গীতবিতান ছুঁয়ে বলছি ২.৭০

৭০

স্কুলে পড়ার সময় দেখতাম, আমি বাড়িতে যে ভাষায় কথা বলি তা সহপাঠীদের থেকে একটু আলাদা। তাদের বাড়িতে গেলে মা-কাকিমারা যেভাবে কথা বলেন, তা আমার মা-পিসিমা বলেন না। ধন্দ লাগত। আমরা বাঙালি, বাংলা ভাষায় কথা বলি। তা হলে উচ্চারণে এবং কোনও কোনও শব্দে এমন তফাত হবে কেন? বড় পিসিমা সটান জবাব দিতেন, ‘ওরা বাঙাল, বাঙাল ভাষায় কথা বলে।’ পিতামহ সতর্ক করতেন, ‘খবরদার, ওদের সঙ্গে মিশছ কিন্তু তোমার জিভে যেন না শুনি। তা হলে তোমার ভাষার পতন হবে।’

জেলা স্কুলের মাস্টারমশাই বেণুদত্ত রায়ের তখন কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে বেশ খ্যাতি। আমাদের ছেড়ে তিনি আলিপুরদুয়ারের কলেজে পড়াতে যাবেন জেনে মন খারাপ। তাঁকেই জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি ব্যাপারটা বুঝিয়েছিলেন। উত্তরবঙ্গের মাটির ভাষা হল রাজবংশী ভাষা। এই ভাষাভাষীরাই প্রথম থেকে এখানে আছেন। ব্রিটিশ আমলের পূর্ববঙ্গের কিছু মানুষের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের কিছু মানুষ কাজের সূত্রে এখানে এসে থেকে গেলেন। এঁরা কিন্তু রাজবংশী ভাষাকে দূরে রেখে নিজেদের ভাষায় কথা বলতেন। ফলে নদিয়ার মানুষ যে ভাষায় কথা বলতেন, ঢাকার মানুষের সঙ্গে মিলল না। স্বাধীনতার পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসা বিপুল মানুষ উত্তরবঙ্গে আশ্রয় নিলেন। মজার ব্যাপার হল, পূর্ববঙ্গের মানুষের ভাষা জেলা অনুসারে আলাদা। কাছাকাছি সীমান্তের ওপার থেকে যাঁরা এসেছেন সেই রংপুর-রাজশাহির মানুষের ভাষায় কিছুটা রাজবংশী প্রভাব রয়েছে। আবার ঢাকার ভাষা চট্টগ্রামের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। চট্টগ্রামের বাঙালির ভাষায় তখনকার আরাকান যা পরে মায়নামোর হয়েছে, সেখানকার ভাষা মিশে গেছে। সিলেটের ভাষা একেবারেই আলাদা। ঢাকার কাছাকাছি হলেও ময়মনসিংহ, ফরিদপুরের ভাষার আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। আবার বরিশালের ভাষা বেশ অন্যরকম। অতএব পূর্ববঙ্গের ভাষা বললে বিশেষ কোনও ভাষাকে চিহ্নিত করা ভুল হবে। এইসব মানুষেরা উত্তরবঙ্গে এসে থাকতে থাকতে ক্রমশ একটি মিশ্র ভাষা তৈরি করে নিয়েছেন নিজেদের অজান্তে।

দক্ষিণবঙ্গ থেকে যারা এসেছেন, বিশেষ করে কলকাতা, বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া বা বর্ধমানের মানুষেরা, এই মিশ্রভাষা থেকে আলাদা হয়ে থেকেছেন। বেণুদা বুঝিয়েছিলেন, বাঁকুড়া, বীরভূমের ভাষা আঞ্চলিক ভাষা। ওই একই কথা বলা যায় পূর্ববঙ্গের ভাষাগুলো সম্পর্কে। কিন্তু এইসব ভাষাই বাংলা ভাষার ডালপালা।

একটা সময় ছিল যখন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মানে গঙ্গা থেকে সাগরের মাঝখানের মানুষ, পূর্ববঙ্গের মানুষকে খাটো চোখে দেখতেন। তাঁদের পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক কিছুতেই স্থাপন করতেন না। একটা কথা চালু ছিল, ‘বাঙালি বাড়িতে মেয়ে দেব না, মেয়ে আনব না।’ শুনে অবাক হতাম। কারণ, খুঁজতে চাইতাম। আমার সহপাঠীদের বেশির ভাগই পদ্মাপারের মানুষ ছিলেন। তাদের বাড়িতে গিয়ে মা-কাকিমাদের যে স্নেহ পেয়েছি তাতে আমি আপ্লুত। তা হলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষরা কোন দোষে তাদের ব্রাত্য করে রেখেছিল তা বোধগম্য হত না। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গীয় এক বৃদ্ধা ধন্দটা ঘোচালেন। বললেন, ‘তুমি কি চাটগাঁয়ের মানুষের বাড়িতে ভাত খেয়েছ? শুনেছি তরকারি, ঝোলে প্রচণ্ড ঝাল দেয়, শুকনো লঙ্কা ছাড়া রাঁধতে পারে না। শুঁটকি মাছ পেলে আনন্দে আটখানা হয়। আমাদের বাড়িতে মেয়ে ওইরকম রান্না, খাবার খেলে দু’দিনেই তাদের পেটে আলসার হবে। ওরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলে তা শুনেছ? বিন্দু বিসর্গ বুঝতে পারবে না। মেয়ের বিয়ে ওদের পরিবারে দিলে সে তো না বুঝতে পেরে দিশেহারা হয়ে যাবে। তার উপর আর একটা ব্যাপার, ওদের বাড়ির মেয়েদের আব্রু কম। হুটহাট বাড়ির বাইরে বের হয়। এই দ্যাখো, আমাদের বাড়ির মেয়েরা কলেজে যায় একজন অভিভাবকের সঙ্গে, ওরা একাই যায়।

আমরা চাই মেয়েরা মেয়েদের কলেজে পড়ুক, তারপর বিয়ে দিয়ে দেব। ওরা ছেলেদের সঙ্গে কলেজে পড়ে তারপর চাকরি করতে চায়। ওদের সঙ্গে আমাদের একটুও মেলে না।

স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময়, সেই ষাট সালে দেখেছি, ঠাকুরদা ছাতির তলায় নাতনিকে নিয়ে বেথুন কলেজে পৌঁছে দিচ্ছেন, নিয়ে যাচ্ছেন। দু-তিন জন পশ্চিমবঙ্গীয় মেয়েকে তাদের অভিভাবিকা আমাদের কলেজের গেট দিয়ে ঢুকে গার্লস কমনরুমে ঢুকিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন। অধ্যাপক ক্লাসে যাওয়ার সময় সেই কমনরুমের সামনে দাঁড়ানো মেয়েদের পিছনে নিয়ে ক্লাসে ঢুকছেন। অথচ পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মেয়েরা ছেলেদের মতনই ক্লাসে যেত। ছেলেদের সঙ্গে কথা বলত। তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হলে দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর পশ্চিমবাংলার মেয়েরা নিজেদের অবস্থান পাল্টাল।

পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগের এই মানসিকতা কখন ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে। এখনকার তরুণ প্রজন্মের কাছে ঘটি-বাঙাল ব্যাপারটা হয়তো ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলার মধ্যে খানিকটা লেগে আছে। একটা সময় শুনতে পেলাম, ‘আমার বউমার রান্নার হাত খুব ভাল। মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। বেয়ান তো ঢাকার মেয়ে।’

উত্তর বাংলায় ক্রমশ একটা মিশ্রভাষা তৈরি হয়ে গেল। জলপাইগুড়িতে গেলে রাস্তায় হাঁটলেই কানে আসে চিৎকার।—’অ্যাই! তুই কবে আসলি?’ এসেছিস বা আইছিস অথবা আসছিলে নয় আসলি। দু-দিন থাকলেই, পরলোকগত পিতামহের নিষেধ সত্ত্বেও আমার মুখ দিয়ে এই মিশ্রভাষা অজান্তেই বেরিয়ে আসে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই মিশ্রভাষা রাজবংশীরা ব্যবহার করেন না। প্রায় দেড়শো বছর এই ভূখণ্ডে বাস করা মদেশিয়ারাও না। এই সেদিন এক বৃদ্ধ কমদতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তুমি তো প্রায়ই বাংলাদেশ যাও। ময়মনসিং গিয়েছ?’

‘হ্যাঁ’ বলতেই তাঁর গলার স্বর বদলে গেল, ‘আমাদের বাসা ছিল নরসিংদিতে। বোঝলা? জানো?’

‘হ্যাঁ’ ওখানেও গিয়েছি।

‘আমার খুব বাসনা, কিন্তু পাসপোর্ট করতেও তো খরচা লাগে।’

মার্চের তিন তারিখে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। ‘উত্তরাধিকার’ পড়ে ওখানকার মানুষ জলপাইগুড়ির ভক্ত। নিজেদের মধ্যে যখন কথা বলছেন, তখন কিছুই বুঝছি না। শেষে না পেরে বললাম, ‘আচ্ছা, আপনারা যে ভাষায় কথা বলেন সেই ভাষায় বাংলা অক্ষরে লেখেন না কেন? অন্তত নিজের লোককে চিঠি লিখতে তো পারেন।’

ওঁরা অবাক হলেন। একজন বললেন, ‘অভ্যাস নাই।’

বললাম, ‘বাংলা আপনাদের পিতৃভাষা। যে ভাষায় কথা বলছেন তা আপনাদের মাতৃভাষা। চেষ্টা করলে লেখা যাবেই। আমরা মোবাইলে বোয়ালে বাংলা লিখি। লেখ্য বাংলায় কথ্য বাংলা লেখা যাবে না কেন?’

বাংলাদেশের বর্তমান সংস্কৃতিমন্ত্রী আসদুজ্জমান নুর বললেন, ‘জানেন সমরেশদা, আমার জন্মভিটে থেকে জলপাইগুড়ি শহরে আধঘন্টায় পৌঁছতাম। আমি ঢাকার ভাষায় কথা বলি না, কিন্তু জলপাইগুড়ির ভাষায় স্বচ্ছন্দে বলতে পারি।’

আচ্ছা, আমাদের উত্তর বাংলার বাঙালিদের একটা নিজস্ব ভাষা তৈরি হচ্ছে তার খবর কি আমরা রাখি?

৭১

এই সেদিনও ছবিটা অন্যরকম ছিল। একটা শহর গড়ে উঠত কয়েকটি মানুষকে ঘিরে। সেই শহরের জন্যে কিছু ভাল কাজ করায় তাঁরা ব্যস্ত থাকতেন। আবার তাঁদের পরে কিছু মানুষ থাকতেন যাদের শহরের সব মানুষ চিনতেন, শ্রদ্ধা করতেন। রায়কত পাড়ার তরু রায়কত অথবা শিল্পসমিতি পাড়ার অনুপম সেন-কে চিনতেন না এমন মানুষ জলপাইগুড়িতে ছিলেন না। শহরটা এমন জমজমাট ছিল যে, মনে হত সবাই এক পাড়ার মানুষ।

একটা শহর এবং কয়েকজন মানুষ। এই ছবিটা বোধহয় বাংলার সব শহরেই অল্পবিস্তর কাছাকাছি ছিল। জলপাইগুড়িতে পড়তে এসেছিলাম চা বাগান থেকে। ক্লাস ফাইভেই জেনে গিয়েছিলাম কারা আমাদের শহরের গর্ব। বাড়ির পাশেই ছিল টাউনক্লাব মাঠ। ফুটবল-ক্রিকেটের ওই ক্লাবের মালি ছিলেন গোপিয়া। বিহারের ওই মানুষটি সারাজীবন টাউনক্লাবকে আগলে রেখেছিলেন।

কতবার ভাঙা দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে ঢুকতে গিয়ে গোপিয়ার তাড়া খেয়েছি, আবার খানিক পরে নিজেই সদর দরজা দিয়ে ডেকে নিয়েছেন তার হিসেব নেই। দেখুন, তখন ক্লাবের মালিকে ‘আপনি’ বলে সম্মান দেখানোর রেওয়াজ ছিল না। ‘তুমি’ বলতাম বাবার বয়সি মানুষটাকে। কিন্তু এখন পিছন ফিরে তাকাতেই ওঁর ডেডিকেশন বুঝতে পেরে মাথা নুইয়ে আসে। পরবর্তীকালে টাউনক্লাবের একটি গেটের নামকরণ হয়েছে ‘গোপিমালি গেট’। ওই গোপিয়া মালি যে মানুষটিকে ঈশ্বর মনে করতেন তাঁকে জলপাইগুড়ির মানুষ ‘ফাদার অফ দ্য টাউন’ আখ্যা দিয়েছিল। তিনি সত্যেন্দ্রপ্রসাদ রায়। খেঁদা রায় নামেই পরিচিত ছিলেন। বেশ কয়েকটি চা বাগানের মালিক অথচ ফুটবল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। লেফট আউটে খেলতেন। তাঁর যৌবনপরবর্তী বয়সের খেলা দেখেছি, রেইনবো কিক মারতেন চমকপ্রদভাবে। ভাল ফুটবল খেললেই চাকরির ব্যবস্থা করে দিতেন অথবা কলকাতার লিগে খেলার জন্যে ক্লাবের ব্যবস্থা করতেন। রোজ সকালে বাবুপাড়ায় তাঁর বাড়ির বাইরে একচালার নিচে বসে মানুষের অভাব শুনতেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন।

বি সি ঘোষ ছিলেন চা বাগানের মালিক। অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ। যে কেউ তাঁর কাছে কিছু চাইলে তাকে নিরাশ করতেন না। ছিলেন চারুচন্দ্র সান্যাল। ডাক্তার হিসেবে তাঁর খ্যাতি এমন ছিল যে, লোকে তাঁকে জলপাইগুড়ির বিধান রায় বলত। দরিদ্র অসুস্থ মানুষ নিঃসঙ্কোচে তাঁর কাছে পৌঁছে যেত, কারণ যার সঙ্গতি নেই তার কাছ থেকে তিনি চিকিৎসার বিনিময়ে দক্ষিণা নিতেন না। ছিলেন রবি সিকদার মশাই, আজীবন কংগ্রেসি রাজনীতি করেছেন কিন্তু মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময় দলীয় রাজনীতি টেনে আনেননি। এই ব্যাপারটা তখন জলপাইগুড়িতে ছিল। ডাক্তার অনুপম সেন কংগ্রেসি ছিলেন কিন্তু পেশেন্ট কোন রাজনীতির সমর্থক তা জানতে চাইতেন না। জানলেও কোনও প্রতিক্রিয়া হত না তাঁর।

আমরা গর্ব করতাম দু’জন ফুটবলারকে নিয়ে। রুনু গুহঠাকুরতা এবং মণিলাল ঘটক। মফসসল শহর থেকে বেরিয়ে এসে দু’জনেই কলকাতায় বিখ্যাত হয়েছেন। রুনু গুহঠাকুরতা ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছেন, মণিলাল ঘটক ইস্টবেঙ্গল দলের গোলকিপার হয়ে বিদেশ সফর করেছেন।

প্রতি রবিবারে তরু রায়কত আসতেন আর্যনাট্য হলে। গানের ক্লাস নিতেন। জলপাইগুড়ির তামাম সংগীত শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে তালিম নিয়েছেন। অথচ ধনী পরিবারের ওই মানুষটি সহজ জীবনযাপন করতেন। যদি স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করে তা হলে তাঁকে সাইকেলে চেপে আদালতে যেতে দেখেছি।

মনে পড়ছে লক্ষ্মণ মৌলিকের কথা। শিয়ালপাড়ায় বাড়ি। ওঁর নেশা ছিল যে কোনও স্পোর্টসে রেফারি হওয়া। ওঁর যখন খেলার বয়স ছিল, তখন আমি শিশু। যখন দেখেছি তখন অত্যন্ত স্মার্ট চেহারার এক প্রবীণকে হুইসল হাতে ছোটাছুটি করতে দেখে মুগ্ধ হয়েছি। একটা সময় ছিল যখন ওঁকে ছাড়া জলপাইগুড়িতে স্পোর্টস হত না।

জলপাইগুড়ির মেয়ে লীনা রাহুত যখন রেডিওতে গান গাইতেন তখন আমাদের কী আনন্দ! পরে নীতি ঘটককে বিয়ে করে লীনা ঘটক হয়েছিলেন। নীতিবাবু ভাল ফুটবল খেলতেন কলকাতার ক্লাবে। আমি প্রদ্যোৎ নারায়ণকে দেখিনি। শুনেছি তিনিও জলপাইগুড়ির মানুষ। কিন্তু রেডিওতে তাঁর গান শুনেছি, শুকতারা ওই দেখো ডুবে যায়, ভোরের আলো তারে বিদায় জানায়।’ অনবদ্য।

জলপাইগুড়ির কলেজে পড়াতে এসেছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। মূলত, তাঁকে ঘিরেই জলপাইগুড়ির তরুণ লেখকরা উজ্জীবিত হয়েছিল। দেবেশ রায়, অর্ণব সেন, অশোক বসু কলকাতার বড় কাগজে লিখতে শুরু করেন। দেবেশদা তো আজ বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিস্তাকে তিনি পদ্মা, গঙ্গা, ধলেশ্বরীর পাশে জায়গা করে দিয়েছেন। ওঁদের আড্ডা ছিল স্টেশনের কাছে কার্তিক লাহিড়ীর মেসে, সেখানে সমরেশ বসুকে দেখেছি।

জলপাইগুড়িতে বহুবছর ধরে নাট্যচর্চা হয়ে আসছে। মূলত আর্যনাট্য এবং বান্ধবনাট্য, অগ্রণী ভূমিকায় ছিল। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন থেনু কাকা এবং সতী কাকিমা। সন্ধ্যায় ওঁরা আর্যনাট্যে রিহার্সালে যেতেন। মনে রাখতে হবে পঞ্চান্ন সালে বাঙালি ঘরের বউ পুরুষদের সঙ্গে নাটক করছে তা নিশ্চয়ই অনেকে মানতে পারতেন না। কিন্তু সতী কাকিমারা সেটাকে সম্ভব করেছিলেন।

আটান্ন সালে কলকাতায় বেড়াতে এসেছিলাম, সঙ্গী ছিল কুমারেশ দেব। বিশ্বরূপায় নাটক দেখে বেরিয়ে সে বলেছিল, ‘জানিস সমরেশ, ভাল নাটক করতে হবে।’ অর্ধশতাব্দী ধরে কুমারেশ জলপাইগুড়িতে তার দল নিয়ে নাটক করে চলেছে।

এখন একটা শহর গড়ে ওঠে, বিস্তৃত হয়, আকাশছোঁয়া বাড়িতে মানুষ বাস করে। এই নবীন শহরগুলো তৈরি হয় প্রোমোটারের পরিকল্পনায়। আগের মতো মানুষের ভালবাসা, ঔদার্য, আন্তরিকতার কোনও ভূমিকা এই শহরগুলোতে থাকে না। মানুষ বেঁচে থাকে যন্ত্রের মতো। পাশের ফ্ল্যাটের মেয়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলে সুযোগ পেলে তার জন্যে আনন্দিত হয় না কেউ। বিপদে পড়ে সাহায্যের জন্যে কারও কাছে যাওয়ার মতো মানুষ এখন নেই।

কিন্তু এখনও জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, কোচবিহার বা আলিপুরদুয়ারে সম্পর্কগুলো যতই ক্ষয়ে যাক তবু যেটুকু আছে তার জন্যে বেঁচে থাকা যায়। ফুটবল খেলতে যাওয়ার নাম করে খেঁদা রায়ের কাছ থেকে বল আর টাকা নিয়ে আমরা পিকনিক করেছিলাম। এখন সেটা ভাবলেই নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আমার লেখায় বারংবার উত্তরবঙ্গ আসে বলে কলকাতায় অনেকে অনুযোগ করেন। আবার দু’-সপ্তাহ আগে ঢাকায় গিয়ে শুনলাম, আমার লেখা পড়ে অনেকেই নাকি শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়িকে স্পষ্ট দেখতে পান। বাকি জীবনে এই কাজটাই করে যেতে চাই।

৭২

‘পঞ্চাশ-চুয়ান্ন বছর আগে, আমরা যখন উত্তর বাংলার স্কুলজীবন শেষ করে কলেজে ভর্তি হতে যাচ্ছি, তখন আমাদের অনেকেরই কোনও লক্ষ্য ছিল না। কী বিষয় নিয়ে পড়লে ভবিষ্যতে উপকৃত হব সে সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা ছিল না। আমাদের অভিভাবকরাও এই ব্যাপারে সুপরামর্শ দিয়েছেন বলে মনে পড়ছে না। হায়ার সেকেন্ডারি পাস করেছ অতএব কলেজে ভর্তি হয়ে যাও, এই রকমটাই সবার ভাবনায় ছিল। যারা বিজ্ঞান নিয়ে পড়ত তাদের সামনে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি হওয়ার পথ খোলা থাকত। কিন্তু যারা আর্টসের ছাত্র, যাদের সংখ্যাই বেশি, তারা যে যেমন পারে বিষয় ঠিক করে অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হত। কয়েকজনকে আলোচনা করতে শুনেছি, কোন বিষয়ে অনার্স নিয়ে কম পরিশ্রম করতে হবে ওরা সেই বিষয়টাকে নির্বাচন করবে। ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই, আমাদের পড়াশোনায় কোনও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিল না।

তখন জলপাইগুড়িতে ছেলেদের একমাত্র কলেজ আনন্দচন্দ্র। বাড়ির ভাত খেয়ে সাইকেলে চেপে দিব্যি কলেজ করা যায়। এখন ভাবি এত ছেলের জায়গা হত কী করে? কেউ কেউ যেন ট্রেন ধরে শিলিগুড়িতে। আর কিছু ছেলে যাদের হায়ার সেকেন্ডারির নম্বর পঞ্চাশের উপর থাকত তারা বাবা-মাকে কোনওরকমে ম্যানেজ করে নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেসে উঠত। তখন নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস শিলিগুড়ি থেকে ছাড়ত সন্ধ্যাবেলায়। সারা রাত গড়িয়ে চলে ভোরের মুখে থামত গঙ্গার চরে। সেই চরের নাম কখনও সকরিকলি-মণিহারি, কখনও খেজুরিয়া-মোকামা। লঞ্চে উঠে কৈশোর পার হওয়া উত্তরবঙ্গীয় তরুণরা অভিযাত্রীর মতো নদীর ওপারে দাঁড়ানো ট্রেনে উঠে শিয়ালদায় নামত বিকেলবেলায়। জেলাস্কুলে পড়তাম এমন দশ-এগারোজন ছাত্র যে যার মতো হাজির হয়েছিলাম কলকাতায় পড়তে। কেন কলকাতা? উত্তরটা তখন খুব সহজ ছিল। কলকাতার কলেজে পড়লে পড়াশোনা খুব ভাল হয়, অনেক কিছু জানা যায়, ভবিষ্যৎ মজবুত হয়।

কলকাতার ছেলেরা উত্তরবঙ্গের ছেলেদের চেয়ে অনেক চৌকশ তাই কলকাতায় পড়ে ওদের সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে। জেলাস্কুল থেকে স্কুল ফাইনালে প্রথম হওয়া অশোককুমার বসু, ফণীন্দ্রদেব থেকে প্রথম দশজনে থাকা রামগোপাল আগরওয়ালরা ব্যতিক্রম। সবাই তো ওদের মতো হতে পারে না। তাই কলকাতায় গিয়ে নিজেকে তৈরি করতে হবে, এইরকম মনোভাব অনেকের ছিল।

শিয়ালদা স্টেশনের একদম কাছে দু’টো কলেজ, সুরেন্দ্রনাথ, বঙ্গবাসী। আর একটু এগোলেই সিটি কলেজ। সেখানে তখন ভর্তির দরজা হাট করে খোলা। উত্তরবঙ্গের ছেলেরা যেন ট্রেন থেকে নেমেই সেখানে ঢুকে বাড়িতে চিঠি লিখত, ‘আমি কলেজে ভর্তি হইয়াছি’। স্যর সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত কলেজ, উত্তরবঙ্গে বসে বাড়ির অভিভাবকরা খুশি হতেন। সকাল, দুপুর, রাত তিন দফায় কলেজ চলত। মজার কথা হল, ওই সিটি কলেজের আগেই সেন্ট পলস। তার পরিবেশ, ছাত্রদের চালচলন দেখে বোঝা যেত, ওখানে পড়াশোনায় কোনও ফাঁকি দেওয়া যায় না। জানি না কেন, আমাদের ছেলেদের অনেকেই কলেজটাকে এড়িয়ে যেত। যেসব সিরিয়াস ছেলে প্রেসিডেন্সি বা স্কটিশে সুযোগ পেত না তারা ভর্তি হত সেন্ট পলসে। গয়েরকাটার ছেলে দীপক পাল ফিজিক্স নিয়ে সেন্ট পলসে ভর্তি হয়ে ভাল রেজাল্ট করেছিল। আমি গিয়েছিলাম স্কটিশচার্চে। ইকনমিক্সে অনার্স চেয়ে না পেয়ে বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। খবর পেয়ে বাবা লিখেছিলেন, ‘তুমি নিজের ভবিষ্যতের সর্বনাশ করলে।’ একথা পড়ে মনে হয়েছিল, এতকাল বাবা কেন উপদেশ দেননি কী করলে আমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে।

উত্তরবঙ্গ থেকে আসা ছাত্রদের প্রধান সমস্যা ছিল থাকার জায়গা পাওয়া। বেশিরভাগ কলেজে হস্টেলের ব্যবস্থা থাকলেও ভর্তি হয়েই জায়গা পাওয়া যেত না। তখন খুঁজে বের করতে হত শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার বা কোচবিহারের ছেলে হস্টেলের বোর্ডার হয়ে আছে কি না। থাকলে তার গেস্ট হয়ে এক-দেড় মাস কাটিয়ে নিজের হস্টেলে চলে যেত সবাই। এই ব্যাপারটা তখন ছিল। চিনি না জানি না কিন্তু নর্থবেঙ্গলে বাড়ি শুনলেই মনে হত এ আমার আত্মীয়। একটা রসিকতা চালু ছিল, ‘কী রকম ভাই? না, মামাতো, মাসতুতো, খুড়তুতো অথবা নর্থবেঙ্গলতুতো।’

নিজের নিজের কলেজ-হস্টেলের বাইরে উত্তরবঙ্গের ছেলেদের একটা ভাল আস্তানা ছিল হিন্দু হস্টেল। মূলত প্রেসিডেন্সির ছাত্রদের জন্য হলেও বাইরের কলেজের ছাত্ররা ওখানে গেস্ট হয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করতে পারত। স্কটিশের ‘রেসিডেন্স’ হস্টেল ছিল তেমনই। স্কটিশের অন্য হস্টেলগুলোতে বাইরের ছেলেরা থাকতে পারত না, কিন্তু রেসিডেন্সে পারত। মালদার সমরেন্দ্র ঘোষ, বালুরঘাটের সাহা, জলপাইগুড়ির অবনীশ, সাধন মৃধারা তিন বছর নরক গুলজার করার পর বিএ ডিগ্রি নিয়ে জেলায় ফিরে যেত। তারপর কেউ জলপাইগুড়ির এলআইসি-তে, কেউ কনট্রাক্টরি বা চা বাগানের সাপ্লাই ব্যবসায় সারা জীবন কাটিয়ে গেল। কলকাতায় পড়তে না গিয়ে আনন্দচন্দ্র কলেজে পড়লে কী ফারাক হত!

তখন একটি ছেলেকে কলকাতার হস্টেলে রেখে কলেজে পড়ালে মাসে জ্ঝঙ্ম টাকা খরচ হত। এটা ষাট সালের হিসেব। এর মধ্যে হস্টেলের খরচ, কলেজের মাইনে ছাড়া হাত খরচও ছিল। ষাট সালের জ্ঝঙ্ম টাকার মূল্য ছিল যথেষ্ট। একজন কেরানি বা স্কুল শিক্ষক দেড়শো টাকা মাইনে পেত। তখন বুঝতাম না, উত্তরবঙ্গের চাকরি করা বাবা কত কষ্ট সহ্য করে ছেলেকে কলকাতায় পড়তে পাঠাতেন। তার বদলে এইসব ছেলেদের কাছ থেকে তাঁরা কী পেয়েছেন তা তাঁরাই জানেন।

কিন্তু কলকাতায় পড়তে গিয়ে দেখেছি আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। সেই পিছিয়ে থাকার ব্যবধান দূর করতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হত, যেমন যারা সাহিত্য নিয়ে পড়তাম তারা জলপাইগুড়িতে কাম্যু, সোরাভিয়ার নাম শুনিনি। এমনকী রবীন্দ্রনাথের নব্বইভাগ রচনা অচেনা ছিল। সার্ত্রে কে জানতাম না। কলকাতার ছেলেরা যখন আলোচনা করত তখন নিজেকে নির্বোধ মনে হত। আসলে আমাদের স্কুলগুলোতে পাঠ্যপুস্তকের বাইরের জগৎটাকে চেনানোর ব্যবস্থা ছিল না। বাইরের পৃথিবীর খবর, একমাত্র খেলা ছাড়া, আমরা রাখতামই না। ফলে কলকাতার ছেলেদের পাশে নিষ্প্রভ থাকত বেশির ভাগ উত্তরবঙ্গের ছেলে। একজন অমিয়ভূষণ মজুমদার, অশ্রু শিকদার, দেবেশ রায়, মণিলাল ঘটক, রুনু গুহঠাকুরতা যে পরিচিতি পেয়েছেন তা তাঁদের যোগ্যতার জন্যই, বাকিরা যোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি তখন।

এখন ছবিটা বদলে গিয়েছে। কলকাতা-শিলিগুড়ির মধ্যে তফাত নেই। কম্পিউটারের কল্যাণে শিলিগুড়ির হাসপাতাল-পাড়ার কিশোরের মুঠোয় পৃথিবীটা চলে এসেছে। অভিভাবকরা পাশে থাকছেন সাহায্যের হাত নিয়ে। মাঝে মাঝে তাদের বাড়াবাড়ি অস্বস্তিকর হলেও ছেলেরা রাস্তা চিনতে ভুল করছে না। তুলনায় মেয়েদের অগ্রগতি হয়েছে বিস্ময়করভাবে। একটি হায়ার সেকেন্ডারি পার হওয়া মেয়ে সেই সময়ের আমাদের চেয়ে বহুগুণে সম্পূর্ণা। এখন আর উত্তর বাংলার ছেলেমেয়েদের হীনম্মন্যতায় ভোগার কারণ নেই।

শুধু একটাই আফসোস, এখনকার উত্তরবঙ্গের ছেলেমেয়েরা বাইরে এসে নিজেদের সম্পর্কের উপর ‘উত্তরবঙ্গতুতো’ ছাপটা মুছে ফেলেছে।

৭৩

আমাদের তরুণ বয়সে জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়িতে যেসব ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন তাঁরা এখন কেমন আছেন? মাঝেমাঝেই মনে হয় তাঁদের খোঁজখবর নিই। ষাট সালে যখন আমি হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার প্রথম ব্যাচের ছাত্র তখন বয়স ষোলো। তারপরের বছরগুলো যোগ করলে ঝট করে সত্তর সংখ্যাটা সামনে চলে আসে। সেই ষোলো বছর বয়সে কেউ সত্তর বছরের শুনলে বেশ সমীহ করতাম আর ভাবতাম, মানুষটা আর কদিন? আমার বন্ধু রায়কতপাড়ার মন্টি ওই বয়সের লোকদের বলত, ‘শুড্যা’। অভিধান দেখিনি কিন্তু অনুমানে বুঝতাম শুড্যা মানে জরাগ্রস্ত পুরুষ, যার থাকা বা না থাকায় কোনও এসে যায় না। আজ সত্তরে পা দিয়ে মন্টির কথা মনে এল। হাসিখুশি ঝকঝকে ওই ছেলেটিকে মেয়েরা খুব পছন্দ করত। পঞ্চাশেই পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে বেচারাকে। শুড্যা হতে হয়নি। কিন্তু আজ মন্টি থাকলে তাকে জিজ্ঞাসা করতাম, একুশ বছর বয়সে যে জীবনযাপন করতাম, এখনও তাই করে যাচ্ছি। সকালে লেখার কাজ সেরে দুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইরের কাজ আর আড্ডার পরে রাত দশটায় যখন ফিরছি তখন একটুও অবসন্ন বোধ করছি না। তা হলে আমাকে কি শুড্যা বলা যাবে? মন্টি বলত, শুড্যার স্টেজে পৌঁছলে মানুষ একটু ঝুঁকে হাঁটে, হাতে লাঠি চলে আসে, মুখে বাঁধানো দাঁত থাকে, জামা বা পাঞ্জাবির রং সাদা হয়। পঞ্চাশে চুল পাকলেই যারা রং লাগাত, তারা ‘শুড্যা এজে’ পৌঁছতেই রং দেওয়া বন্ধ করে। চুল দেখলে চড়ুই পাখির পালকের কথা মনে আসে যার রোঁয়া উঠে যাচ্ছে। ‘শুড্যা এজে’ পৌঁছলে বেশিরভাগ মানুষ ভাবে পৃথিবীর সবাই তাকে অবহেলা করছে। তখন একটাই চিন্তা, গেলেই ভাল হয়।

কিন্তু সত্তর বছরে পৌঁছেও মন্টির ফর্মুলা আমার ক্ষেত্রে একদম কাজে লাগছে না। এখনও শরীরের কলকব্জাগুলো ঠিকঠাক আছে, চুল সাদা হয়ে যাওয়ার আগে-পরে রং লাগানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। রঙিন শার্ট আগের আগের বছরগুলোয় যেমন পরেছিলাম তা এখনও পরছি। দীক্ষা নেওয়ার কথা এখনও ভাবিনি কারণ, রবীন্দ্রনাথ আমাকে দীক্ষা দিয়ে গেছেন। কোনও পার্টিতে গেলে একমাত্র মদিরা খেতেও আপত্তি করি না। ষোলো বছর বয়সে ভাতের সঙ্গে যা যা সবজি বা মাছ, মাংস, ডিম খেতাম এখনও তাই চালিয়ে যাচ্ছি।

এই আমি যখন ভাবলাম আমাদের তরুণ বয়সের ডাকসাইটে সুন্দরীদের সন্ধান করব, যাঁদের গত পঞ্চাশ বছরের উপর দেখিনি, যাঁদের খবর পাইনি, তাঁরা কোথায় আছেন। পঞ্চাশ বছর যে বিশাল সময় তা নিজেকে দিয়ে কখনও ভাবিনি। টেলিফোনে জলপাইগুড়ির তপনকে জানালাম, ‘সামনের রবিবার যাচ্ছি, জরুরি দরকার আছে।’ তপন ক্লাস থ্রি থেকে আমার সহপাঠী। দারুণ গান গাইত। আমাদের অনেক অভিযানের বিশ্বস্ত সঙ্গী। জলপাইগুড়ির আশ্রমপাড়ায় তপনের বাড়িতে আমাদের প্রথম বৈঠক হল। ওকে দেখলে আমার ভাল লাগে কারণ, ও সত্তরে পৌঁছেও শুড্যা এজের বাইরে থেকে গেছে। বললেই ‘মৌ বনে আজ মৌ জমেছে’ গানটা আগের গলায় গেয়ে ওঠে।

আমার উদ্দেশ্য শুনে তপন বলল, ‘সমরেশ, তুই আগের মতো আছিস। একবার ভেবে দেখেছিস তখন যারা পনেরো থেকে সতেরোর মধ্যে ছিল এখন তাদের বয়স কত? প্রায় সত্তর। সত্তর বছরের একজন বাঙালি মহিলার চেহারা কী হতে পারে ভেবে দ্যাখ।’ হেসে বললাম, ‘তুই বেসিক ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস না। আমি কার কীরকম চেহারা হয়েছে তা জানার জন্যে খোঁজ করছি না। বেশিরভাগ মানুষের চেহারা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। যারা বয়সের সঙ্গে লড়াই করতে পারে, শরীর ঠিক রাখতে জিমে যায়, পরিমিত খাবার খায়, নিয়মিত পার্লারে গিয়ে শরীরটাকে তাজা রাখে তাদের ক্ষেত্রে বদলে যাওয়ার প্রক্রিয়া খুব ধীরে হয়। কিন্তু আমি দেখতে চাইছি সেইসব সুন্দরীরা, যাঁদের এককালে অহংকারী মনে হত, তাদের মন মেজাজ এখন কেমন আছে।’

‘খুব ডিফিকাল্ট ব্যাপার। প্রথমত, ওঁদের কাছে পৌঁছনো সহজ নয়। দ্বিতীয়ত, পৌঁছলেও ওঁরা মুখ খুলবেন কি না তাতে আমার সন্দেহ আছে। তাছাড়া, তপন হাসল, যেসব বাড়িতে ওদের তুই, আমি পঞ্চাশ বছর আগে দেখেছি সেইসব বাড়িতে এখন তাঁদের থাকার কথা নয়। জলপাইগুড়ির সব ছেলেরা যাঁদের জন্যে মুখিয়েছিল তাঁদের সৌন্দর্যের জন্যে, সহজেই বিয়ে হয়ে গেছে ভাল পাত্রের সঙ্গে। সেই জলপাইগুড়ির মেয়ে হয়তো এখন শিলিগুড়িতে, কলকাতায়, দিল্লিতে কিংবা লন্ডনে। তখন যে খাঁচায় ছিল সেই খাঁচায় হয়তো এখন অন্য পাখি কিংবা খাঁচা শূন্য। তবু, এই ব্যাপারে রঞ্জনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। ওর বাড়িতে চল।’

রঞ্জন আমাদের সহপাঠী ছিল। বেচারার হাই সুগার, হাঁটুতে ব্যথা, হার্টের ওষুধ খায়। বাড়ির বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। আমাদের দেখে ও খুশি হল বটে, আমার কষ্ট হল। কী দারুণ দেখতে ছিল রঞ্জন সেই সময়।

আমাদের উদ্দেশ্য শুনে রঞ্জন বলল, ‘ওসব কথা এই বয়সে কেন ভাবছিস?’

‘তুই তো ওদের কাউকে কাউকে চিনতিস। তেলিপাড়ায় থাকত নীলা, মাথা খারাপ করে দেওয়ার মতো দেখতে। একমাত্র তোর সঙ্গে কথা বলত। ও কোথায় আছে?’ তপন জিজ্ঞাসা করল। রঞ্জন চোরের মতো ভিতরের দরজার দিকে তাকিয়ে গলা নামাল, ‘নীলা থাকে শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ায়। ওর ছেলে ডাক্তার। একবার নাতনিকে নিয়ে বাপের বাড়িতে এসেছিল। এখন তো সেই বাড়ি বিক্রি করে ওর ভাই কলকাতায় চলে গেছে। ওর স্বামী নামকরা ডাক্তার। ডাক্তার মিত্রের নাম সবাই জানে।’ রঞ্জন বলল।

বেরিয়ে এসে তপন বলল, ‘এটাই ঠিক ছবি। হয় শরীরে মেদ জমেছে, বাতের ব্যথায় ভুগছে, নয় রোগা, পেটের অসুখ ছাড়ছে না, চুল উঠে গেছে অনেকটা। স্বামী বেঁচে থাকলে একরকম, না থাকলে রাত্রে ঘুমনোর আগে ভাবেন, বিয়ের আগে কী ছিলাম!

তপনকে রাজি করালাম। করিয়ে শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ায় এলাম জলপাইগুড়ি থেকে। জানা গেল, তপনের এক পরিচিত ভদ্রলোক ডাক্তার মিত্রের খুবই ঘনিষ্ঠ। তাঁকে নিয়ে হাজির হলাম রবিবারের বিকেলে। বেশ বয়স হয়েছে ডাক্তারবাবুর। একবার বাইপাসও হয়ে গিয়েছে। তবু চাপে পড়ে সকালে আটজনের বেশি পেশেন্ট দেখেন না। বিকেলে তো নয়ই। পরিচয় পেয়ে বললেন, কী সৌভাগ্য। আপনার লেখা উত্তরবঙ্গ সংবাদে আগ্রহ নিয়ে পড়ি। আপনারা আমার শ্বশুরবাড়ির শহরের মানুষ। তারপর চেঁচিয়ে ডাকলেন, ‘নীলা, দ্যাখো, কে এসেছে।’ নীলাদেবী এলেন। ঈষৎ ভারী শরীর, মুখে চর্বি জমেছে, পরনে অল্পবয়সিদের ধরনে পরা রঙিন শাড়ি। সাজগোজের শখ আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘খুব চেনা লাগছে।’ ডাক্তারবাবু পরিচয় দিলে, হেসে ফেললেন, ‘ওম্মা! আপনারা দেখছি প্রায় একইরকম আছেন। আপনার জলপাইগুড়িকে নিয়ে লেখাগুলো বেশ ভাল লাগে। আমাকে কেমন দেখছেন?

