গীতবিতান ছুঁয়ে বলছি ৩.৪০

৪০

এককালে যখন নিয়মিত বাজারে যেতাম তখন সবজির দোকানদার অথবা মাছের দোকানদার দেখতে পেলেই চেঁচিয়ে ডাকত, ‘আসুন দাদা, একদম টাটকা মাল পাবেন।’ তরুণ বা যুবক বয়সে ‘দাদা’ ডাকটা শুনতে ভালই লাগত, যদিও যারা ডাকত তাদের কেউ-কেউ আমার থেকে বয়সে অনেক বড় ছিল। এর বছর কুড়ি বাদে এক সকালে বাজারে গেলাম। মাঝখানের সময়টা আমার বদলে অন্য কেউ কাজটা করেছে। যাওয়ামাত্র শুনতে পেলাম, ‘আসুন কাকা, অনেকদিন পরে এলেন, একদম টাটকা মাল পাবেন।’ ‘দাদা’ থেকে ‘কাকা’ হওয়াতে বিস্মিত হইনি। দেখলাম লোকগুলোরও বয়স বেড়েছে। আবার পাঁচ বছরের ব্যবধানে বাজারে যেতেই ডাক শুনলাম, ‘আসুন জ্যেঠু, অনেকদিন পরে এলেন, একদম টাটকা মাল পাবেন।’ অর্থাৎ আমি ‘দাদা’ থেকে ‘কাকা’ হয়ে জ্যেঠুতে পৌঁছে গিয়েছি, দোকানদারদেরও চুল উঠে গিয়েছে অথবা সাদা হয়েছে। কারও জায়গায় তার ছেলে বসেছে। মাছ বিক্রি করত শিবু, জিজ্ঞাসা করতে ছেলেটি বলল, ‘বাবা তো তিনবছর আগে মরে গিয়েছে।’ একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, কেউ আমাকে ‘মামা’ অথবা ‘মেসো’ বলে ডাকেনি। ‘মামা’ বা ‘মামু’ ডাকলে যে অন্তরঙ্গতা প্রকাশ পায়, তা বোধহয় ওরা আমার সঙ্গে চাইত না। এবার অনেকদিন বাজারে যাইনি। আমার বাড়ির তিন পাশে তিনটে বাজার। হাতিবাগান, শোভাবাজার এবং শ্যামবাজার। প্রথমটাতেই যাওয়া-আসা ছিল। কিন্তু মনে হল এবার বাজার পাল্টাতে হবে। মন বলছে, হাতিবাগানে গেলে নির্ঘাৎ হাঁক শুনব, ‘আসুন দাদু, অনেকদিন পরে এলেন, একদম টাটকা মাল পাবেন।’ ‘দাদা’ থেকে ‘কাকা’ ‘জ্যেঠু’ হয়ে ওরা আমাকে ‘দাদু’তে পৌঁছে দেবেই। যদিও যা বিক্রি করছে সেই মালগুলোর বয়স বাড়ছে না, একদম টাটকাই থেকে যাচ্ছে। আর ‘দাদু’ হচ্ছে এমন একটা অবস্থা যা অনেকটা মোহনায় পৌঁছে যাওয়া নদীর চেহারায় দেখা যায়।

মুশকিল হল, বয়স যে হচ্ছে এটা অনেকেই অনুভব করেন না। আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি, পঞ্চাশ পার হতে না হতেই বেশিরভাগ মানুষের হাতে লাঠি পৌঁছে যেত। ভোরে বা বিকেলে, পাকাচুল বা টাকমাথার যে মানুষগুলো পার্কে বসে পুত্র বা পুত্রবধূর গুণগান করতেন, তাঁদের বয়স ষাট বা তার আশপাশে। সকালে বাজারে যেতেন। ফিরে এসে জলখাবার এবং খবরের কাগজ পড়ে সময় কাটিয়ে দুপুরের স্নান-খাওয়া শেষ করে লম্বা ঘুম। চা খেয়ে বিকেলে একটু হাঁটতে যাওয়ার অছিলায় অন্যদের সঙ্গে আড্ডা মেরে সন্ধের আগেই বাড়ি ফিরে রেডিও, পরে টিভির সামনে বসে খবর শোনার পর রাতের খাওয়া শেষ করে আবার বিছানায়। ছয়ের দশক পর্যন্ত এঁরা কেউ প্রেশারের ট্যাবলেটের কথা জানতেন না। সাতের দশকেও নিয়মিত প্রেশার বা সুগারের ওষুধ খাচ্ছেন এমন মানুষকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। স্মৃতি বলছে ষাট থেকে সত্তরের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ গত হতেন। যাঁরা আশি পেরিয়েও বেঁচে থাকতেন তাঁদের কথা লোকে বলাবলি করত। রিটায়ার করার পরে, মেয়ের বিয়ে দিয়েই নড়বড়ে হয়ে যেতেন অনেকেই। জীবন থেকে আর কিছু পাওয়ার কথা ভাবতেন না তাঁরা।

অবস্থাটা বদলে গেল গত তিরিশ কি পঁয়ত্রিশ বছরে। শরীর ঠিকঠাক রাখতে হবে এই রকম মানসিকতা তৈরি হয়ে গেল। বিশেষ করে সুগার এবং প্রেশার পরীক্ষা করে গলদ ধরা পড়লেই ডাক্তারের নির্দেশমতো ওষুধ খাওয়াটা বাধ্যতামূলক হয়ে গেল। ফলে সত্তর আর শেষ সীমা নয়, আশি পেরিয়েও দিব্যি আছেন অনেকে।

জীবনযাপনের একটুও পরিবর্তন হয়নি অনেকের। এখনও এই মধ্যসত্তরে অনেকেই দুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাত ১ টার পরে বাড়ি ফেরেন। অবসরে আছেন এমন মানুষ সপ্তাহে তিনদিন সন্ধের পরে ক্লাবে গিয়ে রাত দশটা পর্যন্ত আড্ডা মারতে ক্লান্ত হন না। সিএবির সভাপতি জগমোহন ডালমিয়া পঁচাত্তর বছরে চলে গেলেন শুনে আমাদের হাবুলদা মাথা নাড়লেন, ‘আচ্ছা! এত অল্প বয়সে চলে গেল?’ হাবুলদা এখন অষ্টআশিতে, রোজ দু’কিলোমিটার স্বচ্ছন্দে হাঁটেন।

বয়স এখন কোনও সমস্যা নয়। আমার সঙ্গে যাঁরা নিয়মিত আড্ডা মারেন তাঁদের অনেকেই দশ বছরের বা পনেরো বছরের ছোট। তাঁরা যা পারেন, দেখেছি তা পারতে আমার অসুবিধে হচ্ছে না। গালুডি স্টেশনের একদিকে কোনও প্ল্যাটফর্ম নেই। যুবকরা তরতরিয়ে নামতে পারে। আমার মনে এসেছিল, পারব তো? পেরেও গেলাম কিন্তু পড়ে যাওয়ার ভয়টাকেও টের পেলাম। এই ভয়ের কথা সঙ্গীদের বলিনি।

নিত্য আয়নায় মুখ দেখি। দেখতে-দেখতে এতই অভ্যস্ত যে, পরিবর্তনটা আর তেমনভাবে চোখে পড়ে না। চুল পাতলা হয়েছে, সাদাটে হয়েছে, তবু। কিন্তু দিনসাতেক বিছানায় শুয়ে থাকতে বাধ্য হলে আয়নার দিকে তাকিয়ে ধাক্কা খেতেই হয়। কিন্তু চোখের তলায় চামড়া ঈষৎ ফুলে উঠল অথবা গলায় হাঁসের পায়ের ছাপ ফুটল, কিন্তু মন পাল্টাল কই? এখনও হাইওয়ে দিয়ে গাড়িতে যেতে-যেতে শেষ বিকেলের সূর্যের দিকে তাকালে ড্রাইভারকে বলি গাড়ি থামাতে। নিচে নেমে দেখি আকাশে সেই রঙের বাহার যা তরুণ বয়সে বা যৌবনেও দেখেছি অনেকবার। একটুও বদলায়নি। রঙের ওই খেলা যেমন বদলায়নি তেমনই তা দেখে মনে যে আবেগের ঢেউ ওঠে, তারও বদল হয়নি। আমি চেটেপুটে ওই সূর্য ডোবার পালা উপভোগ করলাম, আগে যেমন করতাম। ভাল কবিতা একইভাবে আমাকে আপ্লুত করে। বইমেলায় কোনও তরুণী পাঠিকা যখন এসে অটোগ্রাফ চায় তখন তার নাম জিজ্ঞাসা করি। কেউ-কেউ এমনভাবে তাকিয়ে নিজের নাম বলে যে নদীর ধারে ঢেউ এসে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তোলে। এগুলো বলে না—তোমার বয়স হয়েছে, নিজেকে গুটিয়ে ফেলো, চোখ বন্ধ করে ভাবো তুমি এখন মরুভূমির মধ্যে এক ভরদুপুরে বসে আছো।

ধাক্কাটা আসে অন্যভাবে। সেদিন ক্লাবে এক ভদ্রলোক, যিনি উত্তরবঙ্গে বড় হয়েছেন, একটি আড্ডার আয়োজন করেছিলেন। সেই আড্ডায় যাঁরা ছিলেন সব জলপাইগুড়ির। ষাট থেকে সত্তরের মধ্যে বয়স। পুরুষ এবং মহিলাও ছিলেন, যাঁদের আমি বাল্যকালে চিনতাম, শরীর এত বদলেছে যে এখন চিনতে পারিনি। তাঁরা কথা বলেছেন অসুখ নিয়ে, ডাক্তারদের সম্পর্কে, কেউ-কেউ ধর্ম নিয়ে।

আমার মনে হচ্ছিল, ওই আড্ডা থেকে কতক্ষণে বেরোতে পারব!

৪১

একটি শহর কত পুরনো হলে শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়, আমার জানা নেই। কিন্তু জানি, কেন পরিত্যক্ত হয়। প্রথম কারণ, স্থান সংকুলান হয় না, বসবাসের খুব অসুবিধে এবং আধুনিক জীবনযাপনের প্রতিবন্ধকতার জন্য পুরনো শহর ছেড়ে নতুনের দিকে মানুষ এগিয়ে যায়। ‘পুরনো দিল্লি’-কে একপাশে সরিয়ে ‘নতুন দিল্লি’ তৈরি হয়েছে, ‘পুরনো ঢাকা’-র সঙ্গে ‘নতুন ঢাকা’-র আকাশ-পাতাল পার্থক্য। পুরনো এলাকা খুবই ঘিঞ্জি, একটা ঘ্যানঘানানি আবহাওয়া চাপ হয়ে থাকে; কিন্তু কিছু পুরনো স্মৃতি মাঝে-মাঝে চলকে ওঠে। অমুকের বিরিয়ানি, তমুকের দই কী ফাটাফাটিই-না ছিল! কিন্তু ওই ঘিঞ্জি এলাকায় যাওয়ার কথা হলেই মন না-যাওয়ার বাহানা খুঁজতে শুরু করে।

কিছু দিন থেকে আমার মনে হচ্ছে, এই কলকাতার আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। সেই দিন বেশি দূরে নেই যখন এই ‘চেনা’ কলকাতাকে ‘ওল্ড কলকাতা’ বলে ঘোষণা করা হবে। এখনই এখানকার মানুষের হাঁসফাঁস করার অবস্থা এসে গিয়েছে। বাঁচার জন্য কলকাতাকে বড় হতে হচ্ছে। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে কেউ যদি বলতেন সল্টলেকে এগারো হাজার টাকা কাঠায় জমি পাওয়া যাচ্ছে, তা হলে বেশির ভাগ মানুষ শুনেও না-শোনার ভান করতেন। সল্টলেক? ওটা তো বালির উপর আগাছার জঙ্গল। দু’দিন পরে বাড়ি ভেঙে পড়বে। না-পড়লেও দেওয়ালে নোনা ধরবেই। আমাদের শ্যামবাজার-বাগবাজার-বউবাজার-ভবানীপুরের সুবিধে ওখানে কোথায়? গড়িয়াহাটের বাজারে ওখান থেকে আসতে হলে দিন ফুরিয়ে যাবে।

কিন্তু প্রয়োজন মানুষকে আবিষ্কার করতে সাহায্য করে। শুনেছি ওই এগারো হাজার টাকা কাঠার দাম বাড়তে-বাড়তে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা হয়েছে। দু’-দু’টো সিটি সেন্টার, একগাদা শপিং মল আর ব্লকে-ব্লকে বাজার তৈরি হওয়ায় ওখানকার মানুষ গড়িয়াহাট ছুটছেন না, বরং দক্ষিণের মানুষ সিটি সেন্টারে আসছেন। কলকাতার পাশে ‘নতুন’ কলকাতা এদিকে যেমন তৈরি হয়ে গিয়েছে, তেমনই দক্ষিণেও কলকাতা আধুনিক চেহারা নিয়ে বেড়ে চলেছে। নিউ ইস্ট কলকাতা এবং নিউ সাউথ কলকাতার মানুষ ‘ওল্ড’ কলকাতায় আসতে চাইবেন না, দিনটা বেশি দূরে নয়।

দেখতে-দেখতে এই কলকাতার রাস্তায় পথচলা কী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। প্রথমত রাস্তার যা-অবস্থা এবং তার উপর দিয়ে যত গাড়ি চলা উচিত তার বহুগুণ গাড়িকে পথে নামার অনুমতি দিচ্ছে ‘মোটর ভেহিকেলস’। বোঝাই যাচ্ছে, এই বাবদ যে মোটা কর পাওয়া যায়, তার দিকেই সরকারের ‘লক্ষ্য’। ফলে যে-রাস্তাটা দশ মিনিটে যাওয়া যেত, তা এখন যেতে পঁচিশ মিনিট লাগছে। ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে এসব নিয়ে কেউ ভাবতেই চাইছেন না। রোজ-রোজ সস্তার গাড়ির বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে। চার বছরের পুরনো দামি গাড়ি দু’-লাখে কিনে নেওয়া যাচ্ছে। নতুন গাড়ি না-হয় একটু বেশি। সেগুলো যখন রাস্তায় বের হচ্ছে, তখন সরকার কোনও সীমারেখা টানছে না। বছর তিনেক আগেও কলকাতার রাস্তায় স্কুটার এবং মোটরবাইক দেখা যেত। যাঁরা সেগুলি চালাতেন, তাঁরা রাস্তার একধার দিয়ে যেতেন। কোনও ঝুঁকি নিতেন না। হঠাৎ দুদ্দাড় করে মোটরবাইকের সংখ্যা বাড়তে লাগল। স্কুটার তো কালেভদ্রে দেখা যায়। মনে হয়, সরকার দু’-হাত উজাড় করে মোটরবাইকের লাইসেন্স বিতরণ করছেন। বছর খানেকের মধ্যে সেইসব চালকের সাহস বেড়ে গেল। তাঁরা রাস্তার একপাশে নয়, মাঝখান দিয়ে বাইক চালাতে শুরু করলেন। দু’টো গাড়ির মাঝখানে সামান্য ফাঁক দেখতে পেলে তার মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে বেরিয়ে যেতে শুরু করলেন। প্রথম দিকে অল্পবয়সি চালকদের এই কাজটা করতে দেখতাম, এখন আর বয়স আটকে থাকছে না। প্রায় প্রতিদিন এগিয়ে যাওয়ার তাড়ায় সামনের গাড়িকে ডিঙিয়ে যাওয়ার সময় তার সামনের দু’পাশের আয়নাকে অবলীলায় ভেঙে দিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু তাদের মুখ হেলমেটের আড়ালে, তাই প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। যে কোনও লাল আলোয় গাড়ি দাঁড়ালে পিলপিল করে শ’-খানেক বাইক বিপজ্জনকভাবে এসে সামনে দাঁড়াবে। এঁদের জীবনের সব দায়িত্ব নেবেন অন্য গাড়ির চালকরা। অন্যায়ভাবে এঁরা গাড়ি চালান, অন্য গাড়ির ড্রাইভাররা ঠিক বাঁচিয়ে দেবেন—ভেবে এঁরা এখন বেপরোয়া। দেখা যাচ্ছে, অল্পবয়সি মহিলারাও এখন বাইক নিয়ে পথে নামছেন—যদিও তাঁরা ছেলেদের মতো বেপরোয়া হয়ে ওঠেননি। জানতে ইচ্ছে করে, গত তিন বছরে সরকার কত বাইককে লাইসেন্স দিয়েছেন? প্রায়ই কাগজে পড়ছি, মদ্যপান করে বাইক চালিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করেছেন বাইক-চালক। খবরটাকে দুঃখজনক বলে মনে হয় না। এই গতকালই এক যুবক হেলমেটের মধ্যে মোবাইল চালু রেখে কথা বলতে-বলতে যেতে গিয়ে বাসের গায়ে ধাক্কা খেলেন। মাটি থেকে উঠে তিনি বাসচালককে অশ্লীল গালাগালি দিতে লাগলেন। আমার মনে হচ্ছিল, ওঁর মোবাইল কেড়ে নিই। এখন ইচ্ছেগুলো গিলতে হয়।

‘স্টার থিয়েটার’ থেকে শ্যামবাজারের দিকে এক-বিকেলে আসতে গিয়ে দেখলাম ফুটপাত নেই। সব হকারদের দখলে। হকাররা সর্বহারা। কিছু বলা চলবে না। কিন্তু তাঁরা রাস্তাতেও নেমে এসেছেন। সেই সঙ্গে ভয়ঙ্কর ট্রাফিক জ্যাম। পা ফেলতে পারছি না যে এগোব। গিজগিজ করছে মানুষ। একজনকে পথ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলে বললেন, ‘পুজোর বাজার করতে বেরিয়েছেন? না? তা হলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন কেন? যত্তসব!’ অনেক কিছু বলতে পারতাম। বললাম না, ইচ্ছেগুলো গিলতে হল।

যে-রাস্তায় এতকাল স্বচ্ছন্দে যাওয়া-আসা করেছি, তা একটু-একটু করে ছোট হয়ে গেল। দু’পাশে অস্থায়ী দোকান স্থায়ী হয়ে বসে গেল। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাড়ির পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করল বেকার যুবকরা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাতিবাগানে যাওয়া প্রায় অসাধ্য। এসব গিলতে হবে, সরকার নির্বিকার। ফলে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নতুন শহর দরকার। কলকাতা শহরটাকে না-ছেড়ে তার আগে ‘নিউ’ বসিয়ে দিলেই হল। এই ‘ওল্ড’ কলকাতায় মোটরবাইকের দৌরাত্ম্য, ফুটপাত দখলদারদের আস্বালন থাক, ‘নিউ’ ক্যালকাটায় যদ্দিন একটু স্বস্তিতে বাঁচা যায়, তত দিনই লাভ।

৪২

বাংলা ভাষায় লেখালিখি করে সাহিত্য আকাদেমির পুরস্কারে সম্মানিত হওয়া খুব বড় ব্যাপার ছিল এই সেদিন পর্যন্ত। সেই সব পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের পাঠকরা সম্মান করতেন এবং তাঁদের পুরস্কার নিয়ে কোনও বিতর্ক ছিল না। শুধু একবার, তখন আমরা যুবক, একজনের পুরস্কার পাওয়া নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল। সেটা ক্রমশ নিন্দার ঝড় হয়ে গেল। যাঁকে পুরস্কৃত করা হল তাঁর নাম কমল দাস। বাঙালি পাঠক তাঁর নাম শোনেনি, বই পড়েনি। কিন্তু সেই মহিলার স্বামীর লেখা ‘রাজোয়ারা’ উপন্যাসটি জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই লেখকের নাম দেবেশ দাস।

ওই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এই পুরস্কার ঘোষণা হওয়ার পর বইটির বিক্রি বেড়ে যেত। যেমন বিমল করের ‘অসময়’ পুরস্কৃত হওয়ার আগে যা বিক্রি হয়েছে তার বহুগুণ বিক্রি পরে হয়েছে। সমরেশ বসুর ‘শাম্ব’ এমনিতে জনপ্রিয় উপন্যাস কিন্তু তারও বিক্রি বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল সাহিত্য আকাদেমির পুরস্কার পাওয়ার পর।

আমরা জেনেছি সাহিত্য অকাদেমি একটি স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্যই অনুদান দেন কিন্তু শাসন করেন না। এই পুরস্কার আমাকে যতটা গর্বিত করেছিল, লজ্জিত তার থেকে কম নয়। সেটা উনিশশো চুরাশি সাল। ‘উত্তরাধিকার’-এর পর ‘কালবেলা’ বেরিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে ‘কালপুরুষ’ লিখছি। হঠাৎ এক মধ্যরাতে খবর পেলাম কালবেলা সাহিত্য আকাদেমির পুরস্কার পেয়েছে। তখন বইটি সামান্যই বিক্রি হয়েছিল। মধ্যরাতে খবর পাওয়ার কারণ, আমি যেখানে ছিলাম সেখানে যোগাযোগের সহজ ব্যবস্থা ছিল না। চল্লিশ বছর বয়সে ওই পুরস্কার পেয়ে যতটা খুশি হয়েছিলাম ঠিক ততটাই মনে হয়েছিল, আমি বোধহয় ওই পুরস্কারের যোগ্য নই। আমার চেয়ে দশ বছর আগে যাঁরা লিখছেন, যাঁদের লেখার আমি একনিষ্ঠ পাঠক, বাঙালি পাঠকসমাজ যাঁদের লেখা পড়তে উৎসুক তাঁদের আগে আমাকে পুরস্কার দেওয়ায় স্বচ্ছন্দ ছিলাম না।

পরে আমাকে কয়েকবার এই পুরস্কারের বিচারক করা হয়েছিল। তখন যে নিয়মাবলি পড়েছিলাম তাতে বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা চোখে পড়েছিল। যে বইটিকে পুরস্কৃত করা হবে, তার প্রকাশ বেশি পুরনো হওয়া চলবে না, সংকলন গ্রন্থ পুরস্কারের আওতায় আসতে পারবে না। অতএব কোনও মূল্যবান গ্রন্থ যদি গত তিন বছরের মধ্যে পুরস্কৃত না হয়ে থাকে তাহলে তাকে আর পুরস্কৃত করা যাবে না। প্রতিবারই আমাকে গোটা কুড়ি বই পাঠানো হত। ওগুলো প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা বই। আমি সেগুলো পড়ে মিটিং-এ গিয়ে দেখেছি আর যিনি বিচারকের প্যানেলে আছেন তিনি একটি বইও পড়ে আসেননি। এই ঘটনা আগের যুগে ঘটত না। আমার সহ-বিচারক ছিলেন পশ্চিমবাংলার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় বিদগ্ধ মানুষ। তাঁর বয়স হয়েছিল। তিনি কয়েকটি নাম শুনে এসেছিলেন যাঁদের কেউ পুরস্কারের যোগ্য নন। আমি বুঝলাম ওঁকে ব্যাপারটা বোঝানো দরকার। সেটা খুব দুরূহ ব্যাপার ছিল। শেষ পর্যন্ত যাঁকে পুরস্কৃত করার জন্য আমরা একমত হই তাঁর নাম যেন অফিসিয়াল ঘোষণার আগে বাইরে না জানাই এমন অনুরোধ করা হয়েছিল সাহিত্য আকাদেমির পক্ষ থেকে। কিন্তু বাইরে বেরোবার পনেরো মিনিটের মধ্যেই বইটির প্রকাশক মোবাইলে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন খবরটি সত্যি কি না। আর একবার একজন অতি বয়স্ক কবি আমাকে অনুরোধ করেন একজন অনুজ কবিকে পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করতে, কারণ সেই অনুজ কবি তাঁর স্ত্রী-বিয়োগের কারণে খুবই শোকাহত। আমি বুঝতে পারছিলাম পুরস্কারের মান ধীরে-ধীরে নেমে যাবে এইভাবে চললে। সেই বছর একজন তরুণ ঔপন্যাসিক পুরস্কৃত হলেও পরের দু’বছরের মধ্যে সেই অনুজ কবির পুরস্কার পাওয়ার খবরটা কাগজে পড়লাম।

এইসব কথা মনে আসছে ক’দিন ধরে কাগজ এবং টিভিতে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পাওয়া লেখকদের কাজকর্ম নিয়ে খবর হচ্ছে বলে। একটি কুৎসিত হত্যাকাণ্ড এবং একটি ধর্মান্ধ দলের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু মানুষ সাহিত্য আকাদেমি থেকে পাওয়া পুরস্কার ফেরত দিয়ে নিজের বিবেক পরিষ্কার করতে চাইছেন। এই ব্যাপারটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। মনে প্রশ্ন জাগছে।

এক, এইসব লেখকরা যাঁরা পুরস্কার ফেরত দিচ্ছেন তা কাকে দিচ্ছেন?

দুই, যদি কেন্দ্রীয় সরকারকে দিয়ে থাকেন, কারণ তাঁদের অপদার্থতার জন্য এই নির্মম ঘটনাগুলো ঘটছে, তাহলে বলতে হবে তাঁদের প্রতিবাদ মোদি সরকারের বিরুদ্ধে।

তিন, ধরা যাক যিনি ইন্দিরা গান্ধী বা রাজীব গান্ধীর আমলে পুরস্কৃত হয়েছেন সেই পুরস্কার এখন যাঁর সরকারকে ফেরত দিলেন তাঁদের ভাবনাচিন্তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। দু’টো দুই রাজনৈতিক দলের সরকার।

চার, সাহিত্য আকাদেমি একটি স্বয়ংশাসিত সংস্থা। তাঁরা যে পুরস্কার দিয়েছে তা ফেরত দিয়ে সরকারকে কি লজ্জিত করা যায়?

পাঁচ, প্রত্যেক লেখকের নিজস্ব পাঠক থাকে। সেই মতো তাঁদের বই বিক্রি হয়। যেমন শংকরের পাঠক সংখ্যা বিমল করের থেকে অনেক বেশি ছিল। সুনীলদার বই আমাদের চেয়ে বেশি বিক্রি হত। কিন্তু সাহিত্য আকাদেমির পুরস্কার ঘোষণা করার পর বইটির বিক্রি কিছুদিন আগেও হুহু করে বেড়ে যেত। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, আমার অনেক বই আট-দশ হাজারের বেশি বিক্রি হয়নি। কিন্তু পুরস্কৃত কালবেলার বিক্রি দেড় লক্ষ ছাড়িয়েছে। যে সব লেখক পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের পুরস্কৃত বই-এর বিক্রিও অনেক বেশি হয়েছিল। অনেক বেশি টাকা তাঁরা পেয়েছেন প্রকাশকের কাছ থেকে। জানতে ইচ্ছে করছে, পুরস্কার ফেরত দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেই টাকাটাও কি দিচ্ছেন তাঁরা? দিলে ব্যাপারটা ফিরিয়ে সৎ দিক দেখতে পেতাম।

ছয়, পঁচিশ-তিরিশ বছর আগে পাওয়া ওই পুরস্কার এখন এত পুরনো হয়ে গিয়েছে, পাঠকের দূরের কথা, লেখকরই মনে থাকে না। হঠাৎ তেড়েফুঁড়ে আলমারি থেকে বের করে ফেরত দিচ্ছি বলার ব্যাপারটা সহজে হাততালি পাওয়ার মতো ঘটনা বলে কি মনে হচ্ছে না?

সাত, যাঁরা এককালে পুরস্কৃত হয়েছিলেন, এখন হারিয়ে গিয়েছেন, পাঠক যাঁকে মনে রাখেননি তিনি কি এইভাবে ‘লাইমলাইটে’ আসতে চাইছে?

আট, যে ঘটনাগুলোর প্রতিবাদে এইসব করা তা না করে লেখকরা যদি তাঁদের ভাষার কাগজে লিখে জনমত তৈরি করতেন তাহলে সেটা শ্রদ্ধার ব্যাপার হত। তবে সেটা করতে পরিশ্রম করতে হত।

৪৩

কয়েক মাস আগে শহরজুড়ে বিজ্ঞাপন সাজিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করছেন বলে সেই বিজ্ঞাপনে দাবি করেছিলেন। লক্ষ করছিলাম, ওই খবরে মানুষ বেশ পুলকিত হচ্ছে। একজন তো আহ্লাদের গলায় বলেই ফেললেন, “উঃ, ভাবতেই পারছি না। বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্গা ঠাকুর দেশপ্রিয় পার্কে দেখা যাবে! আচ্ছা, আইফেল টাওয়ারের চেয়ে বড় হবে?

তাকে মনে করাতে হল আইফেল টাওয়ার দুর্গামূর্তি নয়। পৃথিবীর যেসব জায়গায় বাঙালিরা বাস করেন তাঁদের অনেকেই দুর্গাপুজো করেন বটে কিন্তু সেই পুজো প্যান্ডেল বেঁধে করার অনুমতি পাওয়া যায় না। কমিউনিটি হল বা বেসমেন্টে বড় ঘরে সেই পুজো করতে বাধ্য হন তাঁরা। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশ থেকে মূর্তি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তার উচ্চতা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে না রাখলে অনুমতি পাওয়া যায় না। অর্থাৎ আমাদের গ্রামবাংলার সাবেকি দুর্গাপ্রতিমার চেয়ে বড় বিদেশের দুর্গা নয়। আর বাঙালি ছাড়া বিদেশিরা এই পুজোয় একটুও আগ্রহী নয় বলে বিশ্বের অন্যান্য দুর্গা প্রতিমার সঙ্গে তুলনা করা বেশ হাস্যকর ব্যাপার বলে মনে হচ্ছিল। এবং তারপর অন্য একটি পুজোর কর্তারা বিজ্ঞাপনে লিখলেন— “ওরে পাগল! মা কি ছোট বা বড় হয়!” কিন্তু বাঙালি হুজুগে জাতি। কিন্তু হুজুগটা ওই পর্যায়ে যাবে তা ভাবিনি। শুনেছি কয়েক লক্ষ মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশপ্রিয় পার্কের দুর্গা দেখতে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ হস্তক্ষেপ করেছিল, দর্শকদের জন্য পুজো বন্ধ করে দিয়েছিল। গুজব রটেছিল দু’তিনজন মানুষ ভিড়ের চাপে মারা গিয়েছেন। তাদের মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলা হয়েছে, নইলে আগুন জ্বলত। বাল্যকাল থেকে ভিড়ের চাপে, পুলিশ গুলি চালালে অথবা দাঙ্গা লাগলে নাকি মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলা হয় বলে রটনা শুনে এসেছি। কী করে ওই কাজটা করা হয় তা জানতে পারিনি। দেশপ্রিয় পার্কে এরকম ঘটনা ঘটেনি। ঘটলে চাপা থাকত না। কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে ঘটতে পারত। শুধু কলকাতার মানুষ নয়, কলকাতার বাইরে থেকে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের হোটেলে ঘর ভাড়া করে অনেকে ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্গা দর্শন করবেন বলে। সীমান্ত পেরিয়ে ভিসা নিয়ে বেশ কিছু পরিবার এসেছিলেন, না দেখতে পেয়ে আফসোস করেছেন টিভির ক্যামেরার সামনে, ‘এমন জিনিস দেখতে পেলাম না।’

আমরা জানি কুম্ভমেলায় ভিড়ে মানুষ পায়ের চাপে মারা যায়। এই বছর হজ করতে গিয়ে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। দুটি জায়গাতেই ধর্মবিশ্বাসী মানুষেরা যান। ফলে তাঁদের মনে একটা মরিয়া ভাব থাকে। সেটা ভাল না খারাপ ওই তর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু দেশপ্রিয় পার্কের দুর্গা দেখতে যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা কারা? আমার এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, “ওরা জনসাধারণ। তার মধ্যে খ্রিস্টান, মুসলমান, ধর্মের মানুষ যেমন ছিলেন, তেমনই তথাকথিত হিন্দু ধর্মের মানুষও ছিলেন।

আমরা জানি, বাংলায় অনেক গ্রামের পুজোয় তথাকথিত হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষরা হাত মেলান। পুজো কমিটির প্রেসিডেন্ট একজন মুসলমান হলেও অস্বস্তি হয় না। অতএব দেশপ্রিয় পার্কের বিশ্বরূপ দর্শন করতে যে জনপ্রবাহ ছুটেছিল তার মধ্যে মুসলমান বা খ্রিস্টান থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাকি যাঁরা, সরকারি ফর্মে রিলিজিয়ন লেখার সময় হিন্দু লেখেন তাঁরা কতখানি ধর্মের টানে অথবা মজা দেখার উৎসাহ নিয়ে গিয়েছিলেন তা জানতে আগ্রহী হয়েছিলাম। সেই সন্ধ্যাবেলায় দেশপ্রিয় পার্কের ধারে কাছে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু সেদিন যাঁরা ওখানে গিয়েছিলেন তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। একজন পুরুষ, যাঁর বয়স বাষট্টি, ভিড়ের ধাক্কায় পায়ে সামান্য আঘাত পেয়েছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কেন ওখানে গিয়েছিলেন?”

“মাসের পর মাস দেওয়ালে, টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখে মনে হয়েছিল না দেখলে খুব মিস করব। বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্গাপ্রতিমা বলে কথা!” ভদ্রলোক বললেন।

“এরকম বিপদ হবে তা কি ভেবেছিলেন?”

“একদম না। মাসের পর মাস বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, সরকার, মানে পুলিশ নিশ্চয়ই সব জানে। মন্ত্রীরাও আছেন। বিপদের কথা মাথায় আসেনি।”

“আর কোথাকার ঠাকুর দেখলেন?”

“পাড়ার ঠাকুর ছাড়া অন্য কোথাও যাইনি। ওসব পোষায় না।”

“আপনি অঞ্জলি দেন?”

 “ছেলেবেলায় বারদুয়েক, পঞ্চাশ বছরের মধ্যে দিয়েছি বলে মনে পড়ে না।”

“বাড়িতে ঠাকুরঘর আছে?”

“ছিল। মানে একান্নবর্তী পরিবারেযখন ছিলাম তখন ছিল। তারপর সেই বাড়ি ভেঙে প্রোমোটার ফ্ল্যাট বানিয়ে দিল তখন ঠাকুরের জন্য আলাদা ঘর রাখা গেল না। দেওয়ালে দুই-তিনটি ছবি আছে। রোজ একবার ধূপের ধোঁয়া খান রামকৃষ্ণ আর লোকনাথ বাবা।”

“আপনি রোজ প্রার্থনা করেন?”

“প্রার্থনা? কীসের প্রার্থনা?”

“একজন মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ রোজ পাঁচবার প্রার্থনা করেন। শান্তির জন্যে, মঙ্গলের জন্য বছরে একমাস রোজা পালন করেন। আপনি কি তেমন কিছু—?”

হাত নাড়লেন, ‘দূর মশাই! জন্মসূত্রে আমি এমন একটা ধর্ম-পেয়েছি তাতে কিছু না করলেও দিব্যি চলে যায়।”

আপনি ধর্ম পেয়েছেন? আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার বাপ-ঠাকুর্দার ধর্ম তো আমারই ধর্ম। পুরুত যখন মন্ত্র পড়ত তখন, ওই ছেলেবেলায়, হাত জোড় করে বড়দের দেখাদেখি বসে থাকতাম, বিন্দুমাত্র মানে না বুঝলেও আফসোস হত না, বাপ-মায়ের শ্রাদ্ধ করেছি সেই ভাষার মন্ত্র শুনে। কারণ সেটা নাকি দেবতাদের ভাষা, কিন্তু আপনার মতলবটা কী বলুন তো? এসব প্রশ্ন করছেন কেন? আর কোনও সাবজেক্ট নেই?

ভদ্রলোকের কথা আমার পছন্দ হল। আমাদের বেশিরভাগই তো ওঁর মতন।

পাড়ার কিছু যুবক আমার কাছে এল, সামনের বছর পুজো শুরু করব। থিম বলুন।’

 বললাম, “সবে ভাসান হয়েছে, এখনই সামনের বছর?”

“হেভি কম্পিটিশন। থিম বলুন।”

বললাম, “বিশ্বের ক্ষুদ্রতম দুর্গা প্রতিমা তৈরি করো। একটা শক্তপোক্ত প্ল্যাটফর্মের উপর বিশাল মাইক্রোস্কোপ বসবে। পাবলিক লাইন দিয়ে তার ভিতর দিয়ে দেবীদর্শন করবে। কী পছন্দ হচ্ছে?

ছেলেগুলো আবার হাসল। বলল, ‘ফাটাফাটি।’

৪৪

কয়েকবছর হল পুজো আসছে ভাবলেই অস্বস্তি শুরু হচ্ছে। কাজকর্ম ফেলে কোনও বনবাদাড়ে গিয়ে যে বসে থাকব তা-ও সব সময় হয়ে ওঠে না। আমি থাকি শ্যামবাজারে। দু’দিকে দুটো বড় রাস্তা, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট আর চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ। গোটা বছর প্রথম রাস্তা দিয়ে সন্ধের পরে বাড়ি ফিরতাম। পুজোর দেড়মাস আগে এক সন্ধ্যায় রংমহল থিয়েটারের কাছে এসে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। কুড়ি মিনিটেও যখন চাকা নড়ল না তখন ড্রাইভার খবর নিয়ে এসে জানাল, ‘হাতিবাগানে রাত দশটার আগে গাড়ি যাবে না। ‘পাবলিক’ পুজোর বাজার করছে। অর্থাৎ একটি বড় রাস্তা পুজো আসছে বলে আমাদের এড়িয়ে যেতে হবে। ভরসা একমাত্র চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ। কিন্তু পুজো যখন পনেরো দিন পরে তখন দুপুরে ওই রাস্তায় পৌঁছে দেখা গেল সামনের গাড়ির ডিকির লাগোয়া পিছনের গাড়ির বনেট শান্তিতে রয়েছে। এই জ্যাম চলবে দশমী পর্যন্ত। রোজ তো এত গাড়ি থাকে না। হঠাৎ কেন? ড্রাইভার জানাল, সবাই পুজোর বাজার করতে বেরিয়েছে। কোয়েস্ট মল থেকে সাউথ সিটি যাচ্ছে সবাই। অর্থাৎ মহালয়া পর্যন্ত গাড়ি বের করার কোনও মানেই হয় না। আর তারপর থেকে দশমী পর্যন্ত দিনরাত ঠাকুর দেখার ভিড় শুরু হয়ে যাবে। সেই ভিড়ের চেহারা বড় হবে মফসসলের দর্শনার্থীদের জন্য। এই সময় কারও অসুস্থ হওয়া নিষিদ্ধ। কারণ তাকে হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা বিফল হবে।

অতএব নিজের গাড়ি ছেড়ে বাধ্য হয়ে অটোকে হাত দেখাতে হল। উল্টোডাঙায় যাব। লোকটা বলল, ‘উঠুন কিন্তু তিরিশ টাকা দিতে হবে।’

‘আমি শেয়ারে যাব ভাই, ফুল অটো নয়।’

‘তিনজন তো পিছনে বসে আছে দেখছেন। পুজোর সময় ভাড়া তিরিশ হয়ে গিয়েছে।’

‘সে কী! কাগজে তো পড়িনি।’

অটোচালক এমনভাবে তাকাল যে, মনে হল আমার মতো উজবুক লোক সে জীবনে দেখেনি। কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে আর একজন যাত্রী পেয়ে গেল সে।

পুজো আসছে বলে আট-দশ টাকার বদলে তিরিশ চাইছে? প্রশাসন বলে কিছু নেই! রাস্তার মোড়ে ‘কে. পি’ লেখা বাইকের পাশে উদাসীন ভঙ্গিতে দাঁড়ানো সার্জেনের কাছে গিয়ে ব্যাপারটা বললাম। শোনার পর তিনি বললেন, ‘তো?’

‘লোকটা বেআইনিভাবে বেশি ভাড়া চাইছে। কিছু করুন।’

সঙ্গে-সঙ্গে সার্জেন ওয়াকি টকি বের করে মাথা নাড়তে-নাড়তে কথা বলা শুরু করলেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর নিজেকে এক ধরনের গবেট বলে মনে হল।

একটা খালি ট্যাক্সি আসছিল। দেখে চিত্ত জুড়িয়ে গেল। যত জ্যামই হোক চল্লিশ টাকার বেশি মিটারে উঠবে না। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘যাবেন?’

‘আপনাদের সেবায় তো বেরিয়েছি স্যর। কাউকে রিফিউজ করি না।’

‘না, খুব জ্যাম তো।’ দরজা খুলে সিটে বসে বললাম, ‘উল্টোডাঙায় যাব।’

‘নিশ্চয়ই। মিটারে যা উঠবে তার উপরে একটু বোনাস দিতে হবে, স্যর।’

‘বোনাস?’ হকচকিয়ে গেলাম।’

‘আমাদের তো চাকরিবাকরি নেই অথচ পুজো আসছে। সবাইকে জামাকাপড় দিতে হবে। আপনারাই তো মালিক, তাই আপনাদের কাছ থেকে বোনাস চেয়ে নিচ্ছি। বেশি নয়, তিরিশ টাকা দিলেই খুশি হব, ওটা দিতে নিশ্চয়ই আপনার কষ্ট হবে না।’

উল্টোডাঙা পৌঁছেছিলাম। দশ মিনিটের রাস্তা আধঘন্টায়। তখন আফসোস হচ্ছিল, অটোয় উঠলে তিরিশ টাকায় পৌঁছনো যেত।

বাজারে গিয়ে দাম শুনে মাছওয়ালার দিকে তাকালাম। লোকটা লজ্জা-লজ্জা হাসি হাসল, পুজোর বাজার স্যর, সাপ্লাই কম, বেশি দামে কিনতে হচ্ছে তো। আচ্ছা আপনি পাঁচটাকা কম দেবেন।’

বাড়ি এসে বললাম, ‘এই কদিন মাছ খাব না।’

‘অসম্ভব। পুজোর চারদিন নিরামিষ? একদিন তো হয়ই।’ সমস্বরে প্রতিবাদ হল।

কিছু করার নেই। স্রোতে ভাসছি। ভাসতেই হবে।

পাড়ায় দু’দুটো পুজো। খুব আকচা-আকচি। গত বছরও দুশো করে চাঁদা দিয়েছি।

এবার হাজার করে চাইল। চোখ কপালে তুলতে বলল, ‘এবার দশ-বিশ টাকা যারা দিত, তাদের বাদ দিয়েছি। ওই টাকার জন্য অত ঘোরাঘুরি পোষায় না। তাই আপনাদের কাছে আবেদন রাখছি।’

‘আমি কোত্থেকে দেব?’

‘ছিঃ। একথা বলবেন না। আপনি আমাদের পাড়ার গর্ব।’ ছেলেটি গলা নামাল, ‘তা ছাড়া আর একটা সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে যে।’

‘সর্বনাশ? কে করল?’

‘আর বলবেন না। সিবিআই।’

‘অ্যাঁ?’

‘বলছি কী! যারা আগে স্পনসর করত তারা সিবিআই-এর ভয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছে, অথচ বাজেট কমাতে পারছি না আমরা। ওই সারদার জন্য ডুবে গেলাম। তাই আপনারা যদি এগিয়ে না আসেন তা হলে ভাসব কী করে বলুন!’

যে ছেলেটা সকালে কাগজ দেয় সে এসে প্রায় কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘আমাকে বাঁচান। সেই আগস্ট মাসে পুজোসংখ্যা স্টক করেছিলাম বিক্রি করে দুটো পয়সা পাব বলে। নাইনটি পার্সেন্ট বিক্রি করতে পারিনি।’

‘সে কী? কেন? অনেক সময় তো পেয়েছিলে?’

‘কী করে বিক্রি করব? লেখকদের নাম দেখে কেউ কিনতে চাইছে না।

আপনি তো এবছর কোথাও লেখেননি। নিশ্চয়ই কোনও কাগজ ফ্রি-তে আপনাকে পুজোসংখ্যা দেয়নি। গোটা পাঁচেক নিন না। আমি ফাইভ পার্সেন্ট ছাড় দেব।’

পাহাড়ের দেবী বঙ্গভূমিতে এসে তুলকালাম বাধিয়ে দিচ্ছেন ক’বছর ধরে। দিন দিন আরও বাড়বে।

পরিত্রাণের কোনও রাস্তা নেই। এই বিনোদন বন্ধ করার কথা চিন্তাও করা যায় না। যতই নাভিশ্বাস উঠুক।

৪৫

ধর্মতলায় কিছু মানুষের সামনে একজন রাজনৈতিক নেতা সবাইকে অনুপ্রাণিত করতে গোমাংস ভক্ষণ করছেন। তিনি যে রাজনৈতিক দলের সমর্থক তার ঠিক বিপরীত মেরুর ভাবনা নিয়ে যে দল এখন পশ্চিমবঙ্গ শাসন করছে সেই দলে সদ্য যোগ দেওয়া এক কবি পাশে দাঁড়িয়ে সেই মাংসের স্বাদ গ্রহণ করছেন। দু’জনের চোখে মুখে যে উল্লাস ফুটে উঠেছিল, তা টিভির ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল। যেভাবে দ্রুত ওই মাংস চিবিয়ে নরম করে ওঁরা গলার ভিতর দিয়ে উদরে পাঠাচ্ছিলেন তাতে মনে হচ্ছিল, গোমাংস নয়, শিবসেনা অথবা বিজেপি যে অকারণ অস্থিরতার আমদানি করেছে, তা এখনই দূর হয়ে যাবে।

মনে পড়ল আমার মাস্টারমশাই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। বলেছিলেন, ‘স্থবিরতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা অবশ্যই উচিত, কিন্তু উৎকটভাবে নয়। এই যে কলেজ স্কোয়ার, এখানে বসে ডিরোজিওর বিপ্লবী শিষ্যরা পা ছড়িয়ে বসে গরুর মাংস খেয়ে হাড় ছুড়ে ফেলেছিল। সেই সময়ে কোনও হিন্দু বাঙালি যুবক গরু খাচ্ছে, তা স্বপ্নেও ভাবা যেত না। কিন্তু তাতে কী হল? ওই আন্দোলন ধোপে টিকল? কলেজ স্কোয়ার থেকে বেরুতে পারেনি। যারা খেয়েছিল সেইসব যুবকের মধ্যে একজনও তো মাইকেল মধুসূদন দত্ত হতে পারেনি!’

উনবিংশ শতাব্দীতে যে উৎকট প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেছিল তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনও সম্পর্ক ছিল না। এই সেদিন ধর্মতলায় যা ঘটল, তার সঙ্গেও তো সাধারণ মানুষের কোনও সম্পর্ক নেই।

মুসলমান, খ্রিস্টানরা গোমাংস খেয়ে থাকেন, তথাকথিত হিন্দুরা খান না। খ্রিস্টানরা শুয়োরের মাংস খেয়ে থাকেন, মুসলমান এবং হিন্দুরা তা স্পর্শ করেন না। ধর্মের নির্দেশে মুসলমানরা শুয়োরের মাংস খান না। কিন্তু এই বঙ্গভূমির তথাকথিত হিন্দুদের জন্য যখন কোনও ধর্মগ্রন্থ লেখা হয়নি, সংস্কৃত ভাষায় লেখা ধর্মগ্রন্থ থেকে ধার করে আমরা যখন ‘ধার্মিক-ধার্মিক’ ভাব করে থাকি তখন ওইসব মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ হয়েছিল কবে থেকে? উল্টে দেখছি, দেবরাজ ইন্দ্র কালো ষাঁড়ের মাংস খেতে খুব ভালবাসতেন। ওই ইন্দ্র তো খ্রিস্টান বা মুসলমানদের দেবতা নন। ষাঁড়ের মাংস খাওয়ার চল ছিল মুনি ঋষিদের মধ্যে। কিন্তু যে গরু দুধ দেয়, তার মাংস খাওয়া হত না। উল্টে ‘গোমাতা’ বলা হত।

বিদেশে গিয়ে অনেক সময় বাধ্য হয়েছি খাদ্যাভ্যাস বদলাতে, মাছের ঝোল ভাতের সুযোগ যেখানে নেই সেখানে খিদে মেটাতে স্যান্ডুইচ, বার্গার খেয়ে থাকতে হয়েছে। সেই সব খাদ্যের বেশিরভাগই গোমাংসের তৈরি। ‘খাব না’ বললে অভুক্ত থাকতে হবে। মজার কথা হল, যেহেতু সেই মাংস পাউরুটির আড়ালে থাকে তাই ‘কী খাচ্ছি’ তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার হয়নি। মনে আছে, পিটসবার্গ বিমানবন্দরের রেস্টুরেন্টে ভাত দেখে পাশের সসপ্যানে মাংসের লালচে ঝোল দেখে যখন জানতে পারলাম ওগুলো গরুর মাংস তখন হ্যাম স্যান্ডুইচ কিনে নিয়েছিলাম। এতকাল দেখা পাঁঠা বা মুরগির ঝোলের জায়গায় গরুর মাংসকে মেনে নিতে পারিনি।

এই মেনে নিতে না পারা কোনও ধর্মের কারণে নয়, নিতান্তই অভ্যাসের ফল। না হলে স্যান্ডুইচে যা খেতে পারছি, ঝোলে তা পারছি না কেন?

এককালে দেখেছি কোনও মুসলমান সহপাঠী বাড়িতে এলে তাকে বাইরের ঘরে বসাতে হত, তার জন্যে বড়পিসিমা আলাদা গ্লাস বাটি রাখতেন। কেন? এর একটাই উত্তর শুনতাম, ওরা গরুর মাংস খায়। আমার পিসিমাকে কি ‘মৌলবাদী’ বলব? ঢাকায় এক পরিবারে আমি সাদরে নিমন্ত্রিত হয়ে দেখলাম টেবিলের এক কোনায় পাত্রে গোমাংস আছে এবং তা আমাকে পরিবেশন করা হল না, আমার অন্যান্য খাবার খেতে একটুও অসুবিধা হল না। সেই পরিবারের স্বামী-স্ত্রী কলকাতায় বেড়াতে এলে তাঁদের একটি নামী রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম। মাছ-মুরগি অর্ডার দেওয়ার পর ভদ্রমহিলা জানতে চাইলেন, ওই রেস্টুরেন্টে শুয়োরের মাংস রান্না করা হয় কি না! উত্তরে ‘হ্যাঁ’ শুনে তৎক্ষণাৎ রেস্টুরেন্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন তিনি স্বামীকে নিয়ে। ওই মহিলাকে কি ‘মৌলবাদী’ বলব?

আমার এক মুসলমান বন্ধু ঢাকা থেকে চাকরির সুবাদে কলকাতায় এক বছরের জন্য এসেছিলেন। তাঁর জন্যে একটি ফ্ল্যাট খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছিলাম। উত্তর কলকাতার কোনও বাড়িওয়ালা মুসলমান ভাড়াটে রাখতে রাজি হননি। অন্তত আমার জ্ঞানত নয়। তখন সল্টলেকে বা রাজারহাটে এত ফ্ল্যাট হয়নি। শেষ পর্যন্ত পার্ক সার্কাসে ওঁর জন্য ফ্ল্যাট পেয়েছিলাম। সেখানে বাস করার সময় বন্ধু অভিযোগ করেছিল, “তোমাদের ওই এলাকাটা আদৌ পরিষ্কার নয়।” বন্ধু একথা বললেও, লক্ষ করেছি, বাংলাদেশ থেকে যাঁরা কলকাতায় বেড়াতে আসেন, সেই মুসলমান টুরিস্টরা ফ্রিস্কুল স্ট্রিট, মার্কুইস স্ট্রিট থেকে নিউমার্কেট এলাকায় থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। মনে রাখতে হবে, ওইসব এলাকা এক সময় অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের পরে, অবাঙালি মুসলমানদের দখলে ছিল। তথাকথিত হিন্দু বাঙালির গন্ধ না থাকা এলাকাটি মুসলমান টুরিস্টদের পছন্দের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মৌলবাদের প্রচ্ছন্ন গন্ধ কি পাওয়া যায় না! আবার বলি, এটা ধর্মের কারণে নয়, স্রেফ অভ্যাসের বশে।

তাই আমরা এই বঙ্গভূমিতে একসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গান গাই। ধর্ম তখন কণ্ঠরোধ করতে পারে না। ভারতবর্ষের মানুষ এতকাল দিলীপকুমার-শাহরুখ খানদের অভিনেতা ছাড়া অন্য কোনও পরিচয়ে ভাবেনি, মহম্মদ রফি বা তালাত মামুদকে গায়ক হিসাবে শ্রদ্ধা করেছে। আজ হঠাৎ যদি কেউ বলে ‘ওঁরা মুসলমান’ তা হলে কি সেটাই মুখ্য হয়ে উঠবে? ভারতবর্ষের কিছু রাজ্যে ধর্ম নিয়ে যে অস্থিরতা শিবসেনা-বিজেপি তৈরি করছে, তা অবিলম্বে শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে। শাহরুখ খান এর প্রতিবাদ করেছেন শুনে তাঁকে ‘পাকিস্তানের চর’ বলে গায়ের জ্বালা মেটাতে হবে? এই অহেতুক আক্রমণ অবশ্যই নিচু মনের পরিচয় দিচ্ছে, যা অশিক্ষিত মানুষদের ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে।

ধর্মতলায় দাঁড়িয়ে গোমাংস ভক্ষণে যদি বিপ্লব করা হয় তা হলে রাজাবাজার বা মোমিনপুর ইত্যাদি জায়গায় গিয়ে প্রকাশ্যে শুয়োরের মাংস খেতে নিশ্চয়ই আপত্তি থাকবে না। কিন্তু সাহস থাকবে তো?

অহেতুক এই বাড়াবাড়ি করার কী দরকার? পশ্চিমবাংলায় মানুষ যতটা ধর্মনিরপেক্ষ ততটা বোধহয় ভারতবর্ষের অন্য রাজ্যের মানুষ নন।

৪৬

আচ্ছা, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতার সংখ্যা কত? এখন তৃণমূল সবচেয়ে বড় দল। তারপর সিপিএম, কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, এসইউসি ছাড়াও কিছু দল আছে যারা রাজনীতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে। তা এইসব দল থেকে একটা তালিকা তৈরি করলে কতজন রাজনৈতিক নেতার সন্ধান পাওয়া যাবে? মাঝে-মাঝে এরকম প্রশ্ন মনে আসে। আসার কারণ—এই রাজনৈতিক নেতারা যা ভাবেন, তাই আমাদের ভাবতে হয়, এঁরা যে সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই মেনে চলতে হয়। পাঁচ বছরের জন্য আমরা এই কাজ করার অধিকার ওঁদের দিই নির্বাচনের মাধ্যমে। অবশ্য এখন যা পরিস্থিতি, তাতে ওই দেওয়াটাও আমাদের হাতে নেই।

রাজনৈতিক নেতারা দুই রকমের। একদল যাঁদের হাতে শাসনক্ষমতা আছে, অন্যদল ঠুঁটো জগন্নাথ। দ্বিতীয় দল বাধ্য হলে চিৎকার-চেঁচামেচি করেন, নইলে চুপ করে থাকাই নিরাপদ ভাবেন। ওই চেঁচামেচি করতে হয় নইলে নিজেদের অস্তিত্ব মানুষকে জানানো যায় না। এঁরা রাজনৈতিক নেতা হলেও এঁদের সিদ্ধান্ত মেনে চলার দরকার নেই। কারণ এঁরা আইন তৈরি করতে পারেন না, বেআইনি কাজ করলে পুলিশ এদের সমর্থন করে না।

অতএব, আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে সব অর্থে নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারা। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ, যাঁদের জনসাধারণ বলা হয়, এই আমরা, জেনে গিয়েছি কীভাবে জীবনযাপন করতে হয়। এ ব্যাপারে আমাদের পথপ্রদর্শক পাঁকাল মাছ। পাঁকের মধ্যে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে, অন্য মাছের মতো জলে ভেসে বেড়ায় না, তাই সহজে জেলের জালে ধরা পড়ে না। আমরা যারা সাধারণ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকি, তারা কতকগুলো ব্যাপারে বিস্তর জ্ঞান সঞ্চয়ন করেছি। যেমন, কোনও রাজনৈতিক নেতা যদি ক্ষিপ্ত হয়ে অশ্লীল গালাগালি করে ফেলেন, তা না শোনার ভান করি। পাড়ার রকে বসে যেসব রকবাজ অকাতরে অশ্লীল কথা বলে যায় এবং তা আমাদের কানে গেলেও মরমে ঢোকাই না—ঠিক সেইরকম একটা কায়দা আমরা আয়ত্ত করে ফেলেছি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দাদাদের গোষ্ঠী-বিরোধ হলে আমরা চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকি, যেন কিছুই ঘটছে না। বিরোধী দলের নেতা যখন শাসক দলের সম্পদের সঙ্গে গলা জড়িয়ে ধরে গরুর মাংস ভক্ষণ করেন তখন ভেবে নিই ‘ভ্রান্তিবিলাস’ দেখছি। আমাদের যে বাঁদরটি শিখিয়েছিল, কিছু দেখবে না, কিছু শুনবে না, কিছু বলবে না, তার সেই তিন ভঙ্গির মূর্তি তৈরি করে পাড়ায়-পাড়ায় বেদির উপর বসাতে পারলে খুশি হতাম, কিন্তু রাজনৈতিক দাদাকে কে কী বোঝাবে আর তিনি ক্ষিপ্ত হবেন এই ভয়ে ইচ্ছেটাকে গিলে ফেলি।

আমরা শুধু নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকতে চাই। ডিজেলের দাম বাড়লে বাসের মালিকরা ভাড়া বাড়াতে চায়, রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের সঙ্গে দর কষাকষি করেন, আমরা ছাগলছানার মতো তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি। শ্যামবাজার থেকে ডালহৌসি যেতে যদি দু’টাকা ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয় তা হলে বউবাজারের মোড়ে বাস থেকে নেমে হেঁটে যাই। তাতে আগের ভাড়াতেই কাজ হয়ে যায়। বাড়তি দু’টাকার জন্য দুশ্চিন্তা করতে হয় না। যেতে-আসতে চার টাকা। মানে মাসে প্রায় বিরানব্বই টাকা বেশি আর দিতে হল না। বদলে একটু হাঁটাহাঁটি হল। আমরা জেনে গিয়েছি সাধারণ মানুষ হিসাবে আমাদের কী-কী করা উচিত। বাঁচতে হলে কিছু ফন্দি শিখতে হবে। যখন বাজার না করলে না খেয়ে মরতে হবে। সেখানে যাওয়ার সময় গিন্নি বলেন, এটা এনো, সেটা এনো। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে তার আবদার রাখতে হিমশিম খেতে হয়। মাইনের যে টাকা বাজারের জন্য খামে রাখা আছে, তা পনেরো দিনেই খতম হয়ে যাবে। পুজোর আগে ইলিশের আবদার হয়েছিল। এক কেজি বারোশো টাকায় কেনার চেয়ে ডেঙ্গু হওয়া ঢের ভাল। সত্তর গ্রামের একটা পিসের দাম পড়বে ১২০ টাকা। হজম হবে না। কিন্তু আড়াইশো গ্রামের ইলিশ চারশো টাকা কেজিতে পাওয়া যায়। তাই কিনে টুকরো করিয়ে নিয়ে এলে গিন্নি চেঁচাবেন, বড্ড কাঁটা, আর ইলিশ আনতে হবে না। ব্যালেন্স রাখতে আগে যে আলু এক কেজি কেনা হত এখন তা নয়শো গ্রাম নিয়ে এলে গিন্নি টের পাবেন না। এই চালাকি নিশ্চয়ই নিজের সঙ্গে করতে হচ্ছে। কিন্তু না করলে সীমিত আয়ে বেঁচে থাকার উপায় নেই।

এখন মানুষ ভুলে গিয়েছে তার কী করা উচিত। সে জেনেছে, নির্বাচন এলে বক্তৃতা শুনতে যেতে হবে কিন্তু রাজনৈতিক দলের নেতাদের চেলারা ভোট দিতে যেতে নিষেধ করলে ঘরে বসে টিভি দেখতে হবে। এখন নিজের এবং পরিবারের বাইরে আর কোনও কিছু নিয়ে ভাবাটা বিলাসিতা। তার ফল খারাপ হতে বাধ্য। পুজোর ছুটির সময় যখন কর্পোরেশন বন্ধ, তখন যদি দিনরাত এক করে কোনও রাজনৈতিক নেতার কেনা দোতলা বাড়িকে তেতলা করে ফেলে প্ল্যান ছাড়াই, তা দেখেও না দেখার মতো মুখ করে বসে থাকতে হবে।

সেদিন হঠাৎই একজন প্রাক্তন সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হল। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, “বয়স তো হয়েছে, দীক্ষা নিয়েছেন?”

আমি হেসে ফেললাম, “এখনও প্রয়োজন হয়নি।”

”আমি নিয়েছি।” ভদ্রলোক বললেন।

”আপনার নিশ্চয়ই প্রয়োজন হয়েছে।”

“হ্যাঁ। জিনিসপত্রের যা দাম আর পেরে উঠছিলাম না। আমরা যে গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছি তাঁর শিষ্যদের মাছ, মাংস, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন খাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ। উঃ কী বিপুল খরচ বেঁচে গিয়েছে মশাই।” ভদ্রলোক বললেন।

এটাও বেঁচে থাকার একটি ফন্দি। রাজনৈতিক নেতাদের এই কারণে দীক্ষা নিতে হয় না। সাধারণ মানুষের হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের সমস্যা বাড়ায় এই খবরের কাগজগুলো। তারা এমন সব খবর ছাপে যে এত কায়দা করে বেঁচে থাকা মানুষের ঘুম উঠে যায়। ফোন এল, “আচ্ছা, সরকারের নাকি এক কোটি টাকা ধার হয়ে গিয়েছে। এরপর দেউলিয়া হয়ে গেলে আমাদের মাইনে দিতে পারবে না, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাও চোট হয়ে যাবে। কাগজে লিখেছে। তা হলে আমাদের কী হবে বলুন তো?”

সমস্যাটা এখানেই। আমরা সরকারের কাছে সবসময় হাত পেতে থাকি, সরকারকে দিতে শিখিনি। মুষ্টিমেয় রাজনৈতিক নেতার কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও ভূমিকা নেই।

৪৭

আমার তিনতলার শোওয়ার ঘরের জানলার পাশে উঠে এল গাছটা। এই উঠে আসার সময়টায় সম্ভবত নাবালক ছিল। তাই প্রচুর পাখি ওর ডালগুলো দখল করে থাকত। এবছর দেখলাম থোকা-থোকা ফুল ফুটেছে। সঙ্গে-সঙ্গে কাক ছাড়া অন্য পাখিরা ওর ধারে-কাছে আসছে না। আমি বিছানায় শুয়ে পাশ ফিরতেই ফুলগুলোকে দেখতে পাই। বেশ নয়নভোলানো হলদে ফুলের গুচ্ছ।

তারপরেই শুরু হয়ে গেল। ঘরে ঢুকলেই তীব্র গন্ধে নাক জ্বালা করতে লাগল। সেই জ্বালা সহ্য করে ঘরে থাকা বেশ কষ্টকর হয়ে গেল। শেষপর্যন্ত শ্বাসকষ্ট শুরু হল। অথচ ঘর থেকে বের হয়ে গেলে সেগুলো মুহূর্তেই উধাও হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে অসুবিধা হল না, ওই ফুল বিষফুল। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না রবীন্দ্রনাথ এই গাছকে কী কারণে পছন্দ করতেন? না করলে শান্তিনিকেতনের সমাবর্তন উৎসবে কেন ছাতিম ফুলের পাতা উপহার দেওয়া হত। এক বন্ধু বললেন, আপনার নাকের ডগায় ছাতিমফুল ফোটে তাই ওর তীব্র গন্ধ আপনি টের পান। গাছটা যদি একশোগজ দূরে থাকত, তা হলে গন্ধের তীব্রতা কমে যেত, আপনি মিষ্টি গন্ধ পেতেন। বোধহয় রবীন্দ্রনাথ বেশ দূর থেকেই ছাতিমফুলের গন্ধ পেয়েছিলেন। আর দেখবেন, গাছটা সহজে বড় হয়ে যায়, সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করতে পারে। সেই অর্থে সংগ্রামী গাছ। এই স্বভাবটা বোধহয় রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করেছিলেন।

তা হয়তো হতে পারে। কিন্তু আমি তো শোওয়ার ঘর পাল্টাতে পারছি না। একমাত্র পথ হল গাছটাকে সরিয়ে ফেলা। কিন্তু তিনতলা সমান গাছটাকে সরিয়ে ফেলার ক্ষমতা আমার একার নেই। তাছাড়া সরকারি আইনে গাছ কেটে ফেলা দণ্ডযোগ্য অপরাধ। অথচ ওই গাছ এভাবে ফুল ফোটালে আমার মৃত্যুর জন্য বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। আমি যে পাড়ায় থাকি তা তৃণমূল দলের নিয়ন্ত্রণে হলেও গত কর্পোরেশন নির্বাচনে একজন বামপন্থী সবাইকে অবাক করে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। গাছ কাটার অধিকার নিশ্চয়ই কলকাতা কর্পোরেশনের আছে ভেবে তাঁকে টেলিফোন করলাম। সমস্যার কথা জানিয়ে অত্যন্ত বিনীতভাবে অনুরোধ করলাম, ‘দয়া করে গাছটাকে কাটিয়ে ফেলুন, নইলে ওর গন্ধে আমি মারা পড়ব।’

কাউন্সিলর বললেন, ‘পুজোর আগে কিছু গাছের ডালপালা ছাঁটা হয়েছিল বটে, কিন্তু পুরো গাছ—আচ্ছা, দেখছি।’

কিছুদিন অপেক্ষা করলাম। মনে হচ্ছিল, গাছ কাটার লোকজন হইচই করে এসে ওটাকে কেটে এলাকাকে গন্ধমুক্ত করে যাবে। কিন্তু কোথায় কী? শেষপর্যন্ত একজন রাজনৈতিক নেতার শরণাপন্ন হলাম। তিনি উদাসীন গলায় বললেন, ‘কাউন্সিলর কী করবে? কোনও ক্ষমতা আছে নাকি? আপনি এক কাজ করুন, জয়দেববাবুর সঙ্গে দেখা করুন।’

‘তিনি কে? কোথায় পাব?’

‘কর্পোরেশন অফিসের উনিই তো সব। আমাদের লোক। আমার কথা বলবেন। খুব নরম প্রকৃতির মানুষ। লেখার বাতিক আছে, আপনাকে খাতির করবেন।’

অতএব গেলাম কর্পোরেশন। খোঁজ করতেই একজন পিওন গোছের লোক বলল, ‘যাঁর টেবিলের সামনে মানুষের ভিড় তিনিই জয়দেববাবু।’ শুনে পুলকিত হলাম। ক্ষমতাবান লোক না হলে ভিড় হবে কেন?

মিনিট কুড়ি পরে আমার পালা এল। জয়দেববাবুর বয়স পঞ্চাশের আশপাশে। গোটা মাথা নিকিয়ে টাক গিয়ে থেমেছে ঘাড়ের দুই ইঞ্চি ওপরে। সেখানে বেশ পুরু কৃষ্ণকেশ। হেসে বললেন, ‘বলুন। বলুন কী করতে পারি?’

‘আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে।’ ভূমিকা করলাম।

‘হ্যাঁ, আমাকে সত্যজিৎ বলেছে। আপনি তো সমরেশ মজুমদার। বেশ নাম হয়েছে এখন। বলুন, সমস্যাটা কী? কথা বলার সময়েই জয়দেববাবু চিরুনি বের করে ঘাড়ের ওপরের চুল আঁচড়ে নিলেন।

‘ফুলের গন্ধে—।’

সঙ্গে-সঙ্গে লুফে নিলেন জয়দেববাবু, ‘ঘুম আসে না?’

‘প্রায় তাই।’

‘কার গান মনে আসে?’ বলে নিজেই জবাব দিলেন, ‘প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না তাই তো জেগে রই।’ আহা। কী গান! কী লাইন! ভাবুন, একজন মানুষকে ফুলের গন্ধ ঘিরে রেখেছে বলে সে জেগে আছে। ফার্স্ট লাইনটা মনে আছে? ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই’। জয়দেববাবু মাথা নাড়লেন, ‘তখন সত্যিকারের গান হত, কবিতা হত, সাহিত্য হত। বলুন, এখন একজন তারাশঙ্কর বা বিভূতিভূষণের মতো লোক আছেন? এ্যাঁ? তা ফুলের গন্ধ নিয়ে কী বলছিলেন?’

আমার তখন ধৈর্য নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। বললাম, ‘আমার বাড়ির গায়ে একটা ছাতিম গাছ আছে। সেই গাছে ফুল ফোটার পর ভয়ঙ্কর তীব্র গন্ধ বের হচ্ছে। নাক জ্বলছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। দয়া করে বলবেন কী করলে রক্ষা পাব?’

খুব অবাক হলেন। চোখ বড় হয়ে গেল জয়দেববাবুর। বললেন, ‘সে কি! আপনি একজন লেখক হয়ে বলছেন ফুল আপনার শত্রু?’

‘আপনি একদিন থেকে দেখুন!’

‘না না, আপনাকে সহ্য করতে শিখতে হবে।’ আপনি নিশ্চয়ই চাইছেন আমি কর্পোরেশনের কর্মীদের বলি কুঠার-করাত নিয়ে গিয়ে ওই গাছটাকে কেটে ফেলতে? তাই তো? নিরীহ গাছটা তো কর্পোরেশনে এসে প্রতিবাদ করতে পারবে না। আচ্ছা, ছাতিম গাছটা কি শুধু তার সব তীব্র গন্ধ আপনার দিকে থ্রো করছে? আর কেউ গন্ধটা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছে না। তবু, আপনি বলেই বলছি, ভেবে দেখব, আলোচনা করব।’

দু’দিন বাদে পার্ক সার্কাস থেকে সিআইটি রোড ধরে মৌলালির দিকে আসছিলাম। তখন রাত দশটা। আচমকা গাড়ির ভিতর ওই গন্ধ ঢুকল। নাকে রুমাল চাপলাম। ড্রাইভার বলল, ‘সমস্ত কলকাতা জুড়ে ওই গাছ লাগানো হয়েছে, স্যর। ফুল ফুটতে শুরু করলে ডাক্তারদের রোজগার বেড়ে যাবে।’ খুব ঘাবড়ে গেলাম। কলকাতা কি ‘সিটি অফ ছাতিম গাছ’ হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ল, সান্দাকফুতে হেঁটে যাওয়ার সময় একটা জায়গায় অক্সিজেনের অভাব হয়েছিল। শুনেছিলাম, লাকতি নামের একটা ফুল ফুটলেই অক্সিজেন কমে যায় বাতাসে। কলকাতা কি সেইরকম হয়ে যাবে? জানি না।

আমি এখন ফুল ঝরার অপেক্ষায় রয়েছি।

৪৮

এখন যাঁদের আশির আশপাশে বয়স, দেশভাগের সময় তাঁরা বারো-তেরো বছরের ছিলেন। অনেকেই অষ্টাশিতে পৌঁছে দিব্যি পাতাল রেলে দমদম থেকে বালিগঞ্জ যাতায়াত করেন। প্রেশারের ওষুধ খান, শরীর সম্পর্কে সতর্ক থাকেন। এঁরা দেশভাগের সময় যৌবনে পা দিয়েছিলেন। কলকাতায় এত বছর থাকতে-থাকতে এইসব প্রবীণরা বাড়ির বাইরে পা দিয়ে এলাকার ভাষায় কথা বলা রপ্ত করে নিয়েছেন। কিন্তু বাড়ির ভিতরে পূর্ববঙ্গের যে জেলা থেকে এসেছেন, সেই জেলার ভাষায় কথা বলে তৃপ্ত হন। স্ত্রী জীবিত থাকলে তো কথাই নেই। ষাটের কাছাকাছি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কলকাতার ভাষায় কথা বলেন না। তাঁরাও খানিকটা বাবাকে খুশি করতে, খানিকটা মনের টানে পূর্বপুরুষের ভাষা ব্যবহার করেন। কিন্তু নাতি-নাতনিরা অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ কলকাতার ভাষাতেই। ঠাকুরদা তাঁর পৈত্রিক ভাষায় কিছু জিজ্ঞাসা করলে এরা কলকাতার ভাষাতেই জবাব দেয়। ঠাকুরদা সেটা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু ষাট বছরের বাবা তিরিশের ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় কলকাতার ভাষা ব্যবহার করলেও কোনও-কোনও শব্দ নিজের অজান্তেই বলে ফেলেন, যা তাঁদের পিতার কাছ থেকে পাওয়া। এই তথ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সত্যি হলেও ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। নতুন প্রজন্মের ছেলেদের মুখে মাঝে-মাঝে বাপ-ঠাকুরদার ভাষা শুনতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে। এখনও কোচবিহার, জলপাইগুড়ি বা মালদহের বেশ কিছু তরুণ পূর্ববঙ্গের ভাষায় কথা বলে থাকেন।

এখনও পশ্চিমবঙ্গে কয়েক-পুরুষ থাকা মানুষের মনে কিছু ভুল ধারণা আছে। তাঁরা পূর্বপুরুষের কাছে শুনে এসেছেন যে, পূর্ববঙ্গের মানুষ মানেই বাঙাল। প্রথম দিকে বলতেন, পদ্মার ওপারের মানুষরা বাঙাল ভাষায় কথা বলেন। তখন যশোরকে বাদ দেওয়া হত। পরে ওই জেলাকেও জুড়ে দেওয়া হল। বাংলাদেশের মানুষ যে এক ভাষায় কথা বলেন না, জেলায়-জেলায় তাঁদের মুখের ভাষা যে আলাদা, এই বাস্তব সত্য আমাদের জানা নেই। চট্টগ্রামের মানুষ যে-কথা বলেন, তা ঢাকার মানুষের কাছে বোধগম্য হয় না। অথচ আমরা এখানে থেকে ওঁদের ভাষাকে একাকার করে দিচ্ছি।

স্বাধীনতার আগে-পরে যাঁরা উদ্বাস্তু হয়ে বা না-হয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছেন, যাঁদের স্মৃতিতে এখনও সেখানকার মাঠ-নদী-গাছপালা আছে, তাঁদের অনেকের ইচ্ছে হয় একবার গিয়ে দেখে আসার। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের জন্য আলাদা পাসপোর্ট লাগত। সেটার ভিসা নিয়ে অনেকেই যাওয়া-আসা করতেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ আর ফিরে যাননি। না যাওয়ার অন্যতম কারণ অনেকগুলো। সবচেয়ে বড় হল, অভিমান। যে গ্রামে বা শহরে তাঁদের পূর্বপুরুষরা বাস করেছেন, যেখানে শৈশব কেটেছে, বাল্যকালও, সেই জায়গা ছেড়ে তাঁকে চলে আসতে হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। দেশভাগের নির্দয় বলি হতে হয়েছে তাঁদের। সহায়সম্বলহীন হয়ে এই দেশে এসে বাঁচার লড়াই করতে-করতে জীবনটা কেটে গিয়েছে। যেসব জায়গায় তাঁরা বাধ্য হয়ে থেকেছেন, সেই জায়গাগুলোকে যখন কলোনি বলা হয়েছে, তখন তাঁদের মোটেই ভাল লাগেনি। সেইসঙ্গে ‘জবরদখল’ শব্দটি যোগ করা হয়েছে। যাঁরা এই সুযোগটুকু পাননি, তাঁদের অনেকদিন কেটেছে বিভিন্ন ত্রাণশিবিরে। এই জীবন তাঁরা আগে দুঃস্বপ্নেও দেখেননি। ধীরে-ধীরে তাঁরা এখানে পায়ের তলায় মাটি পেয়েছেন বললে কম বলা হবে, পশ্চিমবঙ্গের যেসব মানুষ নিজেদের জায়গায় থাকার সুবিধা পেয়েছেন, তাঁদের অনেকেই টপকে গিয়েছেন। এই অবস্থায় আর জন্মভূমিতে ফিরে যেতে কোথাও বাধো-বাধো লাগে। এই ফিরে যাওয়া কয়েকদিনের জন্য কিন্তু তাতে ব্যথা হয়তো অনেকগুণ বেড়ে যাবে।

দ্বিতীয়ত, গিয়ে কী দেখবেন সেই আশঙ্কাও আছে। তাঁদের বাড়ি, বাগান, পুকুর, তুলসীতলা, সব কি এই আটষট্টি বছরে ঠিকঠাক থাকতে পারে? ভারতবর্ষে আসার আগে কেউ-কেউ নামমাত্র দামে প্রতিবেশী মুসলমান বন্ধুকে বিক্রি করে দিতে পেরেছিলেন, কিন্তু অধিকাংশই খালি হাতে এসেছেন। গিয়ে যদি প্রত্যাশা পূর্ণ না হয়?

তৃতীয়ত, খবরের কাগজে যেসব খবর ছাপা হচ্ছে, তা সবসময় অনুকূলে যাচ্ছে না। বিএনপি-জামাতদের আচরণ অধিকাংশ শান্তিকামী মানুষ পছন্দ করছে না। খুনখারাপির কথা তো নিত্য শোনা যাচ্ছে। গিয়ে বিপদে পড়ার ভয় পাচ্ছেন অনেকে।

চতুর্থ, যাবেন কীভাবে? কলকাতা থেকে প্লেনে চেপে ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে বরিশালের সেই গ্রামে যাওয়ার কী ব্যবস্থা আছে, তা এখন জানা নেই। ট্রেন চালু হয়েছে, সকালে ছেড়ে প্রায়ই সন্ধে পেরিয়ে ঢাকায় পৌঁছায়। পৌঁছে কোথায় উঠবেন? জানা নেই। বাস আছে। মার্কুইস স্ট্রিট থেকে ছেড়ে সারাদিন ধরে চলে সেই সন্ধ্যার মুখে ঢাকায় পৌঁছয়। খবরটবর নিয়ে, নেটের সাহায্যে হোটেল বের করে সেখানে ওঠা যায়। কিন্তু নেটে যে হোটেলগুলোর সন্ধান পাওয়া যায়, সেগুলোর ভাড়া তো নেহাত কম নয়। এইসব অনিশ্চয়তা যাওয়ার ইচ্ছেটাকে রসদ জোগায় না।

পঞ্চমত, যাঁদের বয়স আশির এপাশ-ওপাশে, তাঁদের একটা আশঙ্কা থাকেই। বাংলাদেশে গিয়ে যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তা হলে দেখবে কে? সেখানে কোথায় গেলে ভাল চিকিৎসা পাওয়া যায় ইত্যাদি।

এর আগে একবার লিখেছিলাম। বেশ কয়েক বছর আগে দু’জন প্রবীণ মানুষ, যাঁদের আমি দাদা বলি, জন্মভূমি দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। আমরা বাসে রওনা হয়েছিলাম। শ্যামলী পরিবহণের বাস আমাদের বনগাঁ হয়ে ঢাকায় পৌঁছে দিয়েছিল। যাতায়াত থাকায় ঢাকা ক্লাবে উঠেছিলাম। দুই প্রবীণ দাদার দেশ ছিল ময়মনসিংহ জেলার শহরে এবং গ্রামে। আমার এক বন্ধুর গাড়িতে আমরা রওনা হয়েছিলাম ময়মনসিংহ শহরের উদ্দেশে। ঢাকা শহর ছাড়াতেই দু’জনেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে লাগলেন গ্রামের মাঠঘাট গাছপালা এখনও একইরকম রয়েছে। শুধু রাস্তাটা অনেক ভাল হয়েছে। ওঁদের ছেলেবেলায় এত সুন্দর রাস্তা ছিল না। আমরা শহরে ঢুকলাম। দাদা বললেন, ‘আমার বাড়ি যে পাড়ায় সেখানে একটা নামকরা গার্লস স্কুল ছিল।’ আমরা সেই স্কুলের সন্ধান নিয়ে জানতে পারলাম স্কুলটি অনেক আগে উঠে গিয়েছে। তবু খুঁজে-খুঁজে ওঁর বাড়ি যেখানে ছিল, সেখানে গিয়ে দেখলাম—অন্য একজনের নেমপ্লেট লাগানো আছে। দাদা সঙ্গে-সঙ্গে ফিরে এসেছিলেন।

খুব সম্প্রতি দু’জন বাঙালি যুবক ‘দেশবিদেশ’ নামে একটি সংস্থা তৈরি করেছেন। যেসব বয়স্ক মানুষ নিজের দেশ দেখতে চান, তাঁদের পাসপোর্ট-ভিসা করিয়ে যত্নের সঙ্গে বাংলাদেশের যেখানে যেতে ইচ্ছুক, সেখানে নিয়ে যেতে চান। যা জেনেছি তাতে মনে হয়েছে সম্মানদক্ষিণা বেশি নয়। ওঁরা দেশটাও ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিতে পারেন। দেশ-বিদেশের মোবাইল নম্বর ৯৮৩৬১-৯৭৮৯৩ আগ্রহীরা ভাবতে পারেন।

৪৯

সেদিন একজন বয়স্ক মানুষ আফসোস করছিলেন, ‘জানেন, আমাদের বাড়িতে রান্না হয় না!’ সহানুভূতি পাওয়ার মতো মুখ করে আছেন দেখে বিশদে জানতে চাইলাম। বললেন, ‘আমার স্ত্রী বছর পাঁচেক আগে গত হয়েছেন। তখন রান্নার মাসি ছিল। দু’বেলা এসে রান্না করে দিত। আমি বাজার করে আনতাম। স্ত্রী ওকে হাতে ধরে রান্না শিখিয়ে দিয়েছিল। আমি কী কী খেতে ভালবাসি, তা দিব্যি রেঁধে দিত সে।’

‘আপনি কী খেতে ভালবাসেন, তা নিশ্চয়ই আপনার স্ত্রী জানতেন। বিয়ের পর থেকে আপনার মুখে শুনে-জেনে গিয়েছিলেন। কিন্তু ধরুন, একটা পদ মাংস, আপনি খেতে ভালবাসেন। শুনে আপনার স্ত্রী মাংস রান্না করলেন। কিন্তু সেই রান্না তো আপনার পছন্দসই নাও হতে পারে’ আমি বললাম।

‘একশবার। আমার মা যে পাতলা, লালচে মাংসের ঝোল রান্না করতেন, তা আমার স্ত্রী শিখে নিয়েছিল। সেটাই সে শিখিয়েছে কাজের মাসিকে।’ ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, ‘আসলে বিয়ের সময় স্ত্রীর বয়স অল্প ছিল। আমাদের বাড়িতে এসে মা-পিসিদের কাছে রান্না শিখেছে ‘আর সেই রান্না খেয়ে আমি বড় হয়েছি বলে খেতে বসে খুশি হতাম।’

‘রান্নার মাসি কোথায় গেলেন? অবসর নিয়েছেন নাকি?

‘না’, বয়স একটু হয়েছিল বটে কিন্তু কর্মক্ষমতা হারায়নি।’

‘তা হলে তাঁকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন?’

‘আমার ছেলে অথবা ছেলের বউ খুব ভাল। মাঝে কাজের মাসি দিন দশেক আসেনি। তার প্রতিক্রিয়া হল ভয়ঙ্কর। বউমা ছেলেবেলা থেকে পড়াশোনা নিয়ে থাকত, তার বাইরে কিছু করার সময় পায়নি। কাজের মাসি না-আসায় আমি ভেবেছিলাম, বউমা যাহোক ভাতে-ভাত করে ম্যানেজ করে দেবে। তাই বাজারে যাওয়ার সময় ভাবলাম শুক্তো, লাউ ইত্যাদি না এনে শুধু আলু পেঁয়াজ আর কাটা পোনা নিয়ে আসি। ওরা দুজনেই ন’টায় অফিসে বেরিয়ে যায়। তাই ভোর সাড়ে ছটায় বাজার করে নিয়ে এসে দেখলাম ওরা তখনও ঘুমোচ্ছে। সাতটায় ওরা উঠলে আমি বউমাকে বাজারের কথা বললাম। সে বলল, ‘আপনি আমাকে শুধু বলছেন কেন? আপনার ছেলেকেও বলুন।’

আমি হেসে বললাম, ‘বউমা, সে কখনও রান্নাঘরে ঢোকেনি। সে কেন, এই আমিও জীবনে রান্নাঘরের কাজে লাগিনি।’

বউমা হেসে বলল, ‘আমারও তো একই অবস্থা বাবা। অমিও আপনাদের মতো রান্নাঘরে ঢুকিনি। এখন রান্না করতে গেলে চোদ্দোবার একে-ওকে ফোন করতে হবে। অফিস মাথায় উঠবে। অবশ্য আমরা তিনজনে মিলে যদি হাত লাগাই—।’

পাশ থেকে ছেলে বলল, ‘ইম্পসিবল। আমার দ্বারা হবে না।’

‘তা হলে? আলু পেঁয়াজ চট করে পচে যাবে না কিন্তু মাছ তো নষ্ট হবে। পয়সা দিয়ে কিনে বাড়িতে এনে নষ্ট করব?’

বউমা বলল, ‘নষ্ট হবে কেন? ডিপ ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিচ্ছি। কাজের মাসি যখন আসবে তখন বের করে রাঁধবে।’ সেদিন পাড়ার এক হোম ডেলিভারি সেন্টারে ফোন করলাম খাবারের জন্য। ছেলে এবং ছেলের বউ বলল ওরা অফিসে লাঞ্চ করে নেবে। রাতের খাবার বাইরে থেকে কিনে আনবে। কিন্তু কী বলব ভাই, হোম ডেলিভারির খাবার আমার মুখে রুচল না। আশি টাকা নিয়ে গেল কিন্তু অর্ধেক খাবার খেতেই পারলাম না।’

‘তারপর কী করলেন?’

‘কী আর করব? বিকেলে খিদে পাচ্ছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফুটপাতের দোকান থেকে একটা এগ রোল কিনে খেলাম।’

‘এগ রোল কেন, মাটন বা চিকেন রোল—।’

‘না না, ওগুলোতে কী মিশিয়ে দেবে, তার চেয়ে এগ রোল অনেক নিরাপদ খাবার। কিন্তু তাই খেয়েই সন্ধেবেলায় ঢেকুর উঠল। জোয়ানের আরক খেতে হল। রাত্রে ওরা ফিরে এল চিলি চিকেন আর চাউমিন নিয়ে। কিন্তু ভাই রোজ রাত্রে ওই চাউ বা ফ্রায়েড রাইস খাওয়া যায়?’ ভদ্রলোক খুব বিরক্ত।

‘তা হলে সেই কাজের মাসি আর ফিরে আসেননি?’

‘এসেছিল। তাকে পুরো মাসের মাইনে দিয়ে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’

‘সে কি? কেন?’

‘পনেরো দিন উইদাউট ইনফরমেশন কামাই করার অপরাধটা তো ছিলই। তার ওপর বউমা হিসেব করেছিল, রোজ জলখাবার এবং লাঞ্চের জন্য ওর পিছনে প্রায় দেড়শ টাকা ব্যয় হয়। মানে সাড়ে চার হাজার প্লাস মাইনে তিন হাজার অর্থাৎ সাড়ে সাত হাজার। ওর রান্না আমার ভাল লাগলেও বউমার মনে হত খুব স্পাইসি রাঁধে। আমার জন্য হোম ডেলিভারিকে আড়াই হাজার দিলেও বেঁচে গিয়েছে পাঁচ হাজার। তার সঙ্গে খানিকটা অ্যাড করলে অফিসের ক্যান্টিন থেকে মশলাবিহীন খাবার কিনে আনলে বাজারের খরচ, গ্যাসের খরচ, মুদির দোকানের খরচ বেঁচে যাবে। তাতে বেশ কিছু টাকা বেঁচে যাবে। এর নিট রেজাল্ট হল—রান্নাঘরে রান্না হবে না। ওটা কমপিউটার-ঘর হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। ছেলে বলল, বাবা সেন্টুতে আক্রান্ত হয়ো না। তোমার মা-বাবা যে বাড়িতে থাকতেন, সেখানে ঠাকুরঘর ছিল, তোমার এই বাড়িতে সেটা নেই। মা টেবিলে ঠাকুরের ছবি রেখে মালা পরাত। তোমার বউমা যে ব্যবস্থা করেছে, তা ও প্রথম করেনি। ইউরোপ আমেরিকায় রান্নাঘর সিস্টেমটাই নেই। কোথাও-কোথাও ড্রইং কাম কিচেন থাকতে পারে। আমাদের বাড়িতে না হয় কিচেন উঠে গেল। তাতে দেওয়াল কালো হবে না, আমাদের রোজগার দশ লাখের উপর হলে গ্যাসে সাবসিডি পাব না বলে চিন্তা করতে হবে না। অনেক ঝামেলা থেকে মুক্ত।’

মন দিয়ে শুনছিলাম। এখন অনেক বাড়িতে রুটি হয় না। দুপুরের তরকারি গরম করে পাড়ার ঠাকুরের দোকান থেকে রুটি কিনে ডিনার করা হয়। এসব কথা উঠলে বয়স্কা মহিলারা বলেন, ‘সারা জীবন হাত পুড়িয়ে অনেক রান্না করেছি আর তোমরা সেগুলো গিলতে-গিলতে বলেছ, যাই বলো, মায়ের মতো হয়নি। শুনে গা জ্বলে যেত। এখন বোঝো, কত ধানে কত চাল হয়। এই বউমারা ঠিক কাজই করছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *