২০
উত্তর কলকাতার ‘উদয়ের পথে’ একটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংস্থা। এরা এলাকার মানুষের জন্য যে সামাজিক কাজকর্ম করে তা এককথায় অনবদ্য। মানুষের বিপদের খবর তাদের কাছে পৌঁছে দিলেই ওঁরা সক্রিয় হন। যেহেতু আমি উত্তর কলকাতায় থাকি, তাই ওঁদের কিছুদিন থেকে দেখে আসছি। আমার কলেজ স্কটিশের সামনে হেদুয়ার গায়ে ওঁরা সংস্থার কাজে একত্রিত হন। তারপর ওঁদের হয়ে বাপ্পা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল। আমি আরও বিশদে জানতে পারলাম। পেরে লজ্জিত হলাম।
আমি গল্প-উপন্যাস-ফিচার লিখি। তার বাইরে যা করি তা নিজের অথবা আমার প্রিয়জনের জন্য। এইভাবেই দিন, মাস, বছর এবং শেষে জীবনটাও কেটে যায়। কোনও খবর কাগজে পড়ে খারাপ লাগলে মনে মনে গালাগাল দিই। ওই খারাপ কাজটা কেন হল তা জানতে উদ্যোগী হই না, কোনও হাসপাতালে রুগিরা যদি ঠিকঠাক চিকিৎসা না পান তাহলে সেখানকার ডাক্তার অথবা প্রশাসকদের কাছে গিয়ে অনুরোধ করি না যাতে ওঁরা উপকৃত হন। আমাদের মন খারাপ হয়, গালাগাল দিই বাড়িতে বসে, তারপরে ভুলে যাই। আমাদের রাস্তায় যদি একটা কিছু উপলক্ষকে অজুহাত করে কয়েকজন রাত এগারোটা পর্যন্ত তারস্বরে মাইক বাজায় তাদের কাছে গিয়ে বলি না, ভাই পাড়ায় অনেক অসুস্থ মানুষ আছেন, বয়স্করা আছেন, তাঁদের খুব অসুবিধে হচ্ছে। দয়া করে মাইক বন্ধ করুন, অনেক রাত হয়ে গেছে। বলি না, কারণ ওরা আমাদের অপমান করতে পারে। গাড়িতে একা আসছি। দেখতে পাচ্ছি বাস না থাকায় মানুষ বিপদে পড়েছে। এক বৃদ্ধা তাঁর নাতনির হাত ধরে কাতর চোখে তাকিয়ে আছেন। গাড়ি থামিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করি না, আপনি কোনদিকে যাবেন? আমার গন্তব্যের পথে ওঁরা যেতে চাইলে গাড়িতে তুলে নিই না। নিজেকে বোঝাই একজনকে তুললে দশজন ঝাঁপিয়ে পড়বে গাড়িতে ওঠার জন্য।
অর্থাৎ এই আমি, এবং আমার মতো অনেক অনেক মানুষ নিজের জন্য বেঁচে থাকছি। ক্রমশ এই জীবনযাপনই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আমার ছেলের নাম কলেজের ভর্তির লিস্টে না থাকলে আমি লোক ধরে মোটা টাকা খরচ করে পেছন দরজা দিয়ে ভর্তি করছি। একটুও বিবেকে লাগছে না এবং ঘটনাটা কাউকে জানাচ্ছি না। এই আমি যখন ‘উদয়ের পথে’র সদস্যদের সঙ্গে পরিচিত হলাম তখন এমন ভাব করতে লাগলাম যে আমিও কত ভাল কাজ মানুষের জন্যে করে যাচ্ছি এবং ওঁদের উপদেশ দেওয়ার অধিকার আমার আছে।
‘উদয়ের পথে’র ছেলেরা কী করেন? কারও চিকিৎসার জন্যে রক্তের দরকার হলে ওঁরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কেউ ওষুধ কিনতে সক্ষম হচ্ছেন না, অনুরোধ পেলে ওঁরা চেষ্টা করেন যতটা সম্ভব তাঁর পাশে দাঁড়াতে। ভোরবেলায় হেদুয়াতে হাঁটতে যান অনেক বয়স্ক মানুষ। সেই সময় ‘উদয়ের পথে’র সদস্যরা আরামে যে যাঁর বাড়িতে ঘুমোতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা সপ্তাহে অন্তত এক সকালে চলে আসেন হেদুয়ায় তাঁদের হেলথ-চেক প্রোগ্রামে। প্রাতঃভ্রমণকারী বয়স্কদের ব্লাডপ্রেসার থেকে শুরু করে রক্তের সাধারণ পরীক্ষাগুলো তাঁরা চিকিৎসকদের সাহায্য নিয়ে ওখানেই করে ফেলেন। এছাড়া বছরে কয়েকবার হেলথ ক্যাম্প এবং বিজ্ঞান মেলার আয়োজন তো করেই চলেছেন। প্রশ্ন হল, কেন করছেন। এই কাজে ব্যক্তিগত জাগতিক কোনও লাভ নেই। তাহলে সময় দিচ্ছেন কেন, যা আমি বা আমার মতো বেশিরভাগ মানুষ দিতে চাই না। আজকাল কেউ বা কোনও সংস্থা এইরকম কাজ করলেই মনে হয় পেছনে কোনও উদ্দেশ্য আছে, যা আমরা জানি না।
‘উদয়ের পথে’র অন্যতম উদ্যোক্তা বাপ্পা মাসখানেক আগে টেলিফোনে বলেছিলেন, দাদা, পয়লা জুন সকাল এগারোটায় আমাদের কাছে আসতে হবেই। ওইদিন আমরা রক্ত দান শিবির করছি। শুধু ফোন নয়, পরে কার্ডও এল। প্রথমে মনে হল, এইরকম অনুষ্ঠানে আমি না গেলে ওঁদের কোনও অসুবিধে হবে না। অনেকেই নিশ্চয়ই যাবেন। কিন্তু যে ছেলেটি আমার ফিজিওথেরাপি করে সেই বিকাশ ওঁদের সংস্থার সদস্য হওয়ায় তার দাবি এড়াতে পারলাম না।
কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট এবং শিশির ভাদুড়ী স্ট্রিটের সংযোগস্থলে মঞ্চ বেঁধে অনুষ্ঠান হচ্ছিল। পাশেই বিশাল ক্যাম্প করে দাতাদের কাছ থেকে রক্ত নেওয়া হচ্ছে। মঞ্চে উঠে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, পি কে ব্যানার্জি, মহম্মদ সেলিম, সুভাষ ভৌমিক, দেবশংকর হালদার এবং অনেক বিখ্যাত, কৃতী মানুষ একসঙ্গে বসে আছেন। প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার গৌতমমোহন চক্রবর্তী ‘উদয়ের পথে’র অভিভাবক। তিনি রক্তদানের ব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন। আমি সৌমিত্রদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি এই সকালে সেই গল্ফগ্রিন থেকে উত্তর কলকাতায়?’ সৌমিত্রদা বললেন, ‘এই একটা ব্যাপারে আমন্ত্রণ পেলে এবং শুটিং না থাকলে আমি চলে আসি।’ বক্তৃতায় সুন্দর বললেন তিনি, ‘আমার যে বয়স হয়েছে তাতে রক্ত দিতে চাইলে চিকিৎসকরা আপত্তি করবেন আর না করলে হয়তো যাঁর শরীরে সেই রক্ত যাবে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। কিন্তু আমি আসি কারণ আমার কথা শুনে একজনও যদি ইতস্ততভাব সরিয়ে রক্ত দিতে এগিয়ে যান তাতেই আমি খুশি হব।’
খেয়াল হল, একটু একটু করে বয়স আমাকে যেখানে পৌঁছে দিয়েছে সেখানে এসে আজ আমিও রক্ত দিতে চাইলে তা কাজে লাগবে না। হঠাৎ নিজেকে বাতিল বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু দেবশংকর জানালেন, তিনি আজ রক্ত দেবেন বলে এসেছেন। গতরাতে তাঁর অভিনয় ছিল, আজ বিকেলেও আছে। এই ফাঁকে রক্ত দিয়ে যেতে চান। বছরে অন্তত চারবার রক্ত দিয়ে থাকেন। নিজের রক্তের গ্রুপ শ্রোতাদের জানিয়ে অনুরোধ করলেন, ‘এই গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন হলেই আমায় ফোন করবেন।’ আমি দেবশংকরের দিকে তাকালাম। এক উজ্জ্বল মুখ।
মাঝখানে এলাকার সেইসব ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কৃত করা হল যারা মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে ভাল ফল করেছে। এর পরের ঘটনাটা আমাকে বিহ্বল করেছিল। যাঁরা মৃত্যুর আগে দেহদান করে যান, চক্ষুদান করেন তাঁরা যে উদ্দেশ্যে করে থাকেন, মৃত্যুর পরে তাঁদের পরিবারের মানুষজন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা মেনে নেন না। তাঁরা তাঁদের ধর্মমতে মৃতের শরীরের পারলৌকিক ক্রিয়া করে থাকেন। ফলে মৃতের শেষ আশা যেমন পূর্ণ হয় না তেমনই অনেকেই বঞ্চিত হন। কিন্তু যে সব পরিবার মৃত্যুর পরে প্রিয়জনের এই ইচ্ছেকে সম্মান জানান তাঁদের মঞ্চে ডেকে এনে সংবর্ধনা দিল ‘উদয়ের পথে’। আমি জানলাম, আমাদের তরুণ বয়সের গ্রুপ থিয়েটারের অন্যতম পরিচালক-অভিনেতা শ্যামল ঘোষের দেহদানের ইচ্ছে পূর্ণ করেছেন তাঁর স্ত্রী-কন্যা। ভাল লাগল। দেহদান এবং চক্ষুদানের ব্যাপারে সাহায্য করছে ‘উদয়ের পথে’। হঠাৎ মনে হল, আমাদের শরীর যখন সৃষ্টি হয়েছিল তখন স্রষ্টা প্রতিটি মানুষের শরীরে একই গ্রুপের রক্ত দেননি। এই যে বিভিন্ন গ্রুপের রক্ত দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে তিনিই সবচেয়ে বেশি মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছেন, করে চলেছেন। কিন্তু ‘উদয়ের পথে’র মতো দেশের অনেক সংস্থা এগিয়ে এসে এই বিভাজন দূর করতে এই রক্তদান অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে চলেছে। মানুষের শ্রেষ্ঠ দান হল রক্তদান। সংগৃহীত রক্ত গ্রুপ অনুযায়ী ব্যবহৃত হয়। স্রষ্টা তখন পরাজিত। মঞ্চ থেকে নেমে আসার সময় এক বৃদ্ধকে বলতে শুনলাম, ”যাই বলো ভাই, এই ‘উদয়ের
২১
কৈশোর পেরিয়েছিলাম পনেরো বছর বয়সে। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়া। সেই ফলগুলো জোগান দিতে ঠিকঠাক জোগানদার এসে যেত। নিষিদ্ধ বই (তখন ‘চরিত্রহীন’ পড়লে বাড়িতে লাল চোখ দেখানো হত) থেকে রোমাঞ্চিত হতে চেয়েছিলাম উপন্যাসের নাম জেনে। বন্ধু নিশীথ বলেছিল, ‘কাকার বাড়ি থেকে চুরি করে এনেছি। তুই আগে পড়, তারপর আমি পড়ব। কিন্তু লুকিয়ে পড়বি। ধরা পড়ে গেলে তোর ঠাকুরদা বই কেড়ে নেবে।’ কেন কাড়বে তাও বুঝিয়েছিল সে, ‘চরিত্রহীন মানে লম্পট, ব্যভিচারী, একের পর এক মেয়েদের ভোগ করে।’ চোখ টিপেছিল সে, ‘বুঝতে পারছিস? প্রচুর জ্ঞান পেয়ে যাবি।’
শরৎচন্দ্রের ‘রামের সুমতি’ পড়েছি। কেউ কিছু বলেনি। ছুটির দিনে খাঁ খাঁ দুপুরে তিস্তার কাশবনে বসে ‘চরিত্রহীন’ পড়ছি আর অপেক্ষা করছি কখন সেই সব বর্ণনা পড়তে পারব। একবার দিবাকরকে কিরণময়ী চুমু খেল। কোনও প্রতিক্রিয়া হল না আমার। কিন্তু যেই কিরণময়ী ‘খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল’ অমনি আমার মনে কীরকম মোচড় শুরু হল। উপন্যাস শেষ করে আমি খুব হতাশ হলাম। নিশীথ যা বলেছিল, তার কিস্যু নেই। শরৎচন্দ্র কেন এমন নামকরণ করলেন? সব শুনে নিশীথ বলল, ‘যাতে বই বেশি বিক্রি হয় তাই ওই নাম দিয়েছে। দূর। আমি পড়ব না। বইটা তো ফেরত দিতে পারব না, তিস্তার জলে ভাসিয়ে দিচ্ছি।’
মাংসের ঝোলে যদি দ্বিগুণ লবণ পড়ে যায় তাহলে খাওয়া যায় না। প্রথম নিষিদ্ধ আনন্দ পেতে গিয়ে আমার সেই অবস্থা হল। বাড়িতে কঠোর শাসন, শালা, শুয়ার আর নতুন শেখা শব্দ গাণ্ডু ছাড়া জম্পেশ গালাগালি তখনও শেখা হয়নি। তখন থেকে বাড়িতে ভাল ছেলের অভিনয় করছি আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় ওই তিনটি শব্দ আউড়ে নিজেকে সাবালক ভাবছি।
এইসময় গোবিন্দ নিচু গলায় বলল, ‘দুটো বই এনেছি, কোনটা পড়বি?’
‘কী বই? কার লেখা?’
‘লেখকের নাম নেই। চটি বই। আধঘন্টায় পড়ে ফেলবি। একটার নাম ‘দুপুরের ঠাকুরপো’, অন্যটা হল, ‘লাল সায়া’।’
দ্বিতীয় নামটা শুনে একটু কুঁকড়ে গেলাম। প্রথম বইটা নিতে হাতখরচের জমানো টাকা থেকে গোবিন্দকে চার আনা দিতে হল। তিস্তার চরে বসে পড়া শুরু করলাম। কোনও মলাট নেই, ছাপাও খারাপ। এক মহিলার স্বামী প্রায়ই চাকরির সূত্রে বাইরে যান। তিনি একা থাকেন যখন তখন তাঁর ঠাকুরপোরা প্রায়ই পালা করে দুপুরবেলায় আসে। মহিলা নগ্ন হয়ে তাদের সঙ্গে যা করেন সেই বর্ণনা যখন শুরু হল, তখন শরীর গুলিয়ে উঠল। মনে হচ্ছিল বমি হয়ে যাবে। গোবিন্দকে বই ফেরত দিয়ে বললাম, ‘কী করে এসব পড়িস। ছিঃ।’ তার পরদিন থেকে স্কুলে প্রচার হয়ে গেল ‘গুডিবয় সমরেশ’।
ওই একটি বইয়ের কয়েকটি পাতায় যে বিস্ফোরণ ছিল তা মাথা থেকে নামাতে সাহায্য করলেন শরৎচন্দ্র। পাশের বাড়ির বউদির অনুরোধে বই এনে দিতাম বাবুপাড়া পাঠাগার থেকে। কাজের লোককে দিয়ে পড়া বই পাঠিয়ে দিতেন, আমি পাল্টে আনতাম। সেটা নিয়ে ওদের দোতলায় উঠেছি হঠাৎ কানে এল দাদা গদগদ গলায় কিছু চাইছেন আর বউদি এমনভাবে হেসে উঠলেন যে তৎক্ষণাৎ কিরণময়ীর খিলখিল হাসির কথা মনে চলে এল। বইটি টেবিলের উপর রেখে পালিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু অনেক রাত পর্যন্ত বিছানায় পড়ে ছিলাম। ঘুম আসছিল না। কেবলই হাসির শব্দ শিরায় টোকা মারছিল। আচ্ছা, শরৎচন্দ্র খিলখিল শব্দটা কি ভেবেচিন্তে লিখেছিলেন? ওই শব্দের কাছে ‘দুপুরের ঠাকুরপো’ একশো মাইলের মধ্যে আসতে পারে না।
তখন আমার নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। অভিভাবকরা তার কথা জানতেই পারেননি। আমি অভিনয় করতে শিখে গিয়েছিলাম বলে তাঁরা আমাকে তখনও একটি সরল কিশোর বলেই ভাবতেন। ওই সময় বন্ধুরা প্রেমে পড়তে লাগল। যেহেতু আমি তখন লাবণ্যর প্রেমে মজে ছিলাম তাই সেই চোদ্দো-পনেরো বছরের মেকি সুন্দরীদের নাবালিকা মনে হত। বন্ধুরা তাদের হয়ে প্রেমপত্র লিখতে বললে আমি খুশি হতাম এই কারণে, প্রতিটি চিঠিই আমি লাবণ্যর উদ্দেশে লিখতাম। অমিত রায়কে পছন্দ হত না বলে সেইসব চিঠিতে জ্বালা ছড়িয়ে থাকত।
কলকাতার কলেজে পড়তে এসেই আমার জ্ঞানবৃদ্ধি হল। কলকাতার ছেলেরা, কলেজে পড়া ছেলেরা তখন থেকেই চার অক্ষর, দুই অক্ষরের শব্দগুলো নিজেদের মধ্যে অবলীলায় উচ্চারণ করত। সেই চার অক্ষরের শব্দটির ঠিকঠাক অর্থ কী তখন যেমন বুঝতে পারিনি, এখনও নয়। যারা বলত তারা বোধহয় আরাম পেত কারণ উচ্চারণের রকমভেদ ছিল।
স্কটিশের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সহপাঠী বলেছিল, ‘তুই মফস্বলের ছেলে বলে অন্ধকারে আছিস, শালা বা শুয়োর কেন গালাগালি হবে? শালা হল বউ-এর ভাই, মায়ের ভাই। ওটা আদরের ডাক। আর শুয়োর? আচ্ছা, কাউকে শুয়োর না বলে বাঘ, হরিণ বললে যদি গালাগাল না হয় তাহলে শুয়োর কেন হবে? তোর গাণ্ডু শব্দটা উচ্চারণ করতে লজ্জা লাগে। কেন রে? ওই শব্দটি কী মিষ্টি, কত সুন্দর। গাণ্ডু মানে যে গান করে। কিন্তু সুকুমার সেনরা বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মেশাতেন না। অন্য অর্থে গাণ্ডু মানে নিতম্ব।’
‘কী করে?’ আমি অবাক। সত্যি কিছুই জানি না।
‘গাণ্ডু শব্দটা ব্যবহৃত হতে হতে হয়ে গিয়েছে গাঁড়। গাঁড় মানে নিতম্ব। তুই কোনও অশ্লীল গালাগাল শিখিসনি রে!’
সহপাঠী সীতানাথ হাওড়ার ছেলে। রণেন্দু যা বলেছে তা শুনে সে মাথা নাড়ল। ‘ঠিক বলেছে, গাণ্ডু থেকে গাঁড়, আর রণেন্দু থেকে রাঁঢ়। এইভাবেই শব্দ তার চেহারা বদলায়।’
কলেজে পড়ার সময় ‘লেডি চ্যাটার্লি’ থেকে ‘বিবর’ পড়া হয়ে গেল। আমার মনে হল, এটাও সাহিত্যের একটা দিক। এমনকী ‘লোলিটা’ও।
আমার এক দাদাস্থানীয় ভদ্রলোক সল্টলেকে থাকেন। তাঁর বাড়িতে প্রথমবার যেতেই নাতির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। নিষ্পাপ মুখ-চোখ। দাদা বললেন, ‘এখনও ওর মনে পাপ ঢোকেনি। টিভি দেখতে বসে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, জাপানি তেলের দাম কত? ওই তেল ব্যবহার করলে যে অন্য অনুভব হয় সেটা কী রকম? আমি ওকে বলেছি, ওটা বাতের ব্যথার তেল। ও সেটাই বিশ্বাস করেছে।’
তিনদিন বাদে সিটি সেন্টারের খাবারের ঘরে বসে কফি খাচ্ছি, চারটি মেয়ে পিছনের টেবিলে এসে বসল। ওরা তুই-তোকারি করছে। একটু পরেই মেয়েদের গলায় শালা শুনলাম তিনবার। একটি ছেলে কারও উদ্দেশে চার অক্ষরের গালাগাল দিল। একটি মেয়ে বলল, ‘ওর পিছনে হাম্পু দিতে হয়।’
চা শেষ করে চলে আসার সময় চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। দাদার সেই নাতি চোখ বন্ধ করে সিগারেটের ধোঁয়া টানছে।
বুঝলাম অভিনয় এখনও চলছে, তবে তার রকমটা বদলে গিয়েছে।
২২
নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইট এলাকার একটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার এক অভিনেতা দাদা উল্লসিত হয়ে বললেন, ‘ওই যে, ওই যে ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ’ উঃ!, কয়েক দিন ম্যাকড়োানাল্ড’সে খেয়ে-খেয়ে অরুচি ধরে গেছে। চল, ওখানে গিয়ে জমিয়ে খাই।’
সতর্ক করলাম, ‘দাদা, ম্যাকড়োানাল্ড’সে পাঁচ ডলারে পেট ভরে যায়, ওখানে অন্তত তিনগুণ খরচ হয়ে যাবে।’
‘কোই পরোয়া নেহি। আমি ইন্ডিয়ান, ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁয় খাব।’
তখন দুপুর। রেস্তোরাঁর ভিতরে মাঝারি ভিড়। ওয়েটারের বদান্যতায় বসার জায়গা পেলাম। ওয়েটার যখন অর্ডার নিতে এল, তখন দাদা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই যে বাবা, তুম কাঁহাকা আদমি হ্যায়? দিল্লি, না মুম্বই।’
‘আপনি বাংলায় বলুন স্যর।’ ওয়েটার হাসল।
‘আরে বাবা! তুমি বাঙালি? ফাটাফাটি! বাংলা খাবার কি পেতে পারি?’
ওয়েটার ছেলেটি যা বলল তাতে উত্তর ভারত এবং পাঞ্জাবের খাবারগুলোর নাম শুনতে পেলাম। অভিনেতা দাদা খেপে গেলেন—’তুমি বাংলায় কথা বলছ, অথচ এখানে সুক্তো, ছ্যাঁচড়া, কালিয়া বানাতে পারোনি! ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ মানে কি পশ্চিমবাংলা বাদ? মালিককে ডাকো!’
মালিক এলেন। অভিযোগ শুনে হেসে বললেন, ‘মেনু-র বাইরেও খাবার আছে’। যেমন আলুভর্তা, বেগুনভর্তা, সিমভর্তা, মুগডালঃ।’
‘ভর্তা? ভর্তা মানে? বাংলাদেশের মানুষ ভর্তা খান।’
‘ঠিক, আসলে আমরা তো বাংলাদেশের মানুষ। আমাদের খাবারদাবার তো ভারতের অনেক মানুষের পছন্দ হয় না বলে বিরিয়ানি, চাপ, দিলবাহার সবই মেনু-তে রেখেছি। ওই দেখুন, উনি ফরিদপুরের মানুষ। চিংড়িভর্তা আর ইলিশ খাচ্ছেন।’
‘দাঁড়ান দাঁড়ান। এটা ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ নয়, বাংলাদেশের রেস্তোরাঁ?’
‘হ্যাঁ।’
‘এই মিথ্যাচার করছেন কেন?’
”না করলে কাস্টমার আসবে না, আর যদি সত্যিকথা শুনতে চান তা হলে বাংলাদেশ একসময় পূর্ববঙ্গ হয়ে ইন্ডিয়ার অংশ ছিল। এখন কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, তা হলে আমরা গর্বের সঙ্গে বলি, ‘আমরা বাংলাদেশের মানুষ’।”
দাদা শান্ত হয়ে তিনরকমের ভর্তা এবং ইলিশ মাছ খেয়ে বললেন, ‘বেশ রেঁধেছে হে! মুখটা ছেড়ে গেল। আর, একেবারে পদ্মার ইলিশ!’
ওপাশের টেবিল থেকে এক ভদ্রলোক খাওয়া থামিয়ে বললেন, ‘আমার তো মনে হয় না। ওয়েস্ট ইন্ডিজেও ইলিশ পাওয়া যায়।’
‘অ!’ দাদা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনিও বাংলাদেশের?’
‘না, কলকাতার।’
‘কলকাতার কোথায়?’
‘রানাঘাটে।’
‘তা ভাই, কলকাতা নামে কোনও দেশ আছে আমি জানতাম না। পাসপোর্টে তো ইন্ডিয়ান লেখা আছে, সেটা বললে কি জিভ খসে যাবে?’ দাদা উঠে পড়লেন।
পৃথিবীর সর্বত্র বাংলাদেশের মানুষ খাবারের দোকান করেছেন—কিন্তু নাম দিয়েছেন, ‘ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ’। অথচ নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশি!’ কিন্তু লক্ষ করেছি, পশ্চিমবাংলার মানুষরা নিজেকে ‘ইন্ডিয়ান’ বলেন না, বলেন ‘বাঙালি’ অথবা ‘কলকাতায় বাড়ি’। অন্য প্রদেশের মানুষেরা নিজেকে যতটা ভারতীয় ভাবেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তা ভাবতে পারেন না। আর সেই কারণে ‘গোয়া বা পুদুচেরি আমার দেশ’ এই বোধটা তৈরি হয়নি। ব্রিটিশরা দু’শো বছর ধরে চেষ্টা করেও হার মেনে গেছে।
কয়েক বছর আগে চা-বাগানে গিয়ে বেড়াতে-বেড়াতে কুলি লাইনে পৌঁছে গিয়েছিলাম। কয়েক দিন আগে ভোট হয়ে গেছে। একজন বৃদ্ধ মদেশিয়া ঘাস কাটছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা হল, ‘কাকে ভোট দিলেন?’
বৃদ্ধ হাসলেন, ‘ডাক্তারবাবুর ছেলে এসে বলল, ওদেরই দিলাম।’
‘ডাক্তারবাবু কে?’
‘খুব বড় ডাক্তার। জলপাইগুড়িতে থাকতেন। মাঝে-মাঝে আমাদের কাছে আসতেন। ওঁর ওষুধে কত মানুষ ভাল হয়ে গেছে! ভগবানের মতো মানুষ।’ বৃদ্ধ বললেন।
ডাক্তারবাবুকে চিনতে পারলাম। এককালে গান্ধীজির শিষ্য ছিলেন, কংগ্রেস করতেন, ‘মানুষের সেবা’-ই ছিল তাঁর ধর্ম। ওঁর ছেলে বামপন্থী নেতা। বাবার পথ থেকে অনেক দূরে তাঁর পথ। অথচ ভোট পাচ্ছেন ডাক্তারবাবুর ছেলে বলেই। এরকম বিচিত্র ব্যাপার এই ভারতেই সম্ভব।
নাথুয়ার মোড়ে কয়েকটি ছেলে আড্ডা মারছিল। বোঝা যায়, ওদের বয়স বাইশ থেকে পঁচিশের মধ্যে। নাথুয়া জলপাইগুড়ি জেলার একটি প্রত্যন্ত গঞ্জ এলাকা। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমরা এবার ভোট দিয়েছ?’ সবাই ঘাড় নাড়ল, ‘হ্যাঁ’। তিনজন জানাল, ওরা এবারই প্রথম ভোট দিয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভারতের অর্থমন্ত্রীর নাম জানো?’ সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। অর্থাৎ জানে না। ‘প্রধানমন্ত্রীর নাম নিশ্চয়ই জানো?’ দু’জন মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, ‘মোহন সিং সর্দারজি।’
আর দাঁড়ালাম না। জলপাইগুড়ি শহরে এলাম। কলেজের সামনে ছাত্রদের আড্ডা হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যমন্ত্রীর নাম জানো?’
‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’ একজন বলতে সবাই মাথা নাড়ল।
‘অর্থমন্ত্রী কে?’
‘অমিত রায়।’ একজন সদর্পে জানাল।
এঁরাই ভারতের নাগরিক। নির্বাচনে এঁরাই ভোট দেন বা দেবেন। অনেকেই এখনও মনে করেন—গান্ধী পরিবার দেশ চালাচ্ছে। মোদি আর সোনিয়া গান্ধীর তফাত বোঝেন না এমন মানুষের সংখ্যা প্রচুর। ব্রিটিশরা তাদের প্রয়োজনে গোটা ভারতকে এক করতে চেষ্টা করে পারেনি। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য এবং পরস্পরকে আক্রমণ ধীরে-ধীরে এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, নিজেদের সমর্থকদের নিয়ে তারা অস্তিত্ব বজায় রাখছে। দল ভেঙে তৈরি হয়ে গেছে অনেক নতুন দল। আর তার চাপে ভারতের বেশির ভাগ মানুষের ‘ভারতীয় বোধ’ তৈরি হয়নি। এবং এই কারণে দেশ সম্পর্কে আমাদের আবেগ কতটা বাস্তবনির্ভর তাতে বিলক্ষণ সন্দেহ থাকছে।
২৩
আমি কখনও হাসপাতালের বিছানায় রাত কাটাইনি। যে কারণে কাটাতে হয় সেই কারণগুলোয় আমার শরীর এখনও আক্রান্ত হয়নি। বাড়িতে নিজের বিছানায় শুয়ে সবার সঙ্গে গল্প করতে করতে মরে যাওয়ার সুযোগ আজকাল পাওয়া যায় না। শরীরের হালচাল ভাল না বুঝলেই ডাক্তার বলবেন, ‘হাসপাতালে নিয়ে যান।’ সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির লোকজন ভেবে নেবেন, ‘হাসপাতালে নিয়ে গেলেই বেঁচে যাবে, ওখানেই নিয়ে চল।’
এই ব্যাপারে কথা হচ্ছিল যাঁর সঙ্গে তিনি আর একমাস পরে নব্বইতে পৌঁছবেন। এখনও সোজা হয়ে দোতলায় ওঠেন। সকালে ঘন্টাখানেক হেঁটে আসেন। সন্ধের পরে দুই পেগ হুইস্কি খান ইংরেজি উপন্যাস পড়তে পড়তে। আর দশটা বছর কাটালেই সেঞ্চুরি করবেন। দাদা হাসেন, ‘রেকর্ড দ্যাখো, বাঙালি নব্বই-এর ঘরে খুব নড়বড়ে। পঙ্কজ রায় নিরানব্বইতে আউট হয়ে গিয়েছিলেন ক্রিকেটে।’
এই দাদা আমায় বললেন, ‘তুমি বললে ডাক্তার বললেই তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে বাড়ির লোকজন! কি বাজে বকো!’
‘কেন দাদা?’
আজকাল কোন শিক্ষিত সচ্ছল পরিবারের মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে যায়? আমাকে দেখাও তো?’ দাদা গম্ভীর।
ভাবতে চেষ্টা করলাম। হাসপাতালে অসুস্থ বন্ধু বা আত্মীয়কে দেখতে গিয়েছি কবে? অন্তত তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে। এখন অসুস্থ হলেই নিয়ে যাওয়া হয় নার্সিংহোমে। হেলথ ইন্সিওরেন্সের দৌলতে অনেকটাই ফেরত পাওয়া যায়। তাছাড়া এখন হাসপাতাল মানেই প্রায় মাছের বাজার। এক বন্ধু স্ত্রীকে নামজাদা হাসপাতালে ভর্তি করতে বাধ্য হয়েছিলেন মাঝরাতে। বাড়ির সামনেই সেই হাসপাতাল। পরদিন সকালে টুথপেস্ট, সাবান থেকে ছারপোকা মারার ওষুধ কিনে দিতে হয়েছিল। নার্স বলেছিলেন, ‘কী করব! এখানকার ছারপোকারা আমাদের দেওয়া ওষুধে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। ওষুধ বদলাচ্ছে না বলে রাত্রে বেরিয়ে আসছে। আপনাদের আনা ওষুধে কিছুদিন কাজ হবে।’ বিছানা থেকে খাবার এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে, সেবার চেয়ে চোখ রাঙানো এত জোরালো হয়েছে যে ভর্তি হওয়ার পরের দিনই পেশেন্ট বাড়িতে ফিরে যেতে পারলে বেঁচে যায়। কিন্তু গরিব মানুষদের তো হাসপাতাল ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। দালালদের ধরে একটু চিকিৎসার সুযোগ পেলে বাকি অসুবিধেগুলোকে ভুলে যেতে চায় তারা।
কিন্তু হাসপাতাল বললে কি আমরা শুধু এইসব সরকারি হাসপাতালের কথা ভাবি? অন্যমনস্কভাবে নার্সিংহোম থেকে ঝাঁ চকচকে ধনবানদের চিকিৎসাকেন্দ্রকেও কি হাসপাতাল ভেবে ফেলি না? একটা নার্সিংহোমের ভাবনা যখন ক্রমশ বৃহৎ হয়ে যায়, চিকিৎসার যাবতীয় সুবিধে যখন ওর চৌহদ্দিতে পাওয়া যায় তখন তার চেহারা তো হাসপাতালের চেহারা নিয়ে নেয়। তবে এগুলোকে বিত্তবানদের হাসপাতাল বলা ঠিক হবে। মধ্যবিত্তরা ইন্সিওরেন্স কোম্পানির সাহায্যে যেখানে চিকিৎসিত হতে পারেন।
দাদাকে বললাম। তিনি মাথা নাড়লেন, ‘এটা মন্দ বলোনি। আমি তো তৈরি হয়ে আছি।’
‘মানে?’
‘ধরো, বাথরুমে গিয়ে পড়ে গেলাম। বেশিরভাগ মানুষ ওখানেই পড়ে। ভাইপোরা আওয়াজ শুনে ছুটে আসবে। আজকাল বাথরুমে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে রাখি যাতে ওদের ভাঙতে না হয়। তারপর আমার অবস্থা দেখে ওরা খুব ঘাবড়ে যাবে। এই ঘাবড়ে গিয়ে যাতে উল্টোপাল্টা কাজ না করে তাই আমি শোওয়ার ঘরে কী করতে হবে লিখে রেখেছি।’ দাদা বললেন।
‘কী লিখেছেন?’ জিজ্ঞাসা করলাম।
দাদা বললেন, ‘আমি মেঝেতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেছি অথবা বিছানায় কাতরাচ্ছি দেখলে কেউ যেন নার্ভাস হয়ে ট্যাক্সি ডাকতে না যায়। এমন কী ড্রাইভার থাকলে বাড়ির গাড়িও বের না করে। কাছাকাছি অ্যাম্বুল্যান্স পাওয়া যাবে এমন দু’টো ফোন নাম্বার বড় করে লিখে রেখেছি। ফোন করা মাত্র মিনিট আটেকের মধ্যে অ্যাম্বুল্যান্স চলে আসবে। আমাকে স্ট্রেচারে নামিয়ে তার ভেতর শুইয়ে নার্সিংহোমে নিয়ে যাবে। এই অ্যাম্বুল্যান্সগুলোতে অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকে। দরকার হলে দেবে আমাকে। এটা এক নম্বর।
দুই নম্বর হল, অ্যাম্বুল্যান্সকে ফোন করার পরেই যে দু’জন ডাক্তারের ওপর আমার ভরসা আছে তাঁদের ফোন করে ঘটনাটা জানালে তিনি বলে দেবেন কোন নার্সিংহোমে আমাকে নিয়ে যেতে হবে। প্রথমজনকে পেয়ে গেলে দ্বিতীয়জনকে তখনই ফোন করার দরকার নেই। অ্যাম্বুল্যান্স এলে ডাক্তারের নির্দেশমতো নার্সিংহোমের নাম ড্রাইভারকে জানাতে হবে। ডাক্তারদের ফোন নাম্বার, তিনটি নার্সিংহোমের ফোন নাম্বার (যার একটায় ডাক্তার নিয়ে যেতে বলবেন) লিখে রেখে দিয়েছি।
তিন নম্বর, ডাক্তার নার্সিংহোমের নাম বললেই সেখানে ফোন করে জানাতে হবে এখনই অ্যাম্বুল্যান্স আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, তাঁরা যেন তৈরি থাকেন। এর ফলে বাড়ির লোক আতান্তরে পড়বে না, সময় নষ্ট হবে না।’
বললাম, ‘বাঃ। ভাল ভেবেছেন তো।’
‘আরও আছে।’ দাদা বললেন, ‘বাঙালিদের অভ্যাস হল দল বেঁধে পেশেন্টকে দেখতে যাওয়ার নাম করে বেড়িয়ে আসা। আমাকে দেখতে যেন দু’জনের বেশি কেউ না যায়। দশ বারোটা মুখে কেমন আছেন, শরীর ভাল লাগছে? শোনা অত্যন্ত বিরক্তিকর।’
‘আমার হেলথ ইন্সিওরেন্স রিনিউ করা আছে। তার সমস্ত কাগজপত্র একটা খামে ভরে টেবিলের ওপর রেখেছি। আমি চলে গেলে ভাইপো সব পাবে। তাই ইন্সিওরেন্স কোম্পানি যে খরচ দেবে না সেই খরচ ভাইপো দিয়ে দেবে। পরে আমার অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়ে নেবে। ব্যস।’ দাদা হাসলেন।
মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘বাঃ।’
‘না হে। এখনও বাকি আছে। ডাক্তার জানেন আমি দেহদান করে রেখেছি। সেই সঙ্গে চক্ষুদানও। চলে যাওয়ামাত্র সেই দানগুলো যাতে সঠিক জায়গায় যায় তার ব্যবস্থা তিনি আশাকরি করবেন। আমি থাকব না। কিন্তু আমার চোখ দু’টো দিয়ে অন্য মানুষ পৃথিবীটা দেখতে পাবে।’ দাদা বললেন।
এই বয়সেও নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে পেরেছেন এই প্রায়-নববুইতে পৌঁছে যাওয়া মানুষটি। শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। চলে আসার সময় দাদা বললেন, ‘ওহো, যেহেতু দেহদান করেছি, শেষ কাজ করাতে ভাইপো শ্মশানে নিয়ে যেতে পারবে না তাই শ্রাদ্ধের খরচটা বেঁচে যাবে। সারাজীবন ধর্মাচরণ করলাম না, অথচ শ্রাদ্ধের নামে অংবং বললেই স্বর্গে চলে যাব, এই থিওরিতে আমি বিশ্বাস করি না। শরীরটাকে ওরা ইলেকট্রিক চুল্লিতেও ঢোকাতে পারবে না। হবু ডাক্তাররা এই শরীরটা থেকে শিক্ষা নেবে।’
‘আপনি এটাও ভেবে রেখেছেন?’
হো হো শব্দে হাসলেন দাদা, ‘সামান্য ইলেকট্রিক শক লাগলে যন্ত্রণা সহ্য করতে পারি না, গোটা দেহটা ইলেকট্রিকে পোড়া থেকে তো বেঁচে যাবে।’
দাদা হয়তো মজা করলেন। ওঁর সব কথার সঙ্গে আমি নিশ্চয়ই একমত নই। কিন্তু একটা বয়সে পৌঁছে যাওয়ার পরে এইরকম গোছগাছ করে রাখা যে খুব জরুরি তাতে কোনও সন্দেহ থাকল না।
২৪
তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। এক বিকেলে আমাদের সহপাঠী অমল বলল, ‘কাল দুপুরে আমাদের বাড়িতে খুব খাওয়াদাওয়া হবে।’ কোনও বন্ধুর বাড়িতে খুব খাওয়াদাওয়া হবে শুনলে মন মিইয়ে যেত। বাড়িতে বিধবা বড় পিসিমার রান্না যতই ভাল হোক, খেয়ে-খেয়ে একঘেয়ে লাগত। সেই ডাল-ভাজা-তরকারি আর নদীর ছোটমাছের পাতলা ঝোল। নৃপেন থাকত হস্টেলে। সেখানকার খাবার আরও খারাপ। সব সময় খিদে-খিদে করত। নৃপেন জিজ্ঞাসা করল, ‘কী-কী হবে রে?’
‘মাছের মাথা দিয়ে ডাল, দু’রকমের ভাজা, পটলের দোলমা, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, কাতলার পেটির ঝাল আর কচি পাঁঠার মাংস।’
কানে যাওয়ামাত্র বুকের ভিতর থম ধরল। নিজেকে বঞ্চিত বলে মনে হচ্ছিল। ওসব খাবার কত দিন খাইনি! বিশেষ করে চিংড়ির মালাইকারি। নৃপেন বলল, ‘এসব অন্যায়!’
অমল অবাক হল, ‘কেন বললি?’
‘তুই যখন ওগুলো চিবিয়ে গলা দিয়ে নামাবি তখন আমাদের কথা মনে না-পড়াটা অন্যায় নয়? আমি তখন পাতলা ডাল আলুসেদ্ধ আর ব্লেডে কাটা পোনামাছের ঝোল খাব!’
তপন জিজ্ঞাসা করল, ‘বাড়িতে আর কেউ কি খেতে আসবে?’
অমল মাথা নাড়ল, ”হ্যাঁ, শুনলাম ন’জন খেতে আসবেন।’
নৃপেন বলল, ‘নয়কে বারো করে দে। আমাদেরও খেতে বল। কথা দিচ্ছি, তোর জন্য যা করতে বলবি তাই করব।’
অমল একটু চিন্তা করল। তপন বলল, ”খামোকা ভাবছিস! ন’জন গেস্ট, তোদের বাড়ির ছয়-সাতজন, মানে পনেরো-ষোলো জনের জন্যে যে আয়োজন হচ্ছে তাতে আমাদেরটা দিব্যি হয়ে যাবে। মা বলেন, তিনজনের জন্য রাঁধলে তা চারজনের দিব্যি হয়ে যায়।’
এবার অমল হাসল, “তা হলে তোরা সাড়ে বারোটা-একটার মধ্যে চলে আসিস।”
পরের দিন রবিবার। নেমন্তন্ন আছে বলে স্নান সেরে সেজেগুজে গেলাম অমলের বাড়িতে। গিয়ে দেখি বেশ উৎসব-উৎসব চেহারা। বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা। মহিলারা সেজেগুজে হাসাহাসি করছে। আমাদের দেখে অবাক হলেন তাঁরা। অমল আমাদের নিয়ে দোতলায় একটা ঘরে বসিয়ে বলল, ‘এই ঘর থেকে বেরুবি না। কাজের লোক এখানেই তোদের খাবার দিয়ে যাবে। অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি।’
অমল ব্যস্ত হয়ে চলে গেলে তপন বলল, ‘মাসিমাকে তো আগেও দেখেছি। আমাদের খাওয়াতে অমলকে ওঁকে রাজি করাতে হয়েছে কষ্ট করে? আমি বিশ্বাস করি না। অমল গুল মেরেছে।’
তিনজন বসেই আছি। একসময় কাজের লোক খাবার নিয়ে এল। অমল যা-যা বলেছিল সেইসব পদ। কিন্তু হাত বাড়ানোর আগেই মেয়েলি গলায় হাসির শব্দ কানে এল। দু’টি অল্পবয়সি মেয়ে আমাদের দেখে হেসে গড়িয়ে পড়তে-পড়তে সামলে নিয়ে চলে গেল দরজা থেকে। নৃপেন জিজ্ঞাসা করল, ‘হাসছে কেন রে?’ উত্তর জানা নেই। সবে ডাল শেষ করেছি অমনি হাসির আওয়াজ। এবার আরও একটু বেশি বয়সের তিন মহিলা। আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসির শব্দ করে সরে গেলেন। ধারেকাছে অমল নেই যে তাকে হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করব। কানে এল এক বয়স্কার গলা, ‘কোথায়, কোন ঘরে?’ তারপর দেখলাম তিনজন বয়স্কা মহিলা দরজায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছেন। একদম গুটিয়ে গেলাম আমি। দেখলাম বন্ধুরাও পাথরের মতো বসে আছে। তিন বয়স্কা সরে গেলে তপন মাথা নাড়ল, ‘এভাবে খাওয়া যায় না।’
নৃপেন বলল, ‘চটপট হাত চালা। বড় বাগদা চিংড়ি, ছাড়া যায় না।’
আমরা যখন দ্রুত খাওয়া শেষ করতে চাইছি, তখনও মেয়েদের হাসি কানে আসছিল। খাওয়া যখন শেষ, তখন অমল ঘরে ঢুকে বলল, ‘ওই দিকের কলে জল আছে, তোরা হাত-মুখ ধুয়ে নে।’
নৃপেন হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করলে অমল বলল, ‘কারণটা আগে জানলে কি তোদের আসতে বলতাম? এই নেমন্তন্ন মেয়েদের করা হয়েছে। মা তাই তোদের ডাকতে রাজি হয়নি। আমি অনেক বলায় নিমরাজি হয়েছিল। আজ আমার বড় বউদি সাধ ভক্ষণ করবে। তোরা সেই সাধের খাওয়া খেয়ে গেলি। ছেলে হয়েও। তাই সবাই হাসাহাসি করছে।’
মুখ নিচু করে প্রায় দৌড়েই চলে এসেছিলাম অমলের বাড়ি থেকে।
আসন্নপ্রসবা মহিলাকে তাঁর সাধ মিটিয়ে খাওয়ানোর যে-অনুষ্ঠান এদেশে চালু ছিল তা এখনও বন্ধ হয়নি। কেন যিনি মা হতে যাচ্ছেন তাঁর সাধ মেটাতে হবে? বড় পিসিমাকে প্রশ্ন করে শুনেছিলাম, ‘যদি বাচ্চা হওয়ার সময় মা-র মৃত্যু হয় তাই তাঁর সাধ পূর্ণ করার জন্যই ওই ব্যবস্থা।’ শুনে আঁতকে উঠেছিলাম। মহিলা ওই দিন খাবার খাবেন আর ভাববেন যদি ক’দিন পরে না-বেঁচে থাকি তাই পেট ভরে খেয়ে নিই! যাঁরা খাওয়াচ্ছেন তাঁদের মনে কোনও প্রতিক্রিয়া কখনও হয়নি? এই নিষ্ঠুর লোকাচার বছরের-পর-বছর ধরে আমাদের সংসারে যাপিত হয়ে এসেছে, কোনও মহিলা কি প্রতিবাদ করেননি? করলেও আমার জানা নেই। এখনও আমার মনে প্রশ্ন জাগে। রামমোহন সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। বাবার মুখাগ্নি করতে এসে মা’কে সেই চিতায় জ্বলেপুড়ে মরতে দেখেছে ছেলে। জীবিত মানুষের মুখাগ্নি করা যায় না। কিন্তু সর্বাঙ্গ পোড়ানো যায়! আচ্ছা, ওই মৃত্যু তো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, তা হলে কি তিনদিনে মহিলার শ্রাদ্ধ হত? না কি ওই বলিদানকেই শ্রাদ্ধ ভেবে নিয়ে তাঁর শ্রাদ্ধই করা হত না! আন্দাজ করতে পারি স্বামী ভদ্রলোকের বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে করা হত। ব্যক্তিগতভাবে আমি শ্রাদ্ধ নিয়ে যা ভাবি তা আলাদা কথা, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ যখন শ্রাদ্ধকে গুরুত্ব দেন, তখন তাঁদের পূর্বসূরিরা কি সেই সহমরণে যেতে বাধ্য হওয়া মহিলার আত্মার শান্তি কামনা করে শ্রাদ্ধ করতেন?
এখন বেশির ভাগ পরিবার ভেঙে গিয়েছে। বিয়ের পরে নানা কারণে আলাদা থাকতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক দম্পতি। স্বামী-স্ত্রী ভাল চাকরি করে, সুন্দর ফ্ল্যাট, কাজের লোক না-এলে হোম ডেলিভারির খাওয়া, বেশ চলছিল। এইরকম একটি দম্পতি, যাঁরা আমার খুব ঘনিষ্ঠ, সমস্যায় পড়লেন। ছেলেটি ফোন করে দেখা করতে এলেন, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী। বুঝলাম, তিনি সন্তানসম্ভবা। ছেলেটি বললেন, ‘আমরা আলাদা থাকি বটে কিন্তু মা-মাসিদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। ওঁরা ওকে সাধ খাওয়াতে চাইছেন কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। কী করি বলুন তো!’ মেয়েটি বললেন, ‘ওঁরা আনন্দ পেতে চাইছেন। আমাকে জন্মের সাধ খাইয়ে পুণ্য অর্জন করবেন। আজকের দিনে বাচ্চা হতে গিয়ে ক’টা মা মারা যায় বলুন? আর যদিও কেউ মারাও যায় তা হলে তাকে সাধ খাওয়াতে হবে? কার সাধ? আমার না ওদের? ও যদি আরও চাপ দেয় তা হলে আমি একা থেকে মা হতে রাজি আছি!’
কৈশোরের সেই হাসিগুলির কথা মনে এল। এত দিনে মেয়েরা যা স্বাভাবিক তা-ই বলতে পারছে।
২৫
প্রথম একজন লেখককে দেখি, যখন আমি জলপাইগুড়ির জেলা স্কুলের ছয় কি সাত ক্লাসের ছাত্র। তার আগে যাঁকে সহপাঠী ‘ল্যাডলির দাদা’ বলে জানতাম তিনি না কি তরুণ লেখক হিসাবে বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন! আমাদের স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র দেবেশ রায় তখন কলকাতার কাগজে একটার-পর-একটা ছোটগল্পের গোলাবর্ষণ করে চলেছেন। মাস্টারমশাই সুধাময়বাবু বলেছিলেন, অমিয়ভূষণ মজুমদারের পর জলপাইগুড়ি থেকে আর একজন লেখক বাংলা সাহিত্যে জায়গা দখল করে নিচ্ছেন। এর কয়েক বছর পরেই দেবেশদার সঙ্গে মতবিরোধ হল সবচেয়ে প্রচারিত দৈনিকের পাতায় এবং তিনি ঘোষণা করলেন ওই কাগজে আর লিখবেন না। দেবেশদা হয়ে গেলেন ‘পরিচয়’ পত্রিকার লেখক। ধীরে-ধীরে তাঁর খ্যাতিতে ধুলো পড়ল। তিনি স্বমহিমায় ফিরে এলেন ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ লিখে। মাঝখানের সময়টায় তাঁকে তেমন করে না-পাওয়ায় পাঠক বঞ্চিত হয়েছে।
দেবেশদার সৌজন্যে আমি দ্বিতীয় যে-লেখকের সামনে যেতে পেরেছিলাম তিনি সমরেশ বসু। সমরেশদা দেবেশদার বাড়িতে জলপাইগুড়িতে গেলেই উঠতেন। কথা বলেছিলাম কিন্তু ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাইনি।
কলকাতায় এসে স্কটিশে যখন পড়ছি, তখন ‘লেখালেখির ভূত’ মাথায় চাপেনি। এম.এ পড়ার সময় তৃতীয় যে-লেখকের স্নেহ পেলাম তিনি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। আমাদের মাস্টারমশাই নারায়ণবাবু তখন ছোটগল্পে তো বটেই, উপন্যাস এবং ‘সুনন্দর জার্নাল’-এর মতো ফিচার লিখে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। আমি তাঁর শ্বশুরবাড়ি জলপাইগুড়ির ছেলে বলে সব আবদার মেনে নিতেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরেও তাঁর সাহায্য পেয়েছি। কিন্তু হঠাৎই চলে গেলেন তিনি। তাঁর শেষযাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলাম। কিন্তু তখন তো জানতাম না মৃত্যু তাঁর শরীরকে যেমন গ্রাস করেছিল, তেমনই তাঁর সৃষ্টিগুলোকেও নবীন পাঠকের কাছ থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। একজন শক্তিশালী লেখকের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর সৃষ্টি পাঠক হারায়, এই অভিজ্ঞতা আমার আগে ছিল না।
কফিহাউসে সুনীলদা-শক্তিদার সঙ্গে পরিচয় হল। কিন্তু ওঁদের উদ্দাম জীবনযাত্রার সঙ্গে পা মেলাতে পারিনি। বরং বিমল কর আমাকে টানতেন খুব। ‘দেশ’ পত্রিকায় লেখার সুযোগ পেয়ে বিমলদার সঙ্গে আলাপ। দেখতাম, নিজে একটা গণ্ডি তৈরি করে তার মধ্যে থাকতেই পছন্দ করেন। অপরিচিত পরিবেশে যেতে চান না। বহিরঙ্গের জীবন তাঁকে আকর্ষণ করে না, মনের নিভৃত ভাঁজগুলি লেখায় তুলে ধরতেই খুশি হন। নিজেই একটা আড্ডা বানিয়েছিলেন তরুণ লেখকদের নিয়ে। আকাদেমি পুরস্কার আনতে দিল্লি যেতে হবে বলে যেতে চাইছিলেন না, আমাকে সঙ্গী হতে হয়েছিল। সত্তরের ঘরে পা দিয়ে চুপচাপ চলে গেলেন। ‘বালিকা বধূ’, ‘অসময়’-এর লেখককে ক’জন এখন মনে রেখেছেন? অবশ্য বিমলদা ছিলেন লেখকদের লেখক। সেই অর্থে জনপ্রিয় ছিলেন না। কোনও-কোনও লেখা যখন হইচই ফেলত, তখন তিনি যেন সংকোচে পড়তেন।
ঠিক কাছাকাছি ঘরানার মানুষ রমাপদ চৌধুরী। প্রথম দিকে তিনি আমাকে পছন্দ করতেন না। পরে যখন ঘনিষ্ঠ হলাম, তখন প্রশ্ন করেও জবাব পাইনি। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, আমি তাঁর বৃত্তের মানুষ নই। এখনও, এই নব্বইয়ের কোঠায় এসেও, তিনি বেশ ঝলমলে। বহু বছর আগে কলম বন্ধ করেছিলেন এই বলে যে তাঁর আর লেখার কিছু নেই। আজ পর্যন্ত কোনও লেখক জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা অবস্থায় লেখা বন্ধ করেননি। অনুযোগ করলে বলতেন ‘আপনারা লিখুন’। লেখা বন্ধ করার পরেও দেখা গেল তাঁর উপন্যাস এবং গল্পসমগ্রের বিক্রি কমেনি।
কী করে সমরেশ বসুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলাম, তা এখানে বলতে গেলে জায়গা পাওয়া যাবে না। আমার দেখা অত্যন্ত সুন্দর পুরুষদের মধ্যে তিনি একজন। আমার প্রিয় লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। অথচ কথা বলতে গিয়ে জেনেছি, প্রচুর পড়াশোনা করেছেন তিনি। ‘বিবর’ লেখার আগে ‘বি টি রোডের ধারে’, ‘শ্রীমতী কাফে’ থেকেই তিনি বাঙালির প্রিয় লেখক। ‘বিবর’ তাঁকে অসম্ভব জনপ্রিয়তা দিল। বিবর-প্রজাপতি-পাতক পড়ে কেউ প্রশংসা করল, নিন্দাও কম জোটেনি। ‘কালকূট’ ছদ্মনামের লেখাগুলি বাঙালির বড় আদরের। ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’ বা ‘কোথায় পাব তারে’—কোনটা সেরা এই নিয়ে তর্ক হয়েছে প্রচুর। হঠাৎ আমাকে ডেকে অনেক তথ্য দিয়ে বললেন, ‘আমি পারছি না, হচ্ছে না। তুমি লেখ তো!’ এই সমরেশদা হুট করে চলে গেলেন মধ্য-ষাটে। আশ্চর্যের ব্যাপার পরের বইমেলায় গিয়ে শুনলাম ওঁর বইয়ের তেমন পাঠক নেই। বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছ’জন ঔপন্যাসিক হলেন : বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশংকর, বিভূতিভূষণ এবং সমরেশ বসু। ওঁর মতো শক্তিমান লেখক খুব কম সাহিত্যেই পাওয়া যায়। বাক্যগঠন এবং শব্দ নিয়ে পরীক্ষা করেছেন—কিন্তু পাঠককে পীড়িত করেনি। এই লেখকের বইয়ের বিক্রি তাঁর জীবিতকালে যা হত, তা মৃত্যুর পরে থাকবে না কেন? বড় জটিল প্রশ্ন, উত্তর আমার অজানা।
সন্তোষকুমার ঘোষ ছিলেন আমার কাছে একটি জীবিত এনসাইক্লোপিডিয়া। অথবা এখন বেঁচে থাকলে বলতাম, গুগল। ছোটখাটো মানুষটি সাংবাদিকতার জন্য তাঁর সাহিত্যের কলমটি প্রায় তুলে রেখেছিলেন। শ্রীচরণেষু মা’কে-র লেখককে বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দেখেছি। তীব্র অভিমানে ভুগতেন। দারুণ-দারুণ ছোটগল্প লিখেছেন যিনি, ‘কিনু গোয়ালার গলি’-র মতো উপন্যাস বেরিয়েছে যাঁর কলমে—তাঁর কাছে আমি সাহিত্যের পাঠ নিতাম। লিখতে-লিখতে কোথাও আটকে গিয়েছি, সমস্যায় জিজ্ঞাসা করেছি উত্তর, সঙ্গে-সঙ্গে তিনি জানিয়ে ফোন রেখে দিয়েছেন। সন্তোষদাও চলে গেলেন মধ্য-ষাটে।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর মতো শক্তিশালী লেখক আজীবন দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে গিয়েছেন। অথচ ওঁর অতি ছোট্ট ফ্ল্যাট গিয়ে যখন কথা বলেছি, তখন তিনি অনর্গল জীবনের কথা বলে গিয়েছেন, নিজের কষ্টের গল্প শোনাননি। ‘বারো ঘর এক উঠোন’-এর লেখকের রচনা নিয়ে আজকের পাঠক কেন এত নিস্পৃহ তা তাঁরাই জানেন! জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীও চলে গিয়েছেন চুপচাপ।
সেই ছাত্রাবস্থায় ‘পূর্বপার্বতী’ পড়েছিলাম। পরে জেনেছিলাম ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত সেই উপন্যাসের লেখকের বয়স ছিল মাত্র সতেরো। প্রফুল্ল রায়ের সঙ্গে যখন পরিচয় হল, তখন মনে হয়েছিল বহুকাল ধরেই তিনি আমাকে চেনেন। তাঁর নোনাজল, মিঠেমাটি বা সমুদ্র ও আন্দামানের পটভূমিকায় লেখা উপন্যাস পড়ে মনেই হত না কোনও বাঙালি ঔপন্যাসিকের লেখা পড়ছি! অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছেন প্রফুল্লদা। এখনও তিনি সমান দক্ষতায় লিখে চলেছেন। বইয়ের বিক্রি প্রমাণ করে তাঁর পাঠকের সংখ্যা অজস্র।
বুদ্ধদেব গুহ আমাকে চেনেন যখন আমি একটি সরকারি চাকরি করি, তখন থেকে। ওঁর লেখায় রোমান্টিক ঘরানা থাকায় পাঠকরা মুগ্ধ হয়েছেন বারে-বারে। সেই ‘কোয়েলের কাছে’ লিখেই তিনি প্রথম সারিতে চলে আসেন। স্বাস্থ্য তাঁকে এখন স্তিমিত করেছে। তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন, প্রার্থনা করছি।
শীর্ষেন্দুদা আমার নর্থবেঙ্গলতুতো দাদা। আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। সমসাময়িক সমস্ত লেখকের লেখার সঙ্গে তাঁর লেখার কোনও মিল নেই। খুব গভীরে না-পৌঁছলে তিনি স্বস্তি পান না। সেই ‘ঘুণপোকা’ থেকে তাঁর উপন্যাস ‘দূরবীন’, ‘পারাপার’ হয়ে বাঙালির মন জয় করে স্থির হয়ে আছে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় দীর্ঘজীবী হবেন এবং তাঁর লেখা বাঙালি পাঠক দু’হাত ভরে পেয়ে যাবে।
সুনীলদা চলে গেলেন। গেলেন পরিণত বয়সেই। জীবনটাকে নানাভাবে পরীক্ষা করেছেন, যা রক্ষণশীলদের চোখে সব সময় নিয়মসিদ্ধ নয়। কিন্তু তার প্রতিফলন পড়েছে রচনায়, আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি। তিনি ছিলেন সব্যসাচী। তাঁর কবিতা এবং গদ্য পাশাপাশি একটার-পর-একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। যে বিস্ফোরণ শুধু হৃদয় অনুভব করে। সুনীলদা যা কখনও চাননি, তাই হল। মৃত্যুর পরে কাতর মানুষরা তাঁর শবদেহের কাছে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এল। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সুনীলদার শেষযাত্রাকে সরকারি সম্মান জানানো হল।
আর কোনও লেখক সম্ভবত এটা পাননি। সুনীলদা যা চাননি তাই পেলেন!
২৬
একজন লেখকের লেখায় যখন সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়, চিরাচরিত অভ্যেসগুলোর মধ্যে যে-গলদ রয়েছে তা তুলে ধরা হয়—তখন তা পাঠকদের কতখানি প্রভাবিত করে? ইবসেন সাহেব ‘ডলস হাউস’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন, সহ্য করতে-করতে শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়ানো মহিলার প্রতিবাদের নাটক। নোরা বেরিয়ে এসেছিল মাথা উঁচু করে। এই প্রতিবাদ উদ্বুদ্ধ করেছিল নরওয়ে এবং ইউরোপের নির্যাতিতা মহিলাদের। প্রতিবাদী মহিলারা নিজেকে নোরা মনে করতে পছন্দ করতেন। সেই নাটক যখন বাংলায় হল, প্রবাদপ্রতিম নাট্য পরিচালক অভিনেতা শম্ভু মিত্র আর এক অনন্যা অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে বাংলায় করলেন—তখন আমরা শুধু মুগ্ধ হয়ে তাঁদের অভিনয় দেখলাম। ‘পুতুল খেলা’ নাটকটি দেখে বাঙালি মেয়েরা তাঁদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস পেয়েছে এমন কথা তো কারও মুখে শুনিনি। দুই দেশে দু’রকম প্রতিক্রিয়া হবে কেন যখন ইস্যুটা এক? তবে কি বাঙালি পাঠক এবং দর্শক শুধু গল্পের রসে ডুবে থাকতে চান, তার বেশি মাথা ঘামান না?
তাই-বা ভাবি কী করে? আমি বা আমার বয়সি মানুষ কৈশোরে সুকান্ত ভট্টচার্যর কবিতা পড়ে মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। বিশেষ করে ‘ছাড়পত্র’ কবিতাটি আবৃত্তি করার সময় আমাদের অনেকেরই রক্ত গরম হয়ে যেত। এই বিশ্বকে এই শিশুর বাসযোগ্য করার অঙ্গীকার করেছি সে-সময়। পারিনি, হয়তো পারার চেষ্টাও করিনি। সে-সময় মনে হত সুকান্ত আমাদের বাসনার কথা লিখে গিয়েছেন। তখন সুকান্তকে সবচেয়ে প্রিয় কবি বলে মনে হত। পরে ভাবনা বদলেছে। সেটা অন্য কথা।
কিন্তু জনপ্রিয় লেখকরা, যাঁদের অজস্র পাঠক আছেন, যাঁরা লিখলেই সেসব পাঠক বই সংগ্রহ করেন, তাঁরা কেন উদ্বুদ্ধ হবেন না? হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। স্ট্যাটিস্টিক বলছে, দুই বাংলায় যত লেখক লিখেছেন, কুড়ি বছরের সময়সীমায় হুমায়ুনের মতো বিপুল জনপ্রিয়তা কেউ পাননি। একবার ঢাকার ‘একুশে বইমেলা’-য় গিয়ে দেখলাম বিশাল লাইন পড়েছে। আমাদের দেশে যখন কেরোসিন দুষ্প্রাপ্য ছিল, তখন তা পাওয়ার জন্য যে-লাইন পড়ত তার চেয়ে অনেক লম্বা লাইন। জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওই লাইনে হুমায়ুনের বই কিনে পাঠকরা দাঁড়িয়েছেন তাঁর অটোগ্রাফ করিয়ে নেবেন বলে। দূর থেকে দেখলাম হুমায়ুন মুখ নিচু করে একটা চেয়ারে বসে একের-পর-এক সই করে যাচ্ছে। এমনকী, আমি যখন তার একটি বই এগিয়ে দিলাম, সে আমাকে না-দেখে সই করে দিল, ‘শুভেচ্ছা-সহ হুমায়ুন আহমেদ।’ তারপর, তারিখ। কেউ একজন তাকে ব্যাপারটা জানানোয় সে খুব লজ্জা পেয়ে বার-বার ক্ষমা চেয়েছিল। ওইরকম জনপ্রিয় লেখক অনায়াসেই পাঠকদের উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন। হুমায়ুনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম দু’টো প্রশ্ন, এক) তোমার লেখায় সমসাময়িক ঘটনা বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থাকে না কেন? দুই) সামাজিক অবক্ষয় অথবা ধর্মের দোহাই দিয়ে যেসব বুজরুকি করা হয়, তোমার লেখায় তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নেই কেন?
হুমায়ুন জবাব দিয়েছিল, ‘আমাদের দেশে রাজনীতি নিয়ে সত্যি কথা বললে বিপদ অনিবার্য। সরকার অথবা বিরোধীরা কোনও সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। পাঁচ বছর পরপর সাধারণত সরকার বদলায় এদেশে। আমার নায়ক সত্যি কথা বললে ওরা আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে আমি নিশ্চয়ই লিখছি, কিন্তু ধর্মের নামে যেসব বুজরুকি হয় তা লিখে কোনও লাভ হবে না বলেই লিখি না। আপনাদের দেশে রাজনীতি নিয়ে যা ভাবেন তা লিখতে পারেন? সেই স্বাধীনতা আপনাদের আছে? পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট যখন প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করছে, তখন আপনি ‘কালবেলা’ উপন্যাসে সিপিএমের কড়া সমালোচনা করেছিলেন। অথচ তার জন্য আপনাকে ওরা জেলে ঢোকায়নি। এখানে আমি ওরকম লিখলে আর দেখতে হত না। আমার পাঠক ধর্মের ব্যাপারে বিশ্বাস করেন, আস্থা রাখেন ধর্মগুরুদের উপর। তাঁরা যা বলেন তার বিরোধিতা করার কথা চিন্তা করেন না। আমি যদি প্রতিবাদী-কথা লিখি তা হলে তাঁরা উপেক্ষা করবেন। হয়তো আমার লেখা বর্জন করতে বলা হবে।’
হুমায়ুনের মতো জনপ্রিয় লেখক একান্তে কথাগুলো বলেছিল আমাকে। কিন্তু ওর মধ্যে একটি প্রতিবাদী চরিত্র ছিল। সেই প্রতিবাদ সে করেছে সামাজিক ত্রুটি-বিচ্যুতির ব্যাপারে। তার এবং সমসাময়িক কিছুটা জনপ্রিয় লেখকদের উপন্যাসের নায়ক কখনও মিছিলে হাঁটে না, বনানী থেকে শাহবাগ যদি কেউ যায় তখন কার শাসনকাল তা বোঝা যায় না। কিন্তু কয়েকজন লেখক, যাঁদের সংখ্যা খুবই কম, যেমন হুমায়ুন আজাদ, তাঁদের রচনায় রাজনীতি অথবা ধর্মের বিচ্যুতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। আক্ষেপের বিষয়, এঁরা কেউ জনপ্রিয়তা পাননি, পেয়েছেন বুদ্ধিমান শিক্ষিত পাঠকের কাছ থেকে সমীহ।
লক্ষ করবেন, আমাদের পশ্চিমবাংলাতেও ক্রমশ একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কোনও অবক্ষয়, কোনও প্রথা যা হাস্যকর, তার বিরুদ্ধে কোনও উপন্যাসে এখানকার লেখকরা কলম ধরছেন না। সমরেশ বসু অথবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে-সাহস দেখিয়েছেন তা দেখানোর তাগিদ এখনকার লেখকদের নেই। সত্যি কথা এই যে, এখন জনপ্রিয় লেখকদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। যাঁরা আছেন তাঁদের বয়স পঁয়ষট্টি থেকে বিরাশির মধ্যে। নিজেদের রাজত্ব ঠিকঠাক রাখার জন্যে কেউ বেঁচে থাকেন সংসারের গল্প লিখে, কেউ স্মৃতি নিয়ে কথা সাজান। যাঁরা আসছেন, যাঁদের বয়স পঁচিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ। তাঁদের দুই-তিনজনকে দেখে আশাবাদী হয়েছি। কিন্তু ওই পর্যন্ত।
আর লিখলেই, ঠিকঠাক লিখলেই কি পাঠকদের মধ্যে আলোড়ন তৈরি হবে? আমরা লেখা শুরুর সময়ে জেনেছিলাম, গল্প-উপন্যাস যেন স্লোগানধর্মী না-হয়। বক্তব্য যদি কিছু থাকে তা হলে তা জড়িয়ে-মিশিয়ে থাকবে কাহিনির সঙ্গে। লেখক যেন জ্ঞান না দেন। তা হলেই পাঠক বই বন্ধ করবে। এই কঠিন কাজটা কেউ-কেউ করতে পারেন।
একটি মেয়ে এল আমার কাছে। সে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছে। দেখতে বেশ সুশ্রী। কিন্তু প্রেম করার অবকাশ এবং পুরুষ পায়নি। তাতে তার আক্ষেপও নেই। তার সমস্যা হল, বাবা-মা সম্বন্ধ করে পাত্র নির্বাচন করেছেন। তাকে সে দেখেছে একবার। ফোনে কথাও হয়েছে। কিন্তু প্রায় অজানা একটি পুরুষের সঙ্গে ফুলশয্যার নামে রাত্রিবাস করার জন্য তার আত্মীয়স্বজন ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করতে বলবে, এটা সে মানতে পারছে না। যে লোকটাকে চেনে না, সে তার শরীরে হাত দিলে মনে হবে শ্লীলতাহানি করছে। এই বর্বর প্রথা বন্ধ করা উচিত। আমি কেন এর বিরুদ্ধে লিখছি না!
পাঠক, এককালে আমরা মেয়েদের স্বামীর সঙ্গে পুড়িয়েছি, বালিকাকে বিয়ে দিয়ে দশ বছরে মা বানিয়েছি। মরে যেতে পারে ভেবে জীবনের সাধ মেটানো খাবার খাইয়ে উল্লসিত হয়েছি। সময় পাল্টে গিয়েছে। আজ সম্বন্ধ-করা বিয়ের ষাট ভাগ আদালতে যাচ্ছে জেনেও অপরিচিত দু’টি মানুষকে একত্রিত করার চেষ্টা করছি। এর বিরুদ্ধে লিখলে পাঠক ধৃতরাষ্ট্র হয়ে থাকবেন।
কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, কালকের মেয়েরাই আমাদের বাধ্য করবে লিখতে।
২৭
এই সেদিনও বাংলা গল্প-উপন্যাসের লেখকদের চলচ্চিত্রের প্রযোজকরা কোনও গুরুত্ব দিতেন না। সাধারণত তাঁরা স্ত্রী বা আত্মীয়ের ভাবা কোনও কাহিনির সারাংশ পরিচালককে দিয়ে বলতেন তার উপর নির্ভর করে চিত্রনাট্য লেখাতে, নয় খুব সফল চিত্রনাট্যকারকে ডেকে বলতেন, ”হিট হবে এমন স্ক্রিপ্ট লিখে দিন।” পাশাপাশি অনেক ছবি হত যা সাহিত্যনির্ভর। শুনে পুলকিত হতাম। বাংলা সাহিত্যের হাজার হাজার গল্প যা মানুষের কথা বলেছে তা সিনেমায় রূপান্তরিত করে প্রযোজকরা ব্যবসা করতে পারতেন। অনেকে করেওছেন। সেইসব কাহিনির লেখকরা কে কী রকম সম্মান পেয়েছেন তা জানার উপায় নেই। মনে আছে, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মশাইকে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি উত্তর না দিয়ে হেসেছিলেন। তবু তিনি কিছু ভাল প্রযোজক পেয়েছিলেন। এ-ব্যাপারে কপাল ভাল ছিল বিমল মিত্র মহাশয়ের। এঁদের প্রচুর গল্প ছবি হয়েছে এবং যেহেতু ছবি চলেছে তাই সম্মান ও সম্মানদক্ষিণা থেকে বঞ্চিত হননি। জীবিত সাহিত্যিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যাঁর গল্প নিয়ে ছবি হয়েছে তাঁর নাম প্রফুল্ল রায়। উনিশশো উনসত্তর সালে তাঁর গল্প নিয়ে ‘এখানে পিঞ্জর’ ছবিটি হয়। তিনি সম্মানদক্ষিণা পান ছয় হাজার টাকা। প্রফুল্লদার ভাষায়, ‘খুব খারাপ নয়, কি বল?’ ওঁর গল্প নিয়ে শেষ ছবি হয়েছে গত বছর, সম্মানদক্ষিণা পেয়েছেন সাত হাজার টাকা। অর্থাৎ চুয়াল্লিশ বছরে ওঁর ইনক্রিমেন্ট হয়েছে এক হাজার টাকা। যদি পরিচালক মেইন স্ট্রিমের ছবি না বানান তাহলেও সবাইকে তিনি টাকা দিতে বাধ্য হন শুধু লেখক আর অভিনেতাদের কাছে গিয়ে সহযোগিতা চান। প্রফুল্লদা বললেন, “আমি তপনদার কাছে ভাল টাকা এবং সম্মান পেয়েছি। তিনি একটি গল্পের জন্য সবচেয়ে বেশি টাকা যে প্রযোজকদের কাছ থেকে পেয়েছেন তার পরিমাণ হল সত্তর হাজার টাকা। একজন নায়ক যখন বিশ ত্রিশ বা পঞ্চাশ লক্ষ টাকা একটি ছবির জন্যে নিয়ে থাকেন, একজন সাধারণ অভিনেতা যেখানে এক লক্ষ টাকা পারিশ্রমিক পান সেখানে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম লেখককে কীভাবে দেখা হয় তা এই পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট।
আমার প্রথম গল্প ছবি হয় উনআশি সালে। তখন আমি একেবারেই তরুণ। কেউ আমার গল্প নিয়ে ছবি করবে ভাবতে পারতাম না। প্রযোজক বললেন, তিনি পাঁচ হাজার টাকা দেবেন, এক হাজার অগ্রিম দিলেন। গল্পটার পটভূমি ছিল কলকাতার রেসকোর্স। শুটিং-এর সময় আমায় নিয়ে গেলেন সেখানে। একটা রেস শুরু হওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই রেসে আপনার কোন ঘোড়া পছন্দ?” আমি উত্তরটা জানি না বলা সত্ত্বেও জোর করতে লাগলে একটা ঘোড়ার নম্বর বললাম। বলাবাহুল্য ওই নাম্বারের ঘোড়াটি জেতেনি। কিন্তু প্রযোজক আফসোস করলেন, “আপনার জন্যে ওটা হাজার টাকা খেলেছিলাম। জিতলে দশ হাজার পেতেন। যাক গে। ওটা বাকি চার হাজার থেকে বাদ দিতে হবে।”
এই শুরু হল। এদিকে একটি বিখ্যাত সাপ্তাহিকের চলচ্চিত্র সমালোচকের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। এলেন পার্থপ্রতিম চৌধুরি। আমার কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, ছায়াসূর্য ছবির পরিচালক, পার্থপ্রতিম চৌধুরি সম্পর্কে আমি একটু দুর্বল ছিলাম। উনি এলেন প্রযোজককে নিয়ে। দশ হাজার টাকায় গল্প কিনে ছ’হাজার টাকার চেক অগ্রিম দিয়ে গেলেন। সেই চেক গড়িমসি করে ভাঙাতে গেলাম দিন তিনেক পরে। বেয়ারার চেক বলে নিজের অ্যাকাউন্টে জমা দিলাম না। গিয়ে শুনলাম ওই অ্যাকাউন্টে কোনও টাকা নেই। যা ছিল তা আমাকে চেক দেওয়ার দিনেই তুলে নেওয়া হয়েছে। পার্থবাবুকে ফোন করলাম। তিনি নেই। কিছুদিন পরে টালিগঞ্জে দেখা হলে বললেন, “কী করব ভাই, টাকার খুব দরকার ছিল, তাইঃ। চিন্তা করবেন না, রিলিজের আগে পেয়ে যাবেন।” সেই ছবির শুটিং কখনওই হয়নি।
আর একজন এলেন। গল্প নিয়ে ছবি করবেন বলে হাজার টাকা অগ্রিম দিলেন। অনেক ঘটনা ঘটিয়ে শুটিং শেষ হল। ছবি রিলিজ করছে বলে শুনলাম। আমার বাকি নয় হাজার টাকা দেওয়ার কথা ভুলে বসে আছেন। যোগাযোগ করলে বললেন, “শুটিং করতে গিয়ে নববুইভাগ গল্প বদলে গিয়েছে। আপনাকে হাজার টাকা দিয়েছি, বাকি নববুই ভাগ গল্প আপনার নয়, তাই নয় হাজার টাকা দিচ্ছি না।” কিন্তু তাঁরা টাইটেল কার্ডে লিখেছিলেন সমরেশ মজুমদারের গল্প অবলম্বনে। আমি ইস্টার্ন মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশনকে চিঠি লিখে ব্যাপারটা জানালে তাঁরা হস্তক্ষেপ করলেন। তখন প্রযোজক এসে অনেক কাঁদুনি গেয়ে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেলেন।
আমি একটা কথা বুঝতে পারি না কোনও অপ্রকাশিত গল্পের চিত্ররূপ দেওয়ার সময় টাইটেলে কেন লেখা হয় ‘কাহিনি অবলম্বনে’? অথচ যে পরিচালক নিজেই গল্প চিত্রনাট্য লেখেন তাঁর ছবিতে ঘোষণা করা হয় কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালক অমুক। অবলম্বনে শব্দটির অর্থ পুরো গল্প নয়, গল্প পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে ছবিটি হয়েছে। আমি জানি সাহিত্য এবং সিনেমা সম্পূর্ণ ভিন্ন মাধ্যম। সিনেমা কখনওই সাহিত্যের অনুবাদ হতে পারে না, তার নিজস্ব ভাষা আছে, প্রয়োজনে নতুন কিছু সংযোজিত হতেই পারে। কিন্তু অবলম্বনে বললে মনে হয় সিনেমাটির সঙ্গে সাহিত্যের যোগাযোগ খুব ক্ষীণ। একজন বিখ্যাত পরিচালক বলেছিলেন, “আমি একবার গল্পটা পড়ি। ভাল লাগলে দ্বিতীয়বার পড়ি না। ওই ভাল লাগাটাকেই চিত্রনাট্যে ছড়িয়ে দিই। কখনও কখনও খবরের কাগজের কোনও হেডলাইন থেকেও ছবির বিষয় তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালী, অপরাজিত করার সময় কি অবলম্বনে শব্দটি লিখেছিলেন? যতদূর মনে আছে, লেখেননি।
কোনও কোনও আঁতেল পরিচালক আরও ভাল কর্ম করেন। লেখকের গল্প যদি পছন্দ হয় তাহলেও তিনি নিজের স্বকীয়তা প্রমাণ করতে গল্প থেকে সরে যাবেন। বলবেন, “গল্পে একটু মেটেরিয়াল ছিল, আমি সেটাকে নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছি।”
লেখকের গল্প নিয়ে ছবি হয়েছে কিন্তু বিজ্ঞাপনে তাঁর নাম নেই। প্রিমিয়ার শো-তে নেমন্তন্ন পাননি। টিকিট কেটে হলে গিয়ে দেখেছেন খুব ছোট হরফে লেখা হয়েছে তাঁর নাম, কাহিনি অবলম্বনে। লেখকের কিছু করার নেই।
বুদ্ধদেব গুহ একটা ভাল কথা বলেছিলেন। “সিনেমাওয়ালাদের কাছে গল্প বিক্রি করা মানে মেয়ের বিয়ে দেওয়া। বিয়ের পর মেয়ে কখন খাচ্ছে, কী করছে খোঁজ নিলে বিড়ম্বনা বাড়বে। তাই চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।”
খুব সত্যি কথা। তবে অবস্থাটা বদলেছে। খুব ধীর গতিতেই বদলাচ্ছে। এখন গৌতম ঘোষ অথবা অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরির মতো পরিচালকরা সম্মান এবং সম্মানদক্ষিণা যা দেন তাতে আর অস্বস্তি হয় না।
কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে এঁরা এখনও সংখ্যালঘু। অশিক্ষিত মানসিকতা যতদিন থাকবে ততদিন লেখকরা মর্যাদা পাবেন না।
২৮
বিদেশে যেসব বাঙালি থাকেন তাঁদের দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির উপর টান থাকা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে যাঁরা গিয়েছেন তাঁদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তখন একটা পছন্দের বাংলা বই বা রেকর্ড দেশ থেকে আনাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হত। নতুন কেউ দেশ থেকে এলে তাঁর কাছে জানতে চাইতেন সমরেশ বসুর বই অথবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ড নিয়ে এসেছেন কি না। তখনকার বাজারগুলোতে দিশি আনাজ পাওয়া যেত না, কাছাকাছি চেহারা বা স্বাদের যেসব আনাজ আফ্রিকা থেকে আসত তাই দিয়ে বাড়িতে দিশি তরকারি রান্না করে খুশি থাকতে হত। তখনও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। আমেরিকার ছোট শহরগুলি দূরের কথা, খোদ নিউ ইয়র্কে বাংলা খাবারের রেস্টুরেন্ট প্রায় আকাশকুসুম ছিল।
মূলত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেখানকার ভাগ্যান্বেষী বঙ্গসন্তানরা বেরিয়ে পড়লেন হাজারে হাজারে, পৃথিবীর প্রায় সব দেশে। বাংলাদেশের নাম বিদেশিদের কাছে তখনও অপরিচিত ছিল বলে চট্টগ্রাম, সিলেটের লোক রেস্টুরেন্ট খুলে নাম রাখলেন ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট। সেখানে সুক্তো থেকে চাটনি সবই পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম থেকে ইলিশ থেকে শুঁটকি মাছ এনে বিক্রি করছেন তাঁরা। তখন পশ্চিমবাংলার ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার অথবা কম্পিউটার বিশেষজ্ঞদের আর হা-হুতাশ করতে হল না। মনে আছে কলকাতায় যখন এক কেজি বাংলাদেশের ইলিশের দাম আটশো টাকা তখন নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটের দোকানে গিয়ে শুনলাম এক পাউন্ডের দাম চার ডলার। দু’ পাউন্ড তো এক কেজির কাছাকাছি। তখন পঞ্চাশ টাকায় একটি ডলার কিনতে হত। আট ডলার অর্থাৎ চারশো ভারতীয় টাকায় সেই মাছ কিনে খাওয়ার সময় বুঝেছিলাম, এত ভাল ইলিশ কখনও খাইনি। হিসেবটা বুঝিনি। গায়ে গায়ে থাকা দেশে ইলিশ এনে যে দামে বিক্রি হয়েছে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে আমেরিকায় গিয়ে তার অর্ধেক দামে কী করে বিক্রি হয়েছে? বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আপনি দু’ পাউন্ডের ইলিশ পেয়েছেন আট ডলারে, চার পাউন্ডের ইলিশ কিনলে পঁচিশ-তিরিশ ডলার দিতে হত। একসঙ্গে আনে এবং ছোট ইলিশের চাহিদা বেশি নেই বলে পেয়েছিলেন। আমি শুধু ভেবেছিলাম এটা যদি কলকাতার মানুষ পেত তাহলে কী ভালই হত।
এখন নিউ ইয়র্ক কেন, তামাম পৃথিবীতে বাংলার সব সবজি পাওয়া যায়। কাতলা থেকে ইলিশ, মায় দিশি কই পাওয়া যায় হাত বাড়ালে। প্রায় সব বড় শহরে কেউ না কেউ ব্যবসা শুরু করেছে বই এবং সিডির। দেশ থেকে অর্ডার দিয়ে তাঁরা আনান এবং বাঙালিদের চাহিদা মেটান। নিউ ইয়র্কে জ্যাকসন হাইটের বিশ্বজিৎ সাহার দোকান মুক্তধারায় রাত এগারোটা পর্যন্ত খদ্দেরের ভিড়। সারাদিন ট্যাক্সি চালিয়ে বাড়ি যাওয়ার পথে একটা হুমায়ুন অথবা সুনীল গাঙ্গুলির বই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ভাল করে সন্ধান নিলে দেখা যাবে এঁদের অধিকাংশই বাংলাদেশের মানুষ। রেস্টুরেন্টের রাঁধুনিকে কাজের অবসরে বাংলা উপন্যাস পড়তে দেখে জিজ্ঞাসা করেছি। ‘দেশ কোথায়?’ তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম।’
কিন্তু এই তৃষ্ণা পশ্চিমবাংলা থেকে যাঁরা গিয়েছেন তাঁরা মেটাতে চেয়েছেন একটু অন্যভাবে। তাঁরা বঙ্গ সম্মেলনের আয়োজন করেন প্রতি বছর। এক একবার এক এক শহরে তিনদিন ধরে গান বাজনা নাটক এবং সাহিত্য নিয়ে সেই আসর বসে। আমেরিকা এবং কানাডা থেকে উৎসাহী মানুষরা আমায় টাকা পাঠিয়ে সেই অনুষ্ঠানে যোগদানের অধিকার দেন। আগে সাত-আট হাজার মানুষ একত্রিত হতেন। সাধারণত কলকাতার শিল্পীদের সঙ্গে একজন সাহিত্যিককে আমন্ত্রণ জানানো হত। তারপর মুম্বই-এর গায়ক-গায়িকাদের কাউকে যাঁর গান ওঁরা শুনতে আগ্রহী, আমন্ত্রণ জানান। খরচ হত প্রচুর। প্রথমদিকের বছরগুলিতে বাংলাদেশের মানুষদের কমিটিতে নেওয়া হয়নি, তাঁদের যোগদানের ব্যাপারটাকে উৎসাহ দেওয়া হয়নি। হয়তো কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তারবাবু যিনি বিরাট বাড়িতে বাস করেন, দামি গাড়ি চড়েন তিনি একজন বাংলাদেশি ট্যাক্সিওয়ালা বা রেস্টুরেন্টের মালিককে সমগোত্রীয় মনে করতেন না। কিন্তু অবস্থার বদল হল। বাংলাদেশিরা যাতে উৎসবে আসেন তাই বাংলাদেশ থেকে নামী শিল্পীদের অনুষ্ঠানে আনা হতে লাগল।
এই বঙ্গসম্মেলনকে অনুসরণ করে শুরু হল বঙ্গমেলা। ছোট আকারে তিনদিনের অনুষ্ঠান, বাজেটও কম। কিন্তু ওই ক’দিন বঙ্গসংস্কৃতিকে চেখে নেওয়ার একটু চেষ্টা—!
বঙ্গসম্মেলনে কয়েকবার আমন্ত্রিত হয়েছি। বাঙালি সাজে সেজে আসা পুরুষ-নারীদের দেখে ভাল লেগেছে। লক্ষ করেছি নাটক দেখার আগ্রহ অনেকের কিন্তু সবচেয়ে বেশি উৎসাহ মুম্বইয়ের শিল্পীদের হিন্দি গান শুনতে। নামী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর অনুষ্ঠান অনেককেই আকর্ষণ করে। কিন্তু সাহিত্যের সেমিনারগুলোয় গিয়ে মনে হয়েছে কেন এই আয়োজন করেছেন ওঁরা? প্রথমবার জনা কুড়ি শ্রোতাকে দেখেছিলাম। দ্বিতীয়বার সুনীলদা, শীর্ষেন্দুদার সঙ্গে আমি ছিলাম। শ্রোতার সংখ্যা পনেরো-ষোলো। তৃতীবারে দশেও পৌঁছয়নি। কেন এত কম শ্রোতা জিজ্ঞাসা করলে একজন উদ্যোক্তা বলেছেন, ”এখন দুপুর তো। সবাই লাঞ্চের পর বিশ্রাম নিচ্ছেন। রাতে মুম্বই-এর শিল্পীর গান আছে। তাই—!”
তাহলে এই সেমিনারের ব্যবস্থা করলেন কেন? দেশ থেকে এক-দু’জনকে নিয়ে আসার খরচ তো কম নয়। ভদ্রলোক বলেছিলেন, ”কিছু মনে করবেন না দাদা, অবস্থা দেখে এবার সেমিনার করব না বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু সবাই বলল, বঙ্গসম্মেলন হচ্ছে আর তাতে সাহিত্য থাকবে না, এটা হয় না। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের প্রতি অসম্মান করা হবে।”
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আপনি তো শিক্ষিত বাঙালি। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের নাম বললেন। গত কুড়ি বছরে প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে পড়া আছে এমন দুটো উপন্যাসের নাম বলুন তো!” ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, ”বিশ্বাস করুন, এখানে পড়ার সময় পাই না। পড়া হয় না। সকালে অফিসে যাই, সন্ধেবেলায় ফিরে এসে বাড়ির কাজ সেরে ডিনার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি যাতে পরের সকালে ঠিক সময়ে অফিসে যেতে পারি। শনিবার তো পার্টির দিন। তাই পড়া হয়ে ওঠে না।”
মনে পড়ল নিউ জার্সির এক কলকাতার বাঙালি আমাকে অনুযোগ করেছিলেন, ”আপনি খুব অসভ্য লেখা লেখেন। আমি কলেজে পড়ার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েছি।”
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ”সেই লেখার নাম কী?”
”বিবর!” খুক খুক করে হেসেছিলেন তিনি।
তবু কলকাতার বাঙালিদের ওখানে বঙ্গসম্মেলন করতে হবে। এই খরচের বোঝা কমাবার জন্য ওঁরা কলকাতায় হাজির হন কয়েক মাস আগে। যাঁরা টাকা দেন তাঁদের দেওয়া শর্ত ওঁদের গিলতে হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে চিট ফান্ডওয়ালারা দরাজ হাতে ওঁদের যে টাকা দিতেন তাতে মুম্বই-এর শিল্পীদের লক্ষ লক্ষ টাকা দক্ষিণা দেওয়া যেত। কাগজে পড়েছি সারদা গোষ্ঠী এঁদের মদত দিয়েছে। এখন সব চিট ফান্ডওয়ালা পাততাড়ি গুটিয়েছে, বঙ্গসম্মেলনেও নিশ্চয়ই তার প্রভাব পড়বে। কিন্তু যাঁরা আয়োজক তাঁদের সন্তানদের বেশিরভাগ বাংলা বলতে পারেন না। টান কতদিন থাকবে সেটাই দেখার।
২৯
পঞ্চাশ বছরের সঙ্গীকে কি বন্ধু বলা যায়? এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, না। স্কুলের শেষ ধাপে পরিচয়, সঙ্গী হল কলেজের শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে। কফি হাউসে। পকেট তখন প্রায় খালি। সস্তার প্যাকেট ছিল চারমিনার। তাকে বলা হত আঁতেলের সিগারেট। সেই শুরু। কত রাতে সিগারেটের সঙ্গে দেশলাইয়ের বিবাদ সামলাতে হয়েছে। রাত দশটার পরে হস্টেলের গেট যখন তালাবন্ধ, তখন বাইরে থেকে দেশলাই কিনে আনার সুযোগ নেই। গোটা রাত সামনে, অথচ দেশলাইয়ের কাঠি মাত্র দু’টো। ব্লেড দিয়ে ঝানু সার্জেনের মতো অপারেশন করে দু’টোকে চারটে কাঠি করা—যাতে রাতের খানিকটা সময় সিগারেটকে সঙ্গী রাখা যায়।
তখন টলিউডের বিখ্যাত কোনও চিত্রতারকা ঠোঁটের কোণে এমনভাবে সিগারেট ঝুলিয়ে রাখতেন যে, মনে হত আঠা দিয়ে আটকে রেখেছেন। তাঁকে নকল করেছে পৃথিবীর বহু তরুণ। বোম্বের (‘মুম্বই’ নামকরণের আগের কথাই বলছি) চিত্রতারকারা ধোঁয়া ছুড়ে রিং বানাতেন, রিঙের ভেতর আর একটা রিং। এটা রজনীকান্ত পর্যন্ত চলেছিল। আমার এক বন্ধুর প্রথম প্রেম ভেঙে গিয়েছিল। দিনদশেক দেখা করার পর ওয়াই.এম.সি.এ-র ক্যান্টিনে বসে প্রেমিকা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আচ্ছা তুমি স্মোক করো না?’ দুদিকে মাথা নেড়ে ‘না’ বলেছিল বন্ধু। প্রেমিকা সুচিত্রা সেনের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে বলেছিল, ‘সরি, আমাদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক হতে পারে না। যার সঙ্গে থাকব তার গায়ে ভাল সিগারেটের গন্ধ পাব না, তা কখনও হয়!’
তারপর সেই সময়টা এল। তিরিশ বছর আগেও বিদেশে যাওয়ার সময় দেখেছি, প্লেনে সিগারেট খাওয়ার জন্য আলাদা আসন বরাদ্দ রয়েছে। হঠাৎ সেটা উঠে গেল। দীর্ঘযাত্রায় কেউ সিগারেট ধরালে মোটা জরিমানা। কলকাতা থেকে নিউ ইয়র্ক যাচ্ছি দুবাই হয়ে। দুবাইতে ঘন্টাতিনেক থাকতে হবে। প্লেন থেকে নেমেই ছুটলাম স্মোকিং রুমের সন্ধানে। অত বড় এয়ারপোর্টের টার্মিনাল-পিছু একটা স্মোকিং রুম, জানলা নেই, কাচের ঘরে চাপ-চাপ ধোঁয়া। ঢোকে কার সাধ্যি! দীর্ঘ বাইশ ঘন্টা সিগারেট না-খেয়ে, কেনেডি এয়ারপোর্টের বাইরে এসে সিগারেট ধরাতেই, শরীরের ঝিমঝিমে ভাব। কিন্তু পুলিশ এল, ‘আপনি শেডের মধ্যে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছেন। পাঁচ ডলার ফাইন দিন।’ সদ্যধরানো সিগারেটে টান দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘একটু দাঁড়ান ভাই, ফাইন যখন দিতেই হবে দু’টো সিগারেট খেয়ে না-হয় দেব।’
কিন্তু এই কলকাতায় শেষ পর্যন্ত না-না রব উঠল। এমনকী ছেলেমেয়েরাও প্রতিবাদে পঞ্চমুখ হল। ভালবেসে তার কাছে গেলে সে বলল, ‘সিগারেট পকেটে নিয়ে এসো না। তামাক পোড়ার পীড়া সইতে পারি না।’ এই বাড়িতে সিগারেট খাবেন না, ওই প্রেক্ষাগৃহে নয়। এমনকী, ট্রেনে যেতে-যেতে টয়লেটের সামনের চিলতে জায়গাটুকুতেও দাঁড়িয়ে দু’টো টান দেওয়া যাবে না। ‘আপনি খাচ্ছেন, এবং মরছেন, কিন্তু ধোঁয়া ছেড়ে আরও পাঁচজনকে মারছেন কেন?’
ঘোর দুর্দিন আমার সঙ্গীর। অনেক কষ্টে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছি। কিন্তু গত দেড় মাস ধরে সে যেন আমাকে অন্য বার্তা দিচ্ছিল। মাঝে-মাঝেই কাশি হচ্ছে, একটু কফ উঠছে। তারপর কানে অস্বস্তি। এবং শেষতক সর্দি। পরপর হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে আমি উদাসীন। শেষে সিগারেটে টান দিতেই ইচ্ছে করছে না। গেলাম ডাক্তারের কাছে—যাঁর ওপর গভীর ভরসা আমার। পরীক্ষা করে তিনি সেই নার্সিংহোমে ভর্তি করতে একমুহূর্ত দেরি করলেন না। আমি হতভম্ব। এ কী! আমাকে যে আই.সি.ইউ-তে নিয়ে যাচ্ছে ওরা!! রোজই কাগজে দেখি হাসপাতাল-নার্সিংহোমে ভুল হচ্ছে। আমার বেলায় তা হচ্ছে না তো? নার্সিংহোমের পোশাক পরিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল আরও কয়েকজন অসুস্থের কাছাকাছি খাটে। নাকে গুঁজে দেওয়া হল অক্সিজেনের তার। হাতে গর্ত করে তৈরি হল স্পেসশিপের মতো ওষুধ ঢালার কেন্দ্র। রক্ত নিচ্ছেন এক একজন কেরলের নার্স, যাঁরা ইংরেজি বোঝেন কি বোঝেন না, হিন্দি তো দু’-একটা শব্দ!
প্রথমরাত তলিয়ে গিয়েছিলাম কোথাও। সেটা ঠিক কোনখানে তা জানি না। দ্বিতীয় দিনে চারপাশে তাকালাম অস্পষ্ট চোখে। একজন সমানে চিৎকার করে যাচ্ছেন। প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে তাঁর। ওঁকে ইঞ্জেকশন দেওয়া হল। আবার তলিয়ে গেলাম। বিকেলের পরে চোখ মেলা। পাশের খাটের মানুষটি ডাকছেন, ‘সিস্টার, সিস্টার! ও ব্রাদার!’ কেউ সাড়া দিচ্ছে না। অথচ তাঁদের দেখতে পাচ্ছি, নির্বিকার মুখে কাজ করছেন। একজন যে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে তাঁদের ডাকছেন তা কেন কানে ঢুকছে না? রাত বাড়ল। কেরলের যে-মেয়েটি আমাকে ইঞ্জেকশন দিতে এল তাকে বললাম, ‘এত নিঠুর কেন তোমরা?’ সে বলল, ‘মোবাইল চাইছে। আই.সি.ইউ-তে মোবাইল ব্যবহার করা নিষেধ।’
লোকটাকে নিশ্চয়ই বলা হয়েছে, কিন্তু সে মানতে চাইছে না। ভাল করে লক্ষ করলাম। স্থির মুখ, শরীর নড়ছে না, ঠোঁট থেকে শব্দ ছিটকে আসছে, ‘সিস্টার, সিস্টার! ও ব্রাদার!’
ঘুম ভাঙল। রাত তখন কত? এক নবীন আর.এম.ও ডাক শুনে এগিয়ে গেলেন। ‘বলুন, ডাকছেন কেন?’ ‘মোবাইল দাও ব্রাদার!’ কাতর আবেদন।
‘কাকে ফোন করবেন এই মাঝরাতে?’
উত্তর এল না। নবীন ডাক্তার একটু অপেক্ষা করে ফিরে গেলেন তাঁর ডেস্কে। এটা কী হল? লোকটা জানে না সে কাকে ফোন করবে—অথচ সমানে মোবাইল চেয়ে যাচ্ছিল? না কি, গোপনে রাখতে চাইল পরিচয়?
ভোর চারটের সময় মানুষটির সমস্ত শরীর সাদা কাপড়ের তলায়।
পরদিন ওই বিছানায় নতুন পেশেন্ট। আজ একটি বাঙালি মেয়ে আমার পরিচর্যায়। তাকে অনুযোগ করলাম, ‘লোকটা চলে গেল, মোবাইলটা দিলে কী হত?’
‘কথা বলতে পারত না। সিমকার্ড তৈরি হয়নি।’ মেয়েটি মাথা নাড়ল।
‘তার মানে?’
‘উনি ভগবানের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন।’
সাহিত্যে, পৌরাণিক গ্রন্থে, এমনকী কোরানে যেসব নরকযন্ত্রণার বর্ণনা আছে তা আমি পড়েছি। পাঁচদিনের আই.সি.ইউ-এর অভিজ্ঞতা প্রায় তার কাছাকাছি। এক-একজন করে চলে যাচ্ছেন। একজন টানা তিরিশ ঘন্টা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, ইঞ্জেকশনেও কাজ হয়নি।
পঞ্চম রাত্রে হঠাৎ মনে হল আমি আর পৃথিবীতে নেই। কিন্তু শরীর হালকা নয়, মাধ্যাকর্ষণের সঙ্গে লড়াই করে মহাশূন্যে যেতে-যেতে হঠাৎ বিপুল বিশাল সাদা প্রাসাদ দেখতে পেলাম, যার কোনও জানলা দরজা নেই। অনেক ধাক্কা দেওয়ার পর, একটা অংশ খুলে লম্বা সাদা দাড়ি, প্রফেসর শঙ্কুর মতো টাকমাথা একজন বিরক্ত হয়ে দেখা দিয়ে বললেন, ‘কেন এসেছ? এখন তোমার জন্যে জায়গা খালি নেই। ফিরে যাও। আর হ্যাঁ, পকেটে কিছু আছে?’ আমি হাত ঢোকাতেই তাজা প্যাকেট পেলাম। সেটা নিয়ে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
তিনি কে জানি না, কিন্তু তাঁর হাতে আমার পঞ্চাশ বছরের সঙ্গীকে তুলে দিয়ে এসেছি। এখন একটু একা লাগছে, কী করা যাবে!