তপন মাথা নাড়ল, ‘ভাল’। নীলাদেবী বললেন, ‘একদম না। আমার যা ছিল তা আমার নাতনি নিয়ে নিয়েছে। এই টুসি একটু এই ঘরে আয়।’ নাতনি এসে হাসল। আমি চমকে উঠলাম। অবিকল সেই ষোলো বছরের নীলা। এই সময় বাইরে বাইকের হর্ন বাজল। নীলা বললেন, আপনারা সাইকেলের বেল বাজাতেন, এখনকার ছোকরারা বাইকের হর্ন বাজায়।’

তা হোক, বুঝলাম, সেই ট্র্যাডিশনের কোনও পরিবর্তন হয়নি।

৭৪

সুহাস তালুকদার মশাইয়ের নামে শিলিগুড়ির একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে জেনে খুব খুশি হয়েছিলাম। শ্রীযুক্তা গঙ্গোত্রী দত্ত এবং তাঁর সহযোগীদের এই জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু দু’বার ফোনে লাইন না পাওয়ায় সেই ইচ্ছে পূর্ণ হয়নি।

কেন এই ইচ্ছে হয়েছিল? জ্ঞান হওয়ার পর থেকে জানতাম খবরের কাগজ ছাপা হয় কলকাতা শহরে। সেগুলো বিমানে নামে বাগড়োাগরায়। সেখান থেকে জলপাইগুড়ির বাড়িতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যায়। আবার আমাদের গয়েরকাটার বাড়িতে সেটা পৌঁছয় পরের দিন দুপুরে। কারণ সকালের নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেসে চেপে সেই কাগজ শিলিগুড়িতে নামে পরের দিন সকালে। তারপর গয়েরকাটায় যেতে দুপুর হয়ে যায়। এটাই স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। আমরা সেই কাগজের খবর গোগ্রাসে গিলতাম। বাসি খবরও বাসি সন্দেশের মতো মুখরোচক মনে হত।

জলপাইগুড়ি শহর থেকে দৈনিক খবরের কাগজ বের করার সাহস কেউ দেখাননি। সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হত। যেমন জনমত, তাতে খবরের চেয়ে প্রবন্ধই বেশি থাকত। আর খবর যা থাকত তা সম্পাদকের পছন্দ অনুযায়ী নির্বাচন করা। অতএব রেডিওতে খবর শোনা অথবা বাসি খবরের কাগজ পড়েই আমাদের তৃপ্ত থাকতে হত।

জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার এবং শিলিগুড়ি—এই চারটি শহরের মানুষ চিরকালই সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনস্ক। সে সময় শিলিগুড়িতে বেশি ব্যবসায়ী এবং অবাঙালিরা থাকতেন বলে ওই শহরকে চার নম্বরে রাখা হত। কিন্তু এইসব শহরের মানুষ সাহিত্য পত্রিকার জন্যে কলকাতার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতেন। ছেলেবেলা মাসিক বসুমতী, দীপালি, উল্টোরথ, সিনেমা জগৎ যেমন বাড়িতে আসত তেমনই দেশ পত্রিকারও ব্যাপক চাহিদা ছিল। শংকরের কত অজানারে, চৌরঙ্গী, বিমল মিত্রের সাহেব বিবি গোলামের মতো ধারাবাহিক উপন্যাসের জন্যে দেশ স্টলে পড়ে থাকত না। জলপাইগুড়ি শহর থেকে কেউ কেউ চেষ্টা করতেন মাসিক বা ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা বের করতে। কিন্তু সেগুলোর আয়ু বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যেত। কেন?

মনে আছে, উনিশশো ষাট সালে আমি যখন কলকাতার কলেজে পড়তে আসি তখন গয়েরকাটায় সতী সেনগুপ্ত মশাই, যিনি পরে ময়নাগুড়িতে চলে গিয়েছিলেন, যাঁকে সবাই সতীমাস্টার বলেই জানত, আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন কোরক নামের একটা কাগজ কলকাতা থেকে ছাপিয়ে দিতে। ছাপানো এবং পাঠানোর যাবতীয় অর্থ তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। আমি আগামী পত্রিকার সম্পাদক প্রসূন বসু মশাইয়ের প্রেসে কাগজ ছেপে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ওই পদ্ধতি যে সম্পূর্ণ অব্যবসায়িক, তা সতীমাস্টার পরে বুঝেছিলেন। অথচ জলপাইগুড়ির প্রেসগুলো তখনও পিছিয়ে ছিল। যা ছাপা হত তা কলকাতার পত্রিকার ছাপার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত না। রঙিন প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে এই ব্যবধান প্রকট হত। ফলে পাঠক আকৃষ্ট হতেন না।

কিন্তু সেই সময় ওই চার শহরে ভাল লেখকের অভাব ছিল না। জলপাইগুড়ির দেবেশ রায়ের তো গোটা বাংলায় খ্যাতি, অশোক বসু, সমীর রক্ষিতরা নিয়মিত কলকাতার বড় কাগজে লিখছেন। নির্মলেন্দু গৌতম তো শিশু সাহিত্যে জাতীয় পুরস্কার পেয়ে গেছেন। আলিপুরদুয়ারের বেণু দত্ত রায় তখনই বিখ্যাত কবি গল্পকার। অর্ণব সেন শুরু করেছিলেন আনন্দবাজারে লিখে। তারপর অধ্যাপনা তাঁকে একটু স্তিমিত করলেও থামেননি। সবার উপর ছিলেন অমিয়ভূষণ মজুমদার। কোচবিহার বললেই তাঁর কথা মনে আসে। শিলিগুড়ির অশ্রুকুমার শিকদার প্রবন্ধে গভীর আলোচনা করছেন।

এত শক্তিশালী লেখক থাকা সত্ত্বেও আমাদের ওই চার শহরের কোথাও থেকে একটা মাসিক বা ত্রৈমাসিক পত্রিকা দীর্ঘস্থায়ী হল না। কারণটা কি সমন্বয়ের অভাব? লক্ষ করেছি, ওইসব পত্রিকায় কলকাতার লেখকদের লেখা থাকত। পরে অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, কলকাতার লেখকরা তাঁদের ভাল লেখাগুলো কখনওই পত্রিকায় ছাপতে দেন না। অথচ তাঁদের লেখার জন্যে মুখিয়ে থাকেন এই পত্রিকাগুলোর সম্পাদকরা। এটাও পাঠকদের পছন্দ নাও হতে পারে।

সুহাস তালুকদার মশাই-এর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেই সময়ের খ্যাতিমান লেখক সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। কলকাতার অফিসে সুহাসবাবুর ঘরে আমাকে প্রায় ধরে নিয়ে গিয়ে পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই দেখুন, সমরেশ, জলপাইগুড়ির ছেলে।’

সুহাসবাবু হেসে বলেছিলেন, ‘আমি ওঁর লেখা পড়ি। খুব ভাল হল দেখা হয়ে। আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি আমাদের কাগজে লেখার জন্য। উত্তরবঙ্গের লেখকদের লেখাই ছাপতে চাই।’

আমি শুনেছিলাম, সুহাস তালুকদার শিলিগুড়ি থেকে দৈনিক খবরের কাগজ বের করছেন। সেইসঙ্গে একটি সাহিত্য পত্রিকা যার নাম তথ্যকেন্দ্র। ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে অসুবিধে হয়েছিল। আমাদের ওখানকার মানুষ তখন আনন্দবাজার, যুগান্তর পড়তে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা কেন শিলিগুড়ির একটা খবরের কাগজ পড়বে যা কলকাতার কাগজের সঙ্গে নিঃসন্দেহে পাল্লা দিতে পারবে না! এই কাগজ তো বেশিদিন বের করতে পারবেন না সুহাসবাবু।

কিন্তু সুহাসবাবু আমাকে বললেন, ‘দেখুন শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ির মানুষ দুপুরে কলকাতার কাগজ পায়। তিস্তার ওপারে জায়গাগুলোতে গতকালের কাগজ যায়। মানছি, প্রথম দিকে আমাদের কাগজ ওই কলকাতার কাগজের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। ওরা যে বিজ্ঞাপন পায় তা আমরা পাব না। ওদের কাগজ বাংলা এবং বাংলার বাইরে যায়। আমাদের কাগজ চলবে শুধু উত্তরবাংলায়। তাই বিজ্ঞানপদাতারা প্রথম দিকে আমাদের বিমুখ করবে। কিন্তু সকালের চায়ের কাপের পাশে যদি সেদিনের খবরের কাগজ মানুষ পেয়ে যায়, জরুরি খবরগুলো যদি পড়ে ফেলতে পারে তা হলে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করবে কেন? দুপুরের কাগজ দুপুরে আসুক। সেটা বিকেলে বাড়ি ফিরে পড়া যাবে, সকালের কাগজে কালকের খবর পড়তে পারার আনন্দেই মানুষ উত্তরবঙ্গ সংবাদ পড়বে। তিস্তার ওপারে, ময়নাগুড়ি, ধুপগুড়ি, মালবাজার, গয়েরকাটা থেকে আলিপুরদুয়ার কোচবিহারের মানুষ সকালবেলায় টাটকা খবর না পড়ে একদিনের বাসি খবর নিশ্চয়ই পড়তে চাইবে না! তাছাড়া ‘উত্তরবঙ্গ’ শব্দটা থাকায় কাগজটা তো এখানকার মানুষের নিজের কাগজ হয়ে যাবে। হ্যাঁ, ছাপা, কাগজ ইত্যাদিতে এখন হয়তো খামতি থেকে যাবে কিন্তু আপনি দেখবেন সেদিন বেশি দূরে নেই যেদিন আমাদের সঙ্গে কলকাতার কাগজের ব্যবধান থাকবে না।’

সুহাসবাবু বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন, কিন্তু সাফল্য এসেছে তাঁর ভাবনা অনুযায়ী। শুধু তাই নয়, আজকের প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে কলকাতার বড় কাগজগুলো সময়ের ব্যবধান দূর করতে শিলিগুড়িতেই অফিস খুলে বসে কাগজ বের করছে। কিন্তু সকালবেলায় কাগজ পেয়ে অভ্যস্ত পাঠকরা আর উত্তরবঙ্গ সংবাদকে বাতিল করছেন না।

সুহাসচন্দ্র তালুকদার মশাই আজ পৃথিবীতে নেই। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন থেকে গিয়েছে, সেই স্বপ্ন বাস্তব চেহারা নিয়েছে। এমন একজন উত্তরবঙ্গবাসীর বন্ধুকে সম্মান জানিয়ে রাস্তার নামকরণ শেষ পর্যন্ত করা হল বলে আমি আনন্দিত।

৭৫

আজকের এই লেখায় আমি এমনকিছু বলতে চাই যা বেশ কয়েক বছর ধরে বুকের ভিতর ছোবল মেরে চলেছে। যখনই একা থাকি, রাতের বিছানায় অথবা লিখতে বসে শুরু করার আগে পাঁচ মিনিট, সেই ছোবলগুলো অনুভব করি। ধরুন, যা আমি এখন করতে পারি স্বচ্ছন্দে তা ৩৪ বছর আগে পারতাম না। কিন্তু এখন মনে হয়, ৩৪ বছর আগে যদি করতে পারতাম তা হলে আমার চেয়ে সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর কেউ থাকত না।

আমি যে চা-বাগানের এক কর্মচারীর সন্তান, যার অনেকগুলো দায়িত্ব, ফলে অভাব সংসারে জড়িয়ে আছে তা ছাত্রাবস্থায় কখনওই টের পাইনি অথবা টের পেতে দেওয়া হয়নি। চার বছর বয়সে ঠাকুরদার সঙ্গে চা-বাগান ছেড়ে জলপাইগুড়ির স্কুলে পড়ার জন্য চলে এলেও ছুটি পেলে হাজির হতাম সেখানে। এখন মনে নেই, জলপাইগুড়ি-গয়েরকাটার বাসভাড়া কত ছিল? বোধহয় এক সিকি! নৌকায় তিস্তা পেরিয়ে বার্নিশ থেকে সেই বাস ধরতে হত। নৌকার ভাড়া ছিল এক আনা। ঠাকুরদা দু-আনা দিয়ে বলতেন, ‘বার্নিশে ডাক্তার সুরেশ গুহর বাস জয়তু দাঁড়িয়ে থাকবে। ওই বাস দশটায় ছাড়বে। তুমি কন্ডাক্টরকে নিজের পরিচয় দেবে।’ তিস্তা পার হয়ে সেই বাসে উঠে কন্ডাক্টরের কাছে যেতেই তিনি বললেন, ‘বসে পড়ো। তুমি তো আমাদের শিবুর ছেলে। শিবু ডাক্তারবাবুর ছেলে।’ সেই বয়সে এই ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। ঠাকুরদা যে বাসের ভাড়া বাঁচাতে পরামর্শ দিয়েছিলেন তা মাথায় আসেনি। অথচ বাড়িতে, চা-বাগানের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া মন্দ হত না। রবিবারের সকালে হাফ ডজন লুচি নিয়মিত পেতাম। বাবা কাজের লোককে নিয়ে হাটে যেতেন। দু’তিনবারে বাজার আসত বাড়িতে। অভাব শব্দটার অস্তিত্ব টের পেতাম না।

আসলে তখন আমাদের চাহিদা খুব কম ছিল। একটি নটিবয় শু পরে সারা বছর দিব্যি কাটিয়ে দিতাম। মনে পড়ে না, মাকে বলেছি, এটা দাও, ওটা দাও। সেই সময় খেলা আর পড়া, একটু বড় হয়ে গল্পের বইয়ে ডুবে থাকা, আর একটু সাবালক হলে বন্ধুদের সঙ্গে বাড়িতে না বলে রূপশ্রীতে হাফ টাইমের পর সিনেমা দেখতাম। উত্তম-সুচিত্রার অনেক ছবি দেখেছি। কিন্তু হাফ টাইমের আগে কী হয়েছিল তা জানতে পারিনি। আমরা সেই গল্পটা কী হতে পারে তা আন্দাজ করার চেষ্টা করতাম। আমাদের এক বন্ধুর মামা ওই হলের মেশিন চালাতেন বলে খালি সিটে বসার সুযোগ পেতাম। আর এতেই সন্তুষ্ট ছিলাম। গোবিন্দ বলত, ‘শেষ ভাল যার সব ভাল। আমরা শেষ ভালটা দেখছি। এটাই আসল।’

তখন বাবুপাড়া পাঠাগারই ছিল আমার একমাত্র আকর্ষণ। কত বই আর তাতে কত মানুষ, প্রকৃতির কথা লেখা। আর কী চাই?

আবদার আমি একবারই করেছিলাম। ষাট সালে কলেজে পড়ার জন্য কলকাতায় যেতে চেয়েছিলাম। অনেক বন্ধু খরচের কথা ভেবে আনন্দচন্দ্র কলেজে নাম লিখিয়েছিল। আসলে গাদা গাদা গল্প-উপন্যাস এবং পত্রিকা পড়ে কলকাতায় যাওয়ার নেশা এত প্রবল হয়েছিল যে খরচের কথা মাথায় আসেনি। বাবা বিব্রত হয়েছিলেন। কিন্তু ঠাকুরদা আমাকে সমর্থন করায় নিমরাজি হয়েছিলেন বাধ্য হয়ে। কলকাতায় হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতে আমাকে ১০০ টাকা মাসে পাঠাতেন বাবা। কোনও বিলাসিতা নয়, যেটুকু প্রয়োজন তা মেটাতেই টাকাটা খরচ হয়ে যেত। হস্টেলের থাকা ও খাওয়ার খরচ দেওয়া থাকত। কিন্তু কখনও কখনও মাস শেষ হওয়ার তিনদিন আগে শূন্য পকেটে কলেজে যেতাম। ভাগ্যিস 1ঙ্ম মিনিট হাঁটলেই কলেজে পৌঁছনো যেত! কিন্তু এই পয়সা না থাকাটা সেই সময় গায়ে লাগত না। কলকাতার বন্ধুরা বসন্ত কেবিনে চা-টোস্ট খাওয়াত।

অনেক পরে আমি হিসেব করেছিলাম। ষাট সালে একজন স্কুল মাস্টার, একজন অধ্যাপকের মাইনে কত ছিল? ১৫০ থেকে ৩৫০ টাকা। একজন সওদাগরি অফিসের বড়বাবু অথবা ব্যাঙ্কের কর্মচারীর মাইনে ওই রকমই ছিল। চা বাগানের সিনিয়র কর্মচারী হিসেবে বাবার মাইনে তার বেশি হতেই পারে না। আমরা সাত ভাইবোন। ওদের পড়াশোনার খরচ, সংসার চালানোর দায়িত্ব বাবার উপর ছিল। মানছি তখন একটাকায় দুই সের চাল পাওয়া যেত। রুই-কাতলার সের ছিল তিন টাকা। এক টাকায় ৮০ -টা কমলালেবু পাওয়া যেত। কিন্তু সবার সব প্রয়োজন মিটিয়ে বাবা আমাকে কী করে ১০০ টাকা পাঠাতেন? এই পাঠানোর জন্য তাঁকে কী কী খরচ কমাতে হত? এখন নিজেকে একজন গর্ধ বলে মনে হয়। কেন সেই সময় ব্যাপারটা খেয়াল করিনি! তিন বছর পরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার সময় আমি কলকাতায় ছাত্র পড়ানো শুরু করলাম। বাবার পাঠানো ১০০ টাকার সঙ্গে ত্রিশ টাকা যোগ হওয়ায় মনে হয়েছিল আমি বড়লোক হয়ে গেছি। দু’টি ক্লাস সেভেন-সিক্স-এর মেয়েকে পড়িয়ে ত্রিশ টাকা পেতাম। সপ্তাহে তিনদিন বিকেলের জলখাবারের পয়সা বেঁচে যেত।

তখন এমএ পড়ি। বাবা টাকা পাঠান। সেই টাকায় হস্টেলের বিল মিটিয়ে যাবতীয় খরচ সামলে কফি হাউসে বসে রাজাউজির মারছি। কামু, কাফকা থেকে অমিয়ভূষণ মজুমদারের জমিতে গর্বের লাঙল চষছি। বাংলায় এমএ পাস করে চাকরি পাওয়া যে আকাশ কুসুম ব্যাপার তা বুঝেও বুঝছি না। এরই মধ্যে সহপাঠীদের কেউ কেউ ফুড ইনস্পেক্টর, ইনকাম ট্যাক্সের সাধারণ চাকরি, ব্যাঙ্কে কেরানির পদ খালি দেখে আবেদন করতে শুরু করেছে। এইগুলো পাশ কোর্সে বিএ পাস করলেও করা যেত। বাংলায় অনার্স বা এমএ পড়ার দরকার ছিল না। বাবার অনেক টাকা বেঁচে যেত। কিন্তু কে ভাবে এইসব কথা।

ছুটিতে চা বাগান হয়ে জলপাইগুড়িতে গিয়ে শুনলাম, কোনও এক গুরুর নির্দেশে ঠাকুরদা এবং পিসিমা নিরামিষ খান। মাছ-মাংস-ডিম বাড়িতে ঢোকে না। কিন্তু আমি এসেছি বলে পিসিমা ঠাকুরদাকে মাছ আনতে বললেন। একলা পেয়ে পিসিমা তাঁর আদরের ভাইপোকে জানিয়ে দিলেন, পয়সার অভাবে বাড়িতে আমিষ হয় না। আজ পাশের বাড়ির কর্তার কাছে দশ টাকা ধার করে ঠাকুরদা মাছ কিনতে গিয়েছেন। দুপুরে খেতে বসে মনে হচ্ছিল বমি হয়ে যাবে। কিন্তু খেয়েছিলাম তো!

আজ ওঁরা পৃথিবীতে নেই। মৃত্যুর আট বছর আগে থেকে ঠাকুরদা নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি কেনা বন্ধ করেছিলেন এই বলে, কাল যদি মারা যাই, ওগুলো কে পরবে? আমি কলকাতায় পড়তে যাওয়ার আগে বাবা একটা দামি চশমা কিনবেন বলে ভেবেছিলেন, সেটা আর কেনা হয়নি।

আজ যখনই একা থাকি তখন ছোবলগুলো আমাকে যন্ত্রণা দেয়। কলকাতায় আমার নিজের বাড়ি, ড্রাইভার সমেত গাড়ি, নামকরা ক্লাবের মেম্বারশিপ। এখনও যে সিগারেট খাই তার প্যাকেটের দাম ১৭০ টাকা। ত্রিশবার বিদেশে গিয়েছি আমন্ত্রণ পেয়ে। কিন্তু সেখানে কেনাকাটা করেছি নিজের টাকায় যার পরিমাণ কম নয়। প্রকাশকরা যখন বছরের শেষে স্টেটমেন্ট এবং চেক পাঠান তখন যন্ত্রণাটা বেড়ে যায়। এই যে আমি, ওদের জীবিতকালে কেন ছিলাম না। তখন যে নুন আনতে পান্তা ফুরোত। আজ যখন আটশো টাকা কেজি ইলিশ কিনি তখন ঠাকুরদার দশ টাকা ধার করার কথা মনে পড়ে।

ওরা যদি আজ বেঁচে থাকতেন—! ভাবতেই ম্লান হাসি হাসলাম। ইলিশের দাম শুনে ঠাকুরদা, পিসিমা, বাবা, মা আঁতকে উঠতেন। বলতেন, ‘আটশো টাকা দিয়ে মাছ কিনলি? এত টাকা নষ্ট করছিস?’

এই ভর্ৎসনা শুনতে খুব ভাল লাগত। আফসোস, ভর্ৎসনা করার জন্য ওরা পৃথিবীতে নেই।

৭৬

তখন শিলিগুড়ি থেকে কোচবিহারে এমন অনেক মানুষ ছিলেন যাঁদের একমাত্র জীবিকা ছিল দুই হাত এক করে দেওয়া। আমাদের জলপাইগুড়ি শহরটায় তাঁদের সংখ্যা কম ছিল না। সে সময় জলপাইগুড়িতে কিছু মানুষ রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করতেন, কিছু মানুষ চা বাগানের জেলা-অফিসগুলোতে, কেউ ছোটখাটো দোকান-অফিসে। প্রতিপত্তি ছিল উকিলবাবুদের। মফসসল থেকে মামলা লড়তে যাঁরা শহরে আসতেন তাঁদের তো উকিলবাবুদের দরকার হত। ফলে উকিলবাবুদের অবস্থা যথেষ্ট ভাল ছিল। আমাদের ছাত্রাবস্থায় জলপাইগুড়ি শহরে দেড়খানা হোটেল ছিল। থানার সামনে ছিল রুবি বোর্ডিং যা পরে পিছনের রাস্তায় উঠে গিয়েছে। আর আধখানা ছিল স্টেশনের ঠিক বাইরে। আধখানা বললাম এই কারণে যে, লোক ভাত-ডাল খেতেই সেখানে যেত, থাকত খুব কম। রুবি বোর্ডিংয়ের রান্না খুব ভাল ছিল। বিশেষ করে মাছ। কিন্তু থাকার ব্যবস্থা আদৌ সুবিধাজনক ছিল না। মামলা করতে মফসসলের লোকজন জলপাইগুড়িতে এসে বাধ্য হতেন ওখানে থাকতে। অর্থাৎ এই শহরের মানুষের সামনে রোজগারের পথ খোলা ছিল না। কোনও শিল্প অথবা কারখানার স্বপ্ন কেউ দেখত না। চা বাগানের হেড অফিসগুলোও একসময় শিলিগুড়ি বা কলকাতায় উঠে গেলে অবস্থা আরও করুণ হল। প্রতিটি পুরনো পাড়ায় কিছু প্রাচীন ধনী ব্যক্তি থাকতেন। তাদের কেউ কেউ শহরটাকে চাঙ্গা করে রাখতে চেষ্টা করতেন। মূলত দোকানদাররা সরকারি চাকুরের উপর নির্ভর করে দোকান চালাতেন। ধনীরা কেনাকাটা করতেন কলকাতায় গিয়ে।

সে সময় আমরা বাল্যকাল এবং কৈশোরের সন্ধিক্ষণে। শহরের অর্থনীতির পরিকাঠামো নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও কারণ ছিল না। এমনকী মাসের শেষে বাড়ির খাবারের মেনু যে সংকুচিত হচ্ছে তাও লক্ষ করতাম না। সেই সময় আমার বন্ধু অনিল বলেছিল, ‘আজ আমাদের বাসায় ঘটক আসবে।’ তখন জলপাইগুড়িতে অনেক ঘটক ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ঘটক যাদের উপাধি তাদের গুলিয়ে ফেলতাম। যেমন রায়কত পাড়ার বিলু ঘটক আমাদের বন্ধু। ভাবতাম বিলুর বাবা নিশ্চয়ই ঘটকালি করেন। অনিল ভুল ভাঙিয়ে দিল। বলল, ‘দূর! বিলুদের পরিবার উচ্চশিক্ষিত। ঘটক শুধু টাইটেল মাত্র। ওরা ঘটকালি করবে কেন? ঘটকালি যাঁরা করেন সেই ঘটকদের বেশিরভাগ ব্রাহ্মণ, কায়স্থও কেউ কেউ আছেন। এদের কাছে অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের খবর, ছবি থাকে। আজ যিনি আসছেন তিনি দিদির জন্যে আটটা ছেলের খবর ও ছবি নিয়ে আসবেন।’

জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেলাম। ঘটকালি করে সংসার চালানো সম্ভব! ওই সম্বন্ধ এনে বিয়ে পাকা করে ঘটকরা ভাল দক্ষিণা আদায় করেন। পাত্র ও পাত্রী একমত হলে ঘটকের কাজ বেড়ে যায়। প্রতিদিন দুই বাড়িতে যাতায়াত, সমস্যা হলে তার সমাধান করে দেওয়া। এমনকী বিয়ের সময় বরযাত্রীও যেতে হয়। ওই বরযাত্রী ও বউভাতে তাঁর সঙ্গী হন পরিবারের মানুষেরা। ঘটক বিদায়ের সময় একটু কথা কাটাকাটি হয়। এই যা। কিন্তু দুই পক্ষ থেকে উপার্জন সম্ভব যদি তারা এক শহরের হয়।

তদ্দিনে বাংলা সিনেমার দৌলতে ঘটক দেখে ফেলেছি। বেশিরভাগ ছবিতে কর্তারা ঘটককে তিরস্কার করেন, মানুষ বলে মনেই করেন না। কিন্তু বাস্তবের ঘটকরা অতটা অবহেলিত ছিলেন না। তখন আমি স্কুলে শেষ ক্লাসের ছাত্র। কদমতলায় চৌধুরি মেডিকেল স্টোর্সের রামদা সস্নেহে তাঁর বড় দোকানের একপাশে আমাদের আড্ডা মারার জায়গা দিয়েছেন। সেখানে বিকেলে এক ভদ্রলোক ওষুধ কিনতে এলেন। রামদা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘একি দাদা, কার জ্বর?’

‘আর বোলো না, কাল বরপক্ষ পাত্রী দেখতে আসবে, একটু আগে খবর পেলাম পাত্রী জ্বর বাধিয়ে বসেছে, সর্দি-জ্বর। কিন্তু ওই অবস্থায় তো পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়া যাবে না। পাত্র আবার পরশু সকালে চাকরিস্থলে চলে যাবে। তাই নিজের গরজে ওষুধ কিনে দিয়ে আসতে হবে।’ ভদ্রলোক বললেন।

রামদা বললেন, ‘গরজ তো মেয়ের বাবার হওয়ার কথা।’

‘আর বোলো না, মেয়ে স্কুলে চাকরি করে। বাবার ইচ্ছে আরও দু’-চার বছর পরে বিয়ে দেবেন। কিন্তু মা দেরি করতে চান না। তাড়াতাড়ি পাত্রস্থ করে হালকা হতে চান। ওই মা-ই আমাকে ফোন করে বললেন, ওষুধ নিয়ে যাওয়ার জন্য।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘তাড়াতাড়ি বিয়েটা হয়ে গেলে আমার পকেটে কিছু আসবে, বুঝতেই পারছ।’

রামদা বললেন, ‘ভিতরে এসে একটু বসুন। চা খান আগে, তারপর ওষুধ নিয়ে যাবেন।’

ভদ্রলোক দোকানের ভিতরে এসে আমাদের পাশে বসলেন। পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে বয়স। লং ক্লথের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরনে। হাতে একটা থলি। আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তপন হাসল, জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি ঘটকালি করেন?’

‘হ্যাঁ বাবা, ওটাই আমার জীবিকা।’

‘কী রকম পাত্রপাত্রী আপনার সন্ধানে আছে?’

‘এরকম প্রশ্ন কেন করছ বাবা?’

তপন বেমালুম মিথ্যে বলল, ‘আমার দাদার জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে তো তাই।’

‘কী করেন, তোমার দাদা?’

‘ডাক্তার।’ তপনদের পরিবারে কেউ ডাক্তারি পড়েনি।

‘বাঃ। কত বয়স?’

‘আটাশ, আমার চেয়ে বারো বছরের বড়।’

‘বাঃ কীরকম পাত্রীর খোঁজ করছেন তোমার বাবা-মা?’

‘সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, শিক্ষিতা, গৃহকর্মনিপুণা, লম্বা।’

ওষুধ বিক্রি করার ফাঁকে মুখ ঘুরিয়ে রামদা মন্তব্য করলেন, ‘ফোর ইন ওয়ান।’

‘আছে নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এই শহরে নয়। আলিপুরদুয়ারে।’

‘আপনি আলিপুরদুয়ারের পাত্রীর খবর রাখেন?’

জিজ্ঞাসা করলাম।

‘রাখতে হয় বাবা। শিলিগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, মালবাজার—সর্বত্র আমার নজর আছে। জিজ্ঞাসা করতে পারো কী করে তা সম্ভব? ওই সব জায়গায় যাঁরা এই কাজ করেন, তাঁরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন। ছেলেমেয়ের ছবি পাঠান, আমিও পাঠাই।’ ভদ্রলোক বললেন।

‘তার মানে আপনাদের, ঘটকদের একটা সংস্থা আছে?’

‘না না। ওসব কিছু নেই। এ ওকে সাহায্য করি মাত্র। আলিপুরদুয়ারের মেয়েটি লম্বায় পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি, এমএ পাস করে স্কুলে পড়াচ্ছে, ফর্সা, সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, রন্ধননিপুণা—ছবি দেখবে? দেখাচ্ছি!’

থলি খুলে হাতড়ে হাতড়ে একটা খাম বের করলেন, ‘দ্যাখ। তোমার বউদি হওয়ার উপযুক্ত।’

আমরা ছবি দেখলাম। সাদামাঠা চেহারা। অনেকটা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের আদল আছে। ভদ্রলোক বললেন, ‘সুন্দরীদের সাধারণত ছবি ভাল ওঠে না। তোমার ঠিকানা বল আমি যাব। কোন পাড়ায় থাক?’

‘পাণ্ডাপাড়ায়। আপনার দক্ষিণ কত?’

‘যে যেমন দেয়। তবে এর সঙ্গে বিয়ে হলে আলিপুরদুয়ারের ঘটককে টোয়েন্টি ফাইভ পার্সেন্ট দিতে হবে আমার থেকে। না না, ছবির পিছনটা দেখবে না। ওখানে ঠিকানা লেখা আছে। অনেক পার্টি ঠিকানা দেখে নিয়ে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খায়। পাণ্ডাপাড়ায় কার বাড়ি?’

চা এসে গেল। তপন হাতজোড় করে উঠে দাঁড়াল, ‘আমাকে মাপ করবেন।’ বলে দ্রুত দোকান থেকে বেরিয়ে গেল।

ভদ্রলোক হতভম্ব, ‘কী হল চলে গেল কেন?’

রামদা বললেন, ‘ছাড়ুন তো। ছেলে ছোকরারা ওরকম হয়। কী ওষুধ নেবেন?’

এখন কম্পিউটারের যুগ। ওই ঘটকরা কি এখনও ঘটকালি করে সংসার চালাতে পারছেন? শাদি ডট কম, ম্যারেজ ডট কমের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কি সম্ভব? অবশ্য গুরুদেবরা যদি ঘটকালি করেন, তা হলে সব ডট কম নস্যাৎ হয়ে যাবে।

৭৭

পঞ্চান্ন বছর আগে স্কুলের শেষ ক্লাসে যখন বঙ্কিম থেকে সমরেশ বসু প্রায় পড়া হয়ে গেছে, উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা রূপশ্রী বা আলোছায়ায় গিলে ফেলেছি, তখন কেউ যদি বলত, দু’হাজার চৌদ্দো সালে যেখানেই থাকিস একবার জলপাইগুড়িতে আসিস তা হলে একটি উন্মাদদর্শন করার মতো তাকে দেখতাম। তখন চল্লিশ পার হয়ে গেলেই কোনও মানুষকে প্রৌঢ় মনে হত, পঞ্চাশে পড়লে বৃদ্ধ। আবার বন্ধু মন্টির ভাষায় শ্যুড্ডা। যিনি মারা যেতেন তাঁর বয়স কত হয়েছিল প্রশ্ন করলে শুনতাম তিনি ষাটের ঘরে ছিলেন। যিনি কোনওরকমে সত্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি কালেভদ্রে বাড়ি থেকে বের হতেন। বড়জোর বিকেলে তিস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে আসতেন। অক্টোবর শেষ হওয়ার আগেই মাঙ্কি ক্যাপ, শোয়েটার অথবা আলোয়ান জড়িয়ে লাঠি হাতে ধীরে ধীরে হাঁটতেন। তাদের সংখ্যা কম ছিল।

আমি আমার ঠাকুরদাকে প্রেসারের ওষুধ খেতে কখনও দেখিনি। ব্লাড সুগার পরীক্ষা করাতে কখনও গিয়েছেন কি না তাও জানা নেই। বড় হয়ে শুনেছি, ওসবের চল তখন ছিল না। ডক্টর চারুচন্দ্র সান্যাল মশাই-এর কাছে শরীর খারাপ লাগলে যেতেন। পরে হোমিওপ্যাথের কাছে। আমার দেখা ওই একটি মানুষ এভাবেই নববুই-এর কোঠায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগেও বাজার করেছেন দীনবাজারে গিয়ে। এই ধরনের মানুষের সংখ্যা খুব কম। আমার বাবা তো সত্তরে পা দেওয়ার পর আর বেশিদিন রইলেন না। তাঁকেও নিয়মিত কোনও ওষুধ খেতে দেখিনি।

পশ্চিমবাংলার অন্যান্য শহরগুলোর মতো জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ির মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন না। তাঁর এগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কোনও বাধানিষেধ মানতেন না। প্রথমে ঘি পরে ডালডায় ভাজা লুচি নানান ভাজার সঙ্গে জলখাবার হিসেবে খাওয়ার সময় গুনতেন না ক’টা খাচ্ছেন। পাঁঠার মাংস যে বেশি খাওয়া শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর তা বোধহয় জানা ছিল না তাঁদের। গর্ব করে বলতেন, ‘কচি পাঁঠা হলে একসের খেয়ে নিতে পারি।’ মিষ্টিতে কোনও বাছবিচার নেই। উৎসবের বাড়িতে গিয়ে বাজি ধরে রসগোল্লা খেতে তাঁদের খুব ভাল লাগত। রক্তে চিনি আছে কি না তা নিয়ে ভাবতেন না। যখন অসুস্থ হতেন তখন খাওয়া বন্ধ করে দিতেন ডাক্তার। হু-হু করে রোগা হয়ে যেতেন! দেখা হলে বলতেন, ‘খাওয়াই যখন বন্ধ হয়ে গেছে তখন বেঁচে থেকে আর লাভ কী?’

জলপাইগুড়ি জেলায় একসময় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ছিল। জ্বরজারি লেগেই থাকত। ফলে ওষুধের দোকানের অভাব হত না। আটান্ন-ঊনষাট সালে, যখন আমি না কিশোর না তরুণ তখন আড্ডা মারতে যেতাম রামদার চৌধুরি মেডিকেল স্টোর্সে, দোকানের ভিতরে বসে দেখতাম বেশিরভাগ মানুষ হয় জ্বর নয় পেট খারাপের ওষুধ কিনছেন। মনে পড়ে না তখন অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যেত কিনা! আমি অন্তত শব্দটা তখন শুনিনি। তখনও জ্বর কমানোর জন্যে বোতলে মিক্সচার বিক্রি হত। তাতে সেরেও যেতেন অসুস্থরা।

সেসময় আমরা তিস্তার বন্যার সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলাম। প্রতিবছর দুই থেকে তিনবার একদিনের মেয়াদে তিস্তার জল শহরে ঢুকে পড়ত। যেহেতু আমাদের বাড়ি ছিল তিস্তার গায়ে, হাকিমপাড়ায়, তাই দেখতে পেতাম নালা উপচে তিস্তার জল উঠোনে ঢুকছে। কুফল, উঠোন বাগান সেই ঘোলা জলের তলায় চলে গেল। বাড়ির যাবতীয় জিনিসপত্র ততক্ষণে খাটের উপর তোলা হয়ে গেছে। জল বাড়তে বাড়তে ঘরে ঢুকল। ঢেউ খেলতে লাগল মেঝের উপর। সেই জলে ঘরের ভিতর থেকে আমি একবার বোরলি মাছ ধরেছিলাম। বর্ষার ওই সময়টায়, বন্যা আসবে জেনেই ঠাকুরদা ওষুধ কিনে রাখতেন। পেট খারাপের ওষুধ। বন্যার পরে জল দূষিত হবেই, ফুটিয়ে খেলেও তো বিশ্বাস থাকত না। তাই আমায় সতর্ক হয়ে থাকা। তখন বন্যার সঙ্গে এমন মানিয়ে নিয়েছিলাম যে, জোর গলায় বলতে পারতাম বন্যাকে ভয় পাই না। শুধু জল নেমে যাওয়ার পরে ঘরের মেঝে, উঠোন থেকে পলি পরিষ্কার করতে হিমশিম খেয়ে যেতাম। কিন্তু এইসব-চুরমার করে দিয়েছিল আটষট্টি সালের বন্যা। জলপাইগুড়ি শহরটাকে দুমড়ে মুচড়ে—ভেঙে দিয়ে গিয়েছিল তিস্তা। ভয়ংকর স্রোত নিয়ে একতলা বাড়ির ছাদের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল ঘরে ঘরে মৃত্যু ছড়িয়ে। তারপর হাহাকার খাবারের জন্যে, ওষুধের জন্যে। এরকম ঘটনা ঘটবে, আন্দাজ না থাকায় কেউ তৈরি ছিল না।

তখন আমরা পঞ্চান্ন বছর পরের আমাদের কল্পনা করতে পারতাম না। শুনলেই মনে হত, অতদিন যখন বাঁচব না তখন কল্পনা করে লাভ কী! শুনতাম কোনও লেখক বা গায়ক যদি মৃত্যুর পরে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গিয়েও, তাঁর সৃষ্টির জন্যে সমান সম্মান পাঠক বা শ্রোতাদের কাছে পেয়ে থাকেন তা হলে তাঁকে কালজয়ী বলা হয়। অর্থাৎ পঞ্চাশ বছর হল একটি কাল। মন্টি বলত, ‘তার অনেক আগেই ছবি হয়ে যাব।’ ও কথা রেখেছে।

কিন্তু তখন আমাদের পছন্দের মানুষগুলোর দিকে তাকালে খুব কষ্ট হত। ধরা যাক, একজন গায়ক জলপাইগুড়িতে খুব জনপ্রিয়, আবার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেন। তাঁর বয়স ষাট। তাঁর দিকে তাকালেই মনে প্রশ্ন আসত উনি কি কুড়ি বছর পরে থাকবেন? আবার যখন ছত্রিশ বছর বয়স হবে তখন উনি কি গান শোনাবেন! বাইরে থেকে ঘরে নজর এল। বাবার বয়স তখন চল্লিশের কোঠায়। বাবা নিশ্চয়ই আরও চল্লিশ বছর বাঁচবেন না। কিন্তু তাঁর চশমা, ধুতি, শার্ট, ঘড়ি থেকে যাবে। কী রকম কান্না গলায় এসে আটকে যেত। মাকে বলেই ফেলতাম, ‘তুমি খুব তাড়াতাড়ি মরে যেও না।’

মা অবাক হতেন, ‘কী হল তোর? কেন একথা বলছিস?’

‘মানুষ তো ষাট থেকে সত্তরের মধ্যে চলে যায়। তোমার ষাট হতে আর কুড়ি বছর বাকি আছে। আমার খুব ভয় করছে।’

মা হেসে বলেছিলেন, ‘পাগল!’ ওই একটি শব্দ যা শুনে কীরকম ভরসা পেয়ে গিয়েছিলাম। শব্দটার ভিতর থেকে একটা আশ্বাসের স্পর্শ আমাকে শান্ত করেছিল।

পঞ্চান্ন বছর পরে জলপাইগুড়িতে পা দিলাম। মা, বাবা, ঠাকুরদা, পিসিমা কেউ এখন নেই। জলপাইগুড়ির রাস্তায় প্রচুর ওষুধের দোকান। রামদার চৌধুরি মেডিকেল স্টোর্সে গিয়ে জানলাম ওঁর ছেলে দোকান দেখাশোনা করেন। রামদা মাঝেমাঝে অশক্ত শরীর সত্ত্বেও কিছুক্ষণের জন্যে এসে বসেন। ছেলেটি সাদরে ভিতরে বসাল। সেই চেয়ার যেখানে পঞ্চান্ন বছর আগে বসতাম, সেখানে বসে খদ্দেরদের কথা শুনতে লাগলাম। কেউ এসেছেন প্রেসারের ওষুধ নিতে, কেউ সুগার অথবা হার্টের ওষুধের জন্যে। তিনদিন ধরে জ্বর থাকলেই ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক খেতে বলেছেন। শুনতে শুনতে ভাবছিলাম পঞ্চান্ন বছর আগে এখানকার মানুষরা যদি এইসব ওষুধের খবর পেতেন!

জলপাইগুড়িতে এখন বন্যা হয় না। তিস্তাকে দুর্বল করে দেওয়ার ব্যবস্থা হওয়ায় এখন তার চরে মানুষ নিশ্চিন্তে বাড়ি তৈরি করে আছে। শহরের পরিচিত মানুষদের অন্তত পঁচাত্তর ভাগ এখন আর নেই। ক্রমশ মনে হল তিনি আছেন কি না জেনে তাঁর বাড়িতে খোঁজ করতে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। হয়তো হেঁটে যেতে হবে। লক্ষ্মণদার কথা মনে পড়ল। যে কোনও স্পোর্টস মানেই লক্ষ্মণদা। শুনলাম তিনি নেই। প্রিয় গল্পকার অশোক বসু নেই, অনুপদা নেই। এরা কোথায় গিয়েছেন? কোন রাজ্যে? অথচ আমি এখনও জলপাইগুড়ির রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। জগুদার বাড়িতে গিয়ে আড্ডা মারছি। আর সেই আড্ডায় একটাই কথা জগুদার মুখে, ‘বোঝো না সমরেশ, সেই জলপাইগুড়ি আর নাই। সেইসব মানুষগুলো তো একের পর এক চইল্যা গেল। এখন অচেনা মানুষের ভিড় বেশি।’

এটাই তো নিয়ম। কিন্তু এখনও থানার পাশের রাস্তা দিয়ে গার্লস স্কুলের দিকে যেতে যেতে থমকে দাঁড়াতে হয়, করলার জল কমে গেলেও স্মৃতি থেকে তেমন সরে যায়নি। জেলাস্কুলের মাঠের সামনে দাঁড়ালে মনে হয় সব ঠিক আছে শুধু আমাদের গেমস টিচার শিশিরবাবু নেই। তাঁর জায়গায় নিশ্চয়ই আর একজন গেমস টিচার কাজ করছেন।

পুনশ্চ : পঞ্চান্ন বছর আগে জলপাইগুড়ির কিছু মানুষের খেয়েদেয়ে কোনও কাজ না থাকায় অন্যের ছিদ্র অন্বেষণ করে আনন্দ পেত। ‘ঘরে ফেরা’ লিখতে গিয়ে তপন, নিশীথ, অজিত নামগুলো আমি ব্যবহার করেছি। জলপাইগুড়ির বন্ধু বললে ওদের কথাই মনে আসে। যে ঘটনায় ওরা হয়তো ছিল না, সেই ঘটনার কোনও চরিত্রের নামকরণ ওদের নামেই করেছি। কিন্তু জানতে পারলাম এখনও কিছু ছিদ্র অন্বেষণকারী এদের কাছে গিয়ে বিব্রত করার চেষ্টা করছেন।

ব্যাপারটা সত্যিই দুঃখজনক।

৭৮

প্রথমেই মার্জনা চাইছি।

সম্পাদকমশাই আমাকে প্রতিমাসে দু’দিন এই কাগজে লেখার জন্যে যে অনুরোধ করেছিলেন, তা গতবার রাখতে পারিনি। প্রায় পাঁচ দশক ধরে লেখালেখি করছি এবং কোনও সম্পাদক অথবা প্রকাশক বলার সুযোগ পাননি যে আমি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লেখা দিইনি। মনে আছে, ‘দেশ’ পত্রিকার প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক সাগরময় ঘোষ শীর্ষেন্দুদাকে আক্রমণ করতেন এই বলে, ‘দ্যাখো, সমরেশ সেই মে মাসে উপন্যাস দিয়ে দিয়েছে আর তুমি জুলাই মাসেও দিলে না!’ সেই আমি এবার যে কথা রাখতে পারলাম না তার জন্যেই মার্জনা চাইছি উত্তরবঙ্গ সংবাদের পাঠকের কাছে। বিশ্বাস করুন, ব্যাপারটা আমার হাতের বাইরে ছিল।

গত পাঁচ দশক ধরে আমার জীবনযাপনের পদ্ধতি একইরকম। ভোর ছ’টায় উঠে চা খেয়ে লিখতে বসি। মাঝখানে দশমিনিটের জন্যে জলখাবারের ব্রেক। বেলা বারোটায় লেখার কাজ শেষ করে খবরের কাগজ পড়া। তারপর স্নান-খাওয়া সেরে চরতে বের হওয়া। খুব চাপ না থাকলে আমি কখনওই রাত্রে লিখিনি। বাড়ি ফিরি রাত দশটায়, তারপর বইপড়া, টিভি দেখা, ঘুম। প্রায়ই শুনতাম আমার বয়সি যাঁরা তাঁরা প্রতিদিন এভাবে কাটানোর কথা ভাবতে পারেন না। দেখা হলে বলেন, ‘আরে মশাই, আপনার তো বয়স হয়েছে, কেন ভুলে যাচ্ছেন?

আশ্চর্য কথা! ওঁরা আমার বয়সটাকে টের পাচ্ছেন অথচ আমি পাচ্ছি না। আমরা, বাঙালিরা, কতকগুলো নিয়ম তৈরি করে নিয়েছি। যেমন, যে শহরে নিজের বাড়ি, পরিবার সেই শহরে কম মাইনের চাকরি পেলে বাইরে যাব না। অথচ আমার পাড়ায় মাড়োয়ারি বা গুজরাটি দোকানদারকে বছরের পর বছর দেশে পরিবার রেখে ব্যবসা করে যেতে দেখছি। বছরে এক কি দু’বার ছুটি নিচ্ছে, বৃদ্ধ হয়ে গেলে পাকাপাকি চলে যাচ্ছে ছেলের হাতে ব্যবসা দিয়ে কিন্তু আমি সেরকম করে আমার পরিবারের আয় বাড়ানোর কথা ভাবতেই পারি না। একজন বঙ্গসন্তান ষাট বছর বয়স পর্যন্ত যখন চাকরি করেন, তখন মনে হয় তাঁর উপর বিশ্বের দায়িত্ব। তাঁর ভাবভঙ্গিতে অনেক কর্তৃত্ব। যেই তিনি রিটায়ার করলেন, অমনি তাঁকে চুপসে যেতে দেখা গেল। সকালে বাজার করেন, র‌্যাশন থেকে চিনি আনেন, ব্যাঙ্কে যান, ইলেকট্রিক, মোবাইলের বিল পেমেন্ট করেন, তারপর দুপুরে স্নান-খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েন। বিকেল হলে হয় পরিচিত পাড়ার দোকানে অথবা পার্কে গিয়ে আড্ডা মারেন। সন্ধে সাড়ে সাতটায় বাড়ি ফিরে টিভিতে খবর শুনে রাতের খাবারের জন্যে অপেক্ষা করেন। দেখা গেছে রিটায়ার করার তিন বছরের মধ্যে স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকে দেহ রেখেছেন অনেকেই। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর সুগারে ভুগছেন, হাঁটুতে বাত এসে গেল, ইত্যাদি ইত্যাদি অসুখগুলো কালবৈশাখীর ঝড় হয়ে এসে শ্রাবণের বর্ষা হয়ে গেল। সত্তর-বাহাত্তরে টুপটাপ চলে যাওয়া শুরু হয়ে গেল। এখন তো তবু ভাল, আমাদের কৈশোরে পঞ্চাশে পা দিতে না দিতেই জলপাইগুড়ির মানুষ নিজেকে বৃদ্ধ ভাবতে শুরু করত।

অতএব আমি যে ঠিকঠাক জীবনযাপন করছি না, নিয়ম মেনে চলা উচিত ইত্যাদি উপদেশ শুনতে হয়েছে। সেইসঙ্গে ছিল ধূমপানের অভ্যাস। সেই জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ার তিস্তার চরে কাশবনের মধ্যে লুকিয়ে যার শুরু, তা এই সেদিন অবধি পরিত্যাগ করতে পারিনি। মেয়েরা প্রতিবাদ করেছে, প্যাকেট ফেলে দিয়েছে, কিন্তু অভ্যাস বড় খারাপ জিনিস।

ক’দিন থেকে সিগারেট খেলেই কাশি হচ্ছিল। খাওয়ার ইচ্ছেটা চলে গেল। বুঝলাম লক্ষণটা ভাল নয়। থিয়েটার রোডের বিখ্যাত নার্সিংহোমে পরিচিত ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি খানিকক্ষণ পরীক্ষা করে বললেন, ‘আপনার কোটা শেষ হয়ে গিয়েছে।’

‘কীসের?’

‘সিগারেটের।’ হুইলচেয়ার আনিয়ে সটান পাঠিয়ে দিলেন নার্সিংহোমের আইসিইউ-তে।’ কোনও প্রস্তুতি যেমন আমার ছিল না, সঙ্গীদেরও নয়। দেখলাম, একটা বড়ো হলঘরের দু’দিকে পরপর লোহার খাটের বিছানায় অসুস্থরা শুয়ে আছেন, একমাত্র খালিটায় আমাকে তুলে দেওয়া হল। তখন সবে সন্ধে পার হয়েছে।

আমি কখনও যুদ্ধক্ষেত্রে যাইনি, বইতে পড়েছি। পড়েছি প্রতিদিনের যুদ্ধ শেষ হলে আহতদের চিকিৎসা করা হয়। প্রচণ্ড আহত যোদ্ধারা যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকেন। যাঁরা মৃত, তাঁরা লাশ হয়ে পড়ে থাকেন। বালিশে মাথা রাখার পর আমার মনে হল আমি দিনশেষের যুদ্ধক্ষেত্রে। ততক্ষণে আমার নাকে অক্সিজেনের তার ঢুকে গেছে, হাতের শিরা ফুঁড়ে অনেকরকম ইনজেকশন ঢোকানোর কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কানে আসছে ঠিক তিনটি কণ্ঠ, যন্ত্রণা ছিটকে উঠছে সেইসব কণ্ঠ থেকে। এ আমি কোথায় এলাম।

সাতদিনে তো এক সপ্তাহ। কিন্তু আমার কাছে হিসেব নেই। গতকাল ঘোর ঘোর চোখে পাশের বিছানায় যে পাকা দাড়িওয়ালাকে দেখেছি আজ সেখানে একটি তরুণ শুয়ে আছে নলাবৃত হয়ে। প্রথম রাতে যাঁদের চিৎকার শুনেছিলাম, তাঁদের আর সক্রিয় হতে শোনা যাচ্ছে না। এই সাতদিন খেতে বলেছে কিন্তু জিভে তোলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হয়নি। এই সাতদিনের প্রথম চারদিন আমি ঘুরে বেড়িয়েছি সর্বত্র। কখনও মহাশূন্যে, কখনও গয়েরকাটার আংরাভাসা নদীর ধারে। এ এক আশ্চর্য ভ্রমণ। সে সময় নাকি নিকটজনের কাছে খবর পৌঁছচ্ছিল, এই আছি, এই নেই! আমি অবশ্য বুঝতে পারিনি।

তারপর সেই শেষরাতে এল যখন মনে হল, আমি আর নার্সিংহোমে থাকতে পারছি না। আমার নিজের বিছানা, লেখার টেবিলে না ফিরে গেলে আমি মরে যাব। ভরতির সময় ওরা মোবাইল জমা নিয়েছে। কাউকে জানানোর উপায় নেই। বিছানা থেকে নামলাম, নার্সিংহোমে এখন ঘুমের রাজত্ব। খেয়াল হল, আমার পায়ে চটি নেই, পরনে নার্সিংহোমের পোশাক। কয়েকদিন না কামানো দাড়ি, না স্নান করা চুল নিয়ে এই অবস্থায় হেঁটে বাইরে বের হলে পৃথিবীর সব কুকুর অবশ্যই তাড়া করার অধিকার পাবে। আবার বিছানায় ফিরলাম, শয্যাকন্টক কাকে বলে হাড়েহাড়ে টের পেলাম।

দয়া করে ওঁরা আমাকে কেবিনে স্থানান্তরিত করলেন, বললেন, ‘সিগারেট খেয়ে খেয়ে ফুসফুসের বারোটা বাজিয়েছেন। ওটা সারানো যাবে না। কিন্তু আর যাতে খারাপ না হয়, সেই চেষ্টা করছি। দয়া করে অসৎ সংসর্গ ত্যাগ করুন।’

দীর্ঘদিন বাইরে থাকার পর বাড়ি ফিরে এলে যে স্বস্তি হয়, তার পুরোটা আমি পেলাম না। যখন বুঝতে পারলাম, নির্দিষ্ট সময়ে যে লেখাগুলো দেওয়ার কথা ছিল, তা আমি দিতে পারিনি। এবং তখনই বোধ হল, আমরা যাই করি বা করব বলে ভাবি তার বাইরে আর একটা দিক আছে, যেখানে পৌঁছে গেলে আমাদের সমস্ত করার ক্ষমতা লোপ পেয়ে যায়। আমি ফিরে নাও আসতে পারতাম। এ কথাটা ভাবতেই হাসি পেল।

না ফিরলে এই লেখাটা তো লিখতে পারতাম না! এই বিলম্বের জন্যে, উত্তরবঙ্গের সমস্ত পাঠক নিশ্চয়ই এ যাত্রায় আমাকে মার্জনা করবেন।

৭৯

পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহরে বাংলা ভাষায় লেখার সুবাদে ঘুরে এসেছি, শুধু আমেরিকাতেই তো বাইশ বার হয়ে গেল। প্রথমবার গিয়েছিলাম চুরাশি সালে। প্রথম বিদেশে যাওয়া। কলকাতায় চব্বিশ বছর থাকা হয়ে গেলেও গা থেকে জলপাইগুড়ির গন্ধ দূর হয়ে যায়নি। খুব ভয় লেগেছিল একা যেতে, সেই ভয়ের প্রাবল্যে ফ্র্যাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে পাসপোর্ট, ডলার সমেত কাঁধের ব্যাগ হারিয়ে কী যে বিপাকে পড়েছিলাম! এখন রাত্রে ফ্লাইট ধরতে হলে সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে সুটকেস গুছিয়ে এয়ারপোর্টে যাই। কোনও টেনশন থাকে না। এবার সিডনি শহরের বিখ্যাত সাফারিতে বসে একটি বাংলাদেশের যুবক প্রশ্ন করল, ‘সমরেশদা, আপনি তো অনেক দেশ ঘুরছেন, কোন দেশটাকে আপনার সবচেয়ে ভাল লাগে?

উত্তর দেওয়া খুব কঠিন বলে এড়াতে চেয়েছিলাম। আমি তো সব দেশের সবটা দেখার সুযোগ পাইনি। এই যেমন ধরো তোমাদের দেশ। কলকাতা থেকে ঢাকায় গিয়েছি। সেখানেই আড্ডা মেরেছি। একবার চট্টগ্রাম কী কক্সবাজার একরাত্রির জন্য গিয়েছি। কিন্তু বরিশাল, নোয়াখালি থেকে আশিভাগ জায়গায় যাওয়া হয়নি। তা হলে কী করে বলব দেশটাকে দেখেছি?

‘বেশ। তা হলে বলুন কোন জায়গাটাকে আপনার বেশি পছন্দ হয়েছে?’ ছেলেটি নাছোড়বান্দা।

সমস্যায় পড়লাম। আমার লন্ডন একটুও ভাল লাগেনি। ট্র্যাফালগার স্কোয়ারে ছেঁড়া কাগজ ধুলোর সঙ্গে উড়ছে। সন্ধে নামলেই আগে লোকাল ট্রেনে ছিনতাই হত, এখন দিনদুপুরে মেয়েরা ছোট ছোট দল বেঁধে ওই কাণ্ড করছে। কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ার লন্ডনের চেয়ে অনেক বেশি পরিষ্কার শহর। আমেরিকার শহরগুলোর বয়স বেশি নয়। মানুষের চেয়ে রাস্তা বেশি। একমাত্র নিউ ইয়র্ক শহরের ফুটপাতেই মানুষ দেখা যায়। যে শহরের গায়ে ইতিহাসের গন্ধ নেই সেই শহর আমার পছন্দের নয়। সেইদিক দিয়ে রোম অনেক এগিয়ে। কিন্তু ইতালিয়ান ছিনতাইকারীদের সংখ্যা বোধহয় ইংরেজদের চেয়ে অনেক বেশি। পকেটে ডলার আছে টের পেলেই ওরা পিছু ছাড়ে না। অন্তত রোম শহরে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেই দিক দিয়ে জলের শহর ভেনিসকে ভাল না লাগার কোনও কারণ নেই। কিন্তু ভেনিস ভাল লাগে কয়েকদিনের জন্যে, বেশিদিন সে বৈচিত্র্য ধরে রাখতে বা তৈরি করতে পারে না। একই কথা এই সিডনি সম্পর্কে।

সিডনি অপেরা দেখতে হাজার হাজার মানুষ আসেন। আমাকে টানল না, হঠাৎ মনে হল কোনও একটি জায়গাকে ভালবাসতে হলে তার উপর তৈরি ঘরবাড়ি, সৌধ ইত্যাদি সুন্দর থাকলেই হবে না, সেই জায়গার মাটিটাকেও ভালবাসতে হবে। অথবা বলা যেতে পারে, সেই জায়গার মাটিকে ভাল না বাসলে জায়গাটাকে ভাল লাগবে না। এই ভাবনাটা মনে আসতেই আমি মাথা নাড়লাম। পৃথিবীতে মাত্র একটি জায়গা আছে যাকে আমি চিনি, জানি, তাই ভালবাসি। ব্যাপারটা এইরকম, কোনও নারী যতই রূপবতী হোন না কেন, তিনি যদি ভালবাসা গ্রহণ এবং ভালবাসতে সক্ষম না হন তা হলে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় না। পাঁচজন যাকে সুন্দরী দূরের কথা আটপৌরে চেহারার মানুষ বলে স্বীকার করেন না, দেখা যাবে তাঁর বুকের ভালবাসার কাছে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা হার মেনে গেছে। এই কারণেই আমি যখন বলব আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গার নাম গয়েরকাটা তখন একমত না হওয়ার জন্য মানুষ মুখিয়ে থাকবেন। তাতে কী এসে যায়। আমাদের এক সহপাঠিনী সুচিত্রা বেশ সুন্দরী ছিলেন। কিন্তু ঈর্ষায় অ্যাসিড ঢেলে কেউ তাকে বিকলাঙ্গ করে দেয়। একটা গোল মাংসপিণ্ডকে প্লাস্টিক সার্জারির সাহায্যে ডাক্তাররা হাত-পা ওয়ালা মানুষ তৈরি করে দেন। কিন্তু তার মুখের চেহারা আর স্বাভাবিক হয়নি, দৃষ্টি ফিরে পায়নি। ওই সুচিত্রাকে বিয়ে করেন যিনি তিনি বহুদিন থেকে ভালবাসতেন। ওদের সন্তান হয়। অত্যন্ত সুন্দর মেধাবী সেই সন্তানকে জিজ্ঞাসা করলে সে জবাব দিয়েছে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা তার মা। কারণ, মায়ের ভালবাসায় সে বড় হতে পেরেছে।

যে সময় তিস্তার উপর ব্রিজ তৈরি হয়নি সে সময় জলপাইগুড়ি শহর থেকে নদী পেরিয়ে বাস ধরতে হত বার্নিশের ঘাট থেকে। কয়েকটা চা-সিগারেটের আর ভাত-মাছের দোকান যা সন্ধের মুখে বন্ধ হয়ে যায়, খোলে সকাল সাতটায়। ডুয়ার্সের বাসগুলো ওখানেই থামতে বাধ্য হত। শহরের যাত্রী নিয়ে ছুটে যেত আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, নাথুয়া, ফালাকাটা। প্রতিটি বাসের গায়ে একটা নাম লেখা থাকত। আমাদের বন্ধু শিবদাসের পরিবার ওরকম একটা বাসের মালিক ছিলেন। আমরা সেই বাসে উঠলে কন্ডাক্টর ভাড়ায় কিছু ছাড় দিতেন।

ময়নাগুড়ি, ধুপগুড়ি পার হওয়ার পরে অদ্ভুত একটা ভাললাগায় জড়িয়ে পড়ত মন। যেই ডুডুয়া নদীর সেতুতে বাস উঠত অমনি মনে হত চেনা বাতাসের স্পর্শ পাচ্ছি। তারপর রাস্তাটা বাঁক নিয়ে আংরাভাসার উপর দিয়ে যেতেই সেই পেয়ারা গাছটাকে দেখে সোজা হয়ে বসতাম। শুরু হত চায়ের বাগান। আবাল্য চা বাগান আর তার মাঝে শেডট্রি দেখেছি, সেই শেডট্রিতে টিয়ার ঝাঁক উড়ে আসত রোজ ঘরে গেলে। ডানদিকে শ্রমিক বস্তি। সে সময় শ্রমিক শব্দটি ব্যবহার করা হত না। কুলি লাইন বা কুলি বস্তি বলা হত স্বচ্ছন্দে। চায়ের বাগানে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁরা এই কারণে কোনও আপত্তি করতেন না। পরে শ্রমিক বলে তাঁদের সম্মান জানানো হল বটে কিন্তু অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়েছে কিনা সন্দেহ। বরং সৌহার্দ্যের বদলে দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে।

ওই কুলি লাইনের মুখে হাইওয়ের পাশে ছিল বিকাশের মুদির দোকান। সেই দোকান ছিল আমাদের শেষ কিশোর এবং প্রথম তরুণ বয়সের দুষ্টুমির ডেরা। আর একটু এগোলেই দু’দিকে চা বাগানের বাবুদের কোয়ার্টার্স, বাজার এলাকা যা রবিবার ছাড়া অন্যদিন থাকত চুপচাপ, শান্ত। রবিবার ভোর হতেই লরিতে চেপে ব্যবসায়ীরা মালপত্র নিয়ে আসত। চাষিরা তাদের সবজি। বেলা আটটাতেই হাট জমে উঠত। আশপাশের দশ মাইলের মধ্যে যাঁরা থাকেন তাঁরা সাপ্তাহিক প্রয়োজন মেটাতে আসতেন ওই হাটে। আবার দুপুরের পরে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের বদলে শৌখিন সামগ্রীর দোকান বসত ওই হাটে। একটু এগোলেই আংরাভাসার জল খালের সাহায্যে চায়ের ফ্যাক্টরিতে নিয়ে গিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা হত। সাঁকো পার হলেই নানান দোকান। সেলুন থেকে স্টেশনারি। কিন্তু বাড়তে বাড়তে হাট সেই জায়গাও দখল করল প্রতি রবিবার। হাইওয়ে সেখানে ঢুকেই গুলতির মতো দু’ভাগ হয়ে যেত। এক ভাগ চলে যায় চৌমাথার মোড় হয়ে বানারহাটের দিকে নয় বীরপাড়া, আলিপুরদুয়ার কোচবিহার কিংবা ভুটানের পাহাড়। অন্যভাগ খুঁটিমারির জঙ্গল পার হয়ে নাথুয়াতে।

এই দু’টো রাস্তাকে ত্রিভুজের তৃতীয় রেখার মতো জুড়ে দিল ক্লাবের পিছনের রাস্তা।

এই ছোট্ট জায়গাটা আমার রক্তে মিশে গেছে কখন তা আমি নিজেই জানি না। ওই আসাম রোড, যার উপর দিয়ে বড়জোর আটটা বাস সারাদিনে যাতায়াত করত, যার দু’পাশে লম্বা লম্বা গাছে ঝোলা বাদুড় মারার জন্য মদেশিয়া ছেলেরা গুলতি নিয়ে সন্ধেবেলায় চলে আসত, তার আগে কোয়ার্টার্সের মাঠে আমাদের ফুটবল খেলার সঙ্গী হত। ফুটবল না পেলে বাতাবিলেবু ছিল শীতকালে। অনেকেই বলত জাম্বুরা। তার ফুলের গন্ধ বুকের ভিতর এখনও লেগে রয়েছে। তারপর আংরাভাসা। আমার স্বপ্নের নদী। থাই ছোঁয়া গম্ভীর জলের ধারা মূল নদী থেকে বয়ে যেত বাড়ির পিছনের ফুল আর সজনে গাছের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে। পাথরে ধাক্কা লেগে সেই জলে ঢেউ উঠত। তার বুকে হাত রেখে নানান ছোট মাছ ধরতাম। মদেশিয়া মেয়েরা স্নানে এসে আমায় দেখে একটুও লজ্জা না পেয়ে বলত, ‘আরে ও তো বাবলু, এখনও বাচ্চা, বড় হয়নি।’

বিশ্বাস করুন, গয়েরকাটায় গেলে এখনও এই বয়সে মনে হয়, আমি বড় হইনি। বড় হতে একদম ইচ্ছে করে না। মা যতদিন ছিলেন ততদিন যেমন মনে হত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *