৬০
আমাদের অল্পবয়সে কেউ যদি তিস্তা পেরিয়ে বার্নিশের ঘাট থেকে বাস ধরে ডুয়ার্সে ঢুকে কোনও জনপদ দেখে স্থির করতেন, ওখানেই রাতটা কাটিয়ে যাই, তা হলে নির্ঘাত বিপদে পড়তেন। তখনও ময়নাগুড়ি থেকে চালসার রাস্তায় লাটাগুড়িতে রিসর্ট দূরের কথা, একটা ধর্মশালা ছিল না। পিচের রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকলে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কাঠের বাংলো চোখে পড়ত। দু’টো ঘর, কপাল ভাল হলে জায়গা জুটত। কিন্তু বেশিরভাগ সময় পদস্থ অফিসারের জন্যে বরাদ্দ থাকত। তখন গরুমারা ফরেস্টের এত নামডাক ছিল না। গন্ডার, বাইসন দেখতে কলকাতার পাবলিক ঝাঁপিয়ে পড়েনি বলে সেই ষাট-পঁয়ষট্টি সাল পর্যন্ত জন্তু জানোয়ারগুলো বেশ শান্তিতে ছিল।
আর একটু এপাশে এলে ধুপগুড়িতে চায়ের দোকান, ভাতের হোটেল নিশ্চয়ই পাওয়া যেত, কিন্তু থাকার হোটেল খোলার ভাবনা কেউ ভাবেনি। আর একটু এগোলে চা বাগান পেরিয়ে গয়েরকাটার চৌমাথা। খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। জলপাইগুড়ি থেকে আসা পথটা সোজা চলে গিয়েছে বানেরহাট পেরিয়ে ভুটানে। বাঁ-দিকে গেলে খুঁটিমারির জঙ্গল ডিঙিয়ে নাথুয়া। ডানদিকের পথটা বীরপাড়া হয়ে কোচবিহার-অসম। কিন্তু কেউ যদি ব্যাগ নিয়ে বাস থেকে নেমে এপাশ ওপাশে তাকাত তা হলে গয়েরকাটার কেউ প্রশ্ন করতেন, ‘কার বাড়িতে যাবেন বলুন, বলে দিচ্ছি।’
আগন্তুক মাথা নেড়ে যদি বলতেন, ‘কারও বাড়িতে নয়, এখানে হোটেল আছে?’
‘হোটেল?’ চোখ কপালে উঠত, ‘না না। এখানে হোটেল নেই।’
‘ধর্মশালা?’
‘না, সেটাও নেই। থাকার মধ্যে আছে পিডব্লিউডি-র বাংলো। সেটা সরকারি কর্মচারীদের জন্য। আপনি পরের বাস ধরে আলিপুরদুয়ার চলে যান।’
ছবিটা এইরকমই ছিল। একটা ঘটনার কথা আবার লেখার লোভ সামলাতে পারছি না। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল ছিল। ওঁর বন্ধু দুলাল সরকার থাকতেন গয়েরকাটায়। গয়েরকাটাকে নিয়ে শক্তিদার কবিতাও আছে। তা একবার শক্তিদা বাসে জলপাইগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার যাচ্ছেন, গয়েরকাটায় বাস থামলে ওঁর তৃষ্ণা বেড়ে গেল। অন্য যাত্রীরা যখন চা খাচ্ছেন তখন শক্তিদা পাশের দশরথের দোকান থেকে দ্রুত তৃষ্ণা মিটিয়ে এসে দেখলেন বাস চলে গেছে। ঘটনাচক্রে সেটাই ছিল দিনের শেষ বাস। শক্তিদা জানতেন, তাঁর বন্ধু দুলাল সরকার গয়েরকাটায় নেই। তিনি প্রথমে হোটেল খুঁজলেন। পেলেন না। পিডব্লিউডি-র বাংলোয় গিয়ে দেখলেন, সরকারি কর্মচারীরা ঘর দখল করে আছেন। তখন সন্ধে নেমে গিয়েছে। গয়েরকাটায় রাত আটটার মধ্যেই রাস্তায় মানুষ থাকত না তখন। মোড়ে এসে নিজের পরিচয় দিয়েও যখন পাত্তা পাচ্ছেন না তখন তিনি জানতে চাইলেন, ‘দেশ’ পত্রিকা কে রাখেন?
কেউ একজন আমার বাবার নাম বলেছিল। সেই অন্ধকারে চৌমাথা থেকে আধমাইল হেঁটে শক্তিদা আমাদের বাড়িতে পৌঁছে যান। আমি তখন কলকাতায়।
বাইরের ঘরে বসে বাবা বিকেলে আসা খবরের কাগজ পড়ছিলেন। ঘরে ঢুকে শক্তিদা প্রশ্ন করেন, আপনি ‘দেশ’ পত্রিকা পড়েন? বাবা মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনার পরিচয়?’
‘আপনি পদ্য পড়েন তো?’ শক্তিদা উল্টো দিকের সোফায় বসে পড়লেন।
‘না। গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ পড়ি। আপনি কি কবিতা লেখেন?’
‘আমি পদ্য লিখি। আমার নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়।’
বাবা বলেছিলেন, ‘ও। এই নাম আমি দেশ পত্রিকায় দেখেছি।’
শুনে শক্তিদা অত্যন্ত হতাশ। জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতায় তিনি কবিদের মধ্যে প্রথম সারিতে অথচ চা বাগানের এক ভদ্রলোক ‘দেশ’ রাখলেও তাঁর গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
বাবা জিজ্ঞাসা করেন, ‘বলুন, আমি কী করতে পারি।’
শক্তিদা তাঁর সমস্যার কথা জানিয়ে রাত্রিবাসের জায়গা চাইলে বাবা দ্বিধাগ্রস্ত হলেন। একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষকে বাড়িতে থাকতে দেওয়া সঙ্গত নয়। বললেন, ‘দেখুন, আমি আপনাকে চিনি না। আপনার সঙ্গে কি পরিচয়পত্র আছে?’
হাঁ হয়ে গেলেন শক্তিদা। তাঁর কাছে কেউ পরিচয়পত্র চাইতে পারে তা ভাবতে পারেননি। তিনি অসহায় ভঙ্গিতে ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকাতেই বাঁধানো গ্রুপ ছবিটা দেখতে পেলেন। পাওয়ামাত্র লাফিয়ে উঠলেন, ‘একি! আমার ভাই-এর ছবি এখানে কী করে এল।’
‘আপনার ভাই মানে?’ বাবা অবাক।
‘ওই তো, সমরেশের ছবি, সমরেশ মজুমদার। গপ্পো লেখে। সেই সুবাদে আমার ভাই। শক্তিদা ঘোষণা করলেন।
বাবা হেসে বলেছিলেন, ‘আপনার ওই ভাই আমারই ছেলে।’
শক্তিদা আশ্রয় পেয়েছিলেন। তারপরের ঘটনা বলার জায়গা এটা নয়।
সেই সময়ে ডুয়ার্সের বেশিরভাগ জনপদে অতিথিরা আসতেন আত্মীয় বন্ধুদের বাড়িতে। অথবা ফরেস্ট বা পিডব্লিউডি বাংলো বুক করে। পর্যটনবিভাগ ঘুমিয়ে থাকত। এই যে গয়েরকাটা, এর একপাশে খুঁটিমারির জঙ্গল, সামচির পাহাড়ে ফলের রস আর মদের কারখানা, প্রচুর চায়ের বাগান, নানান প্রাচীন মন্দির, জলদাপাড়ার জঙ্গল এক ঘন্টার পথ, অথচ এখানে আচমকা এসে কেউ থাকার জায়গা পেতেন না। ডুয়ার্সকে পর্যটনের ম্যাপে নিয়ে আসার ভাবনা সরকারের ছিল না। নতুন সরকার আসার পর, বিশেষ করে গৌতম দেব দায়িত্ব নেওয়ার পর ডুয়ার্সকে পর্যটনের মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে। আমার জন্ম, বাল্যকাল, কৈশোর গয়েরকাটায় কাটলেও আমি জানতাম না আংরাভাসা নদীর উৎপত্তিস্থল কোথায়? কয়েক বছর আগে গয়েরকাটার ছেলেরা আমাকে নিয়ে গেল তেলিপাড়া চা বাগানে। অবাক হয়ে দেখলাম, আমার স্বপ্নের নদী আংরাভাসা বেরিয়ে আসছে মাটি ফুঁড়ে। বিশ্বাস, একজন ট্যুরিস্ট দৃশ্যটি অবশ্যই মনে বন্দি করবেন।
গয়েরকাটার কিছু ছেলে খুঁটিমারি জঙ্গলের গায়ে মধুবনী রিসর্ট তৈরি করেছে। আপাতত চারটে বড় ঘর, চমৎকার খাওয়াদাওয়া, বারান্দায় বসলেই একেবারে সামনে জঙ্গলের রহস্য। মাঝে মাঝে হাতিরা চলে আসে রিসর্টে। ভয় লাগলেও মজা কম নয়। আর রাতটা যদি জ্যোৎস্নার হয় তা হলে মনে হবে এমন মাধবী রাত জীবনে এই প্রথম এল।
আমরা যা পাইনি, সরকার যা করেননি, তা গয়েরকাটার কয়েকজন ছেলে করতে পারল। চৌমাথায় নেমে থাকার জায়গা আছে কিনা জানতে চাইলেই যে কেউ বলে দেবে, মধুবনীতে চলে যান।
৬১
বছর তিরিশেক আগের কথা। শিলিগুড়ির কয়েকটি ছেলে আমার কলকাতার বাড়িতে এল। প্রত্যেকেরই বয়স কুড়ি-একুশের মধ্যে। ওই বয়সের স্বাভাবিক ছেলেমেয়েদের চেহারা বেশ ঝকঝকে হয়, এদেরও তাই। ওরা বলল, ‘আপনি জলপাইগুড়ির লোক, মানে উত্তরবাংলার মানুষ। আপনার সাহায্য দরকার।’ একটু অবাক হলাম। তখন অবধি তো বটেই, এই এখনও আমার বেশিরভাগ লেখালেখির পটভূমি জলপাইগুড়ি শহর, শিলিগুড়ি, চা-বাগান। সাহিত্য অ্যাকাডেমির পুরস্কার পেয়েছি প্রায় তিরিশ বছর আগে। কিন্তু লক্ষ করেছি শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকার যেসব প্রবন্ধে ওখানকার সাহিত্য নিয়ে সমীক্ষা প্রকাশিত হয়, সেখানে আমার নাম থাকে না, থাকলেও একটা-দেড়টা লাইনে। বলতে হয় তাই বলা। এই দীর্ঘ তিরিশ বছরে একবারই একটি পত্রিকার উদ্যোগে জলপাইগুড়িতে আমাকে নিয়ে অনুষ্ঠান হয়েছিল। গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না প্রবাদটি মেনে নিয়েছিলাম।
সেই তিরিশ বছর আগে কয়েকটি ছেলে যে দাবি নিয়ে আমার সাহায্য চেয়েছিল তা আমাকে সুখী করেছিল, সন্দেহ নেই। আমার বাড়িতে নর্থবেঙ্গল প্রীতি নিয়ে একটা রসিকতা চালু আছে। সাধারণত সকাল এগারোটা পর্যন্ত আমার লেখার সময়। ফোন না করে এলে আমি তিনতলা থেকে নামি না। নেমে দেখেছি আগন্তুক এমনি দেখা করতে এসেছেন বলে যখন চলে যান, তখন যে লেখাটা লিখছিলাম তা মাথা থেকে উড়ে গেছে। বাড়ির লোকরা তা জানে বলে কেউ এলে আমায় বিরক্ত করে না। বলে দেয়, ফোন করে আসবেন। কিন্তু মাঝেমাঝে তারা নিয়ম ভাঙে। দরজায় এসে বলে, আলিপুরদুয়ার থেকে দু’জন এসেছেন। তারা জেনে গেছে শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি-আলিপুরদুয়ার বা কোচবিহার থেকে কেউ এলে আমি নিয়ম ভাঙব। ওখান থেকে যারা আসেন তাঁরা নাকি আমার দেশোয়ালি ভাইবোন।
ওই ছেলেরাও তেমনই এসেছিল। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কী করতে পারি, বলো?’
ওদের মধ্যে সবচেয়ে রোগা, ফর্সা, লম্বামুখ, চওড়া কপাল, যার কথা বলার ধরন খুব শান্ত বলল, ‘আমরা শিলিগুড়ির কলেজে পড়ি। আপনি জানেন, আমাদের ওদিকে আজও কোনও চলচ্চিত্র উৎসব হয়নি। মানুষ কমার্শিয়াল ছবি দেখতে অভ্যস্ত। আমরা একটা উৎসব করে ভাল ভাল ছবি দেখাতে চাই।’
‘কোথায় করবে?’
‘শিলিগুড়ির মেঘদূত হলে।’
তখন শিলিগুড়িতে বেশি এবং ভাল প্রেক্ষাগৃহ ছিল না। এদের কথা শুনে আমি খুব উৎসাহী হলাম। সেই সময়ে আমি ‘দেশ’ পত্রিকার চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে প্রযোজক-পরিবেশকদের পরিচিত ছিলাম। সাহায্য নিশ্চয়ই করতে পারি তবু একটু দ্বিধা নিয়ে জানতে চাইলাম, ‘অন্তত এক সপ্তাহ ধরে উৎসব করা উচিত। এসব করতে যে খরচ হবে তা কোথায় পাবে?
ওরা চারজনই হাত নাড়ল, ‘ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমরা ডোনেশন তুলব, টিকিট বিক্রি হবেই। আর দেখবেন, শুধু এই বছর নয় প্রতিবছর আমরা উৎসব করব।’
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমরা কলেজে কোন ইউনিয়ন করো? সিপিএম?
রোগা ছেলেটি ঝটপট মাথা নাড়ল, ‘না, কংগ্রেস।’
বামফ্রন্টের সেই আমলে কংগ্রেসি ছাত্ররা এমন উদ্যোগ নিতে সাহসী হয়েছে দেখে অবাক এবং খুশি হয়েছিলাম। ফোন করে কয়েকজন পরিবেশককে ওদের কথা বললাম।
খুব পরিশ্রম করে ছবি জোগাড় করেছিল ওরা। কিন্তু তার পরেই অনুরোধ করল, ‘উদবোধনের দিন আমাকে তো থাকতেই হবে, সঙ্গে আমার ‘দৌড়’ ছবির পরিচালক শংকর ভট্টাচার্য এবং মেঘে ঢাকা তারা’-র জন্য শ্রীযুক্তা সুপ্রিয়া দেবীকে ওরা মঞ্চে পেতে চায়।’
শংকর আমার বন্ধু, ওকে রাজি করালাম। কিন্তু সুপ্রিয়া দেবী অত্যন্ত ব্যস্ত শিল্পী। তাছাড়া ওঁরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান, যেখানে টিকিট বিক্রি করা হয়, সেখানে পারিশ্রমিক ছাড়া যেতে চান না। আমাকে তিনি চিনতেন, আমার লেখা নাকি ওঁর ভাল লাগে, দেখা হলেই বলতেন। অতএব ওঁর কাছে যেতে হল এবং এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, ‘ভালভাবে যেতে চাই, ভাল হোটেলে থাকতে চাই। ওরা যেন সিনক্লেয়ারে আমাকে রাখে।’
তাই হল। আমরা বিমানে বাগড়োাগরায় নামতেই দেখলাম প্রচুর গাড়ি, অনেক ছেলের সঙ্গে আমার পরিচিতরাও অপেক্ষা করছে। সেই সন্ধ্যায় ‘মেঘদূতে’ উৎসবের উদবোধন হয়েছিল। শিলিগুড়ির নামী মানুষ এবং সরকারি কর্তারা মঞ্চে ছিলেন। রাত্রে ছেলেরা এসে আমার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাল। বলল, ‘আশার অতিরিক্ত টিকিট বিক্রি হচ্ছে।’ ওদের ওই কর্মযজ্ঞে আমার ভূমিকা ছিল কাঠবিড়ালির।
কিন্তু সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। কাঞ্চন, কুন্তলরা বহুবছর যোগাযোগ রেখেছে। পরের জীবনে ওরা যখন কাজকর্ম শুরু করল তখন কেউ ট্যাক্সির মালিক, কেউ ব্যবসা, কেউ সাধারণ চাকরি। দেখা হলে অথবা ফোনে যখন কথা বলে ওরা কুড়ি-একুশে ফিরে যায়। আর ওই ফর্সা, রোগা, কম কথা বলা ছেলেটিকে আজকাল রোজ বেশি কথা বলতে হচ্ছে কাজের কারণে। তার উপর মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্ব দিয়েছেন উত্তরবাংলা সামলানোর। সেই ছেলেটি এখন উত্তরবঙ্গ বিষয়ক মন্ত্রী, গৌতম দেব।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বদলায়। পরিস্থিতি মানুষকে ধীরে ধীরে পাল্টে ফেলে। এটাই জীবনের নিয়ম। সেই চারজনের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। পুলক, কুন্তলরা বিভিন্ন পেশায় যুদ্ধ করছে একটু সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকার জন্য। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কেন, কোনও উৎসব সংগঠিত করার সময় এবং উৎসাহ ওদের নেই। শিলিগুড়ি অথবা কলকাতার রাস্তায় আচমকা দেখা হয়ে গেলে এসে হাত জড়িয়ে ধরে, কেমন আছেন সমরেশদা?’
‘কেমন দেখছ?’
‘আপনি একইরকম আছেন।’
‘তোমরা?’
‘সব যে যার মতন।’
‘বাকিদের সঙ্গে দেখা হয়?’
‘খুব কম।’
‘গৌতম?’
‘ও তো এখন খুব ব্যস্ত। ঘুমনোর সময় বোধহয় ঠিক পায় না। আমাদের মধ্যে ওই একজন যে কলেজজীবন থেকে নিজের লাইনে এগিয়ে গেছে।’
অনেকে বলেন, সিনেমায় যা সম্ভব তা জীবনে ঘটে না।’ কিন্তু মাঝে মাঝে সিনেমাকেও হার মানিয়ে দিতে পারে জীবন। তারপর একটা সময় আসে যাকে ইংরেজিতে বলে লার্জার দ্যান লাইফ।
ওই সময় মাথা ঠান্ডা রাখা খুব সহজ নয়।
৬২
আমার প্রিয় নদীর নাম আংরাভাসা। যা প্রিয় তার কথা বারংবার মনে আসে। আমার লেখায় তাই আংরাভাসা এসেছে বারবার। মজার কথা যে আংরাভাসাকে দেখতে দেখতে আমি বড় হয়েছিলাম, সে মূল নদী নয়, শাখানদী। গয়েরকাটার বাজারকে পাশে রেখে মূলধারা বয়ে গেছে ডুডুয়ার দিকে। যাওয়ার মুখে খাল কেটে নদীর জল নিয়ে আসা হয়েছিল চা বাগানের বিদ্যুৎ তৈরি করার জন্য। চওড়ায় বড়জোর পঁচিশ ফুট, হাঁটুর উপর তার জল উঠত না কিন্তু স্রোত ছিল তীব্র। পরিষ্কার সেই জল ছটফটিয়ে বয়ে যেত বিদ্যুৎ তৈরি করতে।
সেই বালককাল থেকে এই নদীর পাশে বসে কত রঙিন মাছের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা লাল চিংড়িকে মুঠোয় ধরে তার পায়ের সংখ্যা গুনতে চেষ্টা করেছি। অথচ আমাদের কোয়ার্টাস থেকে দশ মিনিট দূরত্বে বয়ে যাওয়া আংরাভাসার মূল স্রোতকে দেখতে যাওয়ার কৌতূহল হয়নি। ওই ছোট্ট আংরাভাসায় চা বাগানের কামিনরা স্নান করতে আসত। পাড়ের কুলগাছ, কলাগাছের মতো বালক আমাকেও ওরা প্রকৃতির একটা অঙ্গ হিসেবেই ভাবত। হঠাৎ একদিন কানে এল, ওদের একজন বলছে, ‘ওই দ্যাখ, একটা ছেলে উপরে দাঁড়িয়ে আছে।’ নতুন আসা সেই কিশোরীকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছিল দলের বয়স্করা। বলেছিল, ‘ধ্যেৎ, ও তো এখনও বাচ্চা।’ দৌড়ে পালিয়ে এসেছিলাম। অনেকটা দূরে এসেও কথাটা মন থেকে মুছতে পারিনি। আমি এখনও বাচ্চা। বড় হয়ে গেলে ওখানে আর দাঁড়াতে পারব না। কী জানি, হয়তো সেই মুহূর্ত থেকে আমার বড় হওয়া শুরু হয়ে গেল।
কলকাতায় পড়তে এলাম, তারপর এখানেই চাকরি। কিন্তু ছুটি হলেই চা বাগানে যাই। গিয়ে নদীর পাশে দাঁড়াই, আমাদের সেই ছোট নদী একইভাবে চলেছে এঁকেবেঁকে। গিয়ে দাঁড়াতেই ঢেউ-এর ছলাৎ শব্দ, যেন জিজ্ঞাসা করল, ‘এতদিন কোথায় ছিলে?’ শব্দ শুনে প্রাণ জুড়িয়ে যেত। তারপর এক ছুটিতে নদীর কাছে গিয়ে চোখ বিস্ফারিত হল। নদীতে জল নেই। হাড়ের মতো পড়ে আছে ছোটছোট নুড়ি আর পাথর। কোথাও কোথাও ঘাস গজিয়ে গিয়েছে। আচমকা ঘনিষ্ঠ কারও মৃতদেহের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে যে অবস্থা হয়, আমার তখন সেই অবস্থা। জানতে পারলাম চা ফ্যাক্টরিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনেক সহজে জলঢাকা থেকে বিদ্যুৎ পেয়ে কাজ করতে সুবিধা হয়েছে। তাই মূল শাখা থেকে যে শাখা স্রোত আনা হত তার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে সেই নদীর শুকনো খাতে ঘরবাড়ি গজিয়ে উঠল।
মন খারাপ, খুব মন খারাপ। আর তাই বছর দশেক আগে ডুডুয়া নদীর কাছে আংরাভাসার মূল স্রোতের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। শান্ত জলের ধারা একটা টিলাকে অর্ধবৃত্তের মতো ঘুরে ডুডুয়ার দিকে চলে গেছে। হঠাৎ মনে হল ওই টিলার উপর একটা বাড়ি করলে কেমন হয়! ওই জল তো আংরাভাসার জল। গয়েরকাটায় সুব্রত পাল সঙ্গে ছিল। তাকে বললাম, ‘ওই টিলার জমি কার, কত দাম, খোঁজ করো। খোঁজ নিয়ে সুব্রত জানান, ওটা খাস জমি। বিক্রি হওয়ার নয়। আমি কিন্তু মনে মনে ওই টিলার উপর দু’কামরার ঘর বানিয়ে ফেলেছি। নদীর উপর একটা সাঁকো তৈরি করেছি যাতে যাওয়া-আসা করা যায়। সাঁকোর উপর বসে বয়ে চলা জলের ধারা দেখব। কিন্তু স্বপ্ন তো বেশিরভাগ সময়ে স্বপ্নই থেকে যায়।
জলপাইগুড়িতে পড়তে এসে ঠাকুরদার বাড়িতে উঠলাম। হাকিমপাড়ায় বাড়ি। একদিকে বিশাল তিস্তা নদী, অন্যদিকে টাউন ক্লাবের মাঠের পাশ দিয়ে কয়েক পা হাঁটলেই করলা নদী। নদীর উপর লোহার সাঁকো। সাঁকোর নাম ঝুলনা পুল। গাড়ি দূরের কথা, রিকশাও ওই পুলে উঠত না। পুল শেষ হলেই জলপাইগুড়ির সদর গার্লস স্কুল। তিস্তার বিশাল চেহারার সঙ্গে আংরাভাসার কোনও মিল নেই। কিন্তু করলা নদীর দিকে তাকালে কোথাও একটু মিল খুঁজে পেতাম। চওড়ায় আংরাভাসার আড়াই গুণ, জল গভীর কিন্তু অদ্ভুত শান্তভাব নদীটির গায়ে জড়িয়ে থাকত। বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে জলপাইগুড়ি শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে তিস্তায় পড়েছে। চাপা স্রোতের নদীতে বারোমাস মাছ ধরত শখের মাছ ধরিয়েরা। স্কুলে ছুটি থাকলে চলে যেতাম ঝুলনা পুলে। নিচের জলে মাঝে মাঝে কালবোস মাছ জানান দিত। সবচেয়ে মজা হত দুর্গাপুজোর দশমীর দিন। শহরের সমস্ত প্রতিমাকে নিয়ে আসা হত করলার পাড়ে। সেই আর্যনাট্য থেকে থানার পিছনে নদীর সামনে যেন প্রদর্শনী বসে যেত, কাতারে কাতারে মানুষ আসত নিরঞ্জন দেখতে। আলোয় ঝলমল করত চারধার। তারপর প্রতিমাগুলোকে এক-একটা নৌকোয় তুলে দিনবাজার থেকে তিস্তার মুখ পর্যন্ত ঘোরানো হত। স্কুলে ভেনিসের কথা পড়েছি। মনে হত করলার সৌজন্যে জলপাইগুড়ি সেই রাতে ভেনিস হয়ে উঠল।
বর্ষা বেশি হলে করলার জল বাড়ত। থানার দিকটায় একহাঁটু জল। সেই জল ভেঙে মেয়েরা গার্লস স্কুলে পড়তে আসতে পারত না বলে মাঝে মাঝেই স্কুল ছুটি হয়ে যেত রেনি-ডে ঘোষণা করে। আমি জীবনে প্রথম ডিঙি নৌকো চালিয়েছি করলায়, সে এক অন্যরকম উন্মাদনা।
কলকাতায় পড়তে এলাম। এল আটষট্টির বন্যা। ঝুলনা পুল উড়ে গেল তিস্তার জলের চাপে। তারপর তৈরি হল ইট, সিমেন্টের ব্রিজ। আরও চওড়া যাতে গাড়ি যাতায়াত করতে পারে। ঝুলনা পুলে দাঁড়িয়ে জল দেখার সময় যে মৃদু দোল খেতাম তার দিন শেষ। কিন্তু ধীরে ধীরে করলার চেহারা বদলাতে লাগল। তিস্তার মুখটায় যেখানে করলার জল মুক্তি পেত তা বন্ধ করে দেওয়া হল। তিস্তার জল করলায় ঢুকে নদীকে সবল রাখত। এখন সেটা বন্ধ হওয়ায় করলা ঘুরপথে টিমটিম করে বইছে। বৈকুণ্ঠপুরের জলের জোগান বৃষ্টি না হলে থাকে না বললেই হয়। ফলে এখন শহরের গর্ব করলা নদী একটা মজা খাল হয়ে গেছে। চড়া দেখা যাচ্ছে। শহরের যাবতীয় আবর্জনা ওখানে ফেলায় পচা গন্ধে বাতাস ভারী। একটা নদীকে খুন করা হল ধীরে ধীরে। অথচ ওই করলাকে সংস্কার করে আগের চেহারায় ফিরিয়ে নিয়ে গেলে পর্যটকদের আকৃষ্ট করা সম্ভব হত। হাউসবোট, ভাসমান রেস্টুরেন্ট, বাইচ প্রতিযোগিতা ইত্যাদি সেই আকর্ষণ বাড়িয়ে দেবে। নদীর দু’ধারে সুন্দর সুন্দর স্টল করে একটা কার্নিভালের চেহারা দিয়ে জলপাইগুড়ির বেকারদের কর্মসংস্থান অবশ্যই হবে। আমরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝতে চাইছি না।—আমার দু’টি প্রিয় নদীর একটি আজ মৃত, অন্যটি জরাগ্রস্ত। সরকারই এখন ভগীরথের ভূমিকা নিতে পারে। আজকের ভগীরথের অস্ত্র হল সদিচ্ছা। আমরা তার আশায় বসে আছি।
৬৩
দিনকয়েক আগে খবরের কাগজের ছয়-এর পাতার এক কোণে ছাপা কয়েকটি লাইন পড়ে চমকে গেলাম। তার কিছু পরেই আলিপুরদুয়ার থেকে ফোন এল, ‘দাদা, আপনার প্রতিক্রিয়া কী?’
বললাম, ‘শেষ পর্যন্ত অচলায়তন ভাঙল।’
কিন্তু ব্যাপারটা খুব সহজে ঘটেনি। খবরে ছিল, চা বাগানের শ্রমিক-মালিক-ম্যানেজাররা একসঙ্গে একটি ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। ম্যানেজার, সহকারী ম্যানেজার থেকে বাগানের বাবু বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীও একই দলে মিলেমিশে ফুটবল খেলেছেন। বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছিল। ঘটনা সত্যি হলে আমার তো আনন্দিত হওয়ার কথা।
ব্রিটিশরা এদেশে চা বাগান তৈরি করেছিল। সেই চা বাগানের কাজে উত্তর বাংলার ভূমিপুত্ররা রাজি হয়নি। তাঁদের ধারণা ছিল ওই গাছ অমঙ্গলের গাছ। মাটি থেকে উৎপন্ন গাছের পাতা, ডাল অথবা শিকড় খাওয়া যায় না। ফুলও নয়, ফল তো দূরের কথা। ওই গাছ চাষ করলে শিব রুষ্ট হবেন। এই ভেবে রাজবংশী, কোচ ইত্যাদি সম্প্রদায়, যাঁরা উত্তরবাংলার আদি মানুষ, ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করলেন না। কাজ চালাতে বিহার-উত্তরপ্রদেশের অতি দরিদ্র মানুষদের জলখাবার এবং বাসস্থানের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসা হল যাঁরা তেমনভাবে চাষের কাজ জানতেন না। এঁদের জন্য কুলি লাইনের জন্ম হল। এই শ্রমিক আর ম্যানেজারের মাঝখানে ঠিকঠাক কাজ করানোর জন্যে একটা বাবু সম্প্রদায় তৈরি হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের যুবকদের তুলনায় পূর্ববঙ্গের বাঙালি ভাগ্যান্বেষীদের এই বাবু সম্প্রদায়ে বেশি দেখা গিয়েছে। ম্যানেজারদের বাংলো তৈরি হত কুলি লাইন তো বটেই, বাবুদের কোয়ার্টাস থেকে অনেক দূরে, চা বাগানের এক প্রান্তে। চায়ের সবুজ গালিচার মধ্যে এক-একটি বাংলো। বড়, মেজো, সেজো সাহেবদের বাংলোর আকৃতি এবং ফুলের বাগান থেকে লন, আসবাবপত্র, খানসামা থেকে বাবুর্চি এক হত না। সেটা নির্ভর করত তাঁর পদের উপর। সাহেবরা হাফপ্যান্ট পরে সকালে কাজে বের হতেন জিপ চালিয়ে। পরস্পরকে দেখা হলে গুডমর্নিং-ও বলতেন। পরে সেটা বাবুদেরও বলা চালু হয়েছিল। ঠিক সময়ে ব্রেকফাস্ট করতে বাংলোয় ফিরে যেতেন। তারপর আবার কাজ, কাজেই ফিরে যাওয়া। অপরাহ্নে কাজ সেরে বিকেল শেষে বাংলোয় ফেরা। সোম থেকে শুক্রবার এই রুটিন। শনিবার বিকেল হলেই সেজেগুজে জিপ চালিয়ে বড়, মেজো, সেজো সাহেবরা বিভিন্ন বাগান থেকে এসে টি প্ল্যান্টার্স ক্লাবে জড়ো হতেন। খানাপিনা হত। সেখানেও বড়রা বড়দের সঙ্গে, সেজোরা সেজোদের সঙ্গে আড্ডা মারতেন। তাঁদের স্ত্রী-রাও ওই সীমায় থাকতেন। হঠাৎ কারও সুন্দরী শ্যালিকা উপস্থিত হলে সীমাটা টলমলে হয়ে যেত। কিন্তু এই ছিল ওঁদের জীবন। শুনেছি চাকরি পাওয়ার সময় যেসব শর্তে সই করতে হত তার মধ্যে ছিল, ‘তুমি তোমার থেকে নিচের পদে যে কাজ করছে তার সঙ্গে কোনও সামাজিক সম্পর্কে যাবে না।’ অর্থাৎ বড় দূরের কথা, ছোট সাহেবও কোনও বাবুর বাড়িতে চা খেতে যেতে পারবে না। গেলে চাকরি যাবে। বাবুদেরও সাহস ছিল না, সাহেবের বাংলোয় আড্ডা মারার জন্যে যেতে।
এই বিভাজনের কারণ হিসেবে ব্রিটিশরা ভেবেছিলেন দূরত্ব না থাকলে কাজ ঠিকঠাক হবে না। ভয় এবং সমীহ না করলে কর্মচারীরা তার সুযোগ নেবেই। ব্রিটিশ আমলে চা বাগানের ম্যানেজারদের ক্ষমতার কথা প্রায় গল্পের মতো। কোনও অন্যায় দেখলে তাঁরা চাবুক ব্যবহার করতেন। চাবুক তো দূরত্ব বাড়ানোর পক্ষে যথেষ্ট।
আমার বাবা একটি সাগরপারের কোম্পানির চা বাগানে চাকরি করতেন। পাশাপাশি বাবুদের কোয়ার্টাসে আমরা থাকতাম। সেইসব পরিবারের ছেলেরা একসঙ্গে খেলত। সেইসব খেলায় খেলোয়াড় কম পড়লে মদেশিয়া শ্রমিকদের ছেলেদের ডেকে নিতাম। দেখতাম তারা আমাদের খুব সমীহ করত। আমাদের বাড়ির ভিতর ঢুকত না। অর্থাৎ সাহেবদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের যে দূরত্ব ছিল, অতটা না হলেও অনেকটা দূরত্ব আমাদের মধ্যে থাকত। কিন্তু আমরা, ছোটরা সেই দূরত্ব ভাঙার চেষ্টা করতাম কিছু না বুঝেই। মাঝে মাঝে সাহেবদের দেখতে পেতাম। জিপ চালিয়ে গম্ভীর মুখে চলে যেতেন তাঁরা। ভারত স্বাধীন হলেও বিদেশি কোম্পানির চা বাগানগুলোতে ইংরেজ এবং স্কটিশরা থেকে গিয়েছিলেন বেশ কিছু বছর। তারপর তাঁরা যখন চলে গেলেন তখন ভারতীয় সাহেবরা ওইসব পদে যোগ দিয়ে ঠিক পূর্বসূরিদের অনুকরণ করতে লাগলেন। তাঁরা ভুলেও বাবুদের বাড়িতে এসে চা খেতেন না।
এই সময় দু’টি বিরল ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের বাগানে ধুমধাম করে কালীপুজো হত। সাহেবরাও সেই পুজোয় চাঁদা দিতেন কিন্তু পুজোমণ্ডপে আসতেন না। একবার তাঁরা এলেন। গাড়ি থেকে নেমে দু’চারটে কথা বলে ফিরে গেলেন। এতেই বাবুরা খুব খুশি হয়েছিলেন।
দ্বিতীয় ঘটনাটি চমকপ্রদ। জলপাইগুড়ির একটি ছেলে, যার মা হাসপাতালে নার্সের চাকরি করতেন, পড়াশোনায় খুব ভাল হলেও স্কুল ফাইনালের পর আর্থিক কারণে পড়তে পারছিলেন না। সে সময় জলপাইগুড়ির সত্যেন্দ্রপ্রসাদ রায় মশাইকে তাঁর বিভিন্ন খাতে দান, খেলা নিয়ে প্রবল উৎসাহ ও মানুষের বিপদে সাহায্য করার জন্য লোকে ফাদার অফ জলপাইগুড়ি বলতেন।
সত্যেন্দ্রপ্রসাদ খবর পেয়ে ছেলেটিকে ডেকে পাঠান এবং কলেজে ভর্তি করে সমস্ত দায়িত্ব নেন। সত্যেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন টি-কিং। অনেকগুলো বাগানের মালিক। ছেলেটি পাস করলে তাকে অসমের টোকলাইতে পাঠিয়ে দেন চা নিয়ে পড়তে। ওই সংস্থায় পড়ে পাস করলে চায়ের বাগানে ম্যানেজারদের পদে চাকরি পাওয়া যায়। ছেলেটি পাস করে বিদেশি কোম্পানিতে সহকারী ম্যানেজারের চাকরি পেল। আলাদা বাংলো, গাড়ি, বাবুর্চি, খানসামা, যা কয়েক বছর আগে তার স্বপ্নের বাইরে ছিল। চাকরির শর্ত ছিল, ‘তুমি তোমার চেয়ে অধস্তন কোনও কর্মচারীর সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক রাখবে না। তোমার কোনও আত্মীয় যদি ম্যানেজারের স্ট্যাটাসের নিচের পদে কাজ করে তা হলে তাকে তোমার বাংলোয় জায়গা দেবে না, তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখবে না।’ ভাল চাকরি পেয়ে ছেলেটি তার নার্স মাকে নিজের বাংলোয় আনতে চাইল। তার জন্য মাকে চাকরি ছেড়ে আসতে হবে। মা রাজি হলেন না। বললেন, ‘যে চাকরি করে তিনি এতদিন বেঁচে আছেন, ছেলেকে মানুষ করেছেন তা ছেড়ে দিতে পারবেন না। তুই যেমন আছিস, তেমন থাক। ভাল থাক।’ শুনেছি ছেলেটি সন্ধের পর বাংলো থেকে গাড়ি চালিয়ে জলপাইগুড়িতে গিয়ে গভীররাতে মায়ের সঙ্গে দেখা করে ভোরের আগে ফিরে এসেছিল কয়েকবার। বেশ কিছু বছর টানাপোড়েনের পর ছেলেটি চাকরি ছেড়ে দিয়ে বীরপাড়ার কাছে গ্যারেজের ব্যবসা শুরু করেছিল।
আজকের খবরটা পড়ার পর মনে হল প্রায় দেড়শো বছর ধরে যে ভয়ংকর বিভাজনের আইন ব্রিটিশরা তৈরি করে গিয়েছিল তা দূর হয়েছে। কিন্তু কতটা দূর হয়েছে তা দেখার জন্যে আমাদের আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
৬৪
সেই নাইন-টেন থেকে শুরু হয়েছিল, এমএ পাস করার পরও অভ্যেসটা চালু ছিল। আমরা যারা গয়েরকাটার বাইরে পড়াশোনা করতাম তারা ছুটিতে বাড়ি ফিরলেই একটা আড্ডার জায়গা খুঁজে নিয়েছিলাম। ভবানী মাস্টারের পাঠশালায় বিকাশ পড়ত কিনা মনে নেই কিন্তু একেবারে বাল্যকালে সে আমাদের ফুটবল খেলার সঙ্গী ছিল। যেকোনও কারণেই হোক তার পড়াশোনা হয়নি কিন্তু চা বাগানের প্রান্তে জাতীয় সড়কের পাশে সে একটি মাঝারি মুদির দোকান খুলে বসেছিল। ভরদুপুরে যখন চারপাশে মানুষজন নেই, শব্দ বলতে টিয়ার চিৎকার আর মাঝেমধ্যে ছুটে যাওয়া গাড়ির আওয়াজ, তখন ছুটিতে যাওয়া আমরা সাইকেলে চেপে হাজির হতাম ওর দোকানে। দুপুরের খাওয়া সেরে আসায় সন্ধের আগে আমাদের খোঁজ পড়বে না বাড়িতে। দোকানের পিছন দিকের এক চিলতে ঘরে বসে কলেজপড়ুয়া আমরা কাঁচি সিগারেট ধরাতাম বিকাশের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে। একটাই সিগারেট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টানতাম চার জনে। বিকাশ দোকানের দায়িত্ব আমাদের দিয়ে স্নান খাওয়া সারতে চলে যেত। যাওয়ার আগে একটা কাগজে কোন জিনিসের কী দাম তা লিখে রেখে যেত। যদিও ভরদুপুরে ওই সময়ে খদ্দের আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, তবু কেউ না কেউ এসে পড়ত। তখন তাকে সযত্নে নুন, তেল, চিনি বিক্রি করতে খুব আনন্দ হত। বিকাশের ওই দোকান যেহেতু চা বাগানের শ্রমিক লাইনের খুব কাছাকাছি তাই ওর খদ্দেরদের অধিকাংশই তারা ছিল। জন্ম থেকে শুনে শুনে মদেশিয়া ভাষায় অভ্যস্ত আমাদের তাই কথা বলতে অসুবিধে হত না। বিকাশ ফিরে এলে হিসেব দিতাম। প্রায়ই দেখা যেত আমরা চল্লিশ-পঞ্চাশ পয়সা লোকসান করেছি উৎসাহের আতিশয্যে। বিকাশ হেসে বলত, ‘সব কাজ তো সবাইকে দিয়ে চট করে হয় না। তোরা প্র্যাকটিস কর, দেখবি একদিন ঠিকঠাক দোকানদারি করতে পারবি।’
তখন শিবু সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। দীপু কেমিস্ট্রি অনার্স, আমি বাংলা অনার্স আর চাঁদ ফিজিক্স। কিন্তু স্কুলের নিচু ক্লাসেই থমকে থাকা বিকাশের মতো দোকানদারি করতে পারি না, এটা প্রমাণিত। আমরা ঠিক করলাম রোজ চল্লিশ পয়সার বেশি লোকসান করব না আর লোকসান হলে আমরাই দশ পয়সা করে দিয়ে ম্যানেজ করে নেব। শিবু বোঝাল এটাই দস্তুর। তাদের কলেজ ক্যান্টিনে চায়ের দাম খুব কম, বাইরের সাধারণ দোকানের অর্ধেক। কারণ, কলেজ কর্তৃপক্ষ ক্যান্টিনকে ভরতুকি দেন। পৃথিবীর অনেক কিছুই ওই ভরতুকির উপর চলছে। অতএব নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে আমরাই ভরতুকি দিতে পারি। ব্যাপারটা বিকাশকে জানানো হয়নি। পরপর দু’দিন আমাদের হিসেব দেখে সে খুশি হয়ে বলেছিল, ‘বাঃ, তোরা দেখছি ভাল ব্যবসাদার হবি।’ আমরা কে কী পড়ছি তা সে জানত না। জানলেও সেটা অস্পষ্ট থেকে যেত তার কাছে। ওর আড়ালে দীপু বলেছিল, সে কখনওই ব্যবসাদার হবে না। কারণ, ব্যবসাদাররা বেশ অসৎ হয়। বাংলায় এমএ পাস করেও ব্যবসাদারি করা যায়, একথা সেই বয়সে জানতাম না।
আমরা পাস করে রোজগার শুরু করার আগেই শিবু ইঞ্জিনিয়ার হয়ে একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেল। গয়েরকাটায় গেলে ওর দেখা পাওয়া মুশকিল হত। বিকাশের কাছে শুনতাম শিবু সাইটে আছে। পরেরবার শুনলাম শিবু জিপে চেপে যাতায়াত করে। আমরা তিন বন্ধু বছরখানেক বাদে শিবুর কর্মস্থলে পৌঁছে গেলাম বিকাশের কাছ থেকে সন্ধান নিয়ে। বিকাশের সঙ্গে মাঝেমাঝেই শিবু দেখা করে যেত। জাতীয় সড়ক থেকে কাঁচা রাস্তা ভেঙে অনেকটা যাওয়ার পর পাহাড়ি জঙ্গল এলাকায় যে রাস্তা তৈরি হচ্ছে সেখানেই শিবুদের তাঁবু পড়েছে। আমাদের দেখে সে আহ্লাদিত। বলল, ‘ঠিক সময়ে এসেছিস তোরা। একঘেয়ে লাগছিল খুব। চল, চাপড়ামারিতে যাই।’
আমরা চাপড়ামারির নাম জানি। বানারহাট থেকে যে রাস্তা সেবকের দিকে গিয়েছে তার একটি শাখা খুনিয়ার মোড় থেকে বিন্দুতে পৌঁছেছে। ওই খুনিয়ার মোড়ের পাশেই চাপড়ামারির জঙ্গল। কিন্তু তখন বিকেল। বাড়িতে না জানিয়ে চাপড়ামারিতে যাওয়া ঠিক হবে না। অতদূরে গেলে রাত্রে বাড়িতে ফেরা হবে না। কিন্তু শিবু উড়িয়ে দিল, ‘দূর। রোজ তো বাড়ি ফিরিস। একদিন না ফিরলে যদি মহাভারত অশুদ্ধ হয়, তো হোক না।’ আমাদের জিপে তুলল সে।
বানারহাট-লক্ষ্মীপাড়ার গা ঘেঁষে যে রাস্তা তা সেসময় সত্যি সুন্দর ছিল। চালসা আসার আগেই খুনিয়ার মোড়। ডানদিকে ঘুরে দেখলাম ফরেস্টে ঢোকার গেট। তখন সন্ধের আঁধার নেমেছে। সাধারণত ফরেস্টের গেটে তালা দেওয়া থাকে। ভাগ্য ভাল বলে খোলা গেট পেয়ে শিবু জিপ নিয়ে গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটা বড় পুকুরের পাশে পৌঁছে গেল। সামনেই ফরেস্ট বাংলো। আমাদের কোনও অনুমতিপত্র ছিল না। কিন্তু চৌকিদার, খানসামাদের ম্যানেজ করে ফেলল শিবু। একতলায় বসার ব্যবস্থা, দোতলায় দু’টো ঘর। জানা গেল, তার একটিতে কলকাতার পার্টি রয়েছে। চায়ের অর্ডার দিচ্ছি শুনে শিবু বলল, ‘আমাকে বাদ দিয়ে বল।’ তারপর সে জিপের ভিতর থেকে একটি হুইস্কির বোতল বের করে নিয়ে এল। আমরা তখনও মদ থেকে অনেক দূর। তপন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এ কী রে! তুই মদ খাস?’ শিবু বিরক্ত হল, ‘অশিক্ষিতের মতো কথা বলিস না। মদ খেউ খায় না, পান করে। হ্যাঁ, আমি পান করি। একটা কুয়ো ভর্তি হয়েছে মদের বোতলে। কাল সাইটে আসিস দেখিয়ে দেব।
আমাদের কেউ স্পর্শ করল না। শিবু একাই খেয়ে যাচ্ছিল। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝেমাঝে জঙ্গলের প্রাণীদের ডাক শোনা যাচ্ছে। খানসামা বলল, ‘ভোর তিনটে থেকে হাতি, গন্ডার, বাইসনেরা পুকুরে আসে জল খেতে।’ রাত একটায় শিবুর বোতল শেষ হলে সে খানসামাকে ডেকে আরও মদ চাইল। খানসামা জানাল, তার কাছে মদ নেই। চিৎকার করে কাউকে গালাগালি দিয়ে টলমলে পায়ে শিবু আমাদের প্রবল আপত্তিকে উপেক্ষা করে জিপে গিয়ে বসল। বলল, ‘এখনই মদ কিনে নিয়ে আসছি।’ একটু একটু করে রাত বাড়ল। শিবুর দেখা নেই। তার জিপের হেডলাইটের আলো দেখার জন্যে উন্মুখ হয়ে শেষ পর্যন্ত ভোর হতে দেখলাম। আবছা আলোয় বেরিয়ে পড়লাম শিবুর খোঁজে। হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম জঙ্গলের গায়ে তার জিপ পড়ে আছে। ক্ষতবিক্ষত। শিবুকে পেলাম একটা গাছের ডালে। বেশ নির্লিপ্ত গলায় বলেছিল, ‘হাতির পাল্লায় পড়ে আমি আর মদ কিনতে পারিনি।’
একজন ইঞ্জিনিয়ার কেন রাতদিন মদ খেয়ে গিয়েছে তা আমরা জানি না। আমরা যারা ওর কাছের মানুষ ছিলাম তাদেরও বলেনি। প্রচুর টাকা রোজগার করেছে আর দু’হাতে উড়িয়েছে। একজন বৃদ্ধ ড্রাইভার রেখেছিল কিন্তু তাকে স্টিয়ারিং ধরতে দিত না। বেচারা গাড়ির পিছনে পা ঝুলিয়ে বসে থাকত লাফানোর জন্যে, কারণ, শিবুর হাতে স্টিয়ারিং স্থির থাকত না। একসময় তার সঞ্চয় ফুরিয়ে গেল। তবু মদ ছাড়েনি শিবু। দামি মদ কিনতে না পেরে হাঁড়িয়াতে নেমে গিয়েছিল।
একবার ছুটিতে গয়েরকাটায় গিয়ে বিকাশের দোকানে আড্ডা মারছি। হঠাৎ শিবু এল। জিপ নেই, সাইকেলে, বলল, ‘তোরা এসে গেছিস। দশটা টাকা দে ভাই। সকাল থেকে পেটে মদ পড়েনি। মদ না খেলে মরে যাব।’ আমরা অনেক বোঝালাম। কে কার কথা শোনে।
কিছুদিন পরে খবর পেলাম, শিবু নেই। এখনও আমি বিভ্রান্ত। আত্মহত্যার অনেক পথ আছে। শিবু কেন এই পথটা বেছে নিয়েছিল?
এবার ঘরে ফিরে দেখলাম অনেক শিবু ছড়িয়ে গেছে শিলিগুড়ি থেকে কোচবিহার। মন খারাপ হয়ে গেল।
৬৫
আমি প্রথমবার দার্জিলিং-এ যাই বাষট্টি সালে। তখন কলকাতায় স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ছি। বাড়ি নর্থবেঙ্গলে শুনে সহপাঠীদের ধারণা ছিল আমি দার্জিলিংকে খুব ভাল জানি। যখন বলেছিলাম, আকাশ পরিষ্কার থাকলে জলপাইগুড়ির জেলা স্কুলের মাঠ থেকেও কাঞ্চনজঙঘা দেখা যায়, তখন ওরা আমাকে দার্জিলিং-এরই লোক বলে ভেবে নিয়েছিল।
জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি হয়ে শুকনা কতদূর? কলকাতা থেকে খড়গপুরের চেয়ে কম পথ। আর শুকনা থেকেই তো পাহাড়ের শুরু। এই সামান্য পথ পেরিয়ে একটা আঠারো বছরের ছেলের তো অনায়াসে যাতায়াত করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তব অন্যরকম ছিল। সে সময় মানুষ বাড়ির বাইরে যাওয়া মানে, হয় পুণ্য করতে পুরী বা কাশী অথবা কলকাতায় যাওয়া বোঝাত। আমি এমন অনেক মানুষকে জানি যারা জলপাইগুড়িতে থেকেও কোচবিহারে যায়নি। গয়েরকাটার বেশকিছু মানুষ এখনও শিলিগুড়িতে যায়নি। পঞ্চাশ থেকে পঁয়ষট্টি সালের শিলিগুড়ির ছাত্রছাত্রীরা যখন কলকাতামুখী হয়ে গিয়েছে তখনও অনেক বয়স্ক মানুষ আলিপুরদুয়ারে যাননি। আমার পিতামহ অথবা পিতা ধর্মটর্ম তেমন করতেন না, তাই পুণ্যক্ষেত্রে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। আমি যখন বছর আড়াই-এর তখন পিতা সপরিবারে তাঁর দিদির বাড়ি জামশেদপুরে যাওয়ার পথে কলকাতায় কিছুদিন ছিলেন। সেই স্মৃতি আজ ঝাপসা। হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে আমি ছিটকে চলে গিয়েছিলাম কলকাতার কলেজে পড়তে। সাধারণ পরিবারের ছেলেরা তখন জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজেই পড়ত। আমারও ওখানেই ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। পিতামহ বলেছিলেন, ‘পুকুরে না থেমে নদীতে যাক, তা হলে ভাল সাঁতার শিখবে।’ কিন্তু ওই হলদিবাড়ি থেকে আসা বিকেলের লোকাল ট্রেনের শেষ বগিতে উঠে বসতাম। শিলিগুড়ি স্টেশনে সেটাকে কেটে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হত। সারারাত বসে ঢুলতাম। ভোরে বালির উপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে স্টিমারে উঠে গঙ্গা পেরিয়ে ওপারের ট্রেনে। বিকেলে শিয়ালদায়। আমার কাছে দার্জিলিং দেখার সুযোগ যে নেই তা সহপাঠীদের কাছে বলতে চাইতাম না, নিছক দর বাড়ানোর জন্যে।
গরমের ছুটির আগে দুই সহপাঠী বলল, ‘চল তোর সঙ্গে দার্জিলিং ঘুরে আসি। তিনদিন থাকব। তারপর আমরা ফিরে আসব, তুই তোর বাড়িতে চলে যাস।
সে সময় পশ্চিমবাংলার কোনও জায়গা সম্পর্কে বিশদ বিবরণ ছাপানো বই পাওয়া যেত না, এক বুক অজ্ঞতা নিয়ে রওনা হলাম ওদের সঙ্গে। সে সময় ট্রেনে রিজার্ভেশনের বালাই ছিল না। শুধু ফার্স্ট ক্লাসে নির্দিষ্ট টিকিট বিক্রি হত। ভিড় থাকলেও আমাদের তখন অসুবিধে বোঝার বয়স হয়নি। ট্রেনে এক পরিবারের সঙ্গে আলাপ হল। তাঁরা দার্জিলিং-এ গিয়ে কালীবাবুর হোটেলে উঠবেন। খাওয়া থাকা নিয়ে মাথা পিছু পনেরো টাকা। শৈবাল গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘বেশ কাটলি। তোর জানাশোনা কোনও দশ টাকার হোটেলে উঠব আমরা। আগেই তো বলেছি, বাজেট খুব বেশি হলে সত্তর টাকা।’ আমি ঢোক গিলেছিলাম।
টয় ট্রেনে চেপে দার্জিলিং-এ পৌঁছেছিলাম বিকেল সাড়ে চারটের সময়। এর মধ্যে বন্ধুদের এড়িয়ে এর-ওর কাছে দার্জিলিং সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনেছি। লিঙ্ক নামে একটি সিনেমা হলের পিছনে কয়েকটি হোটেল আছে যেখানে সস্তায় ঘর পাওয়া যায়। কালীবাবুর হোটেল স্টেশনের পাশেই। বাঙালি খাবার পাওয়া যাবে।
স্টেশনে নেমে ঘোষণা করলাম, ‘প্রথম রাতটা কালীবাবুর হোটেলেই না হয় থাকি, বন্ধুরা মেনে নিল। অনুসরণ করে সেখানে গিয়ে শুনলাম জায়গা নেই। দেখলাম, কলকাতার মেসবাড়ির মতো আবহাওয়ায় বাঙালি ট্যুরিস্টরা স্বচ্ছন্দে রয়েছেন। স্টেশন থেকে পোস্ট অফিসের দিকে যে রাস্তা গিয়েছে তার নাম লাডেন লা রোড। আমাকে ভাব করতে হচ্ছিল এমন, যাতে মনে হয় অনেকবার ওই পথে গিয়েছি। কিন্তু ততক্ষণে আমার চোখে পড়েছে রাস্তার ছোট ছোট দোকানে সুন্দরী নেপালি মেয়েরা বসে দোকানদারি করছে হাসিমুখে। জলপাইগুড়ি বা কলকাতায় এই দৃশ্য কখনও দেখিনি। জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ায় আমাদের বাড়ির গায়ে ফরেস্টের চৌকিদারদের বাসস্থান ছিল। তারা সবাই নেপালি। ছোট থেকেই তাদের সঙ্গে মেলামেশা করায় কিছু নেপালি শব্দ শিখেছিলাম। তাই ব্যবহার করে জেনে নিচ্ছিলাম লিঙ্ক সিনেমা হল কোন দিকে! আমার সঙ্গীরা নেপালি শব্দের অর্থ বুঝতে না পারায় আমার অজ্ঞতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করতে পারছিল না। ওষুধের দোকানের পাশের গলি দিয়ে আমরা যে হোটেলে পৌঁছলাম তা রীতিমতো ঘুপসি। একটা ঘরে তিনটে খাট রয়েছে, বাথরুম কমন। ভাড়া কুড়ি টাকা। সেই বয়সে আমরা তাতেই খুশি।
তখন কলকাতায় গরম হলেও দার্জিলিং-এ বিকেলের পর বেশ ঠান্ডা। তবু শৈবাল আদ্দির পাঞ্জাবি পাজামা পরে ম্যাল দেখতে বেরিয়েছিল আমাদের সঙ্গে। ক্যাভেন্ডার্সের রেস্তোরাঁ দেখে আমরা উত্তেজিত। এখানেই সত্যজিৎ রায়ের কাঞ্চনজঙঘার সেই বিখ্যাত দৃশ্যটির শুটিং হয়েছিল, যেখানে অনিল চট্টোপাধ্যায় একজন বিদেশিনীর ছবি তোলার বাহানায় তাঁর কুকুরের ছবি তুলতে চাইছেন। দাস স্টুডিও ছাড়িয়ে ম্যালে পৌঁছতে সন্ধে নামল। শৈবাল শীতে কাঁপছে কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। হঠাৎ একজন বৃদ্ধ নেপালি ঘোড়াওয়ালা এসে শৈবালকে একটুকরো সাদা জিনিস দিয়ে বলল, ‘এটা মুখে রাখো, গরম লাগবে।’ কথাগুলো লোকটা হিন্দিতে বলেছিল। জেনেছিলাম ওটা চমরী গরুর দুধ জমিয়ে করা হয়েছে। শৈবাল চিবিয়ে বলেছিল, ‘ফ্যান্টাস্টিক’।
পরে দার্জিলিং-এর সবচেয়ে দামি হোটেলে থেকেছি কিন্তু সেই প্রথমবারের থাকার স্মৃতিতে কোনও মালিন্য নেই। বেশ মজায় ছিলাম। বয়স কম এবং মন উদার হলে বোধহয় কোনও কষ্টকেই কষ্ট বলে মনে হয় না। পরদিন ম্যালে এক মধ্যবয়সি বাঙালি মহিলাকে প্যান্ট পরে ঘোড়ায় উঠতে দেখলাম। উঠে তিনি চেঁচাচ্ছেন, তাঁর প্যান্টের বোতাম ছিঁড়ে গেছে। জানা গেল, তিনি স্বামীর প্যান্ট পরেছেন। সেই বাহান্ন বছর আগে মহিলার বলা ‘বিদেশ’ শব্দটি কানে খট করে লেগেছিল। দার্জিলিংকে আমরা কি শুধু একটা বেড়ানোর জায়গা, আমাদের ক’দিনের আনন্দিত হওয়ার পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে ভেবে এসেছি? ওই মহিলাকে শৈবাল অনেকক্ষণ বুঝিয়েছিল, আপনি বিদেশে আসেননি। এটা পশ্চিমবাংলা, কোচবিহার-বর্ধমানের মতো।
এখানে আপনার স্বামীর প্যান্ট পরার কোনও দরকার নেই। যদি পরেন তা হলে কলকাতায় ফিরে গিয়ে পরবেন কিন্তু। মহিলা বলেছিলেন, ‘কিন্তু ওদের ভাষা তো আলাদা। বুঝতে পারি না।’ শৈবাল বলেছিল, ‘আপনি জলপাইগুড়ির রাজবংশীদের ভাষা বুঝতে পারেন? মেদিনীপুর-ওড়িশার সীমান্তের বাঙালিদের সব কথা বোধগম্য হয়? মালদার মানুষের কথায় যে টান থাকে তা আপনাকে ভেবে বুঝতে হয় না?’ মহিলা মাথা নেড়েছিলেন, ঠিক-ঠিক।
এর অনেক বছর পরে সমরেশ বসুর সঙ্গে ম্যালের পাশে অজিত ম্যানসনের একটি ফ্ল্যাটে থাকা বিখ্যাত লেখক দীপক চৌধুরির কাছে গিয়েছিলাম। দীর্ঘকাল তিনি সেখানে ছিলেন। তাঁর ঘরের জানলা থেকে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ‘পাতালে এক ঋতুর’ লেখক গাইছিলেন, ‘ও আমার সোনার বাংলা…!’
আমি বিশ্বাস করি, দার্জিলিং-এ যে আগুন জ্বলেছিল তার কোনও দরকার ছিল না, যদি আমরা দার্জিলিংকে নিজের করে ভাবতাম। ওই আগুন একেবারে নিভে যাক, এই প্রার্থনা।
৬৬
আমরা যখন স্কুলের শেষ ধাপে তখন জলপাইগুড়ি শহরে তিনটি সিনেমার হল ছিল। সদর থানা থেকে যে রাস্তাটা সোজা কদমতলার মোড় হয়ে চলে গেছে সেটাই শহরের প্রধান পথ বলে তার দু’পাশে নানান দোকানের সঙ্গে ওই তিনটি সিনেমার হল তৈরি হয়েছিল। রূপশ্রী, আলোছায়া এবং দীপ্তি টকিজ। নতুন ছবি এলেই সাইকেল রিকশায় বিজ্ঞাপন টাঙিয়ে মাইকে প্রচার করা হত শহরের বিভিন্ন পাড়ায় ঘুরে। আমরা শুনতাম, ‘নতুন ছবি, ভয়ংকর অভিযানের ছবি, শ্রেষ্ঠাংশে প্রদীপ কুমার, সুমিতা দেবী। আসুন, দলে দলে আলোছায়ায় এসে দস্যুমোহন দেখুন।’ আমি দেখতাম, শুনতাম, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। কারণ, পিতামহের নির্দেশ অনুযায়ী সিনেমা দেখার অধিকার সে সময় আমার ছিল না।
আমাদের পাড়ায় থাকতেন কালুকাকা। ওঁর ভাইপো অশোক আমার সহপাঠী। অশোকের মুখে শুনতাম কালুকাকা রূপশ্রী সিনেমার প্রোজেকশন ইনচার্জ। অর্থাৎ তিনি ছবি ভালভাবে চালান বলে দর্শকরা ছবি দেখতে পায়। তার মানে কালুকাকা রোজ তিনটে করে শো দেখেন। সে সময় রবিবার ছাড়া রোজ তিনটে শো হত। নাইট শো দেখে মেয়েরা স্বচ্ছন্দে হেঁটে বাড়ি ফিরতেন। এটা বন্ধুদের মুখে শুনতাম। পিতামহ আমাকে মাত্র দু’টো ছবি দেখার অনুমতি দিয়েছিলেন। একটি বড়পিসিমার সঙ্গী হয়ে ‘আত্মদর্শন’ নামের ভক্তিমূলক ছবি, অন্যটি ‘পথের পাঁচালি’। গম্ভীর মুখে বলেছিলেন, ‘যা দেখে শিক্ষিত হওয়া যায় তা দেখা উচিত। নাও, দশ আনা দিয়ে টিকিট কেটো।’
তখনও বিভূতিভূষণ পড়িনি। হলে গিয়ে দেখলাম, একটা বাচ্চা ছেলে আর একটু বড় বালিকার সঙ্গে দৌড়চ্ছে। পোস্টারে ওই ছবি দেখে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমি পরে হলে গিয়ে ‘দস্যুমোহন’ দেখেছিলাম। বাড়ি ফিরে পিতামহকে গল্প বলতে হবে বলে এক পড়ুয়া মাসিমার কাছে ‘পথের পাঁচালি’-র গল্প শুনে উগরে দিয়েছিলাম। শুনে পিতামহ বলেছিলেন, ‘কী যে দেখলে তা তুমিই জান। ভস্মে ঘি ঢাললাম।’
পরে বহুবার ‘পথের পাঁচালি’ দেখবার পরেও মনে হয় সেদিন ওই বয়সে দস্যুমোহন দেখে যে আনন্দ পেয়েছিলাম তার কোনও তুলনা হয় না। ‘পথের পাঁচালি’ বোঝার বয়স তখন হয়নি। কিছুদিন পরে কালুকাকার সঙ্গে আমরা ভাব করে ফেললাম। নিশীথ বুদ্ধিটা দিয়েছিল। ম্যাটিনি শো ভাঙে সাড়ে পাঁচটার পরে। স্কুল ছুটির পরে বাড়ি ফিরে খেলার মাঠে না গিয়ে যদি আমরা সিনেমার হল-এ চলে যাই তা হলে হাফটাইম থেকে ছবিটা দেখতে পারি। আমরা চলে গেলাম কালুকাকার কাছে। তিনি হেসে বললেন, ‘ছবি দেখবে? অর্ধেক দেখে কি ভাল লাগবে? যাও, বলে দিচ্ছি খালি সিটে বসিয়ে দিতে। একদিনের অনুমতিটাই সাপ্তাহিক হয়ে গেল। আমরা হাফটাইমের পর থেকে ছবি দেখি। সেইসব ছবি, যেগুলোতে দর্শক তেমন হয় না।
একদিন নিশীথ এসে বলল, রূপশ্রীতে ফাটাফাটি ছবি এসেছে। ‘পথে হল দেরি’। উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন। যাবি?
হাফটাইমে গিয়ে ফিরে এলাম। কোনও সিট খালি নেই। নিশীথ পরামর্শ দিল, ‘চল, নাইট শো-তে দেখব। পাঁচ আনার টিকিট কেটে।’ চমকে উঠেছিলাম। পিতামহের নির্দেশে রাত ন’টাতেই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়তে হত। ভোর পাঁচটায় হাঁটতে যাওয়া। বাড়ি ঘুমিয়ে পড়ত রাত সাড়ে ন’টায়। তখন যাব কী করে? নিশীথ পরামর্শ দিয়েছিল, ‘তুই পাশবালিশের উপর লেপ চাপা দিয়ে দরজায় কাগজ গুঁজে বাড়ির পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে আসবি। সিনেমা দেখে আবার নিঃশব্দে ফিরে গিয়ে লেপের নিচে ঢুকে যাবি।
তখন শীতকাল। জলপাইগুড়িতে প্রবল ঠান্ডা। সেইভাবে রূপশ্রীতে এলাম। নিশীথ দাঁড়িয়েছিল। টিকিট কেটে সামনের সারিতে বসলাম। সেই প্রথম সুচিত্রা-উত্তমকে দেখলাম। যতটা না উত্তমকে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি সুচিত্রাকে দু’চোখ দিয়ে গিললাম। ‘এ শুধু গানের দিন’ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল আমি অন্য পৃথিবীতে চলে গিয়েছি। সিনেমা ভাঙল প্রায় পৌনে বারোটায়। নিশীথ উল্টোদিকে, নির্জন কুয়াশামাখা রাস্তায় একা হাঁটছিলাম। মাথার উপর নিভুনিভু জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে চাঁদ। হঠাৎ মনে হল আমার দু’পাশে দুই নারী হাঁটছেন, একজন সুচিত্রা সেন অন্যজন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
সাধু সন্ন্যাসীদের সঙ্গ করার বাসনা আমার কখনওই ছিল না। এখনও নেই। কিন্তু এক বন্ধুর সঙ্গে বেলুড়ে গিয়েছিলাম মন্দিরটাকে দেখব বলে। বন্ধু বললেন, ‘চলুন, ভরত মহারাজকে প্রণাম করে আসি।’
ওঁর নাম আমি খবরের কাগজের সৌজন্যে জানি। ইন্দিরা এবং তাঁর মা ওঁর শিষ্যা ছিলেন। খুব পণ্ডিত মানুষ। বন্ধুর সঙ্গে গিয়ে দেখলাম উনি আশ্রমের লনে বসে আছেন। সামনে দু’টো চেয়ার। বন্ধু প্রণাম করে পরিচয় দিল, ‘এর নাম সমরেশ’, লিখছে।’ ভরত মহারাজ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘উত্তরাধিকারের পরে কালবেলা। বেশ লিখছ। বসো।’
আমি অবাক। আমার মতো সদ্য লিখিয়ের খবর ইনি রাখেন? সেদিন আমরা কেউ ধর্মের কথা বলিনি। রাজনৈতিক উপন্যাস নিয়ে উনি কথা বললেন। বিশেষ করে সতীনাথ ভাদুড়ির ‘জাগরী’-র কথা। তারপর পায়েস খাইয়ে বললেন, ‘আবার কবে আসছ?’ বললাম, ‘আসব’।
মাঝে-মাঝেই যেতাম। নানা গল্প হত। নকশাল আন্দোলন নিয়ে খোঁজখবর করতেন। ওইরকম একদিনে ইন্দিরা গান্ধীর বেলুড়ে আসার কথা ছিল। তিনি কলকাতায় সভা করে আসছেন। পুলিশ অফিসাররা বারংবার এসে তাঁর গতিবিধির কথা জানাচ্ছিল। হঠাৎ ভরত মহারাজ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘যখন আসার তখন সে আসবে। বারংবার আমাকে বিরক্ত করছেন কেন?’ পুলিশ অফিসার আমাকে তখন ইশারা করছেন উঠে যেতে। ঝামেলা না বাড়িয়ে আমি চলে এসেছিলাম।
সেদিন বিকেলে বেলুড়ে গেলাম। মন্দিরে ঢুকতেই বৃষ্টির সঙ্গে সন্ধে নামল। প্রায় আধভেজা হয়ে ভিতরে গিয়ে দেখলাম ভরত মহারাজ বাইরে নেই। তাঁর সহকারী জানালেন, ‘মহারাজ ভিতরে আছেন। একজনের সঙ্গে কথা বলছেন।’
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ও অন্ধকার কিছুক্ষণ দেখার পর বললাম, ‘ওঁকে আর বিরক্ত করব না। বলবেন আমি এসেছিলাম।’
সহকারী আমাদের দাঁড়াতে বলে ভিতরে গেলেন। ফিরে এসে বললেন, ‘আপনাকে ডাকছেন।’
গিয়ে দেখলাম মহারাজ তাঁর আসনে বসে আছেন। উল্টোদিকে অনেকগুলো চেয়ার। কিন্তু সেই চেয়ারের প্রথম সারিতে বসে একজন মহিলা ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। মহারাজ ইশারায় আমাকে পিছনে বসতে বললেন। বসলাম। অস্বস্তিকর পরিবেশ। মহিলা অনেক চেষ্টা করছেন নিজেকে স্থির করতে। মহারাজ বললেন, ‘নিজেকে শক্ত করো। আমি জানি তুমি তা পারবে।’
এবার মহিলা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আমি আসি।’
‘এসো’।
মহিলার কণ্ঠস্বর শোনামাত্র আমি যেন বিদ্যুতের স্পর্শ পেলাম। এই গলার স্বর আমার খুব পরিচিত। মহিলা তখন ঘোমটায় মুখ ঢেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন আমার পাশ দিয়ে। মহারাজ বললেন, ‘এসো, সামনে এসে বসো।’
বসলাম, মহারাজ বললেন, ‘কাঁদতে পারলে বুকের বোঝা কিছুটা হালকা হয়ে যায়। কিন্তু পাথর ভাঙনের নুড়ি থেকে যায়। ওঁকে চিনতে পারলে?
মাথা নেড়ে নিঃশব্দে বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ’।
সেই মানুষটি এতদিন পরে চলে গেলেন। তাঁর বুকের বোঝা কতটা হালকা হয়েছিল তা তিনিই জানেন, তবে তাঁর পথে একটু দেরি হলে কী ক্ষতি হত!
৬৭
আমার জীবনে নদীর একটা অন্যরকম ভূমিকা ছিল। ছিল বলছি কারণ, এখনকার প্রজন্ম নদীর হদিশ রাখে না। যারা শহরে জন্মেছে তারা নদীকে ঘিরে সেই আত্মিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না যা আমাদের অনেকেই পেরেছিলেন। পারে না কারণ তারা নদীর সঙ্গে সহবাস করার সুযোগ পায় না।
আবার সব নদী যে একই ভূমিকা নিতে পারে তা নয়। এই যে আমি পঞ্চাশ বছর ধরে কলকাতায় আছি তবু গঙ্গাকে দেখে বিন্দুমাত্র আপ্লুত হইনি। বরং কোনও কারণে গঙ্গার পাশে গেলে মনে হয়, নালা যার ভিতর দিয়ে শহরের মানুষ আবর্জনা সমুদ্রে পাঠায়, গলিত শব, পচে যাওয়া আবর্জনা ভেসে চলেছে, জলের টান নেই বললেই চলে। যেন যেতে হয় তাই যাওয়া। সেই জলের কিছু মানুষ গঙ্গাস্নানের পুণ্য করে নিচ্ছে, সেই জলেই পিতৃপুরুষের তর্পণ করা হচ্ছে। কলকারখানা সেই জলে উজাড় করে দিচ্ছে যাবতীয় বর্জ্যপদার্থ। অ্যাসিড ভাসছে জলে। এরকম নদীকে কখনওই ভালবাসা যায় না।
জলপাইগুড়িতে আমাদের বাড়ি ছিল হাকিমপাড়ায়। উঠোনে দাঁড়ালেই তিস্তা দেখতে পেতাম। যখন বাঁধ তৈরি হল তখন ছাদে গিয়ে দেখতে হত। তিস্তার চরে কাশবন, শীতকালে পক্ষীরাজ ট্যাক্সি, নৌকায় পারাপার সত্ত্বেও তার প্রতি আমার টান তৈরি হয়নি। তার কারণ, ওই নদীর চরিত্র। শীত-গ্রীষ্মে বালি উড়ছে বাতাসে, বার্নিশের দিকে এক চিলতে জলের স্রোত, নদীর হুমকিকে উপেক্ষা করে শহরের দিকের বালির চরে ঘর বাঁধছে গৃহহীনরা। আবার বর্ষায় ফুলে ফেঁপে ঢেউ-এর ছোবল মারলে আমরা ভয় পেতাম, হয়তো ভাসিয়ে দেবে শহর। একতলার ঘরগুলোতে পলি পড়বে, বন্দি হয়ে থাকতে হবে দু-দিন। আটষট্টির বন্যায় শহরটার মাজা ভেঙে দিয়েছিল তিস্তা। বালকের মৃতদেহ ভেসে গিয়েছিল আমাদের বাড়ির ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে। তার কয়েক মাস পরে সেই নদীর বুকে জল খুঁজতে হাঁটতে হয়েছিল অনেকটা। এমন নদীকে একসময় ভয় পেতাম, ভালবাসতাম না। এখন তো ভয়টাও চলে গেছে। তিস্তা এখন নির্জীব হেলে সাপের চেয়েও অধম। অথচ সেই নদীর জল চাইছে বাংলাদেশ, যা পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তির কারণে দিতে পারছে না ভারত সরকার। আচ্ছা, মুখ্যমন্ত্রী যদি আপত্তি না জানাতেন তা হলে ভারত সরকার কি দিতে পারতেন? আপত্তি আছে তাই লড়ছ, না থাকলে কী করতে?
হাকিমপাড়ার এপাশে ছিল করলা নদী। তার উপর খুলনাপুল। অল্পবয়সে করলাকে বেশ গম্ভীর বলে মনে হলেও নদী হিসেবে ভাবতে পারতাম না। বরং খাল, বড় খাল বলেই মনে হত। স্রোত নেই বললেই চলে। শহরের যাবতীয় ময়লা বুকে নিতে তিস্তার দিকে যেতে হয় তাই যাওয়া। তারপর তিস্তায় যাওয়ার মুখ বন্ধ হল। জল কমল করলার। পাশে দাঁড়ালে পচা গন্ধ পেতাম। ভাবতে অবাক লাগে, কংগ্রেস বা বামফ্রন্ট সরকার করলাকে মানুষের স্বার্থে ব্যবহার করল না! তা হলে করলার বুকে হাউসবোট ভাসতে পারত, পর্যটকদের টেনে আনত।
জলঢাকা নদীর চরিত্র খানিকটা তিস্তার মতোই। তবু কয়েকটি শাখানদীর সৌজন্যে শীত-গ্রীষ্মে তার বুক শুকিয়ে যেত না পুরোপুরি। বালির হাড় বেরিয়ে গেলেও জল থাকত খানিকটা। যাওয়া আসার পথে নদীটাকে দেখতাম কিন্তু আত্মীয়তা তৈরি হয়নি। বরং মাঝে মাঝে নদীর পাশে বাঁধের উপরে একটা ছোট বাংলো দেখতে পেয়ে ভাবতাম, ওখানে গিয়ে ক’দিন থাকলে জলঢাকাকে অন্য চেহারায় হয়তো দেখতে পাব। একই অভিজ্ঞতা তোর্সার ক্ষেত্রে। ওপাশে জলদাপাড়া এপাশে সুভাষিণী চা-বাগান, বিশাল নদী যার বুকে শীত-গ্রীষ্মে অজস্র নুড়িপাথর, জলের ধারা দু’পাশে, স্রোত তীব্র। তার বিশাল চেহারা, বর্ষার রুদ্ররূপ ভালবাসা জন্মাতে বাধা তৈরি করে। দেখতাম, মদেশিয়া বালক বালিকারা গাড়ির টায়ারে চেপে ভেসে যাচ্ছে ওপারে। তারপর আরও ওপারে চলে গিয়ে মাছ ধরতে ধরতে টায়ারে ভেসে চলে আসছে এপারে। এই ক’দিন আগেও ওদের ধরা ছিলা মাছ পেয়ে গেলাম একশো টাকায়। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী করবি টাকা নিয়ে?
মেয়েটি বলল, ‘মা-কে দেব।’
তিস্তা বা তোর্সার বিখ্যাত বোরলি মাছের কথা কলকাতায় বসে ভাবা তো প্রায় স্বপ্ন দেখার শামিল। শুনেছি, শিলিগুড়ির একটি ভাতের হোটেলে আগে জানালে এখনও বোরলি মাছ মেনুতে পাওয়া যায়। বোরলির স্বাদ মনে রেখেও তিস্তা-তোর্সা আমার আত্মীয় হয়ে ওঠেনি কখনও।
যে নদীর সঙ্গে শৈশব জড়িয়ে থাকে, যে নদীকে একসময় প্রায় বন্ধুর মতো মনে হয়, তার জন্যে যে ভালবাসা তা আজন্ম থেকে যায়। কিন্তু এখন মনে হয়, চা-বাগানের কোয়ার্টার্সের পিছনে কুলকুল শব্দে বয়ে যেত যে জলের ধারা তাকে কি নদী বলা যায়! বড়জোর তিরিশ ফুট চওড়া ওই জলের ধারা মূল আংরাভাসা নদী থেকে বেরিয়ে তীব্র স্রোত নিয়ে বয়ে যেত চা-বাগানের ফ্যাক্টরির দিকে। আমি যখন প্রায় শিশু, তখন ঝাড়িকাকুর পিছন পিছন হাজির হতাম আংরাভাসার গায়ে। শাখাটিকেও ওই নামে ডাকা হত। ঝাড়িকাকু দীর্ঘকাল কাজ করেছেন আমাদের বাড়িতে। তিনি বাসন মাজতে যেতেন আর আমি অপলক জলের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। একদম পরিষ্কার জলের ঢেউ উঠছে আর নামছে। একটু বড় হয়ে কান পেতেছিলাম জলে। স্পষ্ট শুনেছিলাম নিচে নুড়ির সঙ্গে নুড়ির ঠোকাঠুকির শব্দ। বড়রা যখন হেঁটে নদী পার হত তখন বড়জোর হাঁটুর উপর অবধি জল উঠত। মদেশিয়া মেয়েরা কোমর থেকে যে কালো কাপড় শরীরে জড়াত তার নাম ছিল আংরা। সেই আংরার প্রান্ত জল ছুঁয়ে যেত বলেই সম্ভবত নাম হয়েছিল আংরাভাসা। ঝাড়িকাকু বলত, ‘এখন নদীকে এইরকম দেখছিস, রাতের বেলায় এলে, বিশেষ করে চাঁদনি রাতে, নদীর গান শুনতে পাবি। নদী গান গায় আর ওই কুল গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে ডাক্তারবাবুর ছেলে সেই গান শোনে।’ অনেক চেষ্টা করেও তখন ঝাড়িকাকুর সঙ্গে রাতের বেলায় যেতে পারিনি নদীর কাছে। মা-বড়পিসিমা চোখ বড় করেছিলেন। ওই যে গাছের ডালে যে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে সে আত্মহত্যা করেছে কয়েকবছর আগে। আমায় দেখলে সে নিশ্চয়ই ঘাড় মটকে দেবে। কিন্তু এইসব শুনে মন খারাপ হয়েই থাকত। ভাবতাম, ছেলেটার কী মজা, নদীর গান শুনতে পায়।
এক গরমের ছুটিতে চা-বাগানের বাড়িতে ঢুকেই ছুটে গেলাম নদীর কাছে। তখন বিকেল। ছায়া নেমেছে নদীর জলে। শান্ত জলের ধারা যেন আমাকে দেখেই খলবলিয়ে উঠল। আমার মনে হল, ঢেউগুলো খুশিতে বলে উঠল, ‘এসেছিস! এসেছিস!’ মন ভরে গেল। আমি সন্তর্পণে কাপড়কাচার সিমেন্টের স্ল্যাবটা তুলতেই লালচে চিংড়িগুলোকে দেখতে পেলাম। খপ করে মুঠোয় তুলতেই সেটা এমনভাবে তাকাল যে মনে হল, বলছে, ‘এতদিন কোথায় ছিলে?’
আজ সেই শাখানদী নেই। ফ্যাক্টরির প্রয়োজন মিটে যেতেই মূল নদীর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পড়ে রয়েছে নদীর কবর। কোনওদিন যা করিনি তাই করলাম। নদীর উৎস খুঁজতে গেলাম তেলিপাড়া বাগানে যেখানে জলের ধারা মাটি থেকে বেরিয়ে এসে নদী হয়ে যাচ্ছে। কত প্রিয় মানুষ চলে গেলেও তাদের স্মৃতি নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি। আংরাভাসার ওই শাখানদী আমার মনে সেভাবেই বেঁচে আছে। ভালবাসার মৃত্যু হয় না।
৬৮
যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন কলকাতার পরিচিতরা আমার কাছে দার্জিলিং-এর ব্যাপারে খোঁজখবর নিতেন। দার্জিলিং-এ ভাল বাংলা খাবারের হোটেল আছে কি না, অল্প পয়সায় কোথায় থাকা যায় ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে, সেই সময়েও বাঙালি কলকাতা থেকে শীতের ছুটির সময়েও পশ্চিমে বেড়াতে যেতেন। সেই পশ্চিম হল দেওঘর, জসিডি, মধুপুর, গিরিডি এবং শিমুলতলা। তাছাড়া পুরীতে যাওয়ার চল তো ছিলই। ওসব জায়গায় একটু বিত্তবান কলকাতার বাঙালিরা বাড়ি তৈরি করে রাখতেন। গরমের সময় ভুলেও ওদিকে পা বাড়াতেন না। লোক রাখতেন বাড়ি পাহারা দিতে। শীত পড়লে বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে হাঁড়ি, কড়াই, খুন্তি প্যাক করে ট্রেনে চেপে হাজির হয়ে যেতেন। জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘একটু পশ্চিমে যাচ্ছি ভাই।’
সেই একষট্টি সালে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আমারও ওই অঞ্চলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। শিমুলতলায় থাকার কোনও হোটেল ছিল না। জসিডির পরে ওই নির্জন স্টেশনে নেমে মনে হয়েছিল বানারহাটে নেমেছি। দূরে জঙ্গল, স্টেশনের বাইরে কয়েকটা দোকান এবং ট্রেন দেখতে আসা বাঙালি পর্যটকদের ভিড়। ‘ও মশাই, কলকাতার খবর কী?
আলস্য এবং শীত উপভোগ, টাটকা সবজি, মাছ, মাংস আর ভাল মিষ্টি খেয়ে দিব্যি আনন্দে থাকতেন পর্যটকরা। আলো ফুটলে বাজারে যাওয়ার সময় একটু হেঁটে নেওয়া, বাজারের দোকানে বা খেতে খেতে গপ্পো করা। দুপুরের ভাত ঘুমের পর বিকেলে হাঁটতে যাওয়া, এই ছিল রুটিন। শীত এড়াতে মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ, আলস্টার, মাফলার, কেউ কেউ শাল চাপাতেন। বিমল করের অনেক গল্পের চরিত্ররা ওখানে জীবন্ত হয়ে উঠতেন। দেওঘরে গেলে অতিরিক্ত আকর্ষণ ছিল শিবের মন্দির আর ত্রিকূট পাহাড়। মধুপুর ছিল বর্ধিষ্ণু বাঙালিদের বাগান ঘেরা বাড়ির প্রদর্শনী। খুব গোলাপ ফুটত সে সময়। ট্রেনে চাপলে অল্প সময়ের মধ্যে গিরিডিতে নেমে জলপ্রপাত দেখে আসা যেত। কিন্তু দেখাদেখির মধ্যে বাঙালি ছিল না। এক জায়গায় থিতু হয়ে খাওয়া-দাওয়াতেই তাঁরা খুশি থাকতেন। শিমুলতলায় দুধ তখন আট আনায় এক সের পাওয়া যেত। বয়লার চিকেন কী বস্তু তা কেউ জানতেন না।
কিন্তু বয়স্কদের এই পশ্চিমে যাওয়াকে মেনে নিতে পারছিলেন না তরুণ প্রজন্ম। ‘বোরিং’ শব্দটা তাঁদের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল। কিছু দেখার নেই, যাওয়ার জায়গা নেই। জানাই গেল, ওখানকার জলে লোহাও হজম করা যায়। কিন্তু আমরা তো লোহা খাচ্ছি না যে হজম করতে ওই জল দরকার হবে। পুরীতে গেলে তবু সমুদ্রস্নানের সঙ্গে কোনারকে গিয়ে ওই মূর্তিগুলোকে চোখ ভরে দেখে আসা যায়। কিন্তু কবার?
দিঘা তৈরি হতেই বাঙালি খুশি হল। বকখালি কাছেই কিন্তু ওই সমুদ্রের কোনও আকর্ষণ নেই। ঢেউ কম, কাদাজলে ভাসতে হয়। বাঙালি ছুটল দিঘায়। একটু যাঁরা রবীন্দ্রভক্ত, তাঁরা শান্তিনিকেতন। পৌষমেলায় বা দোলের সময়। ‘ও হঁটি, ও কানু, এদিকে আয় বাবা, হারিয়ে যাবে’, রাস্তায় দাঁড়াতেই সংসার সামলানো মা-দিদিমাদের গলা কানে আসবে। তখন দিল্লি, বোম্বে বা জয়পুর অনেক দূরে। তেষট্টি সালে আমাদের এলাকায় মাত্র একটি পরিবার থেকে একজন বিদেশে গিয়েছিলেন। বিদেশ মানে তখন বিলেত ছিল। এই সময় এক বন্ধুর বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওহে, তোমার বাড়ি তো জলপাইগুড়িতে, দার্জিলিং-এ সস্তায় কোন হোটেলে বাংলা খাবার পাওয়া যায়, বল দেখি?—আমি হতভম্ব। ওঁর কাছে জলপাইগুড়ি আর দার্জিলিং যেন এপাড়া-ওপাড়া। কী করে বোঝাই স্কুলজীবনে দার্জিলিং-এ যাইনি। গিয়েছি একবারই, ওই প্রশ্ন শোনার কয়েকমাস আগে। বলে দিলাম, ‘কালীবাবুর হোটেল। স্টেশনের গায়েই।’
বাড়ির সবাই আর পুরনো জায়গায় যেতে চাইছে না। ভাবছি এই গরমে দার্জিলিং-এ যাব। তা এখন শীত কেমন? ভদ্রলোক প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে গেলেন। আস্তে আস্তে পরিবর্তন শুরু হল। তখন কলকাতা থেকে সকাল ন’টায় নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে চেপে রামপুরহাটে ভাত খেতে বিকেলে গঙ্গার পাড়ে নামতে হত। জলের কারণে ঘাট বদলাত। কখনও ফারাক্কা-খেজুরিয়া, কখনও মনিহারি-সকরিকলি। ট্রেন থেকে নেমে বালির উপর দিয়ে ছুট-ছুট। স্টিমারে জায়গা দখল করে চায়ের সন্ধানে যাওয়া। গঙ্গা পেরিয়ে ওপারে স্টিমার পৌঁছলেই আবার বালির উপর দৌড়ে ট্রেনে ওঠা, যা শিলিগুড়িতে পৌঁছে দিত পরের সকালে। কিছু মানুষ সেখান থেকে টয়ট্রেনে চেপে যেতেন দার্জিলিং। তখনও কালিম্পং উপেক্ষিত। খুব কম মানুষ রবীন্দ্রনাথের পছন্দসই জায়গা বলেই যেতেন। কিন্তু দার্জিলিং ছাড়া যে একটা আস্ত বেড়ানোর জায়গা পড়ে আছে পশ্চিমবাংলার উত্তরে, সে খবর রাখতেন না ভ্রমণবিলাসীরা। দার্জিলিং-এ হাঁড়ি, কড়াই নিয়ে গিয়ে রান্না করে থাকা সম্ভব নয় বলেই ক’দিন ঘোড়ায় চড়ে আর টাইগার হিল দেখেই ফিরে যেতেন। গিয়ে বলতেন, ‘এই গরমে দার্জিলিং-এ ছিলুম।’ আর একটু অর্থবানরা সাহেবদের নকল করে দার্জিলিং-এর দামি রেস্টুরেন্ট, হোটেলে ঘুরতেন, ম্যালের এক প্রান্তে বসে পাইপ টানতেন।
আমরা যখন কলেজে তখন চাপড়ামারি, মেটেলি, মালবাজারের পাশে নিদাম চা-বাগান, বানারহাট ছাড়িয়ে সামচি পাহাড়, জল্পেশের শিব মন্দির, হলং-এর জঙ্গল, বক্সার দুর্গ ঘুরে কোনও ট্যুরিস্ট পরিবারকে দেখিনি। দু-তিনজন বন্ধু একসঙ্গে ওসব অঞ্চলে গিয়েছেন। তখন অবশ্য বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ-সুবিধেও ছিল না। ফরেস্ট বাংলোয় থাকতে গেলে দেখা যেত, আগাম অনুমতির পরে মাত্র দু’টো ঘর রয়েছে। তাছাড়া পিডব্লিউডি-র বাংলো ছিল। তারও ঘরের সংখ্যা দু’টোর বেশি নয়। মালবাজারে ট্যুরিস্ট লজ তৈরি হচ্ছে। গরুমারায় একই অবস্থা। ময়নাগুড়ি থেকে চালসা পর্যন্ত যে সুন্দর রাস্তা তা একেবারেই শুনশান। গরুমারার ফরেস্ট বাংলো ভিআইপিরাই দখল করে রাখতেন। শিলিগুড়িতে হোটেল ছিল, জলপাইগুড়িতে একমাত্র মাথা গোঁজার জায়গা রুবি বোর্ডিং। খুব করুণ অবস্থা তার। তিস্তা পার হয়ে ওপারে গেলে কোনও হোটেল নেই। রিসর্টের কথা কারও ভাবনায় ছিল না। তখন সেলসম্যানরাও জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি অথবা কোচবিহার থেকে ডুয়ার্সে গিয়ে কাজ শেষ করে সন্ধের আগে ফিরে আসতেন। ডুয়ার্স যাওয়ার চল হল বড়জোর বছর কুড়ি আগে থেকে।
তারপর যা হল তা ভাবতে অবাক হতে হয়। বন্যা স্রোতের মতো মানুষ বেড়াতে যাচ্ছে ডুয়ার্সে। যেসব জায়গার নাম ওখানে জন্মে-বড় হয়েও আমি জানতাম না, সেইসব জায়গায় ওঁরা যাচ্ছেন। রাতারাতি হোটেল রিসর্ট তৈরি হয়ে গিয়েছে সর্বত্র। গরুমারা ফরেস্টের বাইরের রাস্তায় তো হোটেল-রিসর্টের মেলা বসে গেছে। সেদিন এক বন্ধু বললেন, ‘বীরপাড়া বলে একটা জায়গা আছে, বুঝলেন, সেখানে একটা ছোট বাড়ি ভাড়া নিয়েছি মাস খানেকের জন্যে। রান্না করে খাওয়া হবে সবাই মিলে। বীরপাড়াকে কেন্দ্র করে ঘুরব।’ শিমুলতলা মধুপুরের বিকল্প যদি ডুয়ার্স হয়, তা হলে মন্দ কি! মানুষের উপকার হবে। জায়গাটা নির্জন থাকবে না, এই যা।
৬৯
প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। তখনও জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি-কোচবিহারের রাস্তায় বড়দের দেখলে অল্পবয়সিরা সিগারেট লুকিয়ে ফেলত। সেই ‘বড়’ লোকটি পরিবারের কেউ নন, পাড়ার সুবাদে দাদা-কাকা মেসোমশাই হতে পারেন। কিন্তু তখনও তাঁর মুখের সামনে সিগারেট খাওয়ার কথা ভাবা যেত না। নিজের পরিবারের বাইরে পাড়ার মানুষদের নিয়ে আরও বড় একটি পরিবার বহুকাল ধরেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কলেজে পড়ছি যখন তখন ভরবিকেলে পাড়ার এক মাসিমা হাত নেড়ে কাছে ডেকে যদি বলতেন, ‘কাঁঠালতলা থেকে একটু সন্দেশ এনে দিবি বাবা, হুট করে অতিথি এসে গেছে অথচ বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে আসার মতো কেউ নেই।’ তাঁর দেওয়া টাকা নিয়ে সাইকেল চালিয়ে ছুটে যেতাম মিষ্টি আনতে। একটুও খারাপ লাগত না। ছুটি শেষ হয়ে গেলে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার আগের দিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে বলে আসতে হত পুজোর ছুটিতে আবার আসব। আর সেই বিদায় নেওয়ার সময় জুটত নারকোলের নাড়ু অথবা মোয়া। তখন টেলিফোনের আকাল ছিল। চিঠি এল অমুক তারিখে অমুক মামাকে নিয়ে মামি আসছেন কলকাতায়। পেটে টিউমার হয়েছে, অপারেশন করতে হবে। সেই সঙ্গে অনুরোধ, ‘তোর ভরসায় যাচ্ছি ।’
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র, হস্টেলে থাকি। বাবার পাঠানো টাকায় চলে। কোনও ক্ষমতা নেই। সেই আমার উপর ভরসা যাঁর সেই মামা থাকতেন জেলা স্কুলের পাশে, খুব গম্ভীর প্রকৃতির লোক। দেখা হলেই বলতেন, ‘সময় নষ্ট করো না, সময় খুব দামি।’ না রক্তের সম্পর্ক, না আত্মীয়তার বন্ধন, কী করি বুঝতে সময় লাগল। ক্লাসের বন্ধুদের বলতেই তারা হইহই করে এগিয়ে এল। মেডিকেল কলেজে কারও দাদা জুনিয়ার ডাক্তার, কারও কাকা সার্জেন। থাকার জায়গার সমস্যা নেই, মির্জাপুর স্ট্রিটের আইডিয়াল হোম হস্টেল আছে। নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে শিয়ালদায় এলেন মামা-মামি এবং তাদের মেয়ে।
আমরা কয়েকজন সেই যে তাঁদের সঙ্গ নিয়েছিলাম, সুস্থ করে ট্রেনে তুলে না দিয়ে তা ছাড়িনি। কলকাতার বন্ধুরা জানত তিনি আমার নিজের মামা। ভুলটা ভাঙাইনি। কারণ, একজন অর্ধপরিচিত পাড়ার মামার জন্যে কলকাতায় কেউ এত ব্যস্ত হয় না।
জানি, ‘নগর পুড়িলে দেবালয় এড়ায় না’, কলকাতার বাতাস ওখানেও পৌঁছে গেছে। পাড়া দূরের কথা, পাশের বাড়ির মানুষের সঙ্গে পরিচয় নেই অনেকের। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে জলপাইগুড়ির মানুষ বাড়ি তৈরি করে অথবা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত। তখন জলপাইগুড়িতে মাল্টিস্টোরিড বাড়ি তৈরি হয়নি, ফ্ল্যাট কিনে মানুষ সেখানে বসবাস করা আরম্ভ করেনি। দু-তিন ঘরের খাঁচায় বাস করার কথা তাঁরা ভাবতে পারতেন না। বাড়ির ভিতরে একটা উঠোন, বাইরে ছোট বাগান, ঘরের মধ্যে একটি ঠাকুরঘর না থাকলে মন উঠত না তাঁদের। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেখছি সব তছনছ হয়ে গেছে। এখনও যাঁরা ওইরকম বাড়িতে আছেন তাঁরা ভাগ্যবান। কিন্তু তাঁদের পরিবারের মহিলারা অত বড় বাড়ির দখল আর সামলাতে চান না। ছোট্ট ফ্ল্যাটেই তাঁরা স্বস্তিতে থাকতে চান। একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ার পরে আমরা অনেক কিছু হারালাম। বাবা-কাকার দ্বন্দ্বের পরিণতি যেহেতু সম্পত্তি ভাগাভাগি, বিক্রি করে আলাদা হওয়া, তাই কাকার প্রতি ভাইপোর, জ্যাঠার প্রতি অন্য ভাইপোর শ্রদ্ধা কমে যেতে বাধ্য। উল্টে তাঁদের উপেক্ষা করার সাহস ওরা পেয়ে গেল। নিজের কাকা-জ্যাঠাদের যেখানে উপেক্ষা করা যাচ্ছে সেখানে পাড়ার কাকা-জ্যাঠাদের সম্মান দেখানোর দায় থাকতে পারে না। এখন জলপাইগুড়ির রাস্তায় বয়স্ক মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে অনেক তরুণকে একটুও সংকুচিত হতে দেখি না।
আমার ছোট পিসিমার বিয়ে হয়েছিল কৃষ্ণনগরের পাত্রের সঙ্গে। বরযাত্রীরা যখন এল তখন পিতামহ আমার পিতা-কে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের দেখাশোনার। বিয়ের রাত্রে তাদের অনেককেই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দেখা গেল। খাবারের অপচয় করলেন সেই কারণেই। পরদিন বর-কনে চলে যাওয়ার পর পিতামহ পিতাকে ডেকে কৈফিয়ত চেয়েছিলেন, ‘তোমাকে দায়িত্ব দেওয়া সত্ত্বেও তুমি ওদের মদ্যপান থেকে বিরত করনি কেন? পিতা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, তাঁর নিষেধ ওরা শোনেনি। আবার বরযাত্রী বলে তিনি বেশি কড়া হতেও পারেননি। পিতামহ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তা হলে তৎক্ষণাৎ আমাকে জানাওনি কেন? আমি ওই মদ্যপদের পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিতাম না। তুমি খুব অন্যায় করেছ, তাই এখন থেকে এই বাড়িতে তোমার জায়গা নেই। বউমা থাকবেন, তোমার ছেলেও থাকবে। শুধু তুমি আর এই বাড়িতে থাকবে না।’
আদেশ শুনে বড়পিসিমা কেঁদে উঠেছিলেন, মা পাথরের মতো বসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বড় পিসিমার আবেদন-অনুরোধে পিতামহ বলেছিলেন, ‘তোমাকে ক্ষমা করছি না, ঠিক আছে, থাকতে পার, তবে দ্বিতীয়বার এরকম হলে আমি কোনও কথা শুনব না।’
ছেলেবেলা থেকেই জলপাইগুড়ির মানুষের মদের প্রতি শুধু নিরাসক্তি ভাবই নয়, বিরূপ মনোভাব দেখেছি। মদ খায় বিত্তহীন শ্রমিকরা আর বিত্তবান মানুষেরা। রেসকোর্সের ওপাশে ইউরোপিয়ান ক্লাবে যারা মদ্যপান করতে যান তাঁদের গাড়ি আছে। আমাদের পাড়ায় মাত্র একটি বিত্তশালী পরিবারের কর্তা পান করতেন বলে শুনতাম কিন্তু এঁরা কখনওই মাতলামি করতেন না। তখন বাংলা-হিন্দি সিনেমায় যেমন প্রচুর মাতাল চরিত্র থাকত তেমনি পথেঘাটে অভাবী মাতাল দেখা যেত। তাদের দেখে আমরা হাসতাম কারণ, মজা পেতাম। তারা আমাদের সমাজের কেউ নয় ভেবে উপেক্ষা করতাম। কেষ্ট মুখার্জি মাতালের ভূমিকায় অভিনয় করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর অভিনয় দেখে লোকে মজা পেত কিন্তু কখনওই বাড়িতে ডেকে খাওয়ানোর কথা ভাবত না।
জলপাইগুড়িতে এলআইসি বিল্ডিং-এর নিচে একটি মদের দোকান ছিল। দিনের বেলায় সেখানে মাছি উড়ত। সন্ধের অন্ধকার নামলেই রিকশা থেকে নেমে টুক করে বোতল কিনে উধাও হয়ে যেত খদ্দের। এই খদ্দের কারা? খোঁজ নিয়ে জেনেছি, যার মফসসল থেকে জলপাইগুড়ির আদালতে মামলা করতে এসে হোটেলে রাত কাটাতে বাধ্য হন, তাঁদের কেউ কেউ একা থাকার স্বাধীনতার সুযোগে একটু রসিক হতে চান। কিন্তু এসব কর্ম খুব গোপনে করা হত। তখনও পিকনিকে গিয়ে নিষিদ্ধ বস্তুর স্বাদ নিতে মদ্যপান করার চল এখনকার মতো ব্যাপক হয়নি।
নব্বই সালের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। জলপাইগুড়িতে সিরিয়ালের শুটিং করতে কলকাতা থেকে যে দল গিয়েছিল তাদের মধ্যে একজন নামী অভিনেতা ছিলেন। যিনি নিয়মিত পরিমিত মদ্যপান করতেন। তাঁর সঙ্গে আড্ডা মারতে গিয়েছিলাম আমি, সঙ্গী শহরের আরও দু’জন, যার একজন অধ্যক্ষ, একজন সরকারি উকিল। তিনি পান করলেন, আমরা কথা বললাম। বোতলটি শেষ হয়ে গেলে আমরা যখন উঠছিলাম তখন সরকারি উকিল সেটি চেয়ে নিলেন। বোতলের গড়ন দেখে শখ হয়েছিল বাড়িতে রাখার। জানুয়ারি, রাত এগারোটা, প্রচণ্ড শীত। রাস্তায় রিকশা দূরের কথা, মানুষই নেই। হেঁটে কমদতলায় এসে যে যার বাড়ির পথ ধরব, এমন সময় পুলিশের উদয় হল। অন্ধকারে লোক দু’টো বোতল হাতে সরকারি উকিলকে দেখে মাতাল ভেবে টানাহ্যাঁচড়া শুরু করল। ভদ্রলোক যতই বলেন তিনি কোনওদিন মদ্যপান করেননি তত লোক দু’টো বলতে লাগল, ‘জলপাইগুড়ির রাস্তায় মদের বোতল নিয়ে ঘোরা? কী আস্পর্ধা!’ লাইটপোস্টের আলোয় এসে চিনতে পেরে একহাত জিভ বেরিয়েছিল লোক দু’টোর। এখন বোধহয় পুলিশ চোখ বন্ধ করে ডিউটি দেয়!