গীতবিতান ছুঁয়ে বলছি ৩.১

বোসদার ফোন এল সাতসকালে, “কী করছেন মশাই?”

বললাম, “খবরের কাগজ পড়ছি রোদ্দুরে বসে।”

“তা পড়ুন। নিউ ইয়ার্সে মাঠে যাবেন না কি? যদি যান তাহলে কমপ্লিমেন্টারি কার্ড রাখব?”

বেশ আন্তরিক গলায় বললেন বোসদা।

“খুব ভিড় হয় সেদিন, বসার জায়গা পাওয়া যায় না।” আমি ইতস্তত করলাম।

“আরে দূর! আপনি আমার বক্সে বসবেন। ছয়জন বসতে পারে। যদি যান তাহলে উনত্রিশ তারিখে ফোন করবেন। রাখছি।” আচমকা ফোন রেখে দিলেন বোসদা। এটা ওঁর স্বভাব। কথা শেষ করেই লাইন কেটে দেন, অন্যের কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করেন না। বোসদার পুরো নাম বিশ্বরঞ্জন বোস। আমার চেয়ে ঠিক ষোলো বছরের বড়। এখন সাতাশি চলছে। মেদহীন লম্বা শরীর। হাঁটার সময় একটুও ঝোঁকেন না। দীর্ঘকাল বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। অবসর নিয়েছেন একুশ বছর আগে। বোসদার মুখে শুনেছি, তিনি প্রথমবার কলকাতা রেসকোর্সে গিয়েছিলেন সাতাশ বছর বয়সে। একজন বয়স্ক সহকর্মী তাঁকে নিয়ে যান রেসকোর্সের সাধারণ গ্যালারিতে। কিছুকাল ইতস্তত করার পর নিয়মিত যাওয়া-আসা শুরু হল। তখন কলকাতায় ঘোড়দৌড় হত শনিবার। সেদিন অফিসে হাফ ডে। রেসের মাঠে যেতে কোনও অসুবিধে নেই। বোসদা বলেন, “রেসটাকে আমি কখনওই জুয়ো হিসাবে নিইনি। এটা একটা স্পোর্ট, এর পিছনে যেমন অনিশ্চয়তা আছে তেমনই বিজ্ঞানও আছে। রেস শুরু করার পর আমি প্রথমেই সিগারেট খাওয়াটা বন্ধ করলাম।”

“সিগারেটের সঙ্গে রেসের কী সম্পর্ক?”

বোসদা হাসলেন, “যখন প্রথম রেসে গিয়েছিলাম তখন রোজ দু’প্যাকেট সিগারেট খেতাম। দামী সিগারেট। ওই সিগারেটের দামের সঙ্গে সামান্য যোগ করে সপ্তাহে একদিন রেস খেলতাম। হেরে গেলে গায়ে লাগত না, জিতলে টাকাটা সংসারে খরচ না করে রেখে দিতাম যদি কখনও রেস খেলতে প্রয়োজন হয় তখন খরচ করব।”

“তারপর?”

“তারপর রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের অনারারি মেম্বারশিপ নিয়ে নিলাম। ঢোকার টিকিট কাটতে হয় না।”

“আপনি এই ষাট বছরে সবচেয়ে বেশি কত টাকা বাজি ধরেছেন?”

“পঞ্চাশ টাকা। হেরে গিয়ে খুব মন খারাপ হয়েছিল। তারপর আর দশ টাকার উপর উঠিনি। এখন আমার দিনের বাজেট হল আশি টাকা। আরে ভাই, দশটা ভাল সিগারেটের দাম তো একশোর নিচে নয়। তাই না?”

বোসদা বিপত্নীক। এই রেস খেলার নেশার জন্যে তাঁর সংসার কখনওই বিব্রত হয়নি। কোনও আর্থিক চাপ পড়েনি। কিন্তু বেঁচে গিয়েছেন বোসদা। কীভাবে?

প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠেন ভদ্রলোক। এই সাতাশি বছর বয়সেও নিজেই চা বানিয়ে খান। তারপর ছাদে উঠে পায়চারি করেন। রোদ উঠলে নিচে নেমে ব্রেকফাস্ট করে বাজারে যান। ফিরে এসে টেবিলে বসেন। এখন প্রায় প্রতিদিন ভারতবর্ষের ছয়টি বড় শহরের কোনও একটিতে ঘোড়দৌড় হয়ে থাকে। সেই দৌড়ের ধারাবিবরণী ছবি সমেত অন্য শহরগুলোর রেসকোর্সে প্রচার করে বেটিং নেওয়া হয়। ফলে সপ্তাহের প্রায় কোনওদিনই রেস বন্ধ থাকে না। বাজার সেরে বোসদা তাঁর টেবিলে সেদিনের রেসবইটি নিয়ে বসেন। গত রাত্রে ডিনারের আগে একপ্রস্থ স্টাডি করা হয়ে গেলেও আবার রিভাইজ করতে শুরু করেন। প্রতিটি বাজিতে যে ঘোড়া দৌড়াচ্ছে তার ইদানীংকার কাজকর্ম ছাড়াও পিতামাতার কীর্তি পর্যালোচনা করেন। এসব তথ্য যে বইগুলোতে পাওয়া যায় তা বোসদার সংগ্রহে আছে।

পড়াশোনা শেষ করে বেলা বারোটার মধ্যে স্নান-খাওয়া সেরে পরিপাটি হয়ে বাড়ি থেকে বের হন বোসদা। ফিরে আসেন সন্ধের মুখে। এসে একটু বিশ্রাম নিয়ে চা-জলখাবার খেয়ে আবার পরের দিনের রেসের বই খুলে বসেন। বাড়ির বাইরে কখনওই কোনও খাবার তিনি খান না। রেসকোর্সের ফাঁকা জায়গায় রোজ অন্তত দুই কিলোমিটার বেশ জোরে না হাঁটলে তাঁর স্বস্তি হয় না। এই রুটিন বোসদাকে এখনও তরতাজা রেখেছে। ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত একটা ঘোরের মধ্যে থাকেন তিনি। ব্যাঙ্গালোরের রেসের আগের দিন আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখেন। বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলে দুঃখিত হন কারণ বৃষ্টি হলে রেস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ভারতবর্ষের রেসকোর্সগুলোতে কবে কোন বড় রেস হচ্ছে তার ক্যালেন্ডার বোসদার মুখস্থ।

সাধারণত ষাট বছরে অবসর নিয়ে বেশিরভাগ মানুষ খুব দ্রুত মন এবং শরীরে জবুথুবু হয়ে যান। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর তাঁদের মনে হয় যাবতীয় কর্তব্য শেষ করা হয়ে গেল। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ধীরে-ধীরে সম্পর্ক শেষ হতে থাকে। সারাদিন অদ্ভুত একাকীত্বে কাটতে থাকে। ফলে জীবনের সমস্ত উৎসাহ ধীরে-ধীরে কমে যায়।

বোসদাকে কখনওই এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। তাঁর সহকর্মীরা সবাই কবে চলে গিয়েছেন পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু এখনও তিনি সামনের বছর হায়দরাবাদে ভারতবর্ষের সেরা ঘোড়দৌড় ইনভিটেশন কাপ হবে জানার পর সেটা দেখতে যেতে তৈরি হচ্ছেন। বললেন, “সময় তো হয়ে আসছে, যাওয়ার আগে হায়দরাবাদটা দেখে আসি।”

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “বোসদা, এখনও মধ্যবিত্ত বাঙালি রেসখেলাকে পাপকর্ম বলে মনে করে। রেসুড়ে শব্দটাকে উচ্চারণ করার সময় তাচ্ছিল্য মেশানো ঘৃণা জড়িয়ে রাখে। আপনি এত বছর রেসকোর্সে যাচ্ছেন, কেউ আপনাকে রেসুড়ে বললে খারাপ লাগবে না? নিজেকে পছন্দ করবেন?

“অফকোর্স করব। গত ষাট বছরে যে উত্তেজনা আমি পেয়েছি তা ওই শব্দটি যারা ব্যবহার করে তারা তার মূল্য জানে না। ধরা যাক একটি রেসে দশটি ঘোড়া দৌড়াচ্ছে। আমি অনেক হিসাব করে ভেবে নিলাম কে ফার্স্ট হবে। রেস হলে আমার ভাবনার সঙ্গে যদি মিলে যায় তাহলে যে তৃপ্তি পাই তা ওরা জানে না। না মিললে বিশ্লেষণ করি কেন মিলল না। শেখার চেষ্টা করি। আর এসবের জন্যে আমার খরচ প্রতি রেসে মাত্র দশ টাকা। একটা সিগারেটের দাম।” হাসলেন বোসদা। “সিগারেট স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই উত্তেজনা আমার স্বাস্থ্যকে স্থির রাখে।”

বোসদাকে ফোন করতে হবে একটা কমপ্লিমেন্টারি কার্ডের জন্য।

জমিয়ে শীত পড়েছে কলকাতায়। প্রথমে একটা হাতকাটা সোয়েটার, তারপর ফুলহাতা, এখন জ্যাকেট অথবা শাল গায়ে না দিলে শীতের সঙ্গে লড়াইটা করাই যাচ্ছে না। কলকাতার মানুষদের ভাগ্যে এরকম কদাচিৎ ঘটে থাকে। অনেক, অনেক বছর শীতকালটা আমরা কাটিয়েছি ফিকে শীতে। তখন মনে পড়েছে জলপাইগুড়ির কথা।

যেহেতু আমার বাল্যকাল, কৈশোর কেটেছে ডুয়ার্সের একটা চা-বাগানে, তাই শীতের সঙ্গে চমৎকার বোঝাপড়া ছিল। শীত আসছে এটা টের পেতাম কালীপুজোর রাত্রে। প্রায় মাঝরাতে ঠাকুরের চোখ আঁকা দেখতে যখন বাবু হয়ে বসে থাকতাম তখন বাড়ি থেকে কেউ একটা আলোয়ান দিয়ে যেত। সেটায় মাথা-শরীর মোড়ার পর মনে হত, আঃ, কী আরাম! চোখ আঁকা হয়ে গেলেই ফিরে যেতে বাধ্য হতাম বড়দের নির্দেশে। কিন্তু ভোর হতেই বিছানা ছেড়ে বাইরে এসে চকচকে ঘাস দেখে বুঝতে অসুবিধা হত না, শিশির পড়েছে শেষ রাতে। শিউলি গাছগুলোর নিচে সাদা ফুলগুলোও সেই শিশিরে ভেজা-ভেজা। অর্থাৎ শীত খবর পাঠাল, সে আসছে।

তারপর সকাল আটটার আগে সূর্যের দেখা নেই, বিকেল চারটেতেই অন্ধকার। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ষোলো ঘন্টাই শীতের দখলে। গাছের পাতাগুলো খসে পড়ছে, জলে হাত রাখলে মনে হচ্ছে আঙুল খসে যাবে। সেসময় আমরা তাপ মাপার যন্ত্রের কথা জানতাম না। কমলালেবু যত মিষ্টি হচ্ছে, নলেন গুড় যত ঘন হচ্ছে তত শীতটাকে ভাল লাগছে। পরনে অলেস্টার, মাথায় টুপি, হাতে উলের গ্লাভস, লড়াই করার জন্যে তৈরি হয়ে থাকতাম তখন। শীত মানেই রোজ পায়েস অথবা পিঠে। সেসব পিঠের কত রকমারি। মা- পিসিদের কাছ থেকে পিঠে পাওয়াটাই স্বাভাবিক মনে হত তখন। এখন বুঝতে পারি, কী পরিশ্রম করতে হত ওঁদের। রান্নাঘরের উনুনে দাউদাউ জ্বলছে কাঠ। তার উত্তাপে ঘর থেকে শীত উধাও। মা-পিসিরা সেখানে বসে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, কারণ আমরা পিঠে খেতে ভালবাসি। এই পর্ব বাঙালির জীবন থেকে আজ উধাও হয়ে গিয়েছে। আমাদের মেয়েরা এই পরিশ্রম করতে চাইবে না, চাইলে আমরাই বাধা দেব। জীবন তার বাঁক নিয়ে নিয়েছে।

কলকাতায় পড়তে এসে প্রথম বছরে আমি অবাক। কোথায় শীত? আমার যখন ডিসেম্বরে একটুও শীত-বোধ হচ্ছে না, তখন কলকাতার ছেলেরা রঙিন শীতবস্ত্র গায়ে চাপিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! শীত নেই প্রমাণ করতে এক শীতের সন্ধ্যায় স্নান করেছিলাম ঠান্ডা জলে। নিউমোনিয়া দূরের কথা, সর্দি কাশিও হয়নি। অনেক পরে পুরনো রেকর্ড ঘেঁটে দেখেছি, সে-বছর কলকাতার তাপমাত্রা ডিসেম্বরে ছিল সাড়ে চোদ্দো। কিন্তু এই শহরে থাকতে-থাকতে আমিও তো একসময় কলকাতার লোক হয়ে গেলাম। অতএব যে কিশোরকালে হাড়হিম করা শীত কাটিয়েছে, সে বারো-তেরো ডিগ্রিতেও কী শীত পড়েছে বলে শালে শরীর মুড়ে ফেলবে।

আজ সকালে কলকাতার তাপমাত্রা এগারো ডিগ্রি। স্মরণকালের মধ্যে একবারই তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল নয় ডিগ্রিতে। কত মানুষ মারা গিয়েছিলেন সে-বছর? আমার জানা নেই। কিন্তু বারো ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা নামলেই অনেক বৃদ্ধের অস্বস্তি শুরু হয়ে যায়। তখন একটু উষ্ণতার জন্যে কাতর হন তাঁরা। হঠাৎ একজনের কথা মনে এল। আমারই বয়সি। পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের কাছে ভালপাহাড় নামে একটা বসতি তৈরি করে আদিবাসী কিশোর- কিশোরীদের পড়াশোনা শেখাচ্ছে সে। সেই কমল চক্রবর্তীকে ফোন করলাম। রিং হচ্ছে, ধরছে না কেন? দ্বিতীয়বারে কমলের গলা পেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেমন আছ?’

‘ভাল আছি। তবে একটু ঠান্ডা পড়েছে, এই যা।’

‘তোমাদের ওখানে এখন কত?’

‘চার ডিগ্রি।’

আমার চোয়াল প্রায় আটকে গেল, চার! জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সহ্য করতে পারছ?’

‘কোনও উপায় নেই। বাচ্চাদের ছুটি দিয়েছি। কিন্তু এখানে থেকে যারা পড়াশোনা করে তাদের তো তিনবেলা খেতে দিতে হবে। তাছাড়া গরুগুলো আছে, ওদের দেখাশোনা না করলে কি চলে? আর রোজ গাছ থেকে এত-এত পাতা খসে পড়ছে, পরিষ্কার না করলে ওগুলো আবর্জনা হয়ে যাবে। ঠান্ডা বলে লেপের তলায় ঢুকে থাকলে কে এসব করবে? পারো তো চলে এসো, শীত ভোগ করে যাও।’ কমল চক্রবর্তী সাদরে আহ্বান জানাল।

কলকাতায় এগারো হতেই সন্ধের পর রাস্তা ফাঁকা। পার্ক স্ট্রিটের হুজুগের সময় চলে গেলে রাস্তাটা শুনশান হয়ে যাবে। এখন কি চাঁদের পক্ষ? অনেকদিন আকাশের দিকে তাকাইনি। শীতার্ত চাঁদের কথা ভাবতেই মনে পড়ল সেই রাতের কথা।

সেটাও ছিল ডিসেম্বর মাস। আমেরিকার ওহায়ো কলম্বাসে বেড়াতে গিয়েছিলাম। জানলার বাইরে বরফ আর বরফ কিন্তু বাড়ির ভেতরে যন্ত্রের সাহায্যে গরম রাখার ব্যবস্থা সক্রিয়। পরের দিন নিউইয়র্কে ফিরে যাব। এক ভদ্রলোক নেমন্তন্ন করেছিলেন রাতের ডিনারে। বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর অনুরোধে যেতে রাজি হলাম। সর্বাঙ্গে শীতবস্ত্র, গাড়িতে উঠে বসলাম। ওঁদের গ্যারাজও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। সন্ধের পরে তিরতিরে জ্যোৎস্নায় দু’পাশের বাড়িঘর বরফে মোড়া অবস্থায় চমৎকার দেখাচ্ছে। গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেখলাম আরও অনেক গাড়ি এসে যাওয়ায় আমাদের গাড়িটাকে খানিকটা দূরে রাখতে হবে। বন্ধু বললেন, ‘দৌড়ে ভেতরে ঢুকে যান।’ আদেশ পালন করলাম।

গল্পে গল্পে রাত বাড়ল। খাওয়া শেষ হলে বন্ধু বললেন, ‘আমি আগে গিয়ে গাড়িটাকে চালু করে হর্ন বাজাব। তখন আপনি যাবেন।’

তথাস্তু। দশ মিনিট হয়ে গেল কিন্তু হর্নের আওয়াজ না পাওয়ায় ভাবলাম বাইরে বেরিয়ে দেখি। বাইরে পা দিতেই মনে হল পৃথিবীটা জ্যোৎস্নায় ভাসছে। সাদা বরফগুলো থেকে যেন জ্যোতি ছিটকে উঠছে। আমি তাকালাম। দেখলাম বন্ধু হাত নেড়ে ডাকছেন গাড়ির ভেতর থেকে। আমি যত গুন-গুন করে এগোচ্ছি তত তাঁর হাত নাড়া বাড়ছে। হঠাৎ জোর কাঁপুনি এল শরীরে। আমি পড়ে যাচ্ছি বুঝতে পারলাম। তারপর আর জ্ঞান নেই। পরে জেনেছি বন্ধু আমাকে হাত নেড়ে ফিরে যেতে বলেছিলেন যাকে আমার মনে হয়েছিল কাছে যেতে বলছেন। ডাক্তার এসেছিল। আমার জ্ঞান ফিরেছিল চোদ্দো ঘন্টা বাদে। আয়নায় দেখলাম মুখ পুড়ে গিয়েছে ঠান্ডায়। বন্ধুপত্নী বললেন, ‘যাই বলুন, আপনাদের, মানে ছেলেদের, একটুতেই ঠান্ডা বেশি লাগে।’ আমি তাকালাম। সত্যি তো। মহিলাদের শীত-বোধ পুরুষদের থেকে অনেক কম। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। ইনি তাঁদের দলে নন।

কিন্তু আমরা ওই শীত চাই না। কলকাতায় শীত নয়-দশে ঘুরে বেড়ালেই আমরা সারা বছর বলতে পারব, ‘উঃ, এবার যা শীত পড়েছিল!’

আপনি কি কখনও ঘুষ দিয়েছেন? প্রশ্নটির উত্তরে না বলতে পারেন এমন মানুষের সংখ্যা যে কম তা আমরা সবাই জানি। বেঁচে থাকার এই যুদ্ধে সামান্য স্বস্তি পেতে আমাদের কখনও না কখনও ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ না দিয়ে যাঁরা বেঁচে-বর্তে থাকেন তাঁদের মনের জোর শুধু নিজের নয়, পরিবারের মানুষদের অশান্তিতে জড়িয়ে রাখে। তারপরেও তাঁরা নিশ্চয়ই ভাবেন, ভেবে আনন্দিত হন যে তিনি আপস করেননি।

সরকারি চাকরির আবেদনে সাফল্য পেয়ে যখন আনন্দে আটখানা তখন স্থানীয় থানা থেকে একজন সাব ইন্সপেক্টর এলেন আমার সম্পর্কে খোঁজখবর করতে। আমার চরিত্র, পাড়াতে আমার ভূমিকা, কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য কি না তা জেনে তিনি যে রিপোর্ট পাঠাবেন তার উপর আমার চাকরি নির্ভর করছে। অর্থাৎ আমি এতকাল পড়াশোনা করে যে ভাল লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছি সেটাই শেষ কথা নয়। সেই সাব ইন্সপেক্টর আমাকে অনেক প্রশ্ন করে শেষ পর্যন্ত বললেন, ‘বাঃ। আপনি দেখছি একদম ক্লিন। পাড়ার লোকজন আপনার সুখ্যাতি করল। ইলিশ বা চিতল মাছ খেয়ে থাকেন?’

তখন ইলিশের সময় নয়। চিতলের দাম শুনেছি বেশ চড়া। তাই মাথা নেড়ে না বললাম। সঙ্গে-সঙ্গে ভদ্রলোক বললেন, ‘যা দাম তা মাইনের টাকায় কিনতে পারি না। কেউ যদি খেতে সাহায্য করে তাহলে খুব ভাল লাগবে।’

আমি ওঁর কথার অর্থ না বুঝতে পেরে ক্যাবলার মতো হাসলাম। উনি বাধ্য হয়ে বললেন, ‘শ’তিনেক টাকা হলে ওই দুটো মাছ সপরিবারে খেতে পারব।’

এইবার বুঝলাম। রাগ হল। আমি যা খেতে পাই না তা খামোকা ওঁকে খাওয়াব কেন? বললাম, ‘এখন তো রোজগার নেই, আপনাকে টাকা দেব কী করে!’

ভদ্রলোক চলে গেলেন। আমি নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যে বরখাস্তের নোটিস পেলাম। উগ্রপন্থী কার্যকলাপের জন্য রুল ফাইভে আমার চাকরি চলে গিয়েছে। বলা বাহুল্য, তিনশো টাকা না পেয়ে ওই সাব ইন্সপেক্টর আমাকে উগ্রপন্থী বানিয়ে রিপোর্ট দিয়েছিলেন।

আত্মীয়স্বজনরা হতভম্ব। তাঁদের মতে ইলিশ আর চিতলের দাম দিয়ে একটা চাকরি পাকা না করার মতো নির্বোধ ভূ-ভারতে পাওয়া যাবে না। আমি ঘুষ দিতে চাইনি, ঘুষ দেওয়াও অপরাধ ইত্যাদি যুক্তি দিলে তাঁরা বলেছেন, ওই ধুয়ে জল খাও। বাকি জীবনে তো সরকারি চাকরি পাবে না। শুনতে-শুনতে মনের জোর কমতে লাগল। একদিন সোজা সেই সাব ইন্সপেক্টরের কাছে গিয়ে বললাম, ‘দাদা, তিনশো টাকা নিন, যত ইচ্ছে ওই দুটো মাছ কিনে খান।’ ভদ্রলোক ম্লান গলায় বললেন, ‘প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন বেরিয়ে যাওয়ার পরে কি আর ট্রেন ধরা যায়?’

আত্মীয়স্বজনরা বোঝালেন অল্পবিস্তর ঘুষ দেওয়া মারাত্মক অপরাধ নয়। তখন কেরোসিন সঙ্কট চলছিল। লাইনে সারাদিন দাঁড়িয়েও কেরোসিন পাওয়া যাচ্ছিল না। গ্যাসে রান্নার চল তখনও হয়নি। ফলে ব্ল্যাকে কেরোসিন কিনতে হত। না কিনলে রান্না হবে না। রান্না না হলে উপোস করতে হবে। ব্ল্যাকে কেনা মানে ঘুষ দেওয়া। উপোস করবে না ঘুষ দেবে, ভেবে দেখো!

চাকরিটা ফেরত পেতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যখন পুলিশের বড়কর্তার কাছে এক সাংবাদিক দাদা আমাকে নিয়ে গেলেন তখন তিনি সেই সাব ইন্সপেক্টরের লেখা রিপোর্ট দেখতে চাইলেন। আমি অবাক হয়ে শুনলাম সেই ফাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফাইলের রিপোর্ট না পাওয়া গেলে পুলিশের বড়কর্তার অধিকার আছে নিজের মতামত জানানোর। তিনি নির্দোষ বলায় আমি চাকরি ফিরে পেলাম। কিন্তু সাংবাদিক দাদা বললেন, ‘শ’পাঁচেক টাকা দাও। আমি তোমার হয়ে দিয়েছি।’

‘সেকী! কী জন্যে?’

‘ওই ফাইল হাওয়া না করে দিলে চাকরি ফিরে পেতে না। পিওনকে দিতে হয়েছে কাজটা করে দেওয়ার জন্য।’ সাংবাদিক দাদা হাসলেন। আমি তিনশোর বদলে পাঁচশো টাকা ঘুষ দিলাম। বন্ধুরা বললেন, ‘ঘুষ ভাবছিস কেন? ওটা তুই বকশিস হিসাবে ভেবে নে।’

ঘুষ এবং বকশিসের মধ্যে বিশাল পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মেনে নিতে বাধ্য হলাম। চাকরি করছি। বিয়ে করেছি। একটি সন্তানও হয়েছে। সে যখন তিনমাসের তখন পশ্চিমবঙ্গে বেবি ফুডের ক্রাইসিস শুরু হয়ে গেল। পাড়ায় বেপাড়ায় কৌটোর দুধ পাওয়া যাচ্ছে না। গরুর দুধ যত পাতলা করে খাওয়ানো হোক পেটে সহ্য হচ্ছে না। হঠাৎ খবর পেলাম লিন্ডসে স্ট্রিটের একটি দোকানে বেবি ফুড এসেছে। গিয়ে দেখলাম লাইন চলে গিয়েছে প্রায় গ্র্যান্ড হোটেল পর্যন্ত। তবু আশা নিয়ে দাঁড়ালাম। আধঘন্টা পরে যখন দশ পা এগিয়েছি তখন এক ভদ্রলোক এসে বললেন, ‘আরে! আপনি লাইনে কেন?’ কারণটা সেই অপরিচিতকে বললাম। ‘আসুন আমার সঙ্গে, ভদ্রলোক নিয়ে গেলেন লিন্ডসে স্ট্রিটের দোকানের পিছনের দরজায়। সামনের দরজায় ক্রেতাদের লাইন। আমাকে দুটো কৌটো একটা ব্যাগে ভরে এনে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘ওপাশ দিয়ে চলে যান।’ দাম দিতে চাইলে উনি মুখের উপর দরজা বন্ধ করে ভিতরে ঢুকে গেলেন। এরকম অভাবনীয় প্রাপ্তিতেও আহ্লাদে আটখানা হতে পারছিলাম না। পরদিন অফিসে গিয়ে সব বলতে সহকর্মী বললেন, ‘আরে ওটা তো কেডিয়ার দোকান। বললেই অফিসে মাল পৌছে দিত। ওর কয়েকটা কাজ পেন্ডিং আছে, এলে করে দিও। এর আগেরবার তোমাকে দেখে গিয়েছে।’ কাজটা করে দিতে হয়েছিল। আমি কী করেছিলাম? ঘুষ দিয়েছিলাম না নিয়েছিলাম? বন্ধুরা বললেন, ‘নিয়েছ’, তবে বাচ্চার প্রাণের জন্য তো, ওতে কোনও পাপ নেই।’

শিয়ালদা থেকে জলপাইগুড়ি যাচ্ছি। একমাস আগে টিকিট কেটেছি। বর্ধমান ছাড়াতেই চেকার এলেন। পার্স খুলে টিকিট দেখাতে গিয়ে ওটা খুঁজে পেলাম না। পকেটগুলোতেও পাওয়া গেল না। তখন কম্পিউটারের যুগ শুরু হয়নি। চেকার বললেন, ‘আপনি উইদাউট টিকিটে ট্রাভেল করছেন। এর জন্যে জেল এবং জরিমানা হতে পারে।’ এক সহযাত্রী, যিনি মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, আমার হয়ে অনেক অনুরোধ করার পর চেকার হাসলেন, ‘ঠিক আছে, আপনি যখন বলছেন, আপনারা যা দেন তাই দিতে বলুন।’ চেকার চলে গেলে ওই রিপ্রেজেন্টেটিভ আমাকে যা ভাড়া তার অর্ধেক দিতে বললেন। জেলে যাওয়ার ভয়ে তা দিয়ে দিলাম। ভদ্রলোক বললেন, ‘নিশ্চিন্ত থাকুন, আর কোনও ভয় নেই।’

সকালে আমার টিকিটটাকে পায়ের কাছে খুঁজে পেয়ে ছুটলাম চেকারের কাছে। তিনি দেখে বললেন, ‘যাক, প্ল্যাটফর্মে নেমে মাথা উঁচু করে বের হতে পারবেন। আর খরচ করতে হবে না। আপনি অসতর্ক ছিলেন তাই টিকিট হারিয়েছিল। তার দাম তো দিতেই হবে। ঠিক কি না?’

মধ্যবয়সে পৌঁছে বেশিরভাগ বাঙালি জীবনযাত্রায় স্তিমিত হয়ে যান। সাধারণত পঞ্চাশে পা দিয়ে তাঁদের মনে যে বোধ জন্মাতে শুরু করে তা ষাটে গিয়ে ডালপালা ছড়িয়ে দেয়। আমার বয়স হয়েছে, যুবক বয়সে যা করেছি, যেভাবে চলেছি তা এখন করা উচিত নয়। এই ভাবনা অনেককেই আক্রমণ করে। লক্ষ করেছি, যাঁরা চাকরি করেন তাঁরা পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলেও সহকর্মীদের সাহচর্য উপভোগ করেন। তাঁদের সঙ্গে পিকনিক বা বাৎসরিক ভ্রমণে গিয়ে খুব উপভোগ করেন। উনষাট বছর বয়সে সহকর্মীদের সঙ্গে পিকনিকে গিয়ে একপাত্র মদ্যপান করেন মধ্যাহ্নভোজনের আগে, তারপর গোটা দুয়েক পান চিবিয়ে বাড়ি ফেরেন নির্মল মুখ করে। সহকর্মীরা কমবয়সি হলেও তাঁদের সঙ্গ উৎসাহিত করে। কিন্তু ষাট পেরিয়ে অবসর নেওয়ার পর দ্রুত জীবনযাত্রায় পরিবর্তন চলে আসে।

ছেলেদের জীবনের অনেকটাই বহির্মুখী বলে ষাটের আগে তাঁরা যে সমস্যায় আক্রান্ত হন না মেয়েদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। সাধারণত, পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে চাকরি না-করা বিবাহিত মহিলারা নিজস্ব জীবন থেকে আচমকা সরে যান। অথবা বলা যেতে পারে নিজস্ব জীবনের ধারাটা বদলে ফেলেন। তখন তাঁর পৃথিবীতে সন্তানদের ভূমিকা বেশি হয়ে দাঁড়ায়, কেউ-কেউ দীক্ষা নিয়ে বাইরের সঙ্গে রোজ কিছুটা সময় কাটান। এবং অবিসংবাদিতভাবে স্বামীর সঙ্গে একটা সূক্ষ্ম দূরত্ব তৈরি হয়ে যায় যাতে মনে হতেই পারে একই সংসারে থেকেও দুজনের পৃথিবী আলাদা।

পঁয়ষট্টি পেরিয়ে গেলে বেশিরভাগ বাঙালির পৃথিবী ছোট হয়ে আসে। সন্তানদের সঙ্গে দূরত্ব তো বাড়েই, স্ত্রীর সঙ্গে অবিরত মতভেদের কারণে চুপচাপ থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে হয়। সুদীর্ঘকাল একত্রে থেকে বেশিরভাগ স্বামী-স্ত্রী মনে করেন পরস্পরের কাছে কিছু পাওয়ার নেই। শুধু একজনের জীবনধারণের জন্য আর একজনের সঙ্গ দরকার। লক্ষ করেছি, ওই বয়সের মহিলারা যখন সন্তানদের কাছে পান তখন স্বামীর বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগ উগরে দেন। এর অনেকটাই হয়তো কাল্পনিক। ওই বয়সের পুরুষেরা সন্তানের কাছে তরল হতে চাইলেও কোন একটা ইগোর কারণে হতে পারেন না। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলেও এই সমস্যার কথা বলতে পারেন না। এক্ষেত্রে আর চুপচাপ থাকা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। সত্তর বছর বয়সে বাজারে গিয়ে জ্যান্ত কই মাছ দেখে লোভ হল। কিনে বাড়ি নিয়ে এসে ভাবলেন আজ তেল-কই খাওয়া যাবে। জ্যান্ত মাছ এনেছেন, আঁশ না-ছাড়িয়ে, দেখে গিন্নি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, তাঁর পক্ষে এই বয়সে কই মাছ মেরে আঁশ ছাড়ানো সম্ভব নয়। এটা তাকে যন্ত্রণা দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। ফোন করে অন্য শহরে থাকা মেয়েকে স্বামীর কুমতলবের কথা জানালেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাছটা রেঁধে দিলেও তা স্বামীর জিভে কি সুস্বাদু লাগবে?

অথচ, বয়স বাড়লেই তো একা হয়ে যেতে হয়। ছেলে বিদেশে, মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে। সাধের ফ্ল্যাটে স্বামী-স্ত্রী। সকাল-সন্ধ্যায় ব্যালকনিতে বসে রাস্তার লোক দেখে সময় কাটে। কাজের মেয়েটি না এলে বিপদ বাড়ে। সে এসে দুধ থেকে বাজার যেমন আনে তেমনি রান্নাও করে দিয়ে যায়। গিন্নির বাতের ব্যথা, হাঁটু মুড়তে পারেন না। এ পাড়ার বয়স্কদের কোনও আড্ডার জায়গা নেই, তাই টিভি দেখা ছাড়া বিনোদনের বিকল্প ব্যবস্থা নেই। কোনও কারণে কাজের মেয়েটি ডুব মারলে মাথায় ছাদ ভেঙে পড়ে। মা ছেলেকে ফোন করে জানান, আজ কি খাব জানি না! ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে নামী হোটেল থেকে লোক এসে খাবারের বাক্স দিয়ে যায়। ছেলে নেটে অর্ডার দিয়ে কার্ডে দাম দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এটাই বা কদিন চলতে পারে!

অথচ সব আছে। সুন্দর সাজানো ফ্ল্যাট। ব্যাঙ্কে জমানো টাকা। ছেলে বিশাল চাকরি করে লন্ডনে। মেয়ে মুম্বইতে, বিয়ের পরে। তারও অবস্থা খুব ভাল। দুই ছেলে-মেয়ের একটি করে সন্তান। আর কী চাই? ওরা বছরে একবার আসে। দিন সাতেক থাকে। তারপর তিনশো আটান্ন দিন প্রতীক্ষায় থাকা। পুত্রবধূ খুব ভাল। লন্ডনে যাওয়ার কথা বহুবার বলেছে। কিন্তু বৃদ্ধার পক্ষে ওই পা নিয়ে প্লেনে বসে থাকা সম্ভব নয়। তাছাড়া ওখানে গিয়ে তো মনে হবে না নিজের বাড়িতে আছি।

এই দু’জনের একজন যদি হঠাৎ চলে যান তাহলে কী হবে? ছেলে- মেয়েরা ছুটে আসবে। শ্রাদ্ধ-শান্তি চুকে গেলে যিনি থাকবেন তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাইবে। তাদের কারও পক্ষে তো কলকাতায় এসে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু দিশেহারা হলেও নিজের আস্তানা ছেড়ে যেতে বেশিরভাগ একা মানুষ রাজি হন না। তখন প্রস্তাব আসে বৃদ্ধাশ্রমে থাকার। কলকাতা এবং আশপাশে উন্নতমানের বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হয়েছে আজকাল। সেখানে সবরকম সুবিধে টাকার বিনিময়ে পাওয়া যায়। ওই বাড়ি বা ফ্ল্যাট বিক্রি করে ব্যাঙ্কে টাকাটা ফিক্সড ডিপোজিট করলে তার সুদে সব খরচ তো মিটবেই, উল্টে ডবল টাকা জমে যাবে।

বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের মানুষ ওষুধের সাহায্যে এখনও অশক্ত হয়ে পড়েন না। বিশেষ করে পুরুষরা। মহিলাদের অনেকেই বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু সেখানেও অনেক বৃদ্ধার সঙ্গে থাকলেও ঠিকঠাক বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আর না গেলে শুধু টিভির সংলাপ একা শুনে যেতে হয়।

কয়েকদিন আগে কাগজে খবরটা পড়ে খুব ভাল লাগল। বয়স্ক মানুষরা যাঁরা নিতান্তই একা, তাঁরা একত্রিত হয়ে কিছুটা সময় কাটিয়েছেন। কথা বলেছেন আর একজন নিঃসঙ্গ বা নিঃসঙ্গার সঙ্গে। উদ্যোক্তারা চেয়েছেন যদি মানসিকতায় মিলে যায় তাহলে বাকি জীবন ওঁরা একসঙ্গে থাকতে পারেন। সেটা বন্ধুভাবেই হোক অথবা স্বামী-স্ত্রী হিসাবে স্বীকৃত হয়ে। দুজনে কথা বলতে পারবেন, মান-অভিমানও হতে পারে, একজনের প্রয়োজনে অন্যজন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। সত্তর পার হওয়া মানুষগুলোর সম্পর্ক নিয়ে বাইরের কেউ মাথা ঘামাবে না যেমন, তেমন নিকট আত্মীয়দের মানসিক দায়ও মিটে যাবে। পড়লাম, একটি শিক্ষিতা মেয়ে তার একাকী মাকে নিয়ে গিয়েছেন ওই সম্মেলনে। ভারি ভাল লাগল।

জীবন তো কয়েক বছরের সমষ্টি। শেষদিন পর্যন্ত যদি পরস্পরের উপর নির্ভর করা যায় তার চেয়ে ভাল আর কী আছে!

সুযোগ পেলেই পিতামহকে গালমন্দ করতেন ভদ্রলোক। স্কুলে ভর্তি করার সময় তাঁর বয়স নাকি একবছর বেশি বলে ফেলেছিলেন পিতামহ, ভুল ধরা পড়েছিল যখন স্কুলের শেষ পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড হাতে এল। ততদিনে পিতামহ পৃথিবীতে নেই। সেই সময় স্কুলে ভর্তি হওয়ার কালে বার্থ সার্টিফিকেট দেখাতে হত না। অভিভাবক যা বলতেন তাই লিখে নেওয়া হত। এই ভদ্রলোক চাকরির শেষ-ধাপে যে বেতন পেতেন তা বেশ লোভনীয় ছিল। কিন্তু তাঁর আফসোস, একবছর বাড়ানো থাকায় তিনি আরও বারো মাসের টাকা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। শুধু বারো মাসের বেতন নয়, ভদ্রলোক সখেদে জানিয়েছেন, একবছর বেশি চাকরি করলে তাঁর পেনশনও বাড়ত, যা তাঁর হকের পাওনা ছিল, পিতামহের জন্য বঞ্চিত হলেন। দাদা চাকরি করে যাচ্ছেন, অথচ ছোটভাইকে সার্টিফিকেটের বয়স মেনে অবসর নিতে হচ্ছে। এরকম ভূরি-ভূরি উদাহরণ একসময় দেখেছি। একসময় হাওড়া স্টেশনের গেটে বেশ কয়েকজন মহিলা টিকিট চেকারকে দেখা যেত। রেলের পোশাক পরে তাঁরা যাত্রীদের টিকিট পরীক্ষা করছেন, তাঁদের কয়েকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হতাম। বুঝতে একটুও অসুবিধে হত না, ওঁদের বয়স অনেককাল আগে ষাট ছাড়িয়েছে। ওই বয়সের মহিলারা কীভাবে সরকারি চাকরি করছেন? উত্তরটা তিনি দিলেন, যিনিও রেলে চাকরি করতেন। বাহান্ন-পঞ্চান্ন বয়সে রেলে কর্মরত অবস্থায় কোনও কর্মচারী মারা গেলে তাঁর পুত্র বা কন্যা মানবিকতার কারণে চাকরি পেয়ে থাকেন। পুত্র বা কন্যা যদি না-থাকে অথবা তারা যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়, তা হলে মৃতের স্ত্রী’কে চাকরি দেওয়া হয়। গোলমালটা এখানেই। সেই চাকরির আবেদনপত্রের সঙ্গে বার্থ সার্টিফিকেট দিতে হয়। কিন্তু ওঁদের জন্ম হয়েছিল বাড়িতে, কারও যদি হাসপাতালে জন্ম হয়ে থাকে তা হলেও তখন সার্টিফিকেট দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না। তাই আবেদনপত্রের সঙ্গে নিজের জন্মতারিখ এফিডেভিট করে ওঁরা দিয়েছেন। ওটা করার সময় যাঁর ছত্রিশ, তিনি তিরিশ লিখেছেন। অতএব ষাট বছর বয়সে যিনি অবসর নিচ্ছেন, তখন তাঁর সঠিক বয়স ছেষট্টি।

আমি জন্মেছিলাম চা-বাগানের বাড়িতে। সে-সময় বাড়ির কোনও ঘরকে আঁতুড়ঘর করে সেখানেই আসন্নপ্রসবাকে রাখা হত। জন্মানোর সময় শিশুমৃত্যুর হার খুব বেশি থাকার কারণ এইটি। ডাক্তার না-পাওয়ায় অর্ধশিক্ষিত দাই-এর সাহায্য নেওয়া হত। শিশুর গলায় মায়ের নাড়ি জড়িয়ে গেলে সেই দাই যেটুকু করতে পারতেন তা যথেষ্ট ছিল না। তবু এভাবেই আমরা পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম। এই আসাটাকে আইনসিদ্ধ করার চিন্তা কেউ করতেন না, যা এখন ভাবাই যায় না। শুধু জন্ম কেন, মৃত্যুর পরে শ্মশানে দাহ করতে মৃতদেহ নিয়ে গেলে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’-এর প্রয়োজন হত না। কত অপরাধী ওই শ্মশানে তাদের অপরাধের প্রমাণ মুছে ফেলেছে!

আমাদের জন্মদিনটি মনে রাখতেন মা-পিসিমারা। সেদিন আর কিছু না-হোক একবাটি পায়েস তাঁরা করে খাওয়াতেন। বন্ধুদের কারও বাড়িতে গ্রীষ্ম বা বর্ষায় পায়েস হচ্ছে শুনলে বুঝে যেতাম, সেদিন ওই বাড়ির কারও জন্মদিন। তখন কেক কাটার চল ছিল না। বোধহয় কেক খুব দুষ্প্রাপ্য ছিল চা-বাগানের মফসসল শহরে। তখন লক্ষ্য করেছি, ছোটদের জন্মদিনেই পায়েস হত, বড়দের ক্ষেত্রে এটা চালু ছিল না। কলকাতার কলেজে পড়তে আসায় জন্মদিনের পায়েস খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। না-এলেও বড় হয়ে গিয়েছি বলে বঞ্চিত হতাম।

শৈশবে জন্মদিন সম্পর্কে যে-ধারণা তৈরি হয়েছিল তা একটু অদ্ভুত। ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। সেদিন স্কুলে উৎসব। গান নাচ নাটক। মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে নির্ভেজাল ছুটি। ২৩ জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্রর জন্মদিনে স্কুল থেকে প্রভাতফেরি, ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’, ‘আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’। সে-সময় বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, নজরুল ইসলামের জন্মদিন পালন করার বারোয়ারি চেষ্টা ছিল না। আমার ধারণা হয়েছিল, যাঁরা খুব বিখ্যাত, যাঁরা দেশের জন্য অনেক করেছেন, শুধু তাঁদের জন্মদিন পালন করতে হয়। একটু উপরের ক্লাসে উঠে স্কুলের স্যরকে প্রশ্ন করেছিলাম, ক্ষুদিরামের জন্মদিন কেন পালন করা হয় না? দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি ‘শহিদ’ হয়েছিলেন, স্যর জবাব দিতে পারেননি। এমনকী, ক্ষুদিরামের জন্মতারিখ কবে তা-ও বলতে পারেননি। এক সহপাঠী বলেছিল, ক্ষুদিরামের জন্মের সময় ‘বার্থ সার্টিফিকেট’ চালু ছিল না, অল্প বয়সে ফাঁসি হয়েছিল, তাই জন্মদিন রেকর্ড করা হয়নি। রবীন্দ্রনাথ বা মহাত্মার যথেষ্ট বয়স হয়েছিল, তাই আমরা জানতে পেরেছি ওঁদের জন্মদিন কবে ছিল। নেতাজি তো এত বিখ্যাত ছিলেন যে জানতে অসুবিধে হয়নি। অতএব অতিবিখ্যাত মানুষদের জন্মদিন পালন করা সহজ।

ইতিহাসের ক্লাস শেষ হয়ে গেলে এক সহপাঠী আচমকা জিজ্ঞাসা করল, অ্যাই, তোদের মজুমদার বংশের ইতিহাস বল! ‘হাঁ’ হয়ে গিয়েছিলাম। সহপাঠী বলল, তুই তো মোগল বংশের বাদশাহের নাম জানিস। বাবর, হুয়ায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গির, শাজাহান, ঔরঙ্গদেব, বাহাদুর শাহ! ছয়জন, ধর, তুই বাহাদুর শাহ, তোর পাঁচ পূর্বপুরুষের নাম বল।

ভেবে দেখলাম, বাবা-ঠাকুর্দা এবং তাঁর বাবার নাম জানি, তাঁদের উপরের দু’জনের নাম জানি না। সহপাঠী জানাল, সে-ও জানে না। আক্ষেপ করে বলল, ‘নিজেদের পূর্বপুরুষের নাম জানি না। অথচ ইতিহাসের নামগুলো মুখস্থ রাখতে হচ্ছে।’

বড়পিসিমা পুরনো দিনের গল্প করতেন, “তোর বাবা জন্মেছিল পয়লা আষাঢ়, কী মেঘ, কী বৃষ্টি সেদিন। তোর দাদু দাই ধরে এনে দু’দিন বসিয়ে রেখেছিলেন।”

‘পয়লা আষাঢ়, কোন সালে?’

বড়পিসিমা ফিক করে হেসে বললেন, ‘সে কি আর এখন মনে আছে? শুধু মেঘ আর বৃষ্টিটার কথা ভুলিনি।’

‘তুমি, তোমার জন্মদিন কবে বড়পিসিমা?’

বালবিধবা বড়পিসিমা খুব অবাক হয়েছিলেন প্রশ্নটা শুনে। বোধহয় আমার আগে কেউ তাঁকে এমন প্রশ্ন করেনি। মা-র কাছে গেলাম। প্রশ্ন শুনে মা উল্টে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন? তোর কী দরকার?’ তারপর ম্লানমুখে বলেছিলেন, ‘ভুলে গেছি।’

আমাদের মা-পিসি-মাসিদের জন্মদিন পালন করা দূরের কথা, তারিখটা কেউ মনে রাখত না এই সেদিন পর্যন্ত। কিন্তু এখন ‘ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড’, ‘আধার কার্ড’-এর দৌলতে তা ছেলেমেয়েদের কাছে স্পষ্ট। আমাদের অজ্ঞানতা, অবহেলার প্রায়শ্চিত্ত এখনকার ছেলেমেয়েরা করছে, মায়েদের জন্মদিনে হেসে বলছে, ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, মা।’

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়রা যখন লিখতেন তখন এ দেশে বইমেলা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রের আমলে এরকম মেলা যে হতে পারে সেই ধারণা কারও ছিল বলে মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্রের বই বাঙালির কীরকম প্রিয় ছিল তার প্রমাণ এখনও পাচ্ছি। কিন্তু ওঁদের পরবর্তী লেখকদের বই কীরকম ও কীভাবে বিক্রি হত? বইমেলার আগে বই বিক্রির পদ্ধতি কীরকম ছিল? নতুন ভাল লেখককে পাঠক কীভাবে চিনতেন? এসব প্রশ্নের উত্তর কেউ খুঁজেছেন কি না জানি না।

আমার স্কুল জীবন কেটেছে জলপাইগুড়ি শহরে। তখন গোটা শহরে মাত্র তিনটে বইয়ের দোকান ছিল। বছরের তিনমাস সেই দোকানগুলোতে ভিড় জমত। মূলত স্কুলের বই বিক্রি হত রমরমিয়ে। তারপর স্কুলের পড়াশোনা শুরু হয়ে গেলে দোকান তিনটি সাহিত্যপ্রেমীদের আড্ডার জায়গা। সারাদিনে কয়েকটা গল্পের বই বিক্রি হলে দোকানের মালিক খুশি। বলতেন, ‘মাসের খরচটা গল্পের বই বিক্রি করে উঠে গেলেই বাঁচি।’ ছাত্রাবস্থায় আমি কাউকে জলপাইগুড়ির ওই তিনটি দোকান থেকে বই কিনতে দেখিনি।

কিন্তু বই পড়ার চল ছিল ব্যাপক এবং সেটা বই না কিনে। শহরে অনেকগুলো পাঠাগার ছিল। প্রায় প্রতি পাড়ায় একটা করে। সবচেয়ে বেশি সদস্য ছিল বাবুপাড়া পাঠাগার, আজাদ হিন্দ পাঠাগার এবং চলন্তিকা পাঠাগারে। বিকেল হতে না হতেই বই নেওয়া বই জমা দেওয়ার জন্য ভিড় জমত। দেখতাম বাড়ির কাজের লোকের হাতে চিরকুট দিয়ে মহিলারা বই জমা দিয়ে নতুন বই নিতে পাঠিয়েছেন। তখনকার পাঠাগারের পরিচালকরা অত্যন্ত সিরিয়াস সাহিত্যপ্রেমিক ছিলেন। বাবুপাড়া পাঠাগারের সুনীলদা আমাকে কীভাবে বাংলা বই পড়তে হবে শিখিয়েছেন। অর্থাৎ বই না কিনেও পাঠাগারের সৌজন্যে বাংলা বইয়ের খবরাখবর শুধু নয়, তার বিষয়ও পাঠকদের জানা হয়ে যেত। আমার প্রতিবেশী জয়ন্ত-এর মায়ের এই জানাটা ছিল অসাধারণ। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে অচিন্ত্যকুমার পর্যন্ত যে কোনও লেখকের যে কোনও বই সম্পর্কে কিছু জানতে হলে ওঁর কাছে যেতাম। মাসিমা গড়গড়িয়ে বলে যেতেন। মনে রাখতে হবে, বাল্যবিবাহের শিকার ওই বৃদ্ধা স্কুলের শেষ ধাপ পর্যন্ত পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি।

যাঁরা বলেন, এককালে বাঙালি বই পড়ত, এখন পড়ে না, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। যাঁরা বলেন, একসময় বাংলা বই প্রচুর বিক্রি হত, এখন পাঠক কোথায়? তাঁদের এই মতকে সত্যি বলে মনে করি না।

ধরা যাক, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বইটির কথা। ছাত্রাবস্থায় বাবুপাড়া পাঠাগার থেকে এনে পড়েছিলাম মাস্টারমশাই বেণু দত্ত রায়ের নির্দেশে। পড়ে আপ্লুত। কলকাতায় পড়তে এসে মাস্টারমশাইদের মুখে বহুবার আলোচনায় ওই বইটির প্রসঙ্গ এসেছে। থিয়েটার হয়েছে। পরে সিনেমাও। আমার ক্রমশ মনে হয়েছিল তিতাস পড়েনি এমন শিক্ষিত বাঙালির সংখ্যা খুব বেশি নয়। এবং বেশ কিছুকাল পরে কলেজ স্ট্রিটে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হল। জানলাম, তিনিই ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর প্রকাশক। অদ্বৈত মল্লবর্মনের এই কালজয়ী উপন্যাসটির বিক্রির পরিমাণ কত জানতে চেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তিরিশ বছরেও বইটি চার হাজার কপির বেশি বিক্রি হয়নি। আমি বিশ্বাস করিনি। প্রকাশকদের কেউ কেউ সঠিক বিক্রি সংখ্যা বলতে চান না। ওই ভদ্রলোকও হয়তো সঠিক তথ্য দেননি। কিন্তু ধন্দ থেকেই গেল।

কিন্তু প্রবীণ প্রকাশকদের কাছে জেনেছি সে সময় বাংলা গল্পের বই পাঁচশো কপিতে একটি এডিশন হত। গোটা বছরে কারও বই যদি একটা এডিশন হত তা হলে সেই লেখককে পেতে চাইতেন অন্য প্রকাশকরা। আমরা যখন লেখালিখি শুরু করলাম তখন বলা হল এগারোশো কপিতে একটা এডিশন করা হয়। তারপরে কেউ কেউ দু’হাজারে, আবার অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক হলে পাঁচ হাজারে এডিশন করা হচ্ছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে বই বিক্রির পরিমাণ না বাড়লে প্রকাশকরা এগারোশো কপি ছাপতেন না। এখন একটি বই অন্তত আটশো কপি বিক্রি না হলে খরচ ওঠে না।

বইমেলাগুলো শুরু হওয়ার আগে একজন প্রকাশক কোনও বই ছেপে একটি কি দু’টি বিজ্ঞাপন দিতেন সাপ্তাহিক পত্রিকায়। দিয়ে দোকানে বসে থাকতেন, ভাবতেন কখন পাঠক এসে লাইন দিয়ে বইটি কিনে নিয়ে যাবে। সেই বিজ্ঞাপন পড়ে কোনও পাঠক তাঁর পাঠাগারকে অনুরোধ করেন বইটি কিনে আনতে। ওরকম অনুরোধ নিশ্চয়ই অন্য সদস্যরা আরও বইয়ের জন্য করে থাকেন। সামর্থ্য অনুযায়ী পাঠাগারে প্রতি বছর যে বই কেনা হয় তার মধ্যে আমাদের প্রকাশকের বইটি থাকলে তিনি খুশি হন।

শহরের বইয়ের দোকানগুলো যদি দ্যাখে কোনও-কোনও লেখকের বইয়ের চাহিদা আছে তা হলে নিজেরাই সেই লেখকের বই নিয়ে যায় বিক্রি করতে। শরৎচন্দ্রের পরে শঙ্কর-ই এ বঙ্গের একমাত্র লেখক যাঁর বই গ্রামের মুদির দোকানে ‘বর্ণপরিচয়’, ‘ধারাপাত’-এর পাশে পাওয়া যেত। কিন্তু এঁরা ব্যতিক্রম। বাংলা বই কেনার জন্য লাইন পড়েছিল একটি বইয়ের ক্ষেত্রে। অচিন্ত্যকুমারের ‘পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ’ কিনতে লোকে নির্দিষ্ট দিনে ভোর থেকে কলেজ স্ট্রিটে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

এইরকম কয়েকটি ব্যতিক্রমী ঘটনার কথা বাদ দিলে বাংলা বইয়ের বিক্রি কখনওই ফার্স্ট থেকে সেকে’ গিয়ারের বেশি ওঠেনি। তখন কোনও লেখকের একটি বই এক লক্ষ কপির বেশি বিক্রি হয়েছে বললে লোকে পাগল ভাবত। এখন অন্তত গোটা পনেরো উপন্যাসের কথা জানি যা লক্ষের সীমা অনেকদিন ছাড়িয়ে গিয়েছে।

বই ছাপা এবং বিক্রি করা প্রকাশকের একটি ব্যবসা। গোটা পৃথিবীর ব্যবসাদাররা যখন তাঁদের পণ্য নিয়ে ক্রেতার দরজায় উপস্থিত হয়েছেন তখন বইয়ের প্রকাশকরা দোকানেই বসে থাকতেন। ধরা যাক, আপনি থাকেন গড়িয়ায়। একটি বই কিনতে কলেজ স্ট্রিট যাওয়ার উৎসাহ কি আপনার মনে আসবে? বইমেলা সেই অভাবটা দূর করল। একসঙ্গে প্রচুর দোকান, শতকরা কিছু কমিশন, প্রকাশকরা দোকান ছেড়ে মাঠে এসেছেন পাঠকদের জন্য, ভিড় জমতে লাগল। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বিভিন্ন প্রকাশকের ছাপা বই কিনে এনে লেখকের সামনে ধরে অটোগ্রাফ নেওয়ার আনন্দ তো কলেজ স্ট্রিট গেলে পাওয়া যেত না। প্রথমে কলকাতা বইমেলা, তারপর জেলায়-জেলায় বইমেলা, এখন তো প্রায় পাড়ায়-পাড়ায় বইমেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। বইমেলায় দাঁড়িয়ে দেখছি এক ব্যাগ বই কিনে হাসিমুখে যাঁরা ঘুরছেন তাঁরা এই নবীন প্রজন্মের মানুষ।

যাঁরা বলেন টিভি, ইন্টারনেটের কাছে বাংলা বই হার মেনেছে তাঁরা ভুল কথা বলেন। বাংলা বই, এখন, আগের চেয়ে অনেক বেশি বিক্রি হচ্ছে।

অপরেশবাবুর সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল গত বছরের কলকাতা বইমেলায়। একটি স্টলে বসেছিলাম। ছেলেমেয়েরা বই কিনছে, কেউ বই-এ সই করিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বায়নাও থাকে, এটা লিখে দিন, এই নাম লিখে দিন। সেসব আবদার রাখার সময় লক্ষ করছিলাম একজন বয়স্ক মানুষ হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন। হাত খালি হলে বললাম, ‘কিছু বলবেন?’

ভদ্রলোক আমার একটি বই এগিয়ে ধরলেন, ‘কিছু লিখতে হবে না, শুধু আপনার নামটি লিখে দিলেই খুশি হব।’

বেশ ব্যতিক্রমী কথা। অনুরোধ রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার নামটা জানতে পারি?’ তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমি অপরেশ দত্ত। আমার খুব ভাল লাগছে কারণ এইসব অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা বাংলা বই কিনছে।’

সেদিন আর বেশি কথা হয়নি। দিন তিনেক পরে আবার ওঁকে দেখতে পেলাম। মেলায় ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমায় দেখে হাসলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কি রোজ বইমেলায় আসেন?’

‘হ্যাঁ। গত আটত্রিশ বছর ধরে আসছি। প্রথম বছরটা খবর পাইনি বলে আসতে পারিনি। তারপর থেকে প্রতিবছর। বইমেলা যেদিন শুরু হয় সেদিন ট্রেন থেকে নেমে হোটেলে যাই। দুপুর থেকে রাত এখানেই কাটে। যেদিন শেষ হয় তার পরের দিন ট্রেন ধরে চলে যাই। টিকিট আগে থেকেই কাটা থাকে।’ অপরেশবাবু বললেন।

‘কোথায় থাকেন আপনি?’

‘ডুয়ার্সে।’ বলেই হাসলেন, ‘যে ডুয়ার্স নিয়ে আপনি বারবার লিখেছেন।’

‘আশ্চর্য ব্যাপার। শুধু বইমেলায় থাকবেন বলে আপনি প্রতিবছর কলকাতায় আসেন? এখানে নিশ্চয়ই আত্মীয়স্বজনরা আছেন!’ অবাক হয়ে বললাম।

‘না নেই। হোটেলে ফিরে রাতের খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে উঠে বইমেলায় কেনা লিটল ম্যাগাজিনগুলো পড়তে পড়তে বেলা বাড়ে। দুপুরের খাওয়া সেরেই তো এখানে আসতে হয়। বিশ্বাস করুন, গত আটত্রিশ বছরে কলকাতার কোথাও যাওয়ার দরকারই পড়েনি। তবে হ্যাঁ, যেখানেই বইমেলা হয়েছে সেখানেই গিয়েছি। তা সে রবীন্দ্রসদনের সামনেই হোক অথবা পার্কস্ট্রিটের সামনে। একবার তো সল্টলেকের স্টেডিয়ামে প্রতিদিন যেতে হয়েছে। এখন এই মিলনমেলার মাঠে। আপনাকে বোধহয় আমি আটকে রেখেছি।’ অপরেশবাবু বললেন।

‘আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে। চলুন, গিল্ডের দোতলায় গিয়ে বসি। ওখান থেকে মেলা দেখা যাবে, কথাও বলা যাবে।’ উনি রাজি হলেন।

আমরা গিল্ড অফিসের দোতলার বারান্দায় গিয়ে বসলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি বয়স্ক মানুষ। প্রতি বছর কি একাই আসেন?’

‘হ্যাঁ। আমি আশিতে পা দেব সামনের মাসে। বিয়ে করিনি। আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। তবে বই আছে। প্রায় সাড়ে তিনহাজার বই। তারাই আমার স্বজন।’

‘কিন্তু বই কিনতে হলে আজকাল তো এতদূরে আসার দরকার হয় না। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারে প্রতিবছর বইমেলা হয়। সেখান থেকেই তো কিনতে পারেন।’

অপরেশবাবু হাসলেন, ‘যখন বইমেলা এখানে শুরু হয়েছিল তখন ওসব জায়গায় মেলা হত না। তাছাড়া এই যে শ’য়ে শ’য়ে বই-এর স্টল, লক্ষ-লক্ষ মানুষ, এর উন্মাদনাই আলাদা। এখানে আসাটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।’

‘ডুয়ার্সে আপনার নিজের বাড়ি?’

‘হ্যাঁ। দেড় বিঘে জমির উপর বাগান, বাড়ি। দুটি কাজের লোক আছে। বই পরিষ্কার রাখার কাজটা আমি নিজের হাতেই করি।’ একটু ভাবলেন অপরেশবাবু, তারপর বললেন, ‘আপনাকে বলি, আমি বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছি।’

‘সে কী? কেন?’

‘দেখুন আমার যে বয়স হয়েছে তাতে খুব বেশিদিন তো পৃথিবীতে থাকতে পারব না। এখন এই মুহূর্তে জমি, বাগানবাড়ি বিক্রি করলে আশি লক্ষ টাকা তো পাবই। ওই টাকা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাব? ওই বইগুলোকে কোথায় রাখব? তাছাড়া ব্যাঙ্কে যা জমিয়েছিলাম তার অঙ্কও কমে আসছিল। হঠাৎ একজন আমাকে প্রস্তাব দিল। বলল, ‘সে আমাকে মাসে চল্লিশ হাজার টাকা দেবে। কলকাতায় যাতায়াতের খরচও দেবে। আমি যতদিন জীবিত থাকব ততদিন ওই বাড়িতেই থাকতে পারব। আমার জীবদ্দশায় সে বাড়িতে ঢুকবে না। আমি যদি কুড়ি বছর বাঁচি তা হলে তার লোকসান, যদি দু’চার বছরের মধ্যে গত হই তার বিরাট লাভ।’ অপরেশবাবু হাসলেন।

‘আপনার কথা শুনে মনোজদার বাঞ্ছারামের কথা মনে পড়ছে। নীরদ সি চৌধুরি একশো বছর পার করে বেঁচে ছিলেন।’

‘কার সঙ্গে কার তুলনা করছেন। তবে হ্যাঁ, কোর্টে গিয়ে ব্যাপারটা আইনসঙ্গত করে নেওয়ার সময় আমি একটি শর্ত রেখেছি। ডুয়ার্সের চারটে কলেজের লাইব্রেরিতে আমার বইগুলো পৌঁছে দিতে হবে। সে রাজি হয়েছে। ওই জন্য আপনাকে বলেছিলাম শুধু নাম সই করে দিন। আমার নাম লিখতে হবে না।’

‘কারণটা ঠিক—!’

‘দেখুন, আমি চলে যাব, আপনিও, আমরা সবাই। কিন্তু ছিঁড়ে না ফেললে বই থেকে যাবে। আপনি লেখক, আপনার সই মূল্যবান ওই বই-এর পাতায়, আমি বইটি কিনেছি, আমার নাম থাকার তো কোনও যুক্তি নেই। কলেজের ছেলেমেয়েরা যখন ওই বই পড়বে তখন নাই বা জানুক কে বইটি কিনেছিল।’

‘কিছু মনে করবেন না। শুধু বই-এর টানে আটত্রিশ বছর ধরে এই বইমেলায় আসছেন? আর কোনও কারণ নেই?’

কিছু একটা বলতে গিয়েও শেষমুহূর্তে মাথা নাড়লেন অপরেশবাবু। বললেন, ‘থাক সেকথা’। বলে হাসলেন।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি হাসতে খুব পছন্দ করেন না?’

‘হাসির মতো মুখোশ আর কী আছে বলুন? খুশিতেও হাসি, দুঃখেও হাসি। নিজেকে নিয়েও—!’

গতকাল বইমেলা শেষ হল। আজ সন্ধ্যার ট্রেনে উঠবেন অপরেশবাবু। আমি আশা করব আগামী বছর তাঁর সঙ্গে দেখা হবে।

বাংলাদেশের বাংলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালক এই মাসের ১-৪ তারিখে ঢাকায় অ্যাকাডেমির উদ্যোগে যে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সম্মেলনের বিষয়বস্তু ছিল, ‘এই সময়ের সাহিত্য’। ওই আমন্ত্রণ পেয়ে আমি খুবই সম্মানিত বোধ করেছিলাম।

বাংলাদেশে আমি প্রথম যাই সাতাশি সালে। এই সাতাশ বছরে বহুবার যাওয়ার ফলে ঢাকা শহরে এবং তার বাইরের প্রচুর মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। ঢাকার রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার একটা মজা আছে। সোনার গাঁও-তে তাহেরের বাড়িতে গোটা দিন জলার ধারে কাটানোর আনন্দের তুলনা নেই। ঢাকায় যাওয়া মানেই গুলশন থেকে বাংলাবাজারে চক্কর মারা। গলির ভিতর ঢুকে ছোট দোকানের বিরিয়ানি খাওয়া। রওনা হওয়ার আগে বন্ধুরা ফোন করলেন ঢাকা থেকে। একাধিক বন্ধু একই কথা বললেন, ‘আপনি হোটেলে বা গেস্টহাউস থেকে সম্মেলনে পুলিশ পাহারায় যদি যেতে চান, বাকি সময় ঘরবন্দি হয়ে থাকলে যদি আপত্তি না করেন তা হলে আসতে পারেন। তা না হলে এখন ঢাকার যা অবস্থা তাতে আপনি একদমই নিরাপদে থাকবেন না। ঢাকার বাইরে তো প্রশ্নই ওঠে না।’

উপদেশ গ্রহণ করলাম। ঢাকায় গিয়ে ওই প্রায়-বন্দিজীবন আমার পক্ষে যাপন করা সম্ভব নয়। গেলাম না, কিন্তু রোজই খবর পাচ্ছি প্রচুর মানুষ পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হচ্ছেন। কেউ মারা যাচ্ছেন, অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসায়। দু’দিন আগে কাগজে পড়লাম, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী এক্সপ্রেস নামের ট্রেনটিতে বোমা ছোড়া হয়েছে। আজকের কাগজে ঢাকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন বাংলাদেশে অরাজকতা চলছে কিন্তু ঢাকা শহরে কঠোর নিরাপত্তা জারি রেখেছে হাসিনা সরকার।

প্রশ্ন হল, এই অবস্থা কেন হল? বাংলাদেশের শাসন-ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামি লিগ। বিএনপি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি, জামাতের তো কথাই ওঠে না। বিএনপি এবং জামাত পরস্পরের বন্ধু। মধ্যপ্রাচ্য থেকে জঙ্গি মুসলমান সংগঠনগুলোর টাকায় জামাত প্রচণ্ড ক্ষমতাবান। সাধারণ মানুষকে ধর্মের ভয় দেখিয়ে দলে টানতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে তারা। যেভাবেই হোক বাংলাদেশকে একটি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় তারা। বিএনপি নির্বাচনে না যোগ দিয়ে এখন আফসোস করছে। সেই নির্বাচনের আগে সাধারণ মানুষ আওয়ামি লিগের নেতাদের আচরণে বিরক্ত ছিল। বিএনপি সেই সুযোগটা নিতে পারেনি। এই দলটি ভারতবিরোধী এবং রাজাকারপুষ্ট। এরা আওয়ামি লিগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়। কোনও রকম গণতান্ত্রিক পথে না হেঁটে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইছে এই বিরোধীরা। বাস-গাড়ি-ট্রেন পুড়িয়ে দেওয়া থেকে মানুষ খুন করতে এদের আপত্তি হচ্ছে না। হাসিনা সরকার চাইছে জরুরি অবস্থা জারি না করে দেশের শান্তি ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু একটা পেট্রোল বোমা ছুড়লে যদি কোনও কিশোরকে দু’হাজার টাকা দেওয়া হয় তা হলে তাকে কী করে পুলিশ আটকাতে পারে?

কিছুদিন আগেই বাংলাদেশের আন্দোলনের সময় বিরোধীরা কয়েকটা দিনকে এড়িয়ে চলতেন। যেমন শুক্রবার। ওই পবিত্র দিনটি মানুষ মসজিদে গিয়ে নমাজ পড়েন, তাই সেদিন কোনও আন্দোলন হবে না। রোজার সময় একমাস ধরে আন্দোলন বন্ধ থাকবে। এছাড়া ঈদের দিনে অথবা মহরমের সময় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখা হত। ইদানীং এই অলিখিত নিয়ম ভেঙে ফেলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল রাজউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী কল্পনার মাধ্যমে। তখন তিনি বিরোধী নেত্রী। বুঝতে পারলাম রাজনীতির বাইরে তাঁর আগ্রহ সাহিত্য নিয়ে। পশ্চিমবাংলার অনেক লেখকের লেখা তিনি নিয়মিত পড়তেন। পাশাপাশি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া সাহিত্যের বা সংস্কৃতি সম্পর্কে তেমন আগ্রহী বলে শোনা যায়নি। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন তাঁকে সম্মান জানাতে দেশ-বিদেশের সাংবাদিকরা দেখা করতে গিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকার তরফ থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। শুনেছি শ্রীযুক্তা খালেদা জিয়া সুনীলদার নাম শুনে বুঝতে তো পারেননি, উল্টে ‘দেশ’ পত্রিকাকে বাংলাদেশের একটি কাগজ ভেবে বিরক্ত হয়েছিলেন। একথা বলার উদ্দেশ্য হল, জামাত বা বিএনপির সঙ্গে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির সম্পর্ক খুব ক্ষীণ।

মনে আছে, খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন ত্রিপুরার উগ্রপন্থীদের নিয়ে আমি ‘এত রক্ত কেন’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম। উগ্রপন্থীরা ভারত থেকে কিডন্যাপ করে বাংলাদেশে নিয়ে যেত ধনী ব্যক্তিদের। উপন্যাসে সময়টার কথা স্পষ্ট বলা হয়েছিল, আমলটা ছিল আওয়ামি লিগের ক্ষমতায় থাকার কাল। কিন্তু বিএনপি সরকার আমার ভিসা বাতিল করে দিল। এই নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছিল দেশ-বিদেশের কাগজে। কয়েক বছর পরে আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় আসার পরে আমার উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হল।

‘তিস্তা জল চুক্তি’ সই হয়নি বলে বাংলাদেশের মানুষের মনে ক্ষোভ রয়েছে। তা তিনি যে কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক হোক না কেন। তার উপর এই যে আন্দোলনের নামে ভয়ঙ্কর অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে তা শান্ত হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখছি না। এখন ঢাকায় একুশের বইমেলা চলছে। সাধারণত, এই সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলন স্থগিত থাকে। এবার তা হয়নি। মেলায় মানুষের উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই কম।

বাংলাভাষার জন্য যাঁরা শহিদ হয়েছেন, বাংলা ভাষাকে যাঁরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে সাহায্য করেছেন, তাঁদের কাছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যাচ্ছেন বলে বাংলাদেশের শান্তিকামী মানুষ উদগ্রীব হয়ে আছে। এই যাত্রা হয় সম্পর্ক আরও নিকট করবে নয় দূরত্ব বাড়াবে।

সকালে চায়ের কাপের সঙ্গে খবরের কাগজ না পেলে মেজাজ রুক্ষ হয়ে যায় এমন মানুষের সংখ্যা কত? বাংলায়, ধরা যাক, প্রতিদিন পঁচিশ লক্ষ খবরের কাগজ বিক্রি হয়। (সংখ্যাটা কি বাড়িয়ে বললাম!)। প্রতিটি কাগজ যদি দুই থেকে তিনজন পড়েন তা হলে পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর লক্ষ পাঠক রোজ পড়ে থাকেন। সংখ্যাটা পশ্চিমবাংলার জনসংখ্যার দশ শতাংশও নয়। অর্থাৎ বাকি নব্বই শতাংশ মানুষ খবরের কাগজ পড়েন না। না পড়ে তাঁদের দিন খারাপ কাটে না। যাঁরা টিভিতে খবর দ্যাখেন বা রেডিওতে শোনেন, তাঁদের বেশিরভাগ কাগজ পড়েন, যাঁরা পড়েন না তাঁদের একটা অংশ ওইভাবে খবর জেনে নেন। এঁদের এক করলে খুব বেশি হলে শতকরা কুড়ি ভাগ মানুষ দৈনন্দিন খবর সম্পর্কে ধারণা রাখেন। বাকিরা উদাসীন।

এপাশ-ওপাশ হতে পারে, ধরে নিতে পারি, পশ্চিমবাংলায় অন্তত পঁচাত্তর ভাগ মানুষ নিয়মিত দেশ-বিদেশের খবর রাখেন না। উত্তরবাংলায় ধূপগুড়ি স্টেশনে নেমে একজন মালবাহক, যিনি ভোট দেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, ‘ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর নাম বলতে পারেন?’ অবাক হয়ে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘একি! আপনি জানেন না? একটা বাচ্চাও তো জানে। মমতাদিদি ছাড়া আর কে প্রধানমন্ত্রী হবেন!’

এই ধূপগুড়ির মালবাহকের সঙ্গে নিউ ইয়র্কের ক্লাস এইটের ছাত্রদের অনেকের খুব মিল আছে। কিছুদিন আগে কাগজে পড়েছিলাম, ওই ছেলেদের জ্ঞানগম্যি জানার জন্য কয়েকটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। তার একটি ছিল, ‘আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্টের নাম কী?’ ওবামার নাম লিখেছিল তিরিশ ভাগ ছাত্র। বাকিরা কেনেডি থেকে ক্লিন্টন, কোনও নাম লিখতে বাকি রাখেনি। ধূপগুড়ির মালবাহকের কথা ছেড়ে দিলাম, শিক্ষিত নাগরিকদের মধ্যে ক’জন ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী, পশ্চিমবাংলার শ্রমমন্ত্রীর নাম ঠিকঠাক বলতে পারবেন? পশ্চিমবাংলার অর্থমন্ত্রীর নাম জানতে চেয়ে ‘অমিত রায়’ শুনতে হয়েছে। আমরা কি ধরে নেব এঁরা খবরের কাগজ পড়েন না?

নিয়মিত কাগজ পড়েন এমন একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বললেন, ‘সকালে চায়ের সঙ্গে কাগজ না পড়লে দিনটা বিশ্রী লাগে। পুজোর সময়, পনেরোই আগস্টের পরের দিন অস্বস্তিতে কাটাতে হয়। ঠিক কথা। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি, সকালের কাগজটা পড়া শেষ হলে আমি কত ঘটনার কথা জানলাম, কত নতুন এবং পুরনো নামের কীর্তি মনে ঢুকল। আজ যাদের নাম জানলাম, কাল আরও নতুন-নতুন নাম জানতে হল। তিনশো পঁয়ষট্টিটা উপন্যাস যদি এক বছর ধরে পড়ে ফেলা যায় তা হলে তাদের সব চরিত্রের কথা কি মনে রাখা সম্ভব? সম্ভব নয়। কিন্তু খবরের কাগজ পড়তে যাঁরা অভ্যস্ত, তাঁরা বহু নাম অনেক কাল ধরে মনে রেখে দিতে পারেন। বিশেষ করে যে নামগুলো তাঁদের মনে দাগ কেটেছিল। ফাঁসি দিত যে লোকটা, যার নাম নাটা মল্লিক এবং যার ফাঁসি হয়েছিল, সেই ধনঞ্জয়কে সেই সময়ের পাঠকরা মনে রেখে দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়লে এত নাম এবং তাদের কার্যকলাপের কথা আমাদের জানতে হয়। তা কি মনে রাখা সম্ভব?

আমি লক্ষ্য করেছি, খুব কম পাঠকই প্রথম পাতার হেডলাইন থেকে শেষ পাতার শেষ লাইন পর্যন্ত খুঁটিয়ে পড়ে থাকেন। পড়তে-পড়তে বেশিরভাগ পাঠক নিজের পছন্দ তৈরি করে নেন। কাগজ খুলে খেলার পাতাটা পড়ে রেখে দেন এমন কিশোর অথবা তরুণ পাঠককে দেখেছি। আবার প্রথম পাতার রাজনৈতিক খবরগুলো পড়ে ক্ষান্ত হন অনেকেই। আবার সম্পাদকীয় পাতা পড়তে আগ্রহী পাঠক পড়া শেষ করে কলম খুলে শব্দ ভাণ্ডারের সমস্যা সমাধান করেন। সিনেমায় আগ্রহীরা শুক্রবার বা শনিবারের কাগজ সম্পর্কে আগ্রহ দেখান।

কাগজের দাম বাড়ছে, কিন্তু নেশাগ্রস্তরা কাগজ পড়া বন্ধ করছেন না। বিদেশে গিয়ে দেখেছি কারও কাগজ পড়ার সময় নেই। সকাল সাতটায় অফিসে বেরিয়ে যাচ্ছেন, সন্ধ্যায় ফিরে সংসারের কাজ শেষ করে ডিনার খেয়ে বিছানায় যাচ্ছেন, রবিবারের দুপুরে ইন্টারনেট থেকে দেশের কাগজের প্রিন্ট আউট বের করে চোখ রাখেন কেউ-কেউ। কুইন্সের যে বাড়িতে ছিলাম সেই বাড়ির গেটের ওপাশে প্যাকেট বন্দি হয়ে খবরের কাগজ পড়ে থাকত দিনভর। প্রচুর পাতা, অনেক খবর অথচ গৃহস্বামীর সময় ছিল না সেগুলো খুলে দেখার। ওইসব কাগজ মাসান্তে কাগজওয়ালার কাছে বিক্রি করার চল ওদেশে আছে কি না জিজ্ঞাসা করিনি। কিন্তু এদেশে আছে। যে মহিলা সারা মাসে কাগজের পাতা উল্টে দ্যাখেন না, তিনি কিন্তু যত্ন করে গুছিয়ে রেখে দেন। মাসের শেষে যখন পুরনো খবরের কাগজ কিনতে বস্তা কাঁধে লোক আসে তখন তার সঙ্গে প্রথমে দরাদরি চলে। তারপর সেই লোকটি যত দাঁড়িপাল্লায় কারচুপি করার চেষ্টা করে, তত মহিলা তৎপর হন সেটা ধরতে। শেষ পর্যন্ত বিজয়িনীর মতো কাগজ বিক্রির টাকা নিঃশব্দে আলমারিতে রেখে দেন। স্বামীকে জানাবার প্রয়োজন মনে করেন না।

খবর কখন বাসি হয়? সহজ উত্তর, পড়া হয়ে গেলে। আমার কৈশোর পর্যন্ত কেটেছিল চা-বাগানে। গতকালের কাগজ কলকাতা থেকে পৌঁছতে আজকের দুপুর হয়ে যেত। ততক্ষণে কলকাতায় আর একটা কাগজ বেরিয়ে গেলেও ওই কাগজটাকেই নতুন মনে হত। তখন কাগজ ট্রেনে চেপে যেত না ডুয়ার্সে। এখনকার মতো একই সঙ্গে, একই সময়ে কলকাতা এবং শিলিগুড়ি থেকে কাগজ ছাপা হত না।

খবরের কাগজ প্রসঙ্গে কার্যত একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। আমি তখন সবে লিখছি। থাকতাম মুক্তারাম বসু স্ট্রিটে। একদিন সকাল সাড়ে সাতটায় দেখলাম শিবরাম চক্রবর্তী দু’হাতে দুটো মিষ্টির ভাঁড় নিয়ে যাচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘পিছন পিছন এসো।’

রাস্তার একপাশে একটা পোস্ট বক্সের সামনে গিয়ে বসলেন, ‘আমি বগলটা ফাঁক করছি, তুমি কাগজটাকে লুফে নাও’।

দেখলাম একটা খবরের কাগজ ভাঁজ করে তার উপর আর একটা সাদা কাগজে ধানবাদের ঠিকানা লিখে স্ট্যাম্প লাগানো হয়েছে। প্রশ্ন করলে বললেন, ‘এই কাগজ আমি ভোরবেলায় বিনা পয়সায় পাই। পড়া হয়ে গেলে ধানবাদে ভাগ্নির কাছে পাঠাই। পঁচিশ পয়সায় কাগজ না কিনে পাঁচ পয়সার স্ট্যাম্প আমাকে দিয়ে গিয়েছে। ওদের ওখানে সকালের কাগজ দশটায় যায়। এই ডাকবক্সে ফেললে বিকেলে যাবে। কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করে খবরের কাগজ পড়লে যদি কুড়ি পয়সা লাভ হয় তো সেটা কম পাওয়া নয়। ডাকবক্সের পেটে কাগজটা ফেলে দাও।’

ইদানীং বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আবার ফিরে না আসা অবধি খুব টেনশনে থাকি। এই টেনশনটা আগে হত না। যে ছেলেটি আমার গাড়ি চালায় তার হাত খুব ভাল জানা সত্ত্বেও সবসময় মনে হয় যে কোনও মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই যেমন গতকালের ঘটনাটা। আমাদের গলি থেকে বড় রাস্তায় পড়ার বাঁকে যেতেই চোখে পড়ল একটি তরুণী কানে মোবাইল চেপে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছে। ঠিক সেই সময় উল্টোদিক থেকে একটা গাড়ি আসায় ড্রাইভারকে বাঁ দিকে সরে হর্ন বাজাতে হল। তীব্র আওয়াজ সত্ত্বেও মেয়েটি নির্বিকার হয়ে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছিল। আমি গাড়ি থামাতে বলে নিচে নেমে মেয়েটির পাশে গিয়ে ওর হাত থেকে যন্ত্রটা তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার বাবার নাম্বারটা বলো।’ মেয়েটি এমন ভঙ্গিতে তাকিয়েছিল, যাতে মনে হচ্ছিল আমি ওর সম্ভ্রম নষ্ট করেছি। কিন্তু প্রশ্ন শুনে একটু হকচকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’ বললাম, ‘তাঁকে বলব রাস্তার মাঝখান দিয়ে মোবাইলে কথা বলতে গিয়ে তোমার যদি অ্যাকসিডেন্ট হত তা হলে তিনি নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাবেন কিন্তু পাবলিক আমার গাড়ি পুড়িয়ে দেবে। আমার কী দোষ!’ মোবাইলটা ফেরত নিয়ে চলে যাওয়ার সময় মেয়েটি উচ্চারণ করল, ‘থ্যাঙ্কু।’ কিন্তু তাতে এক ফোঁটা বিনয় ছিল না।

ফুটপাতে তো বটেই। রাস্তা পার হওয়ার সময় হয় মোবাইল নয় কানে তার গুঁজে নির্লিপ্ত হয়ে হাঁটার প্রবণতা এত বেড়ে গিয়েছে যে ভয় হয় কখন ওরা গাড়ির নিচে ঢুকে যায়! ভয়টা যারা গাড়িতে বসে থাকে তাদের, ওদের নয়। ট্রাফিক সিগন্যালে সবুজ আলোর সংকেত থাকা সত্ত্বেও একটা হাত তুলে দ্রুতগতির গাড়িকে থামতে বলে ওপারে চলে যাওয়ার সময় পথচারী জানে আর যাই হোক কোনও ড্রাইভার ইচ্ছে করে তাকে চাপা দেবে না। আর সেটা জানা আছে বলে যাবতীয় আইন ভাঙার অধিকার তার আছে। এই ব্যাপারটা ইদানীং যেরকম বেড়ে গিয়েছে তা আগে দেখিনি। আঠারো-কুড়ির ছেলের সঙ্গে পঞ্চাশ পার হওয়া মানুষও একইভাবে আইন ভাঙছেন। এই সময় গাড়িতে সিঁটিয়ে বসে থাকতে হয়। ব্রেকে চাপ একটু কম হলেই ছুটন্ত মানুষগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়বে। এখন আর লাল আলোর জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য দ্রুত কমে যাচ্ছে।

কলকাতার রাস্তায় নবীন যন্ত্রণার নাম মোটর বাইক। এই কিছুদিন আগেও রাস্তায় যে সংখ্যায় বাইক দেখতাম এখন তা কতগুণ বেড়ে গিয়েছে তা মোটর ভেহিকল বলতে পারবে। আগে বাইকগুলো যেত রাস্তার একটা পাশ ধরে। ভদ্রভাবে। এখন তারা কোনও নর্মস মানছে না। ষাট সত্তর কিলোমিটার গতিতে রাস্তার মাঝখান ধরে ছোটার চেষ্টা করছে। আর সামনে গাড়ির সারি দেখলে এর ফাঁক গলে, ওর ফাঁক দিয়ে যেভাবে ছুটছে তাতে রোজ এই শহরে শ’খানেক বাইক আরোহীর মৃত্যু হওয়ার কথা। কিন্তু কাগজের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দু’তিনটি দুর্ঘটনায় পড়ছে। লালবাতির জন্যে রাস্তার মোড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দেখি পঙ্গপালের মতো বাইক আমার গাড়ির গা ঘেঁষে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করছে। গত দুই সপ্তাহে ওই অবস্থায় আমার গাড়ির দু’পাশের আয়না ভেঙে দিয়ে গেল পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায়। এই অপরাধের জন্য কোনও অনুতাপ নেই। ভ্রুক্ষেপ নেই। দ্রুত চোখের বাইরে চলে যেতে ব্যস্ত আজ।

মনে আছে বামফ্রন্টের আমলে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একটি বিদেশি সংস্থাকে মোটর বাইকের কারখানা নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য সেই কারখানা হয়নি। কিন্তু কে জানত সেই উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে আচমকা হাজার হাজার বাইক কলকাতার পথে নেমে পড়বে। মাথার হেলমেটের মধ্যে মোবাইল গুঁজে বাইক চালানোর যে ঝুঁকি তা নিতে এরা কেয়ার করে না। কলকাতার কয়েকটি বিশেষ পাড়ায় একটি বাইকে তিনজন আরোহী সবেগে ঘুরে বেড়ায়, যাদের কারও মাথায় হেলমেট থাকে না। পুলিশকে বললে তারা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তাদের দৌরাত্ম্যে সামান্য দুর্ঘটনা ঘটলে আর বাড়িতে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। কলকাতায় গাড়ি চালানো শেখার স্কুল আছে। সেখানে শিখে পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নিতে হয়। নিশ্চয়ই বাইক চালানো শেখার স্কুল আছে। সেখানে বোধহয় বলা হয়, তুমি তোমার মতো চালাবে, গাড়ির ড্রাইভাররা নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য তোমাকে মারবে না। পার্ক সার্কাস-রবীন্দ্রসদন ফ্লাইওভার হচ্ছে বাইকওয়ালাদের স্বর্গরাজ্য। গতির কারণে নিজেরাই মৃত্যু ডেকে আনে সেখানে।

ইদানীং কলকাতায় গাড়ির আরোহীদের নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। লাল আলোয় গাড়ি দাঁড়ালেই বৃহন্নলাদের দল চলে আসছে জানলায়। তালি বাজিয়ে টাকা চাইছে। লাল থেকে আলো সবুজে পৌঁছে গেলেও তাদের সরতে দেরি হচ্ছে। জানতাম ওরা বাড়িতে সন্তান জন্মালে টাকার জন্য হাজির হত। এখন যেরকম নায়িকা-নায়িকা সাজ সেজে চলে আসছে তা দেখে মনে হচ্ছে ওরা দলবদ্ধ হয়ে কাজ করে। কথা শুনে বোঝা যায় বিহার, উত্তরপ্রদেশে খবর পৌঁছে গিয়েছে কলকাতায় গাড়ির বাবুরা চাইলেই দশ টাকা দেয়। পাঁচ টাকার নোট আজকাল পাওয়া যায় না। এক টাকা দু’টাকার কয়েন দিতে চাইলে বাপবাপান্ত শুনতে হবে। পুলিশ নির্বিকার।

যখন বাড়িতে ফিরি তখন মনে হয় আজকের দিনটায় বেঁচে গেলাম। কিন্তু ক’দিন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *