৮০
স্কটিশে পড়ার সময় সহপাঠীরা জেনে গিয়েছিল আমি উত্তরবঙ্গের ছেলে। অনেকেই এসে জিজ্ঞাসা করত কাঞ্চনজঙঘা দেখেছ? আমি প্রায় বুক ফুলিয়ে জবাব দিতাম, ‘তোমরা যেমন ইচ্ছে করলেই গঙ্গা দেখতে পারো, আমরাও সকাল বিকেল কাঞ্চনজঙঘা দেখতাম।’ এমনভাবে বলতাম যে মনে হত কাঞ্চনজঙঘা দেখাটা কোনও বড় ব্যাপার নয়।
একটু সত্যি ছিল। আমাদের জেলাস্কুলের মাঠের যে দিকটায় হস্টেল ছিল, সেদিকে ভোরবেলায় দাঁড়ালে দূরের আকাশে বরফে মোড়া পাহাড় দেখা যেত। জেনেছিলাম সেটাই হল কাঞ্চনজঙঘা। আকাশ পরিষ্কার থাকলে বিকেলের শেষে সেই পাহাড়ের চুড়ো খুব কম সময়ের জন্যে হলেও দেখা যেত। গোটা দিনে তো বটে, অনেক সময় দিনের পর দিন ওই দিকটা মেঘ বা ঘনকুয়াশায় ঢাকা থাকায় কিছুই দেখা যেত না। সত্যি কথা বললে বলতে হয়, জেলাস্কুলের ছাত্র হিসেবে যা নিয়ে মাথা ঘামাতাম না কলকাতার বন্ধুদের বলার সময় তা বেশ গর্বের বস্তু হয়ে উঠত।
অথচ জলপাইগুড়ি থেকে কাঞ্চনজঙঘার দূরত্ব তো প্রচুর। মাঝখানে প্রচুর গাছপালা, বাড়িঘর অথবা মাঠঘাট পড়ে আছে। শিলিগুড়ি থেকে যা দেখা সম্ভব এবং সহজ তা জলপাইগুড়ি থেকেও যে আবছা দেখা যেত তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু কলকাতার বন্ধুদের এব্যাপারে জানার আগ্রহ ছিল খুব। আমি যেহেতু জলপাইগুড়ি থেকে গিয়েছি তাই দার্জিলিং, কালিম্পংকে ভালভাবে জানি। কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করত, ‘আচ্ছা, মংপুতে রবীন্দ্রনাথ যে বাড়িতে থাকতেন তার চেহারা কীরকম?’ যাহোক একটা বর্ণনা দেওয়ার পর লাইব্রেরি থেকে ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ বইটি এনে জ্ঞান বাড়ালাম।
স্কুলে পড়ার সময় আমি দার্জিলিং-এ যাওয়ার সুযোগ পাইনি। পাহাড় দেখেছি বাস বা ট্রেনের জানালা থেকে। শিলিগুড়ি থেকে সেবক ব্রিজ হয়ে মালবাজারে যাওয়ার পথে যেটুকু পাহাড় পড়ে তাই দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। আর একটি পাহাড়ি শহরে কয়েকবার গিয়েছি গয়েরকাটা থেকে, একবার তো সাইকেলে চেপে, সেটি হল সামচি। ভুটানের প্রান্তিক শহর। বানারহাট পার হওয়ার পরই দূরে পাহাড় দেখা যেত। খুব দ্রুত সেই পাহাড় যেন এগিয়ে আসত। সামচির বাজারে যেসব ভুটানি দোকান ছিল, তা সমতলে দেখিনি। পাহাড় কেটে বাড়ি, তার পাকদণ্ডী পথ, ওটুকুই স্মৃতিতে ছিল। কলকাতার বন্ধুদের কাছে পাহাড় দেখার ব্যাপক অভিজ্ঞতা নেই, বড় পাহাড়ের বুকের শহরে যাইনি বলার সুযোগ ছিল না। কারণ, ওরা ধরে নিয়েছিল, কলকাতার লোক যেমন শ্যামবাজার থেকে হাওড়ায় যায় আমরাও তেমন দার্জিলিং, যাওয়া আসা করি। মালা সিনহা তখন বিখ্যাত নায়িকা। তিনি নেপালি। অতএব প্রশ্ন আসত, দার্জিলিং-এর রাস্তায় হাঁটলে মালা সিনহার মতো মেয়েদের দেখা যায় কিনা! জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ায় আমাদের বাড়ির সামনের কয়ে ফরেস্ট কোয়ার্টার্সে একটি নেপালি পরিবার থাকত। তাদের কাছ থেকে অনেকগুলো নেপালি শব্দ শিখেছিলাম। সেই পরিবারের কিশোরী অত দারিদ্র্যের মধ্যেও কীরকম ছিমছাম সেজে থাকত। তাকে দেখার স্মৃতির সঙ্গে মালা সিনহাকে মিশিয়ে এমনভাবে গল্প করতাম যে সবাই বিশ্বাস করত দার্জিলিং-এ গেলেই তাদের দেখা পাবে।
এই ব্যাপারটা আমি বারংবার দেখেছি। গয়েরকাটা থেকে জলপাইগুড়ি শহর মাত্র পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে। আমি এমন কয়েকজনকে জানি, যাঁরা গয়েরকাটা ছেড়ে গিয়েছেন বড়জোর বানারহাট বীরপাড়া অথবা ধুপগুড়িতে। শিলিগুড়ি বা জলপাইগুড়িতে ষাট বছর বয়স হয়ে গেলেও তাঁদের যাওয়া হয়নি। আবার জলপাইগুড়িতে বাস করেন কিন্তু কলকাতায় যাননি এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। আমার কলকাতায় এসে এই অভিজ্ঞতা আরও চমকপ্রদ হল। শ্যামবাজারে থাকা মানুষ, যিনি চাকরি করতে গেছেন ডালহৌসিতে, পায়ে হেঁটে, তিনি কখনওই টালিগঞ্জ, যাদবপুরে যাননি, কেন যাননি? সহজ উত্তরে যাওয়ার দরকার হয়নি। কলেজে পড়ার সময় এক বন্ধুর পিতামহ আমাকে বলেছিলেন, ‘ভাইটি, তোমার বন্ধুকে আমরা একা ছাড়তে পারছি না, তুমি ওর সঙ্গে যাবে?’
‘কোথায়?’ খুব দূরে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি ভেবে খুশি হয়েছিলাম।
‘বোড়শে। আমার সহকর্মী সেখানে বাড়ি করেছিল। কখনও যাইনি। সে গত হয়েছে চিঠি পেলাম। তাই নাতিকে মিষ্টি দিয়ে আসতে পাঠাচ্ছি। যাবে তো?’
‘বোড়শেটা কোথায় দাদু?’
‘সেকি! বোড়শে চেনো না, ওই যে কথায় বলে, ‘বেহুলে-বোড়শে!’
তাতে বোধগম্য হল না। খোঁজ নিয়ে জানলাম নামটা হল বড়িশা, আদর করে বোড়শে বলা হয়। এই ভদ্রলোক কখনওই ঘন্টা দেড়েক দূরত্বের ওই জায়গায় যাননি।
কিন্তু কতকাল না গিয়েও দার্জিলিং কালিম্পং সম্পর্কে মানুষের ঔৎসুক্য মেটানো যায়? টুরিস্ট ব্যুরো যে পুস্তিকা ছাপায় তা পড়ার পরে নিজেরই মনে হল একবার যাওয়া উচিত। কিন্তু আমরা তখন কলেজ ছুটি হলেই যে ট্রেনে চাপি তা শিলিগুড়ি, পরে এনজেপিতে পৌঁছয় সকালবেলায়। পাশের প্ল্যাটফর্মেই জলপাইগুড়িতে যাওয়ার লোকাল ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকে। ওটাকে দেখলেই মনে হত বাড়ি এসে গেছি। সেই ট্রেনে ওঠার পর দার্জিলিং কালিম্পং মাথা থেকে মিলিয়ে যেত। ফেরার সময় জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে থ্রু কোচে উঠতে হত। সোজা শিয়ালদা। তাছাড়া দার্জিলিং যেতে ট্রেনের টিকিট কাটতে হত, হোটেলে থাকার জন্যে টাকা খরচ করতে হত। কলেজের ছাত্র হলেও সেসব সাধ্যের অতীত ছিল। বাবার কাছে দিল্লিতে যেতে হলে হাত পাতা যায়, পাশের দার্জিলিং-এ যাওয়ার জন্যে নয়।
স্পনসরশিপ কী বস্তু তখন জানা ছিল না। আমার মুখে দার্জিলিং-এর গল্প শুনে শুনে দুই বন্ধু শৈবাল এবং বুবু ঠিক করল সেখানে যাবে। আমাকে তাদের সঙ্গী হতে হবে। আমি এড়াতে চাইলাম। বাবা সারা মাসের হস্টেলের খরচ, কলেজের মাইনে পাঠান, তার উপর মাসে দশটাকা হাত খরচ। সেটা জমে না। তাই শূন্য হাতে যাওয়া যাবে না। কিন্তু ওরা প্রস্তাব দিল, আমি যদি ওদের গাইড হয়ে যাই তা হলে ট্রেনের টিকিট ওরাই কাটবে। হোটেলে যে ঘরে ওরা থাকবে, যে খাবার খাবে তাই ভাগ করে আমিও খাব। তার বিনিময়ে ওদের দার্জিলিং-কালিম্পং ঘুরিয়ে দেখাতে হবে। পালানোর পথ ছিল না। আমি শুধু জেনে নিয়েছিলাম, দার্জিলিং স্টেশনের লাগোয়া একটি বাঙালি হোটেল আছে, কালীবাবুর হোটেল যা বেশ সস্তা। সেখানে ওঠার পরই রাস্তায় বেরিয়ে ওরা খুব হতাশ হয়ে বলেছিল, ‘হ্যাঁরে, মালা সিনহারা কোথায়, দেখাবি তো!’
আমি গম্ভীর গলায় বলেছিলাম, ‘তারা সব বোম্বে চলে গেছে।’
‘কাঞ্চনজঙঘা কোথায়? দেখাবি তো?’
‘সেটা এখন মেঘের তলায় চলে গেছে।’
আমি যে ধরা পড়ে গেছি তা ওরা বুঝতে দেয়নি, এটুকুই বুঝে কুঁকড়ে ছিলাম।
__