আজ আমার উপর ভার পড়েছে এই অনুষ্ঠানে তোমাদের কাছে গান সম্বন্ধে কিছু বুঝিয়ে দেওয়া। গান শেখা ভালো এ কথা বলা সহজ, যেমন সহজ বলা যে, চুরি করা ভালো নয়। মেয়েদের গলার গান কানে ভালো শুনায়– এ তো সাদা কথা, ধরা কথা– তাতে আবহাওয়া বেশ একটু সুমধুর হয়।
গানের কথা আমি বলি গানেতেই, গানের কথা আমাকে ফের যদি বলতে হয় ভাষাতে, তবে আমার উপর কি জুলুম হয় না? পুরানো পুঁথিপত্র খুঁজলে দেখবে গান সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ কী বলেছে– যথেষ্ট বলেছে।
আজ বাংলাদেশে গানে একটা খেলো ভাব এসে পড়েছে। কারণ, গান নিয়ে দোকানদারি প্রবল হয়ে পড়েছে। আমি তো ভীত হয়ে পড়েছি। দোকানের মাপেতে দর অনুসারে বাঁকাচোরা করে তার রস-টস চেপেচুপে চলেছে আমারই গান।
এক সময় ছিল যখন, যাঁরা ওস্তাদ তাঁদেরই ছিল গানের ব্যবসায়। তখন গানের যা মূল্য তা তাঁরাই বুঝতেন। তখন টেক্নিক্যাল গান ছিল চলতি এবং তার ঠিকমতো সুর তান মান হল কি না তাঁরাই বুঝতেন।
কিন্তু যারা খেটে খায়, অফিসে যায়, তাদের পক্ষে এ-সব গান হয়ে ওঠে না; তাদের পক্ষে ওস্তাদের মতো গলা সাধা শক্ত। সেইজন্য এখনকার গান ব্যবসাদারির বাইরে থাকাই ভালো। আমার গান আপন মনের গান– তাতে আনন্দ পাই, শুনলে আনন্দ হয়। গান হবে যাতে, যারা আশেপাশে থাকে তারা খুশি হয়; আত্মীয়স্বজন যারা অফিস থেকে আসছে, দূর থেকে শুনতে পেলেও, এটা তাদের জন্যও ভালো। ঘরে মাঝে মাঝে ঝগড়াও তো হয়– গান ঘরের মধ্যে মাধুরী পাওয়ার জন্যে, বাইরের মধ্যে হাততালি পাবার জন্যে নয়। ওস্তাদ যাঁরা তাঁদের জন্যে ভাবনা নেই; ভাবনা হচ্ছে যারা গানকে সাদাসিধেরূপে মনের আনন্দের জন্য পেতে চায় তাদের জন্যে। যেমন তোমাদের টি-পার্টি যাকে বলে, সেখানে যারা সাহেবী মেজাজের লোক তাদের কানে কি ভালো লাগবে? এখানে রবীন্দ্রনাথের হালকা গান, সহজ সুর, হয়তো ভালো লাগবে। তাই বলি আমার গান যদি শিখতে চাও, নিরালায়, স্বগত, নাওয়ার ঘরে কিংবা এমনি সব জায়গায়, গলা ছেড়ে গাবে। আমার আকাঙক্ষার দৌড় এই পর্যন্ত– এর … বেশি ambitionমনে নাই রাখলে।
বাল্যকালে আমাদের ঘরে ওস্তাদের অভাব ছিল না; সুদূর থেকে অযোধ্যা গোয়ালিয়র ও মোরাদাবাদ থেকে, ওস্তাদ আসত। তা ছাড়া বড়ো বড়ো ওস্তাদ ঘরেও বাঁধা ছিল। কিন্তু আমার একটা গুণ আছে– তখনো কিছু শিখি নি, মাস্টারির ভঙ্গি দেখালেই দৌড় দিয়েছি। যদুভট্ট আমাদের গানের মাস্টার আমায় ধরবার চেষ্টা করতেন। আমি তাঁর ঘরের সামনে দিয়ে দৌড় দিতাম। তিনি আমাদের কানাড়া গান শিখাতে চাইতেন। বাংলাদেশে এরকম ওস্তাদ জন্মায় নি। তাঁর প্রত্যেক গানে একটা originality ছিল, যাকে আমি বলি স্বকীয়তা। আমি অত্যন্ত “পলাতকা’ ছিলুম বলে কিছু শিখি নি, নইলে কি তোমাদের কাছে আজকে খাতির কম হত? এ ভুল যদি না করতুম, পালিয়ে না বেড়াতুম, তা হলে আজকে তোমাদের মহলে কি নাম হত না? সেটা হয়ে উঠল না, তাই আমি এক কৌশল করেছি– কবিতার-কাছঘেঁষা সুর লাগিয়ে দিয়েছি। লোকের মনে ধাঁধা লাগে; কেউ বলে সুর ভালো, কেউ বলে কথা ভালো। সুরের সঙ্গে কথা, কবি কিনা। কবির তৈরি গান, এতে ওস্তাদি নেই। ভারতীয় সংগীত ব’লে যে-একটা প্রকাণ্ড ব্যাপার আছে, আমার জন্মের পর তার নাকি ক্ষতি হয়েছে– অপমান নাকি হয়েছে। তার কারণ আমার অক্ষমতা। বাল্যকালে আমি গান শিখি নি– এতে সহজে শেখা যায় না, শিখতে কষ্ট হয়, সেই কষ্ট আমি নেই নি। সেজদাদা শিখতেন বটে– তিনি সুর ভাঁজছেন তো ভাঁজছেনই, গলা সাধছেন তো সাধছেনই, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। হয়তো বর্ষাকাল– মেঘলা হয়েছে– আমার তখন একটু কবিত্ব [জাগল]। তবু যা শুনতাম হয়তো মনে থাকত।
[এইখানে রবীন্দ্রনাথ একটি গান করেন]
খুব মনে পড়ে এই গান যেদিন শিখি। বড়দাদা সেজদাদারা দরজা বন্ধ করে গান শিখতেন। ছেলেমানুষ, আমার তথায় প্রবেশ ছিল না। কারণ, তখনকার দিনে ছেলেমানুষের অনেক অপরাধ ছিল। তানপুরার কান কখনো মুড়ি নি। তবু দরজার পাশে কান দিয়ে শুনেছি, সেটা হয়তো মনে রয়ে গেল। এমনি করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যা শিখেছি তাই তোমাদের কাছে আওড়ালাম। তোমাদের যা দিয়েছি, এই ছুঁয়ে ছুঁয়ে যা শিখেছি তাই দিয়েছি।
আমার গান যাতে আমার গান ব’লে মনে হয় এইটি তোমরা কোরো। আরো হাজারো গান হয়তো আছে– তাদের মাটি করে দাও-না, আমার দুঃখ নেই। কিন্তু তোমাদের কাছে আমার মিনতি– তোমাদের গান যেন আমার গানের কাছাকাছি হয়, যেন শুনে আমিও আমার গান বলে চিনতে পারি। এখন এমন হয় যে, আমার গান শুনে নিজের গান কিনা বুঝতে পারি না। মনে হয় কথাটা যেন আমার, সুরটা যেন নয়। নিজে রচনা করলুম, পরের মুখে নষ্ট হচ্ছে, এ যেন অসহ্য। মেয়েকে অপাত্রে দিলে যেমন সব-কিছু সইতে হয়, এও যেন আমার পক্ষে সেই রকম।
বুলাবাবু, তোমার কাছে সানুনয় অনুরোধ– এঁদের একটু দরদ দিয়ে, একটু রস দিয়ে গান শিখিয়ো– এইটেই আমার গানের বিশেষত্ব। তার উপরে তোমরা যদি স্টিম রোলার চালিয়ে দাও, আমার গান চেপ্টা হয়ে যাবে। আমার গানে যাতে একটু রস থাকে, তান থাকে, দরদ থাকে ও মীড় থাকে, তার চেষ্টা তুমি কোরো।
৩০ জুন, ১৯৪০, ১৬ আষাঢ়, ১৩৪৭, তারিখে কথিত বক্তৃতার অনুলেখন