গীতবিতান ছুঁয়ে বলছি ৩.৩০

৩০

অল্প বয়সে লক্ষ করেছি এবং অবাক হয়েছি। আমাদের দিদি অথবা পিসিমারা মা-বাবা-ঠাকুরদার সঙ্গে মতের মিল না হলেই তর্ক করতেন, কোনও-কোনও ক্ষেত্রে তাঁদের মতকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হতেন অভিভাবকরা। পুজোর আগে মা ওঁদের ওপর ভার দিতেন কাকে কী দিতে হবে, তা ঠিক করে দেওয়ার। আমরা ছোটরা একটু অন্যায় করলেই তাঁরা শুধু শাসকের আঙুল তুলতেনই না, আমাদের কানেও সেটা পৌঁছে যেত। অর্থাৎ আমাদের বাড়িতে দিদি বা পিসিমাদের ক্ষমতা অনেক, কোনও-কোনও ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে মায়ের চেয়ে বেশি। যেমন মা ইচ্ছে করলেই বিজয়া দশমীর বিকেলে ভাসান দেখতে যেতে পারেন না। যেতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হত তাঁকে। পিসিমা কিন্তু ‘বউদি, একটু ভাসান দেখে আসছি’ বলে স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে পড়তে পারতেন। আমরা যে চায়ের বাগানে থাকতাম সেখানে জনবসতি বেশি ছিল না। সবাই সবাইকে চিনত। অতএব পিসিমার একা যাতায়াতে কোনও সমস্যা হত না। এটা দিদির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

তখন দেখতাম, সংসারের যাবতীয় ব্যাপারে নাক গলাতেন ওঁরা। যা ওঁদের বিষয় নয়, সে-ব্যাপারেও। দূর সম্পর্কের কোনও আত্মীয়ার বিয়েতে কী দেওয়া হবে, তা নিয়ে বাবা-মা যখন কথা বলছেন তখন পিসিমা সেই আলোচনায় ঢুকে পড়তেন অনায়াসে। তাঁর আড়ষ্টতা থাকত না।

এই পিসিমা অথবা দিদির বিয়ে হল। অষ্টমঙ্গলায় এসে ছিলেন ক’দিন। তখন বাড়িতে উৎসবের আবহাওয়া। বাপের বাড়িতেও তাঁরা নতুন বউ-এর মত আচরণ করেছেন। আমরা অবাক হয়ে ভেবেছি, এটা তো ওঁদের বাড়ি। এখানে কেন লজ্জা-লজ্জা ভঙ্গি করে রয়েছেন? দ্বিরাগমনের পর শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যাওয়ার পরে দিদি আবার এলেন ছয় মাস পরে। দেখলাম তাঁর চেহারা অনেক সুন্দর হয়েছে। মা বললেন, ‘তুই কত সুন্দর হয়েছিস।’ দিদি হাসলেন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, দিদি যেন আগের দিদি নেই। সবসময় নিজের ঘরে বসে কিছু লেখেন অথবা বই পড়েন। এই সংসারের কোথায় কী হচ্ছে, তার খবর রাখার ইচ্ছে একটুকুও নেই। এমন কী আমরা দুষ্টুমি করলে প্রশ্রয়ের হাসি হাসেন, শাসন করা তো দূরের কথা।

ক্রমশ আমাদের ধারণা হতে লাগল বিয়ের পর মেয়েদের কাছে শ্বশুরবাড়িই সব। যাদের কোনও কালে চিনত না, তাদের কথা বলার সুযোগ পেলে বলতে খুব খুশি হয়। ওঁর জায়ের ছেলে খুব দুষ্টু কিন্তু স্কুলে ফার্স্ট বয়। ওদের কুকুরটা সব কথা এত ভাল বোঝে যে অবাক হতে হয়। এবং বছর দেড়েক পরে দিদি এলে মা বাড়ির কোনও সমস্যা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে দিদি বললেন, ‘আমি কী বলব বল। তোমাদের বাড়ির ব্যাপার—! মা একটু থমকে গেলেও সামলে নিলেন। তিনি নিজে কবে বাপের বাড়িতে গিয়েছেন, তা চট করে খেয়াল করতে পারবে কি?

লক্ষ করা গিয়েছে, তখন, বিয়ের কয়েকদিন পর থেকেই মেয়েদের মনের পরিবর্তন হত। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তাঁরা নতুন দুই মানুষকে বাবা এবং মা বলতে বাধ্য হত। এবং ক্রমশ তাতেই অভ্যস্ত হয়ে যেত। বাপের বাড়িতে মাঝেসাঝে এলে একটু বেশি যত্ন পেত। বিয়ের আগে যা পেত না, বিয়ের পরে তা সামনে সাজিয়ে দেওয়া হত। আর এই ব্যাপারটাই তাকে মনে করিয়ে দিত সে আর এখন এই বাড়ির কেউ নয়, অতিথি মাত্র। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বাবা-মা নিশ্চয়ই তাঁর কথা চিন্তা করতেন। সেই চিন্তা, মেয়ের জীবন যাতে শান্তিতে কাটে, তার জন্য। মেয়ে যদি শ্বশুরবাড়ির সবার মন জয় করে, তা হলে তাঁরা খুশি হন। কিন্তু মা-বাবা নিজের পরিবারের সমস্যা নিয়ে বিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে আলোচনা করার কোনও তাগিদ অনুভব করেন না। দূরত্ব আপনা-আপনি তৈরি হয়ে যায়। বিশেষ করে মেয়ের যদি ভাই বা দাদা থাকে, তারাই বেশি সংসারে গুরুত্ব পায়। যে বাড়িতে মেয়েটি জন্মেছে, বড় হয়েছে, যার সর্বত্র তার স্মৃতি ছড়ানো, মা-বাবা মারা যাওয়ার পর সেই বাড়িতে তার যাওয়া-আসা বন্ধ হয়ে যায়। মায়ের বাড়ি আর বউদির বাড়ি তার কাছে এক থাকে না। দাদা বা ভাই-এর পরিবারে কোনও উৎসব থাকলে যদি তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তাহলেই সে কয়েকদিনের জন্য অতিথি হয়ে ঘুরে যেতে পারে। সে সময় কোনও জামাইকে শ্বশুরবাড়িতে তিন রাতের বেশি থাকতে দেখা যেত না। বাবাও মেয়ের বাড়িতে যেতে বাধ্য হলে ওই সময়ের বেশি থাকতেন না। মেয়ের জন্ম হওয়ার পর মা-বাবা জানতেন এই সন্তান অন্যের বাড়িতে চলে যাবে। এর ওপর নির্ভর করা বোকামি। আরও আগে দশ-বারো বছরে বিয়ে দিয়ে কাঁধ থেকে বোঝা নামানো হত। তার পরে ভাল পাত্র পেতে একটু পড়াশোনা করিয়ে নেওয়া হত। বেশি পড়ানোর পক্ষপাতী ছিলেন না পাঁচ-ছয় দশকের বাবা-মায়েরা। মেয়েকে বেশি পড়ালে সে চাকরি করতে চাইবে। আর সেই চাকরির ফলভোগ করবে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। এটা মনে থেকে মেনে নিতে পারেননি ওঁরা।

আমরা জানি, গত চল্লিশ বছরে আমাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল মেয়েদের ক্ষেত্রে। এখন বেশির ভাগ মেয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেলে যতটা সম্ভব এগিয়ে যেতে চায়। শুধু স্বনির্ভর নয়। সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়। বিভিন্ন পরীক্ষাগুলির ফল বলছে, মেয়েরা ছেলেদের থেকে একটুও পিছিয়ে নেই। কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে গিয়েছে। এখন এক বা দুই সন্তানের বেশি পরিবার খুব কম দেখা যায়। ফলে বাবা-মায়ের সঙ্গে জড়িয়ে বড় হতে-হতে তাঁদের সম্পর্কে অদ্ভুত এক টান অনুভব করে সন্তানরা। এবং এ ব্যাপারে ছেলেদের থেকে মেয়েরা অনেক এগিয়ে। পড়াশোনা করায় তাদের মনের গঠন পাল্টেছে, ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতা হয়তো তাদের কোনও-কোনও ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত করছে কিন্তু বেশিরভাগই তাদের মাটিকে ভুলে যায়নি। বিবাহিত হয়েও, সন্তানের জননী হওয়ার পরেও বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তারা। সেই মেয়েরা কলকাতা বা মুম্বই বা টরন্টোয় থাকুক, প্রতিদিন মা-বাবার সঙ্গে কথা না বললে তাদের মনে শান্তি থাকে না। এদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু ছয় দশকের ছবিটা এখনও যে মুছে যায়নি। আশা রাখি বেশিদিন তার আয়ু নেই।

৩১

জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু হু করে কিন্তু বাজারে গেলে তার প্রতিক্রিয়া বোঝা যাচ্ছে না। সেদিন মাছের বাজারে গিয়ে দাম জিজ্ঞাসা করার আগেই দেখলাম একজন মধ্যবয়সি মানুষ দোকানদারকে বললেন, ‘আড়াই কেজি বাগদা আর দু’কেজি কাটা পোনার দাম কত?’ দোকানদার সেটা জানাতে তিনি দাম মিটিয়ে দিয়ে সঙ্গীকে দেখিয়ে বললেন, ‘রেডি করে রাখো, ও নিয়ে যাবে।’ মধ্যবয়সির পোশাক দেখে মনে হল উনি সংসারে বাস করেন না। উনি চলে গেলে দোকানদার হেসে বলল, ‘মহারাজ আমার অনেকদিনের খদ্দের। উনি কখনওই দরাদরি করেন না।’

আমার এবং আমার সমসাময়িক মানুষদের এখন প্রতিনিয়ত সমস্যায় পড়তে হয়। আমরা যারা বাবা-ঠাকুর্দাকে বাজার করতে দেখেছি, বছর তিরিশেক আগে যারা বাজারে নিয়মিত গিয়েছি, তারা এখন কিছুতেই তাল রাখতে পারছি না।

আজ অনুভব ফোন করেছিল। ছেলেটি খুব ভাল। অনেক পড়াশোনা করেও ভাল চাকরি পাচ্ছিল না। ওর বাবা রিটায়ার করার পর সংসার যখন চালানো মুশকিল হয়ে পড়ছিল, তখন আমার এক বন্ধুর সৌজন্যে তিরিশ হাজার টাকার চাকরি পেয়ে গেল। কেটেকুটে হাতে ছাব্বিশের মতো পাবে। তার মানে সংসারের সমস্যা আর রইল না। সেই অনুভব আজ সকালে ফোন করল, ‘কাকু, আমি মানিকতলার বাজার থেকে বলছি।’

‘আচ্ছা, ওই বাজারে কি মাছ কিনতে গিয়েছ?’

‘হ্যাঁ। খুব ভাল বিডি ইলিশ পেয়েছি। এক কেজি আড়াইশো ওজন, হাজার টাকা কেজি চাইছে। আমাদের বাজারে এই মাছ দেখা যায় না। আপনি যদি বলেন তা হলে আপনার জন্য একটা ইলিশ নিয়ে যেতে পারি।’ অনুভব বলল।

বারোশো পঞ্চাশ টাকায় একটা ইলিশ মাছ? অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘না, না। আমরা দু’জন মানুষ, খাওয়ার লোক কোথায়! লাগবে না।’

যতদূর মনে হয়, ওই মাছ কেটেকুটে নয়টা টুকরো হবে। অর্থাৎ একটা টুকরোর দাম পড়বে একশো চল্লিশের কাছাকাছি। এই মাছ অনুভব ছাব্বিশ হাজার টাকা মাইনে পেয়ে কিনে খাবে? অস্বস্তি বাড়ল। আমার ঠাকুর্দা ওই দাম শুনলে অজ্ঞান হয়ে যেতেন, বাবা পাগল ভাবতেন। অথচ অনুভব, ছাব্বিশ হাজারের অনুভব, এক দুপুরের জন্য বারোশো পঞ্চাশ খরচ করছে। কিন্তু পাঁচজনকে বলতেই আমিই যেন চোরের দায়ে পড়লাম। সবাই বলতে লাগল, ওই সাইজের মাছ এই দামে পাওয়া নাকি ভাগ্যের ব্যাপার। বিডি ইলিশ মানে বাংলাদেশি ইলিশ। তার স্বাদই আলাদা। কোলাঘাট বা দিঘার ইলিশের থেকে অনেক সুস্বাদু। চারটে টুকরো নিজেদের জন্য রেখে বাকিগুলো এর-ওর বাড়িতে পাঠালে তারা সুখ্যাতি করত।

মধ্যবিত্ত বলতে বিশ বছর আগে যাদের মনে করা হত, এখন তার বদল হয়েছে। নিম্লবিত্ত মানুষেরা পঁচিশ-তিরিশ হাজার টাকা আয় করেও কুড়ি বছর আগের দশ হাজার টাকা আয়ের সঙ্গে সমতা রাখতে পারেন না। মাসের শেষ সপ্তাহে বাড়িতে মাছ নিয়ে আসা বন্ধ রাখতে হয়। এখন মধ্যবিত্ত মানুষ ষাট সত্তর হাজার টাকা রোজগার করে সংসার সামলান। তবে তাঁদের সংসারের সদস্য সংখ্যা তিন কি চারের বেশি হওয়া চলবে না। আবার আর একটি সম্মিলিত আয়ের কারণে কোনও পরিবার মধ্যবিত্তের তকমা পাচ্ছে। বাবা মা ছেলে বউমা—চারজনই চাকরি করে। সংসার চালাতে সবাই হাত মেলায়। একসঙ্গে থাকার সুবিধা জেনে যাওয়ায় আলাদা হয়ে হাবুডুবু খাওয়ার ইচ্ছে এখন অনেক কমে গিয়েছে। এই মধ্যবিত্তরা শখ করে বছরে একদিন হাজার টাকা কিলোর ইলিশ খেতেই পারেন। কিন্তু সেই শখটা যদি নিম্ল মধ্যবিত্তের মনে উথলে ওঠে তখনই অস্বস্তি শুরু হয়। আমাদের একটা সহজ সমাধান তৈরি থাকে। যখনই এইরকম বৈষম্য চোখে পড়ে তখন ভেবে নিই ওদের গোপন কোনও আয়ের পথ আছে। এঁরা যদি পুলিশ, আয়কর অথবা কাস্টমসের কর্মচারী হন তা হলে ভাবনাটা পালতোলা নৌকার মতো দৌড়তে থাকে। এখন আরও অনেক বিভাগের কর্মচারীদের সঙ্গে সরকারি রাজনৈতিক দলের সদস্যদের যোগ করা হচ্ছে, যাদের টাকার হিসেব দিতে হয় না।

আবার বলছি, মুশকিল হয়েছে আমাদের। বাল্যকালে ‘নটি বয় শু’ নামে যে জুতো কিনে দেওয়া হত তা গোটা বছর চালাতে হত। ছাল উঠে গেলেও। দাম ছিল আট কি দশ টাকা। তার পরে পঞ্চাশ থেকে দেড়শোর মধ্যে জুতো পরতে অভ্যস্ত ছিলাম। যখন বাড়ির মেয়েদের স্বাধীনতা দেওয়া হল পছন্দমতো বাজার করার তখন ওরা যে জুতো কিনে নিয়ে এল তার দাম হাজার টাকার আশপাশে। তার কম দামে যে জুতো পাওয়া যায় তা পরা যায় না। বাড়তে-বাড়তে সেটা এখন চার হাজারে পৌঁছে গেলেও তাদের খুঁতখুঁতানি যাচ্ছে না।

আগে একজন আয় করতেন আর পরিবারের সাতজন তার ওপর নির্ভর করত। পাঁচের দশকে বাবার চাকরির মাইনেতে আমরা তো একটুও কষ্টে ছিলাম না। রবিবারের সকালের জলখাবারে অনেকগুলো লুচি খেতাম ভাইবোনে মিলে। অনেক পরে, বাবা তখন কত মাইনে পেতেন খোঁজ করতে গিয়ে চমকে উঠেছি। হ্যাঁ, বাড়ি ভাড়া দিতে হত না, জ্বালানির কাঠ কিনতে হত না, কোম্পানি অনেক সুবিধা দিত। কিন্তু সাড়ে চারশো টাকা মাইনে পেয়ে উনিশশো সাতান্ন সালে সাতজনের সংসার বাবা তো দিব্যি চালাতে পারতেন। কী করে সেটা সম্ভব হত? উত্তরটা খুব সহজ। তখন আমাদের কারও মনে চাহিদা তৈরি হয়নি। আমরা যা ব্যবহার করছি তার চেয়ে ভাল কী কী জিনিস বাজারে আছে তার খবরই রাখতাম না। তখন টিভি ছিল না যে, বিজ্ঞাপনগুলো আমাদের কাছে হাজির হবে। সরকারি রেডিও বিজ্ঞাপন বাজাত না। একটি হিন্দি গানের অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হত কিন্তু তখন আমাদের বাড়িতে রেডিওর হিন্দি অনুষ্ঠান শোনা নিষিদ্ধ ছিল।

এসব সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে, আমাদের ক্রয়ক্ষমতা অনেক বেড়ে গিয়েছে। চার থেকে চল্লিশ হাজারের মোবাইল ফোন এখন হাতে-হাতে ঘোরে। শখ মেটাতে খরচ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করি না। কিন্তু এই খরচের টাকা আমাদের পকেটে আসে কোত্থেকে?

এর জবাব দিতে কুণ্ঠিত হই বলেই কি আমরা চারপাশের যাবতীয় অনাচার, রাজনৈতিক আস্বালন দেখেও মুখ খুলতে ভয় পাই! ক্ষণিক সুখের জন্য মেরুদণ্ডহীন হয়ে থাকতে আমাদের খারাপ লাগছে না।

৩২

গত ষাট বছরে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করার উদ্যোগ যাঁরা নিয়েছেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’। একেবারেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারি অনুদান নিশ্চয়ই তারা পেয়ে থাকে কিন্তু কী কাজ করবেন তা নিজেরাই নির্ধারণ করেন। এই সময়ের মধ্যে আরও দুটো প্রতিষ্ঠানকে আমরা পেয়েছি। দুটোই পুরোপুরি সরকারি প্রতিষ্ঠান। একটি দিল্লির সাহিত্য আকাদেমি, অন্যটি পশ্চিমবাংলার বাংলা আকাদেমি। এই দুটো প্রতিষ্ঠান সাধারণত বিখ্যাত লেখকদের জন্মদিন পালন করে, কোনও একটি বিষয় বা বই নিয়ে আলোচনাচক্রের ব্যবস্থা করে। বাংলা আকাদেমি তো তাদের প্রেক্ষাগৃহ ভাড়ার বিনিময়ে ব্যবহার করার জন্য জনপ্রিয়। পাশাপাশি ভারতীয় ভাষা পরিষদ কলকাতায় বসে ভারতের সব ভাষা নিয়ে নিজেদের মতো কাজ করে চলেছে। কিন্তু লক্ষ করেছি, ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাহিত্য নিয়ে ভাবনা অনেক লেখক করেছেন, করছেন কিন্তু নতুন করে কোনও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেনি। এই কাজটি নীরবে করে চলেছে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ।

আজ থেকে একশো বাইশ বছর আগে ১৮৯৩-এর তেইশে জুলাই কলকাতার রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে দুই বাই দুই নম্বর বাড়িতে একটি সভায় ‘বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব লিটারেচার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজি এবং সংস্কৃত সাহিত্যের সাহায্য নিয়ে বাংলা সাহিত্যের উন্নতি ও বিস্তার সাধন করা। মাসে দু’বার ওঁরা আলোচনায় বসতেন এবং কার্যবিবরণী ইংরেজিতেই লেখা হত। ওঁরা যে মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করতেন সেটির ভাষাও ছিল ইংরেজি। কিন্তু ক্রমশ কিছু প্রতিবাদ তৈরি হয়। কেন ইংরেজি, বাংলা নয় কেন, এই দাবিতে মুখর হন অধিকাংশ সভ্য। শ্রীযুক্ত উমেশচন্দ্র বটব্যালের প্রস্তাব মেনে নিয়ে নাম পাল্টে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ রাখা হয়। এই বদল-প্রক্রিয়া শেষ হয় তেরোশো এক সালের সতেরোই বৈশাখ। ধরে নেওয়া যায়, তখনই পরিষদের পথ চলা শুরু হয়েছিল। কিন্তু একজন সদস্যের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজস্ব জায়গায় পরিষদকে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির চারজন—রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ। সঙ্গে ছিলেন রজনীকান্ত গুপ্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সুরেশচন্দ্র সমাজপতির মতো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। কিন্তু মতভেদ সত্ত্বেও প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং পরিষদের কার্যালয় ১৩৭/১ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে বাড়িভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু খুব দ্রুত পরিষদের সদস্য সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল। স্থানাভাবের সমস্যা দূর করার জন্য পরিষদের নিজের বাড়ির প্রয়োজন জরুরি হল। আবেদন জানানো হল সাহিত্যমনস্ক ধনী ব্যক্তিদের কাছে। এবং আর যে ঘটনা ঘটল তা আজ আমাদের কাছে শুধু বিস্ময়কর বললে কম বলা হবে।

মনে রাখতে হবে, পরিষদের নিজস্ব ভবন তৈরি হয়েছিল আপার সার্কুলার রোডে, মানিকতলা এবং গ্রে স্ট্রিটের মাঝখানে। ১৩১৫ সালের ২১ শে অগ্রহায়ণ গৃহপ্রবেশ উৎসব হয়। কাশিমবাজারের রাজার দান করা জমির উপর ভবন তৈরি করা হয়। ৭৩ ফুট বাই ৬৪ ফুট ওই জমি যে পাঁচজন পরিষদের তরফ থেকে নির্বাচিত হয়ে গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

আজ থেকে একশো বছর আগে বাঙালি বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিকরা বুঝতে পেরেছিলেন বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে বিজ্ঞানসম্মত চর্চার খুব প্রয়োজন আছে। এই উপলব্ধিকে বাস্তবায়িত করার জন্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর জন্ম। কিন্তু বাড়ি তৈরি করা থেকে শুরু করে বইপত্র সংরক্ষণ করা ইত্যাদির জন্য যে টাকা দরকার তার জোগান দিয়েছিলেন সম্পন্ন বহু সন্তানরা। এবং সেই তালিকা দেখে এই দুই হাজার পনেরোতে বিস্মিত হয়েছি বললে কম বলা হবে।

মাত্র তিপ্পান্ন বছর আগে কলকাতার হাতিবাগান বাজারে আমি তিরিশ টাকায় এক মণ চাল বিক্রি হতে দেখেছি। তখন সোনার দাম কত ছিল? আমি একথা জানি মাত্র পাঁচশো টাকা মাইনে পেয়ে উনিশশো ষাট সালে পাঁচজনের পরিবার ভালভাবে খেয়ে-পরে শুধু বেঁচে থাকতই না, সেই পরিবারের ছেলে ডাক্তারি পড়লেও তার পড়ার খরচ মেটাতে পারত। তা হলে তারও পঞ্চাশ বছর আগে টাকার যে মূল্য ছিল তার সঙ্গে আজকের টাকার মূল্যের পার্থক্য কত? হিসাব করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

পরিষদের ভবন তৈরির জন্য একশো-দুশো বছর আগে যাঁরা চাঁদা দিয়েছিলেন, তাঁদের বিত্তবান বললে কম বলা হবে, বাংলা ভাষার প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা সম্পর্কে কোনও সংশয় থাকার কথা নয়। শুধু জমি দান করা ছাড়াও কাশিমবাজারের রাজা সাহায্য করেছিলেন বিভিন্ন খাতে। গল্প আছে, এতে ক্ষুণ্ণ হয়ে তাঁর পুত্র অনুযোগ করেছিলেন, ‘আপনি সব দান করে দিলেন?’ রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী নাকি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, ওটা পাবলিক করে দিলাম।’

কিন্তু তালিকার প্রথম নাম লালগোলার রাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায়ের। সেই সময় তিনি ভবন নির্মাণের জন্য ১০০৫৮ টাকা দান করেছিলেন। আজকের দিনে ওই টাকার দাম কত হবে? যাঁরা অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা বলতে পারবেন অঙ্কটা কোটি টাকার সীমা অতিক্রম করবে কি না। দীঘাতিয়ার শরৎকুমার রায় দিয়েছিলেন ২৫৮২ টাকা। কালীকৃষ্ণ ঠাকুর ২০০০। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এক হাজার টাকা, রায় যতীন্দ্রনাথ চৌধুরি ১০০০। খুবই পরিচিত নামের মধ্যে আছেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (৫০০)।

আজকের হিসাবে লক্ষ বা কোটি টাকা সাহায্য দিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিসাধন। কিন্তু তারপর? ক্রমশ আমরা নির্লিপ্ত হয়ে গিয়েছি। বাংলা সাহিত্যকে সম্পদশালী করেছেন প্রতিভাবান লেখকরা, ব্যক্তিগত উদ্যোগে। কিন্তু সেই উদ্যোগে তাঁদের ব্যক্তিগত মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে। এখনও, এই দুই হাজার পনেরোতে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ নীরবে তার কাজ করে চলেছে, যা তার প্রতিষ্ঠাতারা চেয়েছিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন তাঁদের কাছে ওই ভবন তীর্থক্ষেত্রের মর্যাদা পাচ্ছে। একজন সাধারণ বাঙালি হিসাবে পরিষদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

৩৩

ভারত সরকারের মনে হয়েছে টিভি চ্যানেলগুলিকে স্বাধীনতা দেওয়ার পরে তারা যা ইচ্ছে তাই করছে। এর লাগাম টানা দরকার। যে কাজটা করলে তারা বিদ্বজ্জন এবং প্রবীণদের কাছ থেকে সাধুবাদ পাবে বলে ভেবেছিল সেটা হল পর্নো চ্যানেলগুলি বন্ধ করে দেওয়া। আদেশ জানাজানি হলে দেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হল। যাঁরা বিরুদ্ধে বললেন, তাঁদের বক্তব্য হল, এটা আমার শয়নকক্ষের স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা। পৃথিবীর সব দেশের মতো এদেশেও পর্নো চ্যানেল টাকা দিয়ে কিনতে হয়। দেখতে না চাইলে কিনবেন না, তা বলে বন্ধ করে দেওয়া হবে কেন? যাঁরা পক্ষে বললেন, তাঁদের বক্তব্য, পর্নো কালচার ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। বাড়িতে ওই চ্যানেল টাকার বিনিময়ে চালু থাকলে অভিভাবকের অনুপস্থিতিতে অল্পবয়সিরা দেখলে তাদের চরিত্রের পতন হতে বাধ্য। প্রথম দল বলল, “তা হলে তো ‘মহাভারত’ বাড়িতে রাখা যাবে না। ছেলেমেয়েরা ওই বইয়ের ভিতর অজস্র পর্নোগ্রাফি পেয়ে যাবে।”

এই বিতর্কের আপাতত অবসান হয়েছে। যতদূর শুনেছি, মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী সরকার এখনই পর্নো চ্যানেলগুলি বন্ধ করছে না। এই প্রসঙ্গে আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি।

আমি আমেরিকায় প্রথমবার যাই উনিশশো চুরাশি সালে। নিউইয়র্কের কুইন্সে বন্ধু মনোজ ভৌমিকের বাড়িতে থেকে ওর সঙ্গে শহরটিকে দেখেছি। এক বিকেলে মনোজ আমাকে ফর্টি সেকে’ স্ট্রিটে নিয়ে গেল। একদিকে পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনাস, সারা দেশে যাওয়ার বাস ওখান থেকে ছাড়ছে। তারপরেই রাস্তার দু’দিকে সিনেমা হলের মতো রঙিন পোস্টারে সাজানো ঝাঁ চকচকে বাড়িগুলি, যাদের আমি সিনেমা হল বলে ভেবেছিলাম, তা আসলে লাইভ সেক্স শপ। সেইমতো প্রেক্ষাগৃহের কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন পড়েছে। সব বয়সের পুরুষদের সঙ্গে মহিলারাও আছেন। মনোজ বলল, “পঁচিশ ডলার করে টিকিট। চল্লিশ মিনিটের শো।”

“শো মানে?”

“লাইভ সে’ অন স্টেজ।”

“সর্বনাশ!” অবাক হয়েছিলাম। “আমেরিকান সরকার অনুমতি দিয়েছে?”

“সরকারি অনুমতি ছাড়া কি ব্যবসা করা সম্ভব?” মনোজ বলেছিল, “একসময় সুইডেন থেকে হাজার পর্নোফিল্ম পাইরেটরা এদেশে এসে বিক্রি করত। কোনও ট্যাক্স দেওয়ার বালাই ছিল না। সুইডেনে ওপেন সেক্স শো-এর উপর নিষেধাজ্ঞা না থাকায় আমেরিকান ট্যুরিস্টরা ওই দেশে যেত। এই ব্যাপারটা বন্ধ করতে সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল। তারপরেই এই ফর্টি সেকেন্ড স্ট্রিটে সেক্সের রমরমা ব্যবসা শুরু হয়ে গেল।”

সেবার একটু মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল। পাশের থিয়েটার পাড়ায় ভাল নাটক হচ্ছে কিন্তু ভিড় কম, আর এই সে’ শপগুলির সামনে লম্বা লাইন! পাঁচ বছর পরে যখন নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম তখন মনোজ পৃথিবীতে নেই। একদিন সন্ধের মুখে ঘুরতে-ঘুরতে ফর্টি সেকেন্ড স্ট্রিটে গিয়ে বেশ অবাক হলাম। সেইসব সেক্স শপগুলি একইরকম আছে কিন্তু কোনওটার সামনে মানুষের লাইন নেই। কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে দু’জন কালো মানুষ চিৎকার করছেন, ”কাম কাম। এনজয় দ্য সেক্স শো, লাইভ অন স্টেজ, ওনলি টেন ডলারস। টিকেট ওনলি টেন ডলারস।”

পাঁচ বছর আগে ভিতরে ঢুকতে পঁচিশ ডলার লাগত, পাঁচ বছর পরে তা দশ ডলারে নেমে গিয়েছে? তার মানে ব্যবসা ভাল হচ্ছে না। দাম কমিয়ে খদ্দের ধরতে চাইছে। কিন্তু কেন সেক্স শপের দর্শক পাঁচ বছরে কমে গেল? আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাউন্টারের সামনে থেকে একজন কর্মী এগিয়ে এল, “ইয়েস স্যর! থিংক ইউ আর এ ট্যুরিস্ট। হুইচ কান্ট্রি স্যর?”

“ইন্ডিয়া।”

“ওহো। ইন্ডিয়া ইজ ইন্ডিয়া। ওকে, ফর ইউ টিকেট উইল বি ফাইভ ডলারস। হ্যাপি? কাম কাম!”

লোকটা বলে কী! কোনওরকমে ছাড় পেয়েছিলাম লোকটার হাত থেকে।

ঠিক দুই বছর পরে নিউইয়র্কে গিয়ে শুনলাম, ফর্টি সেকে’ স্ট্রিটের সে’ শপগুলি উঠে গিয়েছে। একদমই খদ্দের হচ্ছিল না তাই বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখলাম সেক্স শপগুলির বদলে প্রেক্ষাগৃহে থিয়েটার বা সিনেমা চালু হয়েছে।

কেন এমন হল? ওইসব সেক্স শপের খদ্দের ছিল হয় ট্যুরিস্ট, নয় বয়স্ক মানুষেরা। কিন্তু এই ব্যাপারটায় কোনও নাটক না থাকায়, কাহিনি বলে কিছু না পাওয়ায় দর্শকদের আগ্রহ অল্পদিনেই শেষ হয়ে যেত। তাঁদের কাছে ব্যাপারটি বিরক্তিকর হয়ে উঠত। পথেঘাটে কুকুর বা গরু-ছাগলের মিলনের ঘটনা আকছার ঘটছে। কিন্তু সেই দৃশ্য দেখতে বেশিরভাগ মানুষ আগ্রহী হয় না।

এই যে এতদিন টিভি চ্যানেলগুলিতে পর্নো ফিল্ম দেখানো হত তা নিয়ে বেশিরভাগ মানুষের মাথাব্যথা ছিল না। সরকারই বাতিল করে দেবে বলে বিষয়টি উস্কে দিল। আর শুধু পর্নো চ্যানেল কি মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে? ওটা দেখতে টাকা খরচ করতে হয়, তা না করলেই হল। কিন্তু সাধারণ চ্যানেলগুলি, যা দেখতে মানুষ অভ্যস্ত তা আর একটি কাজ ভয়ানকভাবে করে চলেছে। একটি ঘুমন্ত সাপকে জাগ্রত করে বিজ্ঞাপন প্রচার করেই ক্ষান্ত হয়নি, ‘দিদি তোরা সাতদিনে তিনবার খাট ভেঙে ফেলেছিস’, আর দিদি বলছে, ‘দুষ্টু’, এই বিজ্ঞাপন বাচ্চাদের সঙ্গে বসে দেখতে যে অস্বস্তি প্রথমদিকে হচ্ছিল তা তো আমরা বেশ কাটিয়ে উঠেছি। এগুলি বন্ধ করার কথা সরকারের মাথায় আসে না কেন? না এলে একদিন টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখব, ‘আমি সুইটি, আমার সঙ্গে সময় কাটিয়ে অর্থ উপার্জন করুন।’ দিনটা এল বলে!

৩৪

কেউ জেনেশুনে নির্লিপ্ত মুখে মিথ্যে কথা বলছেন শুনলে আগে উপেক্ষা করতাম। ভাবতাম যা খুশি বলে বলুক, আমার কী যায় আসে। কিন্তু শুনতে-শুনতে আমার তো একসময় রেগে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু রাগতে পারিনি। কারণ রেগে গিয়ে তো আমি কিছুই করতে পারব না। রেগে গেলে সেটা প্রকাশ করতে চাইলে হাতে ক্ষমতা থাকা দরকার। আমার মতো যারা সাধারণ মানুষ, তাদের ক্ষমতা থাকার কথাই নেই। কেউ-কেউ বলবেন, ‘কেন? আপনি লেখক, আপনার হাতে তো কলম রয়েছে।’ সবাই জানে তলোয়ারের থেকে কলমের ক্ষমতা অনেক বেশি।

এই কথাগুলি বলার সময় কেউ ভাবেন না প্রবাদটা কবে চালু হয়েছিল। সে সময়ের সমাজব্যবস্থা, মানুষের যে জীবনযাপন তার সঙ্গে এখনকার কোনও মিল আছে কি না! চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে পর্যন্ত এমন অনেক প্রবাদ দীর্ঘযুগ ধরে চালু ছিল, যাকে সত্যি বলে ভাবার কারণ ছিল। যেমন খনার অনেক বচনের মধ্যে প্রাকৃতিক সত্যটা দেখতে অসুবিধে হত না। ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজা পুণ্য দেশ’। মাঘ মাসের শেষে বৃষ্টি হলে মাঠে সুফসল ফলবে, ঘরে ঘরে অন্নাভাব থাকবে না। সেই দেশের রাজাকে নিয়ে প্রজারা সুখী হবে। মুশকিল হল, এখন বর্ষা কখন হবে, কতটা হবে তার কোনও পূর্বাভাস দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর উত্তাপ বেড়ে যাওয়া, সমুদ্রে নিম্লচাপের হেরফেরে প্রকৃতি যে রকম খামখেয়ালি হয়ে পড়েছে, তাতে বৃষ্টিটা পৌষে বা ফাল্গুনে হলেও শস্যের তেমন হেরফের হচ্ছে না।

আমি জানি না এখনও শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ জাতীয় বাক্য থাকে কি না এবং সেগুলি মুখস্থ করে তাদের পরীক্ষা দিতে হয় কি না। যদি থেকে থাকে, তা হলে এর চেয়ে বেশি মিথ্যাচার আর কী হতে পারে। এগুলি মুখস্থ করা মানে শিশুটিকে জেনেশুনে মিথ্যে কথা শিখতে বাধ্য করা হচ্ছে। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন—’, এই জাতীয় কবিতার সঙ্গে আমাদের জীবনযাপনের যে কোনও সম্পর্ক আর নেই, তা বুঝেও না-বোঝার ভান করে থাকি আমরা। তিন বছরের শিশুকে সাজিয়ে-গুজিয়ে স্কুলের ভিতরে ঢুকিয়ে জননীরা বাইরে অপেক্ষা করেন, ছুটি হলে ফেরত নিয়ে যাবেন বলে। এরকম জননীদের কয়েকজন ওই কয়েকঘন্টা কাটানোর জন্য স্কুলের কাছে ঘরও ভাড়া নিয়েছেন। তাঁদের আলোচনার বিষয়গুলির মধ্যে একটি খুবই জোরালো, ক্লাস থ্রিতে ছেলেকে যখন নামী স্কুলে ভর্তি করতে হবে, তখন যে টাকা দিতে হবে, তার অঙ্ক প্রতি বছর বেড়ে চলেছে। অনেক স্বামী-স্ত্রী তো সেই টাকা জোগাড় করতে পারছেন না বলে সন্তানের জন্ম দিতে সাহসী হচ্ছেন না। এই পরিস্থিতি তো আগে ছিল না। তাই প্রবাদগুলি দিন-দিন অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে। ওইরকম বাড়ির পরিচিত বাড়িওয়ালা একটা ঘটনা শোনালেন। জননী সন্তানের ব্যাগে টিফিনের বাক্স ঢুকিয়ে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। ছুটির পরে সেই বাক্স খালি দেখে খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘বাঃ, সব খেয়ে নিয়েছ! আমার সোনা ছেলে।’ ছেলে মাথা নেড়েছিল, ‘মা মা, আমার পাশে তপন বসেছিল। ও টিফিন আনেনি বলে অর্ধেকটা ওকে দিয়েছি।’ শোনা মাত্র জননীর মুখে মেঘ জমল। তাঁর হাত ছেলের কান চেপে ধরল। তিনি চাপা স্বরে বললেন, ‘আমি এত কষ্ট করে টিফিন করে দিলাম আর তুমি সেটা দাতব্য করে এলে? এরপর যদি শুনি তা হলে মেরে হাড় ভেঙে দেব।’

ছেলের স্বাস্থ্যের কথা, নিজের পরিশ্রমের কথা ভেবে জননী হয়তো কথাগুলি বলেছেন, কিন্তু তিন বছরের ছেলে কী শিখল? নিজের ভাগ থেকে কাউকে দান করা অপরাধ। অথবা, শিখল, কাউকে সাহায্য করলে সেটা বাড়িতে বলা উচিত নয়। তিন বছর বয়স থেকেই সে হয় স্বার্থপর, নয় মিথ্যেবাদী হতে শিখবে।

আসলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির যেমন বদল হয়ে গিয়েছে, তেমনি সেইসব বোধ, যা এক সময় সুস্থ বলে মনে হত তাও অসাড় হয়ে গিয়েছে, এই ব্যাপারটা কখন থেকে কেমন করে নিঃসাড়ে হয়ে গিয়েছে, তা আমরা টের পাইনি। কিন্তু এখন সবাই বুঝে গিয়েছেন, বিদ্যাসাগরের পথে হাঁটলে সারাজীবন বিপর্যয় সঙ্গী হবে।

আমি যখন তেরো পার্বণ ধারাবাহিকটি লিখেছিলাম তখন একটা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম, দশ বছর দেশের বাইরে থাকা এক বাঙালি যুবক কলকাতা ফিরে এসে তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করে দেখল, বারো বছর আগে যাদের যেরকম দেখে গিয়েছিল তার অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। একান্নবর্তী পরিবার থেকে স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের পরিবারে পৌঁছেও মানুষ শান্তি পায়নি। পরিবারের থেকে ব্যক্তিগত সুখ এবং স্বাচ্ছন্দ্য তাদের বেশি কাম্য হয়ে উঠেছে। ফলে ডিভোর্সের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে গিয়েছে। এবং ভবিষ্যতে কী হবে তা জানা না থাকায় আইনি সম্পর্ক তৈরি না করে নারীপুরুষ একত্রে বাস করছে এবং সমাজ একে ‘লিভ টুগেদার’ আখ্যা দিয়ে চোখ বন্ধ করে মেনে নিচ্ছে। তেরো পার্বণ জনপ্রিয় হয়েছিল। কারণ মানুষ তার সঠিক অবস্থা পর্দায় দেখে বোধহয় প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। এই সময় বাবা-মাকে সন্তান ত্যাগ করে যেমন আলাদা সংসার করছে, তেমনি বাবা মাও বিয়ের পর অশান্তির আশঙ্কা করে ছেলেদের আলাদা থাকতে বলছে। মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে না চেয়ে আশা করছে মেয়ে কখন প্রেম করবে, অথচ এঁরাই সবে দলে-দলে ‘বেলাশেষে’ চলচ্চিত্র দেখতে যাচ্ছেন। নিজের সঙ্গে এ এক অদ্ভুত খেলা! অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মিথ্যাচার! নিজের বাবা মায়ের খবর রাখছি না, লোভের ছোবল খেয়ে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছি, গায়ে হাত তুলছি আবার ‘বেলাশেষে’ দেখে এসে অফিস গিয়ে বলছি, ‘অনেকদিন পরে একটা ভাল ফ্যামিলি ড্রামা দেখে এলাম।’

ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত মিথ্যাচারে অভ্যস্ত হয়ে আছি বলে রাজনৈতিক নেতাদের কথাবার্তায় কান দিই না। ওঁদের নাকি মিথ্যে কথা বলতেই হয়। নিজের প্রয়োজনে সাধারণ মানুষ মিথ্যে বলে, ওঁরা বলেন দলের প্রয়োজনে। কেউ অল্প মিথ্যে বলেন, কেউ একটু বেশি। কিন্তু কান না দিলেও শুনে একটু বিভ্রান্ত তো হই! কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য, এদেশে এমন মন্ত্রী আছেন যিনি সত্যি কথা বলতেই জানেন না। এই না-জানাটা মানুষ এত ভাল জেনে গিয়েছে যে তাঁর কথায় কেউ বিভ্রান্ত হয় না। এই মিথ্যে বলার অভ্যেসটা তাঁর ভিতরে এত প্রবল যে, মনে হয়, তিনি ঘুমন্ত অবস্থায় যদি কথা বলেন, তা হলে সেই কথাগুলিও সত্যের ধারেকাছে যায় না।

৩৫

মাস তিনেক আগে আমার এক বন্ধু ফোন করেছিলেন, ”একটা উপকার করবেন? কলকাতার হাসপাতালে একজন খুব গরিব মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেবেন?”

এই বন্ধু সচরাচর কারও সামনে সাহায্য চেয়ে হাত পাতেন না। কিন্তু অনুরোধ শোনামাত্র আমার মনে পড়ছিল না এই ব্যবস্থা করার ক্ষমতা আমার আছে কি না। গত এক বছরে নিজের চিকিৎসার জন্য তিন-তিনবার যে তিনটে জায়গায় যেতে হয়েছিল তাদের হাসপাতাল বলা যায় না। অথচ সেইসব চিকিৎসালয় সাধারণ নার্সিংহোম নয়। সেসব জায়গায় অত্যন্ত যত্নে এবং সতর্কতার সঙ্গে চিকিৎসা করা হয় বলে সম্মানদক্ষিণার পরিমাণও মোটা রকমের। বিমা থাকায় কিছুটা সাশ্রয় নিশ্চয়ই হয়। হয়েছেও। বন্ধু বলেছেন, যাঁর চিকিৎসার প্রয়োজন তিনি গরিব মানুষ। ভারতবর্ষের গরিব মানুষদের নাগালের বাইরে ওইসব চিকিৎসালয়। বিমা থাকলেও নয়। কথাটা লেখার সময় ভাবলাম না যাঁরা গরিব, তাঁদের পক্ষে বিমার কিস্তি দেওয়াও সম্ভব নয়। যদিও বিজ্ঞাপনে দেখলাম মাত্র বারো টাকা কিস্তিতে এখন দু’লক্ষ টাকার জীবনবিমা করার সুযোগ হয়েছে।

বন্ধুকে বললাম, একটু ভেবে দেখি। ভাবতে গিয়ে প্রথমে মনে এল পিজি হাসপাতালের কথা। ডক্টর সান্যাল ছিলেন ওখানকার সুপার, আমার বন্ধু। কিন্তু তিনি কবে অবসর নিয়েছেন! নাম মনে পড়ছে না কারও! যে ছেলেটি আমার ফিজিওথেরাপিস্ট, সে খুব ভদ্র এবং কর্তব্যপরায়ণ। তাকে বলতেই সে বলল, “আমার ভাই আগে পিজি হাসপাতালে ছিল। ওখানে ওর ভাল চেনাশোনা আছে। সামনের সোমবার সকালে এসে পিজিতে কার্ড করাতে বলুন। ওদের মোবাইল থাকলে নাম্বার দিন। না থাকলে আমার ভাই-এর নাম্বার দিয়ে দেব। ও সেদিন সকালে গিয়ে সব ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু স্যার, অসুখটা কী?”

বন্ধু বলেছিলেন চিকিৎসার ব্যবস্থা করাতে হবে। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁকে ফোন করলাম। বন্ধু বললেন, “সম্ভবত প্রস্টেটের সমস্যা। পনেরো দিন হল ওখানকার ডাক্তার ক্যাথিটার ব্যবহার করাচ্ছে। খুব যন্ত্রণা পাচ্ছে। ওখানকার ডাক্তার বলেছেন অবিলম্বে অপারেশন করানো দরকার।”

“কোথায় থাকেন ভদ্রলোক?”

“সুন্দরবনে। সজনেখালির কাছে একটা গ্রামে। কলকাতায় আসতে চার-পাঁচ ঘন্টা লেগে যায়।” বন্ধু বললেন।

“তা হলে তো ওঁদের রবিবার কলকাতায় আসতে হবে। পিজিতে যেতে হবে সোমবার সকালে। গিয়ে টিকিটের জন্য লাইন দিতে হবে।”

“ঠিক আছে। আমি তাই বলে দিচ্ছি। আমার বাড়িতে না হয় রবিবার থাকবে।”

“তা তো হল। যদি ভর্তি হয়ে যায়, তা হলে ওঁকে দেখাশোনার জন্য ওঁর আত্মীয় কাউকে দরকার। ছেলেমেয়ে আছে?”

”মেয়ে আছ। সে-ই থাকবে।”

সোমবার অসুস্থ মানুষটি মেয়েকে নিয়ে দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট করিয়ে যখন ডাক্তারের কাছে পৌঁছলেন তখন ভরদুপুর। ডাক্তার তাঁকে পরীক্ষা করিয়ে বেশ কয়েকটা টেস্ট করাতে লিখলেন, যা আমার ফিজিওথেরাপিস্ট ছেলেটির ভাই দ্রুততার সঙ্গে করালেও বিকেল গড়িয়ে গেল। সেদিনই রিপোর্ট পাওয়া যাবে না। যে ডাক্তার দেখেছেন, তিনি বসবেন আগামী সোমবার। অতএব সেদিন রিপোর্ট নিয়ে তাঁকে দেখাতে হবে। অতএব ওঁদের আরও সাতদিন কলকাতায় থাকতে হবে যা সম্ভব নয়। আবার ট্রেন; ট্রেন থেকে নদী। নদী পার হয়ে অটো, তারপর নদী, সেই সুন্দরবনে পৌঁছে কাতরাতে লাগল লোকটি। বাড়ির সবাই আশ্বাস দিল। পিজির মতো বড় হাসপাতালের ডাক্তার যখন দেখেছে, রক্ত নিয়েছে, তখন অসুখ ভাল হবেই। আশায় বাঁচে চাষা!

আবার পরের রবিবারে কলকাতায় এল ওরা। বন্ধুর বাড়িতেই উঠল। পরদিন মেয়েটি তার বাবাকে রিপোর্ট সমেত নিয়ে যখন ডাক্তারের কাছে পৌঁছলেন তখন তিনি সব দেখে লিখলেন, অ্যাডমিট করা যেতে পারে।

যেন চাঁদ পেয়েছে হাতে, এই মুখ নিয়ে ওরা গেল সেই বিভাগে যেখান থেকে ভর্তির ব্যবস্থা হয়। গিয়ে শুনল, আজ কোনও বেড খালি নেই। আবার সামনের সোমবার আসতে হবে। তখন নিশ্চয়ই বেড খালি পাওয়া যাবে। তা হলেই পেশেন্টকে ভর্তি করা যাবে।

যেন বজ্রপাত হল। যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছেন না লোকটি। আবার স্টেশন, দু-দুটো নদী, আবার এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে এখানে আসা। তাঁর কাতর অনুরোধেও কাজ হল না। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে আসতেই প্রস্তাব ছুটে এল, “অপারেশন হবে তো? বেড দরকার? হাজার পনেরো ডোনেশন দিন, এখনই ভর্তি হয়ে যাবেন।” মেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল, “এটা তো সরকারি হাসপাতাল। অত টাকা কেন চাইছেন?” প্রস্তাবদাতা বলেছিল, “তা হলে ভোগে যান।”

আমার অপরাধবোধ বেড়ে যাচ্ছিল। আমি যদি না বলতাম তা হলে ওরা এত কষ্ট করে, খরচ করে সুন্দরবন থেকে আসত না। আর তখনই মনে পড়ে গেল ডক্টর তপনকুমার লাহিড়ীর কথা। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল। ওঁদের একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলাম। অমায়িক ভদ্রলোক। ফোন করে ব্যাপারটা তাঁকে জানাতেই তিনি পরের দিন পেশেন্টকে নিয়ে যেতে বললেন।

আবার আশার আলো। বন্ধু রাজি হলেন আশ্রয়ের সময় বাড়াতে। মেয়েটি তার বাবাকে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজে গেল। সেখানকার ডাক্তাররা পরীক্ষা করে ভর্তি করতে গিয়েও একটা রিপোর্ট দেখে থমকালেন। পিজি হাসপাতালের সেই রিপোর্ট অনুযায়ী পেশেন্ট ক্যানসারে আক্রান্ত। সঠিক কি না তা আর একবার পরীক্ষা করা দরকার। বাইরে সেটা করাতে বেশ খরচ ও সময়সাধ্য। মেয়েটি আর কলকাতায় থাকতে চাইল না। আরও অসুস্থ হয়ে পড়া বাবাকে নিয়ে ট্রেন, দু’দুটো নদী পার হয়ে সুন্দরবনে চলে গেল। খুব খারাপ লাগলেও আমরা কি একটু স্বস্তি পেলাম না? বন্ধু বললেন, “প্রস্টেট অপারেশন করিয়েও তো লাভ হত না, ক্যানসারেই তো মারা যাবে।” কিন্তু কি আশ্চর্য। মেয়েটি হাল ছাড়েনি। ক্যানিং-এর এক প্যাথলজি থেকে ওই একই পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট পেয়েছে তার বাবার ক্যানসার হয়নি। তাই আবার লড়াই করা সম্ভব। বাবার জন্য। বাঁচার জন্য। লক্ষ-লক্ষ গরিব মানুষ হাসপাতালে-হাসপাতালে চিকিৎসার বাইরে যে লড়াইটা করছেন, তার খবর যাদের রাখা উচিত, তারা কোথায়?

৩৬

এই সেদিনও উত্তর কলকাতার প্রাচীন মানুষদের মুখে ছড়াটা শুনতে পেতাম, ”বাঙাল মনুষ্য নয় উড়ে এক জন্তু…।” বলার সময় তাঁদের মুখে এক অপার্থিব আনন্দ ফুটে উঠত। জলপাইগুড়িতে বড় হয়ে এসে এরকম কুরুচিকর বাক্য কলকাতায় শুনব, তা কল্পনাও করিনি। কিন্তু দেখতাম তখনকার পূর্ববঙ্গ থেকে পূর্ব পাকিস্তান হওয়া দেশের মানুষদের ‘মানুষ’ হিসাবে সম্মান দিতে বাধ্য এদিকের মানুষ, যাঁদের ‘ঘটি’ বলা হত। এই মনোভাবের পিছনে কী কারণ ছিল, তা জানতে চেয়েও অস্পষ্ট থেকে গিয়েছে। ঘটি কারা? মূলত উত্তর কলকাতার বাঙালি। কলকাতা তখন দু’ভাগে বিভক্ত। উত্তর ও দক্ষিণ। ধর্মতলার এপাশে উত্তর কলকাতা, ওপাশে দক্ষিণ। তার মানে ক্রিক রো, বউবাজার থেকে কাশীপুরও উত্তর কলকাতার। ওদিকের বড়বাজার বা এদিকের রাজাবাজার গণ্ডির ভিতরে পড়লেও সেখানে অবাঙালিদের বসবাস। গোটা পশ্চিমবাংলার দিকে তাকালে এলাকাটি বিশাল বড় নয় এবং সেখানকার জনসংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার তুলনায় নগণ্য।

‘আমি ঘটি, আমি মোহনবাগানি’—কথাগুলি গর্বের সঙ্গে তাঁরা উচ্চারণ করেন। কলকাতার ঘটি পরিবারে এই সেদিন পর্যন্ত বোয়াল মাছ হেঁশেলে ঢুকত না। কারণ ওটা বাঙালদের খাদ্য। শুধু বোয়াল মাছ কেন, আমাদের খাদ্যবস্তুর অনেক কিছুই ঘটিরা খান না, অথচ তা পূর্ববঙ্গের মানুষদের বেশ প্রিয়। যেমন শুঁটকি মাছ।

কিন্তু এত উন্নাসিকতা কেন? স্কটিশের এক সহপাঠী, যে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে কলেজে আসত, তাকে প্রশ্ন করেছিলাম। সে হেসে বলেছিল, “আমরা অভিজাত বাঙালি। বংশগৌরব আছে। আমরা যে ভাষায় কথা বলি, সেই ভাষাই স্ট্যান্ডার্ড বাংলা ভাষা বলে স্বীকৃত। প্রমথ চৌধুরির বাংলা বা রবীন্দ্রনাথের বাংলা তো পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের জিভে কখনওই উচ্চারিত হতে পারে না। ওরা যখন এই বাংলায় কথা বলে, তখন শুনলেই বোঝা যাবে কষ্ট করে বলছে। বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ থেকে তারাশংকর বা বিভূতিভূষণ এই বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছেন। গর্ব করার অনেক কিছু আমাদেরই আছে।” আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম পূর্ববাংলায় অনেক বিখ্যাত মানুষ জন্মেছেন, যাঁদের কাছে বাঙালি চিরকাল ঋণী থাকবে। বরিশালের জীবনানন্দ দাশকে বাংলা কবিতা রবীন্দ্রনাথের পরেই মনে রাখবে। কিন্তু কে কাকে বোঝাবে!

আমার এক বন্ধু বিশ্লেষণ করেছিল, ”স্বাধীনতার আগে-পরে যে শরণার্থীরা পূর্ববঙ্গ থেকে এদেশে নিঃস্ব হয়ে এসেছিলেন তাঁরা বাধ্য হয়েছিলেন অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে। শিকড়চ্যুত ওইসব মানুষেরা যে বাংলায় কথা বলতেন, তা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা নয়, এপার বাংলার সাধারণ মানুষও সেই ভাষায় কথা বলে না। ওরা আসায় এদেশের অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে ওঠে এবং তার আঁচ এপার বাংলার মানুষের জীবনে লাগে। তাই থেকে বিরক্তির জন্ম এবং নিজেদের বাঙালি ভাবার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া।”

আমার মনে হয়েছে এই ব্যাখ্যা আংশিক সত্যি। কারণ স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই ওই মানসিক বিভাজন শুরু হয়েছিল।

লক্ষ্য করেছি, হিন্দু-মুসলিম প্রীতির সম্পর্ক বাড়ির বাইরে সীমাবদ্ধ ছিল। যাঁরা নিজেদের নিষ্ঠাবান হিন্দু মনে করতেন, তাঁরা মুসলমানদের সঙ্গে বাড়ির ভিতরে ভাল ব্যবহার করতেন না। অন্দরমহলে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল, মুসলমানরা বাড়িতে এলে তাদের জন্য আলাদা কাপ, ডিশ, বাটির ব্যবস্থা থাকত। বাল্যকালে এর কারণ জিজ্ঞাসা করে বয়স্কদের উত্তর শুনেছি, ”ওরা গরু খায়, মুরগি খায়।” সেসময় গরু যেমন হিন্দুদের কাছে নিষিদ্ধ খাদ্যবস্তু ছিল, মুরগিও বাড়িতে ঢুকত না। পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের সম্পর্কে কলকাতার বাঙালি ঘটি পরিবার এতটা চূড়ান্ত ভাবনা না ভাবলেও প্রায় কাছাকাছি যেতেন। আমরা যখন চাকরিবাকরি পেলাম তখন আমাদের এক বন্ধু, যার বাড়ি শোভাবাজারে, তার প্রেমিকাকে বিয়ে করতে চাইল। কিন্তু তার অভিভাবকদের তীব্র আপত্তির কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। আমরা কয়েকজন তাঁদের বোঝাতে গেলাম। বন্ধুর ঠাকুরদা বললেন, ”অজাত-কুজাতের মেয়েকে ঘরের বউ করতে পারব না। তোমরা যাও।” তাঁকে বললাম, ”মেয়েটির পদবি বসু। তার বাবা জগদীশচন্দ্র বসুর দূর সম্পর্কের আত্মীয়।”

”তাতে কী এসে গেল। হাজার হোক বাঙাল তো। বোয়াল-শুঁটকি খেয়ে বড় হয়েছে। না, না, বাঙাল আর মুসলমান মেয়েকে ঘরের বউ হতে দেব না।”

বিয়েটা হয়েছিল। তবে ওদের আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হয়েছিল। এই সেদিন, আমার পরিণত বয়সে, একজন শিক্ষিত অ্যাটর্নি যাঁর বয়স আশির উপর, আলাপ হল। দুটো কথার পর তিনি জানতে চাইলেন, “ওহে, তুমি বাঙাল কি না বুঝতে পারছি না। জলপাইগুড়িতে জন্মেছ, ওখানে তো বাঙাল গিজগিজ করছে।”

আমাদের ছেলেবেলায় যেসব বাঙালি ‘গাইছি’ ‘খাইছি’ বা ‘বুঝলা’ জাতীয় শব্দ বলতেন, তাঁদের এপার বাংলার লোক বাঙাল বলতেন। তাঁরা খেয়াল করতেন না, পূর্ববাংলার জেলাগুলির মানুষ একই ভাষায় কথা বলেন না। চট্টগ্রামের ভাষার সঙ্গে যেমন বরিশালের সামান্য মিল নেই, তেমন সিলেটের সঙ্গে ফরিদপুরের তুলনা করা যায় না। অর্থাৎ বাঙাল ভাষা বলে নির্দিষ্ট কোনও ভাষা নেই। স্রেফ অজ্ঞতা থেকে এপার বাংলার মানুষ ওইরকম একটা ভাষাকে কল্পনা করে নিয়েছে। আমাদের মেদিনীপুর, বীরভূম বা পুরুলিয়ার ভাষার সঙ্গে কলকাতার ভাষার কোনও মিল নেই। কিন্তু তাদের ভাষা নিয়ে কলকাতার ঘটিরা ব্যঙ্গ করেছেন বলে শুনিনি। একটা মজার ব্যাপার হল, বঙ্গোপসাগরের পাশের জেলা থেকে সেই  চাকমাদের পাহাড়, চট্টগ্রাম পর্যন্ত ভূখণ্ডের অধিবাসী বাঙালিরা কথা বলার সময় যে যাঁর ভাষায় বললেও লেখার সময় একই বাংলা ব্যবহার করতেন, যাকে ‘সাধুভাষা’ বলা হয়ে থাকে এবং যা বাঙালি এখন ত্যাগ করেছে।

উত্তর বাংলায় দক্ষিণ বাংলার মানুষ গিয়েছিল চাকরির প্রয়োজনে। পূর্ববাংলার বিভিন্ন জেলার মানুষ সেখানে এসেছে বাধ্য হয়ে। তাঁদের ভাষা আলাদা, খাদ্যাভ্যাসও এক নয়। কিন্তু একসঙ্গে থাকতে-থাকতে তাঁদের মুখে এক মিশ্র ভাষার জন্ম হল, যার সঙ্গে পূর্ববঙ্গ বা পশ্চিমবঙ্গের কোনও ভাষার মিল নেই। এই মিশ্রভাষার একটা মাদকতা আছে।

এখন কলকাতার ঘটিরা ঢাকার কুট্টিদের মতো ইতিহাস হয়ে যাচ্ছেন। উন্নাসিকতার আয়ু কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

৩৭

ষাট পেরিয়েই সোমনাথবাবুর মনে হয়েছিল, অনেক তো হল, এবার একটু নির্মল জীবনযাপন করা যাক। এই নির্মল জীবন মানে মাছ, মাংস, ডিম ত্যাগ করা, সিগারেট এবং হুইস্কি স্পর্শ না করা। আগে মাঝেমাঝে তাঁকে সস্ত্রীক থিয়েটার রোডের ক্লাবে দেখা যেত, এখন সেটাও বন্ধ। আর যেহেতু স্বামী-স্ত্রীর মনের মিল যথেষ্ট তাই ওঁর স্ত্রীও খুশি হয়ে নিরামিষ খেতে লাগলেন। রোজ সকাল-বিকেল দু’জনে পাশাপাশি বসে ধ্যান করেন। মাঝেমাঝে ফোন করে আমাকে উপদেশ দেন, নিরামিষ খাবারের উপকারিতা কতখানি, তা বোঝান। সোমনাথবাবুদের কোনও সন্তান নেই। মোটা মাইনের চাকরি করতেন। থাকেন পার্ক সার্কাসের সার্কাস রেঞ্জে। কিছুকাল পরে শুরু হল বাড়িতে পুজোর আয়োজন করা। বাড়তে-বাড়তে প্রায় সব হিন্দু-দেবদেবী নিয়ে মেতে থাকতেন প্রৌঢ় দম্পতি।

সোমনাথ এবং তাঁর স্ত্রী কপালগুণে একটি কাজের লোক পেয়েছিলেন, যার নাম সতী। সোমনাথ চাইতেন না চব্বিশ ঘন্টা কোনও বাইরের লোক তাঁর বাড়িতে থাকুক। ঠিকে কাজের লোক পেয়েও গিয়েছিলেন। সতী বাড়িতে আসে সকাল সাড়ে ছটায়। আসার সময় দুধ এবং পাউরুটি নিয়ে ঢোকে। সংসারের সব কাজ, রান্নাবান্না শেষ করে বিকেল চারটের সময় বাড়ি চলে যায়। সোমনাথের স্ত্রী খুব খুশি তার কাজে। এমনকী, ঠাকুরঘরটিও বেশ যত্ন করে পরিষ্কার করে সতী।

এক সন্ধেবেলায় উত্তেজিত হয়ে সোমনাথ আমাকে ফোন করলেন, ‘আমার মিসেসের গলার হার আর হাতের বালা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সলিড সোনার। পার্ক সার্কাস থানায় আপনার পরিচিত কোনও অফিসার আছেন?’

‘কী করে হারাল?’ জিজ্ঞাসা করলাম।

‘আর বলবেন না। বাজে অভ্যেস। স্নানের সময় বাথরুমেই খুলে রাখে। কালও রেখেছিল। কিন্তু বেরনোর সময় তুলতে ভুলে গিয়েছিল।’

‘এক কাজ করুন। কাল কাজের মেয়েটি এলে তাকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন সে কিছু জানে কি না। তারপর থানায় যাবেন।’

কিন্তু পরের সকালে সতী কাজে এল না। বাধ্য হয়ে থানায় গেলেন সোমনাথ। সব শুনে অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই কাজের লোক কীরকম?’

‘ভাল। আজ পর্যন্ত সন্দেহজনক কোনও কাজ করেনি। চার বছর আছে।’

‘নাম বলুন।’

‘সতী।’ সোমনাথবাবু মনে করে বললেন, ‘সতী মাঝি, সম্ভবত।’

‘ওর ছবি এনেছেন?’ হাত বাড়ালেন অফিসার।

‘না তো। ওর ছবি আমাদের কাছে নেই।’

‘আশ্চর্য। বারবার বলা হয়েছে বাড়িতে কাজের লোক রাখলে তার ছবি তুলবেন। আইডেন্টিটি কার্ড রাখবেন। ওটা নিশ্চয়ই নেই।’

‘না।’ সোমনাথবাবু আবিষ্কার করলেন, ডায়মন্ডহারবার বা ক্যানিং, কোনদিক থেকে সতী আসে তা-ও তিনি জানেন না।

সব শুনে হাসলেন অফিসার। ‘কোথায় খুঁজব মেয়েটাকে।’ আমার মনে হচ্ছে সে-ই সোনাগুলো নিয়েছে। বাড়িতে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে যদি কোনও ক্লু পান, তা হলে জানাবেন। আচ্ছা, ও কখন আপনাদের বাড়িতে আসত?’

‘ঠিক সকাল সাড়ে ছটায়।’ সোমনাথ বললেন।

বাড়িতে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেও সুরাহা হল না। তিনি মেয়েটির কোনও হদিশ জানেন না। একবার দুটো নারকেল এনে দিয়েছিল, বলেছিল, ওদের নারকেল গাছের ফল। বাড়িতে নারকেল গাছ আছে, এমন ক্লু দিলে পুলিশ অফিসার পাগল ভাববেন। সোমনাথ তাঁর অজ্ঞতার কথা ফোনে অফিসারকে জানালেন। ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনার বাড়ি থেকে পার্ক সার্কাস স্টেশন বেশি দূরে নয়। কাল ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় থেকে অন্তত এক ঘন্টা স্টেশনে গিয়ে নজর রাখুন। হয়তো মোটা টাকার চাকরি পেয়ে গয়না চুরি করে আপনার বাড়ি ছেড়েছে। ওকে দেখলে কিছু বলবেন না। শুধু আমাকে জানিয়ে দেবেন। এছাড়া অন্য পথ খোলা নেই। আপনার কপাল ভাল হলেই পাবেন।’

সোমনাথ আমাকে ফোন করে অনুরোধ জানালেন তাঁর সঙ্গে পার্ক সার্কাস স্টেশনে যেতে। অত ভোরে ওঁকে সঙ্গ দেওয়ার ইচ্ছে আদৌ হচ্ছিল না কিন্তু এমন করে বললেন, রাজি না হয়ে পারলাম না।

ভোর পাঁচটায় স্টেশনে পৌঁছে একটু আড়াল রেখে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পেলাম দৃশ্যটা। প্ল্যাটফর্মের ওপর একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের ব্যবধান রেখে কয়েকটি লোক বড় ব্যাগ নিয়ে বসে আছে। একটু পরেই ক্যানিং থেকে একটা ট্রেন এল। দেখা গেল লোকগুলো বসেছে ঠিক ট্রেনের দরজার সামনে। হুড়মুড়িয়ে কাজের মেয়েরা নামতে লাগল ট্রেন থেকে। তারপরেই এক একটি লোকের সামনে লাইন তৈরি করে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রথম মেয়েটি মাথা নিচু করে দাঁড়াতেই প্ল্যাটফর্মের লোকটি তার সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে ব্যাগ থেকে শাঁখা আর নোয়া বের করে হাতে পরিয়ে দিতেই সে ছুটল প্লাটফর্মের বাইরে। একে-একে সব মেয়ে একইভাবে সিঁদুর-শাঁখা পরল। পরেই দৌড়ল। যারা লাইনে দাঁড়ায়নি, তারা ট্রেন থেকে নেমেছে শাঁখা-সিঁদুর পরেই। সোমনাথ হতভম্ব। কিন্তু সতীকে দেখা গেল না সাড়ে ছটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। অফিসারকে এ-কথা জানাতেই তিনি বললেন, বিকেল সাড়ে চারটের সময় স্টেশনে যেতে। এবার ফেরার ট্রেন যে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ায়, সেখানে গেলাম আমরা। মেয়েরা দৌড়ে-দৌড়ে এল। সকালের লোকগুলো ওদের সিঁথিতে গুঁড়ো সাবান ছড়িয়ে দিয়ে, কলের জলে মাথা পরিষ্কার করে শাঁখা-নোয়া ফিরিয়ে দিয়ে ট্রেনে চেপে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেল মেয়েরা। না, এদের দলেও সতী ছিল না। অফিসার বললেন, ধৈর্য ধরে দু-চারদিন ওয়াচ করলে ঠিক পেয়ে যাবেন। এই মেয়েগুলো মুসলমান। গোঁড়া হিন্দু বা মারোয়াড়িদের বাড়িতে ওদের পরিচয় জানলে কাজ পাওয়া যাবে না। হিন্দু সাজলে মোটা মাইনে। তাই ওরা দিনের বেলায় সাজ বদলায়। নামও। এর জন্য ওই লোকগুলোকে ভাল টাকা দিতে হয় প্রতি মাসে। আমি নিশ্চিত, আপনাদের সতী হিন্দু নয়।’

সোমনাথ তাঁর পুরো বাড়ি গঙ্গাজলে ধুয়েছেন কি না আমি জানি না।

৩৮

ইদানীং অনেকেই বলছেন, আর খবরের কাগজ পড়া যাচ্ছে না। সকালের কাগজে হাত দিতে গেলে ভয় লাগে, আবার কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা পড়তে হবে। এইসব ঘটনা পড়ার পর নার্ভ ঠিক রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। এই যেমন প্রথম পাতায় ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের ক্রিয়াকলাপ, যা আমাদের যাবতীয় ভাবনাচিন্তাকে অকেজো করে দিচ্ছে, তার বিস্তৃত বিবরণ, একটু নীচে দুর্গাপুরের এক ব্যাঙ্ক ম্যানেজার নির্লিপ্ত মুখে তার প্রেমিকা এবং প্রেমিকার সন্তানকে শুধু খুন করছেই না, তাদের দেহ টুকরো-টুকরো করে ব্যাগে ভরে নদীতে ফেলছে। সাংবাদিকরা এসব লেখার সময় যত বিশদে যান, তত পাঠক হিসাবে আমরা আতঙ্কিত হয়ে উঠি। যেদিন খবরটা হল, সেদিন কাগজে ছেপেই সম্পাদক থেমে গেলেন না। তদন্ত কীভাবে চলছে তা জানাবার নৈতিক দায়িত্ব আছে মনে করে প্রতিদিন একটু-একটু করে সেটা ছেপে চলেছেন। পড়তে গিয়ে শিউরে উঠছি, চোখ সরাতেই চোখে পড়ছে, বিশ্বভারতীতে ছাত্রীর উপর বলাৎকারের প্রতিবাদে আত্মহত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। পাতা খুললেই পড়ছি শিক্ষামন্ত্রী এমন সব কথা বলছেন, যা সৌজন্যবোধের সীমা অতিক্রম করছে। মনখারাপ হয়, দেখ সবাই। ভাবি খেলার পাতায় চলে গেলে মন এসব থেকে বাইরে থাকবে। হায় কপাল, খেলার পাতায় ছবি ছাপা হয়েছে পরাজিত দলের এক খেলোয়াড় রেফারিকে মারতে উদ্যত হয়েছেন। বিরক্ত হয়ে মাঝের পাতা খুলি। পাতা জুড়ে জাপানি তেলের বিজ্ঞাপন। না দেখার ভান করে চোখ সরাতে গিয়ে নাতির গলা শুনে মুখ ফেরান দাদু। চার বছরের নাতি আবদারের গলায় বলে, “দেখি, দেখি, আজও কাগজে দিয়েছে। দেখো না দাদু, বাবাকে কত করে বলেছি জাপানি তেল কিনে আনতে, আনছে না। তুমি নিয়ে এসো না দাদু। ওই তেল মাখলে সাপ কখনওই কামড়ায় না। স্কুলের বন্ধুরা বলছিল।” দাদু কাগজ বন্ধ করলেন।

টিভিতে খবর শোনার অভ্যেস এখন ছাড়তে হচ্ছে। বেশ চলছিল কোনও এক ইস্যু নিয়ে বিস্তর উত্তেজিত কথাবার্তা। পাঁচজন আলোচকের মধ্যে একজন থাকবেন, যিনি সরকার পক্ষের অন্ধ ভক্ত। তাঁর কথাবার্তা হাস্যরসের উদ্রেক করে বলেই বোধহয় তিনি আমন্ত্রিত হন। হঠাৎ সঞ্চালক বিজ্ঞাপন বিরতি ঘোষণা করেন। চট করে রিমোট টিপে চ্যানেল পরিবর্তন করতে চেষ্টা করেন দাদু। কিছু না হোক ন্যাশনাল জিওগ্রাফি। ওই বিজ্ঞাপন বিরতিতে সেই বোনের গলা বেজে উঠতে পারে, “অ্যাই দিদি—!! কোন কর্মের কারণে সপ্তাহে কয়েকবার খাট সারাতে হয়, তা পাশে বসা কিশোর নাতির মুখ দেখে বুঝতে পারা যায় না সে জানে কি না! দাদুকেও উদাস চোখে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।”

এর সঙ্গে সমস্যা বাড়িয়েছে খবরের কাগজ। তারা বর্বরতা, নিষ্ঠুরতার খবর বিস্তৃতভাবে লিখছিল এবং লিখছে যাতে ক্রাইম থ্রিলার পড়ার আনন্দ পাঠকরা পরিপূর্ণভাবে পান। সেই সঙ্গে আধখানা পাতা জুড়ে ‘বান্ধবী চাই’-এর বিজ্ঞাপন ছাপছেন। প্রথম দিকে বিজ্ঞাপনগুলো বেশ নিরামিষ ছিল। ক্রমশ প্রশ্রয় পেয়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের সাহস বাড়ল। ‘একটুও ঠকবেন না’, ‘পুরোপুরি তৃপ্তি পাবেন’—ইত্যাদির সঙ্গে বান্ধবীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে প্রচুর রোজগার করার প্রস্তাব দিচ্ছেন। সেটা কীভাবে সম্ভব, তা বুঝতে পারেন না অনেকেই। আমার পরিচিত এক অধ্যাপককে তাঁর ছেলে বলেছিল, “বাবা, খোঁজ নিয়ে দেখো তো ওরা কী কাজ করার জন্য টাকা দিতে চাইছে আর কত টাকা দেবে!”

আমাদের কারও কিছু করার নেই। যেকোনও ছুতো পেলেই ভোর থেকে রাত এগারোটা অবধি মাইক বাজায় যারা, তাদের অনুরোধ করলেও বন্ধ করবে না জেনে আমরা জানালা বন্ধ করে বসে থাকি। তেমনই আপাত উদাসীন হয়ে বেঁচে থাকার কায়দাটা আমরা ধীরে-ধীরে শিখে ফেলেছি। রাজনৈতিক নেতারা যে অনর্গল মিথ্যে বলছেন, তা বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকছি, জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। আগে যা এক কেজি কিনতাম এখন তার পরিমাণ পাঁচশো গ্রাম নামিয়ে বাড়িতে ফিরে বলছি, এই দিয়েই চালাতে হবে। আবার জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর বিরুদ্ধে কোনও দল রাস্তা অবরোধ করলে মনে-মনে তাদের বাপবাপান্ত করছি।

কয়েক বছর আগে আমাকে বিশেষ প্রয়োজনে নিউ ইয়র্ক শহরে থাকতে হয়েছিল। হোটেলে নয়, পরিচিত এক বাঙালি দম্পতি সাদরে তাঁদের বাড়িতে মাসখানেক থাকতে দিয়েছিলেন। সেই দম্পতি সকাল আটটার মধ্যেই তাড়াহুড়ো করে কাজে বেরিয়ে যেতেন। আমি আমার সময়। ওঁরা বাড়িতে ফিরলেন সন্ধের মুখে। ফিরে চা খেয়ে ডিনার বানাতেন এবং রাত ন’টার মধ্যেই তা খেয়ে শুয়ে পড়তেন। লক্ষ্য করতাম ওঁরা খবরের কাগজ পড়েন না, এমনকী টিভিতেও খবর দেখেন না। টিভি খোলেন শুক্রবার বা শনিবার রাত্রে। তখন কেবলে বাংলা ছবি দেখানো হয়। তার বেশির ভাগই উত্তম-সুচিত্রার ছবি। ক্রমশ বুঝতে পারলাম এঁরা পৃথিবীর কোনও খবর রাখেন না। ভারতবর্ষে বা কলকাতায় কী হচ্ছে, তা জানার তাগিদ বোধ করেন না। অফিসের টিফিনের সময় সহকর্মীরা কী আলোচনা করেন তা আমার জানার কথা নয়। একদিন আবিষ্কার করলাম, অনেক পাতার খবরের কাগজ প্লাস্টিকের ব্যাগে মুড়ে ওঁদের বাগানে ফেলে দিয়ে গিয়েছে হকার। সেই কাগজ ব্যাগমুক্ত কখনওই করা হয় না। তুলে ময়লা ফেলার ড্রামে রেখে দেওয়া হয়। নিউ ইয়র্ক থেকে ওয়াহিও শহরে গিয়ে কিছুদিন থাকার সময় দেখলাম একই ব্যাপার সেখানেও চলছে। শেষ পর্যন্ত গৃহকর্তাকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বললেন, “একদম সময় পাই না। তাছাড়া এত কাগজ দেয় যে পড়ে শেষ করা যায় না। কেউ ফোন করে কোনও খবর জানালে আমরা নেট থেকে প্রিন্ট আউট বের করে পড়ে ফেলি। এককালে সকালে কাগজ না পড়তে পারলে খারাপ লাগত, এখন অভ্যসটাই চলে গিয়েছে।”

ফিরে এসে আমি ওই একমাসের প্রতিটি দিনের কাগজ না পড়ে থাকতে পারিনি। অনেক ঘটনা দুঃখ দিয়েছে, কিন্তু মনে হয়েছে এত অপরাধ এখন রোজ হচ্ছে, কাগজগুলো তা যদি না লেখে তা হলে আয়নায় নিজেদের দেখব কী করে!

৩৯

আমার ছেলে প্রতিটি পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট করেছে। স্কুল-কলেজে যখন পড়ত, তখন সকাল-সন্ধে খুব সিরিয়াস ছিল পড়াশোনায়। যে বয়সে ছেলেরা সিগারেটে টান দিতে শুরু করে, সেই বয়সে সে বলত, সিগারেট খেলে ক্যানসার হয়। জেনেশুনে লোকে কেন যে ধূমপান করে। ওর কোনও আড্ডা মারার বন্ধু ছিল না। দু’একজন সহপাঠীর সঙ্গে ও যোগাযোগ রাখত, যারা পড়াশোনা ছাড়া অন্য বিষয়ে কথা বলতে জানত না। সিনেমা দেখার সময় পেত না, যদি ইচ্ছে হত অ্যানিম্যাল ওয়ার্ল্ড টিভিতে দেখত কিছুক্ষণ। আমরা একটা ব্যাপারে খুব খুশি ছিলাম। মেয়েদের ব্যাপারে আমার ছেলের কোনও আগ্রহ ছিল না। ওর মা অনেক যাচাই করে নিশ্চিত ছিলেন, ওর কোনও বান্ধবী নেই। এমনকী, ও পাস-টাস করে যখন মোটা মাইনের চাকরি পেল তখনও ওর অফিসের কোনও মেয়েকে পাত্তা দেয়নি। এখন সকালে অফিস থেকে গাড়ি আসে, রাত আটটায় ফেরে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বিদেশে ভাল চাকরির অফার পেয়েছিল কিন্তু আমরা একা থাকব বলে যেতে চায়নি। আমাদের উচিত ওকে সংসারী করে দেওয়া। চিরকাল তো আমরা থাকব না। কথাটা প্রচার করতেই এত প্রস্তাব আসছে যে কাকে ফেলে কাকে রাখব, বুঝতে পারছি না।

উপরে যাঁর বক্তব্য রাখলাম, তিনি গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। বক্তব্যটি চিঠিতে আমাকে জানিয়েছিলেন, উনিশশো পঁচাশি সালে, যখন তাঁর পুত্রের বয়স আঠাশ। তাঁর স্ত্রী এখন প্রায় নব্বই-এর কাছাকাছি।

দ্বিতীয় চিঠিটি এক মহিলার, লিখেছেন তাঁর বান্ধবীকে, প্রায় ওই সময়েই। “আমার মেয়ের কথা তোমাকে আর কী বলব! ও যে ডানাকাটা সুন্দরী তা অতি বড় শত্রুও না বলে পারবে না। পড়াশোনায় খুব ভাল, চমৎকার গানের গলা। কথা শুনলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এই তেইশ বছর বয়স পর্যন্ত ও কোনও ছেলের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। যদি কেউ ওর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে তা হলে সময় নষ্ট না করে আমাকে বলে দিয়েছে। আমি ব্যবস্থা নিয়েছি। বেথুন থেকে পাস করার পর ওর বাবা ওকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করেছিল। কিন্তু তিনদিন ক্লাসে যাওয়ার পর ও বেঁকে বসল। এতদিন শুধু মেয়েদের স্কুল-কলেজে পড়েছে, ইউনিভার্সিটিতে যে সব ছেলে পড়তে আসে তাদের কেউ-কেউ ওকে কফি হাউসে নিয়ে যেতে চাইল, কেউ সিনেমা দেখাতে চাইল। ওই তিনদিনে ও এত কাহিল হয়ে পড়ল যে আর ক্লাসে যেতে চাইল না। আমিও ভাবলাম, যতই পড়াশোনা করুক ও তো চাকরি করতে যাবে না। তাই একটি ভাল পরিবারের ভদ্র সন্তানের সঙ্গে সংসার করুক, শান্তিতে থাকুক। এখন আমি সেই পাত্রের সন্ধান করছি। যেমন-তেমন পরিবারের ছেলের সঙ্গে তো ওর বিয়ে দিতে পারি না। তোমার উপর আমার ভরসা আছে, একটু দেখ।”

অর্থাৎ আজ থেকে তিরিশ বছর আগে যেসব ছেলেমেয়ের জন্যে তাঁদের বাবা-মা গর্ব করতেন, সোনার ছেলেমেয়ে বলে প্রতিবেশীরা ঈর্ষা করতেন, তাঁরা আজ এই দুটো বক্তব্য শুনলে অস্বস্তি বোধ করবেন।

বন্ধুবান্ধবহীন, ষোলো ঘন্টা পড়াশোনা অথবা চাকরিতে ডুবে থাকা ছেলে মানেই তার কোনও সমস্যা আছে, সে স্বাভাবিক নয়। একইভাবে কোনও মেয়েই আজ স্বাবলম্বী না হয়ে সংসার করতে চায় না। অন্তত যারা পড়াশোনায় ভাল তারা তো নয়ই। বিয়ে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, এই ভাবনা তারা ছুড়ে ফেলেছে। ক’দিন আগে টিভিতে একটি নতুন ধারাবাহিকে বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছিল। যেখানে একটি অল্পবয়সি মেয়ে কনের সাজে সেজে বলছে, ‘মেয়েদের একটাই জীবন, একটাই বিয়ে।’ নাতনি দ্রুত রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করতেই বাংলা সিরিয়ালের নেশায় ডুবে থাকা ঠাকুমা ক্ষিপ্ত হলেন। নাতনি তাঁকে শান্ত গলায় বলল, ‘এটা দু’হাজার পনেরো খ্রিস্টাব্দ। উনিশ শতক নয়। এই সব ঘটনা হয়তো তোমাদের আমলে স্বাভাবিক ছিল, এখন হাস্যকর বললে কম বলা হবে।’ মেয়েটির কথা সত্যি হলেও মহিলারা ওইসব গপ্পো টিভিতে দেখতে পছন্দ করেন, যেমন ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক ধারাবাহিক তাঁদের আকর্ষণ করে।

সময় বদলে গিয়েছে। দিনের পর দিন মিশেও যখন ছেলেমেয়েরা পরস্পরকে বুঝতে পারছে না, তখন বাবা-মা পছন্দ করে যে পাত্রকে নির্বাচন করছেন তার সঙ্গে জীবনের বোঝাবুঝি কতটা সম্ভব? আর বাবা-মা পছন্দ করবেন কীভাবে? আগে বংশ দেখা হত, আত্মীয়স্বজন এবং পাড়ার লোকের কাছে খবর নেওয়া যেত। প্রয়োজনে পাত্রের অফিসে কোনও না কোনও সূত্র পাওয়া অসম্ভব ছিল না। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গিয়েছে বহুকাল আগে। বংশমর্যাদা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। বেশিরভাগ তথাকথিত ভাল ছেলেরা নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত যে তারা আত্মীয়স্বজনের খবর রাখে না, পাড়ার কারও সঙ্গে মেশে না। অতএব খবর নেওয়ার পথ বন্ধ। অফিসে খবর নিতে গেলে বিয়ে ভেঙে যাবে, কারণ এই গোয়েন্দাগিরির খবর পাত্রের কানে যাবেই। তবু বাবা-মাকে দেখে পাত্র নির্বাচন করেও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে হচ্ছে। কোনও মেয়ের উড়ো ফোনে, যে দাবি করেছে তার সঙ্গে পাত্রের শারীরিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে।

বিয়ে ভেঙে যাওয়া এখন আর অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তিরিশ বছর আগে যা কেউ কল্পনাও করতে পারত না, এখন সেটা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। মনে আছে, কোনও মেয়ে যদি একবার প্রেমে পড়ার পরে যদি কোনও কারণে সেই প্রেম উধাও হয়ে যায় তা হলে দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়তে লজ্জা পেত বদনামের ভয়ে। আমাদের তরুণ বয়সে এটাই নিয়ম ছিল। এখন সম্বন্ধ করে অথবা পছন্দের বিয়ে যদি টালমাটাল হয় তা হলে তা থেকে বেরিয়ে আসতে কেউ দ্বিধা করছে না। যে ছেলে কোনওদিন কোনও মেয়ের দিকে তাকায়নি, যে মেয়ে কোনও ছেলের ছায়া মাড়ায়নি তাদের এখন ‘অস্বাভাবিক’ ভাবা হচ্ছে।

বিবাহবিচ্ছিন্ন হয়ে মেয়ে দিব্যি চাকরি করছে, আবার বিয়ের কথা বললে বলছে, ‘ম্যাগো’। ওর ভবিষ্যৎ ভেবে-ভেবে মাথা খারাপ মা-বাবার। বত্রিশ বছর বয়সে মেয়ে প্রেমে পড়ল এক ডিভোর্সি ছেলের। গোপনে খবর নিলেন বাবা-মা, কেন ছেলের ডিভোর্স হয়েছে? জানতে পেরে শিউরে উঠলেন, ‘ছেলের যৌনক্ষমতা নেই বলেই আগের বিয়ে ভেঙেছে’। মেয়েকে সে কথা বলতেই সে হেসে বলেছে, ‘জানি তো, তাই ওকে ভালবাসলাম। বাকি জীবন একসঙ্গে থাকতে পারব। আমারও তো ওসব একদম ভাল্লাগে না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *