দুই
সাধারণ ভাবে ধর্ম বলে কোনও কিছুর কথা কৃষ্ণ তেমন স্পষ্ট করে বলেননি, যদিও গীতা হয়তো ভারতের প্রধানতম ধর্মগ্রন্থ। তবু একবার বললেন, এই (নিষ্কাম) ধর্মের অল্প অংশও মহাভয় থেকে পরিত্রাণ করে। (২:৪০) সবটাই একটু রহস্যময়: মহাভয় কী? মৃত্যু না পুনর্জন্ম তথা পুনমৃত্যুর ভয়, না অনন্ত নরকবাসের ভয়, না পাপযোনিতে, দীনদরিদ্র, মূর্খ ও ধর্মবোধ বিরহিত বংশে জন্ম, না জন্মের পর দৈন্য, মূর্খতা, ব্যাধি ইত্যাদি দ্বারা আত্মার ওপর দূরপনেয় আবরণ— যার দ্বারা চিত্তবৃত্তি এমন আচ্ছন্ন হয় যে, পুণ্যকর্ম করবার প্রবৃত্তিও থাকে না, সামর্থ্যও থাকে না। প্রেতযোনির কথা গীতা খুব স্পষ্ট করে কিছু না বললেও, সেটা প্রচ্ছন্ন ভাবে সমাজমানসে বিদ্যমান ছিল এবং সে-ও একটি ভয়ের অবস্থা। তার থেকে ত্রাণ করবে কোন ধর্ম? অতএব যোগযুক্ত হয়ে থাকো; যোগ হল কর্মে কৌশল (বা কুশলতা)। (২:৫০) যোগের এই ধরনের ব্যাখ্যা যোগশাস্ত্রেও খানিকটা আছে। এ যোগ ধর্মনিরপেক্ষ কর্মনিষ্ঠা ও কুশলতা। হঠাৎ শুনি, যার ইন্দ্রিয়গুলি নিজের বশে তারই প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত। (২:৬১) অর্থাৎ প্রজ্ঞা নির্ভর করে ইন্দ্রিয়সংযমের ওপর। ‘পর্বত প্রমাণ যার তরঙ্গের উচ্চতা, যেখানে অনবরত জল এসে প্রবেশ করছে। সেইভাবে যার চিত্তে সমস্ত কামনা এসে প্রবেশ করে সেই শান্তি পায়; যে কামনায় নির্বিষ্টচিত্ত সে [সেই শান্তি] পায় না।’ (২:৭০) অর্থাৎ পূর্ণ সমুদ্রে যেমন বাইরে থেকে আসা জল আর প্রবেশপথ পায় না তেমনি সংযতেন্দ্রিয় মানুষের মনে কোনও কামনা প্রবেশ করতে পারে না। কামনা আসে ইন্দ্রিয়ের পথেই, কামনা মানুষের মনে প্রবেশ করে; সে পথ রুদ্ধ করতে হবে ইন্দ্রিয়গুলিকে স্ববশে সংযত রেখে। বলা বাহুল্য, তখন সব ক’টি দর্শনপ্রস্থানই ইন্দ্রিয় সংযমের কথা বলেছে। এমনকী, বৌদ্ধ, জৈন আজীবিক, সকল মতেই এর প্রয়োজন আছে বলা হয়।
গীতার মূল রচয়িতা যদি একজন হন তবু এতে কিছু কিছু প্রক্ষেপ তো আছেই। কিন্তু মূল ও প্রক্ষেপ মিলিয়ে যে গীতা তা অচিরেই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয় এবং প্রায় পুরো আর্যাবর্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে দাক্ষিণাত্যে প্রসারিত হয়। তার কিছু পর থেকেই দেখি নানা রকমের গীতা রচিত হতে থাকে, মহাভারতের ইতস্তত এবং বাইরেও কোনও প্রসঙ্গ ধরে নিবন্ধ রচিত হয় এবং গীতা নামে বিখ্যাত হতে থাকে। এমনি করে আমরা ষোড়শ গীতার সন্ধান পাই। এগুলি হল: বৃত্র, বিচক্ষু (বা পাঠান্তরে বিচক্কু), শম্পাক, হারীত, বোধ্য, শ্রীসপ্তশ্লোকী, মল্কি, হংস, পরাশর, ষড়জ্, অনুগীতা (২), ব্রহ্মগীতা (ভগবদ্গীতা), গীতাসার, অগস্ত্য, পার্বতী, শাত্তি, ব্যাদ, ভীম, গর্ভ, পাণ্ডব, অবধূত, উত্তরগীতা।
বলা বাহুল্য, মূল গীতা রচনার পরে এগুলি রচনার একটা কারণ, ভগবদ্গীতার দ্রুত বিস্তার ও জনপ্রিয়তা। অনেক কম শক্তিমান লেখকের মনে হয়েছিল প্রসিদ্ধি, খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা পাবার একটা উপায় হল গীতা রচনা। মূল গীতার সঙ্গে ভাবে বা বক্তব্যে এগুলির মিল নেই; মিল শুধু ওই নামে। এটা উপনিষদ পুরাণের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। মূল উপনিষদ দশটি বা বারোটি। কিন্তু অনুকরণে অনুসরণে শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় একশো আটটি। তেমনই মূল পুরাণ আঠারোটি। কিন্তু অনুকরণে উপপুরাণ আরও আঠারোটি। গীতার ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যাপার ঘটে। এই পরবর্তী গীতাগুলি সুপাঠ্যও নয়, বক্তব্যেও অধিকাংশেরই কোনও বৈচিত্র্য বা বৈশিষ্ট্য নেই। এগুলি শুধু প্রমাণ করে ভগবদ্গীতার প্রসার ও বিপুল জনপ্রিয়তা। টি এস রুকমনি বলেন, ‘গীতা একটি বহুস্তরের রচনা। এর উদ্দেশ্য কোনও একটি চিন্তাধারার বিশ্লেষণের দ্বারা একটি সুসংহত চিন্তার রূপকল্প নির্মাণ করা নয়।[৬] গীতায় নানা বিভিন্ন দর্শনপ্রস্থানের সহাবস্থান আছে। প্রায় সব পাঠকই তাঁর প্রিয় দর্শন খুঁজে পান গীতায়; ফলে গীতায় কোনও একটি সুচিন্তিত নির্দিষ্ট দর্শন পাওয়া যায় না। বরং নানা মতের একত্র সমাবেশে নির্মিত একটি বহুস্তরিক মতগুচ্ছ পাওয়া যায়। ফলে বৃহৎ এক জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন মতবাদ এতে পাওয়া যায় বলে এর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।
[৬. Journal of Studies in Ancient India. Vol (1), 1994 p. 22]
কৃষ্ণ যখন ধর্মের কথা বলেন, তখন কোন বিষয় তাঁর অভিপ্রেত বা বিবক্ষিত, তা সম্যক বোঝা যায় না। কিন্তু তিনি বলেন, ‘স্বধর্ম যদি বিগুণ [বা গুণবিচ্যুত] হয় তবে তাও যথাযথ অনুষ্ঠিত হলে পরধর্ম থেকে শ্রেয়। স্বধর্মে নিধন [মরণ] ও ভাল, [কিন্তু] পরধর্ম ভয়াবহ।’ (৩:৩৫) এখানে স্বধর্ম এবং পরধর্ম বলতে কী বোঝায় তা স্পষ্ট নয়; কিন্তু এই অংশের আকার হল যুদ্ধে ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করতে গেলে যদি আত্মীয়স্বজনকে হত্যা করতেও হয় তা হলে সু-অনুষ্ঠিত পরধর্মের চেয়ে তাও ভাল। এবার যুগটা স্মরণ করলে হয়তো কিছুটা অর্থ স্পষ্ট হয়। কুষাণ যুগে রচিত গীতার চারপাশের সমাজে তখন বৌদ্ধ প্রভাব বেশ স্পষ্ট। ধর্ম সেখানে মানবিকতা— অহিংসা, মৈত্রী, করুণা। আর কৃষ্ণ বলছেন শ্রেণিধর্মের কথা। ক্ষত্রিয় শ্রেণির ধর্ম হল, আতত্রাণ, শত্রুপক্ষকে আঘাতে নিহত করা। দয়াদাক্ষিণ্যের জায়গা ক্ষাত্রধর্মে নেই। তাই কৃষ্ণ যখন বলেন, নিজের ধর্ম (শ্রেণি) থেকে সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটলেও তা অন্য ধর্ম থেকে শ্রেয় তখন অন্য পরধর্ম হয়তো বা বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক যারা দয়া, মৈত্রীর প্রবক্তা। কাজেই শ্রেণিবিভক্ত ব্রাহ্মণ্যসমাজের নির্ধারিত যে কর্তব্য বা মানবিক বা নৈতিক গুণের প্রবক্তা যে পরধর্ম— যদি তা খুব ভাল ভাবেও অনুষ্ঠিত হয় তা হলেও। অপ্রত্যক্ষ ভাবে এর দ্বারা ক্ষত্রিয়ধর্মোচিত কর্তব্য আত্মীয়হনন থেকে বিচ্যুত না হওয়ার উপদেশ। অর্থাৎ যুদ্ধে বিমুখ অর্জুনকে ক্ষাত্রধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝিয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করার চেষ্টা। এমনকী মৈত্রী করুণাবাদী পরধর্মকে ভয়াবহ বলা হয়েছে, কিন্তু কোনও কারণ না দেখিয়েই।
তার একটু পরেই সেই বিখ্যাত শ্লোকটি, ‘যখন যখন ধর্মের গ্লানি জন্মায়, হে অর্জুন, অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন; তখন আমি নিজেকে সৃষ্টি করি, সাধুদের পরিত্রাণের জন্য দূরাচারদের বিনাশের জন্য; ধর্মকে সুষ্ঠুভাকে সংস্থাপন করবার জন্যে যুগে যুগে আমি আবির্ভূত হই।’ (৪:৭-৮)
ধর্ম সম্বন্ধে কৃষ্ণ কোনও সংজ্ঞা নিরূপণ করেননি তবু বলেছেন, স্বধর্ম ভাল। (৩:৩৪ ) এই স্বধর্ম কী? বর্তমান প্রসঙ্গে ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধই স্বধর্ম। তা হলে পরধর্ম কী? বর্ণধর্মের বাইরে যে ধর্ম, তাই। সেই কুষাণযুগে সমাজে ব্রাহ্মণ্যধর্ম— যাতে বর্ণধর্ম প্রাধান্য পেত— তা ছাড়াও বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক এগুলিও ছিল যাতে বর্ণ ধর্ম বলে কিছু ছিল না (অর্থাৎ যে সব ধর্মে যুদ্ধেও ক্ষত্রিয়ের পক্ষে যুদ্ধ করা বাধ্যতামূলক ছিল না)। সে সময়ে সমাজে ধর্মবোধ নানা রকমের ছিল। নির্দিষ্ট একটাই যে ছিল তা তো নয়। নানা দেশ থেকে নানা ধর্ম এবং ভারতবর্ষেও নানা ধর্মবোধের উৎপত্তি ও বিকাশ ও সংঘাত হচ্ছিল। সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তি তাতে বাড়ছিল। এই সময়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিশেষ প্রয়োজন ছিল অন্য সব মতের বিরুদ্ধে একটি মতকেই অভ্রান্ত বলে প্রতিষ্ঠিত করে অন্যগুলিকে ভ্রান্ত বলে অস্বীকার করা। এই ধরনের শ্লোকে সে কাজটি সুষ্ঠু সম্পাদিত হচ্ছিল।
বক্তা কৃষ্ণ, তাঁকেও অভ্রান্ত একমাত্র সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন ছিল। এই শ্লোকের পরিপ্রেক্ষিতে মনে পড়ে, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিখ্যাত ‘কৃষ্ণচরিত্র’ প্রবন্ধে কৃষ্ণকে সম্পূর্ণ মানুষ বলেই উল্লেখ করেছেন। ‘কৃষ্ণের যে বৃত্তান্তটুকু মৌলিক তাহার ভিতর অতিপ্রাকৃতের কোনো সহায়তা নাই।’ একাদশ অধ্যায়ে যে কৃষ্ণ, ‘তাহার সবটাই অতিলৌকিক অতএব এ কৃষ্ণ মৌলিক নয়, প্রক্ষিপ্ত। মহাভারতের কৃষ্ণ মানব এবং এই কৃষ্ণেরই অতিশয়িত স্তোত্র আছে শান্তিপর্বে, স্তোতা স্বয়ং ভীষ্ম।’ বঙ্কিমচন্দ্র এ প্রসঙ্গে অনেকটাই আধুনিক বৈজ্ঞানিক মতবাদের পুনরুক্তি করেন: ‘গীতা কৃষ্ণের ধর্মমতের সংকলন ইহাই আমার বিশ্বাস।’
গীতার নানা শ্লোকে নানা ভাবে সে কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ও পরিচিত হল: অর্জুন, যখনই ধর্মে গ্লানি [ক্লান্তি বা মালিন্য] দেখা দেয় এবং অধর্ম মাথা তোলে, তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করে [মনুষ্যমূর্তি ধারণ করে] পৃথিবীতে অবতীর্ণ হই। কেন? ‘সাধুদের পরিত্রাণের জন্য, দুষ্কৃতীদের বিনাশের জন্য এবং ধর্মকে ভাল ভাবে সংস্থাপন করবার জন্য তখন আমি আবির্ভূত হই। যুগে যুগে, বারে বারে।’ (৪:৭,৮)
অর্থাৎ মাঝে মাঝেই কৃষ্ণকেন্দ্রিক ধর্ম ম্লান হয়, অবহেলিত হয়। তখন অন্যান্য বিধৰ্ম বা অধর্মের বিকাশ হয়, সেই সময় কৃষ্ণ আবির্ভূত হন স্বরূপে। স্বকর্মে নিযুক্ত হন যাতে ভার্গবধারার ব্রাহ্মণ্যধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যজ্ঞকেন্দ্রিক, বেদনিষ্ঠ ধর্ম— বিশেষত কৃষ্ণকেন্দ্ৰিক ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। সরদেশাইয়ের মতে, ‘গীতা ভারতবর্ষের পশ্চান্মুখিতার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আদর্শিক অস্ত্র যা… কুসংস্কার ও নিয়তিবাদী ও রহস্যবাদী ধারণা এমনকি সাম্প্রদায়িক অবস্থানেরও সূচীমুখ।’ কিন্তু সমাজে বহু ধারার উপাসনা প্রচলিত ছিল, সে সবই কি ভ্রান্ত? কৃষ্ণ বলেন, যে যেভাবে আমাকে উপাসনা করে তাকে আমি সে ভাবেই ভজনা করি। (৪:১১) কিন্তু সকলে তো কৃষ্ণকে উপাসনা করে না? তাই বলতে হল, যে যেভাবে আমার উপাসনা করে আমি তাকে সেই ভাবেই ভজনা করি। এই কথার অর্থ হল, সব উপাসনাই প্রকারান্তরে কৃষ্ণ উপাসনা; প্রতিষ্ঠিত হল কৃষ্ণের প্রাথম্য, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। এর বিশেষ প্রয়োজন ছিল, পরে সে কথায় আসছি।
কিছু পরে সহসা কৃষ্ণ বলেন, গুণ, কর্মবিভাগ অনুসারে চারটি বর্ণ আমি সৃষ্টি করেছি। (৪:১৩) এতে কিছু অযথা জটিলতা আছে। প্রথমত শাস্ত্র মতে সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন ব্ৰহ্মা- বিষ্ণু বা কৃষ্ণ নয়। বেদের প্রথম দিকে চতুবর্ণ নেই এবং যা আছে তাও সঞ্চরণশীল অর্থাৎ এক বর্ণ থেকে অন্য বর্ণে চলে যাওয়া যেত। এবং এ বর্ণবিভাজনে কোন যুগ থেকে যে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ প্রাধান্য পেয়ে এসেছেন তাও ঠিক জানা যায় না। শুধু এটুকু নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে, ব্রাহ্মণই সকলের উপরে অধিষ্ঠিত। কোসম্বী বলেন, ‘চতুর্থ শতকের শিলালিপিগুলিতে ব্রাহ্মণ্য প্রভাবের প্রাধান্য বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়।’[৭] এই ব্রাহ্মণ্যপ্ৰাধান্য যখন সমাজে অবিসংবাদিত ভাবে প্রতিষ্ঠিত তখন, বেদের যুগে চারবর্ণের মধ্যে কতকটা সঞ্চরণশীলতা থাকলেও কিছুকালের মধ্যেই এগুলি পরস্পর অসম্পৃক্ত চারটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায়। এর মধ্যে কৃষ্ণের কোনও অবদানই ছিল না। ঐতিহাসিককৃষ্ণ বহু পরবর্তী কালের মানুষ, এমনকী মহাভারতের তথা ভগবদ্গীতার কৃষ্ণ পৌরাণিক যুগের মানুষ। তাঁর পক্ষে চাতুর্বর্ণ সৃষ্টি করা দূরে থাক, বর্ণবিভক্ত সমাজে বর্ণ সম্বন্ধে হস্তক্ষেপ করারও কোনও অবকাশ ছিল না। নিজেকে অনাদি অনন্ত ব্রহ্মের প্রকাশরূপ প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই প্রাচীনতম, এবং বর্ণ বিভাজনের কর্তা হিসেবে উপস্থাপিত করবার এই প্রয়োজন বা বাসনা।
[৭. ‘From the 4th Century memory insciptions showing a marked rise in Brahmin influence.’ Myth and Reality, Popular Prakasan, Bombay, 1952]
গুণ অনুসারে বিভাগ কোনও দিনই ছিল না। কর্ম অনুসারে বিভাগই মোটামুটি ছিল। এবং সে বিভাজনের সঙ্গে কৃষ্ণের কোনও যোগও ছিল না। এ সেই ধরনের শ্লোক যাতে কৃষ্ণকে প্রাধান্য বা শ্রেষ্ঠত্ব দেবার জন্য নতুন শ্লোক দিয়ে তা প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। বর্ণ বিভাজন ইতিহাসে যে স্তরে প্রতিফলিত, সেখানে কোথায় কৃষ্ণ? আর এ কোন কৃষ্ণ? বৃন্দাবনের রাজপুত্র, না গোষ্ঠের গোপবালকদের দলনেতা, না পাণ্ডবরাজপুত্র অর্জুনের সখা ও যুদ্ধকালে তাঁর সারথি? এঁদের মধ্যে কারওরই বর্ণবিভাজনের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। থাকার কথাও নয়, কারণ বর্ণগুলিকে সৃষ্টি করে সমাজ নিজের প্রয়োজন অনুসারে এবং প্রয়োজনমতো পরিবর্তন এবং পরস্পরের সংবেদনে নূতন বর্ণ বা পরবর্তী কালে জাতি সৃষ্টি করে। যদিও এখানে এটি মুখ্য আলোচ্য বিষয় নয়, তবু মনে রাখা ভাল যে, যে চারটি বর্ণ থেকে কয়েকশো জাতি উপজাতিতে বৃহৎ, একটি জটিল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে তার মূলে বৈদেশিক জনগোষ্ঠীর আগমন ও উত্তর ভারতের সমাজে নানা ভাবে মিশ্রিত হওয়া এবং অন্তর্বিবাহ জাতীয় বিবাহ ঠিক শাস্ত্রসম্মত ছিল না, কিন্তু ঘটবার পরে নানা নামে সমাজ এদের স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। এ ছাড়াও সমাজে কর্মশালায় নানা বৃত্তির উদ্ভব হওয়ায় ভিন্ন ভিন্ন নামেও সেগুলি সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ সব ঘটেছে কয়েক শতাব্দী ধরে। তখন কোথায় কৃষ্ণ কোথায়ই বা তাঁর বর্ণনির্মাণ বা বর্ণবিভাজনের ভূমিকা
কৃষ্ণের অবশ্য এ ছাড়া উপায় ছিল না। সমাজে যা অন্তর্ভুক্ত হয়ে রয়েছে দীর্ঘকাল ধরে তা তাকে তো ফেলা যায় না। তাই সব কিছুরই স্রষ্টা বলে নিজে জাহির করা ছাড়া উপায় ছিল। এর দ্বারা সমাজের বর্ণ, জাতি, উপজাতির এ রকম একটা ব্যাখ্যাও মিলল— তা সে ইতিহাস-সম্মত, বৈজ্ঞানিক বা যথার্থ না হোক, খোদা কৃষ্ণের মুখের বাণী। এই তৎকালীন সমাজ তাকে একেবারে নস্যাৎ করতেও পারত না। আদিবাসী জাতির অস্তিত্বও এখানে ওখানে আছে, খুব প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও। অতএব এই বর্ণজাতির সমস্যাও কৃষ্ণের চিন্তায় কতকটা স্থান পেয়েছে।
গীতার শ্লোকগুলি ঠিক চিন্তার পারম্পর্য হিসাবে সাজানো নয়। পঞ্চম অধ্যায়ে একটু বিচ্ছিন্ন ভাবেই দেখি হঠাৎ কৃষ্ণের স্থান নিয়েছেন ব্রহ্ম: ‘ব্রহ্মে [সর্বকর্ম?] অর্পণ করে, ব্রহ্মকেই [যজ্ঞের] হবি জ্ঞান করে, ব্রহ্ম রূপ অগ্নিতে ব্রহ্ম দ্বারা [তা] আহুতি দেওয়া হলে ব্রহ্মকর্মে একান্ত নিবিষ্ট সে ব্যক্তি ব্রহ্মেই গমন করে।’ (৪:২৪) ব্রহ্মা গীতায় মোটামুটি গৌণ, কৃষ্ণই মুখ্য; শুধু মাঝে মাঝে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে কৃষ্ণই ব্রহ্ম। ছ’টি শ্লোকের পরেই শুনি যে, শ্রদ্ধাবানই জ্ঞান লাভ করে, তার পরেই জিতেন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয়সংযমকে সর্বত্রই খুব মূল্য দেওয়া হয় আর শ্রদ্ধাটা, বলা বাহুল্য, কৃষ্ণকে। মানুষের স্বভাবজ দ্বেষ কামনার নিন্দা করা হয়েছে বহুবার, ‘তাকেই নিত্যসন্ন্যাসী বলা যায়, যার দ্বেষ বা কামনা নেই।’ (৫:৩)
একটি বিখ্যাত বহু-উল্লিখিত শ্লোকে পড়ি পণ্ডিতের সংজ্ঞা: ‘বিদ্যাবিনয়-সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গাভি, হস্তী, কুকুর ও চণ্ডালকে যাঁরা সমদৃষ্টিতে দেখেন, তাঁরাই পণ্ডিত।’ বিদ্যাবিনয়সম্পন্ন ব্রাহ্মণকে যদি কুকুর, হাতি, চণ্ডালের সমান জ্ঞান করতে হয়, তা হলে বিচার ও ভালমন্দের নিরিখকে বিসর্জন দিতে হবে। যিনি অনেক সাধনায় বিদ্যা অর্জন করেছেন, চরিত্রে যাঁর বিনয় আছে, তাঁর মূল্য গাভি, হাতি, কুকুর ও চণ্ডালের সমান? তা হলে বিদ্যা ও সাধনা তো নিষ্ফল বলে গণ্য করতে হবে। সমদৃষ্টি বলতে বুঝতে হবে, মানুষের যা আকস্মিক গৌরব, যেমন, রূপ, অর্থ, বংশ ইত্যাদি। সেগুলিকে উপেক্ষা করে মানুষের যা আত্যন্তিক সত্তা সেইখানে যার মহত্ত্ব তাকেই শ্রদ্ধা বা সম্মান করা যায়। এ বস্তু সাধনা ও সংযমের দ্বারা লভ্য এবং যথার্থ সম্মানের যোগ্য। তার পাশাপাশি যদি গাভি, হাতি, কুকুরকে স্থাপন করা যায় তা হলে সারস্বত বা নৈতিক মূল্যবোধ অর্থহীন হয়ে যায়। চণ্ডালকে সে সময়ে সমাজ যে স্থানে রেখেছিল সেটা এতই হেয়, অপমানজনক ও ঘৃণ্য যে তাকে সমাজের বাকি মানুষের সঙ্গে একাসনে রেখে দেখা শুধু যে উচিত ছিল তাই নয়, না দেখাটা ছিল মানবিক অপরাধ। কিন্তু ভুললে চলবে না যে, ওই হীনতর জীবের তালিকায় শুধু চণ্ডাল নয়, কুকুর, হাতি, সবই ছিল। এটা সমদর্শন নয়, মুড়ি মিছরির একদর। যে বস্তু সাধনায় ও সংযমে অর্জন করা যায় তার পাশাপাশি গরু, হাতি থাকলে তা মূল্যহীন হয়ে যায়। মূল্যবোধের তালিকায় একই সঙ্গে উচ্চারিত হলে, ধর্ম দূরে থাক, মানবিক মর্যাদাও অবলুপ্ত হয়। অথচ গীতায় মাঝে মাঝেই পড়ি, যে মানুষ ভাল-মন্দ, যোগ্য-অযোগ্য-নির্বিচারে সকলকে এক দৃষ্টিতে দেখেন তিনিই মহৎ। তা হলে জ্ঞান, চরিত্রের উৎকর্ষ, ইন্দ্রিয়-সংযম, জ্ঞানী-মূর্খ ইত্যাদি গুণের অভ্যাসের দ্বারা যাঁরা উন্নত হয়েছেন তাঁদের সে সাধনার কোনও মূল্যই নেই? এ ধরনের মূল্যবোধ সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর, সমাজকে টেনে নামায়।
যোগী কে? এর উত্তরে গীতা বলে, যুক্ত হল যোগী, তার দৃষ্টিতে পাথরের নুড়ি, পাথর এবং সুবর্ণ একই। (৬:৮) নির্লোভতা শিক্ষা দেবার জন্য এ কথা বললে তবু একটা মানে হয়; কিন্তু যোগী হলেই তার কাছে পাথর আর সোনা একই মানের হবে, এ কথা মানলে যোগীর যোগ শিশুচিত্তের মতো হয়ে যাবে না? যার কোনও রকম মূল্যবোধই নেই? এই ধরনের কথা পড়ি: বন্ধু, মিত্র, শত্রু, উদাসীন, মধ্যস্থ [নিরপেক্ষ], সাধু এবং পাপিষ্ঠ, এদের প্রতি সমদৃষ্টি যার আছে সেই সে-ই বিশিষ্ট। এই বিশিষ্টতা কিন্তু সমাজের সাধারণ মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর। মূল্যবোধের মান নেমে যায়, অন্য উচ্চতর কিছুর দিকে এগোবার জন্য কোনও আগ্রহ থাকে না। সব মিলে সমাজ এতে স্থাণু হয়ে যায় বা অধোগতি প্রাপ্ত হয়।