৩০
ভারতবর্ষের কথা ছেড়ে দিন, আমাদের পশ্চিমবঙ্গের শতকরা কত মানুষ সক্রিয় রাজনীতি করেন? পণ্ডিতরা বলবেন, যাঁরা ভোট দেন, পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে চান তাঁরাই রাজনীতিতে অংশ নিয়ে থাকেন এবং সেটাকে সক্রিয় না বলার উপায় নেই। কারণ তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দেশশাসন করেন।
কিন্তু এদেশে তো ভোট অসাড়ে হয়। ভোটের দিন সকাল পর্যন্ত যাঁকে ভোট দেবেন বলে ভোটার ভেবেছেন, বুথে গিয়ে তাঁকে সমর্থন না করে অন্য কাউকে দিয়ে এলেন, এমন তো ঘটেই থাকে। আবার দলবেঁধে বাড়ির মহিলারা ভোট দিতে গেল, সঙ্গে কাজের মেয়েটিও। গিন্নিমা যাঁকে ভোট দেবেন জেনে নিয়ে কাজের মেয়েও তাঁকেই ভোট দিল। এই বছর থেকে একটা নতুন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। কোনও প্রার্থীকে পছন্দ না হলে সেটাই জানানো যেতে পারে। অর্থাৎ ওই ভোটটা হিসেবে এল না। কিন্তু একটু চিন্তা করলে বোঝা যাবে যে ব্যক্তি কাউকে ভোট দিলেন না বুথে গিয়ে তিনি কিন্তু বোঝাতে পারতেন তাঁর রাজনৈতিক ভাবনাশক্তি আছে। অতএব সত্তর আশি শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন দেখে যদি বলা হয় তাঁরা সক্রিয় রাজনীতি করেছেন তাহলে জলে অনেক কম দুধ মেশানো হবে।
পশ্চিমবাংলার মানুষ দেখতে ভালবাসে। অল্প স্বল্প উত্তেজনায় আগুন পোয়াতে পছন্দ করে। নির্বাচনের আগে পাড়ায় যে কোনও রাজনৈতিক দলের সভায় তাই একই মুখ ঘুরেফিরে দেখা যায়। বিকেলে শুরু হয় সভাগুলো, শেষ হয় রাত দশটা পর্যন্ত। দেখা যাবে যে সব প্রবীণের কোনও কাজ নেই, সন্ধেটা বাড়িতে কাটছে না কারণ টিভি অন্যের দখলে, তিনি এরকম রাজনৈতিক সভা হলে খুশি হন। ঘন্টা চারেক বক্তৃতা শুনে কাটিয়ে দেওয়া যায়। আজ তৃণমূল, কাল বিজেপি, পরশু কংগ্রেস, তার পর দিন বামফ্রন্ট। আপাতচোখে মনে হবে এঁরা প্রতিটি সভায় বক্তব্য শুনে শুনে স্থির করবেন কাকে ভোট দেবেন। কিন্তু ভোটের দিন কেউ যদি বলেন, ‘দাদু, ভোট দিতে যাবেন না’, তাহলে তাড়াতাড়ি বিছানায় বসে যাবেন পেটে ব্যথা হচ্ছে বলে।
একসময় বিশ্বাস করতাম, মানুষই শক্তির উৎস। মানুষই ভোট দিয়ে অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে। বিশ্বাস এখনও রয়েছে কিন্তু তার উপর ধুলো পড়েছে। ধুলোয় জল মিশলে জং পড়তে বাধ্য। যত দিন যাচ্ছে তত দেখতে পাচ্ছি মানুষের সহ্যশক্তি বেড়ে চলেছে। সহ্যশক্তি বেড়ে যায় দুটো কারণে। এক, মানুষ যখন উদার হয়, ছোটখাটো ত্রুটিকে উপেক্ষা করে নিজেকে আরও বড় করে দেখতে ভালবাসে। দুই, যখন তার মেরুদণ্ডে ক্ষয় শুরু হয়, প্রতিবাদ করলেই আক্রান্ত হব এই ভয়ে কুঁকড়ে থাকে, তখন সে সবকিছু সহ্য করতে চায়। সহ্য না করে তার কোনও উপায় থাকে না।
ভারত বাংলাদেশের সীমান্তে রোজ অনুপ্রবেশ ঘটছে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। সীমান্তের কাছাকাছি কিছু মানুষকে প্রশ্ন করেছিলাম। ”আপনাদের চোখের সামনে দিয়ে ওরা ঢুকছে, বিএসএফ বা পুলিশকে জানানো নাগরিক হিসাবে আপনার কর্তব্য। জানাচ্ছেন না কেন?” উত্তরটা হল, যারা আসছে তাদের দালালরা নিয়ে আসছে পুলিশকে জানালেই সেই দালালরা বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেবে। তার চেয়ে চুপ করে থাকাই ভাল।
তাহলে এই মানুষগুলো সক্রিয় রাজনীতি করেন না। এই যে ময়দানে জনসভা থাকলে হাজার হাজার বাস দূরের গ্রাম-মফস্বল থেকে মানুষ বয়ে নিয়ে আসে, সেই মানুষরা কি সক্রিয় রাজনীতি করেন? শিয়ালদহ-হাওড়া থেকে চলবে না-নিপাত যাও স্লোগান দিয়ে দূরের স্টেশনগুলো থেকে যাঁরা কলকাতায় আসেন তাঁরা তো অবশ্যই রাজনীতি করেন। কিন্তু চোখ খোলা রাখলেই দেখা যাবে শহরে আসা মিছিলের এক অংশ ছিটকে যাচ্ছে কালীঘাট মন্দিরের দিকে, মেট্রো রেল দর্শনে, সাহসীরা দক্ষিণেশ্বরে। মিটিং শেষ হওয়ার আগেই তাঁরা আসেন গ্রামগঞ্জে ফিরে যেতে। একটা সময় শুনতাম এই মানুষগুলোকে জনসভা ভরাতে নিয়ে আসা হত সামান্য হাতখরচ এবং রুটি তরকারি খাইয়ে। স্বামী-স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ি এবং দুটি সন্তানের একটি পরিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিল, “বাবু, কালীঘাট কাছে না দক্ষিণেশ্বর? বেশি সময় তো হাতে নেই!” ‘যে কখনও কলকাতায় আসেনি, আসার সুযোগ পায়নি, তার কাছে এই রকম জনসভায় আসা তো আকাশকুসুম পাওয়া। সেই জনসভায় কী নিয়ে চর্চা হল, কে কে তাতে অংশ নিল এই খবরের কোনও প্রয়োজন নেই, তারা তাদের শরীর দেখিয়ে গিয়েছে, ওইটেই শেষ কথা।
গণতন্ত্র যখন চেহারা বদলাল তখন মহাসভায় গিয়ে প্রাপ্তির বদলে না গেলে জীবন বিপন্ন হওয়ার ভয়ে পায়ে পা মেলাতে বাধ্য হল জনতা। কে কে গিয়েছে, কে যায়নি, কেন যায়নি, তার তালিকা এবং কৈফিয়ত বড় ভয়ঙ্কর। কোনও হাতখরচ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। হেঁটে ময়দান থেকে যদি কালীঘাট ঘুরে না আসা যায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তো যাওয়া যায়, তাই সই। এঁরা কি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে থাকেন?
আমি রোজগার করব কষ্ট করে। সেই রোজগারের টাকায় সংসার চালাব, ছেলেমেয়েকে মানুষ করব। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েই চলেছে তাতে আমার অবস্থা শ্যাম রাখি না কুল রাখি। সরকার দাম কমাতে পারছে না। সরকারি রাজনৈতিক দল এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ মেরে বসে আছে। বিরোধী দল যত গজরাক তাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই। অতএব সামনে দুটো পথ। এক, বিদ্রোহ করা, বাজারে গিয়ে সবাই মিলে প্রতিবাদ জানিয়ে বলা, ওইসব জিনিস যত কষ্টই হোক ব্যবহার করব না। এক বাজার থেকে অন্য বাজারে ওই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়লে অবস্থার পরিবর্তন হতে বাধ্য। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? যিনি প্রথম মুখ খুলবেন তাঁকেই তো সরকার বিরোধী বলে চিহ্নিত করা হবে। দুই, এই পথটা মানুষের ভারি পছন্দ। আন্দোলন, বিপদ ডেকে আনার সম্ভাবনা নেই। যে এতদিন অফিসে বকশিস অথবা ঘুষ নিত না সে নিতে শুরু করুক। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তার গায়ে লাগবে না। ছেলেমেয়েরা ‘মলে’ গিয়ে পছন্দের কিছু কিনতে চাইলে ওদের হাতে টাকা দেওয়া যাবে। এর সঙ্গে ভাল শেয়ার কিনে লাভ করলে তো কথাই নেই। কে রাজনীতি করে?
একটা নির্বাচন হয়ে গেলে দেখবেন বিজয়ী এবং বিজিতের মধ্যে ভোটের গড়পড়তা পার্থক্য বেশি থাকে না। তাদের বাইরের দলগুলো যা ভোট পায় তা বিজিতের ভোটের সঙ্গে যোগ করলে বিজয়ী উড়ে যাবে। কিন্তু ভোট পাওয়া আর আসন পাওয়া এক কথা নয়। যদি সত্তর শতাংশ ভোট পড়ে তাহলে বুঝতে হবে বাকি তিরিশ শতাংশ রাজনীতি না করে দিব্যি বেঁচে আছেন। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ফাঁকি হল, ভোট দিয়েও এদেশে রাজনীতি না করে থাকা যায়। রাজনীতি করেন মাত্র এক শতাংশ লোক। বাকিরা নির্বোধ মোটেই নন। অসীম সহ্যশক্তি নিয়ে সুযোগের সন্ধানে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকেন। থাকেন যে সেটা নিজেরাই জানেন না।
৩১
এখনকার বাঙালি তাঁর ধর্মাচরণ কতটা আগ্রহের সঙ্গে করছেন? তিনি যদি খ্রিস্টান হন তাহলে আমরা ভেবে নেব প্রতি রবিবার সকালে গির্জায় প্রার্থনা করতে যান। আমার এক খ্রিস্টান বন্ধু বললেন, যে তাঁর পিতা ঝড়জল প্রলয় হলেও রবিবার গির্জায় যেতেন। না যাওয়ার কথা ভাবতেই পারতেন না। তিনি অবশ্য জরুরি কোনও কাজ এসে গেলে কোনও কোনও রবিবারে ডুব দেন। সেই কাজটা না করলে যা ক্ষতি হবে তা নিশ্চয়ই গির্জায় যাওয়ার পুণ্যের চেয়ে কম নয়। কিন্তু বড়দিনের সময় সমস্ত জরুরি কাজ দূরে সরিয়ে রাখেন। অর্থাৎ বেশিরভাগ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ তাঁদের প্রার্থনার মধ্যে শান্তি পেতে চান।
কলকাতার মুসলমান সমাজের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বেশ কম। যেটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়েছে অবাঙালি মুসলমান এবং বাঙালি মুসলমানের মধ্যে ভাবনা এবং রুচি, সংস্কৃতির পার্থক্য রয়েছে। এই মুহূর্তে একটি মুসলমান যুবক আমার ঘনিষ্ঠ যে প্রতিবছর নিষ্ঠার সঙ্গে রোজা রাখে, প্রতি শুক্রবারে নমাজ পড়ে আবার তার প্রিয় হিন্দু বন্ধু অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে থাকার সময় বন্ধুর মাতৃবিয়োগ হলে তাঁর মুখাগ্নি শুধু করেনি, শ্রাদ্ধও করেছে। ছেলেটি অবাঙালি। কিন্তু চমৎকার বাংলা বলে। বুঝতেই পারি ছেলেটি ব্যতিক্রম। কিন্তু প্রতি শুক্রবার দুপুরে মসজিদের সামনে যাঁরা নমাজ পড়েন তাঁদের সংখ্যা নিশ্চয়ই কলকাতার যত মুসলমান বাস করেন তার বিশ শতাংশ হবে না। বাকিরা কে কীভাবে ধর্মাচরণ করেন তা আমার জানা নেই। একই দেশে, একই শহরে বাস করি অথচ ঘনিষ্ঠতা তৈরি হচ্ছে না কেন? অথচ সিরাজদা, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সঙ্গে প্রচুর আড্ডা মেরেছি। কিন্তু আমরা কেউ ধর্ম সংক্রান্ত কোনও কথা বলিনি। আমি যখন প্রথম কোরাণ পড়ি তখন অনেক ভুলভ্রান্তি দূর হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ করতাম কোরান নিয়ে কেউ আলোচনা করতে চাইতেন না। একজন হিন্দু অধ্যাপক বলেছিলেন, মুসলমানরা তাঁদের ধর্ম নিয়ে খুব স্পর্শকাতর। বিশেষ করে কোরান তাঁদের কাছে এত পবিত্র গ্রন্থ যে আলোচনা করতে গিয়ে তিক্ততা তৈরি হতেই পারে। কী দরকার!
এসব এই বাংলার কথাবার্তা। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাঙালি এবং তাঁরা মুসলমান। কিন্তু তাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান হৃদয়ে নিয়েছেন, আমাদের লেখায় হিন্দু দেবদেবীর কথা থাকলে দূরে সরিয়ে রাখেন না, জল বাদ দিয়ে দুধ খেতে জানেন। ওঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি। দেখেছি কেউ মুসলমান ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেন না কিন্তু এখন অনেকেই ধর্মের পাশাপাশি ব্যক্তিগত মতামতকেও প্রাধান্য দেন। নিউ ইয়র্কে থাকেন মীনা ফারহা, বাঙালি মহিলা, আল্লাকে সমালোচনা করে বই লিখলেন, ‘গড অন ট্রায়াল’। অনেক অভিযোগ। কেন আল্লা পুরুষদের সুযোগ দিয়ে নারীদের বঞ্চিত করেছেন, এই প্রশ্ন তুলেছেন মহিলা। অথচ এই বই নিয়ে বাংলাদেশে হইচই হয়নি। একটা কথা বলা ভাল, তসলিমা নাসরিনকে বাংলাদেশের মানুষ অপছন্দ করেছিল তাঁর যৌনস্বাধীনতার জন্যে, আল্লা বিরোধিতাতেও যা প্রকট ছিল। মীনা তা করেননি তবু গৃহীত হননি।
যতবার ঢাকা-চট্টগ্রাম গিয়েছি, কাজে অকাজে দিনসাতেক ধরে থেকেছি এবং আমার সঙ্গে যারা ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত থাকত তারা নমাজ পড়ত কখন? সরাসরি জিজ্ঞাসা করলে শুনতাম, রাতে বাসায় গিয়ে পড়ি। দিনের বেলায় অসুবিধা থাকলে রাত্রে!
রোজার সময় যে সবাই নিয়মনিষ্ঠ তা নয়। কেউ কেউ আংশিক রোজা রাখেন, কেউ কোরান থেকে অজুহাত খুঁজে নেন। যেহেতু অসুস্থ অথবা মুসাফিরের রোজা রাখার বাধ্যবাধকতা নেই তাই হাঁটুতে ব্যথা বা সর্দিকাশিতেও রোজা রাখেননি এমন মুসলমানকে আমি জানি, চট্টগ্রামের মানুষ ঢাকায় এসে নিজেকে মুসাফির ঘোষণা করে রোজা রাখবেন না। এ ছাড়াও রাস্তায় যেতে যেতে পর্দা ঢাকা রেস্টুরেন্টে দুপুরবেলায় ভিড় উপচে পড়তেও দেখেছি। এসব নিয়ে ওঁদের সঙ্গে রঙ্গতামাশা করেছি, ওঁরা বিন্দুমাত্র স্পর্শকাতর হননি। বিখ্যাত নাট্যকার ঔপন্যাসিক, কবি সৈয়দ সামসুল হক আমাকে বলেছেন, “আমি মুসলমানদের ব্রাহ্মণ। রোজ পাঁচবার নমাজ পড়ি ভাই। কিন্তু রাত্রে রবীন্দ্রনাথের গান না শুনলে আমার ঘুম আসে না।”
আমার কিছু সমস্যা আছে। বাবা-ঠাকুর্দার কথায় আমি হিন্দু। কিন্তু হিন্দু সংস্কৃতির কোনও কিছুই আমি পালন না করতে অভ্যস্ত, হিন্দুরা যে সাত-আটজন দেবতা তৈরি করে তাঁদের আঁকড়ে ধরে ভাবেন ধর্মাচরণ করছেন তা থেকে হাজার হাত দূরে থাকায় নিজেকে কী করে হিন্দু বলি? সেই যে গল্প, তিন ভাই তিন গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে শাক্ত বৈষ্ণব এবং শৈব হয়ে গেল। কে বড় হিন্দু তা নিয়ে তর্ক শুরু হল, শেষে তিনজন পরস্পরের মাথা ফাটাল। একজন নার্স তাই দেখে মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দিতে দিতে বলল, কালী, কৃষ্ণ এবং শিব-এর শিষ্য হয়ে মারপিট করলেন, আমি জাতে চণ্ডাল কিন্তু ওই তিনজনকেই পুজো করি।
এসব তো প্রাচীন কথা। এখন হিন্দুধর্ম খুঁজতে হয় বারোয়ারি পুজো, ইসকনের রথযাত্রায়। এখন বাড়িতে ঠাকুরঘর নেই। বৃহস্পতিবারে শাঁখ বাজে না। সামনের পুজোয় কোনও ট্রেনে টিকিট পাবেন না, তথাকথিত হিন্দুরা পুজো ছেড়ে ভ্রমণে যাবেন এই সময়ে। মাইকের অত্যাচার, রাস্তায় ভিড় থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইবেন। বাড়িতে পুজো হয় না, বারোয়ারি পুজো পাড়ার দাদারা করে থাকে, ওখানে যাওয়ার ইচ্ছেই হয় না। মা আসেন টিভিতে, চলেও যান টিভিতে। বাঙালি গলা তুলে বলে, পুজো টুজো নয়, সারা বছরের একমাত্র বিনোদন এই ক’দিন। সেটা ঘরে থেকেও যা বাইরে গিয়েও তাই।
একেবারে এড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না বলে সংক্ষেপে সারা হচ্ছে কিছু আচার অনুষ্ঠান। গায়ে হলুদ, মালাবদল, বিয়ের মন্ত্র, বাসর, ফুলশয্যা, সব একদিনে। ছেলের বাড়ি আর মেয়ের বাড়িতে আলাদা না করে একসাথে সবার নিমন্ত্রণ।
ক্রমশ শ্রাদ্ধে পাত পেতে খাওয়া শুধু শ্মশানযাত্রীদের জন্য। ফুল নিয়ে যাঁরা আসছেন তাঁদের জন্য ভাল রসগোল্লা। সুগারের জন্য তাও বেঁচে যাচ্ছে। এখন শ্রাদ্ধবাসরের বদলে শ্রদ্ধাবাসরের আমন্ত্রণ এলে কেউ তাড়া করেন না। ভাটপাড়ায় যে বামুনরা থাকতেন তা এই প্রজন্মের বাঙালি ভুলে গিয়েছে। কিছু কিছু বাড়িতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন বিভিন্ন গুরুর শিষ্যরা। গুরুরা গত হয়েছেন অনেকদিন। শিষ্যরাও যাব যাব করছেন। তবু গুরুদেবের জন্মদিনে লোক খাওয়ানো হয়। আজকের নাতি সেকালের ঠাকুর্দাকে জিজ্ঞাসা করে, তোমার গুরুদেব কি যিশুর মতো?
আমার পরিচিত সান্যালবাবু বড় বিপদে পড়ে আমার কাছে এলেন। তাঁর বাবা দশবছর আগে মারা যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন গয়ায় গিয়ে পিণ্ডি দিতে। শুধু তাঁর একার নয়, তাঁর বাবারও। যাব যাব করে এতদিনে সময় হয়েছে। তিনি গয়ায় যাচ্ছেন দেখে তাঁর স্ত্রী উৎফুল্ল হয়ে চারদিকে ছড়িয়েছেন, ‘জানো, ও গয়ায় যাচ্ছে।’ ব্যস। জনস্রোতের মতো মৃত আত্মার আত্মীয়রা এসে নামগোত্র আর দু’দশ টাকা দিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের হয়ে পিণ্ডি দেওয়ার জন্যে। এত বাঙালি হিন্দু পিণ্ডিহীন হয়ে ছিল ভাবতে পারছেন না সান্যালবাবু। ফাল্গুনি এল ঢাকা থেকে। সঙ্গে তার স্বামী হামিদ। ফাল্গুনি গয়ায় গেল পিণ্ডি দিতে তাঁর পূর্বপুরুষের মুক্তির জন্য। মুসলমানের বউ হলেও সে তো হিন্দু। ফিরে এসে বলল, দিয়ে দিলাম। হামিদও দিল! আমি আঁতকে উঠলাম, ‘সে কী?’
হামিদ বলল, আমি যে মুসলমান তা পাণ্ডা বোঝেনি। ফাল্গুনির গোত্রটা আমায় বলে পিণ্ডি দেওয়াল। পিণ্ডি খেয়ে ওর বাবা যদি স্বর্গে যেতে পারে আমার বাবা বেহেস্ত যেতে পারবে না কেন? হো হো করে হাসল হামিদ, ‘বেশ মজা লাগল।’
বললাম, ‘এই মজাটা পরের প্রজন্ম পেতে চাইবে না।’
৩২
ছেলেটি অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী, সুদর্শন। লম্বায় ঠিক ছয় ফুট, ছিপছিপে শরীর। বয়স আঠাশ। এর মধ্যে প্রচুর পড়াশোনা করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বছরে তিরিশ লাখ টাকার চুক্তিতে চাকরি করছে। সিগারেট অথবা মদের নেশা আছে। শখ ছবি তোলার আর টেনিস খেলার।
আমাদের ক্লাবে নব্বই ভাগ মানুষ যান পানভোজন করতে, একটু আড্ডা মারতে। ছেলেটির বাবা যেহেতু আমাদের আড্ডার শরিক তাই আমরা ওর কাকা। লক্ষ করবেন সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে বের হয়ে এত এত মাইনে পাওয়া ছেলে সামনে এসে আঙ্কল না বলে কাকা বলে। ক্লাবের বয়স্কা মহিলারা ওকে খুব পছন্দ করে, পরিকল্পনাও। সেটা ঠিক কাজে লাগছে না কারণ ক্লাবে এলেই সে সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে কোনও না কোনও খেলার মধ্যে ঢুকে যায়। ওর বাবা শেষপর্যন্ত বললেন, ‘এই ছেলে প্রেম ট্রেম করবে না, বুঝলেন। আরে তোর বাবা যেটা তিরিশ বছর আগে করতে পেরেছিল সেটা তুই আজও পারলি না! বেশি বললে অফিসের ফ্ল্যাটে চলে যাওয়ার ভয় দেখায়।’
আড্ডার এক সদস্য বললেন, ‘প্রেম না করলে সম্বন্ধ করে বিয়ে দাও।’
‘ভয় লাগে, বুঝলেন। কাগজে পড়লাম, আজকাল সম্বন্ধ করা বিয়ের ষাট ভাগই এক বছরের মধ্যে ভেঙে যায়। চেনাশোনা মেয়ে হলে না হয়—!’ ছেলেটির বাবা সসঙ্কোচে বললেন।
‘তোমাদের চাহিদা কিছু আছে?’
‘একদম না। মেয়েটিকে ডানাকাটা পরী হতে হবে না, সুশ্রী হলেই হবে। মিনিমাম গ্র্যাজুয়েশন করা, একটু ইংরেজি বলতে পারা—ব্যস’, ছেলেটির বাবা বললেন, ‘আর ও তো লম্বা তাই ওর সঙ্গে মানানসই হাইট না হলে খারাপ দেখাবে।’
এ তো খুব সাধারণ চাওয়া। তিরিশ লাখ মাইনের জন্যে ইংরেজি জানা গ্র্যাজুয়েট, সুশ্রী এবং পাঁচ ফুট পাঁচ-ছয় ইঞ্চির লম্বা পাত্রী চাই। ওরা অনেক বেশি পড়াশোনা করা অনেক সুন্দরী পাত্রী চাইতে পারত। চায়নি।
পরের সকালে খবরের কাগজ হাতে নিয়েই সূর্যশেখরের কথা মনে এল। সূর্যশেখরের পৈতৃক ব্যবসা সে ভাল চালায়। ওর স্ত্রী তনুকার একটা চালু বুটিক আছে। ওদের দুই মেয়ে। দুজনেই বেশ সুন্দরী, লম্বা, একজন গ্র্যাজুয়েশনের পর এমবিএ-র ফাইনাল দিচ্ছে, ছোটটা সবে কলেজে।
আমি সূর্যকে ফোন করলাম, তনুকা ধরল, জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার মেয়েরা কি প্রেম করছে?’
‘আর বলবেন না দাদা, ওদের দ্বারা কিছু হবে না। পড়াশোনা আর আড্ডা ছাড়া কিছু বোঝে না। বড়টা তো বলেই দিল ওর পক্ষে প্রেম করা সম্ভব নয়।’
‘বাঃ, খুব ভাল।’
‘একী! আপনি ভাল বলছেন? আমি ওর জন্যে বর খুঁজতে পারব না।’
‘খুঁজতে হবে না। এই নাও নাম নাম্বার। তোমরা যোগাযোগ কর। ছেলেটি সম্পর্কে আমার কোনও দ্বিধা নেই। যা বলার সব বললাম।’
ওদের যোগাযোগ হত। কথাবার্তাও। ছেলে এবং মেয়ে, তাদের বাবা-মা একটা রেস্টুরেন্টে আড্ডাও মারল। তার কিছুদিন পরে ছেলেটির বাবা আমার কাছে এসে বললেন, ‘কী করে মুখ দেখাই বলুন তো। এরকম হবে ভাবতে পারিনি।’ কী হয়েছে? না, ছেলেটির বাবার বৃদ্ধ কাকা মেয়েটির ঠিকুজি দেখতে চেয়েছিলেন। সেটা দেখে বিয়ে নাকচ করে দিয়েছেন। বলেছেন প্রেম করে বিয়ে করলে তাঁর কিছু বলার ছিল না, সম্বন্ধ করে এই বিয়ে হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। দুজনের কোনও মিল নেই। দু’হাজার চোদ্দো সালে এই কথাগুলো মেয়ের বাবাকে কী করে বলবেন? আগে জানলে মেয়ের ঠিকুজি পাল্টে কাকাকে দেখাতেন!
অতএব বিয়েটা হল না। এই দুই হাজার চোদ্দো সালে ছেলেটির বাবা- মা তাঁদের কাকাকে বিস্তর গালাগালি দিলেন কিন্তু মেনে নিলেন। ক্লাবে দেখা হলে ভদ্রলোক বললেন, ‘ওই জেনারেশন না যাওয়া পর্যন্ত দেশটা বদলাবে না।’ ‘কাকার বয়স কত?’ ‘আর বলবেন না। একাশি। এখনও তিন কিমি হাঁটেন। কিছু করার নেই।’
‘এই যে আপনি ক্লাবে এসে দু’তিন পাত্র গলায় ঢালেন, তিনি কিছু বলেন না?’
‘দূর! ঠিক ন’টায় ডিনার খেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করেন। আমি ঢুকি সাড়ে দশটায়, তখন তো ওঁর মধ্যরাত।’
অনেকেই শ্রাদ্ধের কার্ড দিতে এসে বলেন, ‘আপনাকে যেতেই হবে। মা বলে গেছেন।’
‘সেকী। ওঁর শ্রাদ্ধে আমাকে যাওয়ার জন্য বলে গেছেন?’ আমি হতভম্ব।
‘শুধু তাই নয়। কীভাবে শ্রাদ্ধ হবে তার ডিটেলস লিখে গেছেন। ব্যবস্থা করতে আমার নাভিশ্বাস।’
‘করছ কেন? কী দরকার?’
‘বদনামের ভয়ে। লোকে বলবে মায়ের শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করল না।’
মা-বাবা থেকে শুরু করে যত গুরুজন বাড়িতে ছিলেন তাঁদের ইচ্ছেই আইন হয়ে যেত। অমুক তিথিতে উপোস কর, সূর্যগ্রহণ চন্দ্রগ্রহণে বাসি রান্না ফেলে দাও, ছেলের ঢাকঢোল পিটিয়ে অন্নপ্রাশন কর আর মেয়ের মুখের ভাত দাও মন্দির থেকে প্রসাদ আনিয়ে, চুপচাপ। এসব চলছিল। তারপর একে একে সবাই চলে গেলেন। ব্রত, উপোস উঠে যেতে যেতে থেকে গেল শ্রাদ্ধ, পৈতে এবং বিয়েতে পূর্বপুরুষের স্মৃতিগুলো। পঞ্চাশ বছরে বাড়ির নতুন মালিক হয়ে ঠাকুরঘরটিকে কম্প্যুটার রুম করার জন্য ছেলের আবদার মেনে নিয়েছেন কিন্তু কিন্তু করে। শনিবার সন্ধেবেলায় দু’তিন বন্ধু এনে আজকাল চায়ের বদলে হুইস্কি ঢালতে অসুবিধা হয় না। বিশেষ করে বাড়ি রং করার পর পূর্বপুরুষের ছবিগুলো দেওয়াল থেকে সরিয়ে চিলেকোঠায় রেখে দেওয়ার পরে।
কিন্তু ওই। সব বদলেও বদল হয় না। সেই সিনেমার বিজ্ঞাপনের মতো। সিনেমাটির নাম ‘যারা রোদ্দুরে ভিজেছিল’। শুনলেই আধুনিক কবিতার লাইন মনে পড়ে, ভাবনাটাও খুব ধারালো। কিন্তু পোস্টারে ছবির নামের উপরে বড় অক্ষরে লেখা থাকছে, ‘আসিতেছে আসিতেছে।’ তাপস পাল যে রেপ করাবে বলেছে তার থেকে কম কিছু নয়। ভাষার গুরুচণ্ডালী দোষ সহ্য করার সঙ্গে ভাবনার আছাড় বড় বেদনাদায়ক।
যেখানে বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে বহুকাল আগে, মা মেয়েকে মানুষ করে বিয়ের আয়োজন করেছেন সেখানে কেন কার্ড ছাপানোর সময় লিখতে হবে, ‘একদা ঢাকার অধিবাসী, পরবর্তীতে কলিকাতার বরাহনগরের স্বর্গত কামাখ্যাপ্রসাদ দত্তের পৌত্রী এবং আমার একমাত্র কন্যা—’? স্বামী যেখানে অতীত এবং আলোচ্য নন সেখানে তাঁর বাবার পরিচয় কী প্রয়োজন?
আসলে আমরা, যেখানে ধর্ম ধর্ম গন্ধ আছে বলে মনে করি, সেখানে অভ্যেসের দাসত্ব নিয়ে ফেলি। বাড়ি থেকে পূর্বপুরুষ-মহিলাদের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতী পুজো উঠে গিয়েছে কিন্তু মুম্বইতে বেড়াতে গিয়ে গণেশ পুজো দেখে বেড়াচ্ছি পরম ভক্তিভরে। আমাদের এই দু’নম্বরী আচরণ পরের প্রজন্ম কিন্তু একটুও পছন্দ করছে না। তারা বড় হচ্ছে তাদের নিজস্ব পথে। আমাদের মতো না ঘাটকা না ঘরকা হয়ে নয়।
৩৩
আমার ছোটপিসির বিয়ে যখন প্রায় পাকা, তখন পাত্রপক্ষের একজন এসে ঠাকুর্দাকে সবিনয়ে বলেছিলেন, ‘কিছু চাই না। শাড়ি-টাড়ি যা দেওয়ার দেবেন, ননদ পুঁটুলির সঙ্গে কিন্তু সোনাটা আলাদা দিলে ভাল হয়।’
সেই আলোচনার সময় আমার বয়সের বালকদের ঘরে ঢোকা নিষেধ ছিল কিন্তু বড়পিসির দৌলতে প্রতিটি বাক্য পরে শুনেছিলাম। ঠাকুর্দা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কত সোনা দিতে হবে তার আন্দাজ যদি দেন—!’ ভদ্রলোক মাথা নেড়েছিলেন, ‘কুড়ি ভরির নিচে নিলে মান থাকবে না। আপনি ওই কুড়ি ভরিই দেবেন।’
‘সেকী!’
‘আরে ওই সোনা আপনার মেয়ের ভবিষ্যতের জন্যে দিচ্ছেন। ভগবান না করুন, যদি খারাপ সময় কখনও আসে তাহলে ওই সোনা আপনার মেয়ের উপকার করবে। বলতে পারেন ওটা আপনার মেয়ের ভবিষ্যতের সিকিউরিটি।’
ঠাকুর্দা গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, ‘তা হলে যার হাতে মেয়ে দিচ্ছি সে অকর্মণ্য, বউয়ের নিরাপত্তা দিতে পারবে না। না মশাই, এই বিয়ে আমি দেব না।’
বিয়ে বিয়ে ভাব বাড়িতে এসে গিয়েছিল বলে ঠাকুর্দার সিদ্ধান্তে মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল আমাদের। তখন সোনার ভরি কত ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার বয়স হয়নি তখন। তবে চার আনায় এক সের ভাল চাল পাওয়া যেত। এক টাকায় আশিটা কমলালেবু। পরে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, সোনার ভরি পঞ্চাশ টাকার মধ্যেই ছিল। অর্থাৎ পাত্রপক্ষের দাবি মেটাতে ঠাকুর্দাকে এক হাজার টাকা খরচ করতে হত। তখন এক হাজার টাকা বেশ স্বপ্ন স্বপ্ন ব্যাপার ছিল।
ঠাকুর্দা রাজি না হলেও বাঙালির বিয়েতে সোনা দেওয়া এই সেদিন পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ছিল। যখন কিছু মানুষের আত্মসম্মানবোধ জেগে উঠল, ছেলেমেয়েরা সিস্টেমটাকে ভাঙতে চাইল, তখন ব্যাপারটা গোপনে সারতে চেষ্টা করছেন অনেকেই। এই আত্মসম্মানবোধের সঙ্গে পণপ্রথার বিরোধ এখনও চলছে। পাত্র এখনও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত হয়ে থাকার চেষ্টা করেন, ভাবখানা এমন, ওসব বড়দের ব্যাপার। আর পাত্রী, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, মনে মনে পাত্রপক্ষের চাহিদা পূর্ণ করার পক্ষে। সোনাটা তো তারই থাকবে।
এইভাবে প্রতিটি বিয়েতে ভরি ভরি সোনা হাতবদল হয়ে থাকে। তবে ঘরে এবং পরে ব্যাঙ্কের লকারে সেগুলো জমা হয়ে পড়ে থাকে। পঞ্চাশ টাকার ভরি যখন বাড়তে বাড়তে তিরিশ হাজারে গিয়ে পৌঁছয় তখনও তাতে হাত পড়ে না। খারাপ সময় এলে ধার করে চালাও কিন্তু আরও খারাপ সময়ের জন্যে ওগুলো রেখে দাও।
এই যে সোনা জমিয়ে রাখার প্রবণতা ভারতীয়দের, বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক দেখা যায়। সময় ভাল যাচ্ছে না বলে আট আঙুলে আটটা সোনার আংটিতে পাথর গুঁজে যিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁকে ভাগ্য কতটা সাহায্য করছে তা জানা গেল না কিন্তু তিনি যে টাকার জোরে অনেকটা সোনা দখল করে আছেন এই হুঁশ তার নেই। কানের দুল, হাতের চুড়ি, গলার হার থেকে শুরু করে একসময় মেয়েরা মাথা থেকে পা পর্যন্ত গয়না পরতেন। পাল্টে যাওয়া সময়ে মেয়েরা আর গয়নার বোঝা বইতে চাইছেন না। একেবারে নব্যরা গয়নার বদলে হাতে-পায়ে উল্কি আঁকিয়ে বেশি খুশি থাকেন। যে মেয়ের হাতে উল্কির আলপনা সে কেন গয়না পরেনি, এই প্রশ্ন বয়স্করাও করবেন না। তা হলে তাঁর মা-ঠাকুমারা যে শরীর ফুঁড়ে সোনার গয়না পরতেন সেগুলো কোথায় গেল? এমন ভয়ঙ্কর দিন তাদের পরিবারে আসেনি যে, সোনা বিক্রি করে সামলাতে হবে। তা হলে সেগুলো জমছে। হয় বাড়ির লোহার ভারী সিন্দুকে, নয় ব্যাঙ্কের লকারে।
শ্রীযুক্তা জয়ললিতা একজন মহিলা। তাঁর স্বর্ণপ্রীতির কাহিনি আমরা এখন জেনেছি। ভরি নয়, কেজিতে তিনি সোনা জমিয়েছেন। তাঁর ভাইবোন অথবা সন্তান নেই বলে জানি। তা হলে তিনি গত হলে ওই কেজি কেজি সোনার কী হবে তার হদিশ খবরের কাগজ দেয়নি। আমার সঙ্গে স্কটিশে পড়ত মল্লিক বাড়ির একটি ছেলে। তার বাবা অল্প বয়সে মারা যান। প্রায়ই সে কলেজে আসত নতুন নতুন সোনার আংটি পরে। জিজ্ঞাসা করলে বলত, তার ঠাকুর্দার সিন্দুকে এরকম একশোটা আংটি আছে। মাঝে মাঝে ব্যবহার করলে চকচকে থাকবে বলে ঠাকুর্দা সিন্দুক থেকে বের করে পরতে দেন। ওই সিন্দুকে কত ওজনের গয়না আছে তা সে জানে না। তবে ঠাকুর্দা একা বের করতে পারেন না বলে তাকে সাহায্য করতে হয়। ভবিষ্যতে ওই গয়না নিয়ে সে কী করবে তার জানা নেই। এমনই দুর্ভাগ্য, ছেলেটি গঙ্গায় সাঁতার কাটতে গিয়ে তলিয়ে যায়। দু’-তিনদিন গিয়ে দেখেছি ওদের বিশাল বাড়ির একতলার একটি ঘরের সামনে চেয়ার পেতে বৃদ্ধ ঠাকুর্দা বসে আছেন। সেই সোনাগুলো গেল কোথায়। গল্পের চরিত্র হয়ে হয়তো ঠাকুর্দা যক্ষের মতো সেগুলো পাহারা দিচ্ছেন।
লক্ষ করছি এখন ছেলেদের শখ বেড়েছে সোনার হার পরার। যাঁদের শরীর-স্বাস্থ্য ভাল তাঁরা এমনভাবে পরেন যাতে লোকে দেখতে পায়। সেই হারগুলো কখনওই তিন ভরির নিচে নয়। এইভাবে ঘরে ঘরে বাঙালি কত সোনা জমিয়ে রাখছে। যদিও সোনা জমা রেখে ব্যাঙ্ক টাকা ধার দিচ্ছে। সেই টাকা খাটিয়ে ব্যবসা করে আরও বড়লোক হয়ে ব্যাঙ্ক থেকে সোনা ছাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যাবে এই পথে বেশি লোক পা বাড়ান না।
গত রাত্রে টিভিতে দেখলাম কলকাতায় একটি বনেদি বাড়ির মহিলারা সারারাত ধরে দুর্গাকে সাজাবেন বলে গয়না নিয়ে বসেছেন। সেইসব সোনার গয়নার চেহারা দেখলেই বোঝা যায় তা দেবীর পক্ষেই পরা সম্ভব। মোটা মোটা সোনার হার, তাতে বড় হিরের লকেট, সাতনরী হার থেকে পায়ের সোনার মল স্তূপ করে রাখা হয়েছিল বিছানার ওপরে। বলা হল গোটা বছরে ওই পঞ্চমীর রাত্রেই গয়নাগুলোকে বের করে মাকে পরানো হয়। ক্যামেরায় যেটুকু দেখা গেল তাতে মনে হল মায়ের গয়নার ওজন জয়ললিতার গয়নার ওজন থেকে খুব কম নয়। এই যে লক্ষ লক্ষ কেজি সোনা বাঙালির ঘরে ঘরে বছরের পর বছর পড়ে আছে, বাঙালি তাদের নিয়ে সুখস্বপ্ন দেখে আবার ভুলেও যায় সময় বিশেষে। বাঙালির যখন সর্বত্র নেই নেই আফসোস তখন এই পড়ে থাকা সোনাগুলোকে মূল্যবান করার চেষ্টা কেন হয় না সেটাই বিস্ময়ের।
৩৪
আমার এক পরিচিত ব্যক্তি তাঁর মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজছিলেন। মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে ভাল চাকরি করছে কিন্তু পাত্র নির্বাচনের দায়িত্ব সে নিজে নেবে না। স্পষ্ট বলেছে, তাকে বিবাহিত দেখতে চাইলে বাবা-মাকেই পাত্র খুঁজে আনতে হবে। এই ব্যাপারে তার বক্তব্য, পাত্র যেন ভদ্রলোক হয়।
‘এর চেয়ে বড় বিপদে জীবনে পড়িনি।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘আরে, এখন তো ছেলেময়েরা প্রকাশ্যে প্রেম থেকে বিয়ে, সবই করছে, সম্বন্ধ করে বিয়ের চল তো উঠেই যাচ্ছে। ঘটকও দেখতে পাওয়া যায় না।’
‘ঘটক দেখতে না পান, শাদি ডট কম জাতীয় ওয়েবসাইট রয়েছে।’
‘সেগুলো ঘেঁটেছি।’ ভদ্রলোক বললেন।
‘পাননি?’
‘পাইনি বললে ভুল হবে’, তবে তারা ভদ্রলোক কিনা কী করে বুঝব? আমার মেয়ে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পাস করে সেক্টর ফাইভে চাকরি করছে। তার উপযুক্ত পাত্র কে হতে পারে এই নিয়েই ক’দিন ভেবেছি। অধ্যাপক? ডাক্তার? ইঞ্জিনিয়ার বা ওর লাইনের কেউ? মেয়েটা যদি টুক করে প্রেম করে ফেলত তা হলে এসব ভাবনা আমায় ভাবতে হত না।’ ভদ্রলোক বিমর্ষ।
একটা সময় ছিল যখন প্রেম নিষিদ্ধ ছিল। ছেলেমেয়েরা প্রেম করে বিয়ে করতে চাইলে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হত। তাদের প্রেমে জোর থাকলে নিজেরাই সইসাবুদ করে আলাদা বাসা নিত। বাবা-মা যেমন সম্পর্ক রাখত না তেমনই তারাও বাড়িমুখো হত না। তাদের সন্তান পৃথিবীতে এলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বদলে যেত। তবে নাতিকে পুরোপুরি, পুত্রকে অর্ধেক গ্রহণ করলেও পুত্রবধূ সম্পর্কে শীতল থাকতেন শ্বশুর-শাশুড়িরা। এখন ছবিটা উল্টে গিয়েছে। এই ভদ্রলোকের মেয়ে যদি প্রেম করত তা হলে এঁরা প্রবল উৎসাহে বিয়ে দিতেন। এখন যা সময় তাতে বেশির ভাগ বিয়েই টিকছে না। না টিঁকলে মেয়ে বাবা-মা’কে দোষ দিতে পারবে না। সেদিকেও রক্ষে।
আমার পরিচিত ভদ্রলোকের সমস্যা হল শুধু উপযুক্ত পাত্র মেয়ের জন্যে খুঁজে পেলে চলবে না, তাকে ভদ্রলোক হতে হবে।
কয়েকদিন পরে ভদ্রলোক ফোন করলেন, ‘খুব সমস্যায় পড়েছি। একটি আইপিএস পাত্রের বাবা প্রস্তাব দিয়েছেন।’
‘সমস্যা কেন বলছেন। খুব ভাল কথা তো!’ বললাম।
‘একদম না। আমার স্ত্রী পুলিশের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছেন না।’
‘আইপিএসকে কি ঠিক, মানে আমরা যাদের পুলিশ ভাবি, তা ভাবা যায়?’
‘চাকরিতে ঢোকার কয়েক মাসের মধ্যে সব এক হয়ে যায়। আচ্ছা, বলুন তো, পুলিশকে কি ভদ্রলোক বলা যায়?’ সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন ভদ্রলোক।
‘দেখুন, আমি যেমন আপনাকে ভদ্রলোক ভাবি, আপনিও আমাকে, তেমনি পুলিশকে ভাবতে অসুবিধে কোথায়?’
‘কোন ভদ্রলোক লাঠি উঁচিয়ে পাবলিককে তাড়া করে? শুনেছি পুলিশে চাকরি করতে গেলে গালাগাল দিতে হয়। গালাগাল শিখছে জামাই, ভাবতে পারেন? যদি কোনওদিন পুলিশের ইউনিফর্ম পরে বাড়িতে আসে তো পাড়ার লোক ভাববে আমরা নিশ্চয় কোনও অপরাধ করেছি। পুলিশের গাড়ি পাড়ায় ঢুকলেই লোকে ভয় পায়, ভাবে আবার কী হল!’
‘তা হলে বলছেন পুলিশে যারা চাকরি করেন তাঁদের বিয়ে হবে না?’
‘কেন হবে না? হাজারবার হবে, নিজেদের মধ্যে তো হতেই পারে। শ্বশুর পুলিশ, জামাই পুলিশ, কোনও আপত্তি নেই! আমাকে আমার শালা বলছিল, আপনি ভুল করছেন জামাইবাবু। বড় পুলিশ অফিসার হলে আপনার মেয়েকে সারাজীবন টাকার চিন্তা করতে হবে না। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?’
অতএব পুলিশ বাতিল হল। ওই শাদি ডট কম জাতীয় সংস্থা থেকে আর একটি সুপাত্রের সন্ধান পেলেন ভদ্রলোক। ছেলেটি ডাক্তার। বছর তেত্রিশের সুদর্শন যুবকটি এর মধ্যেই ভাল নাম করেছে। প্রচুর পেশেন্ট তো দ্যাখেই, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের ভিড় লেগেই আছে। কোনও ডাক্তারের পসার ভাল না হলে তারা ভিড় করে আসে না।
পরিচিত ভদ্রলোক বললেন, ‘যা রিপোর্ট পাচ্ছি তা খারাপ নয়। কিন্তু আমি ওকে স্বচক্ষে দেখতে চাই। আমাকে কখনও দ্যাখেনি, তাই পেশেন্ট হয়ে ওর কাছে যাব।’
‘সে কি! আপনার অসুখ জানতে চাইলে কী বলবেন?’
‘পেটে ব্যথা। সেফ ব্যাপার। পাঁচশো টাকা ফি দিয়ে দেখে আসি।’ দু’দিন পরে আবার এলেন তিনি। মুখ গম্ভীর। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী হল?’
‘সমস্যায় পড়েছি। ছেলেটির কথাবার্তা, ব্যবহার খুব ভাল। অনেকক্ষণ পেট টিপে পরীক্ষা করল। তারপর কয়েকটা টেস্ট করিয়ে আবার যেতে বলল।’
‘বাঃ! এটাই তো স্বাভাবিক।’
‘হুঁ! আমি পরিচিত এক জায়গা থেকে টেস্ট করাতে চাইলে সে বলল, তার পছন্দের জায়গা থেকে না করালে চলবে না। প্রায় পাঁচ হাজার টাকা বেরিয়ে যাবে। আমার পরিচিত জায়গায় তিন হাজারে হয়ে যেত। সোজা চলে গেলাম আমার পরিচিত জায়গায়। তারা বলল, যেখান থেকে ডাক্তার করাতে বলেছে, তারা মোটা কমিশন দেবে। তাই দামও বেশি নেয়। ভাবুন তো! আমার কাছ থেকে পাঁচশো ফি বাবদ নিয়েও লোভ মিটল না, টেস্ট করিয়ে কমিশন খাবে। এটা তো সৎ ব্যাপার নয়!’ ভদ্রলোক বিচলিত।
‘এসব সত্যি না-ও হতে পারে। শোনা কথায় বিশ্বাস করছেন কেন?’
‘তা হলে পার্টিকুলার একটা সেন্টার থেকে টেস্ট করাতে বলবেন কেন? আমি ভাবছি, ওখানে গিয়ে টেস্ট করলে কেমন হয়!’
ভদ্রলোক চলে গেলেন। মনে হল, সত্যি খুব সমস্যায় ফেলে দিয়েছে মেয়েটা। সে এই চাই ওই চাই না বলে একজন ভদ্রলোক স্বামী হিসেবে পেতে চেয়েছে। এখন আমাদের চারপাশে সব আছে, শুধু একজন ভদ্রলোকের খুব অভাব। তা রাজনৈতিক নেতা থেকে ট্যাক্সি ড্রাইভার, সর্বত্র এই আকাল চলছে। মেয়েটি কি জেনেশুনে এমন চাওয়া চাইল?
৩৫
ছাত্রাবস্থায় আমাদের একটা কৌতূহল ছিল। সেই বাবর থেকে বাহাদুর শা, মোগল বংশের সব বাদশার নাম আমরা জানি। কিন্তু আমার পূর্বপুরুষদের নামগুলো জানছি না কেন? এই কৌতূহল শুধু আমার একার নয়, আমার বন্ধুদেরও ছিল। এই ব্যাপারে জেনারেল নলেজ আটকে যেত ঠাকুরদা পর্যন্ত গিয়ে। বাবা এবং ঠাকুরদার নাম জানার পর আর কোনও কৌতূহল এই সময়ের ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখছি না। জিজ্ঞাসা করে উত্তর পেয়েছি, জেনে কী হবে! মোগলদের প্রত্যেকের নাম জানতে হবে পরীক্ষার কারণে, নিজের পিতামহের নাম জেনে তো নম্বর পাওয়া যাবে না।
ঠিক এই মনোভাব আমাদের মধ্যে ছিল না। আমরা খুঁজতে চাইতাম নামগুলো কারণ ওই নামগুলো থেকে চলে যাওয়া সময়টা ধরা যেত। যেমন, আমার ঠাকুরদার নাম ছিল পূর্ণচন্দ্র। স্বাধীনতার পর কোনও সন্তানের নাম পূর্ণচন্দ্র রাখা স্বাভাবিক ছিল না। ঠাকুরদা জন্মেছিলেন আঠারোশো নব্বইতে। হয়তো সেই সময়ে পূর্ণচন্দ্র খুব আদরের নাম। সাধুভাষায় ওই নামকরণের মধ্যে একটা সম্ভ্রমভাবও থেকে গিয়েছে। স্বাধীনতার পরে এইরকম নামকরণ হাস্যকর মনে হতেই পারে। রবীন্দ্রনাথ চিরকুমার সভার নায়কের নাম রেখেছিলেন পূর্ণ। যতদূর মনে আছে, পূর্ণ স্বমহিমায় ছিল, সঙ্গে চন্দ্র যোগ করেননি রবীন্দ্রনাথ। এই চন্দ্র বাদ দেওয়াতে নামটি একটু আধুনিক চেহারা পেয়ে গিয়েছিল। আমার ঠাকুরদার গায়ের রং গৌর ছিল না, নামকরণের সময় সম্ভব বুঝতে পারেননি তাঁর অভিভাবকরা।
আমার ছাত্রাবস্থায় ঠাকুরদা জীবিত ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি একটি পুরনো খাতা এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ”আমার কাছে এটা রাখার আর দরকার নেই, প্রয়োজন বোধ করলে তুমি রেখো।”
সেই খাতায় উনিশশো পাঁচ সালের বাজারদর, দিনের খরচের হিসাব যা পড়ে খুব মজা পেয়েছি। সেই সঙ্গে বংশতালিকার ছয়টি নাম পড়ার সুযোগ হয়ে গেল। ঠাকুর্দার বাবার নাম পরশুরাম। ততদিনে আমি পরশুরাম মুনির কাহিনি পড়ে ফেলেছি। মহাভারতের অন্যতম বর্ণময় চরিত্র। এঁকে বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার বলা হয়ে থাকে। বাবার আদেশে মাকে বধ করার পুরস্কার হিসাবে যখন তাঁকে বর প্রার্থনা করতে বলা হয় তখন তিনি মৃত মাকে আবার জীবিত করে দিতে বলেন। ভীষ্ম দ্রোণ এবং কর্ণের অস্ত্রগুরু ছিলেন। তাঁর নামে সন্তানের নামকরণ করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মের সমসময়ে। মনে রাখতে হবে, ঠাকুরবাড়ি বা ব্রাহ্মসমাজের বাইরে বাঙালি সমাজে হিন্দু দেবদেবীর প্রভাব বিস্তর ছিল। সন্তানের নামকরণের সময় তাই দেবদেবীদের নামই ব্যবহার করা হত। কিন্তু পরশুরাম সেই অর্থে হিন্দুদের আরাধ্য দেবতার মধ্যে পড়েন না। মহাভারতের অনেক নাম পরবর্তীকালে আধুনিক চেহারা নিয়ে এসেছে। যেমন ভীষ্ম অথবা কুন্তী। কিন্তু পাণ্ডু নামের কোনও মানুষের সন্ধান আমি পাইনি। আমার ঠাকুরদার বাবার অভিভাবকরা সন্তানের নামকরণের ব্যাপারে সেই সময়ে কিছুটা ব্যতিক্রমী মানসিকতা দেখিয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই।
শ্রীযুক্ত পরশুরামের পিতার নাম ছিল রামকৃষ্ণ। একথা মনে করার কোনও কারণ নেই যে দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণদেবের প্রভাবে ওঁর নামকরণ করা হয়েছিল। সময়ের হিসাবে পরশুরামের পিতার জন্ম অনেক আগে হয়েছিল। ঈশ্বরভক্তির নজির হিসাবে এই নামকরণ। কিন্তু বঙ্গভূমিতে কৃষ্ণের যে প্রচার এবং গ্রহণযোগ্যতা ছিল অথবা কিছুটা আছে রামচন্দ্রর তা ছিল না। তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হতেন উত্তর ভারতে। কিন্তু যিনি রাম তিনিই কৃষ্ণ এই ভাবনায় ভাবিত হয়ে রামকৃষ্ণ নামকরণ স্বাভাবিক ছিল।
রামকৃষ্ণর বাবার নাম নিয়ে আমার সংশয় এখনও যায়নি। ঠাকুরদা যে খাতা দিয়েছিলেন তাতে রামকৃষ্ণর পূর্বসূরি হিসাবে দু’টি নাম লেখা ছিল। একটি, বৃন্দাবন, অন্যটি মহেশ্বর। এঁদের মধ্যে রামকৃষ্ণর বাবা কে ছিলেন তা লেখা না থাকায় ঠাকুরদাকে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি অজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ওঁরা সম্ভবত দুই ভাই। ঠাকুর্দার দেওয়া খাতায় ওই দু’জনের বাবার নাম ছিল পরমেশ্বর। তাঁর নাম থেকেই বংশতালিকা শুরু করা হয়েছিল। সময় বিচার করলে সতেরোশো আশি নব্বই-এ পরমেশ্বরের জন্ম হয়েছিল। অর্থাৎ আমার আগে ছয় পুরুষের নাম আমি জানতে পারছি। পরমেশ্বরের দুই ছেলের নামের মধ্যে সেই সময়ের শৈব এবং বৈষ্ণব মানসিকতার প্রতিফলন পড়েছিল কি না তা নিয়ে শুধু কল্পনাই করতে পারি। কিন্তু বাঙালি পুরুষের নামকরণের ব্যাপারে তথাকথিত ভগবানের নামের ব্যবহার থেকে যে ছবিটা স্পষ্ট তাতে হরি, নারায়ণ অথবা কৃষ্ণের শাখা অনেক বেশি প্রিয় ছিল। আর এক শাখা, যেমন মহেশ্বর, শিবনাথ, শিবপদ, বিরূপাক্ষ, ত্রিলোচন, পিনাকী, নীলকণ্ঠের নামে নামকরণ থেকে বোঝা যায় ওই পরিবারের মানুষ শিবের ভক্ত। পরমেশ্বর তাঁর ছেলের নাম মহেশ্বর রাখার পাশাপাশি অন্য জনের নাম বৃন্দাবন রেখে আমাদের বিস্মিত করেছেন। তৃতীয় শাখা অবশ্যই শাক্তদের যাঁরা কালীভক্ত। কালীর সঙ্গে শব্দ জুড়ে সন্তানের নামকরণ করেন। এই সব নামকরণের পিছনে একটা প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য হয়তো কাজ করত। সন্তানদের নাম ধরে ডাকাডাকির সময় ভগবানের নাম করা হয়ে যেত।
ছাত্রাবস্থায় আমি যখন ছয় পুরুষে থেমে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম তখন এক সহপাঠীর ঠাকুরদা জানিয়েছিলেন তিনি চোদ্দো পুরুষের নাম জানেন। তাঁর প্রপিতামহের পিতামহ নামগুলো বলে গিয়েছিলেন। সেই নামাবলি এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্ম জেনেছে। তিনি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। সহপাঠীর পদবি ছিল দাস। আমার মনে হয়েছিল ইতিহাস বই-এর বাইরে আর একটি দাস-বংশ দেখতে পেলাম।
এই কিছু বছর আগেও বাঙালি মহালয়ার ভোরে ব্যাপকভাবে পিতৃতর্পণ করতে যেতেন। গঙ্গা অথবা নদীর গায়ে প্রায় মেলা বসত। এখন শীর্ণ হয়ে গেলেও কেউ কেউ নিয়মটা মানছেন। মজার কথা হল, তর্পণের সময় বাবার দিক থেকে যেমন তিন পুরুষের নাম দরকার হয় তেমনই মায়ের দিক থেকেও তিন পুরুষ দরকার যাঁরা জল পেয়ে তৃপ্ত হবেন। অর্থাৎ চোদ্দো পুরুষকে টেনে আনার প্রয়োজন যখন নেই তখন তিন পুরুষেই কাজটা শেষ করা সহজ।
ছাত্রাবস্থায় প্রশ্নটা মাথায় এসেছিল। আমরা চোদ্দো পুরুষের খোঁজ করছি, আমাদের মা, তাঁর মা-দিদিমাদের, অথবা ঠাকুমা, তার মা-দিদিমাদের সম্পর্কে জানতে এক শীতল কেন? আজকের ছেলেমেয়েরা মা-দিদিমাকে, বড় জোর ঠাকুমাকে দেখেছে, নাম জেনেছে। দিদিমা বা ঠাকুমার মায়ের নাম কী ছিল তা জানার আগ্রহ নেই। চোদ্দো পুরুষের পাশাপাশি এই নারীরা কেন প্রাধান্য পাবেন না? কেন উপেক্ষিতা থেকে যাবেন?
৩৬
কানাডার পার্লামেন্টে বন্দুক দিয়ে হামলা করতে গিয়ে নিহত হল যে উগ্রপন্থী তার নাম এখনও জানি না কিন্তু মুখের চেহারাটা আমাদের চেনা হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত উগ্রপন্থীর চেহারায় কোনও পার্থক্য নেই। ভারতের সংসদের ভেতরে যারা হামলা করে নিহত হয়েছে তারাও একই গোত্রের। কিন্তু এই যে মানুষগুলো যখন একটা হামলার পরিকল্পনা করে তখন তারা নিশ্চিত জানে সাফল্য পেয়ে জীবন্ত ফিরে আসতে পারবে না। মুম্বইতে যারা পাকিস্তান থেকে সমুদ্রপথে এসে ব্যাপক হামলা চালিয়েছিল তাদের যতই প্রলোভন দেখানো হোক, ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না জেনেও তারা এসেছিল। এই ব্যাপারটা সত্যি অদ্ভুত।
মানুষ যখন বেপরোয়া হয়ে কিছু করে তখন বুঝতে হবে তার পেছনে কোনও আদর্শ কাজ করছে অথবা মস্তিষ্ক অস্থিরতায় আক্রান্ত। ক্ষুদিরামকে বলা হয়েছিল বোমা মারতে। শোনামাত্র ক্ষুদিরাম ছুটে যায়নি। ইংরেজ শাসকদের শাসন থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার চিন্তা অবশ্যই তার মাথায় ছিল। এই ভাবনায় আবেগে ধরা পড়ে গেলে কী হবে তা নিশ্চয়ই ক্ষুদিরাম চিন্তা করেনি। দেশকে বিদেশির শাসন থেকে মুক্ত করার জন্যে বিপ্লবীরা যখন আত্মদান করেন তখন তাঁদের শহিদ বলতে আমাদের দ্বিধা আসে না। আবার এখানেই কিছু গোলমাল দেখা দেবে যদি ইংরেজ শাসনের সময় কোনও ভারতীয় বিপ্লবী লন্ডনের রানির প্রাসাদে বোমা ছুড়ত, সঙ্গে সঙ্গে তাকে উগ্রপন্থী হিসাবে চিহ্নিত করা হত। যে সব সৈনিক দেশের জন্যে যুদ্ধ করে মারা যান তাঁরা তা জেনেশুনেই গিয়ে থাকেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যে সব আমেরিকান সৈন্য মারা গিয়েছেন তাঁদের নামের তালিকা ওয়াশিংটনের শহিদ বেদিতে লেখা রয়েছে। কিন্তু ভিয়েতনামীদের কাছে তাঁরা কখনওই শহিদ নন, আক্রমণকারী। দেশকে রক্ষা করতে একজন নিহত ভিয়েতনামী অনেক বেশি সম্মান পেয়ে থাকেন।
কিন্তু একথাও সত্যি, মানুষ যখন জেনেশুনে এমন কাজ করে যার পরিণতিতে সে বেঁচে নাও থাকতে পারে তখন বুঝতে হবে তার মধ্যে একটা উন্মাদনা কাজ করছে। সেই উন্মাদনা তাকে বাস্তব চিন্তা থেকে সরিয়ে রেখেছে। যে সৈনিক কাশ্মীরের উঁচু পাহাড়ের নির্জনে বরফের মধ্যে দিনরাত পড়ে থাকে সে কি শুধু মাসের শেষে মাইনে পাবে বলে চাকরি করে? ওই মাইনের মতো রোজগার সে অবশ্যই সমতলে নিরাপদে করতে পারত, না পারলেও তার জীবন অনেক বেশি নিরাপদ থাকত। কিন্তু সেই হিম বরফে রাইফেল হাতে নিয়ে যখন সে ভাবে আমার উপর ভারতের নিরাপত্তা নির্ভর করছে তখন তার রক্ত গরম হয়ে ওঠে, সে তখন আলাদা মানুষ হয়ে ওঠে।
উল্টোদিকে পাকিস্তানি হানাদাররা বা ভারতের উগ্রপন্থীরা যখন ধবংস করতে হানা দেয় তখন বিশেষ মতলববাজরা তাদের মন ওয়াশ করে পাঠায়। আচমকা হামলা করে কিছু মানুষকে মেরে ফেলে তাদের কোনও ব্যক্তিগত লাভ হবে না জেনেও উন্মাদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা ওই কারণেই। যারা এই ব্রেন ওয়াশ করে তারা অত্যন্ত চতুর এবং দক্ষ। তা না হলে এভাবে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হত না।
ভারতবর্ষে নকশাল আন্দোলন যাঁরা শুরু করেছিলেন তাঁরা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। পার্লামেন্টকে শুয়োরের খাঁচা বলা বা বন্দুকের নলই শক্তির উৎস বলে তরুণ রক্তকে উদ্বুদ্ধ করাটা সেই সময় সহজ ছিল। কারণ সেই সময়ের রাজনৈতিক বাতাবরণ তরুণদের ক্ষুব্ধ করেছিল। কিন্তু দেশের শিক্ষিত সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি এবং সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও যে প্রচুর তরুণ বিপ্লবের নেশায় উত্তাল হয়েছিল তার কারণ আবেগ তাদের আবিষ্ট করেছিল। ওই আন্দোলন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন পায়নি। চাকু দিয়ে তলোয়ারের সঙ্গে লড়াই সম্ভব নয় বোঝার আগেই আন্দোলন শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই হতাশ মুখগুলো কি পরের প্রজন্মকে শিক্ষা দিতে পেরেছিল?
নকশাল আন্দোলন শেষ হওয়ার অন্তত কুড়ি বছর পরে মাওবাদীরা আত্মপ্রকাশ করল। এযাবৎকাল তারা কোনও কোনও এলাকায় মানুষ মেরেছে, ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে, ডিনামাইট ফাটিয়েছে। কিন্তু কেন? দিনের পর দিন জঙ্গলে, জলায় লুকিয়ে থাকা, খিদের সময় খাবার না পাওয়ার কষ্ট সহ্য করে পুলিশের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে এরা কী মোক্ষ লাভ করতে চেয়েছে? এইভাবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলে নিজেকেই ধবংস করা হবে জেনেও কেন ঘর ছেড়ে ওরা জঙ্গলে ঢুকে গিয়েছে?
লক্ষ করলে দেখা যাবে, নকশাল আন্দোলনে যারা প্রথমে যোগ দিয়েছিল তারা স্কুল-কলেজের পড়াশোনা তো করেছেই, তার বাইরের শিক্ষাও অনেকের ছিল। কিন্তু মাওবাদী হিসাবে যারা ধরা পড়ছে তাদের বেশিরভাগই অনুন্নত সম্প্রদায়ের মানুষ যারা শিক্ষার আলো দেখেনি। অতি দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা, যাদের সমাজে সুস্থভাবে বাঁচার পথ খোলা নেই তাদের মনে সুস্থ সমাজব্যবস্থার ওপর একটা অভিমান অথবা বিদ্বেষ কাজ করত। ওরা যা পাচ্ছে, আমি তা পাচ্ছি না কেন? এই জ্বালাকে সুড়সুড়ি দিয়ে দলে টেনে নিয়েছে কিছু নেতা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম থেকে খাবার আদায় করতে অসুবিধা হচ্ছে না এবং সেই সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারের থ্রিল থাকছে। কী করছি, কেন করছি, তা জানার দরকার নেই। ফলে এই আন্দোলনও মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। পশ্চিমবাংলার শিক্ষিত ছাত্রসমাজকে এখন পর্যন্ত ওদের সঙ্গ নিতে দেখা যায়নি।
উত্তরবাংলায় কামতাপুরী আন্দোলনও একটা বিশেষ আবেগের ফসল। এই ভূখণ্ড আমাদের, পূর্বপুরুষরা এখানেই জীবন অতিবাহিত করেছেন, তাই এই জায়গার অধিকার আমাদের দিতে হবে। ভাবাবেগে সুড়সুড়ি দেওয়ার সময় প্রথমদিকে কাজ হলেও শেষে স্থিমিত হয়ে পড়েছে, তার প্রমাণ পেয়েছি।
এইসব আন্দোলনের সঙ্গে বর্ধমানে যা ঘটেছে তার কোনও সংশ্রব নেই। বাংলাদেশে জামাতরা এখন কোণঠাসা। আরবদেশের টাকায় সমৃদ্ধ ওই দল ধর্মের দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। আমরা জানি রাজনীতির চেয়ে ধর্ম অনেক বেশি শক্তিশালী। ধর্মের জন্যে শহিদ হলে স্বর্গবাস অবধারিত ভেবে নেয় যে মানুষ তাকে দিয়ে যে কোনও কাজ করানো সম্ভব। বর্ধমান, মালদহ, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি সীমান্ত জেলাগুলোতে ধর্মের ছদ্মবেশে অস্ত্র তৈরি করে তা বাংলাদেশে পাচার করার যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল তা শুরুতেই ধরা পড়ে যাওয়ায় বিপুল বিপর্যয় থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি। স্বামীকে বিস্ফোরণে নিহত হতে দেখেও স্ত্রী প্রমাণ লোপ করতে তার রক্ত মুছে ফেলছে যে মানসিকতা থেকে তা স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। উগ্রপন্থী যে কোনও আচরণ সুস্থ মানুষ করতে পারে না। হয় খাবারের লোভ দেখিয়ে, নয় বিপ্লবের নেশা চাপিয়ে অথবা ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদের অসুস্থ করা হয়।
৩৭
প্রফেশনাল থিয়েটারের রমরমার যুগে আলাদা নাটক যেসব দল শুরু করে, তাদের ‘গ্রুপ থিয়েটার’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে তর্ক হতেই পারে, এই লেখায় আমি সেই তর্কে যেতে চাইছি না। লক্ষ করছি, আমাদের এই আলাদা থিয়েটারের গোড়া থেকে কর্তৃত্ব করে এসেছেন পুরুষরা। বিচ্ছিন্নভাবে কোনও-কোনও নাটকের পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন মহিলারা; কিন্তু তাঁদের সংখ্যা ধর্তব্য নয়। কিন্তু গত সাত দশক ধরে এই নাট্যচর্চায় যেসব মহিলার নাম উঠে এসেছে, থেকে গিয়েছে, তাঁদের অভিনয়-ক্ষমতার কথা ভাবলে শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করতেই হয়।
প্রথম নাম, অন্তত আমার কাছে, তৃপ্তি মিত্র। আমার দুর্ভাগ্য, আমি ‘নন্দিনী’-কে দেখার সুযোগ পাইনি। কিন্তু তারপর কোনও নাটক বাদ দিইনি। তা সে তরলাই হোক অথবা এলা-ই হোক। একক অভিনয় করেছেন মঞ্চ দাপিয়ে। মানুষ হিসেবে ওঁর গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠেনি কখনও। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের কথা বলতেন। সাহস করে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনি যখন নাটক করতে এসেছিলেন তখন মধ্যবিত্ত বাঙালি আজকের মতো উদার ছিল না। আপনার সমস্যা হয়নি?’ খুব হেসেছিলেন। বলেছিলেন, ‘একটা পাহাড়ের আড়ালে ছিলাম তো, তাই ঝড়ঝাপটা গায়ে লাগেনি।’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, কিন্তু মঞ্চেই যে তাঁর রাজত্ব ছিল তা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে।
স্কটিশে যখন পড়তে এলাম, তখন কেয়া চক্রবর্তী পাস করে গিয়েছেন। গেলেও, ‘বসন্ত কেবিন’ অথবা ‘কসমস’-এ আসতেন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে। কলেজে এসে চিত্তরঞ্জন ঘোষমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। বেশ লম্বা, ঋজু চেহারার মানুষটির মধ্যে বাঙালি মেয়েদের লাজুক নরমভাব ছিল বলে মনে হত না। তখন এম.এ পড়তেন। সেই সময় ‘নান্দীকার’ হইচই ফেলে দিয়েছিল ”নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র” করে। অজিতেশ, রুদ্রপ্রসাদ এবং কেয়া চক্রবর্তীর নামের সঙ্গে ক্রমশ বাঙালি পরিচিত হচ্ছে। অজিতেশবাবু একলাফে জনপ্রিয় হয়ে গেলেন ‘হাটে বাজার’-এর সৌজন্যে। কেয়া চক্রবর্তীকে অপেক্ষা করতে হল ‘তিন পয়সার পালা’ পর্যন্ত। তারপর ‘ভালমানুষ’, ‘নটী বিনোদিনী’—নান্দীকারের একের-পর-এক নাটক। বাইরে গিয়ে শ্যামানন্দ জালানের পরিচালনায় ‘তুঘলক’ নাটকে শ্রদ্ধেয় শম্ভু মিত্রের সঙ্গে অভিনয় করে বাংলা নাটকে নিজের জায়গা প্রতিষ্ঠিত করেন। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হওয়ায় বাংলা নাটক বঞ্চিত হয়েছে।
‘চাকভাঙা মধু’ নাটকে মায়া ঘোষের অভিনয় হইচই ফেলল। আমরা বুঝলাম, বাংলা নাটকে একজন প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী এলেন। একের-পর-এক নাটক করে গিয়েছেন মায়া ঘোষ। এই সময়ের আর একজন অভিনেত্রীর নাম না-বললে ভুল হবে। তিনি মমতা চট্টোপাধ্যায়। মূলত ‘নক্ষত্র’ দলের নাটকে তাঁর অভিনয় দু’চোখ ভরে দেখার মতো ছিল।
এঁদের পরে এলেন শাঁওলি মিত্র। শাঁওলি বড় হয়েছেন অভিনয়ের পরিবেশে। ‘বহুরূপী’-র মতো একটি দল তাঁর পাশে ছিল। কিন্তু এরকম তো অনেকেরই থাকে। ক’জন আর শাঁওলি মিত্র হতে পারেন! দলগত নাটকের পরে একক নাটকে শাঁওলি যেন তাঁর মা’কে অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। ‘নাথবতী অনাথবৎ’ তাঁর অভিনয়ের একটি মাইলস্টোন। বড় আফসোস হয়, পরবর্তীতে তিনি নিজেকে ধীরে-ধীরে গুটিয়ে নিয়েছেন।
এই পর্বেই এলেন অনসূয়া মজুমদার। ‘বহুরূপী’-র ‘মৃচ্ছকটিক’ থেকে শুরু করে ‘চেনামুখ’ দলের একটার-পর-একটা নাটকে অনসূয়া নিজস্ব প্যাটার্নে যে-অভিনয় করে গিয়েছেন তা অনেকের স্মৃতিতে বহু দিন থাকবে। অন্তত ‘রানি কাহিনী’-র জন্য তো বটেই।
এই সময় এলেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। সত্যজিৎবাবুর ছবিতে অভিনয় করার কারণে তিনি নিশ্চয়ই আলাদা মাইলেজ পেয়েছিলেন। সেটা কখনওই নাটকের প্রচারে ব্যবহার করেনি ‘নান্দীকার’। ঠিক এই ব্যাপারটা আমরা দেখেছি নীলিমা দাসের ক্ষেত্রে। জনপ্রিয় ছবির অন্যতম নায়িকা হওয়া সত্ত্বেও মঞ্চে যখন চুটিয়ে অভিনয় করেছেন, তা পেশাদার মঞ্চেই হোক অথবা লিটল থিয়েটারের নাটকে—নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। দীর্ঘকাল স্বাতীলেখা এই কাজটি করতে চেয়েছেন। কিন্তু ক্রমশ অভিনেত্রীর বদলে নাট্যকর্মী হিসাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখছেন তিনি। বেশ কিছু দিন নাটক দেখার বাসনা আমার হয়নি। কেন হয়নি জানি না। খবর পাচ্ছিলাম, বিজ্ঞাপন দেখে বুঝছিলাম, নাটক প্রযোজনার ক্ষেত্রে অন্য হাওয়া লেগেছে। গ্রুপ থিয়েটারের অ্যামেচারিশ গন্ধ ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। দশ-পনেরো-কুড়ি টাকার টিকিট এখন দু’শো-আড়াইশোতে কিনতে দর্শকদের তাই আপত্তি হচ্ছে না। বিষয় পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে অভিনয়ের ধারাও।
বহু বছর পরে দেখতে গেলাম ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’-এর ‘বিয়ে গাউনি কাঁদন চাঁপা’। নামটিতে অভিনবত্ব আছে। বোঝাই যায়, পটভূমি শহরের নয়। বেশ ভাল লাগল। সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত একসময় যথেষ্ট প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিলেন। সেদিন হয়তো তাঁর মন ভাল ছিল না। কিন্তু একটি মেয়েকে দেখে আমি অবাক হচ্ছিলাম। চমৎকার অভিনয় করছিল সে। মাঝে একটু বাড়াবাড়ি করলেও সেটুকু আমি উপেক্ষা করতে রাজি ছিলাম। কিন্তু মাত্র একটি অভিনয় দেখে কোনও অ্যাসেসমেন্ট করা ভুল হবে। শিল্পের সব ক্ষেত্রেই একটি কাজের পর হারিয়ে যেতে অনেককেই দেখেছি। জানলাম, মেয়েটি বিশেষ কোনও দলে অভিনয় না-করে অনেকগুলো দলেই করে থাকে। এই ব্যাপারটা আগে ছিল না। একটি দলের ‘শো’ না-থাকলেও অভিনেতা-অভিনেত্রীকে অন্য দলে অভিনয় করার অনুমতি দেওয়া হত না। গত এক দশকে বোধহয় পরিবর্তনটা হয়েছে।
এর পরেই দেখতে গেলাম চন্দন সেনের লেখা এবং পরিচালনায় ‘জাহানারা জাহানারা’ নাটকটি। প্রথম দৃশ্যেই চমকে উঠলাম। সেই মেয়েটি, যার নাম বিন্দিয়া ঘোষ, ঘুম ভাঙার পর যে-গলায় কথা বলছে বস্তির তক্তপোশে শুয়ে তা আমাকে বিদ্ধ করল। পুরো নাটক জুড়ে সে এবং তার ভয়েস অ্যাক্টিং, ফিজিক্যাল অ্যাক্টিং দেখে আমি মন্ত্রমুগ্ধ। এইভাবে নিজেকে ভেঙে আবার নতুন করে গড়ে আমি আজ অবধি কোনও অভিনেত্রীকে অভিনয় করতে দেখিনি। থানার হাবিলদারের শরীরের উপর লাফালাফি করে সংলাপ বলতে কখনওই ব্যালান্স হারায়নি বিন্দিয়া। যখন সে মাতাল, তখন তার দুই চোখকে টকটকে লাল করে রাখতে ভোলেনি। দেখতে-দেখতে মনে হচ্ছিল, এই মেয়ে যে বস্তিতে বাস করা স্বৈরিণীর ভূমিকায় দাপটে অভিনয় করছে তা এক মুহূর্তের জন্যেও সাজানো বলে মনে হচ্ছে না। আলাদা থিয়েটারের প্রথম শ্রদ্ধেয় অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র। এখন পর্যন্ত বিন্দিয়া ঘোষ তাঁর শেষ উত্তরাধিকারী।
৩৮
গত রবিবার আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক খুব উত্তেজিত হয়ে ফোন করেছিলেন, ‘আপনি কি খবর রাখেন, আজ শনি ঘর বদল করবেন?’
আচমকা প্রশ্নটি শুনে হকচকিয়ে গেলেও সামলে নিলাম, ‘আচ্ছা!’ ততক্ষণে বুঝে গিয়েছি এই শনি কোনও মানুষ নন, যিনি এই বাড়ির ঘর থেকে ওই বাড়ির ঘরে যাবেন! ইনি অবশ্যই শনিগ্রহ।
‘ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস সমরেশবাবু। আড়াই বছর পর শনি মঙ্গলের ঘরে যাচ্ছেন। মঙ্গলের কোন ঘরে জানেন? যেখানে বৃশ্চিক রাশি অধিষ্ঠান করছেন।’ ভদ্রলোক বললেন। তাঁর কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা স্পষ্ট।
বললাম, ‘খুব সিরিয়াস ব্যাপার, সন্দেহ নেই।’
‘সিরিয়াস বলে সিরিয়াস। কারও সর্বনাশ হয়ে যাবে, কারও ভাল হতে পারে।’
‘এই নির্বাচনটি কীভাবে হবে?’
‘এখন বৃশ্চিক রাশির লোকজনের উপর খারাপ প্রভাব পড়বে। আপনি কি অ্যাস্ট্রোলজি-র কোনও খবর রাখেন না?’
‘না, মানে!’
‘এই আড়াই বছর খুব মারাত্মক সময়। প্রথমে বৃশ্চিক রাশির উপর শনি-র নজর পড়বে। তারপর সেটা সরে যাবে তুলা রাশি এবং শেষে ধনু রাশির উপর। সর্বনাশ হয়ে যবে অনেক মানুষের।’ ভদ্রলোক বললেন।
‘এর প্রতিবিধান নেই?’
‘নিশ্চয়ই আছে। পুরোটা না-হোক, অর্ধেকটা রক্ষা করতে পারেন জ্যোতিষীরা। এই তো আজই একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। অত্যন্ত উচ্চমানের জ্যোতিষী।’
‘আপনি খুব কৌতূহলী মনে হচ্ছে!’
‘কৌতূহলী? কী বলছেন! আমি এখন মহাসমস্যায়। আমার রাশি যে বৃশ্চিক!’
ফোন ছেড়ে দিলেন ভদ্রলোক। মনে পড়ল, ওঁর বুড়ো আঙুল বাদ দিয়ে প্রায় সব ক’টাতেই আংটি দেখেছি। সেই সব আংটিতে এক-একটা পাথর। হিরেও আছে। আট আঙুলে পাথর পরে তিনি গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেন এতকাল। শনির এই ঘর-বদল তাঁকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। অর্থাৎ তাঁর আঙুলের ওই আটটি অস্ত্র এই নতুন শত্রুর মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে না বলে তাঁর ভয় হচ্ছে।
বাঙালি নরম মনের মানুষ। একটুতেই দুর্বল হয়ে পড়া তাদের স্বভাব। আর তার সঙ্গে ঈশ্বরভীতি যদি মিশে থাকে, তা হলে তো কথাই নেই! অষ্টপ্রহর কীর্তন করলে সংসারের ভাল হবে, অতএব বাঙালি অষ্টপ্রহর ধরে চিৎকার করে নামগান করল। দণ্ডি কেটে জল দিতে যাও, ভবিষ্যৎ ভাল হবে, বাঙালি রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ল। হাতে লালসুতোর বাঁধন পরলে বিপত্তারিণী মা সন্তুষ্ট হবেন, বাঙালি নির্দ্বিধায় পরে ফেলল। এই পরার শেষ নেই। মাদুলি, কবচ থেকে শুরু করে তাবিজ—সারা শরীরে আত্মরক্ষার বর্ম পরে বসে থাকতে স্বস্তি পায় বাঙালি। যারা বেশি দুর্বল, তারা শান্তিস্বস্ত্যয়নের মাধ্যমে নিজেকে শান্ত করতে চান। যাঁরা একটু শক্ত মনের তাঁরা শাক্তদের খোঁজ করেন। তান্ত্রিকের সন্ধান পেলে তাঁকে দিয়ে বাড়ি মন্ত্রপূত করে ফেললে আর দুশ্চিন্তার কিছু থাকে না।
এগুলো ছিল, আছে, থাকবে। বাঙালি জন্মইস্তক অভ্যেসে, সংস্কারে, ভাবনায়। কিন্তু ওই যে জন্মের পর কোষ্ঠী তৈরি করা হল, তার আওতা থেকে ক্রমশ নব্বই ভাগ বাঙালি বেরিয়ে গেলেও দশ ভাগ বেশ মজে রয়ে গিয়েছে। এই দশ ভাগের অনেকেরই তাঁর ছক মুখস্থ। কোন ঘরে কে সোজা হয়ে আছে, কে বক্রি, কে নজর ফেলছে কার উপর : এগুলো নিয়ে তাঁদের মস্তিষ্ক নাড়াচাড়া।
সম্প্রতি আমার পরিচিত একটি ছেলে, যে কি না অসাধারণ ছাত্র ছিল, ছয় অঙ্কের মাইনে নিয়ে বড় চাকরি করছে অথচ প্রেমে পড়েনি, তার বিয়ের জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত যে-মেয়েটিকে সবার পছন্দ হল সে শুধু সুন্দরী নয়, আর যা-যা গুণ থাকলে সম্মান করা যায়, তার সবই আছে। ছেলে এবং মেয়ে পরস্পরকে পছন্দ করার পর বিয়ের দিন ঠিক হওয়ার আগে ছেলের ঠার্কুদা মেয়ের কোষ্ঠী দেখতে চাইলেন। ওই পরিবারের কেউ কোষ্ঠী নিয়ে মাথা ঘামায় না বলে মেয়েটিরও কিছু ছিল না। কারও পরামর্শে ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটের একটা সেন্টার থেকে কম্পিউটারে কোষ্ঠী বের করে এনে পাত্রপক্ষকে দেওয়া হল। সেই কোষ্ঠী-বিচার করে ছেলেটির ঠার্কুদা রায় দিলেন, ‘এই বিয়ে হলে অশান্তির আগুন জ্বলবে, বিয়ে ভাঙবেই।’ ছেলেটি বিশ্বাস না-করলেও তার পরিবার বিরুদ্ধে যেতে পারেনি। বাধ্য হল ছেলেটি মেনে নিতে। শুনে মেয়েটি হেসে বলেছিল, ‘আমার ভাগ্য ভাল তাই একটি মেরুদণ্ডহীন পুরুষকে বিয়ে করতে হল না।’
আর একটি ঘটনা আমাকে খুব পীড়া দেয়। দুই কন্যা জন্ম নেওয়ার পরে মা যখন তৃতীয় কন্যাকে প্রসব করলেন, তখন জ্যোতিষী কোষ্ঠী-বিচার করে বললেন, ‘এই কন্যা বাড়িতে থাকলে সে পিতৃহত্যা করবেই।’ সঙ্গে-সঙ্গে ওই কন্যাকে ত্যাগ করে সন্তানহীন এক ভাইকে চিরতরে দান করে দেওয়া হল। সেই মেয়ে একদিন জেনেছে, যাকে সে বাবা ভেবেছে সে তার মামা, সে মুখ বুজে থেকেছে। যখন মেয়েটি চাকরি করছে, ‘আসল’ বাবা-মা’র তখন আর্থিক সঙ্গতি কমে এসেছে, তখন তাঁদের চৈতন্য হল। মেয়েকে ফিরে পেতে চাইলেন। মেয়ে বলল, ‘ফিরে গিয়ে যদি ইচ্ছে হয় শুধু বাবা কেন, মাকেও হত্যা করি তা হলে কী হবে?’
গ্রহ-নক্ষত্রকে হাতের মুঠোয়, গলা বা হাতের মাদুলিতে কব্জা করার প্রবণতা প্রায় আড়াইশো বছর ধরে এই বঙ্গভূমে চলে আসছে। বাড়িতে একজন মানুষ আমাদের শৈশবে এসেছিলেন। ভোরবেলায় স্নান সেরে তিনি আসনে বসে বলেছিলেন, ‘আমি জ্যোতিষী নই, আমি অ্যাস্ট্রোলজার।’ আমার পিতামহ পরম ভক্তিতে তাঁর করে দেওয়া কোষ্ঠী-বিচার গ্রহণ করেছিলেন। আমার কোষ্ঠী বিচার করে ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘জাতক স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিয়ে কারাবাস করবে?’ তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। যদিও এখনও আমি জেলখানা দেখিনি এবং না-দেখার যুক্তি হল, আবার জন্মমুহূর্ত লিপিবদ্ধ করতে নিশ্চয়ই একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল।
কথাসাহিত্যিক গজেন্দ্রকুমার মিত্রের ‘জ্যোতিষী’ গল্লটির কথা মনে পড়ছে। নিজের কোষ্ঠী-বিচার করে জ্যোতিষী জেনেছিলেন, তিনি মাতৃঘাতী এবং তাঁর স্ত্রী বিশ্বাসঘাতকতা করবেন। ঘটনা বা দুর্ঘটনাক্রমে তাই ঘটে গিয়েছিল। কিন্তু কিছু মানুষ, যাঁরা নিজেদের উপর ভরসা রাখতে পারেন না, তাঁরা এই গ্রহনক্ষত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাকে ব্যবহার বা প্রতিরোধ করার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। এর ফলে অনেকটা সময় নিজের অজান্তেই বেশ কেটে যায় তাঁদের।
গত রবিবারে শনি ঘর পাল্টেছেন বলে বিপদ বাড়বে বা সুখ আসবে, এই খবরটা যদি আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকার গরিব দেশগুলোর লোকজনদের জানিয়ে দেওয়া যেত, তা হলে জ্যোতিষশাস্ত্রের ব্যাপক চর্চা হত।
৩৯
ছাত্রাবস্থায় আমাদের একটা কৌতূহল ছিল। সেই বাবর থেকে বাহাদুর শা, মোগল বংশের সব বাদশার নাম আমরা জানি। কিন্তু আমার পূর্বপুরুষদের নামগুলো জানছি না কেন? এই কৌতূহল শুধু আমার একার নয়, আমার বন্ধুদেরও ছিল। এই ব্যাপারে জেনারেল নলেজ আটকে যেত ঠাকুরদা পর্যন্ত গিয়ে। বাবা এবং ঠাকুরদার নাম জানার পর আর কোনও কৌতূহল এই সময়ের ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখছি না। জিজ্ঞাসা করে উত্তর পেয়েছি, জেনে কী হবে! মোগলদের প্রত্যেকের নাম জানতে হবে পরীক্ষার কারণে, নিজের পিতামহের পিতামহের নাম জেনে তো নম্বর পাওয়া যাবে না।
ঠিক এই মনোভাব আমাদের মধ্যে ছিল না। আমরা খুঁজতে চাইতাম নামগুলো কারণ ওই নামগুলো থেকে চলে যাওয়া সময়টা ধরা যেত। যেমন, আমার ঠাকুরদার নাম ছিল পূর্ণচন্দ্র। স্বাধীনতার পর কোনও সন্তানের নাম পূর্ণচন্দ্র রাখা স্বাভাবিক ছিল না। ঠাকুরদা জন্মেছিলেন আঠারোশো নব্বইতে। হয়তো সেই সময়ে পূর্ণচন্দ্র খুব আদরের নাম। সাধুভাষায় ওই নামকরণের মধ্যে একটা সম্ভ্রমভাবও থেকে গিয়েছে। স্বাধীনতার পরে এইরকম নামকরণ হাস্যকর মনে হতেই পারে। রবীন্দ্রনাথ চিরকুমার সভার নায়কের নাম রেখেছিলেন পূর্ণ। যতদূর মনে আছে, পূর্ণ স্বমহিমায় ছিল, সঙ্গে চন্দ্র যোগ করেননি রবীন্দ্রনাথ। এই চন্দ্র বাদ দেওয়াতে নামটি একটু আধুনিক চেহারা পেয়ে গিয়েছিল। আমার ঠাকুরদার গায়ের রং গৌর ছিল না, নামকরণের সময় সম্ভব বুঝতে পারেননি তাঁর অভিভাবকরা।
আমার ছাত্রাবস্থায় ঠাকুরদা জীবিত ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি একটি পুরনো খাতা এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ”আমার কাছে এটা রাখার আর দরকার নেই, প্রয়োজন বোধ করলে তুমি রেখো।”
সেই খাতায় উনিশশো পাঁচ সালের বাজারদর, দিনের খরচের হিসাব যা পড়ে খুব মজা পেয়েছি। সেই সঙ্গে বংশতালিকার ছয়টি নাম পড়ার সুযোগ হয়ে গেল। ঠাকুরদার বাবার নাম পরশুরাম। ততদিনে আমি পরশুরাম মুনির কাহিনি পড়ে ফেলেছি। মহাভারতের অন্যতম বর্ণময় চরিত্র। এঁকে বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার বলা হয়ে থাকে। বাবার আদেশে মাকে বধ করার পুরস্কার হিসাবে যখন তাঁকে বর প্রার্থনা করতে বলা হয় তখন তিনি মৃত মাকে আবার জীবিত করে দিতে বলেন। ভীষ্ম দ্রোণ এবং কর্ণের অস্ত্রগুরু ছিলেন। তাঁর নামে সন্তানের নামকরণ করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মের সমসময়ে। মনে রাখতে হবে, ঠাকুরবাড়ি বা ব্রাহ্মসমাজের বাইরে বাঙালি সমাজে হিন্দু দেবদেবীর প্রভাব বিস্তর ছিল। সন্তানের নামকরণের সময় তাই দেবদেবীদের নামই ব্যবহার করা হত। কিন্তু পরশুরাম সেই অর্থে হিন্দুদের আরাধ্য দেবতার মধ্যে পড়েন না। মহাভারতের অনেক নাম পরবর্তীকালে আধুনিক চেহারা নিয়ে এসেছে। যেমন ভীষ্ম অথবা কুন্তী। কিন্তু পাণ্ডু নামের কোনও মানুষের সন্ধান আমি পাইনি। আমার ঠাকুরদার বাবার অভিভাবকরা সন্তানের নামকরণের ব্যাপারে সেই সময়ে কিছুটা ব্যতিক্রমী মানসিকতা দেখিয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই।
শ্রীযুক্ত পরশুরামের পিতার নাম ছিল রামকৃষ্ণ। একথা মনে করার কোনও কারণ নেই যে দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণদেবের প্রভাবে ওঁর নামকরণ করা হয়েছিল। সময়ের হিসাবে পরশুরামের পিতার জন্ম অনেক আগে হয়েছিল। ঈশ্বরভক্তির নজির হিসাবে এই নামকরণ। কিন্তু বঙ্গভূমিতে কৃষ্ণের যে প্রচার এবং গ্রহণযোগ্যতা ছিল অথবা কিছুটা আছে রামচন্দ্রর তা ছিল না। তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হতেন উত্তর ভারতে। কিন্তু যিনি রাম তিনিই কৃষ্ণ এই ভাবনায় ভাবিত হয়ে রামকৃষ্ণ নামকরণ স্বাভাবিক ছিল।
রামকৃষ্ণর বাবার নাম নিয়ে আমার সংশয় এখনও যায়নি। ঠাকুরদা যে খাতা দিয়েছিলেন তাতে রামকৃষ্ণর পূর্বসূরি হিসাবে দু’টি নাম লেখা ছিল। একটি, বৃন্দাবন, অন্যটি মহেশ্বর। এঁদের মধ্যে রামকৃষ্ণর বাবা কে ছিলেন তা লেখা না থাকায় ঠাকুরদাকে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি অজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ওঁরা সম্ভবত দুই ভাই। ঠাকুরদার দেওয়া খাতায় ওই দু’জনের বাবার নাম ছিল পরমেশ্বর। তাঁর নাম থেকেই বংশতালিকা শুরু করা হয়েছিল। সময় বিচার করলে সতেরোশো আশি নব্বই-এ পরমেশ্বরের জন্ম হয়েছিল। অর্থাৎ আমার আগে ছয় পুরুষের নাম আমি জানতে পারছি। পরমেশ্বরের দুই ছেলের নামের মধ্যে সেই সময়ের শৈব এবং বৈষ্ণব মানসিকতার প্রতিফলন পড়েছিল কি না তা নিয়ে শুধু কল্পনাই করতে পারি। কিন্তু বাঙালি পুরুষের নামকরণের ব্যাপারে তথাকথিত ভগবানের নামের ব্যবহার থেকে যে ছবিটা স্পষ্ট তাতে হরি, নারায়ণ অথবা কৃষ্ণের শাখা অনেক বেশি প্রিয় ছিল। আর এক শাখা, যেমন মহেশ্বর, শিবনাথ, শিবপদ, বিরূপাক্ষ, ত্রিলোচন, পিনাকী, নীলকণ্ঠের নামে নামকরণ থেকে বোঝা যায় ওই পরিবারের মানুষ শিবের ভক্ত। পরমেশ্বর তাঁর ছেলের নাম মহেশ্বর রাখার পাশাপাশি অন্য জনের নাম বৃন্দাবন রেখে আমাদের বিস্মিত করেছেন। তৃতীয় শাখা অবশ্যই শাক্তদের যাঁরা কালীভক্ত। কালীর সঙ্গে শব্দ জুড়ে সন্তানের নামকরণ করেন। এই সব নামকরণের পিছনে একটা প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য হয়তো কাজ করত। সন্তানদের নাম ধরে ডাকাডাকির সময় ভগবানের নাম করা হয়ে যেত।
ছাত্রাবস্থায় আমি যখন ছয় পুরুষে থেমে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম তখন এক সহপাঠীর ঠাকুরদা জানিয়েছিলেন তিনি চোদ্দো পুরুষের নাম জানেন। তাঁর প্রপিতামহের পিতামহ নামগুলো বলে গিয়েছিলেন। সেই নামাবলি এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্ম জেনেছে। তিনি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। সহপাঠীর পদবি ছিল দাস। আমার মনে হয়েছিল ইতিহাস বই-এর বাইরে আর একটি দাস-বংশ দেখতে পেলাম।
এই কিছু বছর আগেও বাঙালি মহালয়ার ভোরে ব্যাপকভাবে পিতৃতর্পণ করতে যেতেন। গঙ্গা অথবা নদীর গায়ে প্রায় মেলা বসত। এখন শীর্ণ হয়ে গেলেও কেউ কেউ নিয়মটা মানছেন। মজার কথা হল, তর্পণের সময় বাবার দিক থেকে যেমন তিন পুরুষের নাম দরকার হয় তেমনই মায়ের দিক থেকেও তিন পুরুষ দরকার যাঁরা জল পেয়ে তৃপ্ত হবেন। অর্থাৎ চোদ্দো পুরুষকে টেনে আনার প্রয়োজন যখন নেই তখন তিন পুরুষেই কাজটা শেষ করা সহজ।
ছাত্রাবস্থায় প্রশ্নটা মাথায় এসেছিল। আমরা চোদ্দো পুরুষের খোঁজ করছি, আমাদের মা, তাঁর মা-দিদিমাদের, অথবা ঠাকুমা, তার মা-দিদিমাদের সম্পর্কে জানতে এত শীতল কেন? আজকের ছেলেমেয়েরা মা-দিদিমাকে, বড় জোর ঠাকুমাকে দেখেছে, নাম জেনেছে। দিদিমা বা ঠাকুমার মায়ের নাম কী ছিল তা জানার আগ্রহ নেই। চোদ্দো পুরুষের পাশাপাশি এই নারীরা কেন প্রাধান্য পাবেন না? কেন উপেক্ষিতা থেকে যাবেন?