাদিত ভূমিকায় নিজেকে স্থাপন করলেন। কারণ, গীতাকার যিনিই হোন না কেন, গীতা রচনায় তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, গীতার কৃষ্ণকে অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ স্থানে উপস্থাপিত করা।
আগেই বলেছি, গীতার খ্যাতির একটি বিশেষ সূত্র হল একটি সর্বজনপ্ৰিয় শ্লোক: ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। মা কর্মফলহেতুভূমাতে সঙ্গো্যত্বককর্মণি।’ (২:৪৭) কর্মেই শুধু তোমার অধিকার, ফলে কখনওই নয়। কর্মফলের হেতু কখনও হয়ো না, (তা বলে) অকর্মেও আসক্ত হয়ো না। এর প্রথমাংশটা সকলের মুখে মুখে ফেরে এবং প্রায় সকলেই মনে করেন এর অর্থ হল মানুষকে নিষ্কাম কর্মে প্রবৃত্ত করা ও উৎসাহ দেওয়া। কিন্তু একটু বিশ্লেষণ করে দেখলে বোঝা যায়, এর মধ্যে অন্য কথাও আছে। সাধারণ মানুষ কাজ করুক ফলের আশা না করে, শুধু কাজের জন্যই কাজ করুক। দার্শনিক কাণ্ট যেমন বলেছেন, কর্মের মূল্য আসে তার প্রণোদনা থেকে, তার ফল থেকে নয়।’[১৬] এ ভাবে দেখলে নিষ্কাম কর্ম করার প্রণোদনটা বোঝা না গেলেও সেইটেই যে কৃষ্ণের অনুমোদিত তা বোঝা যায়। এমন নয় যে, কৃষ্ণ কর্মে উৎসাহ দিচ্ছেন এবং ফল সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ। কর্ম থাকলে তার ফলও থাকবেই। কিন্তু কৃষ্ণ খুব সচেতন ভাবেই বলেন, সেই ফল কখনওই সেই ব্যক্তি পাবে না, যে কর্মটি করেছে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে কর্ম শ্রমিকের কর্তব্য, ফল ধনিকের লভ্য। কর্মফলের হেতুও সে হবে না এবং অকর্মেও তার যেন প্রবৃত্তি না হয়।
[১৬. ‘Merit of an action devices from its motive and not from its effect.’]
আগেই যেমন কিছুটা আলোচনা করেছি, এর পরও তো একটা কথা থেকে যায়: কর্মফলটার কী হবে? যে কাজ করবে, সে ফল ভোগ করবে না কখনও? কিন্তু কর্মফলটা তো থেকে যাবে। স্পষ্ট বোঝা যায়, এই ফলটা সমাজের উচ্চ, ধনী, শিক্ষিত শ্রেণির মানুষ ভোগ করবে। আজও সমাজে এই বিভাজন প্রচলিত শ্রমিক, কৃষক, মজদুর, কাজই নিরন্তর করবে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পেটভাতায়); তার কর্মের থেকে যে ফল উদ্গত হবে, তাতে, তার কোনও অধিকার নেই।
প্রথম না হোক, দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে দশম অধ্যায় পর্যন্ত গীতার গঠন হল বিষয় অনুসারে সাজানো যুক্তিপরম্পরা— কৃষ্ণের বয়ানে। কদাচিৎ অর্জুন কথা বলেছেন, সেটা যতটা প্রতিবাদ বা খণ্ডন, তার চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণে কৃষ্ণের উক্তির ব্যাখ্যা চাওয়া। এই ভাবেই চলেছে দশটি অধ্যায় পর্যন্ত এবং এ পর্যন্ত অর্জুনকে ক্ষাত্রধর্ম অনুযায়ী কর্ম, অর্থাৎ যুদ্ধ— যে যুদ্ধে স্বজনহত্যা ঘটবে— তাতে অর্জুনের অমত অব্যাহত থেকেছে। কখনও বা দীর্ঘ যুক্তির ভিত্তি হল, কোনও একটি দর্শনপ্রস্থানের বিস্তৃত ব্যাখ্যা। এটা গ্রন্থের মূল বিবক্ষিতকে একটুও অগ্রসর করেনি। অনেকটা যেন কোনও কোনও দর্শনপ্রস্থানকে নতুন বা প্রাচীন যুক্তির ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠিত করা। সেটা যতটা সার্থক ভাবেই নিষ্পন্ন হোক না কেন, গীতায় কৃষ্ণের মূল অভিপ্রায় একটুও যুক্তি বা জোর পায়নি। ফলে ওই দশ অধ্যায়ে আর যাই হোক, কৃষ্ণের অভিপ্রায় সিদ্ধি একটুও এগোয়নি। যা হয়েছে তা হল, তৎকালীন সমাজের বিশেষত বিদ্বমহলে যে দর্শন প্রস্থানগুলি প্রচলিত অর্থাৎ আলোচনায় প্রতিষ্ঠিত বা খণ্ডিত হচ্ছিল সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রক্রিয়া গোছের একটা কিছু। এর দ্বারা গীতায় উদ্দেশ্য একটুও প্রতিষ্ঠা পায়নি।
পায়নি বলেই একাদশ অধ্যায়ে ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন উপায়ে কৃষ্ণ অর্জুনের আপত্তি নস্যাৎ করতে প্রবৃত্ত হলেন। এ আঙ্গিক গীতার মৌলিক বক্তব্যের অনুকূলে হলেও যুক্তিতর্ক খণ্ডন-মণ্ডন, বাদবিতণ্ডা যা এতক্ষণ ধরে গীতার মূল আঙ্গিক ছিল, তা থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে ভিন্ন এক দার্শনিক অসদুপায়ের আশ্রয় নিলেন কৃষ্ণ। যে কৃষ্ণ এতাবৎ অর্জুনকে বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়ে স্বমতে অর্থাৎ ক্ষত্রিয়ের ধর্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন, একাদশ অধ্যায়ে সহসা সে পন্থা পরিত্যাগ করে জাদুবিদ্যা কলাকৌশল অবলম্বন করলেন। এটা যুক্তিবাদীর পক্ষে গর্হিত মনে হওয়াই উচিত যে, যে পরমেশ্বর অর্জুনকে স্ববশে আনবেন সদযুক্তি প্রয়োগের দ্বারা তাঁর পক্ষে এটা একটা নিচু স্তরের প্রচেষ্টা বা উপায়। কিন্তু গরজ বড় বালাই, তাই কৃষ্ণ কিছুমাত্র ইতস্তত না করে এই অযৌক্তিক পন্থা অবলম্বন করলেন। ফলও ফলল, কিন্তু কৃত্য-মানের দিক থেকে গীতা যেন আমাদের চোখে অনেক নেমে গেল। কৃষ্ণের উদ্দেশ্য সাধনের মধ্যে তাঁর আত্মসম্মানও যেন কতকটা নেমে গেল। কিন্তু তিনি গোড়া থেকেই একনিষ্ঠ ভাবে অর্জুনের সারথ্য গ্রহণ করেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যস্থলে। এতক্ষণে ছলে বলে কৌশলে তা সিদ্ধ হল। এর আগে পর্যন্ত কোনও একটি মত প্রধান ও নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠেনি, যুক্তির পরম্পরা ব্যাহত হয়েছে, ফলে এ অংশটি নির্দিষ্ট কোনও মতে পৌঁছতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে এল বিশ্বরূপদর্শন।[১৭]
[১৭. বাইবেলে যিশুও শিষ্যদের সামনে রূপান্তরিত হন, কিন্তু তাতে কোনও নতুন মাত্রা যোগ হয়নি, যিশুর দৈব আয়তনে কোনও নতুন ইষ্ট সিদ্ধ হয়নি, কারণ, শিষ্যরা আগে থেকে তাঁর ঈশ্বরতনয়ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন।]