গীতবিতান ছুঁয়ে বলছি ২.৪০

৪০

কানাডার পার্লামেন্টে বন্দুক দিয়ে হামলা করতে নিয়ে নিহত হল যে উগ্রপন্থী তার নাম এখনও জানি না কিন্তু মুখের চেহারাটা আমাদের চেনা হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত উগ্রপন্থীর চেহারায় কোনও পার্থক্য নেই। ভারতের সংসদের ভেতরে যারা হামলা করে নিহত হয়েছে তারাও একই গোত্রের। কিন্তু এই যে মানুষগুলো যখন একটা হামলার পরিকল্পনা করে তখন তারা নিশ্চিত জানে সাফল্য পেয়ে জীবন্ত ফিরে আসতে পারবে না। মুম্বইতে যারা পাকিস্তান থেকে সমুদ্রপথে এসে ব্যাপক হামলা চালিয়েছিল তাদের যতই প্রলোভন দেখানো হোক, ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না জেনেও তারা এসেছিল। এই ব্যাপারটা সত্যি অদ্ভুত।

মানুষ যখন বেপরোয়া হয়ে কিছু করে তখন বুঝতে হবে তার পেছনে কোনও আদর্শ কাজ করছে অথবা মস্তিষ্ক অস্থিরতায় আক্রান্ত। ক্ষুদিরামকে বলা হয়েছিল বোমা মারতে। শোনামাত্র ক্ষুদিরাম ছুটে যায়নি। ইংরেজ শাসকদের শাসন থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার চিন্তা অবশ্যই তার মাথায় ছিল। এই ভাবনার আবেগে ধরা পড়ে গেলে কী হবে তা নিশ্চয়ই ক্ষুদিরাম চিন্তা করেনি। দেশকে বিদেশির শাসন থেকে মুক্ত করার জন্যে বিপ্লবীরা যখন আত্মদান করেন তখন তাঁদের শহিদ বলতে আমাদের দ্বিধা আসে না। আবার এখানেই কিছু গোলমাল দেখা দেবে যদি ইংরেজ শাসনের সময় কোনও ভারতীয় বিপ্লবী লন্ডনের রানির প্রাসাদে বোমা ছুড়ত, সঙ্গে সঙ্গে তাকে উগ্রপন্থী হিসাবে চিহ্নিত করা হত। যে সব সৈনিক দেশের জন্যে যুদ্ধ করে মারা যান তাঁরা তা জেনেশুনেই গিয়ে থাকেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যে সব আমেরিকান সৈন্য মারা গিয়েছেন তাঁদের নামের তালিকা ওয়াশিংটনের শহিদ বেদিতে লেখা রয়েছে। কিন্তু ভিয়েতনামীদের কাছে তাঁরা কখনওই শহিদ নন, আক্রমণকারী। দেশকে রক্ষা করতে একজন নিহত ভিয়েতনামী অনেক বেশি সম্মান পেয়ে থাকেন।

কিন্তু একথাও সত্যি, মানুষ যখন জেনেশুনে এমন কাজ করে যার পরিণতিতে সে বেঁচে নাও থাকতে পারে তখন বুঝতে হবে তার মধ্যে একটা উন্মাদনা কাজ করছে। সেই উন্মাদনা তাকে বাস্তব চিন্তা থেকে সরিয়ে রেখেছে। যে সৈনিক কাশ্মীরের উঁচু পাহাড়ের নির্জনে বরফের মধ্যে দিনরাত পড়ে থাকে সে কি শুধু মাসের শেষে মাইনে পাবে বলে চাকরি করে? ওই মাইনের মতো রোজগার সে অবশ্যই সমতলে নিরাপদে করতে পারত, না পারলেও তার জীবন অনেক বেশি নিরাপদ থাকত। কিন্তু সেই হিম বরফে রাইফেল হাতে নিয়ে যখন সে ভাবে আমার উপর ভারতের নিরাপত্তা নির্ভর করছে তখন তার রক্ত গরম হয়ে ওঠে, সে তখন আলাদা মানুষ হয়ে ওঠে।

উল্টোদিকে পাকিস্তানি হানাদাররা বা ভারতের উগ্রপন্থীরা যখন ধবংস করতে হানা দেয় তখন বিশেষ মতলববাজরা তাদের মন ওয়াশ করে পাঠায়। আচমকা হামলা করে কিছু মানুষকে মেরে ফেলে তাদের কোনও ব্যক্তিগত লাভ হবে না জেনেও উন্মাদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা ওই কারণেই। যারা এই ব্রেন ওয়াশ করে তারা অত্যন্ত চতুর এবং দক্ষ। তা না হলে এভাবে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হত না।

ভারতবর্ষে নকশাল আন্দোলন যাঁরা শুরু করেছিলেন তাঁরা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। পার্লামেন্টকে শুয়োরের খাঁচা বলা বা বন্দুকের নলই শক্তির উৎস বলে তরুণ রক্তকে উদ্বুদ্ধ করাটা সেই সময় সহজ ছিল। কারণ সেই সময়ের রাজনৈতিক বাতাবরণ তরুণদের ক্ষুব্ধ করেছিল। কিন্তু দেশের শিক্ষিত সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি এবং সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও যে প্রচুর তরুণ বিপ্লবের নেশায় উত্তাল হয়েছিল তার কারণ আবেগ তাদের আবিষ্ট করেছিল। ওই আন্দোলন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন পায়নি। চাকু দিয়ে তলোয়ারের সঙ্গে লড়াই সম্ভব নয় বোঝার আগেই আন্দোলন শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই হতাশ মুখগুলো কি পরের প্রজন্মকে শিক্ষা দিতে পেরেছিল?

নকশাল আন্দোলন শেষ হওয়ার অন্তত কুড়ি বছর পরে মাওবাদীরা আত্মপ্রকাশ করল। এযাবৎকাল তারা কোনও কোনও এলাকায় মানুষ মেরেছে, ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে, ডিনামাইট ফাটিয়েছে। কিন্তু কেন? দিনের পর দিন জঙ্গলে, জলায় লুকিয়ে থাকা, খিদের সময় খাবার না পাওয়ার কষ্ট সহ্য করে পুলিশের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে এরা কী মোক্ষ লাভ করতে চেয়েছে? এইভাবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলে নিজেকেই ধবংস করা হবে জেনেও কেন ঘর ছেড়ে ওরা জঙ্গলে ঢুকে গিয়েছে?

লক্ষ করলে দেখা যাবে, নকশাল আন্দোলনে যারা প্রথমে যোগ দিয়েছিল তারা স্কুল-কলেজের পড়াশোনা তো করেছেই, তার বাইরের শিক্ষাও অনেকের ছিল। কিন্তু মাওবাদী হিসাবে যারা ধরা পড়ছে তাদের বেশিরভাগই অনুন্নত সম্প্রদায়ের মানুষ যারা শিক্ষার আলো দেখেনি। অতি দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা, যাদের সমাজে সুস্থভাবে বাঁচার পথ খোলা নেই তাদের মনে সুস্থ সমাজব্যবস্থার ওপর একটা অভিমান অথবা বিদ্বেষ কাজ করত। ওরা যা পাচ্ছে, আমি তা পাচ্ছি না কেন? এই জ্বালাকে সুড়সুড়ি দিয়ে দলে টেনে নিয়েছে কিছু নেতা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম থেকে খাবার আদায় করতে অসুবিধা হচ্ছে না এবং সেই সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারের থ্রিল থাকছে। কী করছি, কেন করছি, তা জানার দরকার নেই। ফলে এই আন্দোলনও মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। পশ্চিমবাংলার শিক্ষিত ছাত্রসমাজকে এখন পর্যন্ত ওদের সঙ্গ নিতে দেখা যায়নি।

উত্তরবাংলায় কামতাপুরী আন্দোলনও একটা বিশেষ আবেগের ফসল। এই ভূখণ্ড আমাদের, পূর্বপুরুষরা এখানেই জীবন অতিবাহিত করেছেন, তাই এই জায়গার অধিকার আমাদের দিতে হবে। ভাবাবেগে সুড়সুড়ি দেওয়ার সময় প্রথমদিকে কাজ হলেও শেষে স্থিমিত হয়ে পড়েছে, তার প্রমাণ পেয়েছি।

এইসব আন্দোলনের সঙ্গে বর্ধমানে যা ঘটেছে তার কোনও সংশ্রব নেই। বাংলাদেশে জামাতরা এখন কোণঠাসা। আরবদেশের টাকায় সমৃদ্ধ ওই দল ধর্মের দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। আমরা জানি রাজনীতির চেয়ে ধর্ম অনেক বেশি শক্তিশালী। ধর্মের জন্যে শহিদ হলে স্বর্গবাস অবধারিত ভেবে নেয় যে মানুষ তাকে দিয়ে যে কোনও কাজ করানো সম্ভব। বর্ধমান, মালদহ, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি সীমান্ত জেলাগুলোতে ধর্মের ছদ্মবেশে অস্ত্র তৈরি করে তা বাংলাদেশে পাচার করার যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল তা শুরুতেই ধরা পড়ে যাওয়ায় বিপুল বিপর্যয় থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি। স্বামীকে বিস্ফোরণে নিহত হতে দেখেও স্ত্রী প্রমাণ লোপ করতে তার রক্ত মুছে ফেলছে যে মানসিকতা থেকে তা স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। উগ্রপন্থী যে কোনও আচরণ সুস্থ মানুষ করতে পারে না। হয় খাবারের লোভ দেখিয়ে, নয় বিপ্লবের নেশা চাপিয়ে অথবা ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদের অসুস্থ করা হয়।

৪১

প্রফেশনাল থিয়েটারের রমরমার যুগে আলাদা নাটক যেসব দল শুরু করে, তাদের ‘গ্রুপ থিয়েটার’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে তর্ক হতেই পারে, এই লেখায় আমি সেই তর্কে যেতে চাইছি না। লক্ষ করছি, আমাদের এই আলাদা থিয়েটারের গোড়া থেকে কর্তৃত্ব করে এসেছেন পুরুষরা। বিচ্ছিন্নভাবে কোনও-কোনও নাটকের পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন মহিলারা; কিন্তু তাঁদের সংখ্যা ধর্তব্য নয়। কিন্তু গত সাত দশক ধরে এই নাট্যচর্চায় যেসব মহিলার নাম উঠে এসেছে, থেকে গিয়েছে, তাঁদের অভিনয়-ক্ষমতার কথা ভাবলে শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করতেই হয়।

প্রথম নাম, অন্তত আমার কাছে, তৃপ্তি মিত্র। আমার দুর্ভাগ্য, আমি ‘নন্দিনী’-কে দেখার সুযোগ পাইনি। কিন্তু তারপর কোনও নাটক বাদ দিইনি। তা সে তরলাই হোক অথবা এলা-ই হোক। একক অভিনয় করেছেন মঞ্চ দাপিয়ে। মানুষ হিসেবে ওঁর গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠেনি কখনও। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা বলতেন। সাহস করে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনি যখন নাটক করতে এসেছিলেন তখন মধ্যবিত্ত বাঙালি আজকের মতো উদার ছিল না। আপনার সমস্যা হয়নি?’ খুব হেসেছিলেন। বলেছিলেন, ‘একটা পাহাড়ের আড়ালে ছিলাম তো, তাই ঝড়ঝাপটা গায়ে লাগেনি।’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, কিন্তু মঞ্চেই যে তাঁর রাজত্ব ছিল তা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে।

স্কটিশে যখন পড়তে এলাম, তখন কেয়া চক্রবর্তী পাস করে গিয়েছেন। গেলেও, ‘বসন্ত কেবিন’ অথবা ‘কসমস’-এ আসতেন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে। কলেজে এসে চিত্তরঞ্জন ঘোষমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। বেশ লম্বা, ঋজু চেহারার মানুষটির মধ্যে বাঙালি মেয়েদের লাজুক নরমভাব ছিল বলে মনে হত না। তখন এম.এ পড়তেন। সেই সময় ‘নান্দীকার’ হইচই ফেলে দিয়েছিল ”নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র” করে। অজিতেশ, রুদ্রপ্রসাদ এবং কেয়া চক্রবর্তীর নামের সঙ্গে ক্রমশ বাঙালি পরিচিত হচ্ছে। অজিতেশবাবু একলাফে জনপ্রিয় হয়ে গেলেন ‘হাটে বাজার’-এর সৌজন্যে। কেয়া চক্রবর্তীকে অপেক্ষা করতে হল ‘তিন পয়সার পালা’ পর্যন্ত। তারপর ‘ভালমানুষ’, ‘নটী বিনোদিনী’—নান্দীকারের একের-পর-এক নাটক। বাইরে গিয়ে শ্যামানন্দ জালানের পরিচালনায় ‘তুঘলক’ নাটকে শ্রদ্ধেয় শম্ভু মিত্রের সঙ্গে অভিনয় করে বাংলা নাটকে নিজের জায়গা প্রতিষ্ঠিত করেন। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হওয়ায় বাংলা নাটক বঞ্চিত হয়েছে।

‘চাকভাঙা মধু’ নাটকে মায়া ঘোষের অভিনয় হইচই ফেলল। আমরা বুঝলাম, বাংলা নাটকে একজন প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী এলেন। একের-পর-এক নাটক করে গিয়েছেন মায়া ঘোষ। এই সময়ের আর একজন অভিনেত্রীর নাম না-বললে ভুল হবে। তিনি মমতা চট্টোপাধ্যায়। মূলত ‘নক্ষত্র’ দলের নাটকে তাঁর অভিনয় দু’চোখ ভরে দেখার মতো ছিল।

এঁদের পরে এলেন শাঁওলি মিত্র। শাঁওলি বড় হয়েছেন অভিনয়ের পরিবেশে। ‘বহুরূপী’-র মতো একটি দল তাঁর পাশে ছিল। কিন্তু এরকম তো অনেকেরই থাকে। ক’জন আর শাঁওলি মিত্র হতে পারেন! দলগত নাটকের পরে একক নাটকে শাঁওলি যেন তাঁর মা’কে অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। ‘নাথবতী অনাথবৎ’ তাঁর অভিনয়ের একটি মাইলস্টোন। বড় আফসোস হয়, পরবর্তীতে তিনি নিজেকে ধীরে-ধীরে গুটিয়ে নিয়েছেন।

এই পর্বেই এলেন অনসূয়া মজুমদার। ‘বহুরূপী’-র ‘মৃচ্ছকটিক’ থেকে শুরু করে ‘চেনামুখ’ দলের একটার-পর-একটা নাটকে অনসূয়া নিজস্ব প্যাটার্নে যে-অভিনয় করে গিয়েছেন তা অনেকের স্মৃতিতে বহু দিন থাকবে। অন্তত ‘রানি কাহিনী’-র জন্য তো বটেই।

এই সময় এলেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। সত্যজিৎবাবুর ছবিতে অভিনয় করার কারণে তিনি নিশ্চয়ই আলাদা মাইলেজ পেয়েছিলেন। সেটা কখনওই নাটকের প্রচারে ব্যবহার করেনি ‘নান্দীকার’। ঠিক এই ব্যাপারটা আমরা দেখেছি নীলিমা দাসের ক্ষেত্রে। জনপ্রিয় ছবির অন্যতম নায়িকা হওয়া সত্ত্বেও মঞ্চে যখন চুটিয়ে অভিনয় করেছেন, তা পেশাদার মঞ্চেই হোক অথবা লিটল থিয়েটারের নাটকে—নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। দীর্ঘকাল স্বাতীলেখা এই কাজটি করতে চেয়েছেন। কিন্তু ক্রমশ অভিনেত্রীর বদলে নাট্যকর্মী হিসাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখছেন তিনি। বেশ কিছু দিন নাটক দেখার বাসনা আমার হয়নি। কেন হয়নি জানি না। খবর পাচ্ছিলাম, বিজ্ঞাপন দেখে বুঝছিলাম, নাটক প্রযোজনার ক্ষেত্রে অন্য হাওয়া লেগেছে। গ্রুপ থিয়েটারের অ্যামেচারিশ গন্ধ ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। দশ-পনেরো-কুড়ি টাকার টিকিট এখন দু’শো-আড়াইশোতে কিনতে দর্শকদের তাই আপত্তি হচ্ছে না। বিষয় পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে অভিনয়ের ধারাও।

বহু বছর পরে দেখতে গেলাম ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’-এর ‘বিয়ে গাউনি কাঁদন চাঁপা’। নামটিতে অভিনবত্ব আছে। বোঝাই যায়, পটভূমি শহরের নয়। বেশ ভাল লাগল। সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত একসময়

যথেষ্ট প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিলেন। সেদিন হয়তো তাঁর মন ভাল ছিল না। কিন্তু একটি মেয়েকে দেখে আমি অবাক হচ্ছিলাম। চমৎকার অভিনয় করছিল সে। মাঝে একটু বাড়াবাড়ি করলেও সেটুকু আমি উপেক্ষা করতে রাজি ছিলাম। কিন্তু মাত্র একটি অভিনয় দেখে কোনও অ্যাসেসমেন্ট করা ভুল হবে। শিল্পের সব ক্ষেত্রেই একটি কাজের পর হারিয়ে যেতে অনেককেই দেখেছি। জানলাম, মেয়েটি বিশেষ কোনও দলে অভিনয় না-করে অনেকগুলো দলেই করে থাকে। এই ব্যাপারটা আগে ছিল না। একটি দলের ‘শো’ না-থাকলেও অভিনেতা-অভিনেত্রীকে অন্য দলে অভিনয় করার অনুমতি দেওয়া হত না। গত এক দশকে বোধহয় পরিবর্তনটা হয়েছে।

এর পরেই দেখতে গেলাম চন্দন সেনের লেখা এবং পরিচালনায় ‘জাহানারা জাহানারা’ নাটকটি। প্রথম দৃশ্যেই চমকে উঠলাম। সেই মেয়েটি, যার নাম বিন্দিয়া ঘোষ, ঘুম ভাঙার পর যে-গলায় কথা বলছে বস্তির তক্তপোশে শুয়ে তা আমাকে বিদ্ধ করল। পুরো নাটক জুড়ে সে এবং তার ভয়েস অ্যাক্টিং, ফিজিক্যাল অ্যাক্টিং দেখে আমি মন্ত্রমুগ্ধ। এইভাবে নিজেকে ভেঙে আবার নতুন করে গড়ে আমি আজ অবধি কোনও অভিনেত্রীকে অভিনয় করতে দেখিনি। থানার হাবিলদারের শরীরের উপর লাফালাফি করে সংলাপ বলতে কখনওই ব্যালান্স হারায়নি বিন্দিয়া। যখন সে মাতাল, তখন তার দুই চোখকে টকটকে লাল করে রাখতে ভোলেনি। দেখতে-দেখতে মনে হচ্ছিল, এই মেয়ে যে বস্তিতে বাস করা স্বৈরিণীর ভূমিকায় দাপটে অভিনয় করছে তা এক মুহূর্তের জন্যেও সাজানো বলে মনে হচ্ছে না। আলাদা থিয়েটারের প্রথম শ্রদ্ধেয় অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র। এখন পর্যন্ত বিন্দিয়া ঘোষ তাঁর শেষ উত্তরাধিকারী।

৪২

গত রবিবার আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক খুব উত্তেজিত হয়ে ফোন করেছিলেন, ‘আপনি কি খবর রাখেন, আজ শনি ঘর বদল করবেন?’

আচমকা প্রশ্নটি শুনে হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিলাম, ‘আচ্ছা!’ ততক্ষণে বুঝে গিয়েছি এই শনি কোনও মানুষ নন, যিনি এই বাড়ির ঘর থেকে ওই বাড়ির ঘরে যাবেন! ইনি অবশ্যই শনিগ্রহ।

‘ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস সমরেশবাবু। আড়াই বছর পর শনি মঙ্গলের ঘরে যাচ্ছেন। মঙ্গলের কোন ঘরে জানেন? যেখানে বৃশ্চিক রাশি অধিষ্ঠান করছেন।’ ভদ্রলোক বললেন। তাঁর কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা স্পষ্ট।

বললাম, ‘খুব সিরিয়াস ব্যাপার, সন্দেহ নেই।’

‘সিরিয়াস বলে সিরিয়াস। কারও সর্বনাশ হয়ে যাবে, কারও ভাল হতে পারে।’

‘এই নির্বাচনটি কীভাবে হবে?’

‘এখন বৃশ্চিক রাশির লোকজনের উপর খারাপ প্রভাব পড়বে। আপনি কি অ্যাস্ট্রোলজি-র কোনও খবর রাখেন না?’

‘না, মানে!’

‘এই আড়াই বছর খুব মারাত্মক সময়। প্রথমে বৃশ্চিক রাশির উপর শনি-র নজর পড়বে। তারপর সেটা সরে যাবে তুলা রাশি এবং শেষে ধনু রাশির উপর। সর্বনাশ হয়ে যবে অনেক মানুষের।’ ভদ্রলোক বললেন।

‘এর প্রতিবিধান নেই?’

‘নিশ্চয়ই আছে। পুরোটা না-হোক, অর্ধেকটা রক্ষা করতে পারেন জ্যোতিষীরা। এই তো আজই একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। অত্যন্ত উচ্চমানের জ্যোতিষী।’

‘আপনি খুব কৌতূহলী মনে হচ্ছে!’

‘কৌতূহলী? কী বলছেন! আমি এখন মহাসমস্যায়। আমার রাশি যে বৃশ্চিক!’

ফোন ছেড়ে দিলেন ভদ্রলোক। মনে পড়ল, ওঁর বুড়ো আঙুল বাদ দিয়ে প্রায় সব ক’টাতেই আংটি দেখেছি। সেই সব আংটিতে এক-একটা পাথর। হিরেও আছে। আট আঙুলে পাথর পরে তিনি গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেন এতকাল। শনির এই ঘর-বদল তাঁকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। অর্থাৎ তাঁর আঙুলের ওই আটটি অস্ত্র এই নতুন শত্রুর মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে না বলে তাঁর ভয় হচ্ছে।

বাঙালি নরম মনের মানুষ। একটুতেই দুর্বল হয়ে পড়া তাদের স্বভাব। আর তার সঙ্গে ঈশ্বরভীতি যদি মিশে থাকে, তা হলে তো কথাই নেই! অষ্টপ্রহর কীর্তন করলে সংসারের ভাল হবে, অতএব বাঙালি অষ্টপ্রহর ধরে চিৎকার করে নামগান করল। দণ্ডি কেটে জল দিতে যাও, ভবিষ্যৎ ভাল হবে, বাঙালি রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ল। হাতে লালসুতোর বাঁধন পরলে বিপত্তারিণী মা সন্তুষ্ট হবেন, বাঙালি নির্দ্বিধায় পরে ফেলল। এই পরার শেষ নেই। মাদুলি, কবচ থেকে শুরু করে তাবিজ—সারা শরীরে আত্মরক্ষার বর্ম পরে বসে থাকতে স্বস্তি পায় বাঙালি। যারা বেশি দুর্বল, তারা শান্তিস্বস্ত্যয়নের মাধ্যমে নিজেকে শান্ত করতে চান। যাঁরা একটু শক্ত মনের তাঁরা শাক্তদের খোঁজ করেন। তান্ত্রিকের সন্ধান পেলে তাঁকে দিয়ে বাড়ি মন্ত্রপূত করে ফেললে আর দুশ্চিন্তার কিছু থাকে না।

এগুলো ছিল, আছে, থাকবে। বাঙালি জন্মইস্তক অভ্যেসে, সংস্কারে, ভাবনায়। কিন্তু ওই যে জন্মের পর কোষ্ঠী তৈরি করা হল, তার আওতা থেকে ক্রমশ নব্বই ভাগ বাঙালি বেরিয়ে গেলেও দশ ভাগ বেশ মজে রয়ে গিয়েছে। এই দশ ভাগের অনেকেরই তাঁর ছক মুখস্থ। কোন ঘরে কে সোজা হয়ে আছে, কে বক্রি, কে নজর ফেলছে কার উপর : এগুলো নিয়ে তাঁদের মস্তিষ্ক নাড়াচাড়া।

সম্প্রতি আমার পরিচিত একটি ছেলে, যে কি না অসাধারণ ছাত্র ছিল, ছয় অঙ্কের মাইনে নিয়ে বড় চাকরি করছে অথচ প্রেমে পড়েনি, তার বিয়ের জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত যে-মেয়েটিকে সবার পছন্দ হল সে শুধু সুন্দরী নয়, আর যা-যা গুণ থাকলে সম্মান করা যায়, তার সবই আছে। ছেলে এবং মেয়ে পরস্পরকে পছন্দ করার পর বিয়ের দিন ঠিক হওয়ার আগে ছেলের ঠাকুরদা মেয়ের কোষ্ঠী দেখতে চাইলেন। ওই পরিবারের কেউ কোষ্ঠী নিয়ে মাথা ঘামায় না বলে মেয়েটিরও কিছু ছিল না। কারও পরামর্শে ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটের একটা সেন্টার থেকে কম্পিউটারে কোষ্ঠী বের করে এনে পাত্রপক্ষকে দেওয়া হল। সেই কোষ্ঠী-বিচার করে ছেলেটির ঠাকুরদা রায় দিলেন, ‘এই বিয়ে হলে অশান্তির আগুন জ্বলবে, বিয়ে ভাঙবেই।’ ছেলেটি বিশ্বাস না-করলেও তার পরিবার বিরুদ্ধে যেতে পারেনি। বাধ্য হল ছেলেটি মেনে নিতে। শুনে মেয়েটি হেসে বলেছিল, ‘আমার ভাগ্য ভাল তাই একটি মেরুদণ্ডহীন পুরুষকে বিয়ে করতে হল না।’

আর একটি ঘটনা আমাকে খুব পীড়া দেয়। দুই কন্যা জন্ম নেওয়ার পরে মা যখন তৃতীয় কন্যাকে প্রসব করলেন, তখন জ্যোতিষী কোষ্ঠী-বিচার করে বললেন, ‘এই কন্যা বাড়িতে থাকলে সে পিতৃহত্যা করবেই।’ সঙ্গে-সঙ্গে ওই কন্যাকে ত্যাগ করে সন্তানহীন এক ভাইকে চিরতরে দান করে দেওয়া হল। সেই মেয়ে একদিন জেনেছে, যাকে সে বাবা ভেবেছে সে তার মামা, সে মুখ বুজে থেকেছে। যখন মেয়েটি চাকরি করছে, ‘আসল’ বাবা-মা’র তখন আর্থিক সঙ্গতি কমে এসেছে, তখন তাঁদের চৈতন্য হল। মেয়েকে ফিরে পেতে চাইলেন। মেয়ে বলল, ‘ফিরে গিয়ে যদি ইচ্ছে হয় শুধু বাবা কেন, মাকেও হত্যা করি তা হলে কী হবে?’

গ্রহ-নক্ষত্রকে হাতের মুঠোয়, গলা বা হাতের মাদুলিতে কব্জা করার প্রবণতা প্রায় আড়াইশো বছর ধরে এই বঙ্গভূমে চলে আসছে। বাড়িতে একজন মানুষ আমাদের শৈশবে এসেছিলেন। ভোরবেলায় স্নান সেরে তিনি আসনে বসে বলেছিলেন, ‘আমি জ্যোতিষী নই, আমি অ্যাস্ট্রোলজার।’ আমার পিতামহ পরম ভক্তিতে তাঁর করে দেওয়া কোষ্ঠী-বিচার গ্রহণ করেছিলেন। আমার কোষ্ঠী বিচার করে ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘জাতক স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিয়ে কারাবাস করবে?’ তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। যদিও এখনও আমি জেলখানা দেখিনি এবং না-দেখার যুক্তি হল, আবার জন্মমুহূর্ত লিপিবদ্ধ করতে নিশ্চয়ই একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল।

কথাসাহিত্যিক গজেন্দ্রকুমার মিত্রের ‘জ্যোতিষী’ গল্লটির কথা মনে পড়ছে। নিজের কোষ্ঠী-বিচার করে জ্যোতিষী জেনেছিলেন, তিনি মাতৃঘাতী এবং তাঁর স্ত্রী বিশ্বাসঘাতকতা করবেন। ঘটনা বা দুর্ঘটনাক্রমে তাই ঘটে গিয়েছিল। কিন্তু কিছু মানুষ, যাঁরা নিজেদের উপর ভরসা রাখতে পারেন না, তাঁরা এই গ্রহনক্ষত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাকে ব্যবহার বা প্রতিরোধ করার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। এর ফলে অনেকটা সময় নিজের অজান্তেই বেশ কেটে যায় তাঁদের।

গত রবিবারে শনি ঘর পাল্টেছেন বলে বিপদ বাড়বে বা সুখ আসবে, এই খবরটা যদি আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকার গরিব দেশগুলোর লোকজনদের জানিয়ে দেওয়া যেত, তা হলে জ্যোতিষশাস্ত্রের ব্যাপক চর্চা হত।

৪৩

ফিরছিলাম লস অ্যাঞ্জেলস থেকে নিউইয়র্ক। না, প্লেনে চেপে নয়, গ্রে হাউন্ড কোম্পানির বাসে। বাস টানা চললে প্রায় বাহাত্তর ঘন্টার বেশি বসে থাকতে হয়। বলা বাহুল্য, মাথায় পাগলবাবু ভর না করলে এত কষ্ট কেউ ইচ্ছে করে নেয় না। কেউ আমাকে বলেছিল, আমেরিকা দেখতে হলে তোমাকে ওয়েস্ট কোস্ট থেকে ইস্ট কোস্ট বা উল্টোটা বাসে চেপে যেতে হবে না। টানা যেও না, অসুস্থ হয়ে পড়বে। কয়েক ঘন্টা চলার পর নেমে রাত কাটিয়ে আবার কয়েক ঘন্টা যেও। সাতদিনের টিকিট একসঙ্গে কেটে নিলে বাড়তি পয়সা দিতে হবে না। ওই রাত কাটানোর আগে জায়গাগুলো ভাল করে দেখে নিতে পারবে।

টানা গেলে যে অসুস্থতা, সেটা কীরকম? তুমি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসের গদিতে বসে যাচ্ছো বটে কিন্তু জানলার বাইরে হয় মরুভূমির বালি অথবা ন্যাড়া মাঠ ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছ না। ফলে খুব দ্রুত একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হবে, একা থাকলে কথা বলার সঙ্গী পাবে না কারণ অপরিচিত যাত্রীরা গায়ে পড়ে কথা বলা লোককে পছন্দ করে না। চলতে চলতে তোমার মাথা ঘুরবে, মেজাজ রুক্ষ হবে, চেঁচিয়ে কথা বলবে অকারণে।

লস অ্যাঞ্জেলস থেকে চার ঘন্টা পরে লাস ভেগাস, সেখানে দিন-রাতের ক্যাসিনো দেখে আবার বাসে চেপে ফ্ল্যাগস্টপে নেমে গ্র্যান্ড ক্যানিউন দেখেছিলাম আংশিকভাবে। তারপর হপ করতে করতে দেখলাম আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে। ঠান্ডা বাড়ছে। বাসের বাইরে এলেই দার্জিলিং হার মানছে। চার ঘন্টা অন্তর গ্রে হাউন্ড বাস এই রুটে চলে। একটা বাস থেকে পাঁচ-সাত ঘন্টা ঘুরে বেড়িয়ে আবার অন্য বাসে চড়া যায়। এরকম একটা বাসে উঠে অবাক হলাম ছেলেটিকে দেখে। অকারণে চিৎকার করছে। ড্রাইভারকে গালাগাল করছে। চারপাশে বরফের রাজত্ব শুরু হয়ে গেল। জানলার বাইরে শুধু সাদা আর সাদা। ছেলেটা চোখ বন্ধ করে চেঁচাচ্ছে। এক সময় বাস থামিয়ে ড্রাইভার এগিয়ে এল। বিশাল চেহারার কালো মানুষটি ছেলেটিকে বলল, ‘আর একবার চেঁচালে নামিয়ে দেব বাস থেকে। ওই বরফে বাঁচতে পারবে তো?’

ছেলেটি দু’হাতে মাথা আঁকড়ে ধরে বলল, ‘আমি আর পারছি না। এক টানা বসে থাকতে পারছি না।’

‘নেমে যাও কোথাও।’ ড্রাইভার উপদেশ দিল।

‘কী করে নামব? আমার পকেটে মাত্র কুড়ি ডলার আছে। ওতে থাকা যাবে না কোথাও! তা ছাড়া আমার সিঙ্গল টিকিট, একবার নামলে আবার টিকিট কাটার ক্ষমতা নেই।’

‘সব ঠিক আছে, আমি আর চিৎকার শুনতে পছন্দ করব না।’ ড্রাইভার চলে গেল।

ছেলেটা চোখে-মুখে মাফলার জড়িয়ে বসে থাকল। খুব মায়া হচ্ছিল বেচারার জন্য।

ডেটস নামের যে জায়গায় বিকেলে নামলাম তার মাটি দেখা যাচ্ছিল না। রাস্তায় অন্তত এক ফুট বরফ জমে গিয়েছে। গ্রে হাউন্ড বাস সেন্টারের ভিতরটা যন্ত্রের কারণে গরম। শুনলাম মোটেল পেতে গেলে ওই বরফের উপর দিয়ে মিনিট দশেক হাঁটতে হবে। স্যুটকেস টানতে টানতে মনে হচ্ছিল কলকাতার বর্ষায় জমা জলে নোংরা থাকলেও হাঁটা ঢের সহজ। দুটো মোটেলের বাইরে নো রুম সাইন জ্বলছে। এখন আলো যেমন নেই অন্ধকারও নামেনি। শেষ পর্যন্ত একটা মোটেল পেয়ে গেলাম। ভাল ঘর, টয়লেট পরিষ্কার। কিন্তু এদের চা-কফি ছাড়া খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। এই সময় ট্যুরিস্টরা আসে না বলে রাঁধুনির ছুটি হয়ে গিয়েছে। জানলার ডানদিকে খানিকটা গেলে ভিলেজ পাব, পাওয়া যাবে। সেখানে যা চাই খেতে পাব। আপাদমস্তক মুড়ে বরফ ভেঙে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল এভাবে না গেলে এমন চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা হত না। রাস্তা দেখা যাচ্ছে না বরফের কারণে, একটা মানুষ আশপাশে নেই। ফাঁকা জায়গা রেখে যে বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে তার জানলা-দরজা বন্ধ। আমি যেন একটা ভৌতিক গ্রামে ঢুকে পড়েছি। তারপর ভিলেজ পাব চোখে পড়ল। একটা একতলা বাড়ি যার সর্বাঙ্গ বরফে ঢাকা রয়েছে। শুধু উপরের জানলার কাচে আলোর প্রতিফলন পড়ায় বোঝা যাচ্ছে ভিতরে প্রাণ আছে।

কাঠের ভারী দরজা ঠেলে ভিতরে পা বাড়াতেই শরীর এবং কানের আরাম হল। এক ফোঁটা শীত নেই ভিতরে আর কোণের ছোট্ট ডায়াসে বসে এক বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে গিটারে সুর তুলছেন। বেশ বড় নয় হলঘরটি, গোটা বারো টেবিলে চারটে করে চেয়ার। ওপাশে বার কাউন্টার। ম্যাকড়োানাল্ড, বিগম্যাক জাতীয় রেস্টুরেন্টে কাউন্টার থেকে খাবার কিনে টেবিলে নিয়ে গিয়ে খেতে হয়। এখানে এখন যাঁরা টেবিলে টেবিলে বসে আছেন, তাঁদের অধিকাংশই বয়স্ক মানুষ এবং প্রত্যেকের সামনে পানীয়ের গ্লাস। একজন ইউনিফর্ম পরা মহিলা পরিবেশন করছেন দেখে আমি একটা কোণের টেবিলের চেয়ারে বসলাম। একটু পরেই মহিলা যখন এগিয়ে এলেন তখন বুঝলাম ইনি আদৌ বয়স্কা নন। গায়ের রং এবং চুল বলছে ইনি স্প্যানিশ। আমেরিকার পশ্চিম অঞ্চলের জায়গাগুলোর নাম যেমন স্প্যানিশ ভাষার তেমনি ওই ভাষাভাষীদের সংখ্যা এদিকে প্রচুর। মেয়েটি হাসল, ওর গজদাঁত দেখতে পেলাম। বললাম, ‘আমি ক্ষুধার্ত। আপনাদের মেনুতে যা ভাল খাবার আছে তার সামান্য যদি আমার জন্যে নিয়ে আসেন তা হলে খুশি হব।’

মেয়েটি তার অ্যাপ্রনের পকেট থেকে একটা ছোট মেনুকার্ড বের করে সামনে রাখল। পরিষ্কার বলল, ‘আপনি যা খেতে চান তা বলে দিলে ভাল হয়।’

কথাবার্তা ইংরেজিতে হচ্ছিল। কার্ড দেখতে দেখতে আমি দিশাহারা। বেশির ভাগ খাবারের নাম শুনিনি কখনও। হয়তো চেনা খাবার অচেনা নামে রয়েছে। নিজের অজান্তে মুখ থেকে বেরিয়ে এল শব্দটা, ‘মেরেছে।’

সঙ্গে সঙ্গে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল মেয়েটি। তারপর হাসি থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কার্ড দেখে আপনার মনে হল কেউ আপনাকে মেরেছে?’ প্রশ্নটি ইংরেজিতে।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মেরেছে মানে বুঝলে কী করে?’

‘কারণ আমি বাঙালি। দাঁড়ান, আপনার ভাল লাগবে এমন খাবার এনে দিই।’ এবার স্পষ্ট বাংলায় কথাগুলো বলে মেয়েটি চলে গেল ভিতরে।

আমি অবাক। একটি বাঙালি মেয়ে এমন হিমশীতল শহরের ভিলেজ পাবে চাকরি করছে। এখন পড়াশোনা করে আসা প্রচুর মেয়ে বিদেশে বড়-মেজ চাকরি করছে কিন্তু ওয়েট্রেসের চাকরিতে কাউকে দেখিনি। যদিও এদেশে কোনও চাকরি ছোট নয়, করলে মানহানি হয় না, তবু—। মেয়েটি যে খাবার দিয়ে গেল তা রীতিমতো সুস্বাদু। খাওয়া শেষ হলে সে প্লেট তুলে নিতে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি একটু ওয়াইন খাবেন?’

মাথা নেড়ে না বললে সে একটা কাগজ এগিয়ে দিল যাতে খাবারের দাম লেখা রয়েছে। ফিরে এসে সে ডলার হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় উঠেছেন?’ মোটেলের নাম বললে সে বলল, ‘এক মিনিট অপেক্ষা করুন।’ এবার সে ফিরে এল সর্বাঙ্গ শীতবস্ত্রে নিজেকে মুড়ে, বলল, ‘চলুন, আমার ডিউটি শেষ হয়ে গিয়েছে, আপনার পথেই আমাকে যেতে হবে।’

বাইরে বেরিয়ে ঠান্ডায় কেঁপে উঠলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখানেই চাকরি করো।’

‘না। পার্ট টাইম। এখন রাতের কলেজে যাব। সকাল ন’টা থেকে বারোটা হাসপাতালে ইন্টারপ্রেটারের কাজ করি। বাঙালি মহিলারা ইংরেজি জানে না, সাহায্য করি। আর তিন মাস পর ফাইনাল পরীক্ষা, তারপর চাকরি।’

‘এত কষ্ট করছ কেন?’

‘আর কোনও উপায় নেই। এখন আর কষ্ট মনে হয় না।’ মেয়েটি হাসল, ‘আমি তো বাংলাদেশের মেয়ে। লড়াই না করে জিতব কী করে?’

৪৪

লাল আলোর কারণে গাড়িগুলো দাঁড়িয়েছিল। তাদের ফাঁক গলে গলে এগিয়ে আসছিল বাইকগুলো। দু’টো গাড়ির মধ্যে যে চিলতে জায়গা খালি রয়েছে তার ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাবে ওরা। যেই আলো বদলে গেল অমনি ঝড়ের বেগে বাইকগুলো বেরিয়ে যেতে লাগল। যাওয়ার সময় আমার গাড়ির ড্রাইভিং সিটের বাইরে যে আয়না থাকে, তাকে উপড়ে ঝুলিয়ে দিয়ে গেল। চিৎকার করার আগেই বাইকওয়ালা হাওয়া। মোড় পেরিয়ে গাড়ি থামিয়ে দেখলাম আয়না এবং তার স্ট্যান্ড পাল্টাতেই হবে। একজন সার্জেন্টকে দেখে ব্যাপারটা বললাম। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, “বাইকের নাম্বার নিয়েছেন?”

“সুযোগই পাইনি। তবে হলুদ জামা পরেছিল।”

“ছেড়ে দিন। কোম্পানিতে গেলে অনেক টাকা চাইবে, তার চেয়ে মল্লিকবাজারে যান, শ’দুয়েকের মধ্যে পেয়ে যাবেন। চোরাই মাল হলেও তফাত ধরতে পারবেন না।” উপদেশ দিয়ে সার্জেন্ট চলে গেলেন।

কোম্পানিতে ফোন করে জানলাম, সারানো যাবে না, নতুন সেট লাগাতে আড়াই হাজার দিতে হবে। যে বাইকওয়ালা কাজটা করল তাকে আমি কিছুই বলতে পারব না। আমাকে ব্যাপারটা সহ্য করতে হবে। যদি পয়সা বাঁচাতে চাই তা হলে মল্লিকবাজারের চোরাই মাল লাগিয়ে খুশি হতে পারি। একজন পুলিশ অফিসার যখন এই উপদেশ দিতে পারেন তা হলে আমিই-বা লাগাতে পারব না কেন? আয়না লাগিয়ে মল্লিকবাজার থেকে চলে এলে যখন কেউ বুঝতে পারবে না যে ওটা চোরাই মাল তখন এটুকু অ্যাডজাস্ট করতে অসুবিধে কোথায়! যদি মনে অস্বস্তি তৈরি হয় তা হলে সেটাকেও সহ্য করতে হবে। সহ্য করতে না শিখলে এই শহরে বাঁচা সহজ হবে না।

কিছুদিন আগে আমি ভাবতাম, কলকাতার পথে গাড়ি চালাতে শুধু ভাল ড্রাইভার হলেই চলবে না, কপালও ভাল হওয়া চাই। এত গাড়ি তবু যত দুর্ঘটনা ঘটা উচিত তার পয়েন্ট জিরো এক পার্সেন্টও হচ্ছে না। পথচারীরা নিয়ম না মেনে রাস্তা পারাপার করেন, ফুটপাত থাকলেও সেটা ব্যবহার না করে গাড়ির রাস্তায় হাঁটেন, ছুটন্ত গাড়ি এগিয়ে আসছে দেখেও একটা হাত ওপরে তুলে থামতে বলে হেলেদুলে এগিয়ে যান। এসবের জন্যে যত পথচারীর রোজ মৃত্যু হওয়া উচিত তার সংখ্যা কল্পনা করলে শিউরে উঠতে হবে। কিন্তু সেসব কিছুই হয় না। হয় না, কারণ কলকাতার গাড়ির চালকদের দক্ষতা, তাঁদের অসীম সহ্যশক্তির জন্য পথচারীরা বেঁচে যান। একজন ড্রাইভারকে ভাল চালাতে হবে মানে, তাঁর গাড়ির সামনে বেকুব লোকগুলো এসে পড়বে মোবাইল কানে চেপে এবং তাঁকে সময়মতো ব্রেক কষে বাঁচাতে হবে, তা হলেই চালানোটা ভাল বলবে সবাই। উত্তেজিত হওয়া চলবে না, স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে বলতে হবে, সহ্য করো, সহ্য করতে শেখো, লোকে যত অন্যায় করুক তুমি সহ্য করে যাও।

কিন্তু এখন কলকাতার রাস্তার কর্তৃত্ব চলে গিয়েছে বাইকওয়ালাদের হাতে। হাজার হাজার বাইক নেমে গিয়েছে রাস্তায়। কাউকে পরোয়া না করে গতি বাড়াচ্ছে তারা। পাছে দুর্ঘটনা ঘটে যায় সেই ভয়ে গাড়ির ড্রাইভাররা সিঁটিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। আশ্চর্য ব্যাপার, যেখানে কয়েক হাজার বাইকের দুর্ঘটনায় পড়া উচিত সেখানে সারাদিনে গোটা পাঁচেকের বেশি খবর পাওয়া যায় না। ঔদ্ধত্য বাড়ছে। নিজে অন্যায় করেও বাইকওয়ালা পুলিশের হাত ভেঙে দিচ্ছে। এবং এটাকেও সহ্য করতে হচ্ছে, হবে।

বছর পঞ্চাশেক আগে যদি জানা যেত পাড়ার কোনও ব্যক্তিকে সোনাগাছি অথবা হাড়কাটায় দেখা গিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে তীব্র প্রতিক্রিয়া হত। সেই ব্যক্তির পক্ষে পাড়ায় বাস করা মুশকিল হয়ে যেত। কোনও ভাড়াটে নতুন পাড়ায় এলে তাদের আচার-আচরণ সম্পর্কে ঔৎসুক্য থাকত। এরকম স্বামী-স্ত্রীর পরিবারে স্বামীর অনুপস্থিতিতে অন্য পুরুষ এলে পাড়ার আবহাওয়া গরম হয়ে যেত। ঘন ঘন কিছু নারী-পুরুষ তাদের বাড়িতে এলে বাড়িওয়ালা ভাড়াটেকে বাড়ি ছাড়তে বলত যা পাড়ার লোকের সমর্থন পেত। এটা সেই সময় যখন বাঙালি অসবর্ণ বিয়েতে বাধ্য না হলে সম্মতি দিত না। প্রেম করাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হত। সময় পাল্টালে অসবর্ণ বিয়ে অথবা বিয়ের আগের প্রেমকে বাঙালি স্বীকৃতি দিল। কিন্তু বাড়িতে বন্ধুদের নিয়ে মদ্যপান করাকে এই সেদিন পর্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখা হত। ক্রমশ সেটাও মেনে নিয়েছে কিন্তু অবৈধ যৌনজীবন মানতে পারেনি।

কিন্তু কী আশ্চর্য, বাঙালি শেষ পর্যন্ত তা-ও মেনে নিল।

আমাদের অল্প বয়সে খবরের কাগজের ক্লাসিফায়েড বিজ্ঞাপনের ক্যাপশন থাকত, ‘পত্রমিতালি’। চিঠিতে বন্ধুত্ব তৈরির আবেদন থাকত। সেখানে যিনি বিজ্ঞাপন দিতেন তিনি তাঁর হবি-র বিষয় স্পষ্ট লিখতেন। সেই বিষয়গুলো যাঁকে আকর্ষণ করত তিনি চিঠি লিখে যোগাযোগ করতেন। যেমন কারও প্রিয় বিষয় ছিল গোয়েন্দা-সাহিত্য। দু’জনের চিঠি বিনিময় হলে দেখা যেত বিশ্বসাহিত্যের তামাম গোয়েন্দাদের খবর জানা যাচ্ছে। চিলি-র গোয়েন্দার সঙ্গে চিনের গোয়েন্দাদের মিল এবং তফাতটাও স্পষ্ট হচ্ছে।

সেই পত্রমিতালি দীর্ঘকাল চলে আসছিল। এখন নেটের যুগে তার চাহিদা শূন্যে পৌঁছে গিয়েছে। ফেসবুক হওয়ায় কে চিঠি লিখে সময় নষ্ট করবে? ঠিক তখন খেয়াল হল পত্রমিতালির বিজ্ঞাপনের ভাষা এবং বিষয় পাল্টে গিয়েছে। ‘আমি চৈতালী, আপনার সঙ্গে বোল্ড রিলেশনে আগ্রহী।’ একটি বাঙালি বিজ্ঞাপন ছেপে প্রকাশ্যে বোল্ড রিলেশন করতে চাইছে, ভাবলেই তরুণ ও যুবকদের বুকে তিম্পেনিয় ঢাক বাজতে আরম্ভ করে। কিছুদিন পরে ভাষার বদল হল। ‘বান্ধবী চান, সবরকম সঙ্গ দেবে।’ এতেও থেমে থাকল না, ‘পছন্দমতন বান্ধবীর সঙ্গে বোল্ড রিলেশন করে রোজগার করুন।’ ‘অর্থের বিনিময়ে বয়স্কা সুন্দরীরা আপনার সঙ্গ পেতে ইচ্ছুক।’

এই বিজ্ঞাপনগুলো খবরের কাগজের পাতায় ছাপা হচ্ছে। ঠাকুরদা থেকে নাতি দেখছে। ঠাকুরদার চোখে-মুখে বিরক্তি, নাতি ফোন নাম্বার নোট করে নিচ্ছে। সোনাগাছিতে যাওয়ার দরকার নেই। ফোন করে চলে গেলেই হল। কিন্তু বিজ্ঞাপনগুলো কেন ছাপা হচ্ছে তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করছে না। যেমন টিভিতে জাপানি তেলের বিজ্ঞাপন দেখলে ছোটদের সামনে বসে বয়স্করা বুদ্ধদেব হয়ে থাকেন। একবার একটি তিন-চার বছরের শিশু বিজ্ঞাপন দেখে বলে উঠেছিল, ‘মা, মা, কেউ সাপটাকে মেরে ফেলছে না কেন?’ উত্তর পায়নি।

খবরের কাগজ কেন বিজ্ঞাপন ছাপছে, যারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, তারা সাহস পাচ্ছে কোথায়—এসব প্রশ্ন না তুলে আমরা না দেখার ভান করে আছি। সহ্য করছি। আমাদের সহ্যশক্তি এখন এত বেড়ে গিয়েছে যে, পশ্চাদ্দেশে কেউ লাথি মারলেও ব্যথা পাই না, উল্টে সেই পায়ে ফুলবেলপাতা দিয়ে প্রণাম করি।

৪৫

ছয় বছর বয়সে জলপাইগুড়ির জেলা স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। ঠাকুরদা, বড় পিসিমার ছায়ায় বড় হওয়া একটি অবোধ বালক সেই প্রথম গোটা পঁচিশেক সমবয়সি ছেলের সঙ্গ পেয়েছিল। ওই বয়সে খুব দ্রুত অপরিচিতের আড়াল খসে যায়। আবার তার মধ্যে যে একটু বেশি কথা বলতে পারে তার নেতৃত্ব মেনে নিতে অসুবিধা হয় না। প্রথম দু’দিন স্কুল থেকে ফেরার পর বড় পিসিমা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ক্লাসে কী হল, কে কী বলল, ইত্যাদি। আমি যা যা হয়েছিল তার সবই উগরে দিয়েছিলাম যা বড় পিসিমাকে সন্তুষ্ট করেছিল। বলেছিলেন, ‘খুব নামী স্কুল, অনেক কিছু শিখতে পারবি।’

তৃতীয় দিনেই আমাদের ক্লাসের ছেলেদের দুটো দল হয়ে গেল। কিন্তু বড়পিসিমা সেদিন আর ক্লাসের খবর জানতে আগ্রহী হলেন না। চতুর্থ দিনে দুই দলের বেজায় ঝগড়া হল। একজন গাল ফুলিয়ে বলল, ‘শালা!’ সঙ্গে সঙ্গে অন্যজন জবাব দিল, ‘তুই শালা!’ আমার পাশের ছেলেটি নিচু গলায় বলল, ‘ইস, কী খারাপ গালি দিল!’

অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘শালা কি খারাপ কথা?’

‘খুব খারাপ।’ যার উপর রাগ হয় তাকে মনে মনে শালা বললে দেখবে আনন্দ হয় কিন্তু মুখে বললে বড়দের কানে গেলে আর দেখতে হবে না। মার তো খাবেই, খাওয়াও বন্ধ করে দেবে।’ ছেলেটি জ্ঞান দিয়েছিল।

শালা শব্দটি যে নিষিদ্ধ শব্দ তা বুঝে গিয়েছিলাম। আর ওই বয়সে, অবশ্য ওই বয়স কেন, সব বয়সেই, নিষিদ্ধ কিছু বেশ আকর্ষণ করে। ভোর সাড়ে চারটের সময় ঠাকুরদা জোর করে ঘুম ভাঙিয়ে তাঁর সঙ্গে মর্নিং ওয়াকে নিয়ে গেলে তখন রোজকার মতো আমার কান্না পেল। কিন্তু শব্দটি শেখার পর কান্না দ্রুত রাগে পরিণত হয়ে গেল। ঠাকুরদার পিছন পিছন সূর্যোদয় দেখার জন্য হাঁটার সময় মনে মনে উচ্চারণ করলাম, ‘শা-লা।’ করামাত্র কী দারুণ তৃপ্তি পেলাম। আঃ। তৃপ্তিটা আবার পাওয়ার জন্যে শব্দটি আবার উচ্চারণ করতে গিয়ে সেটা সম্পূর্ণ শব্দহীন রইল না। ঠাকুরদার কানে অস্পষ্ট কিছু পৌঁছলে তিনি মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমি কি কিছু বললে?’

দ্রুত মাথা নেড়ে ‘না’ বললাম। ঠাকুরদার কাছে আমার সেই প্রথম মিথ্যে বলা শুরু হল।

একটু বড় হয়ে, যখন শালা বলে ফেলার জন্য কয়েকজন বন্ধু শাস্তি পেয়ে গিয়েছে, তখন জানলাম শালা একটি সম্পর্কের নাম। আমার মামা হলেন বাবার শালা। তা হলে শালা কী করে গালি হবে, নিষিদ্ধ শব্দ বলা হয়েছে? জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়াল এক বন্ধু যখন আমরা ক্লাস নাইনে পড়ি। সে বোঝাল, ধর, আমি কাউকে শালা বললাম। তার অর্থ হল যাকে বললাম তার বোনকে বিয়ে করেছি। কিন্তু বিয়ে না করেও শালা বললে একটা অবৈধ গন্ধ যে পাওয়া যাচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই। তার জন্যে বিয়ের ছাড়পত্র পাওয়া দরকার। ওটা না থাকলে যাকে শালা বললাম তাকে তো বটেই তার বোনকেও অপমান করলাম।

কিন্তু এত জটিল ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে বাড়িতে এমন মুখ করে থাকতাম যে, শালা শব্দটি আমি কখনও শুনিনি, উচ্চারণ করা দূরের কথা!

কলকাতায় পড়তে এসে আমি হতচকিত। তখন ছেলেরা অবলীলায় শালা বলে যাচ্ছে। শুধু অন্য কাউকে উদ্দেশ করে নয় নিজেকেও শালা বলছে। জানো, আমি শালা আগে জানলে যেতাম?’ অথবা, ‘আমার শালা কপালটাই খারাপ।’ এই শালাটির বোন কে ভাবতে গিয়ে নিজের মুখ থেকে বেরিয়েছে, ‘যাঃ, শালা।

শালা আর নিষিদ্ধ শব্দ নয়, প্রকাশ্যেই বলা যায়। কিন্তু সেটা বন্ধুদের আড্ডায়। অধ্যাপক কে ডি যদি কঠোর হন তাহলে তাঁকে নিয়ে আলোচনার সময় শালা কে ডি বলা যাচ্ছে অনায়াসে। কিন্তু পরিচিত বয়স্কদের সামনে শব্দটা উচ্চারণ করিনি আমরা। রকে বসে আড্ডার সময় অপরিচিত বয়স্কদের দেখলে শালা শব্দটি ব্যবহার করতে একসময় আর অসুবিধা হত না।

আমার এক বন্ধু বলেছিল, ‘শালা মানেই ঝামেলা। স্ত্রীর ভাই বলে তার সব দোষ উপেক্ষা করতে হয়। আবদার করলে মেনে না নিলে স্ত্রীর মুখ ভার হয়। আবার ভাইফোঁটার সময় স্ত্রী যখন তাঁর আদরের ভাইয়ের জন্যে মোটা টাকার উপহার কেনেন তখন আপত্তি জানালে মন ছোট প্রমাণিত হবে। এরকম সম্পর্কের লোককে মেনে নেওয়া একটু মুশকিল। তার উপর শালার গুরুত্ব একটু বেশি দেওয়া হয়। কথায় বলে শালা-ভগ্নিপতি। উল্টোটা বলে না। তাই ওই সম্বোধনটা যখন বাধ্য হয়ে সহ্য করতে হয় তখন সেটাকে চাপা গালাগালি হিসেবে ব্যবহার করে খুব ভুল হচ্ছে না।’

কিন্তু আমাদের ছেলেবেলায় ‘শালা’ শব্দটির যত ভার ছিল তা কমতে কমতে এখন ভারমুক্ত হয়ে গিয়েছে। এখন আক্ষেপে ছেলে মায়ের সামনে শব্দটি বললেও তার কোনও খারাপ লাগার বোধ তৈরি হচ্ছে না। ‘জানো মা, ঘুষ না দিলে শালারা পারমিট দেবে না।’ মা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘কত চাইছে?’ যেন শালা শব্দটা তাঁর কাছে অর্থহীন।

শালার তো দিন গিয়েছে, কিন্তু শালী? মোটামুটি সুস্থ পরিবারের কেউ কোনও মেয়েকে শালী বলে গালাগাল দিয়েছে বলে শুনিনি। শালার চেয়ে শালীর সঙ্গে সম্পর্ক অনেক কাছের। তাই, হয় তো। কিন্তু সমীক্ষকরা বলেন, এই শব্দটির বহুল ব্যবহার আছে রেডলাইট এলাকায়, হতদরিদ্র মানুষের মধ্যে। কিন্তু শব্দটার মধ্যে কুগন্ধ এত তীব্র যে, সভ্য সমাজ তা হীন গালাগালি ভেবে বর্জন করেছে। যে শব্দটি উচ্চারণ করে তার রুচিবিকৃতি নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকে না।

একসময় ছেলেদের মুখে উচ্চারণ করা অপরাধ ছিল যা ক্রমশ গা-সওয়া হয়ে গিয়ে ঘরে বাইরে চালু হয়ে গেল সেই শব্দ যে, শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরাও উচ্চারণ করবে তা আগে ভাবা যায়নি। কলেজের মেয়েরা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় ছেলেদের মতোই শালা শব্দটা উচ্চারণ করছে বিন্দুমাত্র জড়তা ছাড়াই। শালা শব্দ উচ্চারণ করতে কোনও দ্বিধা নেই, কারণ শব্দটি এখন সাদামাটা হয়ে গিয়েছে।

পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী বক্তৃতার সময় উত্তেজিত হয়ে শব্দটি উচ্চারণ করেই ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। যেহেতু তাঁর বয়স হয়েছে এবং অল্পবয়সের মূল্যবোধ এখনও লালন করেন তাই বেফাঁস বলে ফেলে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। এটা শুনে অবাক হয়ে কলেজের কোনও পড়ুয়া মেয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘ক্ষমা চাইলেন কেন? উনি কি অন্যায় করেছেন?’

উত্তরটা শুনে চোখ বড় হয়ে গেল মেয়েটির, অসাড়ে তার মুখ থেকে বের হল, ‘যাঃ, শালা!’

৪৬

থানা থেকে ফোনটা এসেছিল বেলা সাড়ে এগারোটায়। সারাজীবন খেলাধুলো নিয়ে থাকা মানুষটিকে চেনেন না এমন কোনও সাংবাদিক নেই। খবরের কাগজের খেলার পাতায় যাঁরা চোখ রাখেন তাঁরাও ওঁর সম্পর্কে জানেন। ফোনটা এসেছিল থানা থেকে। তাঁকে বলা হয়েছে অবিলম্বে সপরিবার বাড়ি থেকে চলে গিয়ে অন্য কোথাও থাকতে এবং চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আগাম জামিন নিয়ে নিতে। যিনি ফোন করেছিলেন তিনি ভদ্রলোকের বেশ পরিচিত এবং বোঝাই যাচ্ছে হিতাকাঙক্ষী। ভদ্রলোক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘কিন্তু এসব কেন করব? আমি তো কোনও অন্যায় করিনি।’

তখন ভদ্রলোক জানতে পারলেন। তিনি, তাঁর স্ত্রী এবং একমাত্র পুত্র একত্রিত হয়ে পুত্রবধূর উপর মানসিক, দৈহিক যে অত্যাচার দিনের পর দিন করে গিয়েছেন তা সহ্য করা আর তাঁর পক্ষে সম্ভব না হওয়ায় তিনি আইনের আশ্রয় চেয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন। তাঁর অভিযোগ শুনে পুলিশ চারশো আটানব্বই-এর এ ধারায় ব্যবস্থা নিতে চলেছে। তখনও সুপ্রিম কোর্ট ওই ধারাটিকে কিঞ্চিৎ সংশোধন না করায় অভিযুক্তকে তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করা হত। খেলাধুলো নিয়ে থাকা পরিচিত ব্যক্তিকে ব্যাপারটা জানানো পুলিশের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু ভদ্রলোকের এমন একটা ভাল ইমেজ ছিল যে পুলিশ তাঁকে সুযোগ দিতে চেয়েছিল।

অতএব বাধ্য হয়ে ভদ্রলোক সস্ত্রীক দক্ষিণ থেকে উত্তর কলকাতার কোনও হেটেলে গিয়ে উঠলেন। কলকাতার বিভিন্ন অংশে তাঁর বন্ধুদের এবং আত্মীয়দের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও হোটেলে ওঠার কারণ হল তিনি ব্যাপারটাকে গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। পুত্রবধূ চারশো আটানব্বই-এর এ করেছে জানালে তাঁর সম্মান নষ্ট হবেই। পরিচিত একজন আইনজ্ঞের মাধ্যমে তাঁরা আগাম জামিন পেয়ে যাওয়ার পরে বাড়িতে ফিরেই থানায় অর্ডারের কপি পাঠিয়ে দিলেন।

একটু স্থিতু হয়ে বসার পর ভদ্রলোক ছেলেকে ফোন করলেন। সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কেমন আছ?’

দুবাই থেকে ছেলে উত্তর দিল, ‘ভাল। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করছ কেন?’

‘তোমার স্ত্রী কলকাতায় এসেছিলেন, জানাওনি কেন?’

এবার ছেলেটি স্বীকার করল। স্ত্রীর সঙ্গে তার গত ছয়মাস কোনও সম্পর্ক নেই। দুবাইতেই স্ত্রীর এক কলিগের বাড়ি, সেখানেই থাকেন। বছরখানেক ধরে ওদের মনোমালিন্য চলছিল। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে উঠেছিল যে আলাদা না হয়ে উপায় ছিল না। কিন্তু ছেলেটি বাবা-মাকে জানাতে চায়নি তাঁরা দুঃখ পাবেন ভেবে। তার মনে হয়েছিল আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তার স্ত্রী যে কলকাতায় গিয়ে থানায় নালিশ জানাবে এটা সে কল্পনা করতে পারেনি।

এই ভদ্রলোক পুত্রবধূর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, বিয়ের পর গত আড়াই বছরে মাত্র দেড়মাস পুত্রবধূ তাঁদের সঙ্গে থেকেছিলেন। ওই সময়ে তিনি বা তাঁর স্ত্রী যদি অত্যাচার করে থাকেন, তা মানসিক বা শারীরিক যাই হোক না কেন, সেই কথা কি বেয়াইমশাই জানতেন? যদি না জানেন, যদি কথাটা চেপে গিয়ে থাকেন তাহলে এতদিন পরে কী ঘটনা ঘটল যে সোজা কলকাতায় এসে তাঁকে থানায় যেতে হল? প্রশ্নের জবাব পুত্রবধূর বাবা দিতে পারেননি। ভদ্রলোক অনুমান করছেন, তাঁর পুত্র এমন কিছু করেছে যা পুত্রবধূর কাছে অসহনীয় বলে মনে হয়েছে। কিন্তু তিনি স্বামীর উপর অসন্তুষ্ট হয়ে শ্বশুর-শাশুড়িকে বিপদে ফেললেন কেন? প্রশ্নের জবাব পাওয়ার চেষ্টা করেছেন ভদ্রলোক। অনেক চেষ্টা করে পুত্রবধূর মোবাইল ফোনের নাম্বার জোগাড় করে কথা বলেছিলেন। গলা শুনে পুত্রবধূ অত্যন্ত ভদ্রভাবে কথা শুরু করেছিলেন। ভদ্রলোক প্রশ্নটা করামাত্র পুত্রবধূ স্থির গলায় বললেন, ‘আপনার ছেলে আমাকে ভয় দেখিয়ে বলত সপরিবারে ধবংস করে দেবে। আমাকে সে অকারণে সন্দেহ করে জীবনটা দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এমনকী আমার পেছনে স্পাই লাগিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমি ওকে শিক্ষা দিতে চাইলাম। এরকম ছেলের বাবা হিসাবে আপনিও দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না। আপনি আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করবেন না।’

এখন দু’পক্ষই আদালতের মুখ চেয়ে রয়েছে।

এসব খবর চাপা থাকে না। আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক খবরটা শুনে বেশ হতাশ গলায় বললেন, ‘কী করব ভেবে পাচ্ছি না। কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ হয়েছিল। ছেলের বিয়ে দেব বলে মেয়ে খুঁজছিলাম, পেয়েও গেলাম। তারপর খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি মেয়েটির পরিবার খুব ভাল। পাড়ায় সুনাম আছে। মেয়েটি শিক্ষিত, ভদ্র, চালচলন নিয়ে খারাপ কথা শুনিনি। কিন্তু এসব তো সত্যি নাও হতে পারে। বাড়ির বাইরে মেয়েটি কোথায় কী করছে তা পাড়ার মানুষ জানবে কী করে! বিয়ের পরে স্বামীকে আলাদা হতে বলে এবং সে যদি রাজি না হয় তাহলে তো স্বচ্ছন্দে আমাদের বিরুদ্ধে ফোর নাইনটি এইট-এ করতে পারে। কী সমস্যা বলুন তো!’

সমস্যাটা তাঁদেরই যাঁরা ছেলের বিয়ে দিয়েছেন অথবা ছেলে বিয়ে করেছে। কিন্তু মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে যে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তা ওই চারশো আটানব্বই-এর এ থেকে কোনও অংশে কম নয়। এটা এখন একটা সময় যখন বিশ্বাস শব্দটি তার মাহাত্ম্য হারিয়ে ফেলেছে। সম্বন্ধ করে মেয়ের বিয়ে দেওয়া এখন প্রায় জুয়া খেলার শামিল। মেয়ে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করলে বাবা-মা হয়তো ভাবেন কাঁধ থেকে দায়িত্ব চলে গেল কিন্তু বিয়ের কিছুদিন বাদে যদি ঝামেলা শুরু হয় এবং মেয়ে ফিরে আসে তখন তো তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিতে কেউ পারবেন না। আগের দিনে সমস্যা হলে বাবা-মা মেয়েকে উপদেশ দিতেন মানিয়ে চলতে, মেনে নিতে। অ-শিক্ষিত মেয়ে যার নিজস্ব কোনও উপার্জন ছিল না, বাধ্য হত উপদেশ শুনতে। কিন্তু এখন মেয়েরা স্বাবলম্বী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে, তারা মাথা নিচু করে থাকবে কেন?

জানি না, একটা অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে বলেই হয়তো বিয়ের বদলে একসঙ্গে থাকার চল শুরু হয়েছে। এখন এই কলকাতা শহরে একসঙ্গে থাকেন এমন যুগলের অভাব নেই। যতদিন ভালবাসা এবং বিশ্বাস থাকবে ততদিন একসঙ্গে আছি, অভাব হলে সরে যাব। তাতে আর যাই হোক, ফোর নাইনটি এইট-এ যেমন হবে না তেমনই বিচ্ছেদের মামলা করে আদালতে ছুটতে হবে না।

ধরা যাক, আপনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একজন কর্মচারী।

৪৭

ধরা যাক, একটি কল্পিত কাঠগড়ায় আপনাকে তোলা হল। আপনি স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় মোটামুটি ভাল ফল করেছেন, আপনার বাবা-মায়ের মতো আপনিও বাংলায় কথা বলেন, তা ছাড়া ইংরেজি খারাপ বলেন না। হিন্দিটা একটু খাটো, লিঙ্গ গুলিয়ে ফেলেন। এই আপনাকে কাঠগড়ায় তুলে আলোকিত করা হল। তারপর আপনার উদ্দেশে প্রশ্ন ভেসে এল।

প্রশ্ন ।। আপনার নাম?

আপনার উত্তর ।। এ কে রায়।

প্রশ্ন ।। আপনাকে বাংলায় প্রশ্ন করা হয়েছে।

উত্তর ।। অপূর্ব কুমার রায়।

প্রশ্ন ।। বয়স?

উত্তর।। ছত্রিশ।

প্রশ্ন।। আপনি কে?

উত্তর ।। আমি একজন বাঙালি।

প্রশ্ন।। কী করে বুঝলেন যে আপনি বাঙালি?

উত্তর।। আমার বাবা-ঠাকুরদা বাঙালি, মা-ও বাঙালি।

প্রশ্ন।। কত বছর ধরে আপনার পূর্বপুরুষ বাঙালি?

উত্তর।। আমার ঠিক জানা নেই।

প্রশ্ন।। ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালির ইতিহাস বইটি পড়েননি?

উত্তর।। না তো!

প্রশ্ন।। আপনার কি কোনও ধর্ম আছে?

উত্তর।। নিশ্চয়ই। আমি হিন্দু।

প্রশ্ন।। হিন্দু কি ধর্মের নাম?

উত্তর।। অবশ্যই।

প্রশ্ন।। কীভাবে আপনি প্রতিদিন সেই ধর্ম পালন করেন?

উত্তর (একটু ইতস্তত করে) ।। প্রতিদিন করতে হয় না। পাড়ায় বারোয়ারি পুজোর সময় চাঁদা দিই।

প্রশ্ন।। ব্যস? হিন্দু ধর্মাচরণ কীভাবে করতে হয় জানেন?

উত্তর।। শিব-বিষ্ণু-দুর্গা-কালীর পুজো করে।

প্রশ্ন।। কীভাবে পুজো করেন?

উত্তর।। ভক্তিভরে মন্ত্র পড়ে।

প্রশ্ন।। কী ভাষায় মন্ত্র পড়েন? বাংলায়?

উত্তর।। না। সংস্কৃতে।

প্রশ্ন।। আচ্ছা। সংস্কৃত ভাষা আপনি জানেন?

উত্তর।। না।

প্রশ্ন।। যে ভাষা জানেন না সেই ভাষায় পুজো করেন কী করে?

উত্তর।। পুরুতমশাই সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করেন, কানে গেলেই আমার পুজো হয়ে যায়। কানে বেশ আরাম লাগে।

প্রশ্ন।। ধর্মাচরণ করার জন্যে কোনও কষ্ট করেন না?

উত্তর।। না। মা-ঠাকুমারা উপোস করতেন নির্জলা। আমি করিনি।

প্রশ্ন।। তার মানে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে আপনার কোনও সম্পর্কই নেই।

উত্তর।। কেন থাকবে না? সরকারি ফর্ম ভর্তি করার সময় একটা কলম থাকে, ধর্ম কী? তখন লিখতে হয়, হিন্দু। তা ছাড়া মৃত্যুর পরে মন্ত্র পড়ে মুখাগ্নি না হলে সৎকার সম্পন্ন হয় না। মরে যাওয়ার পরে অবশ্য মুখে আগুন লাগালে কষ্ট হবে না।

প্রশ্ন।। আপনার নাগরিকত্ব সম্পর্কে কিছু বলুন।

উত্তর।। আমি বাঙালি। কলকাতায় থাকি, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।

প্রশ্ন।। আপনার পাসপোর্ট আছে? থাকলে সেখানে ন্যাশনালিস্ট কি লেখা আছে?

উত্তর।। ওহো, ভারতীয় লেখা আছে।

প্রশ্ন।। আপনি নিজেকে ভারতীয় ভাবতে পারেন না?

উত্তর ।। আসলে নিজেকে বাঙালি বলতে ভাল লাগে।

প্রশ্ন।। আপনি খবরের কাগজ পড়েন?

উত্তর।। নিশ্চয়ই।

প্রশ্ন।। দেশের রাজনৈতিক নেতারা যেসব কথা বলেন তা আপনার ভাল লাগে?

উত্তর।। বেশিরভাগ সময় ভাল লাগে না।

প্রশ্ন।। প্রতিবাদ করেন?

উত্তর।। আশ্চর্য কথা। কী করে প্রতিবাদ করব? আমি তো একজন সাধারণ নাগরিক। মনে মনে মেনে নিতে পারি না, মুখে কিছু বলি না।

প্রশ্ন।। কেন?

উত্তর।। মুখে বললে সেই নেতার চামচারা এসে আমার বারোটা বাজাবে।

প্রশ্ন।। এই নেতারাই তো আপনার গার্জেন, কথাটা মানেন?

উত্তর।। তো তো বটেই। ওঁরা সভা, মিছিল ডাকলে রাস্তায় বাস-ট্রাম বন্ধ হয়ে যায়, আমাদের মেনে নিতে হয়। ওঁরা ধর্মঘট ডাকলে বাড়িতে বসে থাকা ছাড়া কিছু করার থাকে না। গত নির্বাচনের আগে যাঁদের নাম শুনিনি তাঁরা এখন আমাদের গার্জেন হয়ে বসেছেন।

প্রশ্ন।। আমাদের আমাদের বলছেন কেন? আমার বলুন।

উত্তর।। আমার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ একই কথা ভাবে, তাই আমাদের বলছি।

প্রশ্ন।। তাহলে কী দাঁড়াল? আপনার কোনও ধর্ম নেই, একটা কানে শোনা ধর্মকে নিজের ধর্ম ভাবছেন। আপনি ভারতবর্ষের নাগরিক কিন্তু নিজেকে চট করে ভারতীয় ভাবতে পারেন না, আপনি রাজনৈতিক নেতাদের আদেশ পালন করতে বাধ্য হন নিজের ইচ্ছে জলাঞ্জলি দিয়ে। তাই তো?

উত্তর।। সেরকম বলতে পারেন। কিন্তু পেট ভরা থাকলে আমি মনে মনে কত কল্পনা করি, গান গাই। তখন বেশ সুখে থাকি। সেরকমই থাকতে চাই।

৪৮

ঘরে ফেরা

 আমার বাড়িতে একটা কথা চালু আছে। আমি হয়তো তিনতলার ঘরে বসে লিখছি। একতলায় কেউ বেল বাজাল। আগে থেকে না জানিয়ে হুট করে বাড়িতে ঢুকে দাঁত বের করে ‘চলে এলাম সমরেশদা’ যাঁরা বলেন তাঁদের খুব খারাপ লাগে আমার। লেখা ছেড়ে নিচে নেমে অবান্তর কিছু কথা বলে উপরে উঠে এসে দেখি, লেখাটা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। তাই এসব ক্ষেত্রে আমি নিচে নামব না, বলে দেওয়া হবে উনি বাড়িতে নেই। বাড়িতে আছেন এবং লিখছেন বললে আগন্তুক আবদার করবেন, দু’-মিনিটের জন্য নামতে বলুন, মাত্র দু’-মিনিট। নেমে দেখেছি। গ্যাঁজানোর সময়টা কুড়ি মিনিট হয়ে যায়। তাই বাধ্য বয়ে মিথ্যে বলতে হয় বাড়ির লোকদের। কিন্তু কখনও কখনও বেল বাজে, আমি লিখছি, কাউকে বাড়িতে আসতেও বলিনি, অথচ বাড়ির লোক নিচ থেকে ঘুরে এসে বলে, ‘যাও, নিচে যাও।’

প্রথম প্রথম অবাক হতাম, ‘কে এসেছে?’

উত্তর হত, তোমার দেশতুতো ভাই।

অর্থাৎ নর্থ বেঙ্গলের লোক হলে তার সাতখুন মাপ। বিশেষ করে জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, কোচবিহারের মানুষ হলে এবং তাঁকে সাতজন্মে না দেখলেও আমি নিচে যাব। এই নিয়ে মশকরা করে বাড়ির মানুষ। ‘উঃ, বদ্যিরা বাকি বদ্যিদের টানে, গুজরাটিরা শুনেছি গুজরাটিদের দেখে, নর্থ বেঙ্গলের লোক শুনলেই হয়ে গেল, সব আপত্তি উধাও।

এটা হয়। স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। সেই নর্থবেঙ্গলের কাগজ হল এই উত্তরবঙ্গ সংবাদ। আমি জন্মেছিলাম গয়েরকাটা চা-বাগানে। পড়েছি জলপাইগুড়ি স্কুলে। ছেলেবেলায় গতকালের কলকাতার বাংলা কাগজ আজ আসত। পরে সকালের কাগজ বিকালে পেতাম। হঠাৎ ভোর না হতেই কদমতলার মোড়ে কাগজ বিক্রি দেখে অবাক হলাম। দিনের কাগজ ভোরেই পৌঁছে গেছে। সেই প্রথম দিকে কাগজের মান তেমন ভাল ছিল না। কলকাতার কাগজের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে থাকত। কিন্তু সকালে আর কোনও কাগজ না দেখতে পাওয়ার আনন্দে টাটকা খবরগুলো গিলতে কী ভাল লাগত। শুধু শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি কেন, মালবাজার-ময়নাগুড়ি-বানারহাট-বীরপাড়া থেকে ডুয়ার্সের নানান জায়গার মানুষ সেই প্রথম সকালের কাগজ সকালে পড়ার আনন্দ পেয়েছে। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও শিলিগুড়ি থেকে এই সাহসী উদ্যোগ নিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় সুহাস তালুকদার মশায়। আজ অবধি কলকাতার কাগজে লিখে হাত পাকাচ্ছি। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় তখন উত্তরবঙ্গ সংবাদের কলকাতার অফিসের সঙ্গে কর্মসূত্রে যুক্ত। সুধীদা একদিন টেনে নিয়ে গেলেন ওঁদের ডালহৌসির অফিসে। আলাপ হল সুহাসবাবুর সঙ্গে। বললেন, ‘আপনি নর্থ বেঙ্গলের ছেলে, এই কাগজও নর্থ বেঙ্গলের। আসুন না, একসঙ্গে কাগজটা বড় করা যাক।’

সুধীদার অনুরোধে কয়েকটা গল্প লিখেছি, পুজোর সময় নাটকও। কিন্তু তার বেশি জড়ানো হয়নি নানান কারণে। সুধীদা এবং সুহাসবাবুর মৃত্যুর পরে যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। দু’-তিনবার কথা বলেছেন, ওঁর উত্তরসূরি, টেলিফোনে। কিন্তু জলপাইগুড়িতে গেলে লক্ষ করেছি উত্তরবঙ্গ সংবাদ সাবালক হয়ে গেছে। এখন তো আধুনিক যন্ত্রের কল্যাণে কলকাতার কাগাজগুলো ভোরের ডুয়ার্সে পৌঁছে গেছে। তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যায়নি উত্তরবঙ্গ সংবাদ। আমার এক সাহিত্যরসিক দাদা অনুপ ঘোষ নিয়মিত রাখতেন কাগজটা। জলপাইগুড়ির পাহাড়ি পাড়ায় তাঁর বাড়িতে আড্ডা মারতে গিয়ে দেখতাম টেবিলের উপর রাখা দু’টি কাগজের মধ্যে ওটা রয়েছে। অনুপদা বলতেন, ‘আচ্ছা তুমি উত্তরবঙ্গ সংবাদে লেখ না কেন? ওরা চায় না, নাকি পারিশ্রমিক কম দেয় বলে লেখ না!’

হেসে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছিলাম।

কিন্তু যত বয়স বাড়তে লাগল, তত উত্তরবঙ্গ সংবাদ আমাকে টানতে লাগল। একবার গয়েরকাটার সুব্রত পালকে নিয়ে প্রায় জঙ্গলের গায়ে আংরাভাসা নদীর পাশে একটা জমি কিনতে গিয়েছিলাম, যেখানে বাকি জীবনটা চুপচাপ থাকব।

যা হোক, দীর্ঘকাল পরে প্রস্তাব এল এই কাগজে আমি ইচ্ছেমতো বিষয়ে খোলাখুলি লিখতে পারি। খুব ভাল লাগল। কলকাতার দু’টি কাগজে নিয়মিত কলম লিখতে হয়। কিন্তু এই কাগজের পাঠক যাঁরা তাঁরা উত্তরবঙ্গে থাকেন, আমি যে রাস্তায় আশৈশব হেঁটে এসেছি সেই রাস্তায় হাঁটেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্যে আমি সুহাসবাবুর উত্তরসূরিদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আমার একটি ডাকনাম আছে। সেই নাম ডাকার মানুষ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। মালদার মাসিমাই বোধহয় একমাত্র বয়স্ক আত্মীয় যিনি ওই নামে ডাকেন। ৫৩ বছর ধরে কলকাতায় আছি। পরিচিত মানুষের সংখ্যা আর হিসেবে নেই। তাদের কাছে আমি সমরেশ বা সমরেশদা। ওঁদের মুখে ডাকনাম শোনার কথাও নয়। কিন্তু যেই আমি জলপাইগুড়িতে পা রাখি অমনি কেউ না কেউ চেঁচিয়ে বলে, ‘আরে বাবলু, কবে আসলি?’ এখনও কথাটা কানে গেলে বুক জুড়িয়ে যায়। যদিও কাউকে আজ অভ্যেসে বলি, আমি জলপাইগুড়ির ছেলে, তখন তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে। আমায় আর ছেলে বলার বয়স নেই। আমি এখন পূর্ণবয়স্ক লোক। ঠিক হ্যায় ভাই, কলকাতার লোক, কিন্তু নর্থ বেঙ্গলে পা দিলেই যে মনে মনে ছেলে হয়ে যাই।

বহু বছর আগে তিরিশ তো বটেই বাড়ির কাজের লোক এসে জানাল, ‘তোমার সঙ্গে কারা যেন দেখা করতে এসেছে। বসতে বলেছি।’ আমি গম্ভীর হয়ে তাকাতেই সে বলল, ‘নর্থ বেঙ্গলের লোক, শিলিগুড়ির’। তাড়াতাড়ি নিচে নামলাম, দেখি বসার ঘরে তিনজন যুবক বসে আছে। যুবক না বলে তরুণ বলাই ভাল। প্রণাম করতে চেয়েছিল, আপত্তি শুনল।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বলুন কী করতে পারি?’—’আপনি বলবেন না, আমরা শিলিগুড়িতে থাকি, শিলিগুড়ি কলেজে পড়ি। আপনার লেখা পড়ে বড় হয়েছি।’ একজন বিনীত ভঙ্গিতে জানাল।

আমি তাকালাম। আমাদের নর্থ বেঙ্গলের ছেলেদের চেহারা যেরকম হয়। তবে একজন একটু আলাদা। রোগা, ধীরে ধীরে কথা বলে।

জানলাম, ওরা ছাত্র হলেও নানান অনুষ্ঠান করে। এবার ওদের বাসনা একটি চলচ্চিত্র উৎসব করার। মেঘদূত সিনেমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসেছে। আমি যদি ছবিগুলোর নির্বাচন এবং প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে দিই সেই আশায় ওরা এসেছে। রোগা ছেলেটি বলল, ‘আপনি তো দেশ পত্রিকায় চলচ্চিত্র সমালোচনা করেন, তাই ভাবলাম উদ্যোগ নিলে ব্যাপারটা সম্ভব হতে পারে।’

দেখলাম দু’জন কথা বলছে আমাদের উত্তরবঙ্গীয় বাঙালির উচ্চারণে। ‘কবে আসলি, যাক কই’, ধরনের। রোগা ছেলেটি চেষ্টা করছে স্বাভাবিক বাংলা বলতে। আমি ততক্ষণে কাত হয়ে গেছি। নর্থ বেঙ্গলে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল করতেই হবে। যোগাযোগ করতে বললাম প্রযোজক, পরিবেশক, পরিচালকদের সঙ্গে। ওরা কয়েকদিন ছিল কলকাতায়। ফিরে গিয়ে আবার এল পাকা কথা বলার জন্য। ‘দৌড়ে’র পরিচালক শঙ্কর ভট্টাচার্য, বিখ্যাত অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবী এবং আমাকে নিয়ে গেল উদবোধনের দিনে। গেলাম ট্রেনে, হইহই করে উৎসব শুরু হল। আমার আশঙ্কা হত ওদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে না তো! রোগা ছেলেটি আশ্বস্ত করত, ‘না, না হচ্ছে না’।

পরপর দু’-তিন বছর ওরা উৎসব করেছিল মনে পড়ছে। সেই রোগা ছেলেটি আমার ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল। কলেজ থেকে বেরিয়ে এসে আইন পাস করল। কলেজে সে কংগ্রেস ইউনিয়ন করত। কিন্তু কখনওই রাজনীতি নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেনি। ওর বন্ধুরাও তাই। আমি খোঁজ রাখতাম।

কর্মক্ষেত্রে ওর বন্ধুরা কেউ ট্যাক্সির মালিক কেউ ব্যবসাদার। মাঝে মাঝে তাদের আন্তরিক ফোন পাই। কিন্তু রোগা ছেলেটির সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। জানতাম সে কংগ্রেস দলের নেতৃস্থানীয়, হঠাৎ শুনলাম সে তৃণমূলে যোগ দিয়েছে। তারপর তো পৃথিবীর দ্রুতগামী গাড়ির গতিকে ছাড়িয়ে ওপরে উঠতে উঠতে এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উত্তরবঙ্গ মন্ত্রী। একবার কী দু’-বার ফোনে কথা হয়েছিল। একঝলক দেখেছিলাম শিলিগুড়ির একটি হোটেল উদবোধনের সন্ধ্যায়। উত্তরবঙ্গে সে প্রতিবছর অনেক ভাললাগা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। শুনে আনন্দ হয়। সম্ভবত আমাকে সে কলকাতার মানুষ মনে করে। দিনকয়েক আগে ওর বিগত বন্ধুদের একজন ফোন করল। তার গলায় আগেকার সেই উত্তাপ একইভাবে রয়ে গেছে, গৌতমের হয়তো নেই। জীবন কেন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে। মানুষের ক্ষেত্রেও একই কথা। পরিবর্তন মেনে নেওয়া উচিত।

আমি কলকাতায় একরকম, কিন্তু নর্থ বেঙ্গলে পা দিলে কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যাই। জেনেশুনে নয়, অজান্তেই। ছেলেবেলার বন্ধু, পরে মুদির দোকানের মালিক বিকাশের সঙ্গে দেখা হলে সে পকেট থেকে সস্তার সিগারেট বের করে যখন বলে, ‘এটা খেতে পারবি তো—’ তখন গয়েরকাটা-বীরপাড়ার রাস্তায় আংরাভাসা ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আমি স্বচ্ছন্দে সেটা নিয়ে বলি, ‘খুব হাওয়া, ধরাতে পারবি?’

এই আমার জায়গাগুলোতেও কত্ত মান অভিমান। জলপাইগুড়ির লোক শিলিগুড়ির মানুষকে এককালে তির্যক কথা বলত! কেন? এই কলমে আমার যাবতীয় অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছে রইল।

৪৯

কিশোরকালে তিস্তার বাঁধে বসে আমরা বড় বড় ঢেউ দেখতাম। হাকিমপাড়ার বাঁধে বসলে ওপারের বার্নিশঘাট দেখতে পেতাম না। জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর, ওই তিন মাস তিস্তা প্রায় সমুদ্র হয়ে যেত। যদিও সেই বয়সে আমরা সমুদ্র দেখিনি কিন্তু ভেবে নিতাম সমুদ্র বোধহয় এই তিস্তার চেয়ে খানিকটা বড় হবে। আবার শীত-গ্রীষ্মে তিস্তার চরে পক্ষীরাজ ট্যাক্সি ছুটত যাত্রী নিয়ে, শরৎ এলে কাশফুল ফুটত।

আমরা তখনও জানি না, আমাদের প্রিয় স্যর বেণু দত্ত রায় তিস্তা নদীকে নিয়ে উপন্যাস লিখছেন। তখনও বোধহয় দেবেশদার মাথায় তিস্তাপারের বৃত্তান্ত জন্ম নেয়নি। তারপর একটু একটু করে তিস্তা মরানদী হয়ে গেল। এখন এপার-ওপারজুড়ে শুধু বালি আর বালি। কেউ বলেন, তিস্তা ব্যারেজ করে সব জল টেনে নেওয়া হয়েছে, কেউ বলেন, পাহাড় থেকেই কম জল নামছে।

গত সপ্তাহে সেই তিস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম শীর্ণ একটি ধারা বার্নিশের কাছাকাছি বইছে। মন খারাপ হয়ে গেল। আটষট্টির লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন আমি জলপাইগুড়ি থেকে যখন গয়েরকাটায় যাচ্ছিলাম তখন নদীটাকে ফুঁসতে দেখেছিলাম। তারপর ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে তিস্তা জলপাইগুড়ি শহরটাকে তছনছ করে পিছিয়ে দিয়ে গিয়েছিল কয়েক দশক। বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী আমাকে রাতের আড্ডায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তিস্তার সব পানি আপনারাই নিবেন, আমরা কী দোষ করলাম?’ তাঁকে বোঝাতে পারিনি। তিস্তায় জল নেই চরের উপরে দোতলা বাড়ি হয়ে গেছে। চাষ করছে মানুষ। নিশ্চিন্তে বাস করছে। ভদ্রলোক হেসে বলেছিলেন, ‘তাই যদি হয়, তা হলে আপনাদের মুখ্যমন্ত্রী আপত্তি করেন কেন? কোনও কিছু না থাকলে কি তা দিতে কেউ আপত্তি করে?

এবার গিয়েছিলাম কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে। দলগাঁওতে নেমে ঘোরাঘুরি করেছিলাম। ট্রেনে ভুটানে বেড়াতে যাওয়া একটি পরিবারের কর্তা ছেলেমেয়েদের বোঝাচ্ছিলেন, ‘আমরা এখন নর্থ বেঙ্গলে ঢুকে পড়েছি। নর্থ বেঙ্গলের হাসিমারা স্টেশনে নেমে জয়গাঁ হয়ে ভুটানে প্রবেশ করব।’

বাল্যকাল থেকে ওই শব্দটা শুনে আসছি। নর্থ বেঙ্গল। স্বাধীনতার আগে থেকেই নাকি তিনটি বেঙ্গল ছিল। ইস্টবেঙ্গল, ওয়েস্ট বেঙ্গল আর নর্থ বেঙ্গল। ইস্ট থাকলে ওয়েস্ট থাকবেই। নর্থ বেঙ্গল যখন আছে তখন কলকাতা, বর্ধমান, মেদিনীপুরকে সাউথ বেঙ্গল ভাবতে হবে। কিন্তু সাউথ বেঙ্গল কথাটা প্রচলিত নয়। ওই সব জায়গা নাকি ওয়েস্ট বেঙ্গল। ফারাক্কা পার হলেই নর্থ বেঙ্গল, যার শেষ কোচবিহারে। যে কোনও নতুন মানুষ শুনলে ভাববেন নর্থ বেঙ্গল ওয়েস্ট বেঙ্গলের বাইরে। খুব সচেতনভাবে জেনে-শুনে এই ব্যবধানটা তৈরি করা হয়েছে। অনেক পরে যখন বিশ্ববিদ্যালয় হল, তখন নাম দেওয়া হল নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজের আগে নর্থ বেঙ্গল বসিয়ে দেওয়া হল। ভেবে দেখুন তো, গোটা পশ্চিমবঙ্গে একটা সাউথ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি বা সাউথ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ খুঁজে পাবেন কি না। এমনকী, ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ বা ইউনিভার্সিটির হদিশ পাওয়া যাবে না। হ্যাঁ, দীর্ঘকাল নর্থ বেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন চালু থাকার পর সাউথ বেঙ্গল চালু হয়েছে। ওটা নামেই শেষ।

পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখুন, পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে নর্থ বেঙ্গল চিরকাল অবহেলিত এলাকা হিসেবেই সরকার ভেবেছিলেন। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর গৌতম দেবকে উত্তরবঙ্গ বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হল। মুখ্যমন্ত্রীয় মনে হয়েছে, উত্তরবঙ্গ এতকাল অনুন্নত ছিল, মন্ত্রী বসিয়ে যদি কিছুটা উন্নত করা যায়। দক্ষিণবঙ্গ বিষয়ক মন্ত্রীর দরকার নেই। পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ক তো নয়ই, কারণ ওসব জায়গা অনেক উন্নত। অর্থাৎ প্রকারান্তরে স্বীকার করা হল, উত্তরবঙ্গ অবহেলিত ছিল। এই যে এতকাল আমাদের একঘরে করে রেখেছিলেন কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট সরকার তার কারণে নতুন শিল্পটিল্প দূরের কথা, পুরনো চা-বাগানগুলো টিকে থাকার লড়াই-এ পিছিয়ে যাচ্ছিল। আমার এক আমেরিকান বন্ধু যে জলপাইগুড়িতে যেতে চাইছিল, সে দিল্লি থেকে ফোনে বলল, ‘নেটে টিকিট কেটে ফেলেছি ট্রেনের। ভায়া কলকাতা যাব।’

‘কোন ট্রেন?’ জিজ্ঞাসা করলাম।

‘উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস। ওই একটাই তো ট্রেন ওদিকে যায়। বন্ধু তার জ্ঞান জানাল।

‘কেন? দার্জিলিং মেল, তিস্তা তোর্সা, কাঞ্চনকন্যা ছাড়াও অনেক ট্রেন যাচ্ছে ওদিকে।

বন্ধুটি বলল, ‘মাই গড! তা হলে এই ট্রেনটার নাম উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস হল কেন? আমি ভাবলাম অন্যগুলো বোধহয় উত্তরবঙ্গে যায় না।

ভাবুন ব্যাপারটা। আমাদের কথা আলাদা। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এই বাহান্ন বছর ধরে কলকাতার মানুষদের মুখে তো কম কথা শুনলাম না। আমি নর্থ বেঙ্গলের, না ঘটি না বাঙাল। অতএব আমাকে বাটি বলা যায়। দেখতাম, বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখকরা যখন চব্বিশ পরগনা বা বীরভূমের পটভূমিকায় উপন্যাস লেখেন তখন তাঁদের আঞ্চলিক লেখক বলা হয় না। আমি চা-বাগান নিয়ে লিখলেই শুনতে হয়, ‘আপনি আর চা-বাগান থেকে বের হতে পারলেন না। কেন বের হব? জ্ঞান হওয়ার পর যে জায়গা প্রাণভরে দেখেছি, তা আমার লেখায় আলবাত আসবে।’ লক্ষ করেছিলাম, বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দারা, সেই কিরীটি রায় থেকে ফেলুদা হয়ে কাকাবাবু কলকাতার মানুষ। তেত্রিশ বছর আগে যখন কিশোর গোয়েন্দা উপন্যাস বড় কাগজে লিখতে শুরু করেছিলাম, তখন গোয়েন্দা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম অর্জুনকে। তার বাড়ি জলপাইগুড়ির কদমতলায়। রূপমায়া সিনেমার পাশের চায়ের দোকানে আড্ডা মারে। বয়স পঁচিশের নিচে। তার গুরু অমল সোম থাকেন হাকিমপাড়ায়। অজুর্নকে পাঠকরা ভালবেসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *