১০
আজ সকালে মেদিনীপুরের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের দু’জন শিক্ষক আমার কাছে এসেছিলেন। তাঁদের একজন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ওঁদের স্কুলে একটা ভাল পাঠাগার তৈরি করতে এবং সেখানে ছাত্রছাত্রীদের বইমনস্ক করতে উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। এই কাজে অন্য শিক্ষকরাও সহযোগিতা করছেন। কলকাতার লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের বই সংগ্রহ করতে মাঝেমাঝে কলকাতায় তাঁরা আসেন। প্রধান শিক্ষক এবং তাঁর সহশিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমি যা জানতে পারলাম তা আমার জানা ছিল না।
এখন একটি ছাত্র ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়ে আট বছর নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারে এই ভেবে যে সে ফেল করবে না। বছরের শেষে তাকে উপরের ক্লাশে প্রমোশন দিতে হেড মাস্টারমশাই বাধ্য। সরকারি নিয়মটিকে নিজের ইচ্ছে মতো ব্যবহার যদি কোনও ছাত্র করতে চায় তা হলে স্কুল কর্তৃপক্ষের কিছুই করার থাকে না। প্রশ্ন করলাম, ‘এই আট বছরে আপনারা কোনও পরীক্ষা নেন না?’
‘অবশ্যই নিই। কিন্তু বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের লেখা উত্তর পড়লে মনে হয় সারা বছর ধরে ভস্মে ঘি ঢেলে গিয়েছি। বেশিরভাগ দিন ক্লাসে ছেলে আসে না। মিড ডে মিলের লোভে যারা আসে তাদের পড়ায় মন নেই। চোখের সামনে ওদের শরীর বড় হচ্ছে কিন্তু বিদ্যাবুদ্ধি একই জায়গায় থেকে যাচ্ছে।’ হেড মাস্টারমশাই বললেন।
‘আপনারা ছাত্রদের কিছু বলেন না?’ জিজ্ঞাসা করলাম।
‘এক কান দিয়ে ওরা শোনে, অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়।’
‘তারপর?’
‘মাধ্যমিকে যদি বসতে না দিই তা হলে স্কুলের উপর চাপ আসবে।’
‘কীরকম?’
‘নাইন থেকে টেনে উঠতে না দিলে ওরা পড়াশুনো ছেড়ে দেবে। শতকরা আশিজনই স্কুল ছেড়ে চলে যাবে। টেস্টে যত খারাপ করুক ওদের মাধ্যমিকে বসতে না দিলে আমাদের স্কুলের প্রগতি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, তবু টেস্টে যারা খুব খারাপ ফল করছে তাদের বাদ দিতে বাধ্য হই আমরা। ফাইনালের ফল বের হলে দেখা যায় ভাল ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যাদের পাঠানো হয়েছিল তাদের অধিকাংশই ফেল করেছে। আবার পরের বছর পরীক্ষা দেয় ওরা। ফল একই হয়।’
‘এইসব ছেলেদের কি পাঠ্যবই সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই?’
‘বেশিরভাগেরই নেই। আপনি যদি পরীক্ষার সময় সেই বিষয়ের পাঠ্যবই ছাত্রটির সামনে রেখে বলেন, ‘বই দেখে উত্তর লেখো’ তা হলেও বেশির ভাগই সেটা লিখতে পারবে না। তারা নির্ভর করে উত্তর সাপ্লাইকারীদের উপর। বিভিন্ন পথে উত্তর লেখা কাগজ তাদের কাছে পৌঁছনোর ব্যবস্থা আছে। যারা পাঠাচ্ছে তাদের পেটে বিদ্যে না থাকলেও পেশীতে শক্তি বা পকেটে অস্ত্র আছে। তারাই গ্রামের কোনও শিক্ষিত ব্যক্তিকে দিয়ে উত্তর লিখিয়ে পরীক্ষার হলে পৌঁছে দেয়। মাস্টার মশাইরা, যাঁরা নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকেন, তাঁরা বাধ্য হন কোনও অ্যাকশন না নিতে। কারণ তাঁকে পরিবার নিয়ে বাস করতে হবে।’
ছবিটা স্পষ্ট হল। এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় খবরের কাগজে ছবি ছাপা হয়েছিল এক সাপ্লাইকারীর যে দোতলার জানালায় উঠে হলের ভিতরে উত্তর সাপ্লাই দিচ্ছে অবাধে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওই উত্তর নকল করে লিখে ছাত্ররা তো ভাল নম্বর পেয়ে যাবে। তাহলে ফেল করে কেন?’
সহশিক্ষক হাসলেন, ‘স্যর, উত্তরটা কোন প্রশ্নের তা লেখার সময় ওরা গুলিয়ে ফেলে। ভাব সম্প্রসারণের উত্তর লিখতে যে রচনার নকল লিখছে সেই বোধ নেই। দ্রুত লেখার সময় যে ভয়ঙ্করভাবে বানান ভুল করছে তা নিজেরাই জানে না। তাছাড়া যে নকলটা লিখে দিচ্ছে সে যদি ভুল করে তা হলে সেই ভুল উত্তর একাধিক ছাত্রের খাতায় পাওয়া যাচ্ছে।’
প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘গোড়া থেকে যদি ভিত তৈরি না হয় তা হলে এমনটা হবেই। সব বালকের মনে যদি ভয় থাকে, পড়াশোনা না করলে একই ক্লাসে থাকতে হবে, তা হলে তাদের মনে জেদ আসবে পাশ করার জন্য। সে পড়বেই। এইটে এখন খুব কম সংখ্যক ছেলেমেয়ের মধ্যে রয়েছে। আমাদের আক্ষেপ এখানেই।’
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই যে ছেলেরা যারা পড়ল না, স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হল, তাদের ভবিষ্যৎ কী?
দেখলাম দুই প্রবীণ শিক্ষক পরস্পরের দিকে তাকালেন। প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘সবচেয়ে সোজা পথটাই ওরা বেছে নেয়। যে পথে হাঁটলে সহজে পকেটে টাকা আসবে, সাধারণ মানুষ ভয় পাবে আর ওরা সেটাকে সমীহ বলে ভেবে খুশি হবে, সেই পথে চলে যায় ওরা।’
‘অ্যান্টিসোশ্যাল?’
‘সহজ ভাষায় তাই বলা উচিত স্যর। কিন্তু গত চল্লিশ বছরে তার অনেক প্রতিশব্দ বেরিয়ে গিয়েছে সেগুলো নিশ্চয়ই আপনি জানেন।’
‘জানি। এদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ক্ষমতায় যে দল থাকে সেই দলের ছাড়পত্র সংগ্রহ করে ওরা। ফলে পুলিশ চুপচাপ থাকে। এইসব লোক, যারা এককালে আপনাদের ছাত্র ছিল তারা দেখা হলে কিছু বলে না?’
‘কোনও অন্যায় চোখে পড়ে গেলে ওরা সেই সিনেমার ভাষায় বলে, আপনি কিছুই দ্যাখেননি স্যর। আমরা মেনে নিতে বাধ্য হই।’
প্রধান শিক্ষক বললেন।
সহশিক্ষক হাসলেন। ‘তবু স্যার, যখন আমাদের কোনও ছাত্র প্রথম শ্রেণিতে এম এ পাস করে প্রণাম করতে আসে, তখন বুক আনন্দে ভরে যায়। মনে হয় ওরা যেমন আছে, এরাও তো রয়েছে।’
হঠাৎ মনে পড়ল। ক’দিন আগে একটা চিঠি পেয়েছিলাম। প্রচুর ভুল বানানে পত্রপ্রেরক আমাকে অনুরোধ করেছিল একটা চাকরি জোগাড় করে দেওয়ার জন্য। নাম লিখেছিল খোকন রায়, এমপি। বয়স একুশ। ওই বয়সে পার্লামেন্টের মেম্বার হওয়া সম্ভব নয়। এমপি-র অর্থ বুঝতে পারিনি। চিঠিটা ওঁদের দেখাতে দু’জনে খুব হাসলেন। বললেন, ‘এমপি মানে মাধ্যমিক প্লাকড। আগে ম্যাট্রিক প্লাকড বলত। মাধ্যমিকে ফেল করে ওটাকেই খোকন নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা বানিয়ে নিয়েছে।’ আগামী দশকের ছবিটা কীরকম হবে কে বলতে পারে!
১১
গত পঁচিশ বছর ধরে আমাদের পারিবারিক জীবনে একই ঘটনা ঘটে চলেছে। বিশেষ করে কমপিউটার শিক্ষা চালু হওয়া এবং তাতে দক্ষতা অর্জন করার পর এই ঘটনাগুলো আর সীমাবদ্ধ থাকছে না। পড়াশোনায় ভাল ছেলেরা ডিগ্রি অর্জন করে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ অথবা নেটের মাধ্যমে আবেদন করে চাকরি করতে চলে যাচ্ছে প্রবাসে। বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ তো ছিলই এখন গুজরাতের কয়েকটি শহর ওদের লক্ষ্যে এসে গিয়েছে। বছর চব্বিশ আগে যাদবপুর থেকে ভাল নম্বর পেয়ে পাস করা একটি ছাত্রের কাছে দুটি চাকরির প্রস্তাব ছিল। একটি কলকাতায়, অন্যটি হায়দরাবাদে। তার পরিবারের সবাই চাইছিলেন সে কলকাতায় চাকরিটা করুক। মাইনে যখন একই তখন কেন খামোকা অন্য শহরে যাবে! বরং নিজের বাড়িতে থেকে চাকরি করলে প্রচুর টাকা বাঁচাতে পারবে। ছেলেটি এইসব সৎ উপদেশে কান দিচ্ছিল না। তার বাবার অনুরোধে আমি কথা বললাম। হায়দরাবাদে গেলে ফ্ল্যাট ভাড়া করতে হবে, হোটেলে বেশিদিন খেলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে তাই রান্নার লোক রাখতে হবে। তুমি যে মাইনে পাবে তার কিছুটা এসবে চলে যাবে। যদি ভাল পিজি অ্যাকোমোডেশন পাও তাতেও তো মোটা টাকা দিতে হবে। ছেলেটি হাসিমুখে কথাগুলো শুনল। তারপর বলল, কাকা, আপনি যা বললেন, মা রোজ তার রেকর্ড বাজাচ্ছে। এখানে থাকলে আমি কয়েক হাজার টাকা বাঁচাতে পারব কিন্তু তার বদলে স্বাধীনতা হারাব।” আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ছেলেটি বলল, ‘এই বয়স পর্যন্ত আমাকে প্রতিটি স্টেপ মা-বাবার কথামতো ফেলতে হয়েছে। এখানে থাকলে তো ওঁদের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতে হবে। যদি আলাদা ফ্ল্যাট নিই তা হলে আগুন জ্বলবে। হায়দরাবাদে গেলে আমি প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ পাব। ওখানে আমি নিজের মতো থাকতে পারব। তার জন্য মাইনের কয়েক হাজার টাকা খরচ করতে একটুও খারাপ লাগবে না।’
‘তুমি এতদিন নিজেকে পরাধীন ভেবে এসেছ?’ জিজ্ঞাসা করলাম।
‘অবশ্যই। আমি তো বাবা-মায়ের অধীনেই ছিলাম। বিশেষ করে মা। সেই ছেলেবেলা থেকে মা তাঁর ইচ্ছে মতো কাজ আমাকে দিয়ে করিয়েছেন। এমনকী আমি স্কুলে টিফিন নিয়ে গিয়ে কাউকে ভাগ দিয়ে খুব বকুনি খেয়েছি। এটা করো, ওটা করবে না শুনতে শুনতে এত বড় হয়েছি। এখন আমি হাঁপিয়ে উঠেছি।’ ছেলেটি বলল।
বললাম, ‘এসব তোমার ভালর জন্য করা হয়েছে, তাই না?’
‘আপনার কি মনে হচ্ছে না অনেক বাড়াবাড়ি করা হয়েছে ভাল করার দোহাই দিয়ে। বাবার মুখে শুনেছি উনি যখন ক্লাস সেভেনে পড়তেন তখন ঠাকুরদা ভেবেছিলেন ফাইভে পড়েন। অর্থাৎ ছেলে কোন ক্লাসে পড়ছে তার খবরই রাখতেন না। অথচ বাবা পড়াশোনা করে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে চাকরির অনেক উপরের ধাপে রয়েছেন।’ ছেলেটি বোঝানোর ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছিল।
‘তুমি কি ওঁদের আর পছন্দ করছ না?’
‘খুব ভুল কথা। ওঁদের আমি অত্যন্ত ভালবাসি। কিন্তু নিজেকে তৈরি করতে আমি ওঁদের কাছ থেকে একটু দূরে থাকতে চাইছি। এই চাকরিটা আমাকে সাহায্য করবে।’
গত দশ বছরে এই পথে মেয়েরা হাঁটতে শুরু করেছে। এখন প্রবাসের অনেক শহরে বাঙালি মেয়েরা চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছে, কয়েকজন ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকছে। আগে এই কাজটা করতে চাইলে আত্মীয়রা শিউরে উঠতেন। যাঁদের অর্থাভাব নেই তাঁরা বলতেন চাকরি করার কী দরকার। আগে বিয়ে দিয়ে দেওয়াটা যত কঠিন কাজ হোক তা করাতে সক্ষম ছিলেন অভিভাবকরা। এখন তাঁদের কর্তৃত্ব আর জোরালো নয়। মেয়ের ইচ্ছেকে মেনে না নিয়ে উপায় নেই। মেয়েরা, শিক্ষিত মেয়েরা বেরিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনভাবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে জীবনটাকে দেখতে।
এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে এইসব একা ছেলেমেয়েগুলো প্রবাসে গিয়ে টপাটপ পরস্পরের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে! কেউ কেউ বিয়ে করে সংসার করছে, কেউ বিয়ে না করে একসঙ্গে থাকছে। যারা প্রেমে পড়ছে তাদের সংখ্যা বেশি নয়। কারণ আজকের এইসব ছেলেমেয়েরা প্রথমে নিজেদের কেরিয়ারের কথা ভাবে। কেরিয়ারকে জলাঞ্জলি দিয়ে আবেগকে আঁকড়ে ধরার মতো মূর্খামি বেশিরভাগই করতে নারাজ। কলকাতায় কলেজে পড়ার সময় প্রেম, চাকরি নিয়ে কেউ দিল্লিতে, কেউ কর্নাটকে কিন্তু নিত্য টেলিফোনে কথা হয়। তারপর এক ছুটিতে কলকাতায় এসে ওরা বিয়েটাও করে ফেলল। করে ফিরে গেল যে যার শহরে। একসঙ্গে ছুটি নিতে পারলে দেখা হয় কিন্তু প্রেম ফুরিয়ে যায় না। এই সম্পর্কের কথা নকশাল আমলের বাঙালি বোধহয় ভাবতে পারতেন না।
ভারতবর্ষের মধ্যে ছেলেমেয়েরা যখন বিভিন্ন শহরে চাকরি নিয়ে যাচ্ছে তখন তাদের জীবনযাত্রায় কিছুটা বদল আসা খুবই স্বাভাবিক। লক্ষ করেছি, সেই সব প্রদেশের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস ওরা অনেকটাই গ্রহণ করে ফেলে। এক জায়গায় থাকতে থাকতে এটা হয়ে থাকে। এমনকী যে ছেলেটি পনেরো বছর চেন্নাইতে রয়েছে সে যখন বাংলা বলে তখন তার উচ্চারণে তামিল টান অস্পষ্টভাবে হলেও আসে।
কিন্তু ভারতবর্ষের বাইরে যখন এইসব ছেলেমেয়ে চাকরি নিয়ে যায়, বাড়ি ভাড়া করে সংসার করে, তখন লক্ষ করেছি তারা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বাস করে। সাতাশ-আঠাশ বছরের স্বামী-স্ত্রী, যারা দেশ থেকে উঁচু মাপের ডিগ্রি নিয়ে আমেরিকায় চাকরি করতে গিয়েছে তাদের একমাত্র লক্ষ্য ডলার রোজগার করা। ভোর সাতটায় চা-কফি খেয়ে স্নান সেরে বেরিয়ে পড়ে গাড়ি নিয়ে। কাছের স্টেশনের পার্কিং-এ সেটা রেখে ট্রেন ধরে অফিসে পৌঁছয় সাড়ে আটটার মধ্যে। সেখানেই কাজের ফাঁকে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ। দু’জনের আলাদা অফিস হওয়াই স্বাভাবিক। সন্ধেবেলায় একই ট্রেনে ফিরে গাড়ি নিয়ে বাড়িতে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে মেলামেশা নেই। মূল স্রোতের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। ওরা বাড়ি ফিরে ডিনার বানিয়ে খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে, ভোরে উঠতে হবে বলে। ওদের মধ্যে আমেরিকার মাটির কোনও প্রভাব নেই। এই ডলার-চাওয়া মানুষগুলো ভাবে কখনও দেশে ফিরবে মোটা টাকা নিয়ে। এক ডলার মানে তো বাষট্টি টাকা। কিন্তু তার আগেই বেশিরভাগের পায়ে অদৃশ্য সোনার শিকল জড়িয়ে যায়।
প্রবাস আর বিদেশের মধ্যে তাই বিপুল পার্থক্য।
১২
মেয়েটি যে এমন প্রস্তাব দেবে তা পাত্রপক্ষ দূরের কথা, তার বাবা মা-ও কল্পনা করেনি। সম্বন্ধ এনেছিলেন ছেলেটির মামা। টেলিফোনে বিস্তর কথাবার্তা হওয়ার পরে ছেলেকে নিয়ে মা-বাবা এবং মামা এসেছিলেন মেয়েটিকে দেখতে। এখনও বাগবাজারের মিত্র বাড়িতে যেরকম আদর আপ্যায়ন করা হয় তেমনই ব্যবস্থা ছিল। মেয়ের ঠাকুর্দা সিল্কের পাঞ্জাবি এবং শান্তিপুরি ধুতি পরে বসেছিলেন। মেয়েকে নিয়ে আসা হল। বেশ সুন্দরী, দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটি মাথা নিচু করে পাত্রের বাবা-মা এবং মামার প্রশ্নের জবাব দিয়ে যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত মা তাঁর ছেলেকে বললেন, ‘হ্যাঁ রে, তোর কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞাসা কর।’
পাত্র গলা খাঁকারি দিয়ে উচ্চারণ করল, ‘শুনলাম তুমি অনার্স গ্র্যাজুয়েট। এমএ পড়োনি কেন?’
পাত্রী কিছু বলার আগে তার ঠাকুর্দা মুখ খুললেন, ‘এই বাড়ির মেয়েরা চিরকাল শুধু মেয়েদের জন্য যেসব স্কুল বা কলেজ রয়েছে সেখানেই পড়াশোনা করেছে। ওর পিসিরাও এমএ পড়েনি। কারণ এদেশে শুধু মেয়েদের পড়ার জন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয় নেই। আমাদের পরিবারের কোনও মেয়েকে এখনও পর্যন্ত কো-এডুকেশন্যাল স্কুল-কলেজে পড়ানো হয়নি।’
পাত্রীর মা বললেন, ‘যতদিন সিনেমা হলগুলিতে মেয়েদের জন্য আলাদা জায়গা রাখা হত ততদিন আমরা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছি। আমার শাশুড়িমা সঙ্গে যেতে না পারলে বাড়ির কাজের মাসিকে নিয়ে যেতে হত। বিরামের সময় তাকে দিয়ে চানাচুর, বাদাম কিনিয়ে আনতাম।’
পাত্রের মা হাসলেন, ‘আমরা অবশ্য—। সাউথের হলগুলিতে মেয়েদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকত না। তুমি পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে কথাবার্তা বলো? মানে যাদের সঙ্গে ছেলেবেলায় খেলাধুলো করতে!’
পাত্রীর বাবা মাথা নাড়লেন, ‘না না, পরিবারের বাইরের ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশার চল আমাদের বাড়িতে নেই। এখনও পর্যন্ত এ-বাড়ির কোনও ছেলে অথবা মেয়ে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেনি। ইন্টারকাস্ট বিয়ের কথা কল্পনাও করতে পারি না।’
পাত্রের বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দ্যাখো মা, তুমি রান্না করতে জানো কি না, সেলাই শিখেছ কি না এসব প্রশ্ন করব না। আমাদের বাড়িতে ওসব করার জন্য যথেষ্ট কাজের লোক আছে। তুমি গান জানো কি না, এই প্রশ্নও অবান্তর। কারণ বাথরুমে ছাড়া গান গাইবার সুযোগ বউরা পায় না। যদি সে প্রফেশনাল গায়িকা হয় তা হলে আলাদা কথা।’
পাত্রের মা বললেন, ‘ঠিক কথা। আমি তোমাকে চুল খুলে দেখাতে বলব না। যত লম্বা চুলই হোক যদি ছেলের শখ হয় তা হলে তো আর লম্বা থাকবে না। এখন কথা হচ্ছে, তোমাকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।’
পাত্রের বাবা বললেন, ‘ছবিতে যা দেখেছিলাম তার থেকে অনেক ভাল।’
পাত্রের মামা বললেন, ‘অনেকের ফোটো ভাল ওঠে না।’
পাত্রের মা বললেন, ‘তা হলে তুমি ভিতরে যাও, অনেকক্ষণ বসে আছ।’
এবার মেয়ে মুখ তুলল। বলল, ‘আমি একটা কথা বলতে চাই।’
পাত্রের মা এবং বাবা একসঙ্গে বললেন, ‘নিশ্চয়ই। বলো।’
‘আপনারা আমাকে পছন্দ করেছেন শুনে ভাল লাগছে। এই কথা আমার মা-বাবা-দাদুকে স্বস্তি দেবে। কিন্তু—।’
পাত্রীর মা বললেন, ‘আবার কিন্তু কিসের?’
পাত্রের মা বললেন, ‘আচ্ছা, ওকে বলতে দিন মিসেস মিত্র।’
মেয়েটি বলল, ‘আমি তো ওঁকে চিনি না। কখনও দেখিওনি। দু’দিন পরে উনি বরযাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে এসে কয়েকটি মন্ত্র পড়লে আমি ওঁর স্ত্রী হয়ে যাব। তারপর উনি যা বলবেন তাই আমাকে করতে হবে।’
পাত্রীর মা কপালে চোখ তুললেন, ‘ছিঃ। এসব কী বলছিস? আমাকে, তোর ঠাকুমা-দিদিমাকে তো এইভাবে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মনে তো এইসব চিন্তা কখনও আসেনি।’
পাত্রের বাবা বললেন, ‘ওকে বলতে দিন আপনারা।’
মেয়েটি এবার স্পষ্ট তাকাল, ‘আপনারা আমাকে পছন্দ করেছেন, বাবা-মা চাইছেন আপনাদের বাড়িতে আমি পুত্রবধূ হিসাবে যাই। এসবই মেনে নিলে আপনারা সবাই খুশি হবেন। কিন্তু আমি একজন অজানা অচেনা মানুষের সঙ্গে একঘরে থাকার কথা ভাবতে পারছি না। ভাবলেই শরীর ঘিনঘিন করছে।’
পাত্রীর মা কর্কশ গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঘিনঘিন করছে?’
‘হ্যাঁ মা।’
পাত্রীর মা স্বামীর দিকে তাকালেন, ‘এইজন্য বলেছিলাম গল্পের বই পড়তে দিও না। গুচ্ছের বই কিনে দিয়ে ওর মাথা বিগড়ে দিয়েছ তুমি।’
‘আশ্চর্য কথা।’ পাত্রীর বাবা বললেন, ‘আমি তো ওকে রবীন্দ্র রচনাবলী কিনে দিয়েছি। রবীন্দ্রনাথ শত্রুতা করবেন তা আমার জানা ছিল না।’
পাত্রের বাবা বললেন, ‘তুমি কী চাইছ মা?’
মেয়েটি বলেছিল, ‘একটা বছর সময় দিন। এই সময়ে উনি ফোন করলে মা নিশ্চয়ই কথা বললে আপত্তি করবে না। সপ্তাহে একদিন কথা বললে ধীরে-ধীরে নিশ্চয়ই আমরা আমাদের বুঝতে পারব। তখন আর অচেনা মনে হবে না।’
মাথা দোলালেন পাত্রের বাবা, ‘গুড। ভেরি গুড। অত্যন্ত বুদ্ধিমতীর মতো কথা বলেছ তুমি। আমরা এক বছর অপেক্ষা করতে রাজি আছি। কী বলিস?’ ছেলের দিকে তাকালেন তিনি।
পাত্র বলল, ‘একবছর পরে যদি ওঁর মনে হয় আমার সঙ্গে মিল হচ্ছে না, তা হলে—?’
পাত্রের বাবা বললেন, ‘তা হলে অন্য জায়গায় পাত্রীর খোঁজ করবে তোর মামা। মনে রাখিস, এই একবছর কেউ কারও সঙ্গে দেখা করবি না। ও তো বের হবে না, তুই প্রভোক করবি না। ফোনে কথা বলাই ভাল। কথা বলতে-বলতে তোকে ও বন্ধু বলে ভাবে কি না দেখ।’ মেয়ের মা গম্ভীর, বাবার মুখে স্বস্তির ছাপ ফুটে উঠল।
১৩
বিখ্যাত মানুষদের তো বটেই, নিজেদের ব্যাপারেও সকলে বলেন, অমুক দিন জন্মেছি বা জন্মেছে। রবীন্দ্রনাথ পঁচিশে বৈশাখ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কথাটা বহুকাল চালু রয়েছে, তাই অনেক অনেক অসঙ্গতির মতো এটাকেও আমরা মেনে নিয়েছি।
ভ্রূণ থেকে সাত-আট পাউন্ডের শিশু-শরীর যা মাতৃগর্ভে থাকে, তাকে নিয়ে কোনও ভাবনা সচরাচর আমরা ভাবি না। মানব শরীর গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃগর্ভে যে বসবাস করছে সে একটুও জানান দেয় না। কিন্তু তার বোধশক্তি যখন জানান দিতে শুরু করে তখনই সমস্যা শুরু হয়। অন্ধকার গহ্বরকে সে ধীরে ধীরে বুঝতে চেষ্টা করে। এমনকী যে জলাশয়ে সে বাস করে তাতে এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে যে হাত-পা ছোড়ার পর্ব এলে মাঝে মাঝে মরিয়া হয়। ন’মাস দশ দিন নিরাপদে থাকার পর তাকে বাইরের পৃথিবীতে নিয়ে আসার তোড়জোড় শুরু হয়। ভাড়া না দেওয়া ভাড়াটেকে তাড়াবার জন্য জল-আলো বন্ধ করে দেন কোনও কোনও বাড়িওয়ালা। যে জলাশয়ে শিশু-শরীর স্বচ্ছন্দ ছিল তা জলমুক্ত করে দিতে প্রকৃতি দ্বিধা করল না। অনভ্যস্ত জায়গায় না থেকে শিশু-শরীর সামনেই যে পথ পাচ্ছে সেই পথ ধরেই বেরিয়ে আসবে পৃথিবীতে। হয়তো কেউ কেউ এসে যায় কিন্তু অধিকাংশই আসতে চায় না। তারা নিরাপদ বলে যে জায়গাটাকে মনে করে এসেছে, সেখানেই আঁকড়ে থাকতে চায়।
কিন্তু গর্ভবতী জননী ভারমুক্ত হতে চান। শিশু-শরীর তাঁর দেহ থেকে বেরিয়ে গেলে তিনি স্বস্তি পাবেন। তাঁকে উপদেশ দেওয়া হয়, শ্বাস বন্ধ করে চাপ সৃষ্টি করতে, যাতে শিশু-শরীর বেরিয়ে আসে। অনেক ক্ষেত্রেই এতে কাজ হয়। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখা দিলে চিকিৎসককে যন্ত্রের সাহায্য নিতে হয়। সেই যন্ত্র মাতৃগর্ভে প্রবেশ করিয়ে শিশু-শরীরকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে বের করতে হয়। কিন্তু গর্ভবতী জননীর শারীরিক গঠন যদি প্রতিবন্ধক হয় তা হলে? শিশু-শরীরের পক্ষে সেই দুয়ার যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায়? তখন গর্ভবতী জননীকে অজ্ঞান করে তাঁর পেটে অস্ত্র ব্যবহার করে শিশু-শরীরকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। অর্থাৎ প্রথমে ধাক্কা দিয়ে, নয়তো টেনে-হিঁচড়ে বের করার ব্যবস্থা, তাতে সিদ্ধ না হলে অস্ত্রের প্রয়োগ। শিশু-শরীর তার নিরাপদ জায়গা থেকে বের হবে না কিন্তু তাকে শেষপর্যন্ত বেরোতে হবে গর্ভবতী জননী এবং নিজের প্রাণরক্ষা করার জন্য। এই যে প্রতিবাদ, স্ব-ইচ্ছেয় না আসাকে আমরা গুরুত্ব দিতে চাই না। শিশু-শরীর পৃথিবীর বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে যে প্রতিবাদের চিৎকার করে ওঠে তাকে আমরা প্রথম কান্না বলি। সেই কান্নার ফলে তার শরীর সচল, স্বাভাবিক হয়। কিন্তু এই যে প্রক্রিয়া তাতে কোথাও কি শিশু-শরীরের সমর্থন থাকে? ন’মাস দশদিন পরে মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে সে এমনকী প্রমাণ দিয়েছে যে মনে হবে খুশি হয়েছে! অথচ আমরা সগর্বে বলছি, সে জন্মগ্রহণ করেছে এতে মনে হচ্ছে, সে স্ব-ইচ্ছেয় এই পৃথিবীতে এসেছে। হরিণ থেকে গরুর শিশু মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে এসে ধাতস্থ হতে সময় নেয় বড়জোর এক মিনিট। তারপরেই সে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। কয়েক মিনিটের মধ্যে টলমল করে হাঁটতে এবং দৌড়তে থাকে। এই পৃথিবীটাকে নিজের বলে ভেবে নেয়। একটি ব্যাঘ্রশাবক জন্মাবার পর সচল হতে সময় নেয় বেশ কয়েক সপ্তাহ। গরু বা হরিণশিশুর মতো জন্মাবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা লাফাতে বা দৌড়তে পারে না। এক্ষেত্রে একটি মানবশিশুর প্রয়োজন হয় অন্তত দু’বছর। একটি হরিণ বা গরুর শিশু যদি বলতে পারত, আমি জন্মগ্রহণ করেছি, তা হলে সেটাকে অস্বাভাবিক মনে হত না। কিন্তু মানুষ কখনওই বলতে পারে না, আমি জন্মগ্রহণ করেছি। বলা উচিত, জন্মাতে বাধ্য হয়েছি।
এক পরিচিত ভদ্রলোকের ছেলে আমার কাছে এলেন। পরনে শোকের পোশাক। মুখে ঈষৎ দাড়ি। বললেন, ‘জানি না আপনি শুনেছেন কি না, বাবা চলে গিয়েছেন।’ আমি বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করলাম, ‘কোথায়?’
মাথা নাড়লেন ভদ্রলোকের ছেলে, ‘বাবা মারা গিয়েছেন।!’ তাঁর শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণপত্র দিয়ে ওঁর চলে যাওয়ার পরে আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। এই ভদ্রলোক, যিনি আজ পৃথিবীতে নেই, তিনি যখন অসুস্থ হয়ে এক নার্সিংহোমে ছিলেন তখন তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। সেটা মাস আড়াই আগের কথা। তাঁর শীর্ণ চেহারায় অসুস্থতার ছাপ প্রবল থাকলেও আমায় বলেছিলেন, ‘এখন আমি আগের থেকে অনেক ভাল। তবে ডাক্তাররা কবে ছাড়বে বুঝতে পারছি না।’
বলেছিলাম, ‘চিন্তা করবেন না, খুব শিগগির ভাল হয়ে যাবেন।’
মাথা নেড়েছিলেন ভদ্রলোক, ‘বাড়ি ফেরার পরে একদিন আপনার কাছে আড্ডা মারতে যাব। বুঝলেন!’
এই মানুষটি কি চলে যেতে পারেন? পৃথিবীতে থাকার আকাঙক্ষা যাঁর প্রবল ছিল, তিনি কেন খামোকা চলে যেতে চাইবেন? তিনি কেন মরে যেতে চাইবেন? শেষ শ্বাস ফেলার আগেও যাঁর জীবিত থাকার ইচ্ছে, তাঁর শরীর নিথর হয়ে গেলে আমরা কেন বলে থাকি তিনি চলে গেলেন! তিনমাস রোগে ভুগে যে মানুষটি ক্লান্ত কিন্তু হাল ছাড়তে নারাজ অথচ ডাক্তারের কথা শুনে এবং সেবা করে করে আত্মীয়স্বজন অন্তিম সময়ের অপেক্ষা করছেন তাঁদের মানসিকতা তো আলাদা হবেই। দেহ প্রাণশূন্য হয়ে গেলে অতীব শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁরা বলবেন, ‘উনি চলে গেলেন।’ শুনলে মনে হবে যিনি নেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ স্বেচ্ছায় যাঁরা মরতে চান তাঁরা ছাড়া কেউ কোথাও যেতে চান না। আমরা আমাদের মতো কথা বলি। সেই গল্পটা মনে এল। ডাক্তার জবাব দিয়েছেন জেনে অন্তর্জলি যাত্রায় যাচ্ছিলেন এক অতি বৃদ্ধ। তাঁর মাথা ডানদিকে হেলে পড়েছে নিয়ে যাওয়ার সময়। জ্ঞান টনটনে। হঠাৎ একটি এলাকার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি মাথাটা বাঁ দিকে ঘুরিয়ে দিতে বললেন। যৌবনে যে নিষিদ্ধ এলাকায় যাওয়া-আসা ছিল শেষযাত্রায় সেই এলাকা দেখার বাসনা।
মৃত্যুর পর পুত্ররা বলবেন, ‘বাবা চলে গেলেন।’
১৪
প্রথমবার বিদেশে গিয়েছিলাম চুরাশি সালে। আমেরিকার পূর্ব থেকে পশ্চিম ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল একটি আমেরিকান যুবক, যার নাম কেন্ট মুরহেড। আমার আগে সে আর একজন বাঙালি লেখককে চিনত যাঁর নাম শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। শ্যামলদাকেও ওদের দেশ ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্বে ছিল সে! এই কেন্ট ছেলেটি যে বর্ণবিদ্বেষী ছিল তাই নয়, সে এশিয়ানদেরও অপছন্দ করত। যখন বুঝেছিলাম তখন আর আমার কিছু করার ছিল না। সেই সময় স্বাভাবিকভাবে বঙ্গসন্তানদের সংস্পর্শে আসা সম্ভব ছিল না। শুধু নিউ ইয়র্ক দেখে এবং ফিরে আসার পথে আমার বন্ধু মনোজ ভৌমিকের বাড়িতে ক’দিন থাকা ছাড়া। মনোজ এমন একজন মানুষ ছিল যে বাড়ির ভিতরে কলকাতার আবহাওয়া ধরে রেখেছিল। ছুটির দিনে পায়জামা আর চপ্পল পরে আড্ডা মারতে বের হত, যা সে সময়ের বঙ্গসন্তানরা কুনজরে দেখতেন।
পরেরবার যখন ওদেশে গেলাম তখন আমার বয়স বারো বছর বেড়েছে। সেইবার বঙ্গসন্তানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। সেই অষ্টআশি সালে পঞ্চাশের আশপাশের মানুষরা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে শ্যামল মিত্রে মগ্ন ছিলেন। নায়ক বলতে শুধু উত্তমকুমার। রবীন্দ্রনাথ পড়া হয়নি ওঁদের, কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের গান গাড়িতে বাজান। তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণের নাম শরৎচন্দ্রের সঙ্গে উচ্চারণ করেন। সমরেশ বসু এবং সমরেশ মজুমদারের মধ্যে যে বিপুল তফাত তা ওঁদের ধারণায় নেই। বেশ কয়েকজন মহিলা আমাকে কপট লজ্জা দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি খুব অসভ্য! কী করে প্রজাপতি লিখলেন! আমি পড়ার বইয়ের তলায় লুকিয়ে রেখে পড়েছি।’ ওইসব বঙ্গসন্তানের ছেলেমেয়ের সংখ্যা খুবই কম। দেখলেই বোঝা যেত নিজেদের পড়াশোনা নিয়ে তারা বেশ ব্যস্ত। কথা বলার সময় বাংলা শব্দ ব্যবহার করতে হলে হোঁচট খাচ্ছে। কিন্তু মজা লাগত এই দেখে যে ওদের বাবা-মায়েরা আমেরিকায় বসে তিরিশ বছর পিছিয়ে বাংলাকে দেখছেন। সেই সঙ্গে এটাও বুঝেছিলাম, যতই ওঁরা বাৎসরিক বঙ্গ সম্মেলন করুন না কেন তার আয়ু বেশিদিন থাকবে না।
আমার এই ধারণাটা ঠিক ছিল না। একাত্তরের স্বাধীনতা পাওয়ার পর ধাতস্থ হতে বাংলাদেশের মানুষের কিছুটা সময় লেগেছিল। তারপর তাঁরা জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলেন পৃথিবীর সর্বত্র। তা সে অস্ট্রেলিয়া হোক কিংবা ইংল্যান্ড, কানাডা হোক বা আমেরিকা। সাধারণ চাকরি। থাকা-খাওয়ার পর কিছু টাকা দেশে পাঠিয়েই তাঁরা খুশি হতেন। কিন্তু তাঁরা অবসর কাটাতেন বই পড়ে এবং গান শুনে। সেই বই শওকত ওসমান থেকে হুমায়ুন আহমেদের লেখা গল্প-উপন্যাস, আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সবরকম লেখা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান ওঁদের ঠোঁটস্থ। তখনও সুমন কবীর হয়নি। কিন্তু এসব ওঁরা পাচ্ছেন কোথায়?
খোঁজখবর নিয়ে জানলাম নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটে একটি বাংলাদেশি ছেলে উদ্যমী হয়েছে। তাঁর মনে হয়েছে এত যে বাঙালি রয়েছে চারপাশে তারা নিশ্চয়ই বাংলা বই পড়বে, গান শুনবে। দুঃসাহসে ভর করে সে একটা দোকান খুলে ফেলে নাম রাখল মুক্তধারা। ছেলেটির নাম বিশ্বজিৎ সাহা। এই দোকানের কল্যাণে আমেরিকা-কানাডায় বাংলাদেশিরা বাংলা সাহিত্য এবং সংগীতের স্বাদ নিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। মুক্তধারার দেখাদেখি আরও কিছু বই-ক্যাসেট এবং পরে সিডির দোকান খুলে গেল। একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করতাম, ওঁরা আলুভর্তা, বেগুনভর্তা কথা বলার সময় বলেন। বাংলাদেশের লেখকরা তাঁদের গল্প-উপন্যাসে ভর্তাই লিখে থাকেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা যখন আলুসেদ্ধ, বেগুনপোড়া অথবা তরকারি লেখেন তখন তা পড়তে ওঁরা বিন্দুমাত্র অসুবিধায় পড়েন না। মুখের ভাষা বদলাচ্ছে। বাংলাদেশে যেসব শব্দ ব্যবহার করতেন তার সঙ্গে আমেরিকান শব্দ যোগ হচ্ছে কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে ভালবাসা কমছে না।
লক্ষ করেছিলাম, প্রথমদিকে যাঁরা ভাল চাকরি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ওদেশে গিয়েছিলেন, গ্রিন কার্ড পেয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত নাগরিক হয়ে গিয়েছেন তাঁদের বয়স এখন সত্তর পেরিয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ আশির উপরে। অনেকেই চলে গিয়েছেন। যাঁরা আছেন তাঁরা কেউই প্রায় বাংলা বই-এর দোকানে গিয়ে বই কেনেন না। যাঁদের বয়স চল্লিশের নিচে তাঁদের বাংলা পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়নি। বালক-বালিকারা তো অক্ষরই চেনে না। বয়স্কদের যখন জিজ্ঞাসা করেছি কেন এখানকার দোকান থেকে বই কিনতে চান না তখন বেশ মজার উত্তর শুনেছি, কেন যাব? একশো টাকার বই ওরা আট ডলারে বিক্রি করে। আট ডলার মানে প্রায় পাঁচশো টাকা। মানছি, নিয়ে আসার খরচ আছে কিন্তু ওই টাকা দিতে গা করকর করে। তার চেয়ে প্রতিবছর কোনও না কোনও পরিচিত মানুষ কলকাতায় যাচ্ছে। তাদের বলি, পছন্দমতো বই কলেজ স্ট্রিট থেকে কিনে আনতে। একশো টাকার বই ওখানে আশি টাকায় পাওয়া যায়।’ বলেছি, ‘বাঃ, তা হলে তো ভালই। নিশ্চয়ই বই পেয়ে যান।’
পাশে বসা বৃদ্ধের স্ত্রী খিঁচিয়ে ওঠেন, ‘ছাই পাঁশ। যার বাড়ি গড়িয়ায় সে কোন দুঃখে ওর জন্য কলেজ স্ট্রিটে যাবে? একজন তো এনে দিল বাংলা অভিধান। ওর পাড়ার দোকানে পেয়েছে। ওর জন্য আমি মুখ্য হয়ে বসে আছি। মরে গেলে ডলার সঙ্গে নিয়ে যাবে।’
নাগরিকত্ব পাওয়ার পরও এক ডলার মানে সাড়ে বাষট্টি টাকা, একথা ভোলা সম্ভব হচ্ছে না ওই প্রজন্মের।
গতবার ঢাকায় গিয়ে অনেক বাড়িতেই নালিশ শুনেছিলাম, ছেলেমেয়েরা যা বাংলা বলে তার অনেক বেশি ইংরেজি হিন্দি বলছে। ঢাকায় হিন্দি? কেন বলবে না। দিনরাত টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখে দেখে নিজেদের মধ্যেই হিন্দিতে কথা বলছে কিশোর প্রজন্ম। রেগে গেলেও বয়স্কদের কিছু করার নেই।
এই কথা মনে রেখে গত একমাসে অন্তত পনেরোটি বাড়িতে গিয়েছি খোঁজ-খবর নিতে। জেনেছি, শিক্ষিত সম্পন্ন পরিবারের বাঙালিরা কেউই বাংলা গল্প-উপন্যাস পড়েন না। তাঁদের সময় নেই। অতি বয়স্করা হাই চেপে বললেন, ‘পড়ব যে লেখক কোথায়? আমাদের সময় বিভূতিবাবু, তারাশঙ্করবাবু, অচিন্ত্যবাবুরা ছিলেন। বড় গাছগুলি আজ নেই, এখন তো ঢ্যাঁড়শগাছকেই গাছ বলতে হচ্ছে। তার চেয়ে সিরিয়াল দেখেই সময় কাটে।’
এখন কি তা হলে নিউইয়র্ক-কলকাতায় অনেক বাঙালি এক হয়ে গিয়েছেন?
১৫
বছর পঁয়তাল্লিশের মানুষটিকে আমরা খুব পছন্দ করি। ওর নাম রামচন্দ্র, বাড়ি ঝাড়খণ্ডের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। কলকাতায় এসেছিল ভাগ্যান্বেষণে। ভাসতে-ভাসতে পৌঁছে গিয়েছিল আমার এক বন্ধুর অফিসে। বছর আটেক সেখানে পিওনের চাকরি করেছে সে। অত্যন্ত বিনয়ী, কোনও কাজ ফেলে রাখে না, ওকে কোনও দায়িত্ব দিলে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। বন্ধুর মুখে কথাগুলি শুনতাম। মাঝে-মাঝে রামচন্দ্রকে আমার কাছে পাঠায় সেই বন্ধু কোনও কাজে। তখন কথা বলে দেখেছি, বন্ধুর লোক চিনতে ভুল হয়নি।
প্রতি বছর রামচন্দ্র কুড়ি দিনের ছুটি নিয়ে দেশে যায়। ছুটি ফেরত যেসব দিশি খাবার নিয়ে আসে, তার কিছুটা আমাকেও দিয়ে যায়। ওর স্ত্রীর তৈরি সেগুলি। খেতে পারি বা না পারি, খাবারগুলিতে অন্যরকম স্বাদ পাই। দিন পনেরো আগে বাৎসরিক ছুটি নিয়ে রামচন্দ্র তার ঝাড়খণ্ডের গ্রামে গিয়েছিল পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যেই ফিরে এল সে। সচরাচর এমন ঘটনা ঘটে না। যারা একবার দেশে যায়, তারা যবে ফিরবে বলে যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি দিন কাটিয়ে আসে। বন্ধুর ফোন পেলাম, ‘একবার অফিসে এসো, খুব জরুরি।’
বন্ধুর অফিসে যেতে সে রামচন্দ্রকে ডেকে পাঠাল। বলল, ‘আমার মাথা খুব গরম হয়ে আছে। তুই ওর মুখেই ব্যাপারটা শোন।’
রামচন্দ্র এসে হাতজোড় করে দাঁড়াল, এই ক’দিনেই তার চেহারা খুব খারাপ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ভয়ঙ্কর সমস্যায় আছে সে।
রামচন্দ্র যা বলল তা এইরকম—! এবার দেশে যাওয়ার পরের দিন গ্রামের মুখিয়া তাকে ডেকে পাঠায়। সে যেতেই মুখিয়া বলে, ‘তোমার মেয়ের বয়স এখন তেরো, তাই তো? রামচন্দ্র বলেছে, ‘বারো বছর দুই মাস।’
‘ওই হল। বারো পেরিয়ে তেরোতে পড়েছে। তিন মাসের মধ্যে ওর বিয়ে দিতে হবে তোমাকে। ওই বয়সের অবিবাহিতা মেয়ে এই গ্রামে থাকুক তা আমি চাই না।’ খুব গম্ভীর গলায় মুখিয়া ঘোষণা করল।
‘কিন্তু ও তো এখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। স্কুলটা পাস না করলে—।’
‘পাস করে ও কী করবে? বিডিও বানাবে মেয়েকে? মেয়েছেলেকে যা করতে হয়, ওই রান্না করা আর বাচ্চার জন্ম দেওয়া, তাই তো করবে সে। তোমাকে আমি, ঠিক আছে, চার মাস সময় দিলাম।’ মুখিয়া বলল।
‘কিন্তু এই চার মাসে আমি পাত্র পাব কোথায়?’
‘ও নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। মহেশমুণ্ডায় আমার এক জ্ঞাতি থাকে। তাদের মুদির দোকান আছে। ওর ছোট ছেলে সেই দোকানে বসে। বয়স কুড়ি-একুশ। আগামী রবিবার ছেলের বাপ এসে তোমার মেয়েকে দেখে যাবে। ওর জন্য আদর-যত্নের ব্যবস্থা করবে।’
পাত্রের বাবা এসেছিল। মেয়েকে দেখল। মেয়ে কিছুতেই দেখা করতে চাইছিল না। রামচন্দ্রের বউ জোর করে হাজির করেছিল। পাত্রের বাবা বলেছিল, নগদ আশি হাজার টাকা, একটা মোটর বাইক দিলেই হবে। সোনা যা মেয়েকে দেওয়ার দেবেন। কিন্তু পাঁচশো বরযাত্রীর খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। টাকা আর মোটর বাইক মহেশমুণ্ডায় পৌঁছে গেলে বরযাত্রীরা বরকে নিয়ে আসবে।’
বরের বাবা চলে গেলে মুখিয়ার কাছে ছুটে গিয়েছিল রামচন্দ্র। এত টাকা সে কোথায় পাবে? কলকাতায় যে অফিসে সে কাজ করে, সেখানে তার মাইনে মাসে আট হাজার টাকা। নিজের থাকা-খাওয়া ইত্যাদির খরচ মিটিয়ে সে চার হাজার টাকা মাসে পাঠাতে পারে। চাষবাস করে যা পাওয়া যায়, তাতে কোনও রকমে পরিবারের খাওয়া-পরা সামলানো যায়। ওই চার হাজার অন্য প্রয়োজনে লাগে। হাতে জমানো টাকা খুব কম। কী করে সে দাবি মেটাবে।
মুখিয়া নাছোড়বান্দা। এত ভাল পাত্র আর পাওয়া যাবে না। ওই ছেলে যদি সরকারি চাকরি করত, তা হলে পিওন হলে দু’লাখ চাইত। তাছাড়া মুখিয়ার মুখ চেয়ে চল্লিশ ভরি সোনা চায়নি।
বাড়িতে কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল। মুখিয়া পরের দিন ডেকে বলল, ‘হিসাব করে দেখলাম বিয়েতে সাড়ে তিন লাখ খরচ হবে। আমি তিন দেব তোমাকে মাসে শতকরা দু’টাকা সুদে। দশ বছরে শোধ করতে হবে। তবে তার জন্য তোমাকে চাষের জমি বন্ধক রাখতে হবে। ভেবে দ্যাখো।’
চাষের জমি বাঁধা রেখে মেয়ের বিয়ে দিলে, না খেয়ে মরতে হবে না। রামচন্দ্র আর চাপ সহ্য করতে না পেরে কলকাতায় ফিরে এসেছে।
বন্ধু বলল, সব শুনলে! আমি ওকে বলেছিলাম বউ আর মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসতে। আমি থাকার ব্যবস্থা করে দেব। হাজারখানেক টাকা বাড়িয়ে দেব। ও বলছে, এখন নাকি সবার সামনে বউ-মেয়েকে নিয়ে আসতে দেবে না। ভাবো! তুমি ভাবছ ওই মুখিয়া দেবে না, তাই তো! না, দেবে না ওর জ্যাঠা-কাকারা। নির্দেশ অমান্য করে ও পরিবার নিয়ে চলে এলে, ওর সব জ্ঞাতিগুষ্টির ধোপা কাপড় বন্ধ হয়ে যাবে। ওদের চাষের খেতে কেউ কাজ করবে না। পাড়ার মুদিওয়ালা জিনিস বিক্রি করবে না। ভয়ঙ্কর সেই জীবনে যাতে পড়তে না হয়, তাই জ্ঞাতিগুষ্টিরাই রামচন্দ্রের মেয়ে-বউকে কলকাতায় আসতে দেবে না।’
‘থানায় গেলে সাহায্য পাওয়া যাবে না?’ জিজ্ঞাসা করলাম।
‘থানা’ বন্ধু হাসল, ‘তুমি ওই হিন্দি সিনেমাটা দ্যাখোনি বোধ হয়। যেখানে একজন পুলিশ অফিসার বলছে মুখিয়ার বিরুদ্ধে গেলে ধোপা কাপড় বন্ধ হয়ে যাবে। তখন পরিবার নিয়ে বাস করা পুলিশ অফিসার কী করে বাঁচবেন?’
ছবিটা আমি দেখেছি। বোন পাশের গ্রামের ছেলের সঙ্গে প্রেম করেছিল। বাড়ি থেকে পালাচ্ছিল। তার মা ছেলেকে বলেছিল উপযুক্ত শাস্তি দিতে। ছেলে তার বন্ধু, মামা ইত্যাদিকে নিয়ে বোন এবং তার প্রেমিককে ধরে ফেলে প্রেম করার অপরাধে কুপিয়ে-কুপিয়ে যন্ত্রণা দিয়ে পৈশাচিক আনন্দ পেয়ে মেরে ফেলেছিল। মেরে গর্তে ফেলে মাটিচাপা দিয়েছিল। ওটা তাদের পারিবারিক ব্যাপার বলে পুলিশ চোখ বন্ধ করে ছিল। এই ঘটনা দু’হাজার চোদ্দো সালের। দু’হাজার পনেরোর আধুনিক ভারতবর্ষে যখন উন্নয়নের বাজনা সজোরে বাজছে, তখন রামচন্দ্রর মতো বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশের মানুষদের কানে সে বাজনা পৌঁছচ্ছে না।
১৬
ঠিক পঞ্চাশ বছর পরে কলেজ স্ট্রিটের গেট পেরিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ঢুকলাম। পঞ্চাশ বছর বিরাট সময়। পরিবর্তন স্বাভাবিক। বাড়িগুলি অচেনা লাগলেও আশুতোষ হলের সিঁড়িতে পা দিতেই মনে হল আমার বয়স পঞ্চাশ বছর কমে গেল এক লহমায়। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই স্যরের মুখোমুখি হয়ে গেলাম। ধুতি পাঞ্জাবি, হাতে ব্যাগ, স্যর অত্যন্ত হতাশ গলায় বললেন, ‘একি করলে তুমি। আমার পেপারটায় এত ভাল লিখলে, অন্যগুলো মাঝামাঝি, তবু ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া আটকাত না, কিন্তু পালি প্রাকৃত ভাষাতত্ত্বে কোনওরকমে পাস নম্বর? এত অবহেলা করলে?’ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলাম।
এদিনও কিন্তু স্যার সামনে ছিলেন না। ঘটনাটি ঘটেছিল পঞ্চাশ বছর আগে। এমএ পরীক্ষা দেওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরে। মাথা নিচু করে যাঁর ভর্ৎসনা শুনেছিলাম, তিনি তামাম ছাত্রদের মাস্টারমশাই, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর গল্প-উপন্যাস- রম্যরচনায় মুগ্ধ আমি, কেন যে স্যর সম্বোধন করতাম, তা এখনও বুঝতে পারি না।
দোতলায় পা দিতেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হল প্রফেসারদের বিশ্রামঘরে। এই ঘর এখনও স্মৃতিতে স্পষ্ট। ঢুকে দেখলাম পিনাকেশ সরকার এবং শিশির মজুমদারকে। আমার সহপাঠী। পিনাকেশ তো সেই স্কটিশচার্চ কলেজের প্রথম বর্ষ থেকে আমাকে চেনে। বহু বছর বাদে দেখা। ওরা সারাজীবন অধ্যাপনা করেছে, পণ্ডিত হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমি এই পঞ্চাশ বছর বাদে ফিরতে পারলাম।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রদের একত্রিত করার চেষ্টা হচ্ছিল অনেকদিন ধরে। বন্ধু সুভাষ দত্তের কাছে শুনেছিলাম। অশোককুমার কুণ্ডু এবং সুভাষ দত্ত আমাকে ডেকেছিলেন কিন্তু যাব যাব ভেবেও যাওয়া হয়নি। এবার পিনাকেশ এবং শিশিরের আমন্ত্রণ এড়াতে পারলাম না।
দু’বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটাতে হয়েছিল। প্রথম দু’সপ্তাহে ঠিক করে নিয়েছিলাম কোন-কোন অধ্যাপকের ক্লাসে থাকব। এক নম্বরে ছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। তারপর শংকরীপ্রসাদ বসু, প্রমথনাথ বিশী, রথীন রায়। আশুতোষ ভট্টাচার্য, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, হরপ্রসাদ মিত্ররা ছিলেন দ্বিতীয় পছন্দের। এড়িয়ে যেতাম অধ্যাপক বড়ুয়া আর অধ্যাপক মহেশ্বর দাশের ক্লাস। দ্বিতীয়জন যখন পড়াতেন তখন আমরা কফি হাউসে জমিয়ে আড্ডা মারছি। তারই ফলশ্রুতি ওঁদের পেপারে কোনওমতে পাস করা। তাও হত না, যদি দুষ্টুমি না করতাম।
আমাকে নিয়ে যাওয়া হল সেই ঘরে যেখানে একসময় ক্লাস করেছি। ডায়াসে উঠে চমকে গেলাম। ক্লাসরুমে ছাত্রছাত্রী গিজগিজ করছে। ডানদিকে কয়েকজন প্রবীণ নারী-পুরুষ বসে আছেন! যখন শিশির বক্তৃতা দিচ্ছে তখন আমি ছাত্রসংখ্যা গুনতে চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলাম। যখন এখানে ছাত্র হিসাবে বসতাম তখন এক-তৃতীয়াংশ ছাত্রী একপাশে বসতেন। কনুই থেকে আঙুল, সিঁথি থেকে গলা ছাড়া তাঁদের শরীর সতর্ক শাড়ির আড়ালে থাকত। তাঁদের কেউ-কেউ আমাদের সেইসব বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতেন, যাদের চট করে ভাই বলে মনে হত। অন্তত পঞ্চম বর্ষের ক্লাসে তাঁদের বেশ গম্ভীর মনে হত।
আজ সামনের দিকে তাকিয়ে আর একবার মনে হল পঞ্চাশ বছর সময়টা যে এর মধ্যে চলে গিয়েছে, তা এতদিন তেমন করে টের পাইনি। পঞ্চাশ বছর আগে আমি যে জীবনযাপন করতাম, তা এখনও করে চলেছি। কিন্তু এই ক্লাসের ছবিটা দুরন্ত বদলে গিয়েছে এর মধ্যে। মেয়েদের সংখ্যা শতকরা আশি। ক্লাসরুম যেন তাদেরই দখলে। তবে এখনও একটা চরিত্র বদলায়নি। যে ছেলেটি আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছে, একটু আক্রমণাত্মক, তার সঙ্গে আমাদের সময়ের কিছু আঁতেলের চমৎকার মিল রয়েছে। কিন্তু এই যে মেয়েরা, আজকের পোশাকে অভ্যস্ত, সরাসরি তাকাতে যাদের অসুবিধা হচ্ছে না, মনে যা জমছে, তা মুখে উগরে দিচ্ছে, এই ক্লাসরুমে বসে আমাদের সময়ের মেয়েদের কথা বারংবার মনে পড়ছিল এদের দেখে। আজও ওঁরা যদি এদের পাশে এসে বসতেন!
আমাকে কথা বলতে হল। আমাদের সময়ের গল্প। এই ক্লাসরুমে যেসব ঘটনা ঘটে গিয়েছে তার বিবরণ। শংকরীপ্রসাদ বসু পড়াতেন বৈষ্ণব পদাবলি। তাঁর কণ্ঠস্বর সপ্তগ্রামে বিচরণ করত। তারই মধ্যে অবাধ্য ছাত্রদের ধমক দিতেন। সেটা পড়ানো না ধমক বোঝার আগেই পদাবলিতে ফিরে যেতেন। ছোটগল্প নিয়ে খুব গভীর আলোচনা করছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। হঠাৎ লক্ষ করলেন, আমি রণেন্দুর সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলে চলেছি। আমাকে দাঁড় করিয়ে বললেন, “আপনাকে জানাই, আমরা এখানে ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা করছি। আচ্ছা, আপনার প্রিয় ছোটগল্পের নাম জানতে পারি? এক মুহূর্ত দেরি না করে উত্তর দিলাম, ‘টোপ’। শোনামাত্র চোখ বন্ধ করে স্যর বললেন, ‘বসতে পারো।’ নিজের লেখা গল্প নিয়ে কথা না বলাটাই ওঁর ভাল মনে হয়েছিল।
অপছন্দের বিষয় ছিল ভাষাতত্ত্ব। যতটা না বিষয় তার চেয়ে পছন্দ হত না পড়ানোর ধরন। পরের দিন ভাষাতত্ত্বের ক্লাসে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। এবং জেনেছিলাম সেদিন ‘বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দ’ আলোচনার বিষয় হবে। সুকুমার সেনের ভাষাতত্ত্ব বইটি খুলে চোখ বুলিয়েছিলাম। সারা বছর না পড়ে একবার চোখ বোলালে কিছুই হয় না। ক্লাসে ঢুকেই মহেশ্বর দাশ মশাই হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘এমন একটি বাক্য বলো যার মধ্যে কোনও দিশি শব্দ নেই।’ আমি চোখ বোলানো শব্দ মনে করে বলে ফেললাম, ‘নরম গরম সাদা কোমর পছন্দ।’ সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসে হাসির ফোয়ারা ছুটল। মহেশ্বর দাশ মশাই ছিটকে বেরিয়ে গেলেন। তার পনেরো মিনিট পরে অধ্যাপকদের ঘরে আমার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হল। প্রমথবাবু, নারায়ণবাবু থেকে সবাই আছেন। মহেশ্বর দাশমশাই অভিযোগ করেছেন যে আমি তাঁকে অশ্লীল কথা বলেছি। প্রমথনাথ বিশী বললেন, ‘যদিও সব ক’টি শব্দ বিদেশি কিন্তু গরম সাদা কোমর মানে কী? কোমর কি কখনও গরম হয়? এটাতেই বোধহয় মহেশ্বরবাবুর আপত্তি। তাই না?’ মহেশ্বরবাবু বললেন, ‘ঠিক ঠিক।’ হঠাৎ শংকরীপ্রসাদবাবু হাসলেন, ‘শ্রীরাধার জ্বর হলে তাঁর কোমর গরম হয়ে যেত।’ প্রমথনাথ বিশী হেসে বললেন, ‘তাই? তা হলে তো সমরেশ গরম সাদা কোমর পছন্দ করেছে মানে অসুস্থ মানুষকে সেবা করতে চেয়েছে। যাও হে।’
পঞ্চাশ বছর পরেও আমার সমস্ত স্যরদের, মাস্টারমশাইদের আমি ওই আশুতোষ হলের ঘরে বারান্দায় অনুভব করছিলাম। মনেই হচ্ছিল না, ওঁরা আজ কেউ নেই। আর সব চেয়ে সত্যি যে অনুভূতি, নিজেকে এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে বোধ হচ্ছিল।
১৭
অল্প বয়সে এর মুখে, ওর মুখে শুনে শুনে আমাদের মনে কিছু ছবি তৈরি হয়ে যায়। বিশেষ করে যাঁকে কেন্দ্র করে গপ্পোগুলো শুনেছি, তিনি যদি বিখ্যাত মানুষ হন, তা হলে তা মনে গেঁথে থাকে চিরকাল। বেশিরভাগ মানুষ বয়স বাড়লেও এর সত্যাসত্য বিচার করার কথা চিন্তা করেন না। প্রসঙ্গ উঠলেই বহুকাল আগে শোনা গপ্পোটিকে সত্যি ভাবাতে তৎপর হয়ে ওঠেন। যেমন পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘুরছে এই অসত্যকে যারা সত্য বলে আঁকড়ে ধরেছিল, তারা যদি স্বার্থান্বেষীদের কাছ থেকে একটু বেশি কদর পেত তা হলে, কে জানে, আমরা আজও হয়তো চোখ বন্ধ করে থাকতাম।
তখন স্কুলের ছাত্র আমি, নবম শ্রেণির। সদ্য ভর্তি হওয়া কলকাতা থেকে আসা এক সহপাঠী ঠাট্টার গলায় বলল, ‘ভাগ। বেশি রবিঠাকুর রবিঠাকুর করিস না। লোকটা বউদির সঙ্গে প্রেম করত কিন্তু বিয়ে করল অন্য মেয়েকে। সেই দুঃখে বউদি আত্মহত্যা করেছিল। তখনকার দিন তো, রবিঠাকুরের বাবা পুলিশকে ম্যানেজ করে ফেলেছিল। এখন হলে খবরের কাগজের প্রচারে রবিঠাকুরের পাঁচবছর জেল হয়ে যেত।’
কথাগুলো এমন দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিল যে শুনে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু মফসসল শহরের একটি ছাত্রের কাছে বিপরীত তথ্যও ছিল না বলে শরণাপন্ন হয়েছিলাম নবীন বাংলার শিক্ষকের। তিনি গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, ‘বিখ্যাত মানুষদের ওরকম একটু হয়েই থাকে। ওসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ওঁর লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ছোটবেলা পড়। তা হলেই হবে।’
ওটা সেই বয়স যখন কেউ যদি বলে তুমি দক্ষিণ, পশ্চিম, পূর্বদিক যেতে পারো কিন্তু কখনওই উত্তরদিক নয় তখন মন চায় লুকিয়ে চুরিয়ে উত্তর দিকেই যেতে। ‘নষ্টনীড়’ পড়ার পর মনে হল এই তো রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট আত্মকথন, চারু আর কাদম্বরী একাকার হয়ে গেল। তার প্রচার এত প্রবল হল যে কোনও কলেজের সহপাঠী যদি তার বউদির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হত তা হলে তাকে নির্দ্বিধায় অমল বলে ভেবে নিতাম। সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ ছবি দেখতে গিয়ে অনেক প্রবীণকে গম্ভীর গলায় বলতে শুনেছি, ‘বুঝলে হে, এটি রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনী।’ আমার হোস্টেলের একটি যুবক ছবি দেখার পর এমন সত্যজিৎ-বিরোধী হয়ে পড়েছিল যে তাঁকে আক্রমণ করে চিঠি লিখেছিল বেশ কয়েকটা। যদিও একটিরও উত্তর আসেনি। তার বক্তব্য ছিল, রবীন্দ্রনাথ ‘নষ্টনীড়’ লেখার সময় রেখে-ঢেকে লিখেছিলেন তাঁদের পরিবারের কথা ভেবে, সত্যজিৎ রায়ের তো সেই দায় ছিল না। কেন ছবির শেষে চারুলতা আত্মহত্যা করল না? বাস্তবের কাদম্বরী নাকি দু’দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। সত্যজিৎ রায় ওই দু’দিন ধরে চারুলতার মৃত্যুযন্ত্রণার সঙ্গে আমাদের বুঝিয়ে দিতে পারবেন ভালবাসা কারে কয়? চলচ্চিত্র তো সাহিত্যের অনুবাদ নয়, চলচ্চিত্রে পরিচালকদের উদ্ভাবনী শক্তি চলচ্চিত্রকে সাহিত্য থেকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়। ওর ক্ষোভ সে কারণেই।
আমার বিশ্বাস, ‘চারুলতা’ অত্যন্ত উঁচু মানের ছবি হলেও, সত্যজিৎ রায়ের প্রথম তিনটি ছবির একটির মর্যাদা পেলেও দর্শকের একাংশ রবীন্দ্রনাথের অবৈধ প্রেমের সন্ধানে ছবি দেখতে গিয়েছিলেন। তাঁরা সে সময় হতাশ হলেও মুখ খোলার বোকামি করেননি।
লক্ষ করেছি, বাঙালি পাঠক চিরকালই অন্যের কেচ্ছা পড়তে পছন্দ করে। এই অন্য যদি বিখ্যাত ব্যক্তি হন তা হলে পছন্দ আকাশছোঁয়া। গত শতাব্দী শেষ হয়েছে মাত্র পনেরো বছর আগে। বাংলা ভাষায় ওই ধরনের কেচ্ছাকাহিনি কোন বিখ্যাত বা অখ্যাত লেখককে লিখতে দেখেছি বলে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। লেখকরা জীবনী লিখেছেন। কম বেশি অনুগত থেকেছেন যাতে সত্যভ্রষ্ট না হন। শ্রীম-র কথামৃত তো প্রায় ধর্মগ্রন্থ হয়ে গিয়েছে তার বিশ্বস্ততার জন্য। রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনী সাহিত্যের প্রথম শ্রেণির নিদর্শন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সাহিত্য এবং জীবনের মিলনগ্রন্থ। এইসব লেখার পথ ধরে পরবর্তীকালে অনেক জীবনীগ্রন্থ আমরা পড়েছি, যা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি।
সাহিত্যে অশ্লীলতা আবিষ্কার করে কোনও কোনও বইয়ের বিরুদ্ধে আদতে যাওয়া হয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর ‘রাতভর বৃষ্টি’ এবং সমরেশ বসুর ‘বিবর’ অশ্লীল গ্রন্থ, যা মানুষকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে বলে যে মামলা করা হয়েছিল, আদালত তার সঙ্গে একমত হয়নি। ভাবতে অবাক লাগে, চিৎপুর থেকে যেসব যৌনলীলার বিকৃত বিবরণ মলাটবিহীন চটি বই হয়ে বের হত, কিশোর-তরুণদের একাংশ যা লুকিয়ে পড়ত, যার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক ছিল না, তার বিরুদ্ধে কোনও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হয়তো প্রকাশক বা মুদ্রকের নাম ওই চটি গ্রন্থে ছাপা থাকত না। কিন্তু এটাও ঠিক, ওই অশ্লীল গ্রন্থগুলোতে কোনও বিখ্যাত বা নামী লেখককে নিয়ে কল্পিত গল্প বলা হয়নি।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যা হয়নি, তা হতে পারত ভেবে নিয়ে রসাল লেখা লিখলে যে পাঠকের মুখ থেকে গল্প গড়াতে বাধ্য তা পরিকল্পনা করার পিছনে অতি চতুর ব্যবসাবুদ্ধি কাজ করেছে। ইতিমধ্যে আমরা জেনে গিয়েছি, কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার কারণ রবীন্দ্রনাথ নন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবীর দাম্পত্য জীবনে যে ভাঙন দেখা দিয়েছিল তারই পরিণতি আত্মহত্যা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নটী বিনোদিনীর প্রতি আসক্ত হয়েছিলেন। এই আসক্তির কথা জেনে দেবেন্দ্রনাথ রুষ্ট হয়েছিলেন। স্বামীর জামার পকেটে বিনোদিনীর লেখা চিঠি কাদম্বরী দেবী পেয়েছিলেন কি? পেলে কাদম্বরী দেবীর মানসিক অবস্থা কি স্বাভাবিক থাকা সম্ভব ছিল? কিন্তু স্বামীর সঙ্গে বিরোধের কারণে ওই আত্মহত্যার কাহিনি লিখলে পাঠক কখনওই উদ্দীপ্ত হত না। বউদির সঙ্গে দেওরের স্বাভাবিক বন্ধুত্ব নিয়ে এতকাল যে কল্পকাহিনি মুখে মুখে চালু ছিল তা কাগজে ছাপা হল কল্পিত কাহিনিসূত্র ব্যবহার করে। সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার বাঙালি পাঠক রসের সন্ধানে সেই কাহিনিগ্রন্থ কিনতে লাগলেন। তর্ক শুরু করলেন যা লেখা হয়েছে সেটাই সত্যি, কল্পনা-টল্পনা নয়। হায়! এরপরে যদি ‘নিবেদিতার সঙ্গে সারারাত’ জাতীয় কোনও কল্পিত কাহিনি কেউ লেখেন তা হলে তাঁকে কে থামাবে? গত শতাব্দীতে যা কোনও লেখকের রুচিতে আসত না, যাকে সাহিত্য বলা যায় কি না, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে তা এখন বেমালুম লেখা শুরু হয়ে যাবে।
রবীন্দ্রনাথের দুর্ভাগ্য, তিনি বাঙালি। না হলে তাঁকে নিয়ে এই নতুন কালোবাজার তৈরি হত না।
১৮
উনিশশো ষাট সাল। হায়ার সেকেন্ডারির বেড়া পেরিয়ে জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় এসে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হয়েছি, হস্টেলে জায়গা পেয়েছি। পঞ্চান্ন বছর আগে আমাদের ক্লাসে ছাত্র ছিল চল্লিশ জন, ছাত্রী একজন। প্রথম বছরে তিনি ক্লাসে আসতেন অধ্যাপকদের পিছনে হেঁটে। বেরিয়ে যেতেন তাঁদের অনুসরণ করে। বসতেন একটা লম্বা বেঞ্চিতে, একা। তাঁর গলা থেকে পা শাড়িতে ঢাকা, কবজি পর্যন্ত জামার হাতা। আমাদের সঙ্গে কথা বলা দূরের কথা, চোখ তুলে তাকাতেনও না। দ্বিতীয় বর্ষে জামার হাতা কবজি থেকে কনুইয়ে উঠল, অধ্যাপকদের সঙ্গ ছেড়ে একাই ক্লাসে আসা শুরু করলেন। আমাদের মধ্যে যারা সাহসী, তারা কথা বললে তিনি জবাব দিতেন। কিন্তু আপনির নিচে নামেননি।
উনিশশো ষাট সাল। আমাদের সহপাঠীদের কেউ কেউ ধুতি পরে ক্লাসে আসত। ধুতির উপর ফুলশার্ট। যেমন পিনাকেশ সরকার। বহু বছর পরে সেদিন তাকে দেখলাম। সেই একই পোশাকে। বিএ, এমএ-তে প্রথম শ্রেণি পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেও একই পোশাকে রয়ে গিয়েছে। আমরা ফুলপ্যান্ট পরতাম। হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত অনেকটাই ঢোলা। প্রায় পায়জামা প্যান্ট। কেউ চোঙা প্যান্ট পরে এলে গোটা কলেজ তার দিকে তাকিয়ে থাকত।
উনিশশো ষাট সাল। এক সহপাঠী আমার কাছ থেকে বই চেয়ে নিয়ে তিনদিন কলেজে না আসায় অসুবিধায় পড়েছিলাম। তার ঠিকানা জোগাড় করে এক দুপুরবেলায় হাজির হয়েছিলাম বাগবাজারের বাড়িতে। দোতলা বাড়ির দুটো দরজা। একটা বারান্দায় ওঠে, অন্যটা পাশ দিয়ে। প্রথম দরজায় কড়া নেড়ে কারও সাড়া না পেয়ে বাধ্য হলাম দ্বিতীয়টিতে শব্দ করতে। সেটা টিনের দরজা, কোনও কড়া নেই। তৃতীয়বার শব্দ করতেই ভিতর থেকে মহিলার রাগী কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘কে? কে শব্দ করে? ভরদুপুরে কোন হতভাগা?’ আমি হকচকিয়ে গিয়ে টিন এবং ইটের দেওয়ালের মাঝখান দিয়ে ভিতরটা দেখার চেষ্টা করলাম। ভিতরটায় বড় উঠোন বোঝার সঙ্গে-সঙ্গে একটি মূর্তিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম যার হাঁটু থেকে বগল পর্যন্ত একটা বড় গামছার আড়াল। দেখামাত্র ভয় পেয়ে চোঁ চোঁ দৌড় মারা ছাড়া অন্য কথা ভাবতে পারিনি।
উনিশশো ষাট সাল। আমি হস্টেলে থাকি, ওড়িশাবাসী ঠাকুরের রান্না ক্রমশ অসহ্য মনে হচ্ছে জেনে এক সহপাঠী আমাকে বলল, ‘সামনের রোববার তোকে আমার মা দুপুরে খেতে বলেছে। বারোটার মধ্যে চলে আসবি। আমরা বেশি দেরি করে খাই না।’ বেশ অবাক হয়েছিলাম। সে জানিয়েছিল আমার হস্টেলের খাবারের কথা সে তার মাকে বলেছে। তিনি বলেছেন, ‘আহা, মা বাবাকে ছেড়ে আছে ছেলেটা, ওকে খেতে ডাক।’
সহপাঠীর বাড়ির বাইরের ঘরে একজন প্রবীণ বসেছিলেন খবরের কাগজ হাতে নিয়ে। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী চাই?’ আমি সহপাঠীর নাম বললে তিনি মাথা নাড়লেন, ‘ও, তুমি। খেতে এসেছ? বসো। সে নাইতে গিয়েছে।’ প্রায় আধঘন্টা চুপচাপ বসে থাকলাম। প্রবীণ খবরের কাগজ পড়ে চলেছেন। শেষ পর্যন্ত কথা বললাম, ‘আচ্ছা, আমি মাসিমার সঙ্গে দেখা করতে পারি?’
‘মাসিমা? তিনি কে?’ প্রবীণ জিজ্ঞাসা করলেন। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। সহপাঠীর মা ছাড়া আমি আর কাকে মাসিমা বলব? উনি যে ইচ্ছে করে না বোঝার ভান করছেন, তা আমার কাছে স্পষ্ট।
সহপাঠী এল। বলল, ‘এসে গিয়েছিস! একটু বস।’
‘অনেকক্ষণ বসে আছি। চল, তোর মাকে প্রণাম করে আসি।’
‘না না। তুই এখানেই বস। আমি আসছি।’ সে ভিতরে চলে যেতেই প্রবীণ বললেন, ‘তুমি বাইরের ব্যাটাছেলে। হুট করে ভিতরে গেলে অন্দরমহলের মেয়েছেলেরা অসুবিধায় পড়বেন। তাছাড়া খুব নিকট আত্মীয় ছাড়া বাইরের ব্যাটাছেলেদের অন্দরমহলে যাওয়ার রেওয়াজ নেই। আমরা তো বাঙাল নই, আব্রু বলে একটা কথা আছে।’
আমি হতভম্ব। জলপাইগুড়িতে আমাদের বাড়িতে তো এই রেওয়াজ নেই। আমার মা-পিসিরা স্বচ্ছন্দে বাইরের ঘরে এসে গল্প করতেন। আর ঠাকুর্দার কাছে জেনেছি আমাদের আদিবাড়ি ছিল নদিয়া জেলায়। অতএব আমরা তথাকথিত বাঙাল নই। আমাকে অবাক করে সহপাঠী বড় থালায় বাটি সাজিয়ে খাবার নিয়ে এসে একটা টেবিলে রাখল, ‘আয়, খেয়ে নে।’ অর্থাৎ আমাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে খেতে দেওয়া হবে না। কিন্তু গোটা সাতেক বাটিতে সাজানো তরকারি, ডাল, মাছ এবং মাংসের মাঝখানে অনেকটা ভাত দেখে আর দেরি করলাম না। কিন্তু এ কী! যা মুখে দিচ্ছি তা এত মিষ্টিতে ভরা যে গিলতে অস্বস্তি হচ্ছে। ডাল থেকে মাংস যেন চিনির রসে রান্না হয়েছে। পরে জেনেছি, সে সময় উত্তর কলকাতার অনেক বাড়িতে রান্নায় অতিরিক্ত মিষ্টি দেওয়ার প্রবণতা ছিল।
উনিশশো ষাট সাল। উত্তর কলকাতার কোনও রাস্তায় পনেরোতে পা দেওয়া তরুণীকে শাড়ি ছাড়া দেখা যেত না। তার আগে হাঁটু আর গোড়ালির মাঝ বরাবর ফ্রক। পুরুষদের পঞ্চাশ ভাগ ধুতি পড়তেন। সিনেমা হলে মেয়েদের জন্য লেডিজ সিটের ব্যবস্থা ছিল। বাড়ির কোনও মহিলাকে কাছাকাছি কোথাও যেতে হলে কাজের লোককে সঙ্গে নিয়ে যেতে হত। রাত সাড়ে সাতটার পর কারও বাড়িতে অতিথি এলে গৃহস্বামী বিরক্ত হতেন।
মাত্র পঞ্চান্ন বছর। এই সময়ে বাঙালি-জীবনে বিপ্লব ঘটে গেল। এখন প্যান্ট-গেঞ্জিতে যুবতীরা স্বচ্ছন্দ। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বারমহল-অন্দরমহল বলে কোনও ভাগাভাগি থাকছে না। বাড়ির ভিতরে কোনও মধ্যবয়স্কা গামছা পরে ঘুরছেন না। রান্নার ব্যাপারে আন্তর্জাতিকতা এসে গিয়েছে। এত দ্রুত মানসিকতার বদল হল যে বাবা-ঠাকুরদা, মা-পিসিরা চলে যাওয়ার পরে বাড়িতে বন্ধু এলে বলা যায়, ‘কী নেবেন? হুইস্কি না রাম?’
কিন্তু আমি ভাবি, যে মেয়েটি সারা শরীরে শাড়ি জড়িয়ে ষাট সালে আমাদের ক্লাসে আসতেন, তিনি যদি তখনই প্যান্ট আর গেঞ্জি পরতেন তা হলে আজ সত্তর পেরিয়ে গিয়ে ওই পোশাকে তাঁকে কেমন লাগত? তার নিজেরই বা কী মনে হত? একটি আঁচলের অভাব কি তিনি অনুভব করতেন না?
১৯
ভাবতে অবাক লাগে, বাংলা আধুনিক গান বলতে আমরা যা বুঝি, তার জন্মের বহু আগে থেকে রবীন্দ্রনাথ যে গান লিখেছিলেন তা এখনও সমান গ্রহণযোগ্য এবং সেই গানগুলো পরিবেশন করা এক সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে শ্রোতা হতে আগ্রহের অভাব হচ্ছে না। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ এক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ, যাঁকে কোনও যুক্তি দিয়ে বিচার করতে গেলে ঢোক গিলতে হয়। আমার আজকের লেখার বিষয় রবীন্দ্রনাথের গান নয়, তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ের এবং তাঁর চলে যাওয়ার পরের বাংলা আধুনিক গানের জন্ম এবং মৃত্যু।
আমার বাবা সায়গলের ভক্ত ছিলেন। বাড়িতে সায়গলের গান বাজাতেন গ্রামোফোনে। তখন আমি না শিশু না বালক। কিন্তু ওই বয়সেই রেকর্ড বাজলেই কীরকম অস্বস্তি হত। কেন হত তা বোঝার বয়স তখন ছিল না। কিন্তু যেদিন প্রথমবার ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’ শুনলাম, সেদিন কান এবং মন জুড়িয়ে গিয়েছিল। গানটা দ্বিতীয়বার শোনার জন্য ছটফট করেছিলাম। তখন আমি বালক। তারপর যে তিনটি গান বুকের ঘরে বসে গেল, আজও যারা একটুও ম্লান হয়নি, তারা হল ‘রানার’, ‘পালকির গান’ এবং ‘ছোট্ট নদীটি পটে আঁকা ছবিটি’। এখন ভাবি, এই চারটি গান যখন শুনেছি তখন রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেমের কিছু গান যা স্কুলে প্রার্থনার সময় গাওয়া হত, তার বাইরে রবীন্দ্রসংগীত কিছু শুনিনি। এবং এই চারটি গান একজন গায়কেরই গাওয়া। তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আর চারটি গানই বিবরণ ধর্মী, ব্যক্তিপ্রেমের গান নয়। স্মৃতি বলছে, এর পরেই যে গান বুকে থেকে গেল শোনামাত্র, চিরকালের হয়ে গেল, সেটি সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া, ‘পাষাণের বুকে লিখো না’—। বলে রাখা ভাল, আমার বাল্যকাল কেটেছিল কলকাতা থেকে বহুদূরে, চা-বাগানে। কলকাতার সব গান যা পরপর রেকর্ড হয়ে বেরিয়েছিল তা আমাদের কাছে পৌঁছেছিল বিক্ষিপ্তভাবে।
সেই শুরু। মোটামুটিভাবে পাঁচের দশকের শুরু থেকে আধুনিক বাংলা গানের জনপ্রিয়তা আরম্ভ হয়েছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য থেকে শ্রোতাদের মন জয় করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের নাম এবং গান প্রতি শনিবারের আকাশবাণীর ‘অনুরোধের আসর’-এ শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত বাঙালি শ্রোতারা। পাশাপাশি মহিলা গায়িকাদের জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়েছিল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে ইলা বসু, গায়ত্রী বসুর গান বাঙালি মুগ্ধ হয়ে শুনেছে। সময়ের বিচারে আধুনিক বাংলা গানের জনপ্রিয়তার আয়ু তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর। এই সময়ের গান বাঙালির রক্তে মিশে গিয়েছিল। শিল্পীদের অনবদ্য কণ্ঠ ছাড়াও ওই জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ ওই সময়ে একসঙ্গে অনেক প্রতিভাবান সুরকার আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। এই সুরকার এবং শিল্পীদের অমূল্য যোগাযোগে বাংলা আধুনিক গান একটি সূবর্ণ যুগে পৌঁছে গিয়েছিল। সলিল চৌধুরী, অনুপম ঘটক, রবীন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত তো ছিলেনই, সুরকার হিসাবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র এবং সতীনাথ মুখোপাধ্যায় অমূল্য সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন। ওই পঁয়ত্রিশ বছরের সময়সীমায় এত প্রতিভা কী করে একত্রিত হয়েছিল তার ব্যাখ্যা আমার জানা নেই।
বেসিক গান অর্থাৎ চলচ্চিত্রের বাইরে রেকর্ডের গানের জন্য মানুষের অত্যন্ত আগ্রহ ছিল। পুজোর আগে ওই রেকর্ডগুলো সেই আগ্রহকে সুস্থ পরিপূর্ণতা দিয়েছিল। পাশাপাশি চলচ্চিত্রে গানের একটা বড় ভূমিকা ছিল। সেটা অবশ্য শুরু হয়েছিল কাননদেবীর আমল থেকে। ‘আমি বনফুল গো’ গাননি, অন্তত মনে মনেও, এমন কোনও বাঙালি ছিলেন না। প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ ছবিতে ‘দিনের শেষে’ কি শুধু রবীন্দ্রনাথের গান? পঙ্কজ মল্লিকের নয়? এই দিকটা ভাবলে বাংলা আধুনিক গানের থেকে বাংলা চলচ্চিত্রের গান দশ-পনেরো বছর আগে শুরু হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলব, ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে ‘গানে মোর ইন্দ্রধনূ’ সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তৈরি করেছিল। ছবিটি পাঁচের দশকের প্রথম দিকে মুক্তি পেয়েছিল।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অখিলবন্ধু ঘোষ, সুবীর সেন যখন মধ্যগগনে, তখন মান্না দে মশাই হিন্দির পাশাপাশি বাংলা আধুনিক গান শুরু করে কিংবদন্তি হয়ে গেলেন, ভাবতে অবাক লাগে এঁদের অনেকেই যখন চলে গেলেন। যাঁরা থেকে গেলেন তাঁদের শরীর অশক্ত হয়ে উঠল এবং সরে যেতে বাধ্য হলেন পাদপ্রদীপ থেকে, তখন আচমকা বাংলা আধুনিক গানের আলোকিত সাম্রাজ্য নিভে গেল। তখন পুরনো গান নিয়ে বাঙালি সময় কাটাচ্ছে। বিদেশে বাঙালিদের গাড়িতে পাঁচের দশকের গান ক্যাসেট বা সিডিতে বাজছে।
এই সময় আমরা নড়ে বসলাম নতুন এক গায়কের কণ্ঠ, সুর এবং গানের কথা শুনে। তিনি সুমন চট্টোপাধ্যায়, পরে কবীর সুমন। নতুন গানের অভাবে আমরা যখন মুষড়ে পড়েছি, তখন সুমনের ‘তোমাকে চাই’ আমাদের উদ্দীপ্ত করল। মাধবী রাত জাতীয় কথায় সাজানো পাঁচের দশকের বাংলা গানে আমরা ব্যতিক্রমী কথা শুনতে পেয়েছিলাম জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গানে। সুমন সেই পথে হেঁটে বাংলা আধুনিক গানকে আরও সমৃদ্ধ করলেন। কিন্তু তারপর? নচিকেতা চক্রবর্তী আশ্বাস জাগিয়েছিলেন। অন্তত ‘বৃদ্ধাশ্রম’ আমাদের আশ্বস্ত করেছিল। কিন্তু তিনি ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি। খুব ভাল কণ্ঠ শ্রীকান্ত আচার্যর কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য, সুধীন দাশগুপ্তের মতো সুরকারের দেখা পাননি। রূপঙ্করের সৌভাগ্য কবীর সুমনের সুরে গান গেয়েছেন। কিন্তু সেই গানে সুমন বড় প্রকট।
এর বাইরে বাংলা গানের যে প্রচেষ্টা চলছে তা নেহাতই নামতা পড়ার মতো। মেলোডিকে মেরে ফেলার কারণ দুটো। এক, মেলোডি গাইবার ক্ষমতা দলগত গায়কদের নেই। দুই, ছড়া কেটে চেঁচিয়ে গান বলে চালালে সারেগামা শেখার দরকার হয় না। আমি বিশ্বাস করি, বাংলা আধুনিক গানের ভাল গায়ক আছেন, সেই গান তৈরি করার সুরকারের বড় অভাব।