৫০
আচ্ছা ভাবুন তো, শিলিগুড়ি থেকে জলপাইগুড়ির যাওয়ার রাস্তাটা অথবা হাসিমারা থেকে মাদারিহাট যাওয়ার পথটা কেন বছরের পর বছর ভয়ঙ্কর গর্তে ভরা থাকবে? গত তেইশে এপ্রিল মাদারিহাট ছাড়ানোর পর গাড়িতে বসে মনে হয়েছিল হাড়গোড় ভেঙে যাবে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী হয়তো বলবেন, ‘ওই রাস্তার মেরামতির কাজ চলছে’ হয়তো। কিন্তু বাজি রেখে বলতে পারি, বর্ষার পরে চাপা দেওয়া গর্তগুলো আবার বেরিয়ে পড়বে যাতে আবার খরচ করার সুযোগ পাওয়া যায়! বর্ধমান থেকে কলকাতার রাস্তা কখনওই ওরকম হবে না। কারণ, এখনও চিঠিতে ঠিকানা লেখা হয়, অমুক চন্দ্র অমুক, বাবুপাড়া, শিলিগুড়ি, নর্থ বেঙ্গল।
আমরা যে কবে পশ্চিমবাংলার সক্রিয় নাগরিক হব!
আচ্ছা বলুন তো, জলপাইগুড়ি আর শিলিগুড়ির মানুষের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে ঝগড়া বাধানোর চেষ্টা কে প্রথম করেছিল? কেন করেছিল? জলপাইগুড়িতে কোনও ভাল উদ্যোগ সরকার নিলে শিলিগুড়ির লোক কেন আন্দোলনে নামবে? আবার শিলিগুড়িতে তেমন কিছু হলে জলপাইগুড়ির মানুষের গাল কেন ফুলবে?
আমাদের বাল্যকালে এরকম কথা কখনও শুনিনি। মনে আছে তখন তিস্তা ব্রিজ হয়নি, জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন তো দূর অস্ত। জলপাইগুড়ি স্টেশনটির কোনও গর্ব ছিল না। কয়েকটা লোকাল ট্রেন চলত শিলিগুড়ি থেকে হলদিবাড়ি পর্যন্ত। বিকেলে একটা ট্রেন আসত হলদিবাড়ি থেকে, তাতে কয়েকটা কামরা থাকত যা প্রথমে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস পরে দার্জিলিং মেলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হত কলকাতায় যাত্রীদের নামাতে। শিলিগুড়িতে দু’টো স্টেশন ছিল। একটা এখনও আছে বাস টার্মিনাসের পিছনে, আরেকটা ছিল শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন। স্মৃতি বলছে, ওই টাউন স্টেশনটির রমরমা ছিল জলপাইগুড়ি স্টেশনের থেকে অনেক বেশি। আবছা মনে পড়ছে, বাবা-মায়ের সঙ্গে শিলিগুড়ি স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে পূর্ব পাকিস্তান দিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম স্বাধীনতার পরপর। কিন্তু শিলিগুড়ির গুরুত্ব ক্রমশ বেড়ে গেল। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে যাওয়ার প্রধান দরজা শিলিগুড়ি। কলকাতা, বিহার, নেপাল থেকে ওখানেই মানুষ প্রথমে পৌঁছয়। তাই শিলিগুড়িতে একটি আধুনিক এবং বিশাল স্টেশন তৈরির প্রয়োজন হয়ে পড়ল। স্টেশন তো এয়ারপোর্টের মতো শহর থেকে বহু মাইল দূরে তৈরি হতে পারে না। কিন্তু শিলিগুড়ি শহরের গায়ে অত বড় জমি কোথায়? শিলিগুড়ি শহর দার্জিলিং জেলার অন্তর্ভুক্ত। তার গায়ে শ্বাস ফেলছে জলপাইগুড়ির সীমান্ত। দেখা গেল জমি পাওয়া যেতে পারে জলপাইগুড়ি জেলার সীমার মধ্যে। সেখানে জমি পেলে যে স্টেশন তৈরি হবে তার নাম যদি শিলিগুড়ি রাখা হয়, তা মেনে নেবে না জলপাইগুড়ির মানুষ। তখন আমরা বেশ ছোট। শুনেছি, এই নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল। জলপাইগুড়ির দু’জন প্রখ্যাত ব্যক্তি সত্যেন্দ্রপ্রসাদ রায় এবং বীরেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ জেলাকে খুব ভালবাসতেন। সত্যি-মিথ্যে জানি না, বীরেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ উদ্যোগী হয়ে সমস্যা মিটিয়েছিলেন, শিলিগুড়ির গায়ের নতুন স্টেশনটির নাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন চালু করে। তারপরে শিলিগুড়ি শহর বেড়েছে অনেক। জেলার সীমা উপেক্ষা করে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের চারপাশে বাস করছেন শিলিগুড়ির মানুষ। আর জলপাইগুড়ি থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অনেক মাঠ, ঘাট, গ্রাম, গঞ্জ পেরিয়ে যে বিশাল স্টেশনটি চালু হল তার নাম কিনা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন? কী ধরনের জেদ এই রকম প্রকৃতিবিরোধী কাজের পিছনে থাকে! এখন কেউ যখন নিউ জলপাইগুড়িতে নেমে দার্জিলিং বেড়িয়ে এসে আমায় বলেন, আপনার জলপাইগুড়ি দেখে এলাম, তখন তাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলতে হাল ছেড়ে দিয়েছি।
শিলিগুড়িতে মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। জলপাইগুড়ির সম্বল একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। জলপাইগুড়িতে কোনও শিল্প নেই। চা-বাগানের অফিসগুলো সব কলকাতায় চলে গেছে। আটষট্টির বন্যার পরে শহরটা বিয়ে না হওয়া বয়স্কা মেয়ের মতো বাপের বাড়িতে পড়ে আছে, যার বিয়ের বয়সটাও চলে গিয়েছে। রাস্তাঘাট থেকে বাড়িঘরের চেহারা সেই প্রাচীনকালের চৌহদ্দি থেকে বের হয়নি, সামগ্রিকভাবে তুলনায় শিলিগুড়ির বাতাসে টাকা উড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে হু হু করে। অবাঙালি ব্যবসাদারদের দ্বিতীয় আবাস হয়ে গিয়েছে শিলিগুড়ি। পশ্চিমবাংলার অন্য কোনও শহরে এত হোটেল নেই। একমাত্র দার্জিলিং পাল্লা দিতে পারে। দামি গাড়ি এবং বাড়ির চেহারা দেখলেই দু’টো শহরের অর্থনৈতিক পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়।
কিন্তু জলপাইগুড়ির গর্ব ছিল সাহিত্য, গান এবং নাটক নিয়ে। এগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি শিলিগুড়ি। জলপাইগুড়ির লোক বুক ফুলিয়ে বলতেন, টাকা থাকলে ইন্ডাস্ট্রি গড়া যায়, সংস্কৃতি নয়। আমাদের বেণুদত্ত রায় আছেন, দেবেশ রায়, অশোক বসু, অর্ণব সেন আছেন, প্রাবন্ধিক আনন্দগোপাল ঘোষ, উমেশ শর্মা আছেন। শিলিগুড়িতে তো হাতের একটা আঙুলও গোনা যাবে না। শিলিগুড়ির লোক বলবে, পশ্চিমবাংলাকে ভারতের খেলাধুলার জগতে চিনিয়েছে শিলিগুড়ি। বিশেষ করে টেবিল টেনিস। কবে ঘি খেয়েছিল জলপাইগুড়ি রুণু গুহঠাকুরতা বা মণিলাল ঘটককে পেয়ে, এখনও তার গন্ধ শুঁকে যাচ্ছে। ব্যাপারটা এখন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে জলসাঘরের জমিদারের ফিটন গাড়ির পাশে মারুতির অবস্থানের মতো।
অথচ দেখুন, দুই শহরের পাড়াগুলোর নামের কী মিল ছিল! হাকিমপাড়া, বাবুপাড়া, হসপিটাল পাড়া দুই শহরেরই আছে। দুই শহরের বেশিরভাগ মানুষের পূর্বপুরুষ আজকের বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন। কিন্তু সময়ের বিচারে জলপাইগুড়ি শহরের পত্তন হয়েছিল অনেক আগে। অভিজাত মানুষের শহর হিসেবে সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিল জলপাইগুড়িতে।
তা হলে এত বিরোধ কি বানানো? যতদূর মনে পড়ছে, হাইকোর্টের বেঞ্চ কোন শহরে হবে এই নিয়ে ঝগড়া তুঙ্গে উঠেছিল। জলপাইগুড়ির বিখ্যাত আইনজ্ঞ পরলোকগত বিমল হোড় মশাই মরিয়া হয়েছিলেন ওটা জলপাইগুড়িতে নিয়ে আসতে। খোলা চোখে দেখলে শিলিগুড়ির মানুষের যুক্তি অনেক বেশি বাস্তব ছিল। যাতায়াতের সুবিধা, ভাল ভাল হোটেল থাকায় মামলা করতে এসে অসুবিধায় পড়বেন না দু’-পক্ষের মানুষ। জলপাইগুড়িতে এই দু’টোর অভাব আছে। কিন্তু আবেগের কাছে যুক্তি হার মানলে আর কী করা যাবে! বোধহয় সেই কারণে আজও হচ্ছে হচ্ছে করেও জলপাইগুড়িতে হাইকোর্টের কাজ এখনও শুরু হয়নি।
কিন্তু এগুলো সবই বাইরের ব্যাপার। উত্তরবঙ্গ বিষয়ক মন্ত্রী শ্রীযুক্ত গৌতম দেবের কাজের জায়গা শুধু শিলিগুড়ি বা তাঁর নির্বাচনী এলাকা নয়, কোচবিহার থেকে মালদা পর্যন্ত। তার মধ্যে অবশ্যই জলপাইগুড়িও পড়ে। তাঁর কাছে আমরা উন্নয়নের জন্য অনুরোধ জানাতেই পারি। আর কিছু না হোক, রাস্তাগুলোয় যেন গাড়ি চলতে পারে। এর আগে একবার শিলিগুড়ি থেকে গাড়িতে জলপাইগুড়ি যেতে গিয়ে কোমরে ভয়ংকর আঘাত পেয়েছিলাম। তখনকার জাহাজমন্ত্রীর কাছে একটি নিবন্ধে আবেদন করেছিলাম, ওই রাস্তাটা কুড়িফুট খুঁড়ে জলপথ করে দিতে, যাতে লঞ্চে বা বাষ্পচালিত নৌকায় যাতায়াত করা যেতে পারে। তাতে দু’টো সুবিধা, প্রতি বছর মেরামতির জন্য কন্ট্রাক্টরকে টাকা দিতে হবে না এবং মানুষ আহত না হয়ে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছবে। দুই শহরকে একটু কাছাকাছি আনার জন্যে এইরকম একটা ব্যবস্থার দরকার। ও হ্যাঁ, গত সংখ্যার লেখা পড়ে একজন পাঠক জানিয়েছেন, আপনি তো মশাই এখন কলকাতার লোক, যতই ঘরে ফেরার কথা লিখুন কলকাতার গন্ধ। বনের পশু তার শাবকের গায়ে মানুষের গন্ধ পেলে ত্যাগ করে চলে যায়।
হায়! কলকাতা বলে আমি নর্থ বেঙ্গলের লোক। এরপরে তো একটাই ইংরেজি শব্দ মনে আসছে। আউটসাইডার। না ঘাটকা, না ঘরকা।
৫১
গত সপ্তাহে জলপাইগুড়িতে গিয়ে দিন সাতেক ছিলাম। ট্রেনে সরাসরি নেমেছিলাম হাসিমারা স্টেশনে। অন্বিন্দু এসে নিয়ে গিয়েছিল ওর চা বাগান সুভাষিণীতে।
সেটা অনেককালের কথা, যখন চা বাগানের ম্যানেজাররা প্রায় রাজ্যপালের মতো জীবনযাপন করতেন। বাগানের মালিক ছিলেন রাষ্ট্রপতি। এঁরা নিচের তলার মানুষের সঙ্গে মিশতেন না। কাজের বাইরে কথা বলতেন না। সেই ভয়ংকর বাতাবরণ আর নেই। পরের দিন শুভব্রত ঘোষ এলেন। তিনি ওই বাগান তো বটেই আরও দু’টি বাগানের মালিক। অত্যন্ত ভদ্র মানুষ। ডুয়ার্সের চা বাগানগুলো থেকে বাঙালি মালিকরা যখন নিজেদের দোষ অথবা পারিপার্শ্বিকের চাপে বিতাড়িত হয়েছেন, তখন শুভব্রতর মতো তরুণ বাঙালি এখনও ভালবেসে ভাল কাজ করে চলেছেন, দেখতে খুব ভাল লাগে।
হাসিমারা স্টেশনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, শ’-দুয়েক সম্পন্ন মানুষ কাঞ্চনকন্যা স্টেশন থেকে নেমে ভুটানের ফুন্টশিলিং-এ যাবেন বলে ব্যস্ত হয়েছেন। হাসিমারা ছোট্ট স্টেশন। কিন্তু ওই ট্রেনের যাত্রীদের পাওয়ার আশায় ট্যাক্সিওয়ালারা ওঁত পেতে থাকেন। মোটা টাকায় তারা ৩৪ মিনিটে দূরের ভুটানি শহরে নিয়ে যায়। সেখানে হোটেল খুঁজে মোটা টাকার বিনিময়ে দিন এবং রাত কাটিয়ে পরের সকালে এঁরা থিম্পু, গারোতে বেড়াতে যান। সারা রাত ট্রেনে কাটিয়ে হাসিমারায় নেমে যাত্রীরা যদি মোটামুটি আরামদায়ক একটি রিসর্ট পেতেন তাদের আশেপাশের চা বাগানে বিকেলে নিয়ে গিয়ে চা তৈরির প্রক্রিয়া দেখানো হত এবং পরের সকালে ফুন্টশিলিং-এ পৌঁছে দেয়োর ব্যবস্থা রাখা হত তা হলে, আমি নিশ্চিত, বেশিরভাগ থিম্পুযাত্রী একটা রাত পশ্চিমবঙ্গে থেকে যেতেন। পর্যটন বিভাগ এটা নিয়ে ভাবেননি, বেসরকারি ব্যবসাদাররাও নয়। জলপাইগুড়ির উৎসাহী তরুণরা দলবদ্ধভাবে উদ্যোগটা নিতে পারেন। আমার বিশ্বাস আছে, চা বাগানের মালিকরা এই ব্যাপারে সহযোগিতা করবেন। শুভব্রত তো এককথায় রাজি।
জলপাইগুড়িতে যাওয়ার দরকার ছিল। ঠিক হল, যাওয়ার পথে গয়েরকাটায় থামব। নইলে ফেরার পথে রাত কাটাব। গয়েরকাটা চা বাগানে আমার জন্ম হয়েছিল। ছোট্ট জায়গা, কিন্তু এর উপর দিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে অসম এবং ভুটানে গিয়েছে। গয়েরকাটায় কোনও হোটেল নেই। আমার অনেক গল্প উপন্যাসে গয়েরকাটার কথা রয়েছে। খুঁটিমারির জঙ্গল, নাথুয়ার ডায়না নদী, বানারহাট পেরিয়ে ভুটানে বেড়াতে যাওয়ার চমৎকার সুযোগ আছে। থাকার মধ্যে একটা পিডব্লিউডি বাংলো। কিন্তু সেখানে সরকারি আমলাদের ভিড়ে জায়গা পাওয়া যায় না। মনে আছে, বহুবছর আগে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আলিপুরদুয়ার যাওয়ার পথ শেষ বাস থেকে কোনও কারণে গয়েরকাটার চৌমাথায় নেমে কিছুর সন্ধান করায় বাস তাঁকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছিলেন না শক্তিদা। কেউ তাঁকে চিনত না। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলে খোঁজ করলেন কেউ ‘দেশ’ পত্রিকা পড়ে কিনা! সেই সূত্র খুঁজে সন্ধ্যার পর পৌঁছতে পারলেন আমার বাবার কাছে। রাতের আস্তানা জুটল।
জানতাম, এখনও চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পরেও অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। আমাদের ছেলেবেলায় যে গয়েরকাটাকে দেখেছিলাম তার সামান্যই বদলেছে। কিছু সেলুন, ভাল বাড়ি হয়েছে। একটা আধুনিক রেস্তোরাঁ স্বপ্নের বাইরে। গয়েরকাটার কিছু উদ্যমী ছেলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। সুব্রত পাত্র, কানাই চ্যাটার্জি, শ্যামল এবং বুড়োরা একটা কিছু করার কথা ভেবে খুঁটিমারির জঙ্গলের একেবারে গায়ে প্রায় পরিত্যক্ত পার্কে ট্যুরিস্টদের জন্য রিসর্ট করতে চাইল। কিন্তু পার্কের জমি সরকারের। পঞ্চায়েত নিয়ন্ত্রণ করে। পঞ্চায়েত দয়া করে ওদের এক বছরের জন্য কাজ করতে বলল। কিন্তু এক বছরের জন্য কাজের সুযোগ পেয়ে ওরা কী করে টাকার ব্যবস্থা করে ওখানে সেটা নিয়োগ করবে? রিসর্টের জন্য ঘরবাড়ি ইত্যাদি তো দরকার। এক বছর পরে উঠে যেতে হলে কেন ওরা টাকা নষ্ট করবে! আমি উত্তরবঙ্গ বিষয়ক মন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছি, পঞ্চায়েতের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি, ওদের অন্তত পাঁচ বছরের জন্য কাজ করতে দিন। গয়েরকাটায় যদি টুরিস্টরা ওই রিসর্টের জন্য আসে, তা হলে এলাকায় উন্নতি হবে। কিছু বেকার ছেলে কাজ পেয়ে যাবে। খুঁটিমারি জঙ্গলে তো প্রচুর বন্যপ্রাণী আছে। যদি বনমন্ত্রী প্রসন্ন হন, তা হলে হলং থেকে পোষা হাতি শীতকালে ওখানে এনে সকাল বিকেলে তার পিঠে ট্যুরিস্টদের জঙ্গলে ঘোরানোর ব্যবস্থা করলে, তাঁরাও আসতে উৎসাহিত হবেন। মন্ত্রী মশাই, পঞ্চায়েতের বন্ধুরা আশ্বাস দিয়েছেন তাঁরা উদ্যোগ নেবেন।
জলপাইগুড়িতে যাওয়ার জন্য, হাসিমারা থেকে বেরিয়ে মাইল দুই-তিন যাওয়ার পর গাড়ি থামাতে বললাম। বোধহয়, মান্ধাতার বাবার আমলে ওখানে একটা পিচের রাস্তা ছিল। এখন ভয়ংকর গর্ত চারধারে। যেন আকাশ থেকে বোমা ফেলে ওই গর্তগুলো করা হয়েছে। ড্রাইভার আশ্বাস দিল, ‘মাত্র চার কিলোমিটার রাস্তা এইরকম, পরের রাস্তা ভাল’। চার কিলোমিটারের এই হাল কেন? ‘স্যর, যিনি কনট্র্যাক্ট নিয়েছেন তিনি হয় দুর্বল, নয় আর তোলা দিতে পারছেন না,’ ড্রাইভার বলল। মন্ত্রীমশাই বললেন, ‘বামফ্রন্ট যাদের কনট্র্যাক্ট দিয়ে গিয়েছিল তিন বছরের জন্য, তাদের সরাতে আরও এক বছর লাগবে।’
বিশ্বাস করুন, ওই চার কিলোমিটার গাড়িতে পার হতে আমার কোমরে যে ভয়ংকর ব্যথা শুরু হয়ে গেল, তারপর আবার ওই পথে ফিরতে পারিনি। ফেরার সময় বিনাগুড়ি পর্যন্ত গাড়িতে চেপে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে উঠে হাসিমারায় নেমেছিলাম। এবার জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়িতে যেতে পারিনি। বন্ধুরা বললেন, ‘আগে হাড় ভাঙত এখন ভাঙবে না মচকাবে।’
চারধারে এক পরিবর্তন হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। কলকাতা থেকে দুর্গাপুরের রাস্তায় এখন প্লেন নামতে পারে। দু’-ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যায় সেখানে। খড়গপুরের রাস্তা তো রীতিমতো বিদেশের মতো। রাস্তা ভাল হলে উন্নয়ন হতে বাধ্য। তা হলে ডুয়ার্সের মানুষ কী দোষ করল? মন্ত্রীমশাই একটি ঘটনা বললেন, একটি জেনারেটরের দাম যেখানে সাড়ে চার লক্ষ টাকা, সেখানে সাপ্লায়ারকে ভাড়া দিতে হয় ৯৬ হাজার টাকা। ভাড়া বন্ধ করে নতুন জেনারেটর কিনে দিলেই আন্দোলন শুরু হয়। শুধু বিরোধী দল নয়, শাসক দলের নেতারাও নতুন জেনারেটরে আপত্তি করেন। তা হলে রাস্তা ভাল হবে কেন? ফেরার পথে ট্রেনে প্রাক্তন পূর্তমন্ত্রী শ্রীযুক্ত ক্ষিতি গোস্বামী সহযাত্রী ছিলেন। সব শুনে বললেন, ‘ডুয়ার্সের মানুষের অসীম ধৈর্য, কলকাতার দিকে হলে আগুন জ্বলে যেত।’ মনে মনে বলেছিলাম, কত কাল? আর কত কাল?
৫২
বছর বত্রিশ আগে সান্দাকফু গিয়েছিলাম। ঘুম থেকে সুখিয়াপোখরি হয়ে মনেভঞ্জন পর্যন্ত বাসে যাওয়া যেত। তারপর হাঁটতে হত। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ ভেঙে থমকে দাঁড়াতে হত টংলুর কাছাকাছি গিয়ে। আকাশ আড়াল করা পাহাড় সামনে। মনেভঞ্জন থেকে যে মালবাহক আমার সঙ্গী হয়েছিল সে বলেছিল, ‘সাব, ওই পাহাড় সন্ধের মধ্যেই পেরিয়ে যেতে হবে, জোরে পা চালান।’
শরীরে ক্লান্তি জমেছিল অনেকটা হেঁটে আসায়, ওর কথা শুনে সেটা বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ। কপাল ভাল বলে পুরো পাহাড় ডিঙোতে হয়নি। একটা ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত সরকারি অফিস পেয়ে গিয়েছিলাম রাত কাটানোর জন্যে। খবরটা দিয়েছিলেন যিনি, তিনি থাকেন মিনিট চল্লিশেক দূরে। আসার পথে সেখানকার একমাত্র রুটি-তরকারির দোকানে তাঁর সঙ্গে আলাপ। এককালে বনবিভাগে কাজ করতেন। এখন অবসর-জীবন কাটাচ্ছেন গ্রামের বাড়িতে। তখন আমার চোখে নেপালি, লেপচা, সিকিমিজরা একই চেহারার মানুষ বলে মনে হত। ভুটানিদের গড়ন যেহেতু একটু আলাদা তাই ওঁদের এই দলে ফেলতাম না। জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ায় আমাদের বাড়ির সামনে ফরেস্ট এবং পিডব্লিউডি ডিপার্টমেন্টের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা ভাড়া থাকতেন। তাঁদের অধিকাংশই পাহাড়ের মানুষ।
সিন্টু নামের একটি কিশোরী খুব সেজেগুজে থাকত ওদের এক পরিবারে, আমার সঙ্গে সিনেমার নায়িকার মতো পোজ দিয়ে কথা বলত। আমি তাকে নেপালি বলেই ভাবতাম। একদিন সেটা জিজ্ঞাসা করলে সে ফোঁস করে উঠেছিল। বলেছিল, ‘আমি নেপালি হব কেন? আমি লেপচা।’ তারপর থেকে সে আমাকে দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নিত।
ওই অবসর-জীবন কাটানো ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি একজন লেপচা।’
‘কী করে আপনাকে একজন নেপালি থেকে আলাদা করে চিনব?’
‘তফাৎ নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আপনি চট করে ধরতে পারবেন না।’ কথাটা বলে বড় শ্বাস ফেলে ভদ্রলোক চারপাশের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই দেশ আমাদের। আপনি খাবার খান, আমি গ্রামে যাচ্ছি। একটা লেখা পাঠিয়ে দেব, পড়ে দেখবেন।’
ভদ্রলোক চলে গেলেন। খাওয়া শেষ হতেই একটা বাচ্চা ছেলে ছুটে এসে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে চার পাতার টাইপ করা লেখা আমায় দিয়ে চলে গেল। টংলুর ভাঙা অফিসবাড়িতে মোমবাতি জ্বালিয়ে সেই লেখাটা পড়ে ফেললাম। ইংরেজি বাক্যে কোনও ভুল নেই কিন্তু আমার কিছু ভুল ভেঙে গেল।
পলাশির যুদ্ধ জয় করে ইংরেজরা যখন একটু একটু করে দক্ষিণবঙ্গ দখল করে নদী পেরিয়ে উত্তরবঙ্গে পা রাখল, তখন সিকিম রাজ ও ভুটানের রাজা প্রবল বিক্রমে রাজত্ব করছেন। ভুটানের রাজত্ব তখন জলপাইগুড়ি জেলাতেও বিস্তৃত ছিল। এখনও সেখানে একটি জায়গা রয়েছে যার নাম ভোটপট্টি। ওপাশে ছিলেন কোচবিহারের রাজা। সিকিমের এদিকের পাহাড়টা ছিল লেপচাদের দখলে।
দু’জন ইংরেজ পরিব্রাজক ঘুরতে ঘুরতে এই পাহাড়ে এসে দেখলেন এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইংল্যান্ডেও নেই। তাঁরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে জানালেন, অবিলম্বে এই পাহাড়ের দখল নিতে।
ইংরেজরা প্রথমে তাদের সীমিত শক্তি নিয়ে পাহাড় দখল করতে চেয়েছিল। কিন্তু লেপচারা শুধু তির-ধনুক নিয়ে গেরিয়া যুদ্ধ করে তাদের এমন নাস্তানাবুদ করল যে, তারা প্রায় কিষানগঞ্জের কাছে পিছিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করল। লেপচা যোদ্ধারা নেমে এসেছিল পাহাড়ের নিচে, ওদের পিছু ধাওয়া করে। শত্রু পালিয়েছে জেনে তারা আনন্দ উৎসব করতে লাগল। ইংরেজরা আবার শক্তি বাড়িয়ে আক্রমণে এলে লেপচা সেনাপতি চিৎকার করতে লাগলেন, ‘স্যালিগ্রি-স্যালিগ্রি’। শব্দটির অর্থ হল, ধনুকে ছিলা পরাও। অর্থাৎ যুদ্ধের জন্য তৈরি হও।
শব্দটি ইংরেজদের কানে পৌঁছল, ‘শ্যালগিরি-শ্যালগিরি’-তে রূপান্তরিত হয়ে। এই শ্যালগিরি থেকেই জায়গাটার নাম হয়ে গেল শিলিগুড়ি।
পড়ে মজা লাগল। বাল্যকাল থেকে কতবার শিলিগুড়িতে গিয়েছি কিন্তু শিলিগুড়ি নামটি কীভাবে তৈরি হয়েছে তা নিয়ে কৌতূহল হয়নি। পরে অনেককে জিজ্ঞাসা করেছি। বাঙালিদের স্বভাব একমত না হওয়া। কেউ অন্য ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু স্যালিগ্রি থেকে শ্যালগিরি হয়ে শিলিগুড়ি আমার কাছে বেশ নাটকীয় মনে হয়েছে।
কার্শিয়াং-এ আমি প্রথম পা রেখেছিলাম উনিশ বছর বয়সে। তখন স্কটিশের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। সঙ্গী ছিল প্রয়াত লেখক, আমার সহপাঠী শৈবাল মিত্র। সেই যাওয়াটা মনে আছে। কারণ, আধঘন্টা ট্রেনটা থেমে দার্জিলিং-এ যাবে শুনে একটি নেপালি রেস্তোরাঁতে ভাত খেতে গিয়ে থ্রি-এক্স রামের বোতলে তরল পদার্থকে রাম বলে ধরে নিয়ে বোকা বনেছিলাম। ওটায় ভিনিগার ছিল।
এখন কার্শিয়াং নামটি শুনলেই সেই দিনটা সামনে চলে আসে। এই কার্শিয়াং শব্দটির অর্থ কী? টংলুর ওই রাতে কাগজটি পড়ে জানতে পারলাম, মূল শব্দটি হল ‘খর্সং’। খর্সং মানে শুকতারা। লেপচা শব্দ। যেভাবে জানতাম, তা হঠাৎ বদলে গিয়ে জায়গাটা কী রকম সুন্দর হয়ে গেল।
কাগজটিতে লেখা ছিল, উঁচু পাহাড় বলে ঝড়বৃষ্টি হত প্রায়ই। বিদ্যুৎ চমকাত, বাজ পড়ত খুব। লেপচা ভাষায় বাজকে দোর্জলং বলা হয়। দোর্জলং থেকে দোর্জলিং, তা উচ্চারণে দাঁড়াল দার্জিলিং।
এই পাহাড়, পাহাড়ের জনপদগুলো যদি লেপচা অধ্যুষিত ছিল, তা হলে তারা সংখ্যালঘু হয়ে গেল কী করে। কাগজটিতে তার নানা কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
গ্রামের দিকে যে কারণটি দায়ী, তা হল বড়ভাই মারা গেলে যদি তার স্ত্রী সন্তান উৎপাদনে সক্ষম থাকেন তা হলে অবিবাহিত ছোট ভাইদের একজনকে তাকে বিয়ে করতেই হবে। যাতে বিধবা জমির ভাগ নিয়ে অন্য সংসারে চলে যেতে না পারেন। সেই যাত্রায় এই রকম উদাহরণ আমি সান্দাকফুর আগে বিকেভঞ্জনে দেখেছি।
ইতিহাস বলে, বাইরের মানুষের ঢল সামলে ভূমিপুত্ররা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েন। প্রথমে দক্ষিণ বাংলা, পরে পূর্ব বাংলার মানুষের ঢেউ উত্তর বাংলার ভূমিপুত্রদের এই নিয়মেই পিছনে ফেলেছে।
আমেরিকান আদিবাসীদের পিছনে ফেলে দিয়েছে ইউরোপ থেকে আসা মানুষরা। এই বিভাজন তাড়াতাড়ি দূর হোক, এটাই সুস্থ মানুষ আশা করবে। জল আর মাটির উপর অধিকার তাদেরই, যারা রক্ষণাবেক্ষণ করে আন্তরিকভাবে।
৫৩
ইট কাঠ সিমেন্টের বাড়ির দিকে যখন আমরা তাকাই, তখন ভাল দেখালে প্রশংসা করি। কিন্তু যার উপর ওটা দাঁড়িয়ে আছে তার কথা মনেই আসে না। প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর গল্পটা থাকে, যেমন কয়েকবার আছাড় না খেলে সাইকেল চালানো শেখা যায় না। কিন্তু কে সলতে পাকাতে শিখিয়েছিল অথবা ক’বার আছাড় খেতে হয়েছিল তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। বাড়ির ভিত যেহেতু মাটির তলায় থাকে এবং সেটা চোখে দেখা যায় না, তা নিয়ে দর্শকরা মাথা না ঘামালেও, বাড়ি জানে সে কার উপর দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য অকৃতজ্ঞ হলে আলাদা কথা।
জীবনের ক্ষেত্রেও আমি এই তত্ত্বে বিশ্বাস করি। বালকবেলা থেকে কিশোরকাল পর্যন্ত সময়টায় কেউ না কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। নতুন পথের খবর দিয়ে থাকেন। আর সেটাই জীবন বদলে দেয়। এই আমি, এখনও লেখালেখি করে যাচ্ছি, লিখে চমৎকার বেঁচে আছি, আমার জীবনেও দু’জন মানুষ নির্মাতার ভূমিকায় ছিলেন। তাঁরা তখন যেমন জানতেন না যে আমাকে নির্মাণ করেছেন, আমিও তখন তাঁদের ভূমিকা আমার জীবনে কী মহামূল্যবান হবে তা বুঝতে পারিনি।
জলপাইগুড়ির জেলা স্কুলে পড়তাম ঠাকুরদার আশ্রয়ে থেকে। জন্মেছিলাম প্তঙ্ম মাইল দূরের গয়েরকাটা চা বাগানে। তিনছুটিতে ছুটে যেতাম সেখানে। চা গাছ, আংরাভাষা ঝরনা, রবিবারের হাট আর সমবয়সি মদেশিয়া বন্ধুদের সঙ্গে সময়টা কেটে যেত হুহু করে। এখনকার ন্যাশনাল হাইওয়ের নাম তখন ছিল আসাম রোড। ঘন্টায় একটা বাস যেত কিনা সন্দেহ। মাঝে মধ্যে দু’-একটা প্রাইভেট গাড়ি। বাসের সামনে লেখা থাকত নাথুয়া, বানারহাট, আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা, কোচবিহার। কখনও না যাওয়া জায়গাগুলোর নাম দেখে ভাবতাম, আহা বাসটাতে যদি উঠে পড়তে পারতাম। ডুয়ার্সটাকে বেশ চেনা হয়ে গিয়েছিল শুধু নাম দেখেই। আমার জগৎ ছিল তখন টিয়াপাখির ঝাঁকে, বাতাবিলেবুর ফুলের গন্ধে, ঝরনার জলের পাথরের খাঁজে লুকিয়ে থাকা নোনা চিংড়িদের নিয়ে। আর এই সময় আমার ভাইদের পড়াতে এলেন একজন নতুন গৃহশিক্ষক। নাম সতী মাস্টার।
নাইন-টেনে উঠেই আমি বাংলা সাহিত্য গিলতে শুরু করেছিলাম। দস্যু মোহন থেকে নীহার গুপ্ত। সতী মাস্টার একটু রোগা, উদাসীন, ময়লা পা-জামা এবং একইরকমের হ্যান্ডলুমের বহু ব্যবহৃত পাঞ্জাবি পরা একটি মানুষ যার পকেটে নস্যির ডিবে এবং নস্যিকলঙ্কিত রুমাল থাকত। বন্ধুরা বলল, সতী মাস্টার এবারের পুজোর সময় যে নাটক হবে তা পরিচালনা করবেন। গয়েরকাটায় তখন যেসব নাটক পুজোর সময় হত তার নারী চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করতেন তাঁদের মধ্যে সুখ্যাতি পেয়েছিলেন সুধীর ঘোষ। সতী মাস্টার নাকি রিহার্সালে তাঁকে বেশি করে তালিম দিচ্ছেন। আলাপ হল। পড়ার বইয়ের বাইরে যাঁরা আমাকে আকর্ষণ করেন তাঁদের নাম শুনে মাথা নাড়লেন তিনি। বললেন, আজ বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা কোরো।
গয়েরকাটা চৌমাথার পাশ দিয়ে গলির ভিতর একটি কাঠের বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে ছিলেন ওরা। নস্যি নাকে পুরে মধ্য তিরিশের মানুষটি রুমালে নাক মুছে বললেন, ‘কিছু পড়ার আগে তোমাকে ভাবতে হবে, কেন পড়ছ? দস্যু মোহন মানুষের কাহিনি নয়, ওটা অতি অবাস্তবভাবে ঠুনকো মনোরঞ্জনের চেষ্টা মাত্র। তোমার চারপাশে যাদের দেখছ তাদের বাইরে অজস্র মানুষ আছেন। এদের তুমি চেনো না। এদের সুখদুঃখ সংগ্রামের কাহিনি তোমার জানা নেই। যারা মানুষের গল্প লিখে গেছেন তাদের লেখা পড়লে ওই মানুষদের কথা তুমি জানতে পারবে। তোমার অভিজ্ঞতা বাড়বে। বিচার করতে শিখবে। কবিতা পড়?’
মাথা নেড়েছিলাম, ‘না’।
‘কবিতা পড়ো। চাঁদ ফুলের কবিতা নয়, মানুষের জন্য লেখা কবিতা। দাঁড়াও।’
একটা বই এনে পাতা বের করে বললেন, ‘এটা পড়ে দ্যাখো তো। এখনও মনে আছে। কবিতাটা পড়ে আমার ভিতরটায় অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। মনে হচ্ছিল কবির মতো আমারও কাজটা করা উচিত। এই পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়াটা আমারও দায়িত্ব। আমি সুকান্ত ভট্টাচার্যের নাম প্রথম জানলাম, ছাড়পত্র কবিতার কথা কেউ এর আগে বলেনি।
সতী মাস্টার আমার চোখের সামনে একটার পর একটা ভুবন তৈরি করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, পড়বে, দেখবে এবং মন চাইলে লিখবে। তারাশংকর-বিভূতিভূষণ-মানিক পড়বে। তারপর রবীন্দ্রনাথের বইতে হাত দেবে। সাঁতার শিখে না নিলে সমুদ্রের পাড়ে সাঁতরাবে কী করে? কলকাতায় পড়তে গেলাম। হঠাৎ সতী মাস্টারের চিঠি এল। ‘আমি একটা পত্রিকা বার করছি। নাম পাবক। পাবক মানে আগুন। এখানকার লেখকদের লেখা পাঠালাম। কলকাতা থেকে বেশ কিছু লেখা জোগাড় করো। তারপর ভাল করে ছাপিয়ে পুজোর আগেই পত্রিকা আমার কাছে পাঠাও। প্রেসকে জিজ্ঞাসা করো কত টাকা লাগবে। পাঠিয়ে দেব। পত্রিকায় যেন যত্ন থাকে।’ পত্রিকা ছাপানোর অভিজ্ঞতা ছিল না, কোনও প্রেসে যাওয়ার দরকারও পড়েনি আগে, কিন্তু একজন প্রসূন বসুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। আগামী পত্রিকার সম্পাদক ও নবপত্র প্রকাশনীর প্রকাশক। তিনি যত্ন করে ‘পাবক’ ছাপিয়ে দিলেন। সেই পত্রিকা নিয়ে নিজেই গেলাম গয়েরকাটায়। জড়িয়ে ধরেছিলেন সতী মাস্টার। গয়েরকাটা থেকে তিনি চলে যান ময়নাগুড়িতে। সপরিবারে। সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। এখন তিনি নেই। কিন্তু কিছু লেখার সময় আমার পাশে এসে বসেন। বলেন, ‘মানুষের কথা লেখো সমরেশ।’
জলপাইগুড়ির জেলাস্কুলে আমরা যখন সিনিয়র ছাত্র, তখন একজন সুদর্শন যুবক এলেন বাংলার শিক্ষক হয়ে। আদ্দির পাঞ্জাবি এবং ধুতিতে একফোঁটা ময়লা নেই। যেন সিনেমার নায়ক। নাম সুরঞ্জন দত্ত রায়। সবাই ডাকেন বেণুদা বলে। জানলাম রেণুদা কবি এবং গল্পকার। ঝটপট ভাব হয়ে গেল। সেই সূত্রে কত কথা। মানিকবাবুর পদ্মানদীর মাঝি আর অদ্বৈত মল্লবর্মনের তিতাস নদীর মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? সারল্য বিভূতিভূষণকে কতটা সাফল্য দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার অংশগুলোকেই ছোটগল্প বলা যায়। কিন্তু ছোটগল্পে রূপান্তরিত করলে বাস্তবতার সঙ্গে যে লড়াই লাগবে তা কবিতায় হয় না কেন? দরজা খুলে যেতে লাগল একের পর এক। ‘মুক্তি’ ছবিতে প্রমথেশ বড়ুয়া যেমন একটার পর একটা দরজা খুলে বিশাল সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন।
বেণুদা চলে গেলেন আলিপুরদুয়ারে, আমি কলকাতায়। আজ আশি বছর পেরিয়েও বেণুদা লেখার ব্যাপারে তরতাজা। কয়েকমাস আগে কলকাতায় এসে ধমক দিয়েছেন, ‘কী করছিস? কত করে বলছি, বৈকুণ্ঠপুরের রাজা দর্পদেব রায়কতকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখো। কানে যাচ্ছে না?’
কথা দিয়েছি এবার লিখব। আমার যাবতীয় কাজকর্মের ভিত এরা দু’জন। আমার লেখক অস্তিত্বের এঁরাই জনক।
৫৪
রথের দিন চেলাকে সঙ্গে নিয়ে ঠাকুরমশাই আসতেন। চা বাগানে রথের কোনও গুরুত্ব ছিল না। কেউ খেলনার রথ টানছে, এমন দৃশ্য দেখিনি কিন্তু ঠাকুরমশাইকে দেখলেই বড়রা বলতেন, ‘আজ রথ, তাই ঠাকুরমশাই আসবেনই।’
কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা সেরে খোকনদের কোয়ার্টার্সের বারান্দার সামনে তিনি বসে যেতেন মা দুর্গার কাঠামো তৈরি করতে। কয়েকদিনের মধ্যে দুর্গাকে সপরিবারে খাড়া করিয়ে দিতেন। সেই মুণ্ডুবিহীন কঞ্চির কাঠামো দেখে একটা আদল বোঝা যেত, তার বেশি কিছু নয়। ঠাকুরমশাই চেলাকে নিয়ে চলে যেতেন। তখন থেকে আমরা ছোটরা তাই-ই দেখতাম মুগ্ধ হয়ে। মাটি নেই, রং নেই, আঙুল নেই, মুখ নেই কিন্তু তাতে কিছু এসে যেত না। আমরা কল্পনার চোখে দুর্গাকে দেখতে পেতাম। সেই দেখার একটা অন্যরকম উন্মাদনা ছিল।
পুজোর দু-সপ্তাহ আগে ঠাকুরমশাই ফিরতেন দুই চেলাকে নিয়ে। তখন সামনের মাঠের স্বর্ণচাঁপা গাছের নিচে টিনের ছাউনি পড়েছে। তার নিচে কাঠামোকে নিয়ে আসা হত সযত্নে। মাটি পড়তে লাগলে শ্রী আসে। দেখতে দেখতে শরীর তৈরি হয়ে গেল। সেই মাটির শরীর শুকনো হলে আঙুল জোড়ার পালা। তারপর ছাঁচ থেকে বের করা মাথা, যার কোনও চোখ নেই। সেই দুর্গাকে দেখে আমার মনে হত, উনি অন্যগ্রহের মানুষ। চোখ নেই, অথচ সব দেখতে পান। আর একটু বড় হলে বইয়ে দেখা মিশরের নারীর ছবির সঙ্গে মিল খুঁজে পেতাম। এর পরে রং পড়ল শরীরে। পোশাকেও। ঠাকুরমশাই প্রতিমা তৈরির সময়, সামনে একটা পর্দা টাঙিয়ে রাখতেন, যাতে উটকো লোকের নজর না পড়ে। আমরা প্রশ্রয় পেতাম। বোধনের আগে চোখ আঁকা হবে। ঠাকুরমশাই সেই কাজটা করেন মধ্যরাতে, যখন আমাদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার অনুমতি নেই। অনেক কাকুতি মিনতি করে ক্লাস সেভেনেও অনুমতি পাইনি। এইটে ওঠার পর মায়ের মন নরম হল। মাত্র পনেরো মিনিটের জন্য নিঃশব্দে যাওয়া আসা করতে হবে এই শর্তে যখন রাত একটায় বাড়ির বাইরে এলাম, তখন মনে এক অলৌকিক আনন্দ হল। অত রাত্রে আমি কখনও পৃথিবীকে দেখিনি। দেখলাম আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা অতি চেনা গাছগুলো এখন মাথা নিচু করে ঘুমোচ্ছে। বাতাস বইতেই মিষ্টি গন্ধ নাকে এল। সেই গন্ধ শিউলি না বাতাবি ফুলের, তা বোঝা সম্ভব ছিল না। একটা পাখি এসে বসল সজনে গাছের ডালে, এটা কী পাখি! অন্ধকারেও বুঝতে পারছিলাম ওর চোখ ঘুরছে। আমি দৌড়ে চলে গেলাম মণ্ডপে। সেখানে বড়রা গম্ভীর মুখে বসে। ঠাকুরমশাই লম্বা টুলের উপর রংতুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে। ভয় হল, আমায় দেখতে পেলে বড়রা ধমকে বাড়িতে ফেরত পাঠাবেন। তাই ওঁদের পিছনে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মিনিট শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ ঠাকুরমশাইয়ের কোনও তাড়া নেই। শেষ পর্যন্ত তিনি ইশারা করতেই ঢাকে কাঠি পড়ল। সেই নির্জনতম অন্ধকার ছিন্নভিন্ন করে ঢাকের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। মায়ের চোখ ধীরে ধীরে এই গ্রহের মানবীর হয়ে গেল।
তারপর পাঁচদিন ধরে প্রাণভরা উৎসব। সেই সময় চা বাগান ছাড়া আরেকটি পুজো হত গয়েরকাটায়, স্কুলের মাঠে। আমরা তখন মানুষ দেখছি।
মদেশিয়া শ্রমিক যারা ধর্মে খ্রিস্টান, দলে দলে এসে মাদল বাজাচ্ছে মণ্ডপের সামনে। লরিতে চেপে ঠাকুর দেখতে আসছেন ধূপগুড়ি বীরপাড়ার মানুষজন। অষ্টমীর বিকেলে বড় লরির ব্যবস্থা হত। তাতে চেপে বাগানের মা-বোনেদের সঙ্গে আমরা যেতাম বানারহাট-বিন্নাগুড়ির ঠাকুর দেখতে। নির্জন পিচের রাস্তায় দু’পাশে দেওদার-সেগুন গাছের সারি, লরি ছুটছে হু-হু করে। ড্রাইভারকে সতর্ক করছেন পাশে বসা কোনও অভিভাবক। প্রতিবছর এইভাবে ঠাকুর দেখতে দেখতে যখন নাইনে উঠলাম, তখন ফুলপ্যান্ট উঠল অঙ্গে, ঠোঁটের উপর কালচে হয়েছে লোমগুলো। একটা বড় বড় ভাব এসে গেছে মনে। বানারহাটের ঠাকুরকে কেন্দ্র করে বড় মেলা বসত। প্রচুর লরি আসত আশেপাশের বাগান থেকে দর্শক নিয়ে। সেই রকম একটা লরি থেকে নামতে দেখলাম যাকে, তার দিকে তাকিয়ে খোকন বলেছিল, একদম সুচিত্রা সেনের মতো দেখতে।
সুচিত্রা সেনকে তদ্দিনে জেনে গিয়েছি। মেয়েটি খুব হাসছিল সঙ্গিনীদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এবং আড়চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকাচ্ছিল। ওরা কোন চা বাগানের লরি থেকে এসেছিল জেনে নিলাম।
গয়েরকাটায় আমার বন্ধু ছিল শিবু, দীপু, তপন আর খোকন। পরদিন সকালে ওই মেয়েটির কথা ঘুরে ফিরে আসতেই শিবু বলল, ‘চল, আজ ওদের বাগানে যাব।’
শিবুর বাবার একটা অস্টিন গাড়ি ছিল। সেটা চালাতে শিখেছিল শিবু, যদিও লাইসেন্স পাওয়ার বয়স নেই। মুশকিল হল, ওর বাবা সেই গাড়িতে কাউকে হাত দিতে নারাজ ছিলেন। শিবুকে তো নয়ই।
ঠিক হল, দুপুরবেলায় যখন ভদ্রলোক ঘুমোবেন, তখন গাড়ি চালু না করে, ঠেলে গ্যারেজ থেকে নিঃশব্দে বের করে বড় রাস্তায় নিয়ে আসব। চাবিটা চুরি করেছিল শিবু। আমরা গাড়ি বের করে উঠে বসলাম। হইহই করে গাড়ি চলল সেই চা বাগানে। একদিকে ফ্যাক্টরি অন্যদিকে নালার পাশে চা গাছ, মাঝের সরু পথ দিয়ে মণ্ডপে পৌঁছে গেলাম আমরা। তখন দুপুরের শেষ। বাগানের ছেলেমেয়েরা বসে আছে সেখানে। ঠাকুরকে প্রণাম করে চারপাশে তাকিয়েও আমরা সুচিত্রা সেনকে দেখতে পেলাম না। মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর বললাম, ‘ওই যে, ওর সঙ্গে সুচিত্রা সেনকে কথা বলতে দেখেছিলাম।’ যে কিশোরী মণ্ডপের দিকে আসছিল তার সামনে গিয়ে শিবু জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা উনি কোথায়?’
‘কে?’
‘আপনার সঙ্গে যিনি বানারহাটে গিয়েছিলেন ঠাকুর দেখতে।’
‘ও। ওরা কলকাতায় চলে গিয়েছে আজ। কেন বলুন তো?’
জবাব না দিয়ে শিবু ফিরে এল, ‘চল’।
আমরা গাড়িতে উঠলাম। তারপরই হল দুর্ঘটনা। বাঁকে ঘোরার সময় গতি সামলাতে না পেরে গাড়ি আছাড় খেল নালায়। হইহই চিৎকার। সবাই গাড়ি সমেত আমাদের টেনে তুলল। গাড়ি ঠিক থাকলেও কাদায় মাখামাখি। আবার চালু করে শিবু বলেছিল, ‘আজ বাবা পিঠের ছাল তুলে দেবে।’
আর দু’মাস পরেই পুজো। সেই গয়েরকাটা একইরকম রয়ে গেছে। শিবু, দীপু, তপনরা যেমন পৃথিবীতে নেই সুচিত্রা সেন কোথায় আছেন জানা নেই।
৫৫
আমার শৈশব থেকে কিশোরবেলা পর্যন্ত সময়টায় জলপাইগুড়ি শহর থেকে গয়েরকাটায় পৌঁছতে প্রায় তিন ঘন্টা লেগে যেত। পঞ্চাশ মাইলের এই দূরত্ব অতিক্রম করতে নৌকো অথবা পক্ষীরাজ ট্যাক্সি এবং নদীর এপারে বার্নিশ এসে মান্ধাতার আমলের বাসই ভরসা ছিল। ওই পক্ষীরাজ ট্যাক্সি আর ভরা বর্ষায় তিস্তা যাঁদের স্মৃতিতে এখনও আছে তাঁরা আজকের ব্রিজের বাঁধনে বাঁধা মরা তিস্তা দেখে স্বস্তি পেলেও, আমি বিশ্বাস করি, একধরনের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন। শীতে এবং বর্ষায় আগে যে সাইলেন্সর বিহীন স্প্রিং বের করা পক্ষীরাজ ট্যাক্সিগুলো বালির উপর দিয়ে ছুটত, জলের ঢল নামলেই তারা যে কোথাও উধাও হয়ে যেত জানা নেই। তারপর যখন ব্রিজ হল তখন তারা আর ফিরে এল না।
ঠিক তেমনই, নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে চেপে যখন গঙ্গার ঘাটের বালি ঠেঙিয়ে লঞ্চে উঠতাম তখন সেই ঘাটের নাম শুনতাম মণিহারি-সকরিকান অথবা খেজুরিয়া-মোকামা, বোধহয় জলের কমবেশিতে ঘাট বদলে যেত। কিন্তু যেই ফারাক্কার ব্রিজ তৈরি হয়ে গেল অমনি সেই লঞ্চগুলো যে কোথায় চলে গেল! ঘন্টা দুয়েকের সেই লঞ্চ যাত্রায় কত কী ঘটনা ঘটত! লঞ্চের একতলা জনতার জন্যে। দোতলা বিত্তবান এবং অফিসারদের জন্য নির্দিষ্ট থাকত। আমাদের অনেকের, যারা শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি থেকে কলেজে পড়তে যেতাম, প্রথম প্রেমের ছোঁয়া পেয়েছিলাম ওই লঞ্চের দোতলায়। সেই ছোঁয়া ছিল চোরা চাহনিতে, ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা প্রশ্রয়ের হাসিতে। ওই পর্যন্ত। তাতেই জ্বলে-পুড়ে মরতাম আমরা। আমাদের জলপাইগুড়ির বন্ধু গোবিন্দ স্বপ্ন দেখত, যদি সে ওই লঞ্চে চাকরি পায় তা হলে আইন পড়া ছেড়ে দেবে।
হায়, সেই বিরাট চেহারার লঞ্চগুলো কোথায় হারিয়ে গেল!
আমি জন্মেছিলাম গয়েরকাটা চা-বাগানে। তখন বাড়িতেই শিশু জন্মাত। বোধহয় সেই কারণেই শিশুমৃত্যুর হার ছিল খুব বেশি। শুনেছি, ভরদুপুরে, মানে যখন ভূতে মারে ঢেলা তখন আমি পৃথিবী দেখে ভড়কে গিয়ে কেঁদে উঠেছিলাম। কিংবা নিজের ভূত দেখেও কান্না আসতে পারে, নইলে তখনই মায়ের প্রবল জ্বর আসবে কেন? জন্মমাত্র আমি অন্যের কৃপায় বেঁচেছি। মাতৃদুগ্ধ শুধু গর্ভধারিণীই দেন না, অন্য কোনও সদ্য মা কর্তব্য করে জননী হয়ে উঠতে পারেন। আমার ক্ষেত্রে সেই ভূমিকা নিয়েছিলেন সেজোপিসিমা। ওর মেয়ে শোভা তখন সবে জন্মেছিল। আবার অদ্ভুত ব্যাপার, যিনি আমার প্রাণরক্ষা করেছিলেন, তিনি আমার স্মৃতিতে থেকে গেছেন ভয়ঙ্কর স্মৃতি হয়ে। চার বছর বয়সে চা-বাগানের কোয়ার্টার থেকে হিন্দুপাড়ায় ছুটেছিলাম বড়দের পিছু পিছু। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম সেজোপিসিমা খাটে শুয়ে আছেন, তাঁর দুই পা আমার দিকে। সাদা হয়ে যাওয়া সেই পা দু’টির নিচে সিঁদুর বোলাচ্ছিল কেউ। কাঁদছিল সবাই। সাদা পায়ে লাল সিঁদুরের ছবি আজও ভুলতে পারিনি। আমাকে যিনি রক্ষা করেছিলেন, তিনিই প্রথমবার মৃত্যুর স্মৃতি এঁকে দিয়ে গেলেন। অথচ মৃত্যু কী তা তখন বুঝিনি। শৈশবে শোক বড় শিথিল হয়ে থাকে।
তখন কোয়ার্টারের সামনে খেলার মাঠ। তার মাঝখানে একটা লম্বা স্বর্ণচাঁপার গাছ। ওপাশে অসম রোড। দিনেরাতে হাতেগোনা গাড়ি চলত, তাই দিনভর ঘুঘুরা ডেকে যেত। তিন-চার বছর বয়সে ভাবতে চাইতাম ওরা কেন এত ডাকে? কোয়ার্টারের পিছনে সজনে আর কুলগাছের ঝোপ, তারপর আংরাভাসা নদী। আবার সাম্রাজ্য। সেই নদীতে মদেশিয়া মেয়েরা যখন স্নান করত তখন আমাকে গাছ, পাথর বা ছাগলছানা বলে ভেবে নিত। বিবস্ত্র হতে বিব্রত হত না। অথচ আমি দৌড়তাম মুখ ফিরিয়ে নদীর ধার দিয়ে। ওই বয়সে মনের ভিতর যে মন আছে, সে বলত দেখা উচিত নয়। তার চেয়ে নদীর হাঁটুজলে লাল চিংড়ি বা দাঁড় উঁচিয়ে আসা রাগি কাঁকড়াদের দেখো অথবা ওই ঢেউগুলো, যে ঢেউ গিয়ে মিশেছে ডুডুয়ায়, ডুডুয়া থেকে জলঢাকায়। তারপর অনেক নদীর সঙ্গে গলাগলি করে সাগরে। ওই সাগর শব্দটি সদ্য শেখা। তখনও আমি সাগর দেখিনি।
পিতামহ ভর্তি করে দিয়েছিলেন পাঠশালায়। গয়েরকাটায় যেখানে দুর্গাপুজো হত, সেখানেই ছিল ভবানী মাস্টারের পাঠশালা। একটাই ঘরে তিন ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন তিনি। পরনে ধুতি-ফতুয়া। পূর্ববাংলার যশোর জেলায় বাড়ি ছিল বলে কথা বলতেন সেই দেশীয় ভাষায়। তিন মাস পরে যখন পিতামহের সঙ্গে জলপাইগুড়ি শহরে চলে যাচ্ছি, সেখানকার স্কুলে ভর্তি হব, তখন ভবানী মাস্টারকে প্রণাম করে বিদায় চাইলাম। ভদ্রলোক আমাকে তাঁর বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বাবা, বড়ো হও, অনেক বড়ো’। আমি তখন মনে মনে ছটফট করছি, কারণ তার শরীর থেকে কটু গন্ধ বের হচ্ছিল। ছুটি হলেই যখন চা-বাগানে ফিরে যেতাম তখন খবর পেয়ে ভবানী মাস্টার আসতেন। আমার পড়াশোনার কথা জিগ্যেস করতেন। তারপর মাথায় আশীর্বাদের হাত বুলিয়ে চলে যেতেন। কী মাইনে পেতেন ভদ্রলোক? তখন গয়েরকাটার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন দুর্গাপদ মুখার্জি। সামান্য ফেরিওয়ালা থেকে প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। পাঠশালা চালাতে তাঁর ভূমিকা অবশ্যই ছিল। ওদিকে কাঠের করাতকল চালু হয়েছে। নিত্যগোপাল পাল যেমন অগ্রগণ্য ব্যবসায়ী তেমনই আরও কেউ কেউ এগিয়ে এসেছে। একসময় পাঠশালা উঠে গিয়ে প্রাথমিক স্কুল চালু হল। বৃদ্ধ ভবানী মাস্টার বাতিল হয়ে গেলেন। আমি তখন উঁচু ক্লাসের ছাত্র। গিয়ে শুনলাম ভবানী মাস্টার অসুস্থ। তাঁকে দেখতে গেলাম কলোনির বাড়িতে। অভাব তার সবকটা দাঁত-নখ বের করে বসে আছে। আমাকে দেখে অতি শীর্ণ শরীর নিয়ে উঠে বসে জড়িয়ে ধরলেন, ‘বাবা বড়ো হও, অনেক বড়ো’। আশ্চর্য ব্যাপার, তখনও তাঁর শরীর থেকে ঘামের গন্ধ বের হচ্ছিল কিন্তু সেটা আমার মনে একটুও বিরক্তি তৈরি করল না।
এখনও গন্ধটাকে মনে পড়ে, কী একটা নেই? আমার বন্ধু শিবু, তপন, দুলু তাঁকে শেষ যাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল বলে শুনেছি। এই তিনজনই আজ পৃথিবীতে নেই। অথচ গয়েরকাটা রয়ে গেছে গয়েরকাটাতেই। শুধু মানুষ বেড়েছে। ফুটপাতে বাজারের বদলে সেলুন হয়েছে। বাগানের ভিতর যে আংরাভাসা নদী বয়ে যেত সেটা বন্ধ করে দিয়েছে সুইসগেট। যখন হেঁটে যাই তখন চারপাশে অচেনা মানুষের মুখ, কিন্তু মাটি-গাছ আর রাস্তাগুলো একই থেকে গেল। আমার মতো।
৫৬
এই লেখার নামকরণ নিয়ে কারও কোনও আপত্তি থাকতেই পারে। উত্তরবঙ্গ সংবাদের চিঠিপত্র-কলমে চিঠিও বেরিয়েছে। আমি আবার ঘরে ফিরলাম কবে? আমি তো কলকাতার লোক। কলকাতায় পড়তে গিয়েছিলাম জলপাইগুড়ির জেলা স্কুল থেকে পাস করে। সেই যে কর্পোরেশনের জল পেটে পড়ল অমনি আমার শরীর মন থেকে জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি-কোচবিহার হাওয়া হয়ে গেল। পত্র লেখকের বক্তব্য, আমি এখন ট্যুরিস্ট। অবরে শবরে যাই, মজা দেখে ফিরে আসি।
বয়স যখন কম ছিল তখন রাগ হত, তর্ক করতাম। এখন মজা লাগে। গত সপ্তাহের ছ’টা দিন আমি গয়েরকাটা আর সুভাষিণী চা বাগানে ছিলাম। এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি পঁয়ষট্টি সালে রংপুর ছেড়ে চলে এসে জলপাইগুড়িতে পাকাপাকিভাবে বাস করছেন। রংপুরে তাঁদের কী কী ছিল তার গল্প শোনাচ্ছিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখানে তো আপনি আটচল্লিশ বছর আছেন, নিজেকে বিদেশি বলে মনে হয়?’ ভদ্রলোক হকচকিয়ে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার দেশ কোথায়?’
‘এখন এটাই আমার দেশ।’
‘এটা মানে কী?’
‘জলপাইগুড়ি।’
‘জলপাইগুড়ি তো একটা দেশের নাম হতে পারেন না।’
‘ও, পশ্চিমবাংলা।’
‘উহুঁ, ওটাও কোনও দেশ নয়। দেশটার নাম ভারতবর্ষ। আমি ভারতবর্ষের নাগরিক, ভারতবর্ষ আমার দেশ এই সত্যিটা বেশিরভাগ মানুষের জিভে চট করে আসে না। ভেবে দেখুন পূর্ববঙ্গের মানুষ, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ খুব বেশি যুগ আগে শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি-কোচবিহার আসেননি। যখন এসেছিলেন তখন এখানকার আসল বাসিন্দারা, রাজবংশীরা, তাঁদের বিদেশি ভেবেছেন। কিন্তু সময় সব মিলিয়ে দিল। ক্রমশ আদি বাসিন্দারা পিছিয়ে পড়লেন। মদেশিয়ারা চা বাগানের কাজে রাঁচি-হাজারিবাগ থেকে এসে থেকে গেছেন এখানেই। ওঁদের দেশ অবশ্যই ভারতবর্ষ। তা হলে আর সমস্যা থাকে না। আমি জলপাইগুড়িতে থাকি অথবা কলকাতায়, আমার শরীর ভারতবর্ষেই আছে।’
ভদ্রলোক কী বুঝলেন জানি না।
কিন্তু মন তো শরীরের মতো পাঁচজনকে দেখানো যায় না। আমি বাইরের লোক না ভিতরের তা বোঝানোর দায় আমার নেই। এই তিপ্পান্ন বছর ধরে যখন জলপাইগুড়ি বা গয়েরকাটাতে আসি, তখনই পৌঁছে যাই বাল্যকালে। এখানকার প্রতিটি রাস্তার বাঁক, হরেক দোকানগুলো আমার মনে গাঁথা, এসে শুধু ঝালিয়ে নেই। নতুনগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে সময় লাগে না। যে স্টেশনারি দোকানে অনিলদা বসতেন এখন সেখানে তাঁর নাতি বসে। ওকে পাঁচ বছর বয়স থেকে চিনি। কদমতলার চৌধুরি মেডিকেল স্টোর্সের মালিক রায়চৌধুরি আমাদের প্রশ্রয় দিতেন। সতেরো বছর বয়সে তাঁর দোকানের পিছনে বসে লুকিয়ে একটা সিগারেট দুই বন্ধুতে টানতাম। এখন রায়-দার বয়স বেড়েছে, সেই সঙ্গে অসুখবিসুখ। ছেলে দোকান সামলায়। আমাকে কাকু বলে। রায়দা কোনওমতে দিনে ঘন্টা খানেক কাটিয়ে যান। পিছনের ঘরটা এখনও আছে। আমার মনও সেখানে পাক খায়। রাস্তায় হাঁটি, দাদা-কাকাদের খোঁজ নিই। বেশিরভাগই চলে গেছেন। কষ্ট জমে বুকে। কই, এই কষ্ট তো কলকাতার রাস্তায় হাঁটলে হয় না।
গত মঙ্গলবার রায়কতপাড়ায় অজিত নাগের বাড়িতে ভরদুপুরে হাজির হয়ে দেখলাম, তপন এবং তুলসি এসেছে। প্রত্যেকের শরীর পাল্টেছে। আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়তাম। সেই ক্লাস থ্রি থেকে। আড্ডা জমলে দেখা গেল আমরা মাস্টারমশাইদের গল্প করছি। ভূগোলের সুশীলবাবু, সুধাময় রায়, প্রশান্তবাবু, বেণুদা থেকে গেমস টিচার শিশিরবাবু আর তাঁদের নিয়ে চুটকি গল্পে এমন মেতে উঠলাম যে, আমরা এই বয়সেও ছাত্র।
অজিত ছিল আমাদের ক্যাপ্টেন। একটু গম্ভীর প্রকৃতির। বাহাত্তর বছরের অজিত ও তার স্ত্রী আলাদা ঘরে শোয় শুনে তপন আমাকে দায়িত্ব দিল ওদের শোয়ার ঘর এক করার। অজিতের অনুপস্থিতিতে ওর স্ত্রীকে ডেকে বললাম, ‘আপনি কি জানেন, কাল রাত তিনটের সময় অজিতের খুব শরীর খারাপ হয়েছিল!’ ভদ্রমহিলা হতভম্ব, কিছুই জানেন না। বললাম, ‘একসঙ্গে শুলে জানতে পারতেন, সাহায্য করতেন।’ তিনি বললেন, ‘ও যে ফ্যান চালাতে দেয় না, ফ্যান ছাড়া শুতে পারি না।’ বললাম, ‘এক পয়েন্টে চালাবেন। ফ্যান বড় না স্বামী?’ ভদ্রমহিলা আর আলাদা শোবেন না বলে তার মুখ দেখে মনে হয়েছে। এই যে রসিকতা অথবা ঘনিষ্ঠতা, তা কলকাতার কোনও পরিচিত দম্পতির সঙ্গে করার কথা মনেই আসে না। মাস্টারমশাইরা চলে গেছেন কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে তাঁরা বেঁচে। তুলসি হঠাৎ বলল, ‘তোদের বিউটিকে মনে আছে? স্কুলের পাশে বাঁধের উপর দিয়ে হেঁটে যেত!’ সবাই মাথা নাড়লাম, ‘মনে আছে, মনে আছে।’ তুলসি বলল, ‘সেই বিউটির এখন দুই নাতনি। ওদের নিয়ে বিকেল বেলায় আঁকার স্কুলে যায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।’
‘খুঁড়িয়ে কেন?’ জিজ্ঞাসা করলাম।
‘মোটা শরীর, বোধহয় বাতে কষ্ট পাচ্ছে।’ তুলসি বলল।
আমাদের মনখারাপ হয়ে গেল। কী সুন্দর ফিগার ছিল বিউটির। কিন্তু আমরা কেউ আয়নার সামনে দাঁড়ালাম না। ওই আড্ডায় সবাই যেন পনেরো বছরের তরুণ। ওই স্মৃতির বাগানে কলকাতার কোনও ফুল নেই।
আংরাভাসা নদীকে নিয়ে অনেক গল্প লিখেছি। উত্তরাধিকার উপন্যাসে তো অনেকখানি রয়েছে নদীটা। গয়েককাটার সুব্রত পাল আমার ছোট ভাইয়ের মতো। ওকে বলেছিলাম, একটা জমি কিনব আংরাভাসার গায়ে। গয়েরকাটা থেকে ডুডুয়া যাওয়ার পথে হাইওয়ে থেকে পাঁচ মিনিট ভিতরে ঢুকে ও যে জমিটা দেখাল, তাকে ঘিরে কাস্তের মতো বাঁক নিয়ে বয়ে গেছে আংরাভাসা নদী। মাঝের জমিটা উঁচু ঢিবির উপরে। খুব ভাল লাগল দেখে। বন্ধুরা বলল, ‘নার্সারি থেকে গাছ তুলে জমিতে বসানোর পর যে শিকড় ছড়ায় তাকে আবার তুলে নার্সারির জমিতে বসানো যায় না।’ কথাটা ঠিক। কিন্তু গাছের শিকড় আর মনের শিকড় কি এক?
৫৭
মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি। এই লাইনটা আমরা খুব আওড়াতাম। বাড়ি জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ায়। সামনে কোচবিহারের মাঠ। তারপরে সেই চওড়া তিস্তা নদী। তখনও নদীর গায়ে বাঁধ তৈরি হয়নি। বর্ষা এলেই তিস্তা চলে আসত মাঠ ডিঙিয়ে বাড়ির বাগান, কখনও ঘরের ভিতরে। জল নেমে গেলে একটা দিন লাগল পলি পরিষ্কার করতে। সাদা কাপড় গেরুয়া হয়ে যেত। আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। প্রতিবছর দু’-তিনবার ওই ফ্লাড ফ্লাড খেলা আমাদের আনন্দে রাখত। স্কুল বন্ধ তো বটেই। আমরা বড় গামছা জলের স্রোতে ডুবিয়ে ট্যাংরা মাছ ধরতাম। দেড়-দুই ইঞ্চির ট্যাংরা, যা তিস্তা ছাড়া অন্য কোনও নদীতে দেখিনি। ধরলেও তাদের ফেলে দিতে হত। তিস্তা আর নর্দমা এক হয়ে যাওয়ায় বড় পিসিমা ওই মাছ রান্নাঘরে ঢোকাতেন না।
কিন্তু ওই বন্যায় আমরা অভ্যস্ত ছিলাম বলে, ‘মারী নিয়ে ঘর করি’ বলতে খুশি হতাম। হাসপাতালপাড়া, সমাজপাড়া জলের তলায়, কাছারিও। সুযোগ তৈরি করে একবার জলভাসি শহর ঘুরে আসতে খুব মজা লাগত। বাড়ির পাশেই যে টাউন ক্লাবের ফুটবল খেলার মাঠ, মনে হত বিশাল দিঘি। তারপর তিস্তার গায়ে বাঁধ দেওয়া হল, তিস্তার উপরে গাড়ি চলাচলের মজবুত ব্রিজ তৈরি হল। ফলে বর্ষায় জল আসার পথ বন্ধ। যত বৃষ্টি হোক আমাদের বাগান খটখটে। করলার জল একটু বেড়ে হাসপাতালের রাস্তায় কয়েক ঘন্টার জন্য চলে আসত বটে, কিন্তু সেই জলের সঙ্গে পলি মিশে থাকত না। ওপাড়ার ছেলেরা করলার পথভোলা মাছ ধরত পরম আনন্দে।
আটচল্লিশ থেকে ষাট সাল কেটেছিল হাকিমপাড়ায়, ওই বাড়িতে পিতামহ এবং বড়পিসিমার সঙ্গে। কলকাতায় পড়তে গিয়ে বছরে তিনবার সেই যে আসা-যাওয়া শুরু হল তা এখনও চলছে। করলা ধীরে ধীরে মজে যাচ্ছে, তিস্তার চেহারা বছরের বেশিরভাগ সময় দুর্ভিক্ষপীড়িত হাড় জিরজিরে মানুষের মতো। জল সরতে সরতে বহুদূরে। সাহসীরা বাখারির ঘর বানাচ্ছে বাঁধ ঘেষে, তিস্তার চরে। তারপর এল আটষট্টি সাল। সে রাতে তিস্তা জলপাইগুড়ি শহরকে দুমড়ে মুচড়ে তছনছ করে একশো বছর পিছিয়ে গেল।
পুজোর পরে পিতামহের কাছে গিয়ে ক’দিন ছিলাম। লক্ষ্মী পুজোর আগে সকালে জলপাইগুড়ি থেকে চা বাগান যাওয়ার আগে কথা হল, কলকাতায় ফেরার আগে দু’দিন থেকে যাব। সেই সকালে যখন জলপাইগুড়ি থেকে গয়েরকাটার বাসে উঠেছিলাম তখন চারিদিক খুব শান্ত। ব্রিজ পার হতে হতে দেখলাম তিস্তায় একটু জল বেড়েছে। কিন্তু আমাদের ছেলেবেলায় দেখা সেই ভয়ংকর ঢেউয়ের তিস্তার সঙ্গে এর কোনও তুলনাই করা যায় না।
জলপাইগুড়ি থেকে মাত্র পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরের গয়েরকাটায় সেই রাত্রে খুব বৃষ্টি হয়েছিল। সেই জল আংড়াভাসা নদী টেনে নিয়ে ফেলেছিল ডুডুয়ায়। কিন্তু ভোর রাত্রে খবরটা চলে এল, জলপাইগুড়ি শহর আর নেই। তিস্তা ভয়ংকর মূর্তিতে বাঁধ ভেঙে শহরটা গিলে ফেলেছে। শহর নেই মানে পিতামহ আর বড়পিসিমাও নেই। খবরটা কানে যেতে বাবা অজ্ঞান হয়ে গেলেন। খুব ভালবাসতেন তিনি তার বাবা এবং বড়দিকে। জ্ঞান ফিরলে তিনি তখনই জলপাইগুড়িতে যেতে চাইলে আমি বাধা দিলাম। বললাম আমি বন্ধুদের নিয়ে যাচ্ছি, তাঁর যাওয়ার দরকার নেই।
শুনলাম আলিপুরদুয়ার বা ফালাকাটা থেকে যেসব বাস জলপাইগুড়িতে যায় সেগুলো আজ বন্ধ। নাথুয়া থেকে যেটা জলপাইগুড়িতে যাচ্ছে সেটায় উঠলাম। খালি বাস। কিন্তু ডুডুয়া ব্রিজ পার হয়ে জলঢাকায় আসতেই বুঝলাম তাণ্ডব থেকে এই জায়গাগুলোও পুরো রক্ষা পায়নি। ময়নাগুড়িতে ঢোকার মুখে ব্রিজ-ভেঙে গেছে। বাস যাবে না। এর মধ্যে নৌকার ব্যবস্থা হয়েছে। ময়নাগুড়ি থেকে হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তার দু’পাশে জল, কখনও কখনও রাস্তার উপরে হাঁটু পর্যন্ত স্রোত চলছে। মৃতদেহ দেখতে পাচ্ছিলাম। দু’পাশের গ্রাম ভাসিয়ে নিয়েছে মাঝরাতের তিস্তার জল। হঠাৎ চোখে পড়ল একটি যুবতীর মৃতদেহের দিকে। রাস্তার পাশে সামান্য কিছু জায়গায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে। শরীরে সুন্দর শাড়ি, হাতে শাঁখা, নোয়া এবং সরু সোনার চুড়ি। গ্রামের কিছু মানুষ সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন বিধবস্ত হয়ে। তাদের মুখে শুনলাম, বউকে বাঁচাতে না পেরে যুবতীর স্বামী পাশের গাছে উঠে গলায় দড়ি দিয়েছে। তাকেও দেখতে পেলাম। ভয়ংকর দৃশ্য।
জল ভেঙে ভেঙে যখন তিস্তা ব্রিজে উঠে এলাম ব্রিজ অটুট আছে। কিন্তু জলপাইগুড়ি শহরের দিকে যে বাঁধ ছিল তা ভেঙে উড়ে গেছে। নিচে তিস্তার ঢেউগুলো ফুঁসছে। পাহাড়ের কোনও লেক বৃষ্টির জলের চাপ সহ্য করতে না পেরে ভেঙে গিয়ে নিচে নেমে এসেছিল তীব্র গতিতে। বাঁধ উড়িয়ে দিয়েছিল এক লহমায়। হড়পা বান কথাটা তখনও চালু হয়নি। কিন্তু সেই বিপুল জলরাশি নিমেষে শহরটাকে তছনছ করে দিয়েছিল মধ্যরাত্রে। মেঘ ঢেকে রেখেছিল কোজাগরীর চাঁদকে। ঘুম ভেঙে মানুষ চারপাশে শুধু জল দেখেছিল।
আমরা বাঁধের যেদিকটা তখনও অটুট, তার উপর দিয়ে হেঁটে সেন পাড়া পেরিয়ে জেলা স্কুলের পাশে চলে এলাম। জল নেমে গেলেও দেয়ালে যে দাগ রেখে গেছে তা দেখে আঁতকে উঠলাম। অত উঁচুতে জল বয়ে গেলে পিতামহ, বড়পিসিমা বেঁচে থাকতে পারেন না। দূর থেকে বাড়িটাকে ধবংসস্তূপ বলে মনে হচ্ছিল। মাঠের পলি ভেঙে কোনওমতে ভাঙা তারের বেড়ার কাছে পৌঁছে দেখলাম ওটা দুমড়ে গেছে। চোখে পড়ল একটি বালকের মৃতদেহ আটকে আছে জালে। বড়পিসিমার ঘরের দরজা খুলে দেখলাম তিনি শুয়ে আছেন চিৎ হয়ে। তার মুখে কালশিটে। জ্ঞান ছিল। জানলাম জল ঘরে ঢুকলেও তিনি প্রায় বুঝতে পারেননি। তাকে নিয়ে জল খাটশুদ্ধু উপরে উঠেছিল। ছাদের নিচে পৌঁছনোর পর তার বিক্রম থেমেছিল। কিন্তু সেই ছাদের চাপে মুখে কালশিটে পড়েছে। আর আধ ইঞ্চি জল বাড়লে তার শরীর চূর্ণ হয়ে যেত। পিতামহকে আবিষ্কার করলাম বাড়ির ছাদে। সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে প্রায় জড়ভরত হয়ে গেছেন। দু’জনকে চেয়ারে বসিয়ে ওই পলিকাদা ভেঙে নিয়ে এসেছিলাম ময়নাগুড়িতে। আসার পথে সেই ভয়ংকর দৃশ্য চোখে পড়ল। যুবতী বউটির মৃতদেহ তখনও পড়ে আছে। কিন্তু শরীরে একটুকরো সুতো নেই। জামাকাপড়, শাঁখা, নোয়া জীবিত মানুষেরা খুলে নিয়ে গিয়েছে। নদী মাঝে মাঝে ভয়ংকর হয় কিন্তু মানুষের মনে মায়া-মমতাহীন এক নির্মমতা কখন জানান দেবে তা সে নিজেই জানে না।
তিস্তা এখন জরাজীর্ণ। তার যৌবনের দিন শেষ। সভ্যতা তাকে বেঁধে ফেলায় সে ওই একবারই প্রতিশোধ নিতে পেরেছিল। এখন তার বুকে শুধুই শুকনো বালি যা দশ মাস বাতাসে ওড়ে। ‘মারী’ নিয়ে ঘর করার অহংকারের দিন শেষ।
৫৮
নদিয়ার গেদে গ্রাম থেকে স্কুলে শেষ পরীক্ষার সার্টিফিকেট নিয়ে একটি সতেরো বছরের তরুণ একশো দশ বছর আগে ভাগ্যান্বেষণে গিয়েছিলেন অসম। তখন খুব কম বাঙালি সেদিকে যেত। ভাগ্য সদয় না হওয়ায় ভাসতে ভাসতে নেমে এসেছিলেন ডুয়ার্সে। তখনও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিবাবুরা শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়িতে ভিড় জমাননি। ইংরেজরা যে চা বাগানগুলি চালাচ্ছিল তাতে শ্রমিকাভাব ছিল। রাজবংশী সম্প্রদায়কে তারা চা বাগানের কাজে পায়নি। অর্থাভাব থাকলেও তারা সরে থেকেছেন কারণ, যে গাছের পাতা, ফুল, ফল বা শিকড় মানুষের কোনও প্রয়োজন মেটায় না তার পরিচর্যায় গেলে শিব রুষ্ট হবেন বলে একটা ধারণা চালু ছিল। কেউ কেউ তো চা গাছকে ওই কারণে বিষ গাছ বলতেন।
সেই তরুণটি যখন গয়েরকাটায় পৌঁছলেন, তখন তার থাকা খাওয়ার জায়গা নেই। কিন্তু ভাগ্য তাকে সাহায্য করল এবার। একজন অবাঙালি কনট্রাক্টর তাঁকে নিয়ে গেল চা বাগানের সাহেব ম্যানেজারের কাছে। সাহেব কথা বলে খুশি। কারণ, সেই তরুণ ইংরেজিটা ভাল বলছিল। তিনি তরুণকে বাবুর চাকরি দিলেন। একটি টিনের চালওয়ালা, কাঠের দেওয়ালের বাড়িও তার জন্য বরাদ্দ হল। গয়েরকাটা চা বাগানে তখন বাবুর সংখ্যা পাঁচ। বাঙালি তিনজন। বাকি দু’জনের বাড়ি রংপুর জেলায়। গয়েরকাটা থেকে বাংলার ওই অঞ্চল বেশ কাছের ছিল।
ওই তরুণটি দীর্ঘকাল, চার দশকের বেশি চা বাগানে চাকরি করেছেন। অবসর নেওয়ার পর চার বছরের যে নাতিটিকে নিয়ে জলপাইগুড়ি শহরে বাড়ি করে শেষদিন পর্যন্ত ছিলেন তিনি আমার পিতামহ।
পিতামহের কাছে তৎকালীন চা বাগানের নানা কাহিনি শুনেছি। গয়েরকাটা বাজার এলাকায় মানুষের বসতি তেমন গড়ে ওঠেনি। কয়েক ঘর পূর্ববাংলার পরিবার সেখানে থাকতেন। কলোনি শব্দটা তখনও অপরিচিত ছিল। হাট ছিল রবিবারে। স্থানীয় শাকসবজি পাওয়া যেত। চালানি আসত কখনও সখনও। বড় মাছ পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। ফলে পিতামহ সঙ্গী জোগাড় করে ডুডুয়া নদীতে মাছ ধরতে যেতেন ছিপে হুইল লাগিয়ে। ডুডুয়াতে তখন কালবোস মাছ খুব পাওয়া যেত। পিতামহের ভাষায়, ‘তিন-চার কেজি মাছ ছিপে তুলতে হিমশিম খেয়ে যেতাম।’
চা বাগানের সাহেবরা থাকতেন বাগানের অনেক ভিতরের বাংলোয়। বিহার থেকে আসা মদেশিয়া শ্রমিকরা যেমন চায়ের কাজে শ্রম দিতেন তেমনই বাংলো পাহারায় থাকতেন। বিকেল ফুরিয়ে এলেই শুরু হত ভয়। কয়েকজন বাবুর কোয়াটার্সের আশপাশে জঙ্গল ছাড়া কিছুই নেই। সন্ধের পরেই যেখানে অসম রোড সেখানে বাঘের গর্জন শোনা যায়। বিদ্যুৎ নেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কেরোসিন তেল যা পাওয়া যেত তা কৃপণের মতো খরচ করতে হত। সন্ধের পরে কেউ ঘরের বাইরে পা বাড়াত না। অসম রোডে গাড়ি চলত না। যখন দরজায় বাঘের আঁচড় পড়ত তখন ভিতরে বসে টিন বাজাতে হত ভয় দেখানোর জন্য। তখন আড্ডা মারার জন্য গয়েরকাটায় কোনও ক্লাব তৈরি হয়নি।
আমি যখন চার বছরের তখন কোয়ার্টাসের চেহারা সুন্দর হয়ে গিয়েছিল। মাথায় টিনের ছাদ থাকতেও বাড়িটা ইট সিমেন্টের, প্রচুর গাছ গাছালিতে ভরা। সামনে সুন্দর মাঠ। মাঝখানে একটা স্বর্ণচাঁপার গাছ। অসম রোডে গাড়ি যাচ্ছে ঘন্টায় দশটা। কোনও জঙ্গল নেই। বাজার এলাকায় প্রচুর ঘরবাড়ি দোকান। তবে কলোনি তখনও তৈরি হয়নি। এই নিয়ে তুমুল উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল।
পিতামহের সঙ্গে জলপাইগুড়িতে পড়তে গেলেও ছুটি পেলেই আমি চা বাগানে চলে আসতাম। পঞ্চাশ-একান্ন সালেও বাগানের ম্যানেজার হিসেবে সাদা চামড়ার মানুষ দেখেছি। ওই সময়ের পরে প্রথম ভারতীয়, যিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হয়ে বাগানে এলেও তাঁকে সবাই বেশ সম্ভ্রমের চোখে দেখত। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর এটাও একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পিতামহ যখন বিদায় নিচ্ছিলেন তখন তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে কোয়ার্টার্সে এসেছিলেন ম্যানেজার। ভদ্রলোকের নাম মনে আছে, মিস্টার হে। স্কটল্যান্ডের মানুষ। ওই বয়সে আমার মনে হয়েছিল, ভদ্রলোক কত দূরের দেশে চাকরি করতে চলে এসেছেন! তাঁর মুখ দেখে শত্রু বলে মনে হয়নি। যদিও ইংরেজরা তখনও আমাদের শত্রু ছিল।
গত মাসে গয়েরকাটায় গিয়েছিলাম। যে কোয়ার্টার্সে জন্মেছি সেখানে এখন বুবু-জয়দীপ থাকে। আশপাশে আরও অনেক কোয়ার্টার্সে চা বাগানের কর্মীরা আছেন। সেই মাঠটা একইরকম রয়েছে। অসম রোডে এখন প্রতি মিনিটে কত গাড়ি চলে তার হিসেব নেই। বাজারের দিকে আসতে একটা ছোট সাঁকো পার হতে হত, যার নিচ দিয়ে খাল কেটে আংরাভাসার জল নিয়ে গিয়ে ফ্যাক্টরিতে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়েছিল। জলঢাকার বিদ্যুৎ পাওয়ার পর সেই খাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সাঁকো পার হতেই অজস্র দোকান। মুখার্জিদের স্টেশনারি দোকানে এককালে নিবারণ বিষ্ণু ম্যানেজারি করতেন। কলেজে পড়ার সময়ও আড্ডা মেরেছি। সেই চেহারা এখন ভাল লাগল না। কিছু নতুন দোকান হয়েছে একটার পর একটা।
আমার ছেলেবেলায় গয়েরকাটায় সেলুন ছিল না। ঠাকুরমশাই এসে চুল কেটে দিতেন। তাকেই ইটালিয়ান সেলুন চালাতে দেখতাম। এখন সেলুনে রেডিও বাজছে। টিভি সারাইয়ের দোকান রয়েছে। চৌমাথায় গেলে মনে হয়, আজকের কোনও মফসসল শহরে এসেছি।
গয়েরকাটায় পুজো হয় অনেকগুলি। রাজনৈতিক দলের সংখ্যা কম নয়। খুঁটিমারির জঙ্গলের গায়ে মধুবনী রিসর্ট হয়েছে। সেই রিসর্টের বাগানে গিয়ে চমকে গেলাম। দশ টাকার টিকিট কেটে জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়ে একটু নির্জন জায়গা খুঁজে নিয়ে প্রেম করছে। এত সাহস বোধহয় দশ বছর আগেও গয়েরকাটার ছেলেমেয়েদের ছিল না। তবে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ওরা এসেছে একটু বাইরে থেকে। অভিভাবকের চোখ এড়িয়ে এখানে এসে চমৎকার প্রেম করা যায়। সেই জন্যই আসা।
একশো বছরে দ্রুত পাল্টে গেল পরিচিত জায়গাটা। কিন্তু এত পরিবর্তন লন্ডভন্ড হয়ে যায়, যখন খাবারের আশায় দলে দলে হাতিরা বেরিয়ে আসে খুঁটিমারির জঙ্গল থেকে। এক পলকেই তারা একশো বছরের ধারাবাহিকতাকে ফিরিয়ে আনে।
মানুষ সময়ের সঙ্গে বদলায়। বনের প্রাণীরা সেই বদলের খবর রাখে না।
৫৯
জলপাইগুড়ির সেই দিনগুলো কী শান্তিতে ডুবেছিল। জিনিসপত্রের দাম তখনও ধরাছোঁয়ার মধ্যে ছিল, রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেনি। আমরা যারা ছাত্র ছিলাম তারা ঠিকঠাক ক্লাস করতে পারতাম। জলপাইগুড়িতে তখন দু’টো লাইব্রেরি ছিল। যেখানে বিকেল হলেই ভিড় জমত। বাবুপাড়া লাইব্রেরি আর বান্ধব পাঠাগারে বাংলা সাহিত্যের যাবতীয় সম্পদ পাওয়া যেত। লোক তখন বই পড়ত।
অনেকগুলো ফুটবল-ক্রিকেট ক্লাব ছিল যারা নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় রেখে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত। ছিলেন সত্যেন্দ্র প্রসাদ রায়। সবাই খ্যাঁদাদা বলে ডাকত তাঁকে। হাফহাতা পাঞ্জাবি আর ধুতি, মাথায় কদমছাঁট সাদাকালো চুলের মানুষটিকেও এখনও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই। অনেকগুলো চা-বাগানের মালিক হয়েও রোজ বিকেলে টাউন ক্লাবে হাজির হতেন। খেলার উন্নতির জন্যে সময় ও অর্থ খরচ করতেন নির্দ্বিধায়। ভাল ফুটবল খেলতেন। ওঁর পায়ের রেইনবো কিকের কথা নিশ্চয়ই প্রবীণদের মনে আছে।
পাড়ায় পাড়ায় গানের স্কুল ছিল। তরু রায়কত থেকে সৌমেন সিংহ রায়, লীনা ঘটক থেকে মানবেন্দ্র দাক্ষীর মতো সংগীতে নিবেদিত মানুষদের নিয়ে গর্ব করতাম আমরা। নাটক করতেন আর্য নাট্য সমাজের সদস্যরা। আরও অনেক দল। এই সব দেখে দেখে আমি বড় হয়েছি। আর সেইসঙ্গে বন্ধু অজিত রায়চৌধুরির দিদি আমাকে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাইয়েছিলেন। ভদ্রমহিলা কলকাতা থেকে প্রকাশিত অনেকগুলো পত্রিকা নিয়মিত রাখতেন। সেগুলো আমাকে পড়তে দিতেন, বলতেন, ‘এগুলো না পড়লে তুই নদীতেই পড়ে থাকবি, সমুদ্রের কথা জানবি না।’ প্রতিমাসে নিয়ে আসতাম পত্রিকাগুলো। হঠাৎ একটা নতুন পত্রিকা পেলাম, নরনারী। নিষিদ্ধ বস্তুর স্বাদ পেয়ে কান গরম হত। চোরের মতো ফেরত দিতে গিয়ে ধমক খেয়েছিলাম দিদির কাছে। ‘ওইরকম মুখ করে আছিস কেন? কোনও বই পড়া খারাপ নয়। খারাপটাকে না জানলে ভালকে বুঝবি কী করে?’ আমার তখন সবে গোঁফ উঠেছে, ‘চরিত্রহীন’ পড়া নিষেধ। নিষিদ্ধ কিছুর উপর আকর্ষণ সবসময় বেশি। দিদির কাছ থেকে শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন নিয়ে তিস্তার বাঁধে বসে এক দুপুরে কত কী পাব ভেবে পড়তে শুরু করেছিলাম। হতাশ হতে হতে বইটা বন্ধ করে ভাবছিলাম এইরকম সাধারণ কাহিনির নাম চরিত্রহীন রেখেছিলেন শরৎচন্দ্র। আর অভিভাবকরা বোধহয় না পড়ে শুধু নাম দেখেই বইটা না পড়তে আদেশ দিয়েছেন। তবু গল্প পড়ার টানে আর একটু এগিয়ে যেতে চমকে উঠলাম। ওই বয়সে আমার শরীরে কাঁটা ফুটল। কিরণময়ী দিবাকরকে চুমু খেল বলে নয়, চুমু খেয়ে, শরৎচন্দ্র লিখলেন, ‘খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।’ আমি সেই খিল খিল হাসিতে প্রথম যৌবনের গন্ধ পেলাম।
কী অদ্ভুত ভাললাগার মধ্যে কেটেছে সেই দিনগুলো। আমি থাকতাম হাকিম পাড়ায়। পাড়ায় সবাই সচ্ছল, শিক্ষিত। কোনও চিৎকার চেঁচামেচি ছিল না। ওরকম পাড়া আরও অনেকগুলো শহরে ছিল।
সেই সময় কয়েকটি পাড়ায় কয়েকজন দাদা ছিলেন। তখন মস্তান, হিরো ইত্যাদি শব্দ ব্যাপকভাবে চালু হয়নি। এই দাদারা পাড়ার সম্মান রাখার জন্য নেতৃত্ব দিতেন। কোনও তোলা আদায় নয়, কাউকে চাপ দিয়ে টাকা রোজগারের ধান্দা তাঁদের ছিল না। তাঁরা রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট ছিলেন না। এই দাদাদের দশ-পনেরো জন শিষ্য থাকত। কোনও বেপাড়ার ছেলে যদি তাঁদের পাড়ার মেয়েকে টাঙ্কি মারত তা হলে ক্ষেপে যেতেন দাদারা। টাঙ্কি শব্দটি তখন জলপাইগুড়িতে খুব চালু ছিল। অনেকদিন পরে এই লেখা লিখতে গিয়ে মনে এল। দাদা তখন তাঁর দল নিয়ে সেই বেপাড়ার ছেলেটিকে ঠ্যাঙাতে যেতেন। প্রায় প্রত্যেকের হাতে থাকত হকি স্টিক। বোমা, পাইপগান বা ছুরি জাতীয় অস্ত্র ব্যবহার করা হত না। ছেলেটি যে পাড়ার সেই পাড়ার দাদা তাঁর দলবল নিয়ে আক্রমণের মোকাবিলা করতেন। হইহই কাণ্ড। কয়েকজনের মাথা ফাটত, থানায় নিয়ে গিয়ে পুলিশ ব্যবস্থা করত। সব ঠিক হয়ে গেলেও ছেলেটিকে বলা হত ওই পাড়ায় পা না দিতে। এই যে পাড়ার সম্মান রাখার মহান কর্তব্যবোধ ওঁদের মনে যে আবেগ থেকে জন্মাত তা ধীরে ধীরে উধাও হয়ে গেল। মারপিট করতে করতে শহরের কে সেরা দাদা তা পাবলিক ভেবে নিত। এইসব দাদাদের অনেকেই পরবর্তী জীবনে সুস্থ জীবনযাপন করেছেন। কেউ ব্যবসা, কেউ চাকরি। এই মুহূর্তে যাঁদের নাম মনে আসছে তাঁদের মনেই রেখে দিলাম। তাঁর তো বটেই, তাঁদের ছেলেমেয়েরা অস্বস্তিতে পড়বেন।
শ্যামলদা,-শ্যামলকান্তি রায় সেই অর্থে দাদা ছিলেন না। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে বিকম পাস করে আসা শ্যামলদা ছিলেন রায়কত পাড়ার একটি বর্ধিষ্ণু পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। বাবা বিখ্যাত আইনজীবী, দাদা-ভাইরাও সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বাঁধাধরা জীবন শ্যামলদাকে টানত না। বোহেমিয়ান হতে গিয়ে সেই সময়ের জলপাইগুড়ি শহরে তিনি যেসব নিয়ম ভেঙেছিলেন তা অনেকেই সমর্থন করেনি। বিশেষ করে যাঁরা শৃঙ্খলা পছন্দ করেন। শ্যামলদার বাবাও সেই দলে ছিলেন। শ্যামলদার সঙ্গে তাঁর কয়েকজন শিষ্য সবসময় ঘুরতেন। তখন বুঝিনি, এখন মনে হয়, শ্যামলদা হতাশায় আক্রান্ত হয়ে মেকি সভ্যতাকে আঘাত করতে এমন সব মানুষের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছিলেন যাদের অসামাজিক বলা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শ্যামলদা আচমকা উধাও হয়ে যান। একটি বোহেমিয়ান মানুষের উধাও হওয়া নিয়ে প্রথমে কথা ওঠেনি। বেশ কিছুদিন পরে জলপাইগুড়ির কিছু দূরে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি তিস্তার একটি শাখানদীতে যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল ফুলে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় চেনা যাচ্ছিল না, সেই মৃতদেহ জলপাইগুড়ির মর্গে নিয়ে আসা হলে প্রচারিত হল ওটা শ্যামলদার শরীর। পুলিশের অনুরোধে শ্যামলদার পুরো পরিবার মর্গে গিয়ে মৃতদেহকে শ্যামলদার বলে আইডেন্টিফাই করতে পারলেন না। গল্প চালু হল, যুদ্ধের সময় জলপাইগুড়ির কয়েকজন ছেলে পূর্ব-পাকিস্তানের একটি ব্যাঙ্ক লুঠ করে কোটি টাকা নিয়ে ফিরে আসছিল। তাদের মধ্যে একজন সততা দেখাতে তাকেই খুন করে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। বেওয়ারিশ লাশকে পুড়িয়ে দেওয়ার সময় যারা সাক্ষী ছিল তাদের স্পষ্ট বিশ্বাস ওটা শ্যামলদারই দেহ। শ্যামলদার সঙ্গে যারা উধাও হয়েছিলেন তাঁরা পরে ধনী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। শ্যামলদার পরিবার তাঁকে কেন চিনতে পারলেন না, তা নিয়ে জলপাইগুড়ির মানুষ একসময় দুভাগে বিভক্ত হয়েছিলেন।
সেই সময় ওই অত শান্তির জীবনেও শ্যামলদার চরিত্র আমার কাছে আকর্ষণীয় ছিল। বুঝেছিল নিয়মে যাঁরা থাকেন, তাঁরা দৃষ্টি আকর্ষণ করেন না। নিয়ম ভেঙে যাঁরা বর্ণময় জীবনে খুশি থাকেন তাঁরা হয়তো বেশিদিন বাঁচেন না কিন্তু একটা দাগ রেখে যান।