গীতার অন্তর্ধান রহস্য

গীতার অন্তর্ধান রহস্য

এক

সকালবেলায় গলফ খেলে ক্লাব থেকে ফিরছি৷ এমন সময় ফের সুদীশের ফোন৷ গাড়ি চালানোর সময় কখনও ফোনে কথা বলি না আমি৷ এটা সুদীশের তৃতীয় ফোন৷ নিশ্চয়ই জরুরি৷ না হলে বারবার ফোন করত না৷ গাড়িটা রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে ফোন অন করতেই শুনলাম, ‘তুই কোথায় রে কালকেতু? এতবার তোকে ফোন করছি৷ ধরছিস না কেন?’

বললাম, ‘গলফ খেলতে গিয়েছিলাম রে৷ বাড়ি ফিরছি৷’

শুনে ও প্রান্ত থেকে সুদীশ বলল, ‘সত্যি, লাইফটা তোরাই এনজয় করছিস ভাই৷ সামনের জন্মে যেন তোর মতো জার্নালিস্ট হয়ে জন্মাতে পারি৷ ঘুম থেকে উঠে তুই স্বাস্থ্যচর্চা করতে গেছিস৷ আর আমি চোখ খুলে এক নিখোঁজ মহিলার সন্ধানে মাথা ঘামাচ্ছি৷’

বললাম, ‘মাঝে মাঝে আমিও ভাবি, ইস যদি তোর মতো পুলিশ কর্তা হতাম, লাইফটা এনজয় করতে পারতাম৷ যাক গে, বল কেন ফোন করেছিস?’

সুদীশ বলল, ‘তোদের গলফ ক্লাবে কাগজ-ফাগজ কিছু রাখে না? আজ কাগজগুলো দেখিসনি? আমাকে তো একেবারে শেষ করে দিয়েছে ভাই৷ ভাবছি, চাকরি-বাকরি আর করব না৷’

শুনে হাসি পেল৷ সুদীপ প্রায়ই এই কথাটা বলে৷ পুলিশের চাকরি করতে গিয়ে লাইফটা হাল্লাক হয়ে গেল৷ হাল্লাক কথাটার মানে অবশ্য জানি না৷ লাইফ হেল হয়ে গেল, কথাটা শুনেছি৷ হাল্লাক হয়তো তার থেকেও কিছু বেশি মাত্রার কিছু হবে৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই কোথায়?’

‘থানায় এসে গেছি৷ একটা কেসের ব্যাপারে তোর সঙ্গে আলোচনা করার আছে৷ আমি এখুনি একবার তোর বাড়িতে আসছি৷ একটু টাইম দিতে পারবি তো?’

বললাম, ‘আয়৷ আমি মিনিট দুইয়ের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছি৷’

গলফ ক্লাব থেকে গলফ গার্ডেন্স কয়েক মিনিটের রাস্তা৷ বাড়ি ফিরেই চট করে ব্রেকফাস্ট সেরে অফিসে যাব, ভেবে রেখেছিলাম৷ কিন্তু মনে হচ্ছে, তা সম্ভব হবে না৷ সুদীশ নাগ আমার অনেক দিনের বন্ধু৷ ওর সঙ্গে যখন পরিচয় হয়, তখন সুদীশ লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগে ছিল৷ প্রোমোশন পেয়ে পেয়ে এখন যাদবপুর থানার ওসি হয়েছে৷ প্রায়ই ফোনে কথাবার্তা হয়৷ বিশেষ করে, আই লিগে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের খেলা থাকলে৷ সুদীশ পাঁড় ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার৷ রোজ খেলার খবর জানতে চায়৷ ও একবার জিজ্ঞেস করেছিল, লিওনেল মেসিকে যদি লাল-হলুদ জার্সি পরাতে হয়, তা হলে কত টাকা লাগবে রে?

পেশায় আমি…কালকেতু নন্দী কলকাতার নামকরা একটা কাগজের সাংবাদিক৷ কিন্তু নেশায় রহস্যভেদী৷ আমার উপর সুদীশের অগাধ বিশ্বাস৷ পুলিশের লোক হয়েও সুদীশ প্রায়ই জটিল কেসে আমার সাহায্য নিতে আসে৷ বোধহয় কোনো রহস্যভেদে আটকে গিয়েছে৷ আর সেই কারণেই সাত সকালে আসতে চাইছে৷ কলকাতায় আজকাল ক্রাইম রেট বেড়ে গিয়েছে৷ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভিক্টিম হচ্ছেন মেয়েরা৷ খবরের কাগজ অথবা টিভি খুললেই খুন, ধর্ষণ আর দুর্ঘটনা৷ সত্তর ভাগ কেসের কোনো সমাধান হয় না৷ অপরাধীরাও ধরা পড়ে না৷

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখি, সুদীশের জিপ দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ গাড়ি পার্ক করে আমি জিপের কাছে যেতেই সুদীশ বলল, ‘উপরে আর উঠব না রে৷ বিজয়গড়ের দিকে যাচ্ছি৷ তাই ভাবলাম, তোর সঙ্গে কথা বলে যাই৷ আচ্ছা, বিনয় সরকার বলে কাউকে তুই চিনিস?’

কে বিনয় সরকার? চট করে আমি চিনতে পারলাম না৷ সারাদিনে প্রচুর লোকের সংস্পর্শে আসতে হয়৷ সবার নাম মনে রাখা মুশকিল৷ তাই প্রশ্ন করলাম, ‘কোন বিনয় সরকার বল তো?’

‘আরে, তোর সঙ্গে স্কুলে পড়ত যে৷ তোর পুরোনো পাড়া…সাউথ সিঁথির দিকে থাকত৷ তোর কথা আমাদের কাছে বলেছে৷’

এবার মনে পড়ল৷ বিনয়…বিশ্বনাথ পার্কের দিকে থাকত৷ দারুণ ছবি আঁকত৷ আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়েছিল৷ সরস্বতী পুজোর সময় আমাদের ক্লাবের মণ্ডপ সাজানোর ভারটা ওর উপরই পড়ত৷ অল্প বয়সে প্রেমে পড়ে…বিনয় বেকার অবস্থায় কাছাকাছি রায়পাড়ার মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল৷ ছবি এঁকেও তেমন রোজগার করতে পারছিল না৷ শেষ পর্যন্ত বেলঘরিয়ায় কোন এক প্রাইভেট ফার্মে বিনয় চাকরি পেয়েছিল৷ আমি সাংবাদিকতা পেশায় ঢোকার পর গলফ গার্ডেন্সে চলে এলাম৷ তার পর দেখাসাক্ষাৎ খুব কমই হয়েছে৷ মাঝে একদিন লেক গার্ডেন্সের মোড়ে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল৷ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, ভালো নেই৷ কিন্তু ওর কথা সুদীশ জিজ্ঞেস করছে কেন, বুঝতে পারলাম না৷

সুদীশকে বললাম, ‘হ্যাঁ, এবার চিনতে পেরেছি৷ মাস ছয়েক আগে ওর স্ত্রী গীতা আমার কাছে এসেছিল৷ বলেছিল, বিনয় খুব অসুস্থ৷ সরকারি কোনো হাসপাতালে যদি ভরতি করে দেওয়া যায়, তা হলে বাঁচবে৷ শুনে আমি বাঙ্গুর হাসপাতালে ভরতির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম৷ ওর স্ত্রী কিন্তু আমায় আর কোনো খবর দেয়নি৷ ও এখন কেমন আছে রে?’

সুদীশ বলল, ‘বিনয়বাবু সেরে উঠছেন৷ তবে এখনও শয্যাশায়ী৷ এই কাছেই…বিজয়গড়ে এখন উনি থাকেন৷ মারাত্মক এক সমস্যায় পড়েছেন ভদ্রলোক৷ গত শুক্রবার রাতে ওঁর স্ত্রী পুজো দিতে বেরিয়েছিলেন৷ তার পর আর বাড়ি ফেরেননি৷’

‘সে কী! কোথায় পুজো দিতে গিয়েছিল?’

‘বাড়িতে বলে বেরিয়েছিলেন তারাপীঠে যাবেন৷ তারা মায়ের কাছে নাকি মানত করেছিলেন, বিনয়বাবুর সুস্থ হয়ে উঠলে পুজো দেবেন৷ তিনদিন হয়ে গেল, ভদ্রমহিলার কোনো পাত্তা নেই৷’

‘তারাপীঠে গীতা কি একা গিয়েছিল?’

‘তাই তো বিনয়বাবু বললেন৷ বাড়িতে দুটি বাচ্চা মেয়ে৷ একজনের বয়স তেরো-চোদ্দো, অন্যজনের দশ৷ সঙ্গে আর কাকেই বা নিয়ে যাবেন? ভদ্রমহিলা নাকি বলে গিয়েছিলেন, রবিবার সকালের মধ্যে ফিরে আসবেন৷ কিন্তু ফেরেননি৷ কাল একটা ইলেকট্রনিক চ্যানেলের রিপোর্টার আমার থানায় ঘুরঘুর করছিল৷ সন্ধেবেলা থেকে ব্রেকিং নিউজ শুরু করে দিয়েছে, রহস্যজনকভাবে গৃহবধূ নিখোঁজ৷ যাদবপুর থানার পুলিশ নিষ্ক্রিয়৷ চ্যানেলের এই রিপোর্টারগুলোর কি খেয়েদেয়ে কাজ নেই? একটা কিছু পেলেই হল, অমনি ব্রেকিং নিউজ শুরু করে দিল৷ আর একটা চ্যানেল তো আজ রাতে নাট্য রূপান্তর দেখাবে বলছে৷ কখন স্ক্রিপ্ট লেখা হল, কখন শুটিং হল—কে জানে? লাইফটা হাল্লাক হয়ে গেল ভাই৷ কাল রাতে সিপি ফোন করে আমাকে বললেন, দেখুন তো কেসটা কী? আপনি নিজে তদন্ত করে আমায় জানাবেন৷ খোঁজ করে জানলাম, বেশ কমপ্লিকেটেড কেস৷ তাই তোর কথা মনে পড়ল ভাই৷’

সুদীশের মুখে হাল্লাক কথাটা শুনে হাসি পেয়ে গেল৷ কিন্তু হাসলে ও মাইন্ড করতে পারে৷ তাই সিরিয়াস হয়েই বললাম, ‘তুই কি বিনয়ের বাড়িতে গিয়েছিলি?’

‘না, এখনও যাইনি৷ বিনয়বাবুর সঙ্গে ফোনে একবার কথা বলেছি৷ ভদ্রলোক একেবারে ভেঙে পড়েছেন৷ একটা কথা তোর কাছে জানতে চাইছি, ভদ্রমহিলাকে তুই কতটুকু চিনিস?’

‘খুব বেশি না৷ বিনয়ের সঙ্গে দু-একবার দেখেছি৷ টুকটাক কথা-বার্তা হয়েছে৷ ভালো করে আলাপ হল এই সেদিন…যেদিন গীতা আমার কাছে আসে৷’

‘সেদিন ওঁকে দেখে তোর কী ইম্প্রেশন হয়েছিল?’

‘কী ইম্প্রেশন হয়েছিল মানে’

‘মানে…দেখে কখনও কি তোর মনে হয়েছিল, ভদ্রমহিলা অসুস্থ স্বামীকে ফেলে পালিয়ে যেতে পারেন? মানে…অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে?’

প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠলাম৷ সুদীশের কি মাথা খারাপ হয়েছে? গীতাকে দেখে আমার কখনই মনে হয়নি, বিনয়কে ছেড়ে ও কোনোদিন চলে যেতে পারে৷ সুশ্রী, স্বাস্থ্যবতী…অল্পতেই সুখী মধ্যবিত্ত ঘরের বউদের মতো৷ কথায় কথায় গীতা সেদিন বলেছিল, বিনয় অসুস্থ হওয়ার পর থেকে খুব কষ্টে… নিজেই রোজগার করে সংসার চালাচ্ছে৷ বিনয় সুস্থ হয়ে উঠলে কাজটা ছেড়ে দেবে৷ শুনে চিকিৎসার জন্য সেদিন আমি কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু গীতা সেই টাকা নিতে রাজি হয়নি৷ খুব বিনম্রভাবে বলেছিল, ‘এখন দরকার নেই দাদা৷ কখনও লাগলে, বলব৷’ যে মেয়ের এমন আত্মমর্যাদাবোধ, সে কখনোই নিজের সুখের কথা ভেবে অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে যাবে না৷ কথাটা মনে পড়ায় বললাম, ‘না রে, আমার তেমন মনে হয়নি৷ গীতা সে রকম টাইপের মেয়েই নয়৷ ওর কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি তো? তুই বীরভূম পুলিশের কাছে খোঁজ নে৷’

‘খোঁজ নিয়েছি ভাই৷ কোত্থাও কোনো খবর নেই৷ তারাপীঠ আর রামপুরহাটের প্রতিটা গেস্ট হাউস আর হোটেলে আমি খোঁজ নিয়েছি৷ যাতায়াতের পথে পড়ে, এমন হাসপাতালগুলোকেও বাদ দিইনি৷ কিন্তু ওই দিন দুপুরবেলায় গীতা সরকার বলে কেউ কোনো গেস্ট হাউস বা হোটেলে ওঠেননি৷ আমার মনে হচ্ছে, উনি তারাপীঠে যানইনি৷’

‘কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়ি?’

‘না, তেমন কেউ নেই৷ ভদ্রমহিলার বাপের বাড়ি সাউথ সিঁথির রায়পাড়ায়৷ সেখানে লোক পাঠিয়েছিলাম৷ ওঁরা কোনো কথাই বলতে চাননি৷ বাড়ির ইচ্ছের বিরুদ্ধে ভদ্রমহিলা বিনয়বাবুকে বিয়ে করেছিলেন৷ তাই গত পনেরো বছর ওঁরা মেয়ের খোঁজও রাখেননি৷’

‘বিনয় কী বলল?’

‘আরে, ভদ্রলোকের শরীরের এমন অবস্থা, থানায় পর্যন্ত আসতে পারেননি৷ একটা চিঠি লিখে, এক প্রতিবেশীর সঙ্গে বড়ো মেয়েকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন৷ মেয়েটাকে কান্নাকাটি করতে দেখে আমি একজন এসআই-কে বিজয়গড়ে পাঠাই৷ তখনই কথায় কথায় ওর কাছে উনি তোর নামটা করেন৷’

‘বিনয় এখন বিজয়গড়ে থাকে নাকি?’

‘হ্যাঁ, এই তো খুব কাছে৷ চল না, একবার ঘুরে আসি, যাবি?’

অফিস বেরোনোর কথা ভুলে গেলাম৷ বললাম, ‘চল৷’

দুই

বিনয় যে এতটা দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে, তা আগে ভাবতেও পারিনি৷ বিজয়গড়ের ভিতরের দিকে টালির ছাদের দুটো ঘর৷ কাঠের চৌকিতে বিনয় শুয়ে রয়েছে৷ আমাকে দেখে বলল, ‘কালকেতু তুই? তোর কাছে খবরটা গেল কী করে?’

সুদীশ নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘আমিই ওকে নিয়ে এসেছি৷’

বিনয় বলল, ‘সরি ভাই, আমার বাড়িতে একটাই মাত্র চেয়ার৷ আপনি চেয়ারে বসুন৷ আর কালকেতু তুই এসে চৌকিতে বোস৷ আসলে অসুখটা হওয়ার পর আমার সব এলোমেলো হয়ে গেছে রে৷’

বললাম, ‘কী হয়েছিল তোর?’

‘তুই তো জানিস, আমার জীবনের স্বপ্ন ছিল, নামকরা কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হব৷ তা আর হওয়া হল না রে৷ কিছু করে তো খেতে হবে৷ তাই বাধ্য হয়ে সিনেমার বড়ো বড়ো হোর্ডিং, সাইনবোর্ড আঁকার কাজ করতাম৷ আমাদের ছোটো সংসার, ভালোভাবে চলে যেত৷ বছর খানেক আগে বাঁশের ভারা বেয়ে নামতে গিয়ে, মাথা ঘুরে পড়ে যাই৷ এ ডাক্তার সে ডাক্তার করার পর কিছুই ধরা পড়ল না৷ তুই বাঙ্গুর হাসপাতালে ব্যবস্থা করে দেওয়ার পর ডিটেক্টেড হল আমার ব্রেনে টিউবারকিউলিলিস হয়েছে৷ গরিবের ঘোড়া রোগ ছাড়া আর কী৷ মাস তিনেক হাসপাতালে ট্রিটমেন্ট হওয়ার পর এখন তবুও উঠে দাঁড়াতে পারছি৷ কিন্তু চাকরি করতে যাওয়ার মতো অবস্থায় আসিনি৷ আমাকে ক্ষমা করিস ভাই৷ থ্যাংকস জানাতে পারিনি৷ তুই হাসপাতালে ভরতি না করে দিলে আমি হয়তো অ্যাদ্দিন বেঁচে থাকতাম না৷’

ব্রেনে কারও টিবি হয়েছে, এমনটা কখনও শুনিনি৷ কত ধরনের রোগ যে এখন হচ্ছে! চৌকিতে গিয়ে বসলাম৷ বিনয়ের চেহারাটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে৷ কথাও বলছে থেমে থেমে৷ ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, টিভি-ফ্রিজ নেই বটে, কিন্তু একটা যত্নের ছাপ আছে৷ বোঝাই যাচ্ছে, সংসারটা যে চালায়, অভাবে থাকলেও তার রুচিবোধ আছে৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীভাবে বোঝা গেল, তোর ব্রেনে টিবি হয়েছে?’

‘আরে, প্রথম দিকে সকালে ঘুম থেকে উঠে ভীষণ মাথা যন্ত্রণা করত৷ ভাবলাম, সাইনাস হয়েছে৷ তখন তাই স্যারিডন খেয়ে নিতাম৷ যন্ত্রণা কমে যেত৷ পরে দেখলাম, ব্যথাটা সারাদিন ধরে থাকছে৷ বাঙ্গুর হাসপাতালেই ডাক্তার বাগচি লাম্বার পাংচার করার পর জানতে পারলেন, ফ্লুইডে টিবি জার্ম পাওয়া গিয়েছে৷ জার্ম নাকি মেরুদণ্ড বেয়ে মাথায় উঠেছে৷ লাম্বার পাংচার করার পর আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম৷ প্রায় এক সপ্তাহ মেমারি লস৷ আমি কে, তা বুঝতেই পারছিলাম না৷ সেই সময় গীতা পাশে না থাকলে আমার কী যে হত, জানি না৷ বিছানার পাশে বসে ও কেঁদেছে, কিন্তু ধৈর্য বা সাহস হারায়নি৷ শেষ পর্যন্ত আমাকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছে৷ ও খুব দুর্ভাগ্য, জানিস৷ আমাকে বিয়ে করে ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল৷’

বললাম, ‘এ সব কথা এখন ছাড়৷ ঠিক করে বল তো, গীতা তোকে কী বলে গিয়েছিল?’

প্রশ্নটা শুনে মুখটা বিষণ্ণ হয়ে গেল বিনয়ের৷ বলল, ‘আরে, বেশ কিছুদিন ধরেই ও বলছিল, আমি অসুস্থ থাকার সময় তারাপীঠের মায়ের কাছে মানত করেছে৷ সেই পুজো দিতে তারাপীঠ যাবে৷ আমি খুব একটা গা করছিলাম না৷ যা দিনকাল, তাতে ওকে একা এতদূর পাঠাতে আমার ইচ্ছে করছিল না৷ বারবারই বলছিলাম, আমি সুস্থ হলে তার পর সবাই মিলে যাব৷ জানিসই তো, পীঠস্থান হওয়া সত্ত্বেও তারাপীঠের আশপাশে কী হয়৷ সেই কারণে আমি গরজ দেখাচ্ছিলাম না৷ কিন্তু বেস্পতিবার কারখানা থেকে ফিরে এসে গীতা বলল, দিন তিনেক ওদের কারখানা বন্ধ থাকবে৷ মালিক নাকি বউ-বাচ্চা নিয়ে কার বিয়েতে মেদিনীপুরে যাবে৷ এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে না৷ আমি অনেক বারণ করেছিলাম, বুঝলি৷ বাচ্চাগুলোও চায়নি, মা একা যাক৷ কিন্তু টিকিট কেটে ফেলেছে বলে, আমাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে শুক্কুরবার রাতে ও বেরিয়ে গেল৷ তারপর থেকে আর কোনো খবর নেই৷’

‘গীতার কাছে মোবাইল ফোন নেই?’

‘আছে৷ যাওয়ার আগে সেটটা ও ঘরে রেখে গেল৷ কী বলল, জানিস? পাবলিক বুথ থেকে আমি না হয় তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারব৷ কিন্তু ফোনটা আমি নিয়ে গেলে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে কী করে? ফোনটা বরং রেখেই যাই৷’

‘গীতা কীভাবে তারাপীঠে গেছে, তুই জানিস? বাসে, না ট্রেনে?’

‘বাসে৷ এই গড়িয়া থেকে প্রতি শুক্কুরবার তারাপীঠ যাওয়ার একটা প্রাইভেট বাস ছাড়ে রাত বারোটায়৷ শনিবার পুজো দিয়ে লোকেরা আবার ওই বাসেই ফিরে আসে রবিবার সকালে৷ গীতা বাঘাযতীনের মোড় থেকে বাসে উঠেছিল৷ অত রাতে বিজয়গড় থেকে বাঘাযতীন অবধি যাতে যেতে পারে, তার জন্য পাড়ারই এক রিকশাওয়ালাকে আগে থেকে ও বলে রেখেছিল৷ সে-ই ওকে পৌঁছে দিয়েছে৷’

কথা বলার ফাঁকেই দশ-এগারো বছর বয়সি একটা মেয়ে সামনে এসে দাঁড়াল৷ হাতে চায়ের কাপ৷ ওকে দেখিয়ে বিনয় বলল, ‘এ আমার বড়ো মেয়ে উপাসনা৷ ছোটোটা মর্নিং স্কুলে পড়ে৷ মা নেই, দুটো মেয়ে খুব সমস্যার মধ্যে পড়েছে৷ গীতা ফিরে না এলে এরা ভেসে যাবে৷’

মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মন খুব খারাপ হয়ে গেল৷ খুব মিষ্টি দেখতে৷ কিন্তু পরনের ফ্রকটা মলিন৷ দিন তিনেক আগেও মায়ের স্নেহচ্ছায়ায় মানুষ হচ্ছিল৷ আচমকা সাংসারিক বিপর্যয়ে মেয়েটাকে কেমন যেন অসহায় দেখাচ্ছে৷ চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বললাম, ‘তুমি কোন ক্লাসে পড় উপাসনা?’

‘ক্লাস ফাইভ৷ আপনি তো কালকেতু আংকল, তাই না? আপনার কথা বাবা খুব বলে৷’

‘তাই নাকি? কী বলে?’

‘আপনার লেখা বেলুন রহস্য বইটা একদিন স্কুলের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে এসেছিলাম৷ দেখে বাবা বলল, কে লিখেছে জানিস? কালকেতু নন্দী…আমার ছোটোবেলার বন্ধু৷ গল্পটা আমার খুব ভালো লেগেছিল৷ আপনার আর একটা বইও আমি পড়েছি৷ মহারাজের আংটি চুরি৷ বইটা সুরজিতকাকু আমার জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল৷’

বিনয়কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সুরজিতকাকুটা কে রে?’

বিনয় বলল, ‘সুরজিত তরফদার৷ এই কাছেই থাকে৷ গলফ গার্ডেন্সে৷ ছেলেটা ফিজিওথেরাপিস্ট৷ ও-ই আমাকে সুস্থ করে তুলেছে৷ ওর একটা জিমন্যাসিয়াম আছে লেক গার্ডেন্সের মোড়ে৷ খুব পরোপকারী টাইপের ছেলে৷ গীতা ওকে খুব পছন্দ করে৷’

বিনয়ের শেষ কথাটা শুনে সুদীশ খুব অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল৷ তার পর বিনয়কে জিজ্ঞেস করল, ‘এই ছেলেটা কতদিন ধরে আপনার বাড়িতে যাতায়াত করছে মিঃ সরকার?’

‘তা, মাস ছয়েক তো বটেই৷ আগে সপ্তাহে তিন দিন করে আসত৷ এখন রোজই প্রায় একবার করে ঢুঁ মেরে যায়৷ নানা ব্যাপারে ও খুব হেল্প করে আমাদের৷’

‘শেষ কবে এসেছিল, আপনার মনে আছে?’

‘মনে হয়, গত শুক্রবার সন্ধেবেলায়৷ ও এলে মোটর বাইকে করে আসে৷ তাই ঘরে শুয়ে থাকলেও টের পাই৷ শুক্রবার অবশ্য ও আর ঘরে ঢোকেনি৷ বাইরে দাঁড়িয়ে গীতার সঙ্গে কথা বলেই চলে গিয়েছিল৷’

‘ছেলেটার কোনো ফোন নম্বর আছে আপনার কাছে?’

‘হ্যাঁ আছে৷ উপা দিতে পারবে৷’ কথাটা বলেই বিনয় মেয়েকে বলল, ‘ফোন নম্বরটা আংকলদের তুই দে৷ তোর তো মুখস্থ৷’

উপাসনা নম্বরটা বলতেই সুদীশ ওর মোবাইলে স্টোর করে নিল৷ তার পর বিনয়কে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন, বাইরের লোক এমন আর কেউ আছেন?’

‘অনেকেই যাতায়াত করেন৷ গীতা খুব মিশুকে ধরনের৷ খুব গুণীও৷ ভালো গান গাইতে পারে, নাচতে পারে৷ পাড়ায় কোনো ফাংশান হলে, প্রথমেই ওর ডাক পড়ে৷ পাড়ার বাচ্চারাও ওকে খুব ভালোবাসে৷ এ বাড়িতে পাড়ার লোকেরা তো আসেনই৷ তা ছাড়া, কারখানায় ওর সঙ্গে যারা কাজ করে, তারাও মাঝে মাঝে আসে৷ নিজের বউ বলে বলছি না, গীতা খুব আশ্চর্য মেয়ে৷ আমাদের সংসারে এখন এত অভাব, তা সত্ত্বেও মুখে ঠিক হাসিটা ফুটিয়ে রাখে৷ কাউকে ও বুঝতে দেয় না অভাবের কথা৷’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘গীতা কোথায় কাজ করে?’

‘আজাদগড়ে ছাপা শাড়ির একটা কারখানা আছে৷ এই…বাড়ির খুব কাছেই৷ ওখানে জরির কাজ, ফেব্রিকস, কাঁথা স্টিচ আর এমব্রয়ডারির কাজও হয়৷ গীতা সবগুলো কাজই পারে৷ কারখানার মালিক দিব্যেন্দু সাহা তাই ওকে খুব পছন্দ করেন৷ গতকাল টিভিতে বোধহয় গীতার ব্যাপারে কোনো খবর দেখিয়েছে৷ তারপর থেকে পাড়ায় খুব হইচই হয়ে গিয়েছে৷ দিব্যেন্দুবাবুও খোঁজ করতে এসেছিলেন৷ কিন্তু আমি তো অথৈ জলে৷ কিছুই বুঝতে পারছি না৷ সুদীশবাবু আপনি প্লিজ, গীতার খোঁজ এনে দিন৷ পুলিশ ইচ্ছে করলে কী না, পারে? আমার মনে হয়, ও কোনো বিপদের মধ্যে পড়েছে৷’

কথাগুলো এমনভাবে বলল বিনয়, শুনে মনটা ভারী হয়ে গেল৷ বাবার আর্তি শুনে উপাসনা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল৷ সেই মুহূর্তেই ঠিক করে নিলাম, যতটা পারি, এই কেসে সুদীশকে সাহায্য করব৷

তিন

কলকাতায় ফিজিওথেরাপিস্টদের একটা অর্গানাইজেশন আছে৷ তার সেক্রেটারি হলেন চন্দ্রমৌলি বসু৷ একটা খবর নিয়ে কিছুদিন আগে উনি আমার কাছে এসেছিলেন৷ বিনয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়েই ওই ভদ্রলোকের কথা আমার মনে পড়ল৷ চন্দ্রমৌলি নিশ্চয়ই চিনবেন সুরজিত তরফদারকে৷ উনিই ভালো আইডিয়া দিতে পারবেন, সুরজিত ছেলেটা কেমন? শনিবার থেকে ছেলেটা নাকি আর বিনয়বাবুর বাড়িতে যায়নি৷ তা হলে কি সুদীশের ধারণাটাই ঠিক? অসুস্থ বিনয়ের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য গীতা শেষ পর্যন্ত…ওই ছেলেটার সঙ্গে চলে গেল? আমার মন কিন্তু বলল, না৷ একটু আগে বিনয়ের কাছ থেকে যা শুনলাম, তাতে মনে হল, গীতার মতো মেয়েরা নিজের সুখটাকে বড়ো করে দেখে না৷

বাড়ি ফিরে চন্দ্রমৌলিকে ফোন করতেই উনি বললেন, ‘থ্যাংকস কালকেতুদা৷ আমাদের খবরটা ছাপার জন্য৷’

বললাম, ‘সেজন্য আপনাকে ফোন করিনি৷ সুরজিত তরফদার বলে কাউকে কি আপনি চেনেন?’

চন্দ্রমৌলি বললেন, ‘চিনব না কেন? ও আমাদের এক্সিকিউটিভ কমিটির মেম্বার৷’

‘ছেলেটা কী রকম?’

‘পড়ালেখা জানা ছেলে৷ থাকে যোধপুর পার্কের দিকে৷ আমেরিকা থেকে একটা ট্রেনিং কোর্স করে এসেছে৷ ওর জিমন্যাসিয়ামটা খুব ভালো কালকেতুদা৷ আমার তো মনে হয়, সাউথ ক্যালকাটার বেস্ট৷ আমেরিকায় গোল্ড জিমন্যাসিয়াম বলে বিখ্যাত একটা কোম্পানি আছে৷ ও তার ফ্রাঞ্চাইজি নিয়েছে…৷’

চন্দ্রমৌলিবাবু আরও অনেক কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু আমি বাধা দিয়ে বললাম, ‘সুরজিত ছেলেটাকে আমার খুব দরকার৷ ফোন করা সত্ত্বেও ওকে ধরতে পারছি না৷ প্রতিবারই বলছে, আউট অফ রিচ৷ ও কি কলকাতায় আছে, না বাইরে কোথাও গিয়েছে? খোঁজ করে আপনি আমাকে জানাবেন?’

‘এই সময়টায় ওকে ফোনে পাবেন না কালকেতুদা৷ নিজে ওয়ার্ক আউট করে৷ জিম-এ ছেলে-মেয়েদের নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে৷ যত শিগগির সম্ভব ওকে ধরে আপনার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছি৷ ওকে কি বলব, যাতে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে?’

‘তা হলে খুব ভালো হয়৷ একটা ইনভেস্টিগেশনের জন্য ওর সঙ্গে কথা বলা খুব দরকার৷ এখন এই স্টেজে সে ব্যাপারে আপনাকে কিছু বলা সম্ভব না৷ ওকে আপনিও বলবেন না, আমি কেন ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইছি৷’ বলেই আমি ফোনটা ছেড়ে দিলাম৷

আজ বাড়িতে অবশ্য কেউ নেই৷ আমার স্ত্রী ফুল্লরা দু-দিন আগে নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছে, কী এক অনুষ্ঠানের জন্য৷ অফিস যাওয়ার তাড়া নেই৷ স্নান সেরে পোশাক বদলে তাই বারান্দায় গিয়ে বসলাম খবরের কাগজগুলোতে চোখ বুলিয়ে নেওয়ার ইচ্ছায়৷ বারান্দার পূর্ব দিকেই সাউথ সিটি মল আর আবাসন৷ ছত্রিশ তলা বাড়িগুলোতে অসংখ্য খোপ খোপ ফ্ল্যাট৷ রাতের বেলায় যখন ওই খোপগুলোতে আলো জ্বলে, তখন দারুণ দেখতে লাগে৷ বাড়িগুলো হওয়ার আগে সূর্যদেবকে অনেক তলায় দেখতে পেতাম৷ কিন্তু এখন দেখি, বেলা দশটা-সাড়ে দশটায়৷ বৃষ্টির দিনে বারান্দায় বসে যখন সাউথ সিটির দিকে তাকাই, তখন মনে হয়, মেঘ টাওয়ারগুলোর ছাদ পর্যন্ত নেমে এসেছে৷

বারান্দায় বসে কাগজে চোখ বোলানোর সময় একটা হেডিং নজরে পড়ল৷ ‘মুখে বিষ ঢেলে স্বামীকে খুনের নালিশ আমোদপুরে’৷ তাড়াতাড়ি খবরটা পড়তে শুরু করলাম৷ ঘুমন্ত স্বামীর মুখে বিষ ঢেলে খুন করার দায়ে আমোদপুর থেকে এক শিক্ষিকাকে গ্রেফতার করল পুলিশ৷ ধৃত শিক্ষিকার নাম নিবেদিতা ঢালি৷ সোমবার রাতে বিষক্রিয়ায় তাঁর স্বামী জয়দেব ঢালির মৃত্যু হয়৷ জয়দেবের বাবা পঞ্চানন ঢালি মঙ্গলবার দেগঙ্গা থানায় তাঁর বউমার বিরুদ্ধে নালিশ করেন৷ পুলিশের জেরায় অপরাধ স্বীকার করেন ওই শিক্ষিকা৷ খুনের কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷

ছয় কলাম জুড়ে খবর৷ জয়দেবের বয়স খুব বেশি নয়৷ মাত্র একত্রিশ বছর৷ ভালোবেসে ও বিয়ে করেছিল নিবেদিতাকে৷ দুজনের একটা পুত্র সন্তানও আছে বছর দেড়েকের৷ পারিবারিক অশান্তির জন্য পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে জয়দেব বউকে নিয়ে আলাদা বাড়ি ভাড়া করে আমোদপুরে চলে যায়৷ ও তখন একটা টিভি চ্যানেলে অস্থায়ী ক্যামেরাম্যানের কাজ করত৷ এখন বন্ধক রাখার ব্যবসা করে৷ এদিকে, বিয়ের পর দীর্ঘদিন স্কুলে গরহাজির থাকার জন্য নিবেদিতার মাইনে বন্ধ হয়ে যায়৷ ওর বেতন চালু করার জন্য জয়দেব অনেক তদ্বির করেছিল জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদে৷ কিন্তু চালু করতে পারেনি৷ নিবেদিতা দোষারোপ করতে থাকে, এত তাড়াতাড়ি ও গর্ভবতী হতে চায়নি৷ গর্ভবতী হওয়ার জন্য ও স্কুলে যেতে পারেনি৷ স্কুলে বেতন বন্ধ হওয়ার জন্য দায়ী জয়দেবই৷

এ নিয়ে জয়দেবের সঙ্গে প্রায়ই ওর ঝগড়া হত৷ তারই পরিণতি এই খুন৷ খবরটা পড়ে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম৷ সত্যিই কি এই একটা কারণে নিবেদিতা খুন করেছে? নাকি আরও কেউ আছে ওর সঙ্গে? বা অন্য কোনো কারণ আছে এর পিছনে? আমোদপুর থেকে যে ছেলেটা এই রিপোর্ট লিখেছে, তার নাম সিরাজুল ইসলাম৷ সে জয়দেব আর নিবেদিতাদের বাড়িতেও গিয়েছিল কারণটা জানতে৷ প্রতিবেশীদের একজন বলেছে, শনিবার দুজনে তারাপীঠে গিয়েছিল৷ রবিবার ফিরে আসার পর খুব ঝগড়াঝাঁটি হয় ওদের মধ্যে৷ দরজা বন্ধ থাকায় বুঝতে পারা যায়নি, ঝগড়ার কারণটা কী?

নিবেদিতার বাবা গুরুপদবাবু বর্ধমান কোর্টের উকিল৷ সিরাজুল তাঁর সঙ্গেও কথা বলেছিল৷ উনি বলেছেন, চার বছর আগে বাড়ির অমতে নিবেদিতা বিয়ে করে৷ তার পর থেকে মেয়ের আর কোনো খোঁজ তিনি রাখেন না৷ একই উত্তর দিয়েছেন জয়দেবের বাবা পঞ্চাননবাবু৷ জয়দেব আলাদা হয়ে যাওয়ার পর তিনি পারতপক্ষে এড়িয়ে যেতেন ছেলেকে৷ দেড় বছরের বাচ্চাটাকে পুলিশ প্রথমে গুরুপদবাবু, তার পর পঞ্চাননবাবুর কাছে পৌঁছে দিতে গিয়েছিল৷ কিন্তু ওঁরা কেউ রাখতে রাজি হননি৷ তাই বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়েই নিবেদিতা পুলিশ হাজতে গিয়েছে৷

বাচ্চাটার কথা ভেবে সত্যিই মন খারাপ হয়ে গেল৷ আমোদপুর জায়গাটার নাম আমি আগে শুনেছি৷ পুজোর সময় একবার আমি গিয়েওছিলাম, আমোদপুরের ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে তেঁতুলবাড়ি মল্লিকবাড়িতে৷ প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো দুর্গাপুজো৷ আসলে জায়গাটার নাম আহমেদপুর৷ কিন্তু লোকের মুখে মুখে আমোদপুর হয়ে গিয়েছে৷ ওখানে কয়েকটা সুগার ফ্যাক্টরিও আছে৷ আমোদপুরের রেল স্টেশনের কাছটা খুব জমজমাট৷ কে যেন বলেছিল, কাছাকাছি সতীর এক পীঠস্থানও রয়েছে৷ নন্দীকেশ্বরী মন্দিরে৷

আমি জানি, আমোদপুরের পুলিশ সত্যসন্ধানে খুব বেশি সময় খরচ করবে না৷ নিবেদিতা অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে৷ ব্যস, পুলিশের কাজ শেষ৷ ঠান্ডা মাথায় স্বামীকে খুন করার অপরাধে ওর চোদ্দো বছরের জেল হয়ে যাবে৷ দাম্পত্য ঝগড়ায় তিনটে জীবন নষ্ট৷ পুরো রিপোর্ট পড়ে আমার কিন্তু মনে হল, খুনের পদ্ধতি নিয়ে কোথাও একটা গ্যাঁজামিল রয়েছে৷ জয়দেবকে ঘুমন্ত অবস্থায় বিষ দিতে যাবে কেন নিবেদিতা? ইচ্ছে করলে তো ও খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিতে পারত৷ সেই কাজটা ওর পক্ষে অনেক সহজ ছিল৷ কী ধরনের বিষ ও প্রয়োগ করেছিল, সেটা অবশ্য কাগজে লেখেনি৷ সেটা পোস্ট-মর্টেম না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না৷ আমার মন বলতে লাগল, নিবেদিতা হয় কাউকে বাঁচানোর জন্য পুলিশের কাছে মিথ্যে কথা বলেছে, না হয়তো কারও ভয়ে মুখ বন্ধ করেছে৷

কথাটা ভাবতে ভাবতেই বারান্দা থেকে উঠে এলাম৷ মোবাইল ফোনটা ফেলে রেখে গিয়েছিলাম বেডরুমে৷ হঠাৎ মনে হল, চন্দ্রমৌলিবাবুর ফোন করার কথা ছিল৷ সুরজিত তরফদার সম্পর্কে তথ্য দেবেন৷ এখনও ফোন করলেন না কেন? নাকি ফোন উনি করেছেন, আমি শুনতে পাইনি৷ মোবাইল সেটে চোখ বোলাতেই দেখলাম, হ্যাঁ, মিসড কল আছে৷ ফের চন্দ্রমৌলিবাবুকে ফোন করতেই উনি বললেন, ‘হ্যাঁ কালকেতুদা, সুরজিতের খোঁজ নিয়েছি৷ ও তো এখন নার্সিংহোমে৷’

বললাম, ‘কেন, ওর কী হয়েছে?’

‘আর বলবেন না৷ বহুবার ওকে বারণ করেছি৷ মোটর বাইক জোরে চালিও না৷ কিন্তু কে শোনে কার কথা? শুক্রবার সন্ধেবেলায় ও বিজয়গড়ে কারও বাড়িতে গিয়েছিল৷ ফেরার সময় ২৩৪ নম্বর বাসের সঙ্গে এমন অ্যাক্সিডেন্ট করেছে যে, পায়ে মারাত্মক চোট পেয়েছে৷ ও এখন ইডিএফ নার্সিংহোমে ভরতি আছে৷ পায়ে প্লাস্টার৷ ডাক্তার নাকি বলেছেন, ছয় সপ্তাহের আগে উঠে চলে বেড়াতে পারবে না৷ অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার সময় ওর মোবাইল ফোনটা ছিটকে কোথাও পড়ে গিয়েছিল৷ সেই কারণেই ওকে আপনি ধরতে পারেননি৷ আপনি যে ওকে খুঁজছেন, সেটা ওকে বলেছি৷ আজ বিকেলে ওকে দেখতে আমি ইডিএফে যাব৷ তখন আমার ফোনেই আপনার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব৷’

‘ঠিক আছে৷’ বলে ফোনটা ছেড়ে দিলাম৷ সুদীশের সন্দেহের তালিকা থেকে এক নম্বর লোকটা বাদ চলে গেল৷ এবার দেখা যাক, বাকি সন্দেহভাজনদের কীভাবে বাদ দেওয়া যেতে পারে!

চার

আমার ফোন কল ধরেই তথাগত বলল, ‘আমোদপুরে খুনের খবরটা আমাদের কাগজে আজ দেখেছেন কালকেতুদা?’

বললাম, ‘হ্যাঁ দেখেছি৷ লেখাটা কি তোর?’

‘হ্যাঁ৷ খবরটা সিরাজুল পাঠিয়েছিল৷ আমি এডিট করেছি৷ খুব ইন্টরেস্টিং কেস৷ খবরটা ও সন্ধেবেলার দিকে পাঠিয়েছিল৷ তাই ঠিকমতো ফলো আপ করতে পারেনি৷ ওকে আমি কয়েকটা পয়েন্ট বলে দিয়েছি৷ আজ ভালো করে লিখে পাঠাবে৷’

তথাগত আমাদের ক্রাইম রিপোর্টার৷ কলকাতা পুলিশ আর জেলা পুলিশের কর্তাদের সঙ্গে ওর ভালো যোগাযোগ রয়েছে৷ খুব বুদ্ধিমান ছেলে৷ মাঝে মাঝে ওকে আমার কাজেও লাগাই৷ বেসিক ইনফর্মেশনগুলো এনে দেয়৷ আমোদপুরের কেসটা নিয়ে কীভাবে ও ফলো আপ করতে বলেছে, সেটা পরীক্ষা করার জন্য জানতে চাইলাম, ‘তোর কি মনে হয়, নিবেদিতা বলে মেয়েটা ওর স্বামীকে খুন করেছে?’

তথাগত বলল, ‘আমার মনে হয় না কালকেতুদা৷ অন্য কোনো ব্যাপার আছে৷ সিরাজুল কাল মুখে যা বলছিল, তাতে আমার মনে হচ্ছিল, জয়দেব ছেলেটা খুব একটা সুবিধের নয়৷ ওই অঞ্চলে ওর খুব বদনাম আছে৷ আজ ও ফলো আপ স্টোরি পাঠাবে৷ দেখি, কী লেখে!’

শুনে মনে মনে খুশি হলাম আমার ধারণার সঙ্গে ওর ধারণা মিলে গিয়েছে দেখে৷ চার-পাঁচ বছর ধরে তথাগত ক্রাইম রিপোর্টিং করছে৷ অপরাধ জগত সম্পর্কে ওর খানিকটা আন্দাজ হয়েছে৷ একটা অপরাধের ঘটনা ঘটলে, কোন লাইনে কভারেজ করতে হবে, সেটা নির্ভর করে রিপোর্টারের বোধবুদ্ধির উপর৷ তথাগতর সেই বিচার ক্ষমতা আছে৷ ছেলেটার বয়স বেশি না৷ সাতাশ-আঠাশের নীচেই হবে৷ এম এসসি পাশ৷ পুলিশে গেলে ভালো করত৷ ওকে অনেকবার বলেছি, আইপিএস পরীক্ষা দিতে৷ কিন্তু রিপোর্টিং ওর মজ্জায় ঢুকে গিয়েছে৷ সেখান থেকে ও আর বেরিয়ে আসতে পারছে না৷

তথাগতকে ফোনটা করেছি, ওর সাহায্য নেওয়ার জন্য৷ ওর বাড়ি গান্ধি কলোনিতে৷ তার মানে আজাদগড়ের খুব কাছে৷ বললাম, ‘তুই কি বাড়িতে, না বেরিয়ে পড়েছিস?’

‘বেরোনোর জন্য তৈরি হচ্ছি কালকেতুদা৷ কেন, কোনো দরকার আছে?’

‘হ্যাঁ, আমার একটা কাজ করে দিতে পারবি?’

উৎসাহের সঙ্গে তথাগত বলল, ‘নতুন কোনো কেস নাকি?’

‘হ্যাঁ, আজই সুদীশ কেসটা আমায় দিয়েছে৷ তোর বাড়ি থেকে আজাদগড় কত দূরে রে?’

‘খুব বেশি দূরে না৷ কেন কালকেতুদা?’

‘ওখানে কি ছাপা শাড়ির কোনো কারখানা আছে?’

‘হ্যাঁ৷ রীণা ফেব্রিকস৷ যাতায়াতের পথে আমার চোখে পড়ে৷’

‘আমার সঙ্গে ওখানে একবার যেতে পারবি? মালিকের নাম দিব্যেন্দু সাহা৷ ভদ্রলোক সম্পর্কে তো বটেই, ওই কারখানায় যারা কাজ করে, তাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে খবর নিতে হবে৷’ কথাগুলো বলেই গীতা সরকারের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা তথাগতকে জানালাম৷

তথাগত বলল, ‘এখনই চলুন তা হলে৷ আপনি আজাদগড়ের মোড়ে চলে আসুন৷ দেখবেন, ওখানে একটা অ্যাক্সিস ব্যাংকের এটিএম আছে৷ ওখানেই আমি ওয়েট করব৷’

হাতঘড়িতে দেখলাম প্রায় বারোটা বাজে৷ বললাম, ‘দশ মিনিটের মধ্যে আমি আসছি৷’

সেদিন বিনয়ের মুখে শুনেছি, গীতা প্রায় বছর তিনেক ধরে কাজ করছে শাড়ির কারখানায়৷ সবার সঙ্গেই ওর সম্পর্ক খুব ভালো৷ মালিক দিব্যেন্দুবাবু নাকি মাটির মানুষ৷ আপদ-বিপদে পাশে এসে দাঁড়ান৷ বিনয় অসুস্থ হওয়ার পর বেশ কয়েকবার নাকি দিব্যেন্দুবাবু আর্থিক সাহায্য করেছেন৷ স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে উনি একবার দেখতেও গিয়েছিলেন বিনয়কে৷ গতকাল সুদীশের লোক ওঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল৷ উনি গীতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন৷ গীতা নাকি কোনোদিন কামাই করত না৷ ওর হাতের কাজ নাকি অসামান্য৷ কারখানার অন্য কর্মীরা বেলা দশটার সময় ডিউটিতে আসে৷ কিন্তু গীতার কাজে খুশি হয়ে দিব্যেন্দুবাবু ওকে বেলা বারোটা থেকে রাত্তির আটটা পর্যন্ত ডিউটি আওয়ার্স করে দিয়েছিলেন৷

সাত-আট মিনিটের মধ্যেই আজাদগড়ে পৌঁছে গেলাম৷ দেখি, এটিএম ব্যাংকের সামনে তথাগত দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ আমাকে দেখেই বলল, শাড়ির কারখানাটা হাঁটার দূরত্বে৷ তাই গাড়িটা পার্ক করে হাঁটতে হাঁটতেই দুজনে রীণা ফেব্রিকসে পৌঁছে গেলাম৷ কারখানার গেটের সামনে বিরাট তিনটে নারকেল গাছ অদ্ভুতভাবে এঁকেবেঁকে আকাশের দিকে উঠে গিয়েছে৷ একবার কারখানায় এলে গাছগুলোর কথা কেউ ভুলতে পারবে না৷ কারখানায় লম্বা অ্যাসবেস্টার্সের শেড৷ কুড়ি-বাইশজন মেয়ে বসে নানা ধরনের কাজ করছে৷ কেউ সেলাই কল চালাচ্ছে৷ কেউ কাটিং করছে৷ কেউ সূঁচ দিয়ে এমব্রয়ডারির কাজ৷ একজনকে জিজ্ঞেস করায় সে দিব্যেন্দুবাবুর ঘরটা দেখিয়ে দিল৷ তার আগেই কাচের পার্টিশন দিয়ে আমাদের দেখতে পেয়েছিলেন উনি৷ শশব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘কালকেতুবাবু আপনি এখানে?’

ভদ্রলোকের বয়স যত ভেবেছিলাম, তার চেয়ে অনেক কম৷ চল্লিশের নীচে৷ গায়ের রং কালো হলেও সুদর্শন, পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা৷ গলায় সোনার মোটা চেন৷ আঙুলে বেশ কয়েকটা পাথর বসানো আংটি৷ দেখেই মনে হয়, ভদ্রলোক জ্যোতিষে বিশ্বাস করেন৷ এবং ভালো পয়সাকড়ি আছে৷ বললাম, ‘আমাকে আপনি চেনেন?’

দিব্যেন্দুবাবু বললেন, ‘আপনাকে কে না চেনে? টিভিতে তো প্রায়ই আপনাকে দেখি৷ আপনার লেখা গোয়েন্দা গল্পের খুব ফ্যান আমার ওয়াইফ৷ ঠিক বুঝতে পারছি না, আপনি কেন আমার এখানে৷’

‘আমি গীতা সরকারের ব্যাপারে জানতে এসেছি৷’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ৷ গীতাদি একবার আপনার কথা আমার ওয়াইফকে বলেছিল বটে৷ এখন মনে পড়ছে৷ কিন্তু গীতাদি সম্পর্কে কী জানতে চান বলুন৷ আমার কারখানায় দুটো শিফটে প্রায় চল্লিশজন মেয়ে কাজ করে৷ তাদের মধ্যে সবথেকে গুণী গীতাদি৷ ওঁর কাঁথা স্টিচের কাজ পড়ে থাকে না৷ শোরুমে ফেলতে না ফেলতেই বিক্রি হয়ে যায়৷ নামকরা ডিজাইনাররা পর্যন্ত নিয়ে যান৷ গীতাদির ক্রিয়েটিভ সেন্স দেখে আমি নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই৷ ওঁর হাতের কাজ দেখে কলকাতার এক নামী ফ্যাশন ডিজাইনার তো উত্যক্ত করে মারছে৷ প্রথমে টোপ দিয়েছিল, ডাবল মাইনে দেবে৷ ওঁকে নিজের ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু গীতাদি আমাদের ছেড়ে যায়নি৷ সেই ফ্যাশন ডিজাইনারের লোক এখন গীতাদিকে ভয় দেখাচ্ছে৷ মাঝে নাকি একদিন ওঁকে ভয় দেখিয়েছিল৷ আমার ওয়াইফ সেটা থানায় জানাতে বলেছিল৷ কিন্তু গীতাদি রাজি হয়নি৷ এখন দেখছি, থানায় না জানিয়ে ভুল করেছি৷’

ভদ্রলোক তিনবার নিজের স্ত্রীকে ওয়াইফ বললেন৷ তার মানে, পরিবারের শিকড় ওপার বাংলায়৷ সে যাই হোক, দিব্যেন্দুবাবু নতুন একটা খবর দিলেন৷ একজন ফ্যাশন ডিজাইনারের লোক গীতাকে ভয় দেখিয়েছিল৷ কে সেই ডিজাইনার? তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘পুলিশ যখন আপনার কাছে আসে, তখন এই ব্যাপারটা কি আপনি ওদের বলেছিলেন?’

‘না কালকেতুবাবু, কী দরকার ফালতু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার৷ আমি আর আমার ওয়াইফ দিল্লি থেকে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে কোর্স করে এসেছি৷ আমরা জানি, গ্ল্যামার জগৎটা কী ভয়ানক জায়গা৷ ফ্যাশন ডিজাইনারদের মধ্যে কী ধরনের আকচা-আকচি৷ আমাদের চোখেও অনেক বড়ো স্বপ্ন ছিল কালকেতুবাবু৷ কিন্তু আমাদের পুঁজি অল্প বলে ছোট্ট কারখানা খুলেই সন্তুষ্ট রয়েছি৷ তবে এখন আমাদের খুব ভালো লাগে যখন ভাবি, কয়েকটা দরিদ্র পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা তো করতে পেরেছি৷ সেটাই বা কম কিসে?’

‘গীতাকে যিনি ভয় দেখিয়েছিলেন, তিনি কে দিব্যেন্দুবাবু?’

‘ওরে বাব্বা, নামটা আবার আপনি যেন লিক করে দেবেন না৷ তা হলে কিন্তু উনি আমার কারখানাটা তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন৷ টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ড্রেস সাপ্লাই নিয়ে একবার আমার সঙ্গে লোকটার একটা ছোটোখাটো টক্কর হয়ে গিয়েছে৷ আমি বাপ বাপ বলে পালিয়ে এসেছি৷ তখনই বুঝতে পেরেছি, ওঁর হাত কত লম্বা…৷’

বাধা দিয়ে বললাম, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন৷ নামটা বলুন৷ গীতার নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে এই ভয় দেখানোর কোনো সম্পর্ক আছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখা দরকার৷ লোকটাকে জানিয়ে দেওয়া দরকার, আমাদের হাতও কম লম্বা নয়৷’

‘রাকেশ ভাটিয়া৷ নামটা নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন মিডিয়াতে৷’

শুনে একটু অবাকই হলাম৷ রাকেশ ভাটিয়া খুব নামকরা ডিজাইনার৷ ওঁর সম্পর্কে কয়েকদিন আগে একটা লেখা পড়েছিলাম ফ্যাশন উইকলি বলে একটা ম্যাগাজিনে৷ রাকেশ ভাটিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বীরা হলেন রীণা লুথরা, মণীশ মলহোত্রা, রোহিত বাল, মিতা লুল্লা, রকি এস, সব্যসাচী মুখার্জিরা৷ কিন্তু ওঁর মতো একজন সেলেব্রিটি ডিজাইনার গীতার মতো সামান্য হাতের কাজ জানা মেয়ের পিছনে দৌড়বেন কেন? না, এ হতেই পারে না৷ নিশ্চয়ই ওঁর নাম করে অন্য কেউ গীতাকে ভয় দেখিয়েছে৷ তাই বললাম, ‘আপনি শিয়োর রাকেশ ভাটিয়ার লোক গীতাকে ভয় দেখিয়েছিল?’

‘আমি ড্যাম শিয়োর৷ তিলজলায় ওঁর বিশাল কারখানা৷ ক্যামাক স্ট্রিটে শোরুম৷ গীতাদিকে একবার সেখানে ডেকেও নিয়ে গিয়েছিল৷ দাঁড়ান, ওঁর সঙ্গে সেদিন আমার কারখানার ম্যানেজার বিক্রমও গিয়েছিল৷ ওকে ডাকছি…ওকে জিজ্ঞেস করলেই পুরো ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে৷’ কথাগুলো বলেই বেল বাজালেন দিব্যেন্দুবাবু৷ একটা মেয়ে ঘরে ঢুকতেই উনি বললেন, ‘পিয়া, দেখো তো ম্যানেজারবাবু গোডাউনে আছে কিনা৷ বলো, আমি অফিস ঘরে ডাকছি৷’

একটু পরেই তথাগতর বয়সি একটা ছেলে ঘরে এসে ঢুকল৷ গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা৷ পরনে জিনসের প্যান্ট, হলুদ টি-শার্ট৷ এই তা হলে বিক্রম? দিব্যেন্দুবাবু পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইনি গীতাদির ব্যাপারে খোঁজ করতে এসেছেন৷ তুমি এঁকে বলো, রাকেশ ভাটিয়ার লোক ওঁকে ভয় দেখিয়েছিল কিনা৷’

স্পষ্ট দেখলাম, শুনে মুখের রং একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেল বিক্রমের৷ কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দ্রুত নিজেকে ছেলেটা সামলে নিল৷ তার পর বলল, ‘না, সেরকম কিছু না৷ তবে গীতাদি ওদের অ্যাগ্রেসিভ অ্যাটিচুড দেখে মারাত্মক ভয় পেয়ে গিয়েছিল৷’

পাঁচ

খানিকক্ষণ কথা বলেই বুঝতে পারলাম, নাম বিক্রম হলেও ছেলেটা একেবারে ভীতুর ডিম৷ নিজেই খুব কনফিউজড৷ কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না৷ ঘরে ঢুকেই স্যার স্যার বলতে শুরু করল৷ দেখেই মনে হল, মালিকের সামনে ওর মুখ খোলানো যাবে না৷ তাই দিব্যেন্দুবাবুকে বলেছিলাম, বিক্রমের সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চাই৷ শুনে সঙ্গে সঙ্গে ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন উনি৷

বাজারে এত দক্ষ লোক থাকতে রাকেশ ভাটিয়া কেন গীতার পিছনে লেগে ছিলেন ভাই? তুমি জানো? প্রশ্নটা করায় বিক্রম বলল, ‘অনেক কারণ৷ গীতাদি কাঁথা স্টিচের কাজটা খুব ভালো জানত৷ নতুন নতুন জিনিস ভাবতে পারত৷ গীতাদি রিভার্স কাঁথা স্টিচ বলে একটা কাজ করতে পারত, যেটা খুব কম কারিগরই করতে পারে৷ রাকেশ ভাটিয়ার আড়কাঠিরা আমাদের এখান থেকে রিভার্স কাঁথা স্টিচের একটা শাড়ি কিনে নিয়ে গিয়েছিল মাস ছয়েক আগে৷ সেটার খুব চাহিদা হয়৷ আমি যদ্দূর জানি, তার পর থেকেই ওরা গীতাদিকে টোপ দিতে শুরু করে৷ এমন কারিগর পাবে কোথায়?’

‘গীতা ওদের ওখানে গেল না কেন?’

‘দুটো কারণে৷ এক, তখন গীতাদির হাসবেন্ড খুব অসুস্থ৷ তিলজলায় ওদের ফ্যাক্টরিতে যাতায়াত করা মানে দিনের অনেকটা সময় চলে যাওয়া৷ হাসবেন্ডের জন্য তা হলে সময়ই দিতে পারত না৷ সেদিক থেকে আমাদের এই কারখানা ওর বাড়ি কাছে৷ আর মালিকও নরম মনের মানুষ৷ এমনও হয়েছে জানেন, বিনয়দা হাসপাতালে থাকার সময় গীতাদি দিনের পর দিন কাজে আসতে পারেনি৷ তবুও মালিক কিছু বলেনি৷ নিয়মিত মাইনে দিয়ে গিয়েছে৷ আর দ্বিতীয় কারণটা হল, দিবেন্দু সাহার বড়ো একটা গুণ হল, অন্য মালিকদের মতো শোষণ করে না৷ কাজের দাম দেয়৷ এটা গীতাদি নিজের মুখেও স্বীকার করতেন৷’

‘অন্য মালিকরা শোষণ করে…মানে?’

‘ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের পুরো ব্যবসাটাই চলে শোষণের উপর৷ ধরুন, দিন পনেরো খুব খেটে গীতাদি…কাঁথা স্টিচের যে শাড়িটা বানিয়ে দিলেন, সেটা রাকেশ ভাটিয়ারা আমাদের এখান থেকে কিনে নিয়ে যাবেন হয়তো দেড় হাজার টাকায়৷ কিন্তু নিজের শোরুমে সেটাই বিক্রি করবেন পাঁচ হাজার টাকায়৷ এক একটা শাড়িতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা লাভ৷ কী ধরনের এক্সপ্লয়টেশন শুনবেন? আমি জানি, ভাটিয়ার লোক কাঁথা স্টিচের কাজ করার জন্য তিনটে শাড়ি গীতাদির বাড়িতে দিয়ে গিয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে৷ রাত জেগে সেই শাড়ি করে দিয়েছিল গীতাদি৷ ওরা মাত্র ছয়শো টাকা ঠেকিয়েছে৷ ওই শাড়িগুলো কম করেও ভাটিয়ারা বিক্রি করেছে সাত-আট হাজার করে৷ ওই অল্প টাকা পেয়ে গীতাদি কাঁদতে বাকি রেখেছিল তখন৷ এক্সট্রা কাজটা কিন্তু নিয়েছিল, বিনয়দার ট্রিটমেন্টের খরচ জোগাড়ের জন্য৷’

‘গীতা যেদিন ভাটিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যায়, সেদিন কি তুমি ওর সঙ্গে গিয়েছিলে?’

‘আসলে আমি যেতে চাইনি৷ আমাদের মালিকই জোর করে পাঠিয়েছিলেন৷ আমরা ক্যামাক স্ট্রিটের শোরুমে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু কার সঙ্গে গীতাদির কথা হয়েছিল, আমার দেখার সুযোগ হয়নি৷ আমাকে বাইরে বসিয়ে রেখে গীতাদি ঘরের ভিতর গিয়েছিল৷ শোরুম থেকে বেরিয়ে আমায় যা বলেছিল, সেটুকুই আমি জানি৷ তার বেশি বলতে পারব না৷’

‘কী বলেছিল গীতা?’

‘বলেছিল, প্রথমে নাকি ভালো-ভালো কথা বলেছিল ভাটিয়ার লোক৷ তার পর হুমকি দেয়৷ ওদের হয়ে কাজ না করলে শেষ করে দেবে৷ একা গীতাদিকে নয়, পুরো ফ্যামিলিকে৷ স্যার, এ সব কথা আমি আপনাকে বলেছি জানলে ভাটিয়ার লোক আমার বাড়িতে গিয়ে চড়াও হবে৷’

‘তুমি কোথায় থাকো বিক্রম?’

‘এই তো কাছেই রানিকুঠিতে৷ ভাড়া থাকি৷ আসলে আমি আমোদপুরের ছেলে৷ ওখানে আমাদের বাড়ি আর খেতি আছে৷ সে সব দেখাশোনো করেন আমার বাবা আর দাদারা৷’

আমোদপুরের নামটা শুনে একবার ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করি, জয়দেব ঢালি বলে কাউকে চেনে কিনা? কিন্তু জানতে চাইলাম, ‘গীতার সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা কেমন ছিল বিক্রম?’

প্রশ্নটা শুনে একটু চমকে উঠল যেন বিক্রম৷ বলল, ‘খুব ভালো সম্পর্ক স্যার৷ কারখানা থেকে আমরা প্রায় একই সময়ে বেরোতাম৷ ভাটিয়ার লোকরা যাতে ওকে রাস্তায় বিরক্ত করতে না পারে, সেজন্য গীতাদিই চাইতেন আমি ওঁকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিই৷ আমার উপর খুব আস্থা ছিল গীতাদির৷ নানা ব্যাপারে আমার পরামর্শ নিতেন৷ খুব দুঃখের জীবন স্যার৷ বিনয়দা ভালো হয়ে উঠলেন, তো আর একটা ঝামেলা শুরু হল৷ এই কয়েকদিন আগে ওঁর বড়ো মেয়ে উপাকে বিরক্ত করছিল পাড়ার একটা ছেলে৷ জানার পর গীতাদি রাস্তায় ধরে একটা চড় মারেন সেই ছেলেটাকে৷ ভাবুন, কী দিনকাল হয়েছে৷ তেরো-চোদ্দো বছরের একটা মেয়ে…নাবালিকা, তাকেও স্বস্তিতে থাকতে দেবে না৷ আমি শুনেছি, সেই ছেলেটা নাকি বাড়ি বয়ে এসে শাসিয়ে গিয়েছিল, উপাকে দেখে নেবে৷ গীতাদি আমাকে সেদিনই বলেছিলেন, আর নিতে পারছি না ভাই৷ এবার ভাবছি, দু-চোখ যেখানে যায়, চলে যাব৷ ইদানীং এই কথাটা প্রায় বলতেন৷ আমি তখন বুঝিয়ে বলতাম, বিনয়দা আর মেয়ে দুটোকে ছেড়ে আপনি থাকতে পারবেন না গীতাদি৷ বিনয়দা কাজে বেরোলেই দেখবেন, সব ঠিক হয়ে যাবে৷’

‘এখানে আর কার সঙ্গে গীতার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল? মানে…কার সঙ্গে মন খুলে কথা বলত?’

‘সে আমি বলতে পারব না স্যার৷ গীতাদি অনেকের সঙ্গেই মেলামেশা করতেন৷ রাধাপদ নন্দী বলে একজন আছেন৷ উপাকে পড়াতে রোজ উনি গীতাদির বাড়িতে যেতেন৷ আপনি তাঁর সঙ্গে একবার কথা বলতে পারেন৷ ভদ্রলোক ব্যাচেলর, থাকেন নেতাজিনগর কলেজের কাছেই৷ ওখানে মাস্টার বললে সবাই ওঁকে চিনতে পারবেন৷ বিনয়দা যখন হাসপাতালে, তখন নাকি রাধাপদবাবু রোজ রাতের বেলায় গীতাদির বাড়িতে এসে পাহারা দিতেন৷ গীতাদি একবার আমায় বলেছিলেন, ভদ্রলোকের সঙ্গে নাকি ওঁদের কী একটা আত্মীয়তা আছে৷ আমার অবশ্য বিশ্বাস হত না৷ তবে বিপদের দিনে উনি যে টাকা- পয়সা দিতেন, তা নিজের চোখে আমি দেখেছি স্যার৷’

‘ভদ্রলোক এখন উপাকে পড়ান না?’

‘না৷ দিনসাতেক আগে পাড়ার সেই ঝামেলার সময় ভদ্রলোক…গীতাদির পক্ষ নিয়ে কথা বলার জন্য অনেক কটু কথা শোনেন৷ তার পর থেকে ওই বাড়িতে আর আসছেন না৷ স্যার, এ সব গোপন কথা আপনাকে বলছি বটে, আপনি কিন্তু কারও কাছে ডাইভালজ করবেন না৷ আমি কারও সাতে-পাঁচে থাকি না স্যার৷ আমি চাই না, পুলিশ এসে আমাকে নিয়ে টানাটানি করুক৷’

‘না, না৷ তোমার কোনো ভয় নেই৷ জাস্ট শেষ প্রশ্ন, শনিবার সারাদিন তুমি কোথায় ছিলে?’

‘দেশের বাড়িতে গেছিলাম স্যার…আমোদপুরে৷ বাবা হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ তাই সক্কালেই আমি দৌড়ে গেছিলাম৷ আপনি চেক করতে পারেন৷’

তাকিয়ে মনে হল, বিক্রম সত্যি কথাই বলছে৷ তাই বললাম, ‘আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই৷ তুমি এবার দিব্যেন্দুবাবুকে পাঠিয়ে দাও৷’’

ছয়

গীতার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটা ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে৷ পাঁচ-পাঁচটা দিন পেরিয়ে গেল, তবুও কোনো হদিশ পাচ্ছি না৷ টিভিতে প্রথম দু-দিন খবরটা দেখিয়েছিল৷ তার পর বোধহয় ওরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে৷ এখন আর খবরটা দেখাচ্ছে না৷ লোকজনের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হচ্ছে, গীতা স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়নি৷ ওর মারাত্মক কিছু ঘটেছে৷ কিন্তু কী ঘটতে পারে, সেটাই আন্দাজ করতে পারছি না৷ ও এমন কিছু টাকাপয়সা সঙ্গে নিয়ে বেরোয়নি, যাতে টাকার লোভে ওকে কেউ গুম করতে পারে৷ বা ওর সঙ্গে এমন কারও অবৈধ সম্পর্ক ছিল না যে, নিছক যৌনতৃপ্তির কারণে স্বামী আর দুই মেয়েকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে৷ প্রশ্ন একটাই, শুক্কুরবার রাতে বাস ধরার জন্য গীতা বিজয়গড় থেকে বেরিয়েছিল৷ তার পর থেকে কেন ওর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না?

যে রিকশাওয়ালা ওকে বাড়ি থেকে বাঘাযতীন বাসস্ট্যান্ড অবধি পৌঁছে দিয়েছিল, তাকে খুঁজে বের করতে বলেছিলাম তথাগতকে৷ খুঁজে পেল কিনা, সেটা জানার জন্য ওকে ফোন করলাম৷ রিপোর্টারদের একটু বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যেস৷ কিন্তু তথাগত সেরকম টাইপের নয়৷ রোজ সকালে আমার মতোই শরীরচর্চা করে৷ কেননা, ও জানে ফিজিক্যালি ফিট না থাকলে ভালো রিপোর্টার হওয়া যায় না৷ বেশ কয়েকবার রিং হয়ে যাওয়ার পর তথাগত ফোনটা ধরেই বলল, ‘সরি কালকেতুদা৷ আমারই আপনাকে ফোন করা উচিত ছিল৷ কাল অনেক রাতে রিকশাওয়ালা ছেলেটাকে ধরতে পেরেছিলাম৷ ও কিন্তু আমাকে একটা নতুন তথ্য দিল৷ যেটা আপনিও জানতেন না৷’

বললাম, ‘নতুন তথ্য! যেমন?’

‘শুক্কুরবার রাতে ও গীতা সরকারকে বাড়ি থেকে রিকশায় তুলেছিল বটে, কিন্তু উনি একা ছিলেন না৷ ওঁর সঙ্গে সেদিন বিনয়বাবুও ছিলেন!’

শুনে একটু অবাকই হলাম৷ এই কথাটা তো বিনয় সেদিন আমাদের বলেনি! উলটে বিনয় এমন ভাব করেছিল যেন, বাইরে বেরোনোর ক্ষমতাই ওর নেই৷ কথাটা ও চেপে গেল কেন, আমার মাথায় ঢুকল না৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘রিকশাওয়ালার কাছে আর কোনো খবর জানতে পারলি?’

‘হ্যাঁ৷ বিজয়গড় থেকে বাঘাযতীন যাওয়ার পথে গীতা সরকার নাকি খুব কান্নাকাটি করেছিলেন৷ তখন বিনয়বাবু ওঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন৷ বাঘাযতীন বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়েই বিনয়বাবু আর বাসের জন্য অপেক্ষা করেননি৷ শরীর খারাপ করছিল৷ ওই রিকশাতেই তিনি বাড়ি ফিরে আসেন৷’

‘আর কিছু জানতে পারলি?’

‘রিকশাওয়ালা ছেলেটা গীতা সরকারের খুব প্রশংসা করছিল৷ কিন্তু একবার বলেই ফেলল, গীতাদিদির বরটা ভালো লোক না স্যার৷ আগে রোজ রাতে বাংলা খেয়ে ফিরত৷ গীতাদিদি অনেক করে বোঝাত৷ কিন্তু কে কার কথা শোনে? বাংলা খাওয়ার জন্যই লোকটাকে রোগে ধরল৷’

বিনয়ের যে এই বদ অভ্যাসটা আছে, তা জানতাম৷ ওদের মতো শিল্পীদের একটা ঠেক আছে খালাসিটোলায়৷ সেখানে একটা সময় নিয়মিত যেত ও, নামী শিল্পীদের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য৷ ফিরে এসে পাড়ায় আমাদের কাছে তাঁদের মাতলামির নানা গল্প করত৷ তার মানে…বিয়ে করার পরও এই অভ্যেসটা ছাড়তে পারেনি বিনয়৷ তথাগতকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাস ধরতে যাওয়ার সময় গীতার সঙ্গে কী ছিল, সেটা জানতে চেয়েছিলি? মানে সুটকেস বা ওই ধরনের কিছু?’

‘জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ ওঁর সঙ্গে ছোট্ট একটা কিটব্যাগ ছিল মাত্র৷ কিন্তু রিকশাওয়ালা ছেলেটা কথায় কথায় আমাকে একটা অদ্ভুত কথা বলল কালকেতুদা৷ রিকশা থেকে নামার পর বিনয়বাবু নাকি গীতা সরকারকে বারবার সাবধান করছিলেন, জিনিসগুলো সব সামলে রেখো৷ ব্যাগটাকে কখনও কাছছাড়া করো না, কেমন? একবার গেলে আর কিন্তু কিনে দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই৷ শুনে গীতা সরকার তখন ঘাড় নাড়েন৷ তার পর বলেন, তুমি চিন্তা করো না৷ ঠিক সব ফিরিয়ে আনব৷ গীতা সরকারের সঙ্গে নিশ্চয়ই দামি কিছু ছিল৷ না হলে বিনয়বাবু অমন কথা বলতেন না৷’

বললাম, ‘সেটা তো বিনয়কে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে৷ ওর সঙ্গে আমি কথা বলে নিচ্ছি৷ তোকে একটা কাজ করতে হবে৷ অফিস যাওয়ার আগে তোকে একবার ইডিএফ নার্সিংহোমে যেতে হবে৷ সুরজিত তরফদারের সঙ্গে কথা বলতে হবে৷ দ্যাখ তো ওর কাছ থেকে কোনো ক্লু পাস কিনা৷’

তথাগত বলল, ‘ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি৷ কিন্তু আপনার কী মনে হচ্ছে কালকেতুদা? আমার তো মোটেই ভালো ঠেকছে না৷ সুদীশদার সঙ্গে আপনার কি আর কোনো কথা হয়েছে?’

বললাম, ‘একটু পরেই ওর আসার কথা আছে আমার কাছে৷ ও এলে জানতে পারব৷ ও. কে, ছাড়ছি রে৷ সন্ধেবেলায় আমায় জানাস কিন্তু, সুরজিতের কাছ থেকে তুই কী জানতে পারলি৷’

ফোনটা ছেড়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলাম৷ সন্দেহভাজনদের একটা তালিকা তৈরি করেছি আমি৷ এক নম্বরে রাধাপদ নন্দী৷ ব্যাচেলর, গীতার উপর আকর্ষণ থাকা অস্বাভাবিক নয়৷ শনিবার সকাল থেকে ওকেও পাওয়া যাচ্ছে না৷ নেতাজিনগরে খোঁজ নিতে গিয়েছিল তথাগত৷ খবরটা ও-ই নিয়ে এসেছে৷ তবে পাড়ার লোক বলেছে, মাঝেমধ্যেই নাকি রাধাপদবাবু উধাও হয়ে যান৷ তিন-চারদিন পরে আবার ফিরে আসেন৷ সন্দেহভাজন নম্বর দুই, অমল৷ যে ছেলেটা গীতার হাতে চড় খেয়েছিল, উপাকে বিরক্ত করার অপরাধে৷ ভালো ফ্যামিলির ছেলে৷ কিন্তু ছেলেটা বদসঙ্গে মেশে, ড্রাগ খায়৷ মাস্তান টাইপের হয়ে গিয়েছে৷ অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারে৷ তবে এখনও কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই অমলের৷

সন্দেহভাজন তিন নম্বর, বিক্রম৷ ওর কথাবার্তায় নানা অসঙ্গতি আছে৷ খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, শনিবার ও আমোদপুরে যায়নি৷ আমোদপুরে গিয়েছিল পরের দিন অর্থাৎ রবিবার৷ ছেলেটা তা হলে আমাকে মিথ্যে কথা বলল কেন? আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার, রীণা ফেব্রিকসে ওর সঙ্গে সেদিন যখন কথা বলেছিলাম, তখন ছেলেটা গীতা সম্পর্কে পাস্ট টেন্সে কথা বলছিল৷ গীতাদি করতেন, যেতেন, আসতেন৷ বলেছিলেন, করেছিলেন ইত্যাদি৷ তখন খেয়াল হয়নি৷ কিন্তু বাড়ি ফিরে আসার পর বিক্রমের সঙ্গে কথাগুলো যখন মনে মনে রিওয়াইন্ড করছিলাম, তখন খেয়াল হয়েছিল৷

সন্দেহভাজনদের তালিকায় এখন বিনয়কেও স্বচ্ছন্দে রাখা যেতে পারে৷ ও কি আমাদের কাছে কোনো কথা লুকোচ্ছে? তা হলে কি ও যতটা অসুস্থতা দেখায়, ততটা নয়?

এ সব ভাবতে ভাবতেই ডোরবেলের আওয়াজ পেলাম৷ উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখি, সুদীশ৷ ঘরে ঢোকার মুখেই ও বলল, ‘খবর আছে রে৷ আমি যে লাইনে ভাবছিলাম, সেটাই ঠিক৷ গীতা সরকার নিখোঁজ হননি৷ স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন৷ আমায় শুধু জানতে হবে, প্রেমিকটা কে?’

বললাম, ‘এত শিয়োর হলি কী করে?’

‘ভদ্রমহিলা সব গয়নাগাঁটি সঙ্গে নিয়ে কেটে পড়েছেন৷ যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, সব৷ আমায় বল তো, মানতের পুজো দিতে গিয়ে কেউ সব গয়নাগাঁটি নিয়ে যায়? তোর বিনয়ের জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে রে৷’

সাত

মন থেকে সুদীশের কথা মেনে নিতে পারছি না৷ আবার উড়িয়েও দিচ্ছি না৷ সত্যিই তো তারাপীঠে পুজো দিতে গিয়ে সব সোনার গয়না গীতা সঙ্গে নিয়ে যাবে কেন? তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই তথ্যটা তোকে কে দিল রে?’

সুদীশ বলল, ‘বিনয়বাবু৷ ওঁর কাছ থেকেই আমি আসছি৷ কয়েকটা খবর ভেরিফাই করার ছিল বলে ভদ্রলোকের কাছে গিয়েছিলাম৷ থানায় ফেরার সময় তোর এখানে চলে এলাম৷’

‘কী খবর ভেরিফাই করতে গিয়েছিলি?’

‘তোকে বলা হয়নি৷ গড়িয়া বাস ডিপোতে আমার লোক পাঠিয়েছিলাম৷ শনিবার যে বাসটা তারাপীঠ গিয়েছিল, তার ড্রাইভার আর কনডাক্টরকে ইন্টারোগেশন করার জন্য৷ বুঝতেই পারছিস, সরকারি বাস নয়৷ সপ্তাহে একদিন ওই প্রাইভেট বাসটা ছাড়ে৷ কোনো রুট পারমিট নেই৷ স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে ছোটোখাটো ট্যুর করে৷ কখনও দিঘা, কখনও জয়রামবাটি বা হাজারদুয়ারি৷ বাসের মালিক পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল৷ তাই ওদের ধরতে একটু দেরি হয়ে গেল৷ যাই হোক, চাপ দিতেই কনডাক্টর একটা খুব ইন্টারেস্টিং খবর দিয়েছে৷ বিনয়বাবুর স্ত্রী কিন্তু একা যাননি৷ তাঁর এক পুরুষ সঙ্গীও ছিলেন৷’

‘তার মানে? সেই পুরুষ সঙ্গীটি কোত্থেকে উঠেছিলেন?’

‘দুজনে একসঙ্গে ওঠেননি৷ পুরুষ সঙ্গীটি বাসে ওঠেন গড়িয়া থেকে৷ আর গীতা সরকার উঠেছিলেন বাঘাযতীন অথবা এইট বি বাস স্ট্যান্ডের কাছ থেকে৷ ঠিক কোত্থেকে সেটা কনডাক্টরের মনে নেই৷ পিছনের দিকের সিটে ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন ভদ্রলোক৷ বাস কোনা এক্সপ্রেস হাইওয়েতে পৌঁছোতেই গীতা সরকারের পাশে গিয়ে বসেন৷’

‘এমনও তো হতে পারে, দুজনের দেখা হওয়াটা কোইন্সিডেন্টাল?’

‘না তা নয়৷ গীতা সরকার সিট পেয়েছিলেন ড্রাইভারের ঠিক পিছনে৷ তাঁর পাশের সিটে যিনি ছিলেন, তাঁকে পিছনে পাঠিয়ে দেন সেই পুরুষ সঙ্গীটি৷ ভদ্রলোক প্রথমে যেতে চাইছিলেন না৷ বাসের পিছনের দিকে ঝাঁকুনি বেশি হয় বলে৷ কিন্তু গীতা সরকারই নাকি পরে অনুরোধ করেন৷ তাই ভদ্রলোক উঠে চলে যান৷ আমার তো মনে হয়, গীতা জানতেন পুরুষ সঙ্গীটি বাসে উঠবেন৷ উনি চাননি, পরিচিত কেউ ওঁদের দেখে ফেলুক৷’

‘তুই কি এই পুরুষ সঙ্গীটির কথা বিনয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলি?’

‘কী করব বল৷ ওঁকে বলতে বাধ্য হলাম৷ তুই তো জানিস, ইনভেস্টিগেশনের জন্য পুলিশকে কত অপ্রিয় সত্য বলতে হয়৷’

‘বিনয়ের কী রিঅ্যাকশন হল, কথাটা শুনে?’

‘কোনো রিঅ্যাকশনই দেখলাম না৷ উলটে, নির্লিপ্তভাবে বললেন, আমাদের পরিচিত কেউ হবে৷ বিনয়বাবু বিশ্বাসই করতে চাইছেন না, ওঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আর একজন উদয় হয়েছেন৷ এবং তাঁর সঙ্গে গীতা কেটে পড়েছেন৷ বারবার জোর দিয়ে উনি বললেন, এ হতেই পারে না সুদীশবাবু৷ গীতাকে আমি জানি৷ ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না৷ ও যদি এরকম মনোবৃত্তিরই হত, তা হলে অনেকদিন আগেই আমায় ছেড়ে চলে যেতে পারত৷ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ভাই, তোর বন্ধুটি সাবিত্রী-সত্যবানের যুগে পড়ে আছে, নাকি রোগভোগে বাস্তববুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে?’

শুনে বিনয়ের উপর আমার শ্রদ্ধা হতে লাগল৷ পারস্পরিক বিশ্বাস কতটা গভীর হলে, মানুষ এ কথা বলতে পারে! এ রকম ভালোবাসা আজকাল দেখাই যায় না৷ সুদীশ যা-ই ভাবুক না কেন, আমি কিন্তু প্রভাবিত হচ্ছি না৷ তবে একটা ব্যাপারেই খটকা লাগছে, গীতা গয়নাগাঁটিগুলো সঙ্গে নিয়ে গেল কেন? ওদের সংসারের যা অবস্থা, তাতে আদৌ কোনো গয়নাগাঁটি ছিল কিনা, সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে৷ বিনয় এমন কিছু রোজগার করত না, যাতে সোনার গয়না কিনে দিতে পারে বউকে৷ ওদের বিয়েটাও হয়েছে গীতার বাবা-মায়ের আপত্তিতে৷ ফলে বাপের বাড়ি থেকে গীতা কোনো গয়না পেয়েছে বলে মনে হয় না৷ গয়না থাকলেও, যে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, অভাব মেটাতে সেই সংসারে প্রথমেই কোপ পড়বে গয়নার উপর৷ আর গীতা সম্পর্কে আমার যতটা আন্দাজ হয়েছে, এরকম মেয়ে কখনোই গয়নাগাঁটি আঁকড়ে ধরে থাকবে না৷ স্বামীকে সুস্থ করে তুলতে প্রথমেই আলমারি থেকে গয়না বের করে দেবেই৷

সুদীশ আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘কী ভাবছিস তুই?’

বললাম, ‘ওই গয়নাগাঁটির কথা৷ গীতা সঙ্গে নিয়ে গেল কেন?’

‘জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ বিনয়বাবু ভাই…অদ্ভুত কথা বললেন৷ ওঁদের বিয়ে গীতা সরকারের বাবা-মা মেনে নেননি বটে, কিন্তু বিনয়বাবুর মা নাকি কোনো আপত্তি করেননি৷ উনি খুশি হয়েই বউকে ঘরে তুলেছিলেন৷ বিনয়বাবুর মা মারা যাওয়ার আগে নিজের যা গয়নাগাঁটি ছিল, সব দিয়ে গিয়েছিলেন ছেলের বউকে৷ পুরোনো আমলের গয়না৷ দশ-বারো ভরির মতো হবে৷ এখনকার দামে তিন-সোয়া তিন লাখ টাকা৷ একটা সীতাহার, কানের দুল, আংটি, ছয় গাছা চুড়ি, এক জোড়া সলিড বালা৷ শত অভাব সত্ত্বেও সেই গয়না বিক্রি করতে চাননি বিনয়বাবুর স্ত্রী৷ কিন্তু কী আশ্চর্যের ব্যাপার, প্রেমিকের টানে অত গয়না নিয়ে হঠাৎ উনি উধাও হয়ে গেলেন! মানুষের মধ্যে কত যে পরিবর্তন হয়!’

‘গয়নাগুলো যে গীতা নিয়ে যাচ্ছে, সে কথা তো বিনয় জানত৷’

শুনে সুদীশ একটু অবাকই হল, ‘তুই জানলি কী করে?’

‘গীতা সোনার গয়না নিয়ে তারাপীঠ গিয়েছে, সেটা জানতাম না৷ সেটা এখুনি শুনলাম তোর মুখে৷ কিন্তু ও যে সঙ্গে দামি কিছু নিয়ে যাচ্ছে, সেটা তথাগত জেনে এসেছে রিকশাওয়ালা ছেলেটার কাছ থেকে৷’

‘তাই বুঝি৷ আমি তো ভেবেই পাচ্ছিলাম না, বিনয়বাবু এটা অ্যালাউ করলেন কেন? এক মহিলা রাতের বাসে একা একা ট্রাভেল করছেন, তাঁকে কেন অত গয়না ক্যারি করতে দিলেন? জানেন না, নাশনাল হাইওয়েতে রাতের দিকে মাঝে মাঝেই বাস আটকে ডাকাতি হয়!’

‘বিনয়ের কাছে এটা তুই জানতে চাইলি না কেন?’

জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ উনি সব রোমান্টিক কথাবার্তা বললেন৷ আর্টিস্টরা কোন জগতে বাস করে বল তো? উনি কী বললেন, জানিস? পনেরো বছর আগে, ওঁদের রেজিস্ট্রি বিয়ের দু-দিন পরই নাকি মা আর বউকে নিয়ে উনি তারাপীঠে গিয়েছিলেন৷ সেদিনটাও ছিল এক শনিবার৷ বিনয়বাবুর মা…নতুন বউকে পুরো গয়নায় সাজিয়ে সেদিন তারা মায়ের মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ মাঝে আর ওঁদের তারাপীঠে যাওয়া হয়নি৷ তাই এবার যাওয়ার আগে গীতা সরকার নাকি বিনয়বাবুকে বলেন, তোমাকে সুস্থ করে দিয়ে…তারা মা আমার মানত রেখেছেন৷ আমার খুব ইচ্ছে, সোনার গয়নাগুলো পরে ফের মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াই৷ এই কথা শুনে নাকি বিনয়বাবু রাজি হয়ে গিয়েছিলেন৷ ভাব, মেয়েরা কত ধরনের ছলচাতুরীই না করতে পারে৷ আমার ভাই দৃঢ় বিশ্বাস, এ কেসে ছানবিন করে কোনো লাভ নেই৷ গীতা সরকার ফিরে আসার জন্য ঘর ছাড়েননি৷’

‘তুই কি কেসটা তা হলে গুটিয়ে নিবি?’

‘ফালতু সময় দিয়ে কোনো লাভ আছে? সিপি-কে পুরো ঘটনাটি জানিয়ে দিচ্ছি৷ ব্যস, আমার দায়িত্ব শেষ৷ তবে তুই চেষ্টা করে দেখতে পারিস৷ যদি গীতা সরকারের খোঁজ পাস, আমায় জানাস৷ এখন উঠি রে৷’ কথাগুলো বলেই সুদীশ উঠে দাঁড়াল৷

সুদীশ বেরিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ আমার উপাসনার মুখটা মনে পড়ল৷ ওই মেয়েটা এখনও মায়ের আশায় বসে আছে৷ ওর কাছে কথা দিয়ে এসেছিলাম, যে করেই হোক, গীতাকে খুঁজে বের করব৷ সুদীশ পুলিশের লোক, হাত ধুয়ে ফেলতে পারে৷ আমি সরে আসতে পারব না৷ গীতাকে আমি খুঁজে বের করবই৷ আমার কাছে এটা একটা চ্যালেঞ্জ৷

আট

গীতার নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে গত দু-দিন ধরে এত মাথা ঘামিয়েছি যে, অফিসের কাজে মন দিতে পারিনি৷ দুপুরে অফিসে গিয়ে দেখি, একটা চিরকুট লেখা আছে আমার বোর্ডে৷ নিউজ এডিটর কিংশুকদা লিখেছেন, ‘আজ বিকেলের মধ্যেই তোমাকে বোলপুরে পৌঁছোতে হবে৷ কাল শান্তিনিকেতনে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি৷ খবরটা তোমাকে কভার করতে হবে৷ বোলপুরে তোমার সব ব্যবস্থা করে রাখবে সিরাজুল৷ ওকে সব বলে দেওয়া আছে৷ অনেকবার তোমাকে ফোন করেছি, পাইনি৷’

গাড়ি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিলাম৷ এনএইচ টু-তে গাড়ি ঢোকার পরই সিরাজুলের ফোন, ‘হোটেলে আপনার রুম বুক করে রেখেছি৷ হোটেল প্রান্তিক৷ আপনি ওখানে চলে আসুন৷ আমি থাকব৷’

বিকেল পাঁচটা নাগাদ হোটেলে পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গে তথাগতর ফোন, ‘আপনি কোথায়? এখনও অফিসে ঢোকেননি? আমি তো আপনার জন্য বসে আছি৷’

বললাম, ‘কোনো খবর আছে?’

‘হ্যাঁ, রাধাপদবাবুর খোঁজ পেয়েছি৷ ইন ফ্যাক্ট, এই একটু আগে ওঁর সঙ্গে কথা বলে এলাম৷ গীতা সরকারের খবরটা উনি জানতেন না৷ শুনে খুব ভেঙে পড়লেন৷’

‘কোথায় দেখা হল ওঁর সঙ্গে?’

‘বোড়ালে৷ সত্যজিৎ রায় যেখানে পথের পাঁচালি সিনেমার শুটিং করেছিলেন৷ ওখানে একটা এনজিও-র সঙ্গে জড়িত রাধাপদবাবু৷ শুক্রবার থেকে সেখানেই ছিলেন উনি৷ ওঁরা অনেকে মিলে একটা অনাথ আশ্রম চালান৷ বাচ্চাদের একটা প্রোগ্রাম ছিল রবিবার৷ সেটা অ্যারেঞ্জ করার জন্যই গিয়েছিলেন৷’

‘শুনেছি, রাধাপদবাবুর সঙ্গে নাকি আত্মীয়তা আছে গীতার৷ কে হন উনি?’

‘আপন পিসতুতো দাদা৷ তাই আমরা যেটা ভাবছিলাম, সেটা ঠিক নয়৷ অ্যাকচুয়ালি রাধাপদবাবুর ভরসাতেই গীতা সরকার নর্থ ক্যালকাটা থেকে একেবারে সাউথ ক্যালকাটায় চলে আসেন ফ্যামিলি নিয়ে৷ বিনয়বাবুরা এখন যে বাড়িতে থাকেন, সেটা আসলে রাধাপদবাবুর বাড়ি৷ ভদ্রলোক এমন ভালো মানুষ, ওই বাড়িতে বিনয়বাবুদের থাকতে দিয়ে নিজে চলে গিয়েছেন নেতাজি-নগরে৷ বিনয়বাবু বারবার অনুরোধ করেছিলেন তখন ওঁদের সঙ্গে থাকার জন্য৷ কিন্তু রাধাপদবাবু কিছুতেই রাজি হননি৷’

‘রাধাপদবাবু কী করতেন, জিজ্ঞেস করেছিলি?’

‘হ্যাঁ কালকেতুদা৷ উনি এয়ারফোর্সে ছিলেন৷ ভলান্টিয়ারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে উনি বছর তিনেক আগে আগ্রা থেকে ফিরে আসেন৷ নিকটাত্মীয় বলতে একমাত্র গীতা সরকার৷ আমার মনে হয় না কালকেতুদা, ভদ্রলোক কোনোভাবে জড়িত গীতা সরকারের অর্ন্তধান রহস্যে৷ খবরটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে উনি বোড়াল থেকে চলে এলেন আমার সঙ্গে৷ ওঁকে বিজয়গড়ে নামিয়ে দিয়ে আমি অফিসে এলাম৷’

‘তোর সঙ্গে সুরজিত তরফদারের কি কোনো কথা হয়েছে?’

‘না৷ রাধাপদবাবুকে চেজ করতে গিয়ে আর ইডিএফে যেতে পারিনি৷ দেখি, কাল অফিসে আসার আগে ওর সঙ্গে একবার দেখা করে আসবে৷ কিন্তু আপনি এখন কোথায়? অফিসে আসবেন না?’

বললাম, আমি কোথায়৷ শুনে তথাগত বলল, ‘খুব ভালো হল৷ সিরাজুলের সঙ্গে যখন আপনার দেখাই হচ্ছে, তখন জয়দেব ঢালির কেসটা নিয়ে ওর সঙ্গে একবার কথা বলবেন কালকেতুদা? আমার মনে হয়, নিবেদিতা ঢালি নির্দোষ৷ ওর বাবার বাইট শুনলাম টিভিতে৷ জয়দেব ছেলেটা সম্পর্কে যা-তা বলছিলেন৷ পারলে ফেরার সময় আপনি একবার আমোদপুর ঘুরে আসতে পারেন৷’

বললাম, ‘চেষ্টা করব৷ আগে সিরাজুলের সঙ্গে কথা বলি৷ তার পর ডিসিশন নেব৷’

ফোনের সুইচ অফ করতে না করতেই হাজির সিরাজুল৷ ছেলেটার এত অল্প বয়স, ভাবতেও পারিনি৷ জামা পুরো ভিজে গিয়েছে৷ রুমাল দিয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে একগাল হেসে ও বলল, ‘আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো? আমি তো ভাবলাম, বৃষ্টিতে আটকা পড়ে যাবেন৷ এই সময়টায় এই অঞ্চলে ভয়ানক শিলাবৃষ্টি হয়৷ হাইওয়ে দিয়ে কেউ গাড়ি চালাতে চায় না৷’

আসার সময় আকাশে কালো মেঘ দেখেছিলাম৷ কিন্তু বাইরে যে এত ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তা টেরও পাইনি৷ হাতে কোনো কাজও নেই৷ সিরাজুলের সঙ্গে গল্প শুরু করে দিলাম৷ কলকাতায় ঠান্ডা ঘরে বসে আমরা কাজ করি৷ যেখানে- সেখানে যাওয়ার জন্য গাড়ি পাই৷ কিন্তু জেলার রিপোর্টারদের যে কী কষ্ট করে কাজ করতে হয়, সে সব কথা সিরাজুল বলতে শুরু করল৷ বীরভূম জেলায় যত খবর হয়, সব ওকেই কভার করতে হয়৷ সিউড়ি, রামপুরহাট, বোলপুর, দুবরাজপুর, আমোদপুর, সাঁইথিয়া—একা ওকে দৌড়োদৌড়ি করতে হয়৷ খবর পেলেই ও মোটর বাইক নিয়ে ছোটে৷

আমোদপুরের নামটা করায় আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘জায়গাটা বোলপুর থেকে কতদূর সিরাজুল?’

‘তা পঞ্চাশ কিলোমিটারের মতো হবে৷ আজ ওখানে যাওয়ার কথা ছিল আমার৷ কিন্তু আপনি আসবেন বলে আমি গেলাম না৷ আমোদপুরে গেলে বড়ো একটা খবর হত৷’

‘তোমার সেই খুনের খবর? জয়দেব আর নিবেদিতা ঢালি?’

‘খুব ইন্টারেস্টিং কেস কালকেতুদা৷ তথাগতদা বলছিল, আপনি নাকি জানতে চেয়েছেন এই কেসটা সম্পর্কে৷ নিবেদিতা ঢালি এখন আছেন সাঁইথিয়া থানার লক আপে৷ ওঁর সঙ্গে যদি কথা বলতে চান, আমি নিয়ে যেতে পারি৷ আইও আমার খুব পরিচিত৷’

বললাম, ‘কাল রাষ্ট্রপতির ফাংশানটা হয়ে যাক৷ পরশু সকালে ভাবা যাবে৷’

আরও খানিকক্ষণ গল্প করে সিরাজুল বেরিয়ে গেল৷ বাইরে ঝড়-বৃষ্টি থেমে গিয়েছে৷ হঠাৎ লোডশেডিং৷ মফসসল শহরগুলোতে এই এক সমস্যা৷ যখন-তখন কারেন্ট চলে যায়৷ সময় কাটাব কী করে, তাই ভাবছি৷ কুণাল বসুর ছোটো গল্পের সংকলন ‘জাপানিজ ওয়াইফ’ বইটা নিয়ে এসেছিলাম৷ পড়ার কোনো চান্স নেই৷ টিভি চললেও খানিকটা সময় কাটানো যেত৷ অন্ধকারে খানিকক্ষণ বসে থেকে রিসেপশনে ফোন করলাম৷ আলো আসবে কখন? ওরা বলল, জেনারেটর আছে৷ এখুনি চালানো হবে৷

মিনিট পাঁচেক পর আলো আসতেই টিভিটা চালিয়ে দিলাম৷ সারাদিন খবর দেখার সুযোগ পাইনি৷ গলফ গার্ডেন্সে গণধর্ষণ, প্রাক্তন বিচারপতির বাড়িতে হুমকি দেওয়া ফোন, ভাঙড়ে পিটিয়ে খুন৷ হঠাৎ ব্রেকিং নিউজ৷ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় রাষ্ট্রপতির বোলপুর সফর বাতিল৷ সঙ্গে সঙ্গে অফিসে কিংশুকদাকে ফোন করলাম৷ উনি বললেন, ‘এখুনি তোকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম৷ রাষ্ট্রপতি আসছেন না৷ তুই কাল সকালেই চলে আয়৷’

ফোনটা ছেড়েই সিরাজুলকে ধরলাম, ‘কাল সকালে সাঁইথিয়া যাব৷ তুই চলে আসিস৷’

নয়

নিবেদিতা যে এত কঠিন মনের মেয়ে, তা আন্দাজও করতে পারিনি৷ আধঘণ্টা ধরে বোঝানো সত্ত্বেও মুখ খুলছে না৷ আমার পাশেই বসে জয়দেব মার্ডার কেসের আইও মাসুদ আহমেদ৷ উনি বললেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি কালকেতুবাবু৷ কিন্তু উনি খোলসা করে কিছু বলছেনই না৷ আমি বুঝতে পারছি, মার্ডারের পিছনে ভদ্রমহিলার কোনো হাত নেই৷ কিন্তু কার হাত আছে, সে সম্পর্কে উনি যদি আমাদের ক্লু না দেন, তা হলে নিজেই পস্তাবেন৷’

‘এই যে কাগজে বেরিয়েছে নিবেদিতা ঢালি ঘুমন্ত স্বামীর মুখে বিষ ঢেলে মেরে ফেলেছেন, সেটা কি আপনি বিশ্বাস করেন?’

‘একেবারেই না৷ পোস্টমর্টেম রিপোর্টে রয়েছে, জয়দেব বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছেন৷ কিন্তু তখন মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন৷’

ইচ্ছে করেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার চার্জশিট কি রেডি?’

‘অলমোস্ট৷ কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারই দেখাতে হবে৷ ডোমেস্টিক মেড বলছে, সেই বাড়িতে আর কেউ ছিলেন না৷ বিষ নাকি নিবেদিতাই ঢেলে দেন৷ ফাঁসি কেউ আটকাতে পারবে না৷ কিন্তু বাচ্চাটার কী হবে, ভাবতে পারছি না৷ মনে হয়, কোনো অনাথ আশ্রমে পাঠাতে হবে৷ এই দেখুন না, লক আপে মশার কামড় খেয়ে বাচ্চাটার জ্বর হয়েছে৷ এই অঞ্চলে এখন খুব ডেঙ্গি হচ্ছে৷ অনেকে মারাও যাচ্ছে৷ উচিত বাচ্চাটাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া৷ কিন্তু নিবেদিতা কিছুতেই কোলছাড়া করতে চাইছেন না৷ ইচ্ছে করলে আমরা দুজনকেই হাসপাতালে পাঠাতে পারি৷ কিন্তু কেন জানি না মনে হচ্ছে, নিবেদিতা সেফ নন৷ থানার বাইরে গেলেই ওঁর উপর অ্যাটাক হতে পারে৷’

স্পষ্ট দেখলাম, মাসুদ আহমেদের কথা শুনে নিবেদিতা কোলের বাচ্চাটাকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরল৷ কতই বা বয়স মেয়েটার৷ তেইশ-চবিবশ হবে৷ দেখতে যে খুব সুন্দরী ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু পাঁচ দিন লক আপে থেকে, দুর্ভাবনায় মুখ-চোখ সব শুকিয়ে গিয়েছে৷ আমার সামনে বিষাদপ্রতিমা হয়ে বসে রয়েছে৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘নিবেদিতার কনভিকশন হলে, সত্যিই বাচ্চাটার কী হবে মিঃ আহমেদ?’

‘কী আর হবে, জজ সাহেব কোনো অনাথ আশ্রমে পাঠাতে বলবেন৷’ মাসুদ আহমেদ বললেন, ‘আপনি তো জানেনই, সরকারি অনাথ আশ্রমগুলো চলে কীভাবে৷ একটু বড়ো হলেই বাচ্চাটা আন্ডার-ওয়ার্ল্ডে গিয়ে ঢুকবে৷ মা-বাবার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে ওকে৷ জীবনটাই নষ্ট৷’

বাচ্চাটার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা ইচ্ছে করেই ভয় দেখাতে শুরু করলাম৷ কিন্তু তাতে নিবেদিতার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হল বলে মনে হল না৷ ওর সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ হবে না ভেবে যখন উঠে আসছি, তখন হঠাৎ নিবেদিতা বলে উঠল, ‘কালকেতুবাবু আপনি একটু বসুন৷’

স্পষ্ট ইঙ্গিত ও মাসুদ আহমেদের সামনে কোনো কথা বলতে চায় না৷ ইশারায় ভদ্রলোককে চলে যেতে বললাম৷ উনি উঠে যেতেই নিবেদিতা আস্তে আস্তে বলল, ‘আপনি কি সেই কালকেতু নন্দী, যিনি একইসঙ্গে সাংবাদিকতা আর গোয়েন্দাগিরি করেন? যদি আপনি সেই লোক হন, তা হলে আপনার লেখা আমি পড়েছি৷ এবং আপনার উপর ভরসা করা যায়৷’

শুনে খুব ভালো লাগল৷ বললাম, ‘হ্যাঁ, আমিই সেই লোক৷’

‘আমি যে স্কুলে পড়াতাম, সেখানকার লাইব্রেরিতে আপনার অনেক বই আছে৷ লেখক-পরিচিতিতে আপনার ছবিও দেখেছি৷ কিন্তু ঠিক মেলাতে পারছিলাম না, আপনি সাঁইথিয়ায় কেন? যাক সে কথা, কী জানতে চান বলুন৷ পুলিশের উপর আমার কোনো আস্থা নেই৷ সেই কারণেই আমি অ্যাদ্দিন মুখ খুলিনি৷’

‘জয়দেব ঢালির মতো একজন অসামাজিক লোকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে কী করে, সেটা আগে বলো৷’

‘ও অসামাজিক ছিল না কালকেতুবাবু৷ ওর বন্ধুরা ওকে খারাপ করে দিল৷ আমোদপুরে আমরা থাকতাম বাবুপাড়ায়৷ ওরা ফিরিঙ্গিপাড়ায়৷ ছোটোবেলা থেকেই ওকে আমি চিনতাম৷ পড়াশোনায় ও খুব ভালো ছিল৷ ওর জীবনের স্বপ্ন ছিল সাংবাদিক হবে৷ লাভপুরের শম্ভুনাথ কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পর ও সত্যি সত্যি একটা টিভি চ্যানেলে চাকরি পেল৷ এ দিকে, আমিও বিএ বিটি করে জয়দুর্গা হাইস্কুলে চাকরি পেয়ে গেলাম৷ আমি ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে৷ তাই আমার বাবা-মা জয়দেবকে মেনে নেননি৷ তবুও বাড়ির অমতে আমি রেজেস্ট্রি বিয়ে করি৷ অন্য দিকে, জয়দেবের বাবা-মাও আমাকে মেনে নিতে পারলেন না, সাংসারিক কাজকর্মে গা দিই না বলে৷ আমার জীবনটাকে ওঁরা দুর্বিষহ করে দিলেন৷’

বললাম, ‘তাই তোমরা ভাড়া বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলে?’

‘ঠিক তাই৷ কিন্তু সেটাই আমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াল৷ চ্যানেল থেকে এমনিতেই জয়দেব নিয়মিত মাইনে পেত না৷ তার পর ওর কিছু বন্ধু জুটল, যাদের আমার ঠিকঠাক লোক বলে মনে হত না৷ জয়দেব প্রায়ই মদ খেয়ে ফিরতে লাগল৷ এর পর লক্ষ করতে লাগলাম, ওর হাতে প্রচুর টাকা৷ একদিন নেশার ঘোরে ও বলেই ফেলল, অ্যাদ্দিন খবর পাঠিয়ে যা রোজগার করতাম, এখন তার তিনগুণ রোজগার করি খবর না পাঠিয়ে৷ তখনই বুঝতে পারলাম, জয়দেব ব্ল্যাকমেল করে টাকা রোজগার করছে৷’

‘এতে কি ওর বন্ধুদেরও হাত ছিল?’

‘ভিকি বলে ওর একটা বন্ধুই ওকে নষ্ট করে দিয়েছিল৷ সেও আমোদপুরের ছেলে৷ কিন্তু কলকাতার কোথায় যেন চাকরি করে৷ প্রতি শনিবার রাতে সে আমোদপুরে আসত, সোমবার সকালের ট্রেনে কলকাতায় চলে যেত৷ আমার উপরও ওর কুনজর ছিল৷ কলকাতা থেকে মাঝে মাঝে সুন্দর সুন্দর শাড়ি এনে আমাকে গিফট করত৷ জয়দেবের অবর্তমানে হুটহাট করে আমাদের বাড়িতে চলে আসত৷ একবার আমাকে রেপ করারও চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু আমি গালে ঠাস করে চড় মারায় আর এগোয়নি৷’

‘তুমি জয়দেবকে কিছু বলনি?’

‘বলেছিলাম৷ ও বিশ্বাসই করতে চায়নি৷ কেননা, ততদিনে ও স্মাগলিং র‍্যাকেটে জড়িয়ে পড়েছে৷ বন্ধকি কারবার শুরু করেছে৷ ওর হাতে প্রচুর টাকা৷ বাড়িতেই মদের ঠেক বসাতে শুরু করেছে৷ ভিকি নানারকম দু-নম্বরি কাজ করে আসত৷ আর চোরাই মাল এনে রাখত জয়দেবের কাছে৷ পরে সুযোগ মতো বিক্রি করে দিত বর্ধমান, বোলপুরের মতো বড়ো শহরে৷ আমার কাছে একদিন জয়দেব ধরা পড়ে গেল৷ সেটা জেনে ভিকি আমায় শাসাল, জয়দেবকে যদি সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি, তা হলে জয়দেবকে ও বলবে, আমাদের বাচ্চাটা ওর৷ জয়দেবের নয়৷ শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম৷ ভিকির মতো ছেলেরা সব পারে৷ তাই তখনকার মতো চুপ করে গেলাম৷’

‘তোমার স্কুলের মাইনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কেন?’

‘ওই ভিকির জন্যই৷ বাচ্চাটা হওয়ার পর আমি মাস ছয়েক স্কুলে যেতে পারিনি৷ স্কুল কমিটির প্রেসিডেন্ট পার্টির নেতা৷ প্রায়ই ওদের মদের ঠেকে আসত৷ তাকে ইনফ্লুয়েন্স করে আমার মাইনেটা ভিকি আটকে দিল৷ কেননা, একটা সময় আমি আলটিমেটাম দিয়েছিলাম, ডিভোর্স নেব৷ নিজে রোজগার করি৷ কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকব না৷’

‘এই ভিকিই কি জয়দেবের মার্ডারের সঙ্গে জড়িয়ে?’

‘হ্যাঁ কালকেতুদা৷’ বলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল নিবেদিতা৷ কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘চোখের সামনে আমার জয়দেবকে ও মেরে ফেলল৷ জয়দেবকে আমি প্রায় রাজি করিয়ে ফেলেছিলাম, ভিকির সংস্পর্শ যাতে ত্যাগ করে৷ বর্ধমানের এক স্কুলে আমি চাকরি জোগাড় করেছিলাম৷ দুজনে মিলে ঠিকই করেছিলাম, সবার অলক্ষে চলে যাব৷ কিন্তু গত শনিবার ভোরবেলায় ভিকি হঠাৎ এসে হাজির৷ হাতে গয়নার পুঁটলি৷ আড়াল থেকে আমি শুনলাম, কাউকে খুন করে ভিকি ওই গয়না নিয়ে এসেছে৷ খদ্দের ঠিক করে ও পরের সপ্তাহে ফের আসবে৷ গয়নাগুলো নিয়ে যাবে৷ ভিকি চলে যাওয়ার পর আমি খুব রাগারাগি করলাম৷ ঝগড়ার সময় জয়দেব বলল, বন্ধকের সব জিনিসপত্র নিয়ে আমরা তো উধাও হয়ে যাবই৷ গয়নাগুলো ছেড়ে দেব কেন? তবুও আমি ইনসিস্ট করতে লাগলাম, বন্ধকের সব জিনিস সবাইকে ফেরত দিতে হবে৷’

‘এই ব্যাপারটা ভিকি বুঝতে পেরে গিয়েছিল৷ তাই মার্ডার করেছিল, তাই না?’

‘ঠিক তাই৷ কী করে জানব, বাড়ির কাজের মাসিকে ও হাত করে রেখেছিল? মাসিই ভিকিকে সব কিছু জানিয়ে দেয়৷ শনিবার রাতে যখন ভিকি আমাদের বাড়িতে এল, তখনই ওর হাবভাব দেখে বুঝেছিলাম, কোনো অনর্থ ঘটানোর জন্য এসেছে৷ মদ ঢালার পরই ও বন্ধকের জিনিসগুলো ফেরত চাইল৷ কমিশনের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ওদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হল৷ কে জানে, মদের বোতলে ভিকি বিষ মিশিয়ে দেবে? আড়াল থেকে আমি ওদের দিকে নজর রাখছিলাম৷ জয়দেবকে ছটফট করতে দেখে আমি ঘরের ভিতর ঢুকে গেলাম৷ আমায় দেখে ভিকি বলল, বন্ধকের জিনিসপত্রগুলো কোথায় আছে, আমায় বল৷ না হলে তোর আর তোর বাচ্চারও একই অবস্থা করব, যা জয়দেবের করেছি৷ তবে আমি চিৎকার করে উঠতেই ভিকি টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ পরে জানলাম, ওই রাতেই ভিকি জয়দেবের বাড়ি গিয়েছিল৷ ওর বাবাকে বলেছিল, আমি নাকি বিষ দিয়ে জয়দেবকে মেরে ফেলেছি৷ রবিবার ভোরে পুলিশ গিয়ে আমায় অ্যারেস্ট করল৷’ কথাগুলো বলে ফের কাঁদতে শুরু করল নিবেদিতা৷

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললাম, ‘এই ভিকির বাড়ি আমোদপুরের কোথায় নিবেদিতা?’

‘বাবুপাড়ায়৷ ওর বাবার নাম নরেন দাস৷ ওখানে গিয়ে খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন৷’

উঠে আসার আগে বললাম, ‘তুমি চিন্তা কোরো না নিবেদিতা৷ আমায় যা বললে, মাসুদ আহমেদকেও তা বলো৷ তুমি যাতে ছাড়া পাও, তার চেষ্টা অবশ্যই আমি করব৷’

দশ

সকালেই ফোন করে দিব্যেন্দুবাবুকে বলেছিলাম, ‘আপনার ওখানে আজ দুপুরে আমি আর সুদীশ যাব৷ আপনার এমপ্লয়িদের সবাইকে কারখানায় থাকতে বলবেন৷’

উনি সাগ্রহে বললেন, ‘চলে আসুন৷’

কাল অনেক রাতে কলকাতায় ফিরেছি৷ মনটা ভীষণ খারাপ৷ গীতার অর্ন্তধান রহস্য প্রায় সলভ করে ফেলেছি৷ তবে কাউকে কিছু বলিনি৷ আমোদপুরে না গেলে কিন্তু অন্ধকারেই পড়ে থাকতাম৷ জানতেও পারতাম না, মানুষ এমন নৃশংস হতে পারে? সুদীশকে আসতে বলায় ও বলেছিল, ‘বিনয়বাবুকেও কি নিয়ে যাওয়া দরকার?’

আমি বলেছিলাম, ‘না৷ পারলে রাধাপদবাবুকে ডেকে নিতে পারিস৷’

বেলা দুটোর সময় সুদীশকে নিয়ে রীণা ফেব্রিকসে পৌঁছোতেই দেখি, সবাই হাজির৷ এমন কী, দিব্যেন্দুবাবুর স্ত্রী রীণা সাহাও৷ অফিস ঘরে সবার বসার ব্যবস্থা হয়েছে৷ আমাকে দেখেই দিব্যেন্দুবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘গীতাদির কোনো খোঁজ পেলেন কালকেতুবাবু?’

বললাম, ‘পেয়েছি৷ কিন্তু তার আগে আমি জানাতে চাই, গীতা উধাও হল কী করে? গত শুক্রবার রাতে তারাপীঠ যাওয়ার জন্য ও বাসে উঠেছিল৷ বাসে ওর সঙ্গে পরিচিত একজনের দেখা হয়৷ তাকে দেখে গীতা খুব ভরসা পায়৷ কেননা, ওর সঙ্গে মূল্যবান কিছু গয়না ছিল৷ গীতা কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারাপীঠে যেতে পারেনি৷ তার আগেই পরিচিত লোকটির সঙ্গে ও আমোদপুরে নেমে যায়৷ তার পর থেকে ওর কোনো খবর নেই৷ প্রশ্ন হল, এই পরিচিত লোকটি কে?’

সবাই সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন৷ সুদীশই মৌনতা ভাঙল, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না কালকেতু, গীতা সরকারের পুরুষ সঙ্গীটা কে?’

চারদিকে চোখ বুলিয়ে বললাম, ‘সে এখানেই আছে৷ তার নাম ভিকি…ওরফে বিক্রম৷ আর কিছু আমি বলব না, এবার যা বলার বিক্রমই বলবে৷’

বিক্রম বলল, ‘এ সব কী হচ্ছে স্যার? আমাকে কেন ফাঁসানো হচ্ছে?’

সুদীশ আমার দিকে তাকাল৷ আমি ইশারা করে দিলাম৷ উঠে গিয়ে সুদীশ বিরাশি সিক্কার একটা চড় মারল বিক্রমের গালে৷ সঙ্গে সঙ্গে ও ছিটকে পড়ল মেঝেতে৷ জামার কলার ধরে ওকে তুলে ধরে সুদীশ ক্রুদ্ধ গলায় বলল, ‘কী হয়েছিল সত্যি করে বল৷ তুই যে সেদিন বাসে ছিলি, তার প্রমাণ আমার কাছে আছে৷ সবার সামনে বল, তার পর কী করেছিলি? না বললে থানায় নিয়ে গিয়ে তোকে থার্ড ডিগ্রি দেব৷ তখন তোর বাবার নামটা যে নরেন দাস, শুয়ার সেটাও ভুলে যাবি৷’

সুদীশের একটা থাপ্পড়ে যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল বিক্রমের৷ মারাত্মক ভয়ে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে৷ সুদীশ আর একবার হাত তুলতেই বিক্রম কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘বলছি, বলছি৷ গত শুক্কুরবার দুপুরে কারখানায় কাজ করার সময় গীতাদি হঠাৎ বলল, তারাপীঠে পুজো দিতে যাবে৷ কথায় কথায় গীতাদি তখন আরও বলে, শেষবার তারাপীঠে গিয়েছিল পনেরো বছর আগে…বিয়ের দু-দিন পর৷ শাশুড়ির দেওয়া সোনার সব গয়না পরে মা তারার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ শাশুড়ির সেই গয়নাগুলো নাকি নষ্ট করেনি, শত অভাব সত্ত্বেও৷ দশ-বারো ভরি গয়নার কথা শুনে আমার মাথা ঘুরে গেল৷ আমিই টোপটা দিলাম, মানতের পুজো দিতে যাচ্ছ যখন, তখন মায়ের সামনে ফের গয়নাগুলো পরে দাঁড়াবে না কেন? গীতাদি সরল মনে রাজি হয়ে গেল৷’

বাধা দিয়ে সুদীশ জিজ্ঞেস করল, ‘তুই যে তারাপীঠ যাবি, সেটা গীতা সরকার জানতেন?’

বিক্রম বলল, ‘না স্যার৷ বাস দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজ পেরোনোর পর গীতাদি জানতে পেরেছিল৷ বাস আমোদপুরে পৌঁছোল ভোর পাঁচটার সময়৷ তখন আমি বললাম, আমোদপুরে আমার দেশের বাড়ি৷ বাবা-মা সবাই আছেন ওখানে৷ গীতাদি চলো, এখানে নেমে যাই৷ এখান থেকে তারাপীঠ খুব বেশি দূরে নয়৷ স্নান-টান সেরে ফ্রেশ হয়ে আমরা তারাপীঠে চলে যাব৷ হোটেলের খরচটা তা হলে বেঁচে যাবে৷ শুনে গীতাদি রাজি হয়ে যায়৷ আমরা দুজন বাস থেকে নেমে পড়ি৷’ কথাগুলো বলার পরই বিক্রম চুপ করে গেল৷

সুযোগ বুঝে আমি বললাম, ‘এর পরের অংশটা আমিই না হয় বলি৷ তখনও দিনের আলো ফোটেনি৷ বাস স্ট্যান্ড থেকে গীতাকে হাঁটিয়ে বিক্রম লোকালয়ের উলটো দিকে নিয়ে যায়৷ তার পর নির্জন জায়গায় ঝোপের আড়ালে নিয়ে গিয়ে…গলা টিপে ওকে মেরে ফেলে৷ গীতার ব্যাগটা নিয়ে বাড়ি চলে যায়৷ সেই ডেডবডি তিনদিন পর স্থানীয় লোকেরা উদ্ধার করে৷ শেয়ালে খাওয়া, ডিকম্পোজড অবস্থায়৷ কাল বিকেলে আমি আমোদপুর পুলিশ চৌকিতে গিয়েছিলাম৷ ওখানে পুলিশের উদ্ধার করা কিছু জিনিস দেখি৷ তার মধ্যে রীণা ফেব্রিকসের দেওয়া গীতার আইডেনটিটি কার্ডও দেখেছি৷ বিক্রম ব্যাগ থেকে সেটা বোধহয় ফেলে দিয়ে গিয়েছিল৷ এই যে বলা হয়, কোনো অপরাধই নিখুঁত নয়৷ এটা তারই নজির৷’

অফিস ঘরে সবাই চুপ৷ বিক্রমের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে সুদীশ জিজ্ঞেস করল, ‘গয়নাগুলো কোথায় হাপিশ করেছিস, বল৷’

বিক্রমকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে আমি বললাম, ‘সাঁইথিয়া পুলিশ সেটা উদ্ধার করেছে৷ বিক্রম গয়নাগুলো গচ্ছিত রেখেছিল আমোদপুরে ওর এক বন্ধুর কাছে৷ তার নাম ছিল জয়দেব ঢালি৷ ছিল বলছি এই কারণে যে, জয়দেব ঢালি আর বেঁচে নেই৷ এই বিক্রমই তাকে বিষ খাইয়ে খুন করেছে৷ আর সুকৌশলে পুরো দোষটা চাপিয়ে দিয়েছে জয়দেবের বউ নিবেদিতা ঢালির উপর৷ কী, আমি ঠিক বলছি বিক্রম? তোমার কপাল খারাপ, আমার কাছে ধরা পড়ে গেলে৷ একটা নয়, দু-দুটো খুনের দায়ে তোমার ফাঁসি কেউ কিন্তু আটকাতে পারবে না৷’

…বিক্রমকে অ্যারেস্ট করে সুদীশ বেরিয়ে যাওয়ার পর রাধাপদবাবু বললেন, ‘গীতা যে এইভাবে খুন হতে পারে, আমি তা চিন্তাও করতে পারছি না৷ খবরটা বিনয়দের দেব কী করে কালকেতুবাবু? প্লিজ, আপনি আমার সঙ্গে ওর বাড়িতে চলুন৷’

বললাম, ‘আমি পারব না দাদা৷ উপাসনাকে কথা দিয়ে এসেছিলাম, ওর মাকে ফিরিয়ে আনব৷ কিন্তু পারলাম কই? কী করে মুখ দেখাব ওই ছোট্ট মেয়েটার কাছে, বলুন তো?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *