গীতবিতান ছুঁয়ে বলছি ২.১

ভাবতে ভাল লাগছে, কলকাতা বড় হতে হতে গঙ্গা পেরিয়ে মালদহ, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি এমনকী কোচবিহার ছাড়িয়ে বাংলাদেশে পৌঁছে গেছে। এই লাইনটি পড়ে নিশ্চয়ই অনেকের কপালে অবিশ্বাসের লাইন ফুটে উঠেছে, কলকাতার পিনকোড নাম্বার চব্বিশ পরগনাতেই শেষ হয়ে যায়। কলকাতা পুলিশের বিচরণের সীমানাও চিহ্নিত, তাহলে এখন কলকাতা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজগুলোর কলকাতা সংস্করণ শিলিগুড়ি তো দূরের কথা, পুরুলিয়াতেও পাওয়া যায় না। এমন অনেক খবর কলকাতা সংস্করণে থাকে যা মফস্বলের সংস্করণে ছাপা হয় না আবার সেখানে ছাপা খবর কলকাতার সংস্করণ খুঁজে পাবেন না। তাহলে কলকাতা কী করে কোচবিহারে পৌঁছল? বাংলাদেশে তো দূর অস্ত। কলকাতা শহরের নিজস্ব সংস্কৃতির চেহারাটা ষাট সালে কলেজে পড়তে এসে দেখেছি। কেউ পথেঘাটে বিপদে পড়লে মানুষ এগিয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। ষাট থেকে ঊনসত্তরের ট্রাম-বাসে কোনও মহিলার শ্লীলতাহানি হচ্ছে এমন ঘটনা বিরল ছিল। অবশ্য সেই সময় পথেঘাটে মহিলাদের একা দেখা যেত না। বাড়ির বউ মেয়েরা ম্যাটিনিতে সিনেমা দেখতে যেতেন কাজের লোককে সঙ্গে নিয়ে। উত্তর কলকাতার মধ্য তিরিশের বিবাহিত মহিলা পাশের পাড়ার আত্মীয়ের বাড়িতে আসতেন ওইরকম কাউকে নিয়ে। নিরাপত্তার কারণে নয়, সম্ভ্রম বজায় রাখতেই ওটা চালু ছিল। তখন সিনেমা হলগুলোতে লেডিজ সিটের ব্যবস্থা থাকত। কলকাতায় সেই চল নেই। জানি না মফস্বলেও তা টিকে আছে কি না।

থাকার কথা নয়। লক্ষ করবেন, কলকাতার পুরনো ঝরঝরে বাসগুলোয় এখনও ‘লেডিজ’ লেখা থাকে। মহিলারা সদর্পে সেগুলোয় অধিকার নেন। কিন্তু নতুন ঝাঁ-চকচকে বাসগুলোতে পুরুষ মহিলা আলাদা করা হয়নি। তাতে যে মহিলাদের অসুবিধে হচ্ছে তা মনে হয় না। বরং উল্টোটাই দেখতে পাই। লেডিজ মার্কা আসন খালি থাকলেও অল্পবয়সি মেয়েরা সাধারণ আসনেই বসছেন। যেহেতু ওই আসন পুরুষদের জন্য চিহ্নিত নয় তাই সেখানে বসার পূর্ণ অধিকার তাঁদের আছে বলে ঘোষণা করেন। পাতাল রেলের কামরায় দুটো লম্বা আসন মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট। লক্ষ করেছি সেখানে বসতে অনেক মেয়ের অনীহা আছে। সেই আসন খালি থাকা সত্ত্বেও বছর ষাটের দুই মহিলা সিনিয়র সিটিজেন মার্কা আসনে এসে বসলেন। কোনও বৃদ্ধ তাঁদের বিনীতভাবে লেডিজ সিটে গিয়ে বসতে বললে উত্তর শোনেন, ‘কেন যাব? আমরা কি সিনিয়র সিটিজেন নই।’

গত দশ-বারো বছরে কলকাতার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, ‘উড়ালপুল, ঝাঁ-চকচকে মর্গ থেকে শুরু করে লাক্সারি ট্যাক্সি, কলকাতা বড় হচ্ছে। পুরুষদের পরিবর্তন যতটা না চোখে পড়ছে, মেয়েদের বিস্তর বদল হচ্ছে। আমার এক বন্ধু বিদেশে থাকেন। বছর দশেক পরে কলকাতায় এসে ঘুরে ফিরে দেখে বললেন, আচ্ছা, কলকাতায় মানুষের হাতে এত টাকা এল কী করে?

কোথায় টাকা? অর্থাভাবে মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকাই এখন প্রধান সমস্যা।

‘আমার তো মনে হচ্ছে না।’ বন্ধু বললেন, সল্টলেকের দুটো সিটি সেন্টার, আনোয়ার শা রোডের বিরাট মলে যে জনতাকে কেনাকাটা করতে দেখলাম তাদের তো টাটা বিড়লার বাড়ির লোক বলে মনে হল না। কলকাতার রাস্তায় এত গাড়ি, পাঁচ লাখ থেকে পঁচিশ লাখ, কারা চড়ছে? হাজার হাজার বাইক তো আমাদের সময় ছিল না। সিনেমা দেখতে দুশো তিনশো টাকার টিকিট কারা কাটছে? এককালে পাঁচ কি দশ টাকার টিকিট কেটে আমি আকাদেমিতে বহুরূপীর নাটক দেখেছি। এখন দেড়শো-দুশো টাকার টিকিটে হাউসফুল হচ্ছে। নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন এইসব নাটকগুলো মধ্যবিত্ত নিম্লবিত্তরাই দ্যাখে। কাগজে পড়লাম বাজারে হু হু করে দাম বাড়ছে। পিঁয়াজ আশি-নব্বই টাকা। গিয়ে দেখলাম ইলিশ মাছ নয়শো টাকা কেজি সত্ত্বেও মানুষ কিনছে। কোথাও কোনও বাজারে একটাও বিক্ষোভ দেখা যায়নি। তারপরে কী করে বলছেন অর্থাভাবে মানুষ কষ্টে আছে? দেখেশুনে মনে হচ্ছে মানুষের হাতে বৈধ বা অবৈধ যে কোনও রাস্তায় টাকা আসছে। মনে পড়ছে এক পয়সা ট্রামের ভাড়া বাড়ানোয় কলকাতায় পুলিশ-জনতার যুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কত ট্রাম পুড়েছে মানুষের ক্ষোভের কারণে। এখন পাঁচগুণ দাম বেড়ে গেলেও মানুষ তা নিয়ে শুধু কথাই বলে, সেই বিক্ষোভ দেখায় না।

আমার পরিচিত একটি পরিবার, যাদের আয় দশ হাজার টাকার নিচে, তাদের ছেলেমেয়ে যে পোশাক পরে তা রীতিমতো দামি। কৌতূহল হল, প্রশ্ন করে জানলাম, আমরা এগুলো তো ইএমআইতে কিনেছি, ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে বিক্রেতারা। এক হাজার টাকার জিনিস বারোশো টাকায় বিক্রি করে প্রতি মাসে একশো করে নিয়ে যাচ্ছে। এক বছরে শোধ হয়ে গেলে আবার বারো মাসে একশো টাকা দিতে ওরা নিশ্চয়ই পারে।

যা ছিল কলকাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ তা আজ কোচবিহারে পৌঁছে গিয়েছে। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়িতেও ঝাঁ-চকচকে দোকান হচ্ছে। তাদের ক্রেতাও তৈরি হয়েছে। টাকা আসছে কোত্থেকে? এ সব নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামান তাঁদের একজন বলবেন, ‘সবাই যে দু’নম্বরি করে টাকা রোজগার করছে তা নয়। আগে পরিবারের একজন অথবা দু’জন চাকরি করতেন। এখন বাবা- মা-ছেলে-মেয়ে চারজনেই চাকরি করছে। বাবা চাকরির শেষদিন যত মাইনে পাচ্ছেন ছেলে বা মেয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং এমবিএ-র দৌলতে তার দ্বিগুণ মাইনে ঘরে নিয়ে আসছে। বেশিরভাগ বাবা-মা ছেলেমেয়ের কাছে সংসারের জন্যে টাকা চান না। সেই টাকায় ওরা শখ মেটাচ্ছে বলে শপিং মলগুলোর এত রবরবা।

দ্বিতীয়টি আগেও ছিল কিন্তু দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে। ছেলে-মেয়ে যদি কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য বা সমর্থক হয় তাহলে তার ভাগে নানান সোর্স থেকে টাকা আসবেই। কোনও কনট্রাক্টর বৈধ উপায়ে টেন্ডার দিয়ে কাজের বরাত পেলে শুরু করার আগে নৈবেদ্য দিতে হবে। সেই নৈবেদ্যর অংশ অনেক হাতে পৌঁছে যাওয়ার সময় নবীন কর্মীও বঞ্চিত হবে না। কেউ বাড়ি বানাতে গেলে ওদের কাছ থেকেই ইট সিমেন্ট কিনতে হবে চড়া দামে। জিনিস যদি ভাল না হয় তাহলেও প্রতিবাদ করা যাবে না। এই যে জোরজবরদস্তি করে পাওয়া টাকা এখন বাতাসে উড়ছে। উড়তে উড়তে কলকাতা থেকে চলে যাচ্ছে কোচবিহারে। দু’হাজার টাকার টিকিট কেটে শচীনের টেস্ট ম্যাচের প্রায় সমাপ্তি দেখতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।

একটা সময় ছিল উত্তরবাংলার মফস্বল শহরের অনেক পরিবার ছেলের বিয়ে দেওয়ার সময় কলকাতার মেয়েকে গৃহবধূ করার কথা ভাবতেন না। ছেলের জেদে কলকাতার মেয়ে বউ হয়ে যদি কারও বাড়িতে আসে তাহলে পাড়া-প্রতিবেশীরা তাকে দেখতে যেতেন এবং বলতেন ‘এখানে থাকতে তো আসেনি, ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আছে।’

এখন তাঁদের বাড়ির মেয়েরা কলকাতার মেয়েদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। পড়াশোনায়, সাজগোজে। সেদিন শিলিগুড়ির রাস্তায় একটি মেয়ের মুখে শুনলাম, “প্রসেনজিৎ বাদ, বয়স হয়ে গিয়েছে। এখন দেব ছাড়া কাউকে নায়ক বলে ভাবাই যায় না। ওদের চেয়ে আমাদের এখানে অনেক বিন্দাস ছেলে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে যখন কেউ মারা যান তখন খারাপ লাগলেও অবাক হওয়ার মতো কোনও ঘটনা বলে মনে হয় না। আচমকা হৃদযন্ত্রের গোলমালে হাসপাতালে ভর্তি হলেন কেউ, ক’দিন ধরে টানাপোড়েন চলল, তারপর তাঁর শরীর প্রাণমুক্ত হল। এই ঘটনাটা কষ্ট তৈরি করে কিন্তু বিস্ময় বাড়ায় না। আমার একদা এক সহকর্মী মিলন পাউচ থেকে বের করে ভেজা খইনি খেতে শুরু করেছিল। ওই নেশা তার কস্মিনকালেও ছিল না। বলতাম, ‘তোর দাঁতগুলোর বারোটা বাজবে।’ মাস কয়েক বাদে ওকে দেখতে যেতে হল হাসপাতালে। গলায় ক্যানসার ধরা পড়েছে। ওর স্ত্রী আতঙ্কিত। ডাক্তার বললেন অপারেশন করতে হবে। মাস তিনেক বাদে মিলনকে দেখে চমকে উঠলাম। ওই অপারেশনের পরে বীভৎস হয়ে গেছে মুখের চেহারা। প্রায় হরর ফিল্মের চরিত্রের মতো। কিন্তু আমি বা আমরা ওকে স্বাভাবিকভাবে নিলাম। আগের মতোই আড্ডা মারলাম। মাঝে মাঝে ও সিগারেট চাইত, বলত জাস্ট একটা টান দেবে। আমরা অভিভাবকের মতো শাসন করতাম। বছরখানেক পরে আবার অসুস্থ হল মিলন। ক্যানসারের চিকিৎসায় হু হু করে টাকা খরচ হয়। কেমো চলছে কিন্তু ও বেশ স্বাভাবিক কথা বলছে। রঙ্গ রসিকতাও করছে। ওকে দেখলেই মনে হত মৃত্যু খুব বেশি দূরে নেই যাকে ও দেখেও না দেখার ভান করছে। এক বন্ধু বললেন, ‘চিকিৎসার পিছনে এত খরচ হলে ওর পরিবার তো নিঃস্ব হয়ে যাবে।’ আর একজন বললেন, ‘তাই বলে চিকিৎসা না করিয়ে ফেলে রাখা হবে?’ ঠিক। ক্যানসারের প্রথম ধাপে চিকিৎসা শুরু হলে রোগী অবশ্যই রোগমুক্ত হবেন। মারা যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। দ্বিতীয় ধাপে ধরা পড়লে সম্ভাবনা আধাআধি। ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দেন না। তৃতীয় ধাপে ধরা পড়লে ব্যাপারটা সেই টি-টোয়েন্টির মতো দাঁড়ায় যেখানে বল বাকি আছে সাতটা অথচ জিততে হলে তিরিশ রান দরকার। অন্তত চারটে ছয় এবং দুটো চার মেরে জেতা কদাচিৎ ঘটে। শেষের দিকে মিলনের অসুখ তৃতীয় ধাপে পৌঁছে গিয়েছিল। ওর মৃত্যুর খবর পেয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থাকার পর এক বন্ধুর ফোন এল, ‘খবরটা শুনেছেন? মিলন বেঁচে গেল আর ফ্যামিলিটাকেও বাঁচিয়ে গেল।’ এই মৃত্যুতে আমি বা অন্য কেউ অবাক হইনি।

অর্থাৎ শরীর নামক যন্ত্রটি ক্ষয় পেতে পেতে যখন ভেঙে যায় তখন সেটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। মাঝে মাঝেই মনে হয় এটাই নিয়ম হয় না কেন? আমার পিতামহ সাতানব্বই বছরে চলে গিয়েছিলেন। কোথায় গিয়েছেন জানি না কিন্তু চলে যাওয়াটায় বিস্ময় ছিল না। মান্না দে যে বয়সে গত হলেন তাতে কেউ যদি বলেন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বেঁচে ছিলেন তাহলে কি ভুল বলবেন? নীরদ সি চৌধুরি মশাই শতবর্ষ পার করে যখন গত হননি তখন আমরা অবাক হয়েছিলাম। একটা মানুষ এতটা বছর সক্রিয় থাকছেন কী করে? একশো একে তাঁর চলে যাওয়াটা তাই বেদনাদায়ক হয়নি।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চলে যাওয়ার বয়স হয়নি। উনআশি-আশিতে আজকাল প্রচুর মানুষ ময়দানে দৌড়ন। ছিয়াশিতে বাজারে যান। কিন্তু মৃত্যুর বছরখানেক আগে থেকে সুনীলদার শরীর ভাঙছিল। দ্রুত রোগা হয়ে যাচ্ছিলেন। মুখের চেহারা বদলে যাচ্ছিল। তা সত্ত্বেও আমি দেখা হলে কখনওই জিজ্ঞাসা করতাম না, কেমন আছেন? মনে মনে প্রার্থনা করতাম, আবার আগের মতো হয়ে যান আপনি। আগেরদিন কথা বইলেছি। পরের দিন ফোন সুইচড অফ। মন কু গাইল। একে ওকে ফোন করে জানলাম, শরীর ভাল নয় বলে ঘুমোচ্ছেন। পরের দিন সকালে খবর পেলাম। পেয়ে অবাক হইনি। ওঁর ভেঙে চলা শরীর বোধহয় এই জানানটা দিয়ে আসছিল।

কাল সকালে শৈবাল খবরটা দিল, ‘সমরেশদা, কুণাল মারা গিয়েছে।’

‘কী’? চমকে উঠলাম, ‘কী যা তা বলছ?’

‘হ্যাঁ, সমরেশদা। রাত্রে মোটরবাইকে স্টার্ট দিতে গিয়ে পড়ে যায়, আর উঠতে পারেনি। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। শরীরে প্রাণ নেই কিন্তু ঠোঁটে হাসি ছিল।’ শৈবাল বলল।

আমি ধাক্কা খেলাম। অবাক হলাম বললে কম বলা হবে। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চির সুগঠিত শরীরের কুণাল কথা বলত খুব নম্র ভঙ্গিতে। দেখলেই বোঝা যেত ব্যায়াম এবং আসন করে চলেছে শরীর ঠিক রাখতে। একটি বড়সড় ট্র্যাভেল এজেন্সির অংশীদার ছিল সে। আর ছিল অভিনয়ের নেশা। প্রচুর টিভি সিরিয়াল করেছে। ছবিতেও অভিনয় করেছিল। কাহানি ছবিতে নজর কেড়েছিল। পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরি তার পরের হিন্দি ছবিতে ওর কথা ভেবেছিল। এই সেদিনও দেখা হতে আবার ওর বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছিল। বলেছিলাম, ‘নিশ্চয়ই যাব। ঠান্ডাটা আর একটু বাড়ুক।’ ওই বয়সে উপরে ওঠার সিঁড়িগুলি যখন কুণালের সামনে এগিয়ে আসছে তখন একজন স্বাস্থ্যবান মানুষ হয়ে সে কেন মোটরবাইকে স্টার্ট দিতে গিয়ে মাটিতে পড়ে যাবে? পড়ে যাওয়ামাত্র ওর হৃদযন্ত্র কেন থেমে যাবে? আমরা অবাক হয়েছি, চমকে উঠেছি খবরটা পেয়ে। ডাক্তারদের জিজ্ঞাসা করে জেনেছি, একেবারে আচমকা মৃত্যু হানা দেয় না। দেওয়ার আগে সামান্য হলেও জানান দেয়। কুণালকে কি দিয়েছিল? দিলে সে কি বুঝতে পারেনি? কোনও ঘটনায় তার রক্তচাপ কি খুব বেড়ে গিয়েছিল? জানি না। শুধু জানি, মানুষটা নেই।

এই রকমভাবে না থাকাটার প্রতিক্রিয়া কী হয়? ধরা যাক কুণাল কাউকে মোটা টাকা ধার দিয়েছিল, সে সুযোগটা নেবে। কারও সঙ্গে কোর্টে মামলা চললে এখন তার কোনও যৌক্তিকতা থাকবে না। তাকে ঘিরে যারা স্বপ্ন দেখেছিল তাদের চিবুক বুকে নুয়ে পড়বে। আর আমরা প্রতিমুহূর্তে ভাবব, জীবন সত্যি পদ্মপাতায় জল। ভাবব এবং আগামিকাল পরশুর জন্যে বেঁচে থাকতে চাইব। এ বড় যন্ত্রণা। যদি ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বলে দিতে পারতেন কোন মানুষ কতদিন বাঁচবে তাহলে কী ভালই না হত! এই কুণালের মৃত্যুতে আর এক কুণালের কথা মনে এল। কুণাল মিত্র। সেও অভিনয় করত। নামও করেছিল। চল্লিশে পৌঁছয়নি যখন, তখন শুটিংয়ের আগে মেকআপ করতে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। আর উঠল না।

অথচ আমার সামনে এমন প্রচুর মানুষ আছেন যাঁরা বহুকাল বেহিসেবি জীবনযাপন করে চলেছেন। দিনদুপুরেই মদ্যপান করেন, ডাক্তার দেখান না, ওষুধের বালাই নেই। তাঁরা সত্তর পেরিয়েও বেঁচে আছেন, ছবি আঁকছেন, নিজের খেয়ালে নানা সৃষ্টিকর্মে যুক্ত থাকছেন। কী করে সম্ভব? বন্ধু ডাক্তার তাঁদের সতর্ক করেছিলেন, এভাবে চললে সর্বনাশ ডেকে আনবেন। সতর্কিত হওয়ার পর কুড়ি বছর কেটে গিয়েছে।

বেঁচে থাকার এবং চলে যাওয়ার এই রহস্য চিরকাল থাকবে।

প্রকৃতির গবেষণাগারে মানুষ আর গিনিপিগে কোনও তফাত নেই।

আফসোস, গবেষণার ফলাফল কখনওই জানতে পারব না।

কাগজে খবর ছাপা হল, একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কয়েক কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে কাউকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলগুলি সরব হল। লোকসভায় তারা বিক্ষোভ দেখাল। দেশের সমস্ত কাগজে সেই খবর ছাপা হল।

তার প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষ তীব্র অসন্তোষ দেখালেন। পাড়ায়, বাসে, অফিসে বিভিন্ন আড্ডায় তাঁদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চাইলেন। প্রধানমন্ত্রী কেন ওই মন্ত্রীকে পদচ্যুত করছেন না বলে গলা ফাটালেন। দেখেশুনে মনে হবে, ভারতবর্ষের সমস্ত মানুষ এরকম অসৎকর্ম সমর্থন করেন না। তাঁরা চান সমস্ত মানুষ সৎপথে হাঁটুন, কালোবাজারি বা দুনম্বরী কাজকর্ম বন্ধ হোক। এইরকম মানসিকতা শ্রদ্ধার উদ্রেক করে।

মনে পড়ছে, একসময় আচমকা বেবিফুডের আকাল পড়েছিল। পাড়ার দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না, গরুর দুধে শিশুর পেট বেঠিক হচ্ছে। বাবা-মায়ের মাথায় হাত, হঠাৎ খবর পাওয়া গেল, লিন্ডসে স্ট্রিটের একটা দোকানে বেবিফুড বিক্রি হচ্ছে। বেলগাছিয়া থেকে বাবা সেখানে গিয়ে দেখলেন কয়েকশো লোকের লাইন পড়েছে। সেখানেই খবর পেলেন গড়িয়াহাটের একটা দোকানে বেবিফুড পাওয়া যাচ্ছে। ছুটলেন সেখানে। লাইন দেখে যখন হকচকিয়ে গিয়েছেন, তখন দালাল প্রস্তাব দিল দ্বিগুণ দাম দিলে এক কৌটো দুধ পেয়ে যাবেন। শিশুর কথা ভেবে ব্ল্যাকে দুধ কিনে তিনি যখন ফিরে এলেন তখন একবারও ভাবলেন না তিনি অপরাধ করলেন। উল্টে বন্ধুদের বললেন, “কী দিনকাল পড়েছে, ডাবল দাম দিয়ে বেবিফুড কিনতে হচ্ছে!”

