৫০
সেদিন একজন প্রকাশক আক্ষেপ করে বললেন, “একে-একে লেখকরা চলে যাচ্ছেন, এই যে সুনীলবাবু, হাসিখুশি মানুষটা, যাঁর বই ছাপলেই ভাল বিক্রি, তিনিও চলে গেলেন। এরপর কী হবে? বছর সাত-আটের মধ্যেই দিনটা এসে যাবে যখন বই-এর ব্যবসা বন্ধ করার কথা আমাকে ভাবতে হবে।”
ভদ্রলোকের মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম উনি কথার কথা বলছেন না। বললাম, “এখনও অনেক বিখ্যাত লেখক বেঁচে আছেন, যাঁদের বই পাঠকরা উৎসাহের সঙ্গে কেনেন।”
“আছেন। কিন্তু ক’জন আর লিখতে চাইছেন! এই ধরুন, শংকরবাবু, সেই ‘কত অজানা’র থেকে যা লিখেছেন, তাই হটকেকের মতো বিক্রি হয়েছে। বাঙালি পাঠক তাঁকে মাথায় করে রেখেছে। তিনিও আশি পেরিয়ে গিয়েছেন। গল্প উপন্যাসের চেয়ে ধর্মবিষয়ক লেখা লেখেন। বিবেকানন্দকে নিয়ে লিখতে পছন্দ করেন। তাঁর উপন্যাস লেখার মনটা বোধহয় হারিয়ে গিয়েছে। এখনও লেখালিখিতে আছেন প্রফুল্ল রায়। তাঁর বয়সও আশি ছাড়িয়েছে। শরীর সবসময় সুস্থ থাকছে না। সেই ‘কেয়াপাতার নৌকো’ থেকে অনেক বিখ্যাত উপন্যাসের লেখককে পাঠকরা ভালবেসে গ্রহণ করেছেন। ওঁর বই প্রকাশ করলে বিক্রির জন্য চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু বয়স তো সবকিছুকেই শ্লথ করে দেয়। তাই না?”
কয়েকদিন আগে সৌমিত্রদার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আশি পেরিয়ে গিয়েও দিনরাত খাটছেন। একটার পর একটা ছবি, নাটকে অভিনয় করে চলেছেন। বললেন, “বয়সের কথা ভাবি না। ওটা স্রেফ একটা সংখ্যা। তার বেশি কিছু নয়।”
শুনে খুব ভাল লেগেছিল নীরদ সি চৌধুরী একশো পার করে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ বইটি তিনি লিখেছিলেন আটানব্বই বছর বয়সে। অবশ্য এটা প্রমাণ করে না যে সবাই ওই বয়স পর্যন্ত লিখতে পারেন। নীরদ সি চৌধুরীর ক্ষেত্রে আটানব্বই একটা সংখ্যা হতে পারে, কিন্তু অনেকেরই মস্তিষ্ক এবং শরীর তখন কাজ করে না। যাঁদের করে তাঁদের একজন হলেন নীরেনদা। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। নব্বই-এর ঘরে পৌঁছে গিয়েও তিনি সমানে লিখে যাচ্ছেন। অথচ রমাপদ চৌধুরি কলম বন্ধ করেছেন শরীর যখন সুস্থ ছিল তখন থেকেই।
কিন্তু প্রকাশক যাঁদের কথা বলছেন, যাঁদের লেখা বই ভাল বিক্রি হয় তাঁরা তো এখনও আছেন। আমার কথা শুনে প্রকাশক মাথা নাড়লেন, “আছেন। বুদ্ধদেব গুহ চোখের সমস্যায় ভুগছেন। শরীরও সুস্থ নেই। লেখালিখি ইদানীং পেরে উঠছেন না। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় একসময় জনপ্রিয়তম লেখক ছিলেন। হঠাৎ তাঁর মনের পরিবর্তন হল। তিনি রামকৃষ্ণ-সারদামণিতে মগ্ন হয়ে গেলেন। দীর্ঘকাল ওঁদের কথাই লিখে গেলেন। ফলে তাঁর যে পাঠক ছিল যারা হাস্যরসে মুগ্ধ হত তারা হতাশ হল। ইদানীং সঞ্জীববাবু আবার আগের লেখায় ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু যে দিন গিয়েছে, সে দিন হুট করে কি ফিরে আসে!”
আমি বললাম, “আপনি একজনের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন।”
“ভুলিনি। তিনি আমাদের কাছে আকাশকুসুম। চাইলেও যখন পাব না, তখন মনে রেখে লাভ কী!” প্রকাশক এবার গম্ভীর।
“বুঝলাম না।”
“শীর্ষেন্দুবাবু এমনিতেই কম লেখেন। শুনেছি সম্পাদকরা ধাক্কা দিয়ে-দিয়ে ওঁর কাছ থেকে লেখা আদায় করে। আপনি ভাল বলতে পারবেন, আমার শোনা কথা, সাগরময় ঘোষ যখন ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তখন ঠিক সময়ে লেখা দিতে পারেননি বলে ওঁকে বাদ দিয়ে পুজোসংখ্যা বের করেছিলেন। তারপরেও তিনি যা লেখেন, তা আনন্দ পাবলিশার্স বই করে ছাপে। আমাদের দেওয়ার মতো কোনও লেখাই থাকে না। তাই ওঁকে ‘আকাশকুসুম’ বললাম।”
“আপনি এসব বলছেন বটে কিন্তু খবরের কাগজের পাতায় যে বেস্ট সেলারের তালিকা ছাপা হয় তাতে দেখি অনেক জনপ্রিয় লেখক আছেন যাঁদের বয়স আশির অনেক নীচে। তাঁরা তো আগামী বিশ বছরে বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন না।” বিরক্ত হয়ে বললাম।
“আপনি একটা রসিকতা নিয়ে রসিকতা করছেন।”
“কথাটার মানে কী?”
“খুব সহজ। ধরুন একজন নবীন লেখকের কোনও বই বাহান্ন সপ্তাহের মধ্যে চল্লিশ সপ্তাহ ওই বেস্ট সেলার তালিকায় ছাপা হয়েছে। আপনার যদি মনে হয় সপ্তাহে অন্তত একশো কপি বিক্রি হয়েছে ওই বই। তা হলে চল্লিশ সপ্তাহে চার হাজার কপি। বেস্ট সেলার বলে কথা। কিন্তু এত বই কোথায় বিক্রি হয়েছে, তা খুঁজে বের করা ফেলুদার পক্ষেও সম্ভব নয়। প্রকাশক সত্যি কথা বললে অন্য গল্প শুনতে পাবেন।” রহস্যের হাসি হাসলেন প্রকাশক।
“আমি আপনার সঙ্গে একমত নই। কয়েক বছর ধরে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে এক বিশিষ্ট লেখকের তিনটি বই ওই তালিকার গোড়ার দিকে থাকছে। প্রকাশক জানিয়েছেন একের-পর-এক সংস্করণ বেরিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে তিনি ‘সুপারহিট’ লেখক। যত দূর জানি ওঁর বয়স সত্তরের কোঠায়। ওঁকে বাদ দিচ্ছেন কেন?”
খুব নরম গলায় প্রকাশক জিজ্ঞাসা করলেন, “উনি কী লেখেন?”
“রম্যরচনা, জীবনী।”
“রম্যরচনার বই হু-হু করে বিক্রি হচ্ছে, এই খবর আগে কখনও শুনেছেন?”
“হয়েছে। তবে এরকম হয়নি।”
“বইগুলো সত্যি বিক্রি হয়েছে। কারণ, বাঙালির সহজাত আকর্ষণ আছে কেচ্ছাগল্পের দিকে, আর গোপন আগ্রহ আছে মনীষীদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে। তাই প্রাতঃস্মরণীয় কোনও বাঙালির ব্যক্তিগত জীবনে কোনও বই উঁকি মারলে, হু-হু করে সেগুলো বিক্রি হয়। এটাই প্রধান কারণ।”
“কিন্তু—।”
“দেখুন, বিশিষ্ট মানুষদের নিয়ে বই লিখলে সব বইতেই যে কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির কথা থাকবে, তা অবশ্যই নয়। অনেক ভাল-ভাল তথ্যও থাকে। যা ওসব বিশিষ্ট মানুষ সম্বন্ধে আমরা জানি না। তবু কিছু পাঠক প্রত্যাশা করেন যে ‘গোপন খবর’ কিছু-না-কিছু ঠিক পাওয়া যাবে। না-পেয়ে হতাশ হচ্ছেন।”
“তা হলে তো সবাই জেনে যাবে, বিক্রি কমবে।”
“না। আমরা অল্পবয়সে কোনও সিনেমা দেখে খুব খারাপ লাগলে বন্ধুদের কাছে এত প্রশংসা করতাম যাতে ওরাও সিনেমাটা দেখে। আমাদের একার পয়সা নষ্ট হবে কেন!”
এরপর ওই প্রকাশক বললেন, “আশায় আশায় আছি। যদি প্রচেত গুপ্ত, তিলোত্তমারা আরও ভাল লেখেন, পাঠকরা যদি ওঁদের লেখায় মুগ্ধ হয়, তা হলে বাংলা বইয়ের ব্যবসা বেঁচে যাবে। নইলে একের-পর-এক দোকান হয় উঠে যাবে, নয় রচনাবলি ছাপতে বাধ্য হবে।”
এই সেদিন, মাত্র পঞ্চান্ন বছর আগে, যাঁরা লিখতেন, যাঁদের অজস্র পাঠক ছিল, তাঁদের নামগুলো এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রমথনাথ বিশী, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরি, শংকর, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, আশাপূর্ণা দেবী। বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগের এইসব লেখকদের অভাব বোধ করছে কলেজ স্ট্রিট।
৫১
কলকাতায় বেড়াতে এসে প্রথম নাটক দেখেছিলাম ছাপ্পান্ন বছর আগে। বিশ্বরূপা থিয়েটারে ‘ক্ষুধা’ নাটকে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণকুমার, সুব্রতা সেন-রা অভিনয় করেছিলেন। মফসসলের সদ্য তরুণ তাঁদের অভিনয় দু’চোখ দিয়ে গিলেছিল। তার দু’বছর পরে যখন পাকাপাকি কলকাতার কর্পোরেশনের জল পেটে পড়ল, তখন থেকে নাটক দেখার ভূত ঘাড়ে চাপল। এই করতে-করতে বছর দশেক ‘দেশ’ পত্রিকায় সেই সময়কার সেরা নাটকগুলো নিয়ে যা ভেবেছি, তা লিখে গিয়েছি। তারপর একসময় একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হলাম। সেই ‘নবান্ন’ থেকে শুরু হয়েছিল। ‘নবান্ন’ অতিশয় প্রয়োজনের নাটক। কিন্তু তারপর সেই নবান্নকে ভাঙিয়ে একের পর এক গ্রুপ থিয়েটার অভাব বিক্রি করেছে বিভিন্ন মঞ্চে। দারিদ্রসীমার নীচের মানুষদের কষ্ট বিক্রি করেছে আর দর্শকরা সেই নাটক দেখতে গিয়েছেন। পয়সা দিয়ে টিকিট কিনেছেন না কষ্ট কিনেছেন, তা নিয়ে তর্কের অবকাশ নেই। যাঁরা নাটক দেখে আনন্দ পেতে চাইতেন তাঁরা যেতেন শ্যামবাজারের থিয়েটারে। সেখানে বিধায়ক ভট্টাচার্য, দেবনারায়ণ গুপ্তরা নিশ্চয়ই ভাল গল্প বলতে চাইতেন কিন্তু দর্শক যেত উত্তমকুমার থেকে অপর্ণা সেন পর্দা থেকে নেমে এসে মঞ্চে যে অভিনয় করছেন, তা দেখতে বাঙালি বৃহস্পতি-শনি-রবিবারে ভিড় জমিয়েছেন।
ওদিকে ভাল নাটক না পেয়ে গ্রুপ থিয়েটার আঁকড়ে ধরেছে বিদেশি নাটকের। তার ভাবানুবাদ, অনুসরণে টিঁকে থাকতে চেয়েছে। পাশাপাশি মনোজ মিত্র এবং মোহিত চট্টোপাধ্যায় আশার আলো দেখাচ্ছেন। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের সামগ্রিক সমুদ্রে সেই বাতিঘর আর কতটুকু আলো দিতে পারে!
আর ছিল অফিস ক্লাবের থিয়েটার, যাকে অবলম্বন করে অনেক মানুষের সংসার চলত। কেদার রায়, বঙ্গে বর্গী ইত্যাদি নাটকে গলা ফুলিয়ে সংলাপ বলতেন অফিসের বাবুরা, মহিলা চরিত্রে পেশাদার অভিনেত্রীরা, যাঁদের সমস্ত চরিত্র মুখস্থ থাকত। ঐতিহাসিক নাটকের চাহিদা বেশি ছিল, সামাজিক নাটকের মধ্যে দুই পুরুষ থেকে বউদির বিয়ে—গদগদে পারিবারিক গল্প। তখন সংলাপ মুখস্থ করে মঞ্চে উঠে তা উগরে দিলেই হাততালি, তাই নাটক।
শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় এই চোরাবলি থেকে বের হতে চেয়েছিলেন। ‘রক্তকরবী’ থেকে পুতুল খেলা, কল্লোল থেকে তিতাস, নাট্যকারের সন্ধানে থেকে পাপপুণ্য অন্য খাতের নাটক, যা করার ক্ষমতা বেশিরভাগ দলের ছিল না। এবং তার মধ্যে চাকভাঙা মধু থেকে শোয়াইক বা দায়বদ্ধ কিংবা মারীচ সংবাদ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও বলতে হবে বাংলা নাটক মানে মঞ্চ গল্প বলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। দু-পাশের উইংস দিয়ে কুশীলবরা মঞ্চে প্রবেশ করবেন। কথা বলবেন। সেই মঞ্চে বসার ঘর, শোওয়ার ঘর ছবির মতো আলাদা আলাদা থকত। তারপর নতুন রীতি চালু হল। যা শোওয়ার ঘর তাই রাস্তা করে দেখানোর সাহস দেখালেন পরিচালকরা। এমনকী, অভিনয় চলার সময় সেট সাজানোর লোকজন মঞ্চে ঢুকলেও দর্শকরা সেটা উপেক্ষা করতেন। এক সময় নাটকের শেষে লাল আলো জ্বলত। বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের নিন্দুকরা তাকে লালবাতি বলতেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাত্য বসু যখন নাটক শুরু করলেন তখন তাঁর পক্ষে পূর্বসূরিদের অনুসরণ করাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু উইঙ্কাল টুইঙ্কল থেকে বোমা নাটক যে স্রোতের অন্য ঢেউ থেকে আলাদা চেহারা নিচ্ছে তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্তু আচমকা মেঘ সরিয়ে আকাশ দেখালেন ব্রাত্য মুম্বই নাইটস তৈরি করে।
মনে আছে সাতাশি সালে যখন লন্ডনে যাই তখন নাটক দেখতে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম। মঞ্চকে ওভাবে ভেঙেচুরে ব্যবহার করা যায়, হইহই করে পাত্র-পাত্রীরা শরীরের কসরত এবং অভিনয়কে মিশিয়ে ফেলতে পারে এবং দু’ঘন্টার নাটকের শেষে দর্শকদের মনে হবে আর, কী দেখলাম, ওই অনুভূতিটা কেন বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে হয় না। কেন শুধু কথার কচকচি বা সমস্যার বোঝা টানা নাটক দেখতে বাধ্য হবেন দর্শকরা। কেন তাঁরা পয়সার বিনিময়ে বিনোদন পাবেন না। আক্ষেপ ছিল। খুব।
শেক্সপিয়র সাহেবের ‘টুয়েলভথ নাইট’ অবলম্বনে এই বিনোদনটির নাম ‘মুম্বই নাইটস’-সাহস। দুঃসাহসের বাইরে আরত্ত শক্তিশালী কোনও শব্দ যদি থাকত তাহলে সেটাও এই প্রযোজনার ক্ষেত্রে কম বলে মনে হত। ছাপ্পান্নটি চরিত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নির্বাচন করে প্রথমে তাঁদের রোবট করেছেন ব্রাত্য। রোবটদের গান এবং শারীরিক কসরত শিখিয়েছেন। তারপর তাঁদের প্রাণদান করেছেন। ফলে তাঁরা মুম্বই নাইটসেরই চরিত্র হয়ে গিয়েছেন। যতক্ষণ না শেষ হয়েছে ততক্ষণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিজস্ব পরিচয় ছিল না।
একটি পানশালাকে কেন্দ্র করে টানা গল্প শোনাননি নাট্যকার দেবাশিস বা নির্দেশক ব্রাত্য বসু। গল্প দানা বাঁধার মুহূর্তেই তা ভেঙে দিয়েছেন। আবার অবলীলায় কয়েকটি দৃশ্যের পরে গল্পটাকে টেনে এসেছেন।
এই কাহিনি মুম্বইয়ের পটভূমিকায়। ফলে হিন্দি সংলাপ এসেছে স্বাভাবিক ভাবেই। বাংলা আনতে হয় তাই। আবার যে দৃশ্যে প্রেমিকের চলে যাওয়া দেখে উষ্ণতা ষাটের দশকের নায়িকার মতো পিয়ানো বাজিয়ে সন্ধ্যা মুখার্জির গান ‘আরও কিছুক্ষণ না হয় রইতে কাছে’ গেয়ে উঠল তখন বুকের উপর কেউ যেন সুখের হাত বোলাল।
এই প্রযোজনা ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে সংগীত এবং আলোর ব্যবহার করার জন্যে দীনেশ পোদ্দার, সাধন পাড়ুই, শুভদীপ গুহ, দিশারী চক্রবর্তীদের সঠিক নির্বাচন করেছেন ব্রাত্য এবং তাঁরা নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করেছেন।
অভিনয় কেউ করেননি। সবাই এক-একটি চরিত্র হয়ে উঠেছেন। উষ্ণতা ফুল ও সমানিতে মিশে গিয়েছেন অনন্যা পাল ভট্টাচার্য। কে নয়? সুমন্ত রায়, সুমিত দত্ত, রায়তী বসুদের জন্যে অভিনন্দন রইল। আর গৌতম হালদার। তিনি যে ক্ষমতাবান অভিনেতা তা আমরা বহুদিন ধরে জানি। কিন্তু এই প্রযোজনায় আমি গৌতম হালদারকে খুঁজে পাইনি। পেয়েছি রক্তমাংসের টিক্কা আলমকে। বাংলা নাটকে এমন কাজ আর কেউ করেছেন কি না জানি না।
যেভাবে চরিত্রগুলো নেচেছে, গান গেয়েছে এবং চৌকস হিন্দি বলেছে তা চমকে দেওয়ার মতো। নবান্ন থেকে বাংলা নাটক একটা মোড় নিয়েছিল। মুম্বই নাইটস বাংলা নাটককে সাবালক করল। এত বড় বৃক্ষ তৈরি করলেন ব্রাত্য, এখন কাম্য এই বৃক্ষ বাগান তৈরি করুক।
ব্রাত্য বসু, আপনি আমাদের আকাঙক্ষা আরও বাড়িয়ে দিলেন।
৫২
এককালে কলকাতায় অনেকে ছাত্র বা চাকরিজীবী হোস্টেল বা মেসে থাকতেন। এই মেসজীবন নিয়ে অনেক উপন্যাস-নাটক-ছবি হয়ে গিয়েছে। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিটি বাঙালি কয়েক দশক ধরে দেখেছে এবং হেসেছে। ইদানীং কি চাকরিজীবীরা মেসবাড়িতে থাকছেন না অথবা থাকলেও তার সংখ্যা কমে গিয়েছে? জানি না কতটা কমেছে কিন্তু এই মুহূর্তে কারওর মুখ মনে করতে পারছি না, যিনি মেসে থাকেন।
কলকাতায় পড়তে এসে প্রথম পাঁচবছর আমি হস্টেলে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। স্কটিশ চার্চ টমোরি মেমোরিয়াল হস্টেল দারুণ ঝকঝকে ছিল। প্রথম দিন থেকেই একলা-ঘরে থেকেছি। ওখান থেকে যেতে হয়েছিল রেসিডেন্স হস্টেলে। নাক উঁচু মানুষ বলত, ওটা হরি ঘোষের গোয়াল। গ্রে স্ট্রিট আর হরি ঘোষ স্ট্রিটের মোড়ে নিয়মশৃঙ্খলার কড়াকড়ি কম থাকলেও ছাত্ররাই থাকত। তবে তারা বিভিন্ন কলেজের ছাত্র। মিল খুঁজে পাওয়া মুশকিল হত। সেখান থেকে গেলাম শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে। ছাত্ররা অবশ্য বলত, মহেশ্বর দাসের হস্টেল। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ভাষাতত্ত্ব পড়াতেন। থাকতেন হস্টেলের একদিকে, সপরিবার। ওঁর কথা বলার ধরনে একটু মেদিনীপুর-ওড়িশা সীমান্তের উচ্চারণ মিশে থাকত। তাই বোধহয় হস্টেলের রান্না থেকে বোর্ডারদের সংখ্যায় ওই অঞ্চলের প্রভাব পড়ত। কিন্তু এসব সত্ত্বেও হস্টেলগুলোতে পড়াশোনার আবহাওয়া ছিল। এমএ পরীক্ষার পর হস্টেলে থাকতে হলে তখন ল কলেজে নাম লেখাতে হত। আমি সেটা করিনি বলে মেসের সন্ধান নিতে হয়েছিল।
আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিটি কলেজের পাশে ইলিসিয়াম বোর্ডিং নামে একটি মেস ছিল। মেসের মালিক তথা ম্যানেজার ছিলেন শান্তিবাবু। খুব ফরসা এবং চর্বিবহুল শরীর ছিল তাঁর। আমাকে কিছু প্রশ্ন করে বললেন, ‘খাওয়ার সময় খেতে আসতে হবে। আগে-পরে এলে ঠাকুর খাবার দেবে না। রাত সাড়ে দশটায় গেট বন্ধ হয়ে যাবে। আর মেসে বসে মদ্যপান করা চলবে না।’
শেষের বাক্যটি শুনে মনে হল একটু মজা করি। বললাম, ‘যদি পেটের ভেতর মদ নিয়ে সাড়ে দশটার আগে ফিরে আসি, তা হলে কি আপত্তি আছে?’
শান্তিবাবু আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি মদ্যপান করো?’
মাথা নেড়ে ‘না’ বললাম। উনি হাসলেন, ‘বাঃ, বেশ রসিক দেখছি। তিন নম্বর ঘর।’
তিন নম্বর ঘরের দরজায় গিয়ে দেখলাম দু’পাশে দুটো তক্তপোশ। একটায় বিছানা পাতা। দ্বিতীয়টা খালি। আমি হোল্ড অল খুলে বিছানা পেতে গুছিয়ে বসছি, এইসময় একজন প্রৌঢ় ঘরে ঢুকলেন। তারপর পোশাক বদলে পাজামা গেঞ্জি পরে বিছানার মাঝখানে হেঁটমুন্ডু ঊর্ধ্বপদ হয়ে গেলেন। বুঝলাম এই ঘরে ওঁর সঙ্গে আমাকে থাকতে হবে। কিন্তু আমাকে দেখেই, কোনও কথা না বলে ওরকম আসন কেন করছেন তা বুঝতে পারলাম না। মিনিট চারেক ওইরকম আসনের পর বাবু হয়ে বসে চোখ বন্ধ করে গান ধরলেন। তারপর যে গান ধরলেন, তা আমি ছেলেবেলায় শুনতে বাধ্য হতাম। বাবা ছিলেন সায়গলের ভক্ত। সময় পেলেই গ্রামাফোনে সায়গলের রেকর্ড বাজাতেন। ‘গাঁয়ের বধূ’, ‘রানার’ শোনার পর আমার সায়গলের গান পছন্দ হত না। ভদ্রলোক গান শেষ করলেন। একেবারে সায়গলের গায়কি। তারপর চোখ খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কী কর্ম করেন?’
আমি তখন চাকরি খুঁজছি। সেটাই জানালাম।
‘পিতৃদেবের ভরসায় পৃথিবীতে আছেন?’
কথাটা সত্যি হলেও শুনতে ভাল লাগল না। ভদ্রলোক আবার পোশাক পাল্টালেন। তারপর বললেন, ‘গুডবাই’।
একটু পরেই শান্তিবাবু ঘরে এলেন, ‘রুমমেটের সঙ্গে আলাপ হল?’
‘হ্যাঁ। তবে কেউ কারওর নাম জানি না।’
‘ওঁর নাম বিমলেশ সরকার। বিয়ে থা করেননি। হস্টেলের কারওর সঙ্গে কথা বলেন না। ইনকাম ট্যাক্সির কেরানি। মাথায় গোলমাল আছে বলে অফিসে না গিয়েও মাইনে পান। ঠিক সময়ে মেসের টাকা দিয়ে যান। আপনাকে বিরক্ত করবেন না।’ শান্তিবাবু বললেন।
‘ওঁর কেউ নেই?’
‘না। তাই সকাল-বিকেল সামনের হৃষীকেশ পার্কে বসে গান করেন।’
এইসব বিমলেশবাবুরা তখন ছড়িয়ে ছিলেন পাড়ায়-পাড়ায়। কলকাতা থেকে যাঁদের বাড়ি ঘন্টা তিনেকের মধ্যে, তাঁরা শুক্রবারে বিকেল চারটের সময় (অফিস ম্যানেজ করে) ট্রেন ধরে বাড়ি চলে যেতেন। শনি-রবিবার পরিবারের সঙ্গে থেকে ভোরের ট্রেন ধরে মেসে এসে ভাত খেয়ে অফিসে ছুটতেন। দু’দিন চারবেলা খেতেন না বলে তাঁদের কিছু পয়সা ফেরত দেওয়া হত। এই ধরনের মেসের বোর্ডারদের বলা হত হপ্তারবাবু। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে তুলসী চক্রবর্তীকে সপ্তাহান্তে এভাবেই গ্রামের বাড়িতে যেতে দেখা গিয়েছে।
হস্টেলে থাকার সময়ে সম্পর্ক তৈরি হত। অল্পবয়স বলেই বোধহয় সেটা সম্ভব হত। মেসের বোর্ডারদের মধ্যে সেটা কদাচিৎ থাকে। মেসে থাকাটা নেহাতই প্রয়োজনের ব্যাপার ছিল। কলকাতা থেকে অনেক কিছুর মতো সেসব উঠে যাচ্ছে। এখন তো ডায়মন্ডহারবার অথবা বর্ধমান থেকে মানুষ ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে কলকাতায় চাকরি বজায় রাখেন। তখন আমি কল্পনাও করিনি কলকাতায় বাড়িভাড়া করে থাকব। বাড়ি ফেরার কথা দূরের গল্প।
আগে লিখেছিলাম, ঠাকুরঘর উঠে গিয়েছে। রান্নাঘর উঠব-উঠব করছে। আগে প্রেম করে বিয়ে করতে চাইলে অভিভাবকরা আপত্তি করতেন। ছেলেমেয়েদের সন্তান হওয়ার পর মেনে নিতেন। তারপর এটা জলভাত হয়ে গেল। এখন সম্বন্ধ করে বিয়ে দেওয়ার চেয়ে ছেলেমেয়েরা নিজেরা বিয়ে করলে অভিভাবকরা খুশি হন। যত দিন এগোচ্ছে তত মতপার্থক্য বাড়ছে, বিয়ে ভাঙছে। এখন পাড়ায়-পাড়ায় স্টে টুগেদার করে থাকা ছেলেমেয়ের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সমাজ ভেঙেছিল। পরিবার ভেঙেছে। জীবনযাপনের পুরনো রীতিগুলোও পাল্টে যাচ্ছে একের পর এক। যা করলে মানুষ একটু স্বস্তিতে থাকতে পারে, তাই করতে চাইছে। টমোরি মেমোরিয়াল হস্টেল এখন বিশাল মাল্টিস্টোরিড বাড়ি হয়ে গিয়েছে।
এবার অন্য কথা। গত তিন বছর ধরে প্রতি সপ্তাহে ‘গীতবিতান ছুঁয়ে বলছি’ লিখেছি। তা কারওর ভাল লেগেছিল, কারওর পছন্দ হয়নি। এই দুই দলের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সবাইকে একসময় থামতে হয়। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে শরীরে পচন ধরে। সেটা হওয়ার আগেই তো সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়। গত একবছর আমি কোনও গল্প বা উপন্যাস লিখিনি। ইচ্ছে করেই লিখিনি। এখন লেখার চাপ এত বেড়ে গিয়েছে যে এই কলম থামাতে হচ্ছে।
__