চতুর্থ অধ্যায় – জ্ঞানযোগ
“ভগবান বলিলেন, ‘আমি পূর্বে আদিত্যকে এই অব্যয়যোগ কহিয়াছিলাম; তৎপরে আদিত্য মনুকে ও মনু ঈক্ষ্বাকুকে কহিয়াছিলেন এবং নিমিপ্রভৃতি রাজর্ষিগণ পরম্পরাগত (পূর্বাপর ধারাবাহিকরূপে আগত) এই যোগবৃত্তান্ত অবগত হইয়াছিলেন, অনন্তর কালক্রমে উহা বিলুপ্ত হইয়াছিল, আজি আমি তোমার নিকটে সেই পুরাতন যোগবৃত্তান্ত কীর্তন করিলাম; তুমি আমার ভক্ত ও সখা; তন্নিমিত্ত আমি তোমাকে এই রহস্য কহিলাম।’
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে কেশব! আদিত্য জন্মগ্রহণ করিলে পর তোমার জন্ম হইয়াছিল; অতএব আমি কী প্রকারে অবগত হইব যে, তুমি অগ্রে তাঁহাকে এই যোগবৃত্তান্ত কহিয়াছিলে?’
“কৃষ্ণ কহিলেন, ‘হে অর্জুন! আমি অনেকবার জন্মগ্রহণ করিয়াছি; তোমরাও বহু জন্ম অতীত হইয়াছে; তুমি তাহার কিছুই জান না; কিন্তু আমি তৎসমুদয়ই অবগত আছি। আমি জন্মরহিত, অনশ্বর (বিনাশরহিত) স্বভাব ও সকলের ঈশ্বর হইয়াও স্বীয় প্রকৃতিকে আশ্রয় করিয়া আত্মমায়ায় জন্মগ্রহণ করি। যে যে সময়ে ধর্মের বিপ্লব (বিরুদ্ধ ভাবের উদ্ভব) ও ধর্মের প্রাদুর্ভাব হয়, সেই সেই সময়ে আমি আত্মাকে সৃষ্টি করিয়া থাকি। আমি সাধুগণের পরিত্রাণ, অসাধুগণের বিনাশ ও ধর্মের সংস্থাপনের নিমিত্ত যুগে-যুগে জন্মগ্রহণ করি। হে অর্জুন! যিনি আমার এই অলৌকিক জন্ম ও অলৌকিক কর্ম যথাযথ অবগত হইতে পারেন, তিনি শরীর পরিত্যাগ করিয়া আমাকে লাভ করেন; তাঁহাকে পুনরায় জন্মগ্রহণ করিতে হয় না। অনেকে আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ পরিত্যাগ করিয়া একাগ্রচিত্ত, একাগ্র আশ্রিত এবং জ্ঞান ও তপস্যা দ্বারা পবিত্র হইয়া আমার সাষুজ্য (সংযোগ–সাম্য) লাভ করিয়াছে। হে পার্থ! যাহারা যেরূপে আমাকে ভজনা করে, আমি তাহাদিগকে সেই প্রকারেই অনুগ্রহ করি। যে যাহা করুক, সকলেই আমার সেবাপথে আগমন করিতেছি। মনুষ্যলোকে অচিরকালেই কর্মসকল সফল হয়; এই নিমিত্ত কর্মফলাকাঙ্খী মনুষ্যেরা প্রায়ই ইহলোকে দেবতার অর্চনা করিয়া থাকে। আমি গুণ ও কর্মের বিভাগানুসারে (ব্রাহ্মণগণের সত্ত্বগুণ অধিক, তাঁহাদের কার্য্য ইন্দ্রিয়দমনপূর্বক যোগতপস্যাদি। রজোবহুল ক্ষত্রিয়গণের কার্য্য যুদ্ধাদি দ্বারা রাজ্যশাসন-পালন। বৈশ্যগণ রজোমিশ্রিত তমঃপ্রধান, তাঁহাদের কার্য্য বানিজ্য ও কৃষি-গোরক্ষাদি। শূদ্র কেবল তমঃপ্রধান, ব্রাহ্মণাদি ত্রিবর্ণের সেবা দ্বারা সাহায্যই তাহাদের কার্য্য। জাতি দেখিয়া গুণকর্মের এইরূপ কল্যাণকর বিভাগ–গুণ দেখিয়া জাতিবিভাগ নহে) ব্রাহ্মণ প্রভৃতি চারি বর্ণ সৃষ্টি করিয়াছি; তথাপি আমি সংসারবিহীন; আমাকে কর্তা মনে করিও না। কর্ম আমাকে স্পর্শ করিতে পারে না; কর্মফলেও আমার স্পৃহা নেই। যে ব্যক্তি আমাকে এইরূপ অবগত হইতে পারে, তাহাকে কর্মবন্ধনে বন্ধ হইতে হয় না। পূর্বতন মুমুক্ষুগণ আমাকে এই প্রকারে অবগত হইয়া কর্ম অনুষ্ঠান করিতেন; অতএব তুম প্রথমে পূর্বতনদিগের অনুষ্ঠিত কর্ম অনুষ্ঠান কর।
“ইহলোকে বিবেকিগণও কর্ম ও অকর্ম-বিষয়ে মোহিত হইয়া আছেন; অতএব তুমি যাহা অবগত হইয়া সংসার হইতে মুক্ত হইবে, আমি তোমাকে সেই কর্মের বিষয় কহিতেছি, শ্রবণ কর। কর্মের গতি অতি দুরবগাহ, অতএব বিহিত কর্ম, অবিহিত কর্ম ও কর্মত্যাগ এই তিনের তত্ত্ব অবগত হইতে হয়; যিনি কর্ম বিদ্যমান থাকিতেও আপনার কর্মশূন্য এবং কর্মত্যাগ হইলেও কর্মযুক্ত বলিয়া বোধ করেন, তিনিই মনুষ্যের মধ্যে বুদ্ধিমান, যোগী এবং সকল কর্মের অনুষ্ঠাতা। যাঁহার সমুদয় কর্ম নিষ্কাম, পণ্ডিতগণ তাঁহাকে পণ্ডিত বলিয়া থাকেন; তাঁহার কর্মসমুদয় জ্ঞানাবলে (জ্ঞানরূপ অগ্নিতে) দগ্ধ হইয়া যায়। যিনি কর্মফলে আসক্তি পরিত্যাগপূর্বক চিরতৃপ্ত হইয়া থাকেন এবং কাহারও আশ্রয় গ্রহণ করেন না, তিনি কর্মে সম্যক্ প্রবৃত্ত হইলেও তাঁহার কিছুমাত্র কর্ম করা হয় না। যিনি কামনা ও সর্বপ্রকার পরিগ্রহ পরিত্যাগ করেন, যাঁহার মন ও আত্মা বিশুদ্ধ, তিনি কেবল শরীর দ্বারা কর্মানুষ্ঠান করিয়া পাপভাগী হয়েন না। যিনি যদৃচ্ছালাভে সন্তুষ্ট, শীত, উষ্ণ ও সুখদুঃখাদি দ্বন্দ্বসহিষ্ণু ও বৈরবিহীন এবং যিনি সিদ্ধি ও অসিদ্ধি তুল্য জ্ঞান করেন, তিনি কর্ম করিয়াও কর্ম বন্ধনে বদ্ধ হয়েন না। যিনি কামনা পরিত্যাগ করিয়াছেন, রাগাদি হইতে মুক্ত হইয়াছেন এবং যাঁহার চিত্ত জ্ঞানে অবস্থান করিতেছে, তিনি যজ্ঞার্থ কর্মানুষ্ঠান করিলে কর্মসকল বিলয় হইয়া যায়। স্রুক্স্রুবাদি পাত্রসকল ব্রহ্ম; হবনীয় (আহুরিত নিমিত্ত প্রদত্ত) ঘৃতাদি ব্রহ্ম, অগ্নিও ব্রহ্ম ও যিনি হোম করেন, তিনিও ব্রহ্ম; এই প্রকার কর্মস্বরূপ ব্রহ্মে যাঁহার সমাধি হইয়াছে, তিনি ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়েন। কতকগুলি যোগী সম্যক্রূপে দেবযজ্ঞই (দেবতার উদ্দেশ্যে যজ্ঞই) অনুষ্ঠান করেন; কোন কোন যোগী পূর্বোক্ত প্রকারে ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে যজ্ঞরূপ উপায় দ্বারা যজ্ঞাদি কর্মসকল (কর্মত্যাগরূপ) আহুতি প্রদান করিয়া থাকেন; কেহ কেহ সংযমরূপ অগ্নিতে শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়গণকে, আর কেহ কেহ ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে শব্দাদি বিষয় সকল আহুতি দিয়া থাকেন। কেহ কেহ ধ্যেয় বিষয় (পদার্থ) দ্বারা উদ্দীপিত আত্মধ্যানরূপ যোগাগ্নিতে জ্ঞানেন্দ্রিয়ের কর্ম, কর্মেন্দ্রিয়ের কর্ম ও প্রাণবায়ুর কর্মসকল আহুতি প্রদান করেন। দৃঢ়ব্রত যতিগণ দ্রব্যদান, চান্দ্রায়ণাদি ব্রত, সমাধি, বেদপাঠ ও বেদজ্ঞান, এই কয়েকটি যজ্ঞ অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। কেহ কেহ প্রাণবৃত্তিতে অপানবৃত্তিকে আহুদি প্রদান করিয়া পূরক (নাসিকাপথে অভ্যন্তরে), অপানবৃত্তিতে প্রাণবৃত্তিকে আহুতি প্রদান করিয়া রেচক (অভ্যন্তরে পূরিত বায়ুর নিঃসরণ) এবং প্রাণ ও অপানের গতিরোধ করিয়া কুম্ভকরূপ (অভ্যন্তরে বায়ু রোধক) প্রাণায়াম করেন; আর কেহ কেহ নিয়তাহার (সংযত-আহার) হইয়া প্রাণবৃত্তি সমুদয়কে প্রাণবৃত্তিতেই হোম করিয়া থাকেন। এই সকল যজ্ঞবেত্তা যজ্ঞ দ্বারা নিষ্পাপ হইয়া যজ্ঞশেষরূপ অমৃত ভোজন করিয়া সনাতন ব্রহ্মকে লাভ করেন, কিন্তু যজ্ঞহীন ব্যক্তির পরলোকের কথা দূরে থাকুক, ইহলোকও নাই। এবংবিধ ভূরি ভূরি (বহু বহু) যজ্ঞ বেদ দ্বারা বিস্তারিত হইয়াছে, তৎসমুদয়ই কর্ম হইতে উৎপন্ন; তুমি ইহা অবগত হইয়া মুক্তিলাভ কর। ফলের সহিত সমুদয় কর্ম জ্ঞানের অন্তর্ভূত আছে, অতএব দ্রব্যময় দৈবযজ্ঞ অপেক্ষা জ্ঞানযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ।
“হে ধনঞ্জয়! তুমি প্রণিপাত, প্রশ্ন ও সেবা দ্বারা জ্ঞান শিক্ষা কর, তত্ত্বদর্শী জ্ঞানীরা তোমাকে তাহার উপদেশ প্রদান করিবেন। জ্ঞানলাভ করিলে তুমি আর এ প্রকার বন্ধুবধাদিজনিত মোহে অভিভূত হইবে না, তুমি আপনাকে সমুদয় ভূতকে অভিন্ন অবলোকন করিয়া পরিশেষে পরমাত্মাকে আত্মায় অভিন্ন দেখিবে। যদ্যপি তুমি সকল পাপী অপেক্ষা অধিক পাপী হও, তথাপি সেই জ্ঞানরূপ ভেলা দ্বারা সমস্ত পাপ হইতে উত্তীর্ণ হইবে। হে অর্জুন! যেমন প্রজ্বলিত হুতাশন কাষ্ঠ-সমুদয় ভষ্মাবশেষ করে, সেইরূপ জ্ঞানাগ্নি ন্যায় শুদ্ধিকর আর কিছুই নাই, মুমুক্ষু ব্যক্তি কর্মযোগে সিদ্ধি প্রাপ্ত হইয়া আপনা হইতেই আত্মজ্ঞান লাভ করে। যে ব্যক্তি গুরুর উপদেশ শ্রদ্ধাবান, গুরুশুশ্রূষাপরায়ণ ও জিতেন্দ্রিয়, তিনি জ্ঞান লাভ করিয়া অচিরাৎ (১) মোক্ষপদ প্রাপ্ত হয়েন; কিন্তু জ্ঞান ও শ্রদ্ধাবিহীন সংশয়াত্মা ব্যক্তি বিনাশ প্রাপ্ত হয়, সংশয়াত্মার এই লোক ও পরলোক কিছুই নাই এবং সুখও নাই। হে ধনঞ্জয়! যিনি যোগ দ্বারা কর্মসকল ঈশ্বরে সমর্পণ ও জ্ঞান দ্বারা সংশয়চ্ছেদ করিয়াছেন, কর্মসকল এই অপ্রমত্ত ব্যক্তিকে বদ্ধ করিতে পারে না। অতএব হে ভারত! আত্মজ্ঞানরূপ অসি দ্বারা হৃদয়নিহিত, অজ্ঞানসম্ভূত! সংশয় ছেদ করিয়া কর্মযোগ অনুষ্ঠান কর এবং উত্থিত হও।’”