গীতবিতান ছুঁয়ে বলছি ২.১০

১০

সাতাশ বছর ধরে বাংলাদেশে আসছি। একটি দেশ এবং তার মানুষকে একটু-একটু করে জেনেছি। এবার ফেব্রুয়ারির শেষে ‘সার্ক’ দেশগুলির সাহিত্য-সম্মেলন উপলক্ষে আসা। উদ্যোক্তা মিসেস রুবানা হকের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল, আমার অনুষ্ঠানের সময় নিশ্চয়ই জাতীয় জাদুঘরের সাহিত্য-সম্মেলনে যাব, কিন্তু তার বাইরের সময়টা নিজের মতো কাটাব। কারণ ঢাকায় আমার পরিচিত মানুষের সংখ্যা সম্ভবত কলকাতার থেকে বেশি।

উঠেছিলাম ঢাকা ক্লাবে। সেখান থেকে বইমেলা এবং সার্ক-এর অনুষ্ঠানস্থল খুব কাছে। পৌঁছেই বিকেলবেলায় বইমেলায় গেলাম। এত দিন বইমেলা হত বাংলা আকাদেমি-র চত্বরে। ছোট জায়গা, তাই বোঝা যাচ্ছিল জায়গাটা বাড়ানো দরকার। এবার দেখলাম জায়গা বদলে বেশ বড় এলাকাজুড়ে সামনের মাঠে মেলা হচ্ছে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, রাত ন’টা পর্যন্ত মহিলারা বই কিনে বাড়ি ফিরলেন।

অবাক হওয়ার কারণ ছিল। সাতাশ বছর আগে যখন প্রথম ঢাকায় আসি তখন কোনও রাস্তায় মহিলাদের হাঁটতে দেখিনি। একটু ভুল হল, শ্রমজীবী পরিবারের মহিলা নন, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা বিত্তবান পরিবারের মহিলারা ফুটপাতে হেঁটে যেতেন না। সেটা দিনদুপুরেও। তাঁদের দিনের বেলায় দেখা যেত রিকশায়। এমনকী, বেইলি রোডের শাড়ি পাড়ার একটি দোকান থেকে বেরিয়ে উল্টো দিকের আর একটি দোকানে যাওয়ার দরকার হলে রিকশায় উঠতেন। সেটা উনিশশো সাতাশি সাল। কলকাতায় তখন মেয়েরা ফুটবল খেলছেন, আকাদেমি থেকে নাটক দেখে একা বাসে চেপে বাড়ি ফিরছেন। এক পরিচিতকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি বলেছিলেন, ‘একা হাঁটতে, একা কেন, মেয়েরা একসঙ্গে হাঁটতেও অস্বস্তি বোধ করি। খুব নিরাপদ বোধ করি না।’ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে ছেলেমেয়েদের ভদ্রভাবে গল্প করতে দেখেছি, কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে এলে কেউ কাউকে না-চেনার ভান করে চলে যেত।

ধীরে-ধীরে ছবিটা বদলাল। দু’বছর আগে এক বিকেলে বেইলি রোডের ফুটপাতে ফুচকাওয়ালার সামনে কয়েকটি ছেলেমেয়েকে ফুচকা খেতে দেখলাম। বেশ অবাক কাণ্ড। মেয়েদের পরনে জিনস-টপ। একজনের আবার মাথায় নকাব। ওরা ফুটপাতে বসে আড্ডা মারছে। সন্ধে ছ’টাতেও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা কোনও-কোনও রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছেন। পঁচিশ বছর লাগল এই পরিবর্তনের জন্যে।

এবার আরও চমক। ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছি মেয়েরা পড়াশোনা শেষ করে ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড়-বড় চাকরি করছেন। ব্যবসাও করছেন। অনেকেই চাকরি পেয়ে বা আরও পড়ার জন্যে বিদেশে চলে গিয়েছেন। এখন বাংলাদেশে শতকরা অন্তত সত্তরটি পরিবারের ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকেন। দেশে ফিরে আসেন কেউ-কেউ, বেশির ভাগই আসেন না। অর্থাৎ একটা তুমুল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে বাংলাদেশের সমাজজীবনে। শেষদিনের বইমেলায় যাচ্ছি। প্রধান রাস্তায় হাঁটলে অনেকটা হাঁটতে হয় বলে পার্কের ভিতর দিয়ে শর্টকাট করছি। সেই সন্ধেবেলায় দেখলাম দু’জনের জন্য বসতে পারা বেঞ্চিতে জোড়ায়-জোড়ায় ছেলেমেয়েরা বসে আছে। হঠাৎ চোখে পড়ল বোরখা-পরা একটি মেয়ে তার পুরুষসঙ্গীর কাঁধে হাত রেখে গুনগুন করে গান গাইছে। মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না কিন্তু হাতের আঙুল ছেলেটির কাঁধে গানের সুরের সঙ্গে সঙ্গত করছে। এই মেয়েটি যখন বোরখা পরেছে তখন ধরেই নেব সে খুব রক্ষণশীল পরিবারে থাকে। যার মা রাস্তায় হাঁটত না সে বোরখা পরেও পার্কে প্রেম করছে। এই ঘটনার কথা একটি আড্ডায় বলতেই একজন জানালেন, ‘স্যর, মেয়েটি যে প্রেম করছে তা আত্মীয়-পরিজনদের কাছে লুকোতে বোরখা পরেছিল। আপনি ভুল ভেবেছেন।’

এ তো আরও অভিনব ব্যাপার! ধর্মকে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করার সাহস যে মেয়েটির মনে এসেছে সে তো আর একরকমের বিদ্রোহিনী।

সার্ক সম্মেলন উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঞ্চ থেকে প্রথম সারিতে বসে থাকা আমাকে দেখে চিনতে পারলেন তিনি। অনুষ্ঠান শেষ হতেই তিনি নেমে আসছিলেন, কিন্তু প্রোটোকলের কারণে আমাকে কাছে যেতে হল। অনুযোগ করলেন, ঢাকায় আসি খবরটা অন্যের কাছে পেয়ে থাকেন, আমি কেন জানাই না। তার পর প্রশ্ন, ‘আমাকে এখন কেমন দেখছেন?’ বললাম, ‘আগের চেয়ে অনেক সুন্দরী হয়েছেন।’ সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর গালে রক্ত জমল। প্রধানমন্ত্রীকে এই কথা বলার বেয়াদপি তিনি মার্জনা করলেন।

বাংলাদেশের মানুষ বই পড়েন। সুনীলদা তো এখানে খুব প্রিয় লেখক ছিলেন। হুমায়ুন আহমেদ চলে যাওয়ার পরে বাংলাদেশের পাঠকরা কলকাতার লেখকদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়েছেন। চট্টগ্রামের একটি বইয়ের দোকান, যার নাম ‘বাতিঘর’, গিয়ে আমি অবাক। একটা জাহাজের আকৃতিতে অত বড় বইয়ের দোকান আমি কখনও দেখিনি। পাঁচ হাজারের মতো পাঠক অপেক্ষা করেছিলেন সেই সন্ধ্যায়। এরকম ঘটনা আর কোথায় হতে পারে।

সাতাশ বছর আগে যখন এসেছিলাম তখন নবীন শিক্ষিতদের মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে একটা উদাসীনতা লক্ষ করেছিলাম। রোজা’র সময় সারা দিন সবাই উপবাস থাকেন জেনে ভেবেছিলাম আমাকেও তাই থাকতে হবে। মনে-মনে তৈরি হয়েছিলাম। সকাল দশটায় প্রথমে একজন টিফিন ক্যারিয়ারে পরোটা-মাংস নিয়ে এলেন। আমি প্রতিবাদ করলে জানালেন, তিনি রোজা রাখেননি। কারণ তাঁর পেটের অসুখ আছে, ডাক্তার নিষেধ করেছেন অভুক্ত থাকতে। কোরানেও আছে অসুস্থ মানুষ রোজা না-রাখলে ক্ষতি নেই। কিছুক্ষণ পরে আর একজন খাবার নিয়ে এলেন। জানালেন তাঁর বাড়ি সিলেটে। ঢাকায় তিনি মুসাফির। কোরানে আছে মুসাফিররা রোজা না-ও রাখতে পারেন। বুঝতে পারলাম তাঁরা ধর্মের ছাড়ের সুযোগ নিয়ে সেটা ব্যবহার করছেন। আমার সঙ্গে সারাদিন কাটানো অনেককেই নমাজ পড়তে দেখিনি। কিন্তু এঁরা কেউ ইসলামবিরোধী নন। হয়তো বাড়ি ফিরে তাঁদের ধর্মীয় কর্তব্য পালন করেন। আমরা, তথাকথিত হিন্দুরা ঘুম থেকে উঠে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত যা কখনওই করি না। কথাটা নববুই ভাগ সম্পর্কে প্রযোজ্য।

কিন্তু এবারে গিয়ে জানলাম তরুণ প্রজন্ম কোরান পড়ছেন, ধর্মাচরণ করছেন। ব্যাপারটা আমার ভাল লাগছে। ধর্ম মানুষের জীবনে শৃঙ্খলা আনে। ধর্মকে সামনে রেখে অন্ধ-অপব্যাখ্যায় যেসব গুরু সাধারণ মানুষের অজ্ঞতাকে ব্যবহার করে তাদের আওতা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষিত যুব সম্প্রদায় যদি ধর্মের সঠিক প্রয়োগ করেন তা হলে একটি সুশৃঙ্খল প্রজন্ম দেখতে পাব।

১১

যা ছিল রাস্তায়-রকে, অশিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের গা-জোয়ারি ভাষা, তাকে আমরা, তথাকথিত ভদ্রসমাজ উপেক্ষা করে এসেছি, এড়িয়ে চলেছি। এতকাল সন্তানের সঙ্গে রাস্তায় চলতে গিয়ে পাশের ফুটপাত বা রক থেকে অসাড়ে উচ্চারিত হওয়া শব্দাবলি না শোনার ভান করে হেঁটেছি। ভেবেছি পাশে হাঁটা বারো বছরের মেয়েটি যেন দু-অক্ষর চার-অক্ষরের শব্দগুলো শুনতে না পায়। পেলেও ওগুলোকে হিব্রু বলে ভেবে নেয়।

এইসব শব্দ যারা এতকাল বলত তারা অবশ্যই শহর অথবা শহরতলিতে থাকা মানুষ, পশ্চিমবাংলার গ্রামে-গঞ্জে অনেক ঘুরেও গরিব চাষি বা শ্রমজীবীর মুখে কখনওই শুনতে পাইনি। আমাদের সময়ে কলেজে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ কথার লব্জহিসেবে দুই অক্ষরের পুরুষাঙ্গ শব্দটি ব্যবহার করত না। শ্যামপুকুরের রকে এক বৃদ্ধকে মুখ খুললেই এমন কিছু অশ্লীল শব্দ বলতে শুনতাম যাদের মধ্যে উত্তর কলকাতার প্রাচীন গন্ধ মিশে থাকত। একদিন সহ্য করতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আচ্ছা, আপনি বাড়িতেও কি এই ভাষায় কথা বলেন?’ সঙ্গে সঙ্গে জিভ বের করে দু’দিকে মাথা দুলিয়ে তিনি বললেন, ‘কস্মিনকালেও নয়। বাড়িতে ঢুকলেই জিভ অসাড় হয়ে যায়। কথাই বেরোতে চায় না। এই রকে এলে একটু চাঙ্গা হই।’ খুব অবাক হয়েছিলাম। মানুষের অনেকগুলো মুখের কথা জানি, কিন্তু সচেতনভাবে মুখ পাল্টাবার উদাহরণ দেখে মনে হয়েছিল ওই লোকটির মধ্যে একটা স্যাডিস্ট সত্তা কাজ করে।

বাংলা সাহিত্যের শুরু থেকে তিন বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত যা ইতিহাস, তা ঘাঁটলে দেখা যাবে কেউ অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেননি। আমি অশ্লীল বলতে সেই সব শব্দের কথা বলছি, যা আমরা ছেলেমেয়েদের সামনে উচ্চারণ করতে পারি না। বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’-তে লিখেছিলেন, ‘ওটা হয়ে গেল।’ তাতেই তখন হইচই।’ শব্দগুলোতে অবশ্যই অশ্লীল ইঙ্গিত ছিল বলে অভিযোগের আঙুল উঠেছিল। সমরেশদার বিবরে আমি অশ্লীলতা খুঁজে পাইনি যদিও আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। সুনীলদা ও শীর্ষেন্দুদা কখনওই অশ্লীল শব্দ লিখতে পারতেন না। পারেন না। ‘মাগী’ শব্দটি অশ্লীল বলে যাঁদের মনে হয়েছে তাঁরা অভিধান খুলে মুখ বন্ধ করেছেন, বিদ্যাসাগর মশাই স্ত্রীকে আদর করে ওই সম্বোধন করতেন। বিমল কর, রমাপদ চৌধুরীদের পথ ধরে আমরা যে শিক্ষা নিয়ে লিখতে এসেছি, তাতে মনে হয়েছে মানুষের জীবনে অনেক সমস্যা, অনেক কথা আছে, সেগুলো না লিখে অশ্লীল শব্দ লিখতে যাব কেন? এই সেদিনও বাঙালি পাঠক অশ্লীল শব্দ দেখলে লেখককে বর্জন করতেন।

গত দশ বছরে একটু-একটু করে সব বদলাল। এককালে ‘শালা’ শব্দ উচ্চারণ করলে অভিভাবকরা শাস্তি দিতেন। এখন শালা জলভাত। কলেজ ছাত্রীরাও বাক্যে অনর্গল ব্যবহার করে। দু’অক্ষরের পুরুষাঙ্গ শব্দটি মাস্টার্স করা ছেলেদের মুখে ধীরে ধীরে চলে এল। কথাটা বলার সময় তারা বুঝতেই পারে না যে অশ্লীল শব্দ বলছে।

নকশাল আন্দোলনের পর থেকে আমাদের মূল্যবোধে ভাঙন ধরেছিল। সমাজের সব স্তরেই এটা লক্ষ করা যায়। নকশালদের পাইপগান নিয়ে যে আস্ফালন দরিদ্র পরিবারের শিশুরা দেখেছে, তাই থেকে শিক্ষা নিয়েছিল বলে পরবর্তীকালে বিপুল মস্তানবাহিনী তৈরি হয়েছে। আদর্শের ধার ধারেনি তারা। প্রকাশ্যে অশ্লীল শব্দ বলতে বেপরোয়া হয়েছে। সারা সন্ধে রকে বসে অশ্লীল শব্দ বলা কয়েকটি ছেলেকে একটি নাটকের দলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। ঐতিহাসিক নাটক। ওরা রিহার্সালে গেলে পাড়া শান্ত থাকত। রিহার্সাল শেষ করে রাত দশটায় ওরা রকে ফিরে এসে নাটকের সংলাপ যখন বলা শুরু করল তখন শুনলাম সেই সংলাপে অভ্যস্ত অশ্লীল শব্দগুলো বেমালুম ঢুকিয়ে দিয়েছে।

‘হাংরি জেনারেশন’-এর লেখকরা শ্লীল-অশ্লীলের তোয়াক্কা করতেন না। কিন্তু ওই সব লিটল ম্যাগাজিনের বিক্রি সীমিত ছিল এবং বাঙলি পাঠক তাকে গ্রহণ করেনি। কিন্তু গত আট দশ বছরে প্রতিষ্ঠিত এবং বিপুল জনপ্রিয় কাগজে উপন্যাস লিখতে এসে কিছু নবীন এবং নবীনা লেখক অশ্লীল শব্দের বন্যা বইয়ে দিলেন। হয়তো তাঁদের মনে হয়েছিল ওইসব লিখে পাঠকের কাছাকাছি পৌঁছে যাবেন। ওই পত্রিকা পড়া বন্ধ করেছেন অনেক পরিবার। লেখিকার লেখার মান অনেক ভাল হওয়া সত্ত্বেও অকারণ যৌন বর্ণনার জন্যে গৃহীত হলেন না। পরবর্তীকালে এই পথ বর্জন করে তিনি পাঠকের প্রিয় হয়েছেন।

আমাদের চলচ্চিত্রে এককালে চুমু খাওয়া দেখানো হত। সেই নির্বাক যুগে নায়ক-নায়িকরা চুমু খেতেন। একদা প্রকাশিত ‘দীপালি পত্রিকা’য় সেই ছবি আমি দেখেছি। ছবি কথা বলতে শুরু করার পর তা বন্ধ হল। নায়ক-নায়িকার ঘনিষ্ঠতা দেখাতে জলের ছায়া দেখানো হত। অথবা দুটো পায়রা পরস্পরকে আদর করছে। উত্তমকুমার তাঁর কোনও নায়িকাকে চুমু খেয়েছেন কি না মনে পড়ছে না। সম্ভবত না। এটা একটু বাড়াবাড়ি রক্ষণশীলতা যা সেন্সরবোর্ডের তদারকিতে করা হত। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে শেফালি তাঁর বক্ষবাসের বাঁধন খুলে দিতে বলেছিলেন নায়ককে। আমাদের খারাপ লাগেনি, অশ্লীল বলে মনে হয়নি।

কিন্তু কয়েক বছর আগে মুক্তি পাওয়া ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবি সব বাঁধ ভেঙে দিল। পাড়ার মস্তানদের ভাষা অপ্রয়োজনে ব্যবহার করা শুরু হল বাংলা ছবিতে। প্রাক্তন পুলিশ অফিসার প্রসেনজিৎ দু’অক্ষর চার-অক্ষরের অশ্লীল শব্দ যখন বলছেন তখন কিছু ছেলে তাঁকে আত্মীয় ভেবে নিল, অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলারা হেসে গড়িয়ে পড়লেন। সেন্সরবোর্ডের উদারতা অথবা মেরুদণ্ডহীনতা এমন পর্যায়ে চলে গেল যে ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে কিছু বাংলা ছবি তৈরি হতে লাগল। আগে রাস্তা দিয়ে হাঁটলে ভয় হত যে সব শব্দের জন্য, এখন সিনেমা হলে ঢুকলে একই প্রতিক্রিয়া হয়। নির্মাতারা বলবেন, যা সমাজ জীবনে হচ্ছে তাই তো সিনেমায় হওয়া উচিত। একজন আমার সঙ্গে তর্ক করলেন, রবীন্দ্রনাথও তো সন্তানের বাবা হয়েছিলেন। সেইসব সন্তান তো শূন্য থেকে আসেনি। কল্পনায় রবীন্দ্রনাথের সহবাসের দৃশ্য তো তৈরি করতেই পারি। কাদম্বরীর সুইসাইড নোট যদি কল্পনা করে লেখা যায় তাহলে এটা যাবে না কেন?

আমি কথা বলতে পারিনি। ফেব্রুয়ারির শেষে বাংলাদেশে ছিলাম। ঢাকার বইমেলায় গিয়ে কান খাড়া করে ছিলাম। আমাকে হতাশ করেছেন ওখানকার তরুণ সম্প্রদায়। একটিও কলকাতার অভ্যস্ত অশ্লীল শব্দ কানে আসেনি। উল্টে কয়েকজন প্রশ্ন করেছেন, রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে মিথ্যে গল্প সাজিয়ে যে-সব বই লেখা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বভারতী ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? জবাব দিতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথের গানকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করছেন এপার বাংলার শিল্পীরা, হয়তো দেখব রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে ছবি করতে গিয়ে অশ্লীল সংলাপ বলাবেন পরিচালকদের কেউ। আধুনিক হবেন।

১২

ঢাকার অশোক রায় নন্দীর সঙ্গে যখন চট্টগ্রামের উদ্দেশে প্লেনে উঠেছিলাম তখন ওই শহর সম্পর্কে স্পষ্ট কোনও ধারণা ছিল না। অশোক নামী প্রকাশক, ঢাকায় ওর ব্যবসা। বলেছিল, ‘বিকেলে পৌঁছে যেটুকু সময় পাব আপনাকে শহরটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব।’ চট্টগ্রামের নাম আমি প্রথম জানি, যখন মাস্টারদার জীবনী পড়ি। সেই বিখ্যাত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের কাহিনি পড়ে বাল্যকালে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। সূর্য সেন, প্রীতিলতার সংগ্রামের কথা জেনে বাঙালি হিসেবে গর্ব বোধ করেছিলাম। এর পরে একটা নদীর নাম শুনতে পেলাম, কর্ণফুলি, যা নাকি চট্টগ্রাম শহরের বুকের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে। তারপরে যেদিন এক বন্ধুর মা আমাকে প্রথম শুঁটকি মাছ রান্না করে খাওয়ালেন, সেদিন জানলাম চট্টগ্রাম শুঁটকির জন্যও বিখ্যাত। বিশেষ করে লইট্যা শুঁটকি। বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশি মালিকের ‘ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট’-এ গিয়ে জেনেছি তাঁদের কুক চাটগাঁর। আর এও জেনেছি যখন দুজন চট্টগ্রামের মানুষ পরস্পরের সঙ্গে কথা বলেন, তখন বাইরের বঙ্গসন্তানরা বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারবেন না। এই বিদ্যে নিয়ে মার্চের দুই তারিখে ঢাকার এয়ারপোর্ট থেকে অশোকের সঙ্গে প্লেনে উঠেছিলাম। চল্লিশ মিনিটের ওই যাত্রায় অশোক চোখ বন্ধ করেছিল বলে নতুন জ্ঞান আহরণ করতে পারিনি।

ঢাকায় গিয়েছি বহুবার, কিন্তু কখনওই চট্টগ্রামে যাওয়া হয়নি। দীপঙ্কর নামের এক বঙ্গসন্তান কলকাতায় ফোন করে বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে বলছি। এখানে আমার একটা বই-এর দোকান আছে, অনুগ্রহ করে যদি আপনি আসেন তাহলে আমরা খুব খুশি হব।’ এরকম প্রস্তাব প্রায়ই পেয়ে থাকি তাই প্রথমে যাওয়ার কথা ভাবিনি। কিন্তু ঢাকায় যাওয়ার পর ওদের বইমেলায় দাঁড়িয়ে অশোক বলল, ‘আমাদের মেলা আঠাশ তারিখে শেষ হচ্ছে। তারপর একদিনে আপনি আপনার যা কাজ শেষ করে আমার সঙ্গে দু’তারিখে চট্টগ্রামে চলুন।’

‘গিয়ে কী করব?’ আমি এড়াতে চেয়েছিলাম।

”আপনি তো পৃথিবীর অনেক জায়গায় গিয়েছেন। চট্টগ্রামের ‘বাতিঘর’-এর মতো বড় এবং অভিনব বই-এর দোকান আর কোথাও দ্যাখেননি, এটা আমি জোরের সঙ্গে বললাম।”

‘কী রকম?’

‘সেটা নিজের চোখে দেখবেন।’

বই-এর দোকানের নাম বাতিঘর শুনে ভাল লাগল। বাতিঘরের আলো তো একসময় সমুদ্রের জাহাজকে পথ দেখাত। অতএব আমি রাজি হলাম।

কলকাতা থেকে শিলিগুড়ির দূরত্ব ঢাকা-চট্টগ্রামের চেয়ে বেশি। গাড়িতে গেলে ঘন্টা সাতেক লাগে। হাতে সময় থাকলে মূর্খরাই প্লেনে ওঠে। মাটির ওপর দিয়ে গেলে প্রকৃতি ও মানুষের চেহারার বদলটাকে ভালভাবে দেখা যায়। যেহেতু আমাকে চার তারিখ সকালে কলকাতায় ফিরতে হবে তাই মাটির বদলে আকাশ দেখতে বাধ্য হলাম।

শহরের কাছাকাছি এসেই পাহাড়ের দেখা পেলাম। নিচে বড় নদীতে লঞ্চ, নৌকো ভাসছে। বুঝলাম ওই নদীর নাম কর্ণফুলি।

এয়ারপোর্টে আমাদের নিতে এসেছিল দুই তরুণ-তরুণী। একটু দেরি করে ফেলেছিল ওরা। মেয়েটি আমার পাশে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করলে সে নিজের পরিচয় দিল, ‘আমি সাংবাদিকতা করি। আমাদের যেতে ঘন্টাখানেক লাগবে। এই সময়ের মধ্যে আপনার ইন্টারভিউ নিতে চাই।’ সে তার নোটবুক আর কলম বের করল। মিনি রেকর্ডার খুলল।

কেউ ইন্টারভিউ চাইছে শুনলে আমি ভয় পাই। ভয় কারণ সেই বস্তাপচা প্রশ্নগুলো আবার শুনতে হবে। বোকা কথাগুলোর জবাব দিতে হবে। গত তিরিশ বছর ধরে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এই একই ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে। দু’হাজার সালে কলকাতায় যে প্রশ্ন করা হয়েছিল ঠিক সেই প্রশ্ন আমাকে শুনতে হয়েছে নিউ ইয়র্কে, দু’হাজার দশ সালে। অবশ্য প্রশ্নগুলো সাহিত্য বিষয়ক নয়। ওরা কেউ কাউকে চেনে না অথচ একই প্রশ্ন করে কী করে জানি না।

একটু রুক্ষ গলায় বললাম, ‘ওগুলো বন্ধ করুন ভাই।’

‘কেন?’ মেয়েটি অবাক চোখে তাকাল।

‘আমি প্রথমবার এখানে এলাম, জায়গাটাকে দেখতে চাই। কথা বললে দেখা হবে না।’

‘আপনি দেখতে দেখতে কথা বলুন।’ মেয়েটি হাসল।

‘আমি কী করব তা আমাকে ঠিক করতে দিন।’

‘আমি খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম—!’

‘মানুষ সব সময় আশা নিয়ে বাস করে।’

‘বেশ। শুধু একটি প্রশ্নের উত্তর দিন। মাধবীলতাকে মেয়েরা যতটা পছন্দ করে ছেলেরা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি পছন্দ করে। এখনও কালবেলা পড়ে ছেলেরা মাধবীলতার মতো মেয়েকে জীবনসঙ্গী করতে চায়। মেয়েরা অতটা ভক্ত নয়। মেয়েরা দীপাবলীর জন্য পাগল। সাতকাহানের দীপাবলী তাদের মনে শক্তি জোগায়। ছেলেরা আবার দীপাবলী সম্পর্কে একটু উদাসীন। এরকম কেন হল?’ মেয়েটি প্রশ্ন করে বড় চোখে আমার দিকে তাকাল।

এরকম প্রশ্ন আজকের আগে আমাকে কেউ করেনি। তবু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম, ‘বাঃ, এইরকম তথ্য আপনাকে কে দিল?’

এবার মেয়েটি হাসল, ‘সার্ভে করেই। করে জেনেছি। তার ওপর নিজে অনুভব করেছি।’

আমরা কথা বলতে শুরু করলাম। শহরে ঢোকার মুখে বুঝলাম ঢাকার সঙ্গে ওখানকার ট্রাফিকের কোনও পার্থক্য নেই। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। কিন্তু সে সবে মন নেই আমার। ‘দৌড়’ লিখেছিলাম পঁচাত্তর সালে। এই উনচল্লিশ বছরের যত উপন্যাস এবং তার চরিত্রগুলো, তাদের কারও কারও কথা আমি নিজেই ভুলে গিয়েছি। মেয়েটি তাদের ওপর নতুন আলো ফেলছে।

শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন শুনলাম, ‘মেয়েদের ঈর্ষাকাতর বলা হয়। অনেক ব্যাপারে তাদের মন ছোট হয়ে যায়। ভয়ঙ্কর পজেসিভ তারা। এই দিকটা আপনি তুলে ধরেননি। অথচ আপনার বেশিরভাগ উপন্যাসই নারী চরিত্রকেন্দ্রিক। কেন?’

হেসে বলেছিলাম, ‘বছরে একদিনই সূর্যে গ্রহণ লাগে। তিনশো চৌষট্টি দিনের কাছে একদিন কি গুরুত্ব পায়? বলুন ভাই।’

বাতিঘর-এ গিয়ে মেয়েটি কোথায় চলে গেল। পাঁচ হাজার মানুষের ভিড়ে ওকে দেখিনি। অশোক ঠিকই বলেছিল। বিশাল জাহাজের আকৃতিতে একটা বাংলা বই-এর দোকান, যা চট্টগ্রাম ছাড়া অন্য কোথাও দেখিনি। জাহাজের ডেকের দেওয়ালে বই-এর শেলফ। বাংলা অক্ষরগুলো বাক্যের প্রতিমা সাজিয়ে রয়েছে বইগুলোতে।

পরের সকালে ফেরার পালা। মেয়েটিকে দেখতে পেলাম। এগিয়ে এসে বলল, ‘একটা প্রশ্ন করব। মাধবীলতা কুমারী অবস্থায় অনিমেষের সন্তান গর্ভে ধারণ করে মা হয়েছিল। আপনার কোনও আত্মীয়া যদি কাজটা করত আপনি কি তাকে প্রশ্রয় দিতেন?’ চমকে উঠেছিলাম। আমার সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। বললাম, ‘যদি অনিমেষের মতো কেউ সঙ্গী হত তাহলে হয়তো মেনে নিতাম।’ মেয়েটি মাথা নাড়ল, ‘কে অনিমেষ, কে নয় তা বুঝবেন কী করে? কিন্তু দেখুন, বাঙালি পাঠক কী উদার, তারা মাধবীলতাকে ত্যাগ করেনি। গ্রহণ করেছে।’

১৩

নির্মলকুমারের সঙ্গে আজ সকালে ফোনে কথা বললাম। আমার সঙ্গে দেখা হলেই ভাল কথা ভালভাবে বলেন, বলার সঙ্গে বোঝা যায় মানুষটি অন্যদের চেয়ে আলাদা, এরকম মাত্র তিন বা চারজনকে জানি। নির্মলকুমার তাঁদের একজন। সেই মধু বসুর পরিচালনায় ‘শেষের কবিতা’ ছবিতে অমিত রায়ের চরিত্র করে তাঁর অভিনয়-জীবন শুরু হয়েছিল ষাট বছর আগে। এই সেদিনও কাজ করেছেন। আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় মানুষটির সঙ্গে কথা হলেই শুরু করেন। ‘এই যে! কী খবর?’ আপনি বলা বন্ধ করতে চেষ্টা করেছি, সফল হইনি।

নির্মলদাকে আজ অনুরোধ করেছিলাম একটা লেখা লিখতে, শ্যামবাজার পাড়ার থিয়েটার নিয়ে। যখন স্টার থিয়েটারে উত্তমকুমার সাবিত্রী চ্যাটার্জির ‘শ্যামলী’র মতো জনপ্রিয় নাটক বন্ধ হয়ে গেল শিল্পীদের, বিশেষ করে উত্তমকুমারের সময়ের অভাবের জন্য, তখন স্টার থিয়েটারের কর্তা সলিল মিত্র মশাই নতুন যে নাটকটি ধরলেন তা অনেকেরই সাহসে আসত না। এবং সেই নাটকের নামভূমিকায় অভিনয় করতে প্রস্তাব রাখলেন নির্মলকুমারকে। নাটকের নাম ‘শ্রীকান্ত’। প্রবীণেরা মনে করতে পারবেন স্টারের ‘শ্রীকান্ত’ কি বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বহু বছর ওই পাড়ায় নাটক করে নির্মলকুমার শ্যামবাজারি থিয়েটারটাকে জানেন। আর লেখালেখি তো ওঁর এককালের নেশা ছিল। তরুণ বয়সে গল্প লিখেছেন প্রথম শ্রেণির কাগজে। আমার প্রস্তাব শুনে হেসে উঠলেন নির্মলকুমার। বললেন, “ভাই সমরেশ, আপনি একটা কথা ভুলে গিয়েছেন।’

বুঝতে না পেরে জানতে চাইলাম, ‘কী রকম?’

‘আমার বয়স এখন অষ্টাশি। এখন নতুন কিছু করার একদম ইচ্ছে হয় না।’

‘কী ইচ্ছে হয়?’

‘বই পড়তে। কত বই পড়িনি। কত বই না পড়ে চলে যাব।’

‘আপনার শরীর এখন কেমন?’

‘ফার্স্টক্লাস! তপনদা চলে যাওয়ার পর ছবি করা ছেড়েছিলাম। তবু অনুরোধে কিছু ঢেঁকি গিলেছিলাম। আর নয়। এই লেক গার্ডেন্সের বাড়িতেই দিনরাত কেটে যাচ্ছে।’

‘শেষের কবিতা’ আমি দেখেছিলাম কলেজে পড়ার সময়, মুক্তির বহু বছর পরে। পঁচাত্তর সালে যখন ‘দেশ’ পত্রিকার চলচ্চিত্র সমালোচনার দায়িত্ব নিয়েছিলাম তখন নাট্যকার-অভিনেতা এবং আমার প্রিয় দাদা মনোজ মিত্র নির্মলদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। মানুষটাকে দেখেই মনে হয়েছিল একদম অন্যরকম। একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনি স্টুডিও পাড়ায় অভিনেতা হয়ে আসেন কিন্তু আপনাকে ঠিক মানায় না এখানে।’ নির্মলকুমার হেসেছিলেন, ‘ঠিক বলেছেন, আমি এখানে মিসফিট। পেটের দায়ে করে যাচ্ছি ভাই।’

ছাত্রাবস্থায় এখনকার মতো আবৃত্তিকারদের ভিড় ছিল না। তখন শম্ভু মিত্র, রাধামোহন ভট্টাচার্য, বিকাশ রায় এবং নির্মলকুমারই আবৃত্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। প্রথম দু’জনকে পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার ছিল, কলেজ ফাংশনে পরের দু’জনকে পাওয়ার চেষ্টা হত। এঁদের ঠিক পরেই নাম করেছিলেন কাজী সব্যসাচী। তখনও পার্থ ঘোষ বা প্রদীপ ঘোষরা পর্দার আড়ালে। সেই সঙ্গে ছিল এঁদের রেডিও নাটক। রেডিও নাটকে নির্মলকুমারের গলা এত পরিচিত ছিল যে শ্রোতারা সংলাপ শুনেই ওঁর নাম বলতেন।

তপন সিংহর সঙ্গে নির্মলকুমারের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। তপনবাবুর প্রায় সব ছবিতেই ওঁকে দেখা গিয়েছে। মনে আছে, আমরা যখন কিশোর তখন একটি ছবির বিজ্ঞাপনে লেখা হত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। নির্মলকুমার, কাবেরী বসু, সাবিত্রী চ্যাটার্জি অভিনীত ছবিটার নাম ছিল ‘দৃষ্টি’। গোপন সুখ পাব বলে গিয়ে দেখেছিলাম সে সব কিছুই নেই। শুধু দর্শক টানতে পরিবেশক ওই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। পরে বুঝেছি চিত্রনাট্যে ওসব থাকলে নির্মলকুমার নিজেই ছবিটিতে অভিনয় করতেন না।

একটা সময় ছিল যখন নায়ক-নায়িকার প্রেমকাহিনি, বাঙালির সংসারের গল্প ছাড়াও বিখ্যাত লেখকদের জনপ্রিয় উপন্যাস নিয়ে ছবি হত। তপন সিংহ এই ব্যাপারে অগ্রণী ছিলেন। বোধহয় তাঁর নিজের লেখা’ ‘গল্প হলেও সত্যি’, ছাড়া বেশিরভাগ ছবিই বিখ্যাত গল্পের চিত্ররূপ। কিন্তু সেই ছবি আলাদা মাত্রা পেত। ওই সময় তৈরি হয়েছিল এমন একটি ছবি যা অনেককেই চমকে দিয়েছিল বিষয় নির্বাচনের কারণে। ছবির নাম ‘কোন একদিন।’ একজন ট্যাক্সিচালক কলকাতার রাস্তায় সারাদিন ট্যাক্সি চালিয়ে বিভিন্ন যাত্রীর সমস্যার সঙ্গে কীভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে, তার উপর ছবি। ওই চালকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন নির্মলকুমার। অনবদ্য অভিনয়। জানি না ওই ছবির কোনও প্রিন্ট এখনও বেঁচে আছে কি না, থাকলে এখন দেখালেও পুরনো বিষয় বলে মনে হবে না।

প্রত্যেক মানুষের মনে না-পাওয়ার জন্যে অভিমান তৈরি হয়। কেউ সেটা প্রকাশ করে ফেলেন। এটা যাঁরা করেন তাঁদের নিয়ে আমার কিছু বলা উচিত নয়। যাঁরা করেন না, চুপচাপ বহন করে যান তাঁদের উপর শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। এইরকম একজন অভিনেতা ছিলেন অনিল চ্যাটার্জি। তাঁর স্নেহ আমি পেয়েছিলাম। নিয়মিত আড্ডা মারতাম। মাঝে কিছুদিন যোগাযোগ ছিল না। তখন আমি টেলিফ্রেম সংস্থার হয়ে টিভি সিরিয়াল তৈরি করাই। স্টুডিওতে যেতে হয়েছিল প্রয়োজনে, হঠাৎ কানে এল অনিলদার চিৎকার, ‘এই যে, এদিকে একটু তাকাবেন?’ ওঁর মুখে আপনি শুনে বুঝলাম কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। এগিয়ে যেতে সবাইকে শুনিয়ে বললেন, ‘আপনি আগে শিল্পী ছিলেন, এখন শিল্পপতি হয়েছেন, বাঃ বাঃ। খুব ভাল।’ অনেক চেষ্টায় তাঁর অভিমান কিছুটা তরল হল কাজের চাপ ইত্যাদির জন্যে সময় পাচ্ছি না বলে দেখা হচ্ছে না শুনে বললেন, ‘কেন, তোমার ফোনের লাইন কি কেটে দিয়েছে?’

অনিলদার মতো মানুষ অভিমান চেপে রাখতে পারতেন না। দারুণ স্কেচ করতেন, গলফক্লাবের বাড়ির বাইরের ঘরে বসে পান মুখে পুরে বলতেন, ‘কিছুই তো হল না।’ এঁদের বুঝতে পারি। কিন্তু যাঁরা প্রকাশ করেন না তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলেও তা প্রকাশ করতে বাধে। আমি আমার মতো আছি, তুমি তোমার মতো থাকো, আর কিছু চাই না বলে যাঁরা জীবনের অনেক গল্প বুকে নিয়ে আড়ালে চলে যান, তাঁদের মুখোমুখি বসতে ইচ্ছে হয়। মেরুর বরফের দেওয়ালের চেয়ে কঠিন তাঁদের আড়াল।

অর্ধশতাব্দীর বেশি অভিনয় করা নির্মলকুমার এখন দিব্যি তাঁর মতো বেঁচে আছেন। আদ্যোপান্ত ভালমানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছেন বাইরের জগৎ থেকে। রাতে ফোন করেছিলাম আবার। ফোন ধরলে বললাম, ‘আমি সমরেশ।’

‘এই যে! কী খবর?’ তাঁর গলায় হাসি।

‘কেমন আছেন দাদা?’

‘বেশ আছি।’

‘দাদা, আপনাকে নিয়ে একটা লেখা লিখতে চাই।’

‘ওরে ববাবা। না না। একদম না। আপনাকে হাতজোড় করে বলছি সমরেশ, আমাকে আর কোনও কিছুর সঙ্গে জড়াবেন না। আমি তো চুপচাপ আছি, তাই থাকতে দিন।’

নির্মলদা, আমি এই প্রথম আপনার অবাধ্য হলাম। মার্জনা করবেন।

১৪

প্রায় বারো দিন ভুটানের পাহাড়ের গা-ঘেঁষা চিলাপাতার জঙ্গলের গায়ে একটি প্রায় চুপচাপ চা-বাগানে অন্বিন্দুর অতিথি হয়ে ছিলাম। বাংলোর বাগানে ফুলে ফুলে রঙের ঢল নেমেছে। কাকে ফেলে কাকে দেখি! এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, সবেদা গাছগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে সূর্যকে আড়াল করে রাখে দিনভর। কাঁচা সবেদা ফলের গায়ে নখের দাগ, বাঁদরের। ওরা দেখে গিয়েছে, পাকলেই ফিরে আসবে। ওইসব গাছের তলায় চেয়ার-টেবিল পেতে কাটিয়ে ছিলাম বারোটা দিন। আমি যে মুঠোযন্ত্র ব্যবহার করি সেটা অর্ধমৃত। শুনলাম কাছাকাছি কোনও টাওয়ার ওকে জীবন দিচ্ছে না। কান না পাতলেও শুধু পাখিদের গলার স্বর ছাড়া আর যে শব্দটা শুনতে বাধ্য ছিলাম তা হাওয়ার এবং গাছের ডালের ফিচলেমির। ঝড় তো আসেনি যে শত্রুতা জমবে।

মাঝে মাঝে চা-কারখানায় ভোঁ বাজে। বেশ ধমকের মতো শোনায় সেই শব্দ। কাছাকাছি আর কোনও কোলাহল নেই। বাংলোর পরিচারিকা সময়মতো চা-জল দিয়ে যায়। শেষ যখন এসেছিলাম তখন দেখেছিলাম এদের মুখে হাসি লেগেই আছে। এবার কেন এত অন্ধকার? বড়জন বলল, ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে সাহেব। কী করব ভেবে পাচ্ছি না।’

বিস্তারিত জানলাম। তিন বছর আগে এজেন্ট এসেছিল ওদের কাছে। যেভাবে মাঝ আকাশে ডানা মেলেও শকুন ঠিক বুঝতে পারে জঙ্গলের কোথায় পশু মরেছে, জেনে তীব্র বেগে নেমে যায় খাবার খেতে, তেমনই এজেন্টরা বুঝতে পারে দারিদ্রসীমার নিচে কোনওরকমে বাস করা কোন মানুষের মনে দ্রুত টাকা বাড়াবার আকাঙক্ষা আছে। তিন বছরে দ্বিগুণ পাবে বলে এই সামান্যরা তাদের সঞ্চয় তুলে দিয়েছিল ওই শকুনদের হাতে। কেউ পাঁচ হাজার, কেউ বা দশ হাজার। এখনও এখানে বিশ-ত্রিশ হাজারে মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়। কবে এক হাজার পঁচানববুই দিন শেষ হবে তার হিসেব রাখছিল এরা। তারপরের কাহিনি শুধু বাংলা জুড়ে নয়, অসমে, ওড়িশাতেও। খাবার খেয়ে শকুনরা উধাও। তাদের আস্তানায় বারংবার হানা দিয়েও দর্শন মেলেনি। চটজলদি টাকা বাড়াবার স্বপ্ন অনেকটা রক্ত শুষে নিয়েছে শরীর থেকে। এখন এরা রোবটের মতো বেঁচে আছে। মাঝে মাঝে খবর আসে সেই সব শকুনদের কেউ কেউ অন্য শহরে মোটরবাইক হাঁকাচ্ছে। অর্থাৎ মওকা বুঝে দুঃসাহসীরা টাকাটা জমাই দেয়নি কোম্পানির ঘরে।

বললাম, ‘তোমরা কি জানো, মুখ্যমন্ত্রী পাঁচশো কোটি টাকার তহবিল থেকে কিছু কিছু তোমাদের ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এই কাজ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য একটি কমিশনও বসিয়েছেন। তাঁরা আবেদনপত্র চেয়েছেন যাতে সুবিচার করতে পারেন। তোমরা কি আবেদন করেছ?’

এ ওর মুখের দিকে চাইল। শেষ পর্যন্ত খবর নিয়ে এসে জানাল, খুব বড় কোম্পানিতে টাকা রেখে যারা নিঃস্ব হয়েছে, তাদের জন্য কমিশন বসেছে। ওরা রেখেছিল ছোট কোম্পানিতে, তাই তাদের জন্য কোনও সুখবর নেই। টাকা নিয়ে একটা সার্টিফিকেট দিয়েছিল ওই শকুনরা। ইংরেজি পড়তে না জানা লোকগুলো যত্ন করে রেখে দিয়েছে সেইগুলো। অনেক লেখার মধ্যে ছোট হরফে একটা লাইন রয়েছে, তিনবছর শেষ হয়ে গেলে মালয়েশিয়ার কুয়ালা লামপুরের এই ঠিকানায় গিয়ে সার্টিফিকেট দেখালেই দ্বিগুণ টাকা দিয়ে দেওয়া হবে।

পাসপোর্ট পেতে টাকা জমা দিতে হয়, সেই সঙ্গে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। তারপরে যদি ছোট্ট বইটি হাতে আসে, তা হলে প্লেনের টিকিট কাটতে কলকাতায় যেতে হবে। পাঁচ হাজারের বদলে দশ হাজার পেতে এরা যদি কুয়ালা লামপুরে পৌঁছয় তাহলে যে দেনা করে যাবে তা টাকাটা পেলেও শোধ করা যাবে না।

সার্টিফিকেট হাতে ধরে নিজেকেই ধিক্কার দিলাম। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই কাগজটি বিলিয়ে যখন টাকা তোলা হচ্ছিল, তখন প্রশাসন কী করছিল? ওই শকুনরা কি প্রশাসনকেও কিনে রেখেছিল? ওই ভয়ঙ্কর অপরাধ তখনই বন্ধ করলে অনেক মানুষ রক্ষা পেত। ধিক্কার দিচ্ছিলাম কারণ বিপদে পড়লে এই প্রশাসনের কাছেই তো আমাদের সাহায্যের জন্যে ছুটে যেতে হবে।

পরিচারিকারা চলে গেলে বিপরীত ভাবনা মাথায় এল। হ্যাঁ, মানলাম ওই শকুনরা অপরাধী, প্রশাসন চোখ বন্ধ করে বসেছিল। কিন্তু এই দরিদ্র মানুষগুলো তাদের কষ্টে উপার্জিত টাকা পোস্ট অফিসে বা ব্যাঙ্কে রাখেনি কেন? সুদ কম পাবে বলে তা মনে ধরেনি! অর্থাৎ লোভ তাদের মনে ছোবল মেরেছিল। নির্বোধরা ভেবেই দ্যাখেনি যে তিন বছরে ডাবল করে দেবে বলে যারা লোভ দেখাচ্ছে তারা যেমন অপরাধী, তেমনই সেটা নেওয়াটাও কম অপরাধ নয়। কোম্পানি ডুবে যাওয়ার আগে যারা দ্বিগুণ টাকা পেয়ে গিয়েছে তারা আনন্দে নেচেছে। সেই টাকাও তো আইনের চোখে অপরাধের টাকা। যে জেনেশুনে অথবা না জেনে অপরাধ করেছে, সে যতই কষ্ট পাক, তাকে সহানুভূতি দেখানো কি সঠিক কাজ? আমি যদি ওই পরিচারিকাদের ডেকে বলি, তোমরা অন্যায় করেছিলে, লোভ তোমাদের এমন অন্ধ করেছিল যে সার্টিফিকেটটা নিয়ে কোনও ইংরেজি জানা লোককে পড়তে বলোনি, পাছে সে তোমার টাকা জমানোর কথা জেনে যায়, তাই তুমি শাস্তি পেয়েছ, শাস্তিটাকে মেনে নাও। আবার নতুন করে ব্যাঙ্কে বা পোস্ট অফিসে টাকা জমাও।

চিলাপাতার জঙ্গলে কয়েকশো বছর আগে নল নামের এক রাজা দুর্গ তৈরি করেছিলেন। যার নাম এখন নলরাজার গড়। সেই দুর্গ প্রায় ধবংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এক বিকেলে অন্বিন্দু তার জিপসিতে চাপিয়ে আমাকে নিয়ে গেল সেখানে। পিচের পথ থেকে জঙ্গলের গভীরতম অঞ্চলে অসমান রাস্তা দিয়ে যেখানে জিপসি থামল, সেখানে বিকেল চারটেতেই ঘন ছায়া। সরু ইটের ধবংসস্তূপটি চোখে পড়ল। বাঁ, ডান এবং সামনের জঙ্গলে নিস্তব্ধতা। এই জঙ্গলে প্রচুর হাতি এবং বাইসন ঘুরে বেড়ায়। আমরা তাদের আওতায় চলে এসেছি। কীরকম গা-ছমছম ভাব। ভাঙা ইটের স্তূপে সাপেদের রাজত্ব। অন্বিন্দু একটা গাছ দেখাল। খোঁচা দিলেই যে রস বের হয়, তা দেখতে হুবহু রক্তের মতো। এই গাছের কথা কখনও শুনিনি। চারপাশে হাতির বিষ্ঠা। হঠাৎ একটা চালতে গাছ দেখতে পেলাম। নিচে প্রচুর চালতে ছড়িয়ে আছে। অন্বিন্দু জানাল, চালতে নাকি হাতির প্রিয় ফল। আমাদের ড্রাইভার দু’হাত দিয়ে চালতে কুড়িয়ে নিচ্ছিল। হঠাৎ ওপাশের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে আওয়াজ ভেসে এল। কেউ বা কারা বিরক্ত হয়ে এগিয়ে আসছে। ভয় পেয়ে দৌড়ে ফিরে এল ড্রাইভার। দর্শন পাওয়ার আগেই ফার্স্ট গিয়ার, সেকেন্ড গিয়ার, থার্ড গিয়ার।

এই ভয়টা যদি ওই পরিচারিকারা টাকা জমা দেওয়ার আগে পেত, বা কেউ পাইয়ে দিত!

১৫

গল্পটি শুনেছিলাম বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ স্বর্গীয় ভোলা চক্রবর্তীর মুখে। ওঁর চেম্বারে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করার সুবাদে আমাকে স্নেহের চোখে দেখেছিলেন তিনি। বেঁচে থাকতেই কিছু মানুষ কিংবদন্তি হয়ে যান, ভোলা চক্রবর্তী তাঁদের একজন। হাওড়ায় থাকতেন। পার্ক স্ট্রিটের পাশে তাঁর চেম্বার। এরকম মানুষ রাশভারী হবেন, কম কথা বলবেন, এমন ধারণা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দিনের পরে বুঝলাম উনি খুব সহজই নন, অত্যন্ত রসিক।

একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘দীর্ঘকালের কিছু অভ্যেস, যা সাধারণত ক্ষতি করে বলে ধারণা চালু আছে, তা ডাক্তাররা বন্ধ করতে বলে থাকেন। তাতে কীরকম উপকার হয়?’

ভোলা চক্রবর্তী বলেছিলেন, “প্রত্যেক মানুষের শরীরের গঠন এক হলেও তাদের বিভিন্ন অংশের সহ্য ক্ষমতার পার্থক্য আছে। একটা মোটা উদাহরণ দিচ্ছি, কেউ কড়া ঝাল দিব্যি উপভোগ করে, কারও জিভ তার সামান্য সহ্য করতে পারে না। কিন্তু অনেক মানুষের উপর প্রয়োগ করে তার ফল দেখে রোগ অনুযায়ী ওষুধ নির্বাচন করা হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে শোনা যায় যে ওষুধ খেয়ে একজনের খুব উপকার হয়েছে, তা অন্যজনের ক্ষেত্রে তেমন কোনও কাজই করেনি। তাই বলে আমরা তো সেই ওষুধটাকে বাতিল করি না।”

বললাম, ‘খারাপ অভ্যেসের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী প্রতিক্রিয়া দেখেছি। সিগারেট শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর স্লোগান শেষপর্যন্ত সরাসরি বলছে সিগারেট থেকে ক্যানসার হয়। স্মোকিং কিলস। সিনেমায় কোনও চরিত্র যদি সিগারেট খায় তাহলে সেই দৃশ্যের নিচে কথাগুলি না লিখে দিলে সেন্সরবোর্ড ছবিটিকে আটকে দেবে। কিন্তু আমি একজন আশি বছরের বৃদ্ধকে নিয়মিত প্রতিদিন দশটা সিগারেট খেতে দেখেছি এবং সেটা তিনি ষাট বছর ধরে খেয়ে আসছেন। উনি এখনও নিয়মিত বাজার যান।’

ডাক্তার চক্রবর্তী হেসে বলেছিলেন, ”এটা একেবারেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা।”

“একটা গুজব চালু ছিল। গুজব বলছি, কারণ এর সত্যাসত্য জানি না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তির সর্বাধিনায়ক ছিলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। তিনি নিয়মিত লম্বা চুরুট খেতেন। যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স আশি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ তিনি একটু অসুস্থ হলেন। জ্বর এবং অন্যান্য উপসর্গ দেখা গেল। সমস্যা হল, সেইদিনই প্রধানমন্ত্রীর পারিবারিক ডাক্তার আগাম ছুটি নিয়ে লন্ডনের বাইরে গিয়েছিলেন। তাঁর জুনিয়ার খবর পেয়ে চার্চিল সাহেবকে দেখতে এল। ছেলেটির বয়স কম, প্রধানমন্ত্রীকে দেখে প্রেসক্রিপশন করার সুযোগ পেয়ে খুব নার্ভাস, পরীক্ষা করার পর ওষুধের নাম লিখে সে খুব বিনীত গলায় বলল, ‘স্যর, আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে একটা কথা বলতে চাই।’

বিছানায় শুয়ে থাকা চার্চিল সাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন।

তরুণ ডাক্তার সবিনয়ে বলল, ‘স্যর, আপনি যদি ধূমপান বন্ধ করেন তাহলে দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন। নাহলে আরও ক্ষতি হতে পারে।’

‘কীরকম?’ চার্চিল সাহেব জানতে চাইলেন।

‘আপনার ফুসফুসের ক্ষতি হচ্ছে, হার্টের উপর চাপ পড়বে।’

‘ও। ধূমপান বন্ধ করলে আমি আর এক বছর বেঁচে থাকব তো? বেশ, আমি তোমার কথা শুনব। এক বছর যদি বেঁচে থাকি তাহলে তোমাকে এক হাজার পাউন্ড দেব। আর যদি তার আগে মরে যাই তাহলে তুমি আমার উত্তরাধিকারীকে ওই পাউন্ড দেবে। রাজি আছ তো?’ ছেলেটি মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল। রাজি হতে পারেনি।

এই শোনা গল্পটিকে গুজব বলেন কেউ কেউ। কিন্তু সেইসঙ্গে বলা হয়, ‘সবাই চার্চিল সাহেব নন। একশোজনের মধ্যে সাড়ে নিরানববুই জন ধূমপানের কারণে ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়। হার্টের সমস্যা বাড়ে এবং কেউ কেউ ক্যানসারের কবলে পড়ে। অতএব ওটা বর্জনীয়।” তখন রোগী দেখা শেষ হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ হাসতে হাসতে বললেন, “আমার পেশেন্ট ছিলেন জ্যোতি বসু। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী।”

‘উনি হোমিওপ্যাথিতে আস্থা রেখেছিলেন?’

”হ্যাঁ। ওঁর হজমের সমস্যা ছিল। ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রম। আমার ওষুধ খেয়ে ভাল থাকতেন। কিন্তু ওঁর শুভানুধ্যায়ীরা ওঁকে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা করাতে বললেন। তাতে সমস্যাটা একদম দূর হয়ে যাবে। আমাকে বলা হলে বললাম, বেশ তো!

তারপর বেশ কিছুদিন যোগাযোগ ছিল না। হঠাৎ ফোন পেলাম। মুখ্যমন্ত্রী আমাকে তাঁর বাড়িতে যেতে অনুরোধ করেছেন। জানালেন, তিনি খুব অসুস্থ। এখনই যেন তাঁর চিকিৎসা শুরু করি। বারবার বললেন।

আমি গেলাম। গিয়ে যে চিকিৎসা চলছে তার প্রেসক্রিপশন দেখলাম। কোনও ভুল নেই, সঠিক ওষুধ যা অ্যালোপ্যাথিতে দেওয়া যায় তাই দেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, সকালে ঘুম থেকে উঠে রাত্রে শুতে যাওয়া পর্যন্ত আপনি কী কী খাবার খাচ্ছেন?

মুখ্যমন্ত্রী যা বললেন তা সবই সহজপাচ্য, আদৌ মশলা দেওয়া খাবার নয়। হজমে গোলমাল যাঁদের হয় তাঁরা ওই খাবারই খেয়ে থাকেন। খুব চিন্তায় পড়লাম। শেষপর্যন্ত মনে এল। জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা, আপনি কি সন্ধ্যার পান বন্ধ রেখেছেন?

উনি মাথা নাড়লেন, ‘একদম বন্ধ, ডাক্তার অনুমতি দেননি। বলেছেন পান করলে আরও ক্ষতি হবে।’

আমি আমার ওষুধ লিখে দিলাম। তারপর বললাম, আজ থেকে আপনি সন্ধ্যায় এক পেগ খেতে পারেন। কিন্তু পরে দুই-এর বেশি উঠবেন না।

উনি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খেতে পারব?’

অবশ্যই।

দিন তিনেক পরে টেলিফোন পেলাম। ভাল আছেন। অনেক ভাল।” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সেকি? এটা সম্ভব?’

ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, “একজন মানুষ পঞ্চাশ বছর ধরে নিয়ম করে সামান্য পান করে আসছেন। তাঁর শরীরের ভিতরের সব যন্ত্র এর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ যদি সেটা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে শরীর তো ক্ষুব্ধ হবেই। সিস্টেমে পৌঁছে গিয়েছে ওটা। আমি সেটা চালু করেছিলাম মাত্র। পরিমিত পানে শরীরের ক্ষতি হয় না।”

‘কিন্তু এটা তো অন্য বার্তা দেবে’! ডাক্তারবাবু বললেন, “যে কোনও খাবার পরিমিত হলে হজম করা যায়, বাঁধনছাড়া হলে তা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। যে কখনও পান করেনি তাকে আমি বয়স বাড়লে পান করতে উপদেশ দেব না। তাঁর শরীর নিতে পারবে না।”

শুনেছি, নীরদ চৌধুরি মশাই ওয়াইন-ভক্ত ছিলেন। শতবছর পূর্ণ হলেও অভ্যেস ছাড়েননি। এই বিরল ব্যাপারগুলো সত্যি বিস্ময় বাড়িয়ে দেয়।

১৬

কিছু কিছু লেখক ছিলেন এবং এখনও আছেন যাঁরা বছরের পর বছর লিখে চলেছেন, প্রায় প্রতি মাসেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁদের গল্প ছাপা হয়, কোনও কোনও নববর্ষ সংখ্যায় উপন্যাসও। এঁরা যখন লিখতে শুরু করেছিলেন, সেই আঠাশ তিরিশ বছর বয়সে, তখন এঁদের তরুণ লেখক বলা হত। নাট্যাচার্য, নটসূর্য, যাত্রাসম্রাট ইত্যাদি উপাধির মতো ‘তরুণ লেখক’ও যে উপাধি হয়ে উঠতে পারে তা জানা ছিল না। এঁরাও জানতেন না। পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েও যখন বিজ্ঞাপন বা আলোচনায় এঁদের নামের আগে তরুণ লেখক শব্দ দুটো এক করে ব্যবহৃত হয় তখন ওঁদের মন পছন্দ করে না কিন্তু আপত্তিটা মুখ দিয়ে বের হয় না। সবাই জানি, তরুণ লেখক তাঁকেই বলা হয় যাঁর মধ্যে পাঠক-সম্পাদক বড় লেখক হওয়ার সম্ভাবনা যেমন দেখেন, তেমনই তিনি বয়সেও নবীন। আমাদের শংকরদা, মণিশংকর মুখোপাধ্যায় অল্প বয়সে কত অজানারেলিখে খ্যাতি পেয়েছিলেন। তারপর তাঁকে পিছনে তাকাতে হয়নি। প্রফুল্লদা, প্রফুল্ল রায় মাত্র উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে অনবদ্য উপন্যাস ‘পূর্বপার্বতী’ লিখেছিলেন। দেখা গেল ওঁদের লেখা পড়ার জন্য পাঠক তৈরি হয়ে গিয়েছে। তখন আর ওঁদের তরুণ লেখক বলা হত না। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের শ্রেণিতে পৌঁছে দেওয়া হল যৌবনের শুরুতেই।

আমরা যখন লিখতে শুরু করেছিলাম এরকম বয়স্ক তরুণ লেখক অনেকেই ছিলেন বেশ ভাল লিখতেন। তাঁরা বহু বছর ধরে পত্রিকার সম্পাদককে সাহায্য করতেন পাতা ভরানোর কাজে। বিমল করকে ঘিরে লেখকদের যে আড্ডা বসত তাতে নিয়মিত হাজিরা দিতেন এঁরা। দেশ-আনন্দবাজারে প্রচুর লিখেছেন কিন্তু পাঠকরা এঁদের কোনও গল্পের নাম মনে রাখতে পারতেন না। মনে রাখতে হবে, এঁদের কেউ তথাকথিত আঁতেল ছিলেন না, সহজ স্বাভাবিক মানুষের মতো আন্তরিক ছিলেন। আমি অবাক হতাম। কেন এঁদের লেখা পাঠক গ্রহণ করছেন না! পাঠক কোন লেখকের লেখা পড়তে চান তার খবর সবচেয়ে আগে রাখেন প্রকাশকরা।

বই প্রকাশ করা প্রকাশকদের ব্যবসা। ব্যবসা করে কোন মূর্খ ঘরের টাকা জলে ফেলতে চাইবেন। প্রকাশক চাইবেন লেখকের বই ছেপে লাভ করতে। অন্তত আট সাড়ে আটশো বই বিক্রি হয়ে গেলে খরচের টাকা ফেরত আসে। সেইটুকু যদি এক বছরে বিক্রি হয় তাহলে পরের বছরে যা পাঠক কিনবে তাই লাভ হিসেবে ঘরে আসবে। অতএব প্রকাশক সেই লেখককে খোঁজেন যাঁর বই অন্তত আট সাড়ে আটশো বিক্রি হবেই। যাযাবর বা অবধূত তো সবাই নন যে প্রথম বই ছাপা মাত্র হইহই করে বিক্রি হবে। ওঁদের খুঁজে পাওয়া মানে প্রকাশক গুপ্তধন পেলেন, কিন্তু তাঁকে ব্যবসা চালাতে হবে। প্রতিষ্ঠিত লেখক, যাঁদের বই বছরে কয়েক হাজার বিক্রি হয় তাঁদের হিমশিম খাওয়ার মতো অবস্থা। বয়স বাড়ছে, একের পর এক চলেও যাচ্ছেন। তাই নতুন লেখক না-দাঁড়ালে সমস্যায় পড়বেন প্রকাশকরাই।

অতএব সারা বছরই তাঁরা খোঁজ করেন তরুণ লেখকরা কে কীরকম লিখছেন। আমি প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বললাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনারা সুযোগ দিচ্ছেন না কেন?’

‘কী করে দেব বলুন? আমাদের দোকানে বা বইমেলার স্টলে যাঁরা বই কিনতে আসেন তাঁদের প্রশ্ন করি নতুন কোন লেখকের লেখা পত্রিকায় পড়তে ভাল লাগে? বেশিরভাগই মনে করতে পারেন না। কেউ কেউ অবশ্য নাম বলেন, আমরা যাঁর নাম পাঠক বেশি করেছেন, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। জানতে পারি ইতিমধ্যে দু’জন ছোট প্রকাশক তাঁর গল্প বা উপন্যাস ছেপেছেন। কীরকম বিক্রি হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে লেখক বললেন, ‘খুব ভাল, আমার পরিচিতরা অনেক বই কিনেছেন কিন্তু প্রকাশক চেপে যাচ্ছেন। বলছেন, কিছুই বিক্রি হয়নি। আপনারা বড় প্রকাশক বলে ভরসা রাখছি।’ কোন বই কীরকম বিক্রি হচ্ছে তার খবর বাইন্ডারের কাছে পাওয়া যায়। জানলাম প্রথম বাঁধাই-এর একশো এখনও শেষ হয়নি। বলুন, কী করে আবার ওঁর বই ছাপি?’

কেন এটা হচ্ছে? বিমল কর একটা সুন্দর কথা বলেছিলেন, ‘দ্যাখ ওরা খারাপ লিখছে না, খুব চেষ্টা করছে কিন্তু লেখাগুলো দাঁড়াচ্ছে না।’ ছোটগল্প তবু ভাল কিন্তু উপন্যাসে পাঠক খুশি হচ্ছে না কারণ রান্না যেমন নুন ছাড়া খাওয়া যায় না, আলুনি লাগে তেমনই ওদের লেখায় সেই নুনটাই নেই।

অথচ তুলসী সেনগুপ্ত, নিখিলরঞ্জন সরকার, সত্যেন্দ্র আচার্য বা প্রলয় সেনরা লেখার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ছিলেন। এঁদের কোনও দল ছিল না। কিন্তু এই ধরনের কিছু লেখক দল তৈরি করে নিয়েছিলেন। কফি হাউসে তাঁদের নিয়মিত আড্ডা হত। নিজেদের লেখা প্রচারিত করার জন্যে চমকপ্রদ ক্যাপশন আবিষ্কার করেছিলেন। মনে আছে রমাপদ চৌধুরী মশাই উদ্যোগ নিয়েছিলেন এইসব লেখকদের পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে। প্রতি বছর বড় কাগজের শারদীয়া সংখ্যায় একজনের পর একজনের উপন্যাস ছেপে গিয়েছেন তিনি। একমাত্র সুচিত্রা ভট্টাচার্য ছাড়া আর কাউকে পাঠক গ্রহণ করেনি।

এক সময়, এই তিরিশ বছর আগেও বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার সুযোগ কোনও তরুণ লেখক পেলে ধন্য হয়ে যেতেন। প্রথমে সাপ্তাহিক পরে পাক্ষিক সেই পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস লেখা মানে পাঠকের মনের অন্দরমহলে চলে যাওয়ার সুযোগ। কিন্তু গত চব্বিশ বছর ধরে একমাত্র তিলোত্তমা মজুমদার ছাড়া আর কেউ ওই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারলেন না। এখন ওখানে কে ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছেন তার খবরই অনেকে জানেন না, উপন্যাস পড়া তো দূরের কথা। মান নিম্লমুখী হলে আগ্রহ থাকে না।

আমার সমসাময়িক এক তরুণ লেখকের লেখা বিভিন্ন কাগজে নিয়মিত ছাপা হত। বিশ্বসাহিত্যের তাবড় লেখকদের লেখা পড়ে ফেলেছে সে কথা বললে সে সব শুনে মুগ্ধ হতে হয়। তাকে নিয়ে গেলাম কলেজ স্ট্রিটের একজন বড় প্রকাশকের কাছে। বললাম, ‘এই তরুণ লেখকের উপন্যাস ছাপুন।’ আলাপ হওয়ার পরে প্রকাশক বললেন পাণ্ডুলিপি দিয়ে যেতে। কিন্তু সেই রাতে প্রকাশক আমায় ফোন করলেন, সমরেশবাবু, আপনার সঙ্গে আমি তো কখনও খারাপ ব্যবহার করিনি। আমার ক্ষতি হোক কেন আপনি চাইছেন? আমি ওদের বন্ধু লেখকদের কয়েকটা বই ছেপেছি। কোনওটাই দুশোর বেশি বিক্রি করতে পারিনি।

পয়লা বৈশাখের বিকেলে কলেজ স্ট্রিটের বই উৎসবে গিয়ে কথাগুলো মনে এল। সেই সময়ের তরুণ লেখকরা এখন কোথায় হারিয়ে গিয়েছেন। তাঁদের জায়গা নিয়েছে একঝাঁক নতুন লেখক। কিন্তু তাদেরও তো লেখালেখির বয়স দশ বছর হয়ে গেল। একমাত্র প্রচেত গুপ্ত ছাড়া আর কেউ পাঠকের ভালবাসা পেলেন না। কেন এমন হচ্ছে? বাংলা বই-এর বিক্রি পড়ে যাচ্ছে, বাংলা বই-এর পাঠক নেই, এই কথাগুলো যত শুনছি তত মনে হচ্ছে বাংলা বই-এর লেখক কোথায় যে বিক্রি হবে? যা হচ্ছে তার আয়ু বেশিদিন নয়। একজন তিলোত্তমা বা প্রচেতর পাশে আরও লেখক দরকার যাদের উপর আমৃত্যু ‘তরুণ লেখক’ ছাপটা থাকবে না।

১৭

মানিকতলার মোড়ে অনেকক্ষণ আটকে থাকতে হয় বলে রামমোহন লাইব্রেরির উল্টোদিকে সুকিয়া স্ট্রিটে গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়েছিল ড্রাইভার। তার ইচ্ছে সোজা কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ধরে শ্যামবাজারে যাবে। বহুকাল ওই পথে যাইনি। সন্ধে সবে পার হয়েছে, ঝমঝমিয়ে অনেক কথা মাথায় এসে যাওয়ায় ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললাম।

গাড়ি থেকে নেমে চারপাশে তাকালাম। ওই পাড়াতেই কলকাতায় পড়তে এসে একটা বছর ছিলাম। ওই যে ডানদিকের রাস্তা যার নাম আশুতোষ শীল লেন, সেটা ধরে খানিকটা গেলেই রামানন্দ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে পা দিতে হবে। ঠিক সেই মোড়ের ডানদিকে ছিল আমাদের হস্টেল টমোরি মেমোরিয়াল হস্টেল। স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্রদের থাকার হস্টেল। নিশ্চয়ই টমোরি নামের কোনও সাহেবের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে নামকরণ করা হয়েছিল। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে তার বাঁদিকের রাস্তাটার নাম বিদ্যাসাগর স্ট্রিট। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের বাড়ি। হস্টেলের দ্বিতীয় দিনে সেই বাড়ি দেখতে গিয়ে পুলকিত হয়েছিলাম। তখন আমার সতেরো বছর বয়স।

চারপাশে তাকালাম। মোটামুটি একই চেহারায় রয়েছে পাড়াটা। আশুতোষ শীল লেনের মুখের বাড়িতে কাজলদি থাকতেন। স্কটিশে আমাদের চেয়ে দু’বছরের সিনিয়র। মুখটা মনে এল। ফর্সা, বড় চোখ। আলাপ হওয়ার পরেই বলেছিলেন, ‘তুই আমাদের পাড়ায় উঠেছিস? রোববারের সকালে চলে আসবি, জলখাবার খেয়ে যাবি।’ হোক বয়সে বড়, সেই প্রথম কোনও মহিলা আমাকে তাঁর বাড়িতে ডেকেছিলেন। কাজলদির খবর জানি। ওই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন বিয়ের পরে। শুনেছি খুব অসুস্থ তিনি। বাড়িটার দিকে তাকাতেই কাজলদির হাসি মনে চলে এল।

আশুতোষ শীল লেনে ঢুকলাম। এই গলির প্রায় সব বাড়ির মানুষদের ওই এক বছরে চিনে ফেলেছিলাম। আশ্চর্য, এখন কারও নাম মনে পড়ছে না। বাঁদিকে একটি প্রতিবন্ধী ছেলে থাকত। হাঁটতে অসুবিধে হলেও সে তোয়াক্কা করত না। আমার চেয়ে বয়সে ছোট হওয়া সত্ত্বেও দেখা হলেই বকর বকর করত। কী যেন নাম? আঃ!

আর একটু এগোতেই বীরুদের বাড়িটা দেখলাম। এই নামটা তো ভুলিনি, বাড়িটাকে দেখেই মনে এল। বীরু এবং ওর বোন কেয়া। প্রায়ই এই বাড়িতে আসতাম। বীরুর মা যখন-যা পেরেছেন খেতে দিতেন। বীরু কেয়াকে নিয়ে আমার হস্টেলেও যেত। হস্টেলে মেয়েদের ঢোকা নিষেধ থাকা সত্ত্বেও ছয় বছরের কেয়াকে কেউ বাধা দিত না।

দরজা খোলা। প্যাসেজের শেষে আর একটা দরজা, যার ফাঁক দিয়ে আলো বেরিয়ে আসছে। প্রথম দরজায় কড়া নাড়লাম। তিনবারেও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দিল না। বীরুর এক দাদার ব্যবসা ছিল সার্কুলার রোডে। কী যেন নাম? মনে পড়ল না। আমি পাশের জানলায় গেলাম। সেখানে মধ্য তিরিশের একজন বসে আছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বীরুরা নেই বাড়িতে?’

‘কে বীরু?’ ভদ্রলোক অবাক হলেন।

‘আপনার পাশের বাড়িতে থাকে। বীরু, কেয়া।’

‘কাদের কথা বলছেন জানি না। আমরা বছর বারো এখানে আছি। আপনি এখানে শেষ কবে এসেছেন?’ ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন।

আমি বছর গুনলাম। বললাম, ‘তেপ্পান্ন বছর আগে।’

‘তাই বলুন! এতদিন কেউ থাকে!’

‘তার মানে?’

‘এখন মনে হচ্ছে আপনি যাদের খোঁজ করছেন তাঁরা অনেক আগে এই বাড়িতে থাকতেন। একটু দাঁড়ান, আমাদের এখানে যে কাজ করে সে বহুকাল পাড়ায় আছে, তাকে জিজ্ঞাসা করে আসছি।’ ভদ্রলোক ভেতরে চলে গেলেন।

আমরা কথা বলছিলাম জানলার দু’পাশে দাঁড়িয়ে। ভদ্রলোক কী বললেন? এতদিন কেউ থাকে! বীরু আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট ছিল। পঁয়ষট্টি বছরের কোটি কোটি মানুষ পৃথিবীতে কাজ করে যাচ্ছে।

ভদ্রলোক ফিরে এলেন, ‘সরি। বীরুর মৃত্যু আগে হয়েছিল। ওঁর মা তার পরে। বোনেদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কে কোথায় জানা যাচ্ছে না। ওরা আপনার কেউ হয়?’

আমি অসাড় হয়ে গেলাম। কোনওমতে মাথা নাড়লাম, যার মানে, হ্যাঁ হয়। সরে এসে বাড়িটার দিকে তাকালাম। এই বাড়িতে একসময় যাঁরা ছিলেন তাঁদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল আমার। বীরুর মা প্রায় আমার মায়ের ভূমিকা নিয়েছিলেন। গেলেই কিছু না কিছু খেতে দিতেন। এখন বাড়িটা আছে, ওঁরা কেউ নেই, পৃথিবীর অনেক অদল বদল হয়েছে। যদিও আমার মনে ওঁরা এতকাল একই জায়গায় ছিলেন। আমারও যে বয়স বেড়েছে, শরীরের পরিবর্তন হয়েছে, তেমন করে অনুভব করিনি কখনও। বহুকাল ধরে আমি একই জীবনযাপন করে চলেছি। আমার মনের বয়স বাড়তে এখন এই মুহূর্তে একটুও কষ্ট পেল না।

মোড়ের মাথায় এসে চমকে উঠলাম। আমাদের হস্টেলের জায়গায় একটা বহুতল বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একই কলকাতায় থেকেও জানতাম না হস্টেলটা আর নেই। হস্টেলের উল্টোদিকের বাড়িতে অরূপদারা থাকত। কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি। ওঁর মৃত্যুর খবর আমি জানি। শুনলাম বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেছে। পাশের বাড়িটা এখন আগের থেকে ঝকঝকে। ওই বাড়ির মেয়ের নাম ছিল অরুণা। তাকে বিরক্ত করার জন্য আমাদের হস্টেলের ছেলে আশিস খুব ধমক খেয়েছিল সুপারের কাছে। সেই আশিস এখন কোথায় জানি না। মনে হচ্ছিল আমি একটা শ্মশানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। ওই যে জলের কলের বাড়িটা, ওখানেও খুব রাগী এক ভদ্রলোক থাকতেন। রাস্তা দিয়ে আমাদের যেতে দেখলেই মেয়েকে গম্ভীর গলায় বলতেন, ‘জানলা থেকে সরে এসো।’ ভদ্রলোকের এখন আর থাকার কথা নয়। ইতস্তত পায়ে ওই বাড়ির সামনে পৌঁছতেই দেখলাম একজন প্রৌঢ়া জানলার ওপাশে দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছেন। মাথা ভর্তি পাকা চুল। চোখাচোখি হতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিছু মনে করবেন না, এই বাড়িতে চন্দনা আর ওর বাবা থাকতেন। তাঁরা কি আছেন?’

প্রৌঢ়ার মুখে বিস্ময় স্পষ্ট হল। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কে?’

‘আমি ওই হস্টেলে থাকতাম।’

‘বাবা নেই। অনেক বছর হয়ে গেল। আমি চন্দনা। আপনি কি পঞ্চাশ বাহান্ন বছর আগে থাকতেন?’ প্রৌঢ়া জিজ্ঞাসা করলেন।

‘হ্যাঁ’।

‘মনে হচ্ছিল আপনাকে আগে দেখেছি।’ প্রৌঢ়া ভেতরে চলে গেলেন।

বাড়ি ফিরে নিজেকে আয়নায় দেখলাম। পঞ্চাশ বছর আগের যেসব ছবি আমার আছে তার সঙ্গে একটুও মিল নেই। অথচ চন্দনা, মানে ওই প্রৌঢ়া এমন অসত্য বলবেন কী করে? তার পরেই মনে হল, অসত্য কেন ভাবছি! সত্তর বছরের মহিলাকে যাঁরা নাম ধরে ডাকতেন তাঁদের তো এখন বেঁচে থাকার কথা নয়। আমার মতো ওঁরও মা তাই পঞ্চাশ বছর আগে চলে গিয়েছিল!

১৮

আজ দুপুরে টেলিভিশনে খবরটা দেখে আমার মনে হল পশ্চিমবঙ্গে অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে থাকে, তার তালিকায় আর একটি সংযোজিত হল। প্রবীণ অভিনেতা, যিনি এখন কলকাতার শেরিফ, লোকসভার নির্বাচনে ভোট দিতে বুথে গিয়ে জানতে পারলেন ভোটার লিস্টে তাঁর নাম নেই। নাম না থাকায় তাঁকে ভোট দিতে দিলেন না প্রিসাইডিং অফিসার। অনেক সাধারণ মানুষের এই অভিজ্ঞতা আছে। সেটা খবর নয়। কিন্তু কলকাতার শেরিফের নাম ভোটার লিস্টে নেই, তাঁর ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই, এটাই হল খবর।

রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে আমার খুব সুসম্পর্ক। আমার পরিচিত যে ক’জন অতি সুজন মানুষ আছেন তিনি তাঁদের একজন। দীর্ঘ দুই মাস বিদেশে একসঙ্গে থেকে দেখেছি তাঁকে। তিনি কলকাতার শেরিফ হয়েছেন জেনে খুশি হয়েছিলাম। টেলিভিশনে খবরটা দেখানোর পর কয়েকটা ফোন পেলাম। যাঁরা করেছেন তাঁরা ওঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা জানেন। প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘আচ্ছা, রঞ্জিত মল্লিক কলকাতার শেরিফ হয়েছেন, আপনি জানতেন?’ জানতাম বললে প্রশ্ন এল, ‘কিন্তু এখন এই শেরিফ পদটিতে যিনি থাকেন তাঁর কাজ কী?’ আমি সমস্যায় পড়লাম। ‘রঞ্জিত মল্লিককে ফোন করে জিজ্ঞাসা করা যায় না শেরিফ হিসেবে আপনি কী কী কাজ করে থাকেন? আমার খুব প্রিয় মানুষ ডাক্তার আবিরলাল মুখোপাধ্যায় শেরিফ ছিলেন। মৃণাল সেন, চুনী গোস্বামী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও কলকাতার শেরিফ করা হয়েছিল। আমি জবাব দিতে পারিনি। সুনীলদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, উনি হাত নেড়ে বলেছিলেন, ‘দূর, ছাড়ো তো।’

কিন্তু ইংরেজি গল্প উপন্যাসে আমরা ‘শেরিফ’-এর ক্ষমতার নমুনা পেয়েছি। পুরনো দিনের ইংরেজি ছবিতে শেরিফ হলেন শহরের এক নম্বর ব্যক্তি, যাঁর হাতে শান্তিরক্ষার দায়িত্ব থাকে। অপরাধীরা শেরিফ আসছে শুনে পালিয়ে যায়। রবিন হুড-এর গল্পে শেরিফ তো অনেকটা জায়গা পেয়েছেন। এখনও আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের শহরগুলিতে শেরিফের যা ভূমিকা তা আমাদের পুলিশ কমিশনারের মতো। বরণীয় কোনও মানুষ শহরে এলে শেরিফ তাঁর হাতে শহরে ঢোকার প্রতীকী চাবি তুলে দেন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ওটা সম্মান দেখানোর জন্যেই করা হয়ে থাকে।

শেরিফ সম্পর্কে যেসব তথ্য পাচ্ছি তা এইরকম—! কলকাতায় শেরিফ একটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক পদ। রাজ্যের খ্যাতনামা মানুষদের একজনকে মাত্র একবছরের জন্যে ওই পদে নির্বাচিত করা হয়। শেরিফকে অফিস এবং তার কর্মচারী দেওয়া হয় কিন্তু কোনও শাসনক্ষমতা দেওয়া হয় না। সম্মানের দিক থেকে শেরিফের জায়গা ঠিক মেয়রের পরেই। তাঁর অফিস কলকাতা হাই কোর্টেই ব্যবস্থা করা আছে। শেরিফের অন্যতম কাজ হল যখন সরকারের কোনও অতিথি বিদেশ থেকে আসেন তাঁদের অভ্যর্থনা করতে বিমানবন্দরে যাওয়া। নেট থেকে পাওয়া এই তথ্যে শেরিফ সম্পর্কে আর কিছু বলা নেই। আজকের ভারতীয় সংবিধানে শেরিফের কোনও ভূমিকা নেই। সামাজিক জীবনে শেরিফ না থাকলেও আমাদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না যখন, তখন পদটি রাখার কী দরকার?

দরকার নেই তা আজ নির্বাচন কর্মীরা প্রমাণ করে দিলেন। তাঁরা সযত্নে শেরিফ রঞ্জিত মল্লিক এবং তাঁর স্ত্রীর নামটি ভোটার তালিকা থেকে তুলে দিলেন। কলকাতার শেরিফের সম্মান যখন আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে তখন আর পদটি রেখে দেওয়ার কী দরকার! তাঁর অফিসঘর এবং কর্মচারীদের মাইনে বাবদ তো সরকারের খরচ হচ্ছে। ওটা বেঁচে যাবে।

বাংলাদেশের লেখকদের সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন বন্ধুত্বের সম্পর্কে আছি। হুমায়ুন আহমেদ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তিনিই ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। বাংলা অক্ষর লিখে ওঁর মতো জনপ্রিয়তা আজ পর্যন্ত কেউ পাননি। না ওখানে, না এখানে, কেন তিনি এত জনপ্রিয় তা জানার জন্য ওঁর অনেক লেখা পড়েছি। দেখলাম, ওঁর প্রথম দিকের বইগুলি, যেমন ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘বহুব্রীহির’ সঙ্গে পরের রচনাগুলির ধরনের মিল নেই। তাঁর লেখার স্টাইল এত মনোরম যে শেষ না করে ছাড়া যায় না। এই গুণ সুনীলদারও ছিল। মূলত প্রেম, প্রেমহীনতা, সাধারণ জীবনযাপন নিয়ে তিনি লিখেছেন, ষোলো থেকে পঁচিশের পাঠকরা সেইসব লেখা পড়ে আপ্লুত হয়েছে। যখনই ঢাকায় গিয়েছি তখনই তাঁর সঙ্গে মধ্যরাত পর্যন্ত নিয়মিত আড্ডা হয়েছে। তাঁর লেখার জনপ্রিয়তার কথা বললে তিনি সবিনয়ে অন্য প্রসঙ্গে গিয়েছেন। বেশ কিছুদিন ধরে একটা প্রশ্ন করার কথা ভেবেছি এবং সেটা করেই ফেলেছিলাম, ‘তোমার লেখায় সমসাময়িক রাজনীতির কথা নেই কেন? তোমার চরিত্রগুলি কেন রাজনৈতিক দলগুলির সমর্থনে বা বিরুদ্ধে কথা বলে না?’

হুমায়ুন বলেছিল, ‘আপনি চান আমি লেখা ছেড়ে দিই?’

দশ লক্ষ টাকা অগ্রিম দিতে প্রকাশকরা যেখানে প্রস্তুত সেখানে আমি ওই প্রশ্নের কী উত্তর দিতে পারি? শুধু বললাম, ‘পঞ্চাশ বছর পরে যখন তোমার উপন্যাস নিয়ে কেউ গবেষণা করবে তখন তো সে সমস্যায় পড়বে। কোন সময় নিয়ে তুমি লিখেছ, তখন বাংলাদেশে রাজনীতির কী চেহারা ছিল তা বুঝতেই পারবে না। আমি লক্ষ করেছি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, তুমিও দারুণ লেখা লিখেছ। কিন্তু জনাব এরশাদ যখন পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হয়েও যখন জনগণের ইচ্ছে মানতে বাধ্য হলেন তখন সেই সময় নিয়ে চমৎকার লেখা যেত। তোমার কোনও লেখা আমি পড়িনি। হুমায়ুন বললেন, ‘সত্যি কথা বলছি, আমি সমস্যা বাড়াতে চাইনি। আমি কোনও রাষ্ট্রনায়ককে নিয়ে লিখলাম, তার সমালোচনা করলাম। ওই রাষ্ট্রনায়ক পরের কোনও নির্বাচনে জয়ী হয়ে এসে প্রথমে একটা মামলা সাজিয়ে আমাকে জেলে পুরবেন। আমার লেখা কোনও চরিত্র যদি আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধে কথা বলে, বিএনপিকে সমালোচনা করে তাহলে বই ছাপা হওয়ায় পরের দিন আমাকে ভয়ঙ্কর আক্রমণের সামনে পড়তে হবে। এছাড়া আর একটা বিষয় ভাবতে হচ্ছে। আমার পাঠক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক। তাঁদের নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবনার বাইরে এসে আমার বই পড়েন, আমাকে পছন্দ করেন। কারণ আমার লেখায় তাঁদের রাজনৈতিক ভাবনা আঘাত পায় না। এইসব ভেবে আমাকে লিখতে হয়। আপনি দেখবেন, রাজাকারদের একসময় আমাদের লেখায় খুব গালাগাল দেওয়া হত। এখন কমে এসেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখাও খুব বেশি দেখছি না। সবাই ব্যক্তি মানুষের কথাই লিখে চলেছেন। হ্যাঁ, হুমায়ুন আজাদের মতো কিছু লেখক এখনও আছেন যাঁরা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলছেন, কিন্তু লক্ষ করবেন তাঁরা পাঠকদের সমর্থন পাননি। সমরেশদা, আপনি আপনাদের দেশের সিপিএমের যখন প্রবল ক্ষমতা তখন ‘কালবেলা’ লিখেছিলেন। খোলাখুলি সিপিএমের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন কিন্তু তার জন্যে আপনাকে বিপদে পড়তে হয়নি। আমরা অতটা সৌভাগ্যবান নই।’

হুমায়ুন আজ পৃথিবীতে নেই। থাকলে আজকের রক্তাক্ত পৃথিবীতে স্বাধীনতা শব্দটি যে বিপন্ন তা ওঁকে বোঝাতে পারতাম? যে শহরের শেরিফ ভোট দেওয়ার সুযোগ পান না সেই দেশের মানুষ তো অনিশ্চয়তায় ভুগবেই! লেখার ব্যাপারেও আমরা কি ওদের অবস্থায় চলে যাচ্ছি!

১৯

কয়েক বছর ধরে টিভি চ্যানেলগুলো সন্ধের পর সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনার আসর দর্শকদের নিবেদন করছে। কোনও একটি বিষয় নিয়ে আলোচনার সময় বিভিন্ন বক্তার অভিমত আমরা জানতে পারি। কেউ উত্তরে হাঁটেন তো কেউ দক্ষিণে। সঞ্চালক তাঁদের হাল ধরে রাখার চেষ্টা করেন। লক্ষ করেছি, রাজনীতি তো বটেই, যে কোনও বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে যে-মুনশিয়ানা ওঁরা দেখান তাতে বিতর্ক কলহে পৌঁছে যায় সহজেই।

শুরুর সময়ে এই আলোচনা-আসর বেশ ভাল লাগত। তখন বামফ্রন্টের আমল। লক্ষ করতাম, রাজনৈতিক বিষয়গুলো একটু একপেশে হয়ে যাচ্ছে—কারণ তৃণমূলের পক্ষে কথা বলতে কেউ সেই অনুষ্ঠানগুলোতে হাজির থাকতেন না। দর্শক-শ্রোতারা যাঁদের কথা শুনতেন তাঁরা কে কীরকম বলেন তা নিয়ে পরে আলোচনা হত। একটু মজা করে কথা বলার জন্য শ্রীযুক্ত অরুণাভ ঘোষ এবং তথাগত রায়কে পছন্দ করতেন অনেকেই। আর বলার ভঙ্গি এবং বিশ্লেষণ করার গভীরতায় নির্বেদ রায় প্রথম পছন্দের ছিলেন। পরে উদয়নবাবুর বক্তব্য দর্শক গ্রহণ করা শুরু করলেন।

কিন্তু এই অনুষ্ঠানগুলোর সুবাদে—যা বিভিন্ন চ্যানেলে নিত্য হয়ে থাকে—যাঁরা এর আগে অল্প পরিচিত অথবা অপরিচিত ছিলেন, তাঁরা ‘লাইমলাইট’-এ উঠে এলেন। লেখালেখি, অভিনয় অথবা খেলাধুলো করে বিখ্যাত হতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয়। এঁদের ক্ষেত্রে সেটা হল না। আলোচনার সময় একটু নতুন বক্তব্য, বলার ভঙ্গিতে দৃঢ়তা থাকলেই দর্শক-শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়। এই আলোচনাচক্রে যোগ দেওয়ার আগে সাধারণ মানুষ যাঁদের ভালভাবে চিনতেন না তাঁরা একটু-একটু করে পরিচিত হয়ে গেলেন। সাহিত্য সম্পর্কিত বিষয়ে কথা বলতে আমাকে কয়েকবার যেতে হয়েছিল। নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর প্রতিবাদে হেঁটেছিলাম বলে আমাকে ডাকা হয়েছিল। মোট চারবার গিয়েছি এবং তারপরে যাঁরা চারশোবার গিয়েছেন, একঘন্টার অনুষ্ঠানে মাত্র তিন মিনিট কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন—তাঁদের সেলাম জানিয়েছি। গোড়ার দিকের অনুষ্ঠানে ব্রাত্য বসুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ব্রাত্য তখনই সফল নাট্যকার এবং পরিচালক। কিন্তু সে বক্তা হিসেবে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে যখন কথা বলতে শুরু করেছিল তখন সৌজন্য হারায়নি। ক্রমশ ওর কথা বলার ভঙ্গি এবং বিষয় পাল্টাতে লাগল। একজন অর্থনীতিবিদ, যাঁর শুধু অর্থনীতি নিয়ে কথা বলার অধিকার, তিনিও রাজনীতি নিয়ে মুখ খুললেন। দেখা গেল, তৃণমূলের কোনও প্রতিনিধি না-থাকা সত্ত্বেও এঁদের উপস্থিতিতে ওই আলোচনাগুলোকে আর মামুলি মনে হচ্ছে না। মাটির পাত্রের ঘষা ক্রমাগত লেগে গেলে পাথরও ক্ষয়ে যায়। দেখা গেল, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর ওই দু’জনের প্রতি দল কৃতজ্ঞতা জানাল।

এই অনুষ্ঠানগুলো যাঁরা সঞ্চালনা অথবা প্রযোজনা করেন তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিলেন বামফ্রন্ট, কংগ্রেস বা বিজেপি গলা ফাটিয়ে কথা বললেও ‘টিআরপি’ বাড়ছে না। ওরা একই সুরে একটু আলাদা কথা বলছে। কিন্তু তাতে তরজা তৈরি হচ্ছে না। চাপান-উতোর না-হলে অনুষ্ঠান একপেশে হয়ে গেলে দর্শক রিমোট টিপে অন্য চ্যানেলে চলে যাবেন। অতএব ‘টিআরপি’ বাড়াতে চ্যানেলগুলোতে এক-এক করে যোগ দিলেন তৃণমূলের চারজন সমর্থক। কৃষ্ণ নাম সৎ শুধু, আর সব মিছে, এই বাক্যটি মনে গেঁথে নিয়ে তাঁরা মুখ খোলেন। বিরোধীরা আক্রমণ যতক্ষণ করে যাচ্ছেন, ততক্ষণ এঁরা খুব শান্ত হয়ে বসে থাকেন। যখন কথা বলেন—তখন তাঁদের জিভে বামফ্রন্টের চৌত্রিশ বছরের কুশাসন গলগল করে বের হতে থাকে। বিরোধীরা ধর্ষণের পরিসংখ্যান দিলে এঁরা বলেন, বামফ্রন্টের আমলে এর চেয়ে অনেক বেশি ধর্ষণ হত, সেগুলো প্রচারিত হয়নি। সরল সত্য প্রশ্নের জবাবে দাঁত খিঁচিয়ে উত্তর দেন। খিদিরপুরে পুলিশ অফিসার খুন হয়ে গিয়েছেন, যাঁর নির্দেশে খুন হয়েছেন তিনি শাসকদলের ‘ছোট নেতা’ বলে বিরোধীরা অভিযোগ করলে তার জবাব না-দিয়ে নন্দীগ্রামে কত নিরীহ মানুষ খুন হয়েছিল—তার পরিসংখ্যান পেশ করেন। চ্যানেলগুলো কখনওই ওই চারজনকে একসঙ্গে দূরের কথা, দু’জনকেও অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানায় না। ফলে একা কুম্ভ লড়াই করে যান। ক্রমশ অনুষ্ঠান শুরুর সময়ে সঞ্চালক যখন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তখন দর্শক উন্মুখ হয়ে লক্ষ করেন আজকের অনুষ্ঠানে কার বক্তব্য শুনে তাঁরা মজা পাবেন।

কিছু দিন আগে রাতের ট্রেনে উত্তরবাংলা যাচ্ছিলাম। ট্রেন চলতে শুরু করলে সামনে বসা দু’জন যাত্রীর একজন টয়লেটে গেলেন। ফিরে এসে হাসিমুখে তাঁর সঙ্গীকে বললেন, ‘এই কামরায় বকম বকম যাচ্ছেন!’

‘তাই? একা যাচ্ছেন?’ সঙ্গীও উৎফুল্ল হন।

‘তাই তো মনে হল।’

কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাই, এই বকম বকমটি কে?’

‘আপনি টিভিতে আলোচনার আসর দেখে থাকেন?’ প্রথমজন প্রশ্ন করেন।

‘সময় পেলে দেখি।’

”পাকা-কাঁচা চুল, অন্যেরা কথা বলার সময় একমনে নোট নিয়ে যান যে ভদ্রলোক, সপ্তাহে অন্তত তিনদিন অনুষ্ঠানে হাজির হন আর কথা বলার সুযোগ পেলে চোখ বন্ধ করে বলেই যান, বলেই যান যে-ভদ্রলোক, তাঁর নাম আমরা ‘বকম বকম’ রেখেছি।” দ্বিতীয়জন বর্ণনা দিতেই ভদ্রলোককে মনে পড়ে গেল।

‘আর কারও নামকরণ করেছেন না কি?’ হেসে জিজ্ঞাসা করলাম।

”একজন মুখ খুললেই জ্ঞান দেন, কে কার ভাবশিষ্য তা রোজই বলেন। তাঁকে আমরা ‘জ্ঞানদাতা’ বলি। আর একজন, যিনি বিরোধীপক্ষের তরুণ এম.পি, কথা বললেই মনে হবে গোটা পৃথিবীর দায়িত্ব তাঁর উপর, দাদারা এতকাল যেসব শব্দ শিখিয়েছেন তাই যত্ন করে বলেন কিন্তু কোথাও পৌঁছন না, তাঁর নাম দিয়েছি ‘লালপুঁটি’। গেরুয়া পার্টির এক ভদ্রলোক কথা বললেই বোঝা যায় বাংলা কবিতা গুলে খেয়েছেন এবং তা থেকে উদ্ধৃতি দেন যা দর্শকদের অনেকেই জানেন না, তাঁর নাম ‘ন্যাতানো কবি’।” প্রথমজন বললেন।

দ্বিতীয়জন হাত তুললেন, ‘এই থাম। দাদা যদি লিখে দেয় তা হলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’

বললাম, ‘আপনাদের নাম-ধাম তো জানি না। সেই ভয় নেই। আর কারও নাম?’

প্রথমজন দ্বিতীয়কে বলল, ‘বলেই দিই। হ্যারি ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর।’

‘বুঝতে পারলাম না।’ বললাম।

‘হরিবোল পার্টি। হরিবোল ছাড়া কিছুই বলতে জানে না। ফরসা, গোঁফওয়ালা ভদ্রলোক হ্যারি নাম্বার ওয়ান। আমাদের বন্ধুমহলে কেউ অরিজিনাল নাম জানে না। এই নামগুলোতেই বুঝে ফেলে।’

টিভি চ্যানেলগুলো যদি এই ‘স্টার’-দের তৈরি না-করত তা হলে তাঁদের নিয়ে চর্চা হত না। নতুন নামকরণ তো মানুষ এমনি-এমনি করে না। এঁরা আনন্দ দেন বলেই তো কাছের মানুষ হয়ে যান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *