২০
মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা থেকে ফিরেছিলাম অসহ্য দাঁতের যন্ত্রণা নিয়ে। ভাবলাম এখন ফোন না করে কাল সকালে করব। ঢাকার একটি সাহিত্য পত্রিকা তাদের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে ওকে অতিথি হিসাবে চাইছে। আমার কাছে সম্মতির কথা জেনে ওরা সরাসরি যোগাযোগ করবে। কিন্তু পরের ভোরেই মোবাইল বেজে উঠল। সূর্য উঠল, পৃথিবীটা ঠিকঠাক, শুধু সুচিত্রা নেই। প্রস্তাবটা আর কোনওদিন সুচিত্রাকে জানানো সম্ভব হবে না।
সুচিত্রা ভট্টাচার্য। গত পঁচিশ বছরের বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল লেখিকার নাম। ওকে আমি প্রথম দেখেছিলাম আনন্দবাজারের বাড়িতে। মনে আছে, সে সময়ের তরুণ লেখক রাধানাথ মণ্ডল আলাপ করিয়ে দিয়েছিল, “এর নাম সুচিত্রা, পশ্চিমবঙ্গ সরকারে চাকরি করে। দারুণ ছোটগল্প লিখছে। আমাদের গল্পচক্রের সদস্য।” আমি দেখলাম সুচিত্রাকে। চশমা পরা ছোটখাটো সুন্দর চেহারার সম্পদ তার চোখদুটো।
তারপর থেকে মাঝেমাঝেই সুচিত্রার সঙ্গে দেখা হত। একটু একটু করে তার লেখার খ্যাতি ছড়াতে লাগল। সেইসব লেখা বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রায়িত হওয়ায় জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল। গত পঁচিশ-তিরিশ বছরে বাংলা সাহিত্য আর কোনও লেখক-লেখিকাকে পায়নি যিনি সুচিত্রার মতো বিপুল জনপ্রিয় ছিলেন।
স্বাধীনতার পর যে সব লেখিকাদের আমরা পেয়েছি তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে আশাপূর্ণা দেবীর নাম প্রথমেই উচ্চারণ করতে হবে। তাঁর প্রথমদিকের ছোটগল্প এবং উপন্যাসট্রিলজি বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হয়ে আছে। সারাজীবন ধরে তিনি এই সমাজে মেয়েদের অবস্থান, সংসারে তাঁদের উপর যে নির্যাতন চলেছিল বা চলছে, তার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। আর সেই কারণেই বাঙালি পাঠক তাঁকে আঁকড়ে ধরেছিল। গল্পটা কিভাবে বলতে হবে তা তিনি জানতেন। আমি তখন সদ্য যুবক। তাঁর বাড়িতে গিয়ে অবাক হয়ে ভাবছিলাম ইনি কেমন ধরনের লেখক যিনি লেখার কথা না বলে আমাকে নিজের হাতের রান্না খাওয়াতে বেশি পছন্দ করছেন! প্রথম দেখাতেই তাঁকে মাসিমা বলে ডেকেছিলাম। তাঁর প্রতিটি লেখায় স্নিগ্ধ মায়া জড়িয়ে থাকত। ওভাবে লিখতে তো সবাই পারে না।
অনুরূপাদেবী যা লিখেছিলেন। চমৎকার লেখা। কিন্তু তাঁর লেখায় ধারাবাহিকতা ছিল না। মহাশ্বেতা দেবী অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় লেখক। তিনি বিষয় নির্বাচন করতেন মানুষের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। তা সার্কাসের মানুষজন হোক অথবা আদিবাসীদের সংগ্রাম হোক, মহাশ্বেতাদির কলমে জীবন্ত হয়ে উঠত। বাংলা সাহিত্যে ‘হাজার চুরাশির মা’য়ের মতো গল্প এবং ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাস দীর্ঘকাল থেকে যাবে।
প্রতিভা বসুর নাম আজকাল তেমন শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু পাঁচের দশকে অতি উল্লেখযোগ্য লেখক হিসাবে তিনি নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন। ‘রাঙাভাঙা চাঁদ’, ‘হৃদয়ের বাগান’ বা ‘স্মৃতি সতত সুখের’ লেখিকা শ্রদ্ধেয় বুদ্ধদেব বসুর পত্নী হওয়া সত্ত্বেও কখনওই তাঁর নাম ব্যবহার করে, সাহিত্য জগতে পরিচিতি বাড়ানোর চেষ্টা করেননি।
আমরা যখন তরুণ তখন হইচই ফেলে দিয়েছিলেন কবিতা সিংহ। মহিলাসুলভ লেখা লিখতে অত্যন্ত অপছন্দ করতেন তিনি। উল্টে পুরুষ লেখকদের টেক্কা দিতেন তিনি। কেউ লেখিকা বললে সংশোধন করে দিতেন। যিনি লেখেন তিনি লেখক, লেখিকা আবার কী। তাঁর উপন্যাসে কয়েকজন ‘রাগী যুবতী’ থেকেই বিদ্রোহী চরিত্রের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
একথা ঠিক বাংলা সাহিত্যে পুরুষ লেখকদের তুলনায় মহিলাদের সংখ্যা খুব কম। এর কারণ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। মাসিমার মতো সংসার সামলে, রাত জেগে ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’র মতো কালজয়ী উপন্যাস হয়তো অনেকেই লিখতে পারেননি কিন্তু তাঁদের লেখায় বাঙালি পাঠক খুশি হয়েছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
আমার বা সঞ্জীবের পর অনেক লেখক লিখতে এসেছেন। তাঁদের কেউ কেউ অবশ্যই শক্তিমান লেখক। কিন্তু কী রহস্য জানি না, বাঙালি পাঠক তাঁদের সেই জনপ্রিয়তা দেননি যা সুনীলদারা পেয়ে গিয়েছেন। গত তিরিশ বছরে একমাত্র সুচিত্রা এবং কিছুটা তিলোত্তমা মজুমদার ছাড়া আমি এই মুহূর্তে অন্য কোনও মহিলা লেখকের নাম মনে করতে পারছি না।
সুচিত্রাকে কেন বেশিরভাগ পাঠক গ্রহণ করল? কারণ খুব স্পষ্ট। সুচিত্রার বেশিরভাগ উপন্যাসের বিষয় ছিল মানুষের সম্পর্কে এবং তার টানাপোড়েন। সংসারী মানুষের নানা সমস্যা সে তার অনবদ্য ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছিল। মাঝেমাঝে এই নিয়ে আমাদের কথা হত। বলতাম, “সুচিত্রা, এবার বিষয় পাল্টাও, নইলে একঘেয়েমি এসে যাবে।” সে হেসে বলত, “আমি যে অন্য বিষয় ভাল জানি না।”
বিভিন্ন বইমেলায় গিয়ে পাঠিকাদের বলতে শুনেছি তাঁদের প্রিয় লেখকের নাম সুচিত্রা ভট্টাচার্য। তার সামনে আরও অনেক বছর পড়ে ছিল। সেগুলির সদ্ব্যবহারের সুযোগ পেলে বাঙালি পাঠক আরও ভাল রচনা পেতেন।
প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে সুচিত্রা আমাকে ফোন করত, “সমরেশদা, সামনের বছর পুজোয় কোথায় কোথায় লিখছেন?”
এবার বললাম, “দু’হাজার পনেরোতে কোথাও লিখব না। কোনও গল্প-উপন্যাস নয়।” সে অবাক হল, “সে কী! কেন?”
আমার উত্তরটা শুনে বলেছিল, “আপনিই পারেন।”
বয়সে বড় যাঁরা তাঁরা চলে গেলে কষ্ট হয়, খুব খারাপ লাগে। কিন্তু বয়সে যারা ছোট, তাদের এভাবে চলে যাওয়া মানতে ইচ্ছে করে না। পৃথিবীটাকে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
২১
সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্ট আমার বয়স চার কি সাড়ে চার। বাড়ি থেকে সিকি মাইল দূরে সেই চা-বাগান এবং গঞ্জের একমাত্র পাঠশালায় কিছুদিন হল যাওয়া-আসা করছি। হঠাৎ শুনলাম ভারত স্বাধীন হবে। ইংরেজদের এই দেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমরা নাকি এতকাল পরাধীন ছিলাম, পনেরোই আগস্টের পর স্বাধীন হয়ে যাব। সেটা এমন একটা বয়স যে, স্বাধীন বা পরাধীন—কোনও শব্দের অর্থ আমার কাছে অজানা ছিল। চা-বাগানে যেখানে বাবা চাকরি করতেন, তার ম্যানেজার ছিলেন যে সাদা চামড়ার সাহেব তার নাম ছিল হে। বিকেলবেলায় আমরা যখন মাঠে ফুটবল খেলছি তখন গাড়ি থেকে নেমে হে সাহেব আমাদের চকোলেট খেতে দিতেন। খবরটা শোনার পর প্রথমেই মনে হয়েছিল হে সাহেবকে কি চলে যেতে হবে? চলে গেলে আর কেউ আমাদের চকোলেট দেবে না। হে সাহেব কি ইংরেজ? বাবা বলেছিলেন, ‘উনি স্কটল্যান্ডের লোক। কিন্তু স্কটল্যান্ড তো ইংল্যান্ডের মধ্যেই পড়ে। তাই ওঁকেও চলে যেতে হবে।’
এটুকু দুঃখ ছাড়া স্বাধীনতা যে খুব আনন্দের ব্যাপার তা বুঝতে পারলাম, যখন আমাদের দিয়ে নতুন নতুন গান গাওয়ানো হল। পড়াশোনা বন্ধ। গানের দিদিমণি এসে জনগণমন, ধনধান্যপুষ্পভরা গান শেখালেন কদিন ধরে। আর পাঠশালার একমাত্র মাস্টারমশাই ভবানী মাস্টার শেখালেন কীভাবে ‘বন্দেমাতরম’ উচ্চারণ করতে হয়। ‘বন্দেমাতরম’ আর ‘ভারতমাতা কি জয়’ গলার শির ফুলিয়ে চিৎকার করতাম স্কুল ছুটির আগে। আমাদের বলা হয়েছিল পনেরোই আগস্টের ভোরে সূর্য ওঠার আগে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে স্কুলে আসতে হবে। আমাদের দেওয়া হয়েছিল লম্বা কাঠিতে আটকানো ভারতের জাতীয় পতাকা। সেই ভোর আসার আগে যখন রাতের অন্ধকার মুছে যায়নি তখন আমরা যে যার বাড়ি থেকে বেরিয়ে জাতীয় পতাকা মাথার উপর তুলে দৌড়ে গিয়েছি স্কুলের দিকে। আমাদের মুখে বন্দেমাতরম চিৎকার শুনে অসম রোডের দু’পাশের গাছে বসা পাখিরা হইচই করে পাখা মেলল। আহা, কি আনন্দের সেই দৌড় ছিল।
শৈশব এবং বাল্যকালে বন্দেমাতরম ধবনিতে গায়ে কাঁটা ফুটত। কত শহিদের প্রাণের বিনিময়ে শেষপর্যন্ত ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে তার কাহিনি পড়তে-পড়তে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে যেত। তখন কোনও পাঠ্যপুস্তক ছিল না, তবু সেই অগ্নিযুগের কাহিনিগুলি যেখানে পেতাম গোগ্রাসে গিলতাম। ক্ষুদিরাম থেকে বাঘাযতীন, সূর্য সেন থেকে ভগৎ সিং-এর কাহিনি মুখস্থ ছিল। কিন্তু যারা স্বাধীনতার সময় বা পরে জন্মেছে তারা এ ব্যাপারে একটু ধন্দের মধ্যে বাস করত। সূর্য সেন বা বাঘাযতীন যখন প্রাণ দিয়েছেন তখন লক্ষ লক্ষ বাঙালি যে যার বাড়িতে চুপচাপ বসে ছিল কেন? গান্ধীজি যখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, তখন সেই বাঙালিদের গরিষ্ঠ অংশ মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল কেন? এবং একই সঙ্গে আটচল্লিশ সালে কমিউনিস্টরা যখন ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়’ স্লোগান তুলল তখন বিভ্রান্তি বেড়ে গেল। চিনের কাছে আমরা এই একটা ব্যাপারে কৃতজ্ঞ কারণ তারা ভারত আক্রমণ করেছিল। আর আক্রমণ করেছিল বলেই রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে এ দেশে রবীন্দ্রনাথের গানের ঢল নেমেছিল। দেশপ্রেমের পুরনো গানগুলো আবার নতুন করে বেঁচে উঠল। কিশোর এবং তরুণদের সঙ্গে বালকরাও ‘ধনধান্যপুষ্পভরা’ শুনতে পেল, কেউ কেউ গেয়ে উঠল। কিন্তু এই আবেগ বেশিদিন স্থায়ী না হলেও মূলত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং দেবব্রত বিশ্বাসের কল্যাণে সেই যে রবীন্দ্রনাথের গানের জোয়ার শুরু হয়েছিল তাতে এখনও ভাটা পড়েনি। কিন্তু দেশপ্রেমের যে আবেগ চিনের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তৈরি হয়েছিল, তা কয়েক বছর পরে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে দেখা গেল না।
তারপর থেকে ওই আবেগের ধারা শীর্ণ হতে-হতে শীর্ণতর হয়ে এখন নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। এখন দশজন একুশ বছরের যুবকের মধ্যে তিনজন বলতে পারলেও পারে বাঘাযতীনের পুরো নাম কী ছিল, তিনি কী করেছেন। বিবাদি বাগ যাঁদের নামের আদ্যক্ষরে তাঁরা কে ছিলেন, কি হয়েছিল তাঁদের? প্রীতিলতার নাম শোনেননি। একজন কিশোরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সে পরের দিন তার মায়ের কাছে জেনে এসে জবাব দিয়েছিল—প্রীতিলতা আশি বছর আগে সিনেমার নায়িকা ছিলেন। দেশপ্রেম দূরের কথা, নিজেকে ভারতীয় বলার অভ্যেস চলে গিয়েছে এখনকার মানুষের। পরিচয় দেওয়ার সময় তারা নিজেকে বাঙালি বা বিহারি বলতে পছন্দ করে।
মুশকিল হল, আবেগ চলে গিয়েছে এটা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। কিন্তু সেই আবেগকে ব্যঙ্গ করার যে চেষ্টা রয়েছে তা তো ভয়ঙ্কর। কিছুদিন থেকে শুনছি, বাড় খেয়ে ক্ষুদিরাম। এই বাড় খাওয়া শব্দবন্ধ বাংলাভাষায় নতুন প্রবেশ করেছে। কেউ যদি অন্যের হয়ে ভুল করে কোনও কাজ করে ফেলে এবং তার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা হলে সে নাকি বাড় খেয়ে ক্ষুদিরাম। ক্ষুদিরাম নাকি সরল গোবেচারা এক সদ্য তরুণের নাম। তাকে দাদারা বলেছিল, যা সাহেবের উপর বোমা মেরে আয়। তাতে তোর নাম হবে। নাচতে নাচতে ক্ষুদিরাম বোমা নিয়ে গেল, কাকে মারবে জানত না, সাদা চামড়ার মানুষ দেখে বোমা ছুড়ল। ব্যস, ফাঁসি হয়ে গেল ছেলেটার। তাকে বীর বানানোর জন্য পাবলিক ওর মুখে ফাঁসির আগে ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গানটা জুড়ে দিল। মরার আগে আর একবার বাড় খেল ক্ষুদিরাম।
এদের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলেছে। কোনও দেশপ্রেম-ট্রেম নয়, যে যা পারো লুটে নাও, এই হল এখন বেঁচে থাকার ফর্মুলা। যেটুকু ছিল তা নকশাল আন্দোলন শেষ করে দিয়েছিল বাকিটা পরের শাসকরা।
সদ্য বাংলাদেশ থেকে ফেরার সময় ঢাকার বিমানবন্দরে কাস্টমসের একজন মহিলা অফিসার আমায় চিনতে পেরে একটা ঘটনার কথা বললেন। একুশে ফেব্রুয়ারির শহিদ বেদিতে মানুষের ঢল নামে শ্রদ্ধা জানাতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, ভাষা আন্দোলনে যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী নেত্রী। এই বছর পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে যেসব প্রতিনিধি এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন অভিনেতা ছিলেন, যিনি জুতো পায়ে সেই ফুলের বেদির উপর উঠে মোবাইলে সেলফি তুলেছেন। মহিলা অফিসার বললেন, ‘খুব দুঃখ পেয়েছি ওঁর আচরণে। ওঁর মনে কি দেশপ্রেমের প্রতি শ্রদ্ধা নেই?’
২২
একটা সময় ছিল যখন লেখকরা কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিশেল দিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখতেন। সেসব লেখায় কল্পনাই বহু জায়গা নিত, বাস্তব খুব সামান্য। যিনি কল্পনার ব্যাপারে অতিদক্ষ ছিলেন এবং তরকারিতে নুন ব্যবহার করার মতো বাস্তবকে ব্যবহার করে সেই কল্পনাকে সুস্বাদু করতে জানতেন, তাঁকে আমরা বড় লেখকের মর্যাদা দিয়েছি। কিন্তু একটা সময় এল, এই তিরাশি বছর আগে যখন ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’-এর জন্ম হল, শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলো বেরতে লাগল, তখন দেখা গেল যা বাস্তব, তাই সাহিত্যের বিষয় হয়ে যাচ্ছে। কল্পনাকে খুঁজতে হচ্ছে গল্প-উপন্যাসে। বলা হতে লাগল, সাহিত্য হল বাস্তবের দর্পণ। প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখলেন যে উপন্যাস, তার নাম ‘পাঁক’, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর উপন্যাসের নাম ‘বেদে’। এরকম নাম কোনও উপন্যাসের হতে পারে, তা বঙ্কিম এবং তাঁর পরবর্তী ঔপন্যাসিকরা শুনলে কপালে ভাঁজ ফেলতেন। আঁস্তাকুড়, বস্তি, বেশ্যাপাড়ার জীবন উঠে আসতে লাগল গল্প-উপন্যাসে। তখন এর প্রতিবাদে বলা হল, যাঁদের কল্পনাশক্তি খুব ক্ষীণ, নিজে গল্প বানাতে পারেন না, তাঁরাই বাস্তবের ফটো তুলে সাহিত্যে পরিবেশন করে লেখক হতে চাইছেন। পাঠক, এই যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথকে আনার কোনও দরকার ছিল না। তিনি কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের এমন মেলবন্ধন করেছেন যে তাঁকে নিয়ে কোনও তর্ক শুধু নির্বোধরাই করতে পারত। কিন্তু ‘কল্লোল’ এবং ‘কালিকলম’-এর লেখকদের ঔদ্ধত্য, তাঁদের বাস্তবমুখী রচনা, যাঁদের নায়কদের পায়ে ফোসকা পড়ে সাধারণ মানুষের মতো, তাঁদের লেখা পাঠকদের তো আপ্লুত করবেই। প্রেমিকের প্রত্যাখ্যানের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রেমিকা প্রেমিকের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় এবং চুম্বনের পর খিলখিল শব্দে হেসে উঠল যখন শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে, তখন বাঙালি পাঠক বলল, এটা যদি কল্পনা বা বাস্তব নাও হয়, ক্ষতি নেই, এটাই স্বাভাবিক। গোলমাল রবীন্দ্রনাথ নিজেই বাধালেন। সত্তর পেরিয়ে এসে তাঁর মনে হয়েছিল ‘কল্লোল’-এর লেখকদের মতো বাস্তবধর্মী লেখা তিনিও লিখতে পারেন। লিখলেনও। কিন্তু দেখা গেল, তাঁর ‘তিনসঙ্গী’র গল্পগুলো প্রায় রক্তশূন্য। ‘অতিথি’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘জীবিত ও মৃত’ অথবা ‘নিশীথে’-র পাশে তাদের জায়গা কোনও মতেই হতে পারে না।
এ এক অদ্ভুত ব্যাপার! তরুণ বয়সে যা পড়ে শুধু মুগ্ধই হইনি, যাকে বলে গেলা, তাই করেছি, লাইনের পর লাইন মুখস্থ হয়ে গিয়েছে অনায়াসে, সেই বইগুলো এখন পড়লে দু’রকমের প্রতিক্রিয়া হয়। এক, লেখকের মুনশিয়ানা, শব্দচয়ন এবং বাক্যগঠন অবশ্যই শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। কিন্তু সেই মুগ্ধবোধ চলে গিয়ে যখন কাহিনি পড়ে অবিশ্বাসের বাতাবরণে ঢুকে পড়ি তখন লেখাগুলোকে একেবারে সাজানো, বানানো বলে মনে হয়। প্রথমেই বলি যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’-এর কথা। এই বইটি প্রকাশের পর বহুবছর ধরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল। কিশোর-কিশোরী থেকে প্রৌঢ় বয়সের বহু পাঠক ‘দৃষ্টিপাত’-এর লাইনগুলো স্বচ্ছন্দে আওড়াতেন। প্রেমিক-প্রেমিকারা তাদের চিঠিতে ওই লাইনগুলো ব্যবহার করতেন যাতে তাঁদের বক্তব্য রোম্যান্টিক হয়ে ওঠে। এই উন্মাদনা দীর্ঘকাল বাঙালি পাঠকের মধ্যে জীবিত ছিল। এখন ‘দৃষ্টিপাত’ পড়লে বিস্মিত হতে হয়। কাহিনি অত্যন্ত দুর্বল, শুধু শব্দ সাজিয়ে মন ভোলানোর কায়দা রপ্ত থাকায় বইটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল একসময়। এখনকার কোনও কুড়ি বছরের পাঠককে বইটি পড়তে বলেছিলাম। সে পড়ার পর হেসে বলেছিল, “তখনকার মানুষ কীরকম বোকাবোকা ছিল, তাই না। এত সাজানো কথা যারা বলত, তাদের কেউ যে বিশ্বাস করবে না, এটাও জানত না।”
অর্থাৎ সেই কল্পনা আর বাস্তবের পরিমাণ সাহিত্যে কতটা হবে সেই প্রশ্নই উঠে আসছে। ‘শেষের কবিতা’য় রবীন্দ্রনাথ সব উজাড় করে দিয়েছেন। অমিত-লাবণ্য-শোভনলাল যেসব কথা বলেছে, তা শেষ পর্যন্ত সুতোকাটা ঘুড়ির মতো আকাশ থেকে ঢলে-ঢলে পড়েছে। পরিণতিতে মনে হয়েছে ওরা সবাই কাচের পুতুল। মাথা খুঁড়লেও রক্তমাংস পাওয়া যাবে না। আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ কাল্পনিক উপন্যাস লেখার যে পরীক্ষা করেছিলেন, তা অবশ্যই ‘চতুরঙ্গ’-এর ধারে-কাছে পৌঁছাতে পারেনি। কিন্তু তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
ধন্দ লাগছে এই খানেই। মঙ্গল গ্রহে মানুষ বসবাস করছে, কল্পনা করে যদি কেউ উপন্যাস লেখে, তা হলে সেই উপন্যাসকে ‘সায়েন্স ফিকশন’ তকমা দেওয়া হবে। বিজ্ঞানের সাইনবোর্ড বানিয়ে যা ইচ্ছে কল্পনায় সাতখুন মাপ। কিন্তু এখনও মঙ্গল গ্রহে বাস করা বাস্তব নয়। কিন্তু কে বলতে পারে পঞ্চাশ বছর পরে সেটা বাস্তব হবে না! তখন হোঁচট খেতে হবে। গত পঞ্চাশ বছর ধরে, সেই ‘লাইকা’ মহাকাশে ওড়ার পর থেকে দ্রুত আবিষ্কারের কারণে যে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে, তাকে তিনের দশকের মানুষ অবাস্তব বলেই ভাবত। মোবাইল ফোনে কোনও চরিত্র কথা বলছে, শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে পড়লে কী প্রতিক্রিয়া পাঠকের হত, তা অনুমান করতে পারছি না।
ছাত্রাবস্থায় একটি নাটক পড়েছিলাম। একজন বৃদ্ধ বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলেন, তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ ছড়ানো ছিল সেই নাটকে। তখন মেয়েদের বিয়ে হত এগারো থেকে চোদ্দোর মধ্যে। বৃদ্ধের বয়স ছিল পঞ্চাশের বেশি। পঞ্চাশেই বার্ধক্য এসে যেত সে সময়। অতএব বৃদ্ধের বিবাহবাসনা নিয়ে বিদ্রুপ করা চলতেই পারে। এখন সেটা বাস্তব ঘটনা। একাধিক বিবাহ স্বাভাবিক ব্যাপার।
আইনের কারণে একাধিক বিবাহ এখন অস্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু গতকাল কাগজে একটি খবর পড়ার পর আর দোটানায় পড়লাম না। একটি বৃদ্ধাশ্রমে একমাত্র পুরুষ সদস্য বৃদ্ধাদের সঙ্গে বাস করতেন। ভদ্রলোকের বয়স পঁচাত্তর এবং অসুখ-বিসুখে ভুগে-ভুগে ক্লান্ত। তাঁকে সেবাযত্ন করেন যে বৃদ্ধা তিনিও ওই বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকা। তাঁরও বয়স সত্তরের ওপর। বিয়ের পিঁড়িতে কখনও বসেননি। ওঁরা প্রেমে পড়লেন। আশ্রমিকরা সেই প্রেমকে স্বীকৃতি দিলেন। পঁচাত্তরের বৃদ্ধ বৃদ্ধা-স্ত্রীকে নিয়ে হানিমুনে চলে গিয়েছেন। আচ্ছা, এই ঘটনাকে ষাট বছর আগে আমাদের বাঙালি সমাজ হজম করতে পারত? কেউ লিখলে বলত, ‘লেখকের পেট গরম হয়েছে।’ কিন্তু কল্পনা এবং বাস্তবের চমৎকার মিশেলের দৃষ্টান্ত ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ লিখেছিলেন মধুসূদন দত্ত, সেটা যে বহু পরেও বাস্তব, তা উৎপল দত্ত প্রমাণ করে গিয়েছেন।
২৩
বাংলাদেশের নাগরিকদের কলকাতায় বিভিন্ন প্রয়োজনে আসতে হয়। চিকিৎসার প্রয়োজনে আসাটা খুব জরুরি। যাঁরা নিম্লবিত্ত শ্রেণিতে রয়েছেন, তাঁদের পক্ষে মাথাপিছু তিন হাজার টাকা যাতায়াতের বাসভাড়া মিটিয়ে কলকাতায় থেকে চিকিৎসা করানোর খরচ সামলানো সম্ভব হয় না। ওদেশে মধ্যবিত্ত হলেন তাঁরাই, যাঁদের মাসিক আয় ষাট হাজার থেকে দুই লাখের মধ্যে। এই মুহূর্তে ঢাকা শহরে একটি লিচুর দাম তিন টাকা, এক কেজি হিমসাগরের জন্য একশো কুড়ি টাকা দিতে হয়। দেড় কেজি ওজনের ইলিশ কিনতে গেলে কেজি পিছু বাইশশো টাকা অবলীলায় বেরিয়ে যায়। বোঝাই যাচ্ছে, যার মাসে ষাট-সত্তর হাজার রোজগার, তাকেও খুব সতর্ক হয়ে এক বা দু’বার ওসবের স্বাদ নেওয়ার সাধ অঙ্ক করে লালন করতে হয়। আর যাঁরা উচ্চবিত্ত তাঁদের এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা ওঠেই না।
কলকাতায় চিকিৎসা করাতে আসেন মধ্যবিত্তরা। উচ্চবিত্তরা কলকাতার চিকিৎসায় ভরসা না করে উড়ে যান সিঙ্গাপুরে। অসুখ সামান্য হলেও সেখানে গেলে স্বস্তি পান। পশ্চিমবাংলার মানুষ অসুস্থ হলে চট করে বাইরে ছুটে যান না। অভাবী মানুষেরা বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষেরই মতো স্থানীয় হাসপাতালের উপর ভরসা করেন। তাছাড়া তাঁদের সামনে অন্য কোনও পথ নেই। পশ্চিমবাংলায় মধ্যবিত্তদের বড় অংশ সরকারি হাসপাতালের উপর ভরসা না করে নার্সিংহোম বা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ধনী মানুষেরা চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গেলেও পশ্চিমবাংলার ধনীরা চট করে বিদেশে তো যানই না, মুম্বই দিল্লিতেও বাধ্য না হলে যান না। তার মানে এই নয়, পশ্চিমবাংলার ধনী মানুষ স্থানীয় চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কেন্দ্রের উপর প্রবল আস্থা রাখেন। এটা নেহাৎই অভ্যেসের ব্যাপার।
আমার প্রিয় লেখক ভ্রাতৃপ্রতিম হুমায়ূন আহমেদ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ভারত বা সিঙ্গাপুরে না গিয়ে ঢাকা থেকে নিউ ইয়র্কে উড়ে গিয়েছিল। সিদ্ধান্ত নিতে সে দেরি করেনি। শুধু বিপুল খরচ সামলানোর ক্ষমতা ছিল বলেই নয়, আর একটি ব্যাপার পরোক্ষে মানসিক শক্তি জোগাতে সাহায্য করত। এখন পৃথিবীর প্রায় সব দেশে বাংলাদেশের মানুষ ছড়িয়ে আছেন। তাঁদের অবস্থান বিভিন্ন স্তরে হলেও বাংলাভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীতের যোগসূত্র ছিন্ন হয়নি। হুমায়ূনের পাশে এঁরা দাঁড়িয়েছিলেন বলে তার কখনওই মনে হয়নি সে বিদেশে চিকিৎসার জন্য গিয়েছে। এদেশীয় ধনী মানুষেরা যতই ধনী হোন না কেন, এই সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হবেন।
আবার বিস্ময় লাগত, যখন দেখতাম প্লেনে, বাসে বা ট্রেনে এসে বাংলাদেশের মানুষ কলকাতার একটি বিশেষ অঞ্চলের হোটেলে থাকা পছন্দ করেন, ওই অঞ্চলকে আগে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পাড়া বলা হত। তাঁদের অধিকাংশ অস্ট্রেলিয়া অথবা কানাডায় চলে যাওয়ার পর অবাঙালি মুসলমানরা ওই এলাকায় বসবাস করতে থাকেন। পার্ক স্ট্রিট থেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত হেঁটে গেলে সে সময় বাংলা শব্দ কদাচিৎ শোনা যেত। বাংলাদেশের মানুষ কেন যে ওই এলাকা পছন্দ করলেন, তা আমার জানা নেই। মার্কুইস স্ট্রিট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের চেহারা ধীরে-ধীরে বদলাতে লাগল। আমি অনেকবার বাংলাদেশের বন্ধুদের শ্যামবাজার বা গড়িয়াহাটে থাকার কথা বলেছি। বাংলা ভাষা, বাংলা খাবারের সঙ্গে থাকতে তাঁদের ভাল লাগার কথা। কিন্তু তাঁদের ওই প্রস্তাব পছন্দ হয়নি। তাঁরা নিউ মার্কেটের কাছাকাছি থাকাতে পছন্দ করেছেন। অসুস্থদের যাঁরা নিয়ে এসেছেন চিকিৎসার জন্য, তাঁরা বেলভিউ, নাইটিঙ্গেলে প্রথম-প্রথম যাওয়া-আসা করতেন কাছাকাছি হওয়ায়। এখন বাইপাসের পাশের হাসপাতালগুলোয় ভরসা বেড়ে যাওয়ায় অসুস্থদের চিকিৎসার জন্য যাঁরা নিয়ে আসেন, তাঁরা ওইসব হাসপাতালের আশেপাশে দৈনিক ভাড়ার ঘর নিয়ে থাকাই সুবিধেজনক মনে করেন। এঁদের অধিকাংশই শহরের ভিতর বেশি আসা-যাওয়া করেন না।
কিন্তু নিয়মিত টুরিস্ট হয়ে আসা বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে মার্কুইস স্ট্রিট এলাকার চেহারা বদলে গেল। ওখানকার দোকানের সাইনবোর্ড ইংরেজি থেকে হিন্দিতে লেখা হয়েছিল একসময়, এখন বাংলা অক্ষর জ্বলজ্বল করছে। রাস্তায় পা রাখলেই বাংলা শব্দ কানে আসছে। বাংলাদেশি খাবারের রেস্তোরাঁর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। এইসব রেস্তোরাঁর খাবারের রেসিপি ষাট সাল বা তার আগে যাঁরা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, তাঁরা জানতেন। সেই স্বাদ হারিয়ে গিয়েছিল। এখন এদেশীয় বাঙালিদের অনেকেই আলুভর্তা, বেগুনভর্তা, সীমভর্তা, চিংড়িভর্তার স্বাদ নিতে পৌঁছে যাচ্ছেন মার্কুইস স্ট্রিটে। কলকাতার হিন্দু হোটেলের বাঙালি রান্নার সঙ্গে ওই রান্নার ফারাক অনেক। বাংলাদেশের মানুষ তাই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এখন তো মাঝে-মাঝে ওই এলাকাকে মিনি বাংলাদেশের মতো মনে হয়।
নিউ ইয়র্কের একটি এলাকার নাম জ্যাকসন হাইট। জায়গাটা আগে অনেক হাত ঘুরে হিসপ্যানিসদের দখলে ছিল। এখন তারা উধাও। জ্যাকসন হাইট যেন ঢাকার বেইলি রোডের চেহারা নিয়ে নিয়েছে। বেশিরভাগ দোকানের সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা। ফুটপাতে দাঁড়ালে বাংলায় কথা বলতে শুনবেন যে কোনও পথচারীকে। দেখে মনেই হবে না আমেরিকায় আছেন। ক্রমশ কলকাতার এই এলাকাকে ওই চেহারা যদি বাংলাদেশে মানুষ দিয়ে দেন, অবাক হব না।
কিন্তু ভিসা জোগাড় করে কলকাতায় আসা মোটেই সহজ নয় বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে। অকারণ জটিলতা বাড়িয়েছে ভারতীয় দূতাবাস, এই অভিযোগ তাঁরা করেছেন। শুনছি জটিলতা কমবে, তা হলে আরও মানুষ আসবেন। কারা আসবেন? গরিব মানুষ অবশ্যই নন। তাঁরা যখন কাজের খোঁজে দেশান্তরী হন, তখন বৈধ কাগজ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়া গিয়ে শোষিত হন। অথবা মায়নমারের সমুদ্রে ভাসমান নৌকোয় জল-খাবার ফুরিয়ে যাওয়া চাকরিপ্রার্থীদের পড়ে থাকতে দেখা যায়। এঁরা ভারতবর্ষে আসুন, তা দুই দেশের সরকারের ইচ্ছে নয়। বাংলাদেশ সরকার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু অভাবের হাত যে খুব শক্তিশালী হয়।
কিন্তু রোজ বিকেলে মার্কুইস স্ট্রিটের হোটেল থেকে যখন ‘ও আমার সোনার বাংলা’ ভেসে আসে আবেগ-জড়ানো গলায়, তখন অভাবের কথা মনে থাকে না।
২৪
রবিনসন স্ট্রিটের পার্থ দে-র কাজকর্ম নিয়ে শহরে বেশ আলোচনা হচ্ছে। একটি মানুষ মারা গিয়েছিলেন। কীভাবে মারা গিয়েছিলেন? না, তাঁর প্রিয় কুকুরের মৃত্যুশোক তিনি সহ্য করতে পারেননি, তাই অনশনে প্রাণত্যাগ করেছেন। ব্যাপারটা বিশ্বাস্য কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন করব না। আমরা এও জানতে চাইব না, কেন দিদি অথবা মেয়েকে তিলতিল করে মারা যেতে দেখলেন তাঁর ভাই বা বাবা! মৃত্যুর পরে ভাই বললেন, ‘দিদি মারা গিয়েছে, দিদি দীর্ঘজীবী হোক।’ বলে সোফায় চাদরে মুড়ে শুইয়ে রাখলেন। দরজা-জানালার ফাঁক দিয়ে দিদির শরীরের থেকে বের হওয়া পচা গন্ধ যাতে প্রতিবেশীরা টের না পায়, তার ব্যবস্থা করলেন। তার চেয়ে বড় কথাটা হল, ভাই বাবাকে দু’দিন ধরে কাউন্সেলিং করে বোঝাতে সক্ষম হলেন দিদি মারা গেলেও তাঁদের ছেড়ে যায়নি। শেষ পর্যন্ত ছেলের কথা মেনে নিয়ে প্রায় ছ’মাস মৃত মেয়েকে কঙ্কাল হয়ে যেতে দেখলেন বাবা। দেখলেন ছেলে তার দিদিকে রোজ খাবার দিচ্ছে, কথা বলছে আপন মনে। বাবা তখন কী করলেন, তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। শেষ পর্যন্ত মেয়ের মৃত্যুর ছ’মাস পরে বাবা আগুনে পুড়ে মারা গেলেন। মৃত্যুর আগে ডায়েরিতে লিখে গেলেন ভাল-ভাল কথা। ছেলেকে সার্টিফিকেটও দিয়ে গেলেন।
মোটামুটি এই হল গপ্পো। এই নিয়ে তোলপাড় শহর, খবরের কাগজের পাতা। আমি শীর্ষেন্দুদার সঙ্গে একমত, এই গপ্পো নতুন লেখক লিখলে, কোনও সম্পাদক পত্রিকায় ছাপতেন না। এত গোঁজামিল যে, বিশ্বাসের ধারকাছ দিয়ে যায় না। আমরা সব সময় লজিক খুঁজি। যার বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব এখানে নেই।
সুধাময়বাবু এলেন সকাল গড়াতেই। ভদ্রলোকের সঙ্গে কিছুদিন আগে পরিচয় হয়েছে। এ পাড়ায় মাস আটেক আগে ফ্ল্যাট কিনে এসেছেন। আলাপ করতে এসে বলেছিলেন, ‘আপনার প্রায় সব লেখাই পড়েছি। মুশকিল।’
অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। সুধাময়বাবু বললেন, ‘পৃথিবীর অন্য ভাষার লেখকরা কেউই দশ-বারোটার বেশি উপন্যাস লেখেননি। সিরিয়াস লেখকদের কথা বলছি। রবীন্দ্রনাথ বা বিভূতিভূষণের উপন্যাস সংখ্যা বেশ কম। অন্তত আপনাদের তুলনায়। কেন যে এত বেশি লেখেন।’
কথাটা সত্যি। আর এই সত্যি কথাটা বলার জন্য ভদ্রলোককে পছন্দ হয়ে গেল। তারপর থেকে মাঝে-মাঝে আসতেন। ক্রমশ বুঝতে পারলাম, কোনও কিছুকেই সরল মনে গ্রহণ করতে উনি অভ্যস্ত নন।
আজ এলেন, চেয়ারে বসে বললেন, ‘আপনার লেখা পড়ে যতটুকু বুঝেছি তাতে বলতে পারি, রবিনসন স্ট্রিটের ঘটনাটা বিশ্বাসযোগ্য মনে করছেন না?’
‘প্রায় তাই।’ বললাম।
‘কী মনে হচ্ছে। একজন মহিলার এবং দু’টি কুকুরের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে। ওই বাড়ির বাবা এবং ছেলে পাড়ার লোকের সঙ্গে না মিশে কঙ্কালদের সঙ্গে বাস করত। কেন?’ সুধাময়বাবু হাসলেন, ‘কাগজগুলো লিখেছে পার্থ দে সাইকিক ছিল’, নিজে একটা জগৎ বানিয়ে সেখানে বাস করত। তাই বোধহয় দিদির শরীর পচতে আরম্ভ করলে, সে দুর্গন্ধ পায়নি। কিন্তু কোনও কাগজ বলেনি, আত্মহত্যা করার আগে পর্যন্ত ওদের বাবা সেখানে থাকা সত্ত্বেও কী করে দুর্গন্ধ সহ্য করে ছিলেন? তা হলে বাবাও ছেলের গোত্রের। তা হলে আত্মহত্যা করলেন কেন?’
‘আপনার কী মনে হচ্ছে?’
‘মনে হচ্ছে, দিদিকে ভাই খুন করেছিল। বাড়ি থেকে বডি পাচার করতে পারেনি। কুকুর দুটো বাধা দিয়েছিল বলে তাদেরও খুন করেছে। বাবা ছেলেকে খুব ভালবাসত বলে ওই খুন এবং লাশ বাড়িতে রাখা মেনে নিতে -নতে শেষ পর্যন্ত না পেরে আত্মহত্যা করেছেন।’ সুধাময়বাবু বললেন।
‘কিন্তু খুনের উদ্দেশ্য কি?’ জিজ্ঞাসা করলাম।
‘মুশকিল। দিদির বদলে বউ হলে অনেক কিছু কল্পনা করতে পারতাম, কিন্তু দিদি বলেই খুনের উদ্দেশ্য বুঝতে পারছি না। না পারলে পার্থ দে যে খুনই করেছিল, তা বলা যাচ্ছে না। ফলে দ্বিতীয় চিন্তা মাথায় আসছে।’ সুধাময়বাবু চোখ বন্ধ করে একটু ভাবলেন। তারপর মুখ খুললেন, ‘পার্থ তার দিদিকে নিশ্চয়ই ভালবাসত। দিদির শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করার সময় স্বেচ্ছামৃত্যুতে সে বাধা দেয়নি। মৃত্যুর পরে সে দিদিকে তার কাছেই রেখে দিয়েছে, রোজ খাবার রেখেছে কঙ্কাল হয়ে যাওয়ার পরেও। এই ভয়ঙ্কর ভালবাসাকে আমরা পাগলামি বলে থাকি। অ্যাবনর্মাল। আচ্ছা, ধরুন, উল্টোটা যদি হত। আমাদের প্রিয়জন মারা গেলে তাঁর দেহ যদি মেডিক্যাল কলেজে সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকত, তা হলে সেই সুযোগ আমরা কি নিতাম না? প্রতি সপ্তাহে মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে সেই প্রিয়জনের অবিকৃত দেহ দেখে কি আসতাম না? এই যে দেহ দানের জন্য প্রচার হচ্ছে সেটাও তো এতকাল চলে আসা সৎকারপ্রথার পরিপন্থী। কিন্তু অনেকেই তো দেহদান করে যাচ্ছেন। আমি জানি না দিদিকে ঠিক সময়ে সৎকার না করা, মৃত্যুর কথা পুলিশকে না জানানোর কারণে পার্থকে গ্রেফতার করা হবে কি না। তাকে মানসিক চিকিৎসালয়ে পাঠানো হয়েছে। আচ্ছা, সমরেশবাবু, পার্থ যদি বিশ্বাস করে থাকে মৃত্যুর পরেও তার দিদির অস্তিত্ব লোপ পায়নি, আপনি কী বলবেন?’
‘স্মৃতিতে থাকাই স্বাভাবিক। বাস্তবে কখনওই নয়।’ বললাম।
‘কিন্তু পার্থ কি দিদির আত্মাকে অনুভব করে থাকে?’
‘আত্মা?’ হেসে ফেললাম, ‘আপনি এবার ভূতপ্রেতে চলে যাবেন নাকি?’
সুধাময়বাবু চোখ ছোট করলেন, ‘শ্রাদ্ধের সময় মৃতের আত্মাকে হিন্দুরা পিণ্ডি দেয় কেন? বিশ্বাস করে বলেই দেয়। দেহ দাহ করে এসে মৃতের আত্মাকে, যা চোখে দেখা যায় না, প্রমাণ পাওয়া অসম্ভব, তাকে পিণ্ডি খাওয়ানো যদি ভূতূড়ে কাণ্ড না হয়, তা হলে নিজের দিদির কঙ্কালের মধ্যে তার আত্মাকে আটকাতে পার্থ চাইতে পারে।’ উঠে দাঁড়ালেন সুধাময়বাবু, ‘আর কে না জানে, চাইলেই তো সব পাওয়া যায় না।’
২৫
গত কিস্তির ‘গীতবিতান ছুঁয়ে বলছি’ পড়ে অনেক পাঠক ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সেই ক্ষোভের কথা তাঁরা চিঠি বা ফোনে আমাকে জানিয়েছেন। রবিনসন স্ট্রিটের পার্থ দে একটি বিকৃত মস্তিষ্ক মানুষ। সে মনে করে শরীরের মৃত্যু হলেই আত্মার মৃত্যু হয় না। এই মনে করাটা কতটা আন্তরিক, কতটা অভিনয় তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু সে আত্মায় বিশ্বাস করে, একথা বারংবার বলেছে। যেহেতু হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষও আত্মা বিশ্বাস করেন, কিন্তু পার্থ দে’র বিশ্বাসপদ্ধতির চেয়ে তাঁদের ভাবনা-চিন্তা আলাদা হওয়া সত্ত্বেও কোথাও-কোথাও যুক্তির অভাব দেখা যায় তাই, লেখায় দুটি বিষয়ে এসে গিয়েছিল। যাঁরা যোগাযোগ করেছেন তাঁদের আপত্তি এই কারণেই। পার্থ দে’র মতো সাইকিক রোগীর কথা বলতে গিয়ে হিন্দুধর্মের বিশ্বাসের কথা বলা অত্যন্ত গর্হিত কাজ হয়েছে।
সবিনয়ে বলি, কারও ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করার মানসিকতা আমার নেই। কেউ যদি আমার লেখার কারণে আহত হন তাহলে আমাকে ভাবতে হবে আমি যে কোনও দুটোর একটা করেছি। এক, আমি ভুল করেছি। দুই, আমি ভুল করিনি। এই ব্যাপারে আমার এত বছরের ভাবনা অকপটে বলি।
শৈশবে, নাম হওয়ার পরে আমি কারও মুখে শুনিনি যে, আমার ধর্মের নাম হিন্দু ধর্ম। বাড়িতে বিভিন্ন দেবদেবীর পুজো হতে দেখেছি। লক্ষ করেছি দেবতাদের চেয়ে দেবীদের সংখ্যাই বেশি ছিল। পুরোহিত মশাই পুজো করতে আসতেন। তিনি মন্ত্র পড়তেন সংস্কৃত ভাষায় যা আমার বাবা-কাকা কারও বোধগম্য হত না। পরে জেনেছিলাম ওই ভাষা তাঁরা জানতেন না। কৈশোরে পা দিয়ে আমার বড়পিসিমাকে বলেছিলাম পুরোহিতমশাই সংস্কৃতে মন্ত্র পড়ার সময় তোমাকে কিপ্টে বলে গালাগাল দিয়েছে। আমাদের স্কুলে সংস্কৃত পড়ানো হত বলে বড়পিসিমা বিশ্বাস করেছিলেন এবং পুরোহিত বদল হয়েছিল।
এইভাবে আমি হিন্দু হয়েছি। বুঝেছি হিন্দু হওয়া মানে কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করা। আমার এক মুসলমান বন্ধুকে দেখতাম রোজ পাঁচবার নমাজ পড়ে, রোজার সময় একমাস দিনের বেলায় উপোস করে থাকে, শুক্রবার দুপুরে মসজিদে যায়। অর্থাৎ বুঝুক না বুঝুক একটি ধর্মীয় শৃঙ্খলার মধ্যে সে বড় হয়ে উঠছিল, যে ধর্মীয় শৃঙ্খলা যে কোনও মুসলমানধর্মী পালন করত। কিন্তু আমি হিন্দু অথচ আমার কোনও ধর্মীয় শৃঙ্খলা নেই। মনে হত, হিন্দুধর্ম অতি উদার, কোনও বাধ্যবাধকতায় আটকে রাখে না, আর হিন্দু হলে কোনও ধর্মাচরণ করতে হয় না। এ ভারি মজার ব্যাপার!
আমার এক হিন্দু সহপাঠী যে ব্রাহ্মণ এবং ন্যাড়া হয়ে পৈতে নেওয়ার অধিকার তার আছে এবং সেটা আমার নেই জানতে পেরে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম। কারণ, সে পৈতে উপলক্ষে অনেক-অনেক উপহার পেয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল এমনি হিন্দু হওয়ার চেয়ে হিন্দু ব্রাহ্মণ হওয়া ঢের ভাল ছিল। তার কিছুকাল পরে জানলাম, যেসব হিন্দু কালীভক্ত তাঁদের শাক্ত বলা হয় এবং তাঁরা নারায়ণ অথবা বিষ্ণুর ভক্তদের সহ্য করতে পারেন না। সেই বৈষ্ণবরাও শাক্তদের এড়িয়ে চলেন।
ধীরে-ধীরে সময় যখন সব কিছু গ্রাস করে নিচ্ছে, যখন হিন্দুধর্মকেই খুঁজে বের করতে হচ্ছে, তখন এই বিভাজনের অস্তিত্ব আর থাকল না। এবং কৈশোর পেরিয়ে এসে মাস্টারমশাইদের মুখে জানতে পারলাম, হিন্দু কোনও ধর্মের নাম নয়। হিন্দু একটি সংস্কৃতির নাম। কিন্তু সেই সংস্কৃতি ঠিক কী তা এতকালেও আমি বুঝে উঠলাম না। পশ্চিমবাংলার হিন্দুর সংস্কৃতি যদি কিছু থেকে থাকে তার সঙ্গে মহারাষ্ট্রের হিন্দুর সংস্কৃতির মিল কোথায়? আর্যরা এসেছিল এদেশে, এসে থেমেছিল কাশীতে। তাদের বৈদিক ধর্মের ছিটেফোঁটা ছড়িয়ে দিয়েছিল চারপাশে। হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা তার কিঞ্চিৎ কুড়িয়ে এনে নিজেদের হিন্দু বলে জাহির করেছিলেন এই ভূখণ্ডে। ব্যাপারটা এতটাই অসম্পূর্ণ ছিল যে আমরা না ঘাটকা, না ঘরকা হয়ে থাকলাম। এখন সরকারি কোনও ফর্ম ভর্তি করার সময় রিলিজিয়নের পাশে হিন্দু শব্দটি লিখতে হয়। একটি একুশ বছরের ছেলে এটা লেখার সময় আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আচ্ছা, আমার রিলিজিয়ন কী?’
মৃত শরীর পচনশীল। তাই পচন শুরু হয়ে যাওয়ার আগেই সেই শরীরকে বিনষ্ট করার সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হল আগুনে সৎকার অথবা মাটির নিচে কবর দেওয়া। হিন্দুরা আগে কাঠের চিতায় দাহ করতেন। ইলেকট্রিক চুল্লির অস্তিত্ব শাস্ত্রে না থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে সুবিধেজনক বলে তাতেই দাহ করছেন। দাহ করার আগে মৃতের মুখে আগুন ছোঁয়ানোর রীতি আছে। অর্থাৎ শরীর থেকে প্রাণ বের হয়ে গেলেই তাকে জড় পদার্থ ভাবতে হিন্দুরা চাননি। দাহ হয়ে গেলেও মৃতের অস্থি গঙ্গা বা নদীতে বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করেন না তাঁর আত্মীয়স্বজন।
বরং এখান থেকেই শুরু হয়ে থাকে সেই সব কাজকর্ম যার সঙ্গে রবিনসন স্ট্রিটের পার্থ দে-র মানসিকতার কিছু মিল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। দাহ করে এসে লোহা স্পর্শ করার পিছনে কারণ কী? কেন মৃতের ঘরে প্রদীপ জ্বেলে রাখা হয়? এগুলো যদি অন্ধসংস্কার হয়ে থাকে তাহলে আমরা বাস্তববোধ বিসর্জন দিয়ে তাকেই অনুসরণ করি কেন? শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে যে পোশাকের পরিবর্তন পুরুষরা করে থাকেন তা মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না কেন? মহিলাদের শোক কি ধর্তব্য নয়?
আগে মাসব্যাপী শোক পালন করা হত। এখন এগারো দিন। এই এগারোদিন পরে যে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয় তাতে স্পষ্টই ঘোষণা করা হয়, মৃতের আত্মা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে প্রেত বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। পার্থ দে যেমন তার মৃত দিদির আত্মাকে খাওয়ানোর জন্য খাবার রাখত, শ্রাদ্ধে প্রায় সেইভাবে আত্মার উদ্দেশে পিণ্ড দান করা হয়ে থাকে। বলা হয় ওই পিণ্ড খেয়ে প্রেত যেন স্বর্গে চলে যায়। ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হয় না। সারাবছর ধরে একাদশী-অমাবস্যা পালনের নামে মুখের স্বাদ বদলানো হয়। নিয়ম শুরু হওয়ার আগেই তা ভাঙার অজুহাতে শোকার্ত মানুষ বিয়েবাড়ির খাবার খায়। অথচ প্রশ্ন করলে শুনব ভূত-প্রেত-আত্মার অস্তিত্ব নেই, বিশ্বাস করা মূর্খতা। পার্থ দে যা করেছে তার সমলোচনা করছি আমরা, কিন্তু নিজেরাই বা কী করে চলেছি?
তার চেয়ে যাঁরা মৃত্যুর পর ঢাকঢোল না বাজিয়ে ইলেকট্রিক চুল্লিতে যেতে চান, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের বদলে কেউ যদি শ্রদ্ধানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন, তাতে আপত্তি জানিয়ে যান না, সেটাই তো ভাল। স্বেচ্ছায় অন্ধ হয়ে থাকেন যাঁরা তাঁরা এই ভালটা বুঝতে চাইবেন না।
২৬
সময় কখনও ধীরে-ধীরে, কোনও আচমকা আমাদের পরিচিত পৃথিবীটাকে বদলে দেয়। এই বদলে যাওয়া পৃথিবীটাকে পছন্দ করেন অনেকেই। কেউ-কেউ করেন না। যাঁরা করেন না, তাঁদের পুরনোপন্থী বলা হয়। বলা হয়, সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না। এখনকার পৃথিবীতে এঁদের সুস্থভাবে বাস করাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে। যেমন ধরুন, কেউ একজন অহিংসায় বিশ্বাস করেন। কেউ আঘাত করলে প্রত্যাঘাত করেন না। হেসে বলেন, ”তুমি ঠিক কাজ করলে না। ভেবে দেখলে নিজেই দুঃখিত হবে।”
এই মানুষটির দিকে তাকিয়ে এখনকার জনতা কী ভাবতে পারে? অন্য গ্রহের মানুষ। না কি অতীত থেকে ছিটকে আসা একজন, যে যিশু খ্রিস্টের ভাষায় কথা বলে! যা-ই ভাবুক, কেউ এঁকে সমসাময়িক বলে ভাববে না। পাগল ভাবতেও দেরি করবে না যদি এক গালে চড় খেয়ে তিনি অন্য গালে আঘাত নিতে সেটা বাড়িয়ে দেন।
অথচ দেখুন, একটা সময় অহিংসা আন্দোলনে গান্ধীজির নেতৃত্বে দেশ উত্তাল হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—হিংসার ছুরিতে কোনও বাঁট থাকে না, যাকে মারা হল এবং যে মারল সেই দু’জনেই রক্তাক্ত হল। কিন্তু এসব কথা এখনকার মানুষকে সময় ভুলিয়ে দিয়েছে। যিশুর কথাগুলো শুনতে খুব ভাল লাগত এক সময়। এখন চুপচাপ গিলতে হয়। শিশুরা যেমন এখনও মুখস্থ করে ‘সকালে উঠিয়া আমি…’, তখন তারাও জানে এগুলো মুখস্থ করার জন্যই, জীবনযাপনের জন্য নয়।
যেমন, কেউ দেশপ্রেমে বিশ্বাস করেন। দেশকে মা বলে মনে করেন। দেশপ্রেমের গানগুলো পরম বিশ্বাসে গেয়ে থাকেন। এরকম কাউকে দেখলে আজকের প্রজন্ম অবাক হয়ে ভাববে, লোকটা কি উন্মাদ? যখন সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো দেশ শাসনের নামে যা খুশি তাই করছে, তখন এই লোকটা দেশপ্রেমের কথা বলছে? লোকটা যদি বাড়াবাড়ি করে তা হলে তাকে অসহ্য মনে হবে। এবং সেটা মনে হলে পরিণতি যা স্বাভাবিক তাই হবে।
সময় অনেক কিছু বদলে দেয়। বিজয়া দশমীর রাত্রে আমরা দলবেঁধে এ বাড়ি, ও বাড়িতে যেতাম প্রণাম করার বাহানা নিয়ে ভালমন্দ খাবারের আশায়। ঢিপ-ঢিপ সেই প্রণামে ভক্তি কতটা ছিল জানি না, তবে বড়রা খুশি হতেন। যে কাকার সঙ্গে বাবার গোটা বছর ধরে ঝগড়া চলছে, তাঁকেও প্রণাম করতে হত। নইলে কাকা বলতেন, ”দাদা ছেলেকে শিক্ষা দেয়নি।” এখনকার ছেলেরা এসবের মধ্যে নেই। আমরা যারা লোভে পড়ে বা অভিভাবকদের চাপে প্রণাম করতে যেতাম, সেই লোভ বা চাপ থেকে ওরা মুক্ত। সেদিন একটি ছেলে পরিষ্কার বলল, ”আমি মা ছাড়া কাউকে প্রণাম করি না।” এমনকী বাবাকেও না। যুক্তি দিয়েছিল, ”মা আমাকে জন্ম দেওয়ার আগে এবং পরে অনেক কষ্ট করেছেন, তিল-তিল করে যখন বড় করেছেন তখন অনেক ত্যাগ করেছেন। বাবা ওসবের কিছুই করেননি। বরং সকালে অফিসে গিয়ে রাত্রে ফিরেছেন। সে সময় তিনি কী করেছেন, তা তিনিই জানেন। সংসার চালানোর টাকা দিয়েই তাঁর কর্তব্য শেষ হয়েছে। অতএব যাঁকে অনেকটাই জানি না, তাঁকে প্রণাম করব কেন?”
এই সময় তরুণ প্রজন্মকে শিখিয়েছে নিজের কথা ভাবতে। তোমাকে ভাল রেজাল্ট করতেই হবে, না হলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে না, ম্যানেজমেন্টে কৃতী হতে পারবে না। ফলে এরা ক্লাস নাইন থেকে সব ত্যাগ করে একটাই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু এদের সংখ্যা বড়জোর দশ শতাংশ। বাকি নব্বই শতাংশ কী করে? যার গানের গলা নেই, সে অন্যদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে গানের দল খোলে। কিছুদিন তাই নিয়ে মেতে থাকার পরে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। কেউ নাটকের দলে নাম লেখায়। নিজেদের ঘাম ঝরিয়ে দাদাদের নাম প্রচারে সাহায্য করে। কেউ চার থেকে আট হাজারের চাকরি পেয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দ্যাখে। একদল রাজনৈতিক দলের সমর্থক হয়ে যায়। বিশেষত সেই রাজনৈতিক দল যারা ক্ষমতায় আছে। দশ শতাংশ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী আত্মসর্বস্ব না হলে, আমরা হয়তো সৃষ্টিশীল প্রতিভার কর্মকাণ্ডে তৃপ্ত হতাম। কিছুদিন আগে আমি একটি সমীক্ষা করেছিলাম। চোদ্দো থেকে ষোলো বছরের ছেলেমেয়েরা, যারা বাৎসরিক পরীক্ষা এবং মাধ্যমিকে উজ্জ্বল ফল করেছে তাদের প্রশ্ন করেছিলাম, ”চারজন প্রিয় কবির নাম এবং তাঁদের কবিতার প্রথম চারটে লাইন কী?” দশজনই রবীন্দ্রনাথের নাম করেছিল, দু’জন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, একজন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। যে লাইনগুলো বলেছিল, তা তাদের পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্গত কবিতার লাইন। স্বীকার করেছিল পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কোনও কবিতার বই পড়ার কথা তাদের মনে আসেনি, কারণ কবিতা পড়ে ভবিষ্যৎ-জীবনে কোনও লাভ হবে না। যদি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে গেলে কবিতা পড়তে হত, তা হলে তারা তামাম বাংলা কবিতা পড়ে ফেলত। আমি জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম, দশজনের মধ্যে তিনজন সুকান্ত ভট্টাচার্যর নাম শুনেছে কিন্তু কোনও কবিতা পড়েনি। আমার মনে পড়েছিল সতী মাস্টারমশাই-এর কথা।
ডুয়ার্সের যে চা-বাগানে আমার জন্ম, সেখানে সতী মাস্টার ভাসতে-ভাসতে চলে এসেছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকে। পুরো নাম সতী সেনগুপ্ত। মাঝখানে নাথ থাকতে পারে, আমি শুনিনি। রোগা, খাটো, পাজামা এবং হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি পরনে, পকেটে নস্যি মোছার রুমাল, সতী মাস্টার আমাদের কাছে যেন স্বপ্নের সওদাগর ছিলেন। বিকেল বেলায় উনি আমাদের কবিতা শোনাতেন ‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি।’ ‘যে শিশু ভুমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে, তার মুখে খবর পেলাম—।’ শুনতে-শুনতে গায়ে কাঁটা দিত, মুখস্থ হয়ে যেত একটার পর একটা। দশ বছর বয়সের আমি যেদিন শুনেছিলাম, ‘ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে’ সেদিন মনে হয়েছিল এটা সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতা। কারণ ‘ছাড়পত্র’ কবিতার সঙ্গে যেন মিল পাচ্ছি। সতী মাস্টার হেসেছিলেন, আরে, এটা রবীন্দ্রনাথের ‘প্রশ্ন কবিতা’। সতী মাস্টার খবর দিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশের। সেই বয়সে রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশি’র সঙ্গে ‘বনলতা সেন’-এর মিল খোঁজার আনন্দ পেয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সতী মাস্টার।
সময় কিন্তু সব পাল্টে দেয়। কখনও ধীরে, কখনও দ্রুত। আমি জানি না এখন পশ্চিমবাংলার মফসসল শহরে, গ্রামে সতী মাস্টারের মতো মানুষ রয়ে গিয়েছেন কি না, না থাকলে এই সময়টাকে ভয়ঙ্কর স্বার্থপর বলেই ভেবে নেব।
২৭
টিভির পর্দায় তখন পঁচিশ হাজার মানুষের বাঁধভাঙা উল্লাসের ছবি। ভারতীয় খেলোয়াড়রা মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাচ্ছেন ড্রেসিংরুমের দিকে। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, পরপর দু’বার, এটা কী করে সম্ভব হল? একবার হয়তো ফ্লুকে হয়ে যায়, কিন্তু দু’দুবার? ঠিক তখনই মোবাইলটা জানান দিল। বাংলাদেশের নম্বর। অন করতেই চিৎকার কানে এল, “সমরেশদা, আজ সত্যি-সত্যি আমরা ‘বিজয় সিংহ’ হয়ে গেলাম।”
“ঠিক বুঝলাম না!” একটু অবাক হলাম।
“বাঙালির ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিল জয়। আমরা লঙ্কার বদলে বলছি ‘বিশ্ব’ করিল জয়। ভারতকে হারানো আর বিশ্বকে হারানো একই কথা। গুড নাইট।” ফোন কেটে দিল যে, সে বাংলাদেশের একজন তরুণ প্রকাশক।
আমি সহজেই অনুমান করি, এই বর্ষাস্নাত রাত্রে বাংলাদেশের প্রতিটি শহরের রাস্তায়, প্রতিটি গ্রামের পথে-পথে মানুষ বেরিয়ে পড়েছে এই জয়ের আনন্দে। এগারোটা বাঙালি ছেলের এই সাফল্যে পৃথিবীর সর্বত্র যেসব বাঙালি বাস করেন, তাদের খুশি হওয়া উচিত। বাঙালি কোণঠাসা হতে-হতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফেলেছিল, এই এগারোটা ছেলের কল্যাণে ঘুরে দাঁড়াতে পারল।
মিরপুরের স্টেডিয়ামে পঁচিশ হাজারের বেশি দর্শকের জায়গা হয় না। কিন্তু গোটা বাংলাদেশের কোটি-কোটি মানুষ ক্রিকেটের এই জয়কে বাঙালির জয় বলে উল্লসিত হয়েছেন।
আমারও বেশ আনন্দ হল। কল্পনা করতে পারি, বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা মাঠের মধ্যে পরস্পরের সঙ্গে যখন কথা বলেন, তখন অবশ্যই বাংলায় বলেন। কেউ সফল হলে তাঁকে অভিবাদন জানান বাংলায়। এই ব্যাপারটা তাঁরা করেন সিডনি বা মেলবোর্নে, অকল্যান্ডে বা লর্ডসে।
এই ব্যাপারটা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কতটা আলোড়িত করছে?
পশ্চিমবাংলার দুটো শহরের মানুষ ভিন্ন প্রদেশের ভিন্ন ভাষাভাষীদের সঙ্গে একত্রে বাস করেন। এইভাবে বাস করার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব অবশ্যই তাঁদের উপর পড়ে। শহর দুটি হল—কলকাতা এবং শিলিগুড়ি। স্বাধীনতার পর কলকাতায় একটু-একটু করে গোটা ভারত চলে এসেছে। এখানে উপার্জনের সুবিধে অন্য প্রদেশের শহরের থেকে অনেক বেশি। শারীরিক পরিশ্রম করে অন্য প্রদেশের মানুষ এখান থেকে রোজগার করে নিজের বাড়িতে যখন বছরের পর বছর পাঠিয়ে যাচ্ছে তখন পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের সেই পরিশ্রম করতে প্রবল অনীহা। কলকাতায় আগে হাজার-হাজার হাতে টানা রিকশা চলত। তাদের নিরানব্বই ভাগ চালক বিহার, উত্তরপ্রদেশের অথবা ঝাড়খণ্ডের। এখনও রিকশা চলছে। অটোর দাপট তাদের সংখ্যা কমিয়েছে। একেবারে খালি হাতে শিয়ালদহ বা হাওড়ায় নেমে এরা রিকশাওয়ালাদের ডেরায় ঢুকে পড়ে। দশ বারোজন একসঙ্গে রান্না করে খায়। একটাই ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। তাই রোজগারের মোটা অংশ সহজে দেশে পাঠাতে পারে। এককালে কলকাতায় ট্যাক্সিচালকের গরিষ্ঠ অংশ ছিলেন পাঞ্জাবের মানুষ। এখন বিহার বা উত্তরপ্রদেশের। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গাড়ির ইঞ্জিনের গরম বাঙালিদের যে কয়েকজন সহ্য করতে বাধ্য হন, তাঁদের সামনে অন্য কোনও পথ খোলা নেই। এই মুহূর্তে কলকাতায় যেসব ভিন্ন প্রদেশের মানুষ কাজ করেন, তাঁরা যদি আচমকা সিদ্ধান্ত নেন স্বপ্নদেশে ফিরে যাবেন, তা হলে ভয়ঙ্কর বিপদে পড়ে যাবেন কলকাতার বাঙালিরা। আমার পাশের ফ্ল্যাটের বয়স্ক দম্পতি অসুস্থ। তাঁরা বাজারের পরিচিত দোকানিকে ফোন করলে তাঁর পছন্দমতো বাজার করে মুটের মাথায় পাঠিয়ে দেয় দোকানি। এই মুটে ঝাড়খণ্ডের মানুষ। তার সঙ্গে কথা বলে জানলাম, সে রোজ পনেরোটি বাড়িতে ঝাঁকায় করে বাজার পৌঁছে দেয়। বাড়ি পিছু কুড়ি টাকা হলে দিনে তিনশো টাকা রোজগার করে। অর্থাৎ মাসে তার আয় নয় হাজার টাকা। অশিক্ষিতের কথা ছেড়ে দিলাম, শিক্ষিত বাঙালি যুবক ছয় হাজার টাকার কেরানির চাকরির জন্য হাপিত্যেশ করে মরছে, কিন্তু নয় হাজার টাকার পরিশ্রমের কাজ করবে না। কলকাতার তুলনায় শিলিগুড়ির ছবিটা একটু আলাদা। ওই শহরের রাস্তায়, রেস্টুরেন্টে বাংলার তুলনায় হিন্দি অথবা নেপালির দাপট স্বাভাবিক কারণেই কম নয়। ওখানকার বাঙালি যুবকরা জানেন, অলস হয়ে থাকলে নেপালিদের পাশাপাশি গোটা ভারতবর্ষ জায়গা দখল করতে তৎপর হয়ে আছে। তাই তাদের পাল্লা দিতে হচ্ছে। এই পাল্লা দিতে গিয়ে তারা অনর্গল হিন্দি বলছে, নেপালি ভাষাও ব্যবহার করছে। আর এই করতে গিয়ে বাঙালি শব্দটিকে মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করছে না। বেঁচে থাকার জন্যে অর্থ উপার্জনই এখন একমাত্র রাস্তা। অন্য কোনও আবেগে আপ্লুত হওয়ার সময় এই প্রজন্মের নেই।
ক্রমশ পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের মন থেকে বাঙালিয়ানা ধীরে-ধীরে কমে যেতে শুরু করেছে। এখন কলকাতা নাইট রাইডার্স টুর্নামেন্ট জিতলে যে খেলোয়াড়দের নিয়ে ইডেন গার্ডেনে আমরা নৃত্য করছি, তাদের কেউ বাঙালি না হলেও কোনও ক্ষতি নেই। ক্রিকেটে আমরা রনজি ট্রফির প্রাথমিক স্তর পার হতে পারছি না। যদি বাংলাদেশের বদলে আমাদের রনজি খেলোয়াড়দের বলা হত ধোনির ভারতীয় দলের সঙ্গে একটা ওয়ান ডে ম্যাচ খেলতে, তা হলে কী ফল হত তা আড়াই বছরের শিশুও বলে দেবে। মানছি, কলকাতায় হিন্দু এবং উর্দু ভাষাভাষীদের কয়েকটি বড় এলাকা আছে। কিন্তু তার বাইরের বাঙালিরা এখন হিন্দিতে কথা বলতে, গান গাইতে স্বচ্ছন্দবোধ করছে। বিশেষ করে তরুণরা। বাংলা বই-এর পাঠক কমে যাচ্ছে হু হু করে। বইমেলা হয়, শুনেছি কোটি কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। কিন্তু একশোজন পরিচিত বাঙালির বাড়িতে গেলে দেখতে পাব হয়তো একজন বই কিনেছেন সেই মেলা থেকে। আমার নতুন বই যখন এপার বাংলায় বছরে দু’হাজার কপি বিক্রি হয়, তখন সেই বই-এর পাইরেট সংস্করণ (ঢাকার একটি সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী) দশ হাজার কপি বাংলাদেশে বিক্রি হয়ে থাকে। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে যে-বইয়ে এ অটোগ্রাফ দিতে হয়, তা ঢাকার পাইরেটরা ছেপেছে বুঝেও সই দিতে হয়।
আমরা বাঙালি, আমি বাঙালি এই বোধ এপারে যাঁদের এখনও আছে তাঁদের দেখতে কতদিন পাব জানি না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ মনে করে তারা বাঙালি। এই আবেগ তাদের উদ্বুদ্ধ করে বলেই মিরপুর স্টেডিয়ামে ওঠা উল্লাস আকাশ ছুঁয়ে সমস্ত বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
২৮
বেশ কিছুদিন ধরে আমরা একটা ব্যাপার লক্ষ করছি। যখনই কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মীরা বিরোধীদের আক্রমণ করে তখনই তাদের দলের দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠামাত্র সেই দলের নেতৃত্ব দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। তারা বলেন, ওই ঘটনার জন্য তাঁদের দলের কোনও কর্মী দায়ী নয়। ঘটনা যদি ঘটে থাকে তা হলে বিরোধীদলের নিজেদের বিরোধের ফল। এই অস্বীকার প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দল করে থাকেন। কোনও দলই বলেন না, “হ্যাঁ, আমাদের দলের সমর্থকরা ওই হাঙ্গামা করেছেন, তাঁরাই ওই দুষ্কর্মগুলো করেছেন। এই কাজ করেছেন যাঁরা তাঁরা আমাদের সমর্থক বলে আমরা দুঃখিত।”
প্রতিদিন কাগজে রাজনৈতিক সঙঘর্ষের খবর বের হয়। খবরের শেষে সাংবাদিকরা অভিযুক্ত রাজনৈতিক দলের আঞ্চলিক নেতার কাছে বক্তব্য জানতে চাইলে এই অস্বীকার করার কথা জেনে ছেপে দেন। পড়তে-পড়তে আমরাও জেনে গিয়েছি, সব খবরের শেষে ওই অস্বীকারের কথা পড়তে হবে। ধরে নিচ্ছি, কোনও-কোনও ক্ষেত্রে অভিযোগ সত্যি নয় বলে অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওই অস্বীকার মানে মিথ্যে কথা বলা তা আমরা এতদিনে জেনে গিয়েছি। এবং এইরকম মিথ্যে বলাটা যে অপরাধ নয় তাও বুঝতে পারছি।
সম্প্রতি একটি চমৎকার গল্প শুনলাম। এক বৃদ্ধ তাঁর নাতিকে শেখাচ্ছিলেন, ‘সদা মিথ্যে কথা বলিবে, মিথ্যে ছাড়া সত্য বলিবে না। সত্য বলিলে তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হইয়া যাইবে।’ নাতি কথাগুলো মুখস্থ করে তার বাবার সামনে গিয়ে উগরে দিল। বাবার তো চোখ বড় হয়ে গেল। সে তার বাবার কাছে গিয়ে এই ধরনের শিক্ষা দেওয়ার কারণ জানতে চাইল। বাবাকে মনে করিয়ে দিল, ছেলেবেলায় তাকে উল্টো শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। বৃদ্ধ বললেন, ‘যা শিখিয়েছিলাম তার সব ভুল ছিল বলেই তোর ছেলেকে ঠিক শেখাতে চেষ্টা করছি। এই যে তোকে শিখিয়েছিলাম সত্যি কথা বলতে। তুই বউমার মাকে দেখতে যাচ্ছিস বলে সন্ধেবেলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পার্টিতে গিয়ে মদ গিলে আসিস। এটা আমি তখনই জানতে পারি যখন তুই বউমাকে মিথ্যে কথা বলিস। তিনি রেগে গিয়ে আমাকে সব বলে দেন। ছেলেবেলার শিক্ষা তোর জীবনে কোনও কাজে লাগেনি। তাই যেটা কাজে লাগবে সেটাই তোর ছেলেকে শেখালাম।’
মিথ্যে বলার অভ্যেস দু’ধরনের। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে। আমার পরিচিত এক অভিনেতা মিথ্যে বলতেন একান্তই অপ্রয়োজনে। ধরা যাক, তাঁর সঙ্গে বেলা দুটোয় আমার একটা কাজ শুরু করার কথা ছিল। তিনি এলেন তিনটের সময়। এসেই বললেন, ‘আর বলবেন মা, একটা কাণ্ড হয়েছে। বাইপাস দিয়ে আসছিলাম, হঠাৎ দেখি উল্টোদিকের লেন দিয়ে একটা লাল বাতির গাড়ি যাচ্ছে। তার জানলা দিয়ে মন্ত্রীমশাই আমার উদ্দেশে হাত নাড়লেন। আমি রেসপন্স করার আগেই ওঁর গাড়ি চলে গেল। মনে হল, হাত নাড়লাম না বলে উনি কিছু মনে করতে পারেন। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে ওঁর পিছন পিছন গিয়ে যতক্ষণ কথা বলতে না পারলাম ততক্ষণ স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। তাই আপনার কাছে আসতে দেরি হয়ে গেল’, অভিনেতা যে মন্ত্রীর নাম বললেন, পরের দিনের কলেজে দেখলাম তিনি দু’দিন ধরে দিল্লিতে আছেন। এই মিথ্যে একেবারেই অপ্রয়োজনে বলা। আমায় যদি বলতেন, ‘সরি, একটু দেরি হয়ে গেল’, তা হলে আমি কিছুই বলতাম না। ব্যাপারটা আরও চমৎকার হল যখন তাঁর স্ত্রীর মুখ থেকে শুনলাম, ‘আপনি জানেন না, উনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও মিথ্যে বলেন।’
প্রয়োজনে মিথ্যে বলাটা প্রায় শিল্পের পর্যায়ে পড়ে। পৃথিবীর সমস্ত স্বামী সত্যবাদী, একথা কেউ জোর গলায় বলতে পারবেন না। স্ত্রীর কাছে বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যে বলতে পারার ক্ষমতা না থাকলে গৃহবিবাদ অনিবার্য। অফিস থেকে ফেরার সময় কলেজ স্ট্রিটের কফিহাউস চোখে পড়ায় আপনি একটু নস্টালজিক হয়ে বাস থেকে নেমে পড়লেন। পুরনো দু-একজন বন্ধুকে পেয়ে চুটিয়ে আড্ডা মেরে খুশি হয়ে বাড়ি ফিরতেই স্ত্রী প্রশ্ন করলেন, ‘এত দেরি হল?’ কি জবাব দেবেন? সত্যি বললে একগাদা অভিমান জড়ানো বাক্য শুনতে হবে। তার জের চলবে অনেকটা সময়। তাই মিথ্যে বলতে হল। অফিসের এক সহকর্মী অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। এই জবাব দেওয়ায় আপনাকে আর ছোবল খেতে হল না। কিন্তু প্রয়োজনে এমন মিথ্যে বলতে আপনি কতবার পারবেন? বিশেষ করে এই মোবাইলের যুগে। রাস্তায় হাঁটার সময় বন্ধুর ফোন এল। তাকে কাটাবার জন্য বললেন, ‘শরীর খারাপ, শুয়ে আছি।’ খেয়ালই করলেন না আপনার মোবাইল তার কানে ট্রাম-বাসের আওয়াজ পৌঁছে দিচ্ছে। আপনাকে মিথ্যেবাদী ভাবতে তার অসুবিধে হল না।
রাজনৈতিক নেতাদের কোনও বক্তব্যের উপর বিশ্বাস করলে আপনার মতো নির্বোধ খুঁজে পাওয়া যাবে না। টিভির আলোচনার আসরে তিন বছর ধরে যে নেতা বা নেত্রী ক্ষমতায় থাকা সরকারের বাপবাপান্ত করে গিয়েছেন, তাঁকে যদি সরকারি দলে যোগ দিয়ে বুদ্ধদেবের হাসি হাসতে দেখেন তা হলে দয়া করে তাঁকে মিথ্যেবাদী ভাববেন না। রাজনীতির প্রথম পাঠ হল, সদা মিথ্যে বলিবে। সেটা না জানা থাকলে আপনি ঠকবেন। একটা গল্প অনেকটা এইরকম—! একটি রাজনৈতিক দলের জনা কুড়ি সমর্থককে ভালভাবে বুঝিয়ে অস্ত্রসমেত পাঠানো হল বিরোধী দলের অফিস বাড়ি ভাঙতে, পুড়িয়ে দিতে। ঘন্টা দুয়েকের পথ। বাইকে যাবে সবাই। কিন্তু একটা পা-ডোবা জলের নদী পার হতে হবে। নদীর কাছে পৌঁছে সমর্থকরা দেখল হড়কা বান এসেছে। জল না কমলে পার হওয়া অসম্ভব। ওরা অপেক্ষা করতে লাগল। এদিকে ঘন্টা তিনেক চলে গেলে সমর্থকদের আঞ্চলিক নেতা তাঁর অফিসে সাংবাদিকদের ডেকে ঘোষণা করলেন, ‘এই যারা অফিস বাড়ি পুড়িয়ে ফিরেছে তারা কোনওভাবেই তাদের দলের সমর্থক নয়। আমরা এসব করিনি।’ একজন সাংবাদিক অবাক হয়ে বললেন, ‘সেকি! আজ তো এরকম ঘটনা ঘটেনি। না ঘটতেই অস্বীকার করছেন কেন?’
পণ্ডিতরা বলছেন, আগ বাড়িয়ে মিথ্যে না বলে চুপচাপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
২৯
আমার শেষ পাসপোর্টের আয়ু এখনও পাঁচবছর, কিন্তু গতবারই ইমিগ্রেশনের অফিসার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘স্যর, আপনার পাসপোর্টের সব সাদা জায়গা শেষ হয়ে গিয়েছে। এবার নতুন পাসপোর্ট করিয়ে নিন।’
কয়েকদিন পরে মনে হয়, কি দরকার! বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছেটা আর নেই যখন, তখন পাসপোর্ট না থাকলেও চলবে। কিন্তু এক বন্ধু মনে করিয়ে দিলেন, ‘ওই পাসপোর্ট আপনার সবেধন নীলমণি। আপনার আধার কার্ড নেই, ভোটার আইডেনটিডি কার্ড হারিয়ে ফেলার পরে থানায় জানিয়েছিলেন। কিন্তু ডুপ্লিকেট চেয়ে আবেদন করেননি। আপনি যে ভারতীয় তার একমাত্র প্রমাণ হল ওই পাসপোর্ট। অবশ্য এখনও ওটা পাঁচবছর কাজ চালিয়ে দেবে। তার মধ্যে নতুনের জন্য আবেদন করুন।’
কথাগুলো সত্যি। ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে আমি প্রমাণ হিসেবে শুধু ওই পাসপোর্টটাই দাখিল করতে পারি। কিন্তু আমার চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁদের পাসপোর্ট নেই। সেটার জন্য আবেদন করার ইচ্ছেও তাঁদের মনে কখনও জাগেনি। এঁদের ভোটার আইডি, রেশন কার্ড অথবা আধার কার্ড—তিনটেই থাকতে পারে। একটা-দুটো তো আছেই। এখন বলা হচ্ছে, দেশের অভ্যন্তরে ওই আধার কার্ড থাকা খুব প্রয়োজন। না থাকলে ভবিষ্যতে অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হবে। অবশ্য সে কারণে এই পাসপোর্টের প্রয়োজন শেষ হয়ে যাচ্ছে না। এই দেশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের ওই তিনটি পরিচয়পত্র নেই। এই মাটিতে জন্মেছেন, কাজকর্ম করছেন, মারাও যাবেন এখানেই। এঁদের কি ভারতীয় বলা হবে না? নাকি ছিটমহলের বাসিন্দাদের মতো কোনও দেশ নেই বলে স্ট্যাম্প মারা হবে ধরপাকড় হলে? বন্ধু বললেন, ‘তাই হওয়া উচিত। কিন্তু হবে না। চোখ বন্ধ করে থাকা হবে।’
এ-কথা ঠিক, আমার কাছাকাছি মানুষের অনেকেই পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেননি। বললে বলবেন, ‘দুর। আমি তো কখনও বিদেশে যাব না, পাসপোর্ট রেখে কি করব? খামোখা কিছু টাকা খরচ।’
গতকাল এক বন্ধু ফোন করলেন, ‘এ মাসের শেষে সস্ত্রীক সুইডেন যাচ্ছি।’
‘সুইডেন?’ আমি হতভম্ব। যে মানুষ কলকাতার বাইরে বলতে শুধু পুরীতে গিয়েছেন কয়েকবার, সারা জীবন মাথা নিচু করে কেরানিগিরি করে গিয়েছেন, তিনি শহর পেরিয়ে সুইডেনে যাচ্ছেন? তাও আবার সস্ত্রীক?
বন্ধু বললেন, ‘আমার জামাই ওদেশে আছে। বদলি হয়ে গিয়েছে। মেয়ে টিকিট পাঠিয়েছে। যাই ঘুরে আসি।’
‘তোমাদের পাসপোর্ট আছে?’ ঢোঁক গিললাম আমি।
‘ছিল না। জামাই ফোনে বলল, তৎকালে করিয়ে নিতে। করালাম। ওরাই ভিসার ব্যবস্থা করিয়ে দিল। মাস কয়েক ওখানে থাকব। তোমাকে জানিয়ে দিলাম।’
হ্যাঁ। গত পনেরো বছরে বাঙালির কিছু বাবা-মা মেয়েদের চাপে পাসপোর্ট করেছেন, বিদেশে গিয়ে কিছুকাল থেকে আসছেন। তুলনায় ছেলেরা বাবা-মাকে নিয়ে যাচ্ছে বেশ কম। কলকাতা বিমানবন্দরে পরিচিত প্রৌঢ় দম্পতির সঙ্গে দেখা হলে দশজনের মধ্যে আটজন হেসে বলবেন, ‘এই একটু মেয়ের বাড়ি যাচ্ছি, কানাডায়।’
আমি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে পেয়েছিলাম ১৯৮২-র ৮ জুলাই। নিউ ইয়র্কে থাকত বন্ধু মনোজ ভৌমিক। সেখানে গিয়ে চিত্রনাট্য লিখতে হবে বলে সে তাগাদা দিয়ে পাসপোর্ট করিয়েছিল। তখন ব্রেবোর্ন রোডের অফিসে যেতে হত পাসপোর্টের জন্য। পাসপোর্ট অফিসার ছিলেন আমার এক বন্ধুর দাদা। তিনি আবেদনের ফর্মে একজন আইপিএস অফিসারের সুপারিশ লিখিয়ে ওটা জমা দিতে বলেছিলেন। সেটা করতে অসুবিধা হয়নি। পাসপোর্ট পেয়ে গিয়েছিলাম স্বচ্ছন্দে। প্রথমবার বিদেশে যাই ১৬ এপ্রিল, ১৯৮৪ সালে। ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিসের আমন্ত্রণে। মনোজের সঙ্গে কাজটা করা হয়নি।
তারপর আমার পাঁচবার পাসপোর্টের নম্বর বদলেছে। পাঁচটা বই সঞ্চয়ে। তাই এবার ভাবলাম নতুনের জন্য আবেদন না করে কয়েকটা পাতা জুড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করব। কিন্তু জানলাম আইন বদলেছে। আমাকে নতুন পাসপোর্ট নিতে হবে। আর এবার ব্রেবোর্ন রোড নয়, যেতে হবে সেই রুবি জেনারেল হাসপাতালের কাছে যেখানে নতুন পাসপোর্ট অফিস হয়েছে। কিন্তু যাওয়ার আগে ইন্টারনেটে আবেদন করলে ওরা একটা নম্বর দেবে। ফর্মও পাওয়া যাবে নেট থেকে। সেসব ঠিকঠাক করে সকাল দশটায় পৌঁছে গেলাম পাসপোর্ট অফিসে। বিশাল লাইন। কিন্তু বেশ দ্রুত পৌঁছে গেলাম ভিতরে। তরুণ থেকে বৃদ্ধ বাঙালি যে সংখ্যায় পাসপোর্টের জন্য লাইন দিয়েছে তা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ঠিক দু’ঘন্টায় আমার কাজ শেষ হয়ে গেল। ওঁরা বললেন, সাতদিনের মধ্যে বাড়িতে পাসপোর্ট পেয়ে যাবেন। কেউ হাত পেতে বলল না, কিছু দিন।
সাতদিন না, চারদিনের মধ্যে পাসপোর্ট পৌঁছে গেল। অবিশ্বাস্য এই গতি আমার কল্পনায় ছিল না। কিছু মানুষ যে এখনও কাজ করেন তার প্রমাণ পেয়ে খুশি হলাম। দুই সপ্তাহ পরে ফোন পেলাম, মিস্টার মজুমদার, আমি এসআই আমেদ বলছি। আপনার পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন করতে হবে। আপনি শেষ পাসপোর্ট, ইলেকট্রিক বিল, আধার কার্ড-এর জেরক্স কপি রেডি রাখবেন। আগামী সোমবার সকালে যদি যাই অসুবিধা হবে না তো? আমি তাঁকে আসতে বললাম।
মনে পড়ল, প্রথম সরকারি চাকরি পাওয়ার পর পুলিশ এসেছিল ভেরিফিকেশন করতে। এসে টাকা চেয়েছিল। দিতে পারিনি বলে এত খারাপ রিপোর্ট দিয়েছিল যে রুল ফাইভ ওয়ানে আমার চাকরি চলে যায়। বন্ধু বললেন, ‘ওঁরা পেয়ে থাকেন। তুমি দেব না বললে হবে?’
মিস্টার আমেদ এলেন। সব দেখলেন। জেরক্স কপিগুলো নিয়ে বললেন, ‘আমাকে কর্তব্য করতে হল। প্রার্থনা করছি, আপনি ভাল থাকুন, আর আরও লিখুন।’
ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলাম। পৃথিবীতে এখনও কিছু ভদ্রলোক আছেন একথা কেন প্রায়ই ভুলে যাই আমরা?