মেয়ের বিয়ে দেবেন ভদ্রলোক। সম্বন্ধ এল। পাত্র পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ দফতরে চাকরি করে। সুপাত্র। মেয়ের বাবা বললেন, “ঠিক আছে, দেখি।” তিনি সন্ধান করলেন আয়কর, কাস্টমস অথবা ওই জাতীয় দফতরের পাত্রের। পেয়েও গেলেন। উল্লসিত হয়ে বললেন, “যাক, মেয়েটা সারাজীবন অর্থকষ্টে ভুগবে না। ভাল উপরির সুযোগ আছে।” উপরি মানে বকশিস অথবা ঘুষ। সেটা জামাই নিলে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। তাড়াতাড়ি কাজটা করে দিয়ে বহিরাগতকে খুশি করলে বকশিস দেন। অম্লানবদনে সেটা পকেটে ভরা যায়। রেস্তোরাঁয় যে লোকটি খাবার পরিবেশন করে তাকে যেমন বিলের সঙ্গে বকশিস দেওয়া হয়, ঠিক তেমন। আর যে সরকারি আমলার হাতে ক্ষমতা আছে তিনি তার অপব্যবহার করে অম্লানবদনে বাড়িতে টাকা নিয়ে যান। শুনেছি একটা জটিল কেস এলে এক পক্ষের আমলারা শলাপরামর্শ করেন কীভাবে অডিটকে ফাঁকি দিয়ে কাজটা করে দিয়ে মোটা টাকা রোজগার করা যায়।

এইসব সরকারি আমলাদের জন্যে সরকারি ফ্ল্যাট আছে এক একটা কমপ্লেক্সে। সেখানে একটা অদ্ভুত ছবি দেখা যায়। একই মাইনে পান এমন দু’জন আমলার পরিবারের আর্থিক চেহারা একেবারে উল্টো। একজনের স্ত্রী সাউথসিটি মল ছাড়া বাজার করতে পারেন না। আইনক্স ছাড়া ছবি দেখেন না, বাড়িতে অত্যাধুনিক বিনোদনের ব্যবস্থা আছে, মেয়েকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দামি ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করেছেন। অন্যজনের স্ত্রী গড়িয়াহাট থেকে কেনাকাটা করেন, ছবিঘরে সিনেমা দেখেন, ছেলে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে পড়ে। সেই ছেলে প্রায়ই অভিযোগ করে পাশের ফ্ল্যাটে যখন এত এত হচ্ছে তখন তাদের হচ্ছে না কেন? স্ত্রীও মুখ ভার করেন। স্বামীকে বলতেই হয়, “লোকটা ঘুষ নেয়। ওসব ঘুষের টাকায় হচ্ছে।” শুনতে শুনতে স্ত্রী বলে ফেলেন, “উনি যখন নিচ্ছেন তখন তুমি সাধুপুরুষ হয়ে আছ কেন? নিলে তো আমাদেরও সব হত!”

ক্রমশ ব্যাপারটা এমন প্রকট হয়ে যাচ্ছে যে অল্পস্বল্প ঘুষ বা বকশিস নেওয়াকে সাধারণ মানুষের একাংশ দুর্নীতি বলে মনে করেন না। মনে করেন তাঁরাই যাঁরা ওই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। জন্মলগ্ন থেকেই সবাই বলে এসেছে পুলিশ ঘুষ খায়। কেউ অন্যায় করলে তাকে ধরে আদালতে পাঠাবার বদলে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়। এ ব্যাপারে আমার কৌতূহল হতে আমি আমার পুলিশ-বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। জানলাম সব পুলিশ ঘুষ নেন না বা দুর্নীতি করেন না। কিন্তু অনেকেই করেন। এই অনেকের দায় গিয়ে পড়ে গোটা ডিপার্টমেন্টের উপর। রাস্তার মোড়ে যে সেপাই ট্রাক থামিয়ে আগে আধুলি নিত এখন কাগজের নোট নিচ্ছে সে জানে সবাই দেখছে কিন্তু নিতে সঙ্কোচ হচ্ছে না। বড় দাঁও মারলে সেটার সুষ্ঠু বন্টন ব্যবস্থা আছে। যে ছেলেটি অনেক পড়াশোনা করে আইপিএস হয়ে পুলিশে এল সে কি মাছের ঝাঁকে মিশে যেতে পারে? ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু ঘুষ বা বকশিসের পাশাপাশি আর একটি উপায়ে টাকা রোজগারের প্রথা চালু হয়েছে। একটি লোক ব্যবসা করে খাচ্ছে, যার পিছনে কোনও রাজনৈতিক দল নেই তাকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে যদি টোপ ফেলা যায়, হয় দাও নয় জেলে যাও তখন তার না দিয়ে উপায় থাকে না। এটাকে ব্ল্যাকমেল করা বলা হতেই পারে। মজার কথা হল যারা এইসব করে তারা নিজের বাড়ির লোকেদের কাছে সবসময় সৎ ইমেজ তৈরি করে রাখে। অফিসে ঘুষ বা বকশিস নিচ্ছে, ইউনিয়নের ডাকে মিছিলে নামছে আবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ছেলেকে বিবেকানন্দ বা বিদ্যাসাগরের জীবনী শোনাচ্ছে। এই ধরনের মানুষের সংখ্যা কম নয়।

বঙ্কিমবাবুর খুব ইচ্ছে তাঁর নাতিকে দামি স্কুলে ভর্তি করবেন। পাড়ার রকে এসে তিনি তাঁর উদ্বেগের কথা বললেন। রকের আড্ডাবাজদের মধ্যে কথা শুরু হয়ে গেল। খানিক আগে যাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রীর বাপবাপান্ত করছিলেন তাঁদের একজন বললেন, “আমার একটা ভাল সোর্স আছে বঙ্কিমদা। কিন্তু আপনাকে খরচ করতে হবে।”

বঙ্কিমবাবু বললেন, “খরচ নিয়ে ভাবছি না ভাই। কিন্তু ঠিকঠাক লোকের হাতে টাকাটা দিতে চাই। বাজারে বহুৎ ফড়ে ঘুরছে।”

দেখা গেল তিনজন আড্ডাধারী বঙ্কিমবাবুকে সাহায্য করতে উদ্যোগী হয়েছেন। তিনজনেরই সোর্স রয়েছে। দুই লাখ আড়াই লাখ তিন লাখ দর উঠে গেল। বঙ্কিমবাবু তিন লাখেই রাজি হলেন। এই টাকার সঙ্গে স্কুলের মাইনে ইত্যাদির কোনও সম্পর্ক নেই। ভর্তি হয়ে যাওয়ার পর বঙ্কিমবাবু হেসে বললেন, “জানি, কিছু টাকা ও কমিশন পাবে, আমার কাজটা হয়ে যাওয়ায় আমি খুশি।”

একসময় মানুষ কেরোসিন ব্ল্যাকে কিনতেন। তাতে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ জাগ্রত হত না। আমি কিছু করলে সেটা অপরাধ নয়। অন্যলোক করলেই ছিঃ ছিঃ বলব। ঘুষ দেওয়ার সবচেয়ে চমকপ্রদ গল্প শুনলাম। ছেলেটি চাইছিল মেয়েটিকে বিয়ে করতে। মেয়েটিও। মেয়েটির বাবা রাজি নন। তিনি মেয়ের বিয়ে অন্য জায়গায় ঠিক করলেন। প্রেমিক সেই পাত্রের কাছে গিয়ে জানাল মেয়েটিকে সে ভালবাসে। তাতেও পাত্র গলছে না দেখে প্রস্তাব দিল, “হাজার পঞ্চাশ দিতে পারি। সরে দাঁড়ান।”

“মাত্র হাজার পঞ্চাশ!” পাত্র দোনোমনা করেছিল।

“এর বেশি দেওয়ার ক্ষমতা নেই।” প্রেমিক বলেছিল। এর পরে বিয়েতে বাধা হয়নি।

আমার বাংলাদেশি বন্ধুরা কলকাতায় আসতে খুব পছন্দ করেন। যাঁরা চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যেতে পারেন না আর্থিক কারণে, তাঁরা এই শহরের ওপর ভরসা রাখেন। আর যাঁরা বেড়াতে আসেন তাঁদের মূল লক্ষ্য থাকে কেনাকাটা। কলকাতা হয়ে আজমির শরিফে গিয়ে মনে শান্তি নিয়ে ফিরে যাওয়ার পথে নিউমার্কেটে না গেলে স্বস্তি পান না। লক্ষ করেছি, এঁরা যদি বিমানে আসেন তাহলে এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছে যান নিউমার্কেট এবং পার্ক স্ট্রিটের মাঝখানের এলাকায়। যদি বাসে আসেন তাহলে তাঁর যাত্রাপথ শেষ হয় মার্কুইস স্ট্রিটে। ওই এলাকায় প্রচুর হোটেল তৈরি হয়েছে হাজার থেকে দু’হাজারের মধ্যে। ঘরগুলো সব হোটেলেই প্রশস্ত নয়, ঢাকায় যাঁর তিনতলা বাড়ি তিনিও ওই আট বাই দশ ফুটের ঘরে দিব্যি থাকেন। এইসব বন্ধুদের আমি অনেকবার অনুরোধ করেছি, ‘আপনারা উত্তর অথবা দক্ষিণ কলকাতায় চলে আসুন। ওই টাকায় আরও ভালভাবে থাকতে পারবেন।’ ওঁরা শুনেছেন, কিন্তু মত পাল্টাননি। শেষ পর্যন্ত একজন মুখ খুললেন, ‘আসলে এই এলাকায় আমরা নিজেদের নিরাপদ মনে করি। তাছাড়া নিউমার্কেট কাছেই, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, চিড়িয়াখানা যেতে সুবিধা।’

তাঁকে বোঝাই, রাসবিহারী অ্যাভিনিউ বা কলেজ স্ট্রিট আরও বেশি নিরাপদ জায়গা। ‘আপনারা বাংলায় কথা বলেন। যেখানে আছেন তা একদা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের এলাকা ছিল। এখন হিন্দি-উর্দুভাষীদের জায়গা। এই ভাষা আপনাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে একসময় আপনারা আন্দোলন করেছিলেন। যেখানে যেতে বলছি, সেখানে সবাই বাংলায় কথা বলে।’

ভদ্রলোক বললেন, ‘এখানে রাস্তায় নামলে অন্য বাংলাদেশিদের দেখতে পাই। কয়েক বছর আগে খাওয়ার খুব কষ্ট ছিল এখানে। এখন বাংলাদেশের রান্না খাবার রেস্টুরেন্টে পাওয়া যাওয়ার সুবিধা হয়েছে।’ বুঝলাম আমাদের সুবিধে আর ওঁর সুবিধার মধ্যে তফাত আছে।

শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক চূড়ান্ত কথাটি বললেন, ‘দ্যাখেন, আমি যখন প্রথম এই এলাকায় আসি তখন দোকানের সাইনবোর্ড হয় ইংরেজি, নয় হিন্দিতে লেখা থাকত। এখন বেশিরভাগই বাংলায় লেখা। ডজনখানেক টাকা ভাঙানোর দোকান হয়ে গেছে, সবাই বাংলা বলে। এখন জায়গাটাকে বাংলাদেশের অংশ ভাবতে ইচ্ছে করে। এই যে কস্তুরি, রাঁধুনি প্রিন্স রেস্টুরেন্টে যাঁরা ভিড় করেন, তাঁদের আশিভাগই বাংলাদেশীয় মানুষ। পশ্চিমবাংলার প্রধান শহর কলকাতাকে আর বাঙালিদের শহর বলা চলে না। আমরা এই হিন্দি এলাকাকে বাংলা করে দিয়েছি।’ ভদ্রলোক বেশ গর্বের সঙ্গে জানালেন।

কথাটার অনেকখানি সত্যি। কলকাতা শহরে বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের ভিড়। ভারতের অন্য শহরগুলোতে এইরকম ভিড় জমতে দেখা যায় না। এই শহরে স্নান ও খাওয়ার জল বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। এই শহরের ফুটপাতে দিব্যি রাত কাটানো যায়। শরীরে শক্তি নিয়ে এই শহরে এলে মুটেগিরি করতে দু’দিন অপেক্ষা করতে হয় না। দু’দিন দেখে নিলে বিনা লাইসেন্সে রিকশা টানা যায়। কাছাকাছি রিকশাওয়ালাদের ডেরায় গিয়ে দেখেছিলাম, কয়লার উনুন জ্বালিয়ে এগারোজন রান্না করছে। রুটি আর তরকারি। একটাই ঘর। যেখানে পাঁচজন মেঝেতে শোয়। ছয়জন বাইরের ফুটপাতে। বৃষ্টি এলে ওই ঘরে ঠাসাঠাসি। কর্পোরেশনের জলে নাওয়া-খাওয়া। মাসের খরচ মাথাপিছু পাঁচশো টাকা। দুপুরে ছাতু মেখে পেট ভরানো। রোজগার কত? মাসে গড়পড়তা ছয় হাজার টাকা। চারশো টাকা পোস্ট অফিসে জমা দিয়ে দেশে পাঠায় পাঁচ হাজার। সেই টাকায় বাড়ি ভাল হচ্ছে, জমি বাড়ছে। বছরে মাসখানেকের ছুটিতে সব দেখে আসা। এই সুবিধে দিল্লিতে সম্ভব নয়। মুম্বইতে তীব্র প্রতিযোগিতা। চেন্নাইতে ভাষার সমস্যা। কলকাতায় বাঙালিবাবুরা ভাঙা হিন্দিতে তাদের সঙ্গে কথা বলে। বাংলা বলে বিব্রত করে না। কিন্তু এই বিহারের মানুষেরা কলকাতার কোনও নির্দিষ্ট এলাকায় থাকে না। তবে দলবদ্ধ হয়ে ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।

কিন্তু হিন্দি-উর্দুভাষী মুসলমানরা কলকাতায় নিজেদের এলাকা তৈরি করে নিয়েছেন। উত্তরের রাজাবাজারে ঢুকলে মনে হবে উত্তরপ্রদেশের কোনও শহরে পৌঁছে গিয়েছি। এদিকে খিদিরপুর ব্রিজ থেকে গঙ্গা পর্যন্ত এলাকায় কোথাও বাংলা নেই। আগে খিদিরপুরের অনেক জায়গায় সম্ভ্রান্ত বাঙালিদের বাস ছিল। তাঁরা এখন কোণঠাসা। এই মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা রাজনীতির কারণে দলাদলি করলেও ধর্ম ও ভাষার প্রতি একনিষ্ঠ। বাংলায় কথা বলে হিন্দিতে জবাব পেয়েছি। এই ব্যাপারটা মুম্বইতেও ভাবা যায় না। কোনও মারাঠি তাঁর ভাষায় প্রশ্ন করলে সেখানকার বাঙালি কখনওই বাংলায় জবাব দেবেন না।

রাজস্থানের মানুষরা আগে এসেই বড়বাজারে উঠতেন। বাড়তে বাড়তে বড়বাজার ক্রমশ মাড়োয়ারি এলাকা হয়ে গেল। সেখানকার জীবনযাপনের পদ্ধতির সঙ্গে বাঙালিদের কোনও মিল নেই। এমনকী ওখানে যেসব সবজি, ফল বিক্রি হয়, তাদের চেহারা আকর্ষণীয়, যা শ্যামবাজার বা গড়িয়াহাটে পাওয়া যায় না। বোঝাই যায়, বেশি দাম দিয়ে ভাল জিনিস পেতে তাঁরা নারাজ নন।

তামিল তেলুগুরা প্রথমে আস্তানা গেড়েছিলেন দক্ষিণ কলকাতায়। ভাড়াটে হিসাবে ওঁরা বাঙালি বাড়িওয়ালার কাছে নিরাপদ বলে ধারণা ছিল। ক্রমশ সংখ্যা বাড়তে ওঁরা এখন চলে গেছেন সল্টলেকে। এককালে পাঞ্জাবিদের আস্তানা ছিল ভবানীপুরে। মূলত ট্যাক্সি, গ্যারাজ ব্যবসা করতেন তাঁরা। এখন শহরে তাঁদের সংখ্যা কমেছে।

ওড়িশা থেকে কলকাতায় এসে পানের দোকান, রান্না আর জল বয়ে দেওয়ার কাজটা যাঁরা শুরু করেছিলেন, তাঁরা মূলত একই এলাকায় থাকেন। আমার বাড়ির কাছেই যে এলাকা রয়েছে তাকে উড়িয়াপাড়া বলা হয়। বড়-বড় রান্নার সরঞ্জাম নিয়ে তাঁরা অপেক্ষা করেন কাজের জন্যে। ক্যাটারারদের হাতে অনুষ্ঠান চলে যাওয়ার পরেও তাঁদের চাহিদা কমেনি। মাঝে মাঝে মনে হয়, এঁরা এত ভাল রান্না কোথায় শিখলেন? আমাদের হোস্টেলে বা মেসে ঠাকুর মানেই তো ওড়িশার মানুষ। তাঁদের রান্না খেয়ে অরুচি হয়ে যেত।

মোটামুটি কলকাতাকে যদি বিভিন্ন প্রদেশের এবং ধর্মের বাসস্থান বলি তাহলে ভুল বলা হবে না। শ্যামবাজার ছাড়িয়ে এসেই রাজাবাজার, হিন্দিভাষী মুসলমান এলাকা। মৌলালি পেরিয়ে পার্ক সার্কাসও তাই। ধর্মতলা কোনও মতেই বাংলাভাষীদের জন্য নয়। নয় পার্ক স্ট্রিটও। বড়বাজার মাড়োয়ারিদের। খিদিরপুর এলাকাটা হিন্দিভাষীদের। দক্ষিণ কলকাতায় একাংশ দক্ষিণ ভারতের। বাইপাসের অনেকটা এলাকা এখন চায়না টাউন। নামকরণ সার্থক।

আমরা বাঙালিরা প্রথমে চিনে খাবার খেতে শিখলাম। তারপর তন্দুরি রুটি এবং চাপ। শেষে ধোসা, বড়া, উত্তাপম। রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়ার প্রস্তাব এলে ছেলেমেয়েরা ভাল বাংলা খাবারে আপত্তি জানায়। অথচ ঠাকুমা-দিদিমারা চলে যাওয়ার পরে বাড়িতে বাংলা রান্নার পাঠ প্রায় নেই বললেই চলে। আমরা তাই এখন সর্বভারতীয়। এক বন্ধু আশঙ্কার কথা বললেন—কলকাতা থেকে সমস্ত অবাঙালি যদি একসঙ্গে দেশে ফিরে যান তাহলে কী হবে আমাদের?

শোনামাত্র মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কে রিকশা চালাবেন, কে ট্যাক্সি? কে মাল বইবে? পরিশ্রমের কাজগুলো কে করবে? আমরা বাঙালি তো ক্রমে-ক্রমে পি-পু-ফি-শু-তে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। পিঠ পুড়ছে? ফিরে শুই!

তাহলে কি ভারতবর্ষের নাগরিকদের মনে নির্বাচন এবং তার মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকার সম্পর্কে অনীহাভাব এসে গিয়েছে? প্রতিষ্ঠিত ও প্রচারিত বড় দলগুলোর আচরণ দেখে-দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়েও মানুষ গুমরে মরেছে, কিছু করতে পারেনি। বড় নৌকার নিরাপত্তাহীনতা থেকে বাঁচতে মানুষ জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না। তার একটা অবলম্বনের প্রয়োজন হয়। একটা কলাগাছ অথবা কাঠের টুকরো সেই অভাব পূর্ণ করতে পারে। কিন্তু সেই ভরসাটুকু না পেলে নৌকার সঙ্গে জলে তলিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

যত দিন যাচ্ছে, সভ্যতা যত এগোচ্ছে তত মানুষের ভ্রষ্টাচার বাড়ছে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতারা যদি ক্ষমতাসীন হয়ে থাকেন তাহলে তাঁদের সৌজন্যবোধ লোপ পেয়ে যাচ্ছে। তাঁদের আচার-আচরণ এবং কথাবার্তায় সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হচ্ছে। দুঃখ পাচ্ছে কিন্তু কিছু করার থাকছে না। উনিশশো বাহান্ন থেকে উনিশশো সাতষট্টি, এই ষোলো বছরে জাতীয় কংগ্রেস স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান ভূমিকা নেওয়ার সুবাদে মানুষের শ্রদ্ধা নিয়ে ক্ষমতায় এসে ক্রমশ হতাশা তৈরি করেছিল। মনে রাখতে হবে বিধানচন্দ্র রায় এবং প্রফুল্ল সেনের মতো মানুষ মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তখনকার কংগ্রেসি ক্ষমতাবানরা জমিদারি চালানোর ভঙ্গিতে রাজ্যশাসন করতেন। চুরি-চামারিও চলছিল। একজন রাষ্ট্রমন্ত্রী রেসকোর্সের ঘাস কাটার ইজারা নিয়ে অর্থবান হয়েও খুশি হননি, তিনি কম্বল কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লেন। তখনকার মুখ্যমন্ত্রীর সততার কারণে তাঁকে সরে যেতে হয়েছিল। কিন্তু বিধানচন্দ্র লবণহ্রদ উপনগরী, কল্যাণী, দুর্গাপুর ইত্যাদি তৈরি করলেও তাঁর নিজের মানুষগুলোর চেহারা দেখে শিউরে উঠছিল মানুষ। প্রফুল্ল সেনের মতো মুখ্যমন্ত্রী, যাঁর সঞ্চয় বলে কিছু ছিল না। শেষ দিনগুলোতে অর্থকষ্টে ছিলেন, তিনিও ক্ষমতায় থাকার সময়ে এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ছেষট্টি সালেও মানুষ কল্পনা করতে পারত না কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে সরানোর কথা। জলপাইগুড়ির এমএলএ এবং মন্ত্রী শ্রীযুক্ত খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের একটি কথা এখনও মনে আছে ‘দ্যাখো বাবা, আমরা কংগ্রেসিরা খেয়ে-খেয়ে ঢোল হয়ে আছি। পেটে আর জায়গা নেই। কিন্তু বিরোধীরা না খেয়ে শুকিয়ে আছে। যদি মিরাক্যাল হয়। ওরা ক্ষমতায় আসে, তাহলে তো হাঘরের মতো খাবে।’

তবু মানুষ যখন অজয় মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টকে নির্বাচনে লড়তে দেখল তখন তারা বিকল্প খুঁজে পেল। ওই জলে ভেসে যাওয়া কাঠের টুকরোকে আঁকড়ে ধরল তারা। ফলে কংগ্রেস ক্ষমতা থেকে সরে গেল। কিন্তু যখন সেই মানুষরাই দেখল নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে বামফ্রন্ট তৈরি হয়েও দাঁড়াতে পারল না, তখন বাধ্য হল কংগ্রেসকেই ভোট দিতে। শ্রীযুক্ত সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ফিরে এলেন। কিন্তু জরুরি অবস্থায় কংগ্রেসকে যে ভূমিকা নিতে মানুষ দেখল, তা থেকে পরিত্রাণের আশায় বামফ্রন্টকে ভোট না দিয়ে তাদের উপায় ছিল না। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এল। নির্বাচনের আগে প্রচার করা হয় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে। কিন্তু জনতা যখন নীরবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, সেখানে ওই প্রচারের কোনও গুরুত্ব থাকে না।

চৌত্রিশ বছর ধরে বা শেষের দশ বছরে বাংলার মানুষ যতই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠুক, বামফ্রন্টকে সরাবার কথা ভাবতেই প্রতিপক্ষ হিসাবে কাউকে না পেয়ে মাথা নিচু করে ক্ষমতাসীনকেই মেনে নিতে বাধ্য হত। ক্যাডারদের অত্যাচার এবং শোষণ এমন একটা জায়গায় চলে গিয়েছিল যা থেকে নিস্তার প্রতিপক্ষ কংগ্রেস দিতে পারবে না বলে জেনে গিয়েছিল মানুষ।

ততদিনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বামফ্রন্ট বিরোধী বক্তব্য রাখছিলেন তা প্রায় মানুষের মনের কথা। মানুষ দেখল মহিলা একাই দুর্গতদের পাশে ছুটে যাচ্ছেন, তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। দেখল, মহিলার পাশে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতারা নেই। যাঁদের সঙ্গে নিয়ে পরিবর্তন আনতে চাইছেন তাঁরা প্রায় অপরিচিত মুখ। এবং তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন শিল্পী, অভিনেতা, গায়ক এবং বুদ্ধিজীবীরা, যাঁদের সবাই শ্রদ্ধার চোখে দ্যাখে। মানুষের মনে হল মমতাকে সমর্থন করলে তাঁর দলের ভূমিকা কংগ্রেস অথবা বামফ্রন্টের হবে না। লোকসভায় যার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল, বিধানসভায় তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটল। শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম থাকায় তাঁর স্নেহধন্যরা নির্বাচন বৈতরণী পার হয়ে গেলেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি যদি কোন জড়ভরত প্রতিবন্ধীকে মনোনয়ন দিতেন তাহলে তাকেও মানুষ বিজয়ী করত। পৃথিবীর গণতন্ত্রের ইতিহাসে এরকম ঘটনা ঘটেছে কি না জানি না।

 দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় থাকা বামপন্থী দল যাদের নিজস্ব রাজনৈতিক চেতনা আছে, শৃঙ্খলা আছে, কমিউনিজমে যারা নিজের দীক্ষিত বলে দাবি করে, তারা একজন মহিলার সততার সামনে দাঁড়াতে পারল না। এই মহিলা কোনও রাজনৈতিক আদর্শের কথা ঘোষণা করেননি। তিনি শুধু পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। আর সেটাই হয়ে গেল তুরুপের তাস। মমতা যদি পরিবর্তনের ডাক না দিয়ে তাঁর তৈরি আদর্শের কথা বলতেন তাহলে হয়তো বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হত না।

অর্থাৎ যখন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর মানুষ আস্থা হারায় তখন দিশেহারা অবস্থায় সে পথ খোঁজে। এই যে এবার বিজেপি এবং কংগ্রেসকে কোণঠাসা করে আম পার্টি, যার বয়স বছর খানেকও নয়, দিল্লিতে ক্ষমতায় এল, তা ওই পথ খোঁজার একটা নিদর্শন। কিন্তু মানুষের এই আবেগ, বাঁচার এই যে চেষ্টা, তা যদি মর্যাদা না পায় তাহলে আরও অন্ধকার নামতে বাধ্য। আম পার্টি শপথ নেওয়ার পরেই কিছু বিচ্যুতির কথা মানুষ জানতে পেরে উদ্বিগ্ন। নির্বাচনের আগে যা বলে তারা মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তা রক্ষা করার দায়িত্ব ও কর্তব্য আম পার্টির।

এই যে পরিবর্তন, তা মানুষ এনেছে। দায়িত্ব দিয়েছে নবীন দলকে। যাদের শরীরে দীর্ঘ ক্ষমতার মেদ জমেনি। ক্ষমতার মেদ রাজনৈতিক নেতাদের অন্ধ করে দেয়। তখন তাঁর আচরণ একদম ডিক্টেটারের মতো হয়ে যায়। তিনি যা ইচ্ছে তা করতে পারেন, মঞ্চে দাঁড়িয়ে অশ্লীল এবং আইনবিরুদ্ধ গালাগালি অথবা হুমকি দিতে পারেন। দশজনের চোখের সামনে তাঁর অনুগামীরা খুন জখম বা ধর্ষণ করলেও স্বচ্ছন্দে বলে দিতে পারেন তাঁর দলের কেউ ওই কাজ করেনি।

সাধারণ মানুষের ভয় এখানেই। ওই প্রবাদটি যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সত্যি হয়ে যায়। যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। আমি অবাক হই যখন ভাবি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাঁধে সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন তাঁর দলের নেতারা। এত কাজ, মত ভাবনা এত দুশ্চিন্তা সামলে একটি মানুষ কতদিন স্থির মস্তিষ্কে কাজ করে যেতে পারেন? এই আড়াই বছরে যে সামান্য ত্রুটি দেখা গিয়েছে কাজের চাপের কাছে তা কণামাত্র। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সবই তাঁকে সামলাতে হচ্ছে। পশ্চিমবাংলা কেন, গোটা বাংলার ইতিহাসে তাঁর মতো জনপ্রিয় নেত্রী যে আর কেউ ছিলেন না তা স্পষ্ট বলা যায়। আমি নেতাজি, দেশবন্ধু এবং বিধানচন্দ্রের নাম মনে রেখেই বলছি। নেতাজির খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা বেড়ে গিয়েছিল তিনি দেশত্যাগ করে আজাদহিন্দ ফৌজ গঠন করার পরে।

আশঙ্কা একটাই। আড়াই বছরের সরকারে মমতা যেসব কাজ করেছেন তা যেমন মানুষকে উজ্জীবিত করেছে তেমনই তাঁর নিচের তলায় একটু একটু করে মেদ জমছে না তো? মমতার মা দুর্গার মতো দশটা হাত নেই। কিন্তু এখনই রাশ না টানলে মানুষ যদি আবার হাঁসফাঁস শুরু করে তাহলে পৃথিবীর মানুষ আবার গণতন্ত্রের আত্মহত্যা দেখতে পাবে। এখনও মানুষ মমতার পাশে আছে। মাটির তলার উইপোকাগুলোকে সরানো দরকার।

বইমেলায় প্রথম গিয়েছিলাম বিমলদার সঙ্গে। মেলার প্রথম বছরে। তখন আমাদের বৈকালিক আড্ডা ছিল কার্জন পার্কে। বিমলদাকে মধ্যমণি করে প্রতিষ্ঠিত এবং নবীন লেখকরা ট্রামে চেপে গিয়েছিলাম, মনে আছে। তখন মেলা বসত রবীন্দ্রসদনের সামনে। বই-এর দোকানগুলোতে পাঠক গিয়ে বই দেখতে পারতেন হাতে নিয়ে। বেশ ভদ্রগোছের ভিড় হত। বিমল কর নাকে রুমাল চেপে হাঁটতেন মেলার ভিতরে। এই নিয়ে রসিকতা করতাম আমরা। কারণ প্রথম দিকের মেলায় ধুলো উড়ত না।

বিকেলের দিকে মেলায় গেলে প্রায় সমস্ত জীবিত লেখকদের দেখতে পেতাম। রমাপদ চৌধুরীর একা হাঁটার অভ্যেস ছিল না। দু-তিনজন সবসময় সঙ্গী হতেন। সমরেশ বসুর চেহারা এবং হাসি প্রায় উত্তমকুমারের মতো ছিল। মেলায় তাঁকে দেখলে চোখ ফেরানো যেত না। সাগরময় ঘোষ গম্ভীর মুখে আনন্দ পাবলিশার্সের সামনে চেয়ার পেতে বসতেন। বরেন গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, “সাগরদা মুখ গম্ভীর করে কেন থাকেন জানিস?” উত্তরটা নিশ্চয়ই বলেছিলেন, “হেসে কথা বললে কেউ যদি ‘দেশে’ গল্প ছাপতে বলে, তাই!” শংকর, সুনীলদা, শীর্ষেন্দুদাদের নিয়মিত দেখা যেত। থাকতেন অতীনদা, প্রফুল্লদাও। তবে দেখা যেত যে যাঁর প্রকাশকের স্টলেই স্থিতু হতেন। কিন্তু পাঠকরা বই-এর সঙ্গে তার লেখকদের দেখতে পেতেন, কথা বলতেন, অটোগ্রাফ নিতেন। তখন যাওয়ার জায়গা ছিল একটাই, কফি হাউসের স্টলটি। বিমল কর মশাই দীর্ঘদিন বইমেলার সম্পাদক ছিলেন। সেই মেলা যখন অনেক বড় চেহারা নিয়ে পার্ক স্ট্রিটের উল্টোদিকে চলে এল তখনও চরিত্র এক থাকল। সেই সময় লেখক হিসেবে সামান্য পরিচিতি হয়েছে, কিন্তু বড় লেখকদের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হইনি। লক্ষ করতাম, বড় বয়স্ক লেখকদের অনেকেই নিজের বৃত্তে থাকেন, সবাই মিলে একটা বৃত্ত রচনা করেন না। সুনীলদা ‘বুধসন্ধ্যা’ তৈরি করলেন। সেখানে সমরেশদা, দিব্যেন্দু, সাগরদা, বুদ্ধদেবদাকে টেনে নিলেন। কিন্তু অনেকেই যাননি। যাঁরা যাননি তাঁরা সামনাসামনি দেখা হলে হেসে কথা বলতেন, তার বেশি নয়।

বইমেলায় আগুন লাগল। একজন মারা গেলেন। আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম, বইমেলাকে বাঁচাতেই হবে। স্বীকার করতে হবে তৎকালীন সরকার সাহায্য করেছিলেন। তার চেয়ে বেশি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন পাঠকরা। মনে আছে, পোড়া, আধপোড়া বই নিলাম করা হয়েছিল একটি মঞ্চ তৈরি করে। বিদেশে থাকেন এমন বাঙালি পাঠক সেবার মেলায় ছিলেন। তাদের অনেকেই স্মৃতি হিসেবে সেসব বই কিনেছিলেন। মেলা আবার জেগে উঠল। তখন বইমেলা মানে ছিল বই-এর মেলা, লেখক-পাঠক প্রকাশকদের মেলা। কলকাতার যে কোনও প্রান্ত থেকে পার্ক স্ট্রিটের বইমেলায় যাতায়াত করতে কোনও অসুবিধে হয়নি। ধর্মতলা অথবা পার্ক সার্কাস থেকে হেঁটে যেতে দেখেছি অনেককেই। সন্ধে সাতটার পরে বই-এর ভারী প্যাকেট বইছেন অথচ মুখে হাসি রয়েছে এমন প্রচুর মানুষকে দীর্ঘপথ হেঁটে নিজের গন্তব্যের বাস ধরতে দেখেছি। জিজ্ঞাসা করেছি, এতটা পথ হাঁটছেন কেন, পার্ক স্ট্রিটেই তো বাসস্টপ রয়েছে? উত্তর শুনেছি, ওখানে এখন খুব ভিড়। তাছাড়া সঙ্গে বই থাকায় হাঁটার কষ্ট হচ্ছে না। ভাবা যায়? তখন বইমেলায় খাবারের স্টল বাড়ছে। হাজার হাজার মানুষ অতক্ষণ বইমেলায় অভুক্ত হয়ে থাকবেন কেন? কিন্তু স্টলগুলো ছিল একপাশে, বই-এর স্টলের লাগোয়া নয়। ইংরেজি বই-এর স্টলগুলো তখন জমজমাট, ছোটরা ফেলুদা কিনতে লাইন দিচ্ছে।

বইমেলাকে সেখান থেকেও সরতে হল। মূলত সামরিক বাহিনীর আপত্তিতে কলকাতার বইমেলা যখন বন্ধ হওয়ার জোগাড় তখন সুভাষ চক্রবর্তী মশাই গিল্ডের পাশে দাঁড়ালেন। শুরু হল সল্টলেক স্টেডিয়ামে বইমেলা। উত্তরের লোকদের অসুবিধে হয়নি সেখানে যেতে, হল দক্ষিণের।

আমি এবং আমার মতো অনেকেই তখনও নেশায় আক্রান্ত। বইমেলায় না গেলে ভাত হজম হত না। ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছিল লিটল ম্যাগাজিনের উচ্ছ্বাস। তাঁরা চিৎকার করে মেলা জমিয়ে দিতেন। মমার্তের সামনে শিল্পীরাও ছবি নিয়ে বসে যেতেন। এটা অবশ্য রবীন্দ্রসদনের সামনে যখন মেলা শুরু হয়েছিল তখন থেকেই দর্শক-আকর্ষণ করত। প্রকাশ কর্মকারের মতো শিল্পী মেলার মাঠে বসে তাঁর নিজস্ব স্টাইলে ছবি আঁকছেন দেখে ধন্য হয়েছি।

কিন্তু সল্টলেক-মেলা থেকেই ছন্দপতন শুরু হয়ে গিয়েছিল। দশদিনে এক কি দুদিন বিখ্যাত লেখকদের দেখা যেত সেখানে। রমাপদদা যাওয়া বন্ধ করে দিলেন, সমরেশদা ততদিন আর আমাদের মধ্যে নেই। সুনীলদা-শীর্ষেন্দুদা অনিয়মিত যেতেন। প্রফুল্ল রায় কদাচিৎ। মনে হত, মেলা করতে হবে বলেই করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন পেটের অসুখে ভোগা রোগী যে পথ্য খায় তার মতো মেলার অবস্থা। অবশ্য আমার সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন না। যেমন, শোভন বোনার্জি, যিনি একদম গোড়া থেকে মেলার আর্কিটেক্ট হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন, বললেন, “সল্টলেক স্টেডিয়ামে যে বইমেলা হয়েছিল সেটি সবচেয়ে সুসংবদ্ধ ছিল।

তারপর মেলা উঠে এল মিলন মেলার মাঠে যেখানে শহরের যে কোনও প্রান্ত থেকে পৌঁছানো রীতিমতো কষ্টের। প্রথমদিকে বাস পাওয়া যেত না। পার্ক সার্কাসের মোড় থেকে বেশ কয়েক মাইল হেঁটে যাওয়া সম্ভব হত না। ভেবেছিলাম মেলায় মানুষ যাবেন না। কিন্তু ধারণা ভুল হয়ে গেল। বই-এর ব্যাপারে মানুষের পাগলামি দেখে অবিশ্বাস্য শব্দটিকে বাতিল করতে হল। ছুটির দিনগুলো তো বটেই, অন্যদিনেও মিলন মেলার মাঠ জমজমাট। দেখে ভাবতাম, এত মানুষ কী করে এখানে এল, কী করে সবাই বাড়ি ফিরে যাবেন?

কিন্তু মিলন মেলায় গিয়ে বইমেলার চরিত্র বদল হয়ে গেল। এখন একজন প্রিয় বিখ্যাত লেখককে মেলায় দেখতে পাওয়া প্রায় লটারির টাকা পাওয়ার শামিল। একদা যাঁরা তরুণ লেখক হিসেবে প্রত্যাশা জাগিয়েছিলেন তাঁরা ক্রমশ স্তিমিত হয়ে গেছেন। পাঠকদের উৎসাহে ভাটা পড়েছে। তবু মানুষ আসছে। আসছে চলে যাওয়া বিখ্যাত লেখকদের বই কিনতে এবং গল্প-উপন্যাসের বাইরে আচমকা প্রচারিত কিছু বই সংগ্রহ করতে। যেমন, এ বছর সুচিত্রা সেনকে নিয়ে লেখা বইটির প্রতি আগ্রহ অনেকের। কিংবা বাঙালির স্মৃতিতে যেসব মানুষ একভাবে ছিলেন তাঁদের অন্য রঙিন চেহারা কল্পনা করে পাঠকের কৌতূহল উস্কে দেওয়া বইগুলোর বিক্রি কম নয়। ইদানীং শংকর গল্প-উপন্যাস তেমন লিখছেন না। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ইতিমধ্যে নিজেকে ঈশ্বর বিশ্বাসী এবং রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দে নিমজ্জিত লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করায় তাঁর অফুরন্ত হাস্যরস থেকে পাঠকদের বঞ্চিত করেছেন। বুদ্ধদেব গুহ কয়েক বছর ধরে খুব কম লিখছেন। প্রফুল্ল রায় অসুস্থতার কারণে লেখা কমিয়েছেন। একমাত্র শীর্ষেন্দুদাই সক্রিয় এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে। দশ বছরের ব্যবধান সত্ত্বেও আমারও বয়স বাড়ছে। এর পরে বইমেলা কি মিউজিয়াম হয়ে যাবে। পাঠক তখন দর্শক হিসেবে ব্যান্ডের গান আর চ্যানেলের ছবি দেখতে ভিড় জমাবেন? এবার মেলা দেখে সেই আশঙ্কা বেড়েছে। বাউনরাও এসে গেছে বইমেলায়। চরিত্র বদল হতে হতে বইমেলা এখন শুধু মেলায় নেমে আসছে। রাজনৈতিক দলগুলোর স্টলে তাঁদের নেতার বক্তৃতা ভিডিওতে দেখানো হচ্ছে। ধর্মীয় স্টলগুলো থেকে প্রচার চলছে।

জীবিত বড় লেখকরা ক্রমশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

গীতবিতান ছুঁয়ে বলছি, এবার মেলায় গিয়ে আবিষ্কার করলাম বুকে যে টান ছিল তা একেবারেই মুষড়ে পড়েছে। রোজ না গিয়েও দিব্যি ভাত হজম করতে পারছি।

সকালের কাগজ খুললেই মন খারাপ হয়ে যায়। শ্লীলতাহানি থেকে ধর্ষণ এবং তার বিশদ বিবরণ পড়তে আর ইচ্ছে করে না। এই ঘটনাগুলো আগেও ঘটত, কম-বেশির তর্কে না গিয়েও বলা চলে মাঝে মাঝেই কাগজের খবর হত। বানতলার ঘটনার পরে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, এরকম তো ঘটেই থাকে, কথাটা মিথ্যে নয়। কিন্তু ওই অপ্রিয় সত্যি কথাটা বলার জন্যে মানুষ তাঁকে অশ্রদ্ধা করেছিল। কিন্তু এখন ইলেকট্রনিক মিডিয়া শক্তিশালী হওয়ায় ধর্ষণ করে ধর্ষক বা ধর্ষকরা চুপচাপ চলে যাচ্ছে বা তারা যদি বুঝতে পারে মেয়েটি তাদের চিনতে পেরেছে তাহলে অবশ্যই খুন করে যাচ্ছে। কোনও ক্ষেত্রে খুন করতে ভুল হয়ে গেলে পরে পুড়িয়ে মারছে। না মারলে ইলেকট্রনিক মিডিয়া এমন প্রচার শুরু করে দেবে যে ধরা পড়তে বাধ্য হবে তারা। তারা ধর্ষণ করছেঞ্জযৌন তৃপ্তির জন্য, খুন করছেঞ্জআত্মরক্ষার তাগিদে। এই ভয়ঙ্কর খবরগুলো পড়লে আর ভাল লাগে না।

কোনও কোনও কাগজ এখন যে ভূমিকা নিয়েছে তা গত ষাট বছরে দেখা যায়নি। সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের মানী মানুষ যদি সরকার সমর্থক না-হন তাহলে তাঁদের কথা বলতে গিয়ে অশ্লীল শব্দ বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করছে। বড় অক্ষরে সেই শব্দগুলো ছাপা হচ্ছে যা শ্লীলতাহানি অথবা ধর্ষণের আর একটি বিকৃত চেহারা। কেউ প্রতিবাদ করছেন না। আর এখন প্রতিবাদ করলে তার আওয়াজ হুঙ্কারে চাপা পড়ে যাবে। সৌজন্যবোধ লোপ পেয়ে গিয়েছে একেবারে। এককালে বুদ্ধদেব বসু বা সমরেশ বসুর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছিল কারণ আবেদনকারী তাঁদের রচনায় অশ্লীলতা পেয়েছিলেন। সাহিত্যে অশ্লীলতা খুব গোলমেলে ব্যাপার। দুই বিখ্যাত লেখক সসম্মানে মুক্ত হয়েছিলেন। এখন মনে হয় তাঁদের অপরাধ যদি এক দুই তিনের মধ্যে হয়ে থাকে তাহলে এখন সাতাশি অষ্টআশি করেও পার পেয়ে যেতে অসুবিধে হচ্ছে না।

আমরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে কথা বলি, প্রকাশ্যে যৌন আচরণের নিন্দা করি। কোনও মহিলা শিষ্টভাবেও যদি সংক্ষিপ্ত পোশাকে গাড়ি থেকে নেমে দোকানে ঢোকেন তাহলে তাঁর নিন্দায় সোচ্চার হই। আগে হিন্দি ফিল্মে স্বল্পপোশাকে যে মেয়েরা নাচতেন তাঁদের ‘ভ্যাম্প গার্ল’ বলে উদাসীন থাকতাম। এখন দামি নায়িকারা ওই পোশাকে শরীর দেখিয়ে নাচছেন আর আমরা দু’চোখ দিয়ে গিলছি। বাংলা ছবিতে অশ্লীল শব্দের ব্যবহারের কথা কেউ চিন্তাও করতেন না। বছর তিনেক হল তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রসেনজিৎ অভিনীত একটি ছবি দেখতে গিতে আবিষ্কার করেছিলাম সামনের সারিতে বসা দু’জন মধ্যবয়সিনী মোবাইলে সেই সংলাপ রেকর্ড করছেন। বিরতির সময় প্রশ্ন করলে হেসে বললেন, ‘এমনিতে তো কেউ আমাদের সামনে বলে না তাই রেকর্ড করে নিয়ে যাচ্ছি। বাড়িতে গিয়ে শুনব।’ এরপরে কেউ কেউ বলতে পারেন সেন্সরবোর্ড কী জন্য আছে? ভারতচন্দ্র ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন। নগরে আগুন লাগলে দেবালয় দগ্ধ হয়। কী করবে সেন্সর বোর্ড?

আমাদের মধ্যে পুরনো যা কিছু মূল্যবোধ তা ভেঙে তছনছ করে দেওয়ার প্রবণতা চলে এসেছে। পশ্চিমের মানুষ যা করে-করে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে তা এখন আমরা করছি। চুরাশি সালে ম্যানহাটনের সেক্সশপে ঢোকার জন্য লাইন পড়ত। কুড়ি ডলারের টিকিট ছিল। বিরানব্বইতে গিয়ে দেখেছি সেখানে মাছি উড়ছে। মানুষ নেই। এখন তো সেক্সশপ উঠে গিয়ে অন্য দোকান হয়েছে। আমাদের এখানে ওই লাইন দেওয়ার সময়টা শুরু হয়েছে। আমরা মুখে নীতির কথা বলি আর ভিতরে-ভিতরে রসে টসটস করি। সেদিন শুনলাম, দুই তরুণ আলোচনা করছে, একটি তরুণীকে একটি তরুণ একা ধর্ষণ কী করে করতে পারে? মেয়েটির সাহায্য না পেলে কি সেটা সম্ভব? ইত্যাদি ইত্যাদি। বুঝতেই পারছিলাম ওরা এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে বেশ আনন্দ পাচ্ছে।

প্রতিদিনের খবরের কাগজে পত্র-মিতালি শিরোনামায় যে বিজ্ঞাপনগুলো ছাপা হয় তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে কেউ কী ভেবেছেন? বিজ্ঞাপন ছাপলে কাগজের মালিক টাকা পাবেন কিন্তু কী বিজ্ঞাপন ছাপছেন তা নিয়ে ভাববেন না? বিভিন্ন কাগজে সরাসরি যে বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে তা দেখেও অন্ধ হয়ে আছেন পুলিশ কর্তারা?

‘আমি রিকু, বোল্ড রিলেশন ও উষ্ণ অনুভূতি পেতে আমাকে ফোন করুন।’ তার নিচে মোবাইল নাম্বার।

‘শরীর মন উন্মাদনায় ভরিয়ে দেব। একদম ঠকবেন না।’ তার পর মোবাইল নাম্বার।

অর্থাৎ প্রকাশ্যে আমন্ত্রণ, টাকা দিন আমি আপনাকে যৌন আনন্দ দেব। রোজ এগুলো পড়তে -পড়তে ছেলেরা যদি অভিযান করে তাহলে তাদের কে আটকাবে? ইদানীং মেয়েদের আকর্ষণ করতে বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে, ‘অত্যন্ত গোপনে নির্বাচিত পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটান।’

রোজ কাগজে এসব ছাপা হচ্ছে। আমরা দেখছি। চোখ বন্ধ করে থাকছি। একটু খোঁজখবর করলেই পুলিশ এদের সঠিক চেহারা জানতে পারবে। কিন্তু তাদের সেই সময় কোথায়? কলকাতার বিখ্যাত রেডলাইট এলাকায় যাওয়ার জন্য বিজ্ঞাপন ছাপা হয় না। কিন্তু সেখানকার সুন্দরীদের সাহেবপাড়ায় নিয়ে গিয়ে সাময়িক সঙ্গিনী বানিয়ে প্রচুর রোজগার করতে বিজ্ঞাপন দিতেই হয়। শুধুই কি রেডলাইট এলাকার সুন্দরী? অভাবগ্রস্ত পরিবারের মেয়েরাও কি এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন না? বেকার সুদর্শন তরুণরাও তো রোজগার করতে বক্সে নাম লেখাচ্ছেন।

অথচ কেউ কিছু বলছেন না। এমন দিন বেশি দূরে নেই যেদিন সোনাগাছির সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের পাশে পর-পর হোর্ডিং দেখব ভিতরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে। এখনও সেটা হয়নি কারণ মানুষ লুকিয়ে-চুরিয়ে ওই পথে হাঁটে। রেডলাইট এলাকায় গেলে সেটা চাউর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এই বিজ্ঞাপন দেখে পুলকিত হচ্ছে অথচ পকেটে টাকা নেই। তখন মানুষ অমানুষ হয়ে যায় যখন নির্জনে একাকী কোনও তরুণীকে দেখতে পায়। তারা ভেবেই নেয় বিজ্ঞাপন ছেপে যারা ডাক দিচ্ছে তারা যদি অন্যায় না করে থাকে তাহলে আমিও অন্যায় করছি না। সাহস বেড়ে যায়।

ফলে আমরা রোজ ধর্ষণের খবর পড়ি, আঁতকে উঠি। কিন্তু কেউ একবারও ভাবি না বিভিন্ন উপায়ে খাল কেটে আমরাই নদীতে কুমির আনছি। এই কুমির আমাদেরই উদাসীনতার ফসল।

পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের কোনও সরকার বলেনি হিন্দি অক্ষরে বাংলা লিখতে হবে। কেউ বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ঘোষণা করেনি। হুকুম হয়নি, সরকারি-বেসরকারি অফিসে হিন্দি ছাড়া অন্য কোনও ভাষা ব্যবহার করা চলবে না। না ইংরেজ সরকার, না দিল্লির ভারত সরকার। এটা আমাদের সৌভাগ্য। আবার একই সঙ্গে এই কারণেই আমরা বাংলা ভাষাকে অবহেলায় একটু-একটু করে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। কেউ এই ভাষাকে হেয় করার চেষ্টা করেনি বলে আমাদের মনে তার প্রতিরোধ করার শক্তি তৈরি হয়নি।

দেশ যখন দুটো ভাগে বিভক্ত হল তখন ভারতবর্ষের প্রদেশগুলোয় মানুষ তার নিজের মাতৃভাষা ব্যবহার করার স্বাধীনতা পেয়েছিল। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দিকে গোটা দেশের ভাষা হিসাবে ঘোষণা করেছিল কিন্তু তাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবেই প্রদেশগুলো গণ্য করেছিল। কেন হিন্দিকে কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রভাষা বলছে, তা নিয়ে কিছুদিন বিতর্ক চলেছিল, কিন্তু মাতৃভাষাকে তারা হেয় করেনি বলে তা একসময় স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল ভারতের বিপরীত প্রান্তের দু’টি অংশ নিয়ে। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের জীবনযাপন এবং ভাষার মধ্যে কোনও মিল ছিল না। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের ধর্ম ও পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের ধর্মের মধ্যে পার্থক্য ছিল না।

পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। গোটা পাকিস্তানের জনসংখ্যা যা, তার প্রায় পঞ্চান্নভাগ মানুষ তাঁরাই। কিন্তু পাকিস্তানের রাজধানী পশ্চিমে, প্রধানমন্ত্রী সেখান থেকেই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। যদিও উর্দুভাষা পশ্চিম পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা নয়, সেখানে অন্য ভাষাভাষীরাও থাকেন, তবু জিন্নাসাহেব ঘোষণা করলেন গোটা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু। খবর পাওয়া মাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছিল। দিনটা হল, এগারোই মার্চ, উনিশশো আটচল্লিশ। তাদের দাবি ছিল যাবতীয় সরকারি কাজে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করতে হবে। মুদ্রা, ডাকটিকিট এবং নৌবাহিনীর নিয়োগ পরীক্ষায় বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। পুলিশ নেতাদের গ্রেফতার করলে পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। উনিশে মার্চ জিন্নাসাহেব ঢাকায় আসেন। তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করেন বাংলাভাষার দাবি তুলে পাকিস্তানকে দু-টুকরো করার চেষ্টা বরদাস্ত করবেন না। পাকিস্তানে শুধু একটি ভাষা থাকবে, তার নাম উর্দু।

পুলিশের সন্ত্রাসে মানুষ কিছুদিন চুপচাপ থাকল। কিন্তু মনে আগুন জ্বলছিল ধিকিধিকি করে। বাঙালির ইতিহাসে এই প্রথম বাংলাভাষার প্রতি সম্মিলিত আনুগত্য দেখা গেল। এর পরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্দেশ এল, বাংলাভাষাকে আরবি অক্ষরে লিখতে হবে। সঙ্গে-সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। মৌলানা ভাসানির সভাপতিত্বে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ভাষা কমিটি তৈরি হল। এল একুশে ফেব্রুয়ারি, উনিশশো বাহান্ন।

সকাল দশটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এক এক করে একশো চুয়াল্লিশ ধারাকে এড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পৌঁছে গেলেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে ফেলেছে বন্দুকধারী পুলিশ। সওয়া এগারোটার সময় ছাত্ররা মিছিল করে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে বেরোতে চাইলেন। প্রথমে টিয়ারগ্যাস ছুড়েছিল পুলিশ। ছাত্র নেতাদের পুলিশ অ্যারেস্ট করতে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে আইনসভার দিকে ছুটে যায়। এই সময় পুলিশ গুলি চালায়। আবদুস সালাম, রফিউদ্দিন আহমেদ, আবুল বরকত, আবদুল জববার সেই গুলিতে নিহত হন। সঙ্গে-সঙ্গে সমস্ত শহর জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

পৃথিবীর মানুষ অনেক আন্দোলন, অনেক বিক্ষোভ দেখেছে। মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে, রাজনৈতিক বর্বরতার বিরুদ্ধে, সরকারের অনৈতিক সিদ্ধান্ত না মানতে পেরে মানুষ রাস্তায় নেমেছে। সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করেছে, পুলিশের লাঠির আঘাত খেয়েছে। টিয়ার গ্যাসে অথবা কখনও গুলিবিদ্ধ হয়েছে তারা। কিন্তু ওই সব আন্দোলন করেছে জনতার একাংশ, অন্য অংশ নীরব থেকেছে। তার অন্যতম কারণ, যে রাজনৈতিক দল নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের সমর্থক নয় নীরব থাকা মানুষেরা। আর এই সব আন্দোলন ছিল দৈনন্দিন জীবনযাপন যেসব সমস্যা তৈরি করে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু মাতৃভাষাকে অসম্মান করার জন্য যে প্রতিবাদ তৈরি হয়েছিল তাতে কারও ব্যক্তিগত স্বার্থ ছিল না, কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিবাদ ছিল না। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি।

অনেক টানাপোড়েনের পর পাক-সরকার বাংলাভাষাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় উনিশশো ছাপ্পান্ন সালে। কিন্তু স্বীকৃতি পেলেও তারা বাঙালি এবং তার ভাষাকে দ্বিতীয় স্তরেই রেখে দেয়। আর তা থেকেই জমি তৈরি হতে থাকে। জমি তৈরি হয়ে গিয়েছে বুঝতে পেরে শেখ মুজিবর রহমান ডাক দিলেন—ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি করো। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের জন্মের পিছনে অন্যতম কারণঞ্জভাষা আন্দোলন।

যে চারটি তরুণ উন্মাদনায় ছুটে গিয়েছিল, তাদের মৃত্যু নিষ্ফল হয়নি। শুধু পাথরে মাথা ঠুকেই ফুরিয়ে যায়নি। উনিশশো নিরানব্বই সালে ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করল।

বাংলাভাষার মর্যাদাহানি হচ্ছে বলে পশ্চিমবাংলার মানুষ মনে করেন না। করলেও কার বিরুদ্ধে তাঁরা আন্দোলন করবেন? শিলচরের বাঙালিরা একসময় তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। বাংলাভাষাকে হঠাতে চেয়েছিল সেখানকার সরকার। মানুষ নিহত হয়েছিলেন।

কিন্তু এখন কলকাতা শহরে এমন বাঙালি অনেক আছেন, যিনি সারাদিনে একটিও বাংলা শব্দ উচ্চারণ করেন না। এমন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা কম নয়, যারা বাংলার চেয়ে হিন্দি এবং ইংরেজিতে কথা বলতে স্বচ্ছন্দবোধ করে। যখন বাংলা বলে, তখন নিজের অজান্তে হিন্দি শব্দ বাক্যে ব্যবহার করে। এ-ব্যাপারে তাদের মদত দিচ্ছে এফএমের ঘোষকরা। তাদের বিকৃত না-বাংলা, না-হিন্দি উচ্চারণ প্রভাবিত করছে নতুন প্রজন্মকে। কলকাতায় এখন শুদ্ধ বাংলা ভাষাভাষীর গড় সংখ্যা কত তা জরিপ করতে গেলে বিব্রত হতে হবে।

এখন বাংলাদেশও এই ছোঁয়াচ এড়াতে পারছে না। হিন্দি টিভি সিরিয়াল দেখে-দেখে সেখানকার ছেলেমেয়েরাও বাংলার চেয়ে হিন্দিতে বেশি অভ্যস্ত হচ্ছে। তবু, ওরা এখনও বিশে ফেব্রুয়ারির রাতে রাজপথে বাংলা গান গেয়ে মিছিল করে, শহিদ বেদিতে ফুল দেয়। বলে, ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি!’

মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, এই যে চারপাশে যা হচ্ছে, যার প্রতিক্রিয়া আমাকেও মেনে নিতে হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কিছু বলার ক্ষমতা আমার নেই। আমাকে যা ঘটছে তা মেনে নিতে হবে, যাঁরা ঘটাচ্ছেন তাঁদের সহ্য করতে হবে। আমাকে ভেবে নিতে হবে যে আমি কিছু বুঝি না, আমার চেয়ে যাঁরা আমাদের চালান তাঁরা অনেক বেশি বোঝেন। এই আমি, ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে বসে দর্শক হিসেবে দেখে চলেছি।

এই সেদিন, বছর চল্লিশেক আগেও বাঙালির প্রায় চল্লিশ শতাংশ পরিবারে একজন গুরুদেব শ্রদ্ধার আসনে থাকতেন। তারও আগে কুলগুরু বলে একজন পরামর্শদাতা হিসেবে কাছাকাছি বাস করতেন। এই কুলগুরুদের শিষ্য সংখ্যা প্রচুর। তাঁদের সংসারে কয়েকটা দিন কাটালেই বছরটা চমৎকার কেটে যেত। তাঁদের দেওয়া প্রণামীতেই কুলগুরুর সংসার চলত। ওই কুলগুরুদের ছেলেরা চাকরি বা ব্যবসায় ঢুকে গেলে তাদের উপর শিষ্যদের শ্রদ্ধাভাব রইল না। কিন্তু কুলগুরু যতদিন বেঁচে থাকতেন ততদিন তাঁর কথাই ছিল ভক্তদের কাছে শেষ কথা। ছেলের বিয়ের জন্য শিষ্য কুলগুরুর দ্বারস্থ হতেন। গুরু চোখ বন্ধ করে রায় দিতেন, ‘অমুক জায়গায় আমার শিষ্য অমুকের পরমা সুন্দরী, সাংসারিক কর্মে নিপুণা কন্যা আছে। আমি তাকে বলছি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে।’ ব্যস, চিন্তামুক্ত হলেন শিষ্য, ওই বিয়ে অবশ্যই হয়ে যেত। আবার শিষ্যের পরিচিত কোনও ব্যক্তির মেয়ের সঙ্গে নিজের ছেলের বিয়ে দেওয়ার বাসনা নিয়ে কুলগুরুর অনুমতি চাইলে তিনি প্রথমে দু’জনের ঠিকুজি দেখতে চাইতেন। সেই সঙ্গে মেয়ের বাবাকে যোগাযোগ করতে বলতেন। যদি কোনও কারণে তিনি অপারগ হন তাহলে কুলগুরু শিষ্যকে সাবধান করতেন, ‘ঠিকুজি মিলছে না। এই মেয়ে তোর সংসার জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেবে। এর বৈধব্যযোগ আছে।’ এরপরে শিষ্যের সাধ্য থাকত না ওই মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেওয়ার। অর্থাৎ তখন আমাদের পরিবারে একটি বাইরের লোকের কথাই ছিল শেষ কথা, আমাদের কোনও ভূমিকা ছিল না।

কুলগুরুদের সঙ্গ না পেয়ে বাঙালির বেশ কিছু অংশ মহাগুরুদের দিকে ধাবিত হতেন। অমুক মহারাজ, তমুক বাবাজির আশ্রমে লাইন দিতেন। সেই সুবাদে গুরুভাই-বোন তৈরি হয়ে যেত। সেইসব মহাগুরুরা শিষ্যের বাড়িতে ডাকলেই আসতেন না। অতি ভাগ্যবান শিষ্য হলে তিনি কৃপা করতেন। তখন তাঁর বাড়িতে শিষ্যদের মেলা বসে যেত। এরকম একজন বিখ্যাত আইনজ্ঞের বাড়িতে দামি সিল্কের পোশাক পরে বসে মহাগুরু স্মিত হাসছেন। আইনজ্ঞ পাথরের বাটিতে পায়েস তাঁর সামনে রাখলে তিনি বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল তাতে ডুবিয়ে প্রসাদ করে দিলে ভক্তরা উল্লসিত হয়ে অমৃতজ্ঞানে তা ভক্ষণ করলেন।

তখন মহাগুরুর সংখ্যা অনেক ছিল। তাঁদের কারও কারও মধ্যে ভক্তরা নিশ্চয়ই আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন। মহাগুরুর মৃত্যুর পরেও ভক্তরা বছরের পর বছর ধরে তাঁর নির্দেশিত পথে জীবনচর্চা করছেন যখন, তখন বোঝা যায় আকর্ষণের কারণ ছিল। কিন্তু এই মহাগুরু, যাঁর নির্দেশে জীবনযাপন করা হত, তাঁকে ভক্তরাই নির্বাচন করেছেন। মহাগুরুকে মেনে নিতে তাঁরা বাধ্য হননি। কিন্তু ঘটনা হল, এইসব ভক্তদের মৃত্যুর পর তাঁদের পরিবারগুলো থেকে ধীরে-ধীরে মহাগুরুর প্রভাব চলে গেল। পঞ্চাশ থেকে সত্তর সালের মধ্যে ভারতবর্ষে যত মহাগুরু, গুরুমা ছিলেন, তাঁদের নাম মুখে-মুখে শোনা যেত, তাঁরা গত হওয়ার পর আর কেউ সেই জায়গা দখল করতে পারল না। কিন্তু তার জন্য কাউকে আফসোস করতে দেখি না, নতুন প্রজন্ম তাদের পিতৃপুরুষদের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়েছে। নিজের উপর আস্থা বেড়ে গিয়েছে, যা সম্ভবত আগে ছিল না। ফলে জীবিত মহাগুরুদের নাম এখন তেমন সাড়া জাগাচ্ছে না। সত্যি কথা স্বীকার করতেই হবে, ভারতবর্ষের অন্যান্য ভাষাভাষীর মতো বাঙালি এখন আর তেমন ধর্মমুখী নয়। পিতামহ পিতার ধর্মকে এখনও বহন করতে হচ্ছে। কোনও ফর্ম ভর্তি করার কলমে ধর্ম কী জানাতে হিন্দু লিখতে হচ্ছে—এই পর্যন্ত। শতকরা বড় জোর দশ শতাংশ এখনও হিন্দুধর্মের দেবদেবীদের পুজো করেন। শতকরা একাংশ গীতা পড়েননি, বেদ তো দূরের কথা। তাঁদের কিছু অংশ বারোয়ারি পুজোর বিনোদন উৎসবে ঠাকুর দেখতে গিয়ে হয়তো নিজেকে হিন্দু ভাবেন কিন্তু ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত যাবতীয় কাজকর্ম করে থাকেন, শুধু হিন্দু প্রতিপন্ন করতে কোনও ধর্মাচরণ করেন না। এই না করার স্বাধীনতা তাঁরা নিজেরাই আদায় করে নিয়েছেন। বৈষ্ণব-শাক্ত-শৈব শব্দগুলো নবীন প্রজন্মের কাছে প্রায় হিব্রু মনে হয়। অর্থাৎ ধর্মের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তিলাভ হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু কয়েক কোটি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে কয়েকটি রাজনৈতিক দল মাঝেমাঝেই এমন ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে যে তাদের সিদ্ধান্তকেই নীরবে মেনে নিতে হয়। তারা যা ভাল মনে করে তা তাদের বিরোধীরা মন্দ ভাবেন। ক্ষমতায় যারা থাকেন তারা বিরোধীদের ভাবনাকে তোয়াক্কা করে না। যেহেতু তারা বেশি সংখ্যায় নির্বাচিত এবং বিরোধীরা কম সংখ্যায় তাই এই ব্যবস্থা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। গণতন্ত্রে এখন সংখ্যাই শেষ কথা। আর যারা ভোট দিয়ে নির্বাচন করছেন তারা ফল বের হওয়ার পর থেকেই যদি মূক-বধির-অন্ধ না হন তাহলে অনর্থক কষ্ট পাবেন। শাসকদল ধরেই নেয় যাদের ভোটে তারা নির্বাচিত হয়েছে তাদের যাবতীয় সিদ্ধান্ত ভোটাররা মেনে নেবে। না নিলে বয়েই গেল। রামবাবু বলে গিয়েছিলেন আমাদের ভোট দিন। আমি কথা দিচ্ছি তার বিনিময়ে এই দেব, সেই করে দেব। ভোট পেয়ে নির্বাচিত হওয়ার পরে তিনি কথা না রাখলে কে তাঁর কাছে কৈফিয়ত চাইবে? অতএব মেনে নিতেই হবে কয়েক কোটি পুতুলকে নিয়ে নির্বাচিত বাজিকররা খেলা করে যেতে পারে।

মাঝে মাঝে মনে হয়, কয়েক লক্ষ কোটি টাকা নিয়ে একটা দল যদি পশ্চিম বাংলার নির্বাচনে তিন বছর আগে থেকে প্রচার শুরু করে, ভোটারদের অজস্র প্রতিশ্রুতি দেয়, যদি বলে আপনি আমাদের ভোট দিলে এক হাজার পাবেন, ভোট দিতে না গেলে দু’হাজার নগদ পেয়ে যাবেন তাহলে কী হবে? নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানিয়ে কোনও লাভ হবে না, কারণ ভোট কেনার কোনও প্রমাণ তাঁরা রাখবে না। ভোটারদের অধিকাংশ দরিদ্র। তারা এক বা দুই হাজারের লোভ কতটা সামলাতে পারবে? কোনও পরিবারে যদি পাঁচজন ভোটার থাকেন তাহলে ভোট না দিলে দশ হাজার টাকা ঘরে আসবে, যা দিয়ে অনেক ফাঁক ভরাট করা যাবে। যারা ভোট দিতে গেলেন না তাদের ভোট অন্য ব্যবস্থায় দেওয়ার জন্য ওরা অর্থ ব্যয় করবে। যারা দিল তাদের ভোট যদি বিরুদ্ধে যায় তাহলে টাকা নিয়েও বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম ভয়ঙ্কর হবে। গণতন্ত্রকে এভাবে কিনে ফেলার খেলা যদি শুরু হয়ে যায় তাহলে ওই দল ক্ষমতায় আসবে পাঁচ বছরের জন্য। এসে লক্ষ কোটি টাকা নিয়োগ করার বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা তুলে নেবে। গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করতে চাইবে ওরা। সেক্ষেত্রেও আমরা কিছুই করতে পারব না। কারণ ওরা তো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির স্বীকৃতি পেয়েই যা ইচ্ছে তাই করবে।

আমাকে এইসব মেনে নিতে হবে। এখন কোনও অন্যায় দেখলে কাগজে হাজার বার প্রতিবাদ করলেও কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না। ‘পত্রমিতালি’ কলমে যৌন প্রলোভনের বিজ্ঞাপন এখন ছাপা হয়ে চলেছে খবরের কাগজে। অনেক লিখেও বন্ধ করা যায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *